হিয়া মিত্র
পর্ব ১: পূর্ণিমার আগে
উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে ওঠার সময় অরণ্য ভাবছিল, শহরের শব্দকে যদি কাগজে বন্দি করে রাখা যেত, তবে হয়তো সে বুঝতে পারত নীরবতার প্রকৃত মানে কী। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল চা-বাগানের ঢেউ, দূরে নীলচে পাহাড়, আর মাঝেমাঝে রাতের বৃষ্টির পর জমে থাকা কাদা। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই কুয়াশা ওড়ার মতো ভেসে এসে তার গায়ে লাগল—ঠাণ্ডা, কিন্তু দংশনহীন। এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: একান্তে বসে নতুন কবিতার বইয়ের খসড়া শেষ করা। কিন্তু উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলেই কি পথ অনাড়ম্বর থাকে?
গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানে বসে সে অল্প চিনি দিয়ে চা খাচ্ছিল। দোকানদার, বলিষ্ঠ গড়নের, গায়ের ওপর মোটা সোয়েটার টেনে, জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি ভাঙা বাংলোর দিকে যাবেন?”
অরণ্য চমকে তাকাল। “কেন?”
লোকটা চোখ নামাল, যেন কথাটা বলার আগে ভিতরে কোনো শীতল দরজা পেরোতে হচ্ছে। “ওই বাংলোয় কেউ থাকে না। তবু রাতে জানলার পাশে যেন… গান শোনা যায়। পর্যটকেরা যায় না। আপনি শহুরে—সাবধান থাকবেন।”
অরণ্য হেসে বলেছিল, “ভূতের ভয় নেই, দাদাবাবু। ভয় শুধুই সময়ের—ওটা দ্রুত পালায়। আমি তার পায়ের শব্দ শুনতে এসেছি।”
লোকটা আর কিছু বলল না, কেবল ভাঁজ করা মুখে একরকম দীর্ঘ অভ্যাসের নীরবতা ঝুলিয়ে দিল। চা শেষ করে অরণ্য পথ ধরল।
পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে বসে থাকা ভাঙা বাংলোটা দূর থেকেই দেখা যায়—দু’তলা, ছাদের অর্ধেক ভেঙে পড়েছে, বারান্দায় কাঠের রেলিংয়ের বেশিরভাগ পঁচে গেছে। এক পাশে পুরোনো শিমুল গাছ; বাতাস উঠলেই তার শুকনো শিকড় কড় কড় শব্দ করে। ঘরের ভেতর ধুলো, তবু জানলার পাশে রাখা কাঠের টেবিলটা অরণ্য নিজের হাতে মুছে নিল। কলম, খাতাপত্র, আর একটা ছোট্ট টর্চ। এটাই তার বিশ্ব।
সন্ধে গাঢ় হলে পাহাড়ে একটা আলাদা নীরবতা নামে। শহরের নীরবতা হল শব্দ অবসরের পরের কোলাহল, আর এখানে নীরবতা শুরু থেকেই জেগে থাকে। কয়েকটা পোকা জানলা পেরিয়ে আলোয় ঘুরতে থাকে; দূরে পাহাড়ের গায়ে কুকুর ডাকল। অরণ্য খাতায় লিখতে শুরু করল—
“আলো নেমে আসে আজ নদীর মতো,
অন্ধকারের গায়ে জড়িয়ে থাকে তোমার নাম।
কুয়াশার ভেতর, কার আঙুল ডাকে—
শরীরে নেমে আসে নীলচে এক থাম।”
কলম থমকে গেল। “তোমার নাম”— সে কার কথা লিখছে? উত্তর সে জানে না। হয়তো এটাই লেখা, প্রশ্ন রেখে যাওয়া। টর্চ নিভিয়ে জানলার বাইরে তাকাতেই কুয়াশার গায়ে চাঁদের ফালি দেখা গেল। পূর্ণিমা আসতে এখনও দু’দিন বাকি। হঠাৎ খুব সূক্ষ্ম, খুব নরম একটা সুর ঢুকে পড়ল কান বেয়ে— যেন কোনো মেয়ের গলা, দূর থেকে আসা, কিন্তু বেশ পরিষ্কার। গান নয়, গানের ভেতর থমকে থাকা ধ্বনি; ঠিক যে জায়গায় শব্দ জন্ম নিতে চায়, তার আগের নিঃশ্বাস।
অরণ্য ভেবে নিল, হয়তো বাতাস। কিন্তু সুরটা আবার ভেসে এল, এবার একটু কাছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় এল। শিমুল গাছের ছায়ায় কেউ নেই; তবে অদ্ভুতভাবে মনে হল, কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে, দেখা যায় না, তবু তার উপস্থিতি প্রচণ্ড স্পষ্ট।
“কে?” অরণ্য ডাকল। পাহাড় প্রতিধ্বনি করে ফেরাল না; কেবল শিমুলপাতা নড়ে উঠল।
রাতে সে খুব কম ঘুমাল। একবার মনে হল দরজায় টোকা পড়ল; উঠে গিয়ে খুলে দেয়—কবি বলে হয়তো কল্পনা তার সঙ্গে রসিকতা করছে। তবে ভোরের আগে একবার একটা ব্যাপার হলো। জানলার কাঠে আঙ্গুল রেখে সে বাইরে তাকাচ্ছিল; কুয়াশা একটু পাতলা। তখন দেখল—একজোড়া চোখ, ঠিক জানলা থেকে সামান্য দূরে, অন্ধকারের ভেতর জ্বলজ্বল করছে না, বরং একটা নরম নীল আলো ছড়িয়ে আছে সেই চোখের চারপাশে। সে তক্ষুনি টর্চ জ্বালাল, আলো পড়তেই কিছুই নেই। টর্চ নিভিয়ে দিলে আবার যেন অনুভূতি ফিরে আসে—কেউ আছে।
“আপনি এসেছেন?”— খুব আস্তে একটা নারীকণ্ঠ।
অরণ্য কোনোভাবে শব্দ খুঁজে পেল, “কে… আপনি?”
“আমি—এখানেই থাকি।”
“এই ভাঙা বাংলোয়?”
কণ্ঠস্বরের হাসি যেন মেঘফোঁটার মতো গড়িয়ে গেল, “না, কুয়াশায়।”
এতটা অলৌকিক, এতটা সহজভাবে বলা কথা শুনে অরণ্য প্রথমে হেসে ফেলল। তারপরই হাসিটা আটকে গেল; কারণ দরজার ছায়া ফুঁড়ে যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া ভেতরে ঢুকে এল, আর সেই হাওয়ার ভেতর দিয়ে সে দেখল—একটা মেয়ে, খুব ম্লান আলোয় যেন জেগে ওঠা। সাদা শাল, কাঁধে ছুঁই-ছুঁই চুল, আর চোখদুটো—সেখানে নীল আভা। মুখটা স্পষ্ট নয়, কুয়াশায় ভাঙাচোরা, তবু মনে হল, এতদিন ধরে সে এই মুখটাই লিখতে চেয়েছে তার কবিতায়।
“ভয় পান না?” মেয়েটি বলল।
অরণ্য গলা খাঁকারি দিল, “ভয়… হয়তো হচ্ছে, কিন্তু তার চাইতে বেশি কৌতূহল। আপনি সত্যিই…?”
“আমি সবসময় সত্যি না,” মেয়েটি বলল, “কখনও কখনও আমি কেবল কারও অপেক্ষা।”
“আপনার নাম?”
“নিভৃতি।” সে নামটা উচ্চারণ করল এত আস্তে, যেন বাতাসে লেখা একটা শব্দ খুলে পড়ল। “আপনার নাম অরণ্য, তাই না?”
অরণ্য সজোরে তাকাল। “আপনি জানলেন কী করে?”
নিভৃতি জানলার কাঠ স্পর্শ করল। ঠাণ্ডা, যেন বরফের ওপর আঙুল। “আপনি গতকাল চায়ের দোকানে নাম বলেছিলেন। বাতাসের অভ্যাস খারাপ—সে সব কথা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়।”
দু’জনের মধ্যে একটুখানি নীরবতা থাকল। কুয়াশা নড়ে উঠল, যেন মেয়ে-হাওয়াটা একটু পিছু হটল। অরণ্য ধীরে বলল, “আপনি গান করেন?”
নিভৃতি মাথা কাত করল, “না, আমি গানের আগের নিঃশ্বাসটা নিই। তাই মনে হয় গান। আপনি কি কবি?”
“কবি হওয়ার সাধ আছে,” অরণ্য বলল, “কবিতা হওয়ার ভয়ও আছে।”
নিভৃতি আরেকবার হেসে উঠল। হাসিটা শোনা গেল না, কিন্তু বাতাস একটু নরম হল। “আপনি লিখুন। পূর্ণিমার রাতে কথাগুলো আরও স্পষ্ট হয়।”
“আপনি কি… সেই রাতে আসবেন?”
“আমি কেবল সেই রাতে থাকি,” নিভৃতি বলল, “দিনের আলো আমার নাম ভুলে যায়।”
হঠাৎ দূরে শিয়াল ডাকল, শিমুলপাতা ঝরে পড়ল, আর নিভৃতি মিলিয়ে গেল—যেভাবে বাতাস থেকে কুয়াশা ছেঁকে ফেলা যায়, ঠিক সেভাবে। অরণ্য দাঁড়িয়ে রইল, হাত এখনও জানলার কাঠে। সে বুঝল না, কিছুক্ষণ আগে যে সংলাপ হলো, তা কি তার মাথার ভেতর, না কি বাইরে—কিন্তু কাঠে যে শিশির, তার ওপর একটুখানি দাগ পড়ে আছে, আঙুলের, খুব সূক্ষ্ম, আর সেই দাগের মধ্যে লেখা—
“নিভৃতি।”
পরদিন সকালেই অরণ্য আবার চায়ের দোকানে গেল। দোকানদার তাকিয়ে বলল, “ঘুম হয়নি?”
“বাংলোটা সম্পর্কে একটু বলবেন?”
লোকটা চোখ নামাল, অনেক পুরোনো একটা খাতা খুলে দেখার মতো ধীর কণ্ঠে বলল, “অনেক বছর আগে, ওই বাংলোয় এক পরিবার থাকত। মেয়েটির নাম—নিভৃতি। খুব গান গাইত। প্রেম ছিল… ভালো লাগা ছিল… শেষে—” সে থামল, “—একদিন ঝড়ের রাতে বউমা-কে কেউ ভুল বোঝে। সে চলে যায়। কোথায়—কেউ জানে না। তবে পূর্ণিমার রাতে… জানলা দিয়ে যেন কারও নিঃশ্বাস শোনা যায়। কথা না, শুধু শ্বাস। তারপর থেকে ওই বাংলোয় কেউ থাকে না।”
অরণ্য কিছু বলল না। চায়ের কাপে ফেনা জমছিল, আর তার মাথায় কেবল একটাই শব্দ ফিরে ফিরে আসছিল—নিভৃতি। দুপুরে সে বাংলোয় ফিরল। দরজার কাছে পড়ে থাকা শিমুলপাতা সরাতে সরাতে ভাবল, কত নাম, কত গল্প, বাতাসে ভেসে বেড়ায়—কেউ ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু গতরাতে সে তো শুনেছিল, দেখেছিল, অনুভব করেছিল। এসব কি কেবল কল্পনার খেলা?
সন্ধে নেমে এলে সে আবার জানলার টেবিলে বসে লিখতে শুরু করল।
“তুমি যদি কুয়াশা হও, আমি হবো কুয়াশার শ্বাস,
তুমি যদি জানলা হও, আমি হবো তার কাঁচ,
তুমি যদি নাম ভুলে যাও দিনের আলোয়—
আমি রাতের ভাষা শিখে রাখব, তোমার কাছে পৌঁছোতে।”
কলম থেমে গেল। কুয়াশা ঘন হয়ে উঠছে। চাঁদের আলো আজ একটু বেশি—পূর্ণিমার আগের রাত বলে কি? বাইরে খুব নরম একটা শব্দ, পায়ের তলায় শুকনো পাতা চুরমুর। অরণ্য উঠে দাঁড়াল। জানলার ওপারে, সেই নীল আভার সীমানায় মেয়েটি দাঁড়িয়ে—
“আমি এসেছি,” নিভৃতি বলল, “আপনার কবিতার কাছে।”
অরণ্যের গায়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। “আপনি কি সত্যিই থাকেন, নিভৃতি?”
“থাকা না থাকা—দুটোতেই তো প্রেম,” সে বলল, “কেউ থাকে, কেউ না-থাকে; কিন্তু ডাক—ডাক সবসময় থাকে। আপনি কি আমাকে শুনবেন, যতদিন পারি?”
অরণ্য ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “শুনব। আর লিখবও। যতটা পারি।”
নিভৃতি জানলার কাঠে হাত রাখল। ঠাণ্ডা স্পর্শ অরণ্যের আঙুল ছুঁয়ে গেল—ঠিক বরফ নয়, বরফ গলার আগের মুহূর্ত। সে ফিসফিস করে বলল, “পূর্ণিমা হলে আলোর ভেতর আমার নাম আরও কাছে আসে। সেদিন আমি আপনাকে একটা গল্প বলব—যেখানে আমি ছিলাম, আর ছিলাম না। আপনি কি প্রস্তুত?”
অরণ্য বলল, “আমি প্রস্তুত।”
বাতাসে তখন কেবল শিমুলপাতার গন্ধ, আর দূরে পাহাড়ের গায়ে একটা অচেনা সুর জমে উঠছে। নিভৃতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে জানলার ওপর আবার একটুখানি দাগ রেখে গেল—“আগামীকাল।”
অরণ্য টেবিলে ফিরে বসে খাতাটা বন্ধ করল। তার মনে হলো, যে বইটি শেষ করতে সে এসেছিল, সেই বই আজ তাকে শুরু করে দিয়েছে। বাইরে চাঁদের আলো পাথরের গায়ে পড়ে রূপালি দাগ টেনে যাচ্ছে। ভাঙা বাংলোর ভিতর, নীরবতার ঠিক মাঝখানে, সে স্পষ্ট শুনল—নিভৃতির ডাক।
পর্ব ২: পূর্ণিমার আলোয়
ভাঙা বাংলোর জানলাগুলো রাতে আরও অদ্ভুত হয়ে ওঠে। অরণ্য টেবিলের পাশে বসে কলম ঘুরাচ্ছিল, অথচ খাতায় কোনো শব্দ আসছিল না। যেন কাগজ নিজেই অপেক্ষা করছিল কারও নামের জন্য। বাইরে শিমুলপাতার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরেও ছিল এক আশ্চর্য নীরবতা, যা সে আগে কোনোদিন খেয়াল করেনি।
হঠাৎ দরজার নিচ দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ভেতরে ঢুকে এল। অরণ্য বুঝল—সে এসেছে। নিভৃতি। সে ধীরে ধীরে জানলার কাছে গেল। কুয়াশা তখন অনেক ঘন, প্রায় সাদা দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেবল চোখের একফালি আভা দেখা যাচ্ছে, নীলচে, যেন চাঁদের আলোও তার কাছে হার মানছে।
“আপনি এলেন,” অরণ্য ফিসফিস করে বলল।
“আমি প্রতিশ্রুতি ভাঙি না,” নিভৃতির গলা ভেসে এল। “পূর্ণিমার আগে রাতগুলোয় আমি শুধু এক ঝলক। কিন্তু আজ—আজ আমি পুরোপুরি আসতে পারি।”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা যেন সরে গেল। অরণ্য প্রথমবার নিভৃতিকে স্পষ্ট দেখতে পেল। সাদা শাল তার গায়ের চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন বাতাসে গড়া পোশাক। চুলগুলো মুখের ওপর পড়ে আছে, কিন্তু তার চোখ—দুটি গভীর হ্রদের মতো, যেখানে আলো আর অন্ধকার একইসঙ্গে খেলা করে।
অরণ্য এতক্ষণে বুঝল, ভয়ের চেয়ে কৌতূহল অনেক শক্তিশালী হতে পারে। “আপনি কি সত্যিই এই বাংলোয় থাকতেন?”
নিভৃতি মৃদু হেসে বলল, “থাকা আর না-থাকার পার্থক্য কি জানেন? আমি থাকি, কারণ আপনিই আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। অন্য কারও কাছে আমি শুধু বাতাস।”
অরণ্যের বুক ধকধক করে উঠল। “তাহলে আপনি চান আমি আপনাকে লিখে রাখি? কবিতায়?”
“হয়তো,” নিভৃতি কণ্ঠে ফিসফিসের মতো নরমতা মিশে গেল, “হয়তো আপনি লিখবেন, আর আমি সেই শব্দগুলোতে আবার জন্ম নেব। আমাকে জীবিত রাখার একমাত্র উপায় এটাই।”
বাতাসে তখন চাঁদের আলো ঢুকে পড়ছিল। বাংলোর ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে রূপালি আলোর রেখা গায়ে পড়ল। অরণ্য অবাক হয়ে দেখল—আলো যখন নিভৃতির শরীর ছুঁল, তার গায়ে হালকা স্বচ্ছতা ফুটে উঠল। যেন সে আলো আর কুয়াশার তৈরি এক অস্তিত্ব।
“আপনি কি কখনও চলে যেতে চাননি?” অরণ্য জিজ্ঞেস করল।
নিভৃতি চোখ নামাল। “চাইনি বললে মিথ্যে হবে। কিন্তু চলে গেলে এই ডাকটা—যা আমাকে আবার ফিরিয়ে আনে—সেটা হারিয়ে ফেলব। আপনি জানেন না, ডাক কেমন এক শিকল। আমি মুক্ত নই, আবার বাঁধাও নই। শুধু অপেক্ষা।”
অরণ্য দীর্ঘক্ষণ কিছু বলল না। তার মনে হচ্ছিল, এই মেয়েটি—যার হয়তো মৃত্যু হয়েছে বহু বছর আগে—আজও বেঁচে আছে কেবল একটা অসমাপ্ত ভালোবাসার কারণে।
“নিভৃতি,” সে ধীরে বলল, “যদি আমি আপনাকে গল্প লিখে দিই, যদি আমি আপনার সেই অসমাপ্ত ভালোবাসাকে শেষ করি—তাহলে কি আপনি মুক্ত হবেন?”
নিভৃতি তাকাল, নীল আলোয় তার চোখ আরও গাঢ় হয়ে উঠল। “মুক্তি কাকে বলে? যদি আমি মুক্তি পাই, তাহলে হয়তো আর আসব না। আর যদি না আসি, আপনি কি আমাকে মনে রাখবেন?”
অরণ্য কাঁপা গলায় বলল, “আমি আপনাকে মনে রাখব, যতদিন লিখতে পারব।”
ঠিক তখনই বাইরে মেঘের আড়াল সরে গিয়ে পূর্ণিমার আলো ঢেলে পড়ল পুরো বাংলোয়। নিভৃতির শরীর যেন আলোর ভেতর গলে যেতে লাগল। সে হাত বাড়াল অরণ্যের দিকে। অরণ্য দ্বিধা করল, তারপর হাত বাড়াল। স্পর্শ করতেই তার শিরায় রক্ত জমে বরফ হয়ে গেল। এত ঠাণ্ডা, অথচ এত জীবন্ত স্পর্শ সে জীবনে কখনও পায়নি।
“আগামীকাল,” নিভৃতি বলল, “আমি আপনাকে আমার গল্প বলব। কেন আমি ডাক দিই, কেন আমি ফিরে আসি—সব বলব।”
অরণ্য চমকে উঠল। “আর যদি কাল আপনি না আসেন?”
নিভৃতি হেসে উঠল, হাসিটা বাতাসে মিলিয়ে গেল। “আমি এলে গল্প হবে। না এলে—কবিতা।”
বলেই সে মিলিয়ে গেল। কেবল জানলার কাঠে শিশির জমে রইল, আর সেই শিশিরের মধ্যে আঙুলের আঁচড়ে লেখা—“অপেক্ষা করো।”
অরণ্য টেবিলে ফিরে এসে খাতাটা খুলল। হাত কাঁপছিল, তবু লিখল—
“কেউ আসে না, তবু জানলার কুয়াশা নড়ে ওঠে,
কেউ ছুঁয়ে যায়, তবু আঙুলে ঠাণ্ডা জমে থাকে।
কেউ থাকে না, তবু নামের ভেতর ভেসে ওঠে—
অপেক্ষার আরেক নাম, নিভৃতি।”
পর্ব ৩: নিভৃতির কাহিনি
পূর্ণিমার রাত নেমেছে পাহাড়ে। বাংলোর ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে রূপালি আলো ঢুকছে। অরণ্য টেবিলে বসে আছে, অথচ তার হাত থমকে আছে খাতার ওপর। কলম নড়ছে না। মনে হচ্ছে—কলমের অপেক্ষা শেষ, এখন তার নিজের অপেক্ষার পালা।
বাইরে শিমুলপাতার ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ভেসে আসছে। হঠাৎই দরজার কাঠে হালকা এক চাপা শব্দ। যেন কেউ নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল। অরণ্য ঘুরে তাকাতেই কুয়াশার ভেতর থেকে নিভৃতি উদ্ভাসিত হলো। এবার সে আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট—শালটা তার গায়ে আঁকড়ে আছে, চুল নেমে এসেছে কাঁধে, আর চোখের নীল আভা পূর্ণিমার আলোতে আরও গভীর।
“আপনি এসেছেন,” অরণ্যের গলা শুকিয়ে গেল।
“আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম,” নিভৃতি আস্তে বলল। “আজ আমি আমার গল্প বলব।”
অরণ্য জানলার কাঠে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিভৃতি ধীরে ধীরে কণ্ঠ খুলল—
“অনেক বছর আগে, এই বাংলোতেই আমি থাকতাম। বাবা ছিলেন জমিদারবাড়ির পুরোনো কর্মচারী। আমরা বেশি কিছু চাইতাম না—কেবল শান্তি। আমি গান গাইতাম। গানই ছিল আমার আশ্রয়। গ্রামের মেলা, পূজা, কিংবা সন্ধ্যার আসরে আমি গান ধরলে লোকজন থেমে যেত। কিন্তু একদিন, এখানে শহর থেকে এসেছিলেন এক তরুণ—দীপায়ন। তিনি বলতেন, আমার গলা নাকি কুয়াশাকেও থামিয়ে দিতে পারে। আমি হাসতাম। তখনও জানতাম না, কারও কথার ভেতরেই কখনও মৃত্যু লুকিয়ে থাকে।”
অরণ্য নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল। নিভৃতি থামল, যেন মনে ভেতর থেকে কিছু তুলে আনতে সময় লাগছে।
“আমরা দু’জনের মধ্যে প্রেম জন্মেছিল। লুকিয়ে দেখা, নদীর ধারে গান গাওয়া, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন—সবকিছুই তখন সত্যি মনে হয়েছিল। কিন্তু প্রেমের সবচেয়ে বড় শত্রু কী জানেন, অরণ্য? বিশ্বাস। একবার সেটা ভেঙে গেলে সব শেষ। এক রাতে হঠাৎ খবর এল—আমি নাকি অন্য কারও সঙ্গে পালানোর পরিকল্পনা করেছি। দীপায়ন কিছু না শুনেই চলে গেল। আমি অপেক্ষা করলাম। ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেলাম না। গ্রাম আমাকে দোষ দিল। পরিবারও মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম এই বাংলোর বারান্দায়, ঝড়ের রাতে, একা। তারপর… তারপর আমি স্রোতের মতো মিলিয়ে গেলাম। কেউ জানল না কোথায়।”
অরণ্যের বুক ভারী হয়ে উঠল। “আপনি আত্মহত্যা করেছিলেন?”
নিভৃতি তাকাল না, শুধু ঠাণ্ডা গলায় বলল, “হয়তো। অথবা আমি কেবল মুছে গিয়েছিলাম। যেভাবে লেখা কাগজ থেকে অক্ষর হারিয়ে যায়। কিন্তু এক জিনিস থেকে গেল—আমার ডাক। আমি চাইতাম দীপায়ন একবার ফিরে আসুক, আমাকে শুনুক। সেই না-পাওয়া কথাগুলোই আমার শিকল হয়ে গেল। আর প্রতি পূর্ণিমায় আমি ফিরে আসতে শুরু করলাম। ডাক দিই, কিন্তু কেউ শোনে না। অনেকে ভয় পায়, অনেকে এড়িয়ে যায়। আপনি প্রথম মানুষ যিনি ভয় পাননি।”
অরণ্যের আঙুল কাঁপছিল। “তাহলে আপনি চান আমি আপনাকে লিখে রাখি—যাতে আপনার কণ্ঠ হারিয়ে না যায়?”
নিভৃতি এবার সরাসরি তার দিকে তাকাল। চোখের নীল আলোতে যেন অরণ্যের নিজের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। “হ্যাঁ। আমি চাই, আমার গল্প আপনি লিখুন। আমি চাই, কেউ যেন জানে—আমি শুধু এক ভূতের ডাক নই। আমি প্রেমে প্রতারিত এক মেয়ে, যার গান অসমাপ্ত রয়ে গেছে।”
অরণ্যের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। তার মনে হচ্ছিল—সে কবি হওয়ার জন্য এসেছিল, কিন্তু এখানে এসে কবিতা নিজে তাকে খুঁজে নিয়েছে। নিভৃতি কি কেবল কল্পনা? নাকি সত্যিই এক হারানো আত্মা?
“নিভৃতি,” সে বলল, “আপনি যদি আমাকে বলেন, আমি আপনার গল্প লিখব। কিন্তু আমি জানতে চাই—আপনি কি এখনও দীপায়নকে ভালোবাসেন?”
নিভৃতির ঠোঁট কেঁপে উঠল। “ভালোবাসা কি কখনও শেষ হয়, অরণ্য? আমি আজও তার জন্য ডাক দিই। কিন্তু আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে, আমার ডাকের উত্তর কেউ দিয়েছে—আপনি।”
চাঁদের আলো তখন নিভৃতির শরীরকে আরও স্বচ্ছ করে তুলছিল। তার চোখে একফোঁটা জল যেন ঝলমল করল, অথচ ঝরল না।
অরণ্য এক ধাপ এগিয়ে বলল, “যদি আমি আপনাকে কবিতায় বাঁচিয়ে রাখি, তাহলে কি আপনার মুক্তি মিলবে?”
নিভৃতি ফিসফিস করে উত্তর দিল, “মুক্তি নয়—অস্তিত্ব। মুক্তি মানে ভুলে যাওয়া। আমি ভুলে যেতে চাই না। আমি চাই, ডাকটা চিরকাল বেঁচে থাকুক।”
তারপর সে হাত বাড়াল। অরণ্য হাত ধরতে গিয়েও থেমে গেল—বরফের মতো ঠাণ্ডা স্পর্শ মনে পড়ল। কিন্তু এবার সাহস করল। আঙুল ছুঁতেই মনে হল, তার শরীরের ভেতর দিয়ে কুয়াশা বয়ে যাচ্ছে, অথচ সেই কুয়াশার ভেতর এক অদ্ভুত উষ্ণতা লুকিয়ে আছে।
“লিখবেন?” নিভৃতি জিজ্ঞেস করল।
অরণ্যের ঠোঁটে উত্তর ঝরে পড়ল—“লিখব।”
ঠিক তখনই বাইরে কুকুর ডাকল, আর শিমুলপাতা ঝরে পড়ল মাটিতে। নিভৃতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশার ভেতর, কিন্তু যাওয়ার আগে জানলার কাঠে আবার আঙুলের আঁচড় রেখে গেল—
“আমি আছি।”
অরণ্য খাতায় লিখতে শুরু করল—
“যারা চলে যায়, তারা আসলে থেকে যায়।
যারা দেখা দেয় না, তারা আলোয় ভেসে থাকে।
যারা ডাক দেয়, তারা নিঃশব্দের ভেতর বেঁচে থাকে।
নিভৃতি—তুমি নেই, অথচ তুমি আছ।”
পর্ব ৪: গোপন কাহিনি
ভোরের আলোয় পাহাড়টা অন্যরকম লাগে। কুয়াশা সরলেই চারদিকে ঝলমলে সবুজ, কিন্তু অরণ্যের চোখে সবকিছুই ছিল ম্লান। রাতের নিভৃতির কথাগুলো তার মাথার ভেতর রিনরিন করছিল। সে জানত, শুধু লেখা যথেষ্ট নয়—তাকে সত্যিটা খুঁজে বের করতেই হবে।
চায়ের দোকানে বসে গরম ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে অরণ্য দোকানদারের দিকে তাকাল। “দাদাবাবু, আপনি সেদিন বলেছিলেন নিভৃতির নাম। আপনি জানলেন কী করে?”
দোকানদার চুপচাপ রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিঃশ্বাস ফেলল। “আমার বাবার মুখে শোনা গল্প। নিভৃতি ছিল খুব সাদাসিধে মেয়ে, কিন্তু তার গলার জাদু সবাই জানত। গ্রামের অনেকেই চাইত তাকে। কিন্তু ওই দীপায়নবাবু… শহুরে ছেলে, সে-ই তার মন জিতেছিল। শোনা যায়, তারা পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু—” সে থেমে গেল।
“কিন্তু?” অরণ্য চাপ দিল।
“কেউ চাইত না ওই প্রেম টিকে থাকুক। গ্রামের জমিদার পরিবারের ছেলেরা হিংসায় জ্বলছিল। গুজব রটল—নিভৃতি অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। দীপায়ন বিশ্বাস করল না বললেই ভালো হতো, কিন্তু… সে চলে যায়।”
অরণ্যের মনে হল, নিভৃতির কণ্ঠ আর দোকানদারের কণ্ঠ একই ছবিকে আঁকছে, তবে রেখাগুলো এখনও ঝাপসা। “তাহলে নিভৃতি কোথায় গেল?”
লোকটা কেবল মাথা নাড়ল। “কেউ জানে না। কেউ বলে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল, কেউ বলে গলায় দড়ি… কিন্তু দেহ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকেই পূর্ণিমার রাতে এই ডাক।”
অরণ্যের বুকটা হুহু করে উঠল। গল্পটা কেবল এক ভূতের নয়, এটা এক অসমাপ্ত ইতিহাস।
সন্ধের আগে বাংলোয় ফিরতেই অরণ্য টেবিল সাজিয়ে নিল। খাতা খোলা, কলম প্রস্তুত। রাত নেমে আসতেই হঠাৎ জানলার কাঠ কেঁপে উঠল। নিভৃতি এসেছে।
আজ সে আগের চেয়ে শান্ত, যেন বহুদিন পর কিছু ভার নামিয়েছে। “আপনি খুঁজেছেন?”
অরণ্য মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। সবাই বলে আপনি প্রতারিত হয়েছিলেন।”
নিভৃতির চোখে যেন ছায়া নেমে এল। “হ্যাঁ। প্রতারণা আমি করিনি, আমাকেই করা হয়েছিল। আমি শুধু গান আর ভালোবাসা চেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের হিংসা তার চেয়েও জোরে গান গেয়েছিল।”
অরণ্য হাত বাড়িয়ে খাতার দিকে ইশারা করল। “আমি লিখব। আপনার প্রতিটা কথা।”
নিভৃতি কাছে এসে দাঁড়াল। তার ঠাণ্ডা আঙুল জানলার কাঠ ছুঁয়ে রইল। “আপনি জানেন, আমি কেন ফিরে আসি? কারণ আমার সত্যিটা কেউ লেখেনি। সবাই শুধু গুজব লিখেছে। আপনি যদি লিখেন, আমি বেঁচে থাকব। আর যদি আপনার কলম থেমে যায়, আমি আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাব।”
অরণ্য বুঝতে পারল, সে আর কেবল কবি নয়—সে হয়ে উঠেছে সাক্ষী। কিন্তু তার ভেতরে ভয়ও জন্ম নিচ্ছে। কারণ প্রতিটা রাতের সঙ্গে সঙ্গে নিভৃতির উপস্থিতি আরও স্পষ্ট হচ্ছে—সে কি শুধু স্মৃতি, নাকি সত্যিই আত্মা?
ঠিক তখনই বাইরে কারও পায়ের শব্দ ভেসে এল। অরণ্য চমকে জানলা দিয়ে তাকাল। দূরে, কুয়াশার আড়ালে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে—মানুষ, একেবারে স্পষ্ট। নিভৃতি হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল।
“কে ওখানে?” অরণ্য ডাকল।
অচেনা ছায়াটা কিছু না বলে সরে গেল। নিভৃতি ফিসফিস করে বলল, “ওরা চায় না আমার সত্যি কেউ জানুক। সাবধান থাকুন, অরণ্য। আপনার কলম এখন শুধু কবিতা লেখে না, ইতিহাসও বদলে দেয়।”
অরণ্য বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল—প্রথমবার তার মনে হলো, নিভৃতির ডাকের ভেতর শুধু প্রেম নেই, আছে বিপদও।
পর্ব ৫: ছায়ার মুখোশ
ভাঙা বাংলোর বাইরে পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় সেই রাতের পায়ের শব্দ অরণ্যের মাথা থেকে সরছিল না। নিভৃতির চোখে আতঙ্কের যে ছাপ সে দেখেছিল, তা তাকে আরও কৌতূহলী করে তুলেছিল। কে ছিল ওই অচেনা ছায়া? কেনই বা সে চাইবে নিভৃতির কাহিনি চাপা পড়ে থাকুক?
ভোরে উঠে অরণ্য গ্রাম ঘুরতে বেরোল। বাজারের ধুলোভরা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে আড্ডা দিতে দেখল। সুযোগ বুঝে এক বুড়োকে জিজ্ঞেস করল, “দাদু, বাংলোর দিকটা নিয়ে সবাই ভয়ে কথা বলে কেন? কেউ কি সেখানে যেতেন আগে?”
বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও নিভৃতির গল্প ছড়াত। জমিদারবাড়ির ছেলেরা চেয়েছিল তাকে বিয়ে করতে, কিন্তু সে প্রেম করেছিল শহুরে দীপায়নের সঙ্গে। সে দিনগুলোতে অনেক অন্ধকার ঘটনা ঘটেছিল, বাপু। কেউ কেউ বলে, এক জমিদারপুত্র রাতে বাংলোয় ঢুকে নিভৃতিকে অপমান করতে গিয়েছিল, আর সেই রাতের পর নিভৃতি হারিয়ে যায়। পরে তারা সব গোপন করে ফেলে।”
অরণ্যের বুক কেঁপে উঠল। নিভৃতির মুখে শোনা কাহিনির সঙ্গে গ্রামের মানুষের বলা টুকরো স্মৃতি মিলে যাচ্ছিল। কিন্তু কেন আজও কেউ চায় না এ গল্প প্রকাশ পাক?
বাজার থেকে ফেরার পথে হঠাৎ সে খেয়াল করল—একজন মানুষ তাকে খুব লক্ষ্য করছে। মাঝবয়সি, কালো পাঞ্জাবি পরা, চোখদুটো অদ্ভুত তীক্ষ্ণ। লোকটা অরণ্যের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়াল।
“আপনি কি বাংলোয় থাকছেন?” গলায় কাঁপা কিন্তু দৃঢ় সুর।
অরণ্য একটু সঙ্কোচে বলল, “হ্যাঁ, কেন?”
লোকটা হেসে উঠল, সেই হাসিতে শীতলতা। “ওখানে রাত কাটানো বিপদজনক। পূর্ণিমার রাতে ওখানকার ছায়ারা জেগে ওঠে। গল্পে হাত দেবেন না। অনেকেই চেষ্ট করেছে—টেকেনি।”
অরণ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?”
লোকটা সরাসরি উত্তর দিল না। কেবল বলল, “সতর্ক থাকুন। সব সত্যি জানা ভালো নয়।” তারপর ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
বাংলোয় ফিরে অরণ্য অস্থির হয়ে বসে রইল। সন্ধে নামতেই নিভৃতি আবার জানলার কাছে এলো। আজ তার মুখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি।
“আপনার চোখে ভয় দেখছি,” সে বলল।
অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আজ এক অচেনা মানুষ আমাকে সাবধান করল। বলল, সত্যি জানলে বিপদ হবে। নিভৃতি, আপনি লুকোচ্ছেন কী? কারা চায় না আপনার কাহিনি প্রকাশ পাক?”
নিভৃতির চোখ হঠাৎ জ্বলে উঠল। “ওরা সেই একই মানুষদের বংশধর, যারা আমার সত্যি মুছে দিয়েছিল। আমার কণ্ঠ বন্ধ করতে চেয়েছিল। আমি ডাক দিই কারণ আমি চাই না ইতিহাস শুধু মিথ্যে দিয়ে লেখা থাকুক।”
অরণ্যের বুকের ভেতর এক তীব্র ঝড় বয়ে গেল। তার মনে হল, সে এখন আর শুধু এক কবি নয়—সে এক যোদ্ধা, যে শব্দের ভেতর দিয়ে সত্য খুঁজছে।
“তাহলে আমাকে সব বলতে হবে, নিভৃতি। কে আপনাকে শেষবার দেখেছিল, কে আপনাকে চুপ করেছিল—সব।”
নিভৃতি জানলার কাঠে হাত রাখল। তার ঠাণ্ডা আঙুলে শিশির জমে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল,
“তাহলে প্রস্তুত থাকুন, অরণ্য। কারণ সত্যি শোনার পর আপনি হয়তো আর ফিরে যেতে পারবেন না। পরের পূর্ণিমা আমার কাহিনির শেষ অধ্যায় নিয়ে আসবে—সেই অধ্যায়, যেটা আজও রক্তের দাগে ঢাকা।”
চাঁদের আলো ভাঙা বাংলোর দেয়ালে ঝরে পড়ছিল, আর অরণ্যের মনে হচ্ছিল—কবিতা এবার আর প্রেমের খেলা নয়, কবিতা হয়ে উঠছে সত্যের জন্য যুদ্ধ।
পর্ব ৬: রক্তের দাগ
পূর্ণিমার রাত যেন পাহাড়কে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। বাংলোর ভাঙা ছাদ দিয়ে নেমে আসা রূপালি আলোয় ঘর ভরে গেলেও অরণ্যের মনে হচ্ছিল—আজ কিছু ভিন্ন ঘটতে চলেছে। নিভৃতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এবার সে তার শেষ কাহিনি বলবে।
রাত গভীর হলে জানলার কাঠে হালকা টোকা শোনা গেল। অরণ্য কলম ফেলে ছুটে গেল। নিভৃতি দাঁড়িয়ে আছে, আজ যেন আগের চেয়ে আরও স্পষ্ট, আরও জীবন্ত। তার গলার কণ্ঠস্বর এবার ভারী, শোক আর ক্রোধে মিশ্রিত।
“অরণ্য,” সে ফিসফিস করল, “আজ আমি তোমাকে আমার মৃত্যুর সত্যি দেখাবো।”
অরণ্য স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। “আমি প্রস্তুত।”
নিভৃতি হাত বাড়াল। তার ঠাণ্ডা আঙুল অরণ্যের হাত ছুঁতেই অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। হঠাৎই ঘরটা কেঁপে উঠল, জানলার বাইরের কুয়াশা ঘন হতে হতে যেন দেয়াল ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। চোখের সামনে অরণ্য দেখল—ঘর পাল্টে যাচ্ছে।
সে এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই একই বাংলোয়, কিন্তু সময় অনেক পেছনে ফিরে গেছে। দেয়ালে প্রদীপ জ্বলছে, বাইরে ঝড়ের আওয়াজ। নিভৃতি তরুণী রূপে ঘরের ভেতর গান গাইছে, তার কণ্ঠে অদ্ভুত জাদু। হঠাৎ দরজা জোরে ঠেলে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল দু’জন—একজন জমিদারপুত্র, চোখে লালসার দৃষ্টি, আর তার সঙ্গী।
“নিভৃতি,” লোকটা গর্জে উঠল, “তুই দীপায়নের সঙ্গে পালাবি? আমাদের সম্মান ভাঙবি?”
নিভৃতি কেঁপে উঠলেও স্থিরভাবে বলল, “আমি কাউকে অপমান করিনি। আমি কেবল ভালোবেসেছি।”
লোকটা হেসে উঠল। “ভালোবাসা? তোর কণ্ঠে যাকে সবাই মুগ্ধ হয়, সে কণ্ঠকে আমি আজ থামিয়ে দেব।”
হঠাৎই অরণ্যের শরীর কেঁপে উঠল—সে স্পষ্ট দেখল, লোকটা নিভৃতিকে ধাক্কা দিল। নিভৃতি জানলার কাঠ আঁকড়ে ধরল, কিন্তু ঝড়ের রাতে ভাঙা কাচে তার হাত কেটে গেল। রক্ত গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
নিভৃতি ছটফট করতে করতে ফিসফিস করে বলল, “দীপায়ন… তুমি ফিরবে তো?”
কিন্তু উত্তর এলো না। বাইরে কেবল ঝড়। তারপর নিভৃতি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল—যেন কুয়াশা গিলে নিল তার শরীর। আর মাটিতে থেকে গেল কেবল রক্তের দাগ।
অরণ্য চোখ কচলাল। চারদিক আবার আগের মতো কুয়াশায় ঢেকে গেল, সে ফিরে এল নিজের সময়ে। নিভৃতি তার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে শূন্যতা।
“এটাই আমার শেষ রাত,” সে বলল ধীরে। “আমার মৃত্যুর দৃশ্য বারবার আমাকে ফিরিয়ে আনে। তুমি এখন জানো, আমি কীভাবে শেষ হয়েছিলাম। কিন্তু আমি চাই, তুমি আমাকে শুধুই সেই দুঃখে মনে রেখো না। আমি চাই, তুমি আমাকে লিখে রাখো প্রেমের কণ্ঠে, না যে রক্তের দাগে।”
অরণ্যের চোখ ভিজে এল। “কিন্তু নিভৃতি, তোমার আত্মা কি এখন মুক্তি পাবে?”
নিভৃতি মৃদু হাসল। “মুক্তি আমার জন্য নয়, অরণ্য। মুক্তি তোমার জন্য—যখন তুমি বুঝবে, ভালোবাসা কেবল প্রাপ্তি নয়, ভালোবাসা মানে অসমাপ্তকেও বুকে নিয়ে বাঁচা।”
বাইরে হাওয়ার ঝাপটা উঠল। নিভৃতির শরীর ধীরে ধীরে আলোর মধ্যে মিলিয়ে যেতে লাগল। যাওয়ার আগে সে জানলার কাঠে আঙুল বোলাল। শিশির জমে রইল সেখানে, আর তার মধ্যে অরণ্য স্পষ্ট পড়ল—
“ধন্যবাদ।”
অরণ্য টেবিলে বসে কলম তুলে লিখতে শুরু করল—
“একটি নাম, একটি ডাক, একটি অসমাপ্ত গান।
যারা মুছে দিয়েছিল, তারা ইতিহাস লিখতে পারেনি।
আমি লিখব—যেন কুয়াশার ভেতরও
নিভৃতি বেঁচে থাকে চিরকাল।”
বাংলোর বাইরে তখন পূর্ণিমার আলো পাহাড়কে ঢেকে দিচ্ছিল। ভাঙা বাংলোর জানলায় আজ আর কোনো ছায়া ছিল না—কেবল কবিতার নিঃশ্বাস।
পর্ব ৭ : কুয়াশার বাইরে
গ্রামের আকাশ তখনও পূর্ণিমার আলোয় ভিজে আছে। কিন্তু ভাঙা বাংলোর জানলায় আর কোনো ছায়া নেই। অরণ্য জানে—নিভৃতির শেষ ডাক সে শুনেছে। এবার তাকে লিখতে হবে, সেই অসমাপ্ত সুরকে কাগজে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ভোরের হাওয়া ঠাণ্ডা, শিশিরে মাটি ভিজে গেছে। অরণ্য খাতাটা ব্যাগে গুঁজে বাংলোর দরজা বন্ধ করল। জানলার কাঠে এখনও শিশিরে লেখা সেই শেষ শব্দ—“ধন্যবাদ।” আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই অরণ্যের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা আর উষ্ণতা একসঙ্গে ভর করল।
চায়ের দোকানে নামতেই দোকানদার কৌতূহলী চোখে তাকাল। “বাবু, কাল রাতে… কিছু শুনলেন?”
অরণ্য হেসে বলল, “শুনেছি। আর যা শুনেছি, তা চুপ করে রাখার নয়। আমি লিখব।”
লোকটা চুপচাপ মাথা নেড়ে বলল, “তাহলে আপনি সাহসী। কারণ এখানে সবাই ভয় পায়। অনেক সত্যিই হারিয়ে যায় এই পাহাড়ের কুয়াশায়।”
অরণ্য কাপটা হাতে নিল। ধোঁয়া উড়তে লাগল। মনে হল—ধোঁয়ার ভেতরেও যেন নিভৃতির মুখ ভেসে উঠছে। চোখে সেই নীল আভা, ঠোঁটে অসমাপ্ত সুর।
ট্রেনে ফেরার সময় পাহাড় ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছিল। অরণ্য জানলার বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল—প্রেম আসলে কী? কেবল পাওয়া? না কি এক অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি? হয়তো প্রেম মানে কারও অসমাপ্তিকে নিজের কণ্ঠে জাগিয়ে রাখা।
কাগজ খুলে সে লিখল—
“তুমি নেই, অথচ আছো।
কুয়াশার মতো ভেসে থেকেও তুমি আলোয় নাম লেখাও।
তুমি প্রতারণার ইতিহাস নও,
তুমি এক অসমাপ্ত প্রেমের কবিতা।
নিভৃতি—তুমি ডাক দিয়েছিলে,
আমি শুনেছি।”
ট্রেন যখন সমতলে নেমে এল, পাহাড় অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু অরণ্যের ভেতরে পাহাড় থেকে গেল, থেকে গেল সেই ভাঙা বাংলো, সেই জানলার কুয়াশা, আর সেই কণ্ঠস্বর।
নিভৃতির ডাক হয়তো আর শোনা যাবে না। কিন্তু তার গল্প বেঁচে থাকবে অরণ্যের লেখা শব্দে—যেমন প্রেম থেকে যায় মৃত্যুরও পরে।
***




