Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

নির্জন শহর

Spread the love

তমালিকা দাস


মহামারীর প্রথম ঢেউ এসে যেন শহরের প্রাণ এক নিমেষে কেড়ে নিল। কলকাতার মতো এক কর্মব্যস্ত মহানগর, যেখানে প্রতিদিনের সকাল মানেই ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন, গাড়ির হর্নে মুখরিত রাস্তা, আর মানুষের ভিড়ের কোলাহল—সেই শহর হঠাৎই হয়ে গেল এক বিরান চৌহদ্দি। অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে মানুষ ঘরে বন্দি, যেন কেউ আর সাহস করছে না রাস্তায় পা বাড়াতে। দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ, ফুটপাতের চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চা নেই, স্কুল-কলেজের ফটকগুলো তালাবন্ধ, সিনেমাহলের আলো নিভে গেছে। শহরের বাতাসে মিশে আছে শুধু আতঙ্ক আর শূন্যতা। এই নিস্তব্ধতায় একমাত্র ভেসে আসে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন—একটা ভৌতিক আর্তনাদের মতো, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, মৃত্যু যেন প্রতিদিনই আরও কাছে চলে আসছে। মানুষের ভেতর এক অদৃশ্য আতঙ্ক বাসা বাঁধছে—কারও জ্বর এলেই মনে হয় এ হয়তো সেই ভয়ঙ্কর রোগ, কারও কাশি শুনলেই মনে হয় মৃত্যুর ছায়া এসে গেছে। অথচ হাসপাতালের ভেতর জীবন যেন চলছেই অন্য এক ছন্দে। রোগীর ভিড় প্রতিদিন বাড়ছে, ডাক্তার, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীরা সীমাহীন চাপে কাজ করে চলেছেন, নিজেদের ভয় ভুলে রোগীদের বাঁচানোর যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন।

এই যুদ্ধক্ষেত্রে পা রাখে তরুণী ডাক্তার অনন্যা। সদ্য রেসিডেন্সি শেষ করেছে, ডাক্তারি জীবনের আসল শুরুটা যেন এক অদ্ভুত সময়ের সঙ্গে মিশে গেছে। তার স্বপ্ন ছিল ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা, মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করা, কিন্তু প্রথম দায়িত্বেই তাকে নেমে পড়তে হলো এক ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রে। হাসপাতালের করিডর তার কাছে আর সাধারণ কোনো জায়গা নয়—এ যেন প্রতিদিনের মৃত্যুর মাঠ, যেখানে জয়-পরাজয় মাপা হয় কারও শ্বাসফেরার ভেতর দিয়ে। প্রতিদিন সাদা স্যুট, মুখ ঢাকা মাস্ক, গ্লাভস আর ফেস শিল্ড পরে সে দাঁড়ায় মৃত্যুর সামনে। ভেতরে ভেতরে হয়তো ভয় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, কিন্তু চোখে মুখে তার ছাপ দেখা যায় না। সে জানে—যদি সে ভেঙে পড়ে, তবে অসংখ্য মানুষ ভরসাহীন হয়ে পড়বে। আর এই লড়াই শুধু চিকিৎসা নয়, মানসিক শক্তিরও পরীক্ষা। অনন্যার কানে প্রতিদিন ভেসে আসে রোগীর চিৎকার, পরিবারের কান্না, আর হাসপাতালের অস্থিরতার শব্দ। তবুও সে জানে—এই লড়াই থেকে তাকে পিছু হটতে নেই।

শহরের বাইরে মানুষ হয়তো আতঙ্কে বন্দি হয়ে বসে আছে, কিন্তু হাসপাতালের ভেতর অনন্যা আর তার মতো হাজারো ডাক্তার-নার্স এক অদৃশ্য ফ্রন্টলাইনে লড়ছে। অনেক সময় অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যায়, অনেক সময় রোগীর আত্মীয়রা কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারদের দোষারোপ করে। তবুও অনন্যা জানে—সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কাজের শেষে বাড়ি ফিরে সে যখন একা ঘরে বসে, তখন বাইরের শহরের নির্জনতা যেন তার হৃদয়কে চেপে ধরে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে সে দেখে শূন্য রাস্তা, ফাঁকা অন্ধকার গলি, নিঃশব্দ রাত—যেন পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়েছে এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের ভেতর। কিন্তু সেই নিস্তব্ধ রাতেই অনন্যা নিজের ভেতর সাহস খুঁজে পায়। সে ভাবে—“যদি আমরা না দাঁড়াই, তবে কে দাঁড়াবে? এই মৃত্যুপুরীর ভেতর দাঁড়িয়েই আমাদের লড়াই করতে হবে।” নীরব শহরকে দেখে তার চোখে জল আসে, কিন্তু সে জানে—একদিন আবার এই শহর জেগে উঠবে, আবার ভরে উঠবে মানুষের কোলাহলে। সেই আশাই তাকে প্রতিদিন নতুন করে লড়াইয়ের শক্তি জোগায়।

***

হাসপাতালের ভেতর প্রতিদিনের চিত্র যেন যুদ্ধক্ষেত্রের থেকেও ভয়ংকর। ভিড় বাড়তেই থাকে, বেডের সংখ্যা ফুরিয়ে যায়, অক্সিজেনের সিলিন্ডারগুলো ঘড়ির কাঁটার মতো গুনে গুনে ব্যবহার করা হয়। এক রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সবার চোখ আতঙ্কে বড় হয়ে ওঠে—“অক্সিজেন আছে তো?” অনেক সময় দেখা যায়, রোগীর জন্য বাঁচার শেষ ভরসা অক্সিজেন পাইপে চাপ কমে এসেছে, অথবা সিলিন্ডার শেষ হয়ে গেছে। এমন মুহূর্তে অনন্যার মনে হয়, তার হাত থেকে শক্তি সরে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করতে পারে না। চারদিকে শুধু হাহাকার, মৃতদেহ সরানো হচ্ছে তড়িঘড়ি, আর নতুন রোগীকে বেডে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি মৃত্যু যেন তাকে কাঁপিয়ে দেয়, বুকের ভেতর ভারী পাথরের মতো চেপে বসে। তবুও সে নিজের কণ্ঠস্বরকে শক্ত রাখে, রোগীর পরিবারের চোখে চোখ রেখে বলে—“আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।” অথচ ভেতরে ভেতরে সে জানে, প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে তারও একটা অংশ ভেঙে যাচ্ছে।

সহকর্মীদের অনেকে ইতিমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কারও শরীরে জ্বর, কারও টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ, কেউ আবার ভয়েই কাজ ছেড়ে ঘরে বসেছে। প্রতিদিন নতুন খবর আসে—“অমুক ডাক্তার আইসিইউতে ভর্তি, অমুক নার্সকে ভেন্টিলেটরে দিতে হয়েছে।” এইসব শুনে অনন্যার বুক কেঁপে ওঠে। সে ভাবে, যদি একদিন নিজেকেও শ্বাস নিতে কষ্ট হয়? যদি নিজের শরীরেই এই অদৃশ্য শত্রু ঢুকে পড়ে? কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নিজেকে ধমক দেয়—“আমি যদি ভয় পাই, তবে রোগীরা কাকে ভরসা করবে? আমার কাজই হলো তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা।” তবে ভয় যে পুরোপুরি মুছে যায়, তা নয়। মাঝেমাঝে রাতের বেলা ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে অনন্যার মনে হয়—গলায় যেন কিছু আটকে আছে, শরীরে যেন অস্বস্তি শুরু হয়েছে। তখন সে নিজেকে প্রশ্ন করে, “এটা কি সত্যিই রোগের লক্ষণ? নাকি ভয় থেকে তৈরি এক ভ্রান্ত অনুভূতি?” ভয়ের এই ছায়া তার দিনরাত জুড়ে থেকে যায়। তবুও সকালে হাসপাতালের পোশাক পরে আবার সে দাঁড়িয়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে, যেন নিজের ভেতরের ভয়কেও চ্যালেঞ্জ করছে।

এই ভয়ের ছায়া শুধু ডাক্তারদের নয়, পুরো সমাজকেও গ্রাস করেছে। হাসপাতালের গেটে প্রতিদিন আত্মীয়রা ভিড় করে থাকে—কারও হাতে ফুল, কারও হাতে ওষুধের প্রেসক্রিপশন, কারও মুখে অসহায় কান্না। কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই, কেবল খবর আসে ফোনে বা ডাক্তারদের মুখে। অনেকেই ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রাগ ঝাড়ে, অভিযোগ করে, এমনকি অনন্যার গালেও বাজে কথা শোনায়—“তোমরা চেষ্টা করছ না বলেই আমাদের মানুষটা বাঁচল না।” এসব কথা কানে গেলে ভেতরে ক্ষত হয়, কিন্তু অনন্যা জানে, এ শুধু শোক আর ভয়ের প্রকাশ। সে তাদের চোখের জল দেখেই বোঝে, তারা আসলে ডাক্তারদের দোষ দিচ্ছে না, বরং ভাগ্যকেই দোষ দিচ্ছে। অনন্যা একরকম প্রতিজ্ঞা করে নেয়—যত ভয়ই আসুক, যত কষ্টই হোক, যত মৃত্যুই তার সামনে ঘটুক, পিছু হটার উপায় নেই। কারণ এই সময়ে যারা দাঁড়িয়ে থাকবে, তারাই ইতিহাস লিখবে। আর ভয়কে জয় না করলে সেই ইতিহাস কোনোদিন আলো দেখবে না। তাই ভয়ের এই ছায়ার মধ্যেও অনন্যা তার ভিতরের আলো জ্বালিয়ে রাখে, এবং সেই আলোই তাকে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার ও লড়াই করার শক্তি দেয়।

***

অদৃশ্য শত্রু—এমন এক প্রতিপক্ষ, যাকে চোখে দেখা যায় না, অথচ তার ভয়ে মানুষ থরথর করে কাঁপে। হাসপাতালের ভেতরে প্রতিটি মুহূর্তে যেন সেই শত্রুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। রোগীর শরীর থেকে নিঃশ্বাসে, স্পর্শে, এমনকি বাতাসে মিলেমিশে আছে সে। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী—সবাই জানে তারা প্রতিদিন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। অনন্যার জীবনও তাই এক অদ্ভুত সন্ত্রস্ততার মধ্যে বাঁধা। দিনের পর দিন সাদা পিপিই স্যুট পরে কাজ করে, ঘন্টার পর ঘন্টা শ্বাস আটকে রাখা মাস্কের ভেতর থাকতে থাকতে তার মনে হয়, শরীরটা ভেতর থেকে শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসল আতঙ্ক শুরু হয় হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পর। সংক্রমণের ভয় যেন তার পিছু ছাড়ে না। বাসায় ফিরে দরজা পর্যন্ত পৌঁছানো মানেই নতুন এক রীতি—জুতো বাইরে, পোশাক আলাদা, ব্যাগ আলাদা, তারপর গরম জলে গোসল। এত নিয়মের পরেও অনন্যা ভাবে, “কোথাও কি কোনো ফাঁক থেকে গেল?” সেই ভয়ের কারণেই সে বাবা-মায়ের কাছে যায় না, বাড়িতে থাকলেও তাদের ঘরে ঢোকে না। একলা ঘরে বসে ফোনে কথা বলাই তার একমাত্র ভরসা। মায়ের কণ্ঠ শুনলেই বুক ভেঙে কান্না আসে, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখে—“না, তাদের কাছে গেলে যদি কিছু ছড়িয়ে দিই? ভালোবাসার স্পর্শটাই তখন সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।” এই অদৃশ্য শত্রুর ভয় তার প্রতিটি সম্পর্ককে বদলে দিয়েছে।

রাতের বেলা, হাসপাতালের ক্লান্ত দিন শেষে যখন অনন্যা নিজের ঘরে ফেরে, তখন এক অদ্ভুত নির্জনতা তাকে ঘিরে ধরে। সারাদিন এত মানুষকে নিয়ে কাজ করলেও, নিজের ঘরে সে পুরোপুরি একা। কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা নয়, কোনো আত্মীয়র সঙ্গে গল্প নয়, এমনকি পাশের বাড়ির কারও সঙ্গে এককাপ চা ভাগ করেও খাওয়া নয়। সবকিছুই দূরে সরে গেছে। একমাত্র সঙ্গী হলো তার নিজস্ব নিঃসঙ্গতা আর ভয়। সুরক্ষাবস্ত্র খুলে আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে ওঠে। চোখের নিচে ঘুমহীনতার গভীর কালো দাগ, শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট, এলোমেলো চুল, যেন অপরিচিত কারও মুখ। তবে সেই চেহারার ভেতরেই এক অদম্য জেদ লুকিয়ে আছে। আয়নার ভেতরে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে—“হ্যাঁ, আমি ক্লান্ত, আমি ভীত, কিন্তু আমি হার মানব না।” মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো সংক্রমণ শরীরে ঢুকেই পড়েছে, হয়তো এই কাশি বা গলার খুসখুস তারই লক্ষণ। কিন্তু প্রতিদিনের লড়াই শুরু হওয়ার আগে সে নিজেকে শক্ত করে তোলে। ভোর হলে আবার সাদা কোট পরে কাজে বেরিয়ে পড়ে, যেন ভেতরের আতঙ্ককে গলা টিপে হত্যা করছে।

অদৃশ্য শত্রুর ভয় এক অদ্ভুত বিভাজন তৈরি করেছে—একদিকে মানুষ, সম্পর্ক, ভালোবাসা, আর অন্যদিকে দায়িত্ব, কর্তব্য ও যুদ্ধ। অনন্যা বুঝতে পারে, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন, প্রায় অসম্ভব। সে হয়তো মায়ের রান্না করা প্রিয় খাবারের জন্য মন কাঁদে, বা বাবার হাতের স্পর্শের জন্য ব্যাকুল হয়, কিন্তু ভয় তাকে আটকে রাখে। সংক্রমণের আশঙ্কা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছায়ার মতো লেগে থাকে। তবুও সেই ভয় তাকে দমাতে পারে না। বরং প্রতিদিন হাসপাতালের ভেতরে মৃত আর জীবিতের লড়াই দেখে সে এক নতুন শিক্ষা পায়—“অদৃশ্য শত্রু কখনো আমাদের দেহকে আঘাত করতে পারে, কিন্তু আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে নয়।” এই উপলব্ধিই তাকে প্রতিদিন নতুন করে জাগিয়ে তোলে। তার চোখের নিচের দাগ, এলোমেলো চুল, শারীরিক ক্লান্তি সবই যেন হয়ে ওঠে সাহসের প্রতীক। অনন্যা জানে, এই অদৃশ্য শত্রুকে পুরোপুরি হারানো কঠিন, কিন্তু ভয়কে জয় করলেই মানুষ সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জন করতে পারে। তাই সে প্রতিদিন নিজের প্রতিচ্ছবির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করে—“আমি লড়ব, আমি টিকে থাকব, আমি জিতব।”

***

অস্পর্শ, দূরত্ব, মৃত্যুর ভয়—এই তিনটি শব্দ যেন একসাথে মানুষকে নিঃশব্দভাবে আটকিয়ে রাখে। করোনার সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালগুলো এক অনিশ্চিত স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি বেডে শুয়ে থাকা রোগীর চোখে ভয়, দুশ্চিন্তা এবং ক্লান্তির মিশ্রণ দেখা যায়। অনন্যা প্রতিদিন স্নিগ্ধ সকালে হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করে, তার মন কিছুটা অবচেতনভাবে টেনে আনে সমস্ত রোগীদের দিকে, যেন তার উপস্থিতি তাদের ভয় কমিয়ে দিতে পারে। সে জানে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, পিপিই গাউন—সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার মনে আছে, মানুষকে বাঁচানো শুধু চিকিৎসা দিয়ে সম্ভব নয়। চোখের মাধুর্য, শান্ত স্বর, একসাথে থাকা—এই মানবিকতার স্পর্শই কখনো কখনো বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এক বৃদ্ধ রোগী, যিনি শ্বাসকষ্টের সঙ্গে লড়াই করছেন, হাতে হাত ধরে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলে—“মা, তুমি পাশে আছো বলেই বাঁচার সাহস পাই।” সেই ছোট্ট কথাটা অনন্যার মনে এক জোরালো প্রতিধ্বনি ফেলে। সে বুঝতে পারে, ডাক্তার হওয়া মানেই শুধুই রোগ নিরাময় নয়; এটি মানুষের আশা, তাদের শক্তি, তাদের মনোবলকে টিকিয়ে রাখার কাজও।

হাসপাতালের কক্ষগুলো এখন যেন এক ধরনের নীরব নাট্যশালা। সিসিটিভি মনিটরগুলোর ব্লিপ ব্লিপ শব্দ, অক্সিজেন সিলিন্ডারের হিস-হিস এবং দূর থেকে শোনা কাঁদার শব্দগুলো একত্রে একটি নিঃসঙ্গ সুর তৈরি করে। অনন্যা প্রতিদিন এই সুরের মধ্যে দিয়ে হাঁটে, তার মনে এক অদ্ভুত একঘেয়েমি এবং দায়িত্ববোধের সংমিশ্রণ থাকে। প্রতিটি রোগীর চোখে ভয় অনুভব করতে পারে সে, কিন্তু সেই ভয়ের ভেতরেও অনন্যা খুঁজে পায় মানুষের মানবিক চেতনার উজ্জ্বলতা। একটি কক্ষে এক তরুণী কাঁদছে, তার মা শয্যায় শুয়ে আছেন। অনন্যা তাদের কাছে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে—“সব ঠিক হবে, আমরা যত্ন নেব।” এই সহজ কথাটি যেমন রোগীর মনকে প্রশান্ত করে, তেমনি তরুণীর চোখের জল কিছুটা হ্রাস পায়। এমন দৃশ্যগুলো অনন্যাকে প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেয়, ডাক্তার হওয়া মানেই শুধুমাত্র রোগ নিরাময় নয়, এটি মানুষের জীবনে আশার আলো জ্বালানো। তার উপস্থিতি, তার স্পর্শ, এমনকি চোখে চোখ রাখার মৃদু সম্পর্কই প্রমাণ করে, মানবিকতার আলো সবসময় টিকে থাকে, সব ভয়, দূরত্ব, এবং অস্পর্শের মধ্যেও।

দিনশেষে যখন অনন্যা নিজেকে হসপিটালের ছাদে বসে শান্ত করার চেষ্টা করে, তখন শহরের দূরত্ব এবং হাসপাতালের নীরবতা তার চারপাশে মিশে যায়। রাতে ল্যাম্পের আলো কক্ষগুলোকে হালকা হলুদ রঙে রাঙায়, আর সেই আলোতে প্রতিটি রোগীর মুখে ছোট্ট আশা এবং শান্তি দেখা যায়। অনন্যা বুঝতে পারে, রোগীর জীবন শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে নয়, বরং এক মানবিক সংযোগের মধ্য দিয়ে বাঁচানো যায়। হাত জোড় করে প্রার্থনা করা, মৃদু হাসি, সহমর্মিতা—এই ছোট্ট আচরণগুলো কখনো কখনো বড় চমক দেখায়। মানবিকতার এই আলো রোগীদের ভয়কে হ্রাস করে, মৃত্যুর আতঙ্ককে সামলাতে সাহায্য করে এবং এমনকি চিকিৎসকের মনকেও শক্তি জোগায়। অনন্যা প্রতিদিন এই আলোয় ভর করে, তার চোখে এক অদম্য বিশ্বাস জাগে যে, যদিও অস্পর্শ এবং দূরত্ব আমাদের আলাদা করতে পারে, তবে মানবিকতার আলো সব সময় জীবনের পথে প্রবাহিত হয়, মানুষের মনোবলকে টিকিয়ে রাখে এবং আশা জাগায়। এই আলোই তাকে প্রতিদিন পুনরায় শক্তি দেয়, এবং তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, ডাক্তার হওয়া মানেই শুধু চিকিৎসক নয়, বরং মানুষের জন্য আলো হয়ে থাকা।

***

চাপ প্রতিদিনই বাড়ছে। হাসপাতালের করিডরে লাশের সারি যেন নীরব চিৎকার করে ওঠে—একদিকে মৃত্যুর অনিয়ন্ত্রিত উপস্থিতি, অন্যদিকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই। প্রতিটি কক্ষের দরজা খুললেই চোখে পড়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট পোষা রোগীরা, যাদের মুখে ভয় আর ক্লান্তি জায়গা করে নিয়েছে। অনন্যা সকাল থেকে রাত অবধি ছুটে চলেছে, রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ভয় এবং কষ্ট ভাগাভাগি করছে। কিন্তু তার নিজের শরীরও সীমার মধ্যে নেই—জ্বর, মাথাব্যথা, ক্লান্তি প্রতিদিন তাকে টানে। একদিন হঠাৎ সে নিজেই জ্বরে কাঁপতে শুরু করে, হাত নড়াতে কষ্ট হচ্ছে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ব্যথায় ব্যথিত। মনকে ঘিরে আসে এক অদ্ভুত হাহাকার—“যদি আমিও আক্রান্ত হয়ে যাই? যদি আমি এখনই পড়ে যাই?” এই প্রশ্ন তাকে ভেঙে দেয়, তার ভয়, ক্লান্তি এবং মৃত্যুর ছায়া একত্রে তাকে দমিয়ে দেয়।

কিন্তু হাসপাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি চোখ অনন্যার দিকে তাকিয়ে আছে। রোগীদের নির্ভরশীলতা, সহকর্মীদের বিশ্বাস, সব মিলিয়ে অনন্যার হৃদয়ে এক অদ্ভুত চাপ তৈরি হয়। সে বুঝতে পারে, এই ভাঙন শুধুমাত্র তার নয়; এটি পুরো ব্যবস্থার, এই মুহূর্তের মানবিকতার, এবং রোগীদের বাঁচার আশা নিয়ে সংঘর্ষ। এক কোণে শুয়ে থাকা বৃদ্ধ রোগী, যিনি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল, অনন্যার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে—“তুমি থাকলে আমরা বাঁচব।” এই ছোট্ট বাক্য অনন্যার চোখে জল এনে দেয়, কিন্তু সে হাল ছাড়তে পারে না। ক্লান্তি আর অস্পর্শের মধ্যেও একটি শক্তি তাকে ধরে রাখে—প্রমাণ করে, মানুষ কখনো একা নয়। অনন্যা নিজেকে মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি সহানুভূতির স্পর্শ রোগীদের জন্য আলোর পথ তৈরি করে। যদিও মৃত্যুর ছায়া ঘন, এবং ভয় সব জায়গায়, তবুও সেই ছোট্ট আশা, সেই মানবিক স্পর্শই তাকে দাঁড় করিয়ে রাখে।

দিনশেষে অনন্যা নিজের কক্ষে একাকী বসে শরীরের ব্যথা এবং মনস্তাত্ত্বিক ক্লান্তি অনুভব করে। তার চোখ বন্ধ করে হাসপাতালে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো মনে পড়ে—কত রোগী শ্বাসকষ্টের সঙ্গে লড়ছে, কতজন তাদের শেষ নিশ্বাস নিচ্ছে, কতজন অনন্যার দিকে তাকিয়ে আছে বাঁচার জন্য। এই সব দৃশ্য একত্রিত হয়ে তার মনে এক ভাঙন সৃষ্টি করে, যা কখনো শুধু শরীরিক নয়, মানসিকও। কিন্তু ঠিক তখনই মনে পড়ে যায়, হাজারো চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে, হাজারো মানুষ তার শক্তি থেকে বেঁচে থাকার সাহস খুঁজছে। অনন্যা ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, এবং সিদ্ধান্ত নেয়—যদিও ভয়, ক্লান্তি এবং মৃত্যুর ঘন ছায়া ঘিরে রেখেছে তাকে, সে থেমে থাকবে না। মানবিকতার জন্য, মানুষের জন্য, এই ভাঙনের কিনারায় দাঁড়িয়ে সে নিজেকে আবার তৈরি করে। এই অধ্যায় তার জন্য একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে ওঠে, যা তাকে শেখায়, ভাঙা মনের মধ্যেও শক্তি থাকে, এবং ভয়কে অতিক্রম করে মানবিকতার আলোকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

***

অসুস্থ শরীর, জ্বরের ধাক্কা, ক্লান্তি—সবকিছুর মাঝেও অনন্যা আবার দাঁড়ায়। একদিন যখন নিজেকে একাকী হাসপাতালের করিডরে দেখতে পায়, তার শরীর ক্লান্ত এবং শক্তিহীন, কিন্তু মন একেবারে ভেঙে পড়েনি। নিজের ভেতরের ভয়কে নিয়ে সে লড়াই শুরু করে, বুঝতে পারে—ভয়কে জয় করার শক্তি আসলে তার নিজের ভেতরেই নিহিত। যেদিন সে শ্বাসকষ্টে কাঁপছিল, আজ সেই একই শ্বাস নিতে নিতে সে প্রতিটি রোগীর পাশে দাঁড়ায়, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের ভয় কমায়। অনন্যা উপলব্ধি করে, মানুষের জীবন শুধু চিকিৎসা এবং ঔষধ দিয়ে নয়, বরং বিশ্বাস, সাহস এবং মানবিক স্পর্শ দিয়ে বাঁচানো যায়। প্রতিটি রোগীর চোখে সে একটি নতুন আশা দেখছে, এবং সেই আশা অনন্যাকে আরও শক্তি জোগায়।

হাসপাতালের করিডরগুলো আজও এক ধরনের চাপের স্থল, কিন্তু অনন্যা এখন তার চোখে দৃঢ়তা এবং মনোজ্ঞ সাহস নিয়ে হাঁটে। তরুণ ডাক্তাররা তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাকে অনুসরণ করে, অনন্যার প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের কাছে শিক্ষা হয়ে যায়। অনন্যা শুধু রোগীর চিকিৎসা দেয় না, বরং তাদের সঙ্গে মানসিক সংযোগ স্থাপন করে, তাদের জীবনের মানে এবং সাহস ফিরে আনে। এক কোণে শুয়ে থাকা এক শিশু, যিনি আগের দিন আতঙ্কে কাঁদছিল, আজ অনন্যার হাসি দেখে শান্ত হয় এবং চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয়। অনন্যার মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তা এবং মানবিক স্পর্শ তরুণ ডাক্তারদের মধ্যে নতুন উদ্যম জাগায়, তাদের দেখায় যে সত্যিকারের চিকিৎসা মানে শুধুই শারীরিক আরোগ্য নয়, এটি মানুষের ভয় দূর করা এবং তাদের হৃদয়ে আশা জাগানোও। অনন্যা নিজেও শিখেছে—ভয়কে শুধু প্রত্যাখ্যান করা নয়, বরং তার সঙ্গে লড়াই করা এবং অন্যকে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে সাহসকে পুনর্জীবিত করা যায়।

দিনশেষে যখন হাসপাতালের ছাদে বসে অনন্যা তার ভেতরের শান্তি খুঁজে পায়, তখন অনুভব করে, প্রতিটি দুঃসাহসিক মুহূর্ত এবং প্রতিটি জীবনকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। সে বুঝতে পারে, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া এবং ক্লান্তি অনুভব করা কোনও পরাজয় নয়, বরং এটি সাহসের পুনর্জন্মের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। অনন্যা তার চোখে এক অদম্য দৃঢ়তা ধরে রাখে, যা শুধু নিজেকে নয়, তার চারপাশের মানুষকেও শক্তি দেয়। হাসপাতালের তরুণ ডাক্তাররা তাকে অনুসরণ করে, রোগীরা তার চোখে আশা খুঁজে পায়, এবং নিজেকে ভয়কে জয় করার শক্তি হিসাবে উপলব্ধি করে। এই অধ্যায় অনন্যার জন্য একটি নতুন সূচনা হয়ে ওঠে, যা তাকে এবং তার চারপাশের মানুষকে দেখায়, ভয়কে অতিক্রম করে এবং মানবিকতার আলোকে জীবনের প্রতিটি পথে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

***

মহামারী শুধু রোগ নিরাময় বা মৃত্যুর গল্প নয়; এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলে। আগে সমাজের চোখে নারী ডাক্তারদের প্রশ্ন থাকত—“তুমি কি সক্ষম? তুমি কি এই চাপের মুখোমুখি হতে পারবে?” কিন্তু অনন্যার দৃঢ়তা, সাহস এবং সহমর্মিতা সেই সমস্ত প্রশ্নকে চুপ করে দেয়। হাসপাতালে তার কাজকে নজরদারি করে দেখেছে তরুণ ও বৃদ্ধ, রোগী এবং তাদের পরিবার। অনন্যার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সাহসিকতা রোগীদের চোখে এবং সহকর্মীদের মনেও অনুপ্রেরণা জাগায়। সে শুধুমাত্র চিকিৎসক নয়; সে মানুষের আশা এবং সাহসের প্রতীক হয়ে ওঠে। এক বৃদ্ধা রোগী, যিনি মহামারীর প্রাকৃতিক ভয় ও অসহায়তার মধ্যে আটকে ছিলেন, অনন্যাকে দেখে বলে—“তুমি আমাদের জন্য আলো, তুমি আমাদের ভয়কে দূর করেছ।” এই মুহূর্তে অনন্যা বুঝতে পারে, তার কাজ কেবল রোগ নিরাময় নয়; এটি সমাজকে নতুন দৃষ্টিকোণ দেখানোর কাজও।

হাসপাতালের করিডর, রোগী ও ডাক্তাররা, একদিকে যন্ত্রণার গল্প আর অন্যদিকে মানবিকতার প্রদর্শনী—সবকিছু মিলিয়ে সমাজের আয়নার মতো। অনন্যার সাহস এবং দৃঢ়তা শুধু হাসপাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; শহরের মানুষ এবং সংবাদমাধ্যমও তার গল্পকে ছড়িয়ে দেয়। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়—“নারী শক্তির নতুন প্রতীক।” এটি কেবল একটি সংবাদ নয়, বরং একটি সামাজিক প্রতীক, যা দেখায় মহামারী যেমন মানুষের মনকে কেঁপে দিচ্ছে, তেমনি নারীর ক্ষমতা, দৃঢ়তা এবং সাহসকে সমাজের সামনে তুলে ধরছে। অনন্যার সাহসিকতা নতুন প্রজন্মের নারীদের দেখায় যে, সমাজের চোখে প্রতিটি সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সম্ভব। তার উপস্থিতি সমাজের জন্য একটি চেতনার আলো হয়ে ওঠে, যা পুরনো ধারণা, অনিশ্চয়তা এবং ভয়কে অতিক্রম করে।

অনন্যা বুঝতে পারে, মহামারী শুধু রোগকে নয়, মানুষের বিশ্বাস, শক্তি এবং সামাজিক মানসিকতাকেও পরীক্ষা করেছে। আগে যে সমাজ নারী ডাক্তারদের অদম্য শক্তি নিয়ে সন্দেহ করত, আজ সেই সমাজ অনন্যার মাধ্যমে নতুন দৃষ্টান্ত দেখে—নারী কেবল চিকিৎসক নয়, সাহসী যোদ্ধা, মানবিকতার প্রতীক, এবং পরিবর্তনের বাহক। তার চোখে সেই দৃঢ়তা রয়েছে যা সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে। হাসপাতালের তরুণ ডাক্তাররা অনন্যাকে অনুসরণ করে, রোগীরা তার দিকে তাকিয়ে আশা খুঁজে পায়, এবং সমাজের মানুষ তার সাহসকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করে। এই অধ্যায় দেখায়, মহামারী কেবল মানুষের জীবনের পরীক্ষা নয়, বরং সমাজকে নিজের আয়নায় তাকাতে শেখানোর একটি মুহূর্ত, যেখানে অনন্যার সাহস এবং মানবিকতার আলো সমাজকে নতুন দিশা দেখায়।

***

মহামারী কিছুটা কমেছে, কিন্তু শহর এখনও অচেনা মনে হচ্ছে। রাস্তায় মানুষ আছে, কিন্তু সেই আগের হাসি, চাঞ্চল্য এবং জীবনের ছন্দ নেই। হাসপাতালের করিডরগুলোও এখন শূন্যের মতো, যেখানে আগে রোগী ও ডাক্তারদের ভিড় ছিল, এখন শুধুই নিঃশব্দ বাতাস বইছে। অনন্যা ছাদে দাঁড়িয়ে শহরের দূরত্বপথ, খালি রাস্তাগুলো এবং নিস্তব্ধতা দেখে অনুভব করে, এই নির্জনতার মাঝেও আশা জেগে থাকে। চোখে অশ্রু, মনে এক অদ্ভুত ভারমুক্তি—যেন এক দীর্ঘ যুদ্ধে সে নিজের শক্তি খুঁজে পেয়েছে। সে স্মরণ করে, কতো রোগী জীবনের সঙ্গে লড়েছিল, কতো সহকর্মী তার পাশে দাঁড়িয়েছিল, কতোবার তার মন ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের সাহস পুনর্জন্ম লাভ করেছিল। মহামারীর এই নির্জনতা অনন্যাকে শেখায় যে, ভয়কে অতিক্রম করলে মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তি এবং মানবিকতার আলো সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পায়।

ছাদে দাঁড়িয়ে অনন্যা আকাশের দিকে তাকায়, যেখানে সূর্যের আলো নগরের ধূসর রঙের উপর পড়ছে। এই আলো তাকে মনে করিয়ে দেয়, নির্জনতা কখনো চিরস্থায়ী নয়। শহর একদিন আবার প্রাণে ভরে উঠবে, মানুষ আবার আগের মত হাঁটবে, হাসবে, আর জীবনের ছন্দ ফিরে পাবে। কিন্তু এই নির্জনতার মুহূর্ত, এই সংকটকাল, ইতিহাস হয়ে থাকবে—প্রমাণ হয়ে থাকবে যে, মানুষ ভয়কে জয় করতে পারে এবং সবচেয়ে বড় শক্তি অর্জন করতে পারে। অনন্যার চোখে সেই শক্তির প্রতিফলন দেখা যায়। হাসপাতালের প্রতিটি কক্ষ, প্রতিটি করিডর, প্রতিটি রোগী এবং সহকর্মীর জন্য তার লড়াই একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকে। তার সংগ্রাম শুধু চিকিৎসার জন্য নয়; এটি মানুষের মনোবল, আশা এবং সাহসকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার গল্প।

দিনশেষে, ছাদের ধূসর আলো আর শহরের নিঃশব্দতার মাঝে অনন্যা একাকী হলেও এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করে। তার চোখে অশ্রু, কিন্তু সে জানে, তার লড়াই ইতিহাসের পাতায় থাকবে। মানুষ দেখবে, শুনবে, এবং অনুপ্রাণিত হবে—ভয়কে জয় করা সম্ভব। নির্জনতার ওপারে দাঁড়িয়ে অনন্যা উপলব্ধি করে, এই মুহূর্তের একাকীত্ব, এই নিঃশব্দ শহর, মানুষকে এবং সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শেখাবে। তার ভেতরের দৃঢ়তা, সাহস এবং মানবিকতার আলো প্রমাণ করে যে, মানুষের ভিতরে থাকা শক্তি সবসময়ই বিজয়ী। শহর আবার প্রাণে ভরে উঠবে, মানুষের হৃদয় আশা নিয়ে ধন্য হবে, আর অনন্যার এই লড়াই প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

****

1000064452.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *