শাশ্বত বসু
সেদিন সন্ধেটা মেঘলার জীবনে অদ্ভুত এক মোড় নিয়ে এল। শহরের এক নামী সাহিত্যিক সংগঠন আয়োজিত বার্ষিক সাহিত্য উৎসবে স্বামী অনিকেতের সঙ্গে গিয়েছিলেন তিনি, মূলত সামাজিক কর্তব্যবোধ থেকে। সাহিত্য নিয়ে মেঘলার আগ্রহ একসময় প্রবল হলেও সংসারের চাপে, অফিস আর গৃহস্থালির দায়ে সেই আগ্রহ অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলের ভেতরে ঢুকতেই বাতাসে বইয়ের গন্ধ, মঞ্চে আলো, দর্শকসারিতে অচেনা অথচ উৎসুক মুখগুলো যেন তাঁর ভেতরে বহু পুরোনো দিনের আবেগকে নাড়া দিল। হাতে ধরা শাড়ির আঁচলটা আঁটসাঁট করে তিনি বসেছিলেন প্রথম সারির মাঝ বরাবর। তখনই হঠাৎ মঞ্চে নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এক পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল—সেই কণ্ঠস্বর, যা তিনি কোনোদিন ভুলতে পারেননি। বুকের ভেতর কেমন যেন ধক করে উঠল। ঘোষকের কণ্ঠে ভেসে এল, “আজকের আলোচক, তরুণ কবি ও লেখক—আরিন্দম মুখার্জী।” মেঘলার বুকের ভেতর ধরা-ছোঁয়ার মতো স্পন্দন শুরু হলো। এতগুলো বছর পরে, ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত নাম শুনে মনে হলো সময় যেন এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেছে।
মঞ্চের আলোয় যখন আরিন্দম উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর চোখ একবারের জন্যও মেঘলাকে এড়িয়ে যেতে পারল না। অনেক মানুষ, অনেক অচেনা মুখ, অথচ তার মধ্যেই সেই পরিচিত দৃষ্টি যেন সরাসরি তাঁর ভেতরে এসে ধাক্কা মারল। মেঘলা দেখলেন, আরিন্দম বদলে গেছে—চোখের কোণে বয়সের ছাপ, মুখে হালকা দাড়ি, পরিপক্বতার ছায়া। তবুও ভেতরের সেই উজ্জ্বল দীপ্তি, সেই পরিচিত হাসি এখনো অক্ষত। চোখাচোখি হওয়ার সেই মুহূর্তে, দুজনেই যেন ফিরে গেল এক যুগ আগের কলেজের দিনগুলোয়। যেখানে প্রথম কবিতা পাঠের আসরে আরিন্দম তাঁকে তাঁর লেখা শোনাতেন, আর মেঘলা মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। সেই অসমাপ্ত চিঠিগুলো, অব্যক্ত ভালোবাসা, সমাজ আর পরিবারের বাঁধনে ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্ক—সব একসঙ্গে এসে ভিড় করল তাঁর মনে। তিনি অনুভব করলেন বুকের ভেতরে জমে থাকা এক শূন্যতা হঠাৎ পূর্ণ হয়ে উঠছে, আবার ভয়াবহ এক অপরাধবোধও জেগে উঠছে—কারণ তিনি এখন কারো স্ত্রী।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সবাই যখন নিজেদের মতো আড্ডায় মেতে উঠেছে, তখনই আরিন্দম এগিয়ে এলেন। প্রথমে যেন কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না দুজনেই। মেঘলার হাতে ধরা ব্যাগটা আঁকড়ে ধরা আর তাঁর মৃদু হাসির মধ্যেই ধরা পড়ছিল লজ্জা আর অস্বস্তির মিশ্রণ। আরিন্দম বলল, “তুমি? সত্যিই তুমি? ভাবতেই পারিনি এতদিন পর দেখা হবে।” মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “হ্যাঁ… জীবনে অনেক কিছুই ঘটে যায়, ভেবেছিলাম হয়তো আর কোনোদিন…।” বাকিটুকু যেন গিলে নিলেন তিনি। চারপাশের কোলাহল সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে এক অদৃশ্য বৃত্ত তৈরি হলো, যেখানে কেবল তাঁদের দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দই শোনা যাচ্ছিল। মেঘলা খেয়াল করলেন অনিকেত তখন অন্য সাহিত্যপ্রেমীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, আর এই ক্ষণিক অবকাশে তিনি আরিন্দমের সঙ্গে কিছু অমূল্য মুহূর্ত খুঁজে পাচ্ছেন।
কথা বলতে বলতে তাঁরা বাইরে বেরিয়ে এলেন, আলো-ঝলমলে প্রাঙ্গণের সামনের বাগানে। চারপাশে লোকজনের ভিড়, তবুও তাঁদের মনে হচ্ছিল এই আঙিনাটা কেবল তাঁদের জন্যই তৈরি। আরিন্দম বললেন, “তুমি বদলাওনি একেবারেই, মেঘলা। শুধু আরও গভীর হয়ে গেছো।” কথাটা শুনে মেঘলার গাল লাল হয়ে উঠল। তিনি হাসলেন, আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন। অনেক অপ্রকাশিত প্রশ্ন, বহু বছরের অভিমান আর অগণিত মধুর স্মৃতি একসঙ্গে ঘুরপাক খেতে লাগল তাঁদের মনে। তাঁরা জানতেন এ মুহূর্তটা বিপজ্জনক—কারণ এটা সমাজের চোখে নিষিদ্ধ, এটা মেঘলার বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতি অবিচার। তবুও তাঁদের দৃষ্টির বিনিময়ে এক অদ্ভুত আকর্ষণ ধরা দিল, যেন আগুনে ফেলে রাখা শুকনো কাঠ হঠাৎ আবার জ্বলে উঠল। সেদিন রাতেই, ফেরার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের আলোয় ভিজতে ভিজতে মেঘলা বুঝলেন—জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে গেছে, যা তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না।
–
সেদিনের সাহিত্য অনুষ্ঠানের পর থেকে মেঘলার ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন কাজ করছিল। অনিকেত স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিলেন, স্ত্রীর চোখে আনন্দ শুধুই অনুষ্ঠানের আবহে, কিন্তু আসলে মেঘলার মনে জমে থাকা বহু বছরের সুপ্ত স্মৃতির কুয়াশা ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না তাঁর। আলো-অন্ধকারে অনিকেতের শান্ত নিঃশ্বাস কানে বাজতে লাগল, অথচ তাঁর মনের ভেতর যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ঘুম ভাঙা চোখে তিনি আলমারির ওপরে রাখা একটি পুরনো বাক্স নামালেন—যা বহুদিন ছোঁয়া হয়নি। বাক্সের ভেতর রঙচটা কয়েকটি ডায়েরি, কিছু কবিতার খাতা আর শুকনো ফুল। হাত কাঁপতে কাঁপতে তিনি খুললেন একটি ডায়েরি, যেখানে পাতার ভাঁজে সময়ের গন্ধ জমে আছে। কয়েকটি পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল সেই পুরনো চিঠিগুলো—যেগুলো একসময় আরিন্দমকে লিখেছিলেন, কিন্তু কখনো পৌঁছে দিতে পারেননি। প্রতিটি চিঠির ভাঁজে লেখা ছিল তাঁর অব্যক্ত ভালোবাসা, অভিমান, আকাঙ্ক্ষা আর অশ্রু।
চিঠিগুলো হাতে নিয়ে তাঁর মনে হলো যেন এক অদ্ভুত সময়যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথম চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন—“আরিন্দম, তুমি যখন প্রথমবার আমার কবিতা পড়ে বলেছিলে আমি ভেতরে ভেতরে আলোকিত হচ্ছি, সেদিন থেকেই আমি জানতাম তুমি আমার জীবনের বিশেষ মানুষ। কিন্তু আমি তা কখনো বলতে পারিনি, কারণ ভয় ছিল—যদি তুমি না বোঝো?” এই লাইনগুলো পড়ে মেঘলার বুকের ভেতর যেন হাহাকার করে উঠল। আরেকটি চিঠিতে লেখা ছিল—“আমাদের চারপাশে কত বাঁধা, কত দায়িত্ব। তুমি যখন বলেছিলে লেখালিখি ছাড়তে, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে হারাতে চাও না, অথচ বুঝলাম আমাদের স্বপ্নগুলো একসঙ্গে বহন করা কঠিন।” এইসব লাইন পড়ে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল—যদি সেই সময় এগুলো আরিন্দমের হাতে পৌঁছে যেত? যদি তাঁর অনুভূতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেত, তাহলে কি তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া আটকানো যেত? হয়তো আজ তিনি অন্য জীবন বেছে নিতেন, যেখানে স্বামী নয়, আরিন্দমই তাঁর সঙ্গী হতেন।
মেঘলা জানতেন, এই ভাবনাগুলো বিপজ্জনক। তিনি এখন একজন দায়িত্বশীল স্ত্রী, সমাজে প্রতিষ্ঠিত এক পরিবারে যুক্ত। কিন্তু ডায়েরির পাতাগুলো যেন তাঁকে মুক্তি দিতে চাইছিল না। প্রতিটি শব্দ তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তিনি কেবল একজন স্ত্রী নন, তিনি একজন নারীও—যাঁর আবেগ, আকাঙ্ক্ষা ও অপূর্ণতা আছে। তিনি ভাবলেন, কেন তিনি এত বছর নিজের ভেতরের এই কণ্ঠস্বরকে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন? হয়তো সংসারের দায়িত্ব, হয়তো সামাজিক বাঁধা, হয়তো ভয়ের কারণে। কিন্তু সেই রাতেই তিনি উপলব্ধি করলেন—এই অসমাপ্ত চিঠিগুলো আসলে তাঁর অন্তর্জগতের আঙিনা, যেখানে প্রবেশ করলে আর ফেরা সম্ভব নয়। ডায়েরির পাতাগুলো স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে যেন তিনি আবার আরিন্দমের হাত ধরলেন, কলেজের করিডোরে হাঁটলেন, কবিতার আসরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। এই অনুভূতিগুলো এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি চোখ বন্ধ করতেই আরিন্দমের উপস্থিতি অনুভব করলেন চারপাশে।
রাত গভীর হতে থাকল, আর মেঘলা অশ্রুসিক্ত চোখে ডায়েরির ওপর হাত রেখে বসে রইলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন ভিড় করল—জীবনের এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তিনি কি অতীতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন? নাকি অসমাপ্ত চিঠিগুলো কেবলই স্মৃতির পাতায় বন্দি থাকবে? তিনি জানতেন, বাস্তবের নিয়ম অনুযায়ী তাঁর উচিত ডায়েরি বন্ধ করে রেখে আবার সংসারে মন দেওয়া। কিন্তু হৃদয় বারবার ফিসফিস করে বলছিল—এই চিঠিগুলো কেবল স্মৃতি নয়, এগুলো তাঁর সত্যিকারের ভালোবাসার সাক্ষী। তিনি ভাবলেন, হয়তো আগামী দিনে সাহস করে আরিন্দমের সঙ্গে এই চিঠিগুলো ভাগ করে নেবেন। হয়তো সে জানতেও পারবে না কত গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন তাঁকে। আবার ভয়ও লাগছিল—যদি এই স্বীকারোক্তি তাঁর জীবনে ঝড় ডেকে আনে? ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি ডায়েরি আবার বাক্সে ভরে রাখলেন, কিন্তু ভেতরে জানলেন—একবার যে আগুন আবার জ্বলে উঠেছে, তাকে আর নেভানো সম্ভব নয়। সেই আগুনই হয়তো তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে সেই নিষিদ্ধ আঙিনার আরও গভীরে।
–
সেদিনের সাহিত্য অনুষ্ঠানের পর থেকে মেঘলার ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন কাজ করছিল। অনিকেত স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিলেন, স্ত্রীর চোখে আনন্দ শুধুই অনুষ্ঠানের আবহে, কিন্তু আসলে মেঘলার মনে জমে থাকা বহু বছরের সুপ্ত স্মৃতির কুয়াশা ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না তাঁর। আলো-অন্ধকারে অনিকেতের শান্ত নিঃশ্বাস কানে বাজতে লাগল, অথচ তাঁর মনের ভেতর যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ঘুম ভাঙা চোখে তিনি আলমারির ওপরে রাখা একটি পুরনো বাক্স নামালেন—যা বহুদিন ছোঁয়া হয়নি। বাক্সের ভেতর রঙচটা কয়েকটি ডায়েরি, কিছু কবিতার খাতা আর শুকনো ফুল। হাত কাঁপতে কাঁপতে তিনি খুললেন একটি ডায়েরি, যেখানে পাতার ভাঁজে সময়ের গন্ধ জমে আছে। কয়েকটি পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল সেই পুরনো চিঠিগুলো—যেগুলো একসময় আরিন্দমকে লিখেছিলেন, কিন্তু কখনো পৌঁছে দিতে পারেননি। প্রতিটি চিঠির ভাঁজে লেখা ছিল তাঁর অব্যক্ত ভালোবাসা, অভিমান, আকাঙ্ক্ষা আর অশ্রু।
চিঠিগুলো হাতে নিয়ে তাঁর মনে হলো যেন এক অদ্ভুত সময়যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথম চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন—“আরিন্দম, তুমি যখন প্রথমবার আমার কবিতা পড়ে বলেছিলে আমি ভেতরে ভেতরে আলোকিত হচ্ছি, সেদিন থেকেই আমি জানতাম তুমি আমার জীবনের বিশেষ মানুষ। কিন্তু আমি তা কখনো বলতে পারিনি, কারণ ভয় ছিল—যদি তুমি না বোঝো?” এই লাইনগুলো পড়ে মেঘলার বুকের ভেতর যেন হাহাকার করে উঠল। আরেকটি চিঠিতে লেখা ছিল—“আমাদের চারপাশে কত বাঁধা, কত দায়িত্ব। তুমি যখন বলেছিলে লেখালিখি ছাড়তে, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে হারাতে চাও না, অথচ বুঝলাম আমাদের স্বপ্নগুলো একসঙ্গে বহন করা কঠিন।” এইসব লাইন পড়ে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল—যদি সেই সময় এগুলো আরিন্দমের হাতে পৌঁছে যেত? যদি তাঁর অনুভূতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেত, তাহলে কি তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া আটকানো যেত? হয়তো আজ তিনি অন্য জীবন বেছে নিতেন, যেখানে স্বামী নয়, আরিন্দমই তাঁর সঙ্গী হতেন।
মেঘলা জানতেন, এই ভাবনাগুলো বিপজ্জনক। তিনি এখন একজন দায়িত্বশীল স্ত্রী, সমাজে প্রতিষ্ঠিত এক পরিবারে যুক্ত। কিন্তু ডায়েরির পাতাগুলো যেন তাঁকে মুক্তি দিতে চাইছিল না। প্রতিটি শব্দ তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তিনি কেবল একজন স্ত্রী নন, তিনি একজন নারীও—যাঁর আবেগ, আকাঙ্ক্ষা ও অপূর্ণতা আছে। তিনি ভাবলেন, কেন তিনি এত বছর নিজের ভেতরের এই কণ্ঠস্বরকে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন? হয়তো সংসারের দায়িত্ব, হয়তো সামাজিক বাঁধা, হয়তো ভয়ের কারণে। কিন্তু সেই রাতেই তিনি উপলব্ধি করলেন—এই অসমাপ্ত চিঠিগুলো আসলে তাঁর অন্তর্জগতের আঙিনা, যেখানে প্রবেশ করলে আর ফেরা সম্ভব নয়। ডায়েরির পাতাগুলো স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে যেন তিনি আবার আরিন্দমের হাত ধরলেন, কলেজের করিডোরে হাঁটলেন, কবিতার আসরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। এই অনুভূতিগুলো এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি চোখ বন্ধ করতেই আরিন্দমের উপস্থিতি অনুভব করলেন চারপাশে।
রাত গভীর হতে থাকল, আর মেঘলা অশ্রুসিক্ত চোখে ডায়েরির ওপর হাত রেখে বসে রইলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন ভিড় করল—জীবনের এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তিনি কি অতীতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন? নাকি অসমাপ্ত চিঠিগুলো কেবলই স্মৃতির পাতায় বন্দি থাকবে? তিনি জানতেন, বাস্তবের নিয়ম অনুযায়ী তাঁর উচিত ডায়েরি বন্ধ করে রেখে আবার সংসারে মন দেওয়া। কিন্তু হৃদয় বারবার ফিসফিস করে বলছিল—এই চিঠিগুলো কেবল স্মৃতি নয়, এগুলো তাঁর সত্যিকারের ভালোবাসার সাক্ষী। তিনি ভাবলেন, হয়তো আগামী দিনে সাহস করে আরিন্দমের সঙ্গে এই চিঠিগুলো ভাগ করে নেবেন। হয়তো সে জানতেও পারবে না কত গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন তাঁকে। আবার ভয়ও লাগছিল—যদি এই স্বীকারোক্তি তাঁর জীবনে ঝড় ডেকে আনে? ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি ডায়েরি আবার বাক্সে ভরে রাখলেন, কিন্তু ভেতরে জানলেন—একবার যে আগুন আবার জ্বলে উঠেছে, তাকে আর নেভানো সম্ভব নয়। সেই আগুনই হয়তো তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে সেই নিষিদ্ধ আঙিনার আরও গভীরে।
–
সেদিনের অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলনের পর থেকে মেঘলা আর আরিন্দম যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা হয়ে গেল। অনুষ্ঠান শেষে তারা সরাসরি কোনো যোগাযোগ করেনি, কিন্তু ভেতরের টানটা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই মেঘলা হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ পেলেন—একটি সাধারণ “কেমন আছো?” সেই দুটি শব্দ পড়তেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠল তাঁর। প্রথমে দ্বিধা হয়েছিল, উত্তর দেবেন কিনা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বুঝলেন, উত্তর না দিলে হয়তো এই প্রশ্ন তাঁকে আরও অশান্ত করে তুলবে। লিখলেন, “ভালো আছি। তুমি?” এতটা নিরীহ কথোপকথন, অথচ এর ভেতর লুকিয়ে ছিল কত আবেগ, কত দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সেইদিন রাত অবধি কথোপকথন চলল, কবিতা, বই, কলেজের স্মৃতি—সব মিলিয়ে। যেন সময় পেরিয়ে তাঁরা আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলেন, যেখানে সম্পর্ক ছিল কেবল আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুজনেই জানতেন, এবার আর তা এতটা সরল থাকবে না।
ফোনে কথা বলতে শুরু করলেন তারা, প্রথমে সপ্তাহে একবার, তারপর দিনে একবার, আর শেষে দিনে বহুবার। কথা শুরু হতো নির্দোষ ভঙ্গিতে—“আজ কী রান্না করলে?” বা “অফিসে খুব চাপ আছে”—কিন্তু অচিরেই সেসব বদলে যেত অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতায়। মেঘলা আবিষ্কার করলেন, আরিন্দম এখনো সেই মানুষ, যিনি তাঁর অন্তরের অন্ধকার কোণগুলো আলোকিত করতে জানেন। আরিন্দম বুঝতে পারছিলেন, মেঘলা ভেতরে কতটা শূন্যতায় ভুগছেন। ধীরে ধীরে কথার ভেতরে স্পর্শের অনুষঙ্গ ঢুকে পড়ল। ফোনের ওপারে আরিন্দম বলতেন, “যদি তোমার হাতটা এই মুহূর্তে ধরতে পারতাম…” আর মেঘলার শরীর শিহরিত হয়ে উঠত। কখনো আবার রাত গভীরে তারা কথা বলতেন অতীতের অপূর্ণতা নিয়ে—যেভাবে একে অপরকে হারিয়ে ফেলেছিলেন, যেভাবে অসমাপ্ত চিঠিগুলো রয়ে গিয়েছিল। এইসব আলাপের মধ্যে মেঘলা নিজের ভেতরের চাপা আকাঙ্ক্ষা মুক্তি দিচ্ছিলেন, যা তিনি স্বামী অনিকেতের সঙ্গে কোনোদিন ভাগ করে নিতে পারেননি।
শুরুটা ছিল কথোপকথন, কিন্তু খুব দ্রুতই তারা আবিষ্কার করলেন, শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে দেহের স্পর্শের আবেশ। হোয়াটসঅ্যাপে তারা শেয়ার করতে লাগলেন পুরোনো ছবি, তারপর নতুন ছবি। মেঘলার সেলফি, আরিন্দমের কফিশপ থেকে পাঠানো হাসিমাখা মুখ—সবকিছুই হয়ে উঠল গোপন সম্পর্কের প্রমাণ। মেঘলা মাঝে মাঝে ভয় পেতেন, অনিকেত যদি হঠাৎ ফোন দেখে ফেলেন! তবুও সেই ভয় তাঁদের দমিয়ে রাখতে পারল না। বরং ভয়ই বাড়িয়ে তুলল উত্তেজনা। কথোপকথনের ভেতর ক্রমশ উন্মোচিত হতে লাগল সেই কামনা, যা এতদিন মেঘলার অন্তরে বন্দি ছিল। তিনি অনুভব করলেন, শব্দ দিয়ে ভালোবাসা যেমন প্রকাশ করা যায়, তেমনি শব্দ দিয়েই তৈরি করা যায় এক অদৃশ্য স্পর্শ, এক অমোঘ টান। আরিন্দমও ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁরা দুজনেই বুঝে ফেলেছিলেন—এ সম্পর্ক আর কেবল “বন্ধুত্বের পুনর্মিলন” নয়, এটি আসলে এমন এক দহনজ্বালা, যা থামানো অসম্ভব।
তাদের এই গোপন আলাপ একদিকে মেঘলার জীবনে আবার নতুন আলো আনছিল, অন্যদিকে তাঁকে অপরাধবোধে জর্জরিতও করছিল। প্রতিবার ফোন কেটে দেওয়ার পর তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতেন—তিনি কি তবে একজন বিশ্বাসঘাতক স্ত্রী? কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হতো, তিনি তো কেবল খুঁজে নিচ্ছেন সেই ভালোবাসা, যা তাঁর প্রাপ্য অথচ অনুপস্থিত। এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই গড়ে উঠছিল তাঁদের নিষিদ্ধ আঙিনা—যেখানে সমাজ, সংসার, নৈতিকতার নিয়ম মানা হয় না। কেবল আবেগ আর আকাঙ্ক্ষাই সেখানে প্রাধান্য পায়। মেঘলা জানতেন, এই পথ বিপজ্জনক, তবুও প্রতিটি কথোপকথনের শেষে তাঁর ভেতরে এক অদম্য উচ্ছ্বাস জন্ম নিচ্ছিল। আরিন্দমও জানতেন, তাঁরা দুজনেই এমন এক স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন, যার গন্তব্য অনিশ্চিত। তবুও থামাতে পারছিলেন না তাঁরা নিজেদের। কারণ তাঁরা দুজনেই জানতেন—এই গোপন আলাপ আসলে সেই অসমাপ্ত ভালোবাসারই পুনর্জন্ম, যা এতদিন চাপা পড়ে ছিল, কিন্তু এখন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
–
প্রথমে মেঘলা ভেবেছিল, এ সম্পর্ক কেবল কাগজের পাতায় ভেসে থাকা অক্ষরের মতো—যতক্ষণ চ্যাটবক্স জ্বলছে, ততক্ষণই টিকে থাকবে। কিন্তু দিন যত গড়াল, ততই সে বুঝল, কথোপকথনের ভেতর জমে থাকা উষ্ণতা যেন ভার্চুয়াল দেওয়াল ভেঙে বাস্তবে এসে পড়ছে। সেই চেনা মানুষটার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা তার বুকের ভেতর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল। সংসারের নিয়মকানুন, স্বামী-সন্তানের প্রতি দায়বদ্ধতা, প্রতিবেশীর চোখ— মিলিয়ে মেঘলা জানত, এই পথ একেবারেই নিরাপদ নয়। তবু অজান্তে সে এক নিষিদ্ধ আঙিনায় পা রেখেছিল। যেন নিজের ভেতরকার ইচ্ছেগুলোকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে, আর একদিন সাহস করে খোলা আঙিনার দরজা ঠেলে দিল। “চলো কোথাও দেখা করি”—হোয়াটসঅ্যাপের ওই পাঁচটা শব্দ মেঘলার চোখে যেন ঝড় তুলে দিল। অনেক ভেবে, দ্বিধা পেরিয়ে সে রাজি হলো। মনে মনে ভাবল, একটা কফিশপে দেখা করা খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে না। শহরের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সহজ হবে।
সেদিন বিকেলে মেঘলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকবার নিজেকে দেখল। সাধারণ শাড়ির বদলে সে বেছে নিল একটুখানি আধুনিক সাজ—হালকা রঙের কুর্তা, চুল খোলা, ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক। মনে হচ্ছিল, যেন সে আবার কলেজের সেই দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছে। কফিশপের দরজায় পা রাখতেই বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়ল। চোখের কোণে ভেসে উঠল সেই মানুষটা—চেনা অথচ নতুন রূপে। সাদা শার্ট, গম্ভীর মুখ, আর চোখে এক অদ্ভুত মায়া। মুহূর্তের জন্য দুজনের দৃষ্টি আটকে গেল, আর সেই দৃষ্টি যেন সময়কে থমকে দিল। তারা হাসল, হাত মেলাল—আর এই সাধারণ স্পর্শেই যেন পুরনো শিখা হাওয়ায় নতুন করে দপ করে জ্বলে উঠল। কথা বলতে বলতে কফির ধোঁয়া, ভিড়ের গুঞ্জন, চারপাশের আসা-যাওয়া সব মিলিয়ে গাঢ় এক আবহ তৈরি করল। বাইরের পৃথিবী যেন অচেনা হয়ে গেল, তারা দুজনই শুধু নিজেদের কথোপকথনের ঘেরাটোপে বন্দি।
মেঘলার মনে হচ্ছিল, সে আসলে কতদিন পরে নিজের মতো করে হাসছে, মন খুলে কথা বলছে। সংসারের নিয়মের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা এই ছোট্ট সময়টা তার কাছে যেন মুক্তির নিঃশ্বাস। কিন্তু সেই মুক্তির ভেতরেই এক অদ্ভুত অপরাধবোধ তার বুক চেপে ধরছিল। বারবার মনে হচ্ছিল—যদি কেউ দেখে ফেলে? যদি স্বামী জানতে পারে? তবে এই ভয়ই কি আসলে তাকে আরও উত্তেজিত করে তুলছিল না? নিষিদ্ধতার স্বাদ সবসময়েই বেশি আকর্ষণীয়। আর যখন সেই মানুষটা হঠাৎ তার হাতের উপর হাত রাখল, তখন মেঘলা বুঝল—সে আর পিছিয়ে আসতে পারছে না। হাতটা সরিয়ে নিতে পারত, কিন্তু নেয়নি। বরং অনুভব করছিল, নিজের অজান্তেই সে যেন নতুন এক গল্পের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। চোখের ভাষা, ঠোঁটের নীরবতা, টেবিলের নিচে অচেনা উষ্ণতার বিনিময়—সব মিলিয়ে তাদের মাঝে জমে ওঠা মুহূর্ত যেন এক গোপন আঙিনার প্রথম ইট বসিয়ে দিল।
সেদিনের কফিশপে দেখা শেষ হলো, কিন্তু মেঘলার জীবনে এক নতুন দরজা খুলে গেল। ঘরে ফিরে সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলল, রান্না করল, সন্তানকে পড়াল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন অন্য কেউ হয়ে উঠেছিল। ফোনের স্ক্রিনে নতুন মেসেজ ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার বুক কেঁপে উঠছিল। তারা দুজনই জানত—এ পথ সহজ নয়, এ পথে অনেক কাঁটা। তবু এ-ও সত্যি, একবার যে আঙিনার দরজা খোলা হয়ে গেছে, তা আর আগের মতো বন্ধ করা যায় না। মেঘলা জানত, সে আর শুধু মেয়ে, স্ত্রী বা মা হিসেবে নিজের পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয়। তার ভেতরকার নারীসত্তা, যা এতদিন সংসারের চার দেয়ালে আবদ্ধ ছিল, সেই সত্তা এবার নিজের নিষিদ্ধ আঙিনায় পা রেখেছে। আর এই পা রাখা মানেই নতুন ঝুঁকি, নতুন রোমাঞ্চ, আর অজানা এক আগুনে নিজেকে সঁপে দেওয়া। সেদিনের গোপন দেখা ছিল কেবল শুরু, অথচ মেঘলার মনে হচ্ছিল—তার জীবনের দিশাই যেন পাল্টে গেছে।
–
প্রথম দেখা থেকেই মেঘলা জানত, এই সম্পর্কের ভিতর কোনো সরল রেখা নেই। সবকিছুই যেন বাঁকানো, কুয়াশায় ঢাকা এক পথের মতো—যেখানে আলো যেমন আছে, অন্ধকারও তেমনি ঘন হয়ে আছে। কফিশপের টেবিলে সেই প্রথম স্পর্শ, তারপরে বারবার চোখে চোখ পড়া—এ যেন দু’জনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বহুদিনের খিদেকে জাগিয়ে তুলল। সংসারের নিয়ম, সামাজিক বাঁধন, লোকসমাজের চোখ—সবকিছুই একে অপরকে ঠেকানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু মনের ভেতরে যে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়েছিল, তার দম আর কারও হাতে ছিল না। তারা বুঝতে পারছিল, যত বেশি এড়িয়ে যেতে চাইছে, ততই অদৃশ্য কোনো টান তাদের একে অপরের দিকে টেনে আনছে। মেঘলার চোখে সেই অদ্ভুত ঝিলিক, আর তার স্পর্শে যে কাঁপুনি বইছিল, তা তাকে পাগল করে তুলছিল—এ যেন নিছক দেখা নয়, এক অগ্নিকুণ্ডের আহ্বান।
শারীরিক আকর্ষণ যখন মনকে গ্রাস করে, তখন বাকি সব যুক্তি যেন ম্লান হয়ে যায়। অফিসের ব্যস্ততার আড়ালে, ক্লান্তিকর সংসারের অগোছালো দিনগুলির মাঝে, তারা খুঁজে পেল এক নতুন আশ্রয়। ফোনের মেসেজ, গোপন দেখা করার অজুহাত, শহরের নির্জন কোনো জায়গায় হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ানো—সবই যেন দমবন্ধ জীবনের ভেতরে প্রাণের অক্সিজেন হয়ে উঠছিল। মেঘলার শরীরের উষ্ণতা আর তার চোখের ভাষা তাকে বুঝিয়ে দিল, এই আকর্ষণ শুধু সামান্য নয়, গভীর এক ঝড়। প্রথম চুমুর মুহূর্তে, যেন বহুদিনের অপেক্ষা একসঙ্গে বিস্ফোরিত হল। ঠোঁটের স্পর্শে শুধু প্রেম নয়, লুকিয়ে ছিল বহু অস্বীকার করা কামনার রঙ। যেন সমাজের চোখ এড়িয়ে, আঙিনার অন্ধকার কোণে তারা আগুন জ্বালিয়ে বসেছে—যে আগুন নিভনো অসম্ভব।
তবে আগুনের আলো যেমন উজ্জ্বল, ছায়াও তেমনি গাঢ় হয়। তাদের সম্পর্কের ভিতরও সেই ছায়ার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। প্রতিবার দেখা করার পর, এক অদ্ভুত অপরাধবোধ গ্রাস করত—মেঘলার চোখে দেখা যেত এক ধূসর কুয়াশা, যেখানে সুখের সঙ্গে লুকিয়ে ছিল ভয়। সংসারের দায়িত্ব, পরিবারের কথা, সন্তানদের নির্দোষ মুখ—সব যেন মুহূর্তেই ভেসে উঠত। তবুও, এই ভয় তাদের দূরে সরাতে পারল না, বরং আরও কাছে ঠেলে দিল। তারা বুঝতে পারছিল, এই সম্পর্ক কোনো নিরাপদ আশ্রয় নয়, বরং ঝড়ের ভেতরে ডুবে যাওয়া এক নৌকা। তবু তারা চাইছিল সেই ডুবকে, কারণ ডুবে যাওয়ার মধ্যেই তারা খুঁজে পাচ্ছিল মুক্তি। যেন শরীর আর আত্মা মিলেমিশে এমন এক ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করেছে, যা থেকে বেরোনো অসম্ভব।
এই অগ্নিস্রোতে প্রেম আর কামনা এক হয়ে গিয়েছিল। তারা জানত, একদিন হয়তো সব ভেঙে পড়বে, সত্যি বেরিয়ে আসবে, সমাজের বিচার তাদের আঙুল তুলবে। তবুও, বর্তমানের উন্মত্ততায় তারা নিজেদের আটকাতে পারছিল না। প্রতিটি গোপন আলিঙ্গন, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস—তাদের আরও গভীর অন্ধকারে টেনে নিচ্ছিল। যেন তারা জেনেই আগুনে হাত দিচ্ছে, জেনেই ছায়ার সঙ্গে খেলছে। ভালোবাসার নরম সুর আর কামনার তীব্র স্রোত মিশে তৈরি হল এক উন্মাদনা—যা তাদের কাছে পাপ নয়, বরং মুক্তির দরজা। তারা জানত, এই আগুন একদিন ছাই করে দেবে তাদের সবকিছু, তবুও তারা ছুটে চলল তার দিকেই—কারণ সেই অগ্নির মধ্যেই তারা খুঁজে পাচ্ছিল জীবনের আসল স্বাদ, এক নিষিদ্ধ অথচ অপরিহার্য আকর্ষণের মোহ।
–
মেঘলার চোখে যেন নতুন এক ছায়ার জন্ম হয়েছে। কয়েকদিন আগেও যে তিনি অনিকেতের সামনে নিখুঁত স্ত্রী ছিলেন, সংসারের নিয়মে বাঁধা একজন দায়িত্বশীল নারী—আজ সেই চোখে কেবলই অস্থিরতা, অপরাধবোধ আর এক অদ্ভুত অগ্নি খেলে যায়। অনিকেত প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো তার শরীর খারাপ অথবা কোনো কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়েছে, কিন্তু প্রতিদিনের ছোট ছোট আচরণে তিনি বুঝতে শুরু করলেন—কিছু একটা বদলে গেছে। অনিকেত রাতে কাজের টেবিলে বসে ফাইল গোছাচ্ছেন, কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করেন মেঘলা বিছানার ধারে বসে আছে, অথচ তার মন যেন অন্য কোথাও। চোখে এক ধরনের দোদুল্যমানতা, যেন নিজের সাথেই লড়াই করছে। কথা বলতে গেলেও যেন থমকে যায়, অনেক সময় চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে। অনিকেত এগিয়ে এসে বললে—“সব ঠিক আছে তো?”—মেঘলা হালকা হেসে এড়িয়ে যায়, কিন্তু সেই হাসিতে শান্তি নেই, বরং একটা গোপন দহন যেন আড়ালে লুকিয়ে থাকে।
ভেতরে ভেতরে মেঘলা দগ্ধ হচ্ছিলেন। তিনি জানেন, যা করছেন তা ভুল। স্বামীর প্রতি প্রতারণা যে শুধু অন্যায় তা নয়, তার অস্তিত্বকেই ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু আরিন্দমের আকর্ষণ থেকে তিনি নিজেকে সরাতে পারছেন না। যখনই চোখ বন্ধ করেন, মনে পড়ে যায় তার ঠোঁটের স্পর্শ, গায়ের গন্ধ, সেই বেপরোয়া ছোঁয়া। দিনভর সংসারের ব্যস্ততা, রান্নাঘরের ঝক্কি, সন্তানের পড়াশোনা—সব কিছুর মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ আরিন্দমের স্মৃতি তাকে যেন টেনে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। তিনি চেষ্টা করেন মন শক্ত করার, স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার, কিন্তু সেই চেষ্টার মাঝেই অপরাধবোধে তার শরীর-মন আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে দিন কাটতে থাকে—একদিকে অনিকেতের শান্ত ও স্থির ভালোবাসা, অন্যদিকে আরিন্দমের আগুনমাখা স্পর্শ। এই দ্বন্দ্বের আঁচ মেঘলার চোখে মুখে প্রকাশ পেতে শুরু করে, যা অনিকেত আর উপেক্ষা করতে পারলেন না।
সেই রাতেই অনিকেত খেয়াল করলেন, মেঘলা তাকে এড়িয়ে চলছেন। সাধারণত রাতে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েন তারা, কিন্তু সেদিন মেঘলা বিছানায় শুয়েই উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অনিকেত চুপচাপ তাকে দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল, স্ত্রীর শরীর তার পাশে শুয়ে আছে, কিন্তু মন যেন বহু দূরে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনিকেতের বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক গেথে যাচ্ছিল। তিনি চেষ্টা করলেন স্পর্শ করতে, কাছে টানতে, কিন্তু মেঘলা হঠাৎ চমকে উঠে বললেন—“খুব ঘুম পেয়েছে, আজ কথা বলব না।” সেই কণ্ঠে ছিল কৃত্রিম ক্লান্তি, কিন্তু অনিকেত সহজেই বুঝলেন এর আড়ালে অন্য সত্য লুকিয়ে আছে। সারা রাত তিনি ঘুমোতে পারলেন না। নিজের ভেতরে প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগল—মেঘলা কি সত্যিই তাকে ভালোবাসেন? তার জীবনে কি অন্য কোনো মানুষ প্রবেশ করেছে? নাকি শুধুই তার কল্পনা? এই প্রশ্নগুলো অনিকেতকে ছিঁড়ে খাচ্ছিল, আর মেঘলার অপরাধবোধ আরও বেড়ে যাচ্ছিল—কারণ তিনি জানেন, স্বামী তার চোখে ধরা পড়ছেন ধীরে ধীরে।
রাতের অন্ধকারে দু’জন মানুষ একই বিছানায় শুয়ে থেকেও যেন আলাদা দুনিয়ায় ভেসে যাচ্ছিল। মেঘলার ভেতরে অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, তবুও তার শরীর আরিন্দমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকছিল। অনিকেতের মনে জন্ম নিচ্ছিল সন্দেহ, শূন্যতা আর ক্রোধের ছায়া, যদিও তিনি মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এ যেন এক নীরব দ্বন্দ্ব—যেখানে একদিকে অপরাধবোধ, অন্যদিকে আকর্ষণ; একদিকে ভালোবাসার স্থায়িত্ব, অন্যদিকে কামনার অস্থিরতা। সেই রাতে তারা দুজনেই ঘুমোতে পারলেন না, ঘরের চার দেওয়ালের ভেতর নীরবতা ঘনিয়ে উঠল, আর বাতাসে জমে রইল অদ্ভুত এক অশান্তি। দু’জনেই জানলেন—এই নীরবতার আড়ালে শুরু হয়ে গেছে সম্পর্কের গভীর ফাটল, যা একদিন বিস্ফোরিত হয়ে উঠবেই।
–
মেঘলা রাতের নির্জনতায় হঠাৎ বুঝতে পারলেন, তিনি যেন নিজের ভেতরে এক অদৃশ্য কারাগারে বন্দি হয়ে গেছেন। দিনের বেলায় সংসারের নিয়ম-কানুন, কাজের তালিকা, আত্মীয়দের প্রত্যাশা, আর রাতের বেলায় নিজের বিবেকের কণ্ঠস্বর—সব মিলিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। তিনি জানেন, আরিন্দমের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই সমাজের চোখে অপরাধ, কিন্তু যখনই তার সঙ্গে দেখা হয়, তখনই জীবনের নিস্তেজতা যেন মুছে গিয়ে এক নতুন রঙে রাঙিয়ে ওঠে। তার হাসি, তার আলাপ, তার দৃষ্টির কোমলতা—সবকিছু মেঘলাকে মনে করিয়ে দেয়, তিনি এখনো বেঁচে আছেন, তিনি এখনো অনুভব করতে পারেন, ভালোবাসতে পারেন। অথচ ঘরে ফিরে যখন স্বামী অনিকেতের নির্লিপ্ত মুখোমুখি দাঁড়ান, তখন সেই বেঁচে থাকার অনুভূতি মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। যেন এক কঠিন দেয়াল তার চারপাশে দাঁড়িয়ে গেছে—যেটি তিনি ভাঙতে চান, কিন্তু পারছেন না।
এই দ্বন্দ্বে দিন কাটাতে কাটাতে মেঘলা উপলব্ধি করলেন, সমাজের শেকল কত অদৃশ্য অথচ কতটা শক্তিশালী। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, এমনকি নিজের সন্তানদের চোখেও তিনি যেন দায়বদ্ধ—মায়ের দায়িত্ব, স্ত্রীর দায়িত্ব, গৃহিণীর দায়িত্ব। কেউ তাঁকে সরাসরি বেঁধে রাখেনি, অথচ সেই দায়িত্ববোধই যেন তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। অনেক সময় তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবেন—এই কি সত্যিই সেই মেঘলা, যে একসময় স্বপ্ন দেখত, গান গাইত, কবিতা লিখত? এখন তো তিনি শুধু একজন দায়িত্বপালনকারী মানুষ, যার নিজের ইচ্ছেগুলো চাপা পড়ে গেছে সংসারের নিয়মে। আরিন্দমকে মনে পড়লেই তার চোখ ভিজে ওঠে—কারণ ওর পাশে তিনি নিজের সেই হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বাকেই খুঁজে পান।
তবু ভয় তাকে সবসময় ঘিরে ধরে রাখে। যদি কেউ জেনে যায়? যদি সমাজে রটে যায়? যদি সন্তানের চোখে তিনি অপরাধিণী হয়ে ওঠেন? এই ভয়ই তাকে বারবার টেনে নিয়ে আসে সংসারের নিরাপদ ঘেরাটোপে। কিন্তু সেই নিরাপত্তা আবার এক অদ্ভুত শূন্যতার মতো। তিনি যতই নিজেকে বোঝান, ততই বোঝেন যে তাঁর আসল অস্তিত্ব এখন শুধু আরিন্দমের কাছেই বেঁচে আছে। তার কাছে যাওয়া মানে ঝুঁকি নেওয়া, কিন্তু না গেলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়া। এই দ্বন্দ্বই তাকে প্রতিটি মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন করছে। একদিকে ভালোবাসার নেশা, অন্যদিকে পারিবারিক দায়িত্ব—দুটোই সত্যি, অথচ একইসঙ্গে দুটি পথে চলা অসম্ভব।
শেষরাতে বিছানায় শুয়ে মেঘলা অনুভব করলেন, তিনি যেন সত্যিই অদৃশ্য শেকলে বাঁধা। তিনি হাত-পা নড়াতে পারছেন, কথা বলতে পারছেন, হাসতেও পারছেন, কিন্তু মনটা বাঁধা আছে এমন এক শিকলে, যা কেউ চোখে দেখে না, তবু যা ভেঙে ফেলা তাঁর সাধ্যের বাইরে। সমাজ, সংসার, দায়িত্ব—এসবই তাঁকে আটকে রেখেছে, আর অন্যদিকে আরিন্দমের উপস্থিতি সেই শিকল ভাঙার প্রলোভন দেখাচ্ছে। তিনি জানেন, একদিন হয়তো তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। কিন্তু আজকের রাতটা শুধু দ্বন্দ্বে ভরে রইল—ভালোবাসা আর ভয়, স্বাধীনতা আর দায়বদ্ধতা, বেঁচে থাকা আর বাঁচার মতো অনুভূতির লড়াইয়ে। তিনি চোখ বন্ধ করলেন, অথচ ঘুম এল না। মনে হচ্ছিল, এই অদৃশ্য শেকল চিরকাল তাঁর শ্বাস রোধ করে রাখবে।
–
অনিকেত সেদিন অফিস থেকে একটু আগে ফিরে এসেছিল। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, কাঁচের জানলার কপাট কাঁপছিল, আর ঘরের ভেতরেও যেন এক অদৃশ্য অস্থিরতা ছড়িয়ে ছিল। মেঘলা রান্নাঘরে ছিল, ফোনটা ড্রইংরুমের টেবিলেই পড়ে ছিল অসাবধানতাবশত। অনিকেত প্রথমে শুধু আবহাওয়ার খবর দেখতে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা একটি মেসেজ তার চোখে পড়ে—‘কাল বিকেলে দেখা করব, তোমায় ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না।’ আঙুল যেন অবশ হয়ে এল, বুকের ভেতর ধকধক শুরু হলো। সে চুপচাপ ফোনটা খুলে আরও কিছু মেসেজ দেখতে লাগল, যেখানে অদ্ভুতভাবে আরিন্দমের নাম বারবার জড়িয়ে আছে। অনিকেতের কাছে এই মুহূর্তে সবকিছু ভেঙে পড়ার মতো মনে হচ্ছিল। বিশ্বাস, ভালোবাসা, এত বছরের সম্পর্ক—সব যেন এক মুহূর্তে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল। তার ভেতরে এক অসহ্য রাগ জমে উঠল, তবে সেই রাগের চেয়েও বড় ছিল বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষত।
মেঘলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই অনিকেতকে অচেনা চোখে তাকাতে দেখে থমকে গেল। অনিকেতের হাতে ফোন, আর তার চেহারায় যেন আগুন জ্বলছে। মুহূর্তের মধ্যেই সব বুঝে গেল মেঘলা। এক মুহূর্তের জন্য তার দম বন্ধ হয়ে এল, মনে হলো সমস্ত সত্যি প্রকাশ পেয়ে গেছে। অনিকেত কঠিন গলায় বলল, “এগুলো কী, মেঘলা? কাকে পাঠাচ্ছো এসব মেসেজ?” তার কণ্ঠে ছিল অবিশ্বাস, রাগ আর অপমানের মিশ্রণ। মেঘলা কোনো উত্তর খুঁজে পেল না, শুধু কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে জল এসে গেলেও সে জানত এই জল হয়তো এখন আর অনিকেতকে নরম করবে না। ঘরের ভেতরের নীরবতা যেন আরো ভারী হয়ে উঠল, বৃষ্টির শব্দও দূরের মতো লাগছিল।
সেই মুহূর্তে মেঘলার মনে হচ্ছিল সে যেন এক ভয়ানক সঙ্কটে আটকে গেছে—একদিকে আরিন্দমের কাছে পাওয়া ভালোবাসা, অন্যদিকে অনিকেতের প্রতি দায়িত্ব, সংসারের অঙ্গীকার। সে ভেতরে ভেতরে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, আরিন্দম তার জীবনে শুধু কিছু উষ্ণ মুহূর্ত এনে দিয়েছে, অথচ সংসার ভাঙার মতো কোনো ইচ্ছা তার নেই। কিন্তু অনিকেত কি সেটা বিশ্বাস করবে? এই প্রশ্নই তাকে আরও অসহায় করে তুলল। অনিকেত এদিক-ওদিক হাঁটছিল, তার চোখে প্রতিশোধ আর অবিশ্বাসের আগুন। মেঘলা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “অনিকেত, তুমি যা ভাবছো, তার সবটা ঠিক নয়।” কিন্তু তার এই কথা শুনে অনিকেত হেসে উঠল তিক্তভাবে—“তাহলে ঠিকটা কী? তোমার জীবনে আমি কি শুধু দায়?” সেই কথাগুলো যেন মেঘলার বুক চিরে বেরিয়ে এলো, তার নিজের ভেতরের অপরাধবোধকে আরও তীব্র করে তুলল।
সেই রাতে তারা দু’জন একসঙ্গে একই ঘরে থেকেও দুই প্রান্তের মানুষ হয়ে গেল। অনিকেতের মনে ক্ষোভ জমে রইল, আর মেঘলা দ্বিধা আর অপরাধবোধে ভেঙে পড়ল। দাম্পত্যের যে সেতু এতদিন ধরে টিকিয়ে রেখেছিল, সেটাই এখন ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। মেঘলার মনে হচ্ছিল, তার সমস্ত লুকোনো আবেগ যেন হঠাৎ করেই উন্মোচিত হয়ে গেছে—যে আবেগের জন্য তার নিঃশ্বাস ফেরত আসত, সেই আবেগই আজ তাকে শৃঙ্খলিত করে ফেলেছে। অনিকেত চুপচাপ বিছানার এপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল, মেঘলা অন্য পাশে চোখের জল সামলাতে সামলাতে বুঝল—এই মুহূর্ত তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। সামনে কোন পথ সে বেছে নেবে, সেটা হয়তো আজই ঠিক হয়ে গেল। কারণ সত্য লুকোনো আর সম্ভব নয়, আর মেঘলার জীবনে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন—সে কি দায়িত্বের শেকলে বাঁধা থাকবে, নাকি হৃদয়ের টানে আরও গভীর অন্ধকারে পা বাড়াবে?
–
রাতটা ছিল গাঢ় অন্ধকারে মোড়া, নিস্তব্ধতার আড়ালে জমে থাকা অজস্র অপ্রকাশিত অনুভূতির ভার যেন বাতাসকেও ভারী করে তুলেছিল। মেঘলা আর আরিন্দম একসঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছিল শহরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরোনো বাংলোয়। চারদিক জুড়ে নির্জনতা, কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের কুকুরের মাঝে মাঝে ডেকে ওঠা—সেই একঘেয়ে শব্দের আড়ালে তাদের মন যেন আরও অস্থির হয়ে উঠেছিল। মেঘলা জানত, এই রাতের পর আর কিছুই থাকবে না, যতটা চাওয়া, যতটা ছুঁয়ে দেখা, যতটা দুঃসাহস—সব কেবল স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। আরিন্দম তার হাত চেপে ধরে বলল, “আমাদের ভালোবাসা কি সত্যিই এভাবে শেষ হয়ে যাবে?” মেঘলা চোখ নামিয়ে নিল, সে জানত এই ভালোবাসা যত সত্য, ততটাই অসম্ভব। সমাজের চোখ, সংসারের দায়, চারপাশের কটূক্তি—সব মিলে তাদের সম্পর্ক কেবলই এক নিষিদ্ধ আঙিনা, যেখানে প্রবেশ করা মানেই আত্মবিধ্বংসী পথ বেছে নেওয়া।
বাংলোর ভেতরে মৃদু আলোয় বসে তারা দু’জন এমন সব কথা বলল, যা হয়তো এতদিন কেউ জানত না। মেঘলা স্বীকার করল, অনিকেতের সঙ্গে তার দাম্পত্য ছিল নিছক নিয়ম মেনে বাঁচা, যেখানে ভালোবাসার কোনও পরশ ছিল না। সেই শূন্যতায় আরিন্দম এসেছিল এক আলোর মতো, আর ধীরে ধীরে সেই আলোই তার অন্ধকার ভরাট করেছিল। কিন্তু আলো যত উজ্জ্বল হয়, তার ছায়াও তত গভীর হয়—আজ সেই ছায়াই তাকে গ্রাস করতে বসেছে। আরিন্দম বোঝাতে চাইল, যদি তারা চাইত তবে একসঙ্গে নতুন করে শুরু করতে পারত। কিন্তু মেঘলার চোখে জল এসে গড়িয়ে পড়ল—সে জানত, নতুন করে শুরু করার জায়গা তার জীবনে নেই। অনিকেতকে ছেড়ে যাওয়া মানে শুধু সংসার ভাঙা নয়, মানে সমাজের তিরস্কার, বাবা-মায়ের অবমাননা, ছেলেমেয়ের প্রতি দায়বদ্ধতার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া। এইসব জটিলতার ভেতরে তাদের ভালোবাসা কেবলই অবৈধ থেকে যাবে, যতটা সত্য ততটাই অগ্রহণযোগ্য।
ঘড়ির কাঁটা এক এক করে রাতকে গভীর করে তুলছিল। তারা দু’জন একে অপরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল, যেন সেই আঁকড়ে ধরা মুহূর্তটাই তাদের শেষ আশ্রয়। বাইরের পৃথিবীতে এই সম্পর্কের কোনও নাম নেই, নেই কোনও জায়গা—কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের হৃদয়ের টান অস্বীকার করা যায় না। আরিন্দমের চোখে ছিল বিদ্রোহ, মেঘলার চোখে ছিল বেদনার স্রোত। তাদের নীরবতা অনেক সময় শব্দের চেয়েও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—যেন দুটি আত্মা একে অপরকে শেষবারের মতো উপলব্ধি করছে। রাতের আকাশে হঠাৎ করে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা দিল, সঙ্গে হালকা বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ পড়তে শুরু করল বাংলোর টিনের চালায়, সেই শব্দ যেন তাদের বিদায়বেলার সুর হয়ে উঠল। মেঘলা হেসে উঠল এক অদ্ভুত কষ্টের হাসি দিয়ে, বলল—“ভালোবাসা যদি কেবল ছায়ার মতো থাকে, তবে তাকে ধরে রাখা যায় না আরিন্দম, কেবল মনে রাখা যায়।”
অবশেষে যখন রাত ভাঙার সময় ঘনিয়ে এল, তারা দু’জনই বুঝে গেল এই শেষ রাত তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। আরিন্দম চাইল মেঘলাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে, কিন্তু সে জানত বাস্তবের খাঁচা থেকে বেরোনো সম্ভব নয়। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল, আর মেঘলা ধীরে ধীরে তার হাত ছাড়িয়ে নিল—যেন দীর্ঘ যাত্রার শেষে এক চূড়ান্ত বিদায়। দু’জনের চোখেই ছিল ভিজে অশ্রু, কিন্তু সেই অশ্রুর মধ্যে ছিল না কোনও অনুতাপ, ছিল কেবল এক অমোঘ সত্যের স্বীকারোক্তি। তারা দু’জনই জানল, এই ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলেও তার স্মৃতি বেঁচে থাকবে চিরকাল, হয়তো গোপনে, হয়তো অপ্রকাশ্যে, কিন্তু তাদের জীবনজুড়ে। নিষিদ্ধ আঙিনার এই শেষ রাত তাই হয়ে উঠল এক অনন্ত ব্যথার আখ্যান, যেখানে প্রেম ও বাস্তবতা চিরকালের মতো পরস্পরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রইল।
–
মেঘলার ফেরাটা ছিল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের যাত্রা। বাইরের চোখে মনে হয়েছিল, সবকিছু যেন আগের মতো হয়ে গেল—পরিবারের দায়িত্ব, সংসারের নিয়মিত ছন্দ, চারপাশের আত্মীয়স্বজনের ভিড়, আর সমাজের সেই অদৃশ্য শিকল, যা এতদিন তাকে টেনে রেখেছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, কিছুই আগের মতো নেই। সেই রাত, সেই “নিষিদ্ধ আঙিনা”-য় কাটানো শেষ মুহূর্ত, আর আরিন্দমের নিঃশব্দ বিদায়—সবকিছু যেন তার মনের ভেতরে অচলাবস্থার মতো জমে আছে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে খাবার বানানোর সময়, বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করার সময়, এমনকি ঘুমের ভেতরেও হঠাৎ সেই স্মৃতিগুলো এসে ভিড় করত। কেউ তাকে দেখে বুঝতে পারত না—কেমন করে সে দ্বিধা, আক্ষেপ আর অপরাধবোধের ভার নিয়ে নিঃশব্দে বেঁচে আছে।
আরিন্দমের জীবনও আর স্বাভাবিক রইল না। সে দূরে সরে গেল, ঠিকই, কিন্তু সেই দূরত্বের ভেতরেও প্রতিটি দিন তাকে মেঘলার কথা মনে করিয়ে দিত। অফিসের ব্যস্ততা, রাত জাগা প্রজেক্ট, কিংবা একা ঘরে ফিরে জানালার পাশে বসে থাকা—সবকিছুই যেন এক অনুপস্থিত উপস্থিতি দিয়ে ভরে উঠেছিল। মেঘলার মুখ, তার কণ্ঠ, তার স্পর্শ যেন বারবার মনে করিয়ে দিত, কীভাবে সমাজের নিয়ম তাদের ভেঙে দিল। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করত—এটাই হয়তো সঠিক, এটাই বোধহয় দায়িত্বের প্রতি সম্মান। কিন্তু সত্যিটা হলো, ভালোবাসা আর দায়িত্বের এই লড়াইয়ে জয়ী কেউ নয়, হেরে গেছে দু’জনেই। আরিন্দম জানত, তারা একে অপরের খুব কাছাকাছি থেকেও এখন আজীবনের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে।
মেঘলা যতই সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করুক, ততই বুঝতে পারল, “ফেরা” আসলে পুরোপুরি ফেরা নয়। তার প্রতিটি হাসির আড়ালে চাপা কান্না, প্রতিটি কথার ভেতরে দমিয়ে রাখা আকুলতা, প্রতিটি নীরবতার ভেতরে গোপন আর্তি লুকিয়ে থাকল। তার স্বামী কিংবা পরিবার কিছুই টের পেল না, কারণ সে নিখুঁতভাবে নিজের অনুভূতিকে আড়াল করতে শিখে ফেলল। কিন্তু যখন আয়নায় নিজেকে দেখত, মনে হতো—এটা কি সত্যিই সেই মেঘলা, যে একদিন আঙিনার নিষিদ্ধ আলোয় দাঁড়িয়ে আরিন্দমকে দেখেছিল? একইভাবে আরিন্দমও বুঝতে পারল, তার নিজের জীবন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলেছে—কাজ, বন্ধু, বাইরের দুনিয়া—কিন্তু হৃদয়ের ভেতরে শুধু একটাই শূন্যতা, যা কোনো কিছুর দ্বারা পূর্ণ হলো না।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা থেকে গেল—এটা কি সত্যিই “ফেরা”, না কি নিছক “হারানো”? সমাজের চোখে তারা ফিরে গেছে তাদের নিজের নিজের জায়গায়, দায়িত্ব পালন করছে, নিয়ম মেনে চলছে। কিন্তু সত্যি বলতে গেলে, তারা দু’জনেই বন্দি হয়ে রইল সেই নিষিদ্ধ আঙিনায়—যেখানে তাদের ভালোবাসা অসমাপ্ত থেকে গেল, যেখানে তাদের আত্মা চিরকাল আটকে রইল এক অসম্ভব স্মৃতির ভেতরে। হয়তো তারা কোনোদিন আর মুখোমুখি হবে না, হয়তো সমাজের নিয়মে তারা কোনোদিন নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তব করতে পারবে না। তবু, তাদের হৃদয়ের গভীরে সেই অদৃশ্য বাঁধন রয়ে গেল, যা কোনো নিয়ম ভাঙতে পারবে না। এইভাবেই মেঘলা আর আরিন্দমের প্রেম শেষ হয় না—বরং চিরন্তন হয়ে ওঠে, অসমাপ্তির মধ্যেই পূর্ণতা খুঁজে নেয়, হারানোর ভেতরেই ফেরা হয়ে ওঠে এক অনন্ত যন্ত্রণার নাম।
___
				
	

	


