অমৃত ঘোষ
পর্ব ১: নির্জন বারান্দা
আনজু জানলার কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে বসে ছিল। বাইরের দিক থেকে কুয়াশার মতো নেমে আসা বিকেলটা ধীরে ধীরে সাঁঝে গড়িয়ে যাচ্ছিল। এই বাড়িটার বারান্দা জুড়ে এমন এক রকমের নিঃসঙ্গতা বিরাজ করত, যেন সময় থেমে গেছে বহু আগে। সুমিত তখনো অফিস থেকে ফেরেনি। ফেরার কথা সাতটার মধ্যে, কিন্তু এখন সাতটা পঁচিশ। আনজু অপেক্ষা করে না আর, শুধু হিসেব রাখে — দেরি, আগমন, নিরবতা, স্পর্শহীন রাত।
চৌদ্দ বছরের সংসার, কিন্তু তাতে প্রেম আছে কিনা, সেটা বুঝে উঠতে পারেনি কখনো। সুমিত ভালো মানুষ, এই শহরের প্রায় সবাই তাই বলে। নিয়মিত অফিস যায়, বাজার করে, দায়িত্ববান। কিন্তু ভালোলাগা আর দায়িত্ব এক নয়। ভালোলাগা বলে কিছু থাকলে হয়তো আনজুর সন্ধ্যাগুলো এমন খালি খালি লাগত না।
এই সময় ফোনটা বাজল।
“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে গলার স্বরটা এল, নিচু, একটু কর্কশ, কিন্তু উষ্ণতায় ভরা—
“আজ বারান্দায় দাঁড়াবে?”
আনজুর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল।
“তুমি এখন ফোন করছো?”
“তোমার গলাটা শুনতে ইচ্ছে করছিল।”
“আমরা তো কথা না বলার কথা বলেছিলাম,” আনজু চাপা স্বরে বলল।
“কথা না বলা আর কথা না শোনা এক জিনিস নয়,” বলে হেসে উঠল লোকটা।
এই গলার হাসির সঙ্গে আনজু অদ্ভুত রকমের অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই এই ফোনটা আসে। আর তিন মাস আগে… সেই সন্ধ্যায়ই তো পরিচয় ওদের।
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল বারান্দাতেই। সেদিন সুমিত অফিসে নাইট ডিউটিতে ছিল, ছেলেটা—ঈশান, পাশের ঘরে পড়ছিল। আনজু একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, গ্রীষ্মের রাত, একটু হাওয়া উঠেছিল। তখনই পাশের বাড়ির ছাদ থেকে চোখে পড়ে লোকটাকে—হাতে একটা চা-এর কাপ, চোখে অদ্ভুত এক বিষণ্নতা।
লোকটা দেখল ওকে, হাসল না, হাত নাড়ল না, শুধু তাকিয়ে রইল। তাও খানিকটা সময়। আনজু অস্বস্তি বোধ করল না বরং যেন কোথাও একটু কৌতূহল জন্মাল। তারপর একদিন ছেলেকে কোচিং থেকে নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ ওই লোকটাই সামনে এসে দাঁড়াল।
“আপনার নাম আনজু?”
আনজু থমকে গেল।
“আপনারা সামনের ফ্ল্যাটে থাকেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু…”
“আমি অরিত্র, ও পাশের ছাদের লোক।”
সেইদিন থেকেই শুরু। শুরু হয় দীর্ঘ হাঁটাচলা, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে হঠাৎ দেখা, ধীরে ধীরে বারান্দায় চোখাচোখি থেকে ফোন নম্বর আদানপ্রদান। আনজু জানত এই সম্পর্কে রাস্তাগুলো ঠিক কোথায় গিয়ে মিশবে। কিন্তু এই নিষিদ্ধের আনন্দের ভেতরেই একটা মুক্তির স্বাদ ছিল।
অরিত্র বিবাহিত নয়। থিয়েটারে কাজ করে, লেখালিখিও করে মাঝেমধ্যে। আনজুর তুলনায় বয়সে ছোট, পাঁচ বছরের মতো। কিন্তু গলার স্বরে, চোখের দৃষ্টিতে যে অভিজ্ঞতা ছিল, তা আনজুকে অদ্ভুত ভাবে আন্দোলিত করত।
ফোনে অরিত্র বলল, “আজ সন্ধে ছটা পঁচিশে তুমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে। তুমি জানো, তোমার এই কপালে ঠেকানো ভঙ্গিটা দেখলে আমার মনে হয় তুমি সত্যিই ক্লান্ত।”
“তুমি সব দেখো?”
“তোমায় দেখার জন্যই তো আমি থাকি।”
এই কথাটা শুনলে আনজুর গলা শুকিয়ে আসে। এত সহজে, এত সরলভাবে কেউ কীভাবে বলেও ফেলে! সুমিত কখনো বলেনি ওকে দেখে ওর দিন বদলে যায়, কিংবা কোনোদিন আনজুর চুলের গন্ধ মনে রেখে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
“তুমি চাইলে আমরা একদিন বাইরে যেতে পারি,” অরিত্র বলেছিল একদিন।
“যা হচ্ছে, সেটাও তো ঠিক নয়, আর তার ওপর দেখা করা?”
“তাহলে কী হবে আনজু? আমি কী কেবল জানালা দিয়ে তাকিয়েই থাকব?”
আনজু চুপ করে যায়। নিজের মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ জমা হতে থাকে। তবুও, বারবার ফোন ধরতে ইচ্ছে করে, বারবার ওই ছাদটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে, যেখানে একটা চা-এর কাপ ধরা হাত অপেক্ষা করে।
সেই দিন সন্ধ্যায় হঠাৎই সুমিত ফিরে আসে একটু আগে। ঘরে ঢুকেই বলে, “আজ একঘেয়ে লাগছে রে, চল আমরা কোথাও যাই।”
আনজু চমকে ওঠে।
“এখন?”
“হ্যাঁ, কোনো এক ছাদে বসে চা খাবি?”
চা? ছাদ? আনজুর বুকের ভেতরটা যেন ধসে পড়ে। কীভাবে এমন কাকতালীয় হতে পারে?
“না, আজ মাথা ধরেছে আমার,” সে বলে।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি গিয়ে ঈশানকে পড়িয়ে দিই।”
সুমিতের মুখে কিছু রাগ ছিল না, কিন্তু একটা বিষণ্নতা যেন জমে ছিল চোখে। আনজু তাকিয়ে থাকল সেদিকে, অনেকক্ষণ। ও কি টের পেয়েছে কিছু? না কি কেবল নিজের ক্লান্ত জীবনের একঘেয়েমিকে এভাবে দূরে সরাতে চাইছে?
রাত গভীর হলে আনজু নিজের খাতায় কিছু লিখল—
“ভালোবাসা যখন আসে, সে আর হিসেব মানে না। সে স্রোতের মতো, ভেঙে ফেলে বাঁধ। কিন্তু এই ভাঙনের শব্দ আমি কাউকে শুনতে দিই না। আমি কেবল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি, সাঁঝের দিকে চেয়ে থাকি, কারণ জানি, সে তখন তাকিয়ে আছে।”
ফোনটা আবার বাজল, এবার হোয়াটসঅ্যাপ। অরিত্র একটা ছবি পাঠিয়েছে—একটা খালি চা-এর কাপ, ছাদের এক কোণে রাখা। নিচে লেখা—
“আজ তুমি দাঁড়াবে কি না, জানি না। কিন্তু আমি থাকব। তুমি থাকো কি না থাকো, আমি ভালোবাসি।”
আনজু ফোনটা বন্ধ করল না, কিন্তু উত্তর দিল না। কেবল জানালার দিকে হাঁটল, ধীরে ধীরে। পেছনে ঈশানের পড়ার আওয়াজ, সুমিতের ঘুমোতে যাওয়ার শব্দ। বাইরে কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে। জানালায় দাঁড়িয়ে সে নিজেকে দেখল—আয়নায় নয়, অরিত্রের চোখে।
বারান্দার বাতাসে আজ কেমন যেন একটা শব্দ নেই, অথচ গভীর কিছুর স্পর্শ আছে। আনজু জানে, এই গল্পের শুরুটা নিরব, কিন্তু শেষটা হয়তো আগুন হয়ে উঠবে।
পর্ব ২: এক ফোঁটা চা, এক গ্লাস ছায়া
আনজু যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে এল, তখন ঘরজুড়ে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছায়ার মতো মিশে ছিল। সুমিত তখনও ঘুমোচ্ছিল। ঈশান ডাইনিং টেবিলে বসে দুধ খাচ্ছিল, হাফ-ঘুমন্ত চোখে মোবাইলটা স্ক্রল করতে করতে। দিনের শুরুতে এমন গা-ছাড়া পরিবেশে আনজুর মনটাও ঘোলাটে হয়ে থাকত, যেন সবকিছু চললেও থেমে আছে।
চা বানাতে বানাতে বারবার মনে পড়ছিল অরিত্রের পাঠানো ছবিটা। গত রাতে সে উত্তর দেয়নি, তবুও লোকটা মেসেজ করেই গেছিল।
“তুমি থাকো কি না, আমি ভালোবাসি।”
এই সরল কথাটা কি খুব নিষিদ্ধ? নাকি এই নিষিদ্ধতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের একমাত্র সত্য?
চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে আনজুর চোখ পড়ল উঠোনে। সামনের গাছে দুটো কাক ঝগড়া করছে, একটা পাখি পাখনা ঝাঁকিয়ে উড়ে গেল, আর ও পাশে, জানালার ওপারে, অরিত্র দাঁড়িয়ে। সাদা টি-শার্ট, হাতে আবার সেই চা-এর কাপ, চোখে অবাক করা ধৈর্য। এই চোখই তো বারবার আনজুকে গিলে ফেলেছে।
তাদের গল্পের শুরুটা হয়তো অন্যরকম হতে পারত। হয়তো একদিন কলেজের করিডোরে দেখা হতে পারত, হয়তো বইয়ের দোকানে, কিংবা কোনও নাট্য মঞ্চে। কিন্তু সেটা হয়নি। হয়েছে এই শহরের দুই বাড়ির মাঝখানে, দুই জানালার ফাঁকে, এক নিষিদ্ধ প্রেক্ষাপটে।
সেদিন দুপুরে হঠাৎ অরিত্র ফোন করল।
“আনজু, একটা চা খাবে?”
“এখন?”
“হ্যাঁ, আমি রিকশায় করে যাচ্ছি চৌরঙ্গী মোড়ে, তুই যদি পারিস, দশ মিনিটে দেখা।”
আনজু জানত না কীভাবে রাজি হয়ে গেল। হয়তো নিজের একঘেয়েমিকে একটু ধাক্কা দিতে চেয়েছিল, কিংবা নিজের মধ্যেকার কোনো চুপচাপ ঘরে আলো ফেলতে চেয়েছিল। ঈশান তখন অনলাইনে ক্লাসে বসে, সুমিত অফিসে। আনজু বেরিয়ে পড়ল। মুখে সামান্য সানস্ক্রিন, সালোয়ার কামিজটা এমন বেছে নিল যাতে কেউ না বলে ‘সে সাজছে।’
চৌরঙ্গী মোড়ের এক কোনায় অরিত্র দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে দুটো চা-এর কাপ, একটা তাকানোর মতো হাসি নিয়ে।
“তুই এসেছিস, জানতাম,” বলল সে।
তারা চুপ করে হাঁটছিল। চারপাশে ব্যস্ততা, ভিড়, অথচ তাদের চারপাশে যেন একটা কাচের ঘর তৈরি হয়ে গেছিল, যার মধ্যে ঢুকে পড়লে বাইরের শব্দ ঢোকে না।
“তুই কেন এসব করছিস, অরিত্র?”
“তুই মানে?”
“তুই জানিস না আমি বিবাহিতা? একটা বাচ্চাও আছে আমার।”
“জানি। জানি বলেই ভালোবাসি।”
আনজু থেমে যায়।
“মানে?”
“যে মানুষটা এতদিন সংসার করে এসেছে, ত্যাগ করেছে, মুখ বুজে গেছে — সেই মানুষটাই তো সবচেয়ে গভীর। আমি নতুন কাউকে চিনি না, আমি চিনি তোকে — তোর ক্লান্তি, তোর নিরবতা, তোর অপেক্ষা।”
এইসব কথায় কি কেউ সত্যিই গলে যায়? না কি সময়ের অভাব, স্পর্শের ক্ষুধা আর চোখের উষ্ণতা মিলে এক ধরণের তৃষ্ণা তৈরি করে?
দুপুরের আলো পড়েছিল ওদের মুখে, হঠাৎ মেঘ করেছিল আকাশ। অরিত্র বলল, “চল, একটু রিকশায় ঘুরি?”
ওরা উঠল এক পুরনো রিকশায়, যেটার ছাউনিতে ফুটো ছিল। মেঘ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল। অরিত্র তার গায়ে থাকা একটা হালকা শাল খুলে আনজুর কাঁধে দিল।
“শীত করছে?”
“না,” বলল আনজু, “তুই দিলি তাই ভালো লাগছে।”
এই প্রথম “তুই” বলা সহজ হয়ে যাচ্ছিল। সম্পর্কের ভেতর একটা ভরসার মতো কিছু জন্ম নিচ্ছিল। কিন্তু পাশাপাশি, একটা গভীর অপরাধবোধ আনজুর বুকের ভেতরে জমে উঠছিল।
রিকশাটা থেমে গেল বটতলার মোড়ে। সেখান থেকে অরিত্র বলল, “আজ যদি না থাকিস বারান্দায়, আমি মনে করব তুই আর আসবি না।”
“তাহলে তুই আর তাকাবি না?”
“দেখব। ঠিক আগের মতো। কিন্তু জানব, আমি শুধু একটা ছায়াকে দেখছি।”
ঘরে ফিরে এসে আনজু চুপ করে বসল। সুমিত তখন ফিরেছে। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “আজ বাইরে গিয়েছিলে?”
“না, বারান্দায় বসেছিলাম।”
“তোমাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না।”
“সাইলেন্টে ছিল। মাথাটা একটু ধরেছিল।”
সুমিত আর কিছু বলল না। এইখানেই সুমিত আর অরিত্রের পার্থক্যটা প্রকট হয় — একজন প্রশ্ন করে না, আরেকজন প্রতিদিনের প্রতিটি নিঃশ্বাস বোঝে।
সন্ধ্যা নামল ধীরে। আনজু এবার সত্যিই বারান্দায় দাঁড়াল না। দাঁড়াল ভেতরের ঘরে, জানালার পাশে, ঠিক যেখানে থেকে অরিত্র তাকে দেখতে পায় না। বাইরে হালকা বৃষ্টি, রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। তার চোখ পড়ল সামনের ছাদে — অরিত্র দাঁড়িয়ে নেই।
কিন্তু এক মুহূর্তে ফোনটা বেজে উঠল।
“তুই বারান্দায় নেই কেন?”
“তুই জানবি কী করে?”
“আমি নেই, মানে এই না যে আমি দেখছি না। তোকে না দেখলেও তোর উপস্থিতি বুঝি।”
আনজুর চোখে জল চলে এল। এত সহজে, এত সাহসে কেউ কেন ভালোবাসে? সে কি অরিত্রকে ভালোবাসে? না কি শুধুই ভালোবাসা পাওয়ার তৃষ্ণাটা ওর ভিতরে গাছ হয়ে উঠেছে?
ফোনের ওপাশে অরিত্র বলল, “চাইলে সব ছেড়ে তোকে নিয়ে চলে যেতে পারি। তবে তুই যদি শুধু বারান্দার গল্পটাই বাঁচিয়ে রাখতে চাস, তাও পারি। কিন্তু ভেবে দেখিস, তোকে কেউ এভাবে ভালোবেসেছে কখনো?”
আনজুর মুখে কোনো উত্তর এল না। তার চোখে শুধু ছাদ ভেসে উঠল — ছাদে একটা খালি কাপ, বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে পড়ে তার মধ্যে কেবল শব্দ জমে থাকছে।
পর্ব ৩: ছায়ার ভেতরে চিঠি
পরের দিন সকাল থেকে আনজুর মনের ভেতর এক অস্থিরতা খেলে যাচ্ছিল। এমন নয় যে সে প্রথমবার নিজের সঙ্গে লড়ছে, কিন্তু আজকের দ্বন্দ্বটা অন্যরকম। অরিত্রর কথাগুলো যেন তার মনের দেয়ালে সারাদিন ধরে ছায়ার মতো লেগে ছিল — “তোকে কেউ এভাবে ভালোবেসেছে কখনো?”
সেইরাতটা সে বারান্দায় যায়নি। তবুও অরিত্র জানত সে দেখছে। এই দেখার ক্ষমতা কীভাবে জন্মায়? কারও চোখে চোখ রেখে এইরকম পড়ে ফেলা সম্ভব হয়? নাকি ভালোবাসা আসলে ভবিষ্যতের দরজা খুলে ফেলার চাবি?
দুপুরে সুমিত ঘরে ফিরল হঠাৎ।
“আজ অফিসে অডিট হয়েছে, একটু আগে ছেড়েছে,” বলল সে।
“তুমি খাবে কিছু?”
“তুই বল কী আছে?”
“তুই”। সেই শব্দটা সুমিত সচরাচর ব্যবহার করত না। ওদের সংসারে সৌজন্যবোধ যেন একটা চুক্তির মতো ছিল। কিন্তু আজ সুমিত একটু আলগা, একটু অন্যরকম।
“তুই আজকাল চুপচাপ থাকিস কেন?” হঠাৎ প্রশ্নটা এল।
আনজু থমকে গেল, চা ঢালছিল হাতে।
“আমি?”
“হ্যাঁ। আগে অনেক বেশি কথা বলতে, এখন যেন শুধু মুখে মুখে হ্যাঁ-না।”
“বয়স হয়েছে, তাই হয়তো…”
সুমিত হেসে উঠল না, বলল, “তুই জানিস, আমি তোকে ঠিকমতো দেখি না কতদিন হয়ে গেল। শুধু দেখি ঘরের কাজ, ঈশান, খাবার, কিন্তু তোকে — মানে তোর ভেতরের মানুষটাকে দেখি না। তুই কি এখনও কোথাও আছিস?”
আনজুর গলা শুকিয়ে এল।
সে কিছু বলল না। হ্যাঁ, সে নেই। নেই সুমিতের সেই চেনা জগতে, নেই ডাইনিং টেবিলের হাসির পেছনে। সে আছে অন্য কোথাও — এক ছায়ার জগতে, যেখানে কেউ তাকে দেখছে, পড়ছে, ভালোবাসছে।
সন্ধে নামল ধীরে ধীরে। আনজু এবার জানালার পাশে দাঁড়াল না। সে দাঁড়াল বারান্দার পাশের ছোট্ট বইয়ের তাকটার সামনে, যেখানে পুরনো কিছু চিঠি রাখা ছিল। বিবাহের আগে, সুমিত তাকে হাতে লেখা অনেক চিঠি দিত। “তুই” সম্বোধনে লেখা, কিশোর প্রেমের মতো সেইসব বাক্যগুলো আজ অদ্ভুত রকমের ভিনদেশি মনে হল।
হঠাৎ একটা খাম চোখে পড়ল — অরিত্রর নাম লেখা। অবাক হয়ে খুলল। ভিতরে এক টুকরো কাগজ, হাতের লেখা একেবারে অরিত্রর।
“তুই যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলিস, জানিস তো আমি ঠিক তোর ছায়ার ভেতর খুঁজে পাব।”
এই চিঠিটা ও কীভাবে রেখেছে? কবে দিয়েছিল অরিত্র? মনে পড়ল, সেদিন এক বিকেলে একটা বই এনে দিয়েছিল — “নীল রঙের অরণ্য”। ভেতরে হয়তো রেখেছিল চিঠিটা। আনজু পড়েনি তখন, শুধু বইটা তাকেই রেখে দিয়েছিল।
তারপর হঠাৎ ফোন বাজল।
“আমি জানি, তুই এখন বারান্দায় দাঁড়াসনি। কিন্তু তুই কি আমার কথা ভাবছিস?”
“অরিত্র, তুই কেন এত নির্ভার? তুই কি ভয় পাও না?”
“ভয় পাই। তোকে হারানোর ভয়, তোকে না ছুঁতে পারার যন্ত্রণা।”
“আমি জানি না, আমি কী চাই।”
“তুই নিজেকে খুঁজে পেলেই বুঝবি।”
আনজু এবার বারান্দায় পা রাখল। বাইরে মেঘলা আকাশ, ছাদে অরিত্র নেই। তবে জানে, কোথাও কাছেই আছে। হঠাৎ বাতাসে একটা কাগজ উড়ে এসে পড়ল বারান্দার কোণে। কুড়িয়ে দেখে, সেই চিঠিটা — ঠিক সেই একই, কিন্তু এখন তাতে আরও একটা লাইন যোগ হয়েছে।
“যদি তুই তোর সংসার বাঁচাতে চাস, তবুও আমি ভালোবাসব, কারণ ভালোবাসা দাবি নয়, অনুরাগ।”
আনজুর চোখ ছলছল করে উঠল। ও কি সত্যিই ভালোবাসে অরিত্রকে? না কি সে কেবল ভালোবাসা খুঁজছে?
একটা পুরনো গান মনে পড়ল ওর —
“ভালোবাসা সেই, যে আসে নীরবে, ছায়ার মতো পাশে পাশে হাঁটে।”
রাতে সুমিত বলল,
“চলো কোথাও ঘুরে আসি ঈশানের সঙ্গে। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি।”
আনজু অবাক হয়ে বলে, “তুমি এমন ভাবছো কেন হঠাৎ?”
“কারণ আমি বুঝি, তোকে আমি হারিয়ে ফেলছি, আর সেটা হয়তো চুপচাপ, ধীরে ধীরে। কিছু করার সুযোগ চাই।”
সেই রাতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে, আনজু অরিত্রকে একটা মেসেজ পাঠাল—
“আমার ভেতরের ছায়াগুলো তুমি যেমন পড়েছ, কেউ পড়েনি। কিন্তু এখন যদি আমি কিছুদিন চুপ থাকি, জানবে, আমি হারাইনি, আমি খুঁজছি — নিজেকে, তোকে, আমাদের ছায়ার চিঠিটাকে।”
পর্ব ৪: নীল রঙের অরণ্য
ট্রেনটা ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠছিল। জানালার ধারে বসে ঈশান ঘুমিয়ে পড়েছে, সুমিত খবরের কাগজে চোখ রেখেছে, আর আনজু তাকিয়ে আছে বাইরে। পাহাড়, ধূসর আকাশ, কুয়াশায় মোড়া গাছের সারি — এই সবকিছুর ভেতরেও আনজুর বুকের ভিতরটা যেন একটা টান টান দড়ির মতো বাঁধা।
এই সফর হঠাৎ করেই ঠিক হয়ে গেছে। সুমিত বলেছিল, “চলো, দু’দিনের জন্য বাইরে যাই। পাহাড়ে।”
পাহাড় মানেই আনজুর কাছে একধরনের মুক্তি। কিন্তু এবার এই মুক্তির মাঝেও কোথায় যেন এক বিষণ্নতা মিশে আছে। হয়তো অরিত্রর মুখটা সেখানে রয়ে গেছে — ছায়ার মতো, দৃশ্যের পেছনে লুকিয়ে।
দার্জিলিঙের এই হোমস্টেটা অনেক নিরিবিলি। পাশেই একটা ছোট্ট জঙ্গল, সামনের বারান্দা থেকে দূরের পাহাড় দেখা যায়। ওরা তিনজন একসঙ্গে খেতে বসলে এক অদ্ভুত অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। যেন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু মন ছুঁতে পারছে না।
রাতের খাবার শেষে ঈশান নিজের ঘরে পড়তে বসে যায়, সুমিত বারান্দায় বসে ফোনে অফিসের মেল পড়ছিল। আনজু বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে, কিন্তু ঘুম আসে না। ঘরের টেবিলের ওপর একটা বই রাখা — “নীল রঙের অরণ্য”।
অরিত্র যেদিন এই বইটা দিয়েছিল, বলেছিল,
“তুই পড়ে দেখিস, গল্পটা আমাদের মতোই। একটা মেয়ে আছে, যে তার সংসারের ছায়া ছাড়িয়ে নিজেকে খোঁজে।”
“আর গল্পের পুরুষটা?”
“সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, অপেক্ষায়, ছায়ার কিনারায়।”
বইটা খুলে পড়তে শুরু করল আনজু।
প্রথম পাতায় লেখা —
“ভালোবাসা যদি পথ হারায়, তাও সে ফিরে আসে। কারণ তার ঠিকানা মানুষের ভিতরের নির্জনতা।”
আনজুর বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগে। অরিত্র কি ইচ্ছে করে এই বইটা দিয়েছিল? বইয়ের মধ্যেই কি কোনো ইশারা লুকিয়ে রেখেছে?
পরদিন সকালে সুমিত প্রস্তাব দিল,
“চল, আমরা তিনজন হাঁটতে যাই জঙ্গলের ভেতর।”
ঈশান আপত্তি করল না। আনজু চুপচাপ মাথা নাড়ল।
জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে চারদিক কুয়াশায় ঢাকা। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির, পাখির ডাক, আর কোথাও কোথাও মাটি ফুঁড়ে বেরোনো গাছের শিকড়—সব মিলিয়ে এক রহস্যময় আবহ। হঠাৎ সুমিত বলল,
“তুই জানিস, আমি কখনও তোকে বুঝতে পারিনি। কী ভালো লাগে তোর, কী ভাবিস—সব যেন চুপ করে রেখে দিস।”
আনজু থেমে গেল।
“তুমি কী বলতে চাইছো?”
“বলছি, তুই এখন এমন কিছু ভাবছিস, যেটা আমার ধারণার বাইরের। আমি সেটা টের পাই।”
“তাহলে?”
“তাই তো ভাবছি, আমি এত বছর ধরে কীভাবে সংসার করলাম? শুধু একটা ছায়ার সঙ্গে?”
এই কথার মধ্যে দুঃখ ছিল, কিন্তু রাগ ছিল না। সুমিত হয়তো সত্যিই চেষ্টা করছে, কিন্তু সেই চেষ্টা এসে পৌঁছচ্ছে না আনজুর গভীরে। ও জানে, চেষ্টার পেছনে যত ইচ্ছেই থাকুক, প্রেম না থাকলে সেই চেষ্টা কেবল দায়িত্বে পরিণত হয়।
হঠাৎ পেছন থেকে ঈশান চেঁচিয়ে উঠল,
“মা, দেখো না! একটা খরগোশের মতো কিছু দৌড়ে পালিয়ে গেল!”
আনজু ছেলেকে নিয়ে এগিয়ে যায়। সুমিত একটু পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর ফেরার পথে তারা তিনজন একদম চুপচাপ, শুধু জঙ্গলের পায়ে হাঁটা পাতার খসখসে শব্দ শুনতে পাচ্ছিল।
বিকেলে, আনজু বারান্দায় একা বসেছিল। হাতে “নীল রঙের অরণ্য”। হঠাৎ বইটার ভাঁজে কিছু একটা ফেঁসে আছে দেখতে পেল। বের করে দেখে — একটা ছোট্ট কাগজ, হাতে লেখা —
“তুই যদি ভুলে যাস, আমি মনে রাখব। যদি না চাস দেখা করতে, আমি তবুও দেখে যাব। যদি তুই হারিয়ে ফেলিস নিজেকে, আমি ঠিক খুঁজে নেব — নীল অরণ্যের গাছের ফাঁকে, পাখির চোখে, অথবা তোর এক ফোঁটা কান্নার ভিতর।”
— অ.”
আনজুর চোখ ছলছল করে উঠল।
সে কি সত্যিই এমন কারও ভালোবাসার যোগ্য? একজন মানুষ, যে ছায়া ছাড়িয়ে, নির্জনতাকে ভালোবাসে?
সেই রাতে ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। সুমিত পাশে ঘুমিয়ে। আনজু জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। মেঘে ঢাকা পাহাড়ের ছায়া যেন গলে এসে চোখে পড়ে। হঠাৎই মনে হল, কেউ যেন ডেকে উঠল — “আনজু…”
সে চমকে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু বুকের ভিতর যেন একটা কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে আনজু চেক করল। কোনো নতুন মেসেজ নেই। কিন্তু আগের কথোপকথন খুললে দেখা যাচ্ছে শেষ মেসেজটা বদলে গেছে —
“তুই আজ পাহাড়ে, জানি। কিন্তু পাহাড়ও জানে, কারা তাদের বুকের ভিতর লুকিয়ে থাকে। তুই যদি দেখতে চাস, আমি ঠিক কাল সকালে ও জঙ্গলের এক ফাঁকা গাছতলায় থাকব। যদি আসিস, শুধু একবার দেখবি। ছুঁতে চাইব না।”
আনজু বুকের মধ্যে এক ধরণের কাঁপুনি অনুভব করল।
এই দেখা কি হবে? না কি এই দেখা কেবল আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া — সীমানার ওপারে?
পর্ব ৫: তাকিয়ে থাকি, ছুঁই না
সকালটা একধরনের কুয়াশায় মোড়া। আকাশ মেঘলা, বাতাসে পাহাড়ি ঠান্ডা, যেন প্রকৃতি নিজেই নিঃশব্দে কিছু লুকিয়ে রেখেছে। আনজু জানে, আজকের সকালটা অন্যরকম। বারবার মনের ভিতর একটা প্রশ্ন উঠছে — সে কি যাবে? অরিত্রর সঙ্গে দেখা করবে? নাকি এই চিঠি, মেসেজ, দূর থেকে দেখা — এখানেই সীমা টানবে?
সুমিত তখন বাথরুমে, ঈশান ঘুমিয়ে। চুপচাপ বুট জুতো পরে বেরিয়ে পড়ল আনজু। হোমস্টের পেছনের পথ ধরে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেল, যেখানে আগের দিন গিয়েছিল। হাঁটার সময় পায়ের নিচে পড়া শুকনো পাতাগুলো খসখসে শব্দ করে উঠছিল, ঠিক যেন ভাঙনের প্রতিধ্বনি।
কিছুদূর গিয়ে সেই গাছটা দেখতে পেল — বিশাল এক চিরসবুজ গাছ, যার নিচে বসে আছে অরিত্র। সাদা সোয়েটার, মাথায় হুড, চোখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। ওর পাশে একটা চা-এর কাপ রাখা, অন্যটা হাতে।
আনজুকে দেখে অরিত্র উঠে দাঁড়াল না, হাসলও না। শুধু তাকাল, গভীরভাবে, যেন সেই চেনা চাহনি দিয়ে ওর মনের দরজা খুলে ফেলল এক মুহূর্তে।
“তুই এলি,” অরিত্র বলল।
“হ্যাঁ, এলাম। কিন্তু জানি না কেন।”
“তুই না এলেও আমি থাকতাম। তুই এলে শুধু দৃশ্যটা পূর্ণ হয়।”
আনজু একটা পাথরের গায়ে বসল, অরিত্রর বিপরীতে। তাদের মাঝে এক-দুই হাতের দূরত্ব। কিন্তু দূরত্বের মাপ কখনও ফিট বা ইঞ্চিতে হয় না — হয় চোখের গভীরতায়, নিঃশ্বাসের তাপে।
“তুই বলেছিলি ছুঁতে চাইবি না,” আনজু বলল।
“তাই তো বলেছি। আমি তোকে ছুঁই না — আমি তোকে স্পর্শ করি, কিন্তু অন্যভাবে। তোকে পড়ি, তোকে বোঝার চেষ্টা করি।”
আনজু চুপ। চোখ নামিয়ে দেখে পাতার ফাঁকে আলো পড়ছে অরিত্রর হাতে ধরা কাপের ওপর। হালকা ধোঁয়া উঠছে। এতদিনের পরিচয়ের মধ্যেও তাদের সম্পর্কটা এই এক বিষম — দেখছে, জানছে, স্পর্শ ছাড়াও হৃদয়ে ঢুকে পড়ছে।
“তুই কেন আমাকে এত গভীরভাবে ভালোবাসিস?”
“কারণ তুই নিজেও জানিস না তুই কতটা গভীর।”
আনজুর চোখে জল চলে এল। কেউ তাকে এভাবে চিনেছে? না কি সে নিজেই ভুলে গিয়েছিল, তার ভিতরে একটা পরিপূর্ণ নারী আছে, শুধু একজন মা, একজন স্ত্রী নয়?
“তুই জানিস, আমার ভয় করে,” আনজু বলল।
“ভয় করাটা ঠিক। তুই একা নোস। তোর একটা জীবন আছে, ছেলে আছে, সংসার আছে।”
“তবুও তুই ভালোবাসিস?”
“হ্যাঁ। কারণ ভালোবাসা মানে দাবি না, ভালোলাগার স্থায়িত্ব।”
একটা পাখি পাশের গাছ থেকে ডানা মেলে উড়ে গেল। মুহূর্তটা যেন থেমে গেল তাদের চারপাশে। কোনো কথা নেই, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ আর দু’জোড়া চোখ — একে অন্যকে দেখে, বোঝে, আবার না বোঝার ভান করে।
হঠাৎ অরিত্র ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করল।
“তোর জন্য লিখেছি। পড়বি পরে।”
আনজু কাগজটা নিল, ভাঁজ করে রেখে দিল শালে। উঠে দাঁড়াল।
“আমার এখন ফিরতে হবে। ঈশান ঘুম থেকে উঠে গেলে আমায় না পেলে খুঁজবে।”
“আমি জানি। আমি তো তোকে জোর করিনি।”
“আমি কি আর আসব?”
“তা আমি জানি না। কিন্তু আমি থাকব। ঠিক এভাবেই — তাকিয়ে থাকব, ছুঁবো না।”
আনজু মাথা নোয়াল, হেঁটে ফিরে গেল। পেছনে তাকাল না একবারও, যদিও সে জানত — পেছনে একটা চোখ এখনো তাকিয়ে আছে, স্থিরভাবে।
ফিরে এসে দেখে সুমিত বারান্দায় বসে আছে, হাতে কফির কাপ, চোখে চিন্তার রেখা।
“তুই কোথায় গেলি?”
“ভেতরের পথ ধরে হেঁটে এসেছিলাম,” বলল আনজু, চোখ না তুলে।
“আমি তো ঘুম ভেঙে তোকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম, হয়তো চলে গেছিস… নিজের ভেতরের দিকে।”
আনজু থেমে গেল।
সুমিত কি বুঝে ফেলছে কিছু? নাকি সেও একটা শেষ চেষ্টা করছে?
রাতে ঘুমের আগে, আনজু কাগজটা খুলল। অরিত্রর লেখা —
“ভালোবাসা মানে সবসময় একসাথে থাকা নয়। কখনও ভালোবাসা মানে দূরে দাঁড়িয়ে, কারও মুক্তিকে আশীর্বাদ জানানো।
তুই যদি আমাকে চুপ করে ভালোবাসতে চাস, ভালোবাস।
তুই যদি আমাকে ভুলে যেতে চাস, ভুলে যা।
কিন্তু তোর মনের ভেতর যদি কোনোদিন কিছু অনুচ্চারিত রয়ে যায় — জেনে রাখিস, আমি সেই নীরবতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব, তাকিয়ে থাকব, ছুঁই না।”
আনজুর বুকের ভিতর ফাঁকা হয়ে গেল। এতটা ভালোবাসা, এতটা নিরবতা, এতটা অধিকার ছাড়াও — এটা কীসের নাম?
সে জানত না এই গল্পটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে। তবে জানত, এই গল্প আর আগের মতো নয়। সে নিজে আর আগের মতো নেই।
পর্ব ৬: চোখের ভাষা, মুখের নয়
ফেরার ট্রেনটা রাত দশটায় পৌঁছেছিল। শহরের বাতাসে একটা অচেনা শীত লাগছিল — পাহাড়ের নিঃসঙ্গতা ছেড়ে ফেরত আসা এই শহর যেন এক বদ্ধ ঘরের মতো। যেখান থেকে মন যত দূর ছুটতে চায়, শরীরের টান ততটাই তাকে বেঁধে রাখে।
তিনটে দিন কেটে গেছে ঘরে ফিরেও। আনজু যেন সব কিছু আগের মতো করে — রান্না করে, ঈশানকে পড়ায়, বাজারের তালিকা লেখে, সুমিতের জামা-জুতো গুছিয়ে রাখে। কিন্তু সে জানে, সে আর আগের মানুষ নয়।
সেই সকাল, সেই গাছতলা, সেই চোখ—সবকিছু এখনো তার শরীরের ভিতরে গেঁথে আছে। অরিত্র কিছুই চায়নি—না ছোঁয়া, না দেখা, না কোনো প্রতিশ্রুতি। শুধু চেয়েছিল তাকে দেখতে, বুঝতে, ভালোবাসতে—অবিকল তার মতো করে।
সন্ধ্যায় আনজু যখন বারান্দায় দাঁড়াল, তখন একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার বুকের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জানে, সামনে ছাদে অরিত্র থাকবে না। সে শহরে নেই। কিন্তু তাও চোখ চলে যায় সেই দিকেই — যেমনটা যায় অভ্যেসে, যেমনটা যায় ভালোবাসার চেনা রাস্তা ধরে।
হঠাৎ ঈশান এসে বলল,
“মা, জানো? স্কুলে একটা অভিনয়ের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। আমি ‘চোখের ভাষা’ নামের একটা নাটকে অংশ নিচ্ছি।”
আনজু অবাক হয়ে তাকাল,
“সে আবার কেমন?”
“মানে যেখানে মুখে কথা বলা যাবে না, শুধু চোখ দিয়ে সব অভিব্যক্তি বোঝাতে হবে।”
আনজুর বুকটা ধক করে উঠল। কী আশ্চর্য! যেন ঈশান নিজের অজান্তেই মায়ের গল্পটা মঞ্চস্থ করতে চাইছে। গত কয়েক মাসে সে যা বলেছে, সবই তো ছিল চোখের ভাষায়। মুখে কিছুই বলে উঠতে পারেনি।
সেই রাতে, আনজু শুয়ে ছিল, ঘুম আসছিল না। পাশের ঘরে সুমিত নরম নরম গুঞ্জনে ঘুমোচ্ছে। আর সে চুপ করে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। হঠাৎ ফোনটা বাজল — নীচু টোনে, চেনা নাম স্ক্রিনে জ্বলছে।
অরিত্র।
এক মুহূর্ত দম বন্ধ হয়ে এল তার। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরল।
“তুই ফিরেছিস?”
“ফিরিনি। আমি পাহাড়েই আছি, কিন্তু তোর শহরের আকাশ আজ খুব কাছে লাগছে।”
“কেন ফোন করলি?”
“শুধু জানতে ইচ্ছে করল, তোর চোখে এখন কী আছে? ভালোবাসা? না অপরাধ?”
আনজু চুপ। খুব চুপ। তারপর বলল,
“আমি কিছুই জানি না, শুধু জানি, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিছু না চাওয়া ভালোবাসার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোর চোখ আজ নেই আমার সামনে। আমি শুধু তাকিয়ে আছি শূন্য দিকে।”
“শূন্য জায়গায় তাকালেই ভেতরের মানুষটা দেখা যায়,” অরিত্র বলল।
“তুই এখনও ভালোবাসিস?”
“তুই যদি আর না ফিরিস, তাও আমি ভালোবাসব। কারণ এটা তো আমার ভাষা — চোখের ভাষা, মুখের নয়।”
ফোনটা রেখে আনজু জানালার পাশে বসে পড়ল। বাতাসে পাতার হালকা শব্দ, কোথাও একটা কুকুরের ডাক, আর তার ভিতরে শব্দহীন প্রেমের ঢেউ।
পরদিন সকালেই সুমিত বলল,
“আজ না আমার প্রোমোশন ফাইনাল হয়েছে। পার্টির প্ল্যান হচ্ছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ। আমি চাই, তুই আমার সঙ্গে ওই পার্টিতে আসিস।”
“আমি?”
“হ্যাঁ, আমার স্ত্রী হিসেবে, সঙ্গী হিসেবে — অনেকদিন তোকে আমার পাশে চাইনি, আজ চাই।”
আনজু অবাক হয়। কী এক অদ্ভুত টানাপোড়েন! এদিকে একদিকে নিষিদ্ধ ভালোবাসা, অন্যদিকে পুরনো সম্পর্কে নতুন করে টান দেওয়ার চেষ্টা।
সন্ধ্যায় সে মেকআপ করল হালকা করে। একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরল, গলায় ছোট্ট মুক্তোর হার, চোখে সামান্য কাজল। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে চমকে গেল। এতদিন পর নিজের দিকে ভালোভাবে তাকাল কি?
পার্টিতে সুমিত ওকে গর্ব করে পরিচয় করাচ্ছে—“এই আমার স্ত্রী, আনজু।”
কেউ কেউ বলছে, “ওমা, আপনাদের দেখে তো মনে হচ্ছে কলেজে প্রেম করছেন আবার!”
আনজু হাসছে, মাথা নাড়ছে, কিন্তু তার চোখে যেন কেউ পড়ে ফেলছে—একটা গোপন অরণ্য, যেটা মুখে বলা হয় না।
পার্থ নামের একজন সহকর্মী এসে বলল,
“আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি অনেক কিছু দেখেছেন, কিন্তু কাউকে বলেননি।”
আনজু হেসে বলল,
“ভালো চোখ সব দেখে, মুখে বলে না।”
এইসব কথার মধ্যেও তার চোখ খুঁজছিল অরিত্রকে। কি আশ্চর্য, সে জানে লোকটা এখন পাহাড়ে, তারপরও তার মনে হচ্ছিল, ভিড়ের মধ্যে কোথাও হয়তো একটা তাকানো চোখ লুকিয়ে আছে, তাকে পড়ছে, বোঝার চেষ্টা করছে।
রাতে ফিরে এসে সুমিত বলল,
“আজ অনেকদিন পর তোকে দেখে ভালো লাগল। তুই কি ফিরে এলি?”
আনজু চুপ করে ছিল। তারপর ধীরে বলল,
“আমি কোথাও যাইনি, আমি শুধু নিজেকে খুঁজছিলাম।”
সুমিত ওর দিকে তাকাল।
“তুই যা খুঁজছিস, সেটা যদি আমিও খুঁজি, তাহলে কি আমাদের দেখা হবে?”
“হয়তো।”
সেই রাতে, বিছানায় শুয়ে, আনজু হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ পাঠাল —
“তুই যদি কখনও জানতে চাস, আমি মুখে কিছু বলিনি কেন — মনে রাখিস, চোখের ভাষা ছিল অনেক গভীর। আমি বুঝিনি, আমার চোখও কথা বলে, তুই না বললে কেউ বুঝত না।”
পর্ব ৭: চিরকুটের ভেতর গোধূলি
শহরের আকাশে গোধূলি নেমেছে। দিনের শেষে আলো আর অন্ধকারের মাঝখানে এই অদ্ভুত সময়টা যেন মানুষের মনের দ্বিধার মতো—কী ফেলে যাই, আর কী সঙ্গে রাখি, বোঝা যায় না।
আনজু আজ বারান্দায় বসে আছে এক কাপ কফি নিয়ে, সামনে চৌরঙ্গীর মোড়। দূরে একটা বাচ্চা কাক গাড়ির ছায়া ফেলে হাঁটছে, রিকশা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে—সবকিছু যেন সেই একই, কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা অন্যরকম। তার কোলের উপর একটা ছোট্ট চিরকুট রাখা, যেটা সে আজ দুপুরে সিঁড়ির ধারে পেয়েছে, একটা বাদামী খামের ভেতর।
কোনো প্রেরকের নাম নেই, কেবল লেখা—
“তুই ভাবিস তুই হারিয়ে যাচ্ছিস। আসলে তুই খুঁজে পেতে শিখছিস। চোখের ভাষা পড়ে যে চিঠি লেখা যায়, সেটা কেউই পায় না—তুই পেয়েছিস। গোধূলি নামে যারা, তারা রাত নয়, তারা আলো নিয়ে ফেরে।”
হাতের লেখা অরিত্রর, নিঃসন্দেহে। কিন্তু সে তো শহরে নেই! তবে? এই চিরকুট কীভাবে এলো? আনজুর মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল, যেন আবার কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে, আবার কিছু একটা ফিরে আসছে।
সেই রাতেই অরিত্রর মেসেজ এলো—
“আমি শহরে ফিরিনি। কিন্তু তোর শহর আমাকে টেনে নিচ্ছে, তোর চোখের ভাষা আমার অপেক্ষার পাশে বসে আছে। আমি আর কিছু চাই না, শুধু একটা জিনিস জানাতে চাই—ভালোবাসা কখনও মুছে যায় না, শুধু রূপ বদলায়।”
আনজু উত্তর দিল না। তবুও সে জানে, তার ভিতরে কিছু বদলে গেছে।
পরদিন সকালে সুমিত অফিসে চলে যায়, ঈশান স্কুলে। আনজু একা ঘরে। চুপচাপ এক কাপ চা নিয়ে পুরনো বইয়ের তাক ঘাঁটছিল। হঠাৎ “নীল রঙের অরণ্য” বইটা আবার চোখে পড়ল। খোলা পাতায় পড়ে ছিল সেই চিঠির মতো বাক্যগুলো।
তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখে পিওন দাঁড়িয়ে—
“ম্যাডাম, আপনার নামে একটা পার্সেল।”
আনজু সই করে প্যাকেটটা নেয়। খুলে দেখে, ভেতরে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স, তার ভিতরে একটা হাতঘড়ি। ঘড়ির কাঁটা চলছে না।
ঘড়ির নিচে একটা সাদা কাগজ—
“সময় সব কিছু বলে না, কিছু সময় থেমে যায়, শুধু মনে করিয়ে দিতে—তুই তখন কোথায় ছিলি, আর কে তখন তোর কথা ভাবছিল।”
আনজুর গলা শুকিয়ে এল। এই ঘড়িটা! এ তো সেই ঘড়ির মতো, যেটা অরিত্র একদিন দেখিয়ে বলেছিল—
“যখন তুই কিছু বলবি না, এই ঘড়ি তোর হয়ে বলবে। সময়ের থেমে যাওয়া মানেই সব শেষ নয়, কখনও শুরুও হতে পারে।”
তখন হঠাৎ ফোন বেজে উঠল—সুমিত।
“আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরব। সিনেমা দেখতে যাবি?”
“সিনেমা?”
“হ্যাঁ। তোর পছন্দের পরিচালক এসেছে। পুরনো প্রেমের গল্প, কিন্তু নতুন করে বলা। ভাবলাম, তুই পছন্দ করবি।”
আনজু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আচ্ছা, যাব।”
সন্ধ্যায় তারা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে গেল। থিয়েটারের ভেতর অন্ধকার, স্ক্রিনে প্রেম, বিচ্ছেদ, পুনর্মিলনের গল্প চলছে। সুমিত আনজুর হাত ধরে বসে আছে। বছর দশেক পর তারা একসঙ্গে সিনেমা দেখছে।
চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যে, এক পুরুষ চরিত্র বলে—
“যাকে ভালোবাসি, তাকে পেতে চাই না। শুধু চাই সে যেন ভালো থাকে, এমন কেউ তার পাশে থাকে যে ওর চোখের ভাষা পড়তে পারে।”
আনজুর চোখ ঝাপসা হয়ে এল। সুমিত কি তার চোখের ভাষা পড়তে পারছে এখন?
সিনেমা শেষে সুমিত বলল,
“আজ তুই কেমন যেন বদলে গেছিস। আগের থেকে নরম, কিন্তু অনেক দৃঢ়।”
“তুমি কি আজকাল আমাকে নতুন করে দেখছো?”
“হ্যাঁ। মনে হচ্ছে, আমি যাকে চিনি, সে নিজেকে নতুন করে চিনছে।”
ফেরার পথে, আনজুর চোখ বারবার খুঁজছিল ছায়া, মুখ, চোখ — কেউ কি এই রাস্তায় হাঁটছে? কেউ কি জানে, এই মেয়েটি তার জন্য অপেক্ষা করত বহু সন্ধ্যায়, কেবল বারান্দায় দাঁড়িয়ে?
রাতে, সে ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ লিখল—
“তুই যদি কখনও একবার বলিস, তুই আর আসবি না, তাও আমি জানব, তুই আমার মধ্যে থেকেই যাবি। তোর চিরকুটের ভিতরে যে গোধূলি আছে, সে আলোর নাম দেয় না, শুধু ছায়াকে স্পষ্ট করে।”
ক্লান্ত রাতে, জানালার পাশে বসে আনজু একা, কিন্তু একা নয়। তার পাশে আজ অনেক অনুচ্চারিত শব্দ বসে আছে, অনেক না বলা ভালোবাসা, অনেক চোখের ভাষা।
তিন দিন পরেই ঈশানের নাটক। আনজু নিজে সাজাচ্ছে ওকে—মুখে কোনো সংলাপ নেই, কেবল চোখ। সে জানে, ওর চোখ বলবে সব। যেমন কেউ একদিন শিখিয়ে দিয়েছিল—ভালোবাসা মুখে নয়, চোখে লেখা থাকে।
পর্ব ৮ (শেষ): যেখানে ছায়া কথা বলে
ঈশানের নাটক আজ। পুরো স্কুলের হলরুমে উচ্ছ্বাস, আলো, ব্যস্ততা। পিতা-মাতারা সামনের সারিতে বসেছেন, শিশুরা ঘোরাফেরা করছে মঞ্চপেছনে। আনজু শাড়ি পরে এসেছে—হালকা নীল, একদম সাদামাটা, কিন্তু তার মুখে আজ একরকম দীপ্তি। সুমিত পাশে বসে। তার চোখেও আজ প্রশান্তি। যেন অনেকদিন পর তারা একই ছবি দেখতে এসেছে—একটা সম্পর্কের, একটা পরিবারের।
নাটকের নাম “চোখের ভাষা”। কথা নেই, সংলাপ নেই। শুধু মুখভঙ্গি আর চোখ দিয়ে অভিনয়। ঈশান মঞ্চে এল, কাঁধে স্কুলব্যাগ, চোখে ক্লান্তি। নাটক শুরু হল—বাবা-মায়ের ভেতরকার দূরত্ব, মায়ের নিঃশব্দ কান্না, ছেলের অসহায়তা। ঈশান অভিনয় করল একজন সন্তান হিসেবে, যে তার মায়ের চোখ দেখে বুঝতে শিখেছে ভালোবাসা, বিষণ্নতা, অভিমান।
আনজুর বুক ধকধক করে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়ানো এই শিশুটার চোখে কি ওর নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে? ঈশান কি জানে তার মায়ের ভিতর কতগুলো নীরব গল্প জমে আছে? সে কী জানে, এই নীরবতা কোনো একদিন ভালোবাসার আকুলতায় গড়ে উঠেছিল?
নাটক শেষে করতালি পড়ল। সুমিত বলল,
“ও যে এত ভালো অভিনয় করে, জানতাম না।”
আনজু হেসে বলল, “ও তো সব কিছু দেখে, মুখে না বলেও বোঝে।”
ফিরে আসার পর আনজু একা বারান্দায় দাঁড়াল। সন্ধ্যাটা যেন আজ একটু বেশি স্নিগ্ধ, একটু বেশি পরিণত। হঠাৎ ফোনটা বাজল। অরিত্র। দীর্ঘদিন পর।
হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নিঃশব্দ। তারপর ধীরে ধীরে কথা এল,
“তুই কি এখনো তাকিয়ে থাকিস?”
“হ্যাঁ, কিন্তু ছুঁই না।”
“তুই কি আর আসবি না?”
“না অরিত্র, আমি আসব না। কিন্তু আমি থাকব। আমি থাকব তোর দেওয়া ছায়ার ভেতর, তোর লেখা শব্দের পাশে।”
অরিত্র চুপ। তারপর বলল,
“তুই তো এখন আলো। আমি ছায়া। তুই চলে গেলেও, আমি তোর ছায়াকে বাঁচিয়ে রাখব।”
“আমার জীবন আবার নতুন আলো খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু তোর দেওয়া ছায়া না থাকলে আমি নিজেকে চিনতেই পারতাম না।”
ফোনটা কেটে যাওয়ার পর আনজু মেসেজ পাঠাল—
“ভালোবাসা সবসময় পাশে থাকা নয়, কখনও কখনও পিছনে দাঁড়িয়ে ছায়া হয়ে যাওয়াই ভালোবাসা। তুই আমার ছায়া হয়ে থাকিস। আমি তোর আলো হয়ে থাকি দূরে।”
সে জানে, এই সম্পর্ক সমাজে মান্যতা পাবে না। সে জানে, সুমিত তাকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখছে। সে জানে, ঈশান তার চোখে সব বুঝে গেছে।
কিন্তু সে এটাও জানে—যে ভালোবাসা দাবী করে না, কিন্তু প্রতিটি সন্ধ্যায় চুপচাপ অপেক্ষা করে, সেই ভালোবাসাই মানুষকে ভেঙে আবার গড়ে তোলে।
রাতে ঘুমানোর আগে সে নিজের খাতায় লিখল—
“আমি আজ চুপ। মুখে কিছু বলি না। কিন্তু বারান্দায় দাঁড়ালে ছায়া নিজেই কথা বলে। আমি এখন জানি, ভালোবাসা কখনও চিৎকার করে না। সে বারান্দার বাতাসে ফিসফিস করে, একটা পুরনো ঘড়ির থেমে যাওয়া কাঁটার মতো।”
সুমিত এসে পাশে বসে বলল,
“তুই এত শান্ত কেন?”
আনজু তাকাল, বলল,
“কারণ আমি ছায়াকে ক্ষমা করে আলোতে ফিরেছি।”
সুমিত চুপ করে ওর হাত ধরল।
সেই মুহূর্তে, জানালার কাঁচে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। দূরে কোথাও কেউ হয়তো আজও দাঁড়িয়ে আছে, জানালার ওপারে, এক কাপ চা হাতে, মুখে কোনো শব্দ নেই। কিন্তু তার চোখে আছে এক অনন্ত অপেক্ষা।
আনজু জানে, ভালোবাসার শেষ নেই। কেবল রূপ বদলে যায়।
কখনও সে হয় বারান্দা, কখনও ছায়া, কখনও চিরকুটে লেখা একটি অমোচনীয় সন্ধ্যা।
সমাপ্ত