Bangla - কল্পবিজ্ঞান

নিউরো কলকাতা

Spread the love

তানিয়া বসু


অধ্যায় ১ : নিউরো সিটির স্পন্দন

প্রযুক্তির সোনালী জাল যেন ২০৭৫ সালের কলকাতাকে এক নতুন ছন্দে বেঁধে ফেলেছে। মেঘছোঁয়া টাওয়ারগুলোর কাচের দেয়ালে রাতের নীয়ন আলো ঝিলমিল করে, আকাশপথে ভেসে চলা মেট্রোকারগুলো গঙ্গার ওপারে লালচে চাঁদের প্রতিচ্ছবি কেটে যায়। এই শহরের প্রতিটি মানুষ এখন এক অদৃশ্য নেটওয়ার্কের অংশ—মস্তিষ্কের ভেতর স্থায়ীভাবে বসানো নিউরো-লিঙ্ক চিপ তাদের চিন্তা, অনুভূতি, কাজকর্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ব্যাংকের পাসওয়ার্ড থেকে প্রিয় গানের প্লেলিস্ট, অফিস মিটিং থেকে ঘরের দরজার লক—সব কিছু এক নিমিষে মস্তিষ্কের সিগন্যালেই নিয়ন্ত্রিত। প্রযুক্তির এই মহোৎসবে কলকাতা যেন হয়ে উঠেছে “নিউরো সিটি”—এক এমন মহানগর, যেখানে বাস্তব আর ভার্চুয়াল একে অপরের সীমানা মুছে ফেলেছে। কিন্তু এই চকচকে আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। শহরের পুরনো গলিগুলোর পাথরচাপা পথের নীচে এখনো টিকে আছে শতাব্দীর পুরনো অন্ধকার, আর সেই অন্ধকারের ভেতরেই যেন ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে এক অচেনা সন্ত্রাস। সেদিন রাত থেকেই অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো শুরু হয়েছিল—প্রথমে ছোটখাটো ভুলে যাওয়া, তারপর হঠাৎ করেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি উধাও হয়ে যাওয়া। কেউ সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে নিজের নাম মনে করতে পারছে না, কেউ বা গতরাতের খাবার কার সঙ্গে খেয়েছিল সেটাই ভুলে গেছে। হাসপাতালগুলোর নিউরো-সার্ভারগুলো একের পর এক সংকেত পাঠাচ্ছে, অথচ কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে কোনো ত্রুটির নথি নেই। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি নিঃশব্দে মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে ঢুকে পড়ছে, স্মৃতির পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

এই রহস্যময় অস্থিরতার মাঝেই পেশাদার সাংবাদিক রোহিণী দত্ত প্রথম বুঝতে পারলেন ঘটনাটা শুধু প্রযুক্তিগত কোনো সিস্টেম-ত্রুটি নয়। ত্রিশের কোঠায় পা রাখা রোহিণী শহরের অন্যতম শীর্ষ ডিজিটাল নিউজপোর্টাল ইনফোপালস-এর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। নিউরো-লিঙ্কের প্রাথমিক ট্রায়াল থেকেই তিনি এ প্রযুক্তির সম্ভাবনা আর বিপদের দিকগুলো নিয়ে লিখে আসছেন। প্রযুক্তির গোপন ফাঁদ নিয়ে তাঁর ধারালো প্রতিবেদন ইতিমধ্যেই তাকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে দিয়েছে। সেই রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে যখন তিনি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটছিলেন, তখনই তাঁর চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। রাস্তায় হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়েছে এক তরুণী; তার চোখ ফাঁকা, ঠোঁট কাঁপছে, যেন কোনো গভীর স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করছে অথচ পারছে না। কয়েক সেকেন্ড পর মেয়েটি হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে—“আমি কে?” আশেপাশের মানুষজন ভয়ে সরে দাঁড়ায়, কিন্তু কেউ কাছে যেতে সাহস করে না। রোহিণী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নিউরো-লিঙ্কের ইমার্জেন্সি স্ক্যান চালান, কিন্তু স্ক্রিনে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে না। এর আগের দিনই তিনি খবর পেয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এক বৃদ্ধ অধ্যাপক নাকি নিজের পরিবারের সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে বসেছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন এটি হয়তো কোনো আলঝাইমার জাতীয় রোগের নতুন রূপ, কিন্তু এত দ্রুত এতজন মানুষের স্মৃতিহীনতা চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো স্বাভাবিক ব্যাখ্যায় মেলে না। তাঁর সাংবাদিকসুলভ প্রবল কৌতূহল তাকে একের পর এক সূত্র খুঁজে বের করতে বাধ্য করে।

রোহিণীর মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল—কে বা কারা এই অদৃশ্য আক্রমণের পেছনে? শহরের নিউরো-সার্ভারের সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় দুর্ভেদ্য, সেখানে হ্যাক করা প্রায় অসম্ভব। তবু কি কোনো অজানা হ্যাকার নতুন প্রজন্মের কোয়ান্টাম ভাইরাস ব্যবহার করছে? নাকি নিউরো-লিঙ্কের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন কোনো ত্রুটি, যা প্রকাশ্যে আসলে পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে? সাংবাদিকতার পেশাগত স্পৃহা তাঁকে আরও গভীরে টেনে নিল। তিনি ঠিক করলেন, এই অদ্ভুত ঘটনাগুলোর নেপথ্যে যে রহস্য লুকিয়ে আছে, তা উন্মোচন করতেই হবে। সেই রাতে নিজের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে তিনি নিউরো-ডিভাইস খুলে ফেললেন, যেন তার মস্তিষ্কে কোনো গুপ্ত সংকেত প্রবেশ না করতে পারে। বাইরে তখন ধোঁয়াটে কুয়াশায় ঢাকা আকাশে মৃদু নীল আলো ছড়াচ্ছে শহরের বিজ্ঞাপন ড্রোনগুলো, গঙ্গার ধার থেকে আসছে অচেনা সাইরেনের শব্দ। রোহিণী জানলেন, কলকাতা হয়তো এমন এক ভোরের দিকে এগোচ্ছে যেখানে মানুষের সবচেয়ে ব্যক্তিগত সম্পদ—স্মৃতি—কেবল নিজের থাকবে না, কোনো অদৃশ্য হ্যাকার হয়তো ইতিমধ্যেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। তাঁর বুকের ভেতর ধুকপুক করা হৃদস্পন্দনের সঙ্গে যেন পুরো নিউরো সিটির স্পন্দন একাকার হয়ে গেল।

অধ্যায় ২ : স্মৃতির ভাঙাচোরা মানচিত্র

কলকাতার ব্যস্ত সকালেও যেন অদৃশ্য এক অস্বস্তি ভেসে বেড়াচ্ছে। নীয়ন আলো মাখা মেগাস্ক্রিনগুলোতে হাস্যোজ্জ্বল বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি চলছে সরকারি বার্তা—“নিউরো-লিঙ্ক সুরক্ষিত, আতঙ্কিত হবেন না।” অথচ রাস্তাঘাটে মানুষের মুখে অদ্ভুত শূন্যতা। রোহিণী দত্ত তার কাঁধে হোলোগ্রাফিক ক্যামেরা ঝুলিয়ে একের পর এক সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, আর প্রতিটি গল্পই যেন নতুন এক শীতল আতঙ্কের দরজা খুলে দিচ্ছে। পার্ক সার্কাসের এক তরুণী বলল, গতকাল হঠাৎ করেই সে নিজের কলেজজীবনের প্রেমিককে মনে করতে পারছে না—সেই মানুষটির হাসি, কণ্ঠস্বর, এমনকি নামটাও তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেছে। অন্যদিকে বেলেঘাটার এক মধ্যবয়স্ক ট্যাক্সি চালক কাঁপা গলায় জানালেন, জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন—তার মেয়ের জন্মদিন উদযাপনের স্মৃতি—পুরোপুরি অদৃশ্য। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল কলেজ স্ট্রিটের এক বই বিক্রেতার ঘটনা। তিনি দাবি করলেন, গত দুই দিন ধরে তার মাথার ভেতর এমন কিছু স্মৃতি জন্ম নিচ্ছে যা কখনোই ঘটেনি। তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না, কোনটা সত্যি আর কোনটা কেবল মস্তিষ্কে প্রোথিত এক মিথ্যা কাহিনি। রোহিণীর অভিজ্ঞ সাংবাদিক সত্তা বুঝতে পারল, এখানে কোনো এলোমেলোতা নেই; প্রতিটি হারানো বা গড়া স্মৃতি ব্যক্তিগত ও গোপনীয়, যেন কেউ সচেতনভাবে মানুষের জীবনের অন্তঃস্থল থেকে এমন তথ্য বেছে নিচ্ছে যা তাদের অস্তিত্বের মূলে আঘাত হানে। স্মৃতি মুছে যাওয়া যেমন ভয়ংকর, তেমনই ভয়ংকর নতুন স্মৃতির জন্ম, কারণ তা মানুষকে নিজের বাস্তবতা নিয়ে সন্দিহান করে তোলে।

রোহিণী যখন এই সাক্ষাৎকারগুলো রেকর্ড করছিলেন, তখন লক্ষ্য করলেন নিউরো সিটি কর্পোরেশনের মনিটরিং ড্রোনগুলো অস্বাভাবিকভাবে চারপাশে চক্কর কাটছে। প্রতিটি সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাক্ষাৎকারদাতারা যেন আচমকা অনুতপ্ত হয়ে পড়ছেন। পার্ক সার্কাসের তরুণীটি তাড়াহুড়ো করে জানালেন যে, সে আর কিছু বলতে চায় না; বেলেঘাটার ট্যাক্সিচালক ফোন ধরতেই অজানা এক ভয় নিয়ে পিছিয়ে গেলেন। কলেজ স্ট্রিটের বই বিক্রেতা হঠাৎ করেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দোকানের দরজা নামিয়ে দিলেন। রোহিণীর মনে হলো, কেউ যেন অদৃশ্যভাবে এই নাগরিকদের মস্তিষ্কে হস্তক্ষেপ করছে, হয়তো নিউরো-লিঙ্কের সিগন্যালের ভেতর লুকিয়ে থেকে সতর্কতা পাঠাচ্ছে। শহরের ডিজিটাল বোর্ডগুলোতে চলতে থাকা আশ্বাসমূলক বার্তাগুলো আরও সন্দেহ জাগাচ্ছিল—“সকল নিউরো-লিঙ্ক সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। গুজবে কান দেবেন না।” কিন্তু রোহিণী জানতেন, এই ঘটনাগুলো কোনো গুজব নয়। তার নিজের রেকর্ড করা ফুটেজগুলোর কয়েকটি অজানা কারণে ঝাপসা হয়ে গেছে, যেন ডিভাইসের ভেতরেই কেউ ঢুকে গিয়ে ডেটা বিকৃত করেছে। ইনফোপালসের সাইবার টিমে পাঠানো এক নমুনা ফাইলও সার্ভারে আপলোডের মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর পেছনে কারা কাজ করছে তা অনুমান করা কঠিন, কিন্তু ঘটনাগুলো এক নিখুঁত পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। শহরের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রশাসনিক সংস্থা নিউরো সিটি কর্পোরেশনই হয়তো এই অদৃশ্য আক্রমণের আসল তথ্য গোপন করছে। তারা প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমের কাছে একই ব্যাখ্যা দিচ্ছে—“কিছু বিচ্ছিন্ন সিস্টেম গ্লিচ, যা দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে।” অথচ শহরের হাসপাতাল, স্কুল, ব্যাংক সবখানেই একই ধরণের স্মৃতিহীনতার ঘটনা বাড়ছে।

এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রোহিণীর নিজের মনের ভেতরেও দ্বন্দ্ব বাড়তে লাগল। সাংবাদিকের নৈতিক দায়বদ্ধতা তাকে সত্য উন্মোচনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কিন্তু শহরের অদৃশ্য নজরদারি তাকে বারবার সতর্ক করছে। রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনি লক্ষ্য করলেন, তার নিউরো-লিঙ্কের নোটিফিকেশন প্যানেলে হঠাৎ করে অচেনা এক বার্তা দেখা যাচ্ছে—“তুমি যত বেশি জানবে, তত বেশি হারাবে।” এই বার্তাটি কোনো সরকারি নেটওয়ার্কের অংশ নয়, অথচ ডিভাইসের ভেতর ঢুকে থাকা ছাড়া এটি দেখা সম্ভব নয়। বুকের ভেতর ধকধক করতে লাগল। তিনি তৎক্ষণাৎ লিঙ্কটি অফলাইনে নিয়ে গেলেন, কিন্তু ভাবনার ভেতর ঢুকে পড়ল এক অদ্ভুত শীতলতা। যদি এই অদৃশ্য হ্যাকার শুধু মানুষের স্মৃতি নয়, তাদের চিন্তার মানচিত্রও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে? যদি আজকের সাক্ষাৎকারগুলোর মতো কাল তিনি নিজেও নিজের অতীত নিয়ে বিভ্রান্ত হন? গঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন রোহিণী, আকাশে জ্বলজ্বল করছে হাজারো ড্রোনের আলো, শহরের কোলাহলের ভেতরেও কেমন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। মনে হলো, পুরো কলকাতা যেন এক বিশাল নিউরো-মস্তিষ্কে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি স্মৃতি একেকটি ডেটা পয়েন্ট—আর সেই ডেটার মানচিত্র ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, এই স্মৃতির ভাঙাচোরা মানচিত্রের আসল সূত্র তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

অধ্যায় ৩ : কোডের অচেনা ছাপ

রোহিণীর ডেস্কের চারপাশে রাত তখন নিঃশব্দ, শুধু হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের নীলচে আলো তার চোখে ছায়া ফেলছে। ইনফোপালস অফিসের সাইবার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে বসে তিনি গত কয়েকদিনের সমস্ত সাক্ষাৎকার ও ঝাপসা হয়ে যাওয়া ফুটেজ পুনরায় পরীক্ষা করছিলেন। নিউরো সিটি কর্পোরেশনের “সিস্টেম গ্লিচ” তত্ত্বের সঙ্গে মাঠের বাস্তবতার তফাৎ তাকে ক্রমশ অস্থির করে তুলছিল। ডেটা বিশ্লেষণের সময় তিনি লক্ষ্য করলেন, মুছে যাওয়া ফাইলগুলোর মেটাডেটায় একটি অচেনা এনক্রিপশন কোড লুকিয়ে আছে—একটি অদ্ভুত বাইট প্যাটার্ন যা কোনো স্বীকৃত প্রোটোকলের সঙ্গে মেলে না। তার চোখে পড়ল এক অদ্ভুত সিগনেচার: “নির্বাণ/07x”. প্রথমে ভেবেছিলেন এটি হয়তো সিস্টেমের কোনো এলোমেলো গ্লিচ, কিন্তু কোডের ধারাবাহিকতায় এমন কিছু গাণিতিক রিদম ছিল যা একজন মানুষের পরিকল্পিত কাজ ছাড়া সম্ভব নয়। সন্দেহ বাড়তেই তিনি ডার্ক নেটের আন্ডারগ্রাউন্ড হ্যাকার ফোরামগুলো খুঁজতে শুরু করলেন—এক এমন ডিজিটাল অন্ধকার যেখানে প্রবেশ করাই আইনত নিষিদ্ধ, অথচ সেখানেই লুকিয়ে থাকে সবচেয়ে অদ্ভুত সত্য। কয়েক ঘন্টার অবিরাম অনুসন্ধানের পর তিনি প্রবেশ করলেন মাইন্ডমার্ক নামের এক গোপন ফোরামে। সেখানে অসংখ্য হ্যাকার ছদ্মনামে নিজেদের সাফল্যের গল্প শেয়ার করছে, কেউ বা শহরের নিউরো-সার্ভার ভেঙে ফেলার স্বপ্ন দেখছে। ঠিক সেখানেই তিনি খুঁজে পেলেন সেই অচেনা ছাপ—ছদ্মনাম “নির্বাণ।”

“নির্বাণ”-এর পোস্টগুলো অন্যসব হ্যাকারদের সাধারণ টেকনিক্যাল কথাবার্তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কোনো কোড ব্রেকিং টিউটোরিয়াল বা হ্যাকিং টুলের বিবরণ নয়, বরং এক ধরনের দার্শনিক বার্তা, যা একই সঙ্গে সতর্কবাণী ও চ্যালেঞ্জের মতো শোনায়। একটি পোস্টে শুধু লেখা ছিল—“স্মৃতি হলো স্বাধীনতার শেষ দুর্গ। প্রস্তুত হও।” অন্য একটি বার্তায় আবার বলা হয়েছে, “যত বেশি স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করবে, তত বেশি হারাবে নিজের সত্তা।” এই বাক্যগুলো পড়ে রোহিণীর শরীরের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগল। শহরের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো—মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতি মুছে যাওয়া বা নতুন করে জন্ম নেওয়া—এই বার্তাগুলোর সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই “নির্বাণ” হয়তো শুধু একজন হ্যাকার নয়, বরং এমন এক সত্তা, যে কোডের ভেতর দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে। কিন্তু সমস্যা হলো, নির্বাণ মানুষ নাকি কোনো স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রাম, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তার প্রোফাইল ছবিতে শুধু এক অস্পষ্ট নীল বৃত্ত, যার ভেতর ক্রমাগত ঢেউয়ের মতো কম্পন ছড়াচ্ছে—যেন কোনো নিউরো সিগন্যালের ভিজ্যুয়ালাইজেশন। রোহিণী ফোরামের অন্যান্য সদস্যদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন, কিন্তু যতবার তিনি নির্বাণের থ্রেডে প্রবেশ করছেন, ততবারই তাঁর স্ক্রিনে অচেনা সাউন্ড প্যাটার্ন ভেসে উঠছে, যা সাধারণ এনক্রিপশন নয় বরং একধরনের ব্রেনওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সির মতো। মনে হচ্ছিল, কেউ বা কিছু যেন সরাসরি তার নিউরো-লিঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে।

অস্বস্তি আরও গভীর হলো যখন রোহিণী দেখলেন, নির্বাণের সর্বশেষ পোস্টটি কয়েক সেকেন্ড আগেই আপলোড হয়েছে—“রোহিণী, তোমার অনুসন্ধান ঠিক পথে। কিন্তু সতর্ক থেকো, শহরের প্রকৃত শত্রু তোমার কল্পনার বাইরে।” তিনি শিউরে উঠলেন। ফোরামে নিজের নাম প্রকাশ করেননি, এমনকি ছদ্মনামে লগ ইন করেছিলেন, তবু নির্বাণ কীভাবে তাঁর পরিচয় জানল? তিনি তাড়াতাড়ি সিস্টেম লগ পরীক্ষা করলেন, কিন্তু কোনো উৎস ধরা গেল না। মনে হলো, তার প্রতিটি ক্লিক, প্রতিটি চিন্তা যেন কারও নজরে রয়েছে। বাইরের আকাশ তখন গাঢ় বেগুনি, নিউরো সিটির মেগাস্ক্রিনে বিজ্ঞাপন ড্রোনের আলোয় ঝলমল করছে নদীর ধারে হাইওয়ে। রোহিণী জানলেন, এই রহস্য কেবল প্রযুক্তিগত নয়, এর ভেতর লুকিয়ে আছে মানব স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ। যদি স্মৃতি সত্যিই স্বাধীনতার শেষ দুর্গ হয়, তবে নির্বাণ সেই দুর্গে ঢুকে পড়েছে। তিনি ঠিক করলেন, যত বিপদই থাকুক, এই অচেনা কোডের ছাপ অনুসরণ করতেই হবে—কারণ হয়তো নির্বাণের মেসেজের মধ্যেই রয়েছে শহরের ক্রমবর্ধমান স্মৃতি হারানোর আসল চাবিকাঠি।

অধ্যায় ৪ : সিলভার নেটওয়ার্কের গোপন দরজা

কলকাতার রাত তখন এক অদ্ভুত নীরবতায় ঢেকে আছে, যেন পুরো শহর অপেক্ষা করছে কোনো অজানা বিস্ফোরণের জন্য। ইনফোপালস অফিস থেকে বেরিয়ে রোহিণী সোজা চলে এল পার্ক স্ট্রিটের এক পুরনো ক্যাফেতে, যেখানে তার শৈশবের বন্ধু অর্ণব গোপনে দেখা করতে ডেকেছিল। অর্ণব একজন শীর্ষ নিউরো-ইঞ্জিনিয়ার, সরকারের নিউরো-লিঙ্ক উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করার সুবাদে সে এমন অনেক তথ্য জানে যা সাধারণ নাগরিকদের কল্পনার বাইরে। ক্যাফেটি ছিল অন্ধকার, কেবল কয়েকটি টেবিলে নীল আলো ছড়াচ্ছিল ছোট ছোট হোলোগ্রাফিক মেনু। অর্ণবের মুখে অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট—চোখে ঘন ক্লান্তি, ঠোঁটে চাপা উত্তেজনা। কফির মগ নামিয়ে রেখে সে ফিসফিস করে বলল, “রোহিণী, যে স্মৃতিহীনতার ঘটনা তুমি খুঁজছ, তার উত্তর লুকিয়ে আছে নিউরো সিটির সিলভার নেটওয়ার্কে। সরকারের অফিসিয়াল কোডের ভেতর এমন একটি ব্যাকডোর রয়েছে, যা সাধারণ প্রযুক্তিবিদরা কখনো খুঁজে পাবে না। এই গোপন দরজা দিয়ে যেকোনো মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করা সম্ভব।” রোহিণীর বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে গেল। সিলভার নেটওয়ার্ক—এটি নিউরো-লিঙ্কের মূল অবকাঠামো, যেটি নাগরিকদের চিপ থেকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সার্ভারে ডেটা পাঠায়। অর্ণব জানাল, ব্যাকডোরটির নকশা এত নিখুঁত যে কেউ চাইলে নির্দিষ্ট স্মৃতি মুছে ফেলতে বা নতুন স্মৃতি প্রোথিত করতে পারবে, অথচ আক্রান্ত ব্যক্তি টেরও পাবে না।

রোহিণী বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। “কিন্তু এই ব্যাকডোর তৈরি করল কে?”—তার কণ্ঠে কাঁপুনি। অর্ণব গম্ভীর মুখে বলল, “সরকারি নথিতে এর কোনো উল্লেখ নেই। অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট টিমের কেউই এর উৎস জানে না। আমার অনুমান, এটি প্রকল্পের শুরুর দিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, হয়তো সিকিউরিটি টেস্টিং-এর নামে। কিন্তু এর কোড সিগনেচার সম্পূর্ণ ভিন্ন—যেন কোনো বহিরাগত বা স্বয়ংক্রিয় এআই এটি তৈরি করেছে।” সে আরও যোগ করল, “আমি যখন সিলভার নেটওয়ার্কের কোর কোড পরীক্ষা করছিলাম, তখন এক রহস্যময় এনক্রিপশন লেয়ার খুঁজে পাই, যার ভেতর একই বার্তা ঘুরছে: Freedom is Memory।” রোহিণীর মনে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল আন্ডারগ্রাউন্ড ফোরামের সেই ছদ্মনাম—“নির্বাণ”—এবং তার বার্তা, “স্মৃতি হলো স্বাধীনতার শেষ দুর্গ।” যেন একই সুর ভিন্ন ভাষায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অর্ণব জানাল, এই গোপন দরজার কোড এমনভাবে লেখা যে এটি শুধুমাত্র একটি বিশেষ কী ব্যবহার করে সক্রিয় করা সম্ভব, আর সেই কী যে কারও হাতে চলে গেলে পুরো শহরের নিউরো-লিঙ্কের নিরাপত্তা ধ্বংস হয়ে যাবে। রোহিণীর মনে অদ্ভুত এক ভয় জন্ম নিল—হয়তো নির্বাণ সেই কী খুঁজে পেয়েছে এবং এখন এই ব্যাকডোর ব্যবহার করে মানুষের স্মৃতি নিয়ে খেলছে।

ক্যাফের বাইরে তখন ধোঁয়াটে কুয়াশা গা ঘেঁষে নামছে, রাস্তার ওপারে মেগাস্ক্রিনে সরকারের নতুন বার্তা ঝলকাচ্ছে—“নিউরো-লিঙ্ক সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। গুজবে কান দেবেন না।” অথচ রোহিণীর চোখে সেই আশ্বাস এখন কেবল এক প্রহসন। তিনি জানলেন, এই ব্যাকডোরের অস্তিত্ব প্রকাশ পেলে সরকার এবং কর্পোরেশনের সমগ্র ক্ষমতার কাঠামো ভেঙে পড়বে। অর্ণব সতর্ক করল, “তুমি যদি এ বিষয়ে প্রতিবেদন করো, তারা তোমাকে চুপ করিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। নিউরো সিটির প্রতিটি ক্যামেরা, প্রতিটি চিপ তোমাকে নজরে রাখছে।” কিন্তু রোহিণীর সাংবাদিকসুলভ প্রবৃত্তি এই বিপদের মধ্যেও তাকে পিছু হটতে দিল না। তার মাথার ভেতর নির্বাণের শব্দ ঘুরতে লাগল—“প্রস্তুত হও।” সে অনুভব করল, এই ব্যাকডোর শুধু একটি প্রযুক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং মানুষের স্বাধীনতা আর ব্যক্তিসত্তাকে ধ্বংস করার এক মারাত্মক ফাঁদ। গঙ্গার ওপার থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় যেন সিলভার নেটওয়ার্কের অদৃশ্য স্পন্দন ধ্বনিত হচ্ছিল, আর সেই অচেনা দরজার প্রতিধ্বনি তার মনের ভেতর ধীরে ধীরে এক অপ্রতিরোধ্য সংকল্প জাগিয়ে তুলছিল—কোনোভাবে তাকে এই রহস্যের উৎস খুঁজে বের করতেই হবে।

অধ্যায় ৫ : প্রাচীন কলকাতার ছায়া

রোহিণীর অনুসন্ধান এবার তাকে নিয়ে গেল এক অচেনা কলকাতায়—যে শহরের অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে নীয়ন আলো আর আকাশছোঁয়া টাওয়ারের আড়ালে। নির্বাণ ও সিলভার নেটওয়ার্কের গোপন ব্যাকডোরের সূত্র খুঁজতে গিয়ে তিনি প্রথম পৌঁছলেন শিয়ালদহের পুরনো বিদ্যুৎঘাটে, যেখানে একসময় ব্রিটিশ আমলের পাওয়ার সাবস্টেশন ছিল। শতাব্দী প্রাচীন লোহার খুঁটি আর মরচে ধরা কেব্‌লের ভেতর দিয়ে এখনো বয়ে চলেছে অচেনা স্পন্দন। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই ধুলো ধরা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল পুড়ে যাওয়া তামার তারের গন্ধ, কোথাও কোথাও মৃদু ঝিরঝির শব্দ, যেন শহরের অতীত নিজেই গোপন সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। এই পরিত্যক্ত স্টেশনের গোপন কক্ষে রোহিণী আবিষ্কার করলেন এক অদ্ভুত নেটওয়ার্ক হাব—একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সার্ভার, যা সরকারি নথিতে নেই। পুরনো দেয়ালে হোলোগ্রাফিক গ্রাফিতি জ্বলজ্বল করছে—“Memory Is Freedom”—নির্বাণের বার্তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। সার্ভারের ড্যাশবোর্ডে চোখ বুলিয়ে তিনি বুঝলেন, এখানে এমন ডেটা সংরক্ষণ করা হয়েছে যা সরকারের মেইনফ্রেম থেকেও আলাদা। তার মনে প্রশ্ন জাগল—কে বা কারা এই স্টেশন গড়ে তুলেছে এবং এতদিন গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে? গঙ্গার দিকে বেরোনো এক ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলে তিনি দেখতে পেলেন পুরনো আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল, যা শহরের সেন্ট্রাল সাবওয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই অন্ধকার টানেলের দেয়ালে অস্পষ্ট কোড খোদাই করা, প্রতিটি লাইনের নিচে অদৃশ্য স্ক্যানারের মতো নীল আলো জ্বলছে। মনে হচ্ছিল, এই টানেল শুধু শহরের প্রাচীন বিদ্যুৎব্যবস্থার অংশ নয়, বরং এক বিশাল ডিজিটাল গোলকধাঁধার প্রবেশপথ।

টানেলের গভীরে নামতেই তিনি একদল মানুষের সামনে পড়লেন, যারা নিজেদের পরিচয় দিল “স্মৃতি রক্ষক” নামে। মাঝবয়সী, ধূসর চুলের প্রোগ্রামারদের দলটি অন্ধকার ঘরে বসে পুরনো সার্ভার টার্মিনাল চালাচ্ছিল। তাদের পোশাকে প্রযুক্তির ছাপ নেই, কিন্তু চোখেমুখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। দলের নেতা অদ্বৈত নামের এক প্রবীণ প্রোগ্রামার ধীরে ধীরে বললেন, “আমরা একসময় সরকারের নিউরো-লিঙ্ক প্রকল্পের প্রাথমিক ডেভেলপার ছিলাম। তখন ভেবেছিলাম মানুষের জীবনে সুবিধা আনব, কিন্তু প্রকল্পের ভেতরে যে গোপন কোড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আবিষ্কার করার পর আমরা বুঝতে পারি—এটি কেবল প্রযুক্তি নয়, মানুষের মনের স্বাধীনতা দখলের ষড়যন্ত্র।” অদ্বৈত জানালেন, সিলভার নেটওয়ার্কের ব্যাকডোর কোনো সাধারণ সিকিউরিটি লুপহোল নয়, বরং সরকারের ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি। “প্রথম দিন থেকেই সরকারের আসল উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের স্মৃতি সংগ্রহ করে একটি কেন্দ্রীয় ডেটা আর্কাইভ তৈরি করা। মানুষ যত বেশি নিউরো-লিঙ্কের উপর নির্ভরশীল হবে, তত সহজ হবে তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করা।” স্মৃতি রক্ষকরা এই ষড়যন্ত্র থামাতে নিজেদের আন্ডারগ্রাউন্ড সার্ভার তৈরি করেছে, যেখানে মানুষের প্রকৃত স্মৃতির ব্যাকআপ গোপনে সংরক্ষণ করা হয়। তাদের মতে, নির্বাণ হয়তো এই লড়াইয়ের অদৃশ্য সৈনিক, যে সরকারের তৈরি ব্যাকডোরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইছে।

রোহিণী মনোযোগ দিয়ে অদ্বৈতের কথা শুনছিলেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল তিনি যেন এক আধুনিক পৌরাণিক কাহিনির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন। আকাশের ওপরে চকচকে নিউরো সিটি, আর মাটির নীচে এই ছায়াশহর—দুটি বাস্তবতা একে অপরকে ছেদ করে চলেছে। স্মৃতি রক্ষকদের সার্ভার কক্ষে ঝলমল করা পুরনো ডেটা ক্যাবলগুলো যেন অতীত ও ভবিষ্যৎকে এক সুতোর মধ্যে বেঁধে রেখেছে। অদ্বৈত তাঁকে সতর্ক করে বললেন, “তুমি যদি এই সত্য প্রকাশ করো, সরকার শুধু তোমাকে নয়, পুরো নেটওয়ার্ককেই ধ্বংস করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে। ব্যাকডোরের কোড যতদিন সক্রিয় থাকবে, মানুষের ব্যক্তিসত্তা ততদিন বিপন্ন থাকবে।” গঙ্গার দিকে মুখ করে থাকা ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রোহিণী দেখলেন, নদীর কালো জলে প্রতিফলিত হচ্ছে নিউরো সিটির ঝলমলে আকাশরেখা—উপরের কৃত্রিম আলো আর নীচের গোপন ছায়া যেন দুই ভিন্ন জগতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাঁর মনের মধ্যে জন্ম নিল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—এই সত্য কি তিনি প্রকাশ করবেন, নাকি স্মৃতি রক্ষকদের মতো নীরবে লড়াই চালিয়ে যাবেন? কিন্তু নির্বাণের রহস্যময় বার্তা আবার মনে পড়ল—“প্রস্তুত হও।” সেই শব্দ যেন গঙ্গার বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আর রোহিণী অনুভব করলেন যে প্রাচীন কলকাতার এই ছায়া শুধু অতীতের অবশেষ নয়, ভবিষ্যতের মুক্তির পথও হতে পারে।

অধ্যায় ৬ : মিথ্যা পরিচয়ের জাল

রাতের শেষ প্রহরে, যখন নিউরো সিটির আকাশে ক্রমশ ম্লান হয়ে আসা নীল আলোতে ভেসে উঠছিল সিলভার নেটওয়ার্কের ঝিলিক, রোহিণী তখন অর্ণবের গোপন ল্যাবে বসে অনির্দিষ্ট তথ্যের সমুদ্র ঘেঁটে যাচ্ছিল। পর্দার ওপারে হঠাৎ এক অচেনা ফাইল খুলে গেল—নির্বাণের একাধিক ছদ্মনামের নিচে এক বিস্ময়কর সত্যের খণ্ডচিত্র। ফাইলের ভেতর লুকিয়ে ছিল পুরোনো সরকারি নথি, পরীক্ষামূলক কোড, এবং একটি মৃত বলে ঘোষিত মানুষের রেকর্ড—ড. অনিরুদ্ধ সেন। নিউরো প্রকল্পের প্রাথমিক ডিজাইনার এবং মানব-স্মৃতি সংযোগের মূল স্থপতি এই অনিরুদ্ধকেই কয়েক বছর আগে রহস্যজনক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া বলে জানানো হয়েছিল। অথচ ডিজিটাল ডিএনএ স্ক্যান, পুরোনো ইমেইল লগ, এমনকি কোডিং স্টাইলের জটিল অ্যালগরিদম বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে দিল—নির্বাণ আর অনিরুদ্ধ একই সত্তা। রোহিণীর চোখে এক মুহূর্তের জন্য বাস্তব ও অবাস্তবের সীমারেখা ঘোলা হয়ে গেল। যে মানুষটিকে সরকার মৃত বলে ঘোষণা করেছিল, সে কি আসলে নিজের মৃত্যুকেই একটি ছদ্মনাম বানিয়ে বেঁচে ছিল? আর যদি বেঁচেই থাকে, তবে এই সমগ্র স্মৃতি হ্যাকিং অভিযানের উদ্দেশ্য কি শুধুই মানুষকে সতর্ক করা, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কোনো অভিসন্ধি?

অর্ণব ধীরে ধীরে রোহিণীর কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ, এর মানে কী?” রোহিণী পর্দার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এর মানে সরকার শুরু থেকেই জানত, কিন্তু সত্য আড়াল করেছে।” অর্ণব ব্যাখ্যা করল যে, নিউরো চিপে ব্যবহৃত বেস কোডের অনেকগুলো লাইন কেবলমাত্র অনিরুদ্ধই লিখেছিল, আর সেই কোডের ভেতর লুকিয়ে ছিল একটি ব্যাকডোর—যা পরে সিলভার নেটওয়ার্কের গোপন দরজা হয়ে ওঠে। এই ব্যাকডোরই আজ শহরের স্মৃতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান অস্ত্র, অথচ সরকার প্রকাশ্যে সব দায় চাপিয়েছে অজানা হ্যাকার নির্বাণের ওপর। রোহিণীর মনে পড়ল নির্বাণের মেসেজ—“স্মৃতি হলো স্বাধীনতার শেষ দুর্গ। প্রস্তুত হও।” হয়তো অনিরুদ্ধ চেয়েছিলেন মানুষকে সতর্ক করতে, দেখাতে যে প্রযুক্তির অন্ধ বিশ্বাস কেমন করে নিজেদের মস্তিষ্ককেই পরাধীন করে ফেলতে পারে। কিন্তু কেন এত ভয়াবহ উপায়ে? কেন মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতি চুরি করে তিনি বার্তা দিচ্ছেন? অর্ণবের কণ্ঠে আতঙ্ক ফুটে উঠল, “হয়তো সে কেবল সতর্ক করতে নয়, প্রতিশোধ নিতেও নেমেছে। সরকার যে দিন তাকে মুছে দিয়েছিল, সেদিন থেকে ওর নিজের স্মৃতিই হয়তো সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্র।”

ল্যাবের চারপাশে তখন নীরবতার গাঢ় আবরণ নেমে এসেছে, কেবল মেশিনের অবিরাম গুঞ্জন আর দূরের গঙ্গার ঢেউয়ের ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রোহিণী জানত, এই আবিষ্কার কেবল শহরের জন্য নয়, তার নিজের জীবনেরও এক অমোঘ মোড়। অনিরুদ্ধ সেন বেঁচে আছেন—এটা প্রমাণ করা মানেই সরকারের মুখোশ উন্মোচন, নিউরো সিটির সমগ্র কাঠামোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া। কিন্তু ততক্ষণে অনিরুদ্ধের ছায়া যেন আরও জটিল হয়ে উঠছে; শহরের বিভিন্ন টাওয়ারে নতুন নতুন স্মৃতি হারানোর রিপোর্ট আসছে, মানুষের মস্তিষ্কে অচেনা স্মৃতি জন্মাচ্ছে, আর সবকিছুর সূত্রপাত যেন এক অদৃশ্য সুতোর টানে রোহিণীর দিকেই এগিয়ে আসছে। নিজের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রোহিণী অনুভব করল, অনিরুদ্ধ যেন অদৃশ্য কোনো লেন্স দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে, হয়তো তার প্রতিটি চিন্তাকেও পড়ে ফেলছে। এই মিথ্যা পরিচয়ের জালে আটকে পড়ে রোহিণী বুঝল, সামনে যা আসছে তা শুধু এক হ্যাকার বা এক বিজ্ঞানীর লড়াই নয়, বরং মানুষের নিজস্ব স্মৃতির উপর টিকে থাকা স্বাধীনতার শেষ পরীক্ষা।

অধ্যায় ৭ : ডিজিটাল গহ্বরের আক্রমণ

ভোরের অন্ধকার তখনও পুরোপুরি কাটেনি, কিন্তু নিউরো সিটির আকাশে ঝুলে থাকা আয়নাগ্লাস টাওয়ারগুলোর নীল-সবুজ আলো হঠাৎ করেই অস্বাভাবিকভাবে ঝিকমিক করতে শুরু করল। এক মুহূর্তের জন্য শহরের প্রতিটি স্ক্রিন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ একযোগে সব নাগরিককে পরীক্ষা করছে। তারপরই নেটওয়ার্কের গভীর থেকে শুরু হয় এক বিভীষিকাময় আক্রমণ—ডিজিটাল গহ্বরের আক্রমণ। প্রথমে কয়েকজনের মস্তিষ্কে হালকা ঝাঁকুনি, তারপর একে একে হাজার হাজার মানুষ নিজেদের নাম, ঠিকানা, এমনকি শৈশবের পরিচিত মুখগুলো পর্যন্ত ভুলে যেতে লাগল। কেউ নিজের সন্তানের নাম মনে করতে পারছে না, কেউ হঠাৎ করেই ভুলে যাচ্ছে তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেমন ছিল। শহরের রাস্তায় তখন শুরু হয়েছে অদ্ভুত এক হাহাকার—মানুষ দৌড়চ্ছে, চিৎকার করছে, আবার অনেকে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে অচেনা চোখে চারপাশ তাকিয়ে আছে। নিউরো চিপের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক যেন একযোগে বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। রোহিণী নিজের চোখে দেখছিল স্কাই-বুলেভার্ডের ছাদ থেকে, কীভাবে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে আধুনিকতম এই শহর এক অজানা আতঙ্কের গ্রাসে ঢেকে যাচ্ছে। তার চারপাশে ড্রোন ক্যামেরাগুলো বারবার জরুরি সম্প্রচার চালাচ্ছিল—“শান্ত থাকুন, সরকার নিয়ন্ত্রণে আছে”—কিন্তু মানুষের মুখে ফুটে উঠছিল কেবল অসহায় বিভ্রান্তি।

সরকার দ্রুত “কোড রেড” জারি করল, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হল প্রধান নেটওয়ার্ক হাবগুলোর চারপাশে, তবু কেউ নিউরো চিপ বন্ধ করতে পারল না। চিপগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা যে, একবার সক্রিয় হলে ম্যানুয়াল শাটডাউন কার্যত অসম্ভব। সিলভার নেটওয়ার্কের কেন্দ্রীয় সার্ভার থেকে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছিল অদ্ভুত ডেটা-প্যাকেট, যা মস্তিষ্কের স্মৃতি অংশকে প্রথমে বিভ্রান্ত, পরে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোহিণী শুনল, এক বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে নিজের মেয়ের নাম মনে করার চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রতিবারই অচেনা এক শব্দ তার জিহ্বায় উঠে আসছে। আরেকজন যুবক আতঙ্কে জানাচ্ছে যে সে হঠাৎ করে মনে করতে পারছে না সে আসলে কার সাথে বিয়ে করেছে। পরিচয়ের এই ধ্বংস শুধু মানসিক নয়, সামাজিক সম্পর্ককেও ভেঙে দিচ্ছিল মুহূর্তে। অর্ণব ল্যাব থেকে জানাল যে আক্রমণের প্যাটার্ন সরাসরি সরকারের ব্যাকডোর কোডের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, যা প্রমাণ করে এই আক্রমণ কোনো সাধারণ হ্যাকারদের কাজ নয়। নির্বাণের ছায়া নিঃসন্দেহে এর পেছনে আছে, কিন্তু এই আক্রমণের মাত্রা দেখে মনে হচ্ছে, অনিরুদ্ধ সেন হয়তো একা নন। হয়তো সরকারের ভেতর থেকেও কেউ এই গহ্বরকে খোলা রেখেছে, অথবা অ্যালগরিদম এতটাই স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে যে এখন সেটি নিজেই নিজের নিয়ম লিখছে।

রোহিণীর হৃদস্পন্দন তখন অস্বাভাবিক দ্রুততায় বেজে চলেছে। সে জানত এই আক্রমণ শুধু স্মৃতি মুছে দেওয়ার জন্য নয়, বরং মানুষের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞ। অর্ণবের সঙ্গে এনক্রিপটেড লিঙ্কে কথা বলতে বলতে সে দেখল, তাদের নিজেদের চিপও ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে—হঠাৎ করে সে মনে করতে পারছে না গতরাতের শেষ মেসেজটি কার কাছ থেকে এসেছিল। এই ক্ষণিকের ভুলে যাওয়া তাকে যেন এক তীব্র শীতল স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বাইরে ড্রোনগুলো আকাশে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ঝলসে উঠছে, জরুরি সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ ছুটছে গঙ্গার তীর থেকে এসপ্ল্যানেডের উঁচু টাওয়ার পর্যন্ত। মানুষের চিৎকারের ভেতর দিয়ে রোহিণী বুঝতে পারছিল, নিউরো সিটির প্রতিটি নাগরিক এখন এক অদৃশ্য যুদ্ধে বন্দি—যেখানে শত্রু হলো তাদের নিজেদের মস্তিষ্ক, আর যুদ্ধক্ষেত্র সেই স্মৃতিই, যা দিয়ে তারা নিজেদের চিনত। রোহিণীর ভেতর থেকে তখন একটাই প্রশ্ন উঠছিল—এ আক্রমণ কি কেবল সতর্কবার্তা, নাকি স্বাধীনতার শেষ দুর্গ ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি?

অধ্যায় ৮ : স্মৃতির মুদ্রা

নিউরো সিটির আকাশ তখন ধূসর কুয়াশায় ঢাকা, ঝলমল করা টাওয়ারগুলোর আলো যেন অদ্ভুতভাবে ম্লান হয়ে এসেছে, আর শহরের প্রতিটি স্ক্রিনে ঝলমল করছে সরকারি আশ্বাসের বার্তা—“নিউরো-লিঙ্ক সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। আতঙ্কিত হবেন না।” কিন্তু রোহিণী জানে, এই ঝলমল আসলে কেবল ভাঁড়ের মধ্যে ফাঁদ; বাস্তবতা অনেকটাই অন্য রকম। নির্বাণ হঠাৎ করেই তার সঙ্গে এনক্রিপটেড চ্যানেলের মাধ্যমে গোপনে যোগাযোগ শুরু করে। স্ক্রিনে ঝলমল করা নীল আলোতে তার অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল—এক মানুষ নাকি এক অচেনা প্রোগ্রাম, কে জানে? নির্বাণ শুরু করল: “রোহিণী, তুমি যা দেখছ, তা শুধু অংশবিশেষ। নিউরো সিটি কর্পোরেশন মানুষের স্মৃতি থেকে ডেটা মাইনিং করে বিশ্ববাজারে বিক্রি করছে। তোমার হাসি, কান্না, ভালোবাসা, আনন্দ, দুঃখ—সবই তাদের জন্য এক পণ্য। ক্রেতারা কিনে নেয় মানুষের অনুভূতি, তাদের মনোবৃত্তি, এবং এমনকি সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো। এভাবে শহরকে তারা পরিণত করেছে এক ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে, যেখানে মানব অভিজ্ঞতা বিক্রি হয়।” রোহিণীর কণ্ঠে হতাশার ছাপ, চোখে অশ্রু, এবং মনের ভেতর ক্রমশ এক অদ্ভুত শীতলতা ভেসে ওঠে। যদি সত্যিই মানুষের স্মৃতি এখন একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে, তবে পুরো মানব সমাজের স্বাধীনতা, স্বাধীন চিন্তা—সবই ধ্বংসপ্রায়।

নির্বাণের কথাগুলো স্পষ্ট এবং কঠিন—তার লক্ষ্য শুধুমাত্র সরকারি এই বাণিজ্য বন্ধ করা। তবে সমস্যা হলো, সিলভার নেটওয়ার্কের ব্যাকডোরের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করলে শহরের প্রতিটি নাগরিকের চিপ ক্র্যাশ হয়ে যাবে। ফলে কোটি কোটি মানুষ স্থায়ীভাবে তাদের স্মৃতি হারাবে। রোহিণী অনুভব করল, নির্বাণ কেবল শহরের মানুষের মনোবিজ্ঞানকে পুনরুদ্ধার করতে চায় না, বরং পুরো শহরের ডিজিটাল অস্তিত্বের ওপরও দায়িত্ববোধ অনুভব করছে। “আমি জানি, এটি ভয়ঙ্কর,” নির্বাণ বলল, “কিন্তু যদি আমি থামি, তারা মানব অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণভাবে পণ্য বানিয়ে দেবে। যদি আমি এগিয়ে যাই, শহর নষ্ট হতে পারে। তোমার সাহায্য দরকার—তুমি শুধু তথ্যসংগ্রহ করছ না, তুমি মানুষের জন্য একটি নিরাপদ পথ খুঁজছ।” রোহিণী অনুভব করল, নির্বাণের এই পদ্ধতি যদিও ভয়ঙ্কর, কিন্তু এটি ছাড়া শহরের মানুষ কখনো নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে না।

রাত্রি ক্রমশ গভীর হচ্ছে, গঙ্গার ধারে ঠান্ডা বাতাস বইছে, আর শহরের রাস্তায় এখনো বিভ্রান্তি আর আতঙ্ক। রোহিণী বুঝতে পারছে, এবার তার সামনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত—নির্বাণের পথ অনুসরণ করে ব্যাকডোরের বিরুদ্ধে লড়াই করা, নাকি সরকারের এই ডিজিটাল বাণিজ্যের গোপন সত্যকে ফাঁস করে মানুষকে অগত্যা বিপন্ন করা। নির্বাণ জানাচ্ছে, শহরের স্মৃতি পুনরুদ্ধার করার জন্য তারা এক নতুন “ডেটা রেসকিউ অপারেশন” তৈরি করেছে, কিন্তু সেই পরিকল্পনায় যেকোন মুহূর্তে কোটি মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতি চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। রোহিণী নিজেই অনুভব করল, মানুষের হাসি, কান্না, ভালোবাসা—সবই কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং দুর্লভ। এই ভয়ঙ্কর বাণিজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং নৈতিক এবং মানবিক যুদ্ধও বটে। স্ক্রিনে নির্বাণের বার্তা আবার দেখা দিল—“প্রস্তুত হও, রোহিণী। এখনই সময়, নয়তো আমাদের স্মৃতি অন্য কারও হাতে বিক্রি হয়ে যাবে।” রোহিণীর মন ভরে উঠল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা আর সংকল্পে—এই যুদ্ধে শুধু তথ্য বা সংবাদ নয়, মানুষের অস্তিত্বও জড়িত।

অধ্যায় ৯ : শেষ সংযোগ

নিউরো সিটির আকাশ তখন গভীর নীল ও ধূসর কুয়াশায় ঢাকা, আর শহরের প্রতিটি টাওয়ারের আলো যেন এক অদ্ভুত শীতল চমক ছড়াচ্ছিল। রোহিণী এবং অর্ণব জানতেন, তাদের সামনে এমন এক যাত্রা অপেক্ষা করছে, যা সফল হলে শহরের হাজার হাজার মানুষ বাঁচবে, কিন্তু কোনো ভুল পলকে লক্ষাধিক মানুষের স্মৃতি চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। তারা গোপনে কেন্দ্রীয় নিউরো-নেটওয়ার্কের মূল সার্ভারের দিকে এগোতে লাগল। সার্ভারের অবস্থান ছিল শহরের সবচেয়ে অবহেলিত, প্রায় ধ্বংসপ্রায় কনট্রোল সেন্টারে, যেখানে বছরের পর বছর কোনো মানুষ প্রবেশ করেনি। ভিতরে ঢুকেই তাদের চোখে পড়ল অসংখ্য কেব্‌ল, টুইস্ট করা ফাইবার অপটিক্স, এবং ঝকঝকে হোলোগ্রাফিক মনিটর। প্রতিটি স্ক্রিনে চলছিল মানুষের মস্তিষ্কের নিখুঁত ভিজ্যুয়ালাইজেশন—চোখের অদৃশ্য ঝিলিক থেকে শুরু করে হৃদয়ের স্পন্দন, সকল কিছু এখানে লাইভ ট্র্যাকিংয়ে দেখা যাচ্ছিল। রোহিণী এক মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গেলেন—শহরের প্রতিটি নাগরিকের আত্মার ক্ষুদ্রতম স্পন্দনও যেন এই সার্ভারের হাতের মুঠোয় বন্দি। অর্ণব নীরবে তার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা আওয়াজে বলল, “একটা ভুল কোড, একটা ভুল ক্লিক—এখানে কোনোকিছু স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে।”

রোহিণী এবং অর্ণব তখন নির্বাণের নির্দেশনা অনুসরণ করে সার্ভারের গভীরে প্রবেশ করতে লাগল। সার্ভারের ভেতরে প্রতিটি লেয়ার ছিল এক ধরণের নিরাপত্তা ফাঁদ, যেখানে মানুষের স্মৃতির ডেটা এবং নিউরো-লিঙ্কের কোর কন্ট্রোল একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। তারা লক্ষ্য করল, যে অংশগুলো সবচেয়ে সংবেদনশীল, সেখানে চলছিল অদ্ভুত একটি ফ্রিকোয়েন্সি, যা মস্তিষ্কের নরম কোষের সাথে সরাসরি সমন্বয় করছে। নির্বাণের বার্তা মনে পড়ল—“প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তা করে নেওয়া। এখানে তুমি শুধু চিপের সঙ্গে কাজ করছ না, মানুষের আত্মার সঙ্গে কাজ করছ।” রোহিণী ধীরে ধীরে প্রতিটি কনসোল পরীক্ষা করতে লাগল, অর্ণব পাশে থেকে হালকা হুম শোনাচ্ছে প্রতিটি কোডের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, সার্ভারের ভেতর একটি অদৃশ্য চোখ তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, প্রতিটি পদক্ষেপ যাচাই করছে। তারা বুঝতে পারল, এক ধরনের ন্যানো-অ্যালগরিদমিক প্রতিরক্ষা সিস্টেম প্রতিটি হ্যাকারকে চিহ্নিত করছে, এবং একবার নিরাপত্তা লুপে ভাঙন ধরলেই মানুষের মস্তিষ্কের ডেটা স্থায়ীভাবে মুছে যাবে।

সবচেয়ে গভীর কক্ষে পৌঁছানোর পর তারা দেখতে পেল সার্ভারের সবচেয়ে কেন্দ্রীয় লেয়ার, যেখানে এক বিশাল হোলোগ্রাফিক কোর ঝিলমিল করছে—মানুষের স্মৃতি লাইভ ডেটা হিসেবে এখানে প্রবাহিত হচ্ছে। রোহিণী অনুভব করল, প্রতিটি স্মৃতির ফাইবার অপটিক তার নিজের চোখের সামনে গলে যাচ্ছে, যেন সে নিজেই সেই স্মৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। অর্ণব হালকা কণ্ঠে বলল, “এখানেই আমাদের শেষ সংযোগ। যদি আমরা এই কোড ঠিকভাবে রাউট করি, শহরের মানুষ বাঁচবে। কিন্তু একটি ভুল পদক্ষেপ—স্মৃতি চিরতরে হারিয়ে যাবে।” রোহিণী গভীর নিঃশ্বাস নিলেন, নিজের হাতের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করলেন, এবং নির্বাণের এনক্রিপশন কী অনুযায়ী কোড রাউট করতে লাগলেন। প্রতিটি লাইনের সঙ্গে তার মন মিলিয়ে চলল, যেন পুরো শহরের মানুষদের হৃদয় স্পন্দন করছে তার হাতের নাড়ির সঙ্গে। মুহূর্তে মনে হল, সময় থমকে গেছে—একটি ভুল ক্লিক, একটি ভুল সংকেত, এবং তারা সকলেই হারিয়ে যাবে। তবে রোহিণীর দৃঢ়তা ছিল অটল; সে জানত, এই শেষ সংযোগ সফল হলে শুধুমাত্র শহরের মানুষ নয়, মানব স্মৃতির স্বাধীনতাই পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে।

অধ্যায় ১০ : স্মৃতির স্বাধীনতা

নিউরো সিটির আকাশ তখন অদ্ভুতভাবে নীরব, শুধু বাতাসের হালকা গুঞ্জন আর দূরের গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রোহিণী ও অর্ণব কেন্দ্রীয় সার্ভারের কোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যেখানে প্রতিটি লাইনের মধ্যে মানুষদের স্মৃতির সরাসরি প্রবাহ ভেসে উঠছিল হোলোগ্রাফিক ফ্লো হিসেবে। নির্বাণের এনক্রিপ্টেড বার্তা, স্মৃতি রক্ষকদের সতর্কতা—সবই মনের গভীরে স্পন্দিত হচ্ছিল। মুহূর্তে রোহিণী উপলব্ধি করলেন যে এই প্রযুক্তি শুধু মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং তাদের নিজের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসকেও ঝুঁকিতে ফেলেছে। প্রতিটি স্মৃতি যে তাদের নয়, কোনো কোম্পানি বা সরকারের ডাটাবেসে বন্দি—এই ধারণা মানুষের স্বাধীনতাকে অসম্পূর্ণ করে। রোহিণী বুঝতে পারলেন, সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে মানুষের নিজের সিদ্ধান্ত থেকে, মানুষের নিজের চয়ন ও সচেতনতা থেকে। তাই তিনি ঠিক করলেন, এই মুহূর্তে কোনো centralized কোড, কোনো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নয়, বরং প্রত্যেক নাগরিকের হাতে ক্ষমতা ফেরত দিতে হবে।

তিনি অর্ণবের সাহায্যে এমন একটি বিশেষ কোড তৈরি করলেন, যা নিউরো-নেটওয়ার্কের প্রতিটি চিপে প্রবেশ করল। এই কোডের কাজ একটাই—প্রত্যেক নাগরিক নিজের মেমরি লক বা আনলক করার ক্ষমতা পাবে। কেউ চাইলে স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে পারবে, কেউ চাইলে চিরতরে মুছে দিতে পারবে, আর কেউ চাইলে নতুন স্মৃতি প্রোথিত করতে পারবে। প্রথমে একটি হালকা কম্পন অনুভূত হল সার্ভারের কোরে, তারপর ক্রমশ সবকিছু স্থিতিশীল হয়ে এলো। রোহিণী দেখতে পেলেন, মানুষের চোখে অচেনা উজ্জ্বলতা ফুটছে, কারণ তারা হঠাৎ করে বুঝতে পারছে যে তাদের নিজের মনেই সত্যিকারের ক্ষমতা। রাস্তায়, বাসে, অফিসে, স্কুলে—প্রত্যেক নাগরিকের মুখে আতঙ্কের স্থলে এসেছে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। মানুষ তাদের নিজের স্মৃতি পুনরুদ্ধার করছে, হারানো মুহূর্তগুলো ফিরিয়ে আনছে, আবার কেউ চাইলে নিজের স্মৃতির নতুন অধ্যায় লিখছে।

শহর ক্রমশ আলোয় ভরে উঠল। টাওয়ারের নীল-সবুজ আলো পুনরায় ঝিকমিক করতে শুরু করল, হোলোগ্রাফিক স্ক্রিনগুলোতে মানুষের হাসি, কান্না, ভালোবাসা—সবই যেন পুনর্জীবিত হয়েছে। রোহিণী জানত, এই স্বাধীনতা স্থায়ী নয়, কারণ মানুষের নিজেরা কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে, স্মৃতির সঙ্গে খেলা করতে পারে। তিনি এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলেন—কারণ যেকোনো সময় মানুষ নিজের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পথ ঠিক করতে পারবে। নির্বাণ, দূর থেকে গোপনে পর্যবেক্ষণ করে রোহিণীকে একটি বার্তা পাঠাল—“মানবতার আসল শক্তি সবসময় স্বাধীন চয়নেই।” রাস্তায়, নদীর তীরে, গঙ্গার ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে যায় নতুন দিনের আলো, মানুষের চোখে নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু রোহিণীর মনে এক প্রশ্ন জাগছে, যা হয়তো চিরকাল অমীমাংসিত থাকবে—যখন স্মৃতি সম্পূর্ণ মানুষের হাতে, তারা কি সত্যিই তা রক্ষা করতে পারবে, নাকি আবার প্রযুক্তির লোভে হারিয়ে যাবে তাদের মূল্যবান অনুভূতিগুলো?

-শেষ-

 

1000071365.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *