অভিষেক ভট্টাচার্য
পর্ব ১: কোণের ঘরে এক পুরনো নথি
শোভন রায়, কলকাতার এক উঠতি ইতিহাসবিদ, চাকরি করেন একটি নামী গবেষণা সংস্থায়। চৈতন্যদেবের জীবনের ওপর একটি নতুন ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে তাকে পাঠানো হয় পুরী। উদ্দেশ্য—চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের শেষ দিনগুলির ওপর তথ্য সংগ্রহ এবং তার মৃত্যু সম্পর্কে প্রামাণ্য প্রমাণ খোঁজা। যদিও ইতিহাস বলে, ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে একরাত্রে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে কীর্তন করার সময় হঠাৎই অন্তর্ধান হয়ে যান তিনি—কেউ বলেন তিনি সমাধিস্থ হন, কেউ বলেন তিনি গিয়েছিলেন সমুদ্রপথে। কোনো স্পষ্ট সমাধান নেই।
শোভনের আগ্রহ ইতিহাসের চেয়েও বেশি কৌতূহলের। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রতিটি অন্তর্ধান কিংবা মৃত্যু রহস্যের অন্তরালে থাকে বাস্তব। আর বাস্তব যত গোপন থাকে, ততই বেশি চঞ্চল করে একজন গবেষককে।
পুরী পৌঁছানোর তিনদিন পর, তিনি স্থানীয় রাজগ্রন্থাগারে প্রবেশ করেন। গ্রন্থাগারিক মিশ্রজী প্রথমে অনীহা দেখালেও, যখন শোভন তার পরিচয়পত্র ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন, তখন একটি কোণের ঘরের চাবি হাতে তুলে দেন। “এই ঘরটা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না,” বললেন তিনি। “কিন্তু একসময় রাজ পরিবারের পুরোনো চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ এইখানেই রাখা হতো। সাবধানে দেখতে হবে, কারণ অনেক কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে।”
ঘরটিতে ঢুকতেই শোভনের মনে হল যেন কেউ দীর্ঘদিন ধরে তার অপেক্ষায় ছিল এই নীরব কক্ষ। ধুলোময় তাক, ছেঁড়া কাগজ, পুরোনো পুঁথির গন্ধ—সব কিছু মিলে যেন একটা নিঃশব্দ সময়ের দরজা খুলে গেল।
ঘণ্টাখানেক ধরে পর্যালোচনার পর তিনি দেখতে পান এক পাতলা, চর্মবন্ধ পাণ্ডুলিপি—চৈতন্যদেবের সমসাময়িক এক মন্দির পুরোহিতের হাতে লেখা বলে অনুমান করা যায়। লেখাটি সংস্কৃত মিশ্রিত ওড়িয়া ভাষায়। শোভনের সৌভাগ্য, এই দুই ভাষায়ই তার দক্ষতা রয়েছে। পৃষ্ঠার একাংশে লেখা:
“আজ রাত্রি ত্রয়োদশীর পূর্ণিমা। প্রভু নীলাচলে অবস্থান করছেন, কিন্তু সন্ধ্যার পর তাঁকে মন্দির চত্বরের দক্ষিণ দ্বারে এক অচেনা পরিধানে দেখা যায়… তিনি একা ছিলেন না।”
শোভনের হাত কেঁপে ওঠে। ইতিহাস বলে, সেই রাতেই অন্তর্ধান ঘটেছিল মহাপ্রভুর। তবে কার সঙ্গে ছিলেন তিনি? এই তথ্য তো কোথাও নেই!
সে রাতেই হোটেলে ফিরে এসে শোভন সেই পাণ্ডুলিপির অনুবাদ শুরু করে। প্রতিটি শব্দ যেন খুলে দেয় এক এক রহস্যের দ্বার। পরের লাইনেই ছিল একটি চমকপ্রদ তথ্য—”তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যক্তি ছিলেন এক রাজপুরুষ, মুখে কাপড় ঢাকা, কণ্ঠে ছিল বেদপাঠের সুর, কিন্তু চলনে ছিল দুর্বোধ্যতা।”
পরদিন সকালে শোভন ফের যোগাযোগ করেন পুরীর ইতিহাস গবেষক প্রণবনন্দন মিশ্রের সঙ্গে। প্রণববাবু বয়সে প্রবীণ, বহুদিন ধরেই কাজ করছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে। শোভনের এই নতুন আবিষ্কারে তিনি চমকে ওঠেন। “তুমি নিশ্চিত এই পাণ্ডুলিপিটা সেই সময়কার?” জিজ্ঞেস করেন তিনি।
“হ্যাঁ, কাগজের ধরন, হস্তাক্ষর, ও ভাষার গঠন মিলিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত।”
প্রণববাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “তবে একটা কথা মনে রেখো, পুরীর রাজপরিবার সবসময় চেয়েছে চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানকে অলৌকিক করে রাখতে। কারণ সেটা ঈশ্বরতুল্য মহিমাকে জিইয়ে রাখে। যদি তুমি প্রমাণ করে দাও তার মৃত্যু ছিল পরিকল্পিত—তবে শুধু ইতিহাস নয়, ধর্মীয় ভাবাবেগেও আঘাত লাগবে।”
শোভন ধীরে বলেন, “আমার উদ্দেশ্য আঘাত নয়, সত্য উদঘাটন।”
সেদিন সন্ধ্যায় শোভন আবার সেই কোণের ঘরে ফিরে যান। আরও কিছু কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে পান একটি ধূসর খামে রাখা, সাদা চামড়ার ফাইলে মোড়া দলিল—তাতে লেখা ছিল “গুপ্তবিবরণ, আচার্য রঘুনাথ দাস গোস্বামীর নিকট হস্তান্তরিত”।
রঘুনাথ দাস ছিলেন চৈতন্যদেবের ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের একজন। যদি তিনি এই দলিল হস্তগত করেই থাকেন, তবে এর মধ্যে এমন কিছু থাকতে পারে যা বহুদিন ধরে চাপা পড়ে আছে। ফাইলটি খুলতেই বেরিয়ে আসে আরেকটি চিঠি—এইবারে তা বাংলা ভাষায়, পুরোনো ছন্দে লেখা:
“তাঁহার সেই রাত্রির শ্বাস ছিল ভারী।
বলিলেন, ‘জগন্নাথেরও লুকায়ে আছে দারি।’
কেবল আমায় বলিলেন, করো সংরক্ষণ,
আমি যাব ইহলোক হইতে অদৃশ্যরণ।”
চিঠিটির নিচে লেখা—“রঘুনাথ”।
শোভনের শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। ইতিহাসে কোথাও এই বক্তব্য নেই। চৈতন্য নিজে যদি বুঝতেন তাঁর অন্তর্ধান আসন্ন, তাহলে কেন তা আগে থেকে জানানো হয়নি? অথবা, তিনি নিজেই কি কোথাও চলে গিয়েছিলেন? নাকি কেউ তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিল?
হোটেলে ফিরে এসে শোভন সিদ্ধান্ত নেন—এবার তাঁকে যেতে হবে গম্ভীরা ঘরে। সেই ঘর যেখানে শেষ জীবনের সময়টি কাটিয়েছিলেন চৈতন্যদেব। যদিও সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ সেখানে নিষেধ, তবে প্রণববাবুর সহায়তায় হয়তো একবার সে সুযোগ মিলতে পারে।
পরদিন, গম্ভীরা ঘরের দ্বারে দাঁড়িয়ে শোভনের মনে হয়—এই ঘরটাই হয়তো জানে, সেই রাতে কী ঘটেছিল। কিন্তু ঘর তো কথা বলে না। তাই শোভনকে কথা বলাতে হবে ইতিহাসকেই।
পর্ব ২: গম্ভীরা ঘরের কড়চা
গম্ভীরা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শোভন মনে মনে গুনছিলেন—এটা সেই জায়গা, যেখানে চৈতন্য মহাপ্রভু জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। ছোট্ট একটি কক্ষ, উত্তর-পূর্ব কোণে পুরী মন্দিরের প্রাচীন অংশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই ঘরটিতে আজও রক্ষিত আছে তাঁর ব্যবহৃত কাঠের খাট, একটি কাঁসার লৌটা, কিছু পোড়ামাটির প্রদীপ। মন্দির কর্তৃপক্ষ ঘরের প্রবেশাধিকার কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখে।
তবে প্রণববাবুর সুপারিশে মন্দিরের পুরোহিতরা এক ঘণ্টার অনুমতি দেন। শোভনের সঙ্গে যায় পুরীর এক তরুণ গবেষক—বিশ্বজিত পাল, স্থানীয় ইতিহাসে পারদর্শী এবং সাহসী। “এই ঘরের দেয়ালে দেওয়াল আছে না,” বিশ্বজিত হেসে বলেছিল, “এখানে শব্দ রয়ে গেছে, সময় হারিয়ে গেছে।”
ঘরের ভেতরে পা দিতেই শোভন এক অদ্ভুত ভার অনুভব করলেন। যেন বাতাসে জমে আছে কোনো অপূর্ণতা। কাঠের খাটের ওপর জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ যেন অপেক্ষা করছিল নতুন করে কাউকে শোনাতে, সেই রাতের এক একটি অনুচ্চারিত মুহূর্ত।
তিনি মোবাইলের আলো দিয়ে ঘরের বিভিন্ন কোণে দেখতে শুরু করলেন। দেয়ালের এক অংশে খয়েরি রঙের ছোপ, মাটির তলায় কিছু চিহ্ন। বিশ্বজিত বলল, “লোকমুখে শোনা যায়, সেই রাতে প্রভু একা ছিলেন না। কেউ এসেছিল। তবে কেউই নাম বলে না—শুধু বলে, ‘তাঁর ছায়া ছিল দীর্ঘ, কিন্তু মুখ ছিল ঢাকা।’”
শোভনের মনে পড়ে গেল পাণ্ডুলিপির সেই অংশ—”মুখে কাপড় ঢাকা রাজপুরুষ”। তাহলে কি সেই সাক্ষী সত্যিই ছিল? যদি কেউ এসেছিল, তার পায়ের ছাপ বা কিছু চিহ্ন কি এখনো এই ঘরে লুকিয়ে আছে?
হঠাৎ বিশ্বজিত মাটি খুঁটে কিছু একটা তুলল। একটি ধাতব রিং, যেন কোনো পুরনো বাক্সের হ্যান্ডেল। মাটি সরিয়ে দেখা গেল একটা কাঠের খোলা, যা অনেক বছর ধরে মাটির নিচে লুকিয়ে ছিল। শোভনের হাত কাঁপতে শুরু করল। তারা দুজনে মিলে বাক্সটি টেনে বার করল।
বাক্সটি খোলার পর ভেতরে পাওয়া গেল তিনটি জিনিস—একটা নীল কাপড়ের পুঁটলি, একটি মাটির প্রদীপ, আর একটি খণ্ডিত তালপাতার পুঁথি।
শোভন ধীরে কাপড়ের পুঁটলি খুললেন। ভিতরে আছে একটি রুদ্রাক্ষ মালা, কিছু খয়েরি রঙের চূর্ণ (সম্ভবত বটপাতা গুঁড়ো) এবং একটি সিলমোহর দেওয়া কাগজ। চৈতন্যদেব নিজে চিঠি লিখতেন না বলে জানা যায়, কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য ও চিন্তাধারা তিনি তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করাতেন।
তালপাতার পুঁথিতে লেখা:
“আজ রাত্রে আসিবে তিনি, যাঁকে আমি প্রভু বলে স্বীকার করি না।
তিনি আসিবেন রাজদ্বার হইতে, শাস্ত্রের ব্যাখ্যা নয়, রক্ত চাইবে।
আমি প্রস্তুত, শরীর নয়, আত্মাই রাখিব মুক্ত।
যদি আমি নাহি ফিরি, তবে রঘুনাথ জানিবে কে ছিল সত্যিকার প্রভু।”
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল শোভনের। একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যদি এমন কথা বলে যান, তাহলে পরিস্থিতি কতটা সংকটজনক ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। কে ছিল সেই “তিনি”? রক্ত চাইবে—মানে কি হত্যার আশঙ্কা? তাহলে কি চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান আদতে ছিল একটি হত্যাকাণ্ড?
বিশ্বজিত ধীরে বলল, “এই অংশটা হয়তো কেউই বিশ্বাস করতে চাইবে না। কেউই চাইবে না যে, প্রভুর অন্তর্ধানকে এক ষড়যন্ত্র বলে ধরে নেওয়া হোক। কিন্তু সত্য চাপা রাখা যায় না। আজ না হয় কাল, উঠে আসবেই।”
প্রদীপটা যখন জ্বালাতে গেল, তার নিচে দেখা গেল খোদাই করা একটি নাম—“জগদীশ রাউত”। শোভন দ্রুত তার ডায়েরিতে নামটা লিখে রাখলেন।
পুরী শহরের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৩৩ সালে রাজ্য প্রশাসনের সহকারী ছিল একজন ব্রাহ্মণ named জগদীশ রাউত, যিনি একসময় চৈতন্যদেবের ভাবধারায় ভীষণ আকৃষ্ট হয়েছিলেন, পরে মতভেদে সরে দাঁড়ান। কেউ কেউ বলেন তিনি পরবর্তীকালে গোপনে রাজপরিবারের হয়ে কাজ করতেন।
এই নতুন সূত্র পেয়ে শোভন আর বিশ্বজিত দ্রুত ফিরে যান পুরনো রেকর্ড অফিসে। সেখানে রাজকর্মচারীদের নথিপত্রে সন্ধান করতে করতে পেয়ে যান একটি বিরল দলিল—“প্রবেশ-নিবন্ধন পুস্তিকা”। এতে এক জায়গায় লেখা—
“ত্রয়োদশীর রজনীতে রাজপরিবারের প্রাচীন হোমঘরে গমন করেন জগদীশ রাউত, প্রভু চৈতন্যদেবের সাক্ষাৎ পাইবার পূর্বে।”
এই নথি প্রমাণ করে, অন্তত সেই রাতে রাজ পরিবারের একজন প্রতিনিধি চৈতন্যদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তার মানে, অলৌকিক অন্তর্ধানের পেছনে কোনো না কোনো মানবিক হস্তক্ষেপ ছিলই।
শোভনের মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—চৈতন্যদেব কি জানতেন যে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে? তাহলে তিনি কেন পালিয়ে যাননি? নাকি তিনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন এক অলৌকিক অপসারণের পথ, যাতে তাঁর ভাবমূর্তি চিরকাল অম্লান থাকে?
এর উত্তর হয়তো রয়েছে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর কোনো রোজনামচায়। তিনি জীবিত ছিলেন প্রভুর মৃত্যুর অনেক পর পর্যন্ত এবং রেখেছিলেন বহু লেখাজোখা।
বিশ্বজিত বলল, “নবদ্বীপে তাঁর একমাত্র বংশধরের পরিবারের কাছে কিছু লেখা আছে বলে শুনেছি। চাইলে আমি যোগাযোগ করতে পারি।”
শোভন হালকা মাথা নাড়লেন। “আমাদের যেতে হবে নবদ্বীপ। এই সত্যর খোঁজ এখন শুধু ইতিহাসের নয়, এটা এক দায়িত্ব।”
সেই রাতে শোভন বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরীর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাতাসে ভাসছিল শঙ্খধ্বনি, জগন্নাথ মন্দিরের পঁচিশটা ঘণ্টার শব্দ, আর এক গোপন বিষাদের ছায়া।
চৈতন্যদেব যদি সত্যিই আত্মত্যাগ করে গিয়েও থাকেন, তবে তা কী কারণে? কাদের আড়াল করতে গিয়ে? আর তাঁর মৃত্যুর পরে কি কেউ সেই সত্যকে চিরতরে চাপা দিতে চেয়েছিল?
এই প্রশ্নগুলো নিয়েই শোভন আর বিশ্বজিত যাত্রা শুরু করবেন নবদ্বীপে—সেই জায়গায়, যেখানে একসময় ‘নিমাই পণ্ডিত’ নামের এক মানব, এক মহামানব হয়ে উঠেছিলেন।
পর্ব ৪: গুপ্তেশ্বর গুহার ছায়া
কটক থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুপ্তেশ্বর গ্রামের নাম যদিও এখনো সরকারি মানচিত্রে অস্পষ্টভাবে চিহ্নিত, কিন্তু স্থানীয়দের মধ্যে এর পরিচিতি রয়েছে ‘বুজে না যায় এমন গাঁ’ নামে। পাহাড়, ঘন বন, এবং সংকীর্ণ কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে শোভন ও বিশ্বজিত পৌঁছল সেই গ্রামে। সময় তখন বিকেল পাঁচটা, সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ঢলে পড়েছে, আর গ্রামের ঘাসফড়িংয়ের ডাক এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
একজন বয়স্ক গ্রামবাসী, যিনি নিজেকে দয়ানাথ বলে পরিচয় দিলেন, বললেন, “তোমরা শহর থেকে এসেছ শুনে ভাবলাম আবার কেউ ট্যুরিস্ট হবে, কিন্তু তোমাদের চোখে তো অন্য আগুন দেখছি।”
শোভন বলল, “আমরা চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তিম সময়ের সন্ধান করছি। শুনেছি এখানে এক গুহায় তিনি এসেছিলেন।”
দয়ানাথ দীর্ঘ সময় চুপ করে থাকলেন। তারপর বলেন, “আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা বলতেন—এই গাঁয়ে একদিন এক মহাজ্ঞানী সাধু এসেছিলেন। তিনি কারো নাম বলেননি, কিন্তু তাঁর চোখ এমন ছিল, যেন কারো দিকে তাকালেই লোক চুপ হয়ে যেত। তিনি পাঁচ মাস এই গ্রামে ছিলেন। তারপর একরাতে গুহার ভিতরে গিয়েছিলেন—আর ফেরেননি।”
বিশ্বজিত উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করে, “এই গুহাটা কি এখনো আছে?”
দয়ানাথ মাথা নাড়লেন। “আছে, তবে সেখানে কেউ যায় না। কারণ, যারা গিয়েছিল, তারা ফিরে আসেনি—অন্তত সেই রাতেই নয়। গুহাটার ভেতরে কিছু একটা আছে, কেউ বলে আত্মার ছায়া, কেউ বলে কালের খাতা।”
সেই কথার মধ্যেই তাদের সঙ্গে যোগ দেন গ্রামের এক যুবক—ভবেশ। সে স্থানীয় বনবিভাগে অস্থায়ী কাজ করে, পাহাড়ের প্রতিটি গলি গাছ তার চেনা। ভবেশ রাজি হয় তাদের গাইড হতে।
তিনজন পরদিন ভোরে রওনা দেয় পাহাড়ের দিকে। পথটা কষ্টকর, পাথুরে মাটি আর খাড়া চড়াইয়ে ভরা। কিন্তু শোভনের পায়ের তলায় যেন আগুন। তার মনে হচ্ছে, বহু বছর ধরে যে সত্য চাপা পড়ে ছিল, আজ হয়তো সেই মুখ খুলবে।
দু’ঘণ্টার পর তারা এক গুহার সামনে পৌঁছে যায়। মুখটা বেশ সংকীর্ণ, কিন্তু ভেতরে ঢোকার রাস্তা পরিষ্কার—কেউ যেন সচেতনভাবে এপথটি কিছুদিন অন্তর পরিষ্কার রাখে।
ভবেশ বলে, “এই গুহাটাই। আমরা এদিকে কেউ আসি না, কিন্তু কিছু কিছু রাত্তিরে আলো দেখা যায় গুহার ভিতর থেকে—অদ্ভুত সোনালি আলো।”
শোভনের মনে পড়ে যায় রঘুনাথ গোস্বামীর লেখা সেই শ্লোক:
“আলোক যেখানে অদেখা সত্য,
সেখানে ছায়াও ধ্বনিময় হয়।”
তারা তিনজন মশাল জ্বালিয়ে গুহায় প্রবেশ করে। প্রথম দশ-পনেরো ফুট গলির মতো সরু পথ, তারপর এক বিস্তৃত খোলা জায়গা, দেয়ালে শ্যাওলা, ভেতরে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ—মাটি আর পুরোনো তেল জ্বালানোর গন্ধ। যেন কেউ এখানে বসবাস করতেন, স্নান করতেন, ধ্যান করতেন।
হঠাৎ এক পাশে তারা দেখে খোদাই করা প্রতিমার মতো কিছু—কিন্তু সেটা দেবতা নয়, বরং একজন বসে থাকা সাধুর রূপ। খালি গায়ে, চোখ বন্ধ, ডান হাতটি উপরে তোলা, আর পায়ের নিচে বসানো রয়েছে একটি তালপাতার পুঁথির প্রতিরূপ। এই খোদাই দেখে শোভনের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
তিনি গুটিগুটি পায়ে প্রতিমার সামনে গিয়ে তাকান। সেখানে এক প্রস্তরফলকে খোদাই করা আছে ছ’টি শব্দ—“নিমাই এক্ষণে মানুষ, ঈশ্বর নয়।”
এই বাক্য যেন শোভনের বুকের মধ্যে ঘুঁষি মারে। চৈতন্যদেব নিজেই কি এখানে এসেছিলেন? এবং নিজেই কি এই সত্য খোদাই করেছিলেন? যদি করেন, তবে কেন?
ভবেশ হঠাৎ গুহার এক কোণে একটা পাথর সরিয়ে কিছু একটা খুঁজে পায়। একটি ছোট বাক্স, কাঠে খোদাই করা ‘ন’ অক্ষর—সম্ভবত নিমাই-এর জন্য। শোভন ধীরে ধীরে বাক্স খুলে দেখেন—ভিতরে আছে একটি তাম্রপত্র। তাম্রপত্রে খোদাই করা আছে এক শ্লোক:
“যারা ঈশ্বরতা খোঁজে, তারা আমাকে পাবে না।
যারা ভালোবাসা খোঁজে, তাদের চোখে আমি ফিরব।
আমার শরীর নয়, আমার বাণী অমর থাকুক।
এবং মৃত্যুর গোপনতা হোক বিশ্বাসের জন্ম।”
বিশ্বজিত নিঃশব্দে বলে, “এটা ওনার উইল, হয়তো?”
শোভনের গলা শুকিয়ে যায়। “হয়তো বা… কিংবা এটাই সেই আলেখ্য, যেটা আমরা যুগ যুগ ধরে ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম।”
ভবেশ বলল, “আপনারা কি এসব প্রকাশ করবেন?”
শোভন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, “আমি ইতিহাস বিকৃতি করব না। আমি যা পেয়েছি, তার সবটা প্রকাশ করব না—কিন্তু একদিন, কোনোভাবে, এ সত্য মানুষের কাছে পৌঁছাবে। তবে তা এমনভাবে, যেন ঈশ্বরতাকে অপমান না করে, বরং মানুষকে আরও কাছের করে তোলে।”
তারা গুহা থেকে বেরিয়ে আসে। রোদ উঠে গেছে। পাহাড়ের গায়ে আলো খেলছে, আর নীচের গ্রাম থেকে ভেসে আসছে মৃদু ঘণ্টাধ্বনি।
সেদিন সন্ধ্যায় শোভন একা বসে ডায়েরিতে লেখেন:
“আজ আমি একটি মানুষকে খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেলাম এক ঈশ্বর, যিনি নিজে থেকে ঈশ্বর হতে চাননি। যে ইতিহাস ঈশ্বরতাকে পাথরে খোদাই করে রেখেছে, সেই ইতিহাস আজ একবার ভাঙল। এবং আমি জানি, সেই ভাঙা অংশটাই একদিন হবে ভবিষ্যতের আলো।”
পর্ব ৫: ইতিহাসের শরীর এবং ছায়া
কলকাতা ফিরে আসার পর প্রথম তিনদিন শোভনের ঘুম হয়নি। যতবার চোখ বন্ধ করেন, গুহার ভিতরে বসে থাকা সেই রহস্যময় প্রতিমা তাঁর চোখে ভেসে ওঠে। গুহার ছায়া যেন তাঁর মনে প্রশ্নের শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে—চৈতন্যদেব যদি নিজেই ঈশ্বরতা অস্বীকার করে মানুষের মুখোশ পরে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন, তাহলে ধর্মের দিকদর্শন কোথায় দাঁড়িয়ে থাকে? বিশ্বাসের কাঠামো কি মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে?
তবে এই সংশয়ই তাঁর গবেষণাকে আরও তীব্র করে তোলে। তাঁর পরিকল্পনা স্পষ্ট—সে এখন এক নতুন বই লিখবে, যার নাম হবে: “শেষ গাম্ভীর্য: অন্তর্ধান ও অন্বেষণ”। বইটি হবে ইতিহাস ও বর্তমান অনুসন্ধানের সমান্তরাল এক ধারায়—কোনো পক্ষপাত, কোনো অলৌকিকতার মোহ নয়। কেবল তথ্য, সাক্ষ্য, দলিল ও অনুভব।
বিশ্বজিত meanwhile পুরীতে থেকে যায়। তার দায়িত্ব হয় স্থানীয় কিছু মানুষ, সেবায়েতদের সঙ্গে কথা বলা এবং পুরীর পুরাতন রাজপরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করা। ইতিহাসের এই বাঁকে দাঁড়িয়ে রাজপরিবারের মতামত ও নীরবতা—দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সত্যের খোঁজ সহজ নয়। তার প্রকাশ আরও কঠিন। কারণ, এক সন্ধ্যায় শোভনের ই-মেইলে আসে একটি অচেনা ঠিকানা থেকে সংক্ষিপ্ত বার্তা—
“চৈতন্য আমাদের ঈশ্বর। তাঁর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে আমাদের বিশ্বাসের অন্ত্যেষ্টি। বন্ধ করুন। না হলে…”
এই ই-মেইল প্রথমে তাকে চমকে দেয় না। সে জানত, এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আসবেই। কিন্তু বার্তার শেষে যে লাইনটা ছিল, সেটাই তাকে কাঁপিয়ে দেয়—
“আপনার গুহার সন্ধানই আপনার পতনের সূত্র হবে।”
শোভন অবাক হয়ে ভাবেন—এই তথ্য তো মাত্র তিনজন জানে: সে নিজে, বিশ্বজিত, এবং ভবেশ। তাহলে কি তাদের মধ্যে কেউ বা কারও আশেপাশে কেউ তথ্য ফাঁস করেছে?
ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন আসে বিশ্বজিতের। গলা অস্থির—“ভাই, একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। আমি পুরীর মন্দির থেকে ফিরছি, দেখি আমার হোটেলের ঘরে কেউ ঢুকেছিল। আমার ল্যাপটপ, সেই পাণ্ডুলিপির স্ক্যান কপি, সব গায়েব। আমি সিকিউরিটি ক্যামেরা খুঁজতে গেছি, দেখি সার্ভার ‘অ্যাকসিডেন্টাল ইরেজ’ হয়েছে। এটা নিছক চুরি নয়—এটা সাফ হুমকি।”
শোভন মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলে, “তাহলে সময় হয়েছে আমাদের সামনের দিকটা আরও সচেতনভাবে সাজানোর।”
এখন তাদের কাছে যেটুকু আছে তা হলো—(১) গম্ভীরা ঘর থেকে পাওয়া পাণ্ডুলিপি, (২) রঘুনাথ দাসের ডায়েরির অনুলিপি (আসলটি সত্যনারায়ণ গোস্বামীর বাড়িতে রয়েছে), এবং (৩) গুপ্তেশ্বর গুহা থেকে পাওয়া তাম্রশ্লোক ও খোদাই।
শোভন সিদ্ধান্ত নেয়—তাকে এগুলো নিয়ে পৌঁছাতে হবে আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে, যেন একমাত্রিক ‘ধার্মিক ইতিহাস’-এর বাইরে গিয়ে প্রমাণ ভিত্তিক গবেষণার জায়গা তৈরি হয়।
কিন্তু আরও কিছু প্রমাণ দরকার—বিশেষত যদি রাজপুরুষ বা রাজপরিবারের কেউ চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানের রচয়িতা হয়ে থাকে, তবে তাদের লেখা বা সাক্ষ্য অন্বেষণ অত্যন্ত প্রয়োজন।
এই মুহূর্তে বিশ্বজিত জানায়, সে একজন অবসরপ্রাপ্ত রাজপরিবারের ইতিহাসরক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে—তাঁর নাম অনন্ত বরাল, বয়স প্রায় নব্বইর কাছাকাছি, কিন্তু স্মৃতি আজও প্রখর। তিনিই দীর্ঘদিন ধরে রাজার পারিবারিক পাণ্ডুলিপি ও ব্যক্তিগত ডায়েরি সংরক্ষণ করতেন।
শোভন দ্বিতীয় দিনেই আবার পুরী ফিরে যায়। এবার তারা দুজন মিলে পৌঁছায় অনন্ত বরালের একসময়ের বাড়ি—এখন একটি ছায়াঘেরা ছোট দালান, দরজার সামনে শালগাছের পাতায় ঢেকে থাকা উঠোন।
অনন্ত বরাল তাঁদের দেখে প্রথমে চমকে যান, তারপর আস্তে বলেন, “তোমরা যদি ইতিহাস খুঁজতে এসো, আমি বলব সসম্মানে ফিরে যাও। তবে যদি সত্যের পিপাসা থাকে, তাহলে শোনো।”
তিনি ভেতরে নিয়ে গিয়ে একটি ছোট বাক্স তুলে দেন শোভনের হাতে। কাঠের বাক্স, উপরে খোদাই করা—“বিশ্রাম”।
ভেতরে একটি রেকর্ডেড অডিও ক্যাসেট ও একটি পাণ্ডুলিপি—পুরাতন ওড়িয়া ভাষায় লেখা। শোভন জিজ্ঞেস করে, “এটা কী?”
অনন্ত বলেন, “এটা এক রাজগুরু রচিত কাহিনি। তাঁর নাম লেখেননি, কারণ সে নিজেই নিজের নাম মুছে দিয়েছিলেন। তবে এটুকু জানি, তিনি সেই রাতের সাক্ষী ছিলেন। এবং এই পাণ্ডুলিপিতে তিনি বলেছেন কীভাবে চৈতন্য মহাপ্রভু মন্দির থেকে গম্ভীরা ঘরে পৌঁছান, কীভাবে এক বিশেষ মন্ত্র পাঠ করে নিজেকে সংবরণ করেন এবং কীভাবে তাঁর শরীরটি গায়েব হয়ে যায়—কোনও অলৌকিকতা নয়, বরং এক বিশেষ ওষুধের দ্বারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে একটি পালকি চেপে গুহার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।”
বিশ্বজিত ধীরে বলে, “মানে গোটা অন্তর্ধান ছিল একটি পরিকল্পিত স্নায়বিক সংবরণ—জীবন্ত শরীরকে মৃত করে দেখানো?”
অনন্ত চোখ মুছে বলেন, “হ্যাঁ, কারণ প্রভু জানতেন, মৃত্যুই তাঁকে অমর করে তুলবে। জীবিত থাকলে তাঁকে প্রশ্ন করা হত, ব্যাখ্যা চাইত জনতা। কিন্তু অন্তর্ধান—তা তাঁকে করল দেবতা।”
এই অংশে এসে শোভনের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তবু সে অনুভব করে, এই সত্য কোনও বিশ্বাসের বিরোধিতা নয়। বরং ঈশ্বরতাকেও বুঝতে হয় মানবিকতায়। আর একজন মানুষ যদি নিজেই নিজেকে অমর করে তোলেন—সেটা কি আর তার মৃত্যুই?
তাদের হাতে এখন এক একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে—পাণ্ডুলিপি, ডায়েরি, গুহার খোদাই, অডিও ক্যাসেট, এবং এই অজানা রাজগুরুর লিখিত সাক্ষ্য।
এবার শোভনের সামনে প্রশ্ন—এই সত্য কাকে বলবে? কতটা বলবে?
পর্ব ৬: শব্দের অন্তর্ধান, নিঃশব্দের জন্ম
শোভন এক অদ্ভুত দ্বিধার মুখে দাঁড়িয়ে। তাঁর হাতে এখন এমন সব প্রমাণ, যা শুধু ইতিহাসকে নয়, বিশ্বাসকে, সংস্কৃতিকে, এমনকি লক্ষ লক্ষ মানুষের আস্থা ও আবেগকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এবং এই মুহূর্তেই তাঁর মনে হচ্ছিল, সত্য প্রকাশের থেকেও বেশি কঠিন হলো সত্য গ্রহণ করানোর প্রস্তুতি তৈরি করা।
পুরীর সেই ছোট্ট হোটেল ঘরে বসে, জানালার বাইরের শঙ্খধ্বনি, সমুদ্রের গর্জন আর ভেসে আসা সন্ধ্যার ঘন্টাধ্বনি—সব কিছু মিলে যেন তাঁকে বলছে, ‘সতর্ক হও, শোভন, কারণ তুমি যে দরজা খুলেছ, তার পেছনে আলো নয়, আগুনও থাকতে পারে।’
বিশ্বজিত মেঝেতে বসে ল্যাপটপে সেই পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি টাইপ করছে। গম্ভীর চোখে প্রশ্ন করে, “আমরা যদি সবটা প্রকাশ করি, যদি নাম সহ জানিয়ে দিই যে এই অন্তর্ধান ছিল এক কৌশল, তবে তুমি কি ভাবো মানুষ বিশ্বাস করবে?”
শোভন মাথা নাড়লেন, “বিশ্বাস নয়, ওরা প্রথমে ঘৃণা করবে। বলবে আমরা ঈশ্বরকে মানুষ বানানোর চেষ্টা করছি। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, একজন মানুষ নিজেই নিজেকে ঈশ্বরতুল্য করে তুলেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন মানুষ তাঁর মানবিকতাকে গ্রহণ করবে না। তাই তিনি নিজের শরীর সরিয়ে দিলেন, রেখে গেলেন কেবল বাণী।”
বিশ্বজিত চুপ করে যায়।
এক সময় শোভন উঠে পড়েন। টেবিলের উপরে রাখা সেই তাম্রপত্র, সেই রাজগুরুর লেখা, রঘুনাথের ডায়েরির অনুলিপি—সব কিছু জড়ো করে রাখেন একটি সাদা কাপড়ে। তিনি বলেন, “আমাদের কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। আমি চাই এগুলো দেশের কয়েকজন বড় ইতিহাসবিদ, দার্শনিক এবং গবেষক দেখতে পান। একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কীভাবে, কী পরিমাণে এই তথ্য প্রকাশযোগ্য। কারণ এটা শুধু ইতিহাস নয়, এটা ধর্ম, সমাজ এবং রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যকেও নাড়িয়ে দিতে পারে।”
ফিরে আসার আগের রাতে তারা আবার একবার যায় জগন্নাথ মন্দিরের সামনে। দূর থেকে দেখে সেই গম্ভীরা ঘরের জানালা, জানালায় নেমে থাকা ধুলোর পর্দা, আর যেন অস্পষ্ট ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কেউ—হয়তো সেই মহাপ্রভু, যিনি আর ফিরবেন না, কিন্তু যাঁকে মানুষ ভুলতেও পারবে না।
কলকাতায় ফিরে পরের দু’সপ্তাহ শোভনের সময় কাটে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও বৈঠকে। তিনি যোগাযোগ করেন ডঃ অনিন্দিতা মজুমদার, যিনি জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্ত গবেষক।
প্রথম সাক্ষাতে ডঃ অনিন্দিতা ডকুমেন্টগুলো দেখে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর বলেন, “তুমি জানো তো, এই তথ্য প্রকাশের পর সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া কোথা থেকে আসবে?”
শোভন মাথা নাড়ে, “ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে।”
“না,” অনিন্দিতা বলেন, “সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া আসবে সেই মানুষদের কাছ থেকে, যারা নিজের জীবনের সংকটে একমাত্র আশ্রয় পেয়েছে চৈতন্যদেবের অলৌকিকতার মধ্যে। তারা ভাববে তুমি তাঁদের নিরাশ্রয় করে দিলে।”
শোভন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, “কিন্তু আমি তো কাউকে কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছি না। বরং আমি দেখাতে চাই, একজন মানুষ কতখানি মহান হলে নিজেকে মুছে দিতে পারেন, যাতে তাঁর ভাবধারা যুগ যুগ ধরে টিকে থাকে। আমার কাছে এই বিসর্জন ঈশ্বরতুল্য নয়?”
অনিন্দিতা মৃদু হাসেন। “তুমি ইতিহাসকে মানবিকতা দিয়ে লিখছ, এটা ভালো। কিন্তু তোমাকে সাংবাদিকতা নয়, সাহিত্য নয়—একটা সংলাপ তৈরি করতে হবে। ইতিহাসের নতুন পাঠ তৈরি করতে হবে, যেখানে প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু উত্তর চাপিয়ে দেওয়া হবে না।”
এই কথাগুলো শোভনের মাথায় ঘুরতে থাকে। তার সিদ্ধান্ত দৃঢ় হয়—সে বই প্রকাশ করবে, তবে গবেষণা পত্রাকারে, তথ্য ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে, না ছুঁয়ে যাবে কারো বিশ্বাসকে, না গোপন করবে প্রাপ্ত সত্যকে।
এই সময়েই আবার হঠাৎ তার মোবাইলে আসে একটি অজানা ফোন। কণ্ঠস্বর রুক্ষ, ধীর এবং রেকর্ডিংয়ের মতো মসৃণ:
“তোমার হাতে যা আছে, তা কেবল কাগজ নয়। এটা আগুন। প্রকাশ করো, যদি সাহস থাকে, তবে মনে রেখো—আগুনে শুধু সত্য নয়, মানুষও পুড়ে যায়।”
শোভন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে, এই পথ সহজ হবে না।
পরের দিন সে এক ছোট্ট প্রেস কনফারেন্সে অংশ নেয়, যেখানে সাংবাদিক ও গবেষকদের সামনে সে তুলে ধরে ইতিহাসের নানা প্রশ্ন: “চৈতন্যদেবের মৃত্যু রহস্য কেন আজও অস্পষ্ট? গম্ভীরা ঘরে কী ঘটেছিল সেই রাতে? কেন রাজপরিবার বা পুরোহিতেরা এতকাল এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গেছেন?”
এইসব প্রশ্ন রেখে, সে জানায়—একটি নতুন গবেষণা গ্রন্থ খুব শিগগির প্রকাশ পাবে, যেখানে এই প্রশ্নগুলির নানাদিক আলোচিত হবে।
সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করে, “আপনার দাবি কি তাহলে চৈতন্যদেবের মৃত্যু প্রাকৃতিক ছিল না?”
শোভন উত্তর দেয়, “আমার দাবি নয়, আমার লক্ষ্য—প্রমাণ দেখানো। আর প্রমাণ দেখিয়ে মানুষকে ভাবতে শেখানো। ওঁর মৃত্যু যদি সাধারণ হয়েও অসাধারণ হয়ে থাকে, তবে সেটাই তো আমাদের বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হতে পারে।”
সেদিন রাতেই সে ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লেখে:
“যখন কেউ প্রশ্ন করে ঈশ্বরের মৃত্যু হয় কিনা, তখন আমি বলি—না, যদি ঈশ্বর মানে হয় বিশ্বাস। কিন্তু হ্যাঁ, যদি ঈশ্বর হন একজন মানুষ, যিনি শুধু নিজের কথা ভাবেননি, ভাবেননি তাঁর শরীর থাকবে কিনা—তাঁর বাণী বাঁচলেই তিনি অমর। সেই বিশ্বাসেই আমি এই লেখা শেষ করছি।”
পর্ব ৭: কুয়াশার মধ্যে শব্দেরা
কলকাতার শেষ শরতের সকাল। হালকা কুয়াশা, কাকদের ডাকে ছিন্ন বাতাস। শোভন নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে, হাতে ধরা চায়ের কাপটা থেকেও যেন অনেক দূরে। আজ বইটির শেষ অধ্যায় লিখবেন তিনি—যে অধ্যায়ে একটিও নতুন প্রমাণ নেই, কিন্তু আছে সবচেয়ে কঠিন কাজ—সত্যকে ভাষায় পরিণত করা।
একটা সত্য যখন কাগজে আসে, তখন সে আর ব্যক্তিগত থাকে না। তখন তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়, বোঝাতে হয়, কাদের জন্য তা লেখা, কেন তা লেখা, কতখানি বলা আর কতটা চেপে যাওয়া জরুরি।
এই সব ভাবনার মধ্যেই ফোন আসে বিশ্বজিতের।
“ভাই,” ওর গলা শোনামাত্র বোঝা যায় উত্তেজনা ও শঙ্কা মিশে আছে, “তুই জানিস তো, গতকাল রাতে গুপ্তেশ্বর গ্রামের দয়ানাথ মারা গেছেন। হঠাৎ স্ট্রোক বলছে, কিন্তু আমি যেভাবে শুনলাম, মনে হচ্ছে ওঁকে চাপে রাখা হয়েছিল শেষ কিছুদিন।”
শোভনের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। “চাপে রাখা মানে?”
“গ্রামে গুঞ্জন ছিল, কেউ নাকি ওঁর কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল গুহা নিয়ে সব কিছু—আমাদের যাওয়া, প্রতিমা, তাম্রপত্র—সব। ওঁর ছেলে বলছে, দু-তিনজন অপরিচিত লোক কয়েকদিন ধরে তাদের নজর রাখছিল। এখন হঠাৎ ওঁর মৃত্যু… আমি বলছি না খুন, কিন্তু এটার পেছনে কেউ আছেই।”
এক মুহূর্তে শোভন যেন হালকা হোঁচট খায়। তারপর নিজেকে সামলে বলে, “তাহলে সময় এসেছে আমাদের লেখাটা শেষ করার।”
“আরেকটা কথা,” বিশ্বজিত বলে, “সত্যনারায়ণ গোস্বামী আমাকে ফোন করেছিলেন। উনি চান তুমি একবার আবার নবদ্বীপে যাও। বললেন—’একটা জিনিস থেকে গিয়েছিল, যা আমি তখন দিইনি। এখন মনে হচ্ছে, ওটা তোমার হাতেই থাকুক।’”
শোভন সিদ্ধান্ত নেয়—এইবার নবদ্বীপ সফরই হবে তার লেখার শেষ প্রস্তুতি।
দুইদিন পর, কুয়াশায় ঢাকা এক সকালে শোভন দাঁড়িয়ে থাকে সত্যনারায়ণের দাওয়ায়। বৃদ্ধ মানুষটি যেন আরও শীর্ণ হয়ে গেছেন, অথচ চোখে সেই চিরকালীন দীপ্তি।
“তুমি যা করছ, তা কেবল ইতিহাস নয়, এটা আত্মার কাজ,” বলেন তিনি। “তবে আত্মার কাজ করতে গেলে অন্তরের মধ্যে অন্ধকারকেও চিনতে হয়। আমি জানতাম, তুমি আবার আসবে। এ নাও।”
তিনি বারান্দার কোণ থেকে একটি ছোট্ট তামার বাক্স এনে দেন। খুলতেই দেখা যায় এক সরু তালপাতার টুকরো, যেটা জলে ভেজানো কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা ছিল।
তাতে লেখা আছে—
“শেষ রাত্রে আমি তাঁকে দেখিলাম, গম্ভীরা ঘরের কোণে বসিয়া, কাঁদিতেছিলেন। তিনি বলিলেন, ‘আমার শিক্ষা হবে অস্ত্র, আমার শান্তি হবে অভিশাপ। আমি থাকিলে কেউ বোঝে না আমি কী বলিতে চাহি। আমি গেলে তবেই আমার শব্দ গৃহে প্রবেশ করিবে।’”
এই বক্তব্য ছিল রঘুনাথ দাসের নিজের হাতে লেখা শেষ কটি বাক্যের একটি, যেটি সে তার ব্যক্তিগত পাণ্ডুলিপির বাইরে রেখেছিল।
শোভনের হৃদয় কেঁপে ওঠে। একজন ধর্মগুরু, যাঁকে মানুষ ঈশ্বররূপে পুজে, তিনি শেষ রাত্রে কাঁদছিলেন। কারণ, তিনিও জানতেন, তাঁর শিক্ষা পৃথিবীর সামনে যেভাবে হাজির হচ্ছে, তা হয়তো তাঁকে ভুল ব্যাখ্যায় বন্দি করে রাখবে। তাঁর উপস্থিতি যতটা আলো ছিল, অনুপস্থিতিও ততটাই তীব্র।
এই পাঠ শোভনকে রুদ্ধ করে দেয় কিছুক্ষণ। সে অনুভব করে, চৈতন্যদেব কেবল একটা ধর্মীয় আন্দোলনের মুখ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক নাট্যকার—যিনি নিজেকে সরিয়ে দিয়ে পর্দা ছেড়ে দিয়েছেন অন্যের জন্য।
ফিরে এসে শোভন বইয়ের শেষ অধ্যায় লেখে—‘অন্তর্ধান ও অনুপস্থিতি’।
সেখানে সে লেখে:
“চৈতন্য মহাপ্রভু হয়তো নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর শিক্ষাকে সামনে রেখেছিলেন। মানুষ তাঁকে খুঁজেছে অলৌকিকতায়, কিন্তু যিনি নিজেই বলেছিলেন—‘আমি নাম নই, আমি ধ্বনি।’ সেই মানুষটি তাঁর মৃত্যুতে চেয়েছিলেন এক নীরব বিস্ফোরণ। এবং এই নীরবতাই হয়তো আমাদের যুগে যুগে ধ্বনির উৎস হয়েছে।”
বই শেষ হয় এই তিনটি বাক্যে:
“আমি তাঁকে খুঁজিনি মৃত্যুর জন্য।
আমি খুঁজেছি তাঁকে অনুপস্থিতির মধ্যে।
কারণ, কেউ একজন ছিলেন বলেই তো এত অনুপস্থিতি।”
বইটির নাম শেষ পর্যন্ত রাখেন—”নির্বাচিত অনুপস্থিতি”।
তারপর যা ঘটে, তা অভাবনীয়।
বইটি প্রকাশের পর প্রথমে অল্প কিছু গবেষক ও পাঠকের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কেউ বলেন এটি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল, কেউ বলেন এটি এক নিন্দনীয় প্রশ্ন উত্থাপন। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় বইটির কিছু অংশ।
প্রথম আলোচনা শুরু হয় রঘুনাথ দাসের ডায়েরির সেই উদ্ধৃতি নিয়ে—”তাঁর মৃত্যুর দিন তিনি বলেছিলেন—আমি যাব, কিন্তু ঈশ্বর হয়ে নয়, মানুষ হয়ে।” এই লাইন ধর্মপ্রাণ অনেক মানুষকে উস্কে দেয়, আবার অনেককে প্রভাবিত করে এক নতুন পাঠ গ্রহণে।
একটি কীর্তনমঞ্চে একজন প্রবীণ গায়ক বলেন, “যদি সত্যিই তিনি মানুষ হয়েও এতটা দূরদর্শী হয়ে থাকেন, তবে তো তিনি আরও বড় ঈশ্বর।”
এই শব্দটাই শোভনের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।
কারণ সে বুঝতে পারে—চৈতন্যদেব যদি নিজের অন্তর্ধানকে ব্যবহার করে থাকেন নতুন বিশ্বাস গড়ার জন্য, তবে সে বিশ্বাস একদিন নিজেই প্রশ্নের মুখোমুখি হবে। এবং তাতে ভয় নেই। কারণ, বিশ্বাস তখনই টিকে থাকে, যখন সে প্রশ্নে কাঁপে, কিন্তু পড়ে না।
পর্ব ৮: শব্দযাত্রার প্রতিবেদন
বই প্রকাশের দশম দিনে শোভন একটি বিশেষ আমন্ত্রণপত্র পান—ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদের (Indian Council of Historical Inquiry) পক্ষ থেকে। সেখানে আয়োজন করা হয়েছে একটি ‘ওপেন ডায়ালগ সেশন’—বিষয়: Faith, Fact, and the Forgotten: The Death of Chaitanya Mahaprabhu. তাকে অন্যতম বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
শোভনের হৃদয়ে একসঙ্গে দুটো সুর বাজে—গর্ব আর শঙ্কা। বইটি এখন শুধুই কাগজে ছাপা তথ্য নয়, এটা এখন বহু মানুষের বিশ্বাস, বিতর্ক এবং ব্যক্তিগত যন্ত্রণার কেন্দ্রবিন্দু। প্রশ্ন উঠেছে টিভি টক-শোতেও—”চৈতন্যের অন্তর্ধান কি এক পরিকল্পিত নীরবতা ছিল?”
গবেষণা পরিষদের সভাকক্ষ ছিল ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের পেছনের একটি ছায়াঘেরা সভাকক্ষ। চারপাশে বইয়ের তাক, দেওয়ালে ঝুলছে ভারতীয় মনীষীদের দুর্লভ পোর্ট্রেট। উপস্থিত ছিলেন নামকরা ঐতিহাসিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, গবেষক এবং কিছু প্রাক্তন আমলাও।
সভা শুরু হয় সভাপতি ডঃ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেন, “আজ আমরা শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এক আধ্যাত্মিক আন্দোলনের অন্তর্ধান নিয়েও কথা বলতে এসেছি। এবং আমাদের মাঝে আছেন সেই তরুণ গবেষক, যিনি সাহস করেছেন প্রশ্ন তোলার।”
শোভন যখন মাইকের সামনে দাঁড়ান, তখন তার সামনে কেবল পণ্ডিতেরা নয়, ছিল প্রশ্ন, চাহনি আর বহু মানুষের অভিমানের মুখ।
সে শুরু করে সরল গলায়—
“আমি ইতিহাসবিদ নই, দার্শনিকও নই। আমি কেবল একজন অনুসন্ধানকারী, যার একটাই লক্ষ্য—শুনতে পাওয়া সেই গল্প, যেগুলো চুপ করে বসে আছে আমাদের নথির ফাঁকে, মাটির নিচে, কিংবা মানুষের চোখের ক্লান্ত কোণে।”
তারপর সে ধাপে ধাপে তুলে ধরে তার অনুসন্ধান—
• গম্ভীরা ঘরের পাণ্ডুলিপি
• রঘুনাথ দাসের ডায়েরির লুপ্ত অংশ
• গুপ্তেশ্বর গুহার খোদাই ও তাম্রপত্র
• রাজগুরুর সাক্ষ্যপত্র
• সত্যনারায়ণের দেওয়া শেষ পাতার নোট
সবশেষে সে বলে—
“আমার কাছে, চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান এক অলৌকিকতা নয়। বরং এটি এক মহামানবের কৌশলী অবসান—যেখানে তিনি নিজেই সরে গেছেন, যাতে তাঁর কথা থেকে যায়। আমি তাঁকে ঈশ্বর বলে মানি না, কারণ আমি তাঁকে মানুষ হিসেবে বেশি শ্রদ্ধা করি।”
ঘরে নেমে আসে এক নিঃশব্দ স্তব্ধতা।
একজন প্রবীণ বৈষ্ণব গবেষক, ডঃ বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে বলেন, “তুমি কি জানো, এই কথাগুলো শুনে কত মানুষের মনে ব্যথা হবে? তুমি কি বুঝতে পারছো, তুমি একজন ‘অবতার’কে আবার রক্ত-মাংসের মানুষে নামিয়ে আনছো?”
শোভন মাথা নিচু করে বলেন, “আমি কাউকে নামাইনি, আমি কেবল দেখিয়েছি তিনি নিজেই নেমেছিলেন। তাঁর এই নেমে আসাটাই তো প্রকৃত শিক্ষা।”
এই উত্তরে অনেক মুখ থেমে যায়।
তবে সম্মেলনের শেষে ডঃ অনিন্দিতা মজুমদার বলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা—
“চৈতন্যদেব যদি সত্যিই এমন পরিকল্পিত অন্তর্ধান ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি নিছক একজন ধর্মপ্রচারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বাস নির্মাণের একজন শৈল্পিক চিন্তক। আর ইতিহাসে এই দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থাকা উচিত।”
এই বক্তব্যে আবার আলো আসে।
সন্ধ্যাবেলায়, অনুষ্ঠান শেষে, শোভন যখন একা একা বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তাঁর মোবাইলে আসে একটি অজানা নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ।
তাতে শুধু একটি পুরোনো কালি-ছাপচিত্র।
চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে: গম্ভীরা ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে একজন মৃদু চন্দনে গায়ে মালা পরা যুবক, চোখ দুটি যেন ঝলমল করছে, আর তাঁর পায়ের পাশে বসে রয়েছেন এক রাজপুরুষ, যার মুখ আড়াল।
ছবির নিচে লেখা:
“কথা বলা শেষ হয়েছিল না। কিন্তু শুনে যাওয়া হয়তো শুরু হয়েছিল।”
শোভনের মনে হয়, এই ছবিটিই তার বইয়ের সবচেয়ে নিরীহ অথচ তীব্র উত্তর।
এইসব ভাবতে ভাবতে সে হঠাৎ আবিষ্কার করে—তার বইটির একটি অধ্যায়, যেটা সে টাইপ করেছিল কিন্তু মেইন ফাইলে ঢোকায়নি, সেটিই হঠাৎ প্রকাশ হয়ে গেছে অনলাইনে—বহু অনুরাগী সেই অধ্যায় কপি করে পোস্ট করেছে ফোরাম, ফেসবুক পেজ, এমনকি ইউটিউবেও আবৃত্তির আকারে।
অধ্যায়ের নাম ছিল—“মৃত্যুর গান”। তাতে লেখা ছিল:
“যে চলে যায়, সে যদি কথা না রেখে যায়, তবে তার চলে যাওয়া কেবলই মৃত্যু।
আর যে চলে গিয়ে অন্যের শব্দে বাসা বাঁধে, তার অনুপস্থিতিই হয়ে ওঠে স্থায়ী সঙ্গ।
চৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন সেই সঙ্গ—যিনি হারিয়ে না গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার কথাই বলেছিলেন।”
এই অধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় বইটি এখন শুধু গবেষকদের নয়, এক নতুন প্রজন্মের তরুণ পাঠকদের হাতেও পৌঁছেছে। কেউ কেউ বলছে—“এই বই না থাকলে আমরা জানতাম না, একজন ধর্মগুরুরও ভয় থাকতে পারে, এবং সেই ভয় থেকেও জন্ম নিতে পারে অসীম আলো।”
তবে এই আলোতে আগুনও আছে।
পরের দিনই সংবাদে আসে খবর—বিশ্বজিতকে ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। “ধর্ম নিয়ে কথা বলো না, ইতিহাস নিয়ে থাকো,” বলা হয়েছে।
শোভন বুঝে যায়—যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। সত্যের পথে চলা মানে কেবল তথ্য প্রকাশ নয়, সেই তথ্যকে বাঁচিয়ে রাখাও এক সংগ্রাম।
সেদিন রাতে সে ডায়েরির নতুন পৃষ্ঠায় লেখে—
“আমি চাইনি বিশ্বাস ভাঙাতে। আমি চেয়েছি বিশ্বাসের ভিত্তি জানাতে।
আমি চাইনি ইতিহাস পাল্টাতে। আমি চেয়েছি ইতিহাস শুনতে।
আমি চাইনি ঈশ্বর খণ্ডন করতে। আমি চেয়েছি মানুষের ঈশ্বর হয়ে ওঠার শক্তিকে দেখাতে।”
তারপর সে কলম রাখে, জানালার দিকে তাকিয়ে বলে—
“চৈতন্য, তুমি যদি কোথাও থেকো, তবে জানো—আমি তোমার অদৃশ্য হওয়ার গল্প নয়, তোমার মানুষের মতো লড়াইয়ের গল্পটাই চিরকাল লিখে যেতে চাই।”
পর্ব ৯: দেবতার চিঠি ও দংশনের পরশ
কলকাতার সেই শীতের সন্ধ্যায় বালিগঞ্জের এক পুরোনো হোটেলে বিশেষভাবে আয়োজিত হয়েছিল একটি গোপন মিটিং—উপস্থিত ছিলেন ভারত ও বিদেশের বিশিষ্ট কয়েকজন ইতিহাসবিদ, মনোবিজ্ঞানী, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং স্ট্রাকচারাল মিথোলজি নিয়ে গবেষণা করা কয়েকজন আন্তর্জাতিক স্কলার। মূল আলোচ্য: “চৈতন্যদেব: ইতিহাসের অন্তর্ধান নাকি মননের সন্ন্যাস?”
এই মিটিংয়ে অতিথি বক্তা হিসেবে প্রথমবার ডাক পেয়েছিলেন শোভন। তবে এবার তাঁকে বলা হয়েছিল, তাঁর বইয়ের বাইরে যে তথ্যে তিনি কাজ করছেন—বিশেষ করে সেই গুপ্তেশ্বর গুহার খোদাই, রাজগুরুর চিঠি, এবং রঘুনাথ দাসের শেষ পাণ্ডুলিপির কিছু অনূদিত অংশ—সেগুলোর ওপরে তিনি যদি একটি গবেষণা থিসিস রচনা করেন, তাহলে তাঁর লেখাকে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক সংস্থার তরফে।
কিন্তু শর্ত ছিল—নামহীনতা বজায় রাখতে হবে।
তাঁর কাজ, তাঁর অনুসন্ধান, সব কিছুকে এক ‘এনোনিমাস অথর’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
এই প্রস্তাবে অনেকেই খুশি হতেন। কিন্তু শোভনের মনে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তাঁর কি লেখা শুধু তথ্যের জন্য? না কি এ লড়াই ছিল স্বাক্ষরের জন্য? চৈতন্যদেব যদি নিজেই নিজের নাম সরিয়ে দিয়ে নিজের অন্তর্ধানকে এক বিস্ময় বানাতে পারেন, তবে শোভন কি পারবেন নিজেকে সরিয়ে রাখতে?
সেই রাত্রে, হোটেল ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে, তিনি গঙ্গার জলরেখার দিকে তাকিয়ে থাকেন। স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে সেই গম্ভীরা ঘর, সেই গুহার খোদাই, সেই তাম্রপত্র, সেই মৃত্যুর আগের চোখদুটো যাকে দয়ানাথ বলেছিলেন ‘আলোয় ভর্তি কিন্তু ভয়ংকর’।
তিনি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন—
“যদি আমার নাম না থাকে, তবু কি আমার কথাগুলো থেকে যাবে? যদি আমি অদৃশ্য হয়ে যাই, তবে কি কেউ কখনো মনে রাখবে, আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম দেবতার নামে?”
ঠিক এই সময়, বিশ্বজিত তাঁকে মেসেজ করে একটা ছবি পাঠায়।
ছবিটা অস্বাভাবিক।
একটা চিত্রলেখার প্রতিলিপি, সম্ভবত কোনও প্রাচীন দরবেশ শিল্পীর আঁকা। তাতে দেখা যাচ্ছে, এক গম্ভীর পুরুষ—চৈতন্যদেবের মতো চেহারা—দাঁড়িয়ে আছেন একটি সাদা শূন্যতায়। তাঁর হাতে একটি খোলা পত্র, পেছনে রয়েছে এক ঝাঁক ছায়ামানব, যাদের চোখে আলো নেই, কিন্তু কপালে লেখা নানা ভাষার শব্দ—‘বিশ্বাস’, ‘ঈশ্বর’, ‘সত্য’, ‘ভয়’।
ছবির নিচে লেখা:
“চিঠি লিখেছিলেন তিনি, কিন্তু পাঠানো হয়নি। পাঠকরা নিজেই চিঠির পথ বেছে নিয়েছিল।”
শোভন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর মেসেজ করে উত্তর দেন—
“বিশ্বাস কর, আমরা সেই চিঠির কালি। সে চিঠি পৌঁছেছে।”
পরদিন ভোরে তিনি হাঁটতে বের হন। প্রিন্সেপ ঘাটের কাছাকাছি গঙ্গার ধারে বসে পড়েন। তাঁর সঙ্গে শুধু একটি নোটবুক আর কলম।
সেখানে তিনি লিখেন—
“আজ মনে হলো, চৈতন্য ছিলেন এমন এক লেখক, যিনি একটিও বই লেখেননি, কিন্তু এক বিশাল পাঠ তৈরি করে গেছেন। তাঁর অন্তর্ধান ছিল তাঁর শেষ অধ্যায়, আর আমরা, পাঠকেরা, কেউ কেউ শুধু শিরোনামে আটকে গেছি।”
তারপর তিনি লেখেন একটি কাল্পনিক চিঠি—চৈতন্যদেবের নামে, ঠিক যেন সেই অন্তর্ধানের আগের রাত্রে তিনি কাউকে লিখে গিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি লিখেন:
“আমি চলে যাব। কারণ আমার থাকা এখন আমার কথার বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি ঈশ্বর হতে পারিনি, মানুষ হয়ে উঠেছিলাম।
তাই আমার প্রস্থান দরকার—না হলে আমার শব্দের মৃত্যু হবে।
আমি চাই, কেউ খুঁজে পাক এই শূন্যতা।
কেউ প্রশ্ন করুক, কেন আমি সরে গেছিলাম।
আর কেউ যদি সত্যিই ভালোবেসে খুঁজে নেয়—তবে আমি থেকে যাব।
কীর্তনের ঢোলের ফাঁকে, একা কোনো পাঠকের চোখে, অথবা ইতিহাসের পাদটীকার পাশে।
আমি দেবতা হতে চাই না।
আমি চাই, আমাকে মনে রাখা হোক একজন প্রস্থানকারী হিসেবে,
যে থেকে যাওয়ার থেকেও বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছিল চলে গিয়ে।”
এই চিঠি লিখে শোভন বহুক্ষণ স্থির বসে থাকেন।
এক সময় একটি তরুণী পাশে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে শোভনের বইটি। হেসে বলে, “আপনি শোভন রায় তো? আমি আপনার লেখা পড়ে এখন চৈতন্যদেবকে আরও বেশি ভালোবাসি।”
শোভন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ভালোবাসা কমলো না?”
তরুণী মাথা নাড়িয়ে বলে, “না। কারণ একজন ঈশ্বর যদি মানুষ হয়ে নিজেকে সরিয়ে দিতে পারেন, তবে সেটাই তো সবচেয়ে মানবিক ভালোবাসা। আমি এখন আর তাঁর অলৌকিকতা খুঁজি না, আমি খুঁজি সেই চোখদুটো—যেখানে ছিল ভয়, ছিল সত্য, ছিল পরিত্যাগ। সেই ভয়ই তো আমার সাহস হয়ে দাঁড়ায়।”
এই কথায় শোভন মনে মনে হাসেন। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর কাজ শেষ হয়নি, কিন্তু শুরু হয়েছে এক নতুন পাঠ—এক নতুন সময়ের, যেখানে দেবতা আর মানুষ হাত ধরাধরি করে দাঁড়াবে, আর কেউ একজন চুপ করে একটি চিঠির খামে সিল মারবে।
সেই খামের ওপরে লেখা থাকবে—“নিলাচলের শেষ রাত্রি। প্রাপক: ভবিষ্যৎ।”
পর্ব ১০: ভবিষ্যতের প্রাপক
এক মাস কেটে গেছে শোভনের বই প্রকাশের পর। বিতর্ক পেরিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে তাঁর গবেষণা। কেউ তাঁকে সাহসী ইতিহাসবিদ বলছে, কেউ ‘ধর্মবিরোধী’, আবার কেউ বা তাঁকে বলছে এক ‘শব্দজাদুকর’, যিনি অতীতকে নতুন আলোয় দেখতে শিখিয়েছেন। কিন্তু এইসব আখ্যা এখন আর তাকে স্পর্শ করে না।
এখন তার কাছে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন: এরপরে কী?
তিনি কি এখানেই থেমে যাবেন? না কি আরও খোঁজ করবেন?
এই দোলাচলে থাকতেই একদিন ডাক আসে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে—একটি আন্তর্জাতিক আলোচনাসভা আয়োজিত হচ্ছে “Absent Presences: Mysticism, Memory, and Modernity”—এবং শোভনকে keynote speaker হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
শান্তিনিকেতনের হেমন্তের বাতাসে এখনও টগর ফুলের ঘ্রাণ থাকে, পলাশ গাছে নতুন পাতার চিহ্ন, মাটির গন্ধে ইতিহাসের ধুলো। সেখানে দাঁড়িয়ে শোভন বুঝতে পারেন—এই মাঠেই কখনো রবীন্দ্রনাথ হেঁটেছেন, ‘গোরা’ বা ‘শেষের কবিতা’র ছায়া এখানে আজও বিচরণ করে। আর আজ, এই জমিতে তিনি কথা বলবেন চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান নিয়ে।
মঞ্চে উঠে তিনি বক্তব্য শুরু করেন এক পংক্তি দিয়ে—
“যে চলে যায়, সে কি আর ফিরে আসে?
না কি আমরা নিজেরাই তাকে ফিরিয়ে আনি—প্রতিটি প্রার্থনায়, প্রতিটি প্রশ্নে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে?”
তারপর তিনি বলেন—
“আমরা যে সময়ে বসবাস করছি, সেখানে বিশ্বাস আর তথ্য একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কিন্তু ইতিহাস কখনো কাউকে বাতিল করে না। ইতিহাস আমাদের শেখায়—মানুষ কীভাবে দেবতা হয়, এবং দেবতা কীভাবে মানুষের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।”
তিনি যখন বলেন, “চৈতন্যদেব নিজে তাঁর অন্তর্ধান রচনা করেছিলেন—একটি জীবনচিত্রের শেষ পর্ব, যাতে তাঁর শিক্ষাই চিরন্তন থাকে, শরীর নয়”—তখন অনেক দর্শক নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।
সভা শেষে এক বৃদ্ধ অধ্যাপক এগিয়ে এসে বলেন, “তুমি জানো? আমি যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ভাবতাম ঈশ্বর সব জানেন। আজ মনে হয়, ঈশ্বর নিজেও জানতেন না মানুষ তাঁকে কতভাবে ভাঙবে। তোমার লেখায় আমি সেই ভয়টাকে পেয়েছি—ঈশ্বরেরও যে ভয় হয়।”
শোভন মাথা নিচু করে কৃতজ্ঞতা জানান।
ফিরে আসার ট্রেনে তার পাশে বসে এক কিশোরী, চোখে গাঢ় কালো চশমা, হাতে মোড়া কাগজ। হঠাৎ সে বলে, “আপনি শোভন রায়?”
শোভন মৃদু হেসে বলে, “হ্যাঁ, তুমি কীভাবে চিনলে?”
মেয়েটি বলে, “আমি আপনার বই পড়ে একটা কবিতা লিখেছি। পড়বেন?”
সে পড়ে শোনায়—
“তুমি ছিলে বলে আমি ঈশ্বর খুঁজিনি,
তুমি চলে গেলে আমি তোমার খোঁজে পথ দেখলাম।
তুমি না থেকে থেকেছো,
আর আমরা, যারা অপেক্ষায় বসে ছিলাম,
তারা বিশ্বাস করলাম—
হয়তো চলে যাওয়ার মধ্যেই
তোমার সবচেয়ে বড় ফিরে আসা লুকিয়ে ছিল।”
শোভনের চোখ ভিজে ওঠে। সে বুঝতে পারেন, এই মেয়েটিই ভবিষ্যতের প্রাপক। যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন ‘নিলাচলের শেষ রাত্রি’তে, তা ঠিক পৌঁছে গেছে তার ঠিকানায়।
দু’মাস পর।
একটি সন্ধ্যায়, যখন কলকাতার আকাশে ধোঁয়াশা আর ভাঁপা বাতাস, শোভন তাঁর ডেস্কে বসে শেষ পাণ্ডুলিপিটা টাইপ করেন—একটি নতুন বই, নাম “চুপ করে থাকা ঈশ্বর”।
এটিতে থাকবে চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানের বাইরেও আরও কিছু হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়—রঘুনাথ দাসের দার্শনিক ভাবনা, রাজগুরুর আত্মসংযম, গুহার প্রতিচিত্র এবং মানুষের চেতনার ভাঙাগড়া।
তাঁর সামনে সেই তাম্রপত্রের প্রতিলিপি পড়ে থাকে। আর বারান্দায় বাতাসে দুলছে রুদ্রাক্ষ মালা।
একসময় বিদ্যুৎ চমকায়, এবং শোভনের চোখ পড়ে জানালার বাইরের এক বালক পিঁপড়ে দেখছে। তার হাঁটুতে চোট, মুখে চিন্তাভাবনার রেখা। শোভন হঠাৎ ভাবে—এই ছেলেটিই যদি একদিন ঈশ্বরের নতুন সংজ্ঞা খোঁজে, তবে কি সে চৈতন্যদেবকে একজন চিরসত্য বলে মেনে নেবে, না কি একজন ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবে?
সে জানে না।
কিন্তু সে এটুকু জানে, এই গল্প শেষ নয়।
চৈতন্যদেব যেখানে নিজেকে অদৃশ্য করেছিলেন, সেখানে কেউ একজন ঠিক দেখেছিল তাঁকে—আর সেই দেখা থেকেই জন্ম নিয়েছিল নতুন এক দৃষ্টি।
সেই দৃষ্টি দিয়েই ইতিহাস শুধু লেখা নয়, দেখাও যায়।
আর সেই দেখাতেই লুকিয়ে থাকে সত্য।
তাই শেষ পৃষ্ঠায়, শোভন লেখে একটিমাত্র বাক্য—
“আমি তাঁকে দেখি না। আমি তাঁকে দেখিয়ে দিই।”
(শেষ)