Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

নিষিদ্ধ উঠোন

Spread the love

শ্রেয়া বসু


গ্রামের ভেতরটা এখনও যেন এক পুরোনো ছবির মতো আটকে আছে—মাটির রাস্তা, গাছপালার ছায়া, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী জমিদারবাড়ি। বাড়িটার সামনে বিশাল দোতলা বারান্দা, অথচ তার উঠোনে কারও পদচিহ্ন নেই। বছরের পর বছর ধরে শুনে আসা কড়া নিয়ম—“মেয়েরা এই উঠোনে পা রাখবে না।” যেন মেয়েদের উপস্থিতি ওই পুরুষতান্ত্রিক প্রতীকের গাম্ভীর্য ভেঙে দেবে।

শিউলি, গ্রামের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে, ছোট থেকেই শুনে এসেছে সেই নিষেধাজ্ঞার কথা। ছোটবেলায় ঠাকুমা গল্প শোনাতেন—একসময় নাকি জমিদারবাড়ির উঠোনে উৎসব হতো, নাটক হতো, পুজো হতো। কিন্তু সবই পুরুষদের দখলে। নারীরা থাকতো রান্নাঘরে বা অন্দরমহলে, দূর থেকে গোপনে তাকিয়ে দেখতো আনন্দ।

সন্ধ্যার পর একদিন শিউলি হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে গেল বাড়িটার সামনে। মাথার ভেতর প্রশ্ন ঘুরছিল—আজও কেন সেই নিয়ম মানা হচ্ছে? কেন মেয়েরা উঠোনে পা রাখতে পারবে না? চারপাশে অন্ধকার নামছিল, কাকেরা ডানা গুটিয়ে বসেছে গাছের ডালে। হঠাৎ শিউলি নিজের বুকের ভেতর সাহস জমতে অনুভব করল।

ধীরে ধীরে সে এগোল, মোসাজমা ভেঙে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়াল। গেটের জং ধরা তালা অর্ধেক ভাঙা, টেনে খুলতেই একটা কটকটে শব্দ হল। ভিতরে ঢুকে উঠোনটা যেন নিঃশ্বাস ফেলল—পুরোনো ইট, ভাঙা চাতাল, ঝরা পাতার স্তূপ।

তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন শত বছরের পুরুষতান্ত্রিক চোখগুলো আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তবুও সে পা বাড়াল—একটি, দুটি, তারপর তিনটি পদক্ষেপ।

উঠোনের মাটি যেন কেঁপে উঠল, আর শিউলির মনে হল—এই প্রথম কোনো মেয়ে সাহস করে নিষিদ্ধ উঠোনে পা রাখল।

দূরে গ্রামের দু’একজন দেখছিল, কেউ ফিসফিস করছিল, কেউ আবার অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। শিউলি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকল উঠোনের মাঝখানে। যেন বলছিল—“এবার থেকে নিয়ম আমি লিখব।”

শিউলির পা রাখা সেই এক মুহূর্ত যেন সারা গ্রামে বজ্রপাতের মতো ছড়িয়ে পড়ল। খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে গেল—“মেয়েটা জমিদারবাড়ির উঠোনে ঢুকে গেছে!” কেউ অবিশ্বাসে, কেউ আতঙ্কে, কেউ আবার কৌতূহলে ফিসফিস করতে লাগল।

গ্রামের মোড়ের দোকানে চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছিল, আর সেই ধোঁয়ার ভেতরেই ভেসে আসছিল কথাবার্তা। এক বৃদ্ধ বললেন, “ওই মেয়েটার সর্বনাশ হবে। এই বাড়ির শাপ আছে।” আরেকজন ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর দিলেন, “শাপটাপ কিছু নেই। সাহস আছে বলেই করেছে। তবে বাপ-মায়ের মানসম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিল।”

শিউলির মা, সন্ধ্যায় ছেলেমেয়ের খোঁজে বাইরে বেরোতেই শিউলিকে দেখে থমকে গেলেন। তাঁর চোখে ছিল ভয় আর উদ্বেগ। ঘরে ফিরে তিনি মেয়েকে বকাঝকা করলেন—“তুই কি জানিস না, এভাবে করলে লোকে কী বলবে? আমাদের পরিবারকে কি মুখ দেখাতে হবে না?” কিন্তু শিউলির চোখে তখন অন্যরকম জেদ। সে শান্ত গলায় বলল, “মা, নিয়ম মানে সবসময় অন্যায়কে মেনে নেওয়া নয়।”

রাতে শিউলির বাবা গম্ভীর মুখে বসেছিলেন। গ্রামের লোকজন ইতিমধ্যেই তাঁকে খোঁচা দিচ্ছে। “মেয়েকে সামলাও, না হলে মান মর্যাদা যাবে।” তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিজের মেয়ের সাহসকে অস্বীকার করতে পারছিলেন না, কিন্তু সমাজের চোখে তিনি যেন বন্দি হয়ে পড়েছেন।

পরের দিন সকালে গ্রামে এক অঘোষিত সভা বসে গেল। গ্রামের প্রভাবশালী পুরুষেরা চৌকাঠে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। কারও মুখে রাগ, কারও মুখে ভয়—“যদি মেয়েদের মাথায় এভাবে আগুন লাগে? কাল আরেকজন উঠোনে ঢুকবে, পরশু পুজোতেও হয়তো মেয়েরা দাবি করবে বসার। তখন কী হবে?”

শিউলি এ খবর শুনে একা নয়, কিছু সহপাঠিনীকে সঙ্গে নিয়ে উঠোনে আবার ঢুকল। এবার সে ভয়ে কাঁপছিল না। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল সাহসে—“এই উঠোনে আমরাও দাঁড়াবো। পুজোয় গান গাইব, আলো ঝাড়ব, উৎসব করব। পুরোনো নিয়ম যদি ভাঙতে হয়, তবে আজ থেকেই ভাঙা শুরু হোক।”

চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গ্রামের নারীরা, যারা এতদিন দূর থেকে সব দেখত, তারা আস্তে আস্তে গেটের পাশে ভিড় জমাতে লাগল। তাদের চোখে ছিল বিস্ময়, ভয়, আবার এক ঝলক আশার আলো।

শিউলি বুঝল—সে একা নয়। তার এই পদক্ষেপ অন্য মেয়েদের ভেতরেও আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

গ্রামের আকাশ যেন অকারণেই ভারী হয়ে উঠেছিল। দুপুরের রোদ্দুরেও একটা চাপা অস্বস্তি ছড়িয়ে ছিল বাতাসে। শিউলির সাহসী পদক্ষেপ গ্রামজুড়ে আলোড়ন তুলেছে, আর সেই আলোড়নকে থামাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে গ্রামের প্রভাবশালী পুরুষেরা।

সন্ধ্যার আগে পাকা রাস্তায় মাথায় গামছা বাঁধা কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেল। ওরা ছিল গ্রামের তথাকথিত রক্ষক, যারা সবসময় “সমাজের নিয়ম” বজায় রাখার দায়িত্ব নেয়। তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট রাগ। একজন গলা চড়িয়ে বলল, “আজ যদি এই মেয়েকে শাস্তি না দেওয়া হয়, কালকে আর কেউ আমাদের কথা শুনবে না।”

চৌধুরী কাকার উঠোনে গ্রামপ্রধান বসেছেন, পাশে আরও কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষ। তাঁদের চোখমুখে গাম্ভীর্য, কিন্তু ভেতরে ভেতরে উদ্বেগও লুকোনো নেই। একজন বলল, “এভাবে নিয়ম ভাঙলে সমাজ টিকবে না। ওর বিয়ে বন্ধ করে দাও, কোথাও যেন মানসম্মান না থাকে।” আরেকজন বলল, “না, মেয়েকে বের করে দেওয়া উচিত গ্রাম থেকে। তাহলেই শিখবে।”

কিন্তু সবাই একমত হচ্ছিল না। গ্রামের ডাক্তার, যিনি পড়াশোনা করা মানুষ, শান্ত গলায় বললেন, “কেন শুধু মেয়েটাই অপরাধী? যে নিয়মটা অন্যায়, সেটাই তো আসল অপরাধ।” তাঁর কথায় হইচই শুরু হয়ে গেল। “তুমি কি মেয়েদের পক্ষ নিচ্ছো?”—চিৎকার করে উঠল কয়েকজন। ডাক্তার চুপ করলেন, কিন্তু তাঁর চোখে ছিল দৃঢ়তা।

এদিকে শিউলি জানত সভা বসেছে। সে ভীত হয়নি। বরং সন্ধ্যা নামতেই নিজের সহপাঠিনী, পাড়ার কাকিমারা, এমনকি কিছু ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আবার জমিদারবাড়ির গেটে দাঁড়াল। হাতে মোমবাতি, চোখে দৃঢ়তা। উঠোনের সামনে তারা আলো জ্বালাল—মোমবাতির আলো যেন অন্ধকার নিয়মকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে।

নারীদের এই দৃশ্য দেখে গ্রামের পুরুষেরা হতবাক। এতগুলো মেয়ে, নারী, এমনকি বয়স্ক দিদিমারা পর্যন্ত শিউলির পাশে দাঁড়িয়ে গেছে! কারও মুখে মন্ত্রোচ্চারণ, কারও মুখে গান, কারও চোখে জল।

গ্রামপ্রধান খবর পেলেন। তিনি চুপচাপ নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তায় এলেন। ভিড়ের সামনে গিয়ে বললেন, “এটা যদি থামানো না যায়, তবে আমাদের প্রথা শেষ হয়ে যাবে।”

শিউলি তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, “প্রথা শেষ হবে না, অন্যায় শেষ হবে।”

এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর নারীদের কণ্ঠে একসঙ্গে ধ্বনি উঠল—“আমরা সবাই উঠোনে ঢুকব।”

গ্রামের ইতিহাসে এ দৃশ্য আগে কেউ দেখেনি।

গ্রামের রাতটা যেন হঠাৎই ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল। মোমবাতির আলোয় নারীরা গেটের সামনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের চোখে ভয়ের চিহ্ন নেই—বরং এক অচেনা দীপ্তি। অন্যদিকে, গ্রামের পুরুষেরা জড়ো হয়েছে লাঠি হাতে, যেন যুগের পর যুগ ধরে জমে থাকা কর্তৃত্ব আজ রক্ষা করতে হবে।

চৌধুরী কাকা গর্জে উঠলেন—“তোমরা জানো, এটা করলে গ্রামের অমঙ্গল হবে! মেয়েদের পা পড়লে এই উঠোন অপবিত্র হবে।” তাঁর কণ্ঠে ছিল হুমকির সঙ্গে আতঙ্কও।

শিউলি সামনে এগিয়ে দাঁড়াল। তার গলায় কাঁপন নেই—“উঠোনে পা পড়লেই যদি অপবিত্র হয়, তবে সেই উঠোনের সম্মানই বা কিসের? এখানে উৎসব হবে, এখানে আলো জ্বলবে, আর সেই আলোয় নারী-পুরুষ একসঙ্গে থাকবে।”

একজন যুবক চিৎকার করে উঠল, “চুপ করো! বেশি সাহস দেখালে ভালো হবে না।” সে লাঠি উঁচিয়ে এগোতেই শিউলির পাশের নারীরা একসঙ্গে হাত তুলে দাঁড়াল। “আমাদের একজনকে আঘাত করলে, সবার রক্ত ঝরবে”—এমন নিঃশব্দ বার্তা যেন ভেসে গেল।

দূরে থাকা ছেলেমেয়েরা হৈচৈ করতে লাগল। বৃদ্ধারা ফিসফিস করে বলছিলেন—“আমরা তো কোনোদিন উঠোনে পা রাখতে পারিনি। আজ যদি ওরা পারে, তবে সব মেয়েদেরই নতুন জীবন হবে।”

ঠিক তখনই গ্রামের ডাক্তার সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি পুরুষদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা কি মেয়েদের ভয় পাও? নিয়মের নামে যেটা আঁকড়ে আছো, সেটা আসলে তোমাদের কর্তৃত্বের খোলস ছাড়া কিছু নয়। আজ যদি ওরা উঠোনে যায়, তবে সমাজ ধ্বংস হবে না—বরং নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।”

তার কথা শুনে কিছু যুবক দোটানায় পড়ে গেল। কেউ লাঠি নামাল, কেউ আবার দাঁত কামড়ে চুপ রইল।

শিউলি এবার মোমবাতিটা হাতে নিয়ে গেটের ভেতর পা রাখল। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন মেয়ে ঢুকে পড়ল। মোমবাতির আলো একে একে ছড়িয়ে গেল উঠোনের ইট-ভাঙা চাতালে। নারীরা গান ধরল—“আগুন জ্বেলেছি আমরা, আঁধার ভাঙব।”

পুরুষদের হুমকি আর চিৎকার ডুবে গেল সেই গানের ভেতর। শতবর্ষের নিস্তব্ধতা ভেঙে জমিদারবাড়ির উঠোনে প্রথমবার নারীদের পদচারণা প্রতিধ্বনিত হলো।

গ্রামের আকাশে হঠাৎ বাতাস বইল, পলাশগাছের শুকনো পাতা ঝরে পড়ল উঠোনে। যেন প্রকৃতিও বুঝিয়ে দিল—সময়ের পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে।

উঠোনের ভেতরে মোমবাতির আলোয় নারীদের মুখগুলো যেন অচেনা দীপ্তিতে উজ্জ্বল হচ্ছিল। গান থেমে গিয়েছিল, কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরেই ছিল এক প্রবল শক্তি—যেন শতবর্ষ ধরে গোপন রাখা সাহস হঠাৎ জেগে উঠেছে।

পুরুষেরা বাইরে দাঁড়িয়ে, কেউ লাঠি আঁকড়ে, কেউ চোখ নামিয়ে। তাদের রাগ ধীরে ধীরে বিভ্রান্তিতে বদলে যাচ্ছিল। এত নারীর একসঙ্গে দাঁড়ানো—এ দৃশ্য কল্পনাও করেনি কেউ।

চৌধুরী কাকা আবার গর্জে উঠলেন, “এটা যদি আজ মানা হয়, তবে কাল থেকে সব ভেঙে পড়বে! সমাজ বলে কিছু থাকবে না।”

শিউলি তাঁর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, “সমাজ ভাঙছে না, কাকা। ভাঙছে শুধু শৃঙ্খল। উঠোনে আমাদের পা পড়লেই যদি অমঙ্গল হয়, তবে সেই অমঙ্গল নিয়ে বাঁচব আমরা। কিন্তু অন্ধকারে আর থাকব না।”

তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা নারীরা একসঙ্গে হাত তুললেন। তারা বললেন, “আমরা বেঁচে থাকতে এই সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমাদের মেয়েরা যেন পায়।” কণ্ঠ কেঁপে উঠলেও দৃঢ়তায় ছিল বজ্রের মতো ঝাঁকুনি।

ডাক্তার আবার এগিয়ে এলেন। তাঁর কণ্ঠ শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ—“সমাজ শুধু পুরুষদের নয়। সমাজ মানে নারী-পুরুষ একসঙ্গে। আজ যদি মেয়েরা উঠোনে দাঁড়ায়, তবে সেটা পতন নয়—এটাই আসল পুনর্জন্ম।”

কিছু যুবক মাথা নিচু করল। লাঠি একে একে মাটিতে পড়ল। গ্রামের আকাশে ভেসে উঠল শিউলির কণ্ঠ—“আজ থেকে এই উঠোন সবার। উৎসব হবে, আলো জ্বলবে, গান বাজবে, আর নারীরা আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে না।”

গ্রামের ভেতরে ঢাক বাজতে শুরু করল—কেউ জানত না কে বাজাল, কিন্তু সেই শব্দে ছড়িয়ে পড়ল বিজয়ের আবহ। নারীরা মোমবাতি হাতে উঠোনে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পলাশপাতা উড়ে এসে তাদের মাথায় পড়ল, যেন প্রকৃতি আশীর্বাদ ছড়িয়ে দিল।

সেই রাতেই সিদ্ধান্ত হল—আগামী পূজোয় নারীরাই প্রথম প্রদীপ জ্বালাবে।

গ্রামের ইতিহাসে প্রথমবার নিষিদ্ধ উঠোন হয়ে উঠল মুক্তির প্রতীক।

শিউলি আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় তার চোখ ঝলমল করছিল। মনে হচ্ছিল, সে শুধু একটা উঠোনে পা রাখেনি—সে ভেঙেছে যুগের বেড়া।

উঠোনে প্রথম পদচিহ্ন পড়ার পর থেকেই গ্রামে যেন অদ্ভুত এক বিদ্যুৎ বইছে। দিনগুলো আর আগের মতো নেই। ভোরবেলা উঠোনের ধুলো ঝাড়তে এখন আর শুধু দারোয়ান নয়, মেয়েরাও এসে ঝাড়ু ধরছে। দুপুরে রান্নার গন্ধ উঠছে অন্দরমহল থেকে, কিন্তু খাওয়ার পর তারা আবার এসে উঠোনে বসে গল্প করছে, গান ধরছে। একসময় যেখানে শুধু পুরুষদের গম্ভীর পদচারণা শোনা যেত, সেখানে এখন হাসির শব্দ ভেসে আসছে।

কিন্তু এই দৃশ্য দেখে সবাই খুশি নয়। গ্রামপ্রধান চৌধুরী কাকার মুখে প্রতিদিন চাপা রাগ জমছে। তিনি ভাবছেন—“এভাবে চলতে থাকলে কর্তৃত্ব আর থাকবে না। মেয়েদের হাতে যদি উৎসবের লাগাম যায়, তবে আমরাই তুচ্ছ হয়ে যাব।” তাঁর মতো আরও কয়েকজন প্রভাবশালী পুরুষ রাতে গোপনে বসে আলোচনা করল। সিদ্ধান্ত হল, শিউলিকে ভয় দেখাতে হবে। ওকে যদি দমিয়ে দেওয়া যায়, তবে বাকিরা ভয় পাবে।

এক সন্ধ্যায় শিউলি উঠোনের কোণে বসে আলপনা আঁকছিল। পাশে তার কয়েকজন সহপাঠিনী, হাতে কাঁচা হলুদ আর চালের গুঁড়ি। হঠাৎই তিনজন অচেনা যুবক এসে দাঁড়াল। গলায় কটকটে স্বর—“রাতের বেলা এখানে কী হচ্ছে? জানিস না, এখানে মেয়েদের থাকা বারণ?”

শিউলি চোখ তুলে তাকাল। ভয় নয়, চোখে ছিল অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে শান্ত গলায় বলল, “বারণ মানেই অন্যায় মেনে নেওয়া নয়। আমরা উঠোন সাজাচ্ছি, আগামী উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

একজন যুবক এগিয়ে এল, হাত থেকে আলপনার থালা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। শিউলির বন্ধুরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল। চারপাশে তখন অন্য মেয়েরাও এসে হাজির। অচেনা যুবকরা বুঝে গেল—সংখ্যায় কম পড়ে গেছে। দাঁত কিঁচিয়ে বলল, “এবার ছাড়ছি, কিন্তু সাবধান! বেশি বাড়লে খারাপ হবে।”

তারা চলে যেতেই উঠোনে নিস্তব্ধতা নেমে এল। মোমবাতির আলোয় শিউলির হাত থরথর করছিল, কিন্তু চোখে জল ছিল না। সে বলল, “এরা ভয় দেখিয়ে থামাতে চায়। মানে ওরা বুঝে গেছে, আমরা জিততে চলেছি।”

রাতে ঘরে ফিরে শিউলি মায়ের কাছে সব বলল। মা দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “ভয় কোরো না। এবার যদি তোকে দমায়, তবে আমি-ও উঠোনে যাব।”

শিউলি হঠাৎ যেন বুকের ভেতর আরও বড় সাহস অনুভব করল। উঠোন শুধু তার নয়—এটা এখন হয়ে উঠছে সবার।

পরের সপ্তাহেই গ্রামে যেন ঝড় বয়ে গেল। চৌধুরী কাকা আর তার সহযোগীরা খবর আনলেন—কলকাতা থেকে এক নামী পুরোহিত আসছেন। তিনি এসে সিদ্ধান্ত দেবেন নারীরা উঠোনে পা রাখা, আলপনা আঁকা, প্রদীপ জ্বালানো—এসব ধর্মমতে কতটা গ্রহণযোগ্য। খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামজুড়ে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল।

সেই দিন সকালে জমিদারবাড়ির সামনে ভিড় জমল। লাল পাগড়ি পরা, কপালে চন্দন কাটা পুরোহিত এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ভারী, চোখে কর্তৃত্ব—“শাস্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে, নারীর স্থান অন্দরমহল। যে নারী বাইরে আসে, তার গৃহ ভাঙে, সমাজ ভাঙে। এই উঠোনে নারীর পদচিহ্ন অশুভ।”

পুরুষেরা মাথা নেড়ে সমর্থন জানাল। কেউ বলল, “শুনেছ তো? এটা পাপ। এখনই থামা উচিত।”

কিন্তু শিউলি চুপ রইল না। ভিড়ের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, “শাস্ত্র যদি অন্ধকারে রাখে, তবে সেই শাস্ত্র মানুষের জন্য নয়। আলোতে দাঁড়ানোর অধিকার আমারও আছে।”

পুরোহিত চোখ কুঁচকে তাকালেন—“তুমি কাকে জ্ঞান দিচ্ছ? মেয়ে হয়ে?”

তখনই ডাক্তার সামনে এগিয়ে এলেন। শান্ত গলায় বললেন, “পুরোহিতমশাই, আপনি শাস্ত্রের কথা বললেন। কিন্তু শাস্ত্র তো মানুষ লিখেছে। আর মানুষই সময়ের সঙ্গে নিয়ম পাল্টায়। নারীর কণ্ঠ যদি শোনা না যায়, তবে সমাজের অর্ধেক অংশ অন্ধকারে থাকবে।”

এই কথা শুনে চারপাশে গুঞ্জন উঠল। তরুণদের একটা অংশ ফিসফিস করে বলল, “ডাক্তারবাবুর কথাও মিথ্যে নয়।”

পুরোহিত গলা চড়িয়ে বললেন, “যারা নারীর সঙ্গে দাঁড়াবে, তারাও পাপে ভাগী হবে।”

শিউলি এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে বলল, “পাপ যদি হয়, তবে আমি সেই পাপ নেব। কিন্তু মেয়েরা আর ভয়ে থাকবে না।”

তার কণ্ঠস্বর আকাশে প্রতিধ্বনিত হলো। কয়েকজন যুবক, যারা এতদিন দ্বিধায় ছিল, এবার এগিয়ে এসে নারীদের পাশে দাঁড়াল।

চৌধুরী কাকার মুখ গাঢ় কালো হয়ে গেল। তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল ভেতরের ভয়—শক্তির ভারসাম্য বদলাচ্ছে।

গ্রামে সেদিন সন্ধ্যা নামতেই হাওয়া ভারী হয়ে এল। আকাশে মেঘ জমছিল, আর বাতাসে যেন ছিল অদ্ভুত অশান্তি। শিউলি আর তার সঙ্গীরা উঠোনে বসে আলো ঝাড়ছিল, পরের দিনের মহালয়ার প্রস্তুতি চলছিল। মোমবাতির আলোয় মেয়েদের হাসি, গানে ভরে উঠছিল চারদিক।

কিন্তু রাত গভীর হওয়ার পর, যখন সবাই ঘরে ফিরে গেল, তখনই ঘটে গেল অঘটন। হঠাৎই বজ্রপাতের মতো আওয়াজ শোনা গেল জমিদারবাড়ি দিক থেকে। গ্রামের মানুষ দৌড়ে গিয়ে দেখল—উঠোনের ছোট্ট মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। দেবমূর্তির ফুল মাটিতে ছড়ানো, প্রদীপ উলটে ভেঙে গেছে।

সাথে সাথে গলা চড়িয়ে উঠল চিৎকার—“এই সব মেয়েদের কাজ! ওরা অপবিত্র করেছে জায়গাটা!” চৌধুরী কাকা লাঠি উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমি আগেই বলেছিলাম, মেয়েদের পা পড়লে অমঙ্গল হবে। আজ প্রমাণ হয়ে গেল!”

মুহূর্তের মধ্যে অভিযোগের ঝড় উঠল। কেউ বলল, “ওদের শাস্তি দিতে হবে।” কেউ বলল, “ওদের আর উঠোনে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।”

শিউলি ভিড় ঠেলে সামনে এগোল। তার চোখে ভয় নেই, শুধু ক্ষোভ—“আমরা সবাই তো সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরেছি। ভাঙচুর করেছে যারা, তারা রাতের অন্ধকারে ঢুকেছে। কেন আমাদের দোষ দেওয়া হচ্ছে?”

কিন্তু পুরুষেরা শুনল না। কেউ কেউ “চোর-চোর” বলে মেয়েদের দিকে ইট ছুড়তে উদ্যত হলো।

ঠিক তখনই ডাক্তার আর কিছু তরুণ এগিয়ে এল। তাদের একজন চিৎকার করে বলল, “আমরা নিজের চোখে দেখেছি—চৌধুরী কাকার লোকেরা রাতের বেলা গোপনে এখানে ঢুকেছিল।”

সবাই থমকে গেল। দৃষ্টি ঘুরে গেল চৌধুরীর দিকে। তিনি মুহূর্তে লজ্জিত হলেন না, বরং আরও গর্জে উঠলেন—“মিথ্যে! আমাদের অপমান করতে এই মিথ্যে বানাচ্ছে!”

শিউলি শান্ত গলায় বলল, “সত্যিটা মিথ্যে দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। ভাঙচুর যদি অমঙ্গল হয়ে থাকে, তবে সেটার দায় আপনাদের। আমরা আলো জ্বালাই, আপনারা অন্ধকার আনেন।”

গ্রামে এক অদ্ভুত বিভাজন দেখা দিল। অর্ধেক মানুষ নারীদের পাশে দাঁড়াল, বাকিরা রইল পুরুষতান্ত্রিক শিবিরে। বাতাসে চাপা যুদ্ধের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।

সেই রাতে উঠোনে আর আলো জ্বলল না, শুধু নিস্তব্ধতায় ভরে ছিল। কিন্তু নারীদের চোখে আগুন নিভল না—বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ভাঙচুরের ঘটনার পর গ্রামে একরকম ভাঙন নেমে এল। বাজারে, খেয়াঘাটে, চায়ের দোকানে—যেখানেই ভিড় জমছে, সেখানেই নারীদের উঠোনে প্রবেশ নিয়ে তর্ক শুরু হচ্ছে। কেউ বলছে, “মেয়েরা এবার সীমা ছাড়িয়েছে।” আবার কেউ জবাব দিচ্ছে, “যতদিন ওরা ভয় পেত, ততদিন সমাজ শান্ত ছিল। ভয় ভাঙার দিন শুরু হয়েছে।”

চৌধুরী কাকা আর তাঁর অনুগামীরা চাপ দিতে লাগল—“একটা খোলা সভা ডাকো। সামনে বসে সব ঠিক করা হোক।” গ্রামের মাঠে ঘোষিত হল দিনক্ষণ। যে দিন নির্ধারিত হল, সেদিন সকালের আলো উঠতেই মানুষ ভিড় জমাল। মঞ্চের একপাশে প্রভাবশালী পুরুষেরা, অন্যপাশে নারীরা সার বেঁধে বসে।

ডাক্তার প্রথমে উঠে বললেন, “এই সভা শুধু একটি নিয়ম নিয়ে নয়। এই সভা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। নারীরা সমাজের অর্ধেক। তাদের বাইরে রেখে কোনো সমাজ চলতে পারে না।”

চৌধুরী কাকা গর্জে উঠলেন, “এটা বিদ্রোহ! শাস্ত্রে যা লেখা আছে, তাই সমাজের নিয়ম। মেয়েদের উঠোনে দাঁড়ানো মানেই প্রথা ভাঙা। আর প্রথা ভাঙা মানে সমাজ ধ্বংস।”

শিউলি এবার দাঁড়াল। তার গলায় কোনো ভয় নেই। “সমাজ কি শুধু পুরুষদের? আমরা কি মানুষ নই? আমাদের পায়ের ছাপ অপবিত্র করে যদি উঠোন, তবে সেই উঠোনেরই শুদ্ধতা প্রশ্নে পড়ে যায়। আমরা আলো জ্বালাতে চাই। অন্ধকারে বাঁচতে চাই না।”

ভিড়ের ভেতর থেকে আওয়াজ উঠল—“মেয়েরা ঠিক বলছে।” সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রান্ত থেকে প্রতিধ্বনি—“না, এটা পাপ।”

এক অদ্ভুত গোলমাল শুরু হল। কেউ হাততালি দিল, কেউ হট্টগোল তুলল। মাঠের বাতাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল।

তখন এক বৃদ্ধা, যিনি এতদিন নীরব ছিলেন, হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর গলাটা কাঁপছিল, কিন্তু কথা ছিল আগুনের মতো—“আমরা সারাজীবন বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছি। উৎসব দেখেছি জানলার ফাঁক দিয়ে। যদি এই মেয়েরা আলো জ্বালাতে পারে, তবে আমাদের চোখে শান্তি আসবে। আমি ওদের পাশে।”

মাঠে এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এল। সেই নীরবতায় যেন গ্রাম বিভক্ত হয়ে পড়ল—অর্ধেক পক্ষে, অর্ধেক বিপক্ষে।

সবশেষে সিদ্ধান্ত হল—উৎসবের দিনই নির্ধারণ হবে ভবিষ্যৎ। যদি নারীরা প্রদীপ জ্বালাতে পারে আর কোনো অমঙ্গল না ঘটে, তবে নিয়ম পাল্টে যাবে চিরদিনের জন্য।

শিউলি আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যার তারা ফুটে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, এক নতুন ভোর জন্ম নিতে চলেছে।

উৎসবের দিন সকাল থেকেই গ্রামের বাতাস অন্যরকম। আকাশ ধোয়া-তোলা নীল, চারদিকে তালপাতার কাঁসরে বাজছে ঢাক। জমিদারবাড়ির উঠোনে বছরের পর বছর পরে আবার সাজসজ্জা হচ্ছে—আলপনায় ঢাকা চাতাল, ফুলে ভরা দালান, প্রদীপের সারি। তবু ভিড়ের মধ্যে চাপা উত্তেজনা স্পষ্ট। আজকের দিনেই নির্ধারণ হবে সমাজের ভবিষ্যৎ।

নারীরা শাড়ি পরে, হাতে ফুল আর প্রদীপ নিয়ে উঠোনে দাঁড়াল। তাদের কণ্ঠে গান, চোখে ভয় আর গর্বের অদ্ভুত মিশ্রণ। চারপাশে পুরুষদের ভিড়—কেউ কৌতূহলী, কেউ অবিশ্বাসী, কেউ আবার ক্রুদ্ধ। চৌধুরী কাকা চুপচাপ কোণে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর চোখে উদ্বেগের ছাপ।

ডাক্তার এগিয়ে এসে বললেন, “আজ আমরা দেখব, আলো নিভে যায় কি না। যদি যায়, তবে শিউলিরা ভুল। যদি না যায়, তবে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।”

শিউলি প্রদীপ হাতে এগোল। তার কপালে ঘাম, বুকের ভেতর ধুকপুকানি, কিন্তু চোখে অনড় দীপ্তি। সে প্রথম প্রদীপ জ্বালাল। শিখা কেঁপে উঠল, তারপর স্থির হয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে লাগল।

ভিড়ের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল।

তারপর একে একে অন্য মেয়েরাও প্রদীপ জ্বালাতে লাগল। আলোর সারি ক্রমে বাড়তে লাগল, উঠোনের প্রতিটি কোণ আলোয় ভরে উঠল। ঢাকের শব্দ আরও জোরে বাজতে শুরু করল, যেন প্রকৃতিই সঙ্গ দিচ্ছে।

চৌধুরী কাকার গলা থেকে শব্দ বেরোল না। তাঁর অনুগামীরা হতবাক হয়ে দেখল—কোনো অমঙ্গল ঘটল না, বরং উঠোনে এমন সৌন্দর্য তারা আগে কখনো দেখেনি।

নারীরা গান ধরল—“আলোতে ভরুক পৃথিবী, শৃঙ্খল ভাঙুক।” তাদের গলা আকাশ ছুঁয়ে গেল। পুরুষদের ভিড় থেকে কয়েকজন তরুণ লজ্জা মেখে এগিয়ে এল, প্রদীপ হাতে নিয়ে তারা-ও নারীদের পাশে দাঁড়াল।

গ্রাম প্রথমবার বুঝল—সমাজ মানে বিভাজন নয়, একতা।

রাতের শেষে জমিদারবাড়ির উঠোন শুধু আলোকিত নয়, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল। যেখানে একসময় নারীর পদচিহ্ন নিষিদ্ধ ছিল, আজ সেখানে তাদের হাসি, গান আর প্রদীপের আলো ভরে উঠল।

শিউলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল—সে শুধু একটা নিয়ম ভাঙেনি, সে এক নতুন প্রজন্মের দরজা খুলে দিয়েছে।

চাঁদের আলোয় উঠোন ঝলমল করছিল। আর গ্রামের মানুষ জানল—এবার থেকে আর কোনো দরজা, আর কোনো উঠোন, নারীদের জন্য নিষিদ্ধ থাকবে না।

 সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-17-at-9.59.14-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *