Bangla - ছোটদের গল্প - সামাজিক গল্প

নির্বাক পুতুল

Spread the love

সুব্রত দাশগুপ্ত


রিমার চোখে এই শহর ছিল এক স্বপ্নময় চিত্রপট — বড় বড় বিল্ডিং, আলোর রোশনাই, গাড়ির একটানা শব্দ, আর ছাদের ওপর নীল আকাশে উড়তে থাকা সাদা পায়রার মতো সুখ। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগেনি। মায়ের মৃত্যুর পরে মামা তাকে শহরে নিয়ে আসে, একটা “ভালো” বাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। বয়স দশ হলেও, রিমা জানত কাজ বলতে কী — খাটুনি, হাঁটু পর্যন্ত ঝাঁপ দেওয়া, বকুনি খাওয়া আর সবশেষে নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুতে ঘুমিয়ে পড়া। প্রথম দিন শহরে এসে মালবিকার বাড়িটা দেখে তার মনে হয়েছিল, এ যেন এক রাজপ্রাসাদ। চারপাশে ঝকঝকে কার্পেট, অচেনা গন্ধে ভরা ঘর, দেয়ালে টাঙানো ছবি আর চকচকে সিঁড়ি। কিন্তু সেই চকচকে দেয়ালের ফাঁকেই ছিল তার বন্দিত্বের শুরু। রিমা জানত না, পুতুল হয়ে যাওয়ার মানে কী — যতদিন না সে নিজেই এক ‘নির্বাক পুতুল’ হয়ে ওঠে।

প্রথম সকালেই রিমাকে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ঝাঁটা। রান্নাঘরের মেঝে মোছা, জামাকাপড় ধোয়া, মালকিনের শাড়ি ঠিক করে ভাঁজ করে রাখা — সবই তার দায়িত্ব। কেউ জিজ্ঞেস করেনি সে কিছু খেয়েছে কিনা, কেউ বলেনি তার নামটা কী। “ওই মেয়ে, আয় তো!” — এই ডাকেই সে সাড়া দিতো। তারই বয়সী মালবিকা যখন নতুন বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে বেরোত, তখন রিমা জানালার আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকত। সেই ব্যাগের গন্ধ যেন তার নাকের ভিতর ঢুকে হৃদয় ছুঁয়ে যেত। মালবিকার হাতে চকচকে পুতুল, ভিডিও গেম, রঙিন বই — আর তার হাতে কেবল থালা-বাসন, লিকলিকে সাবানের ফেনা। তবুও রিমা হাঁসফাঁস করত না। কারণ, এই রাজপ্রাসাদের বাইরে যে বাস্তবতা ছিল, সেটা ছিল আরও নিষ্ঠুর — গ্রামের সেই খড়ের ঘর, ক্ষুধার রাত, আর মাতৃহীন কোলের শূন্যতা।

একদিন দুপুরে মালকিন বাইরে, মালবিকা তার ঘরে খেলছে। রিমা জামাকাপড় ভাঁজ করতে করতে খেয়াল করল, খাটের ওপরে একটা খোলা বই পড়ে আছে — বইটায় আঁকা বড় বড় অক্ষর, পাশে রঙিন ছবি। সে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বইটা খুলল। তার চোখ যেন ঝলসে গেল, এত রঙ, এত শব্দ! হঠাৎ, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মালবিকাকে দেখে সে বইটা ফেলে দিতে চাইল, কিন্তু মালবিকা বলল, “তুমি কি পড়তে চাও?” রিমা কেঁপে উঠল, ভাবল এখন বুঝি বকা খেতে হবে। কিন্তু মালবিকা হাসল, বইটা বাড়িয়ে বলল, “এই পাতা থেকে পড়ো।” রিমা কিছু পড়তে পারল না, কেবল ‘অ’ চিনতে পারল — “এটা আমি জানি, এই অ আ ক খ!” মালবিকা অবাক হয়ে তাকাল, তারপর বলল, “তুমি স্কুলে যাও না কেন?” প্রশ্নটা যেন রিমার বুকের ভেতর কিছু ছিঁড়ে দিল। সে কিছু বলল না, শুধু জানালার দিকে তাকাল — যেখান দিয়ে হাওয়ায় ভেসে আসছে এক হারিয়ে যাওয়া শৈশবের ঘ্রাণ।

ভোর পাঁচটা বাজতেই রিমার ঘুম ভেঙে যায়। একটা ছোট্ট চৌকাঠের পাশে পাতলা তোশকে ঘুমায় সে, যেখানে একদিকে রান্নাঘরের ধোঁয়া, অন্যদিকে বাথরুমের গন্ধ এসে মিশে থাকে প্রতিদিনের সকালকে ঝাপসা করে দেওয়া এক কুয়াশায়। ঘুম ভাঙতেই চোখ কচলাতে কচলাতে সে জল গরম করে, চা বসায়, তারপর রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে মালকিনের রুটি বানানোর হুকুম পালনে। ঘড়ির কাঁটা ছয়টায় পৌঁছাতেই বাড়িটা জেগে ওঠে, আর রিমার গলার ওপর চাপ পড়ে মালকিনের চিৎকারে: “ওই মেয়ে, জামাটা ইস্ত্রি করলি না এখনো?” তার দিনটা এমনই — কাজ আর কাজ, মাঝে মাঝেই একটা থালা পড়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়া, তার জেরে কপালে একটা ঠাস করে চড়। কিন্তু এই নিয়মের মধ্যেও একটা জিনিস ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল — মালবিকার চোখে রিমাকে দেখা।

মালবিকা আগে রিমাকে দেখত না বললেই চলে। রিমা ছিল ওর কাছে একটা পটুল, একটা ছায়ামানবী, যার কাজ হল ওর খেলনা গুছিয়ে দেওয়া বা চুপি চুপি খাটের নিচে গড়িয়ে যাওয়া বলটা এনে দেওয়া। কিন্তু সেদিন, যখন সে রিমাকে “অ” চিনতে দেখে, তার ভেতরে কিছু নড়ে উঠেছিল। পরদিন সকালেও সে লক্ষ্য করল, রিমা দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখছে — মালবিকা নতুন স্কুল ব্যাগ খুলছে, বই গুছাচ্ছে। সে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা বই রিমার দৃষ্টির সামনে খুলে রাখল, তারপর দেখল, রিমা থেমে থেমে তাকিয়ে আছে পাতার দিকে। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোতে শুরু হল তাদের এক নীরব সেতু — একদিকে খেলনার রাজ্যে রাজকুমারী মালবিকা, আর একদিকে থালাবাটি রাজ্যের নিঃশব্দ দাসী রিমা। মালবিকার মনে প্রশ্ন জমে উঠল — “আমার মতোই তো দেখতে, তাহলে কেন ও পড়তে পারে না? কেন ওর খেলার সময় নেই?”

দুপুরে রিমা কাজ সেরে ছাদে গিয়েছিল শুকোতে দেওয়া কাপড় তুলতে। হঠাৎ মালবিকা উঠে এসে পাশে দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করে, “তুমি কবে থেকে এখানে আছো?” রিমা মাথা নিচু করে বলে, “তিন মাস।” মালবিকা বলে, “তুমি কি আগে কোনোদিন স্কুলে গেছিলে?” রিমা মাথা নাড়ায়, “না।” এরপর তারা দুজন ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, চুপচাপ। দূরে স্কুলের ঘণ্টা বাজে। রিমা তার বুকের ভেতর কিছু কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমি পড়তে চাই।” মালবিকা চমকে ওঠে, আবার তাকায় রিমার দিকে — এই মেয়েটা তো তার মতোই, দুটো চোখ, একটা হাসি, একটা মন — কেবল সময়টা তাকে পুতুল বানিয়ে রেখেছে। সেই মুহূর্তে মালবিকার মনে প্রথমবার একটা বোধ জাগে — ন্যায়ের, অমানবিকতার, আর এক সত্যিকারের বন্ধুত্বের।

সেদিন বিকেলে মালবিকা তার স্কুলব্যাগ থেকে বাংলা পাঠ্যবইটা বের করে টেবিলে রেখে বাইরে খেলতে গিয়েছিল। রিমা, মালকিনের নির্দেশে ঘর মুছছিল। হঠাৎ চোখে পড়ে বইটা — খোলা পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা: “আমার প্রথম দিন”। গা ছমছমে এক আকর্ষণে টেনে নেয় তাকে সেই পাতার দিকে। জলমুছা কাপড়টা এক পাশে রেখে সে বসে পড়ে বিছানার ধারে, নিঃশব্দে বইটা কোলে তোলে, আঙুল ছুঁয়ে দেখে ‘অ’, ‘আ’, ‘আম’, ‘আলো’। শব্দগুলো সে চিনে, আংশিক। বইয়ের গন্ধটা যেন তার হারিয়ে যাওয়া কিছু ফিরিয়ে আনে — গ্রামে থাকা ছোটমাসির ছেলের বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়, যেটা হাতে নিয়ে একদিন বলেছিল, “আমিও একদিন স্কুলে যাবো!” সেই স্বপ্নটা তখন কেউ গুরুত্ব দেয়নি, যেমন আজও কেউ দিচ্ছে না।

মালবিকা হঠাৎ ফিরে আসে ঘরে, দেখে রিমা বইয়ের ওপর ঝুঁকে আছে। সে চমকে ওঠে, কিন্তু রাগ করে না। ধীরে ধীরে কাছে এসে বলে, “এইটা তুমি বুঝতে পারো?” রিমা লজ্জায় চোখ নিচু করে ফেলে বইটা। মালবিকা বইটা তুলে আবার খোলে, বলল, “দেখো, এখানে লেখা ‘আমার প্রথম দিন’ — তুমি বলো তো, ‘অ’ কোনটা?” রিমা আঙুল তুলে ‘অ’ চিনিয়ে দেয়, গলা নামিয়ে বলে, “আমি একটু একটু পারি।” মালবিকার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, যেন রিমা তার নতুন খেলার সঙ্গী — কিন্তু এই খেলা পুতুল-গাড়ির নয়, এটা অক্ষরের, কল্পনার, জানার খেলা। মালবিকা এক পাতা পড়ে শোনায়, আর রিমা চুপচাপ শোনে — শব্দগুলো যেন তার বুকের ভিতরে গেঁথে যায়।

এরপরের কয়েকদিনে মালবিকা নিজের পাঠ শেষ করে রিমাকে শব্দ শেখায় — লুকিয়ে, ধীরে ধীরে, প্রতিদিন দুপুরে যখন মালকিন ঘুমোতেন। “আলো”, “জল”, “ঘর” — শব্দগুলো রিমা শিখতে থাকে, লিখতেও চেষ্টা করে মালবিকার পুরনো খাতায়। একদিন হঠাৎ রিমা বলে ওঠে, “আমারও একটা নাম আছে, আমি শুধু ‘ওই মেয়ে’ না — আমি রিমা।” মালবিকা থমকে যায়। এতদিন ধরে সে-ও তো “ওই মেয়ে” বলেই ডেকে এসেছে। সেই দিন থেকে মালবিকা রিমাকে নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। আর এই ছোট্ট নামেই রিমা যেন নিজের অস্তিত্ব ফিরে পায়। এক শিশুর হাতে যখন কাগজ আর পেন্সিল তুলে দেওয়া হয়, তখন সেটা শুধুই লেখার উপকরণ হয় না — সেটা হয়ে ওঠে তার আত্মা, তার জীবনের প্রথম ছাপ।

মালবিকার মনে এক অদ্ভুত রকম অস্বস্তি জমে উঠেছিল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে রিকশায় বসা এক সমবয়সী মেয়েকে দেখে সে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেছিল, “মা, ওরা কেন স্কুলে যায় না?” মা বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “ওরা গরিব ঘরের মেয়ে, ওদের পড়ালেখা করে কী হবে?” — কথাটা তখন অতটা তাড়না দেয়নি, কিন্তু রিমার সঙ্গে যখন তার অক্ষর শেখা শুরু হল, তখনই সে বুঝতে পারল—গরিব হওয়া মানে কি শৈশব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাওয়া? মালবিকা প্রথমবার নিজের জীবন আর রিমার জীবনের ফারাকটা দেখতে শেখে। দু’জনেরই বয়স প্রায় এক, কিন্তু একজনের হাতে বই, আরেকজনের হাতে বাসন। একজন খায় পাস্তা বা চিজ স্যান্ডউইচ, অন্যজন খায় ঠান্ডা বেঁচে যাওয়া ভাত। তবুও, দু’জনেরই চোখে একই রকম কৌতূহল, একইরকম স্বপ্ন — শুধু একজনের স্বপ্নে আলো পৌঁছায়, অন্যজনের স্বপ্ন আঁধারে ঢাকা পড়ে থাকে।

একদিন স্কুলে সমাজ বিজ্ঞান ক্লাসে ‘শিশুশ্রম’ নিয়ে একটি আলোচনায় শিক্ষক বললেন, “এখনও বহু শিশু ঘরে, দোকানে বা রেস্তোরাঁয় কাজ করে। আমরা কেউ যদি তা দেখি, প্রতিবাদ করা উচিত।” মালবিকার বুক কেঁপে উঠল। সে তো রোজ এমন এক শিশুকে দেখছে, যে তার বাড়িতেই কাজ করছে। কিন্তু সে কি প্রতিবাদ করতে পারে? সেটা কি মা-বাবার বিরুদ্ধে যাওয়া হবে? — তার ভিতরে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সে রাতে মা-বাবার সামনে খুব স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করল, “রিমা কি আমার বয়সী না?” মা চোখ না তুলে বললেন, “হ্যাঁ তো, কী হয়েছে?” — “তাহলে ও স্কুলে যায় না কেন?” মা বিরক্ত হয়ে বই পড়তে বললেন। বাবা একটু নরম সুরে বললেন, “ওদের সংসার চালাতে হয় মা, ওর মা নেই, মামা এনে দিয়েছে কাজ করতে। তুমি এসব নিয়ে ভাবছো কেন?” মালবিকার গলা নরম হয়ে আসে, “কারণ ওরও তো ইচ্ছে করে পড়তে, খেলতে… আমায় বলেছে।” কথাটা শুনে মা হঠাৎ চুপ করে যান, হয়তো প্রথমবার সেই গৃহকর্মী মেয়েটির মুখটা মনে পড়ে যায় একজন ‘শিশু’ হিসেবে।

পরদিন দুপুরে, যখন মা চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছেন, তখন মালবিকা রিমার হাতে নিজের পুরনো একটা পেন্সিল আর খাতা দিয়ে বলে, “তোমার জন্য এটা।” রিমার চোখ কেমন যেন জ্বলে ওঠে, কিন্তু সে কিছু বলে না — কেবল কাগজটা হাতে নিয়ে নিজের নামটা লিখতে চায়। পা ঝাঁপিয়ে বসে, পেন্সিলটা খাতায় ছোঁয়ায় — “রি… মা” — এক অস্পষ্ট লেখা, কাঁপা হাতের অক্ষর। মালবিকা বলল, “তুমি পারবে রিমা, আমি জানি।” সেই মুহূর্তে যেন দুই ভিন্ন জগত — ধনী-দরিদ্র, রাজকন্যা আর কাজের মেয়ে — একটা অদৃশ্য সেতুতে দাঁড়িয়ে হাত ধরেছিল। এই সেতু আর পেন্সিলই তখন রিমার জীবনের একমাত্র মুক্তির পথ হয়ে উঠতে শুরু করে।

মালবিকার স্কুলে একদিন ‘শিশুশ্রম ও শিশুর অধিকার’ বিষয়ে একটি প্রজেক্টের ঘোষণা হয়। ক্লাসে শিক্ষক বলেন, “তোমরা চাইল্ড লেবার নিয়ে কাজ করবে — খোঁজ করে বের করবে কোন কোন জায়গায় শিশুরা কাজ করছে, কেন করছে, তাদের জীবন কেমন।” সবাই নানা পাড়ার দোকান, হোটেল বা রাস্তাঘাটের শিশুশ্রমিকদের কথা ভাবতে থাকে। কিন্তু মালবিকার মাথায় শুধু একটা নাম ঘুরছিল — রিমা। সে কি এক শিশুশ্রমিক নয়? সে কি তারই বাড়ির ভিতরে বন্দি একটি জীবন্ত উদাহরণ নয়? সেদিন ক্লাস থেকে ফিরে মালবিকা সরাসরি নিজের ঘরে গিয়ে পুরনো পেনসিলে রিমার নামটা বড় করে লিখল: “RIMA – A SILENT CHILD”। খাতার পাতায় সে লিখতে থাকে — রিমা সকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে, খেতে পায় অবশিষ্ট খাবার, তার পড়াশোনা নেই, খেলাধুলা নেই, ছুটি নেই। সে নিজে তার চোখ দিয়ে যা দেখেছে, তা-ই সে এক নিঃশব্দ প্রতিবাদের মতো লিখে চলেছে।

মালবিকার খাতা ধীরে ধীরে যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছিল — শুধু রিমার কথা নয়, সে সেখানে লিখল তার মায়ের সেই কথাও: “ওদের জীবনের দাম নেই, ওরা কাজের জন্যই জন্মেছে।” এই বাক্যগুলো তাকে আহত করেছিল, আর সেই ক্ষতের মধ্য দিয়েই জন্ম নিচ্ছিল এক সাহস। প্রজেক্ট জমা দেওয়ার দিনে সে ক্লাসে উঠে দাঁড়ায়, সবার সামনে বলে, “আমি যে শিশুশ্রমিকের কথা বলতে এসেছি, সে আমারই বাড়িতে কাজ করে — তার নাম রিমা।” প্রথমে ক্লাসে ফিসফাস পড়ে যায়, কিন্তু শিক্ষিকা থামান না। বরং তিনি বলেন, “তুমি ঠিক কাজ করেছো মালবিকা, সত্যি বলার সাহস অনেকের থাকে না।” এরপর স্কুল থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয় মালবিকার অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে — রিমার বিষয়ে কিছু করণীয় নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে।

চিঠিটা পাওয়ার পর বাড়িতে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে। মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “তুমি এত বড় হয়ে গেছো বুঝি?” বাবা একটু ভেবে বলেন, “আমরা কী করতে পারি ওর জন্য?” মালবিকা থামতে চায় না — সে নিজের জেদে বলে, “রিমাকে স্কুলে পাঠান। ও শুধু কাজের লোক নয়, ও একজন মানুষ, একজন শিশু।” সেই রাতে অনেক কথা কাটাকাটি হয়, দ্বিধা, লজ্জা, সংকোচ — “লোকে কী বলবে”, “অন্য মেয়েরা চলে যাবে” — কিন্তু মালবিকা এক পা-ও পিছোয় না। এবং ধীরে ধীরে, যেমন করে নদী পাথরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে, তেমনি মালবিকার নিষ্পাপ যুক্তির ঢেউ ভেঙে দেয় সমাজের ভিতরের বরফ জমা স্তর — মা অবশেষে বলেন, “আচ্ছা, দেখি কী করা যায়। একবার স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখি।” রিমা তখনো কিছু জানে না, কিন্তু তার চুপচাপ উপস্থিতি এক নতুন বিপ্লবের অনুচ্চ স্বর হয়ে উঠছে, মালবিকার কলমে, চিঠিতে আর ক্লাসরুমে — এক পুতুলের প্রথম প্রতিবাদ।

বাড়িতে তখন অদ্ভুত এক অস্বস্তিকর নীরবতা। মালবিকার মা, অর্ণা সেনগুপ্ত, প্রথমে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না এই পুরো ব্যাপারটা। “আমার মেয়েটা এখন আমাকে শেখাবে কে কী করবে?” — এই প্রশ্নটা যেন তার ভিতরে অভিমান হয়ে বসে ছিল। কিন্তু যখন স্কুল থেকে প্রিন্সিপাল নিজে ফোন করে বললেন, “আপনার কন্যা শিশুশ্রম নিয়ে যে সচেতনতা দেখিয়েছে, তা খুব প্রশংসনীয়। আমরা চাই আপনি ওর পাশে থাকুন”— তখন কিছুটা যেন ভিতরে নড়ে উঠল। তবু লজ্জা, সামাজিক মর্যাদার ভয়, পরিচারিকা হারানোর ভীতি এসব জড়াজড়ি করে ওঁর ভাবনায়। সেই রাতে তিনি চুপচাপ বসেছিলেন নিজের সোফায়, হাতে রিমার বয়স লেখা একটা নথিপত্র, মালবিকার লেখা প্রজেক্ট রিপোর্ট, আর স্কুলের চিঠি। প্রথমবার সেই কাগজে লেখা ছিল — “Rima is just like me, but her voice has no name.” — একটা তীব্র খোঁচা যেন বুক ভেদ করে গেল।

মালবিকা কিন্তু থামেনি। সে একরকম জেদ ধরেই বসেছে — প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে রিমার সঙ্গে অল্পস্বল্প পড়তে বসায়, নতুন নতুন শব্দ শেখায়, খাতায় ছবি আঁকতে বলে, নাম লেখায়। একদিন খেলার ছলে রিমা লিখল, “মা” — সেই একটা শব্দ দেখে মালবিকার গলা জড়িয়ে আসে, সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “তোমারও তো মা ছিল, তাই না?” রিমা মাথা নাড়ায়, চোখে জল। সেই রাতে মালবিকা প্রথমবার মাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি জানো রিমা কবে জন্মায়?” মা বললেন না, শুধু বললেন, “মামা ওকে আমাদের দিয়ে গিয়েছিল বলেই জানি।” — “তুমি কখনো জানতে চেয়েছিলে ও কী চায়, ও কী পারে?” মা এবার চুপ করে রইলেন, মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। সেই নীরবতা যেন ভিতরের একটা প্রাচীন প্রাচীর ভেঙে ফেলছিল — মা বুঝলেন, এটা শুধুই মেয়ের এক জেদ নয়, এটা একটি ন্যায়বোধ থেকে জন্ম নেওয়া দায়িত্ববোধ।

পরদিন সকালে মালবিকার মা নিজেই একটি স্থানীয় এনজিও-তে ফোন করে সাহায্য চান — “আমাদের বাড়িতে একটি শিশু কাজ করছে, কিন্তু আমরা চাই ও স্কুলে যাক। আপনারা কি সাহায্য করতে পারবেন?” ফোনের ওপার থেকে এক প্রশান্ত কণ্ঠ বলে, “অবশ্যই ম্যাডাম, এটা একটি বড় পদক্ষেপ।” বিকেলে যখন এনজিওর এক কর্মী এসে রিমার সঙ্গে কথা বলেন, তখন সে চুপ করে ছিল, মাথা নিচু করে, কারণ এতদিনে তার শিখে যাওয়ার অভ্যাস — প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া। কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমি পড়তে চাও রিমা?” — তখন সে ধীরে ধীরে চোখ তুলে বলে, “হ্যাঁ, আমি পড়তে চাই।” এই প্রথম, এই বাড়ির ড্রইংরুমে রিমার কণ্ঠ শোনা যায় নিজের স্বরে — ভয় না পেয়ে, সংকোচ না করে। আর মা… অর্ণা সেনগুপ্ত, যিনি এতদিন তাকে দেখতেন একজন ‘সহকারী’ হিসেবে, সেই প্রথম তাকালেন একজন শিশুর চোখে — যেখানে অভিমান, আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চনা আর লুকোনো স্বপ্ন জড়াজড়ি করে আছে। তার মনে হল, মালবিকার প্রতিবাদ আসলে কেবল এক পুতুলের নয় — তা ছিল এক মায়েরও জাগরণ।

এক রবিবার সকালে, ঘুম থেকে উঠে রিমা দেখে তার বিছানার পাশে রাখা আছে একটা ছোট প্যাকেট। সে অবাক হয়ে তাকায়—তার তো কোনও জিনিস থাকে না নিজস্ব। প্যাকেটটা খুলতেই চোখে পড়ে এক নতুন খাতা, সঙ্গে একটা রংবেরঙের পেনসিল বাক্স। খাতার ওপর গোলাপি কভার, সামনে সাদা বেলুন আর সোনালি অক্ষরে লেখা—”Rima”। নিচে ছোট হরফে—”From Malvika”। রিমা মুহূর্তে থমকে যায়, যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেছে। বুকের ভেতর কোথাও এক চাপা কান্না কাঁপতে থাকে। এ খাতা কেবল খাতা নয়—এ তার স্বপ্নের প্রথম দরজা, তার অস্তিত্বের প্রথম পরিচয়। ধীরে ধীরে সে খাতাটা হাতে তোলে, আঙুল ছোঁয়ায় নামের অক্ষরে, যেন বারবার নিজের নামটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে—”আমি আছি, আমি কেউ একজন, আমি রিমা।”

সেইদিন থেকেই রিমার নতুন দিন শুরু হয়। সকালে কাজের ফাঁকে মালবিকা তাকে আধঘণ্টা সময় দেয়—নতুন অক্ষর শেখায়, সংখ্যা চেনায়, ছবি আঁকতে শেখায়। রিমা শিখতে থাকে “ঘড়ি”, “পাখি”, “মেঘ”, “তারা”—শব্দ নয় যেন ছোট ছোট স্বপ্ন। সে প্রথমবার নিজের নাম পূর্ণ লিখতে শেখে—RIMA। সেই চারটে অক্ষরকে বারবার খাতার পাতায় লিখে যায়, যতক্ষণ না হাত ব্যথা হয়ে যায়। দুপুরবেলা বাড়ির মালকিন—অর্ণা সেনগুপ্ত—ঘুমান। সেই ফাঁকে মা-মেয়ে একসঙ্গে বসে রিমার লেখাপড়ার অগ্রগতি দেখে নেন, আর রিমার মুখে এক অপূর্ব দীপ্তি দেখা যায়—যে আলো কেবল শিখতে চাওয়ার থেকে নয়, নিজের জায়গা ফিরে পাওয়ার আলো।

একদিন বিকেলে রিমা ছাদে বসে চুপচাপ একটা আকাশ আঁকছিল খাতার পাতায়। পাশে দাঁড়িয়ে মালবিকা বলল, “তুমি তো দারুণ আঁকো! তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?” রিমা একটু থেমে বলল, “আমি স্কুল মাস্টারমশাই হতে চাই।” মালবিকা হেসে ওঠে, বলে, “তাহলে তো তুমি আমাকে একদিন পড়াবে!” রিমা লাজুকভাবে হেসে গলায় বলে, “তুমি তো আমায় প্রথম পড়াতে শুরু করেছিলে।” কথাটা শুনে মালবিকা চুপ করে যায়। দূরে রোদের আলো ধীরে ধীরে নরম হতে থাকে। সেই আলোয় তারা দুইজনে বসে থাকে পাশাপাশি—একজন স্বপ্নের ভিতর জন্ম নেওয়া এক শিক্ষক, আর একজন নতুন আলোয় গড়ে ওঠা এক শিক্ষার্থী। এই বন্ধুত্ব, এই খাতা আর এই প্রথম লেখার আনন্দই তখন রিমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। একজন যে শুধু ভালোবাসা দিয়েই একটা শিশুর জীবনের পথ বদলে দিতে পারে—সেই সত্যটা ধীরে ধীরে খাতার পাতায় পাতায় লেখা হয়ে যাচ্ছে।

বছরের শেষ সপ্তাহে, মালবিকার পরিবার চুপচাপ একটা সিদ্ধান্ত নেয়। অর্ণা সেনগুপ্ত, যিনি এতদিন রিমাকে শুধুমাত্র এক “ঘরের মেয়ে” বলেই দেখতেন, এক বিকেলে তার পাশে বসে বলেন, “তোমার স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করছি, রিমা। তুমিও পড়বে মালবিকার সঙ্গে।” রিমার হাতে তখন সেই খাতা, সেই পেনসিল—আর মুখে থমকে থাকা এক বিস্ময়। সে বিশ্বাস করতে পারে না, নিজের কানকে জিজ্ঞেস করে—সত্যি? আমি স্কুলে যাব? নিজের স্কুলব্যাগ থাকবে? ইউনিফর্ম পরব? অর্ণা তার মাথায় হাত রেখে বলেন, “তুমি আর কেবল কাজের মেয়ে নও। তুমি এখন আমাদের পরিবারের একজন। তোমার পড়াশোনা, তোমার স্বপ্ন—সবকিছু আমরা দেখব।” সেই মুহূর্তে রিমা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ভিতরে ভিতরে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কারণ এতদিন ধরে তার জীবনের সমস্ত দরজাগুলো বন্ধই ছিল—আজ প্রথমবার একটা দরজা খোলা পড়ে।

দু’সপ্তাহ পরে, রিমার হাতে এল নতুন স্কুল ইউনিফর্ম, এক জোড়া জুতো, আর একঝাঁক নতুন বই। তার নাম লেখা হলো স্থানীয় একটি সরকারী স্কুলের প্রথম শ্রেণির তালিকায়। যেদিন প্রথম স্কুলে যাবার কথা, সেই সকালে রিমা আয়নায় নিজের ছায়া দেখে একটু থেমে যায়—সে আর সেই পুরনো রিমা নয়, তার চোখে এক নতুন দীপ্তি, ঠোঁটে ধরা ধরা হাসি, আর বুকের ভিতর গুঞ্জন তুলে থাকা অজস্র প্রশ্ন: “কেমন হবে ক্লাসঘর? বন্ধুরা কেমন হবে? আমি কি পারব?” মালবিকা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি পারবে রিমা, কারণ তুমি চেয়েছো। আর যারা চায়, তারা ঠিক পৌঁছে যায়।” গাড়ির জানালায় বসে রিমা বাইরে তাকায়—এই শহরটা আজ আর আগের মতো ভয়ানক বা দুর্দান্ত নয়, এটা আজ তার আপন শহর।

শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, একটি ছোট স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিমা। তার গায়ে নীল-সাদা ইউনিফর্ম, কাঁধে ঝুলছে নতুন ব্যাগ। পাশে মালবিকা, হাত ধরে রেখেছে দৃঢ়ভাবে। পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন অর্ণা সেনগুপ্ত, যিনি আজ আর শুধু এক গৃহিণী নন—একজন মা, যিনি একটি শিশুর শৈশব ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। রিমা ধীরে ধীরে স্কুলের ভিতরে পা রাখে, জানে—এই প্রথম সে নিজের জীবনে সত্যিকারের একজন মানুষ হিসেবে হাঁটছে। তার বুকের মধ্যে আর কোনও ভয় নেই, কণ্ঠে আর কোনও নীরবতা নেই। এখন সে আর নির্বাক পুতুল নয় — এখন সে রিমা। একজন কন্যা, একজন শিক্ষার্থী, একজন স্বপ্ন দেখা মেয়ে। গল্পের শেষে, সূর্যের আলোয় রিমার মুখের জ্যোতি যেন বলে— “আমিও আলো হতে পারি।’’

 

1000039034.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *