সুভাষ বৰ্মন
অধ্যায় ১: পুরনো দরজার ওপার
কলকাতা শহরের কোলাহলের মাঝখানে ইতিহাসের পাতায় ডুবে থাকা ঋদ্ধিমা বসুর জীবন ছিল এক ধীরগতির প্রবাহ, যেটা কেবলমাত্র মুছে যাওয়া নাম, ধুলো জমা নথি আর পুরনো চিঠির ভাঁজেই নিজের ছন্দ খুঁজে পেত। সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষক, এবং সম্প্রতি তার গবেষণার বিষয় নির্ধারিত হয়েছে—”১৯৪৬-৪৭ সালের পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের জমিদার সমাজের মনস্তত্ত্ব ও ভয়াবহতা”। তার থিসিসের জন্যই শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি পুরনো জমিদার বাড়ি—‘দত্ত কুঠি’—তাকে ডাকা দিয়েছে, যেটি ১৯৪৭ সালের পর থেকে প্রায় পরিত্যক্ত। এই কুঠিরে কেউ থাকে না, তবে পুরাতত্ত্ব দফতরের অনুমতি নিয়ে ঋদ্ধিমা এক মাসের জন্য এখানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। কুঠিরে পৌঁছে যখন প্রথম দরজাটি খুলল, কাঠের পুরনো গন্ধ, ছাদের জালজমা মাকড়সার জাল, আর আসবাবপত্রের চাপা চিৎকার যেন একসাথে তার মনে স্পর্শ করল। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ বয়ে গেল তার শরীরজুড়ে, ঠিক যেমনটা হয় কোনো পুরনো রত্ন খুঁজে পেলে।
বাড়িটিতে ঢুকেই তার চোখ আটকে যায় এক বিশাল কাঠের তাকের দিকে, যেখানে ধুলো চাপা কিছু বই আর নোটবুক স্তরে স্তরে সাজানো। এগুলোর মধ্যে একটি বাঁধাইখাতা হঠাৎই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে—হালকা বাদামি মলাট, পেছনের পাতায় লেখা একটি নাম, ‘বৃন্দাবন দত্ত’, এবং নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা—”A Private Logbook, Do Not Read”. এই ‘নিষেধাজ্ঞা’ যেন আরও গভীর কৌতূহল সৃষ্টি করে তার মধ্যে। পরের দিন সে ধীরে ধীরে খাতাটি খুলে পড়ে দেখতে শুরু করে। প্রথম পাতাগুলিতে জমিদার বৃন্দাবন দত্ত তার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখেছেন, যেগুলো একদম স্বাভাবিক—কোন কৃতজ্ঞ ভৃত্যকে দান করলেন, কেমন করে রাতের খাবারে মুরগির ঝোল দিলেন। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা পর হঠাৎই লেখা বদলে যায়—”আমি প্রতিদিন দেখি দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ তাকাচ্ছে। যখন গিয়ে দেখি, কেউ নেই। হয়ত আমি ভুল দেখছি… হয়ত না।” এমন আরও কিছু বাক্য—”ঘড়ির কাঁটা রাত ১টায় থেমে যায়, যেন ঘড়িটিও ভয় পেয়েছে” কিংবা “আমার নাম কে যেন বারবার নিচ্ছে—ধীরে ধীরে, ফিসফিস করে, যেন বাতাসে লেখা একটা নাম”—ঋদ্ধিমাকে কাঁপিয়ে তোলে। এক অজানা স্রোতে সে জড়িয়ে পড়ে ওই খাতার মাঝে, যেখানে সময় যেন ১৯৪৭-এ আটকে আছে।
ঋদ্ধিমা প্রতিদিন সন্ধের পর নিজেকে পুরো কুঠিরে একা রেখে খাতাটি পড়তে বসে। বাড়িটির প্রতিটি কক্ষ যেন তার চোখে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিছু পুরনো ফটো অ্যালবামে বৃন্দাবন দত্তের একটি ছায়াচ্ছন্ন ছবি খুঁজে পায় সে, যেখানে তার চোখ দুটি পরাবাস্তবভাবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে। তার ঘুমে ছেদ পড়ে—রাত ১টার সময় ঘড়ির কাঁটা সত্যিই থেমে যায়, বারান্দার ছায়ায় যেন কারও উপস্থিতি টের পায়। অথচ বাইরে তাকিয়ে দেখলে, কারও ছায়া পড়ে না। আশেপাশের স্থানীয়রা যখন তাকে বলে—”আপনি সন্ধ্যার পর ওখানে একা থাকবেন না ম্যাডাম, ওই কুঠিতে কেউ আছে… আজও”, তখন ঋদ্ধিমা এক রকম চুপ করে শোনে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার মন বলে—এই ভয়, এই অস্বস্তিই হয়তো ইতিহাসের সত্যি। আর এই সত্যের কাছে পৌঁছাতে গেলে তাকে একা যেতে হবে সেই দরজার ওপার—যেখানে অপেক্ষা করে এক হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর, এক অসমাপ্ত দিনলিপি।
এই সব কিছুর মধ্যেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় অরিত্র চৌধুরীর—এক শান্তিনিকেতনের স্থানীয় গাইড, যিনি একটু অন্যরকম। সে বেশি কথা বলে না, কিন্তু একদিন কুঠিরের বাইরে তাকে দেখে বলে, “আপনি দিনলিপিটা পড়ছেন তো? ওটা অনেক আগেই থেমে গেছিল। এখন আবার শুরু হলে সাবধান থাকবেন। বৃন্দাবনের লেখা শেষ হয়নি, কারণ সে নিজেই হারিয়ে গিয়েছিল খাতার পাতার মধ্যে।” ঋদ্ধিমা বিস্মিত হয়। কে এই অরিত্র? তার কী জানার কথা এই দিনলিপি সম্পর্কে? রাত বাড়ে, এবং কুঠিরের আকাশ যেন ঘন কালো হতে থাকে। প্রথমবার তার মনে হয়—গবেষণা নয়, সে এখন এক এমন রহস্যে জড়িয়ে পড়ছে যেটার উত্তর কেবল ইতিহাস নয়, বরং আত্মার গহীন আর্তনাদও হয়তো হতে পারে। কুঠিরের সেই পুরনো দরজাটি এখন তার জন্য শুধু অতীত নয়, বরং এক ভিন্ন জগতের প্রবেশদ্বার।
অধ্যায় ২: কালো কালির দিনলিপি
দিনের আলোয় দত্ত কুঠির যতটা নীরব, রাতের গভীরে সে যেন এক আশ্চর্যসজ্জিত মঞ্চ হয়ে ওঠে, যার প্রতিটি দেওয়ালে, কাঠের দরজায়, এমনকি বাতিল করা দেয়ালঘড়ির ফাটলতেও যেন কিছু অদৃশ্য শব্দ বয়ে চলে। দ্বিতীয় রাতটিতে, যখন সব কিছুকে পেছনে রেখে ঋদ্ধিমা সেই দিনলিপি নিয়ে বসে, তার মনে হয় আজকের পৃষ্ঠা যেন সেদিনের তুলনায় একটু ভিজে, একটু ঘন। কালির ছাপ গাঢ়, অক্ষরগুলো সোজা নয়—কেমন যেন এলোমেলো। পাতার এক পাশে হঠাৎই লেখা, “আজ সে আমার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। মুখ দেখা যায়নি, কিন্তু তার ছায়া দেয়ালের ওপর হাঁটছিল। আমি দরজা খুলে ফেলি, কেউ নেই। কিন্তু আমার জানালায় এক ফোঁটা রক্ত!” লেখা এই জায়গা থেকেই কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ে। ঋদ্ধিমা আতঙ্কিত নয়, বরং কৌতূহলী। ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে সে বিশ্বাস করে, প্রতিটি ভয় আসলে এক ভিন্ন তথ্য। কিন্তু সেই রাতে তার ঘরের দরজায় হঠাৎ তিনটি শব্দ হয়—টক… টক… টক। সে দরজা খুলে দেখে, কেউ নেই। কিন্তু মেঝেতে একটুকরো কাগজ পড়ে আছে। কাগজে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু আঙুলে নিল কালির দাগ, ঠিক যেমনটা দিনলিপির পাতায় দেখা যায়। প্রশ্ন জাগে—কে ফেলল এই কাগজ? বৃন্দাবনের লেখা কি এখনো চলমান?
পরদিন সকালবেলা, চা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঋদ্ধিমা স্থানীয়দের কয়েকজনকে দেখে যারা কুঠিরের বাইরে দাঁড়িয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বলে, “ম্যাডাম, আপনি কি দিব্যি রাতে একা থাকেন?” ঋদ্ধিমা হাসেন, “আমি ভয় পাই না।” বৃদ্ধা চোখ সরিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “বৃন্দাবন বাবু রাতের সময় লিখতেন। খাতার পাতাগুলোতে আগুন ধরেনি কোনোদিন, কারণ ওগুলো জীবন্ত। আপনি বুঝতে পারছেন না এখন, বুঝবেন।” দুপুরে অরিত্র আবার আসে—একটা ছোট পুরনো মানচিত্র হাতে। সে বলে, “এই কুঠিরের নিচে একটা পুরনো ঘর ছিল, অনেক আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে কেউ যেত না। এই ঘরেরই নিচে।” ঋদ্ধিমা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখে, সে বুঝতে পারে বাড়ির পূর্বদিকের এক কাঠের তাকের পেছনে দেয়ালের মধ্যে কিছু একটা লুকানো। সে তখনই উঠে গিয়ে তাক ভেঙে দেয়—আর দেখতে পায় কাঠ দিয়ে ঢাকা একটা সরু দরজা। ভিতরে নামার মতো এক সিঁড়ি। বাতাস ভারি, আর নিচে নামার সময় তার মনে হয়—দিনলিপির কালো কালি যেন ধীরে ধীরে তার শরীর ঘিরে ফেলছে।
ভূগর্ভস্থ সেই ঘরটিতে কোনো আলো নেই, কেবল একটি ভাঙা লণ্ঠন পড়ে আছে। ঋদ্ধিমা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেয়, আর দেখতে পায় ঘরটির দেয়ালে শালার কাঠ দিয়ে বানানো তাক, যেখানে অগুনতি খাতা সাজানো। প্রত্যেকটির মলাটে লেখা—“Private, By B.D.”। সে বুঝতে পারে বৃন্দাবনের ব্যক্তিগত দিনলিপির এসব খণ্ড কোনোদিন কেউ পড়েনি। সে এলোমেলোভাবে একটি খাতা তোলে, খোলে—প্রথম লাইনেই লেখা, “আজ আমি তাকে দেখেছি। সে আমার ছায়া নকল করে। আমি হাঁটলে, সে আগে হাঁটে। আমি বসলে, সে দাঁড়ায়।” কাঁপা হাতেও সে খাতা গুটিয়ে নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে, ঘরের এক কোণ থেকে খসখস শব্দ আসে, যেন কেউ কাঠের পাটাতনের নিচে ঘষছে পায়ে। ঋদ্ধিমা পেছনে ঘুরে দেখে, কেউ নেই। কিন্তু পাটাতনের ফাঁক দিয়ে একটি চোখ—রক্তবর্ণে ভরা, তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তেই সে দৌড়ে উপরে উঠে আসে, দরজা বন্ধ করে দেয়। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসে কয়েক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু তার মনে তখন শুধু একটি ভাবনা—এই দিনলিপি বৃন্দাবনের নয় শুধু, বরং কুঠিরের আত্মার আত্মজীবনী।
ঋদ্ধিমা সিদ্ধান্ত নেয়, এই দিনলিপিগুলি সে এক এক করে পড়বে এবং বিশ্লেষণ করবে, কারণ এগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ১৯৪৭ সালের সেই ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাসের ছাপ, যা কেবল এক জমিদার নয়, হয়তো পুরো এক অঞ্চলের মনের উপর ছায়া ফেলে গেছে। অরিত্র তাকে সাহায্য করে খাতাগুলো ঘরে নিয়ে যেতে। কিন্তু যেইদিন সে দ্বিতীয় খাতা পড়ে, আরেকটি নতুন বাক্য সামনে আসে—“আমি জানি আমি মরিনি, আমার শব্দ বেঁচে আছে। কেউ যদি আমার শব্দগুলো পড়ে, সে হবে পরবর্তী লেখক।” ঋদ্ধিমা হঠাৎ বুঝে যায়—এই দিনলিপি পড়া মানে কেবল পড়া নয়, বরং সেই লেখার উত্তরাধিকার গ্রহণ করা। বৃন্দাবনের আত্মা কি খুঁজছিল একজন উত্তরসূরি লেখককে? আর সে কি এখন নিজেকে খাতার মধ্যে আটকে ফেলেছে? তার চারপাশের বাতাস ঘন হয়ে ওঠে, শব্দহীন কুঠির যেন ফিসফিস করে ওঠে, আর দিনলিপির পাতাগুলো অলক্ষ্যে যেন উল্টে যেতে শুরু করে, এমন এক অধ্যায়ে, যেটা এখনো কেউ লেখেনি।
অধ্যায় ৩: অরিত্র ও তার গল্প
ঋদ্ধিমা দিনলিপির পাতায় ডুবে থাকলেও তার মধ্যে একটা প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছিল—কে এই অরিত্র চৌধুরী? কেন সে এত কিছু জানে এই কুঠি সম্পর্কে, যেন নিজের জীবনের গল্পের মতো? সে কি শুধুই এক ইতিহাসপ্রেমী গাইড, নাকি এই রহস্যের কোনো অংশ? পরদিন বিকেলে সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় অরিত্রকে ডেকে এনে কথা বলবে, সামনাসামনি। স্থানীয় মোড় থেকে তাকে ডেকে আনা হয়। অরিত্র এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দার ধারে, যেন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে ভয় পাচ্ছে। “ভয় পাচ্ছো?”—ঋদ্ধিমা জিজ্ঞেস করে। অরিত্র মাথা নাড়ে, “ভয় নয়, সম্মান। এই কুঠি অনেক কিছু গিলে নিয়েছে—মানুষ, গল্প, শব্দ। তাই আমি কখনো ভেতরে আসিনি।” কথাটা শোনার পর ঋদ্ধিমার কাঁপুনি দেয়। সে অরিত্রকে ঘরের ভেতরে ডাকে, যেখানে সেই পুরনো দিনলিপির খাতাগুলো বিছানার ওপরে এলোমেলো পড়ে আছে। অরিত্র সেগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে—“তুমি জানো, এগুলো শুধু লেখা নয়। এগুলো হচ্ছে আত্মা-বাঁধা নথি। বৃন্দাবন দত্ত যখন এগুলো লিখেছিল, তখন ওর মানসিক অবস্থাটা আর মানুষের মতো ছিল না। সে নিজেকে খাতায় বাঁচিয়ে রেখেছে।” ঋদ্ধিমা সোজাসুজি প্রশ্ন করে, “তুমি এত কিছু জানো কীভাবে?”
অরিত্র তখন ধীরে ধীরে এক গল্প বলতে শুরু করে, যার প্রতি বাক্য ঋদ্ধিমার শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। “আমার ঠাকুরদা ছিলেন বৃন্দাবন দত্তের কুঠিরের কেয়ারটেকার। তিনি একসময় এই বাড়িতে থাকতেন, একা। বৃন্দাবন যখন নিখোঁজ হন, তখন পুলিশ বাড়ি তল্লাশি করে কিছু পায়নি। কিন্তু আমার ঠাকুরদা বলেন, বৃন্দাবন কোথাও যায়নি—সে আছে এই কুঠিতেই, লেখা হয়ে। পরে ঠাকুরদাও একদিন উধাও হয়ে যান। শুধু একটা কাগজ রেখে যান আমার বাবার কাছে, যেখানে লেখা—‘যে শব্দ বাঁচে, সে শরীর ছাড়ে’। আমি সেই কাগজ বড় হয়ে যখন পড়ি, তখন থেকেই কুঠির আর দিনলিপির প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। আমি ইতিহাস ভালোবাসি না, আমি ভালোবাসি সেই ছায়া, যে ইতিহাসের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে।” কথা বলতে বলতে অরিত্র এমন এক অভিব্যক্তি নেয়, যেন সে এইসব চোখে দেখেছে, অনুভব করেছে। “তুমি কি বিশ্বাস করো বৃন্দাবন এখনও এখানে আছে?”—ঋদ্ধিমার প্রশ্নে অরিত্র একবারও চোখ না নাড়িয়ে বলে, “সে আছে, কারণ তুমি লিখছো না—তুমি ওর লেখা পড়ছো। লেখার মধ্যে সে এখনো বেঁচে। আর সে খুঁজছে কাউকে, যে ওর কথা শেষ করবে।”
ঋদ্ধিমার মনে একদিকে ভয়, অন্যদিকে টান অনুভব হয়। দিনলিপি এখন শুধু গবেষণার বস্তু নয়, বরং সে নিজেই যেন সেই লেখার পাতায় ঢুকে পড়েছে। সে অরিত্রকে জানায় সেই গোপন ভূগর্ভস্থ ঘরের কথা, সেই চোখের, সেই ফিসফিসানির। অরিত্র চমকে ওঠে—“তুমি নিচে গিয়েছিলে? ওটা তো ‘মৌন ঘর’। বৃন্দাবন ওটা বানিয়েছিল শুধু তার নিজের জন্য। সেখানে ও লিখত, হাসত, কখনো কাঁদতও। কেউ কখনো ঢোকেনি। এমনকি আমার ঠাকুরদাও নয়।” এখন ঋদ্ধিমা ও অরিত্র বুঝতে পারে—তারা যে গল্পে ঢুকেছে তা আর কেবল কাগজে লেখা নয়, বরং সেটা তাদের নিজের শরীরকে ব্যবহার করে নতুন অধ্যায় তৈরি করতে চায়। হঠাৎ অরিত্র বলে, “দিনলিপির প্রথম খাতার প্রথম পাতার পেছনে কিছু লেখা আছে, যেটা আগেই কেউ দেখে না।” ঋদ্ধিমা দ্রুত খাতা টেনে আনে, পেছনে দেখে—হ্যাঁ, এক অদ্ভুত সংকেত। বাংলা ও ইংরেজির অদ্ভুত মিশ্রণে লেখা—“যে দেখে, সে হয়। যে পড়ে, সে লেখে। যে লেখে, সে শূন্য হয়।” দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এক সময় অরিত্র বলে, “তুমি এখন ওর জায়গায় যাচ্ছো ঋদ্ধিমা। তুমি শূন্য হবার পথে।”
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে কুঠির যেন হালকা কাঁপতে থাকে। বাতাসের গতি বাড়ে, জানালায় পর্দা দুলে ওঠে। অরিত্র উঠে দাঁড়ায়—“আজ পূর্ণিমা। আজই বৃন্দাবন নিখোঁজ হয়েছিল। আজই প্রথমবার সেই ঘরে লেখা থেমে গিয়েছিল। জানো, এরপর যা ঘটেছিল, তা কেউ জানে না। হয়তো আজ আমরা জানব।” ঋদ্ধিমা তাকিয়ে থাকে দিনলিপির পাতার দিকে। পাতায় হঠাৎই কিছু লেখা দেখা যায়—যেটা সে লেখেনি, কেউ লেখেনি। শুধু কালো কালি দিয়ে এক লাইন—“স্বাগতম, নতুন লেখক।” ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কোথাও যেন দূরে মৃদু হাসির শব্দ। আর এই মুহূর্তেই গল্প আর বাস্তব এক হয়। কুঠির আর তার ইতিহাস—ঋদ্ধিমা ও অরিত্রকে টেনে নিচ্ছে এক গভীরতার দিকে, যেখান থেকে ফেরা নেই। কিংবা যদি ফেরাও হয়, হয়তো তারা ফিরবে অন্য কেউ হয়ে—শুধু নামটা একই থেকে যাবে।
অধ্যায় ৫: ছায়া ও শব্দ
দিনলিপির সেই রাতের লেখার পর কুঠিরের ভেতরের পরিবেশ যেন বদলে গিয়েছিল—আর সেটা শুধু চোখে দেখা পরিবর্তন নয়, বরং এক অনুভূতিগত বদল, যা ঘরের প্রতিটি কণায় ছড়িয়ে পড়ে। ঋদ্ধিমা বুঝতে পারছিল, তার মাথার মধ্যে মাঝে মাঝে শব্দ বাজছে—জানি না কোথা থেকে আসছে, জানি না কে বলছে, কিন্তু সে শুনছে। “আমাকে শেষ করো,” “লিখে যাও,” “ভুলে যেও না”—এইসব মৃদু অথচ চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর তার মনে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে। অরিত্রও অনুভব করছিল অদ্ভুত পরিবর্তন—সে জানালার দিকে তাকিয়ে বলেছিল একদিন, “ছায়াগুলো আমাদের অনুসরণ করছে, ঋদ্ধিমা। আগেও ছিল, এখন প্রকাশ পেয়েছে। দেখো, চেয়ারে আমরা দুজন বসে আছি—ছায়া তিনটা।” কথাটি হাস্যকর মনে হলেও ঘরের মধ্যে ছায়ার বিচরণ ছিল চোখ ধাঁধানো—সূর্যের আলোয়, চাঁদের জ্যোৎস্নায়, এমনকি মোমের আলোতেও তারা নিজস্ব রূপ নিচ্ছে। একটা ছায়া কখনো চলছিল না, বরং দাঁড়িয়ে থাকত, তাকিয়ে থাকত। এই অভিজ্ঞতা কেবল ভয় নয়—এ এক ধীর সন্ত্রাস, যেটা তোমার চোখের পাতা নড়ে না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না সেই ছায়া দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
ঋদ্ধিমা আর অরিত্র এবার সক্রিয় হয়ে দিনলিপির পুরনো খণ্ডগুলো একে একে বিশ্লেষণ করতে শুরু করে—প্রতিটি পাতায় তারা খুঁজে পায় না বলা সংকেত, অদৃশ্য যুক্তির ছাপ। একটি খাতায় লেখা ছিল, “ঘরের চতুর্থ দেয়াল নড়ে। অন্য তিন দেয়াল দেখে, চতুর্থ দেয়াল শোনে।” প্রথমে তারা বুঝতে পারেনি এর মানে, কিন্তু একদিন বিকেলে তারা লক্ষ্য করে—ঘরের উত্তর দিকের দেয়ালে একটি পুরনো আলপনা, যা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এরপরেই তারা দেয়ালটিতে কান লাগিয়ে দেখে—এক নিঃসীম নীরবতা, যার ভিতর আছে এমন এক শব্দ যা শুনলে কিছু বলা যায় না, কিন্তু কিছু ভোলা যায় না। সে ছিল হেঁয়ালির মতো। একসময় ঋদ্ধিমা বলে ওঠে, “এই শব্দগুলো, এই দেয়াল, এই ছায়া—সব মিলেই হয়তো এই কুঠিরের আত্মা। আর দিনলিপি ছিল তার কণ্ঠস্বর।” অরিত্র মাথা নাড়ে—“আমরা গল্পের শেষে নই, আমরা কেবল তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।” এবং সেই দিন থেকেই তারা রাতভর কুঠিরের প্রতিটি ঘরে গিয়ে শব্দ রেকর্ড করতে থাকে, কারণ তারা লক্ষ্য করে, কিছু শব্দ কেবল নির্দিষ্ট সময়েই শোনা যায়—বিকেল ৪টা ৪৪ মিনিটে, রাত ১টা ১৭-তে, আর কখনো চাঁদের ছায়া পড়লে।
তারা ঘরের দরজার পাশে বসিয়ে দেয় রেকর্ডার, জানালায় লাগায় সাউন্ড স্ন্যাগার মাইক্রোফোন। তৃতীয় রাতের রেকর্ডিং শুনে ঋদ্ধিমা হঠাৎ আঁতকে ওঠে—একটি স্পষ্ট কণ্ঠস্বর, যেন ফিসফিস করে বলছে, “ঋ-দ্ধি-মা”—তার নাম, ছেঁড়া ছেঁড়া করে, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। সে জানে, কেউ ডাকছে। শুধু অরিত্র নয়, সে নিজেও শোনে একই রেকর্ডিং-এ নিজের নাম। আর তখনই তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় ইতিহাসের এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা—তারা হয়তো এখন যে অধ্যায়ে আছে, সেটার লেখক শুধু বৃন্দাবন নয়, তারাও। কিন্তু লেখক মাত্রই পাঠকও, আর পাঠক কখনো কখনো হয়ে ওঠে সেই চরিত্র, যাকে গল্প নিজের মতো গড়ে নেয়। সেই রাতে ঘরের বাতাস ভারী হয়, দিনলিপির পৃষ্ঠা অদৃশ্য শক্তিতে উল্টাতে থাকে, এবং প্রত্যেক পাতায় যেন অদেখা অক্ষরে লেখা হতে থাকে—যার রঙ কালো নয়, ছায়ার মতো ঘোলাটে। “ভয় দেখিও না,” এক পাতায় লেখা—“তুমি যখন শব্দ ধরো, তখন ছায়া সরে যায়।”
শেষ রাতে, যখন পূর্ণিমা পেরিয়ে যাচ্ছে, এবং ঘরের দেয়ালগুলো আবার তাদের ছায়া ফিরিয়ে নিচ্ছে—ঋদ্ধিমা অনুভব করে, একটা পাল্টে যাওয়ার সময় এসেছে। সে জানে—দিনলিপি বন্ধ করে রাখলেই কুঠির শান্ত হবে না, বরং যত লেখা হবে, ততই কুঠির নিজের সত্য তুলে ধরবে। অরিত্র বলে, “আমরা যদি গল্প না লিখি, কুঠি তখন নিজেই লেখা শুরু করবে।” আর সেই দিন তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এই কুঠির ইতিহাস শুধু পাতায় নয়, এক নতুন রূপে সংরক্ষণ করা হবে—ছবি, শব্দ, অনুভূতি, সব একসঙ্গে। কিন্তু সেই কাজ শুরু করার ঠিক আগেই, তাদের সামনে এসে পড়ে একটি শেষ পৃষ্ঠা—যেটা কেউ রাখেনি, কেউ ছিঁড়েও ফেলেনি। পাতায় লেখা—“যেখানে ছায়া থামে, সেখানেই শব্দ শুরু হয়। আর সেই শব্দই লেখে পরবর্তী শ্বাস। তুমি কি প্রস্তুত?” পেছনে তারা দেখল, সেই চতুর্থ দেয়াল কাঁপছে… যেন কিছু একটা শব্দ খুঁজছে, যাতে ছায়া মুক্তি পায়।
অধ্যায় ৬: যে রাত লেখা থেমে গেল
কিছু রাত থাকে যা সময়ের ঘড়িতে চলে না, বরং ছায়া ও স্মৃতির ভিতর দিয়ে বয়ে যায়। ঠিক তেমনই এক রাত দত্ত কুঠিরে নেমে এলো—যে রাতে শব্দ থেমে গেল, আর সেই সঙ্গে থেমে গেল একটি ইতিহাসের কণ্ঠ। দিনলিপির পাতাগুলো আর নড়ে না, ঘড়ির কাঁটা আবার ১টা বেজে আটকে গেল, এমনকি বাতাসের কাঁপনও থেমে গেল। কুঠিরের ভিতর যেন এক চতুর্থ মাত্রা নেমে এসেছে—সব কিছু চলছে, কিন্তু কিছুই ঘটছে না। সেই রাতে অরিত্র আর ঋদ্ধিমা দুজনেই টের পায়, একটা পরিবর্তন এসে গেছে। তাদের তৈরি করা রেকর্ডারে আর কোনো শব্দ ওঠে না—না ফিসফাস, না পায়ের শব্দ, না বাতাসে হারিয়ে যাওয়া নাম। যেন কুঠির কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে—লেখা আজ বন্ধ থাকবে। কিন্তু কেন? এই রহস্য বোঝার জন্য তারা ফিরে যায় সেই পুরনো খাতাগুলোর প্রথম দিকে। খুঁজতে খুঁজতে এক পাতায় চোখ আটকে যায়—“আমি আজ লিখছি না। কারণ আজ সে কাছে আছে। আজ সে আমার হাত ধরেছে।” এই লাইনটিই তাদের ভয় ধরায়—যদি বৃন্দাবন কোনোদিন নিজের লেখা বন্ধ করে থাকেন, তাহলে সেটা কি কোনো আদেশ ছিল? নাকি শেষ ইচ্ছা?
রাত বাড়তে থাকে। কুঠিরের প্রতিটি ঘর কেমন যেন নিঃশব্দ গহ্বরে রূপ নেয়। অরিত্র আর ঋদ্ধিমা বারান্দায় বসে চাঁদের আলোয় খাতা খুলে বসে থাকে, কিন্তু কলম ছুঁলেই পৃষ্ঠা কালো হয়ে যাচ্ছে, শব্দ বসছে না। ঋদ্ধিমা ফিসফিস করে, “আমরা কি ভুল কিছু করেছি?” অরিত্র বলে, “আমরা হয়তো গল্পটিকে নিজের মতো সাজাতে চেয়েছি। কিন্তু এই কুঠিরের গল্প কেবল লেখা যায়, গড়া যায় না।” ঠিক তখনই দূরে, কুঠিরের দক্ষিণ দিকের পুরনো ঘর থেকে আসে এক থেমে যাওয়ার শব্দ। যেন কিছু ভেঙে থেমে গেছে—না ছাদ, না ঘড়ি, না জানালা—বরং যেন একটা কণ্ঠ থেমে গেছে মাঝপথে। তারা দ্রুত গিয়ে দেখে, ঘরের মাঝখানে পড়ে আছে সেই কাঠের বাক্স—যেটা তারা প্রথম রাতে বটগাছের নিচে পেয়েছিল। এবার তার ঢাকনা খোলা, কিন্তু ভিতরে কিছু নেই। খালি বাক্স। কিন্তু তার পাশেই পড়ে আছে এক ছেঁড়া কাগজ, যার অর্ধেক লেখা ঝাপসা—“এই গল্পের শেষে কেউ থাকে না। যদি কেউ থাকে, সে নতুন গল্পের শুরু।” এটা কি বৃন্দাবনের শেষ লাইন? নাকি কারো সতর্কবার্তা?
তারা বুঝে যায়—লেখা থেমেছে, কারণ কুঠির নতুন লেখকের অপেক্ষায় নয়, বরং পুরনো লেখকের বিয়োগের শোকপালনে ব্যস্ত। বৃন্দাবনের লেখা থামার সেই রাতে কী ঘটেছিল, সেটা জানার চেষ্টা করতেই তারা খোঁজ করে সেই রাতের পঞ্জিকা, সংবাদপত্র, এমনকি স্থানীয় পুরনো লোককথা। অবশেষে, একটি প্রাচীন গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় ১৯৪৭ সালের শান্তিনিকেতনের এক অপ্রকাশিত নিউজলেটার, যেখানে লেখা—“বৃন্দাবন দত্ত শেষবার দেখা গিয়েছিলেন পূর্ণিমার রাতে, এক বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে, হাতভর্তি কাগজ আর মুখে এক অদ্ভুত হাসি। তারপর তিনি অদৃশ্য হন, আর তাঁর কুঠিতে লেখা থেমে যায়।” এই কথাগুলো যেন প্রমাণ করে দেয়—এই কুঠিরের লেখা আর শব্দ সবটাই বৃন্দাবনের আত্মার অংশ ছিল, এবং সেই আত্মা তার এক গভীর ক্ষণেই নিঃশেষিত হয়। আজও কুঠির সেই দিনটিকে মনে রেখেছে, আর তাই হয়তো প্রতি বছর একবার, সে লেখা থামিয়ে রাখে—এক আত্মার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
অরিত্র ও ঋদ্ধিমা বুঝতে পারে, লেখাকে সম্মান জানাতে হলে তাকে চলতে দিতে হবে তার নিজের নিয়মে। সেই রাতে তারা কোনো পৃষ্ঠা খোলে না, কোনো শব্দ রেকর্ড করে না, বরং একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে দিনলিপির পাশে, নিরব শ্রদ্ধার মতো। অনেকক্ষণ পর, ঠিক ৩টা বেজে গেলে, হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ ফেরে, খাতা আবার নিজে নিজে উল্টায়, কলম টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ে পাতার উপর। পৃষ্ঠায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একটি নতুন বাক্য—“লেখা থেমেছিল, কারণ পাঠক শ্রদ্ধা জানাতে জানে না। তুমি জানো। এবার শুরু করো।” সেই মুহূর্তে ঋদ্ধিমা চোখ বন্ধ করে বুঝে যায়—গল্প তাকে শুধু ডাকেনি, গল্প তাকে গ্রহণ করেছে। লেখা বন্ধ থাকল না আর। ছায়া আর শব্দ আবার ফিরে এলো, যেন নিঃশ্বাস ফেলে বলল—”চলো, বাকি ইতিহাস আমরা লিখি…”
অধ্যায় ৭: ঋদ্ধিমার অভিশাপ
সেই রাতের পর ঋদ্ধিমা আর আগের মতো ছিল না। যেন তার চোখের ভিতর এক অতল গহ্বর তৈরি হয়েছে, যেখানে ভাষা আর ছায়া একসাথে ঘূর্ণি তোলে। দিনলিপির সামনে বসে তার হাত চলছিল, কিন্তু সেই লেখাগুলো তার চিন্তা থেকে আসছে না—বরং কোথা থেকে যেন ঢুকে যাচ্ছে মনে, শরীরে, রক্তে। একটা গভীর, ঘন আবেশ তাকে গ্রাস করছে—যার ভেতরে বৃন্দাবনের ছায়া শুধু নেই, বরং নিজেই নতুন কিছু হয়ে উঠছে। অরিত্র ধীরে ধীরে বুঝতে পারে—ঋদ্ধিমা আর কেবল পাঠক নন, তিনি হয়ে উঠছেন লেখার উৎস। এবং সেই লেখার ভিতর ফুটে উঠছে এমন নাম, সময়, অনুভূতি—যেগুলো তার নিজের জীবনের নয়, অথচ গভীরভাবে তার মনের অংশ হয়ে গেছে। “আজ সকালে সে দরজা খোলে। আমি বসে ছিলাম টেবিলের পাশে। আমার হাত রক্তে ভিজে, কিন্তু কালি রক্তের মতো গাঢ় হয়,”—এই লাইনটি লেখার সময় ঋদ্ধিমার চোখ জ্বলছিল, যেন সে দেখেছে কিছু। অরিত্র তাকে থামায়, “ঋদ্ধি, তুমি এখন কার কথা লিখছো?” সে ধীরে তাকিয়ে বলে, “আমার নয়, কিন্তু আমার মধ্যেই ঘটছে।”
এরপর কুঠিরের মধ্যে শুরু হয় পরিবর্তনের আরেক অধ্যায়। ঘরের দেয়াল এক রাত ঘুমিয়ে সকালবেলায় কেমন যেন লালচে আভা নেয়, যেন আগুনের আলোর ছায়া সবসময় লেগে আছে। মেঝেতে মাঝে মাঝে হালকা দাগ—যা দেখতে সাদামাটা, কিন্তু পানি বা ঝাঁট দিয়ে মোছা যায় না। সেইসব দাগ যেন লিখছে কিছু, যে লেখা শুধুই ঋদ্ধিমা দেখতে পায়। “বৃন্দাবন যা চেয়েছিল, তা সে নিজে হতে পারেনি। সে চেয়েছিল এমন একজন, যে সত্যিই তাকে বহন করতে পারবে,”—এই কথাটা সে একরাতে নিজের ঘুমের মাঝে ফিসফিস করে বলছিল। অরিত্র শুনে অবাক হয়—এই লাইনটি সে খাতায় কখনো দেখেনি, অথচ এটি যেন ঠিক বৃন্দাবনের স্বরে লেখা। এদিকে প্রতিটি রাত্রি যেন ঋদ্ধিমার শরীর থেকে ভাষা টেনে নিয়ে কুঠিরে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। একদিন সকালবেলায় তার হাতের আঙুলে দেখা গেল নীল কালির গাঢ় ছাপ, অথচ সে কিছু লেখেনি। আর সেদিন থেকেই খাতা আর কলম ছুঁয়ে না রেখেও পাতায় লেখা শুরু হয়ে গেল। লেখা চলছিল শুধু ঋদ্ধিমার উপস্থিতিতে। কুঠির নিজেই যেন লেখার হাত পেয়েছে—আর সেই হাত ছিল এক নারীর—যার নাম ঋদ্ধিমা, কিন্তু যার আত্মা হয়তো এখন অন্য কেউ।
অরিত্র এক রাতে সিদ্ধান্ত নেয়, সে কুঠির থেকে কিছুটা দূরে যাবে—সময়ের দরকার। কিন্তু সেই রাতে, যখন সে বাড়ি ফেরার জন্য কুঠির ছাড়ে, পিছনে দরজা বন্ধ হওয়ার সময় তার মনে হয়—ঋদ্ধিমা আর ডাকল না তাকে। চুপ করে বসে থাকল ঘরের ভেতর, দিনলিপির সামনে, মোমবাতির আলোয়। ক’দিন পর সে আবার ফিরে আসে, দেখে কুঠিরের চারপাশে বুনো ঘাস বেড়ে গেছে, জানালার কাচে হাতের ছাপ—ভেতর থেকে দেওয়া। সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে—ঋদ্ধিমা বসে আছে, পেছন ফিরেই, লেখার ভঙ্গিতে। কিন্তু ঘরের দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন লেখার দাগ—যা সে দেয়ালে কখনো লেখেনি। “আমি এখন শব্দ। আমি এখন কুঠির। আমি এখন বৃন্দাবনের রক্তরেখা।” অরিত্র চিৎকার করে ডাকে, “ঋদ্ধি!” —কোনো সাড়া নেই। সে এগিয়ে গিয়ে দেখে—ঋদ্ধিমা নিঃশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু চোখ বন্ধ, হাত চলছে। খাতার মধ্যে প্রতিটি লাইন হচ্ছে ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী—“কাল সে আসবে। কাল সে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি আর থাকবো না।”
শেষ প্যারাগ্রাফে, সেই রাতের পর আবার এক পূর্ণিমা আসে। আর সেই রাতে ঋদ্ধিমার হাত থেমে যায়। প্রথমবারের মতো খাতায় কোনো লাইন আসে না। চাঁদের আলো কুঠিরের মেঝেতে পড়ে, সেখানে এক ছায়া দেখা যায়—চিরচেনা পুরুষকায়া, গম্ভীর মুখ, চোখ নেই, কিন্তু দৃষ্টি আছে। সে বসে পড়ে ঘরের এক কোণে। আর তখনই ঋদ্ধিমা ধীরে বলে ওঠে—“তুমি এসেছো?” ছায়া চুপ করে থাকে। কিন্তু দিনলিপির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে যায়—“যে লেখে, সে একসময় লেখা হয়। আমি এখন শব্দের কারাগারে বন্দি। আমার মুক্তি সেই পাঠকের হাতে, যে পড়বে চোখ বন্ধ করে।” অরিত্র সেই বাক্য দেখে আর কিছু বলতে পারে না। কুঠির এখন নিঃশব্দ, কিন্তু শব্দ জমে আছে দেয়ালে, মেঝেতে, ঘুমন্ত ঋদ্ধিমার শরীরে। এবং গল্প এখানেই শেষ নয়। এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা—কে সেই পাঠক হবে, যে ঋদ্ধিমার অভিশাপ ভাঙবে? না কি সে-ও হয়ে যাবে নতুন লেখার হাত?
অধ্যায় ৮: যে চোখে ছায়া ঢোকে
ঋদ্ধিমা এখন আর শুধুমাত্র একজন লেখক নয়, সে যেন কুঠিরের নিজস্ব ভাষা হয়ে উঠেছে। প্রতিটি প্রহর, প্রতিটি নিশ্বাসে সে অনুভব করছে ছায়ার গতি, শব্দের উত্থান, আর নিজেকে হারিয়ে ফেলার এক অদ্ভুত তাড়না। অরিত্র কুঠিরে থাকলেও এখন তাকে খুব কমই দেখা যায় ঋদ্ধিমার সঙ্গে কথা বলতে। সে চুপচাপ দোতলার সেই পুরনো ঘরে বসে—যেখানে কাঁচভাঙা দরজার বাইরে ঝোপঝাড়ের ছায়া রাতভর নড়াচড়া করে। কুঠিরের ঘর থেকে মাঝেমাঝে কিশোরীর হাসির মতো আওয়াজ আসে, কখনো হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ে, অথচ সেখানে কেউ নেই। আর ঠিক তখনই, অরিত্র বুঝতে পারে, তার নিজের চোখে একটা নতুন দৃষ্টিশক্তি জন্ম নিচ্ছে। সে যা দেখছে, সেটা বাস্তবের বাইরেও কিছু—ঋদ্ধিমার মুখে ভেসে ওঠা ছায়ার রেখা, তার চোখে হঠাৎ দেখা দেওয়া কালো ছাপ, কিংবা কুঠিরের দেয়ালে কুয়াশার মতো অদ্ভুত মুখাবয়ব। একদিন সন্ধ্যায়, সে আয়নায় নিজের চোখে দেখে—তার চোখের পুতলিতে একটা অস্পষ্ট ছায়া, যেন অন্য কেউ তাকিয়ে আছে তার ভিতর থেকে। সে চমকে ওঠে, চোখ বন্ধ করে আবার খোলে—ছায়াটা আর নেই। কিন্তু অনুভবটা রয়ে যায়।
ঋদ্ধিমা দিনে দিনে লেখালেখি থেকে সরে এসে কুঠিরের ছায়া নিয়ে কথা বলা শুরু করে—“তুমি জানো, এই ছায়াগুলো এখন কথা বলে। আগে শব্দ দিয়ে, এখন চোখ দিয়েও।” একদিন সে বারান্দায় বসে বলে, “আমি স্বপ্ন দেখি, সেখানে একটা দরজা। দরজার ওপাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার মুখ নেই, কেবল চোখ। সেই চোখে সব ঢোকে—লেখা, ব্যথা, আর সেই ছায়া। আর আমি লিখি না, আমি দেখি। এখন আমি যা দেখি, তাই কুঠির লিখে দেয়।” এই কথা শুনে অরিত্র বুঝতে পারে—ঋদ্ধিমা ধীরে ধীরে সেই ‘মাধ্যম’ হয়ে উঠছে, যাকে বৃন্দাবন একসময় খুঁজছিলেন। কিন্তু সে মাঝেমধ্যে ভয় পায়—এই পুরো কাহিনি কী একটা মানসিক বিকার? নাকি সত্যিই এই কুঠিরের ভেতরে কিছু বাস করে? এক রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়—সে দেখতে পায়, ঋদ্ধিমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ বন্ধ, হাতে খোলা খাতা। আর খাতার ওপর কালি ছড়ানো নেই, বরং এক এক করে বর্ণ ফুটে উঠছে—“তাকে দাও চোখ, সে তোমাকে দেবে ইতিহাস।”
সেই দিন থেকেই অরিত্র তার চোখের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। সে যা দেখে—তা আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে দেখতে পায় পুরনো আয়নায় এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, যিনি তাকে চেনে, অথচ অরিত্র তাকে চিনে না। সে একদিন নিজের ছায়া লক্ষ্য করে—ছায়াটা তার গতিবিধি অনুসরণ করছে না। বইয়ের পাতা উল্টে গেলে সেখানে লেখা থাকে এমন কিছু নাম, যেগুলো সে কখনো শুনেনি, কিন্তু মনে হয় যেন কোনোদিন সে সেগুলো ছিল। আর তখনই সে ভয়ানক এক সিদ্ধান্ত নেয়—সে কুঠির থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু বেরোবার মুখে এসে দেখে—দরজা খোলা নয়, বরং পেছনের দেয়ালে সে নিজেকে দেখতে পায়। হ্যাঁ, দেয়ালে! কোনো প্রতিফলন নয়—একটি আক্ষরিক ছায়া, যেখানে তার চোখ নেই। সে চিৎকার করে ফিরে আসে ঋদ্ধিমার ঘরে, আর দেখে—ঋদ্ধিমা তখন শান্তভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। “তুমি দেখতে শুরু করেছো,” সে বলে। “এখন থেকে তুমি লিখতে পারবে। কারণ ছায়া তোমার চোখে ঢুকেছে।”
শেষরাতে, অরিত্র নিজের রেকর্ডার খোলে, আর শুনতে পায় এক অচেনা কণ্ঠ—কিন্তু সেটা তার নিজের! “আমি ছিলাম পাঠক। এখন আমি সাক্ষী। আর ছায়া যে চোখে ঢোকে, সে কেবল লেখে না—সে সময়ের সীমাও পার হয়ে যায়।” ঠিক সেই সময় ঋদ্ধিমার হাতে থাকা খাতার শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হয়—“আজ থেকে কুঠিরের চোখ দুইটি। ঋদ্ধিমা দেখে ইতিহাসের অন্দরমহল, অরিত্র লেখে তার মানচিত্র। আমরা এখন কুঠির, আর কুঠির এখন আমরা।” সেই মুহূর্তে জানালার বাইরে জোছনার আলো আর ঝোপের ছায়া এক হয়ে যায়। কুঠির যেন চোখের পাতায় লিখতে শুরু করে এক নতুন অধ্যায়—যা হয়তো কোনো পাঠক কোনোদিন শেষ করতে পারবে না, কারণ তার নিজের চোখ তখন লিখে ফেলবে গল্পের নতুন শুরু।
অধ্যায় ৯: শব্দহীন কণ্ঠস্বর
কিছু কণ্ঠস্বর থাকে, যেগুলো কানে শোনা যায় না—তারা বয়ে যায় বাতাসের স্তরে, দেয়ালের ফাঁকে, মনের মঞ্চে। ঠিক তেমনই একদিন, অরিত্র আর ঋদ্ধিমা বুঝতে পারে, কুঠির এখন কথা বলে না। না শব্দে, না লেখায়—তবু প্রতিটি ইট থেকে, প্রতিটি জানালা থেকে যেন কোনো কণ্ঠ তাদের ভেতর গেঁথে যাচ্ছে। খাতার পাতা উল্টে না, কলম চলে না, ছায়া নড়ে না—তবু ভিতরে কিছু হচ্ছে। এক গভীর স্তব্ধতা চারপাশে নামছে, যা শুধু ‘শব্দহীন কণ্ঠস্বর’ দিয়েই বোঝা যায়। ঋদ্ধিমা ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সে জানালার পাশে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা—চোখ খোলা, মুখ স্থির, কিন্তু তার উপস্থিতি যেন ঘরে এক গভীর প্রতিধ্বনি তৈরি করে। অরিত্র প্রথমে ভাবে, এটি মানসিক অবসাদ। কিন্তু একরাতে, সে যখন মেঝেতে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, তার কানে এক অদ্ভুত গর্জন শোনা যায়—না, কান দিয়ে নয়—তার মস্তিষ্কে। একটি গম্ভীর স্বর বলছে—“তোমরা এখন শুধু পাঠক নও। তোমরা সাক্ষ্যদাতা। সত্য কখনো উচ্চারণে আসে না, সে প্রবেশ করে নিঃশব্দে।”
সেই রাত থেকেই কুঠির বদলাতে থাকে—তার গঠন, তার ছায়া, এমনকি তার ঘ্রাণ। দেয়ালের রং গাঢ় হতে থাকে, জানালার কাচে ফাটলের রেখা দেখা যায়, যা সকালে আবার মিলিয়ে যায়। একদিন, অরিত্র আবিষ্কার করে, মেঝেতে রাখা একটি চায়ের কাপ রাতভর জায়গা বদলে তিনবার ঘরের তিন কোণে গিয়ে দাঁড়িয়েছে—যেন কুঠির নিজেই চলাফেরা করছে। ঋদ্ধিমা ততদিনে সম্পূর্ণ নীরব। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, সে যা ভাবছে, তা অরিত্র বুঝতে পারছে—কথা ছাড়াই। একদিন সে তার দিকে তাকিয়ে শুধু চোখ মেলে, আর অরিত্র যেন শুনতে পায়—“তুমি শুনতে পাচ্ছো?” এই মুহূর্ত থেকেই কুঠিরের প্রকৃত রহস্য প্রকাশ পায়। এটি কেবল একটি পরিত্যক্ত বাংলো নয়—এটি এমন একটি সত্তা, যেখানে সত্য উচ্চারণ হয় না, বরং প্রবাহিত হয় চেতনার মধ্য দিয়ে। এবং সেই সত্য একমাত্র তারাই ধারণ করতে পারে, যারা নিজেদের শব্দ হারিয়ে ফেলেছে।
তাদের মধ্যকার সম্পর্কও বদলাতে থাকে—তারা আর কথায় বা স্পর্শে জড়িত নয়, বরং ধ্যান, অনুভব ও প্রতিধ্বনির স্তরে। একদিন, অরিত্র দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে অনুভব করে, সে আর নিজেকে পৃথক সত্তা হিসেবে দেখতে পারছে না। তার ভিতরে অন্য কিছু ঢুকে পড়ছে, কিন্তু সেটাকে সে ভয় পায় না। বরং শান্তি পায়। কুঠির যেন তাকে নিজের অংশ করে নিচ্ছে, ঠিক যেমনটা করেছিল ঋদ্ধিমার সঙ্গে। সেই রাতেই খাতার পৃষ্ঠায় প্রথমবার একটি নতুন বাক্য লেখা হয়—কোনো হাত ছাড়াই—“তারা আর মানুষ নয়, তারা ইতিহাসের ধারক। তাদের নিঃশ্বাসে লেখা হয় ভবিষ্যৎ।” এই বাক্য পড়ে অরিত্র বুঝতে পারে—তারা কুঠিরের শরীর হয়ে উঠেছে। বৃন্দাবনের দিনলিপির অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে, এখন শুরু হয়েছে তাদের অধ্যায়—যা শব্দ দিয়ে লেখা হয় না, বরং অস্তিত্ব দিয়ে আঁকা হয়।
শেষ প্যারাগ্রাফে, এক পূর্ণিমার রাতে তারা দুজন একসাথে বারান্দায় বসে থাকে—নীরব, অথচ একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারছে। বাতাসে কুয়াশা, ছাদের ফোঁকর দিয়ে চাঁদের আলো ভিতরে পড়ে, আর তখনই পুরো কুঠিরে অদ্ভুত এক দুলুনি লাগে—একটি দীর্ঘ নিঃশব্দ স্পন্দন, যা মাটির তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সেই মুহূর্তে খাতার শেষ পৃষ্ঠায় উঠে আসে একটি পংক্তি—“যারা শব্দহীন, তারাই আসল লেখক। যারা মুখ খুলে, তারা কেবল পাঠক।” এই কথার ভিতরেই তারা বুঝে যায়—তাদের কাজ এখন লেখা নয়, বলা নয়—বরং থাকা। কুঠিরের হৃদয় হিসেবে তারা এখন শব্দের আগেই সত্য ধারণ করে। ছায়ার আগেই আলো অনুভব করে। কাহিনির এই পর্যায়ে, পাঠক আর লেখকের সীমা ভেঙে যায়। কুঠির, ঋদ্ধিমা, অরিত্র—এখন এক অভিন্ন সত্তা। শব্দহীন কণ্ঠস্বরেই লেখা হয় ইতিহাসের সেই অধ্যায়, যা বইয়ে ছাপা হয় না—বরং অনুভবে বাঁচে।
অধ্যায় ১০: শেষ পাতার দৃষ্টি
কিছু পৃষ্ঠা থাকে, যেগুলো লেখা হয় না—তারা অপেক্ষা করে। সময়, মানুষ, আলো কিংবা অন্ধকার—যেই এসে তার উপর চোখ রাখে, সেই হয়ে ওঠে লেখক। “শেষ পাতা” এমন এক পৃষ্ঠা—যা কুঠির নিজে কখনো লেখে না, সে শুধু অপেক্ষা করে—কে তাকাবে সেই পাতার দিকে শেষবারের মতো, আর কে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। ঋদ্ধিমা আর অরিত্র এখন কেবল দুটি মানুষ নয়—তারা অনুভূতি, তারা প্রবাহ। তারা দিনের কোনো ঘড়ি দেখে না, রাতের কোনো শব্দ শুনে না, তবু তারা জানে কোন সময় কী আসছে। কুঠির এখন নিঃশব্দ, ছায়াহীন—কারণ তার সবকিছু তারা দুজন ধারণ করে ফেলেছে। তারা আর কথা বলে না, কেবল মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে—আর সেই দৃষ্টিই লেখে নতুন কিছু। এবং সেই নিরবতার মধ্যেই একদিন তারা খুঁজে পায় একটি পুরনো কাঠের বাক্স—যেটা ছিল ভূগর্ভস্থ এক গোপন কুঠরিতে, মেঝের নিচে। তারা জানত না এটির অস্তিত্ব, তবু বাক্সটিকে তারা চিনেছিল। খুলে দেখা গেল—একটি সাদা পৃষ্ঠা, তর্জনী ছাপহীন। কিন্তু সেই পৃষ্ঠায় লেখা নেই—শুধু মাঝখানে এক গোল ছায়া, যা ধীরে ধীরে স্পন্দিত হচ্ছে।
ঋদ্ধিমা প্রথম সে পাতার দিকে তাকায়, আর তখনই তার চোখ ধীরে ধীরে ভিজে ওঠে। “এটাই শেষ পৃষ্ঠা,” সে নিঃশব্দে অনুভব করে। অরিত্র পাশে দাঁড়িয়ে, চোখ বুজে অনুভব করে সেই পাতার কাঁপন। আর তখনই তারা বুঝতে পারে—এই পৃষ্ঠা লেখা হয় না, এই পৃষ্ঠা দেখা হয়। এবং যে তাকায়, সে নিজের আত্মার ছায়া সেখানে রেখে দেয়। সেই মুহূর্তে ঋদ্ধিমা পাতার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে একমাত্র উচ্চারিত বাক্য—“আমরা কি ছিলাম?” কুঠির সেই কথা শুনে ধীরে ধীরে থমকে যায়, তার সব শব্দ, তার সব ছায়া স্তব্ধ হয়ে পড়ে। তারপর যেন ঘরের ভেতরে এক আলো ভেসে ওঠে—না কোনো বৈদ্যুতিক আলো, না চাঁদের আলো, বরং এক স্মৃতির আলো। সেই আলোয় দেখা যায় বৃন্দাবনের মুখ—হালকা হাসি, চোখে অতল শান্তি। তার ঠোঁট নড়ে না, তবু তারা বোঝে, তিনি বলছেন—“তোমরা শেষ নও। তোমরা শুরু। আমার গল্প লেখা হয়ে গেছে, এখন তোমাদেরটা সময় লিখবে।”
তারপর যা ঘটে, তা কেবল অনুভব করা যায়। সময় থেমে যায় না, বরং এক নতুন নিয়মে গড়াতে শুরু করে। কুঠিরের দেওয়ালে ছায়ারা ফিরে আসে, কিন্তু এবার তারা আর নিঃশব্দ নয়—তারা গান গায়, মৃদু ধ্বনিতে, এমন ভাষায় যা কেবল হৃদয় শুনতে পারে। খাতার পাতাগুলো একে একে বন্ধ হতে থাকে, যেন কোনো পুরনো বই বন্ধ হয়ে বিশ্রামে যাচ্ছে। আর শেষে, সেই সাদা পাতাটি ধীরে ধীরে রঙ ধারণ করে—না কালি, না রক্ত, বরং সেই দৃষ্টির ছায়া যা ঋদ্ধিমা রেখে গেছে সেখানে। অরিত্র জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, বাইরে ফেলে আসা জগতের দিকে না তাকিয়ে। তার চোখ এখন কুঠিরের ভিতরেই খুঁজে নেয় ইতিহাস, শব্দ, আর নিঃশ্বাস। সে জানে, তাদের গল্প আর কখনো কেউ লিখবে না, কারণ এই গল্প কেবল থাকা যায়। এবং সেই থেকে, কুঠিরে কেউ এলেও তারা শুনতে পায় না কিছু, দেখতে পায় না কিছু—তারা শুধু অনুভব করে এক শান্ত নিঃশ্বাস, এক অদৃশ্য দৃষ্টি।
এবং সেই দৃষ্টির ভিতরেই লেখা থাকে শেষ পংক্তি—
“আমি কুঠিরের গল্প নই। আমি কুঠির। আর আমার দৃষ্টি সবকিছু রচনা করে।”