Bangla - ভূতের গল্প

নিশির বাঁশি

Spread the love

শহরের একেবারে প্রান্তে, ব্যস্ততা ও জনবসতির বাইরে যেন পৃথিবীর ভিন্ন এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো শ্মশান। চারদিক ঘন গাছপালা দিয়ে ঢাকা, লতাগুল্মে জড়ানো ভাঙাচোরা ঘাট, অর্ধেক ডুবে থাকা শিলাস্তম্ভ আর শেওলা ধরা সিঁড়ি—সব মিলিয়ে জায়গাটি যেন সময়ের হাতে পরিত্যক্ত। দিনের আলোয়ও এখানে এক অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করে, আর রাতের অন্ধকারে শ্মশান হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ অন্য রূপে। বহু বছর আগে এখানে চিতা জ্বলত নিয়মিত, শবদেহ সৎকারের জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ আসত, কিন্তু এখন অনেক বছর হলো কেউ আর এখানে শবদাহ করতে আসে না। ধীরে ধীরে জায়গাটা জনশূন্য হয়ে পড়ে, শুধু কাক, শেয়াল আর বাদুড়েরা এটিকে নিজেদের রাজত্বে পরিণত করেছে। অথচ শ্মশানের নাম এখনও গ্রামবাসীর মুখে মুখে উচ্চারিত হয় ভয়ে এবং আতঙ্কে, কারণ বিশ্বাস করা হয়—প্রতি অমাবস্যার রাতে এখানে বাজে এক অদ্ভুত বাঁশির সুর।

গ্রামের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বলেন, এই বাঁশির সুর অন্যরকম। প্রথমে মিষ্টি, সুরেলা, যেন দূরে কোথাও বিয়েবাড়ি চলছে; তারপর হঠাৎ সেই সুর গা শিরশিরে ঠান্ডা স্রোতের মতো শরীর জুড়ে নেমে আসে, আর শুনতে শুনতে মনে হয় কারও অদৃশ্য হাত টেনে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানের দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যারা এই বাঁশির সুর শুনে কাছে গেছে, তারা আর কখনও ফিরে আসেনি। কারও ছেলে, কারও স্বামী, কারও বন্ধু—অমাবস্যার রাতে বাঁশির টানে তারা সবাই হারিয়ে গেছে অচেনা অন্ধকারে। তাই অমাবস্যার রাত এলেই গ্রামবাসী সূর্যাস্তের পর বাইরে বেরোয় না, দরজা-জানলা আটকে ভেতরে বসে থাকে, যেন বাইরের সেই সুরের ডাক থেকে নিজেকে বাঁচানো যায়। কেউ কেউ মেনে নেয় এটা নিছক গুজব, মানুষের তৈরি ভৌতিক কল্পকাহিনি, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে এখানে কোনো অশরীরী শক্তি কাজ করছে। ভয়ের গন্ধ যেন বাতাসেই মিশে আছে।

তবু সব গুজবের মতো এরও দুটি দিক রয়েছে। গ্রামের কচিকাঁচারা স্কুলের পর আড্ডায় মশকরা করে—“ওসব পুরনো গল্প, কিছুই সত্যি নয়।” তারা সাহস দেখানোর জন্য বন্ধুরা মাঝে মাঝে বাজি ধরে, কে গিয়ে শ্মশানের কাছাকাছি দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সূর্য অস্ত গেলেই সেই সাহস উধাও হয়ে যায়। আবার কিছু তরুণ বলে, এসব সবই ভয়ের ব্যবসা, যাতে গ্রামবাসীরা রাতে বাইরে না যায়। অন্যদিকে ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাস করে, এ অভিশাপ এক পুরনো ঘটনার ফল, কোনো নিরীহ আত্মাকে একসময় বলি দেওয়া হয়েছিল আর সেই আত্মাই বাঁশি বাজিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। গ্রামে এ নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে—কোথাও বলা হয়, এক সানাইবাদককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল; আবার কোথাও শোনা যায়, এক মৃত দেহসৎকারের সময় বাঁশিওয়ালা সহসা শ্মশানের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল। সত্যটা কেউ জানে না, কিন্তু ভয়টা সকলের মনে স্থায়ী হয়ে গেছে। আর তাই, শ্মশানের বাঁশি আজও গ্রামবাসীর কাছে শুধু একটি গুজব নয়, বরং এক অমোঘ সত্যের মতো দুঃসহ আতঙ্ক হয়ে ছড়িয়ে আছে।

রণেন চট্টোপাধ্যায়, বয়স আনুমানিক আটাশ, স্থানীয় এক জনপ্রিয় দৈনিকের অপরাধ ও রহস্যসংক্রান্ত সংবাদদাতা। পেশায় তরুণ হলেও তার কলমে সাহস ও নির্ভীকতার ছাপ অনেক আগেই সবার নজরে পড়েছে। গ্রামে গ্রামে ভূতের গল্প, তান্ত্রিক কাহিনি বা অলৌকিক ঘটনা নিয়ে খবর প্রকাশ করতে গিয়ে বহুবার রণেন প্রমাণ করেছে—ভয় বা কুসংস্কার তার কাছে কেবলই মানুষের অজ্ঞতার ফসল। তাই যখন সে শুনল শহরের বাইরে ওই পুরনো শ্মশানকে ঘিরে “বাঁশির সুরে মানুষ নিখোঁজ” হওয়ার গল্প, তখন তার কৌতূহল চরমে পৌঁছায়। প্রথমে সহকর্মীরা মজা করে বলেছিল, “এই কেসটা তুই গেলে ভালো হবে, ভূতটা যদি তোর রিপোর্ট লিখে দেয়!” কিন্তু রণেন সিরিয়াস। সে মনে করল, এই ভয়ের আবহে যদি সত্যিই কিছু থাকে, তবে তা বের করে আনতে হবে। আর যদি কেবলই গুজব হয়, তবে সেই মিথ্যেকে ভাঙা জরুরি। মানুষের কুসংস্কার ভাঙতে পারলে সেটাই হবে তার সবচেয়ে বড় সাংবাদিকতার সাফল্য।

ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডার আর একটা ছোট নোটবুক—এই তিন অস্ত্রই রণেনের ভরসা। সে জানে, লোকজনের মুখে মুখে ছড়ানো গল্পকে প্রমাণ ছাড়া সংবাদ করা যায় না। তাই সে ঠিক করে, অমাবস্যার রাতে শ্মশানে গিয়ে সবকিছু চোখে দেখবে ও কানে শুনবে। অফিসে সম্পাদককে বিষয়টা জানাতেই তিনি হেসে বললেন, “ভালো, চেষ্টা করে দেখো। তবে সাবধানে থেকো।” সম্পাদক জানতেন, এসব খবর মানুষের আগ্রহ জাগায়, পত্রিকার বিক্রিও বাড়ায়। তাই তিনি আপত্তি করেননি। তবে গ্রামের দিকে যাওয়ার আগে রণেন গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলল। চায়ের দোকানে, হাটে, কিংবা শ্মশানের কাছের মাঠে দাঁড়িয়ে সে নানা মানুষের মুখে একই কাহিনি শুনল—অমাবস্যার রাত, বাঁশির সুর, আর নিখোঁজ মানুষ। কারও কণ্ঠে আতঙ্ক, কারও কণ্ঠে নিস্পৃহতা, আবার কেউ যেন অদ্ভুত ভয়ে কাঁপছে। রণেন সবই খুঁটিয়ে নোট করল, কিন্তু তার মুখে একরাশ দৃঢ়তা—“সত্যিটা আমিই বের করব।”

গ্রামে থাকার জায়গা জোগাড় করে রণেন প্রস্তুতি নিতে লাগল। দিন গড়ালেই আসবে সেই অমাবস্যার রাত, যেদিন সবাই ঘরের ভেতর নিজেদের গুটিয়ে রাখে। গ্রামের বৃদ্ধরা তাকে অনেকবার সাবধান করেছিল—“বাবা, ও রাতে ওদিকে যাস না। বাঁশির ডাক মানে মৃত্যু।” কিন্তু রণেন শুধু হাসল। তার কাছে ভয় নামক জিনিসটা কেবল গল্পের উপাদান, সাংবাদিকের কাছে সত্যি হলো প্রমাণ। তাই সে নিজের ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ করল, ভয়েস রেকর্ডারে নতুন ব্যাটারি লাগাল, আর নোটবুকে লিখে রাখল—“অমাবস্যা, রাত বারোটা, শ্মশান।” যেন এই দিনটিই তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। গ্রামবাসীরা যখন দরজা জানালা বন্ধ করে গৃহবন্দি হতে শুরু করল, রণেন তখন উল্টো দিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে—শ্মশানের অন্ধকারে প্রবেশ করার। তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন এই রাত তার পেশাগত সাফল্যের সোপান হবে। কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি, যে সুরকে সে নিছক কুসংস্কার ভেবেছিল, সেটিই তাকে টেনে নিয়ে যাবে এক ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি।

গ্রামের বাইরে, প্রায় দুই মাইল হেঁটে গেলে যে বিশাল বাঁশঝাড় আর ঝোপঝাড়ে ঘেরা জায়গাটি পড়ে, সেটিই সেই শ্মশান। অনেক বছর আগে এটি ছিল আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষের একমাত্র দাহঘাট। নদীর ধারে হলেও এখন নদী সরে গেছে দূরে, তাই ঘাটটি আর ব্যবহার হয় না। চারদিকে ছড়িয়ে আছে কাঁটার ঝোপ, বুনো ঘাস, আর বেতগাছের জঙ্গল। ভাঙাচোরা ঘাটের পাথরে শেওলা জমে সবুজে ঢেকে গেছে, যেন সময়ের ছোপে প্রাচীন ইতিহাস মুছে গিয়ে শুধু ভৌতিক আবহটাই থেকে গেছে। পুরনো চিতার কাঠ এখনো আধপোড়া অবস্থায় এখানে-ওখানে পড়ে আছে, বাতাসে মিশে আছে পোড়া কাঠ আর মৃতদেহের গন্ধের সঙ্গে মিশ্রিত এক স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, যা শ্বাস নিতেই বুক ভারী করে তোলে। দিনের আলোয়ও এই জায়গার চারপাশে অদ্ভুত এক নীরবতা ছড়িয়ে থাকে, যেন সময় এখানে থেমে গেছে বহু আগেই। গ্রামের লোকজন খুব প্রয়োজন ছাড়া এই পথ মাড়ায় না, আর রাত হলে তো কেউ নামও নেয় না।

সন্ধ্যা নামতেই জায়গাটির চেহারা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আকাশে চাঁদহীন অন্ধকার নামলে শ্মশান যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে এক ভয়াবহ রূপে। বাতাসে কেমন যেন ঘন ধোঁয়ার মতো আস্তরণ জমে, কুকুরেরা দূরে কোথাও হাহাকার করতে থাকে, যেন অদৃশ্য কোনো শিকারী তাদের আতঙ্কিত করেছে। বাদুড়েরা ঝোপ থেকে উড়ে বেরোয়, একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, তাদের ডানার শব্দ যেন শূন্যে অশুভ সংকেত ছড়িয়ে দেয়। মাঝেমধ্যেই শিয়ালের হাহাকার শোনা যায়, আর দূরে পেঁচার ডাক। ভাঙাচোরা চিতার কাঠে বসে থাকে সাপ কিংবা কাক, তাদের চোখ অন্ধকারে চকচক করে ওঠে। বাতাস বইলেই শুকনো পাতার খসখস শব্দ হয়, কিন্তু শোনা যায় না কোনো মানুষের উপস্থিতির ছাপ। চারদিকে এতটাই নির্জনতা যে নিজের পায়ের শব্দও কানে অস্বাভাবিক মনে হয়। এই ভৌতিক নীরবতা গ্রামবাসীদের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে যে, এখানে কোনো না কোনো অশরীরী শক্তির বাস আছে, আর সেই শক্তিই বাঁশির সুর তোলে প্রতি অমাবস্যায়।

শ্মশানের ভেতরে ঢুকলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। চারপাশের বাতাস ঠান্ডা, ভেজা, আর দমবন্ধ করা ভারী। গা ছমছমে পরিবেশে মনে হয় অদৃশ্য কেউ যেন চুপচাপ তাকিয়ে আছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটি যেন অশুভ সংকেতে ভরে ওঠে। টর্চের আলো পড়লেও ছায়াগুলো অদ্ভুতভাবে নড়ে ওঠে, যেন সেগুলো জীবন্ত। শ্মশানের সিঁড়ি ভাঙা, কোথাও কোথাও শ্যাওলায় ঢাকা স্ল্যাব পিচ্ছিল হয়ে আছে, আর অর্ধভাঙা চিতা যেন এখনও কোনো মৃতদেহের অপেক্ষায় শূন্য হয়ে পড়ে আছে। রণেন টের পেল, এই জায়গাটিকে সাধারণ মানুষের চোখে ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। বিজ্ঞান বা যুক্তি দিয়ে পরিবেশকে বোঝানো গেলেও মনের ভেতর এক অকারণ ভয়ের স্রোত বয়ে যায়, যা তাকে আরও অস্থির করে তোলে। গ্রামের মানুষ যে কেন এ জায়গাকে অভিশপ্ত বলে মনে করে, সেই কারণটা টের পাওয়া যায় চারপাশের প্রতিটি গন্ধে, প্রতিটি আওয়াজে, আর প্রতিটি নিস্তব্ধতায়। শ্মশানের এই ভয়ঙ্কর বর্ণনাই যেন আসন্ন ঘটনার পূর্বাভাস।

রণেনের শ্মশানে যাওয়ার খবর গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমে লোকজন ভেবেছিল শহর থেকে আসা এই তরুণ সাংবাদিক কেবল গল্পের খোঁজ করছে, কিন্তু যখন তারা জানল সে সত্যিই অমাবস্যার রাতে সেখানে ঢুকতে চায়, তখন আতঙ্ক গ্রাস করল সবার মন। হাটে, চায়ের দোকানে, এমনকি মন্দিরের সিঁড়িতে বসেও গ্রামের বয়স্করা আলোচনা শুরু করল—“ছেলেটা বুঝছে না কিসের সঙ্গে লড়তে যাচ্ছে।” গ্রামের পরিবেশ তখন ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছিল। কারও চোখে ছিল করুণা, কারও চোখে অদ্ভুত ভয়ের ছাপ। রণেন যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই তাকে সাবধান করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের প্রবীণ মহিলারা বারবার বলেছে, “বাবা, ভুলেও যাস না ও রাতে। ওই বাঁশির ডাক মানুষের কানে সহ্য করার নয়।”

এক সন্ধ্যায় রণেন যখন স্থানীয় বাজার থেকে ফিরছিল, তখন তাকে থামাল গ্রামের এক বৃদ্ধা—ঝরা দাঁত, কুঁচকানো মুখ, কিন্তু চোখে এক গভীর আতঙ্ক। সে কাঁপা গলায় বলল, “শোনো বাবা, ওই বাঁশি মানুষের নয়। বহু বছর আগে এই শ্মশানে এক সানাইবাদককে নির্মমভাবে বলি দেওয়া হয়েছিল। জমিদারের আদেশে, গ্রামের অভিশাপ মোচনের জন্য। লোকটা ছিল গরিব, ভিখিরির মতো জীবন কাটাত, কিন্তু সানাই বাজাতে ওস্তাদ ছিল। তাকে নদীর ঘাটেই কেটে ফেলা হয়, আর দেহ পোড়ানো হয় শ্মশানে। তারপর থেকেই প্রতি অমাবস্যায় বাজে ওই অভিশপ্ত বাঁশি। আমি চোখে দেখেছি—আমার নিজের দাদা ওই সুরে টেনে গিয়েছিল। আমরা আর তাকে ফেরাতে পারিনি।” বৃদ্ধার কণ্ঠে কাঁপুনি ছিল, চোখের কোণে ভেসে উঠেছিল জমাট অশ্রু। গ্রামের আরও অনেকেই একই কাহিনি বলল—কারও ভাই, কারও স্বামী, কেউ আবার প্রতিবেশীর গল্প শোনাল, সবাই হারিয়েছে কাউকে না কাউকে। তাদের কথার মধ্যে ছিল দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ভয় আর অসহায়তা।

কিন্তু রণেনের ভেতরকার যুক্তিবাদী মন এসব গল্পকে নিছক লোককথা বলে উড়িয়ে দিল। সে জানত, ভয় আর কুসংস্কার মানুষকে অন্ধ করে দেয়, আর এই গল্পগুলো প্রমাণ ছাড়া শুধু গুজব। তবু গ্রামের আতঙ্কের গভীরতা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কেন এত মানুষ একই গল্প বলছে? কেবল গুজব হলে এত বছর ধরে এতজন মানুষ নিখোঁজ হলো কিভাবে? এই প্রশ্নগুলো তার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু যাই হোক, সে পিছিয়ে আসেনি। সে জানত, সাংবাদিক হিসেবে তার দায়িত্ব হলো ভয় আর গুজবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল সত্যটাকে প্রকাশ করা। তাই সবাই যখন তাকে অনুরোধ করল, “ওখানে যেও না, বাবা,” সে তখন হেসে উত্তর দিল, “আপনারা ভয় পাচ্ছেন, আমি দেখব ভয়ের আড়ালে সত্যিই কিছু আছে কিনা।” গ্রামের লোকেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কেউ কেউ মাথা নাড়ল, আবার কেউ ফিসফিস করে বলল—“ছেলেটা আর ফিরবে না।” এই আতঙ্কিত পরিবেশে রণেনের অটল মানসিকতা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল—সে ঠিক করেছে, অমাবস্যার রাতেই শ্মশানে গিয়ে সত্য উন্মোচন করবে।

রাতের আকাশে চাঁদের কোনো অস্তিত্ব নেই, কেবল গাঢ় অন্ধকারে ঘনিয়ে থাকা নক্ষত্রের ক্ষীণ আলো। অমাবস্যার এই নিস্তব্ধতায় শ্মশান যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। চারপাশে এতটাই নীরবতা যে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসকেও রণেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ সেই নীরবতাকে বিদীর্ণ করে উঠল এক সুর—বাঁশির মতো হলেও তাতে এক অদ্ভুত টান, যেন একসঙ্গে আহ্বান আর সতর্কবার্তা। সুরের শুরুটা ছিল কোমল, মায়াময়, যেন কোনো অদৃশ্য শিল্পী নদীর ধারে বসে গোধূলি রঙে ভরপুর সঙ্গীত পরিবেশন করছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই সুরের ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে গেল এক অস্বস্তিকর শীতলতা, যার প্রতিটি স্রোত রণেনের শরীর বেয়ে কাঁটার মতো নেমে আসছিল। সে কাঁপা হাতে ভয়েস রেকর্ডার চালু করল, ক্যামেরার লাল আলো জ্বলে উঠতেই তার মনে হলো—এই নীরবতা আর বাঁশির অদৃশ্য স্রোত যেন তাকে ঘিরে ফেলেছে।

রণেন বারবার নিজেকে বোঝাতে লাগল—এ সবই মানুষের তৈরি, কোনো অশরীরী শক্তি নয়। তার যুক্তিবাদী মন বলছিল, নিশ্চয়ই গ্রামের কেউ ইচ্ছে করে এই গুজবকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য বাঁশি বাজাচ্ছে। তবু সুরের মধ্যে যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন, সেটি তাকে ভাবিয়ে তুলল। একেক মুহূর্তে সুরটা যেন তার মায়ের শোনানো লোরির মতো কোমল হয়ে যায়, আবার পরক্ষণেই তা রূপ নেয় শবযাত্রার মর্মান্তিক ক্রন্দনে। দূরে শ্মশানের এক কোণে আলো টিমটিম করছে—মনে হলো হয়তো কোনো জোনাকি, আবার কখনো মনে হলো কারও হাতের প্রদীপ। টর্চ জ্বালাতেই অন্ধকার ভেদ করে শ্মশানের শেওলাধরা সিঁড়ি, আধভাঙা চিতার পাশে ছায়ার মতো কিছু নড়তে দেখা গেল। রণেন দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতর যেন ঢাক বাজছে, তবু সাহস করে এগোতে লাগল। তার প্রতিটি পদক্ষেপে শুষ্ক পাতার মচমচে শব্দ যেন আরও ভীতিকর হয়ে উঠছিল।

বাঁশির সুর ক্রমশ কাছে আসছে বলে মনে হচ্ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো—সুরটা কোথা থেকে ভেসে আসছে, তা বোঝা যাচ্ছিল না; কখনো মনে হলো গাছের ডাল থেকে, কখনো ভাঙা ঘাটের দিক থেকে, আবার কখনো একেবারে তার কান ঘেঁষে। রণেন টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। তার রেকর্ডার সুরটাকে স্পষ্ট ধরে ফেলেছে, সেটি দেখে কিছুটা সাহস পেল সে। নিজের মনে বলল—যদি মানুষের বাজানো হয়, তবে প্রমাণ মিলবেই। কিন্তু ঠিক তখনই তার টর্চের আলো পড়ে এক অর্ধভাঙা পাথরের উপর, আর সেখানে শাদা কাপড়ের মতো কিছু উড়তে দেখা গেল। হাওয়া একটুও নেই, তবু কাপড়টি যেন নিজেই নড়ছে। সুরটা হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ, ভয়ার্ত আর ছমছমে হয়ে উঠল, যেন সতর্ক করছে—‘থেমে যা।’ রণেনের বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু সে পিছোল না। বরং আরও কয়েক কদম এগিয়ে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো হাত তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের গভীরে। শ্মশানের বুকভাঙা নীরবতায় তখন কেবল বাঁশির অদ্ভুত সুর, আর রণেনের শ্বাসের দ্রুত ওঠানামা। সে জানত না—এই সুর তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিংবা আদৌ ফিরতে দেবে কিনা।

হঠাৎ যেন সবকিছু থেমে গেল। যে বাঁশির সুর এতক্ষণ বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলেছিল, তা হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রণেনের হাতে ধরা টর্চটা ফ্লিক করতে করতে নিভে গেল, চারপাশের অন্ধকার হয়ে উঠল গাঢ় কালির মতো ঘন। সে চোখ বড় বড় করে চারদিকে তাকাতে লাগল, কিন্তু শূন্যতা ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শ্মশানের ভাঙাচোরা ঘাট, অর্ধচিতা আর কাঁটাঝোপে ঢাকা চারপাশ যেন আরও অচেনা, আরও ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল। হঠাৎ করেই সে অনুভব করল, বাতাসে এক শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সেই বাতাসের স্বাদ সাধারণ ঠান্ডা হাওয়ার মতো নয়, বরং যেন কারও নিঃশ্বাস তার ঘাড়ের কাছে এসে লেগে যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল, কপালে ঘাম জমল, অথচ শরীর ঠান্ডায় কেঁপে উঠছিল। যুক্তিবাদী মানুষ হলেও সেই মুহূর্তে রণেন বুঝতে পারল, তার সঙ্গে একা আর কেউ নেই—কেউ আছে, কিন্তু চোখে দেখা যায় না।

সে নিঃশ্বাস আটকিয়ে পেছন ফিরতেই হঠাৎ করেই ভেসে এল এক চাপা হাসি—অতর্কিত, অদ্ভুত আর শীতল। হাসিটা যেন খুব কাছে থেকেও আবার অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। সেই শব্দে রণেনের হাত কেঁপে উঠল, ভয়েস রেকর্ডার প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, আশেপাশে কিছুই নেই, শুধু ঘন অন্ধকার আর ঝোপঝাড়ের ভাঙা ছায়া। তার মনের ভেতর এক ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্ব শুরু হলো—একদিকে ভয়, অন্যদিকে প্রমাণ পাওয়ার এক অদম্য তৃষ্ণা। ঠিক তখনই আবার বাঁশির ধ্বনি শোনা গেল। আগের মতো নয়, এবার সুরটা অনেক বেশি গভীর, যেন অজানা এক বেদনার কান্না মিশে আছে তাতে। প্রতিটি সুর যেন শ্মশানের ভাঙা ইটের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে তার মস্তিষ্কে ঢুকে যাচ্ছিল। রণেনের মনে হলো, বাঁশি বাজানো সেই অদৃশ্য উপস্থিতি তাকে ইশারা করছে—‘তুই যতই খুঁজিস, ততই হারিয়ে যাবি।’

রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে একবার কুকুরের হাহাকার শোনা গেল দূরে। সেই আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আবার যেন এক রহস্যময় ছায়া তাকে ঘিরে ধরল। রণেন বুঝতে পারছিল, কেউ তার চারপাশে হাঁটছে, পদচিহ্নের শব্দ নেই, তবু উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। তার মনে হলো, ঠান্ডা আঙুলের মতো কিছু যেন তার কাঁধ স্পর্শ করে গেল, যদিও সে পিছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। ভয়েস রেকর্ডারের আলো মৃদু জ্বলছে, আর সেই আলোয় যেন মুহূর্তের জন্যে ভাঙা চিতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি চোখে পড়ল—কিন্তু পলক ফেলতেই সেটা মিলিয়ে গেল। বাঁশির সুর তখন আবার তীব্র হলো, রণেন অনুভব করল, তার বুকের ভেতর কাঁপুনি ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে, যেখানে সত্যি আর গুজবের মধ্যে সীমারেখা মুছে যায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, রণেন বুঝতে পারল—এ লড়াই আর শুধু গুজব উন্মোচনের নয়, এ লড়াই তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখারও।

রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ভোরে যখন রণেন গ্রামে ফিরল, তার চোখে ঘুম নেই, মুখে অদ্ভুত শূন্যতা। লোকজন তাকে চারপাশ থেকে প্রশ্ন করতে লাগল—“কি হলো? কিছু শুনলি?”—কিন্তু রণেন কোনো উত্তর দিল না। তার মনের ভেতর তখনো বাজছিল সেই বাঁশির অদ্ভুত সুর আর চাপা হাসি। ভেতরের কৌতূহল ও আতঙ্ক মিশে এক অজানা দোটানা তৈরি করেছিল। সকালে সে সিদ্ধান্ত নিল, কেবল অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করলে চলবে না, ইতিহাস ঘেঁটে সত্যিটা খুঁজতে হবে। এই ভাবনায় সে গ্রামের মন্দিরে গিয়ে দেখা করল পুরোহিত হরিহর শাস্ত্রীর সঙ্গে। দীর্ঘকায়, শীর্ণদেহ বৃদ্ধ পুরোহিতের চোখদুটি যেন সবকিছু ভেদ করে দেখতে পারে। রণেন সব শুনে তাকে জিজ্ঞেস করল—“আপনি তো গ্রামটার প্রাচীন নথি-পাতার খোঁজ জানেন, শ্মশান নিয়ে কোনো তথ্য আছে কি?” পুরোহিত প্রথমে চুপ করে থাকলেন, তারপর গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্দিরের ভেতরের একটি কাঠের বাক্স খুলে আনলেন। ধুলো জমা কাপড়ে মোড়া কিছু দলিল বের করে তিনি বললেন—“তুমি সত্য জানতে চাইছ, তাহলে শোনো।”

পুরোহিত একটি দলিল মেলে ধরলেন, যার পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গিয়েছে, কালি ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। তাতে লেখা ছিল, বহু বছর আগে এই শ্মশানে বলিপ্রথা প্রচলিত ছিল। জমিদারেরা বিশ্বাস করত, অকাল মৃত্যু, মহামারি আর খরার অভিশাপ দূর করতে হলে মানুষের প্রাণ উৎসর্গ করতে হবে। সেই বলির শিকার হয় গ্রামেরই এক গরিব বাঁশিওয়ালা। নথিতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল—লোকটা ছিল অতুলনীয় প্রতিভাবান। গ্রামের প্রতিটি অনুষ্ঠানে, বিয়েতে, পূজায় তার বাঁশির সুর শোনা যেত। কিন্তু ভাগ্য তার প্রতি নিষ্ঠুর ছিল। ঋণ শোধ করতে না পেরে একদিন তাকে জমিদারের কাছে মাথা নোয়াতে হয়। আর সেই সুযোগে জমিদাররা তাকে ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে বেছে নেয়। বলা হয়, পূর্ণিমার রাতে তাকে ধরে এনে শ্মশানের ঘাটে টেনে আনা হয়। সেখানে মন্ত্রপাঠের পর নির্মমভাবে তার গলা কেটে ফেলা হয়, আর দেহ চিতায় ফেলে দেওয়া হয়। দলিলের এক পাশে রক্তমাখা হাতের ছাপের মতো দাগ এখনো শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে, যা দেখে রণেনের বুক কেঁপে উঠল। পুরোহিত বললেন—“তার আত্মা শান্তি পায়নি। সানাই ছিল তার প্রাণ, তাই মৃত্যুর পরেও সে সেই বাঁশির সুরে আমাদের শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে।”

রণেন দলিলের লেখা পড়তে পড়তে যেন সময়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল এক দরিদ্র সানাইবাদকের ছবি—যে প্রাণ দিয়ে বাজাত, অথচ ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় প্রাণটাই বলি গেল। এখন বুঝতে পারল, কেন প্রতিটি অমাবস্যায় সেই সুর ভেসে আসে। এটি কেবল গুজব নয়, ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিক, যা গ্রামের মানুষের মনে আতঙ্ক হয়ে রয়ে গেছে। তবু রণেনের সাংবাদিক মন তাকে শান্ত হতে দিল না। সে ভাবল, দলিলের তথ্য সত্যি হলে অবশ্যই কোনো প্রমাণ পাওয়া যাবে—হয়তো পুরনো হাড়গোড়, হয়তো বলির কোনো চিহ্ন। সে পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করল—“আপনি এতদিন এসব লুকিয়ে রাখলেন কেন?” পুরোহিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—“আমরা লুকোইনি, আমরা ভয় পেয়েছি। যারা খোঁজ নিতে গিয়েছিল, তারা আর ফিরেনি। তুমি যদি সত্যিই ওখানে আবার যেতে চাও, তবে মনে রেখো—এই বাঁশি মানুষকে টেনে নেয়, আর সেই টান থেকে কেউ মুক্তি পায়নি।” পুরোহিতের কণ্ঠে ছিল সতর্কতা, কিন্তু রণেনের মনে তখন আরও প্রবল হলো সত্য উন্মোচনের জেদ। সে বুঝে গেল, তার পথ আরও অন্ধকার, আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

অমাবস্যার সেই ভয়াবহ রাতের অভিজ্ঞতার পরও রণেন থেমে থাকেনি। বরং আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল তার সংকল্প। এবার সে সিদ্ধান্ত নিল, কেবল একা নয়, সঙ্গে আরও কিছু মানুষকে নিয়ে শ্মশানে যাবে, যাতে সত্যি হলে প্রমাণিত হয় সবার সামনে। পরদিন সে শহর থেকে নিয়ে এল দুটি ক্যামেরা, একটি উন্নত মানের ভয়েস রেকর্ডার আর টর্চলাইট। সঙ্গে এল তার দুই সহকারী—তন্ময় আর সুদীপ, দুজনেই তরুণ, পত্রিকারই স্টাফ রিপোর্টার। তারা প্রথমে রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু রণেনের জেদে আর উত্তেজনায় টেনে আনা গেল। রাত নামতেই তারা তিনজন শ্মশানের দিকে রওনা দিল। চারপাশের গাছগাছালির মধ্যে ঝিঁঝিঁর ডাক, হঠাৎ কোথাও থেকে ভেসে আসা শেয়ালের হাহাকার, আর বাতাসে অদ্ভুত এক কাঁচা গন্ধ—সব মিলিয়ে শ্মশান তখন যেন ভিন্ন জগতে পরিণত হয়েছিল। রণেন ক্যামেরার লাল আলো জ্বালিয়ে রেকর্ডিং চালু করল, ভয়েস রেকর্ডার চালু করে নিজের কণ্ঠে বলল, “এখন আমরা শ্মশানের ভেতরে প্রবেশ করছি। সময়—মধ্যরাত্রি।” তার কণ্ঠ স্থির হলেও মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর যেন ঝড় বইছে।

ঠিক তখনই ভেসে এল সেই চেনা বাঁশির সুর। আগেরবারের মতোই রহস্যময়, কিন্তু এবার যেন আরও করুণ, আরও টানাটানি করা। তন্ময় আর সুদীপ একে অপরের দিকে তাকাল—তাদের চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক। “দাদা, এই সুরটা… অস্বাভাবিক,” তন্ময় ফিসফিস করে বলল। সুদীপ তো সরাসরি রণেনের হাত চেপে ধরে বলল, “আমরা ফিরব দাদা। এ জায়গা ভালো নয়।” কিন্তু রণেন অনড়। সে কাঁধ সোজা করে বলল, “তোমরা চাইলে ফিরতে পারো, কিন্তু আমি থামব না। আমি দেখতে চাই, সুরটা কোথা থেকে আসছে।” সহকারীরা দ্বিধায় পড়ল, তবে কিছুদূর পর্যন্ত তার সঙ্গে চলল। বাঁশির সুর ক্রমশ কাছে আসছিল, শীতল বাতাস যেন তাদের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ টর্চলাইট ঝলসে উঠতেই তারা দেখতে পেল, দূরে শ্মশানের ভাঙা ঘাটের ওপর কিছু একটা নড়ছে। তন্ময় আঁতকে উঠে পেছনে সরল, আর সুদীপ প্রার্থনার মতো হাত জোড় করল।

তারপরই, চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছায়ামূর্তি। সাদা ধুতি পরা, কঙ্কালসার শরীর, মুখ অস্বাভাবিকভাবে লম্বাটে আর শুকনো, চোখ দুটি গহ্বরের মতো কালো। কাঁধে হাড়সার হাড় দেখা যাচ্ছে, হাত কাঁপছে, আর সেই হাতেই ধরা একটি বাঁশি। চাঁদের আলো না থাকলেও চারপাশে এক অদ্ভুত ম্লান আলোয় মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বাঁশিতে ফুঁ দিতেই আবার শোনা গেল সেই অদ্ভুত সুর—যা একদিকে মায়াময়, অন্যদিকে মৃত্যুর ডাকের মতো ভয়ানক। তন্ময় আর সুদীপ আতঙ্কে চিৎকার করে পালাতে চাইলো। তন্ময় তো প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ল, সুদীপ টেনে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু রণেন দাঁড়িয়ে রইল, তার চোখ স্থির হয়ে গিয়েছে ছায়ামূর্তির দিকে। যেন হিপনোটাইজড হয়ে গেছে। সে টের পাচ্ছিল, এই মূর্তি মানুষ নয়, অথচ কোনো একসময় মানুষ ছিল। তার প্রতিটি নিশ্বাসে মৃত্যুর গন্ধ মিশে আছে। সানাইবাদকের অভিশপ্ত আত্মা—এই প্রথমবার রণেন যেন তাকে সামনাসামনি দেখতে পেল। ক্যামেরা তখনও রেকর্ড করছিল, ভয়েস রেকর্ডারে কেবল সেই বাঁশির তীব্র প্রতিধ্বনি ধরা পড়ছিল। কিন্তু রণেনের শরীর জমে গিয়েছিল, সে কিছুতেই হাত নাড়তে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, সুরটা তাকে নিজের ভেতর টেনে নিচ্ছে, এমন এক গভীর অন্ধকারে, যেখান থেকে ফেরা অসম্ভব।

মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে ছায়ামূর্তিটি হঠাৎই বাঁশি বাজাতে শুরু করল। সেই সুর একেবারেই অচেনা—না পুরোপুরি করুণ, না পুরোপুরি ভয়ঙ্কর, বরং এমন এক সঙ্গীত যা শুনলে মনে হয় বুকের ভেতর থেকে প্রাণটাকেই যেন টেনে নেয়। বাঁশির প্রতিটি সুর যেন শ্মশানের ইটপাথরে প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার রণেনের কানে প্রবেশ করছিল। তার দুই সহকারী—তন্ময় আর সুদীপ, যারা আতঙ্কে কেঁপে উঠছিল, তারা মুহূর্তের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। প্রথমে শুধু চোখ উল্টে গিয়েছিল, তারপর নিস্তেজ হয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল, যেন প্রাণটাই সুরের মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে। রণেন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল—সে নিজেও টের পাচ্ছিল বুকের ভেতর ধকধক করছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর ভারী হয়ে আসছিল, হাত কাঁপছিল, তবু তার সাংবাদিক প্রবৃত্তি থেমে থাকতে দিল না। কষ্ট করে কাঁপা আঙুলে ক্যামেরার বোতাম চালু রেখেছিল সে। লেন্সের ভেতর দিয়ে সে দেখছিল, কেমন করে ছায়ামূর্তির চারপাশে কালো কুয়াশার মতো আস্তরণ ঘনীভূত হচ্ছে।

ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। প্রতিটি পদক্ষেপে শুকনো পাতার খসখস শব্দ হচ্ছিল, অথচ তার পায়ের ছাপ মাটিতে পড়ছিল না। রণেনের মনে হচ্ছিল, সময় থেমে গেছে। বাতাস জমাট বেঁধে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। মূর্তিটি তার সামনে দাঁড়াতেই বাঁশি ঠোঁট থেকে নামাল, আর অস্বাভাবিক গভীর কণ্ঠে বলল—“আমার সুর থেকে কেউ রক্ষা পায় না।” সেই কণ্ঠস্বর ছিল না মানবীয়—শুকনো পাতা ঘষাঘষির মতো কর্কশ, আবার নদীর গহ্বর থেকে ভেসে আসা গম্ভীর প্রতিধ্বনির মতো অদ্ভুত। রণেনের শরীর ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেল, হাঁটু কাঁপছিল, তবু সে দমে যায়নি। ক্যামেরা এখনও রেকর্ড করছে ভেবে তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত সাহস কাজ করছিল। সে ঠোঁট শুকিয়ে গিয়ে গলা শুকনো অবস্থাতেও বিড়বিড় করে বলল, “আমি… আমি সত্যটা সবাইকে দেখাবো।” ছায়ামূর্তি তখন এক অদ্ভুত হাসি হাসল—চাপা, কিন্তু কানে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই রক্ত হিম হয়ে যায়।

এরপরই হঠাৎ চারদিক যেন কেঁপে উঠল। শ্মশানের শুকনো গাছগুলো অস্বাভাবিকভাবে দুলতে শুরু করল, বাতাসে উঠল এক ভয়াবহ ঝড়। ঝড়ের সঙ্গে ধুলো, ছাই আর পচা গন্ধ ভেসে এসে রণেনের চোখে-মুখে লাগছিল। আকাশ কালো হয়ে উঠল, অন্ধকার যেন আরও গভীর হলো। মাটিতে ভাঙা চিতার কাঠগুলো একে অপরের সঙ্গে আঘাত খেয়ে শব্দ করছিল, বাদুড়েরা পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে হাহাকার তুলছিল। হঠাৎ রণেন দেখল, ছায়ামূর্তির চারপাশ থেকে কালো কুয়াশা ঘূর্ণির মতো ছড়িয়ে পড়ছে, আর সেই কুয়াশা তন্ময় ও সুদীপের নিথর দেহকে ঢেকে ফেলেছে। তার নিজের বুকের ভেতর তখন এমনভাবে ধুকপুক করছিল যেন হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। মাথা ঘুরে আসছিল, চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, আর সে শেষ শক্তি দিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সুর থামেনি—বাঁশি বাজতেই থাকল, সুর তীব্রতর হলো, আর সেই সুরের ভেতরেই যেন মৃত্যু, অভিশাপ আর চিরন্তন অন্ধকারের আহ্বান মিশে ছিল। রণেন বুঝে গেল, তার সামনে এখন শুধু প্রশ্ন—সে এই অভিশপ্ত বাঁশির হাত থেকে বাঁচতে পারবে, নাকি চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে মৃত্যুর অন্ধকারে।

১০

ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই পুরো গ্রামজুড়ে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের দু-একজন ভোরবেলা শ্মশানের পথ ধরে জ্বালানি কাঠ আনতে গিয়েছিল। তারা হঠাৎ লক্ষ্য করল, ভাঙা গাছপালার মধ্যে ছড়িয়ে আছে রণেনের সরঞ্জাম—ক্যামেরা, রেকর্ডার, আর কিছু ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। ক্যামেরার লেন্সে কাদামাটির ছাপ, রেকর্ডারের শরীরে যেন কারও আঙুলের দাগ খোদাই হয়ে আছে। আশেপাশে মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই। না রণেন, না তার সহকারীরা—তিনজন যেন রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মুহূর্তেই খবরে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল—“ওরা নেই! শ্মশানের বাঁশিওয়ালা ওদের নিয়ে গেছে।” কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শত শত গ্রামবাসী ভিড় জমাল শ্মশানের চারপাশে। কেউ দূর থেকে তাকিয়ে থাকল, কেউ আবার ভয় আর কৌতূহলের টানে ভেতরে ঢুকে গেল। হঠাৎ এক কিশোর সাহস করে ক্যামেরাটি চালু করল। স্ক্রিনে ঝাপসা ছবি, গা ছমছমে শব্দ, তারপর ধীরে ধীরে ফুটে উঠল এক কালো ছায়ামূর্তি—সাদা ধুতি, কঙ্কালসার মুখ, হাতে বাঁশি। সবাই শ্বাস আটকে দেখছিল। বাঁশির তীব্র সুর বেজে উঠতেই স্ক্রিন কাঁপতে লাগল, ঠিক তখনই রেকর্ডিং কালো হয়ে গেল। ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ হয়নি, তবুও পর্দা নিভে গেল। সেই দৃশ্য দেখে জনতার মধ্যে চিৎকার উঠল। মানুষ হুড়োহুড়ি করে পালাতে লাগল। মুহূর্তেই গ্রাম যেন দমবন্ধ করা ভয়ে ডুবে গেল।

গ্রামের প্রবীণরা একত্র হয়ে বসলেন। তাঁদের চোখে আতঙ্কের সঙ্গে মিশে ছিল দীর্ঘদিনের চাপা আতঙ্কের সত্য প্রমাণিত হওয়ার যন্ত্রণা। দীর্ঘদিন ধরেই গ্রামজুড়ে গুজব চলছিল যে, শ্মশানের বাঁশিওয়ালার সুরে নাকি কেউ টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু এতদিন সেটা নিছক গুজব বলেই ধরা হত। রণেন শহর থেকে এসে বলেছিল, সে প্রমাণ করবে এসব কিছুই মিথ্যে। কিন্তু তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আর ক্যামেরার শেষ রেকর্ডিং দেখাল, গুজব আদতে ভয়াবহ সত্যের প্রতিচ্ছবি। গ্রামজুড়ে এখন ভয়ের এক নতুন নিয়ম শুরু হল। মানুষ শ্মশানের পথ ঘেঁষে চলত না। যেসব কৃষক ওই পাশের জমিতে কাজ করত, তারা ফসল না কাটিয়েই জমি ফেলে দিল। রাত হলে গ্রামে আর কেউ বাইরে বের হত না। বাঁশির সুরের গল্প যেন অন্ধকারের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলল, রণেন ও তার সহকারীরা মারা গেছে, আবার কেউ বলল, তাদের আত্মাও এখন বাঁশিওয়ালার দাস হয়ে গেছে। গ্রামশিশুরা আর সন্ধ্যার পর বাইরে খেলতে বের হতো না, মায়েরা আঁচলে মুখ ঢেকে সন্তানদের আঁকড়ে ধরত। মানুষের মনে ভর করল এক অচেনা শূন্যতা—যেখানে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস একসাথে লড়াই করছিল।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হল, রণেনের পরিবারের কাছে খবর পৌঁছতে অনেক দেরি হয়নি। শহরে বসে তাঁরা বারবার ফোন করলেন, কিন্তু কোনো খোঁজ মিলল না। শেষমেশ গ্রাম থেকে পাঠানো লোক এসে জানাল সেই রাতের ঘটনার কথা। শহরের মানুষ প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইল না, তারা ভেবেছিল এটা নিছক গুজব বা গ্রামীণ কুসংস্কার। কিন্তু ক্যামেরার শেষ রেকর্ডিং যখন তাঁদের চোখে দেখানো হল, তখন সবার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ল—“শ্মশানের বাঁশিওয়ালা গ্রাস করল শহুরে সাংবাদিককে।” টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হল। শহুরে মানুষের কৌতূহল বাড়ল, কিন্তু গ্রামবাসীর ভয়ের কোনো সীমা রইল না। শ্মশানের পাশে দিয়ে এখন দিনের আলোতেও কেউ হাঁটে না। বাঁশির সুর যেন বাতাসে ভেসে বেড়ায়—কেউ শোনে, কেউ আবার বলে সেটা মনের ভুল। কিন্তু ভয়াবহ সত্য এটাই যে, রণেন আর তার সহকারীরা আর কখনো ফেরেনি। তাদের স্মৃতি মিশে গেল শ্মশানের নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে। গুজব আর গুজব নয়, সেটা এখন এক ভয়ঙ্কর বাস্তব, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গ্রামের বুক কাঁপিয়ে রাখবে।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *