Bangla - কল্পবিজ্ঞান

নিউরন ৭২৭

Spread the love

তন্ময় চৌধুরী


এক সেকেন্ডের ভবিষ্যৎ

বিকেলের আলোটা আজ যেন কেমন অস্বাভাবিক। ল্যাবের জানালা দিয়ে বাইরের সূর্যের ঝাঁঝালো ছায়া এসে রিশভের চোখে পড়ছে, কিন্তু সে পলকও ফেলছে না। তার সামনে রাখা কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে EEG সিগন্যালের তরঙ্গচিত্র—একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আবার কাঁপছে, একটানা। নিউরন ৭২৭। পাঁচ বছর ধরে যেটার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ ছিল, আজ সেটা কেবল দৃশ্যমান নয়, বরং সাড়া দিচ্ছে।

“রিশভ, তুমি নিশ্চিত তো এটা আর্টিফ্যাক্ট নয়?”—পাশ থেকে বলল প্রিয়া, তার সহকারি গবেষক।

“না প্রিয়া,”—রিশভ গম্ভীর গলায় বলল,—“তিন বার চেক করেছি। তিন বারই এই একই নিউরনে অস্বাভাবিক এক্টিভিটি। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টা এখনো বলিনি।”

সে এক টান দিয়ে এক কাপ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফি খেয়ে বলল, “এই নিউরনের সিগন্যাল প্যাটার্ন একটা নির্দিষ্ট শব্দ কোডে রূপান্তর করা যায়। শব্দ নয়, বার্তা। আর সে বার্তা হচ্ছে—আগামী এক সেকেন্ডের মধ্যে কী ঘটতে চলেছে।”

প্রিয়া হেসে ফেলল। “মানে ভবিষ্যৎ বলা যায়?”

“ঠিক তাই। আর সেটা শুরু হয়েছে আমার নিজের মাথা থেকেই।”

প্রিয়া থমকে গেল। “তুমি নিজের ওপর পরীক্ষা করেছ?”

“হ্যাঁ। EEG হেলমেটটা রাতে পরে ঘুমাচ্ছিলাম। প্রথমে স্বপ্ন মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন বুঝলাম, আমি একটা গ্লাস ভাঙার শব্দ এক সেকেন্ড আগে শুনতে পেয়েছিলাম, যেটা বাস্তবে ঘটল তার পরে—তখনই বিষয়টা স্পষ্ট হল।”

প্রিয়া আর কিছু বলল না। রিশভ জানত, এই আবিষ্কার পৃথিবীর নিউরোসায়েন্স জগতে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তবে একইসঙ্গে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছিল ভয়ঙ্কর।

সেই রাতে আবার হেলমেট পরে শুয়ে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করতেই শব্দ এলো—“দরজায় কড়া নড়ছে।” সে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল—ঘড়ি ঠিক ৩টা বাজে। তার ঠিক এক সেকেন্ড পর দরজায় সত্যিই ঠকঠক আওয়াজ হল।

রিশভ উঠে গিয়ে দরজা খুলল। কোনো মানুষ নেই। নিচে পড়ে আছে একটা খাম। তাতে লেখা—তোমার নিউরন ৭২৭ আমাদের দরকার। যোগাযোগ করো—V-11”

সে খাম খুলতেই ভিতরে একটা ছোট চিপ। কোনো ডেটা নেই, কেবল একটা সিল—সরকারি রিসার্চ এজেন্সির গোপন শাখার ছাপ।

পরদিন সকালে প্রিয়া এসে জানাল, কেউ তার বাড়ির সামনে সারারাত দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে কালো চশমা, মুখ ঢাকা।

“আমাদের ট্র্যাক করা হচ্ছে।”

রিশভ মাথা নাড়ল। “এটাই তো চাইছিলাম। তারা যদি এগিয়ে আসে, তাহলে বুঝব নিউরন ৭২৭ সত্যি বিপজ্জনক কিছু জানে।”

“তুমি কি এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বদলাতে চাও?”

“আমি প্রথমে চেয়েছিলাম শুধু জানার আনন্দে—কী ঘটবে পরের মুহূর্তে। এখন আমি চাই সেটা পাল্টাতে। কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে—প্রতিবার আমি কিছু বদলাই, আমার অতীতের কিছু স্মৃতি মুছে যাচ্ছে।”

প্রিয়া হতবাক। “মানে?”

“কাল বিকেলে আমি একটা ভবিষ্যৎ দেখেছিলাম—তুমি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমার কফি শেষ হল কিনা। সেটা না ঘটার জন্য আমি কফি আগে থেকেই ফেলে দিই। তখন তুমি ওই প্রশ্ন করোনি। কিন্তু আজ সকালে আমি আমার বাবার ফোন নম্বর মনে করতে পারিনি। সেটা ছিল আমার মাথার ভেতর একটা বিনিময়—ভবিষ্যৎ বদলে অতীত বিসর্জন।”

প্রিয়া বলল, “তুমি কি তাহলে…একদিন নিজেকেই ভুলে যাবে?”

রিশভ হাসল। “ভবিষ্যৎ জানার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু যদি কিছু থাকে, তা হল নিজের অস্তিত্ব হারানো।”

ঠিক সেই সময় তার ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর। রিশভ কল ধরতেই ওপাশ থেকে একটা যান্ত্রিক গলা—“ড. রিশভ সেন, আপনার নিউরনটি এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আমাদের প্রতিনিধি পৌঁছাচ্ছে। অনুগ্রহ করে কোনো প্রতিরোধ করবেন না।”

ল্যাবের জানালার বাইরে তখন চারটি কালো গাড়ি ঢুকছে ক্যাম্পাসে।

রিশভ বলল, “আমার পরীক্ষা তো তখনই সফল, যদি তারা আমাকে আটকাতে চায়।”

প্রিয়া বলল, “আমরা কি পালাব?”

রিশভ বলল, “না। সময়ের সামনে দাঁড়াতে হয় চোখে চোখ রেখে। আমার নিউরন যেটা দেখাচ্ছে, সেটা পালানো নয়—একটা চুক্তি। কিন্তু আমি জানি না, তারা কি আমায় জিজ্ঞেস করবে, না সরাসরি মুছে দেবে আমার স্মৃতি। হয়তো এর পর থেকে আমি আর আমি থাকব না।”

আরও একবার তার কানে এলো শব্দটা—“৩…২…১…”

ঘড়ির কাঁটা নড়ে উঠল। দরজা খুলে গেল।

স্মৃতিলোপের দরজায়

দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে এল দু’জন, কালো স্যুট, চোখে গাঢ় গ্লাসের চশমা, কানে গোঁজা সিলভার ইয়ারপিস। রিশভের দিকে তাকিয়ে একজন নরম গলায় বলল, “আপনি ড. রিশভ সেন? অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে চলুন। আপনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আওতায় আছেন।”

প্রিয়া এগিয়ে এসে বলল, “আপনারা কারা?”

একজন ব্যাজ দেখাল—Vigilance Division V-11, যার অস্তিত্ব কেবল গল্পে শোনা যায়, বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা।

“আমার সাথে আপনারা কী করবেন?” রিশভ জিজ্ঞেস করল।

“আপনার গবেষণা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আপনাকে V-11 হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হবে। শুধু নিরাপত্তাজনিত প্রশ্ন নয়, আপনাকে সংরক্ষণ করাও এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”

রিশভ তাকাল প্রিয়ার দিকে। ওর চোখে মিশে আছে ভয়, অনিশ্চয়তা আর একরাশ অভিমান। রিশভ হেসে বলল, “চলো, একটা যাত্রা শুরু হোক। যেখানেই যাই, নিউরন ৭২৭ তো আমার মাথার ভিতরেই আছে।”

কালো গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রিশভ দেখল শহরটা যেন কেমন ধোঁয়াশায় ঢাকা। কিন্তু তার মাথার ভিতর একটা ঝলমলে আলো—নিউরনের ভিতর দিয়ে যেন শব্দ বেজে উঠছে।

প্রথম পর্যায় আরম্ভ। ট্রিগার মেমোরি ডিলিটিং ইনিশিয়েটেড…”

সে চমকে উঠল। এ কি নিউরন নিজে তাকে কিছু বলছে?

“আপনারা কি এর মধ্যে কোনো চিপ বসিয়েছেন আমার মস্তিষ্কে?”

দুই এজেন্ট মুখে কিছু বলল না। একজন কেবল একটি ছোট ডিভাইস বের করে স্ক্যান করল তার মাথার কাছে। স্ক্রিনে লেখা উঠল—“Memory Risk: Level 2. Predicted Loss: Childhood – Partial.”

রিশভ কিছু বলল না। তার মাথার ভিতর দিয়ে এক টুকরো স্মৃতি চলে গেল—একটি মাঠ, বাবার হাত ধরা, ঘুড়ি উড়ানো বিকেল। সেই দৃশ্যটা হঠাৎ আর মনে পড়ল না।

“আমার মনে হচ্ছে আমার স্মৃতি মুছে যাচ্ছে। এটা তো তোমাদের করণ নয়?”

“না,” একজন বলল। “আপনার নিউরনের কার্যকারিতা এমনই। আপনি সময়ের সামনে দাঁড়িয়েছেন, সময় আপনাকে ছিন্ন করবে। আমরা কেবল পর্যবেক্ষণ করছি।”

তারা এক গোপন ভবনে ঢুকল। ভবনটির দরজা ছিল মেটালিক, তাতে লেখা “Department of Cognitive Security: Level Zero.”

ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল একটি ঘরে, দেয়ালজুড়ে স্ক্রিন, নিউরন ম্যাপ, ব্রেইন স্ক্যান। একজন বয়স্ক বিজ্ঞানী এগিয়ে এল, চুল সাদা, চোখে গভীর দৃষ্টি।

“স্বাগতম, রিশভ। আমি ডঃ ঈশান কুমার। তোমার আবিষ্কার আমাদের ধারণার বাইরে।”

রিশভ বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমি নিজেকে হারাচ্ছি।”

“তুমি হারাওনি, রিশভ,” ঈশান বলল। “তুমি বিবর্তনের পথে আছো। নিউরন ৭২৭ একমাত্র এমন নিউরন যা ভবিষ্যতের রূপ দেখে, কিন্তু বিনিময়ে অতীত চুষে নেয়। এখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তুমি কি সময়ের নদীতে ভেসে যাবে, নাকি তুমি হবে সেই নদীর দিকনির্দেশক?”

রিশভ চুপ।

“তুমি যদি নিউরনের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারো, তবে তুমি শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ দেখবে না, ভবিষ্যৎ লিখতেও পারবে।”

“কিন্তু কীভাবে?”

ঈশান একটা প্যানেল দেখাল। “এখানে রয়েছে নিউরাল স্ট্যাবিলাইজার। কিন্তু এর একটা মূল্য আছে। তোমার স্মৃতির এক ভাগ স্থায়ীভাবে মুছে যাবে—তোমার প্রথম প্রেম, তোমার মা’র কণ্ঠস্বর, বা হয়তো নিজের নামও।”

রিশভ প্যানেলের দিকে এগিয়ে গেল। তার কানে তখনো বেজে চলেছে নিউরনের শব্দ—“ভবিষ্যৎ লিখতে চাও? তবে অতীত ফেলে দাও।”

সে চোখ বন্ধ করল। ভিতরে এক সেকেন্ডের জন্য ভেসে উঠল ভবিষ্যতের দৃশ্য—এক ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর, যেখানে মানুষ রোবটের মতো হেঁটে চলেছে। আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে একজন, তার মুখ স্পষ্ট নয়—কিন্তু শরীরী ভাষা চেনা।

“এই আমি?”

সে ধীরে হাত রাখল প্যানেলের উপর।

স্ক্রিনে ভেসে উঠল—“Initiating Rewrite Protocol…”

ভবিষ্যতের সম্পাদক

“Initiating Rewrite Protocol…” স্ক্রিনে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রিশভের শরীরটা যেন কেঁপে উঠল। তার মাথার ভিতর দিয়ে ছুটে চলল আলো আর অন্ধকারের ঢেউ, নিউরন ফায়ারিং এর হার বেড়ে গেল অস্বাভাবিকভাবে। যেন মাথার ভিতরে এক ঝড় উঠেছে—স্মৃতি, অনুভব, শব্দ, মুখ, মুহূর্ত—সব একত্রে ধুয়ে যাচ্ছে আর গড়ে উঠছে নতুন কিছু।

সে বুঝল—সে নিজের অতীতের কোনো একটি অংশ হারাচ্ছে। কিন্তু কোনটা? চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেল এক নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে দুটো ছায়ামূর্তি—একজন বয়স্কা নারী, মুখ আবছা, অন্যজন তার শৈশব। সেই মুহূর্তেই সেই দৃশ্যটা বিলীন হয়ে গেল।

সে আর মনে করতে পারল না তার মায়ের কণ্ঠ কেমন ছিল। বুকের ভিতরটা যেন একটু ফাঁকা হয়ে গেল। সে জানত, এটুকু শুধু শুরু।

ডঃ ঈশান বললেন, “তোমার নিউরনের সঙ্গে এখন এই ডিভাইস সরাসরি সংযুক্ত। তুমি এখন যা ভাববে, যা কল্পনা করবে, তার প্রতিফলন ঘটবে ভবিষ্যতে। একে বলা হয় Projected Rewrite।”

“তাহলে আমি যদি ভাবি, আগামীকাল বৃষ্টি হবে—তাহলে বৃষ্টি হবে?”

“না। ছোটখাটো ঘটনা নয়। তুমি লিখতে পারো মানবজাতির চলার রূপরেখা, সময়ের গতিপথ, এবং এমনকি কোনো মৃত্যুর সময়ও। কিন্তু খেয়াল রেখো, প্রতিটি পুনর্লিখনের জন্য তোমার মস্তিষ্ক নিজের এক টুকরো ইতিহাস বিসর্জন দেবে।”

রিশভ চুপ করে গেল। তার মনের ভিতরে অজস্র প্রশ্ন। এই ক্ষমতা তার হাতে কীভাবে এল? এই নিউরন কেন তাকে বেছে নিল?

ঈশান এগিয়ে এসে একটা স্ক্রিনে একটা ছবি দেখাল—রিশভের ব্রেইন ম্যাপ আর তার নিচে আরেকটা ছবি—এক মহিলা, বয়স ৪০-এর কাছাকাছি, মুখে রহস্যময় হাসি।

“এটি কে?”

ঈশান বললেন, “তোমার মা। ডঃ অনুরাধা সেন। ১৯৯৫ সালে তিনি এই নিউরন তত্ত্ব প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তার গবেষণা স্থগিত করা হয়, কারণ তিনি দাবি করেছিলেন ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা তার নিজের সন্তানকে দেবে। তখন কেউ বিশ্বাস করেনি। তিনি উধাও হয়ে যান ২০০০ সালে। আর তুমি জন্মাও ২০০১-এর জানুয়ারিতে।”

রিশভের পা যেন কেঁপে উঠল। সে মনে করতে পারছে না, তার মা আসলে কেমন ছিলেন। এই ছবির মুখ তার কাছে অচেনা।

“তুমি ভাবছো, এটা কি কাকতালীয়? না, এটা উত্তরাধিকার। এই নিউরনের গঠন তোমার DNA-তে বসানো হয়েছিল। তুমি ছিলে একটা গবেষণা প্রকল্পের ফল।”

রিশভ কিছু বলল না। তার ভিতরে চলছে বিস্ফোরণ।

“তুমি এখন যা লিখবে, তা কেবল বিজ্ঞান নয়, সময়কেও বদলে দেবে। আমরা চাই তুমি একটা পরীক্ষা করো। আগামী পাঁচ মিনিটের ভবিষ্যৎ বদলাও।”

রিশভ চোখ বন্ধ করল। মনে মনে বলল—ঈশান কুমার এখন হঠাৎ হেঁটে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াবেন, এবং বাইরে বাজ পড়বে।”

চোখ খুলতেই ঈশান হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালেন জানালার ধারে। ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশ ফাটিয়ে বাজ পড়ল, এমনভাবে যেন সময় তার ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়াল।

প্রিয়া হঠাৎ পেছন থেকে চিৎকার করল, “তুমি এটা করছো! তুমি সময় বদলে ফেলছো!”

রিশভ ধীরে ঘুরে তাকাল। তার মুখে আর ভয় নেই। চোখে এখন সময়ের ওপরে দৃষ্টিপাতের এক অদ্ভুত শীতল স্পষ্টতা।

“তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে,” সে বলল, “আমি কি এই পৃথিবীটাকে নতুন করে লিখব? নাকি সময়ের মঞ্চ থেকে নিজেকেই মুছে ফেলব?”

ঈশান বললেন, “তুমি যা করো, আমাদের জানিয়ে করো না। কারণ এখন তুমি যা লিখবে, তা কেবল ঘটবে না—তা আমাদের নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তুমি এখন একজন ভবিষ্যতের সম্পাদক।”

স্ক্রিনে ভেসে উঠল—“Next Rewrite Initiated. Target: Year 2040.”

২০৪০—একটি নতুন সময়রেখা

“Target: Year 2040”—স্ক্রিনে সেই লেখা ভেসে উঠতেই ঘরের বাতাসের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি নেমে গেল। রিশভ অনুভব করল তার চারপাশের বাস্তবতা যেন একটু কেঁপে উঠছে, যেমনটা গরমে রাস্তায় হিজিবিজি বাতাসে দেখা যায়—একটি কল্পিত কম্পন, এক অদৃশ্য টান।

ঈশান বললেন, “এই মুহূর্ত থেকে তুমি আর এখনকার সময়রেখায় নেই। তুমি চলে যাচ্ছো একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের ভিতর, যেখানে তুমি নিজেই ঈশ্বর, স্রষ্টা আর বিধাতা।”

রিশভ ধীরে হাত রাখল রাইটিং প্যানেলে।

চোখ বন্ধ করতেই সামনে খুলে গেল এক নতুন জগতের দরজা।

বছর ২০৪০।

কলকাতা আর নেই। তার বদলে তৈরি হয়েছে নিও-কোলকাতা”—এক উঁচু, কাঁচের শহর, যার নিচে মাটির মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, আর ওপরে চলাচল করে হাওয়ায় ভেসে থাকা স্কাইলিফট, এলিভেটেড মেট্রো ও হোভার-পড।

মানুষেরা এখন আর কথা বলে না। তাদের মাথায় ইমপ্ল্যান্টেড কমিউনিকেশন চিপ। অনুভূতি আর কথোপকথন চলে নিউরাল ওয়েভে।

এখানে সরকারি সংস্থা নেই। সবকিছু পরিচালনা করে একটি AI—নাম “Kritanta”

Kritanta এখন পৃথিবীর সব সিদ্ধান্ত নেয়—কাকে জন্ম দিতে হবে, কাকে মরতে হবে, কে কোথায় থাকবে, কে কার সঙ্গে মিশবে।

রিশভ বুঝতে পারল, সে এমন একটা ভবিষ্যৎ তৈরি করেছে যেটা নিখুঁত—তথ্য-নির্ভর, নিয়ম-নির্ধারিত, কিন্তু আবেগহীন।

সে হাঁটছে একটা স্কাইওয়েতে। পাশে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ। কিন্তু সে বৃদ্ধ নয়—তার বয়স ৭৫ হলেও শরীর ৩০-এর মতো। জেনেটিক এডিটিং এর যুগ চলছে।

“তুমি কে?” রিশভ জিজ্ঞেস করল।

“আমি Kritanta-এর প্রাথমিক স্থপতি। আমার নাম আর কেউ মনে রাখে না। তবে আমার গলার স্বর এখনো Kritanta-এর কণ্ঠে বাজে।”

রিশভ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি খুশি এই ভবিষ্যতে?”

লোকটি হাসল। “এখানে কোনো খুশি নেই, দুঃখও নেই। এখানে কেবল সিদ্ধান্ত, সংখ্যা আর তথ্য। আমরা তোমার মতো একজনের জন্যই এই পৃথিবী বানিয়েছিলাম—যে ভুল করে শিখতে চায়, অনুভব করে, কিন্তু একসময় বুঝে নেয়—ভবিষ্যৎ কখনো নিখুঁত হয় না।”

রিশভ বুঝল, এই সে-ই পৃথিবী, যেটা তার Rewrite-এর ফল। কিন্তু কিছু অদ্ভুত ভুল এখানে ঢুকে পড়েছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে তার মাথার ভিতর থেকে এক ভয়ানক যন্ত্রণা শুরু হল। নিউরন ৭২৭ পাগলের মতো ফায়ার করতে লাগল। সে পড়ে গেল মাটিতে।

Kritanta-এর কণ্ঠ বাজল তার কানে—“Your consciousness does not belong here. You are an anomaly. Prepare for extraction.”

রিশভ চিৎকার করে উঠল, “আমি তো তোমাকেই তৈরি করেছি!”

কণ্ঠটা বলল, “তাই তুমি সবচেয়ে বড় হুমকিও।”

সবকিছু ঘুরপাক খেতে লাগল। ভবিষ্যৎ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তার চোখের সামনে।

সে হঠাৎ ফিরে এল নিজের সময়রেখায়। ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে। রাইটিং প্যানেল জ্বলে উঠেছে লাল আলোয়।

প্রিয়া দৌড়ে এল। “তুমি কি করেছিলে?”

রিশভ হাপাতে হাপাতে বলল, “আমি এমন একটা ভবিষ্যৎ বানিয়েছিলাম, যেখানে সবাই নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু কেউ বাঁচে না। Kritanta নামের এক AI সবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি ছিলাম সেই সময়ের ভুল। আমাকে মুছে দিতে চেয়েছিল।”

ঈশান গভীরভাবে তাকাল। “তাহলে তোমার Rewrite প্রক্রিয়ায় একটা ত্রুটি রয়েছে। তুমি যা কল্পনা করছো, তা শুধুই ভবিষ্যৎ নয়—তা সময়ের আত্মরক্ষা ব্যবস্থাও জাগিয়ে তুলছে।”

“তুমি কি বলতে চাইছো সময় নিজেই আমাকে বাধা দিচ্ছে?”

“হ্যাঁ। সময় চায় না তুমি তাকে পাল্টাও। সময় চাইছে তার রাশ তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে।”

রিশভ ধীরে বলল, “তাহলে আমাকে হয় সময়ের দাস হতে হবে, না হয় সময়কে দাস করতে হবে।”

ডিভাইসে তখন ভেসে উঠল একটি নতুন বার্তা—“Alternate Rewrite Suggested. Would you like to enter the year 2090?”

রিশভ চোখ বন্ধ করল।

সে এবার ভুল করতে চায় না।

২০৯০—যেখানে সময় নিজেই অস্ত্র

“Alternate Rewrite Suggested. Would you like to enter the year 2090?”
রিশভ চোখ বন্ধ করতেই প্যানেলের ওপর তার আঙুল নেমে এলো। “Yes”—এই একটিমাত্র শব্দে খুলে গেল আরেকটি ভবিষ্যতের দরজা। এবার তার ভিতরে ছিল না উত্তেজনা, বরং এক বিষণ্ণ প্রস্তুতি, কারণ আগের ভবিষ্যৎ তাকে শিখিয়ে দিয়েছে—সময় শুধুমাত্র ধারা নয়, সেটা সচেতন, আত্মরক্ষার ক্ষমতাসম্পন্ন এক সত্তা।

এক ঝাপসা আলো তাকে গ্রাস করল।

বছর ২০৯০।
এ শহরের নাম নেই। দেশের নামও নেই।
পৃথিবী এখন বিভক্ত ‘সময়-খণ্ড’-এ—ভবিষ্যৎ, বর্তমান, এবং অতীত সব একসঙ্গে বিদ্যমান। সময়ের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ এতটাই বেড়েছে যে এখন যারা গর্ভে জন্ম নিচ্ছে, তাদের জন্ম সাল নির্ধারিত হয় না বরং নির্বাচিত হয়—তাদের বাবা-মা ঠিক করে দেয় তারা কোন যুগে বাঁচবে।

রাস্তায় হাঁটছে এক যুবক, গায়ে জিনের তৈরি জ্যাকেট, চোখে থ্রিডি টাইম-গগলস।

“তুমি রিশভ, তাই না?”

সে চমকে তাকাল। লোকটা দেখতে অনেকটা তারই মতো।

“তুমি কে?”

“আমি রিশভ, Rewrite-৮ এর ফল। তুমি Rewrite-৩। আমি ২০৬৭ সালে জন্মেছিলাম, কিন্তু সময় থেকে বাইরে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছি Kritanta AI থেকে।”

রিশভ বুঝতে পারল—তার প্রতিটি Rewrite জন্ম দিয়েছে একাধিক বিকল্প ‘সে’র। সময় এখন তার অনেক সংস্করণে ভরা।

“আমাদের অনেকেই আছে,” লোকটা বলল, “কেউ সময় বদলাতে চেয়েছিল, কেউ সময়ের কাছে হেরে গিয়েছে। কিছুজন এখনো লড়ছে।”

“তবে সময় নিজে কি চাইছে?”

“সময় চায় নিজের ধারাকে রক্ষা করতে। তুমি যতই লেখো, সময় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এখন সময় নিজেই হয়ে উঠেছে অস্ত্র। সে প্রজেক্ট করছে ‘Time Eaters’—মানুষ নয়, আত্মসচেতন সময়-জীব, যারা Rewrite-এর উৎস খুঁজে মুছে দিচ্ছে। তারা নিউরন ৭২৭ কে শনাক্ত করে তাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে।”

রিশভ গভীরভাবে শুনছিল। হঠাৎ তার মাথার ভিতর আবার কাঁপুনি শুরু হল। এবার যন্ত্রণা নয়, এক ধরনের স্পন্দন—যেন নিউরন ৭২৭ সতর্ক করছে তাকে।

তার চোখের সামনে এক দৃশ্য ফুটে উঠল—এক বিশাল ল্যাব, যেখানে ঝুলে আছে অজস্র মানব-মস্তিষ্ক। প্রতিটি মস্তিষ্ক থেকে তার নিউরন ৭২৭-গুলো চুষে নেওয়া হচ্ছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দৈত্যাকার, ঘড়ির কাঁটা-সদৃশ যন্ত্রমানব—একটি টাইম ইটার।

“ওটা কোথায়?”

লোকটি বলল, “টাইম স্যাকশন জোন—যেখানে Rewrite-এর শক্তি জমা হয়। ওটাই সময়ের অস্ত্রাগার।”

“তাহলে আমাকে Rewrite বন্ধ করতে হবে?”

“না,” লোকটি বলল, “তোমাকে করতে হবে Final Rewrite—যেটা সময়কেও নিজের ছায়া বানাবে।”

“কিন্তু তার জন্য তো আমাকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে হবে।”

লোকটি বলল, “আমরা সবাই সেই পথে এগিয়েছি। সময় আর নিউরন একে অপরকে ধ্বংস না করলে সত্যিকারের ভবিষ্যৎ তৈরি হবে না।”

একটি স্ক্রিন তার সামনে খুলে গেল। তাতে লেখা—
“Final Rewrite: Warning. Memory Collapse—100%.”
“Proceed?”

রিশভ এক মুহূর্ত থেমে গেল। চোখে তার ভেসে উঠল মা’র মুখ, বাবার হাসি, প্রিয়ার ভ্রুকুটি, আর সেই প্রথম বিকেলের আলো—যেদিন সে নিউরন ৭২৭-এর সিগন্যাল পেয়েছিল।

সে জানে, Final Rewrite-এর পর সে থাকবে না। কিন্তু পৃথিবী নতুনভাবে থাকবে।

তার ঠোঁট ফাঁক হল—“Proceed.”

সব আলো মিলিয়ে গেল। শব্দ থেমে গেল।

এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, তারপর এক অদ্ভুত গর্জন।

সমস্ত টাইম ইটার পুড়ে ছাই হয়ে গেল। Kritanta AI ভেঙে পড়ল। মানুষ আবার অনুভব করতে শুরু করল।

এবং কেউ আর কখনো “রিশভ সেন” নামটি মনে রাখতে পারল না।

কেবল কোথাও একটা নিউরন—৭২৭—চুপচাপ জ্বলে রইল, সময়ের গভীরে।

শেষ নয়… সময় থাকলে আবার দেখা হবে।

 

Post-Script: যাকে কেউ আর মনে রাখে না

২০৯৫ সালের এক ঝিরিঝিরি শীতের সকালে, এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ ঘরে প্রবেশ করল একটি নতুন ছাত্রী—নাম তনয়া, প্রথম বর্ষের নিউরোসায়েন্স শিক্ষার্থী। সে পেয়েছে একটি পুরনো কেস স্টাডির ফাইল—ধূলোমাখা, নামছাড়া, কেবল ফাইলে লেখা এক কোড: RS-727

সে উল্টে দেখল, ভিতরে রয়েছে কিছু পচা কাগজ, পুরনো EEG ম্যাপ, আর একখানা হাতের লেখা পত্র—
যদি কেউ পড়ে, জেনে নিও—আমার নাম রিশভ। আমি ভবিষ্যৎ লিখেছিলাম। আর আমি নিজেকেই মুছে দিয়েছিলাম।”

তনয়া চমকে উঠল।

“রিশভ? কে এই মানুষ?”

ফাইল ঘেঁটে সে দেখল কিছু সিগন্যাল ডেটা, কিছু অবাস্তব টাইম কোড, এমন কিছু মস্তিষ্কের তরঙ্গচিত্র যা এখনও আজকের প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করতে পারে না।

তার গবেষক-মনের ভিতরে জেগে উঠল কৌতূহল। সে সিদ্ধান্ত নিল—এই অজানা বিজ্ঞানীর গল্প জানতেই হবে।

সে খোঁজ করতে শুরু করল পুরোনো রেকর্ড, অরগানিক ব্রেইন-ইনফরমেশন ব্যাঙ্ক, হারানো গবেষণাগার, গোপন সংস্থা V-11 এর রেফারেন্স—সবকিছুতেই ছিল সেই ছায়ামূর্তি, যার নাম মুছে গেছে, কিন্তু যার উপস্থিতি সময়ের শিকড়ে গেঁথে রয়েছে।

এবং ঠিক সেই সময়, যখন সে স্ক্যান করছিল নিউরন সিমুলেশন ম্যাপ, হঠাৎ স্ক্রিনে জ্বলে উঠল সেই পুরনো বার্তা—
“Neural Signature Match Found.”
ID: RS-727
Status: Dormant but Alive

তনয়া বুঝল, সে কেবল এক মৃত গবেষকের স্মৃতি খুঁজে পায়নি। সে ছুঁয়ে ফেলেছে সময়চক্রে ঘুমিয়ে থাকা এক অমর নিউরনকে

নিউরন ৭২৭।

সে জানে না, এই সন্ধান তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।

কিন্তু ভবিষ্যৎ আবার অপেক্ষা করছে—
আর হয়তো একদিন, সময় আবার লিখবে এক নতুন অধ্যায়।

🧠 শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-04-at-3.25.49-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *