Bangla - রহস্য গল্প

নিখোঁজ প্রতিমা

Spread the love

দেবাশিস সেন


ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। গ্রামের পূর্বদিকের পাহাড়ের মাথায় লালচে আভা ফুটে উঠেছে, আর ধানখেতের কুয়াশার ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে ভেসে আসছে পাখিদের ডাক। শত বছরের পুরোনো দুর্গামন্দিরে ভক্তরা ভিড় জমিয়েছে, আজকের সকাল যেন অন্য সব সকালের মতোই ভক্তিময় হওয়ার কথা ছিল। ঘণ্টা বাজছিল, ধূপকাঠির গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর মন্দির চত্বরে ঢাকের মৃদু আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছিল ভোরের নীরবতার সঙ্গে। মন্দিরের প্রধান পূজারি হরিদাস পণ্ডিত তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে গঙ্গাজল ছিটাচ্ছিলেন আর ভক্তদের আহ্বান জানাচ্ছিলেন—“এসো, মা দুর্গার চরণে প্রণাম করো।” কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আরতির পর যখন সবাই প্রতিমার দিকে তাকালো, তখন হঠাৎ বোঝা গেল—মায়ের আসন ফাঁকা! কোনো অলঙ্কার নেই, কোনো রঙ নেই, কেবল ধূপের ধোঁয়া ভাসছে শূন্য মঞ্চের চারপাশে। এক মুহূর্তে সময় যেন থমকে গেল। কারও চোখে বিশ্বাস জমল না, কারও মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। কেবল নারীদের দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল চিৎকার আর কান্নার শব্দ—“মা উধাও! মা নেই!”

শুরু হলো ভয়ের স্রোত, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গোটা গ্রামে। কেউ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মন্দিরের সামনে, কেউ ভয়ে মূর্ছা গেল, আবার কেউ ফিসফিস করে বলতে লাগল—“দেবী অপমানিত হয়েছেন, তাই তিনি অভিমান করে চলে গেছেন।” গ্রামজুড়ে অন্ধকার কুয়াশার মতো গুজব ঘনিয়ে আসতে লাগল। হরিদাস পণ্ডিত সিঁড়ির ধাপে বসে বারবার মাথায় হাত দিয়ে কাঁপা গলায় জপ করতে লাগলেন—“ওঁ মা, এ কেমন খেলা?” বৃদ্ধা মহিলারা বলল, গত কয়েকদিন গ্রামের ছেলেরা মন্দিরের সামনে খেলা করছিল, হয়তো তাতেই দেবী রুষ্ট হয়েছেন। কেউ কেউ আবার বলল, “না, এটা চোরের কাজ।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত বড় প্রতিমা কে, কিভাবে, আর কোন শক্তিতে সরিয়ে নিতে পারে? সন্দেহের ছায়া তখনই নেমে এল মন্দিরের রাখাল শিবুর উপর, কারণ সে-ই রাত জেগে পাহারা দেয়। ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকজন পুরুষ এগিয়ে এসে শিবুকে ঘিরে ধরল, তার কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করতে লাগল—“বল, কোথায় রাখলি প্রতিমা? তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে?” শিবু কাঁদতে কাঁদতে শপথ করে বলল সে কিছু জানে না, কিন্তু কেউ তখন শোনার মতো অবস্থায় নেই। আতঙ্ক আর সন্দেহ মিলে অগ্নিকুণ্ডের মতো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল।

মন্দির চত্বরে এলো এক অদ্ভুত অস্থিরতা। ধূপ-প্রদীপ আর ভক্তির গন্ধ মিলেমিশে এখন হয়ে উঠল শোকের পরিবেশ। গ্রামবাসীর মনে প্রবল দ্বন্দ্ব—এ কি সত্যিই দেবীর অলৌকিক অভিমান, নাকি কোনো মানুষের লোভের খেলা? গোপাল চা-ওয়ালা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল যে সে নাকি রাতে মন্দিরের চারপাশে আলো ঝলকানি দেখেছে, যেন কেউ গোপনে কিছু করছিল। তাতেই ভিড়ের ভেতর ফিসফাস আরও জোরালো হলো। “তাহলে নিশ্চয়ই চোর!”—কেউ বলে উঠল, আবার কেউ বলল—“না, মা-ই চলে গেছেন, এখন সর্বনাশ হবে।” বাতাসে ভয়ের সঙ্গে মিশে গেল এক অদ্ভুত অশুভ শীতলতা, যেন অদৃশ্য কিছু অঙ্গুলি হেলন করছে গ্রামের দিকে। শিশুরা কাঁদতে লাগল, মহিলারা শোকার্ত গলায় দেবীর গান গাইতে শুরু করল, আর পুরুষেরা একে অপরের দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এভাবেই সেই সকালটি আর পাঁচটা সকালের মতো উজ্জ্বল রইল না—এটি হয়ে উঠল এক বিভীষিকাময় সকাল, যার ভেতর থেকে জন্ম নিল এমন এক রহস্য, যা গোটা গ্রামের নিয়তি বদলে দেবে।

হরিদাস পণ্ডিতের কণ্ঠস্বর যেন বজ্রপাতের মতো নেমে এলো সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে। “দেবী অপমানিত হয়েছেন”—এই একটি বাক্য পুরো গ্রামে এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হলো, যেন তার প্রতিটি অক্ষরে লুকিয়ে আছে অশুভ সংকেত। পূজার পর থেকে গ্রামের মানুষ এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগছিল, কিন্তু এই ঘোষণার পর তাদের মনে ভয় যেন বাস্তব রূপ নিল। অশ্বত্থ গাছের নীচে বসা বৃদ্ধরা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “এবার সর্বনাশ আসন্ন।” মহিলারা চুলোর আগুন নিভিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা-জানালা আটকে দিল, বাচ্চাদের আঁকড়ে ধরে রাত কাটাতে শুরু করল। গ্রামের সরু পথগুলো, যেগুলো সাধারণত সন্ধ্যায়ও হাসি-ঠাট্টায় গমগম করত, হঠাৎ করে ফাঁকা হয়ে গেল। দূরে বাঁশবনের মধ্যে বাতাসের শব্দই কেবল শোনা যাচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল সেই শব্দে মিলেমিশে যাচ্ছে অদ্ভুত এক শিস বাজানো সুর। মানুষজন বলাবলি করছিল—রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে রতনের বাঁশির সুর ভেসে ওঠে, আর যার কানে সেই সুর পৌঁছোয়, সে নাকি আর ভোরের আলো দেখে না। এমনকি গ্রামের কিছু যুবক যারা আগে এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করত না, তারাও এখন ভয়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল, অশুভ শক্তি যেন তাদের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে, আর পালাবার কোনো পথ নেই।

হরিদাস পণ্ডিত গ্রামবাসীকে আরও আতঙ্কিত করে তুললেন। তিনি বললেন, “দেবীকে অশ্রদ্ধা করার ফল আমরা সবাই ভুগব। অশুভ শক্তি গ্রামে নেমে এসেছে। এখন যদি রাতের পর রাত কোনো সুর বাজতে শোনো, জানবে সেটা সাধারণ বাঁশির সুর নয়, সেটা হলো দেবীর ক্রোধের প্রতিধ্বনি।” এই ঘোষণা শোনার পর মানুষজন যেন নিঃশ্বাস ফেলতে পারল না। গ্রামের একপ্রান্তের বিধবা কমলা বলল, আগের রাতে সে নাকি খড়ের গোদাম থেকে ফিসফিসানি শুনেছে—কেউ যেন শ্বাসকষ্টে কেঁদে কেঁদে ডাকছিল। কৃষক গোপাল দাবি করল, সে যখন রাতের আঁধারে খেতের পাশে গিয়েছিল গরু দেখার জন্য, তখন হঠাৎ মাটির ভেতর থেকে ঠান্ডা বাতাস বেরোতে দেখে ভয়ে দৌড়ে ফিরে এসেছে। প্রতিটি কথাই গ্রামবাসীর ভয়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। এদিকে রতনের বাঁশির সুর রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কারও কাছে সেটা ভৌতিক সঙ্গীতের মতো শোনাচ্ছিল, কারও কাছে শবযাত্রার শোকসঙ্গীতের মতো। আর কেউ কেউ বলছিল, সেই সুরের ভেতর লুকিয়ে আছে অচেনা কণ্ঠের আহাজারি। মানুষজন আর জানত না কী বিশ্বাস করবে—এটা কি নিছক কোনো দুষ্ট ছেলে রতনের দুষ্টুমি, নাকি সত্যিই অলৌকিক শক্তির আগমন?

গ্রামে এক সময়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গেল। শিশুরা আর উঠোনে খেলতে বেরোয় না, পুরুষরা রাতে আলো হাতে বাইরে যেতে ভয় পায়, মহিলারা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কেবল দেবীর নাম জপ করে চলে। গ্রামটাকে যেন কোনো অদৃশ্য শৃঙ্খল বেঁধে ফেলেছে। একসময়ের উর্বর মাঠগুলো এখন ভুতুড়ে নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। খেতের ধারে শুকনো পাতা খসখস শব্দ করলেই মনে হয় যেন কেউ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরগুলোও মাঝরাতে হঠাৎ করে চিৎকার শুরু করে, যেন তারা অদৃশ্য কাউকে দেখতে পাচ্ছে। হরিদাস পণ্ডিত বারবার মানুষকে সতর্ক করছিলেন—“দেবীকে শান্ত না করলে সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না।” কিন্তু কিভাবে দেবীকে শান্ত করা যায়, তা তিনি খোলসা করছিলেন না। যেন তিনিও কোনো গোপন ভয়ের ভিতর দিয়ে চলেছেন। গ্রামের বয়স্করা পুরোনো দিনের ভূতের কাহিনি টেনে আনছিল, কেউ বলছিল—এটা ডাইনির ছায়া, কেউ বলছিল—এটা বনদেবীর অভিশাপ। প্রতিটি রাত মানুষের মনে নতুন ভয়ের জন্ম দিচ্ছিল, আর সেই ভয়কে আরও গভীর করছিল রতনের বাঁশির অদ্ভুত সুর। গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, মানুষ আর বুঝতে পারছিল না—এই অন্ধকার থেকে মুক্তি আদৌ সম্ভব কি না।

ভোর গড়িয়ে দুপুর এলেও গ্রামের হাহাকার থামছিল না। মন্দিরের সিঁড়ি থেকে উঠোন পর্যন্ত ভিড় জমে ছিল, সবাই একে অপরের সঙ্গে ফিসফিস করে আলোচনা করছিল। প্রশ্ন একটাই—এত বড় প্রতিমা গেল কোথায়? আর যেহেতু উত্তর মেলেনি, তাই সন্দেহের তীর ছুটে গেল সেই একমাত্র ছেলের দিকে, যে মন্দির পাহারা দেয়—শিবুর দিকে। একসময় ভিড়ের মাঝখান থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, “এটা নিশ্চয়ই শিবুর কাজ! প্রতিমার পাহারাদার ও-ই তো, রাতভর মন্দিরে থাকে। অন্য কেউ ঢুকলেই সে জানত না?” এই কথা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়তেই ভিড়ের মানুষজন একে একে শিবুকে ঘিরে ধরল। কেউ তার জামা টেনে ধরল, কেউ কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। কচি বয়সের ছেলেটি ভয়ে কেঁপে উঠল, চোখে জল জমে গেল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি কিছু করিনি। আমি মায়ের শপথ করে বলছি, আমি প্রতিমাকে হাতও লাগাইনি।” কিন্তু কান কে শোনে? যখন গ্রাম আতঙ্কে পুড়ছে, তখন সন্দেহ যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে—যাকে একবার স্পর্শ করে, তার নির্দোষিতাও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না।

শিবুর কান্না আর কাকুতি-মিনতির মাঝেও ভিড়ের উত্তেজনা কমল না। উল্টে আরও কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, “চুরি না করলে আলোর রহস্য বোঝাবে কে? রাতে তোকে ছাড়া কেউ মন্দিরে ঢুকতে পারে না।” ঠিক তখনই গোপাল চা-ওয়ালা, যাকে গ্রামের সবাই খবরের পসরা বলা যায়, সামনে এগিয়ে এল। মুখে একটা রহস্যময় ভঙ্গি এনে সে বলল, “আমি বলছি শুনুন, ওই রাতে আমি চায়ের দোকান গুটিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। তখন দেখি মন্দিরের ভেতরে ঝলমলে আলো! অথচ ওই সময়ে ভেতরে তো কেবল শিবুই ছিল।” গোপালের এই কথায় ভিড়ের মধ্যে হুলস্থুল পড়ে গেল। “আলো?”—কেউ প্রশ্ন করল। কেউ আবার বলল, “তাহলে প্রতিমা সরানোর কাজ ওই সময়েই হয়েছে!” অনেকেই তখন শিবুর দিকে আঙুল তুলতে লাগল। ভিড়ের মধ্যে থেকে ফিসফিসানি উঠল—“চোর ধরা পড়েছে।” শিবু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, কিন্তু গোপালের কথার পরে তার কান্নার সুর যেন কারও হৃদয় স্পর্শ করল না। বরং তার দিকে অবিশ্বাসের আঁচর আরও গভীর হলো।

মন্দিরচত্বরে সেই মুহূর্তের পরিবেশ ছিল একেবারেই শ্বাসরুদ্ধকর। একপাশে হরিদাস পণ্ডিত নীরব দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখ নামানো, ঠোঁট নড়ছে জপ করার মতো। তিনি যেন কিছু না শুনেই কেবল দেবীর নাম উচ্চারণ করছিলেন। অন্যপাশে গ্রামের মহিলারা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে, কেউ কাঁদছে, কেউ অভিশাপ দিচ্ছে। শিবু কাকুতি করে বলছিল, “আমি যদি দোষী হই তবে মা আমাকেই শাস্তি দেবেন, কিন্তু আমি প্রতিমা চুরি করিনি।” তার গলা ধরে আসছিল, তবু সে শেষ চেষ্টা চালাচ্ছিল নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গা তখন অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছে। গোপালের সেই আলো দেখার গল্প যেন গ্রামবাসীর মনে সীলমোহর মেরে দিল—শিবুই দায়ী। অথচ অমরেশ বাবু দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সবকিছু লক্ষ্য করছিলেন। তাঁর চোখে শিবুর কান্না সত্যি মনে হচ্ছিল, কিন্তু ভিড়ের চাপে তখন যুক্তির কোনো স্থান নেই। ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকা সন্দেহ গ্রামটাকে এমন এক জায়গায় ঠেলে দিল, যেখানে মানুষের চোখ অন্ধ হয়ে যায় আর কেবল অভিযুক্তকে শত্রু ভাবতে শেখে। এইভাবেই প্রথমবার গ্রামবাসী একত্রে আঙুল তুলল এক ছেলের দিকে, আর সেই আঙুলের ছায়া পুরো গ্রামে আরও অন্ধকার ডেকে আনল।

গ্রামের উঠোনে সেই সন্ধ্যায় অদ্ভুত এক টানটান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। প্রতিমা নিখোঁজ হওয়ার পর সবাই যখন ভয়ে, আতঙ্কে কেঁপে উঠছে, তখন কমলা বৌদি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন—“না, আর দেরি নয়। আমি পুলিশ ডাকব।” তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল শোকের সঙ্গে রাগ মেশানো দৃঢ়তা। কিন্তু সাথে সাথেই গ্রামের প্রবীণরা একযোগে বাধা দিলেন। কারও মুখে শোনা গেল—“পুলিশ ডাকলে অশান্তি বাড়বে, বাইরের লোক ঢুকে পড়বে, গ্রামের নাম খারাপ হবে।” কারও মুখে আবার ভেসে এলো অদ্ভুত কুসংস্কারমিশ্রিত ভয়—“যদি সত্যিই এটা বনদেবীর অভিশাপ হয়, তবে পুলিশ এসে কি পারবে?” ভয়ে চুপ করে থাকা বেশ কয়েকজন তরুণও বয়স্কদের সমর্থন করছিল, কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল অকারণে শত্রু তৈরি করে কোনও লাভ নেই। বাতাসে যেন ফিসফিসানি ছড়িয়ে পড়েছিল—বাঁশির সুর, অদ্ভুত নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, আর অন্ধকার জঙ্গলের রহস্য। এই গুজবের মাঝেই কমলা বৌদির প্রতিবাদী স্বর ধীরে ধীরে একা হয়ে পড়ছিল, কারণ সংখ্যাগুরু প্রবীণরা তাঁর গলা চেপে ধরতে চাইছিল যুক্তির বদলে ভয় আর গুজব দিয়ে।

এমন উত্তেজিত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে উঠলেন গ্রামের স্কুলশিক্ষক অমরেশ বাবু। মধ্যবয়সী, শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি সাধারণত ঝগড়াঝাঁটি এড়িয়ে চলেন, কিন্তু আজ তাঁর মুখে অন্য এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল। তিনি সবাইকে শান্ত হতে বলে স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন—“আপনারা যা ভাবছেন, তা নিছক ভ্রান্তি। প্রতিমা অকারণে উধাও হয়ে যায়নি। জঙ্গলের গভীরে বাঁশির সুর হঠাৎ ভেসে আসা—এসব সবই আমাদের ভয়কে কাজে লাগানোর কৌশল।” গ্রামের প্রবীণরা গজগজ করে উঠলেও তিনি থামলেন না। একে একে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে থাকলেন, “পুলিশ ডাকলেই নাম খারাপ হবে—এই ধারণা ভুল। বরং যদি আমরা কিছু না করি, তাহলে বারবার এরকম ঘটনা ঘটবে। আর ‘অভিশাপ’ বলে যদি ভেবে বসে থাকি, তাহলে চোর-ডাকাত বা যারা প্রকৃত অপরাধী, তারা আরও সুযোগ পাবে।” তাঁর প্রতিটি কথার মধ্যে যুক্তির ধার ঝলসে উঠছিল। তিনি গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বললেন, “মানুষ ছাড়া এর পেছনে আর কারও হাত নেই। বাঘ-ভালুক মানুষ ধরে নিয়ে যায় না। কারও ষড়যন্ত্র আছে এখানে। তাই পুলিশ ডাকাই একমাত্র পথ।” কিন্তু প্রবীণরা তখনও নড়েনি, তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট ভয় আর অন্ধবিশ্বাসের ছাপ।

অমরেশ বাবুর পাশে এসে দাঁড়াল তাঁর কিশোরী মেয়ে মালতী। সবার সামনে সে বাবার পাশে থেকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—“বাবা ঠিক বলছেন। প্রতিমা পিসিকে তো আমরা সবাই চিনতাম, তিনি ভয়ে জঙ্গলে ঢুকতেন না। কেউ তাঁকে প্রলুব্ধ করেছে, বা জোর করে নিয়ে গেছে।” তার স্পষ্ট স্বরে গ্রাম্য মণ্ডপে নীরবতা নেমে এলো। মালতীর এই সাহসী অবস্থান অনেককে অস্বস্তিতে ফেললেও, কয়েকজন তরুণ-তরুণী নিঃশব্দে সমর্থন জানাতে শুরু করল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, মনে মনে ভাবল—‘এতদিন আমরা ভয় পেয়েই চুপ থেকেছি, কিন্তু সত্যিই কি পুলিশ ছাড়া কিছু হবে?’ মালতীর গলার স্বর যেন তাঁদের ভেতরে চাপা সাহসকে আবার জাগিয়ে তুলল। কমলা বৌদি চোখে জল নিয়ে মালতীর মাথায় হাত রাখলেন, আর বললেন—“হ্যাঁ, এভাবে ভয় পেয়ে থাকলে চলবে না।” চারপাশের ভিড়ের মধ্যে ধীরে ধীরে মতভেদ তৈরি হতে লাগল—একদিকে প্রবীণদের কুসংস্কার আর ভয়ের যুক্তি, অন্যদিকে অমরেশ বাবুর দৃঢ় যুক্তি আর মালতীর সাহস। গ্রামের অচলাবস্থায় যেন নতুন এক দ্বন্দ্ব তৈরি হলো, আর সেই দ্বন্দ্ব থেকে জন্ম নিল একটিই প্রশ্ন—এই গ্রামের মানুষ কি ভয়কে আঁকড়ে ধরে বসে থাকবে, নাকি সত্য খুঁজে বের করতে পুলিশের শরণাপন্ন হবে? এই রাতের আলোচনার মধ্যে সেই প্রশ্নটাই যেন বাতাসে ভেসে উঠল বারবার।

অমরেশ বাবু সেই দিন থেকে গ্রামে যেন এক অদৃশ্য কুয়াশার ভেতর হাঁটছিলেন। প্রতিমার হদিশ মেলেনি, অথচ আশেপাশের অজস্র গুজব দিন দিন ঘন কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। তাঁর অন্তরজুড়ে এক অদ্ভুত আশঙ্কা বোনা হচ্ছিল, যেন সমস্ত রহস্যের সুতোগুলো একে অপরের গায়ে গা ঘষে উঠে আসছে, কিন্তু তিনি সঠিক প্রান্তে হাত রাখতে পারছেন না। তিনি বারবার গ্রামপ্রান্তের ভাঙাচোরা মন্দিরে যেতেন। সেই মন্দির একসময় পূর্ণ গৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু আজ ভাঙা স্তম্ভ, কালচে পাথরের গায়ে শ্যাওলা আর অন্ধকার কুঠুরি তাকে অচেনা, ভৌতিক রূপ দিয়েছে। ভাঙা সিঁড়িগুলোয় ধুলো জমে আছে, কিছু সিঁড়ি একেবারে ধসে গিয়ে গর্তে পরিণত হয়েছে। তবুও, অমরেশ বাবু জানতেন প্রতিমা কোনো না কোনো সূত্র রেখে গেছে। অনেক পুরোনো লোককথায় শোনা যায় এই মন্দিরের ভেতরে এক গোপন পথ ছিল, যা দিয়ে পুরোহিতরা পুজোর সময় প্রতিমা সরাতেন কিংবা কোনো অনিষ্ট হলে তা আড়ালে রাখতেন। তিনি লণ্ঠন হাতে সেই গোপন পথের সন্ধান করতে করতে ভাঙা ইট, কাঁদা আর পোকামাকড়ের আড়াল সরিয়ে ফেলতে শুরু করেন। গোপনে তিনি যা বুঝলেন, এই ভাঙা মন্দির যেন কেবল ইট-পাথরের শরীর নয়, বরং স্মৃতির স্তরে স্তরে ঢাকা এক রহস্যের প্রহরী। কিন্তু তাঁর কানে বারবার বেজে উঠছিল দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর—কখনও শান্ত, কখনও বিষণ্ণ, আবার কখনও যেন বিদ্রূপের মতো। সেই সুর যেন তাঁকে উপহাস করে বলছিল, তিনি যতই খোঁজেন, প্রতিমার পথ তাঁকে ধোঁকা দিয়ে যাবে।

এদিকে গ্রামে ভিন্ন দৃশ্য ফুটে উঠেছিল। রতনের বাঁশির সুর যেন গ্রামজুড়ে নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। প্রতিটি ঘরের আলো নিভলেই লোকেরা কেঁপে ওঠে, “আবার বেজে উঠল।” এই বাঁশি এখন কেবল রতনের বিনোদন নয়—এটি যেন প্রতিমার সঙ্গে অদৃশ্য কোনো যোগসূত্রে বাঁধা। গ্রামের লোকেরা ফিসফিস করে বলত, প্রতিমা হয়তো রতনের কাছেই আছে, তাই বাঁশির সুরে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রতন নিজেও কি তা জানে? নাকি কেবল কোনো অশরীরী শক্তি তাকে দিয়ে বাজাচ্ছে এই সুর? প্রতিবার সন্ধ্যার পর যখন গাঢ় অন্ধকারে বাতাস ঘন হয়ে আসে, বাঁশির সুর দূর থেকে ভেসে আসে—কখনও বাঁশঝাড় থেকে, কখনও শ্মশানের দিক থেকে, আবার কখনও গ্রামের পুকুরঘাটে। মহিলারা ঘর থেকে বেরোতে ভয় পেতেন, শিশুদের কানে তুলো দিয়ে শুইয়ে রাখা হত। আর পুরুষেরা দল বেঁধে আলো হাতে খুঁজতে যেতেন সুরের উৎস, কিন্তু ফিরে এসে শুধু বলতেন—“দূরে গেলেই সুর সরে যায়, যেন আমাদের সঙ্গে খেলছে।” এইসব কথাবার্তা ক্রমে রতনকে সন্দেহের কেন্দ্রে ঠেলে দিল। লোকেরা তাকে নিয়ে কানাঘুষো করতে লাগল—“হয়তো প্রতিমা লুকিয়ে রেখেছে, বাঁশি বাজিয়ে আমাদের ভড়কে রাখছে।” অমরেশ বাবু জানতেন, সত্যি এত সহজ নয়। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে উপলব্ধি করলেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যত দেরি হবে, গ্রাম আরও আতঙ্ক আর সন্দেহে গ্রাস হয়ে পড়বে।

অমরেশ বাবু এক রাতে আবার মন্দিরে গেলেন, এবার তাঁর ভেতরে এক অদম্য সংকল্প। লণ্ঠনের আলো ম্লান হলেও তাঁর চোখে ছিল অন্ধকার ভেদ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ভাঙা সিঁড়ির এক কোণে তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা এক গর্তের মতো ফাঁক। ঝুঁকে দেখলেন সেখানে যেন বাতাস টানছে—অন্ধকারের ভেতর এক অচেনা শ্বাসপ্রশ্বাস। তিনি ইট সরাতে সরাতে বুঝলেন এটাই সেই গোপন পথ। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে তাঁর মনে হচ্ছিল প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে ছায়ার ভেতরে টেনে নিচ্ছে। তবুও ভয়কে জয় করে তিনি নামলেন, আর সেই সঙ্গে বাঁশির সুরও যেন আরও স্পষ্ট হতে লাগল। মাটির নিচের পথ কোথায় নিয়ে যায় তিনি জানতেন না, তবে মনে হচ্ছিল ছায়ারা তাঁকে পথ দেখাচ্ছে। হয়তো এ পথই প্রতিমার গোপন ঠিকানা, হয়তো এ পথই রতনের বাঁশির রহস্যের উন্মোচন। কিন্তু তাঁর মনে এক আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠল—তিনি যদি একবার এই ছায়ার পথে পা বাড়ান, ফিরে আসা হয়তো সহজ হবে না। কারণ প্রতিমা কেবল হারিয়ে যাওয়া কোনো মূর্তি নয়, এটি এক শক্তি, এক অদৃশ্য স্রোত, যা মানুষকে টেনে নিয়ে যায় অজানার গভীরে। আর সেই গভীরতা থেকে যে ফিরে আসে, সে আর আগের মতো থাকে না।

গ্রামে খবর ছড়াল এক নতুন ব্যবসায়ী এসেছে, নাম সজন দত্ত। তার পোশাক-আশাক, ভাষা, চালচলন সবই ছিল শহুরে। সাদা গাড়ি, চকচকে জুতো, দামি সুগন্ধি—সব কিছুতেই যেন এক ধরণের ভান করা ভদ্রতা মিশে ছিল। সে প্রথমে গ্রামের কিছু লোকের সঙ্গে খোশগল্প জমাতে শুরু করল। কারও বাড়িতে ঢুকে চা খেল, কারও জমির খোঁজখবর নিল। বলল সে নাকি এখানে কিছু জমি কিনে রিসোর্ট বানাতে চায়, যাতে বাইরের লোকেরা এসে গ্রামীণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। গ্রামের লোকেরা প্রথমে অবাক হলেও পরে একটু একটু করে স্বস্তি বোধ করল, কারণ এরকম শহুরে ব্যবসায়ী এলে গ্রামে উন্নতি হবে, কাজের সুযোগ হবে—এই আশাই তারা করতে লাগল। কিন্তু গোপালের চোখে সবকিছুই ঠিক ঠেকছিল না। সে খেয়াল করল সজন দত্ত বারবার জঙ্গল আর পুরোনো মন্দির সংলগ্ন জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জমির চেয়ে তার আগ্রহ যেন অন্য কিছুর দিকে বেশি। এমনকি একদিন তাকে দেখা গেল স্থানীয় পুরোহিতকে নানা প্রশ্ন করতে—মন্দিরে কোন কোন প্রতিমা আছে, কত পুরোনো, কোথা থেকে এসেছে। পুরোহিত এসব প্রশ্নে চমকে গেলেও, সহজেই উত্তর দিয়ে দিল। কিন্তু গোপালের মনে হল, লোকটা মন্দিরকে নিয়ে কিছু অস্বাভাবিক কৌতূহল লালন করছে।

একদিন বিকেলে গোপাল নদীর ধারে হাঁটতে বেরিয়েছিল। দূর থেকে সে সজন দত্তের গাড়ি দেখতে পেল। গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের পথের কাছে। সজন তখন আর গাড়ির পাশে নেই, সম্ভবত জঙ্গলের দিকে গিয়েছে। গোপাল চুপচাপ কাছে গিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। সামনের সিটে কিছু কাগজপত্র ছড়ানো, তাতে নকশার মতো আঁকা ছিল, সম্ভবত পুরোনো মন্দিরের কোনো মানচিত্র। কিন্তু তার চোখ আটকে গেল পিছনের সিটে রাখা একটি বড়ো বাক্সে। বাক্সটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা, আর তার উপর অদ্ভুত কিছু চিহ্ন আঁকা। গোপালের বুক কেঁপে উঠল। সে মনে পড়ল সম্প্রতি গ্রামের বাইরে প্রতিমা পাচারের খবর ছড়িয়েছিল, আর রাতের অদ্ভুত বাঁশির শব্দও একই সময়ে শুরু হয়েছে। মনে হতে লাগল, সব যেন কোনো অদৃশ্য সুতায় বাঁধা। ঠিক তখনই সজন দত্ত ফিরে এল। গোপাল তড়িঘড়ি পেছনে সরে গিয়ে লুকিয়ে গেল। দূর থেকে দেখল লোকটা খুব সাবধানে চারপাশ দেখে গাড়ির ভেতরে ঢুকল, তারপর আবার ব্যস্তভাবে কোথাও ফোন করল। তার মুখের ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল ব্যাপারটা সাধারণ নয়। সে স্পষ্টতই কিছু গোপন কথা বলছিল, হয়তো কারও সঙ্গে প্রতিমা বিক্রির পরিকল্পনা করছে। গোপাল তখনই স্থির করল, এই লোকটা কেবল ব্যবসায়ী নয়—এর আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু।

গোপাল ঘটনাটা কারও সঙ্গে তৎক্ষণাৎ শেয়ার করল না। কারণ সে জানত, যদি প্রমাণ ছাড়া এমন কথা বলে, তবে গ্রামের লোকেরা উল্টে তাকে পাগল বলবে। তাই সে ঠিক করল চুপচাপ নজর রাখতে হবে। সজন দত্ত প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন অজুহাতে গ্রাম ঘুরে বেড়াত—কখনও জমির মাপ নিচ্ছে, কখনও গ্রামের বয়স্কদের সঙ্গে আলাপ করছে, আবার কখনও শিশুদের ললিপপ দিয়ে কাছে টানছে। সবকিছুই যেন খুব সাজানো নাটকের মতো। রাতে তার গাড়ি থেকে মাঝে মাঝে আলো জ্বলে উঠত, আবার কেউ কেউ শুনেছে সে একা একা বাঁশি বাজায়। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোপালের সন্দেহ আরও গাঢ় হল। গ্রামের মানুষ ভাবত, হয়তো শহুরে লোকের শখ, কিন্তু গোপাল জানত এর ভেতরে অশুভ কিছু লুকিয়ে আছে। সজনের গাড়ির সেই অদ্ভুত বাক্সে আসলে কী আছে, কেন সে বারবার মন্দির আর জঙ্গলের চারপাশে ঘোরাফেরা করে, আর কেনই বা বাঁশির সুরে হারিয়ে যায় মানুষ—এসব প্রশ্নের উত্তর এখন শুধু গোপালের কৌতূহল নয়, তার এক ধরণের ভয় হয়ে দাঁড়াল। সে বুঝতে পারল, ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে এক ভয়ঙ্কর খেলা শুরু হয়েছে, আর সেই খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে তাদের নিরীহ গ্রাম।

মালতী সেদিন সকালের আলো ফোটার আগেই মন্দিরের চত্বরে চলে আসে। রাতভর তার ঘুম হয়নি—চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ভাঙা দরজা, শূন্য বেদি আর ভয়ার্ত গ্রামবাসীদের মুখ। এতদিন ধরে যে প্রতিমাটিকে তারা জীবন্ত সত্তার মতো পূজা করেছে, আচমকা তার হারিয়ে যাওয়া কেবল অলৌকিক ঘটনা নয়, মানুষের মধ্যে এক গভীর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামের বৃদ্ধারা ফিসফিস করে বলছিলেন—“মূর্তি যদি নিজের পায়ে হেঁটে চলে যায়, তবে দুর্ভিক্ষ আসবেই।” কেউ বলছিল—“এ তো দেবীর অভিশাপ।” কিন্তু মালতীর মন মানতে চাইছিল না। অজানা শক্তি নয়, মানুষের লোভই যেন কোথাও কাজ করছে, এমন অনুভব তার ভিতরে জমাট বাঁধছিল। সে পাথরের বেদির চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে কিছু গুঁড়ো রঙ, যেন লালচে-সোনালি আভা মাটির সঙ্গে মিশে আছে। ঝুঁকে দেখল, রঙগুলো অতি সামান্য হলেও চিনে ফেলা যায়—এগুলোই প্রতিমার গায়ের রঙ, যা বছরভর ম্লান হয়ে গেলেও এখনও দেবীর শরীরে অটুট থাকে। মালতী হাতের আঙুলে একটু গুঁড়ো তুলে ঘষতেই সেই গন্ধ পেল, যা প্রতিবার প্রতিমা রঙ করার সময় ছড়াত। বুকের ভেতরে যেন হঠাৎই উত্তেজনার ঢেউ খেলে গেল—এগুলো কোনো দৈব চিহ্ন নয়, এ স্পষ্ট প্রমাণ যে প্রতিমাকে কেউ বাইরে টেনে নিয়ে গেছে। সে চারপাশে আরও খুঁজতে লাগল। মন্দিরের সিঁড়ির ধারে, ঘাসের ভেতর, এমনকি পুরোনো অশ্বত্থ গাছের গোড়ায়ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই গুঁড়ো। যেন ভারী কোনো বস্তু টেনে নেওয়ার সময় আঁচড়ে আঁচড়ে পড়েছে। গ্রামের লোকজন তখনও মূর্তি উধাও হওয়ার রহস্যে শিউরে উঠছে, কিন্তু মালতীর চোখে তা ধরা দিল অন্যভাবে—এ এক মানুষের কাজ, খুবই সুপরিকল্পিত চুরি।

এদিকে, অমরেশ বাবু গ্রামের মেলায় ফেরার প্রস্তুতি ছেড়ে সকালেই মন্দিরে চলে আসেন। তিনি পুরোনো দৃষ্টিশক্তি হারালেও অনুভূতিগুলো তীক্ষ্ণ। মালতীর হাতে রঙের গুঁড়ো দেখে তিনি প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর গভীর স্বরে বলেন—“মালতী, দেবতা নিজে হেঁটে যান না, মানুষই তাঁর আসন ভাঙে।” তার কণ্ঠে তিক্ততা, কিন্তু দৃঢ়তা স্পষ্ট। তিনি জানালেন, এতদিন তিনি গ্রামবাসীদের ভয়-ভক্তির মধ্যে কোনো যুক্তির আলো আনতে পারেননি, কিন্তু আজ এই গুঁড়ো রঙই প্রমাণ করছে প্রতিমাকে অলৌকিকভাবে হাওয়া করা হয়নি, কেউ ইচ্ছে করে সরিয়েছে। প্রতিমার গা থেকে রঙ চটে চটে মাটিতে পড়েছে, মানে ভারী দেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর কণ্ঠে আক্ষেপ মিশল—“লোভী মানুষের লোভই আজ দেবীকে বন্দি করেছে। যে হাতে ফুল দিত, সেই হাতেই হয়তো এখন বিক্রি হবে দেবীর মূর্তি।” আশপাশে জড়ো হওয়া কিছু গ্রামবাসী তখন কেঁপে উঠল, কারণ এতদিন যাকে অলৌকিক বলে মানছিল, সেটা যে মানুষের কাজ, তা মানতে তাদের অসুবিধে হচ্ছিল। কিন্তু অমরেশ বাবুর যুক্তি আর মালতীর চোখে ধরা পড়া চিহ্নগুলো একসঙ্গে মিলে নিঃসন্দেহ প্রমাণ দিল—কোনো অশরীরী শক্তি নয়, লোভের হাতেই প্রতিমা চলে গেছে। মালতী দেখল, তাঁর ঠোঁট কাঁপছে, চোখের কোণে জল টলমল করছে। বহুদিন ধরে এই মন্দিরকে তিনি পাহারা দিয়েছেন, আর আজ তাঁর সামনেই তা ভেঙে গেছে মানুষের ধূর্ততায়।

মন্দিরের ভেতরে নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা। গ্রামবাসীরা একদিকে ভয়ে আড়ষ্ট, অন্যদিকে ক্ষোভে ফুঁসছে। কারা এমন কাজ করতে পারে? মূর্তি চুরি করলে শুধু ধর্মীয় অপমান নয়, গোটা গ্রামেই অশান্তি ছড়িয়ে পড়বে। কেউ কেউ একে অপরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে লাগল—গ্রামের বাইরের দুষ্কৃতীরা কি এটা করেছে, নাকি ভেতরেরই কেউ হাত মিশিয়েছে? মালতীর বুক কেঁপে উঠল এই ভেবে—যদি তাদেরই চেনা কারও হাত এতে থাকে? অমরেশ বাবু গ্রামের প্রবীণদের ডেকে বললেন, “আজ থেকে ভয়ের কথা নয়, সত্যি কথা বলো। প্রতিমা হারানো মানে দেবী রুষ্ট হয়েছেন—এটা মিথ্যে। দেবী আমাদের ভেতরের দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছেন। আমরা লোভী মানুষকে খুঁজে না বের করতে পারলে গ্রাম আরও অন্ধকারে ডুবে যাবে।” মালতী তখন মনে মনে শপথ করল—সে যেভাবেই হোক এই অদৃশ্য চিহ্নগুলোর মানে বের করবে। ভাঙা গুঁড়ো রঙই তার পথ দেখাচ্ছে, যেন দেবী নিজে তাকে সত্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। সূর্যের আলো তখন গাছের ফাঁক দিয়ে সোনালি রেখা এঁকে দিচ্ছিল মন্দিরের বেদির উপর, আর সেই আলোয় গুঁড়ো রঙগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল—অদৃশ্য সত্যের প্রথম দিকচিহ্ন হয়ে। এই আবিষ্কার কেবল রহস্য উন্মোচনের সূচনা নয়, বরং গ্রামের মানুষকে অন্ধবিশ্বাস থেকে বাস্তবতার পথে টেনে আনার প্রথম পদক্ষেপ। মালতী বুঝল, সামনে পথ কঠিন, কিন্তু এখন আর ফেরার সুযোগ নেই—সে ও অমরেশ বাবুই হবে সেই সত্য অনুসন্ধানের যাত্রী, যাদের হাত ধরে গ্রামের লুকোনো অন্ধকার ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে।

রতন বাউল প্রথম থেকেই পুরো ঘটনার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছিল। তার বাউলগান, তার নির্লোভ জীবনযাপন তাকে গ্রামে অনেকের কাছেই বিশ্বস্ত করে তুলেছিল। তাই সেই রাতে, যখন সে অমরেশ বাবুর কাছে গোপনে এসে বলল—“আমি সজনকে দেখেছি, মন্দিরের কাছে… রাত গভীর ছিল, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা। আমি তখন বাঁশির সুর শুনতে পাই, সেই সুর টেনে নিয়ে যায় মন্দিরের দিকে। আর ঠিক তখনই দেখি সজন, মন্দিরের চূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে। তার চোখে ছিল এক ধরনের ভয়ের ঝিলিক, যেন কাউকে খুঁজছে, আবার যেন কারও কাছে কিছু গোপন করছে।” অমরেশ বাবু চমকে ওঠেন। তিনি জানতেন, সজন শান্ত, নিরীহ ছেলে বলে সবার চোখে ধরা দেয়, কিন্তু ভিতরে কি সে অন্য কিছু করছে? তবুও রতনের কাছে কোনো দৃঢ় প্রমাণ নেই। শুধু দেখা আর আন্দাজে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যায় না। তবে এই তথ্য অমরেশ বাবুর মনে সন্দেহের আগুনকে আরও জ্বালিয়ে দিল। তিনি জানতেন, এই রহস্যের উত্তর লুকিয়ে আছে অন্ধকারের ভিতরে, আর সেই অন্ধকার ভেদ করার একমাত্র উপায় হলো সত্যকে বাইরে টেনে আনা।

অমরেশ বাবু চুপচাপ পরিকল্পনা সাজালেন। গ্রামের পুরনো মন্দির, যেখানে বাঁশির সুর ভেসে আসে, সেটাকেই তিনি কেন্দ্র করে এক ফাঁদ তৈরি করতে চাইলেন। তিনি জানতেন, যদি সত্যিই সজনের সঙ্গে এর যোগ থাকে, তবে সে আবারও সেখানে যাবে—কারণ অপরাধী যতই সতর্ক হোক, তার টান থাকে সেই জায়গার দিকে যেখানে তার রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই এক সন্ধ্যায় তিনি বিশ্বস্ত কয়েকজন মানুষকে নিয়ে নিরবে মন্দিরের চারপাশে ফাঁদ পাতলেন। আড়ালে থেকে লণ্ঠনের আলো নিভিয়ে তারা অপেক্ষা করতে লাগল। বাতাসে তখনও শোনা যাচ্ছিল বুনো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূরে শেয়ালের হাহাকার, আর মাঝে মাঝে বাঁশবনের পাতার কাঁপন। অমরেশ বাবুর চোখ স্থির ছিল মন্দিরের অন্ধকার ফটকে, তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল রতনের বলা সেই বর্ণনা—সজনের ভয়ের ছাপ, তার ছায়ামূর্তি। সময় যেন থেমে গিয়েছিল। একদিকে গ্রামের নিস্তব্ধতা, অন্যদিকে মানুষের উৎকণ্ঠা—সব মিলিয়ে মুহূর্তগুলো ভারী হয়ে উঠছিল।

অবশেষে সেই রাতের নিরবতার বুক চিরে ভেসে উঠল পরিচিত বাঁশির সুর। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এলো উপস্থিত সবার মধ্যে। অমরেশ বাবু ইশারায় লোকদের সতর্ক করলেন। সুরের মায়াজালে যেন বাতাসও স্থির হয়ে পড়েছে। তারপর ছায়ার ভিতর থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সজনের মূর্তি। তার হাতে বাঁশি, চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা, ঠোঁটে যেন মন্ত্রবৎ জমে থাকা ভয়। সে মন্দিরের সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াতেই অমরেশ বাবু ঝাঁপিয়ে পড়লেন লোকজন নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সজন ধরা পড়ে গেল। সজন প্রথমে চুপ করে ছিল, তারপর হঠাৎ এক করুণ হাসি দিয়ে বলল—“আপনারা যা দেখছেন, তা সত্যির একদিক মাত্র। আসল সত্য যে দরজার আড়ালে, তা খোলার সাহস ক’জনের আছে?” তার কণ্ঠে এমন এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল যে উপস্থিত মানুষজন কেঁপে উঠল। অমরেশ বাবুর বুক কেঁপে উঠলেও তিনি জানলেন, এটাই সেই মুহূর্ত, যখন সত্যের দরজা খোলার শুরু হলো—অন্ধকারের ভিতর থেকে আলোর পথে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় এই ফাঁদ, আর সজনের রহস্যময় স্বীকারোক্তি সেই পথকে আরও রহস্যময় করে তুলল।

অন্ধকার রাত, চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের কুকুরের হাহাকার—পুরুলিয়ার জঙ্গলের ভেতরে সজনের হৃদস্পন্দন যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। হাতে মোড়া কাপড়ে বাঁধানো প্রতিমা, যেটি দেখতে সাধারণ পাথরের টুকরো মনে হলেও গ্রামের মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী শত বছরের পুরনো দেবমূর্তি। কয়েকদিন ধরেই সে সুযোগের খোঁজ করছিল, আর আজ অবশেষে পাচারের রাত এসে গেছে। অল্প ক’জন সঙ্গী নিয়ে নির্ধারিত পথ ধরে এগোতে লাগল সজন, বুকের ভেতর লোভের আগুন জ্বলছিল—শহরে এই প্রতিমার দাম লাখে উঠবে। পেটের দায়, দারিদ্র্য আর একটুখানি ধনী হওয়ার স্বপ্ন তাকে বারবার এই অন্ধকার পথে টেনে এনেছিল। তার চোখে বারবার ভেসে উঠছিল শহরের অর্ডারদাতার প্রতিশ্রুতি—“একবার কাজটা সফল করো, তারপর তোমার অভাব মিটে যাবে।” কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে তার মনে হচ্ছিল, জঙ্গলের ভেতরে কিছু অদৃশ্য চোখ তাকে দেখে ফেলছে, বাঁশির মৃদু সুর যেন কানে বাজছে, আর শরীর শিউরে উঠছে অজানা আতঙ্কে। তবুও সে থামল না, কারণ লোভের বাঁধন তাকে কেবল সামনে ঠেলে দিচ্ছিল।

হঠাৎ পথের মোড়ে মৃদু আলো দেখা গেল। সজন ভেবেছিল হয়তো সঙ্গীরা আগে এসে অপেক্ষা করছে, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো দৃশ্য স্পষ্ট হলো। আলোটা আসছিল পুলিশের টর্চ থেকে, আর তাদের মুখের কড়া অভিব্যক্তি দেখে সজনের বুক কেঁপে উঠল। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল পুলিশ, আর তার সঙ্গীরা ভয়ে দৌড়ে পালালেও সে প্রতিমাসহ ধরা পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখের সামনে ভেঙে পড়ল সব স্বপ্ন, প্রতিশ্রুতি আর লোভের জাল। পুলিশ অফিসার দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তুমি জানো এটা শুধু প্রতিমা নয়, গ্রামবাসীর বিশ্বাস, তাদের আত্মার অংশ। তুমি সেটা বিক্রি করতে যাচ্ছিলে?” সজন তখন আর সাহস পেল না মিথ্যে বলার, প্রতিমা ধরে ভেঙে পড়ল মাটিতে। নিজের মুখেই স্বীকার করল যে শহরের কালোবাজারে প্রতিমা বিক্রির জন্য সে অর্ডার পেয়েছিল। তার কণ্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছিল, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ঘামের ফোঁটা। ভেতরে কোথাও এক অদ্ভুত স্বস্তি বোধ হচ্ছিল—যেন দুঃস্বপ্নের মতো অপরাধের ভার নামতে শুরু করেছে, কিন্তু সেই সঙ্গে বুকে চাপা দিচ্ছিল ধরা পড়ার লজ্জা আর ভবিষ্যতের অন্ধকার।

পুলিশ প্রতিমা উদ্ধার করে গ্রামের মন্দিরে ফিরিয়ে দিল। সেই রাতে গ্রাম যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, কারণ দেবমূর্তি তাদের কাছে শুধু এক টুকরো পাথর নয়—ঐতিহ্য, ভক্তি আর অস্তিত্বের প্রতীক। মানুষজন মশাল জ্বালিয়ে প্রতিমা ফিরে পাওয়ার আনন্দে উৎসব করল, আর সজনের নাম উচ্চারণ হল অভিশাপের মতো। যে লোভ তাকে ভেতর থেকে গিলে খেয়েছিল, সেটাই আজ তাকে অপমানের গভীর গহ্বরে ঠেলে দিল। তার হাতকড়া পরা অবস্থায় মুখ ঢেকে রাখা, পুলিশের গাড়িতে ওঠার সময় গ্রামের বাচ্চাদের ভয়ার্ত চোখ, আর বৃদ্ধাদের অভিশাপ—সবকিছু তার আত্মায় গভীর ক্ষত তৈরি করছিল। সজন বুঝল, সামান্য লোভই মানুষের সমস্ত জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। প্রতিমা যেমন গ্রামবাসীর কাছে পবিত্র, তেমনই তার ধরা পড়া হয়ে উঠল এক শিক্ষা—যে লোভে মানুষ ধরা দেয়, সেই লোভই শেষ পর্যন্ত তাকে ধ্বংস করে। রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন চুপচাপ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মানুষের লোভ, বিশ্বাস আর ন্যায়বিচারের সংঘর্ষের।

১০

গ্রামজুড়ে যেন নতুন ভোরের আবহ তৈরি হলো। সকলে একে অপরকে ডাকাডাকি করতে করতে মন্দির প্রাঙ্গণে ভিড় জমাল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা সকালের আলোয় মন্দিরের সিঁড়ি যেন সোনালি হয়ে উঠল। সেই সিঁড়ি বেয়ে প্রতিমা ধীরে ধীরে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করল। চারদিকে ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলেও কারও চোখের জল আটকে রাখা গেল না। গ্রামের মহিলারা কপালে সিঁদুর নিয়ে প্রতিমাকে স্বাগত জানাল, আর পুরুষেরা ভক্তি ভরে মাথা নোয়াল। এতদিন ধরে নিখোঁজ থাকা সেই প্রতিমা আবার নিজের ঘরে ফিরে এসেছে—এ যেন নিছক একটি মূর্তির প্রত্যাবর্তন নয়, বরং বিশ্বাস, ঐতিহ্য আর একসঙ্গে লড়ে যাওয়ার প্রতীক। অনেকেই কান্না চেপে রাখতে পারছিল না; কেউ আবার হাত জোড় করে প্রণাম করতে করতে কেঁদে ফেলছিল। এই আবেগে ভরা মুহূর্তে সবাই যেন অনুভব করল, দেবী কেবল পাথরের গড়া রূপ নন, তিনি আসলে সেই শক্তি যিনি মানুষের মনোবলকে একত্রে বেঁধে রাখেন। অমরেশ বাবুর চোখেও জল জমে উঠল, তবে তাঁর মুখে এক শান্ত হাসি—যেন তিনি আগেই জানতেন, সত্য প্রকাশের পর দেবী আবার ফিরবেন।

হরিদাস পণ্ডিত সবার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় ভর দিয়ে বললেন, “আজ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, দেবীকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তিনি শুধু মন্দিরের মূর্তি নন, আমাদের বিশ্বাসের প্রতীক। বিশ্বাস যদি অটল থাকে, তবে দেবী সর্বদা আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।” তাঁর কণ্ঠে এমন দৃঢ়তা ছিল যে গ্রামের সবাই নতুন করে আশ্বস্ত হলো। কিন্তু এর মধ্যেই অমরেশ বাবু গলা পরিষ্কার করে বললেন, “তবে মনে রাখবেন, ভক্তির মানে অন্ধ বিশ্বাস নয়। যদি কেউ শুধু ভয় পেয়ে প্রণাম করে, তবে সে ভক্তি অসম্পূর্ণ। সত্যকে খুঁজে বের করাই আসল ভক্তি। দেবী চান আমরা অন্যায়কে প্রশ্ন করি, সত্যকে সামনে আনি। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মিথ্যা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আলো আসলেই তা ভেঙে পড়ে।” তাঁর এই কথাগুলো অনেককে নাড়া দিল। এতদিন যাঁরা নিছক অলৌকিক শক্তির ওপর ভরসা করছিল, তাঁদের মনে হলো আসলে সত্য ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানোই দেবীর আসল পূজা। গ্রামের তরুণেরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানাল—এখন থেকে তারা শুধু মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাবে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলবেও।

প্রতিমা গর্ভগৃহে স্থাপন হতেই মন্দিরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এলো। যেন দীর্ঘদিনের অস্থিরতা, সন্দেহ আর ভয় সব মিলিয়ে এক নতুন শান্তির জন্ম হলো। গ্রামবাসী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রু ঝরাতে লাগল। কেউ বলল, দেবী তাঁদের পরীক্ষা নিয়েছিলেন, কেউ আবার বলল মানুষের মনুষ্যত্বই জয়লাভ করেছে। যে যেভাবেই ব্যাখ্যা দিক, সবাই বুঝল এ ঘটনার ভেতরে গভীর শিক্ষা লুকিয়ে আছে। শিশুরা হাসতে হাসতে শঙ্খ বাজাচ্ছিল, মহিলারা আলপনা আঁকছিল, আর পুরুষেরা একত্রে ভোগের আয়োজন করছিল। কিন্তু অমরেশ বাবু নীরবে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকালেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, এই প্রত্যাবর্তন শুধু মূর্তির নয়, মানুষের অন্তরেরও। ভক্তি আর সত্য একসঙ্গে মিলে নতুন বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। তিনি ধীরে ধীরে চোখ মুছে নিলেন এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—এই গ্রামে আর কেউ কখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে না, কারণ প্রতিমার প্রত্যাবর্তন তাঁদের শিখিয়েছে, আলোর পথে হাঁটলেই দেবীর সত্যিকারের আশীর্বাদ পাওয়া যায়। এই উপলব্ধির সঙ্গে গ্রাম যেন নতুন জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গেল, যেখানে প্রতিমা কেবল পাথরের গড়া রূপ নয়, মানুষের হৃদয়ের আলো হয়ে রইলেন।

***

1000061329.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *