Bangla - ভূতের গল্প

নির্বাক দর্পণ

Spread the love

রূপক হালদার


অধ্যায় ১

মুর্শিদাবাদের শেষপ্রান্তে, ভগ্নপ্রায় এক জমিদারবাড়ি — ‘নির্বাণ ভিলার’ — দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের শোকস্তব্ধ কঙ্কালের মতো। ছায়ায় ঢাকা তার প্রবেশপথ, দেয়ালজুড়ে শ্যাওলা আর বিস্মৃতির ছাপ। প্রত্নতত্ত্ববিদ অচিন্ত্য লাহা এই বাড়ির কথা প্রথম শোনেন পুরাতন নথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে—বর্ণনা ছিল সংক্ষিপ্ত: “রায়চৌধুরী রাজপরিবারের ধ্বংসপ্রাপ্ত ভিলা, অচেনা এক আয়নার রহস্য।” এতেই কৌতূহলের জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অচিন্ত্য, যিনি বিলেতে প্রত্নবিদ্যার উপর ডক্টরেট করে ভারতের একাধিক প্রাচীন নিদর্শন উদ্ধার করেছেন, এমন রহস্যময় বর্ণনা উপেক্ষা করতে পারলেন না। ভরা গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে, তিনি পৌঁছালেন সেই জমিদারবাড়ির সামনে—ক্যামেরা, স্কেচবুক, কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি আর এক বুক ইতিহাস-জিজ্ঞাসা নিয়ে। কেয়ারটেকার মাধবচরণ, একটি শীর্ণকায় বৃদ্ধ, প্রায় নিঃশব্দে তাঁকে স্বাগত জানালেন। “এই বাড়ির ভিতরে যাঁরা গেছেন, সবারই কিছু না কিছু হারিয়েছে বাবু… আপনি ইতিহাস খুঁজতে এসেছেন, ঠিক আছে, কিন্তু কিছু যদি জেগে ওঠে, আমি দায় নেব না।” তার গলা কাঁপছিল, চোখে লুকানো ছিল আতঙ্ক। অচিন্ত্য হেসে বিষয়টিকে উড়িয়ে দিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যুক্তিতে, ভূতের গল্পের নয়।

ঘরের ভেতর ঢুকতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ—বিষণ্ন ধুলোর, পুরনো কাঠের, আর কিছু অব্যাখ্যাযোগ্য কিছুর, যা যেন সময়ের অতল থেকে উঠে আসছে। ঘরের একপাশে পড়ে থাকা পুরাতন ছবিগুলো দেখে বোঝা গেল, রায়চৌধুরী পরিবারের ভব্যতা ছিল একসময় অভিজাততার প্রতীক। কিন্তু সবথেকে বেশি নজর কাড়ল একটি ঘর, যার দরজায় তালা। “এই ঘরটা খোলেন না বাবু,” চাপা গলায় বললেন মাধবচরণ। অচিন্ত্য কিছু না বলে চাবিটা নিয়ে তালা খোলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক দমকা হাওয়া যেন শরীর ভেদ করে বেরিয়ে এল। ঘরটা নিঃশব্দ, মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা পুরাতন বইপত্র, উল্টে-পড়া ফ্রেম, আর ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল, ধুলো ধরা আয়না। আয়নাটির চারপাশে কাঠের খোদাই — অশুভ চোখের মত দেখতে প্রতীক, সাপের জিভ বের করা মুখ, আর নিচে খোদাই করে লেখা ল্যাটিন এক বাক্য: “Speculum Mortis”— যার অর্থ “মৃত্যুর দর্পণ”। অচিন্ত্য চমকে উঠলেন। কিছুটা রোমাঞ্চিত হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। প্রতিচ্ছবিতে নিজেকে দেখলেন ঠিকই, তবে চোখের ভিতর যেন কেউ তাকিয়ে আছে। মুহূর্তখানেকের জন্য, যেন মনে হলো প্রতিচ্ছবিটি এক চুল দেরিতে অনুকরণ করছে তার অঙ্গভঙ্গি। ঘরটি হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। অচিন্ত্য অনুভব করলেন, ঘাড়ের পেছনে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। তিনি ফিরে তাকালেন—কেউ নেই।

সেই রাতেই অচিন্ত্য কটেজে বসে দিনপঞ্জিতে নোট লিখছিলেন। প্রতিটি নিদর্শনের ছবি তুলেছিলেন, কিন্তু আয়নার ছবি তুলতেই মোবাইল ক্যামেরা হ্যাং হয়ে যায়। বারবার চেষ্টা করেও আয়নার প্রতিচ্ছবি ধারণ করা গেল না। অদ্ভুতভাবে, আয়নার কাঁচে একটি দাগ ছিল—যা দিনে পরিষ্কার না হলেও রাতে আবছা লেখা দেখা গেল—“তোমার সময় আসছে…” তিনি ভাবলেন, হয়তো পুরনো দাগ, বা আগের কোনো পর্যবেক্ষকের লেখা। কিন্তু তারপরই একটা ঘটনা ঘটল—ঘড়ির কাঁটা মাঝরাত ১২টা ছুঁতেই আয়নার গায়ে এক ঝলক আলো খেলে গেল। কোনো বাহ্যিক আলোর উৎস ছিল না। আয়নায় তখন দেখা গেল অচিন্ত্যর প্রতিচ্ছবির পেছনে একটা ছায়ামূর্তি, যেটা সে নিজে ঘুরে দেখলেই পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই ছায়ার চোখ দুটো যেন আয়নার মধ্য থেকে সরাসরি তাকিয়ে আছে তার চোখে। পরমুহূর্তে অচিন্ত্য ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের দরজা তখনও বন্ধ, বাতাস থেমে আছে, কিন্তু তাঁর বুকের ভেতর অজানা এক আশঙ্কা ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছিল। তখনও তিনি জানতেন না—এই আয়নার ভেতরে রয়েছে সময়ের এমন এক অভিশাপ, যা ইতিহাস নয়, ভবিষ্যৎও নয়—বরং এক নীরব প্রতিশোধ, যা আজ থেকে অনেক শতাব্দী আগেই শুরু হয়ে গেছিল। ‘নির্বাক দর্পণ’ আরেকবার জেগে উঠেছে। এবার হয়তো ইতিহাস শুধু পাঠ নয়, অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে অচিন্ত্যর জীবনে।

অধ্যায় ২

পরদিন সকালে সূর্যের আলো বাড়ির ধূসর দেয়ালে পড়ে যেনও প্রাচীন কালের কাঁচের মধ্যে থেকে আসা ঝাপসা রশ্মির মতো লাগছিল। অচিন্ত্য ভোরবেলায় উঠেই আয়নাটিকে আবার পরীক্ষা করতে ঘরে ঢুকলেন। আয়নার রূপালী পিঠ জুড়ে যেন ঘন কুয়াশার মতো আবরণ, কিন্তু অচিন্ত্য লক্ষ্য করলেন, কুয়াশার মধ্যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত রেখা তৈরি হচ্ছে, যেগুলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি খেয়াল করলেন, আয়নার গায়ে তার প্রতিচ্ছবি ঠিক যেন একটা নির্দিষ্ট ছন্দে দুলছে, যেমন জলেই যেন তার প্রতিবিম্ব। সেই মুহূর্তেই মাধবচরণ এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “একটা চিঠি এসেছে বাবু, কলকাতা থেকে পাঠানো, নামটা দেখছি—জীবন্ত সেনগুপ্ত।” অচিন্ত্য চিঠিটা হাতে নিয়ে অবাক হলেন। জীবন্ত, তার একদা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী, অনেকদিন ধরেই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ছেড়ে এখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। চিঠির খামটি খুলে পড়তে পড়তে অচিন্ত্যর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। জীবন্ত লিখেছেন: “এই আয়নার কথা আমি জানি, অচিন্ত্য। বহু বছর আগে এক গবেষণায় তার উল্লেখ পাই। তুমি যদি সত্যিই ‘Speculum Mortis’-এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে সাবধান হও। এটি শুধু প্রতিচ্ছবি নয়, ভবিষ্যতের ছায়াও দেখতে দেয়। কিন্তু তার মূল্য দিতে হয় সময় দিয়ে… কিংবা জীবন দিয়ে। আয়নাটি মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি দেয়—যা তুমি বদলাতে পারো না। আর একবার যদি সে জেগে ওঠে, সে আর ঘুমোবে না। আয়নার পেছনের আত্মা কোনো মুক্তি চায় না, চায় প্রতিশোধ।” অচিন্ত্য নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখতে লাগলেন—গতরাতের ছায়ামূর্তি, ফিসফিসে শব্দ, আর আয়নায় নিজের পেছনে দেখা মুখটি—সবকিছু যেন জীবন্তের লেখার সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।

চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল আরও একটি পুরাতন স্কেচ, সম্ভবত ব্রিটিশ আমলে আঁকা, যেখানে ‘নির্বাণ ভিলার’ একটি অভ্যন্তরীণ অংশ দেখানো হয়েছে—তার মধ্যেই আয়নার অবস্থান স্পষ্ট করা আছে। তবে অদ্ভুত বিষয়, ছবির নীচে লেখা ছিল: “দয়ানিধি রায়চৌধুরী, আয়নার কারাবন্দি আত্মা”—অচিন্ত্য প্রথমবার এই নামটা শুনলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ মাধবচরণকে ডেকে পাঠালেন, এবং জানতে চাইলেন, “তুমি কি দয়ানিধি রায়চৌধুরীর নাম জানো?” মাধবচরণ থমকে গেল, মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য ফুটে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “জানি বাবু, জানি… তিনি ছিলেন এই ভিলার শেষ প্রকৃত জমিদার। খুবই প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন, সংগীত, কবিতা, যুদ্ধবিদ্যা—সবেতেই পারদর্শী। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত এক অভিশাপের শিকার হন।” মাধবচরণ জানালেন, দয়ানিধির মৃত্যু হয়েছিল রহস্যজনকভাবে—তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করেছিল তাঁরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়েরা, যারা সম্পত্তির লোভে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিল। মৃত্যুর ঠিক আগেই দয়ানিধি বলেছিলেন, “আমার প্রতিচ্ছবি থাকবে, আমি নিজে থেকে সরব হবো না… তবে প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকের বংশধর একদিন আমার চোখে নিজের শেষ দেখবে।” সেই সময় থেকেই বাড়ির আয়নাটি বন্ধ ঘরে তালাবদ্ধ রাখা হয়। অচিন্ত্য হতবাক হয়ে শুনলেন এই কাহিনি, কিন্তু মন থেকে বিজ্ঞান এখনও বিদায় নেয়নি। তিনি ভাবলেন, আয়নার কাঁচে কোনো রসায়নিক বিক্রিয়ায় হয়তো প্রতিচ্ছবি বিকৃত হয়, কিংবা কোনো প্রাচীন যন্ত্রাংশ থাকা আয়নার আভ্যন্তরীণ ফ্রেমে লুকানো রয়েছে, যেটা আলো বা শব্দে সাড়া দেয়। কিন্তু তার যুক্তিগুলি ঠুনকো হয়ে পড়ে গেল যখন তিনি জীবন্তের চিঠির নিচের শেষ বাক্য পড়লেন—“আমি ১৯৯২ সালে এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, এবং আমার মা ১৯৯৪ সালে ঠিক সেই সময়টায় মারা যান, যেটা আমি আয়নায় দেখেছিলাম। বিশ্বাস করো, অচিন্ত্য, আমি জানতাম ঠিক কখন কী হবে, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।” অচিন্ত্যর চোখ স্থির হয়ে রইল চিঠির সেই বাক্যে।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ভিলার এক অদ্ভুত নিঃশব্দে ঢাকা পড়ল। পাখির ডাক নেই, কুকুরের ঘেউ ঘেউ নেই—শুধু বাতাসে একটা থমথমে শব্দ—যেন দূরে কোথাও কেউ হাঁটছে চুপিসারে। অচিন্ত্য ফের আয়নার ঘরে প্রবেশ করলেন, এবার এক দণ্ডকালীন লণ্ঠন ও নোটবুক নিয়ে। দরজা বন্ধ করে তিনি সামনে দাঁড়ালেন আয়নার, যেন মুখোমুখি হতে চান সেই সত্যের, যেটা জীবনবিজ্ঞান ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এবার আয়নার প্রতিচ্ছবি যেন একটু স্পষ্ট। তিনি দেখতে পেলেন—তার পেছনে একটা দরজা ধীরে ধীরে খুলছে আয়নার ভিতরে, অথচ বাস্তবে সে দরজা ছিলই না। সেই দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে এক যুবক—সাদা পোশাক, কপালে রক্তের ফোঁটা, চোখ দুটি অতলে ঠান্ডা। অচিন্ত্য চিৎকার করতে পারলেন না, গলা শুকিয়ে এল। সেই প্রতিচ্ছবি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে একটাই শব্দ বলল—“সময়… শুরু হয়েছে।” আয়নায় সেই মুহূর্তে ভেসে উঠল একটি সময় ও তারিখ—“৩রা সেপ্টেম্বর, ১০:১৬ PM।” অবিশ্বাস, আতঙ্ক আর রোমাঞ্চের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ নিয়ে অচিন্ত্য ধীরে ধীরে পিছিয়ে এলেন। তাঁর মনে হলো, আয়নার মধ্যকার সেই চোখ দুটি এখন আর কাঁচের পেছনে নেই, বরং তার শরীরের ভিতরে ঢুকে পড়ছে ধীরে ধীরে—যেন সময়ের প্রতিচ্ছবি আর বাস্তবের সীমারেখা মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানতেন না সেই সময়টিই আসলে তাঁর নিজের মৃত্যুর সময় কিনা, নাকি কারও অন্য এক আপনজনের, কিন্তু নিশ্চিত জানতেন—এই আয়না আর তার চোখের দেখা কোনো সাধারণ দৃশ্য নয়। সময়ের এক নীরব নরক এখন তাকে ঘিরে ফেলছে, আর পালাবার পথ নেই। ‘নির্বাক দর্পণ’ মুখ না খুলেই বলে দিচ্ছে সবকিছু।

অধ্যায় ৩

সপ্তাহান্তের সকালের ঝিমঝিমে রোদ যেন নিঃশব্দেই মিশে গিয়েছিল মুর্শিদাবাদের সেই ধূসর জমিদারবাড়ির ভাঙাচোরা জানালা দিয়ে, যেখানে প্রত্নতত্ত্ববিদ অচিন্ত্য লাহা ধীরে ধীরে জড়াচ্ছিলেন এক অতিপ্রাকৃত ইতিহাসের জালে। এমন সময়ই পৌঁছালেন অনীশা—অচিন্ত্যের একমাত্র কন্যা। কলকাতা থেকে ছুটি নিয়ে বাবার সঙ্গে কিছুদিনের জন্য এসেছেন পুরনো নিদর্শন দেখার ইচ্ছায়। চিত্রশিল্পী অনীশা রঙ, রেখা আর আভাসের ভাষা বোঝে; বাস্তবের বাইরেও তার এক নিজস্ব চোখ রয়েছে, যেখানে প্রতিটি দৃশ্য ছায়ায় ভিজে থাকে। বাড়িতে পা দিয়েই সে বলেছিল, “এখানে বাতাসটা যেন থমকে আছে, বাবা।” মাধবচরণ তাকে মৃদু হেসে চা দিলেও চোখে ছিল এক চাপা আতঙ্ক। বিকেলে, যখন অচিন্ত্য তার নোট ও জীবন্তের চিঠির কপি নিয়ে বসেছেন, তখন অনীশা একা ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় সেই পুরনো ঘরে—যেখানে বসানো আছে ‘নির্বাক দর্পণ’। ঘরের গায়ে শ্যাওলা আর ছাদের কর্কশ শব্দ সত্ত্বেও আয়নাটির সামনে দাঁড়িয়ে সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অনুভব করে। প্রথমে সে দেখতে পায় নিজের প্রতিচ্ছবি—স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরে? প্রতিচ্ছবি যেন তার চোখে চোখ রেখে বলছে কিছু, ঠোঁট নড়ে কিন্তু কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ সে দেখতে পায়, প্রতিচ্ছবির পেছনে ঘড়ির কাঁটার মতো দাগ কেটে উঠছে আয়নার ওপর—“২৫ সেপ্টেম্বর, রাত ১১:৪৭।” অনীশা কেঁপে ওঠে। সে ফিরে যেতে চায়, কিন্তু পা যেন আটকে যায় মেঝেতে। আয়নার কাচ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে ওঠে, আর একটি অশরীরী হাত যেন কাচের ওধার থেকে ছুঁতে চায় তাকে।

সে চিৎকার করে উঠে যায় ঘর থেকে, দৌড়ে আসে বাবার কাছে। অচিন্ত্য প্রথমে ভেবে নেন হয়তো মাকড়সা বা ইঁদুর দেখে ভয় পেয়েছে। কিন্তু অনীশা তখনো স্তব্ধ, তার কাঁধ কাঁপছে, ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেলেও শব্দ নেই। একমিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট—তারপর হঠাৎ সে বলে ওঠে, “আমি আমার মৃত্যুর দিন দেখেছি, বাবা।” অচিন্ত্য থমকে যায়। চোখে চোখ রাখতেই সে বুঝতে পারে, মেয়েটা মিথ্যে বলছে না। সে চায় বিশ্বাস করতে এটি কেবল এক ভৌতিক বিভ্রম, কিন্তু তার নিজের অভিজ্ঞতাও কম নয়। অনীশা বলল, “আয়নার মধ্যে কেউ রয়েছে, সে আমার দিকে তাকিয়েছিল, সে বলেছে—সময় ঘনিয়ে এসেছে।” সেই রাতেই সে আঁকতে শুরু করল এক মুখ—সেই ছায়ামূর্তির মুখ, যার কপালে রক্ত, চোখ দুটি অতল আর ঠোঁট চাপা। অচিন্ত্য দেখে আশ্চর্য হলেন—এটি সেই একই মুখ, যেটি তিনি আয়নায় দেখেছিলেন, যে বলেছিল “সময় শুরু হয়েছে।” মেয়ের আঁকা ছবিতে এমন কিছু রেখা ছিল, যা কোনও নবীন শিল্পীর সাধ্যের বাইরে। অনীশা নিজেই জানত না, কীভাবে তার হাতে এমন মুখ ফুটে উঠছে, বারবার একই মুখ, এক অদ্ভুত যন্ত্রণার রেখা নিয়ে। সেই রাতের ঘুম অচিন্ত্যর চোখে আসেনি, শুধু ভেতর থেকে এক প্রশ্ন বারবার বেরোচ্ছে—এই আয়না কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতকেও দেখাতে পারে? তাহলে কি এটি কোনো সময়চক্রের ফাঁদ?

পরদিন সকালে অনীশা জানায়, সে এক স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক রাজপ্রাসাদে, কোথাও কেউ নেই, শুধু এক দীর্ঘ গ্যালারি—আর তার শেষে দাঁড়িয়ে আছে সেই রক্তাক্ত কপালের যুবক। সে বলছে, “তোমরা সবাই ফিরবে, কারণ রক্তের সূত্র কেউ ছিন্ন করতে পারে না।” অচিন্ত্যর রক্ত হিম হয়ে এল। তার মনে পড়ল জীবন্তের সেই কথাটি—এই আয়না কেবল একজন নয়, গোটা উত্তরসূরিকে গ্রাস করে। ইতিহাস প্রতিশোধ নেয় ভবিষ্যতের উপর। মাধবচরণ যখন জানতে পারল অনীশাও এখন আয়নার প্রতিচ্ছবির শিকার, সে বলল, “বাবু, এবার এই আয়নাটাকে আবার বন্ধ ঘরে তালা দিয়ে ফেলুন, এর অভিশাপ জেগে উঠেছে। দয়ানিধির আত্মা ঘুমোচ্ছে না আর।” কিন্তু খুব দেরি হয়ে গেছে। আয়নার মধ্যেকার ছায়া এখন কেবল কাচের মধ্যে নেই, অনীশার ছবিতে, অচিন্ত্যর স্বপ্নে, এমনকি সেই বাড়ির বাতাসেও তার অস্তিত্ব ছড়িয়ে গেছে। আয়না যেন শুধু এক বস্তু নয়, সে একটা জীবন্ত সত্তা, যার চোখে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি সময় এখন প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। ‘নির্বাক দর্পণ’ এবার কেবল সময় দেখাবে না, সময়কেই বাঁকিয়ে দেবে, এবং হয়তো কেউ তার থেকে মুক্তি পাবে না। অচিন্ত্য জানতেন, আয়নার ইতিহাস শুধু গবেষণার বিষয় নয়, এখন তার মেয়ের জীবন মরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে।

অধ্যায় ৪

মুর্শিদাবাদের সেই জমিদারবাড়িতে গুমোট বাতাসের সঙ্গে যেন জড়িয়ে ছিল শতাব্দী পুরনো কোনো শ্বাসরুদ্ধ ইতিহাস, যা এখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল ‘নির্বাক দর্পণ’-এর প্রতিফলনে। অনীশার প্রতিক্রিয়া, আঁকা মুখের অদ্ভুত মিল, আর অচিন্ত্যর স্বপ্নের ভেতর পায়ের শব্দ—সব মিলিয়ে এখন বিষয়টি কেবল গবেষণার কৌতূহল ছিল না, বরং পরিণত হচ্ছিল এক ভয়ংকর বাস্তবতায়। সেই সকালে অচিন্ত্য সিদ্ধান্ত নিলেন—সময় এসেছে আয়নার ইতিহাস খুঁটিয়ে জানার। জীবন্তের দেওয়া কিছু সূত্র মাথায় রেখে এবং স্থানীয় রেকর্ড অফিস ঘেঁটে তিনি সন্ধান পেলেন “দয়ানিধি রায়চৌধুরী”-র নাম। ১৭৯০ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে রাজত্বকাল ছিল এই জমিদারের। এলাকার প্রাচীন দলিলে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে ‘অত্যন্ত প্রতিভাবান, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন কিন্তু নির্জন স্বভাবের একজন ব্যক্তি’ হিসেবে। পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর রেকর্ড নেই—শুধু এক অদ্ভুত নোটেশন: “অন্তর্ধান রাত্রি-অন্ধকারে, আত্মা রয়ে গেছে প্রাসাদের প্রতিচ্ছবিতে।” অচিন্ত্য প্রথমে এটি কাব্যিক অলঙ্কার ভাবলেও, এরপর আরও কয়েকটি তথ্য তাঁর সামনে আসে যা গায়ের লোম খাড়া করে দেয়। দয়ানিধির হাতে তৈরি এক “জাদুকরী আয়নার” উল্লেখ পাওয়া যায়—যেটি তাঁর প্রিয় কাচনকরের হাতেই তৈরি হয়, এবং শোনা যায়, সেই আয়নার উদ্দেশ্য ছিল “ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি দেখা।” প্রথমে খেলনার মতো মনে হলেও, আয়নার নির্মাণ শেষে প্রাসাদে শুরু হয় একের পর এক মৃত্যু। রাত্রির শেষে কেউ কেউ বলতেন, তাঁরা আয়নায় নিজেদের মৃতদেহ দেখেছেন আগের রাতে। তখন থেকেই বাড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

মাধবচরণ, যিনি রায়চৌধুরীদের সেবকের বংশধর, অনেকটা ইতস্তত করেই কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুখ খোলেন অচিন্ত্যর অনুরোধে। “এই আয়নাটা আমার ঠাকুরদা দেখেছিলেন বাবু,”—তার চোখে এক চাপা স্মৃতি ভেসে ওঠে—“সে বলত, আয়নার ভেতরে একটা ছেলে ঘুরে বেড়ায়। সবাই বলে দয়ানিধি নাকি আয়নার মধ্যেই বন্দী হয়ে আছেন, কারণ তাঁর মৃত্যু আসলে কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না।” অচিন্ত্য বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, “তাঁর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল?” মাধবচরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তাঁকে হত্যা করা হয়—তাঁর নিজের ভাই ও দূর সম্পর্কের কাকা, সম্পত্তির লোভে। রাতের বেলায় তাঁকে ঘুমের ঘরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু মৃত্যুতে শান্তি আসেনি। তাঁর প্রিয় আয়নার সামনে তাঁকে মাটিচাপা দেওয়া হয়, আর বলা হয়, তাঁর আত্মা সেই আয়নায় প্রবেশ করে অনন্তকাল জেগে থাকবে।” অচিন্ত্য বুঝলেন, এই আয়নার ইতিহাস শুধুই ভৌতিক নয়—এ এক প্রতিশোধের কাহিনি, অভিশাপের ইতিহাস। শুধু তা-ই নয়, মাধবচরণ আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য দেন—“রায়চৌধুরীদের পরিবারে যারা যারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল, তারা সকলেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একেকজন করে মারা গেছে। অনেকে সরে গিয়েছিল, পালিয়েও বাঁচতে পারেনি। তাদের শেষ দিনটা ঠিক আয়নায় দেখা সময়েই এসেছিল।” অচিন্ত্যর মনে পড়ে গেল অনীশার মুখে শোনা সেই সময়—“২৫ সেপ্টেম্বর, রাত ১১:৪৭।” যদি সত্যিই এই অভিশাপ কাজ করে থাকে, তাহলে সময় হাতে আছে মাত্র কুড়ি দিন।

সে রাতে অচিন্ত্য ও অনীশা আয়নার ঘরে একসঙ্গে গিয়ে দাঁড়ায়। এবার তারা ভয় পায় না—চায় বুঝতে, আয়না আদৌ কী দেখাতে চায়। অনীশা আবার দেখল সেই তারিখ, কিন্তু এবার ঘড়ির কাঁটা নড়ে উঠছে—যেন কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। হঠাৎ অনীশা কিছু না বলেই ফিসফিস করে বলল, “সে আবার আসছে… আমি শুনতে পাচ্ছি তার পায়ের শব্দ।” আয়নায় অচিন্ত্য দেখতে পেল এক ছায়া ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে, ঠিক আয়নার পেছনের মধ্যবিন্দুতে—যেখান থেকে তাদের প্রতিচ্ছবি জন্মায়। সেই ছায়া ধীরে ধীরে মানুষের আকৃতি নেয়—এবার আর শুধু চোখ নয়, ঠোঁটও নড়ে উঠল, শব্দ ছাড়া বলল, “রক্তের উত্তরাধিকার ফিরেছে। এবার আমার গল্প শেষ হবে।” অচিন্ত্য বিস্ময়ে দেখল—ছায়াটি দয়ানিধির, যেমন জীবন্ত তার স্কেচে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল শেষ দৃশ্য—আয়নায় প্রতিচ্ছবিতে দেখা গেল অনীশা পড়ে আছে মেঝেতে, রক্তে ভেজা মাথা, আর চারপাশে ছায়া ঘিরে রেখেছে তাকে। বাস্তবে কিছু ঘটেনি, কিন্তু আয়না যেন ভবিষ্যতের এক অদ্ভুত ট্রেলার দেখিয়ে গেল। অনীশা জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে—“আমরা কিছু করতেই পারছি না, বাবা। সময়টা এগিয়ে আসছে। আমি জানি।” অচিন্ত্য এবার বুঝলেন—এটি আর যুক্তির খেলা নয়, এটি সময়ের বিরুদ্ধে এক অসম প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রতিটি দিন অনীশাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার অজানা পরিণতির দিকে। ‘নির্বাক দর্পণ’ আর নীরব নেই—সে কথা বলছে, ছায়ায়, প্রতিচ্ছবিতে, এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্করভাবে—ভবিষ্যতের রক্তাক্ত ভাষায়।

অধ্যায় ৫

মুর্শিদাবাদের সেই জমিদারবাড়িতে সময় যেন অন্য নিয়মে চলছিল। প্রতিটি সকাল আর রাত একই রকম বিষণ্নতায় জড়ানো, যেন একটি অনন্ত অপেক্ষা—একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের প্রতীক্ষা। সেই নির্ধারিত মুহূর্ত, যা ‘নির্বাক দর্পণ’-এর আয়নায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। অনীশার নিঃশব্দ আতঙ্ক, অচিন্ত্যর যুক্তি দিয়ে সব ব্যাখ্যা করার চেষ্টাকে প্রতিদিন দুর্বল করে তুলছিল। এখন আর তিনি কোনো বিজ্ঞান দিয়ে এই আয়নার ঘটনা বোঝাতে পারছিলেন না। প্রতিটি রাতে তিনি দেখতেন, আয়নার পেছনে সেই ছায়ামূর্তি আরও স্পষ্ট হচ্ছে। কিছু একটা গঠন হচ্ছে—যেন আয়নার ভেতরে সময় জমাট বাঁধছে, ঘনিয়ে উঠছে ভবিষ্যতের ছায়া। এক সন্ধ্যাবেলায় অচিন্ত্য একটি মোবাইল ঘড়ি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। ঘড়ির সময় ছিল ৮টা ৩ মিনিট। আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা সেই প্রতিচ্ছবিতে ৮টা ৫ মিনিট দেখাচ্ছিল। তিনি প্রতিটি মিনিট লক্ষ্য করতে লাগলেন। বাস্তব সময় ও আয়নার সময়ের পার্থক্য মিনিটে মিনিটে বাড়ছিল—দুই, তারপর তিন, তারপর চার। এর মানে আয়নার সময় বাস্তব সময়ের থেকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কেন? আর কার জন্য? হঠাৎই আয়নায় আবার ভেসে উঠল সেই পরিচিত সময়—“২৫ সেপ্টেম্বর, রাত ১১:৪৭”—এই বার্তাটি যেন খোদাই হয়ে আছে কাচের তলায়। আয়নার নিচে আরও কিছু দাগ কাটা দেখা গেল, যা আগেও চোখে পড়েনি। ঝুঁকে ভালো করে দেখলে বোঝা যায়—চিহ্নগুলি আসলে কাউন্টডাউন। প্রতিটি দাগ একটি দিনকে নির্দেশ করে, এবং অচিন্ত্য খেয়াল করলেন, সেই দাগের সংখ্যা আর কুড়ি নেই, মাত্র আঠারোটি। সময় সত্যিই কমছে।

অচিন্ত্যর কাছে এটি এখন নিছক গবেষণার বিষয় নয়, এটি পরিণত হয়েছে ব্যক্তিগত এক যুদ্ধের মতো। অনীশার ভিতরের স্থিরতা ভেঙে পড়ছে দিনকে দিন। রাতে ঘুমের মধ্যে সে হাঁটতে শুরু করেছে—প্রথমে নিজের ঘরের ভেতর, তারপর আয়নার ঘর পর্যন্ত। এক রাতে অচিন্ত্য হঠাৎ জেগে উঠে দেখে, দরজা খোলা আর অনীশা সেখানে নেই। অন্ধকারে টর্চ নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে সে পৌঁছায় আয়নার ঘরে। সেখানে সে দেখে—অনীশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ দুটো বন্ধ, ঠোঁটে মৃদু হাসি। আয়নায় দেখা যাচ্ছে সে দাঁড়িয়ে নেই, বরং মেঝেতে পড়ে আছে, রক্তাক্ত। অচিন্ত্য তড়াক করে মেয়েকে টেনে নিয়ে আসে, জোরে চিৎকার করলেও সে তখন ঘুমন্ত অবস্থায়। পরদিন সকালে এই ঘটনা মনে ছিল না অনীশার। কিন্তু তার চোখে চোখ রাখলে অচিন্ত্য বোঝে—অনীশার ভিতরে কিছু বসে গেছে, কোনো এক ছায়া। সে এখন আর আগের মতো নেই। আর তার আঁকা ছবিগুলোও বদলে গেছে—প্রতিটি চিত্রে সেই মুখ, সেই ছায়া, আর এখন প্রতিটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ঘড়ি—সব ঘড়িতেই সময় আটকে আছে ১১:৪৭-এ। একবার একটি ছবি আঁকা শেষ হওয়ার পর অনীশা বলেছিল, “এই মুহূর্তটা কখনই আসেনি, কিন্তু আমি জানি কেমন হবে।” এমন কথা শুনে অচিন্ত্যর গা শিউরে উঠেছিল। তিনি জানতেন, এটি কেবল মস্তিষ্কের খেলা নয়—আয়নার প্রভাবে সময় আগেভাগে তার অস্তিত্ব নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে মানুষের মনে, দখল করে নিচ্ছে বাস্তবতা। আয়নার ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে এই বাড়ির প্রতিটি করিডোরে, প্রতিটি দরজার ফাঁকে, আর সবচেয়ে বেশি—অনীশার হৃদয়ের গভীরে।

এক দুপুরে, অচিন্ত্য আর্কাইভ রুমে বসে জীবন্তের পাঠানো আরও একটি পুরনো চিঠি খুঁজে পান, যা আগের খামে আলাদা করে রাখা ছিল। সেখানে লেখা ছিল, “যদি আয়নার সময় বাস্তবের থেকে এগিয়ে চলে, তবে জানবে—তোমার নিজের জীবনের সময় কমে আসছে। আয়না তোমার ভবিষ্যৎ শুধু দেখায় না, সে নিজেই সময়কে পরিবর্তন করে, এক নতুন সময়রেখা তৈরি করে, যেখানে প্রতিচ্ছবির মৃত্যু আগে আসে, বাস্তব পরে।” অচিন্ত্য আর থেমে থাকতে পারলেন না। তিনি স্থির করলেন, দয়ানিধি রায়চৌধুরীর আসল কবরস্থান খুঁজে বার করতেই হবে। হয়তো সেই কবরের মাটি, সেই মুহূর্তের অভিশাপ কিছু রহস্য জানাতে পারে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—পরের দিনই যাবেন পুরনো শ্মশানে, যেখানে রায়চৌধুরী পরিবারের পূর্বপুরুষরা দাহ হতেন। কিন্তু যাওয়ার আগের রাতে আবার একটি ঘটনা ঘটল। আয়নার ঘর থেকে শব্দ এল, যেন কাঁচ ভেঙে পড়ছে। দৌড়ে গিয়ে দেখা গেল—আয়না অক্ষত, কিন্তু ঘরের দেয়ালে লেখা হয়ে গেছে নতুন একটি বার্তা—“শুধু সময় নয়, তুমি নিজেও তার অংশ হয়ে গেছো।” এই বার্তাটি লেখা যেন কেউ আঙুল দিয়ে রক্তে আঁকছে। অচিন্ত্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এবার তিনি নিশ্চিত, আয়নার অভিশাপ কেবল একটি নির্ধারিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না, বরং তার নিজের অস্তিত্বকেও বদলে দিচ্ছে। ‘নির্বাক দর্পণ’ এখন শুধু প্রতিচ্ছবি নয়—এটি সময়ের চেয়েও বড় এক জীবন্ত সত্তা, যা নিজের মতো করে সময়কে লিখে চলেছে, আর প্রতিটি দাগে খোদাই করছে এক অনিবার্য পরিণতির নাম।

অধ্যায় ৬

পরদিন সকালেই অচিন্ত্য মাধবচরণকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন রায়চৌধুরী পরিবারের পুরনো শ্মশানের খোঁজে, যা শহর থেকে প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরে, ঝোপঝাড়ে ঢেকে যাওয়া এক নালার পাশে অবস্থিত। জায়গাটা বহু বছর পরিত্যক্ত, কোনো সংরক্ষণ নেই, মাথার ওপর শুধু ধূসর আকাশ, আর আশপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। শ্মশানে পৌঁছে অচিন্ত্য খুঁজতে লাগলেন সমাধি ফলক, যেখানে হয়তো দয়ানিধির নাম লেখা আছে। বেশ কিছু সময় খোঁজার পর তিনি একটি ভাঙাচোরা পাথরের গায়ে দেখতে পেলেন ম্লান হয়ে আসা খোদাই—“Dayanidhi Raychowdhury—1792(?)–1812(?)”—তার নিচে লেখা রয়েছে ল্যাটিনে: “Animus in speculo clauditur”, যার অর্থ: “আত্মা আয়নার ভিতরে বন্দি।” অচিন্ত্য হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লেন সেই সমাধির সামনে। এর অর্থ দয়ানিধি হয়তো নিজের ইচ্ছাতেই এই আয়নাতে আত্মাকে আটকে রেখেছিলেন, হয়তো প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে মৃত্যুর পরেও নিস্তার পাননি। এমনকি খোদাইয়ের নিচে একটা ছোট গহ্বরের মতো দেখা গেল, যেখানে হয়তো কিছু রেখে যাওয়া হয়েছে। মাধবচরণের অনুমতি নিয়ে অচিন্ত্য সেই গর্ত খুঁড়ে বার করলেন একটি ছোট কাঠের বাক্স, যার ভিতরে একটি হাতে লেখা কাগজ আর একটি ধাতব তাবিজ। কাগজে লেখা, এক ধরণের গদ্যকবিতা—“আমার প্রতিচ্ছবি থাকবে, তবেই আমার অস্তিত্ব থাকবে। আমার যন্ত্রণার সাক্ষী যারা, তারা আমার চোখের সামনে শেষ হোক। আয়না আমার রক্ষাকবচ নয়, আমার অস্ত্র। প্রতারণার জন্য নয়, প্রতিহিংসার জন্য আমি তৈরি করেছি এক দর্পণ—যা সময়কে গিলে খাবে, আর প্রতিটি মুখে রেখে যাবে মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট সুর।”

এই বার্তাটি ছিল ভয়ঙ্কর। অচিন্ত্য বুঝলেন—এখানে কেবল অতৃপ্ত আত্মা নয়, একজন চরম ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অপরিসীম কষ্ট থেকে তৈরি হয়েছে এক অতিপ্রাকৃত অস্ত্র, যার মূল উপাদান সময় ও প্রতিচ্ছবি। আর সেই অস্ত্র এখন তার মেয়েকে গ্রাস করতে চলেছে। তাবিজটি হাতে নিয়ে তিনি অনুভব করলেন যেন শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, আর মাধবচরণ বলল, “এই তাবিজটা হয়তো আয়নার ক্ষমতা কিছুটা হলেও কমাতে পারে। আমার ঠাকুরদা বলেছিলেন, আয়নার শক্তি সেদিনই মুক্তি পাবে, যেদিন তার স্রষ্টার ইচ্ছা সম্পূর্ণ হবে। দয়ানিধির শেষ ইচ্ছা ছিল প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকের রক্তধারা মুছে ফেলা—তুমি যদি প্রমাণ করতে পারো যে তোমরা সেই পরিবারে অন্তর্ভুক্ত নও, হয়তো রেহাই পেতে পারো।” অচিন্ত্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর বাবার দিকের ইতিহাস পুরনো কলকাতার, কিন্তু মায়ের দিকের শিকড় ছিল এই মুর্শিদাবাদেই। হঠাৎ মাথার ভিতরে একটা সাড়া দিয়ে উঠল—তার মাতামহের নাম ছিল চন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী। চোখে অন্ধকার নেমে এল। তাহলে আয়না যা করছে, তা নিছক কাকতালীয় নয়—এ এক পূর্বনির্ধারিত সময়চক্র। অনীশা, রক্তের সূত্রে, সেই বংশেরই উত্তরসূরি। দয়ানিধির অভিশাপ এবার যেন অর্থ পাচ্ছে—সে চায় না শুধুমাত্র সময় দেখাতে, সে চায় শোধ, চায় রক্ত, আর সেটাই আয়নার প্রতিফলনে ধরা পড়ে বারবার।

ফিরে এসে অচিন্ত্য সেই তাবিজটি অনীশার গলায় পরিয়ে দিলেন, আর তাঁকে জানালেন সবকিছু—তার মাতামহের ইতিহাস, আয়নার অভিশাপ, দয়ানিধির প্রতিজ্ঞা। অনীশা সব শুনে চুপ করে রইল। একসময়ে ধীরে ধীরে বলল, “তাহলে আমিই তার লক্ষ্য। সে আমার মধ্য দিয়েই মুক্তি খোঁজে।” সেই রাতেই আবার আয়নার ঘরে দাঁড়িয়ে দু’জনে সেই ছায়ার সামনে পড়লেন। এবার ছায়া সম্পূর্ণ রূপে মানবমূর্তিতে রূপ নিয়েছে। চোখে ভয়ঙ্কর শূন্যতা, কণ্ঠস্বরে নেই শব্দ, তবু ঠোঁট নড়ে উঠছে—“আমি এখনও শেষ করিনি। সময় এখনও বাকি আছে, ১১:৪৭ পর্যন্ত।” আয়নার পাশে সেই দাগগুলি এক এক করে মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন প্রতিটি দিন তার পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে নির্ধারিত পথে। অচিন্ত্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমার রক্ত যারা চুরি করেছিল, আমরা তাদের উত্তরসূরি নই। আমরা শুধু ইতিহাস জানি, বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।” আয়নায় দয়ানিধির মুখে এক কাতর অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। সে এবার বলল, “প্রমাণ দাও, নয়তো আয়না তোমার ভবিষ্যত গিলে ফেলবে।” সেই মুহূর্তে আয়নার নিচে আরেকটি গোপন খাঁজ খুলে গেল, যার ভিতরে রাখা ছিল আরেকটি ছোট নোট। অচিন্ত্য তুলে নিলেন সেটি—এখানে দয়ানিধির নিজের হাতে লেখা, রক্তে লেখা বার্তা—“যদি কোনো পবিত্র আত্মা আমার যন্ত্রণাকে সান্ত্বনা দেয়, তবে আমি নিশ্চিন্ত হব। নয়তো আমিই সময়ের শাসক হয়ে উঠব।” আর তখনই অনীশা চিৎকার করে উঠে বলল, “আমি পারি। আমি আঁকবো তোমার যন্ত্রণার সব মুহূর্ত, আমি তোমার চোখের ভিতর যা রয়েছে, তাকে ক্যানভাসে তুলে ধরবো। যেন তুমি নিজেই দেখতে পাও নিজের গল্প।” হয়তো এটাই সেই সান্ত্বনার পথ, হয়তো এই ছবির মধ্য দিয়েই দয়ানিধির অভিশাপ শেষ হতে পারে। ‘নির্বাক দর্পণ’ এবার যেন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এল, আর আয়নার পেছনের ছায়াটি মিলিয়ে যেতে লাগল নিঃশব্দে, তার চোখে প্রথমবারের মতো শান্তি দেখা গেল। তবে সময় এখনও চলছেই। কারণ, আয়না চুপ হয়েছে, কিন্তু সময়ের চাকা এখনো ঘুরছে—এবং ২৫ সেপ্টেম্বর এখনও আসেনি।

অধ্যায় ৭

প্রাসাদবাড়ির ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, যেন ‘নির্বাক দর্পণ’ কিছু সময়ের জন্য সত্যিই নীরব হয়েছে। কিন্তু অচিন্ত্য জানতেন, সেটি কেবল একটি ছায়া সরানোর মতো—আশ্রয় ফুরোলে তা ফিরে আসবেই। সেই মুহূর্তে তিনি একমাত্র বিশ্বাস করতে শুরু করলেন অনীশার প্রতিজ্ঞাকে। মেয়ে বলেছিল, “আমি তার যন্ত্রণাকে আঁকবো”—এবং সেই বিশ্বাসে ভর করেই একটি ঘর খালি করে সেখানে বসানো হল মল্লিকার পেন্টিং বোর্ড, তুলি, রং, কাগজ ও কাঠের ক্যানভাস। প্রথম দিনই অনীশা বসে পড়ল, চোখ বন্ধ করে যেন অনুভব করতে লাগল আয়নার ভিতরের সেই অতীত। এবং তারপর যা ঘটল, তা ছিল বিস্ময়কর। অনীশা যে চিত্র এঁকে ফেলল, তা যেন কোনো মানুষ আঁকে—সেটি বিশ্বাস করা কঠিন। ছবিতে দেখা গেল দয়ানিধির ঘর—মশালের আলোয় আলোকিত, পাশে এক রক্ষিতার বাঁশি, আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক, যার চোখে আগুন আর কপালে রক্তরেখা। পরের ছবিটিতে মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতকতা, আর কবর দেওয়ার দৃশ্য—সব কিছু এমন বাস্তব হয়ে ফুটে উঠল যেন সে এগুলো স্বপ্নে নয়, প্রত্যক্ষভাবে দেখেছে। অচিন্ত্য সেই আঁকাগুলো দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এক রাতে আঁকা শেষ হওয়ার পরে অনীশা তার বাবাকে বলল, “বাবা, আজ রাতে আমি তাকে দেখতে পেয়েছি। সে আর রাগে ফুঁসছে না, বরং যেন একটা গল্প বলার চেষ্টা করছে। সে আমাকে এমন সব দৃশ্য দেখিয়েছে যা কেউ কোনো বইয়ে লেখেনি—রায়চৌধুরীদের ব্যর্থতা, হত্যার মুহূর্ত, এমনকি শেষ নিশ্বাসেও তার চোখ খোলা ছিল।” অচিন্ত্য বুঝলেন, এই আঁকাগুলিই সম্ভবত দয়ানিধির সেই ‘সান্ত্বনা’র রূপ, যা সে তার মৃত্যুর পরে এত বছর ধরে চেয়েছে—কেউ তাকে শুধু প্রতিশোধ নয়, বোঝার চেষ্টা করুক।

দিন যেতে লাগল। ২৫ সেপ্টেম্বর আর মাত্র তিন দিন দূরে। কিন্তু ‘নির্বাক দর্পণ’ আগের মতো সক্রিয় নয়। আয়নার প্রতিফলন এখন আগের চেয়ে কম জ্বলজ্বলে, যেন কাচটা ধীরে ধীরে তার শক্তি হারাচ্ছে। অচিন্ত্য প্রতিটি দিন তার মেয়ের আঁকা ছবি গুছিয়ে রাখেন, যেন সেগুলো একটি ধারাবাহিক গদ্যের মতো সময় ধরে সাজানো, যার শুরু দয়ানিধির যৌবন, আর শেষ তাঁর আত্মাবন্দি হওয়ার মুহূর্ত। কিন্তু হঠাৎ করে চিত্রের ধারায় ফাটল দেখা দিল। অনীশা বলল, “সে আর আমাকে কিছু দেখাচ্ছে না, বাবা। তার মুখ আবার কঠিন হয়ে যাচ্ছে।” অচিন্ত্য চিন্তায় পড়ে গেলেন। হয়তো কেবল ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে নয়, দয়ানিধির মুক্তি সম্পূর্ণ করতে গেলে প্রয়োজন আরও কিছু—একটা চূড়ান্ত সম্মানের মুহূর্ত, যেন কেউ তাকে ‘শুধু প্রতিশোধ নয়, স্মৃতি’ হিসেবে স্থান দেয়। সেই সময়ই অচিন্ত্য সিদ্ধান্ত নিলেন—এই ছবিগুলি নিয়ে একটি প্রদর্শনী করবেন স্থানীয় মিউজিয়ামে, যেখানে দয়ানিধির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, তার প্রতিচ্ছবি, তার অভিশাপ, আর আয়নার গল্প সবাই জানতে পারবে। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, এবং এলাকার ইতিহাসপ্রেমী মানুষদের আগ্রহ জাগল—এক জমিদার যার আত্মা এক আয়নায় বন্দি, যার প্রতিশোধ ভবিষ্যৎ পর্যন্ত ছায়া ফেলেছে—এমন গল্প কেউ আগে শোনেনি। প্রদর্শনীর দিন ঠিক হল—২৪ সেপ্টেম্বর, একদিন আগে। এবং আয়নার ঘরের ঠিক পাশের কামরাতেই আয়োজন করা হল সেই অস্থায়ী গ্যালারির।

২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঘরের প্রতিটি কোণ আলোয় ভরে উঠল। স্থানীয় লোকজন, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, এমনকি জেলার কালেক্টরও উপস্থিত ছিলেন। সবাই অবাক হয়ে চিত্রগুলি দেখছিলেন, আর অনীশার চোখে পানি জমেছিল—এই প্রথম সে অনুভব করল, দয়ানিধির আত্মা হয়তো আজ মানুষের চোখে একজন মানবিক চরিত্র হয়ে উঠেছে। প্রদর্শনীর শেষে অচিন্ত্য বললেন, “এই আয়না এখনো আছে, কিন্তু আজ প্রথমবার তার ভিতরের আত্মা একটি সম্মান পেয়েছে।” সেই রাতে ফিরে এসে অনীশা আয়নার সামনে দাঁড়াল। এবার আয়নায় দেখা গেল দয়ানিধি—একেবারে শান্ত মুখে। ঠোঁট নড়ল না, চোখে এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা। তারপর প্রথমবার আয়নায় দেখা গেল সময়ের পরিবর্তন—১১:৪৭ থেকে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে এসে দাঁড়াল ১১:১০-এ। এটা কী ছিল? একটা নতুন সময়ের সম্ভাবনা? একবারও কি আয়না তার ভবিষ্যতের দৃশ্য বদলে দিচ্ছে? আর সেই রাতেই আয়নার কাঁচে ফাটল ধরল—এক হালকা রেখা। অচিন্ত্য জানতেন, অভিশাপ হয়তো পুরোপুরি ঘুচেনি, কিন্তু ফাটল ধরেছে—এবং সেই ফাটল দিয়েই মুক্তি আসবে। ‘নির্বাক দর্পণ’ প্রথমবার তার নিজস্ব নিয়তিকে প্রশ্ন করেছে, আর হয়তো সময়—এই প্রথম—নিজেকে নতুন করে ভাবতে শিখছে।

অধ্যায় ৮

২৫ সেপ্টেম্বরের সকালটা অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই বুঝতে পেরেছে এই দিনটা আলাদা, এই দিনেই হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এক শতাব্দীপ্রাচীন অভিশাপের চক্র। জমিদারবাড়ির বাতাসে চাপা উত্তেজনা, ঘরের দেয়ালে আঁকা ছবিগুলোর রং যেন আরও গাঢ়, যেন তারা জানে যে আজকের দিনটাই চূড়ান্ত। অনীশা সারারাত ঘুমোয়নি, আয়নার ঘরের সামনে বসে বসেই সে চুপ করে সময় দেখছিল, আর একটি নতুন ছবি আঁকছিল—দয়ানিধির চোখ, ঠিক যেমনটি সে প্রথম দেখেছিল প্রতিচ্ছবিতে, কিন্তু এবার সেই চোখে নেই আগুন, নেই রক্ত; বরং এক গভীর ক্লান্তি, এক নিঃসঙ্গ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সকাল থেকে অচিন্ত্য কিছুতেই মেয়েকে একা ছাড়ছিলেন না। আয়নার ঘরের দরজা খুলে রাখা ছিল, কাঁচে এখনও সেই ফাটল, এবং তাতে প্রতিচ্ছবির গতি ধীর, নিস্তরঙ্গ। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে, যেন ঘরের ভিতর বাতাস ভারী হয়ে উঠছে—আয়নার আশেপাশের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত ছায়া, যেগুলি আগে কখনো ছিল না। ঘড়ি এগোচ্ছে, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, আর বিকেল থেকে সন্ধ্যা। ১০টা বাজতেই কাচে লেখা সময় আবার ঝলসে উঠল—১১:৪৭। শেষবার। এবার প্রতিটি মুহূর্ত যেন কাঁচে খোদাই হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই আয়নায় আর প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঘন কালো কুয়াশা, আর সেই কুয়াশার ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটি অবয়ব—দয়ানিধি।

১১টা পেরোনোর কিছু পরেই ঘরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। আয়নার ফ্রেমে দাগ দেখা দিল, যেন ভেতর থেকে কিছু একটা মুক্তি পেতে চাইছে, অথবা ফুঁড়ে বেরোতে চাইছে চিরদিনের বন্দিদশা থেকে। অনীশা তখন ঠিক আয়নার সামনে, তার হাতে আঁকা শেষ ছবিটি ধরা—যেখানে দয়ানিধির মুখ শান্ত, পেছনে জ্বলন্ত রাজপ্রাসাদ, আর সামনে কেবল এক পথ—যা অনন্তকাল পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। সে ছবিটি আয়নার সামনে মেঝেতে রাখতেই আয়নার কাঁচে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখা দিল—ছবির কালি যেন আয়নার কাচের ভিতরে ঢুকে গেল, এবং প্রথমবার কাঁচের ভিতরে দেখা গেল এক নতুন দৃশ্য—দয়ানিধি হাঁটছে সেই পথ ধরে, তার হাতে কিছু নেই, চোখে পানি, আর পেছনে একটি দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঘরটা হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কাঁচের ফাটল যেন নিজে থেকেই ভাঙতে শুরু করল, এবং ঠিক ১১:৪৭-এ ‘নির্বাক দর্পণ’ শব্দহীন এক চিৎকারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে গেল মেঝেতে। কোনো বিকট আওয়াজ নেই, কেবল এক প্রশান্ত কাঁপুনি যেন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এল। অনীশা স্তব্ধ, তার গলা শুকিয়ে গেছে, চোখে বিস্ময়—সে জানে, কিছু একটা শেষ হয়েছে। মাধবচরণ দৌড়ে এসে দেখলেন, আয়নার টুকরোগুলি শান্তভাবে ছড়িয়ে আছে, প্রতিচ্ছবি নেই, ছায়া নেই, সময় নেই—কেবল অচেনা শূন্যতা। অচিন্ত্য ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। অনীশার কাঁধে তখন এক অদ্ভুত ভার—না যন্ত্রণা, না স্বস্তি—একটা এমন বোঝা, যা সে বহন করেছিল পূর্বপুরুষের ইতিহাসের দায়ে, আর আজ মুক্ত হয়েছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তারা সবাই একবার পিছন ফিরে তাকাল। ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলিতে প্রতিফলন ধরা পড়েনি, কেবল ছড়ানো রং, একটুকরো ছায়া, আর নিঃসঙ্গতা। ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলি যেন নিঃশব্দে সম্মতি জানাচ্ছে এক পরিণতির, এক সমাপ্তির, যার জন্য সময় নিজেই অপেক্ষা করছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। সেই রাতে বাড়িতে কেউ ঘুমোতে পারেনি, কিন্তু কেউ ভয়েও ছিল না। যেন এক দীর্ঘ কুয়াশার ভিতর থেকে উঠে এসেছে সূর্য, যেটি সত্যিই আগামীর প্রতিচ্ছবি বহন করে। সকালে যখন অনীশা ও অচিন্ত্য প্রাসাদবাড়ির শেষ রুমটি ঘুরে দেখছিলেন, তারা খেয়াল করলেন একটি প্রাচীন খোপে দয়ানিধির হাতে লেখা আরেকটি বার্তা—কাঁচের পেছনে গোপনে রাখা ছিল, যা ফাটলের কারণে বেরিয়ে এসেছে: “যদি কেউ আমার দৃষ্টিকে কাগজে তুলে আনে, আমি মুক্ত। সময় তার শাসন ছাড়ে। আয়না নয়, হৃদয়ের আয়নাই চিরকালীন।” এই শব্দগুলি পড়ে অচিন্ত্য বুঝলেন—দয়ানিধি যা চেয়েছিলেন, তা কোনো মৃত্যু নয়, বরং চিরস্থায়ী সম্মান। আর অনীশা তা-ই দিয়েছে। ‘নির্বাক দর্পণ’-এর গল্প শেষ নয়, বরং এটি এখন নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা—যেখানে সময় আর প্রতিচ্ছবি শুধু ভবিষ্যত নয়, ইতিহাসকেও বদলে দেয়।

অধ্যায় ৯

‘নির্বাক দর্পণ’ ভেঙে পড়ার পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল। প্রাসাদের দেয়াল, করিডোর, আর মেঝেগুলি যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রশান্ত, নিঃশব্দ। অনীশা আবার ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা তার চোখে আটকে থাকত মাঝেমধ্যে—যেন জীবনের একটি অধ্যায় যা সে না চাইলেও লিখে ফেলেছে, এখন শুধু বাকিটুকু বই হয়ে পড়তে হবে। অচিন্ত্যও গবেষণার কাজে মন দিয়েছেন, কিন্তু রাতে যখন ঘর নিস্তব্ধ, তখনও তার কানে বাজে ভাঙা কাচের সেই মুহূর্ত, আর দয়ানিধির প্রতিফলনে থাকা শেষ বার্তাগুলির ধ্বনি। একদিন প্রাসাদের পুরনো ঘর গোছাতে গিয়ে মাধবচরণ একটি কাঠের বক্সের ভিতরে পেয়ে গেলেন আয়নার একটি ক্ষুদ্র টুকরো—খুবই ছোট, যেন নখের সমান, তবে চকচকে আর একটুকু সোনালি আভা ছড়ানো। বিষয়টা অচিন্ত্যর সামনে আনতেই তার বুক কেঁপে উঠল। আয়নাটি কি সত্যিই পুরোপুরি নিঃশেষ হয়েছে? নাকি কিছু ছায়া থেকে গেছে এই টুকরোটিতে? তাকে টেবিলের ওপর রেখে তারা সকলেই চুপ করে রইল। হঠাৎই আলো নিভে গিয়ে ঘরটা কাঁপতে লাগল না, ছায়াও গাঢ় হলো না—বরং সেই আয়নার টুকরোর মাঝে দেখা গেল অনীশার মুখ। কিন্তু এই প্রতিফলন বাস্তব নয়—সে হাসছে না, কাঁদছে না—চোখে এক শূন্যতা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখা গেল সময় ১১:৪৭।

অচিন্ত্য দ্রুত সেই টুকরো কাচটিকে একটা সিসা-ঢাকা বাক্সে রেখে বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু তখনই অনীশা চুপচাপ বলল, “বাবা, এটা কোনো অভিশাপ না। এটা একটা সতর্কতা।” তার ঠোঁট কাঁপছিল না, অথচ চোখে ফিরে এসেছিল সেই পুরনো ভাব—যেন সে কিছু ‘দেখছে’ যা আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। “দয়ানিধির মুক্তি হয়েছে, কিন্তু আয়না ছিল শুধু তার বাহন। তার ভিতরের শক্তি যে সময়ের সঙ্গে খেলতে পারে, সেটা আয়নাটির মধ্য দিয়ে জন্মেছে। আর এই টুকরো এখন সেই শক্তির শেষ অংশ—যেটা না বোঝা গেলে, কেউ না কেউ আবার ভুল করে জাগিয়ে তুলবে ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।” অচিন্ত্য স্তব্ধ। তার মেয়ে হয়তো ঠিকই বলছে। আয়না ভাঙলেও সময়ের যে বিকৃতি, যে বাস্তবকে প্রতিফলনের মতো বদলে দেওয়ার ক্ষমতা—সেটা কি এক টুকরো কাচেই বেঁচে থাকতে পারে? যদি কেউ আবার তাকায়, যদি কেউ জেনে না বুঝে ‘নির্বাক দর্পণ’এর নতুন গল্প শুরু করে? রাতে অচিন্ত্য চুপিচুপি সেই বাক্সটি তুলে রেখে দিলেন কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের পুরাতত্ত্ব বিভাগে, যেন পরবর্তী প্রজন্ম গবেষণা করলেও তা এক নির্দিষ্ট নিরাপত্তার ভেতরে থাকে। কেউ যেন এই আয়নার ছায়া নিয়ে খেলতে না পারে, কারণ এই খেলায় জয় কারোর হয় না—শুধু ভবিষ্যৎ নিজের মতো করে বাস্তবকে লিখে ফেলে।

সেদিন রাতে, অনীশা আবার একবার আয়নার ঘরে গিয়ে বসে। দেয়ালে তার আঁকা শেষ ছবিটি তখনও ঝুলে আছে—দয়ানিধির মুখ, শান্ত অথচ শূন্য। হঠাৎ জানালার কাচে দেখা যায় তার প্রতিফলন, কিন্তু প্রতিফলনে নেই কোনো ব্যতিক্রম। সে জানে—ছায়া ঘুমিয়ে পড়েছে, সময় থেমেছে। তবে জানে এটাও, একদিন হয়তো কেউ আবার সেই আয়নার কণা তুলে চোখে ধরে, ভবিষ্যৎ দেখতে চায়। আর সেইদিন আবার জেগে উঠবে এক নির্বাক দর্পণ—নতুন কাহিনি নিয়ে, নতুন অভিশাপ নিয়ে, অথবা হয়তো এক নতুন মুক্তির খোঁজে। অনীশা ধীরে ধীরে বলল, “তুমি এবার ঘুমাও… কিন্তু জানি, গল্প শেষ হয়নি। শুধু থেমে আছে এক পাতার ভাঁজে।” ঘরের বাতি নিভে যায়, ছবির রঙ ফিকে হয়ে আসে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে থেকে যায় এক কথাহীন সাবধানবার্তা—সময়, প্রতিচ্ছবি আর অতীতের গল্প, একসঙ্গে মিলেমিশে গড়ে তোলে এমন এক আয়না, যাকে দেখলেই প্রশ্ন জাগে—আমি কি ভবিষ্যৎ দেখছি, না ভবিষ্যৎ আমায় দেখছে?

অধ্যায় ১০

কয়েকমাস কেটে গিয়েছে ‘নির্বাক দর্পণ’-এর সেই রাতের পর থেকে। অনীশা এখন আবার নিজের জগতে ফিরেছে, কলকাতার একটি আর্ট ইনস্টিটিউটে তার কাজ শুরু হয়েছে, আর অচিন্ত্য তার গবেষণায় নতুন অধ্যায় খুলেছেন—“প্রতিফলন ও সময়ের সম্পর্ক: ইতিহাসের অপর পিঠ।” কিন্তু গভীর রাতে, নির্জনে, যখন মন স্তব্ধ হয়—তখনও যেন তাদের মধ্যে ফিরে আসে সেই আয়নার স্মৃতি, সেই নিঃশব্দ অভিশাপ, আর এক অদ্ভুত প্রশ্ন—আয়নার ভিতরের শক্তিটা কি চিরতরে নিঃশেষ হয়েছে? নাকি তার ছোট্ট কণাটি কোনো নিঃশব্দ কোণে আজও শ্বাস নিচ্ছে, অপেক্ষা করছে? ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের যে ঘরে ‘নির্বাক দর্পণ’-এর শেষ কণা একটি সিসাবদ্ধ বাক্সে রাখা হয়েছে, সেখানে সিকিউরিটি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। একদিন, এক পুরাতত্ত্ববিদ যিনি নতুন করে সময়-ভিত্তিক শিল্পকর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন, সে ঘরে গিয়ে বক্সটির উপর আঙুল বুলিয়ে দিলেন—আর সেই মুহূর্তে ক্যামেরায় ধরা পড়ল, ঘরের মধ্যে বাতি এক সেকেন্ডের জন্য নেভে, এবং কাচের কণাটির গায়ে দেখা যায় এক ক্ষীণ কম্পন, যার রূপ মানুষের চোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু যন্ত্রের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না।

এদিকে অনীশা, যিনি এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে দেখেন নিজের প্রতিচ্ছবিকে, একদিন নিজের আঁকার ঘরে একটা নতুন চিত্র এঁকে ফেলল—বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ছবিটিতে দেখা গেল এক আয়না, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ নয়—ভাঙা, অসম্পূর্ণ, আর তার ভিতর এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে, চোখে নেই ভয়, কেবল দৃষ্টি তার পেছনে থাকা ভবিষ্যতের দিকে। পাশে লেখা একটি বাক্য—“যেখানে প্রতিচ্ছবি শেষ হয়, সেখানেই সময় শুরু।” অচিন্ত্য ছবিটি দেখে কিছু না বললেও বুঝলেন—এটি কেবল শিল্প নয়, এটি একটি ভবিষ্যদ্বাণী। হয়তো এই গল্পের সম্পূর্ণ সমাপ্তি নেই, কেবল স্তব্ধতা আছে, আর এক শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা—যেখানে কালের কাঁটা আবার ঘুরবে সেই রাতের দিকে। এক সন্ধ্যায় অচিন্ত্য পুরনো চিঠিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে জীবন্ত সেনের লেখা একটি পুরনো খামের পেছনে খুঁজে পান এক লাইন খোদাই করা—“আয়নার কণার ভিতর সময় জমে থাকে। যখন কেউ তাকাবে ভালোবাসা নিয়ে, সে শুধু ভবিষ্যৎ দেখবে না, সে ভবিষ্যতের অংশ হয়ে উঠবে।” এটা কি সতর্কতা, না এক মানবিক সম্ভাবনার বার্তা?

বছর ঘুরে যায়। ‘নির্বাক দর্পণ’-এর গল্প ধীরে ধীরে লোককথা হয়ে ওঠে। মুর্শিদাবাদের সেই জমিদারবাড়ি এখন পর্যটকদের কাছে এক চিত্রশালা, যেখানে অনীশার আঁকা সেই চিত্রগুলি প্রদর্শিত হয় নির্দিষ্ট গ্যালারিতে, আর এক কোণে লেখা থাকে—“এই ঘর একসময় আয়নার ছিল, যে আয়নায় দেখা যেত নিজের শেষ দিন।” নতুন প্রজন্ম এই গল্প পড়ে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে, আবার হেসে বলে—“এ তো রূপকথা।” কিন্তু ঘরের এক কোণে একটি আয়না টাঙানো আছে—সাধারণ, ছাঁচবিহীন—যেখানে কেউ কেউ বলেছে, তারা নিজের চোখে দেখেছে ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ আটকে যেতে, অথবা পিছিয়ে যেতে। কেউ দেখে না, কেউ বিশ্বাস করে না। শুধু সময় জানে, প্রতিচ্ছবি জানে—‘নির্বাক দর্পণ’ ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু তার ছায়া ছড়িয়ে গেছে মানুষের গল্পের গভীরে, ইতিহাসের একান্ত প্রান্তে। এবং কোনো এক দিন, কোনো এক ক্ষণে, যখন কেউ আরেকবার প্রশ্ন করবে—”আমি কি নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে চাই?”—ঠিক তখনই কোথাও আবার জেগে উঠবে এক আয়না, এক প্রতিচ্ছবি, আর এক অনন্ত প্রশ্ন—আমরা আয়নার দিকে তাকাই, নাকি আয়না আমাদের দিকে?

___

1000033320.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *