অমাবস্যার সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই আকাশে অদ্ভুত একটা চাপা গুমোট তৈরি হয়েছিল, যেন দিনের আলোও বাতাসে লুকিয়ে থাকা অজানা আশঙ্কাকে অস্বীকার করতে পারছিল না। নীরজ সেই সকাল থেকেই গুরুর নির্দেশমতো ঘর ছাড়িয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিস জোগাড় করতে বেরিয়েছিল—একটি প্রাচীন লাল কাপড়ের টুকরো, কালো মোমবাতি, শিবের জীর্ণ মূর্তি, আর সেই দুর্লভ পুঁতির মালাটি, যা এক সময় গুরুর গুরু তার হাতে তুলেছিলেন। প্রতিটি জিনিস যেন নিজের ভেতর গোপন কোনো স্পন্দন বহন করছিল, নীরজ মনে মনে বুঝতে পারছিল, এ রাত শুধু আরেকটা সাধনার রাত নয়; এ রাতে এমন কিছু ঘটতে চলেছে, যার ওজন বহন করা সহজ নয়। শহরের ভাঙা প্রাচীন অলিগলি, গঙ্গার তীরের নোংরা ঘাট আর পুরনো শ্মশানপথ পেরিয়ে যখন নীরজ ফিরে এল, তখন সূর্য পশ্চিমের রক্তিম আকাশে শেষ আলো ছড়াচ্ছিল, আর গুরুর চোখে সেই অদ্ভুত দীপ্তি দেখা যাচ্ছিল, যা নীরজ আগে কেবল শুনেছে গল্পে—যখন কোনো তান্ত্রিক বহু বছরের সাধনা শেষে এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তী সেদিন সকাল থেকেই কণ্ঠ নিচু করে কথা বলছিলেন, চোখে ছিল জিজ্ঞাসু ভয়, অথচ ভেতরে লুকোনো এক আগুনের স্পর্শ, যা কেবল শক্তির লোভই জাগাতে পারে। তিনি জানতেন, একবার যদি এ সাধনা শুরু হয়, তবে আর ফেরার পথ নেই। তবু তিনি থামলেন না। শিষ্যের হাতে তুলে দিলেন সেই ধুলো ধরা গ্রন্থ, যার ভেতর লুকিয়ে ছিল শতাব্দীর পুরনো মন্ত্র, আর নির্দেশ দিলেন, আজ রাতেই সবকিছু প্রস্তুত করতে হবে। নীরজের বুকের ভেতর কেমন জানি কেঁপে উঠল—এ শুধু তন্ত্রসাধনা নয়, এ এমন কিছু, যা অন্ধকারের মধ্যে ডাক দেয়, আর সে ডাক ফেরা বড় কঠিন। শিষ্য চুপচাপ মাথা নাড়ল, গুরুর চোখের ভাষা বুঝে নিল, আর সূর্য ডোবার আগেই দু’জনে মিলে বেরোল সেই শ্মশানের দিকে, যা এ রাতের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।
পথটা যত এগোচ্ছিল, তত অদ্ভুত এক নীরবতা ঘিরে ধরছিল তাদের, যেন চারপাশের গাছপালা, পাখি এমনকি বাতাস পর্যন্ত জানে যে এ রাতে অচেনা কিছু ঘটতে চলেছে। শ্মশান ঘাটের পাথরের ঘাট আর ভাঙা শিবমন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে নীরজ দেখল, মাটির ধুলো উড়ছে হাওয়ার ঝাপটায়, আর চিতাভস্মের গন্ধ ভিজিয়ে দিচ্ছে নিশ্বাস। শ্রীপাদ চক্রবর্তী শ্মশানের একপাশে জায়গা বেছে নিয়ে বললেন, “এখানেই হবে।” এরপর শুরু হলো যন্ত্রমণ্ডল আঁকার প্রক্রিয়া—মাটির ওপর নিখুঁতভাবে আঁকা ত্রিকোণ আর বৃত্ত, যার মধ্যে বসানো হলো সেই লাল কাপড়, পুঁতির মালা আর শিবমূর্তি। গুরু নিজের চোখে সবকিছু পরীক্ষা করে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, আর নীরজ তার নির্দেশমতো কালো মোমবাতিগুলো জ্বালাতে লাগল। রাত তখন আরও গাঢ় হয়েছে, দূরে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে, আর শ্মশানপথের ঝোপে হাওয়ার দোলায় শুকনো পাতা কাঁপছে অজানা সুরে। মোমবাতির আলোয় গুরুর মুখ যেন আরও ভৌতিক, গভীর আর অদ্ভুত দেখাচ্ছে, আর নীরজ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, গুরুর কপালের তিলকের তলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এমন সময় নীরজের মনে পড়ল গুরুর বলা পুরনো কথা—“যে তন্ত্র অজানা শক্তিকে ডাকে, তাকে আবার ফিরিয়েও আনতে হয়, নাহলে সেই শক্তিই তোমায় গ্রাস করবে।” তার বুকের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার উঠল, তবু সে জানে থামা নেই। এ সাধনার পেছনে লুকিয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে গুরুর তৃষ্ণা—শক্তির তৃষ্ণা, যা শুধু দেখার নয়, অনুভব করার, নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার।
রাত যখন মধ্যরাত ছুঁয়েছে, অমাবস্যার চাঁদ যখন আকাশে অদৃশ্য, তখন গুরু আর নীরজ একসাথে বসে মন্ত্রপাঠ শুরু করল। নীরজ অনুভব করল বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে গেছে, মোমবাতির শিখা একবার দুলে নিভে যেতে যেতে আবার জ্বলছে, আর অদূর থেকে যেন কারো নিঃশ্বাস শোনাতে পাচ্ছে। গুরুর কণ্ঠ তখন গভীর, থরথর করা; সেই স্বর মিশে গেল শ্মশানঘাটের নীরবতায়। হঠাৎ নীরজের মনে হলো, সে আর একা নেই, চোখ বন্ধ করেও সে বুঝতে পারছে—আরো কেউ আছে এই যন্ত্রমণ্ডলের চারপাশে। সেই উপস্থিতি—না মানুষ, না কোনো সহজে বোঝা যায় এমন কিছু—এক অদ্ভুত উষ্ণতা আর শীতলতার সংমিশ্রণ বয়ে আনছে। নীরজ ভয়ে চোখ মেলল, আর দেখল গুরুর মুখে আতঙ্ক আর তৃপ্তির অদ্ভুত মিশ্রণ; যেন বহু বছরের প্রতীক্ষার শেষে সত্যিই কিছু এসে গেছে। দূর থেকে শোনা গেল হাওয়ার মধ্যে ফিসফিসানি, ছায়ার মত কিছু একটা যন্ত্রমণ্ডলের কাছে এগিয়ে এলো। ঠিক তখনই নীরজ বুঝল, যা ডাকা হয়েছে, তা আর ফেরানো যাবে না। শ্মশানের গন্ধ, রাতের অন্ধকার আর বাতাসের ভেতর সেই অদৃশ্য উপস্থিতির স্পর্শ এক ভয়ঙ্কর সত্যে পরিণত হলো—অগ্নিকণা এসেছে, আর সেই নিশির অন্ধকারে তারা দু’জনই ঢুকে পড়ল এক এমন বৃত্তে, যা থেকে মুক্তি পেতে হলে দিতে হবে ভয়াবহ মূল্য।
–
শ্মশানের নীরবতা গভীরতর হতে হতে যেন নিজেই এক জাগ্রত সত্তায় রূপ নিল, যা মানুষের ফিসফিসানি, মন্ত্রোচ্চারণ আর নিঃশ্বাসের শব্দ গিলে নিতে চায়। চারপাশে ছড়ানো পুরনো চিতাভস্ম আর পোড়া কাঠের গন্ধে নীরজের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, মনে হলো অদৃশ্য ধোঁয়ার আস্তরনে সময় আর বাস্তবতা দুটোই জড়িয়ে যাচ্ছে। গুরুর কণ্ঠের মন্ত্রপাঠ ধীরে ধীরে ঘন, ভারী আর গভীর হতে থাকল, আর সেই স্বর যেন শ্মশানপথের ভাঙা ঘাট, ভগ্ন মন্দির আর বটগাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বাতাসের দোলায় যন্ত্রমণ্ডলের চারপাশে রাখা কালো মোমবাতির শিখাগুলি একবার দুলে নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়, আবার হঠাৎ জ্বলে ওঠে; সেই আলো-ছায়ার খেলায় গুরুর চোখের তীক্ষ্ণ দীপ্তি আর ক্লান্তির রেখা একসাথে ধরা দেয়। নীরজ শ্বাস বন্ধ করে অনুভব করল, তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কোনো অদৃশ্য কিছু, যা গরম নিশ্বাস ফেলছে তার ঘাড়ের কাছে, অথচ চোখ ঘুরিয়েও সে দেখতে পেল না; শুধু বাতাসের অদ্ভুত চলাচল আর নিজের হাড়ের মধ্যে কাঁপুনি টের পেল। রাতের গভীরে সেই ভয় যেন আরও জোরালো হয়ে উঠল, মনে হলো পৃথিবীর বুকের নিচে থেকে উঠছে ফিসফিসানি—একইসাথে ডাক আর অভিশাপ।
গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তীর চোখ তখন অদ্ভুত জ্যোতিতে জ্বলছিল, কপালে রক্ত জমাট বাঁধা তিলক, ঠোঁটের কোণে ঘাম ঝরছে; তবু তিনি থামলেন না। মন্ত্রপাঠের ছন্দে সময়ের অনুভূতি হারিয়ে গেল, আর নীরজ নিজেকে এমন এক অচেনা বৃত্তের ভেতর আবিষ্কার করল, যেখানে সে আর গুরু ছাড়া আর সবই অজানা। যন্ত্রমণ্ডলের কেন্দ্রে রাখা লাল কাপড়ের টুকরো একবার দুলে উঠল, তারপর থেমে গেল, ঠিক তখনই দূর থেকে শোনা গেল হাহাকার—নাকি বাতাসের প্রতারণা, বোঝা গেল না। শ্মশানের ছায়ার মধ্যে ভাঙা শিবমূর্তির পাশ দিয়ে ধোঁয়ার মতো কালো কিছুর স্রোত আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো, আর নীরজের মনে হলো সেই অদৃশ্য কণাগুলি তাকে দেখছে, খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে তার গভীরতম ভয়। গুরুর মুখের দিকে তাকিয়ে নীরজ দেখল, সেখানে এক অদ্ভুত রকমের তৃপ্তি ফুটে উঠেছে—যেন বহু বছরের সাধনার ফল অবশেষে ধরা দিতে চলেছে। কিন্তু সেই তৃপ্তির নিচে স্পষ্ট আতঙ্ক লুকানো, যা ভেতর থেকে গুরুকে গ্রাস করছে। সেই মুহূর্তে নীরজ বুঝতে পারল, তারা যা ডাকছে, তার ওজন বোঝা তাদের সাধ্যের বাইরে।
বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে এলো, শ্মশানের শুকনো পাতা আর ধুলো বাতাসে ঘুরপাক খেতে লাগল, আর যন্ত্রমণ্ডলের চারপাশে রাখা মোমবাতির শিখা নীলচে আলোয় জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দেখা গেল এক ঝলক অগ্নিকণার ছায়া—না মানুষ, না পশু, না কোনো ধোঁয়ার ঢেউ; কিছু একটা, যা শ্বাস নেয় না, অথচ চারপাশের বাতাসকে নিজের মতো করে নাড়ায়। গুরুর কণ্ঠ থেমে গেল, নীরজের গলা শুকিয়ে এলো, মনে হলো বুকের ভেতর যে ভয়ের আঁধার লুকিয়ে আছে, অগ্নিকণা তা স্পর্শ করছে। সেই স্পর্শ শীতল, অথচ দহনময়; যেন simultaneously বরফ আর আগুন। শ্মশানের রাত তখন নিঃশব্দ, চারপাশে শুধু বাতাসের ফিসফিসানি, আর অগ্নিকণার অদৃশ্য দৃষ্টি। হঠাৎ গুরুর কণ্ঠে আবার মন্ত্র ফেটে বেরোল, তাতে আশার চেয়ে বেশি আতঙ্ক মেশানো; আর নীরজ অনুভব করল, সেই ডাক আর ফেরানোর ডাক নয়, সেই ডাক এক অজানা শক্তিকে বশ করার মরিয়া চেষ্টা, যে শক্তি এই রাতের অন্ধকারের মধ্যে থেকে ফিসফিস করে বলে—‘আমি এসেছি, আমাকে ফেরানো যাবে না।’ নিশির রাত তখন তাদের গিলে নিচ্ছে, আর নীরজ টের পেল, তাদের সামনে যাত্রা শুরু হয়েছে, যেখানে ভোর আর আলো দূরের স্বপ্ন মাত্র।
–
যন্ত্রমণ্ডলের রেখাগুলি রাতের আঁধারে যেন আরও গভীর, আরও জীবন্ত মনে হচ্ছিল, মাটিতে আঁকা সেই ত্রিকোণ আর বৃত্ত যেন নিছক চুনের দাগ নয়, বরং এক অদৃশ্য দরজার মতো কাজ করছিল—যার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করা যায় অজানা জগতে। নীরজ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সেই কেন্দ্রে রাখা লাল কাপড়ের টুকরো আর শিবমূর্তির দিকে, আর তার চারপাশে ছড়ানো পুঁতির মালা থেকে যেন অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছিল, যা ধোঁয়ার মতো মাথায় উঠে গিয়ে ভেতরের সমস্ত ভয় আর কৌতূহলকে জাগিয়ে তুলছিল। গুরুর কণ্ঠ তখনো থামেনি, মন্ত্রের স্বর ধীরে ধীরে আরও গম্ভীর হয়ে উঠছিল; আর সেই মন্ত্র যেন শুধু বাতাসে নয়, নীরজের হাড়ের ভেতরেও ঢুকে পড়ছিল। রাতের নীরবতা তখন আর নিঃসঙ্গ নয়, মনে হচ্ছিল যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ রেখার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য অদৃশ্য চোখ, যারা নিঃশব্দে দেখছে, শুনছে, আর অপেক্ষা করছে। একসময় নীরজ টের পেল, তার দেহের লোম দাঁড়িয়ে গেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, তবু সে চোখ সরাতে পারল না সেই ত্রিকোণ থেকে—যা এখন কেবল এক আঁকা নকশা নয়, বরং এক জীবন্ত চেতনা, যা নিশিরাতের অন্ধকারের মধ্যে ধুকধুক করছে।
হঠাৎ বাতাসের মধ্যে থেকে যেন এক শীতল ঢেউ বয়ে গেল, মোমবাতির শিখা নিভে যেতে যেতে আবার জ্বলে উঠল, আর সেই ম্লান আলোয় প্রথমবার স্পষ্ট দেখা গেল অগ্নিকণাকে—না মানুষ, না ছায়া, না কুয়াশা; বরং সেই সবকিছুর মিশ্রণ, যা এক ঝলক দেখে মনে হয় আগুনের মতো, আরেক ঝলকে কেবল অন্ধকার। নীরজের চোখ স্থির হয়ে গেল, তার মাথায় অদ্ভুত চাপা যন্ত্রণা শুরু হলো, আর সে স্পষ্ট টের পেল, সেই অগ্নিকণার দৃষ্টি শুধু তাকিয়ে নেই, বরং খুঁজে বের করছে তার ভেতরের লুকোনো ভাবনা, দুর্বলতা আর গোপন ভয়। গুরুর কণ্ঠ তখন কেঁপে কেঁপে উঠছে, কিন্তু তবুও তিনি থামছেন না; মন্ত্রপাঠে এক ধরনের মরিয়া চেষ্টা, যেন এই অশরীরী শক্তিকে বশে আনতে পারলেই সমস্ত সাধনা পূর্ণ হবে। নীরজ জানত, গুরু বহু বছর ধরে এ রাতের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন, বহু সাধক এই মন্ত্রমণ্ডল নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল—তবু গুরুর বিশ্বাস অটল ছিল, তিনি পারবেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে নীরজের মনে সন্দেহের কাঁটা ফুটল; যদি এই শক্তি সত্যিই ডেকে আনা যায়, তবে তাকে ফেরানোর ক্ষমতাও কি তাদের আছে? মন্ত্রের ধ্বনিতে শ্মশান কেঁপে ওঠা শুরু করল, আর বাতাসের গন্ধ বদলে গেল—পোড়া কাঠ, চিতাভস্ম আর রক্তের মতো টক গন্ধে।
নীরজের চোখ তখন অগ্নিকণার দিকে, আর তার মনের মধ্যে ভেসে উঠতে লাগল অতীতের স্মৃতি, যা সে ভুলতে চেয়েছিল—শৈশবে মা-বাবাকে হারানোর রাত, একা শ্মশান থেকে গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়ার রাত, যখন প্রথম বার সে মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছিল; মনে হলো সেই স্মৃতি আর এই রাতের ভয় এক হয়ে যাচ্ছে। গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তীর চোখেও আতঙ্কের ছায়া পড়ল, যদিও মুখে তা ঢাকার চেষ্টা করলেন; কারণ তিনি জানতেন, ভয়ের গন্ধ পেলে অশরীরী শক্তি আরও প্রবল হয়ে ওঠে। যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ তখন নীরজের চোখে এক জীবন্ত দানবে রূপ নিল—যা ক্রমেই টানছে তাকে, আর কানে শোনা গেল ফিসফিসানি—“তোমরা আমায় ডেকেছ, আমাকে ফেরাবে কিভাবে?” সেই ফিসফিসানি বাতাসে ভেসে আসেনি, এসেছে মনে, রক্তে, হাড়ে। আর সেই মুহূর্তে নীরজ বুঝল, তারা এক বৃত্ত তৈরি করেছে যার শুরু আছে, শেষ নেই। নিশিরাতের অন্ধকার তখন তাদের দুজনকে এক অদৃশ্য খাঁচায় বন্দী করেছে, আর বাইরে শ্মশানের বাতাসে সেই অগ্নিকণার ছায়া ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক ভয়াবহ বাস্তবে—যা তাদের ডাক শুনেছে, আর এখন তার নিজের শর্তে উত্তর দিতে চলেছে।
–
রাতের নীরবতায় হঠাৎ যেন ছেদ পড়ল, বাতাসের ভেতর দিয়ে এক অজানা কম্পন ছড়িয়ে পড়ল যা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো নীরজের হৃদয়ে, আর সেই কম্পন ধীরে ধীরে যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ আঁকাবাঁকা রেখাগুলির গায়ে গায়ে জড়িয়ে গিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠল। গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বর তখন মন্ত্রের ভারে আরও গম্ভীর, তবু ভেতরে লুকনো আতঙ্ক স্পষ্ট হয়ে উঠল তার চোখের কোণে, আর সেই আতঙ্ক নীরজের বুকেও ঢেউ তুলল, যদিও সে প্রাণপণে তা চেপে রাখার চেষ্টা করছিল। এক ঝলকে মনে হলো, শ্মশানের ভাঙা চিতাভস্ম আর শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সাপের মতো কিছু একটা সরসরিয়ে এগিয়ে এলো যন্ত্রমণ্ডলের দিকে, আর ঠিক তখনই চারপাশের বাতাস ঘূর্ণির মতো ঘুরতে শুরু করল। মোমবাতির শিখাগুলি হেলে পড়ে নিভে যেতে যেতে আবার জ্বলে উঠল, আর সেই নীলচে আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল অগ্নিকণার প্রথম ছায়া—একটি অদ্ভুত আকার, যা আগুন, ধোঁয়া আর ছায়ার মিশ্রণে তৈরি, কিন্তু তাতে মানুষের মতো কিছু বৈশিষ্ট্যও লুকানো। সেই ছায়া স্থির দাঁড়িয়ে না থেকে অদ্ভুতভাবে দুলছিল, যেন এক সময়ের জন্যই দৃশ্যমান, তারপরেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। নীরজ শ্বাস নিতে ভুলে গেল, আর গুরুর কণ্ঠ থেমে গেল এক পলকের জন্য; সেই ক্ষণিকের নিস্তব্ধতায় শোনা গেল শুধু নীরজের দ্রুত নিঃশ্বাস আর শ্মশানের হাওয়ার ফিসফিস।
অগ্নিকণার উপস্থিতি যেন শ্মশানজুড়ে ছড়িয়ে গেল, বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে এলো, আর সেই ঠান্ডায় কেবল শীতলতা নয়, এক ধরণের তীক্ষ্ণ ব্যথা লুকানো ছিল; যেন হাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ছে কোনো অদৃশ্য শীত। নীরজ স্পষ্ট টের পেল, সেই ছায়া কেবল তাদের দেখছে না, তাদের মন পড়ছে, তাদের ভেতরের সমস্ত লুকনো আতঙ্ক, লোভ, অপরাধবোধ খুঁজে বের করছে। গুরুর চোখের দৃষ্টি তখন আর আগের মতো স্থির নয়; তাতে মিশে গেছে বিস্ময়, ভয় আর এক অজানা আবেশ। শ্রীপাদ চক্রবর্তী বহু বছরের সাধনা, বহু পুরনো গ্রন্থ আর তন্ত্রশাস্ত্রের জ্ঞান দিয়ে যা ডেকেছেন, এখন তা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ সে যে শক্তিকে বশ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটিও বুঝতে পারছেন। অগ্নিকণা ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এলো, যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণের কেন্দ্রে রাখা লাল কাপড়ের টুকরো আর পুঁতির মালার ওপর দিয়ে অদৃশ্য হাত বুলিয়ে দিল, আর সেই স্পর্শেই কাপড়ের রঙ যেন গাঢ়তর হয়ে গেল, মালার পুঁতিগুলি যেন ক্ষীণভাবে জ্বলে উঠল। বাতাসে তখন আর আগের মতো পোড়া কাঠের গন্ধ নেই, তার বদলে ভেসে এলো তীব্র ধাতুর গন্ধ, রক্ত আর আগুনের গন্ধ, যা নীরজের শ্বাসরুদ্ধ করে দিল।
গুরু মরিয়া হয়ে আবার মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, কণ্ঠে আগের চেয়ে বেশি জোর, কিন্তু সেই শব্দে ভয়ের কম্পন স্পষ্ট; আর নীরজের মনে হলো, মন্ত্রের প্রতিটি শব্দ যেন শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে, অগ্নিকণার রোষকে আটকানোর শক্তি রাখছে না আর। অগ্নিকণার সেই ছায়া ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দাহ করা চোখের মতো দুটি আলোক বিন্দু, যেগুলি সরাসরি নীরজের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই চোখের দৃষ্টি ঠান্ডা, কিন্তু তার গভীরে লুকানো আছে এমন কিছু, যা নীরজ ভাষায় প্রকাশ করতে পারল না—যেন সেই চোখ শুধু দেখছে না, বরং প্রশ্ন করছে, পরখ করছে, আর সম্ভবত তার আত্মার গহীনে ঢুকে যাচ্ছে। শ্মশানের রাত তখন নিঃশব্দ, চারপাশে কেবল বাতাসের শোঁ শোঁ আর সেই ধোঁয়ার ভেতরে ভাসমান অগ্নিকণার ফিসফিসানি—যা কানে নয়, বরং মনে শোনা যায়। আর সেই ফিসফিসানির অর্থ একটাই: “তোমরা আমায় ডেকেছ, এবার তোমাদের দিতে হবে তোমাদের চাওয়ার মূল্য।” সেই মুহূর্তে নীরজ বুঝল, তারা যা চেয়েছিল, তা এখন তাদেরই দিকে ধেয়ে আসছে, আর শ্মশানের অন্ধকারের মধ্যে তারা দু’জন, গুরু-শিষ্য, দাঁড়িয়ে আছে এক এমন শক্তির মুখোমুখি, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, আর যে রাত তাদের ডেকেছিল, সে রাতই হয়তো আর ভোর দেখবে না।
–
অগ্নিকণার উপস্থিতি তখন শ্মশানের বাতাসকে শুধু ভারী নয়, যেন বিষাক্ত করে তুলেছিল; প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে নীরজ অনুভব করছিল বুকের ভেতর আগুনের মতো এক জ্বালা, আর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যা ক্রমশ গিলে নিচ্ছে তার চিন্তা আর ইচ্ছাকে। যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ রেখাগুলি তখন ধোঁয়ার ভেতর স্পষ্ট-অস্পষ্ট হয়ে এক অদ্ভুত নৃত্য করছে, আর সেই ত্রিকোণের কেন্দ্রের লাল কাপড়ের টুকরো ক্রমেই আরও গাঢ় হয়ে যেন রক্তমাখা কাপড়ে পরিণত হচ্ছে। গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তী মরিয়া হয়ে মন্ত্রপাঠ জারি রাখলেন, তার কণ্ঠস্বর আর আগের মতো গম্ভীর নয়, বরং আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠছে; প্রতিটি শব্দ যেন নিজেই নিজের অর্থ হারাচ্ছে, বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে নীরজ স্পষ্ট দেখতে পেল, গুরুর কপালে বড় লাল তিলকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, আর তার চোখের গভীরে লুকোনো লালসা আর ভয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ জ্বলছে—যা এই তান্ত্রিক সাধনার শুরু থেকেই ছিল, কিন্তু এত স্পষ্ট আগে কখনও ফুটে ওঠেনি। গুরুর সেই দৃষ্টি, যা একসময় ছিল স্থির আর শক্ত, এখন অগ্নিকণার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নত হচ্ছে, আর সেই নত দৃষ্টিতেই ফুটে উঠছে এক লম্বা যাত্রার ক্লান্তি, লোভ আর পরাজয়ের স্বাদ।
নীরজের মনে হলো, গুরুর কণ্ঠস্বর এখন আর কেবল মন্ত্র নয়; তার মধ্যে এক প্রকার প্রার্থনা, এক প্রকার ক্ষমা চাওয়া লুকিয়ে আছে—যেন তিনি নিজেই বুঝে গেছেন যে যা ডেকেছেন, তা আর তার হাতে নেই। বাতাসের মধ্যে তখন অগ্নিকণার ফিসফিসানি আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল, তবে সেই শব্দ কানে নয়, মনে ভেসে আসছিল, আর সেই ফিসফিসানি যেন সরাসরি নীরজের আত্মার গভীরে গিয়ে আঘাত করছিল। শ্মশানের চারপাশের ছায়াগুলি আরও গাঢ় হয়ে এলো, বাতাসে উড়তে থাকা ধুলো আর ছাই যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ রেখাগুলিকে ঢেকে দিতে চাইল, অথচ অদ্ভুতভাবে রেখাগুলি অদৃশ্য হয়নি—বরং সেই ধুলোতেই যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকল। সেই আলোর মধ্যে অগ্নিকণার ছায়া আর স্পষ্ট হয়ে উঠল; আগুনের মতো ঝলসে ওঠা চোখ, ধোঁয়ার মতো গড়িয়ে যাওয়া দেহ আর অদৃশ্য শিকলের মতো বিস্তৃত হতে থাকা ছায়া। সেই ছায়া এক পলকে গুরুর দিকে এগিয়ে এলো, আর নীরজ দেখল গুরুর চোখের ভেতর দিয়ে আতঙ্ক রক্তের মতো ছড়িয়ে পড়ল; তার কণ্ঠ থেমে গেল, ঠোঁট কেঁপে উঠল, আর সেই ফাঁকা চোখের গভীরে ফুটে উঠল নিজের সাধনার ফলাফল দেখতে পাওয়ার ভয়াবহ সত্য।
নীরজের মনে হলো, শ্মশানের রাত যেন হঠাৎ অসীম লম্বা হয়ে গেছে; সময় স্থির হয়ে গেছে, আর সেই স্থির সময়ের মধ্যে তারা দু’জন দাঁড়িয়ে আছে এক এমন শক্তির মুখোমুখি, যার জন্য তারা তৈরি ছিল না। অগ্নিকণার ছায়া তখন ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে গুরুর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তার স্পর্শে গুরুর গলার স্বর ভেঙে যাচ্ছিল, তার চোখ ছলছল করছিল, আর তবু মুখে ফুটে উঠছিল সেই পুরনো লালসা, যা এত বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই লালসাই হয়তো তাকে এই রাতে টেনেছিল, এই রাতের অন্ধকারকে আহ্বান করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু অগ্নিকণা তার লালসা আর ভয়কে একসাথে বের করে এনে নীরজের সামনেই দেখাল—গুরু এক সময়ে যা চেয়েছিলেন, সেই ক্ষমতা, সেই প্রতিশোধ, সেই শত্রুকে হারানোর ইচ্ছা—সবই এখন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে, আর তার জায়গায় রয়ে যাচ্ছে কেবল মৃত্যু আর অন্ধকার। নীরজের বুকের মধ্যে হাহাকার উঠল, অথচ সে কিছুই বলতে পারল না; গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেল, ঠোঁট শুকিয়ে গেল। আর সেই মুহূর্তে সে বুঝল, এই সাধনা শুরু হয়েছিল এক প্রবল ইচ্ছা দিয়ে, কিন্তু শেষ হবে এক অমোঘ অভিশাপে—যেখানে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়া মানেই আত্মাকে সেই অশরীরী শক্তির কাছে সমর্পণ করা, আর সেই সমর্পণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
–
রাতের অন্ধকার তখন কেবল আর শ্মশানের আকাশে নয়, যেন নীরজের চোখের ভেতর ঢুকে পড়েছে; প্রতিটি নিশ্বাসে সে অনুভব করছিল এক অজানা ভার, যা বুকের ভেতর ঠেলে দিচ্ছে দুঃস্বপ্নের মতো দৃশ্য—যেন তার চারপাশের বাস্তবতা ভেঙে গিয়ে নতুন, অচেনা এক জগৎ তৈরি হয়েছে। যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ তখন আর মাটিতে আঁকা নিছক এক নকশা নয়; বরং যেন সেই ত্রিকোণের মধ্যে দিয়ে খুলে গেছে এক অদৃশ্য দরজা, যার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে ছায়া, ধোঁয়া আর অগ্নিকণার অশরীরী উপস্থিতি। নীরজের চোখে ভাসতে লাগল বিভ্রান্তিকর ছবি: ছোটবেলার সেই রাত, যখন সে প্রথম শ্মশানের ধোঁয়া আর আগুন দেখেছিল, গুরুর হাত ধরে সেই রাতের শ্মশান পার হওয়ার ভয়; দেখল মায়ের অশ্রু, বাবার মৃতদেহের চিতা আর সেই চিতার আগুন, যা রাতের অন্ধকারে এক অদ্ভুত সুরে ফিসফিস করেছিল। সেই সব স্মৃতি যেন বাস্তবের চেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠল, আর নীরজ বুঝতে পারল, সে আর বর্তমানের শ্মশানে নেই; সে আছে স্মৃতির ভিতরে, বিভ্রমের মধ্যে, আর সেই বিভ্রম তাকে টেনে নিচ্ছে এক অজানা গভীরতায়।
গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তীও তখন আর শ্মশানের ধুলোয় বসে থাকা এক তান্ত্রিক নন; তার চোখে ফুটে উঠেছিল এমন কিছু, যা একাধারে আতঙ্ক আর মোহের মিশ্রণ। অগ্নিকণার ছায়া তাকে ঘিরে যেন নৃত্য করছিল, আর সেই নৃত্যের তালে তালে গুরু নিজের মনেও হারিয়ে যাচ্ছিলেন। তার চোখ ভরে উঠল অতীতের সেই রাতগুলোর স্মৃতি দিয়ে—যখন তিনি প্রথম এই তন্ত্রমন্ত্রের শক্তি অনুভব করেছিলেন, যখন অন্ধকার তাকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, “আমাকে ডাকো, আমি তোমাকে ক্ষমতা দেবো।” সেই স্মৃতি এখন আর সুখের নয়; বরং তাতে লুকিয়ে আছে হতাশা, ব্যর্থতা আর অপরাধবোধ। বহু বছর ধরে যে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তিনি শ্মশান থেকে শ্মশান ঘুরেছেন, সেই শক্তির স্পর্শ যখন অবশেষে এলো, তখনই তিনি টের পেলেন, এ শক্তি মানুষকে ক্ষমতাধর নয়, বরং দাসে পরিণত করে। গুরুর ঠোঁট থেকে অস্পষ্ট ফিসফিসানি বেরিয়ে এলো—মন্ত্রের ভগ্নাংশ, অনুতাপের স্বর আর মৃত্যুভয়ের ছায়া। সেই শব্দ শ্মশানের বাতাসে মিলিয়ে গেল, অথচ সেই ফিসফিসানি যেন আরও ভারি করে তুলল চারপাশের অন্ধকারকে।
বাতাস তখন অদ্ভুতভাবে ভারী আর জীবন্ত মনে হচ্ছিল, যেন সে নিজেই একটি প্রাণী, যা শ্বাস নিচ্ছে, নীরজ আর গুরুকে ঘিরে ধরে রাখছে। অগ্নিকণার চোখ তখন আরও দাহ করা লাল আলোর মতো জ্বলে উঠল, আর সেই চোখের দৃষ্টি নীরজের হৃদয়ের গভীরে গিয়ে ছুঁয়ে দিল তার সবচেয়ে গোপন ভয়কে। এক পলকের জন্য নীরজ দেখল নিজেরই প্রতিচ্ছবি—কিন্তু সেই প্রতিচ্ছবির চোখে মানুষ নয়, বরং অগ্নিকণার আগুন জ্বলছে। মনে হলো, ধীরে ধীরে সে আর গুরু নয়, বরং অগ্নিকণারই অংশ হয়ে যাচ্ছে, আর নিজের স্বপ্ন, স্মৃতি, ভালোবাসা সবই বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেই আগুনের মধ্যে। শ্মশান তখন নিঃশব্দ, তবু সেই নীরবতার ভেতর দিয়ে গর্জন শুনতে পাচ্ছিল নীরজ; মনে হচ্ছিল শ্মশানের প্রতিটি পোড়া কাঠ, প্রতিটি ধূলিকণা, এমনকি বাতাসও ফিসফিস করছে—একই বার্তা বারবার: “ফিরে যাওয়া নেই, ফিরে যাওয়া নেই…” সেই বার্তায় মিশে ছিল প্রলোভন আর অভিশাপ, আর নিশিরাতের সেই বিভ্রমের মধ্যে নীরজ বুঝতে পারল, তারা এমন এক পথ পেরিয়ে গেছে, যার শেষ আছে কেবল অন্ধকার আর দুঃস্বপ্নে।
–
শ্মশানের বাতাস তখন নিঃশব্দ অথচ ভারী, যেন প্রতিটি ধূলিকণার ভেতর লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য চিৎকার। অগ্নিকণার চোখের আগুন তখন আরও জ্বলছিল, সেই দৃষ্টির তীব্রতায় মনে হচ্ছিল, নীরজের অন্তরাত্মা নগ্ন হয়ে গিয়েছে, সমস্ত গোপন ইচ্ছা, দুর্বলতা, আর অন্ধকার বাসনা খুলে পড়ে গেছে অদৃশ্য আদালতের সামনে। গুরুর গলা তখন কেঁপে কেঁপে উঠছিল, মন্ত্রের ছন্দে আর সেই আগের মতো আস্থা নেই; বরং প্রতিটি শব্দ যেন ভয়ে কাঁপা আঙুলের মতো আকাশে আঁকা রেখা মাত্র। ঠিক তখনই অগ্নিকণার ফিসফিসানি শোনা গেল—সেই স্বর বাতাসে নয়, মনে প্রতিধ্বনির মতো ধাক্কা দিতে লাগল, স্পষ্টভাবে শোনাল: “আমাকে আহ্বান করেছ, আমার মূল্য দাও…” সেই শব্দে ছিল না কোনো রাগ, বরং এক ধরণের ঠান্ডা স্থিরতা, যা মানুষের যুক্তি আর সাহস উভয়কেই ভেঙে দিতে পারে। নীরজের গা শিরশির করে উঠল; মনে হলো বুকের ভেতর থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে হৃদয়টাকে মুঠোয় ধরেছে। অগ্নিকণার ছায়া তখন ত্রিকোণের কিনারা ঘিরে ঘুরছে, ধোঁয়ার দোলায় তার রূপ কুয়াশায় মিশছে, তবু সেই চোখ—যা দু’জোড়া জ্বলন্ত কয়লার মতো—এক মুহূর্তের জন্যও সরছে না গুরু আর নীরজের দিক থেকে।
গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তীর কণ্ঠ এবার যেন নিজেই নিজের ভরসা হারিয়ে ফেলল; তার কপালে ঘাম জমে বিন্দু বিন্দু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে, ঠোঁটের কোণে ফিসফিস করে উচ্চারিত মন্ত্রের শব্দগুলো টুটে যাচ্ছে, আর সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে এক নিঃশব্দ অনুতাপ। এত বছরের সাধনা, এত বছরের প্রতীক্ষা, তন্ত্রশাস্ত্রের পাতা ওল্টানো রাতগুলো, শ্মশানজীবনের একাকীত্ব—সব মিলিয়ে যে শক্তিকে আহ্বান করেছিলেন, সেই শক্তিই আজ তার কাছে দাম চাইছে, আর সেই দাম কেবল কিছু পুঁতির মালা বা রক্তাক্ত কাপড় নয়; বরং তার আত্মা, তার চরম ভয়, এমনকি হয়তো তার শিষ্যের প্রাণ। নীরজের মনে অজানা শীত বয়ে গেল; অগ্নিকণার সেই দাবি তাকে স্পষ্ট করে শোনাল: “তোমাদের একজনের আত্মা, অথবা দু’জনের তন্দ্রা ভাঙবে না কখনো…” সেই শব্দ যেন শ্মশানের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, আর সেই প্রতিধ্বনি শুধু কান নয়, হাড়ের ভেতর পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠল। গুরুর চোখের কোণে তখন ভয়ের ছায়া, তবু সেই ভয়ের আড়ালে লুকানো ছিল এক মুহূর্তের স্বার্থপরতা—যা নীরজ স্পষ্ট দেখতে পেল।
নীরজ জানত, সেই স্বার্থপরতা আসলে মানুষেরই; সেই মানুষ, যে সমস্ত জীবনের সাধনা বিসর্জন দিয়েছে শক্তির জন্য, সে শেষ মুহূর্তে নিজের প্রাণ রক্ষায় শিষ্যকেও উৎসর্গ করতে দ্বিধা করবে না। অগ্নিকণার ছায়া তখন যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ ভেঙে আরও কাছে এলো, আর সেই আগুনের চোখে প্রতিফলিত হলো গুরুর মুখ—ভয়ে কুঁচকে যাওয়া, তবু তাতে লোভ আর বাঁচার মরিয়া আকুতি। বাতাস তখন যেন পুরু হয়ে গেল, শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে গেল, আর সেই ভারী বাতাসের মধ্যে গুরুর ঠোঁট কাঁপল; উচ্চারণ করল এক ভগ্ন মন্ত্র, যা আর কোনো অর্থ বহন করে না, কেবল অনুতাপ আর অন্ধ আতঙ্কের ভাষা। অগ্নিকণার চোখ তখন নীরজের দিকে ফিরল—সেই দৃষ্টিতে ছিল না রাগ, বরং এক নিঃসঙ্গ শক্তির নীরব দাবি, যা বলল: “তোমরা ডেকেছ, তোমরাই দেবে মূল্য।” সেই দাবি শ্মশানের অন্ধকারে প্রতিধ্বনি হয়ে গিয়ে ফিরে এলো, আর সেই প্রতিধ্বনির ভারে নীরজ টের পেল, রাতের সমস্ত শব্দ থেমে গেছে—শুধু আছে ফিসফিসানি, আর সেই ফিসফিসানি একটিই কথা বলে: “মূল্য দাও… মূল্য দাও…”
–
শ্মশানের বাতাস তখন কেবল ঠান্ডা নয়, যেন ধারালো হয়ে নীরজের ত্বক কেটে যাচ্ছিল; প্রতিটি নিশ্বাস যেন আগুনের মতো দগ্ধ করছে ফুসফুসকে। অগ্নিকণার চোখ তখন আগের চেয়েও তীব্র লাল আভায় জ্বলছিল, সেই আলোতে গুরুর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—এক অভিজ্ঞ তান্ত্রিকের নয়, বরং এক ভীত, ক্লান্ত মানুষের, যে নিজের ডাকা শক্তির ওজন আর নিজেকেই টানছে গহ্বরের কিনারায়। বাতাসে শোনা গেল সেই ভেতর থেকে ওঠা ফিসফিসানি—যা কানে নয়, বরং নীরজের রক্তে, হাড়ে গিয়ে আঘাত করল: “মূল্য দাও… রক্ত দাও… আত্মা দাও…” সেই স্বর ছিল একইসাথে শান্ত আর ভয়াবহ, যেন সে জানে এই দাবি অমান্য করা তাদের সাধ্যের বাইরে। যন্ত্রমণ্ডলের ত্রিকোণ তখন অদ্ভুতভাবে জ্বলছিল; প্রতিটি আঁকা রেখা যেন লালচে আলো ছড়াচ্ছিল, আর সেই আলোতে নীরজ স্পষ্ট দেখতে পেল অগ্নিকণার ছায়া ত্রিকোণের মধ্যে দিয়ে গুরুর দিকে এগিয়ে আসছে। গুরুর ঠোঁট কাঁপছিল, চোখের পাতা থরথর করে উঠছিল; তবু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যা আতঙ্কের চূড়ান্ত প্রকাশ।
গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তীর কণ্ঠ হঠাৎই ভেঙে বেরোল, ভগ্নস্বরে বললেন, “আমরা… আমরা তো তোর ডাক শুনেছি… তোর জন্য রক্ত দেব… কিন্তু…” সেই ‘কিন্তু’ শব্দটিই বাতাসে ঝুলে রইল, আর অগ্নিকণার চোখ তখন যেন আরও কাছ থেকে তাকাল, সেই দৃষ্টি গুরুর আত্মাকে বিদ্ধ করল। শ্মশানের ছাই, পুড়ে যাওয়া কাঠ আর ধাতুর গন্ধ মিলে বাতাসকে ভারী করে তুলল; সেই গন্ধের মধ্যে স্পষ্ট শোনা গেল আরেকটি ফিসফিসানি—“তোমরা কি নিজের রক্ত দিতে পারবে? আত্মীয়ের রক্ত? শিষ্যের রক্ত?” সেই কথাগুলি শুনেই গুরুর চোখের ভেতর দিয়ে আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল, নীরজ তা স্পষ্ট দেখল। একপাশে ছিল গুরুর বছরের পর বছরের সাধনা, ক্ষমতা পাওয়ার লোভ, আর অন্যপাশে সেই লোভকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শিষ্যের রক্ত উৎসর্গ করার চিন্তা। সেই মুহূর্তে নীরজ বুঝতে পারল, গুরুর মনে দ্বন্দ্ব নয়, বরং এক প্রকারের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে; গুরুর ঠোঁট কেঁপে উঠল, হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ হলো, আর সেই মুষ্টিতে লুকানো ছিল বছরের পর বছর লালিত লালসা আর ভয়ের অন্ধকার।
নীরজের বুকের ভেতর তখন কেবল আতঙ্ক নয়, এক অদ্ভুত রকমের শূন্যতাও ভর করল; মনে হলো, এটাই তো শিখিয়েছিলেন গুরু—যে শক্তিকে ডাকবে, তাকে রক্ত দিতে হবে, প্রাণ দিতে হবে, আর সেই প্রাণ নিজের না হলে শিষ্যের রক্তও চলবে। শ্মশানের বাতাস হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল; সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে নীরজ স্পষ্ট শুনল নিজের হৃদয়ের ধকধকানি, আর সেই শব্দকেই ঢেকে দিল অগ্নিকণার ফিসফিসানি—“তোমাদের মধ্যে একজনের রক্ত চাই… এখনই… এই ত্রিকোণের ভেতর…” সেই দাবি বাতাসে মিলিয়ে গেল, অথচ শ্মশানের প্রতিটি ছায়া যেন সেই একই কথা বারবার বলছে। গুরুর চোখে তখন ভয়ের পাশাপাশি জ্বলছিল এক অদ্ভুত রকমের দৃষ্টিও—যা শিষ্যকে উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। অগ্নিকণার সেই রক্তের শর্ত শুনে নীরজের হৃদয়ের মধ্যে দুঃস্বপ্নের দরজা খুলে গেল, আর সেই দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে শুধু অন্ধকার, যার শেষ নেই, আর আলো কখনো পৌঁছায় না।
–
শ্মশানের বাতাস তখন নিঃশব্দ, তবু সেই নীরবতার গভীরে ফিসফিস করে ঘুরছে অগ্নিকণার দাবি—যা একবার শুনলে আর মন থেকে মুছতে পারে না কেউ। “তোমাদের মধ্যে একজনের রক্ত দাও… এখনই… ত্রিকোণের ভেতর…” সেই ফিসফিসানি বাতাস নয়, বরং নীরজের হাড়ের ভেতরে, রক্তের ভেতরে গিয়ে চেপে বসে, এমনভাবে যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। অগ্নিকণার ছায়া তখন আর নিছক কুয়াশার মতো নয়; বরং ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, যেন মানুষের মতো মাথা, হাত আর চোখের আকার নিচ্ছে, আর সেই আগুনের চোখে জ্বলছে অমোঘ দাবি। গুরুর চোখে তখন ভয়ের পাশাপাশি কুৎসিত এক আশা—যা শিষ্যকেও বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। নীরজের বুকের ভেতর শ্বাস আটকে এলো; হঠাৎ অনুভব করল, গুরু তাকে আর শিষ্য হিসেবে দেখছেন না, বরং সেই ত্যাগের পাত্র হিসেবে দেখছেন, যে রক্ত দিলে তান্ত্রিক সাধনা পূর্ণ হবে। শ্মশানের অন্ধকার আর ধোঁয়া তখন অগ্নিকণার ছায়ার সঙ্গে মিশে এক জীবন্ত দানবে রূপ নিল, যা ধীরে ধীরে গুরুর কাঁধ ছুঁয়ে ত্রিকোণের কাছে ফিরল, আর সেই ত্রিকোণ তখন যেন পিপাসার্তের মতো কাঁপছে, শুধু রক্তের জন্য।
নীরজের মনে ভেসে উঠল গুরুর কাছে আসার প্রথম দিন; এক অবলম্বন খুঁজে পেয়েছিল সে, যে তাকে এই অন্ধকার থেকে রক্ষা করবে। অথচ আজ সেই মানুষই অন্ধকারকে তৃপ্ত করার জন্য তাকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। গুরুর ঠোঁট কাঁপল, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো, আর মন্ত্রের ভগ্নাংশের ফাঁকে শোনা গেল চাপা স্বর—“তুই… তুই যদি এবার তোর রক্ত দিতে পারিস… তাহলে…” বাক্য শেষ করলেন না, কিন্তু চোখের ভাষা বলে দিল, তিনি চান নীরজ নিজের ইচ্ছায় রক্ত দিক, যাতে সেই পাপের ভাগ তাকে নিতে না হয়। নীরজের হাতের আঙুল ঠান্ডা হয়ে এলো, মনে হলো রক্ত জমে যাচ্ছে; অথচ বুকের ভেতর এক অদ্ভুত স্পর্ধা আর ক্ষোভ জেগে উঠল—যে মানুষ তাকে শিখিয়েছেন, তাকে ভালোবেসেছেন, সেই তিনিই নিজের বাঁচার জন্য এই বলি চান। অগ্নিকণার চোখ তখন দু’জনের মাঝখান থেকে তাকিয়ে দেখছিল; সেই দৃষ্টিতে কোনো আবেগ নেই, কেবল ঠান্ডা, শিকারির মতো ধৈর্য, আর অদৃশ্য শিকলের মতো শক্ত দাবি—“রক্ত চাই… বলি চাই…”
গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তীর কণ্ঠ এবার ভেঙে এলো, ভয়ে না প্রার্থনায় বোঝা গেল না—“আমার সাধনা পূর্ণ হবে… ওরে নীরজ, এই একবার, এই এক ফোঁটা রক্ত…” সেই স্বর শ্মশানের বাতাসে মিলিয়ে গেল, অথচ প্রতিধ্বনিতে ফিরে এল আরেকটু বিকৃত হয়ে। নীরজের চোখে অন্ধকার নাচল, গলার কাছে ধাতুর মতো স্বাদ টের পেল, আর বুকের ভেতর সেই প্রতিধ্বনির মধ্যে স্পষ্ট শুনল অগ্নিকণার চূড়ান্ত দাবি—“বলিই দিতে হবে… নয়তো তোমরা কেউ ফিরতে পারবে না…” সেই শর্তের ওজন বুঝে গুরুর চোখে তীব্র ভয় আর লালসা একসাথে ফেটে পড়ল; ঠোঁট কেঁপে উঠল, হাত নীরজের দিকে বাড়ল, আর শ্মশানের নিস্তব্ধতার মধ্যে অগ্নিকণার ছায়া দু’জনের মাঝখানে রক্তের আয়োজনের জন্য ধোঁয়ার আঙুল তুলল। সেই মুহূর্তে নীরজ টের পেল, রাতের আঁধারে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, আর ত্রিকোণের পিপাসার্ত রেখাগুলি কেবল রক্ত, আর কিছুই চায় না—আর সে, নীরজ, হয়তো সেই রক্ত দিতে বাধ্য হবে।
–
শ্মশানের রাত তখন আর নিছক অন্ধকার নয়, যেন এক জীবন্ত দানব, যার প্রতিটি নিশ্বাসই ভারী আর ধোঁয়ায় ভরা, আর সেই নিশ্বাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর পূর্বাভাস। অগ্নিকণার ছায়া তখন আরও গাঢ় হয়ে ত্রিকোণের চারপাশে পাক খেতে খেতে উঠে এলো; সেই ছায়ার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এল আগুনের মতো দুটি চোখ, যা সরাসরি গুরুর দিকে তাকাল—আর সেই দৃষ্টিতে স্পষ্ট ছিল ধৈর্য হারানোর হুঁশিয়ারি। গুরু শ্রীপাদ চক্রবর্তী তখন আর নিজের মতো করে মন্ত্রপাঠ করতে পারছিলেন না; তার কণ্ঠস্বর ভাঙা, শ্বাস অনিয়মিত, আর চোখের ভেতর থেকে ভয়ের রঙ যেন রক্তের মতো গড়িয়ে পড়ছিল। হাতের আঙুল বারবার নীরজের দিকে উঠছে, আবার নামছে; সেই দ্বন্দ্ব, সেই শেষ মুহূর্তের মানুষী লোভ আর ভয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নীরজ স্পষ্ট দেখতে পেল গুরুর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অজানা শব্দ বেরোচ্ছে—না মন্ত্র, না প্রার্থনা—বরং এক ধরণের প্রলাপ, যেখানে গুরুর নিজের চাওয়া, ভয় আর মৃত্যুর আতঙ্ক গুলিয়ে গেছে। সেই প্রলাপের মধ্যেই অগ্নিকণার ছায়া এক ঝটকায় গুরুর দিকে এগিয়ে এলো, আর শ্মশানের বাতাসে শোনা গেল সেই আগুনের চোখের গর্জন—“রক্ত দাও… এখনই… শেষ রাত্রি…”
নীরজের পায়ের তলা যেন এক পলকে হাওয়ায় ভেসে গেল; চোখের সামনে ভেসে উঠল শৈশবের স্মৃতি, সেই রাতের শ্মশান, মায়ের চোখের জল, আর সেই বিশ্বাস—যা সে গুরুর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল। অথচ আজ সেই মানুষ, যিনি তাকে হাত ধরে অন্ধকারের পথ দেখিয়েছিলেন, তিনিই এখন নিজের জীবনের জন্য শিষ্যের জীবন দিতে চাইছেন। গুরুর হাত বাড়িয়ে এলো, আর তাতে নীরজ স্পষ্ট দেখল—সেই হাত কাঁপছে, শুধু ভয়ে নয়, বরং ত্যাগের প্রস্তুতিতে। গুরুর কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, “নীরজ… শুধু এক ফোঁটা… আমাদের বাঁচার জন্য…” সেই অনুনয় শ্মশানের নিস্তব্ধতায় মিলিয়ে গেল, অথচ তাতে লুকানো ছিল এক নিষ্ঠুর সত্য—যদি নীরজ নিজে না দেয়, গুরু হয়তো নিজেই বলি নেবে। অগ্নিকণার ছায়া তখন ত্রিকোণের ভেতর থেকে হাতের মতো কিছু বাড়িয়ে দিল; সেই অদৃশ্য হাতের স্পর্শে বাতাস আরও ভারী হয়ে এলো, আর নীরজ টের পেল, হৃদয়ের ভেতর থেকে রক্ত যেন টেনে নেওয়া হচ্ছে। সেই স্পর্শ শুধু শীতল নয়, বরং এমন এক আতঙ্কে ভরা, যা জীবনের ইচ্ছাকে পর্যন্ত স্তব্ধ করে দিতে পারে।
শেষ মুহূর্তে গুরুর চোখে ভয়ের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হলো লোভের আগুন—যা বলি চায়, শক্তি চায়, এমনকি নিজের শিষ্যের প্রাণ দিয়ে হলেও। অগ্নিকণার দাবির ওজন যেন চারপাশের ধুলো, ছাই, বাতাস—সবকিছুকে চেপে ধরল। হঠাৎই গুরুর কণ্ঠ ভেঙে উঠল, এক হাত দিয়ে নীরজের কব্জি চেপে ধরলেন, আর সেই চোখে নীরজ দেখল অন্ধকারের শেষ চিহ্ন—যেখানে প্রেম নেই, কেবল ক্ষমতার জন্য মরিয়া আত্মার চাহিদা আছে। ছায়া তখন নীরজের গায়ে লেগে গেল; এক শীতলতা গিয়ে ঠেকল তার হাড়ের গভীরে, আর সেই শীতলতার মধ্যে টের পেল রক্তের স্রোত, যা ত্রিকোণের পিপাসা মেটাতে ধীরে ধীরে ঝরছে। শ্মশানের রাত নিঃশব্দ, শুধু অগ্নিকণার চোখের আলো আর ত্রিকোণের তীব্র আলো নীরজের রক্তে প্রতিফলিত হলো। সেই আলোয় সবকিছু মিলিয়ে গেল—গুরু, শিষ্য, তন্ত্রসাধনা, সবই। রক্তের শেষ রাত্রিতে নীরজ টের পেল, এই অন্ধকারের শুরু যেমন ছিল এক আহ্বান, তেমনি এর শেষ এক রক্তাক্ত আত্মসমর্পণ, যার পর আর ভোর আসে না—শুধু থাকে ছায়া, অভিশাপ আর নিস্তব্ধ অন্ধকার।
***