সৌম্যজ্যোতি ভট্টাচার্য
ভোর চারটের দিকে কলকাতার আকাশে বৃষ্টির গন্ধ মিলিয়ে ছিল ধোঁয়ার মত আবছা আলো। কৌশিক মৈত্র জানালার ধারে বসে ছিল চুপ করে, ছয়তলার ফ্ল্যাটের নিচে তখনও শহর জেগে ওঠেনি। তার গলায় ঝুলে থাকা কাঁপতে থাকা একচিলতে নিঃশ্বাস, বিছানার ধারে পড়ে থাকা খোলা ঘুমের ওষুধের শিশি, ও পাশের টেবিলে ছেঁড়া কাগজে কুংথিত দুটো শব্দ— “মাফ করো”। গত রাতটা সে ঠিক কীভাবে পার করল, মনে পড়ে না। অথবা, মনে পড়াতে চায় না। এ জীবনের সব ছায়া, সব আগুন, সব ব্যর্থতা ঘিরে রেখেছিল তাকে এক অদ্ভুত অস্পষ্ট ধোঁয়াশায়, যেন কিছুই আর বাস্তব নয়—সবই বাষ্প। সেই বাষ্পেই ঘোর লাগা চোখে হঠাৎ পড়ে যায় টেবিলের উপর রাখা একটা খাম। সেটা এসেছে গতকাল দুপুরে, কিন্তু সে ছিঁড়ে দেখেনি। খামের উপরে নাম নেই, শুধু লেখা আছে “তিলোত্তমা”, আর নিচে কালো কালিতে এক অচেনা প্রতীক—তিনটি ত্রিভুজ একটির ভিতরে আর একটি—যার মাঝখানে একটি তিল চিহ্ন। খামটা খুলতেই তার শরীরের ভিতর দিয়ে হিমেল একটা স্রোত বয়ে যায়। ভেতরে রাখা চিঠির কালি যেন চলমান, অক্ষরগুলো পড়তে পড়তে মনে হতে থাকে সে যেন কোনো পরিচিত কণ্ঠ শুনছে। তাতে লেখা—“তুমি প্রস্তুত, কৌশিক। অরুণাচলের তন্ত্র তোমার অপেক্ষায় আছে। পথ শুরু হবে কাশীতে। আমি তোমার সামনে থাকব না, কিন্তু প্রতিটি স্তরের পেছনে আমার ছায়া থাকবে।” কে এই তিলোত্তমা? নামটা যেন ধোঁয়ার মধ্যে পুরোনো চেনা কিন্তু এখনো অস্পষ্ট। ছ’সাত বছর আগেকার কোনো এক কালবেলার স্মৃতি মাথায় ভাসে, মেঘের মধ্যে মুখ হারিয়ে ফেলা এক মেয়ে, যে হঠাৎ করে হারিয়ে গিয়েছিল, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়া।
কাশীতে পৌঁছাতে কৌশিকের সময় লাগল তেতাল্লিশ ঘণ্টা—মনের অবস্থা অনুযায়ী সময়ের গতিবেগও যেন বিকৃত হয়। সেই দগ্ধ গরমে ঘামতে ঘামতে সে নামল বারাণসী ষ্টেশনে, চোখে তখনও ঘোরের ছায়া। ঘাটের দিকের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়াল ‘শ্রীপঞ্চদশী গ্রন্থাগার’ নামের একটি ভাঙাচোরা দালানের সামনে, যেটার নাম সে আগে কখনো শোনেনি। চিঠির অন্য পৃষ্ঠায় লেখা ছিল এই স্থানটির নাম, স্পষ্ট হস্তাক্ষরে। সেই দালানের কষ্টিপাথরের দরজা খুলে গেল যেন নিজে থেকেই। ভিতরে একঘেয়েমি ধুলো আর শুকিয়ে যাওয়া তাম্রবর্ণের আলো। তার মধ্যে বসে ছিলেন একজন বৃদ্ধ, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, চোখে মোটা চশমা, যিনি তাকাতেই বললেন, “তুমি এসে গেছো, কৌশিক। সে জানতো তুমি আসবে।” কৌশিক স্তব্ধ। সে এই মানুষটিকে চিনতে পারে না, কিন্তু তার কণ্ঠে অদ্ভুত আত্মীয়তা। তিনি পরিচয় দিলেন—“আমার নাম ত্রিযাম্বক নাথ। এই গ্রন্থাগার আমি দেখি। কিন্তু বাস্তবে এটি গ্রন্থাগার নয়—এটি এক ‘অন্তর্দ্বার’। তুমি যদি ‘অরুণাচলের তন্ত্র’ খুঁজে থাকো, তবে জানতে হবে—এই পথ কেবল বাইরের নয়, ভিতরেরও। তুমি কি প্রস্তুত?” ত্রিযাম্বকের প্রশ্নে উত্তরের থেকে বেশি উঠে আসে ভয়। কৌশিক হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। সে বসে পড়ে মেঝেতে, তার ভিতর যেন কোনো প্রাচীন কাঁপুনি জেগে ওঠে—এটা কি সেই ছায়ার পথ, যেটা বহুদিন ধরে তার স্বপ্নে ফিরে আসে?
পরদিন সকালে, কৌশিক এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ঘুম ভাঙে। সে দেখে যে সে গ্রন্থাগারের ভিতরের একটি অজানা কক্ষে শুয়ে আছে, মাথার পাশে রাখা একটি পুঁথি—অত্যন্ত পুরাতন, তাম্রলিপিতে লেখা, যার প্রতিটি পাতায় ছায়া নড়ে। সে পাতাগুলো ছুঁতেই পারে না। ত্রিযাম্বক এসে জানায়, “এ গ্রন্থ তোমাকে নিজে থেকে ডাকবে—তুমি ডাকলেই সে সাড়া দেবে না।” তারপর কৌশিককে নিয়ে যান মণিকর্ণিকা ঘাটের দিকে। সেখানকার একটি নির্জন গলিতে, ধ্বংসপ্রায় এক আশ্রমে নিয়ে গিয়ে দেখান একটি সাদা দেয়াল—যেখানে আঁকা সেই একই তিলোত্তমার প্রতীক। ত্রিযাম্বক বলেন, “তিলোত্তমা বাস্তব নয়, তবু সত্য। সে এক অনাহূত শক্তি, যাকে প্রতিটি পথিক নিজ নিজ মনের গভীরে সৃষ্টি করে নেয়। কেউ প্রেমে, কেউ অন্ধতায়, কেউ ত্যাগে।” কৌশিক তখন প্রথম বুঝতে পারে, এই পথ শুধু মৃত্যুকে হারাবার নয়, নিজেকে খুঁজে পাওয়ারও। কিন্তু নিজের ভিতরে নামা, নিজের ভয়কে চিনে নেওয়া, তার চেয়ে কঠিন আর কিছু নেই। ঠিক সেই রাতে, সে প্রথম মুখোমুখি হয় ‘ছায়াপুরুষ’-এর, স্বপ্নের ভেতর এক ফুঁসে ওঠা ছায়ামূর্তির, যে বলে—“তুই যে মরতে চাস, সেটা জানি। কিন্তু আমি তোকে বাঁচিয়ে রাখব—যতক্ষণ না তুই আমাকে মেরে ফেলতে পারিস।” সেই স্বপ্নেই সে দেখে একটি দরজা খুলছে—দরজার ওপার থেকে উঠে আসছে পুরনো এক হাসির আওয়াজ, তিলোত্তমার কণ্ঠ। দরজার ওপারেই হয়তো ‘অরুণাচলের তন্ত্র’। কিন্তু তার আগে পার হতে হবে ভয়, ক্ষোভ, শূন্যতা আর নিজের তৈরি কর্ণিক অন্ধকার।
–
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার ছায়া মিশে যাওয়ার ঠিক আগের সময়টা—কাশীর ঘাটগুলো তখন নিঃশব্দ শ্বাসের মতো নিস্তরঙ্গ। কৌশিক মৈত্র সেই সময় বসে ছিল মণিকর্ণিকা ঘাটের এক কোণায়, গঙ্গার ঢেউয়ের সাঁ সাঁ শব্দের মাঝে নিজের নিঃশ্বাসকেও যেন শুনতে পারছিল। ত্রিযাম্বক নাথ সকালেই তাকে বলে গিয়েছিলেন, “আজ রাতে প্রথম দরজা খুলবে। ভয় পাবে, সন্দেহ করবে, পালাতে চাইবে। কিন্তু পালানোর পথ নেই, কৌশিক। কারণ তুমি তো নিজেকেই খুঁজতে এসেছ।” তারপরে সে যে মানসিক অবস্থা নিয়ে ঘাটে বসে ছিল, তা ঠিক উদ্বেগ নয়—এ যেন এক রকমের নিবিষ্ট নিরপেক্ষতা। যাকে বলে ‘চেতন নিঃশব্দ’। সূর্য ডুবতেই কাশীর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল চন্দনের গন্ধ, ভস্মের ধোঁয়া, আর এক প্রাচীন সুর—যেন সহস্র বছর ধরে কেউ কোনো বাঁশিতে একই সুর বাজিয়ে চলেছে, গভীর মনস্তাত্ত্বিক স্তরে থরথর করা কোনো শব্দ। হঠাৎ করেই কৌশিক চোখ মেলল—তার সামনে দাঁড়িয়ে সেই ছায়া, যার মুখ নেই, চোখ নেই, কিন্তু কৌশিক জানে তার নাম ‘ছায়াপুরুষ’। এক বিকৃত ছায়া, যে কথা বলে না—শুধু বলে মনে মনে, যেন নিজের ভিতর থেকে কেউ বলছে, “তুই নিজেরই গল্প ভুলে গেছিস, এখন সেই গল্পটা তোকে আবার লিখতে হবে।”
ঘোর লাগা দৃষ্টিতে কৌশিক খেয়াল করে, সে এখন আর কাশীর ঘাটে নেই। পরিবেশ বদলে গেছে—পেছনে ঘাট, সামনে গভীর অন্ধকারে ডুবে থাকা এক অচেনা ঘর। ঘরটির দেয়াল নেই, ছাদ নেই, শুধু অসীম শূন্যতা, আর মাঝখানে একটি আয়না। আয়নায় কোনো প্রতিবিম্ব নেই। ত্রিযাম্বকের কণ্ঠ যেন দূর থেকে আসে, “এই আয়না তোর চেতনার প্রতিফলন নয়, অবচেতনের দরজা। এখানে যা দেখবি, তা সত্যি—কিন্তু তুই মানবি কি না, সেটাই পরীক্ষার বিষয়।” কৌশিক আয়নার দিকে এগোতেই ভেতর থেকে উঠে আসে এমন সব দৃশ্য, যা সে কখনো ভুলতে চায়নি—মায়ের মৃত্যুর মুহূর্ত, অফিসে সহকর্মীর গলায় চিৎকার, প্রেমিকার মুখে বলা শেষ কথা—“তুই নিজেকে ভালোবাসিস না, তাই কাউকে ভালোবাসতে পারিস না।” এই আয়নায় প্রতিটি ভ্রান্তি, প্রতিটি ব্যর্থতা, প্রতিটি চাপা অপরাধবোধ ধরা পড়তে থাকে, একেকটা যেন ছুরি হয়ে কৌশিকের বুকে বিঁধে যায়। সে পেছাতে চায়, কিন্তু পা চলেনা। আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানেই নিজের ভিতরের ছায়াকে আলিঙ্গন করা, আর সেটাই সবচেয়ে কঠিন। ঠিক তখনই, ছায়াপুরুষ আবার আবির্ভূত হয়। এবার তার মুখ আছে, আর সে কৌশিকের মুখের মতোই দেখতে। সে বলে, “আমি তুই—যে তোর ভুল, লোভ, ভয়, বিষণ্নতা নিয়ে তৈরি। তুই আমায় ভয় পাস, কারণ আমি তোর প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তুই যদি আমায় গ্রহণ করিস, তবে আমি তোকে পথ দেখাব।” এই সংলাপে কৌশিক বুঝতে পারে, যুদ্ধটা বাইরের নয়, একান্ত ভিতরের।
রাত বাড়ে, ঘরের অদৃশ্য দেয়ালগুলো কালো হয়ে ওঠে, যেন চারপাশ থেকে অসংখ্য মুখ ঘিরে ধরছে। তারা চিৎকার করছে না, শুধুই দেখছে—নীরব তিরস্কারের মতো। কৌশিক ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, তার চোখে জল—কিন্তু তা দুর্বলতার নয়, উপলব্ধির। এই উপলব্ধি যে সে তার জীবনের প্রথম সত্যিকারের যুদ্ধটা শুরু করেছে। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি তোকে মানি, ছায়াপুরুষ। তুই আছিস, কারণ আমিও আছি। কিন্তু তুই আমাকে চালাতে পারবি না।” সেই উচ্চারণেই যেন কিছুটা আলো ফোটে। ঘর আবার বদলে যায়। এবার সে নিজেকে দেখতে পায় এক বিশাল পাণ্ডুলিপির সামনে বসে, যার উপর লেখা—অরুণাচলের তন্ত্র: প্রারম্ভ। পাতাগুলি তখনও বন্ধ, কিন্তু পৃষ্ঠার উপর একটা অদৃশ্য শ্বাস চলমান। সেই মুহূর্তে ত্রিযাম্বক আবার আসে, এবার অনেক কোমল স্বরে বলে, “তুই প্রথম দরজা পেরোলি, কৌশিক। কিন্তু সামনে আরও গভীর স্তর, যেখানে বাস্তব আর মায়া মিলেমিশে এক হয়ে যায়। যেখানে তুই ঠিক করবি তুই কে—শরীর, মন, না শুধুই চেতনা।” কৌশিক বুঝতে পারে, সে কেবল একটা বই পড়তে আসেনি, বা এক চিঠির উত্তর খুঁজতে নয়—সে এসেছে নিজেকে ভেঙে গড়ার জন্য। আর সেই গড়নের যন্ত্রণা এবার শুরু হলো সত্যিকারের তান্ত্রিক প্রবেশের মধ্য দিয়ে।
–
রাত গভীর হলে কাশীর বাতাসের চরিত্র বদলে যায়—ধূপের গন্ধ থেমে গিয়ে ভেসে আসে ঘাটে পোড়া কাঠের ধোঁয়া, শবের ছায়া, আর বাতাসে ছড়িয়ে থাকা এক ধরনের মৃদু কান্নার শব্দ, যাকে চট করে কেউ ধরতে পারে না। সেই রাতেই কৌশিক মৈত্রর সামনে ত্রিযাম্বক দাঁড়ালেন এক রক্তবর্ণ চাদরে মোড়া হয়ে, হাতে এক তাম্রপাত্র। বললেন, “আজ শুরু হবে তোর দ্বিতীয় প্রবেশ—অগ্নিমুদ্রা। আগুন শুধুই দাহ করে না, সে রূপান্তরও ঘটায়। কিন্তু তার আগে তাকে নিজে স্পর্শ করতে হয়, পোড়াতে দিতে হয় সমস্ত সংবেদনা। চল।” কোনো প্রশ্ন না করে কৌশিক উঠে দাঁড়াল। আশ্রম থেকে দক্ষিণ দিকে একটা সরু গলি ধরে তারা এগিয়ে গেল অনেকটা পথ। সেই গলির শেষে দাঁড়িয়ে ছিল এক ধ্বংসস্তূপের ভিতরকার ছোট্ট শ্মশান, যেটাকে কেউ চেনে না, কেউ ব্যবহার করে না। তার মাঝখানে ছিল এক অগ্নিকুণ্ড—আগুন তখনও জ্বলছিল, যেন তাদের অপেক্ষাতেই। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঠের গুঁড়ি, পোড়া ছাই, আর ঠিক মধ্যিখানে বসে ছিল একজন নারী—চোখ বুজে, আগুনের দিকে হাত ছুঁয়ে রাখা, সারা গায়ে ছাই আর অশ্রুর দাগ। কৌশিক থমকে গেল। ত্রিযাম্বক বললেন, “ও তোরই মনের এক মুদ্রা—যা না জানিস, না মানিস, কিন্তু তোর ভিতরে লুকিয়ে ছিল বহুদিন।” সেই নারীর নাম তিলোত্তমা। আবার সে ফিরে এসেছে—কিন্তু এবার কোনো স্মৃতির রূপে নয়, এক জ্যান্ত মূর্তির মতো।
তিলোত্তমা চোখ খুলে চেয়ে রইল কৌশিকের দিকে—চোখে কোনো অভিমান নেই, ভালোবাসাও নয়—একধরনের নির্মম নির্লিপ্তি, যা সমস্ত হিসেব ছাপিয়ে যায়। সে বলল, “তুই আমায় অনেকবার স্বপ্নে দেখেছিস। ভেবেছিস আমি হারিয়ে গেছি। কিন্তু তুই কি কখনো নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিস, আমি কেন হারিয়ে গেছিলাম?” কৌশিক চুপ করে থাকে, কারণ তার মুখে কোনো উত্তর নেই। সে শুধু বোঝে, এই নারী একসময় তার জীবনে ছিল, হারিয়েও গেছে, কিন্তু মনের ভেতরে যে ঘুণ ধরে ছিল—তা আজও পচে আছে। তিলোত্তমা আবার বলে, “এই আগুন শুধু তোর ব্যর্থতাগুলোর সাক্ষী নয়, এ তোর কামনা, ভয়, ঈর্ষা, অবসাদ—সবকিছুর প্রতিচ্ছবি। তুই যদি সত্যিই তন্ত্রের পথে যেতে চাস, তাহলে এই আগুনে ঢুকতে হবে, পোড়াতে হবে সেই কৌশিককে, যে আর বাঁচতে চায় না।” ত্রিযাম্বক তখন একটা মুদ্রা বের করে দেন—তামার তৈরি, তাতে আঁকা অগ্নিসূর্য ও আটটি অক্ষর, যা সাধারণ চোখে পড়েই না। তিনি বলেন, “এই অগ্নিমুদ্রা তোর অন্তর-আগ্নিকুণ্ড খুলে দেবে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখ—যা দেখবি, তা বিশ্বাস করবি না; আর যা বিশ্বাস করবি, তা দেখতে পাবে না।” কৌশিক মুদ্রাটি হাতে নিতেই তার ভিতরে হঠাৎ এক চোরা তাপ ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই সে আর আগুনের বাইরে থাকে না—সে ঢুকে পড়ে এক অদ্ভুত রক্তবর্ণ জগতের ভেতর, যেখানে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা ঘোলাটে।
সে দেখতে পায় নিজেকে একটা শূন্য ঘরে—দেয়ালে আগুন জ্বলছে, কাঁচের জানালায় তারই ছায়া বারবার রক্তাক্ত হয়ে ভেঙে পড়ছে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিলোত্তমা—এবার একেবারে ভিন্ন রূপে। সে নগ্ন, চোখে আগুন, ঠোঁটে ছায়া, আর কণ্ঠে এক মায়াবী সুর—যা ভয় ও আকর্ষণকে একসাথে ডাকে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলে, “তুই চেয়েছিলিস আমায়, কিন্তু ভালোবাসতে পারিসনি। তুই পেয়েছিলি, কিন্তু ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছিস। এখন এই আগুনে শুধু আমাকে নয়, নিজেকেও পোড়াতে হবে।” তারপর ঘরজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কৌশিক জ্বলতে থাকে, কিন্তু শরীরে নয়—তার ভিতরের অতীত, স্মৃতি, অপরাধবোধ সবকিছু ধ্বংস হতে থাকে সেই আগুনে। সে চিৎকার করে, কাঁদে, কিন্তু অবশেষে চোখ খুলে দেখে—তিলোত্তমা নেই, আগুন নেই, কেবল সে বসে আছে শ্মশানের ধারে, হাতে সেই মুদ্রা—এবার তার রঙ বদলে গেছে। আগুনের লাল থেকে একরকম ধাতব সোনালি আলো বেরোচ্ছে। ত্রিযাম্বক বলেন, “তুই অগ্নিমুদ্রার মধ্য দিয়ে পেরোলি। কিন্তু মনে রাখিস—তিলোত্তমা এখন থেকে তোকে পরীক্ষা করবে, তোর প্রতিটি সিদ্ধান্তে। কারণ সে এখন তোর অন্তর্গত কামনাশক্তির রূপ।” কৌশিক মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার শরীর কাঁপে না, চোখে জল নেই। শুধু একটা অদ্ভুত নিশ্চিন্ততা, যেন কিছু পুড়ে শেষ হয়ে গেছে—আর যা পড়ে আছে, তা নিখাদ সত্য।
–
ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি এক সময় থাকে, যেখানে শব্দ ঢোকে না, আলো আর অন্ধকারের তফাৎ থাকে না—সেই অনির্বচনীয় স্তরেই ঢুকে গিয়েছিল কৌশিক। আগুনের মধ্য দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলার পর তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ফুরিয়েছে—একটা দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন, এক ক্লান্তিময় দ্বন্দ্ব। কিন্তু তার জায়গা নিচ্ছিল এক অজানা নিরবতা, যার ভিতরে কোনো ভাবনা আসে না, ভয়ও আসে না, এমনকি নিজের অস্তিত্বের চিহ্নও অনুপস্থিত থাকে। সে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে এক মহাশূন্যে, যেখানে সময় দাঁড়িয়ে আছে, আর সমস্ত অনুভূতি থেমে গেছে। সেই নিঃশব্দতার মধ্যেই হঠাৎ সে অনুভব করল—একটা দরজা। দরজাটা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভবে তার অস্তিত্ব স্পষ্ট—একটা বদ্ধ কাঠের দরজা, যার ওপারে কিছু লুকিয়ে আছে। ত্রিযাম্বকের কণ্ঠ, ধীর ও নিঃসাড়ভাবে বলে উঠল, “এবার তুই দাঁড়িয়েছিস নিজের সামনে। দরজার ওপারে কিছু নেই, আবার সবকিছু। এই দরজা খুলবে তখনই, যখন তুই নিজের সব প্রশ্ন ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শুধু উপলব্ধি করবি।”
সেই মুহূর্তে কৌশিক নিজেকে দেখতে পেল এক বিশাল শ্বেত পটভূমিতে, যেখানে চারপাশ জুড়ে শুধু কুয়াশা, কুয়াশার ভেতর তার নিজের প্রতিকৃতি—শুধু একটাই নয়, অসংখ্য। প্রতিটি প্রতিকৃতি একেকটা মুহূর্তের কৌশিক—একটা কাঁদছে, একটা হাসছে, একটা হিংস্র, একটা মৃতপ্রায়। তারা সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন এক নিরব বিচারের আসরে সে অভিযুক্ত। তাদের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কৌশিক নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে—“আমি কি সেই যে ভালোবাসতে পারেনি, না কি যে ভালোবাসা পাওয়ার অযোগ্য ছিলাম? আমি কি সেই যে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, না কি সত্যিই মরতে চেয়েছিলাম?” প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর আসে না, শুধু সেই প্রতিকৃতিগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, যেমন মানুষের স্মৃতি হালকা হতে হতে একসময় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। হঠাৎ কৌশিক বুঝতে পারে, সে যত উত্তর খুঁজছে, ততই দরজাটা দূরে সরে যাচ্ছে। সে থেমে যায়। শ্বাস নেয়। মনে করে ত্রিযাম্বকের বলা কথা—“তোর সত্য কোনো উত্তর নয়, তোর সত্য তুই নিজেই।” তখন সে আবার দরজাটার দিকে ফিরে দাঁড়ায়, চোখ বন্ধ করে, আর মনে মনে বলে, “আমি কৌশিক মৈত্র—না ভালো, না খারাপ, না আলোর, না অন্ধকারের। আমি শুধু এক খোঁজ।”
এই স্বীকারোক্তি ছিল দরজার জন্য চাবি। কৌশিক চোখ খুলতেই দেখে, দরজাটা আর নেই—সে নিজেই দরজা হয়ে গেছে। তার সামনে এক প্রশস্ত ধ্যানকক্ষ, যার মাঝে ভাসছে “অরুণাচলের তন্ত্র”-এর মূল পাণ্ডুলিপি, আগুন ও ছায়ার মাঝে ধুলোমাখা শব্দেরা একে একে জেগে উঠছে, যেন হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকা সত্তাগুলো আরেকবার কথা বলতে শুরু করেছে। ত্রিযাম্বক তার পাশে এসে দাঁড়ান—এবার তার মুখে এক ধরনের গর্ব, কিন্তু চুপচাপ। তিনি শুধু বলেন, “দরজার ওপারে আর কেউ তোকে পথ দেখাবে না। এবার পথ তুই তৈরি করবি। এখন থেকে তুই নিজেই নিজের ত্রাতা, নিজেই নিজের বিধ্বংসী।” কৌশিক ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতায় হাত রাখে। চামড়ার মতো শক্ত, কিন্তু স্পর্শেই কেঁপে ওঠে। তার চোখের সামনে দেখা দেয় এক অদ্ভুত প্রতীক—বৃত্তের ভেতরে এক বিন্দু, আর তার চারপাশে ছয়টি আঁচড়—যা নাকি মানুষের চেতনার ছয় স্তর বোঝায়: বাসনা, ভয়, মায়া, স্মৃতি, অভিমান, আর আত্মপ্রবঞ্চনা। এই ছয়টিকে অতিক্রম করলেই জন্ম নেয় সপ্তম স্তর—নির্বাণ। এবং কৌশিক জানে, তার যাত্রা এখন সেই সপ্তম স্তরের খোঁজেই শুরু হতে যাচ্ছে।
–
চেতনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা যে জগৎ, তার মূল স্তরগুলোকে একত্রে বলা হয় ‘সপ্তচেতনা’—ত্রিযাম্বক নাথ কৌশিককে এক গভীর ধ্যানাবস্থার মধ্যে প্রবেশ করানোর আগে বলেছিলেন, “এই সাত স্তরের প্রতিটি হল এক-একটি বন্ধ দরজা। দরজা খুলতে হবে ভিতর থেকে। বাইরে থেকে কেউ পারবে না।” সেই রাতেই, তন্ত্রপাঠের প্রথম পাঠের পর কৌশিক ঢুকে পড়ে প্রথম স্তরে—বাসনার বলয়ে। ঘরটা আবছা আলোয় ভরে থাকে, যেন আগুন আর সোনালি ধূপ একসঙ্গে মিশেছে বাতাসে। ঘরের মাঝখানে সে দেখতে পায় একটি আয়না, তার সামনেই বসে আছে তিলোত্তমা—এবার স্পষ্ট, সজীব, উষ্ণ। সে বলে, “তুই তন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছিস, কিন্তু এখনো তো বাসনার থেকে মুক্ত না। যদি মুক্তি পেতে চাস, আগে চাইতে শিখতে হবে। সত্য চাওয়া ছাড়া কিছুই ফেলে রাখা যায় না।” কৌশিক বুঝতে পারে, এই স্তরে তার সব ইন্দ্রিয় তাকে পেছনে টেনে নিতে চাইবে। ঘর ঘিরে উঠতে থাকে পুরনো স্মৃতি—প্রেম, শরীর, লোভ, আকাঙ্ক্ষা—যা একদিকে কোমল, অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক। কিন্তু হঠাৎ সে নিজেকে বলে, “বাসনা মানেই পাপ নয়। বাসনা আমারই এক রূপ, কিন্তু আমি তা নই।” সেই উচ্চারণে চারপাশের দৃশ্য মিলিয়ে যায়, সে ঢুকে পড়ে দ্বিতীয় স্তরে—ভয়ের বলয়ে।
এখানে বাতাস নেই, আলো নেই—আছে শুধু অন্ধকার আর শীত। কৌশিক অনুভব করে এক চাপা শ্বাসরোধকারী বৃত্ত, যেন তার বুকের মধ্যে কেউ বসে আছে। সামনে হঠাৎ জ্বলে ওঠে একটি দৃশ্য: এক অন্ধকার সিঁড়ির গায়ে সে নিজেকে দেখতে পায়—মায়ের মৃত্যুর দিন, তার নিজের ব্যর্থতা, আত্মহত্যার চেষ্টা—সব একসাথে ফিরে আসে। এখানে ভয় চুপ করে বসে নেই—এ ভয় ছায়াপুরুষের রূপ ধরে, তার মুখেই কৌশিকের গলা, তার চোখে তিলোত্তমার অস্বীকৃতি। সে বলে, “তুই পালাতে চাস, কারণ তুই জানিস তুই কিছুই না। আমি তোর ভেতরের কণ্ঠ, আমি বলি, তুই ব্যর্থ, তুই মূল্যহীন।” কিন্তু এবার কৌশিক ভয়কে চিৎকার করে বলে, “তুই আমার ভিতরের শব্দ, আমার সত্য নও। আমি তোর অস্তিত্ব মানি, কিন্তু তোর দাস নই।” সেই স্বীকারোক্তি ভয়ের বৃত্ত ভেঙে দেয়, সে প্রবেশ করে তৃতীয় স্তরে—মায়ার বলয়ে।
এখানে পৃথিবীটা স্বপ্নের মতো—চারপাশের দৃশ্য মনোরম, যেন তার সমস্ত ইচ্ছের প্রতিফলন: মা ফিরে এসেছে, পুরনো প্রেমিকা পাশে বসে, ত্রিযাম্বক তার পিঠ চাপড়ে বলছেন, “তুই পারিস।” কিন্তু কৌশিকের ভিতরের আরেক চোখ বলে, “এইসব এত সহজ হতেই পারে না। এ শুধু প্রতারণা।” তিলোত্তমা এবার আসে এক আশীর্বাদীর বেশে, বলে, “এটাই তো তোর কাঙ্ক্ষিত জীবন। এটাই সত্যি হতে পারত, যদি তুই আমাকে আঁকড়ে ধরতে পারতি।” কৌশিক এবার এক গভীর ধৈর্যে বলে, “সত্যিই যদি এটা আমার হয়, তবে এ আসত বাস্তবে—not in illusion.” সেই সাথে চারপাশ ভেঙে পড়ে। মায়ার দরজা পেরিয়ে সে আসে চতুর্থ স্তরে—স্মৃতির বলয়ে, যেখানে কুয়াশার মধ্যে ঝাপসা হয়ে থাকা পুরনো দিনের শব্দেরা ফিরে আসে—বাবার অপমান, সহপাঠীদের বিদ্রুপ, নিজের গালাগালি দেওয়া প্রতিচ্ছবি।
এভাবেই কৌশিক একে একে অতিক্রম করে অভিমান ও আত্মপ্রবঞ্চনার স্তর—প্রতিটি স্তরে তাকে মুখোমুখি হতে হয় এমন কণ্ঠের, এমন মুখের, এমন মিথ্যার, যা তাকে সারা জীবন চালিত করেছে। আত্মপ্রবঞ্চনার স্তরে এসে সে অনুভব করে যে সে আসলে নিজেকে কষ্ট দিতে পছন্দ করত, কারণ তাতেই সে ‘বিশেষ’ মনে করত নিজেকে—এক ধরনের গোপন অহংকার। কিন্তু সেই অহংকারই ছিল তার আত্মবিনাশের বীজ। সে এবার তা মেনে নেয়। আত্মদ্রোহী কৌশিক প্রথমবার নিজেকে জড়িয়ে ধরে, বলে—“আমি যা ছিলাম, তা আমার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন আমি যা হব, তা আমার সিদ্ধান্ত।” সেই মুহূর্তে সপ্তম স্তরের দরজা খুলে যায়—নির্বাণের কক্ষ, যেখানে আলো নেই, অন্ধকারও নেই—শুধু এক গভীর নিস্তব্ধতা, এবং সেখানে বসে থাকে এক ছায়ামূর্তি—তিলোত্তমা নয়, ত্রিযাম্বক নয়—বরং সেই কৌশিক, যে সবকিছু পেরিয়ে এখানে পৌঁছেছে। তারা মুখোমুখি বসে থাকে অনেকক্ষণ, কেউ কিছু বলে না। কারণ শেষ স্তরে ভাষা অপ্রয়োজনীয়—শুধু উপলব্ধি থাকে, চেতনার নিরব চুম্বকীয় টান থাকে। কৌশিক জানে, সে ফিরে যাবে হয়তো আগের দুনিয়ায়, কিন্তু আর আগের মানুষ হয়ে নয়।
–
ভোরবেলার আলো আস্তে আস্তে ছুঁয়ে দিচ্ছিল মণিকর্ণিকা ঘাটের পুরোনো পাথরগুলো—সেই আলোর ভিতর দিয়ে উঠে আসছিল একটা নতুন শ্বাস, যেন কোনো দীর্ঘ শীতের পর বসন্ত এসে গিয়েছে অচিরেই। সেই শ্বাসেই ধীরে ধীরে চোখ মেলে কৌশিক মৈত্র। সে ঠিক কোন অবস্থায় ছিল, কতক্ষণ ছিল, তার মনে নেই। মনে আছে শুধু অসংখ্য স্তর অতিক্রম করার একটা ঝাপসা অনুভব—মনে আছে তার চোখের সামনে দরজা ছিল, ছায়া ছিল, আগুন ছিল, আর শেষে ছিল এক অপার নিস্তব্ধতা। সে যেখানে বসে ছিল, সেই কক্ষ এখন ফাঁকা। ত্রিযাম্বক নেই, তিলোত্তমা নেই, কোনো তান্ত্রিক চিহ্ন নেই। যেন কিছুরই অস্তিত্ব কোনোদিন ছিল না। কিন্তু তার মনের মধ্যে, শরীরের প্রতিটি কোষে, সে জানে—সব ছিল। সে উঠে দাঁড়ায়। তার শরীর কাঁপছে না, চোখে কোনো বিভ্রম নেই—এক ধরনের স্থিরতা, যেন ভেতরের রক্তজলে ধুয়ে নেওয়া হয়েছে সব দাগ। বাইরে চড়াই-উৎরাই, কিন্তু ভেতরে এক সমুদ্রশান্তি।
কাশীর সেই গলিগুলোর মধ্য দিয়ে হেঁটে চলা যেন অনেক সহজ হয়ে গেছে। যেই শহর একদিন তাকে গিলে ফেলতে চেয়েছিল, আজ তার পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে রাস্তায় একসময় সে দাঁড়িয়ে হতাশায় নিজেকে হীন মনে করত, আজ সেখানেই দাঁড়িয়ে সে এক অজানা উপলব্ধিতে বলে—“তুমি যা আমাকে দিয়েছ, তার জন্য ধন্যবাদ। আর যা কেড়ে নিয়েছ, তার জন্যও।” রিকশা ডেকে সে পৌঁছায় স্টেশনে। ট্রেনের টিকিট কাটার সময় সে ভাবে, এতদিন পর একটা ফিরতি যাত্রার কথা ভাবতে পারছে। কিন্তু তার এই ফেরা, আগের জীবনে ফেরা নয়—এই ফেরা এক অভ্যন্তরীণ পরিক্রমার পর, যেখানে সে ফিরে দেখবে পুরনো পৃথিবীটাকে নতুন চোখে, নতুন উপলব্ধিতে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়, তাদের মুখে হিংসা, ভালোবাসা, ক্লান্তি, আশা—সবকিছু তাকে স্পর্শ করলেও ছুঁয়ে যেতে পারে না। সে জানে, তার ভিতরে এখন এমন এক স্তর জেগে উঠেছে, যাকে আর কেউ ডুবিয়ে দিতে পারবে না।
ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে কৌশিক জানালার পাশে বসে পড়ল। তখনই তার পকেটে রাখা একটা পুরনো কাগজের টুকরো চোখে পড়ে—সেই চিঠি, তিলোত্তমার লেখা। কিন্তু এবার কাগজটা খুলে সে দেখে, সেখানে কোনো শব্দ নেই। শুধু সাদা কাগজ। মনে হয়, লেখা কিছু ছিলই না—অথবা, যা ছিল, তা সে পড়ে ফেলেছে নিজের ভিতর দিয়ে। হঠাৎই কৌশিকের মনে হয়, তিলোত্তমা কখনো একজন মানুষ ছিল না—সে ছিল এক তত্ত্ব, এক প্ররোচনা, এক ছায়া, যা তাকে ভিতর থেকে ধাক্কা দিয়ে সজাগ করেছে। ত্রিযাম্বকও হয়তো কোনো বাস্তব চরিত্র ছিল না, বরং এক ‘মহাজ্ঞাতা চেতনা’—যে মানুষের ভিতরের গুরু, যে কেবল তখনই জাগে, যখন ছাত্র প্রস্তুত হয়। এই ভাবনার ভেতর দিয়েই ট্রেন ছাড়ে—ধীরে ধীরে, চাকার শব্দে এক ধরনের ধ্যান জাগে মনে। কৌশিক জানে, তার জীবন একই রকম থাকবে না। সে হয়তো অফিসে ফিরবে, হয়তো নতুন করে বাঁচবে, হয়তো প্রেমও করবে আবার। কিন্তু সে আর আগের মতো হবেনা—সে নিজেকে জানে। এবং নিজেকে চেনে বলে, পৃথিবীর কোনো অস্ত্র, কোনো ব্যর্থতা, কোনো ছায়া আর তাকে দেবে না পরাজয়ের ভয়।
–
কলকাতায় ফিরে আসার পরে কৌশিক মৈত্রর জীবনের ছন্দে বাহ্যিক কিছুই বদলায়নি—সেই পরিচিত রাস্তা, কফি মগের তলায় জমে থাকা আধপোড়া সিগারেট, অফিসের ম্লান আলো আর মানুষের পরিচিত মুখ। কিন্তু ভিতরের কিছু একেবারেই বদলে গেছে। প্রতিটি দিনের মধ্যে সে এখন খুঁজে পায় এক ধরনের ‘বিস্তৃত নিরবতা’—যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়, নিজের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি শ্বাসে। কিন্তু এই নতুন উপলব্ধির মাঝেও তার ভিতরে একটা প্রশ্ন দিনরাত ঘোরে—ত্রিযাম্বক কোথা থেকে এলেন? আর কেন তার ছায়াটুকুও রইল না? কয়েকদিন পর, ঠিক একটা ভোরবেলা, কৌশিক ঠিক করল—সে ফিরবে কাশীতে। আবার। কিন্তু এবার মনের মধ্যে আর কোনো আগুন নেই, শুধুই এক গভীর, মৃদু কৌতূহল। সে মনে মনে ভাবছিল—যে মানুষ তার ভিতরের সব ভয়, ছায়া, অভিমান, বাসনা ভেঙে দিয়ে তাকে মুক্তির পথে পৌঁছে দিল, সে কি সত্যিই কোনো বাস্তব মানুষ? নাকি কৌশিকের চেতনা নিজেই তার মতো এক মূর্তি তৈরি করেছিল?
কাশীতে ফিরে সে ‘শ্রীপঞ্চদশী গ্রন্থাগার’-এর পথ ধরল ঠিক আগের মতোই। কিন্তু এবার পথ যেন আরো সরু, আরো অপরিচিত মনে হলো। যখন সেই স্থানটিতে পৌঁছল, তখন সে দাঁড়িয়ে পড়ে চমকে যায়—গ্রন্থাগার নেই। যেখানে আগে সেই কালো দরজা আর পাথরের ধূসর দেওয়াল ছিল, এখন শুধু একটা বন্ধ ঘর, দেওয়ালে তালা, উপরে ধূলোমাখা একটা পাটকাঠির বোর্ড, তাতে লেখা—”ভগ্ন ইমারত, প্রবেশ নিষেধ।” এক পাশে একটা বৃদ্ধ দারোয়ান বসে। কৌশিক কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এইখানে কি শ্রীপঞ্চদশী গ্রন্থাগার ছিল?” বৃদ্ধ একবার তাকিয়ে হেসে বলল, “এই নামের কোনো জায়গা তো এখানে ছিল না বাবু। আমি তো চল্লিশ বছর ধরে এখানেই আছি।” কৌশিক নির্বাক। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। অথচ সে তো এখানে বসেই পাণ্ডুলিপি ছুঁয়েছে, ছায়ার সামনে দাঁড়িয়েছে, নিজেকে পুড়িয়ে ফেলেছে। তাহলে সেগুলো কি শুধুই মনের প্রতিফলন ছিল? কিন্তু তার মনের যে সেই অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার নয়, তার শরীরই তার সাক্ষ্য দেয়।
সেই সন্ধ্যায়, নিরাশ মনে গঙ্গার ধারে বসেছিল কৌশিক। ঠিক তখনই এক ঋষিপ্রতিম ব্যক্তি পাশের সিঁড়িতে এসে বসেন। মাথায় মাটির রঙের পাগড়ি, হাতে কাঠের মালা। কৌশিকের দিকে না তাকিয়ে তিনি বলেন, “যাকে তুই খুঁজিস, সে তো তোকে খুঁজেই এসেছিল। তুই তখনও প্রস্তুত ছিলি না জানার জন্য, তাই সে রূপ ধরেছিল। এখন তুই জানিস, তাই সে আবার রূপহীন হয়ে গেল।” কৌশিক অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকায়। প্রশ্ন করতে চায়—“আপনি কে? আপনি ত্রিযাম্বক নন তো?” কিন্তু তাঁর দিকে চেয়ে সে কিছু বলে না। কেননা সে হঠাৎ উপলব্ধি করে—এই মানুষটার মধ্যে ত্রিযাম্বকের কোনো বাহ্যিক চিহ্ন নেই, কিন্তু উপস্থিতি আছে। তন্ত্রের পথ এমনই—গুরু রূপ ধরে না, চেতনায় গড়ে ওঠে। এবং যখন শিষ্য প্রস্তুত হয়, তখন গুরু আপনিই দূর হয়ে যান, নিজের অস্তিত্ব রেখে নয়—উপলব্ধির ভিতরে রূপান্তর ঘটিয়ে।
রাত গভীর হলে কৌশিক আবার ফিরে যায় সেই বন্ধ ঘরের সামনে। এবার সে কিছু খোঁজে না। তালা খুলতে চায় না, দরজায় ধাক্কাও দেয় না। শুধু একবার হাত রাখে সেই পাথরের গায়ে। স্পর্শে কাঁপে না কিছুই, আলো জ্বলে না, কোনো অলৌকিক ঘটেও না। কিন্তু তার বুকের ভেতরে একটা শব্দ ভেসে ওঠে—একটিমাত্র শব্দ, নিঃশব্দে উচ্চারিত—“তুই জানিস।” কৌশিক জানে, এই জানাটাই শেষ চিহ্ন। ত্রিযাম্বকের অন্তর্ধান মানে হলো, কৌশিকের নিজের ভিতরের ত্রিযাম্বক জন্ম নিয়েছে। এই জ্ঞান বহন করে সে ফিরে যাবে জীবনে—অন্ধকারে আলো নিয়ে নয়, আলোর নিচে নিজের ছায়াকে চিনে নিয়ে।
–
তিলোত্তমা—এই নামটা কৌশিকের জীবনে যেন এক ধোঁয়াশার মুদ্রা, যার একদিকে প্রেম, অন্যদিকে প্রতারণা; একদিকে আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে অস্বীকৃতি। কাশী থেকে ফিরে আসার পরে সে যতই নিজের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছে, তিলোত্তমার উপস্থিতি ততই ঘনীভূত হয়ে উঠেছে তার প্রতিটি অনুভবের প্রান্তে। কোনো এক অলিখিত যুক্তিতে সে অনুভব করতে থাকে—তিলোত্তমা কেবল একটি মানুষ নয়। বরং সে যেন এক বহুমাত্রিক রূপ—প্রতিটি অনুভবের পেছনে, প্রতিটি বিকারের ভিতরে, সে নিজেকে ছায়ার মতো বিছিয়ে রেখেছে। একরাতে, ঘুমের অদ্ভুত প্রহরে, কৌশিক ঢুকে পড়ে এক অচেনা জায়গায়—এটা কোনো বাস্তব শহর নয়, না-ও পুরোটাই স্বপ্ন। সে দেখতে পায় এক বৃত্তাকারে সাজানো তিনটি দরজা, প্রতিটির গায়ে লেখা—”ইচ্ছা”, “ভ্রান্তি”, ও “নির্জনতা”।
প্রথম দরজায় সে ঢোকে, “ইচ্ছা”—সেখানে তিলোত্তমা তাকে স্বাগত জানায় তার কলেজ-বয়সের রূপে। সে হাসছে, ঝলমলে, প্রাণোচ্ছল—যে তিলোত্তমার চোখে ছিল কৌশিকের জীবনের প্রথম উজ্জ্বল প্রতিফলন। এখানে তারা কথা বলে, হাত ধরে হাঁটে, এমনকি সেই অসমাপ্ত চুম্বনের স্মৃতিও ফিরে আসে। কিন্তু হঠাৎ করেই তিলোত্তমা বলেই ফেলে, “তুই তো আমায় ভালোবাসিসনি। তুই চেয়েছিলি আমাকে নিজের মতো করে পেতে। তোর বাসনা আমার স্বাধীনতাকে ভেঙে ফেলত।” সেই উচ্চারণে মুহূর্তেই দৃশ্য বদলে যায়—আলোকোজ্জ্বল ইচ্ছার তিলোত্তমা পরিণত হয় এক দাবির, শর্তের, আর আত্মমোহের ছায়ায়। কৌশিক বুঝতে পারে, এই তিলোত্তমা ছিল তার কামনার নির্মাণ—যার রূপ সুন্দর, কিন্তু ভিত্তি ভাঙা। সে ধীরে পেছন ফিরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
দ্বিতীয় দরজাটি “ভ্রান্তি”—এখানে সে দেখে এক তিলোত্তমাকে, যিনি এক মায়ের মতো তার কাঁধে হাত রাখেন, কৌশিকের ব্যর্থতা নিয়ে রাগ করেন না, বরং তাকে ক্ষমা করেন বারবার। তিনি বলেন, “তুই যা ভুল করিস, তাতে আমি আছি।” এই রূপে কৌশিক নিজেকে নিরাপদ মনে করে। সে ভাবে—এটাই সত্য তিলোত্তমা, যে তাকে ছুঁয়ে ছায়া হয়ে থাকত সব সময়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেই তিলোত্তমার মুখ বদলে যেতে থাকে—স্নেহের জায়গায় আসে অবজ্ঞা, দৃষ্টির গভীরে জমে ওঠে ক্লান্তি, তারপর বিরক্তি। তিলোত্তমা ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “তুই আমাকে মায়ের মতো করেছিস, যাতে তুই নিজের ব্যর্থতাকে দায় না দিতে পারিস। তুই আমার কোলে মাথা রাখিস, কিন্তু কোনোদিন মাথা তুলিস না।” এই কথা যেন কৌশিকের ভিতরে আঘাত করে। সে বুঝতে পারে—এই দ্বিতীয় ছায়া ছিল আত্মপ্রবঞ্চনার, মমতার মুখোশ পরে থাকা এক সহনশীল ভ্রান্তি।
শেষ দরজাটি “নির্জনতা”—এখানে কৌশিক একা। চারদিকে শুধু ধূসর কুয়াশা। হঠাৎ সেই কুয়াশার ভিতর থেকে উঠে আসে তিলোত্তমার তৃতীয় রূপ—এই রূপে সে নিঃশব্দ, চোখে অদ্ভুত শীতল আলো, মুখে না বিদ্বেষ, না ভালোবাসা—শুধু নিঃস্পৃহ দৃষ্টি। সে বলে, “আমি তোর নিঃসঙ্গতা। আমি তোর চুপ থাকা, তোর না বলা শব্দ। তুই যেদিন থেকে নিজেকে ভাঙতে শুরু করেছিলি, সেদিন থেকেই আমি ছিলাম। আমি প্রেম নই, আমি প্রত্যাখ্যান নই—আমি তোর অস্তিত্বের নির্জন সত্তা।” এই কথা শুনে কৌশিকের গা দিয়ে ঠান্ডা ঘাম নামে। কিন্তু সে এবার পেছনে ফিরতে চায় না। সে তিলোত্তমার দিকে এগিয়ে যায়। বলে, “তুই তিনজন। আমি তোকে খুঁজেছি প্রথম রূপে, ভুল করেছি দ্বিতীয় রূপে, কিন্তু পেয়েছি তৃতীয় রূপে। আমি তোর প্রেমিক নই, আমি তোর যাত্রী।” এবং সেই উচ্চারণের সাথে সাথে সবকিছু মিলিয়ে যায়—তিন দরজা, তিন ছায়া, তিন রূপ—সব যেন কৌশিকের অন্তঃসত্তায় এক হয়ে গলে যায়।
সে আবার জেগে ওঠে নিজের বিছানায়। জানালার বাইরে শহর। ভোরের আলো কাগজের মতো পাতলা। কিন্তু তার চোখে আর কোনো খোঁজ নেই—কারণ সে জানে, তিলোত্তমাকে পাওয়া মানে কোনো মানুষকে পাওয়া নয়, বরং নিজের ভিতরের তিনটি রূপকে চিনে নেওয়া। এবং তাদের মধ্যে দিয়ে নিজেকে ছুঁয়ে ফেলা।
–
মুক্তি শুধু জ্ঞান নয়, মুক্তি হলো চূড়ান্ত বিসর্জন—এই কথাটা কৌশিক বুঝতে শুরু করেছিল তিলোত্তমার তিন ছায়া অতিক্রম করার পরে। কিন্তু বুঝতে পারা আর বাস্তবে সেই পথে হাঁটা এক জিনিস নয়। তন্ত্র বলছে—শেষে সবকিছু ছাড়তে হয়, এমনকি নিজের পরিচয়ও। কৌশিক জানে, সে এখনও নিজের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব আঁকড়ে ধরে আছে—সে এখনো “আমি” শব্দটা মুছে ফেলেনি। আত্মবিসর্জনের সাধনা মানে নিজের অস্তিত্বের শেষ শ্বাসে দাঁড়িয়ে থাকা। কাশীর সেই শ্মশান-ঘাট, যেখানে সে একবার আগুনের মুদ্রা ধারণ করেছিল, সেইখানেই সে ফিরে যায়। ভরা দুপুরের রোদ মাথায়, কিন্তু তার মন নিস্তব্ধ। চারদিকে সাদা কাপড় পরা কিছু শবদেহ, জ্বলতে থাকা কাঠের স্তূপ, আর গঙ্গার ধারে বসে থাকা মৌন পুরোহিত। কৌশিক সেখানে বসে পড়ে, একাকী। আজ কোনো গুরু নেই, কোনো চিহ্ন নেই—শুধু একটা কল্পিত প্রশ্ন তার হৃদয়ের ভিতর ঝড় তুলছে—“আমি কে?”
সে চোখ বন্ধ করে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে গভীর করে। প্রথমে সে নিজের শরীর অনুভব করে—তপ্ত, ক্লান্ত, জীবনের ভারে স্লান। তারপর একে একে সে মন ঘাঁটে—বাসনার স্তর, ভয়, প্রতারিত হওয়া, আত্মপ্রবঞ্চনা, প্রতিটি স্তর। সে দেখতে পায় একেকটা পরিচয় ভেসে উঠছে—ছোটবেলার কৌশিক, প্রেমিক কৌশিক, ব্যর্থ চাকরিজীবী কৌশিক, আত্মহত্যাপ্রবণ কৌশিক, গুরুর শিষ্য কৌশিক। তারা সবাই যেন তার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে, তাকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু কৌশিক শুধু চোখ বন্ধ করে মৃদু স্বরে বলে—“তোমরা সবাই আমার অংশ, কিন্তু আমি তোমাদের কেউ নই।” একবার, দু’বার, বারবার সে উচ্চারণ করে এই বাক্য, যতক্ষণ না সমস্ত পরিচয়ের ছায়াগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে, এক গভীর শূন্যতায়। এই শূন্যতা প্রথমে ভয়ঙ্কর মনে হয়—কেননা এখানে কেউ নেই, কিছু নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই শূন্যতা হয়ে ওঠে পরম আশ্রয়—যেখানে সে নিজেকে অনুভব করে না, বরং এক সমগ্রতাকে অনুভব করে।
তার দেহ নিস্তব্ধ, চোখ দুটো শান্ত, কপালে গঙ্গার বাতাস। তখনই, যেন খুব দূর থেকে এক কণ্ঠ ভেসে আসে—ত্রিযাম্বকের কণ্ঠ, যিনি বলে ওঠেন, “এটাই তোর মৃত্যু। আর এই মৃত্যুই তোর জন্ম। যারা সত্য পায়, তারা নিজেদের শেষ করে তারপর সেই সত্যে ঢুকে পড়ে।” সেই কণ্ঠ শুনে কৌশিক আর কাঁদে না, আর হাসেও না—শুধু ধীরে ধীরে তার মুখে ফুটে ওঠে এক ধরনের নির্লিপ্ত শান্তি। চারপাশের শবদেহ জ্বলতে থাকে, জীবন চলে, মৃত্যু আসে। আর কৌশিক? সে এখন আর কোনো নাম ধরে নেই। তার কোনো পরিচয় নেই। সে শুধু হয়ে উঠেছে এক উপলব্ধির রেখা—যে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে খুঁজে পেয়েছে সেই কেন্দ্রকে, যেখানে কেউ কেউ পৌঁছাতে পারে, অনেকেই পারে না।
দিনের শেষে কাশীর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সেই নিরব আত্মবিসর্জনের তরঙ্গ। কেউ জানে না, কেউ দেখে না, কিন্তু সেই তরঙ্গ ছুঁয়ে যায় জীবনের গোপন বর্ণমালা। আর সেই মুহূর্তে, এক পুরনো পাণ্ডুলিপির কোনো এক পাতায়, অদৃশ্য কালিতে লেখা হয়ে যায়—“অরুণাচলের তন্ত্রের শেষ পাঠ সম্পন্ন হল।”
–
শূন্য—এ শব্দটা এতদিন কৌশিক মৈত্রর কাছে ছিল একরকম ভয়, এক ধ্বংস, এক শেষ বিন্দু। কিন্তু আত্মবিসর্জনের পর যখন তার মধ্যে সব কিছু মুছে গেল, তখন সে প্রথমবার বুঝতে পারল, শূন্য আসলে শেষ নয়—এ এক সূচনা। নাম, মুখ, অতীত, অভিমান, এমনকি ‘আমি’ বলার অধিকারও যখন সরে যায়, তখন ভিতরে যে নিঃশব্দ রেখা রয়ে যায়—সেইটাই শূন্যের সত্তা। কাশীর ঘাটে নিজের সেই বিসর্জনের অভিজ্ঞতার পর সে যেন হারিয়ে যায় এক অনস্তিত্বের চাদরে। কতদিন কেটে গেছে, কে জানে! সময় এখানে এক ভাসমান গন্ধ মাত্র, সে তাকে মাপতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, সে বেঁচে আছে, কখনো মনে হয়—সে হয়তো আগেই মরে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো—তার কিছুই জানা দরকার নেই আর।
সে এখন যে জায়গায় আছে, সেটা বাস্তব জগৎ নয়, না-ও কোনো স্বপ্ন। এটা যেন দুইয়ের মাঝের এক স্তর, এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন—যেখানে চেতনার রেখাগুলো মিলিয়ে যায় অস্তিত্বের শিকড়ের সাথে। চারদিকে কিছুই নেই—না আলো, না অন্ধকার—শুধু এক বিস্তীর্ণ স্পন্দন। সেই স্পন্দনে কৌশিক শুনতে পায় নিজেকেই—কিন্তু সেই স্বর আর কৌশিকের কণ্ঠ নয়। তা যেন কোনো আদিম চেতনার স্পন্দিত জ্যামিতি। শব্দ নেই, অথচ ভাষা আছে। উচ্চারণ নেই, অথচ বোধ জন্ম নিচ্ছে। সে উপলব্ধি করে, এখন সে যা, তা কোনো ব্যক্তি নয়—বরং এক প্রবাহ, এক তরঙ্গ, এক সূক্ষ্ম কম্পন। এই অবস্থায় হঠাৎ সে দেখতে পায় সামনে একটি প্রতীক ভেসে উঠছে—একটা বিশাল বৃত্ত, যার কেন্দ্র শূন্য। আর সেই কেন্দ্র থেকেই আলো বেরোচ্ছে, আবার সেই আলোই মিলিয়ে যাচ্ছে চারপাশে।
এই প্রতীকটা খুব চেনা। “অরুণাচলের তন্ত্র”-এর প্রথম পাতাতেই সে এই চিহ্ন দেখেছিল। কিন্তু তখন এর মানে জানত না। এখন সে বুঝতে পারে—এই চিহ্ন এক সূত্র: কেন্দ্রহীন হওয়ার মধ্যেই নিহিত আছে সমস্ত কেন্দ্রতা। যে মুহূর্তে কৌশিক নিজেকে হারিয়েছে, সে তখনই হয়ে উঠেছে সবকিছুর অংশ। সে নিজেই প্রশ্ন আর উত্তর, স্রষ্টা আর সৃষ্ট, উপাসক আর উপাস্য। এই উপলব্ধির মুহূর্তে হঠাৎ এক কণ্ঠ শুনতে পায়—তিলোত্তমার কণ্ঠ। কিন্তু এবার তা কোনো আবেগভরা প্রেমিকার নয়, বরং এক নিরাসক্ত, জ্যোতির্ময় শক্তির। সে বলে—“তুই ফিরতে পারিস। কিন্তু ফিরবি কি না, সেটা তোর ইচ্ছের উপর নয়—তোর প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে।”
কৌশিক ভাবে—সে কি ফিরতে চায়? সেই পুরনো শহর, পুরনো মুখ, পুরনো রাস্তাগুলোতে? নাকি সে এই অনস্তিত্বেই বিলীন হয়ে যেতে চায়? কিন্তু ঠিক সেই সময়, তার চেতনায় একটি ছবি ভেসে ওঠে—এক খুদে ছেলে একটা ভাঙা কাগজের ঘুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। সে কৌশিক নয়, সে অচেনা। কিন্তু তার চোখে সেই একই খোঁজ, যা কৌশিক একদিন অনুভব করেছিল। কৌশিক তখন বুঝতে পারে—তাকে ফিরতেই হবে। কেননা সে এখন আর নিজের জন্য নেই, সে এখন এক পথপ্রদর্শক। যারা আজও ছায়ার মধ্যে, যারা আজও নিজেকে ভুলে আছে, তাদের কাছে সে এক নিরব বাতি হয়ে দাঁড়াবে।
আবার আলো নামে। আবার শব্দ ফিরে আসে। আবার চেতনা তার শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ে ধীরে ধীরে। কৌশিক চোখ মেলে দেখে—সে কাশীরই এক মন্দিরে শুয়ে আছে। আশেপাশে কিছু সাধু, কেউ কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। এক বৃদ্ধ শুধু এগিয়ে এসে বলে, “ঘুম থেকে উঠেছ, বৎস? অনেক গভীরে গিয়েছিলে তুমি।” কৌশিক এবার মৃদু হাসে। সে কোনো উত্তর দেয় না। কারণ সে জানে, এ ঘুম ছিল না, এ ছিল এক মৃত্যু, এবং সেই মৃত্যুর ভিতর দিয়েই জন্ম নিয়েছে নতুন সে—এক শূন্যের অতল থেকে উঠে আসা যাত্রী, যে নিজে আলো হয়ে উঠেনি, কিন্তু আলো দেখার চোখ তৈরি করে ফিরেছে।
–
তন্ত্রের পথ কখনো একাকী থাকে না। যে একবার পথ ধরে, সে চিরকাল এক যাত্রী—নিজের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে অন্য কারো পথ তৈরি করে দেয়। কৌশিক মৈত্র জানত, এবার তার সামনে নতুন আর কোনো দ্বার খোলার নেই। এবার সময় এসেছে কাউকে পথ দেখাবার। সেই উপলব্ধি এক সকালে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন সে বসেছিল কাশীর এক পুরনো ঘাটে, আর দূরে দেখতে পেল এক কিশোরকে—চোখে অদ্ভুত দৃষ্টির গভীরতা, শরীরের ভঙ্গিমায় এক ক্লান্তি, আর নিঃশব্দে গঙ্গার জলে পাথর ছুঁড়ে ফেলা যেন তার অন্তরের কিছু লুকোনো কথা। কৌশিক চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার পাশে গিয়ে বসে। কিছু না বলেও, দু’জনের মাঝে এক অদ্ভুত সংযোগ গড়ে ওঠে—যেন দু’জনে একে অপরকে আগে থেকেই চেনে, ছায়ার মতো।
ছেলেটির নাম অভীক। বয়স হয়তো আঠারো হবে। সে বলে, “কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু আমার মধ্যে একটা আওয়াজ সবসময় বাজে, যেন কেউ আমায় ভেতর থেকে ডাকছে। আমি জানি না সে কে। শুধু জানি, আমি অন্যদের মতো নই।” কৌশিক তার দিকে তাকিয়ে ধীরে জিজ্ঞেস করে, “তুই কি মরতে চাস?” অভীক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “হয়তো চাই। কিন্তু তার থেকেও বেশি, আমি জানতেও চাই। আমি জানতে চাই, আমি কে।” কৌশিক তখন বুঝে যায়—এই সেই মুহূর্ত, যেটার জন্য সে ফিরে এসেছিল। “অরুণাচলের তন্ত্র” শুধু তার জন্য নয় ছিল, এটা ছিল একটা সঞ্চারশক্তি—যে প্রতিটি প্রস্তুত আত্মায় জেগে উঠতে চায়, তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য।
তিন সপ্তাহ পর, সেই ঘর—যেটা কৌশিক একদিন ভগ্ন অবস্থায় দেখেছিল—আবার নতুন করে খোলা হয়। কৌশিকই খুলে দেয় তালা। ভিতরে কিছুই নেই—শুধু ধুলোয় ঢাকা এক চৌকাঠ, আর এক পুরনো কাঠের বাক্স। বাক্স খুলে কৌশিক দেখে—“অরুণাচলের তন্ত্র”-এর সেই পাণ্ডুলিপি। পাতা পাতা পেরিয়ে শেষে দেখা যায়, একদম শেষ পৃষ্ঠায় লেখা—“এই তন্ত্র কখনো শেষ হয় না। শেষ পাঠ মানেই নতুন পাঠ শুরু।” কৌশিক বুঝে যায়, অভীকই হবে নতুন পাঠক, নতুন পথিক, নতুন তন্ত্রজ্ঞ।
পরের কয়েক মাস, অভীক ধীরে ধীরে প্রবেশ করে সেই ধ্যান, সেই চেতনার স্তরে। কৌশিক তাকে পথ দেখায় না—সে শুধু পাশে থাকে। কেননা তন্ত্রে গুরুর ভূমিকা নির্দেশক নয়, উদাহরণ। কৌশিক জানে, অভীকও একদিন নিজেকে বিসর্জন দেবে, আবার উঠে আসবে নতুন রূপে। ততদিন সে পাশে থাকবে। একদিন সকালে, অভীক তার কাছে এসে বলে, “আমার ভিতরে একটা দরজা খোলার শব্দ পেয়েছি কাল রাতে। আমি জানি, আমি প্রস্তুত।” কৌশিক তখন তাকে স্পর্শ করে মাথায় হাত রাখে। বলে, “তুই আমাকে ভুলে যাবি। এটাই নিয়ম। কারণ তোর সত্য শুধু তোরই। আমি ছিলাম, শুধু পথ দেখাতে। এবার থেকে তুই নিজেই পথ হবি।”
বছর ঘুরে যায়। কাশীর সেই ঘর আবার নিঃশব্দ। কেউ জানে না সেখানে কেউ আছে কি না। শহরের বাইরে বেরোলে কেউ কেউ বলে, একটা নতুন সাধক নাকি গঙ্গার ধারে বসে থাকেন, চোখে ছায়া আর কণ্ঠে আলো। তার ছাত্রেরা আসছে দূর দূরান্ত থেকে। আর কেউ কেউ বলে, কোনো এক রাতে সেই ঘাটের ধারে একটা কিশোর নাকি একটা পাণ্ডুলিপি খুলে দেখে—আর তার চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে আলো।
“অরুণাচলের তন্ত্র” তার পথ খুঁজে নিচ্ছে—মানুষ থেকে মানুষে, শিষ্য থেকে গুরুতে, চেতনা থেকে বিসর্জনে। আর ‘নির্বাণপথের দ্বার’ বারবার খুলে যাচ্ছে, সেই সকল আত্মার জন্য যারা সত্য জানতে চায়—ভয় না পেয়ে, নিজেকে হারাতে প্রস্তুত হয়ে।
——