ঈশান দত্ত
পর্ব ১: জানলার ধারে বসে
নিউ জলপাইগুড়ির শালবন ঘেরা রেল কোয়ার্টার পাড়ার ঠিক পেছনে ছিল এক পুরনো ইংরেজ আমলের স্কুল—”নিউ জলপাইগুড়ি বয়েজ হাই স্কুল”। সেই স্কুলের দশম শ্রেণির ‘বি’ সেকশনের শেষ বেঞ্চে বসত পাঁচজন—সোহম, তন্ময়, রিমঝিম, অরিত্র আর সঞ্জনা। সবার মধ্যে কিছুটা যেন ছন্দে গাঁথা বন্ধুত্ব ছিল, আর তার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রেম, অভিমান আর একটা কাঁচা উত্তেজনা।
সোহম আর তন্ময়—শৈশবের বন্ধু। একসঙ্গে হিউম্যানিটিজ নিয়েছে। ক্লাসে সবসময় তৃতীয় বা চতুর্থ রোল নম্বরেই থাকে, কিন্তু পড়াশোনায় তেমন মন নেই। সোহমের চোখের কোণ সবসময় সঞ্জনাকে খোঁজে, আর তন্ময় সেটা জানলেও কিছু বলে না। তন্ময়ের মন পড়ে থাকে নীল আকাশে, সেও জানলার ধারে বসে কবিতা লেখে। আর রিমঝিম? সে যেন একটা চলন্ত বাজ পড়া—মেয়ে হয়েও সব ছেলেকে টক্কর দিতে পারে ক্রিকেটে, সাইকেল রেসে বা তর্ক প্রতিযোগিতায়।
অরিত্র ছিল সবচেয়ে চুপচাপ। সায়েন্স নিলেও তার মন ঘোরে ক্যানভাসে, জলরঙে, আর সঞ্জনার হাসিতে। কেউ জানে না, অরিত্র চুপচাপ ডায়েরিতে সঞ্জনার ছবি আঁকে, যেমন করে সঞ্জনা গল্প লেখে—সেসব লেখা পড়ে ফেললে কেউ বুঝতেই পারত, ওর গল্পের ‘রেহান’ চরিত্রটা কার অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি।
সেই বছর অক্টোবর মাসে স্কুলে শুরু হল ‘প্রিয় বন্ধু সপ্তাহ’। ক্লাসে সবাই একে অপরের জন্য ছোট ছোট নোট লিখে দিচ্ছিল। সোহম একটা কাগজে লিখল—”তুই হাসলে আমার দিনটা ভালো যায়, সঞ্জনা”। কিন্তু সঞ্জনার পার্সে সেই চিঠি দিয়ে দেওয়ার সাহস হল না। বরং ভুল করে সেটা পড়ে ফেলল রিমঝিম। প্রথমে একটু চমকালেও, সে কিছু বলল না, শুধু পরদিন সোহমকে বলল, “চিঠিটা ভালো ছিল, কিন্তু যে মেয়েটার জন্য লিখেছিস, সে তো গল্পে কারও জন্য অপেক্ষা করে না।”
সোহম বুঝতে পারল না, এটা উপদেশ না ব্যঙ্গ। তন্ময় তখন নিজের কবিতার খাতায় লিখছে—“তুই আমার কাছেই বসে থাকিস, অথচ প্রতিদিন দূরে চলে যাস।”
এদিকে স্কুলে ঘোষণা হল, ‘স্মৃতির রঙ’ নামে একটা ছোট সাহিত্য পত্রিকা বেরোবে, যেখানে গল্প, কবিতা, আঁকা, প্রবন্ধ সব জমা দেওয়া যাবে। সবাই উৎসাহে ভরে উঠল। সঞ্জনা নিজের লেখা গল্প জমা দিল—”জানলার ধারে যে ছেলেটা বসে”। রিমঝিম দিল একটা প্রতিবাদমূলক প্রবন্ধ—”কেন মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে পারবে না?” তন্ময় দিল একটা কবিতা, যার শেষ লাইনে লেখা ছিল—”তুই তো জানিস না, আমি জানলা দিয়ে তোকে দেখি না, আমি দেখি নিজের প্রতিচ্ছবি।”
কিন্তু অরিত্র কিছু জমা দিল না। শুধু চুপচাপ সঞ্জনার গল্প পড়ে মুখে হাসি ফুটল—”জানলার ধারে ছেলেটা” কি তবে সোহম?
দিন কেটে গেল, একটা সন্ধে এলো যেদিন পাঁচজন ঠিক করল স্কুলের পেছনের গাছতলায় বসে গল্প করবে। সেই দিনই হঠাৎ বৃষ্টি নামে। ছাতা ছিল না কারও। সবাই দৌঁড়ে চলে এল সাইকেল শেডে। সেখানেই রিমঝিম হঠাৎ জিজ্ঞেস করল—”তুমি জানলার ধারে বসে আছো মানে সোহম না তন্ময়?” সঞ্জনা হেসে বলল, “তুমি ভাবছো গল্পটা রোমান্টিক? না রে, ওটা একটা আত্মজিজ্ঞাসা ছিল।” কিন্তু তন্ময় মুখ নামিয়ে নিল, কারণ তার মনে হচ্ছিল—এটা হয়তো তার কথাই লেখা।
সেদিন রাতেই ক্লাসের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অরিত্র একটা আঁকা পোস্ট করল—পাঁচজনকে একসঙ্গে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, পেছনে একটা জানলা, আর তার পাশে এক বৃষ্টিভেজা বিকেল। নিচে লেখা, “আমাদের গল্প এখনো শেষ হয়নি…”
সেই আঁকা দেখে সঞ্জনা প্রথমবারের মতো অরিত্রকে আলাদা করে রিয়েক্ট করল। কিন্তু ঠিক তার পরদিন সকালেই একটা ঘটনা সবকিছু বদলে দিল।
পর্ব ২: বৃষ্টি ভেজা ভুল বোঝাবুঝি
পরদিন সকালে স্কুলের বাতাসে একটা অদ্ভুত নিঃশব্দতা ভেসে ছিল। যেন সকালের বৃষ্টি শুধু মাঠ নয়, কথাগুলোও ধুয়ে দিয়েছে। ক্লাসে ঢুকেই সোহম বুঝে গেল, কিছু একটা বদলে গেছে। অরিত্র চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে আছে, তন্ময় জানলার দিকে তাকিয়ে, সঞ্জনা কানে হেডফোন লাগিয়ে গল্পের খাতা খুলে বসে আছে। শুধু রিমঝিম একটু নরম হাসি নিয়ে সোহমের দিকে তাকিয়ে বলল, “কালকের ছবিটা দারুণ ছিল, না?”
সোহম শুধু মাথা নেড়ে বলল, “অরিত্র তো অসম্ভব আঁকে। কবে যেন কমিক বই বের হবে ওর নামে!”
কিন্তু সঞ্জনা একবারও চোখ তুলে তাকাল না সোহমের দিকে। সোহমের গলা শুকিয়ে এলো। তার ভিতরে কেমন একটা অস্থিরতা—কাল রাতে সে সাহস করে অরিত্রের পোস্টে কমেন্ট করেছিল, “তুই আমাদের গল্প আঁকলি, কিন্তু কে কার পাশে বসবে সেটা তুই ঠিক করলি কেন?” উত্তরে কিছুই আসেনি।
সোহমের ফোনে তখন একটা মেসেজ এল—‘সঞ্জনা uploaded a new story: Storms Are Quieter Than Words।’ সে ক্লিক করল। গল্পটা ছিল মাত্র তিন লাইনের:
“আমরা পাঁচজন ছিলাম। কেউ ভালোবেসেছিল, কেউ বুঝতে পারেনি। কেউ কিছু বলেনি, আর কেউ ভেবেছিল, যা বুঝেছে তাই সত্যি।”
সোহম ধাক্কা খেল। এটা কি তাকে নিয়েই লেখা? অথচ কোনো নাম নেই। সে মেসেজ পাঠাল সঞ্জনাকে—“গল্পটা পড়লাম। খুব বাস্তব।” কিন্তু রেপ্লাই এল না। seen-ও হয়নি। অথচ সে জানে, ক্লাসের মধ্যে বসে সঞ্জনা চুপচাপ ফোন চেক করে।
রিমঝিম আবার সোহমকে বলল, “তুই কি জানিস, তন্ময়ও নাকি সঞ্জনার গল্প পড়ে খুব কষ্ট পেয়েছে? ও ভেবেছে সেই জানলার ধারে ছেলেটা ও।” সোহম অবাক হয়ে বলল, “তন্ময়! কিন্তু তন্ময় তো কখনো কিছু বলেনি!”
রিমঝিম একবার চোখ পাকিয়ে বলল, “সব সময় কি বলতে হয় রে? কিছু কিছু অনুভব বোবা হয়ে থাকে, তবুও চিৎকার করে।”
সেই মুহূর্তে ক্লাসে ঢুকল বাংলা ম্যাডাম—“আজ তোমাদের পত্রিকার কাজ জমা নেওয়া হবে। যারা দেয়নি, এখন দিয়ে দাও।” সবাই ব্যস্ত হয়ে খাতা খুঁজে বের করল। সোহম এবার ঠিক করল—না, আজ সে নিজের মনের কথাটা লেখেই দেবে। খসখস করে খাতার পেছনের পৃষ্ঠায় লিখে ফেলল—“প্রিয়, জানলার ধারে বসে থেকো না। জানলার ওপারে কেউ অপেক্ষা করে না। তুই যদি সামনে এসে বলিস—তাহলে বুঝব, সত্যিই কিছু ছিল।” নাম দিল না। শুধু লেখাটাই জমা দিল।
সঞ্জনা তখন মৃদু গলায় বলল, “রিমঝিম, তুই একটা কথা জানিস? জানলার ধারে বসা ছেলেটা আমি চিনতাম না। আমি শুধু ভাবতাম, কেউ যদি বুঝে যায়, তাহলে ঠিক গল্পটা শেষ হবে।”
রিমঝিম একটু থেমে বলল, “শেষ না, শুরু হতো।”
তন্ময় তখন ক্লাসের একদম কোণে বসে একটা পুরনো কবিতার খাতা খুলে পড়ছিল। তার কবিতাগুলো ছিল কুয়াশার মতো—দৃষ্টির বাইরে, অথচ ভিজিয়ে দেয়। সেদিন সে লিখল—
“একটা গল্প শুরু হয়েছিল রোদে,
শেষ হয়েছিল এক বৃষ্টির নীচে।
আর মাঝখানে জানলার গ্লাসে কুয়াশা—
কেউ কারও চোখে তাকায়নি ঠিকঠাক।”
অরিত্র তখনও কিছু বলেনি। সে শুধু খাতার ভাঁজে আঁকছিল পাঁচটা পাতার ছবি—একটা ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। নীচে একটা নাম—“অপূর্ণতা”।
বেল বাজল। সবাই ছুটল টিফিনের জন্য। মাঠে তখন বৃষ্টির জল জমে কাদায় ভরা। কিন্তু কেউ হাঁটতে কষ্ট করল না। তন্ময় আর সঞ্জনা দাঁড়িয়ে ছিল করিডরের একপাশে, আর সোহম একটু দূরে। হঠাৎ সঞ্জনা বলে উঠল, “তুই জানিস, কেউ যদি গল্প লিখে ফেলে আর কেউ সেটা পড়ে ভুল বোঝে, তখন দায় কার?” তন্ময় মাথা নিচু করে বলল, “লেখকের। কারণ সে জানত না, পাঠকও ভালোবাসে।”
সোহমের চোখে জল এসে গেল। সে বুঝতে পারল—সবাই কারও জন্য কিছু রেখেছিল, কিন্তু সবাই ভেবেছিল, শুধু তার নিজেরই কথা অপ্রকাশিত।
সেই দিন বিকেলে, স্কুল শেষে পাঁচজন একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিল না। সবাই ছড়িয়ে গিয়েছিল। শুধু সোহম আর রিমঝিম হাঁটছিল পেছনের রেললাইন ধরে। সোহম বলল, “সবকিছু জট পাকিয়ে গেছে রে।” রিমঝিম মাথা নেড়ে বলল, “না রে, জট না, এটাই সম্পর্ক। যদি খুব সোজা হতো, তাহলে গল্প হতো না। আমাদের মাঝে গল্প আছে, মানেই আমরা বেঁচে আছি।”
রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে যেতে সোহম কানে শুনল দূরে ট্রেনের হুইসেল। সে জানত—এই শব্দই আবার তাদের পাঁচজনকে কোথাও না কোথাও এনে ফেলবে একসঙ্গে। কারণ কিছু গল্প শেষ হয় না, শুধু কিছুক্ষণ থেমে থাকে।
পর্ব ৩: যাকে কেউ চায়নি, সেই জানত সবচেয়ে বেশি
নিউ জলপাইগুড়ির আকাশে তখনও ছিটেফোঁটা মেঘ ভেসে বেড়ায়। তেমন জোরে বৃষ্টি নেই, কিন্তু বাতাসে একধরনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ জমে আছে। স্কুলের ভেতরে সেই গন্ধ যেন কিছুদিন ধরে কথাবার্তার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। সবাই একটা অদৃশ্য টানাপোড়েনে আটকে গেছে। কেউ মুখে কিছু বলছে না, তবুও যেন প্রত্যেকে প্রত্যেকের মন পড়ে ফেলছে নিজের মতো করে। আর এই ভিড়ের মধ্যেই, একেবারে অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছিল অরিত্র।
অরিত্র—যার চুপচাপ থাকাটা কারও চোখে পড়তো না। সে এমনভাবে থেকেছে যে তার ভালোবাসা, তার অভিমান, তার আঁকা সব কিছুই যেন কেবল তার নিজের জন্য। অথচ সে সব জানত—কে কাকে পছন্দ করে, কার চোখে কষ্ট, কার মনে আশাভঙ্গ। সে জানত, সোহম সঞ্জনাকে ভালোবাসে, তন্ময় ভাবত, সঞ্জনার গল্পটা হয়তো তার কথা বলছে। সে জানত, রিমঝিমের কথার আড়ালে একটা অতৃপ্ত আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে আছে, আর সঞ্জনার হাসির ভিতর একটা অদ্ভুত দোলাচল।
তবুও, কেউ তাকে চায়নি। কেউ জিজ্ঞেস করেনি, “তুই কী ভাবিস?” কিংবা, “তুই কাকে দেখিস?” অথচ অরিত্র প্রতি দুপুরে, যখন সবাই টিফিনে ব্যস্ত, তখন জানালার ধারে বসে পেন্সিলের ডগায় গল্প আঁকত। কোনোদিন সঞ্জনার দিকে চোখ তুলে কিছু বলেনি, কিন্তু তার সমস্ত ডায়রির পাতায় সঞ্জনার মুখ। এমনকি, যে গল্পটা সবাই পড়ছিল—“জানলার ধারে ছেলেটা”—ওটা অরিত্র আগে থেকেই আঁকায় রূপ দিয়েছিল। সঞ্জনা হয়তো লিখেছিল শব্দে, কিন্তু সেই অনুভব অরিত্র বহুদিন আগে থেকে বহন করছিল রঙে।
সেই সপ্তাহে স্কুলে লিটারেচার ক্লাবের তরফ থেকে ঠিক হল একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা হবে—বিষয়: “ভালোবাসা না বন্ধুত্ব—কে বেশি টেকে?” সোহম আর রিমঝিম বন্ধুদের পক্ষ নিয়ে, আর সঞ্জনা ও তন্ময় ভালোবাসার পক্ষ নিয়ে। অরিত্র কারও সাথেই নয়। ও শুধু ফর্ম জমা দিতে গেল, নাম লেখাল, একা প্রতিযোগী হিসেবে।
সবাই অবাক—“তুই একা কেন? দলে নয়?”
অরিত্র শুধু বলল, “আমি এমন কিছু বলব, যা দল নয়, মন বোঝে।”
প্রতিযোগিতার দিন এল। অডিটোরিয়াম ভর্তি। প্রথমেই সোহম বলল, “বন্ধুত্ব সেই, যা প্রেমকেও ভুলিয়ে দেয়। যখন প্রেমে মন ভাঙে, তখন বন্ধুই পাশে থাকে।”
রিমঝিম বলল, “বন্ধুত্বেই সত্যতা। প্রেমের মধ্যে প্রত্যাশা থাকে। বন্ধুত্ব শুধু সঙ্গে থাকা।”
সঞ্জনা পাল্টা বলল, “প্রেম থাকলে বন্ধুত্ব এমনিতেই থাকে। প্রেম ছাড়া বন্ধুত্ব নিছকই অভ্যাস।”
তন্ময় বলল, “ভালোবাসা মানে নিজেকে কারও জন্য ছেড়ে দেওয়া, আর সেটা যতদিন সত্যি থাকে, ততদিন কোনো বন্ধু লাগে না।”
শেষে ডাক পড়ল অরিত্রর। সবাই চুপ। সে মাইকে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর বলল,
“আমি কাউকে বলিনি, আমি ভালোবাসতাম। কাউকে বলিনি, বন্ধুত্বও চাইনি। আমি শুধু পাশে বসতে চেয়েছিলাম। যখন কেউ জানালার ধারে তাকিয়ে গল্প ভাবছিল, আমি জানালার কাচে তার প্রতিচ্ছবি আঁকছিলাম। আমি জানতাম, যে মেয়েটাকে সবাই ভালোবাসে, সে আসলে কাউকেই চায় না, শুধু অনুভব করতে চায়—তার গুরুত্ব আছে কিনা। আর যে ছেলেটা তাকে চেয়ে দেখে, সে নিজেও জানে না, সে দেখতে পায় না—পাশেই কেউ আছে, যে তাকে দেখছে আরো গভীরভাবে। আমি কোনো পক্ষের নই। কারণ প্রেম আর বন্ধুত্ব—দু’টোর মাঝেই আমি নেই। আমি শুধু জানি, যাকে কেউ চায় না, সেই জানে সবচেয়ে বেশি।”
ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা। তারপর এক সময় হাততালির শব্দ উঠল, কিন্তু সেটা খুব মৃদু। কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না—এটা অভিনয় ছিল না তো? কারণ অরিত্রর চোখে জল ছিল না, কিন্তু গলায় ছিল থরথর করে কাঁপা।
সেই সন্ধেয়, সোহম আর তন্ময় স্কুলের বাইরের চায়ের দোকানে বসে ছিল। তন্ময় বলল, “তুই কি জানতিস, অরিত্র এতটা বুঝে?”
সোহম মাথা নাড়ল, “না। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমরা সবাই গল্প লিখছি, প্রেম করছি, অথচ আসল চরিত্র তো আলগোছে বসে আছে ক্যানভাসের পাশে।”
তন্ময় বলল, “ও কি সঞ্জনাকে ভালোবাসে?”
সোহম উত্তর দিল না। কারণ উত্তর সে জানে।
রিমঝিম পরে সঞ্জনার পাশে বসে বলল, “তুই জানতিস, অরিত্র তোকে ভালোবাসে?”
সঞ্জনা একটু হাসল, “ভেবেছিলাম। কিন্তু কখনো নিশ্চিত ছিলাম না। আমি ওকে কোনোদিন ভাবিনি সে ভাবে।”
রিমঝিম বলল, “তবু ও তো ভেঙে পড়েনি। ও বলল, সে শুধু পাশে বসতে চেয়েছিল।”
সঞ্জনা কিছু বলল না। শুধু মনে মনে বলল—“কিছু ভালোবাসা শব্দ চায় না, পাশে থাকলেই অনেক।”
সেই রাতে, অরিত্র ডায়েরিতে লিখল—
“আজ প্রথম বললাম সব। তবু শান্তি পেলাম না। কারণ আমি জানি, বললেও কেউ শুনবে না, কারণ শুনতে হলে আগে চাওয়া লাগে।”
পর্ব ৪: বন্ধুত্বের খাতার শেষ পৃষ্ঠা
সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। নিউ জলপাইগুড়ির বাতাসে তখনও একটা থমথমে ভাব। স্কুলের বারান্দাগুলো যেন কথার ভারে ঝিমিয়ে পড়েছে। বিতর্ক প্রতিযোগিতার দিন অরিত্রর সেই বক্তব্য যেন এক অদৃশ্য বিদ্যুৎ রেখেছিল সকলের মনের ভেতর। কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলেনি, তবুও সবার অভ্যন্তরে নেমে এসেছিল একরাশ অস্বস্তি। সম্পর্কগুলো আবার নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সোহম সেই দিন থেকেই একটু বদলে গেছে। আগের মতো ঠাট্টা-মশকরা করছে না। ক্লাসে চুপচাপ বসে, সঞ্জনার দিকে তাকায় না, এমনকি তন্ময়ের সঙ্গেও কথাবার্তা কমে গেছে। কারণ তার মনে হচ্ছে—সে নিজেই নিজের মধ্যে হেরে গেছে। সে ভালোবেসেছিল, কিন্তু বলা হয়নি। তারপর বুঝেছে, অরিত্র চুপচাপ অনেক কিছু বলেছে, তবু কেউ শুনেনি।
তন্ময় অবশ্য নিজের মতই রয়েছে। সে জানে, তার কাব্যিক ভালোবাসা হয়তো কারও মন ছুঁয়েছিল, হয়তো নয়। কিন্তু সে এখন এসব নিয়ে বেশি ভাবতে চায় না। সে আবার নিজের খাতায় কবিতা লিখতে শুরু করেছে। সেই কবিতার নাম দিল—”তোর জন্য নয়”। যদিও সে জানে, প্রতিটি শব্দই ঠিক সঞ্জনার জন্য।
এদিকে সঞ্জনার অবস্থাও সহজ নয়। অরিত্রর কথাগুলো তার ভেতরে গভীর করে নাড়া দিয়েছে। সে বুঝে গেছে, ভালোবাসা মানেই চিঠি নয়, গোলাপ নয়, কখনো কখনো শুধু নিরবে পাশে বসে থাকাও ভালোবাসা হতে পারে। অথচ সে সেই অনুভবকেই উপেক্ষা করেছিল, না বুঝে। এখন সে কী করবে?
রিমঝিম যেন একমাত্র যে নিজেকে সামলে রাখতে পারছে। ওর মতে, ভালোবাসা, অভিমান, ভুল—এসব হতেই পারে, কিন্তু বন্ধুত্বটা ভেঙে গেলে কিছুই থাকে না। ও একদিন ঠিক করল—সবাইকে আবার এক জায়গায় নিয়ে আসবে।
স্কুলের পেছনের মাঠে একটা পুরনো কাঁঠাল গাছের নিচে তারা প্রায়শই বসত। সেই জায়গাটাই রিমঝিম বেছে নিল। একটা পুরনো খাতার কয়েকটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তাতে সবাইকে চিঠি লিখল।
প্রথম চিঠিটা সোহমের জন্য—
“তুই জানিস, তোকে ছাড়া আমাদের বন্ধুত্বের দলটা অসম্পূর্ণ। তুই কথা না বললে গল্প হয় না। চুপ করে থাকিস না। তোরও অনুভব আছে, জানি। এবার বল, কারণ বললেই বোঝা যাবে—তুই কতটা নিঃশব্দ ভালোবাসিস।”
তন্ময়ের জন্য চিঠিটা এমন—
“তোর কবিতায় আমরা ডুবে থাকি। কিন্তু তুই নিজেই যদি ডুবে যাস ভুল বোঝায়, তাহলে কে তোকে টেনে তুলবে? তোর কাব্যিকতা তোর অস্ত্র, সেটা তো ভুল করে কারও ওপর ছুঁড়িস না।”
সঞ্জনার জন্য—
“তুই গল্প লিখিস, কিন্তু নিজের গল্পটা কী? সেটা তো আমরা জানি না। আমরা সবাই তোকে ঘিরে হাঁটছি, অথচ তুই? তুই তো নিজেই জানিস না, তুই কাকে খুঁজছিস।”
অরিত্রর জন্য চিঠিটা খুব সহজ—
“তুই হয়তো সবচেয়ে চুপ, কিন্তু তুই জানিস সবচেয়ে বেশি। এবার চুপ করিস না। গল্প লেখ আর নিজেকেও সেই গল্পে রাখ। না হলে তো সব আঁকা অপূর্ণ রয়ে যাবে।”
চিঠিগুলো সে নিজে হাতে সবাইকে দিল। তারা কেউ কিছু বলল না, কিন্তু চোখে-মুখে একটা আলো ফুটল—একটা ভরসার আলো।
সন্ধ্যায় আবার সেই পুরনো জায়গায়, কাঁঠাল গাছের নিচে সবাই এল। সোহম প্রথমে বলল, “দোষ আমার। আমি শুধু ভাবছিলাম—আমার ভালোবাসা সবচেয়ে সত্যি। অথচ বুঝিনি, সবার ভালোবাসা আলাদা, সত্যিও আলাদা।”
তন্ময় হাসল, “আমি ভাবতাম আমি কেবল কবি, সবাই বুঝবে আমার মনের কথা। কিন্তু কবিতা তো একা একা পড়ে বোঝা যায় না। শোনাতেও হয়, বুঝিয়েও নিতে হয়।”
সঞ্জনা চুপ করে বসে ছিল। তারপর বলল, “আমার গল্পগুলো আসলে ভয় থেকে লেখা। আমি ভয়ে থাকি—যদি বলি আমি কাকে পছন্দ করি, আর যদি সে না চায় আমাকে? তাই আমি সবসময় গল্পে রেখে দিই নিজেকে। যেন ধরা না পড়ে।”
অরিত্র প্রথমে কিছু বলেনি। তারপর বলল, “আমি জানি, তুই আমাকে পছন্দ করিস না, সঞ্জনা। কোনোদিন করিসনি। কিন্তু আমি তোকে দোষ দিই না। আমি শুধু চাই, তুই নিজেকে ভুল বুঝিস না। কারণ তুই অনেক কিছু পারিস, শুধু স্বীকার করতে ভয় পাস।”
আকাশে তখন সূর্য ডোবে ডোবে। মাঠে আলো কমে আসছে, আর একটা শান্তি নেমে আসছে তাদের মুখে। অনেকদিন পর, তারা একসঙ্গে হেসে উঠল। যেন কোনো অভিমান, ভুল, ভালোবাসা—সব মিলে গেছে বন্ধুত্বের খাতার শেষ পৃষ্ঠায়।
তারা ঠিক করল, স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানের আগে তারা একটা দেওয়াল পত্রিকা বানাবে, নাম—“শেষ বেঞ্চের গল্প”। সবাই মিলে লিখবে, আঁকবে, সাজাবে।
কারণ তারা বুঝেছে—শেষ বেঞ্চে বসা মানে পিছিয়ে পড়া নয়। বরং সেখানে বসে থাকা মানে সবকিছু দেখা, অনুভব করা, আর একদিন হয়তো নিজের মতো করে সব কিছু বলা।
পর্ব ৫: বিদায়ের আগের গল্প
নিউ জলপাইগুড়ি বয়েজ হাই স্কুলের করিডোরে তখন বিদায়ের গন্ধ। জানলার কাঁচে আলতো করে ঝুলে থাকা পর্দাগুলোর মতো, সময়ও যেন থেমে থেমে দুলছে। দুধসাদা দেওয়ালে নতুন রং লাগানো হচ্ছে, ক্লাসের দেয়ালে ‘বিদায় ২০২৫’-এর পোস্টার। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়েরা কলেজের ফর্ম ফিল-আপ নিয়ে চিন্তিত, আর ভেতরে ছাত্রছাত্রীরা শেষ মুহূর্তের হাসি-মজা আর ফটোসেশনে ব্যস্ত।
শেষ বেঞ্চের পাঁচজন, মানে সোহম, তন্ময়, রিমঝিম, সঞ্জনা আর অরিত্র—এবার আবার একসঙ্গে। অনেক ভুল বোঝাবুঝির পরে তারা নিজেদের মতো করে মিলেমিশে গেছে। সম্পর্কের গিঁটগুলো একটু আলগা হয়েছে ঠিকই, তবে ছিঁড়ে যায়নি। বরং কোথাও গিয়ে তারা বুঝেছে—সব অনুভব বলা যায় না, কিছু কিছু শুধু মেনে নিতে হয়, আর কিছু অনুভব কেবল ধরে রাখতে হয়।
রিমঝিম পত্রিকা তৈরির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল। নাম দিয়েছে—“শেষ বেঞ্চের গল্প”। সবাইকে বলেছে, নিজের লেখা বা আঁকা দিতে হবে। স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে সেই দেওয়াল পত্রিকাই হবে তাদের শেষ উপহার।
তন্ময় একটা কবিতা লিখেছে, নাম—“আলোর আড়ালে ছায়া”। শেষ লাইনে লিখেছে—
“কেউ পেছনে বসে থেকেও দেখে সবচেয়ে ভালো,
কারণ তারা জানে—শেষ মানেই শেষ নয়,
শেষ মানে শুরু হওয়ার আগে একটুখানি থেমে থাকা।”
সঞ্জনা লিখেছে একটা ছোটগল্প—“যদি আবার দেখা হয়”—যেখানে একজন মেয়ে আর একজন ছেলে একই ট্রেনে উঠেও পরস্পরকে বলে না যে তারা একে অপরকে চিনে। তারা শুধু জানালার কাচে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে যায়। গল্পের শেষে লেখা—”ভালোবাসা মানে সবসময় জানিয়ে দেওয়া নয়, কখনও জানিয়ে না দেওয়াটাই অনেক বেশি চিরকালীন।”
অরিত্র এঁকেছে পাঁচটা জানলা। প্রতিটা জানলার ভেতর একেকটা মুখ—কেউ হাসছে, কেউ তাকিয়ে আছে দূরে, কেউ চোখ বন্ধ করে আছে, কেউ কাঁদছে আর কেউ কেবল শুনছে। সবকটি জানলার বাইরে বৃষ্টি। ছবির নিচে লেখা—“বাইরে যতই বৃষ্টি হোক, ভিতরে কারও না কারও গল্প চলছেই।”
সোহম প্রথমে কিছু লিখতে চাইছিল না। ওর মনে হচ্ছিল, লেখার কিছু নেই আর। কিন্তু বিদায়ের দিন যত কাছে আসছিল, ওর ভেতরে জমে থাকা কথাগুলো হাত কাঁপিয়ে বেরিয়ে এল।
“আমরা পাঁচজন ছিলাম। একসঙ্গে ক্লাসে ঢুকতাম, একসঙ্গে বাইরে বেরোতাম। কেউ কারও প্রেমে পড়েছিল, কেউ বুঝতে পারেনি, কেউ ব্যথা পেয়েছিল, কেউ অপেক্ষা করেছিল, কেউ চুপ করে ভালোবেসেছিল। তবুও আমরা গল্পটা ছিন্ন হতে দিইনি। এটাই আমাদের গল্প—শেষ বেঞ্চের।”
দেওয়াল পত্রিকার নিচে ছোট করে লেখা হল—”Presented by: Last Benchers Forever.”
স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন সকাল সকাল সবাই হাজির। ছেলেরা সবাই ফতুয়া বা পাঞ্জাবিতে, মেয়েরা শাড়ি আর চুড়িদারে। অডিটোরিয়ামের একপাশে দেওয়াল পত্রিকা টাঙানো। যে দেখছে, একবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ চুপ করে পড়ছে, তারপর হেসে চলে যাচ্ছে, বা হয়তো চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।
সঞ্জনার মা এসে বললেন, “তোমাদের লেখাগুলো পড়ে মনে হল যেন কোনো সিনেমার চিত্রনাট্য। খুব গর্ব হচ্ছে তোদের জন্য।”
রিমঝিম হেসে বলল, “আন্টি, সিনেমা না হোক, জীবন তো হলো একটা গল্প!”
অনুষ্ঠান শুরু হল। ক্লাস টিচার বললেন, “তোমরা যারা সবসময় সামনে বসে থেকো, তারা নিয়ম মানো। কিন্তু যারা পেছনে বসে থেকো, তারা জীবনটাকে দেখো অন্যভাবে। এই শেষ বেঞ্চাররা আমাদের শেখাল—ভুল করে, ভালোবেসে, ভেঙে আবার গড়ে, কীভাবে জীবনের গল্প লেখা যায়।”
বক্তৃতার পর গান, নাটক, নাচ। তারপর সেই চিরাচরিত—“ফটোসেশন টাইম!”
তন্ময় হেসে বলল, “চল, পাঁচজন একটা ফটো তুলি—ঠিক আমাদের বেঞ্চের সামনে।”
সবাই দাঁড়াল। রিমঝিম ক্যামেরা সেট করল। তারপর পাঁচজন একসঙ্গে ক্লিক।
কিন্তু অরিত্র একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সোহম টেনে বলল, “এই তো, তুই সব জানিস, সব আঁকিস, সব বোঝাস, কিন্তু সামনে দাঁড়াতে ভয় পাস?”
অরিত্র হেসে বলল, “চুপ করে থাকাই তো আমার ভাষা। তবে আজ দাঁড়ালাম।”
তারা ফটো তুলল। হাসি মুখে। তবুও সবার চোখে একটু জল। কে জানে, আবার কখন দেখা হবে!
সেই রাতেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রিমঝিম একটা ছবি দিল—তাদের পঞ্চজনের ছবি, নিচে ক্যাপশন—
“বন্ধুত্ব মানে সব সময় একসঙ্গে থাকা নয়, বরং যখন দূরে থেকেও কেউ মন খুলে হাসে, জানবে—তোর কথা মনে পড়ছে।”
সোহম উত্তর দিল—“একদিন আবার জানলার ধারে বসে থাকব আমরা, হয়তো কেউ লেখক হবে, কেউ কবি, কেউ শিক্ষক, কেউ আঁকিয়ে… কিন্তু সেই জানলার পাশে থাকবে গল্প। এবং সেই গল্পের নাম হবে—শেষ বেঞ্চ।”
পর্ব ৬: জানলার ওপারে আমাদের শহর
বিদায়ের ক’টা দিন পরেও নিউ জলপাইগুড়ির আকাশ ঠিক আগের মতোই ছিল। কুয়াশা ভোরের বাতাসে ভেসে বেড়াত, ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটার সময়ও মনে হত—স্কুলটা এখনও ডাকে। কিন্তু বাস্তব বদলে গেছে। পাঁচজন এখন আলাদা পথে পা বাড়িয়েছে। কেউ জলপাইগুড়ির বাইরেই চলে গেছে, কেউ কলেজে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায়, কেউ আবার ঘরে বসে নতুন স্বপ্ন বুনছে।
সঞ্জনা শিলিগুড়ির এক নামী কলেজে ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হয়েছে। কলেজে পা দিয়ে প্রথম দিনেই সে বুঝে গিয়েছিল, স্কুলের মতো নির্ভরতা এখানে নেই। নতুন মুখ, নতুন ভাষা, আর অনেক বেশি অনিশ্চয়তা। সবাই যেন নিজের মতো করে এগিয়ে যেতে চায়, কারও মধ্যে নেই সেই শেষ বেঞ্চের গন্ধ। সঞ্জনা খাতার পাতা খুলে একদিন লিখল—“আমাদের স্কুলটাই ছিল জানলার ধারে বসার মতো। এখানে সবাই শুধু নিজের জানলা বন্ধ করে রাখে।”
তন্ময়, জলপাইগুড়ির কলেজেই বাংলা নিয়ে ভর্তি হয়েছে। সে আগের মতোই কবিতা লিখছে, তবে এখন লেখাগুলো একটু বেশি নির্জন। আগে যাদের জন্য লিখত, তাদের কেউ এখন আর সামনে নেই। মাঝেমধ্যে সঞ্জনার ইনস্টাগ্রাম স্টোরি দেখে বুকটা ধক করে ওঠে, কিন্তু সে আর কিছু বলে না। শুধু লিখে—
“তুই যখন দূরে চলে গেলি, আমি তখনও জানালার কাছে বসে থাকি। তুই আসবি না জানি, তবুও অপেক্ষা করি—এই শহরটাই যে তোর গন্ধে ভরা।”
সোহম এখন কলকাতায়, এক প্রাইভেট কলেজে সমাজতত্ত্ব পড়ছে। মেসে থাকে, নতুন বন্ধু হয়েছে, কিন্তু রিমঝিম ছাড়া আর কারও সঙ্গে মনের মতো কথা বলতে পারে না। রিমঝিমই একমাত্র, যার সঙ্গে এখনও নিয়মিত কথা হয়, ফোনে, মেসেজে। ওরা একে অপরকে ‘ফ্রেন্ডশিপ সিস্টেম’ নামে একটা মজা করত—যার মানে, “তুই চুপ করলেও আমি বুঝে নেব।”
রিমঝিম এখন জলপাইগুড়িতেই কলেজে ভর্তি হয়েছে, ইতিহাস অনার্সে। কিন্তু ওর মন পড়ে থাকে মানুষ আর সম্পর্কের ব্যাখ্যায়। একদিন বিকেলে ছাদের ওপর বসে হঠাৎ সে ফোনে সোহমকে বলল, “জানিস? জানলার ওপারের শহরগুলো সব আলাদা, কিন্তু জানলার ধারে বসে যে মনটা থাকে, সেটা একটাই। আমরা সবাই সেই মনটাকে বয়ে বেড়াচ্ছি।”
সোহম চুপ করে ছিল। তারপর বলল, “আমরা কি আবার একসঙ্গে বসব কোনোদিন?”
রিমঝিম বলল, “হয়তো, যদি সময় জানলার ধারে বসে আমাদের ডাক দেয়।”
এদিকে অরিত্র? সে এখন শিলিগুড়িতেই এক আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছে। তার আঁকার গণ্ডি এখন অনেক বড়, ক্যানভাস বড় হয়েছে, কিন্তু আঁকার ভিতর এখনও সেই পাঁচটা মুখ, সেই স্কুলের জানলা, সেই কুয়াশার মাঠ। ক্লাস শেষে সে রোজ এককাপ চা নিয়ে বসে যায় ইনস্টিটিউটের জানলার ধারে, আর আঁকে—চুপচাপ।
একদিন সে ইনস্টাগ্রামে একটা ছবি দিল—পাঁচটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে একটা প্ল্যাটফর্মে, ট্রেন চলে যাচ্ছে পেছনে, আর তারা তাকিয়ে আছে এক দিকেই। ছবির নাম—“পাঁচজনের যাত্রা”।
সেই ছবিটা দেখে সঞ্জনা কমেন্ট করল—”তুই এখনও আঁকিস, আর আমরা এখনও দেখি।”
অরিত্র শুধু রিপ্লাই দিল—”দেখা মানেই না বোঝা, তবুও চোখ ফিরিয়ে নিইনি তো কেউ। এটাই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের।”
তারপর হঠাৎ একদিন, রিমঝিম একটা গ্রুপ মেসেজ পাঠাল—
“তোমরা কি ১৫ অগাস্ট স্কুলে যাচ্ছো না? আমি যাচ্ছি।”
সবার উত্তর আসতে সময় লাগল না।
সোহম বলল, “আমি শিলিগুড়ি হয়ে যাব।”
তন্ময় বলল, “আছি জলপাইগুড়িতে, অবশ্যই আসব।”
সঞ্জনা একটু পরে লিখল, “কলেজ বন্ধ থাকলে আমিও যাব।”
অরিত্র শুধু একটা পেন্সিল স্কেচ পাঠাল—একটা স্কুলের গেট, যার ওপরে লেখা—”Welcome Back!”
১৫ অগাস্ট সকালে স্কুলের মাঠে পতাকা উঠল, জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল, আর সেই পুরনো ছেলেমেয়েরা আবার সেই পুরনো বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়াল।
তারা কেউ বদলায়নি, শুধু আরও একটু বড় হয়ে গেছে। কিন্তু চোখে-মুখে সেই একই আলো, সেই একই উত্তেজনা।
সোহম বলল, “আচ্ছা, কেউ কি ভেবেছিল, আমরা একদিন আবার একসঙ্গে দাঁড়াব?”
সঞ্জনা হাসল, “ভেবেছিলাম, শুধু বলিনি।”
তন্ময় বলল, “আমরা আসলে জানলার ধারে থাকতেই পছন্দ করি—যেখানে দূরে তাকালেও একে অপরকে দেখা যায়।”
অরিত্র বলল, “আমি আজ একটা নতুন ছবি আঁকব—পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের গেটের সামনে, পেছনে জাতীয় পতাকা, আর সবার মুখে একটা শান্তির হাসি।”
রিমঝিম বলল, “তোর আঁকা এখন শুধু ছবি নয় রে, আমাদের স্মৃতি।”
তারা আবার হাঁটল স্কুলের করিডোর দিয়ে। আবার ছুঁয়ে দেখল পুরনো বেঞ্চ, জানলা, লকার, ক্লাসরুমের দেয়াল। যেন একটা সময় ফিরে এসেছিল কুয়াশার শহরে। জানলার ওপারে আরও অনেক শহর, আরও অনেক গল্প—কিন্তু এই শহর, এই স্কুল, এই বন্ধুত্ব তাদের চিরকাল জানলার ধারে বসিয়ে রাখবে।
পর্ব ৭: যদি গল্পটা বই হতো
১৫ অগাস্টের দিনটা যেন একটা আলতো ঘোর লাগা সকাল ছিল। স্কুলে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর সোহম, তন্ময়, রিমঝিম, সঞ্জনা আর অরিত্র আবার একসঙ্গে হাঁটছিল সেই পুরনো করিডোরে, যেখানে তাদের পায়ের ছাপ রয়ে গেছে সময়ের পাতায়। কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু মনে মনে প্রত্যেকেই একটা প্রশ্ন বয়ে বেড়াচ্ছিল—এই কি শেষবার দেখা? এই কি আমাদের গল্পের শেষ অধ্যায়?
সঞ্জনা হঠাৎ থেমে বলল, “আচ্ছা, যদি আমাদের গল্পটা একটা বই হতো?”
তন্ময় বলল, “তাহলে নাম হতো ‘শেষ বেঞ্চের দিনলিপি’। আমি কবিতা লিখতাম ভেতরে।”
রিমঝিম বলল, “তাহলে আমি লিখতাম ফোরওয়ার্ড—‘এই বইটি তাদের জন্য, যারা বন্ধুত্বে প্রেম খুঁজে পায়, প্রেমে বন্ধুত্ব খুঁজে পায়, আর শেষে শুধু স্মৃতি বয়ে বেড়ায়।’”
সোহম বলল, “আমি হয়তো প্রুফরিড করতাম, কারণ আসল কথাগুলো অনেক সময় বানান ভুলের মতো, চোখে পড়ে না কিন্তু বোঝাতে হয়।”
অরিত্র চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর সে থেমে বলল, “আর আমি আঁকতাম কভারের ছবি—পাঁচটা ছায়ামূর্তি জানলার পাশে বসে আছে, বাইরে কুয়াশা, আর বইয়ের নাম—‘জানলার ধারে পাঁচজন’।”
ওদের মধ্যে এমন স্বচ্ছ সমঝোতা আগে কখনো দেখা যায়নি। এত আলাদা হলেও যেন এক সুতোয় বাঁধা। কেউ পুরোটা বলছে না, কেউ বুঝিয়ে দিচ্ছে না, তবু বোঝা যাচ্ছে—এই বন্ধন মিথ্যে নয়।
পরে তারা সবাই গিয়ে বসল স্কুলের সেই কাঁঠাল গাছের নিচে। চারপাশে নতুন ছাত্রছাত্রীরা ঘুরছে, কিন্তু এই পাঁচজনের সামনে যেন পুরনো সময় জেগে উঠেছে।
সোহম বলল, “আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন ভাবতাম বড় হয়ে গেলে সবাই নিজের মতো করে বদলে যাবে। কিন্তু আজকে দেখে মনে হচ্ছে, আমরা যত বড় হয়েছি, ততই ছোট ছোট জিনিসের গুরুত্ব বুঝেছি।”
সঞ্জনা বলল, “আসলে আমরা বদলাই না, শুধু মুখোশ পাল্টাই।”
তন্ময় হেসে বলল, “তবে আমরা পাঁচজন এখনও যেন মুখোশ পরিনি। তাই আবার একসঙ্গে বসতে পেরেছি।”
সন্ধে নামছিল তখন। তারা স্কুলের ছাদে উঠল—সেই ছাদে যেখানে ক্লাস টেন-এর পরে আর কেউ যায় না, কারণ সেটা ‘পুরোনোদের এলাকা’ বলে পরিচিত। আজকের দিনে সেই পুরোনো তারাই।
ছাদে দাঁড়িয়ে শহরটাকে দেখলে মনে হয়, সময় থেমে আছে। ট্রেনের শব্দ ভেসে আসে, দূরে পাহাড়ের রেখা হালকা নীলচে, আর মাথার ওপর নরম মেঘ।
অরিত্র বলল, “আমাদের শহরটা আসলে একটা বড় জানলা—যেখানে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম স্বপ্ন। কেউ সেই জানলা খুলে বাইরে গেছে, কেউ এখনও সেই জানলার ধারে দাঁড়িয়ে।”
রিমঝিম বলল, “আচ্ছা, আমরা কি আবার একসঙ্গে কোনও দিন কাটাব? যেমন স্কুলে কাটাতাম?”
সঞ্জনা বলল, “হয়তো পারব না। জীবন তো আর স্কুল নয়, যেখানে প্রতি বছর ক্লাস বদলালেও বন্ধুরা থেকে যায়।”
তন্ময় তখন বলল, “তবু যদি আমাদের গল্পটা বই হতো, তাহলে পাঠকরা হয়তো জানত, আমাদের গল্পের শেষটা এতটা নরম আর মেঘে ঢাকা।”
সোহম বলল, “তারা ভাবত, এরা নিশ্চয় প্রেমে পড়েছিল, কিংবা কারও সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছিল। কিন্তু তারা জানত না, আমরা আসলে কাউকে হারাইনি, আমরা শুধু সময়কে হাতছাড়া করেছি।”
পাঁচজন একসঙ্গে চুপ করে বসেছিল ছাদের ধারায়। পেছনে সূর্য ডুবছে, আকাশে কমলা-লাল আলো।
হঠাৎ সঞ্জনা ব্যাগ থেকে একটা ছোট খাতা বের করল। বলল, “এই খাতা আমি স্কুল ছাড়ার সময় থেকে রাখছি। আজকে তোরাই লিখে দাও এর শেষ পাতাটা।”
খাতাটা ঘুরে ঘুরে গেল। তন্ময় একটা কবিতা লিখল, সোহম একটা ছোট মেসেজ—“তোর হাসি যেন মনে পড়ে সবথেকে বেশি।”
রিমঝিম লিখল—“তোর সঙ্গে শেষ বেঞ্চে বসে আমি শেখেছি—সব সম্পর্কের নাম দিতে হয় না।”
অরিত্র একটা ছোট স্কেচ আঁকল—পাঁচটা ছাতা, একসঙ্গে বৃষ্টির ভেতর দাঁড়িয়ে, আর তাদের ছায়া গিয়ে মিশে গেছে একটা জানলার কাঁচে।
শেষে সঞ্জনা নিজের কলমে লিখল—“যদি কোনোদিন কেউ এই খাতা পড়ে, তারা জানবে—এই শহরে পাঁচজন বন্ধু ছিল, যারা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসত, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারেনি। তবু তারা একসঙ্গে ছিল, আর এই ছিল তাদের গল্প—একটা না বলা ভালোবাসার বই।”
আকাশে তখন প্রথম তারা ফুটছে। আর পাঁচজন জানত—আজকের রাতটা স্মৃতির রাতে বদলে যাবে। হয়তো এদের দেখা আবার হবে, হয়তো হবে না। হয়তো কেউ বিদেশে যাবে, কেউ চাকরি পাবে অন্য শহরে, কেউ পরিবার গড়বে, কেউ হয়তো খাতা বন্ধ করে নতুন গল্প লিখবে। কিন্তু একটা বই, যেটা লেখা হয়নি, সেটা থেকে যাবে। তাদের মাঝখানে, নিরবে।
পর্ব ৮: ফিরে দেখা, ফেলে আসা
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর তিনে দাঁড়িয়ে ছিল সোহম। তার হাতে একটা পুরোনো ব্যাগ, ব্যাগের চিপায় গুঁজে রাখা একটি নোটবুক—যেটা সে স্কুলে পড়ার সময় ব্যবহার করত, আর এখন মাঝে মাঝে খুলে পড়ে পুরোনো পাতাগুলো। আজ দশ বছর পর সে আবার এই শহরে ফিরেছে। শহরের গন্ধ, স্টেশনের হাঁকডাক, এমনকি ট্রেনের হুইসেলের শব্দও তার চেনা। তবু মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়েছে।
দুপুরের দিকে রিমঝিম ফোন করেছিল—“তুই তো এবার এসেছিস, চল না আজ বিকেলে স্কুলে যাই। জানিস, কাল স্কুলের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। তোকে ছাড়াই কি সম্ভব রে?”
সোহম হেসে বলেছিল, “স্কুলে গেলে হয়তো নিজেকে আবার ছাত্র মনে হবে।”
রিমঝিম বলেছিল, “তোর হাতের লেখাও এখনও আগের মতো আছে?”
সোহম বলেছিল, “খারাপের দিকেই গেছে। কিন্তু মনে রাখার ক্ষমতাটা ভালো আছে—তুই যেমন হাসত, সেটা এখনো মনে আছে।”
স্কুলে পৌঁছে তারা যেন এক ধাক্কায় ফিরে গেল পুরোনো সেই দিনগুলোয়। করিডোরটা আগের মতোই, একটু বেশি রংচঙে হয়েছে বটে, কিন্তু সেই জানলার কাচটা এখনও খসে পড়ে, সেই ঘড়িটা এখনও থেমে আছে ১১:৪৫-এ।
তন্ময় এসে জড়িয়ে ধরল সোহমকে, বলল, “এতদিন পরেও তোর মুখে সেই একই বোকা বোকা ভাব!”
সোহম হেসে বলল, “তুইও তো এখনও কবিতা লিখিস। এখন তোর কবিতায় প্রেম আছে নাকি কর্পোরেট হতাশা?”
তন্ময় বলল, “দুটোই মেশানো। এখন তো প্রেমও মাইনে দেখে হয়!”
রিমঝিম সঙ্গে সঙ্গে যোগ করল, “আর বন্ধুত্বের হিসেব চলে লিংকডইনে। তবু দেখ, আমরা এখনও একে অপরকে নম্বর না দেখে চিনতে পারি।”
হাসির ঢেউ উঠল।
সঞ্জনা তখন গেট দিয়ে ঢুকছে। মাথায় একটা হালকা সাদা-কালো প্রিন্টেড শাড়ি, চোখে সেই পুরোনো কাজল। ওকে দেখেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেল সবাই। যেন সময় আটকে গেল।
সঞ্জনা বলল, “তোমরা একটুও বদলায়নি, জানো?”
সোহম বলল, “তুই তো চশমাও বদলায়নি।”
সঞ্জনা হেসে বলল, “আমি ভেতরটাও বদলাইনি। এখনও গল্প লিখি, জানলার ধারে বসে। শুধু গল্পগুলো আর প্রেম নিয়ে নয়, জীবন নিয়ে।”
তারা সবাই মিলে গেল সেই পুরোনো ক্লাসরুমে। বেঞ্চগুলো পাল্টে গেছে, কিন্তু দেয়ালের সেই স্ক্র্যাচ মার্ক এখনও আছে। সোহম আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে বলল, “এইখানেই আমি লিখেছিলাম—‘S + S’।”
সঞ্জনা একটু পিছিয়ে বলল, “আমি জানতাম, লেখাটা তুই করেছিলি। কিন্তু কখনো কিছু বলিনি।”
সোহম একটু থেমে বলল, “আমি ভেবেছিলাম—তুই বুঝিসনি।”
সঞ্জনা বলল, “ভেবেছিলাম—তুই জানলে আর বলবি না।”
তন্ময় হঠাৎ বলল, “আমরা পাঁচজন মিলে একটা বই লেখার কথা বলেছিলাম, মনে আছে?”
রিমঝিম বলল, “‘জানলার ধারে পাঁচজন’?”
অরিত্র, যে একটু আগেই এসেছে, বলল, “আজ এনেছি আমি সেই বইয়ের খসড়া। গত বছর থেকে আঁকা শুরু করেছিলাম। এখন চাই, আমরা সবাই মিলে লেখাটা শেষ করি।”
সে ব্যাগ থেকে একটা মলিন পেঁজা বাঁধাই খাতা বার করল। ভেতরে আঁকা সাদা-কালো স্কেচ, পেন্সিলের দাগ, পাতা জুড়ে পাঁচজনের ছায়া।
সোহম পাতা উল্টে দেখল, তন্ময়ের কবিতা, সঞ্জনার গল্প, রিমঝিমের লেখা কিছু সংলাপ, অরিত্রর আঁকা প্রতিটি অনুভব। এক জায়গায় লেখা—
“তোর সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে বুঝেছি—বন্ধুত্ব মানে একে অপরের ছায়া হওয়া। না থাকলেও অনুভব করা যায়, একদম নিজের মতো করে।”
সঞ্জনা বলল, “চল আমরা এটাকে শেষ করি। এবার আর কেউ না বলে ফেলে রাখব না।”
তন্ময় বলল, “তাহলে বইটার শেষ লাইনটা লিখিস তুই, সোহম।”
সোহম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর কলম হাতে নিয়ে শেষ পাতায় লিখল—
“যদি কোনোদিন জানলার ধারে বসে একা লাগে, মনে করিস—আমরা চারজন পাশে বসে আছি। চুপ করে, কিন্তু ভালোবাসায় ভরা।”
আকাশে তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। স্কুলের মাঠে শিশুরা খেলছে, কিন্তু এই পাঁচজন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল জানলার পাশে।
রিমঝিম ফিসফিস করে বলল, “তোর মনে আছে, আমরা বলেছিলাম—‘শেষ বেঞ্চ মানে পিছিয়ে থাকা নয়’?”
সোহম বলল, “এখন তো বুঝি, শেষ বেঞ্চ মানে হলো সবকিছুর সাক্ষী হওয়া। আর শেষ কথা না বলেও, বুঝিয়ে দেওয়া—কে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”
তারা জানত, আবার ছড়িয়ে যাবে, আবার হাজার দূরত্ব আসবে, হয়তো ফোনে মেসেজও কমবে। কিন্তু এই দিনটা, এই ফিরে দেখা—এটাই থেকে যাবে তাদের সবচেয়ে সত্যি গল্প হয়ে।
পর্ব ৯: একটি অপ্রকাশিত চিঠি
বিকেলটা কুয়াশায় ভেজা ছিল না, অথচ হৃদয়ে জমে ছিল এক অজানা ধোঁয়াশা। নিউ জলপাইগুড়ির সেই পুরোনো স্কুল ভবনের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে অরিত্র তাকিয়ে ছিল মাঠের দিকে, যেখানে এখন ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে। সময় থেমে থাকে না, কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্ত সেই সময়ের ভেতরেই আটকে যায়। সেই মুহূর্তই আজ আবার ফিরে এসেছে, অনেক বছর পর।
বইয়ের খসড়াটা আজও অরিত্রর ব্যাগেই। তারা পাঁচজন একসঙ্গে বসে ঠিক করেছিল, এটা একটা সত্যি বই হবে—নিজেদের জীবন, অনুভব আর হারিয়ে যাওয়ার গল্পে গাঁথা। কিন্তু তার আগেই, অরিত্র সবাইকে বলল, “আজ তোমাদের একটা চিঠি পড়াতে চাই। এটা আমি লিখেছিলাম ক্লাস টেনের দিনগুলোতে, কিন্তু কাউকে কখনও দিইনি।”
তন্ময় বলল, “চিঠি? আমাদের জন্য?”
রিমঝিম একটু অভিভূত হয়ে বলল, “তুই তো কখনও কথা বেশি বলিস না, চিঠিও লেখেছিস?”
সঞ্জনা শান্ত চোখে বলল, “তুই পড়, অরিত্র।”
অরিত্র ব্যাগ থেকে একটা পুরনো খাম বার করল। কাগজটা একটু হলুদ হয়ে গেছে, কোণ ভেঙে গেছে, কিন্তু অক্ষরগুলো ঠিকঠাক রয়ে গেছে। সবাই নীরব, যেন শব্দগুলো নিজেদের মাঝেই আটকে পড়েছে।
অরিত্র পড়তে শুরু করল—
“প্রিয় বন্ধুরা,
যখন তোমরা হাসো, আমি দেখি। যখন তোমরা চুপ করে থাকো, আমি শুনি। যখন কেউ কাউকে ভালোবাসে আর বলতে পারে না, আমি আঁকি। আমার কাজ ছিল দেখে যাওয়া, ধরে রাখা, আর না বলা। তোমরা সবাই কারও না কারও হয়ে উঠেছিলে। আমি কারো হয়ে উঠিনি। তবুও প্রতিটি মুহূর্তে আমি ছিলাম, জানালার ঠিক পাশে, শেষ বেঞ্চে।
সোহম, তুই সবসময় সাহসী ছিলি, তবুও নিজের মনের কথা বলতে পারিসনি। আমি জানি, তোর মুখে না বলা কিছু কথা আজও ঘুরে বেড়ায়। তবুও তুই বন্ধু হিসেবে নিঃস্বার্থ, সেটাই তো সব।
তন্ময়, তোর কবিতা আমার আঁকাকে প্রাণ দিয়েছে। তুই ভাবতে জানিস, কিন্তু অনুভবটা তোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তুই যদি কখনও মন খুলে বলতি, অনেক কিছুর গতি বদলে যেত। তবুও তোর কবিতার ছায়ায় আমি আশ্রয় পেয়েছিলাম।
রিমঝিম, তুই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছ। তোর কথায় আঘাত থাকলেও ভান ছিল না। তুই এমন একজন, যে চোখে চোখ রেখে সত্যি বলার সাহস রাখে। তোর বন্ধুত্ব আমাকে সবসময় একটা নির্ভরতা দিয়েছে।
আর সঞ্জনা…
তুই জানিস না, আমি তোর জন্যই আঁকা শুরু করেছিলাম। তোর গল্পগুলো পড়তে পড়তে আমার পেন্সিল সরে যেত কাগজে। আমি জানতাম, তুই আমাকে পছন্দ করিস না। তুই অন্য কারও দিকে তাকাস, আমি জানতাম। তবুও তুই হাসলে আমার ভিতরটায় আলো পড়ত। আমি কোনোদিন তোর কাছে কিছু চাইনি, শুধু চেয়েছিলাম তুই যেন জানিস, তোকে ভালোবাসা মানে আমার চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখা।
আজ আমরা হয়তো আবার একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু সময় আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। আমি জানি, আমরা আবার দূরে চলে যাব, নতুন জীবন, নতুন দায়িত্ব। কিন্তু এই বন্ধুত্ব, এই প্রেম, এই চিঠি—সবকিছু থেকে যাবে আমার আঁকায়, তোর কবিতায়, তোর গল্পে, তোর মেসেজে।
ভালো থেকো। যদি কখনও মন কাঁদে, মনে রেখো—আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব—তোমাদের গল্পের অব্যক্ত রঙ হয়ে।
ভালোবাসা সহ,
অরিত্র”
চিঠিটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশটা যেন আরও নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কোনো শব্দ করল না, শুধু হাওয়ায় একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়াল।
সঞ্জনা চোখ নামিয়ে বলল, “তুই যখন ভালোবেসেছিলি, তখন কেউ জানত না। আর আজ যখন জানাল, তখন কেউ আর প্রশ্নও করতে পারছে না।”
সোহম বলল, “এই চিঠিটা আমাদের বইয়ের শুরু হওয়া উচিত। কারণ এটা সেই কথাগুলোর স্মারক, যেগুলো বলা হয়নি। কিন্তু অনুভব করা গিয়েছে প্রতিটি পলকে।”
তন্ময় বলল, “এই চিঠিটা পড়ার পর আমি নিজের লেখা আবার নতুন করে ভাবতে চাই।”
রিমঝিম বলল, “আমরা সবাই তোর প্রতি কিছুটা অবিচার করেছি, অরিত্র। তবু তুই সব জেনেও আমাদের ভালোবাসিস, এটাই আমাদের সেরা প্রাপ্তি।”
অরিত্র মাথা নাড়ল, চোখে জল নেই, কিন্তু মুখে একটা শান্তি। সে জানে, এখন যা বলেছে, সেটা আর তার একার অনুভব নয়, এখন সেটা সবার।
পাঁচজন তখন স্কুল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে চিঠিটা। নিচে মাঠে ছোটরা খেলছে, তারা জানেই না—একসময় তারাও এমনই কারও গল্প হবে।
সন্ধের হাওয়া গায়ে এসে লাগছিল। সোহম বলল, “এই শহরটা চুপচাপ, অথচ তার বুকের মধ্যে কত না বলা কথা জমে আছে, জানিস?”
তন্ময় বলল, “আর আমাদের মধ্যে সেই শহরের ছায়া আছে।”
সঞ্জনা চিঠিটা আবার একবার ছুঁয়ে বলল, “তুই যদি তখন দিতি চিঠিটা, হয়তো আমার গল্পগুলো অন্যরকম হতো।”
অরিত্র বলল, “তখন দিলে হয়তো তুই দূরে সরে যেতে, এখন তো তুই পাশে দাঁড়িয়ে শোনলি।”
পাঁচজন তখন বুঝেছিল, জীবনের অনেক কিছু সময়মতো না হলেও, তার মানেই সব শেষ হয়ে যায় না। কিছু কিছু অনুভব, ঠিক সময় খুঁজে নেয় নিজে থেকেই।
পর্ব ১০: জানলার ধারে আমরা রয়ে গেলাম
নিউ জলপাইগুড়ির সেই স্কুলবাড়ি রাতের অন্ধকারে যেন আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। পাঁচজন বন্ধু—সোহম, তন্ময়, রিমঝিম, সঞ্জনা আর অরিত্র—দাঁড়িয়ে ছিল ছাদের এক কোণে, জানলার ধারে। তাদের সামনে কুয়াশায় ঢাকা মাঠ, দূরে ট্রেনের আলো, আর পেছনে পড়ে থাকা শৈশবের গন্ধ।
তারা জানত, কালকের সকালটা আর ফিরবে না। হয়তো কেউ কলকাতা ফিরে যাবে, কেউ শিলিগুড়ি, কেউ ব্যাঙ্গালোরের চাকরিতে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে। হয়তো আবার মাসের পর মাস কথা হবে না, বা হোয়াটসঅ্যাপে “seen” হয়ে রয়ে যাবে “replied না”। তবু আজ রাতটা যেন থেমে ছিল, শুধু তাদের জন্য।
সোহম চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে সঞ্জনা। অনেক না বলা কথা জমে আছে মাঝখানে, তবু এতদিন পরও কথা না বলেই যেন সব বলা হয়ে গেছে।
সোহম বলল, “তুই কি কোনোদিন বুঝেছিলি?”
সঞ্জনা চোখ তুলে তাকাল, তারপর ধীরে বলল, “বুঝেছিলাম। শুধু ভয় পেয়েছিলাম—সব কিছু বদলে যাবে। আমরা যেমন ছিলাম, সেটা আর থাকবে না।”
সোহম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আর এখন?”
সঞ্জনা মৃদু হাসল, “এখন কিছু বদলানোর নেই, কারণ আমরা যা হারিয়েছি, তার থেকেও অনেক বেশি কিছু ধরে রাখতে পেরেছি। এই বন্ধুত্বটা, এই রাতটা, এই ফিরে আসা।”
অন্যদিকে তন্ময় আর রিমঝিম নিচে বসে ছিল পুরোনো বেঞ্চে। তন্ময় নিজের ডায়েরি খুলে দেখাচ্ছিল রিমঝিমকে। সেখানে একটা নতুন কবিতা লেখা—
“আমরা যারা ফিরে যেতে পারি না,
তাদের গল্প থাকে জানলার ধারে।
আমরা যারা কিছু বলি না,
তাদের চোখে জমে থাকে শেষ বিকেলের আলো।
তুই যদি শুনিস, তুই যদি বুঝিস,
জানিস—তোর কাছেই আমি সবচেয়ে সত্যি ছিলাম।”
রিমঝিম চোখ বুজে বলল, “তোর কবিতায় আমার মুখ থাকে রে। আমি জানি না তুই কখন বুঝবি, আমি তোকে ভালোবাসতাম, নিজের মতো করে। কিন্তু আমি জানতাম—তোর মন কারও অন্য জানলায় বসে থাকে।”
তন্ময় চুপ করে গেল। তারপর ধীরে হাতটা রিমঝিমের হাতের উপর রাখল। কিছু না বলেও সব বলে দেওয়া স্পর্শ।
অরিত্র তখন একা জানলার ধারে বসে ছিল। সামনের মাঠে তাকিয়ে, যেন চোখ দিয়ে ছবির খাতা আঁকছে। তার চোখে জল নেই, শুধু একটা প্রশান্তি। যেন বহুদিন পরে সে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে।
তার পেছনে এসে দাঁড়াল সঞ্জনা। বলল, “তুই এখনও আমাদের আঁকিস?”
অরিত্র বলল, “তোমাদের ছাড়া কিছু আঁকতে পারি না।”
সঞ্জনা বলল, “তুই আমার গল্পের প্রথম পাঠক ছিলি, অথচ আমি তোকে কোনোদিন ধন্যবাদও দিইনি।”
অরিত্র তাকাল না, শুধু বলল, “আমি তো চাইনি ধন্যবাদ। আমি শুধু চেয়েছিলাম, আমার জায়গাটুকু তুমি যেন ভুলে না যাও।”
সঞ্জনা মুচকি হাসল, “আমি ভুলিনি। কোনোদিন ভুলবও না।”
আকাশে তখন একটা তারা ঝলকে উঠল। পাঁচজন আবার একসঙ্গে দাঁড়াল। কেউ বলল না কিছু, শুধু একটা ছবি তোলা হল মোবাইলের টাইমার অন করে—পাঁচজন জানলার ধারে, কুয়াশার আলোয় গা ঢাকা মুখগুলো, তবু প্রত্যেকের চোখে এক রকম উজ্জ্বলতা।
সোহম বলল, “এই ছবিটাই হোক আমাদের বইয়ের কভার।”
তন্ময় বলল, “এবং বইয়ের শেষ লাইনে লিখব—‘জানলার ধারে আমরা রয়ে গেলাম’।”
রিমঝিম বলল, “এই শহরটাও আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে, আমরা যখনই ফিরি, তখনই আবার গল্প শুরু হবে।”
সঞ্জনা বলল, “আমাদের প্রেম হোক বা না হোক, এই বন্ধুত্বটাই থাক, চিরকাল।”
অরিত্র বলল, “এই শহরের কুয়াশা জানে, আমরা যে সত্যি ছিলাম।”
তারপর ধীরে ধীরে তারা নিচে নেমে এল। স্কুলের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ছিল দারোয়ান কাকু, যিনি একদিন তাদের খাতার পেছনে সিগনেচার করে দিয়েছিলেন, ক্লাস ফাঁকি দিলে না বলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, আবার রেজাল্টের দিন এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়েছিলেন।
তারা কাকুকে নমস্কার করল।
কাকু হাসল, “তোমরা পাঁচজন এখনো একসঙ্গে? স্কুলটা এখনো বাঁচল তাহলে।”
সোহম বলল, “হ্যাঁ কাকু, আমরা শেষ বেঞ্চে বসা পাঁচজন, এখনো জানলার ধারে রয়ে গেছি।”
সেই রাতে, সবাই নিজ নিজ হোটেল বা বাড়িতে ফিরে গেল। মোবাইলে ভেসে এল সেই ছবিটা। রিমঝিম ক্যাপশন দিল—
“The End is a New Beginning.”
আর সেই ছবির নিচে, প্রথম কমেন্ট করল অরিত্র—
“এই ছবি নয়, এইটাই আমাদের বই।”
কিছু অনুভব কেবল একবার আসে, কিন্তু তাদের প্রতিধ্বনি চিরকাল থাকে। নিউ জলপাইগুড়ির সেই স্কুল, সেই জানলা, সেই পাঁচজন বন্ধু—তারা হয়তো আলাদা হয়ে যাবে জীবনে, কিন্তু কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা জানলার ধারে ঠিক রয়ে যাবে চিরকাল।
কারণ…
শেষ বেঞ্চ মানে পিছিয়ে পড়া নয়।
শেষ বেঞ্চ মানে—সব দেখে ফেলা, সব অনুভব করে ফেলা, আর চুপ করে ভালোবেসে ফেলা।
-সমাপ্ত-




