ইশিতা দে
অধ্যায় ১:
কলকাতার শীতকাল একরকমের বিষণ্ণতায় মোড়া থাকে, যেন শহরটা হঠাৎই ধীরে নিঃশ্বাস নিতে শেখে। গা জড়ানো শালের মোলায়েম পরশ, ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা কফির উষ্ণতা আর ফুটপাথের পুরনো বইয়ের গন্ধে মেশা হাওয়ার সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই শহরের মানুষের। ঠিক এমনই এক সকালে প্রথম দেখা হয়েছিল অরিন্দম আর রূপার — কলেজ স্ট্রিটের এক ছোট্ট ক্যাফেতে।
ক্যাফেটারিয়াটার নাম ‘কোয়েট লাইফ’। কাঠের টেবিল, ধুলো ধরা বইয়ের তাক আর দেয়ালে ঝুলন্ত পুরনো পোস্টারগুলো বলে দেয়—এখানে গল্প জমে, চুপিচুপি। এখানে এসে কফির কাপ নিয়ে বসে থাকা মানেই সময়কে একটু থামিয়ে রাখা। অরিন্দম ঠিক সেটাই করতে চেয়েছিল সেদিন।
সে এসেছিল এক পরিচিত লেখকের পান্ডুলিপি নিতে। সেই লেখক, অধ্যাপক শ্রীবাস্তব, ছিলেন এক প্রবীণ সাহিত্যিক এবং রূপা তাঁর ছাত্রী—এখন নিজেও একজন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা। তিনি টাইপ করে দিচ্ছিলেন লেখকের আত্মজীবনী, যা পরবর্তী বই আকারে প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
অরিন্দম, একজন মধ্যবয়সী পুরুষ, নামকরা এক প্রকাশনা সংস্থার সহকারী সম্পাদক। তার চেহারায় বিশেষ কিছু নেই—সাধারণ গড়নের, সামান্য মুটিয়ে যাওয়া দেহ, কিন্তু চোখ দুটো খুব শান্ত, যেন বহু কিছুর ভার বহন করে চলেছে অথচ কাউকে কিছু বলে না। জীবনে প্রচুর পড়াশোনা করেছে, কিন্তু ইদানীং সে খুব একটা লেখে না, লেখাও পড়ে কম। অফিস, ইমেল, প্রুফ, কর্পোরেট মিটিং—সব মিলিয়ে দিনগুলোকে যেন বেঁধে ফেলেছে নিয়মের বেড়াজালে।
ক্যাফের কোণার টেবিলে বসে রূপা তখন এক কাপ চা সামনে রেখে বই পড়ছিল। অরিন্দমের প্রথম নজরেই সে আটকে গিয়েছিল, কারণ মেয়েটির চেহারায় কোনো কৃত্রিম সৌন্দর্য ছিল না, কিন্তু তার ভঙ্গিতে একধরনের আত্মবিশ্বাস ও একাকীত্বের মিশেল ছিল, যা সহজে চোখে পড়ে না। তার লম্বা কেশ, গাঢ় কাফতান, এবং চোখের কোণে লেগে থাকা ক্লান্তির রেখাগুলো বলছিল—এই মেয়েটি হয়তো বহু কিছু দেখেছে, বোঝে, এবং অনেক কিছু চাপা দিয়ে বাঁচে।
“আপনি রূপা সেন?”
অরিন্দম প্রশ্ন করেছিল, টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে।
রূপা মাথা তোলে, একটু হাসে—“হ্যাঁ, আপনি নিশ্চয়ই অরিন্দম ঘোষ?”
তার চোখের দৃষ্টি ছিল স্থির, জিজ্ঞাসু, কিন্তু অভ্যস্ত।
অরিন্দম মাথা নাড়ল—“স্যার আপনার কথা বলেছিলেন। ফাইলটা আনা আছে?”
রূপা ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে তাকে এগিয়ে দেয়। তারা দুজনেই জানে, এই দেখা কেবলমাত্র একটি প্রথাগত কাজের জন্যই। কিন্তু সেই টেবিল, সেই মুহূর্ত, যেন কিছু অন্যরকম পরিকল্পনা করেছিল। অরিন্দম বসে পড়ে তার সামনে। শুরু হয় অল্পস্বল্প কথা, মূলত লেখার বিষয় নিয়ে। কিন্তু কথায় কথায় প্রসঙ্গ গড়াতে থাকে।
“আপনি লেখালিখি করেন না?”
অরিন্দম জানতে চায়।
রূপা বলে, “করি, তবে নিজের জন্য। অন্য কেউ পড়ে না।”
“সবচেয়ে সত্য লেখাগুলো নিজের জন্যই হয়,” অরিন্দম বলে ফেলে, এবং সেদিন প্রথমবার রূপা হাসে—একটা চুপচাপ, ধরা না-পড়া হাসি।
তারা সেদিন অনেকক্ষণ কথা বলেছিল—লেখা, সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা, কলেজের ছাত্রদের নিয়ে সমস্যা, সামাজিক যন্ত্রণা, প্রেম ও পলায়নবাদী সাহিত্য। কখনও টেবিলে দু’জনে হাত রাখে খুব কাছাকাছি, কিন্তু কেউ ছোঁয় না। তবুও, একটা টান তৈরি হয়—অদৃশ্য, কিন্তু পরিস্কার।
রূপা তার চায়ের কাপটা শেষ করে কেবল একবার বলেছিল, “আপনার স্ত্রীও কি সাহিত্য ভালোবাসেন?”
অরিন্দম একটু চমকে গিয়েছিল। তারপর হালকা মাথা নাড়িয়ে বলেছিল, “না, ওর দুনিয়া আলাদা। মালবিকা কর্পোরেট দুনিয়ায়, মেট্রিক্স আর রিপোর্টের ভিতর বাঁচে। সাহিত্য ওর কাছে সময়ের অপচয়।”
রূপা আর কিছু বলেনি। শুধু জানালার বাইরের কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। মনে মনে যেন অনেক কিছু বলেছিল—সেই সব কথা যা কাউকে বলা যায় না।
এরপর সপ্তাহ পার হয়। একদিন রূপার ফোনে আসে একটা ছোট্ট মেসেজ:
“Thursday, 9 am. Same café?”
প্রেরক—অরিন্দম।
রূপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়—”See you.”
এভাবেই শুরু। এক সকাল থেকে আরেক সকালে পৌঁছনো। সপ্তাহে একবার, বৃহস্পতিবার, অফিসের আগে এক ঘণ্টা—তাদের দেখা হত। নিয়মিত। না, কেউ কিছু স্বীকার করত না, কেউ কিছু বলতও না। তবু সেই টেবিলের দুই প্রান্তে বসে, তারা একে অপরের মধ্যে খুঁজত সেই নীরবতা—যেটা ঘরে ফিরে পাওয়া যায় না।
রূপার দাম্পত্যজীবনও নিঃসঙ্গ। তার স্বামী রণদীপ একজন ব্যস্ত আইনজীবী, যার কাছে সংসার কেবল নিয়ম মেনে চালানো একটি ফাইল মাত্র। সকাল সকাল বেরিয়ে যাওয়া, রাত করে ফেরা, ছুটির দিনে ফোনে কেসের আলোচনা। রূপা অনেকদিন ধরেই বুঝে গিয়েছে, ওর জীবনে সে কেবল উপস্থিত এক চরিত্র—আসল নাটকটা অন্য কোথাও।
একবার ক্যাফেতে অরিন্দম বলেছিল, “তুমি কখনো ভাবো না, এসব ঠিক না?”
রূপা চুপ করে থেকেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, “আমি জানি, সমাজ আমাদের এই বন্ধুত্বকে ‘পাপ’ বলবে। কিন্তু যেটা মিথ্যে, সেটা তো সংসার, যেখানে আমি দিনের পর দিন একা বাঁচি। এখানে অন্তত কিছু সত্য আছে—তুমি আমাকে বোঝো, আর আমি তোমাকে।”
সেই দিন অরিন্দম তার জন্য বই নিয়ে এসেছিল—জীবনানন্দের একটি ছোট কবিতার সংকলন। প্রথম পাতায় লিখে দিয়েছিল—
“তুমি সন্ধ্যার মত—”
তার নিচে কোনো নাম নেই, কেবল একটা তারিখ।
রূপা চুপ করে বইটা নিয়েছিল, তার ঠোঁটে কোনো হাসি ছিল না, কিন্তু চোখে এক অপার কৃতজ্ঞতা।
দিন যেতে থাকে। তাদের সম্পর্ক বদলায় না—তাতে চ Physical বা সামাজিক কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু প্রতি বৃহস্পতিবার তারা ফিরে আসে সেই ক্যাফেতে, যেন এইটুকুই তাদের একমাত্র সত্য।
কিন্তু সত্যও তো কখনো কখনো চাপে পড়ে যায়।
একদিন অরিন্দম এসে বলল, “মালবিকা হয়তো কিছু আঁচ করছে। গত সপ্তাহে আমার ফোনে তোমার মেসেজ পড়ে ফেলেছিল। কিছু বলেনি, কিন্তু ওর চোখে ছিল প্রশ্ন।”
রূপার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল।
সে বলেছিল, “তাহলে কী করবে তুমি?”
অরিন্দম বলেছিল, “আমি জানি না। আমি মালবিকাকে ভুলতে চাই না, কিন্তু তোমাকেও হারাতে চাই না। আমি নিজেকেই মাঝে মাঝে চিনতে পারি না রূপা।”
সে দিন প্রথমবার রূপা একটু দূরে বসে ছিল টেবিলের। তারা একে অপরকে স্পর্শ করেনি, এমনকি চোখেও তাকায়নি খুব বেশি। কেবল জানত—কিছু একটা বদলাতে শুরু করেছে।
তবে জীবন থেমে থাকে না। তারা আবারও আসে, আবারও কথা বলে। একে অপরের খোঁজ নেয়—কে কী পড়ছে, কলেজে কী হলো, অফিসে কোন ঝামেলা। এত বছর ধরে যেটা দু’জনেই স্বামী-স্ত্রীর কাছে খুঁজে পায়নি, সেটা তারা একে অন্যের মধ্যে খুঁজে পেতে থাকে।
এভাবেই বছর ঘুরে যায়।
তাদের ভালোবাসা আজও নামহীন—কেউ কাউকে ‘ভালোবাসি’ বলেনি, কেউ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবুও তারা জানে, এই সম্পর্ক তাদের অনেক কিছু দিয়েছে—সম্ভবত, নিজেকে ফিরে পাওয়ার সাহস।
তারা ভালোবাসে, কিন্তু চুপচাপ।
অধ্যায় ২:
রাত্রিটা ছিল একরকমের থমকে থাকা সময়। ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছিল, কিন্তু রূপার ভেতর চলছিল উল্টো দিকে যাত্রা—একটা সময়ের দিকে, যেখানে সে একা ছিল না, একটা সম্পর্ক ছিল যার ভিতরে কিছু ‘না বলা’ বেঁচে ছিল এখনও।
রণদীপ তখন বিছানার এক কোণে মুখ ঘুরিয়ে ঘুমোচ্ছিল। ঘরের মধ্যে হিটার চলছিল, জানালার পর্দা সামান্য দুলছিল কুয়াশার হাওয়ায়, আর জানালার বাইরে কোনো এক দূরের কুকুর মাঝে মাঝে হুংকার দিচ্ছিল। এই শহরে রাত্রি কখনো পুরোপুরি নীরব হয় না, ঠিক যেমন ভালোবাসা কখনো পুরোপুরি নিঃশেষ হয় না।
রূপা শুয়ে ছিল চোখ বন্ধ করে, কিন্তু তার মাথার মধ্যে চলছিল একটি চিঠি লেখার প্রয়াস—যে চিঠি সে কাউকে দেবে না, কেবল নিজের মধ্যে রাখবে। চিঠির প্রাপক অরিন্দম। পাঠানো হবে না, কিন্তু প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন গভীরতর কোনো সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় তাকে।
“অরিন্দম,
তোমার কাছে আমার কোনো দাবি নেই। এমনকি তুমি আমার জীবনের কোনো পরিণতির প্রতীকও নও। তুমি আমার সকালগুলোর মধ্যে একটি কফির রঙ, কিংবা জানালার কাচ দিয়ে ঢুকে পড়া আলো। তুমি হয়তো এসে গিয়েছিলে ঠিক সেই সময়ে, যখন আমি নিজেরই কথা ভুলতে বসেছিলাম।
আমি জানি, এই সম্পর্ক অসম্পূর্ণ। তবু তুমিই আমাকে লিখতে শেখালে আবার, ভাবতে শেখালে যে ভালোবাসা মানে কেবল ছুঁয়ে থাকা নয়, বরং বুঝে নেওয়া।
আজ রণদীপের সাথে চুপচাপ ডিনার করলাম। তর্ক হলো না, কথা হলো না—হয়তো এটাই এখন স্বাভাবিক। রান্না টেবিলে বসে কেবল একটা শব্দ শুনলাম—‘পেঁয়াজটা একটু কাঁচা’। সেই শব্দের মধ্যে ভালোবাসা ছিল না, কোনো কৌতূহল ছিল না। শুধুই অভ্যাস।
তোমার সাথে কথা বলার সময় আমি টের পাই—আমাকে কেউ শুনছে। কেবল কথার শব্দ নয়, আমার নিঃশব্দতাও কেউ বোঝে।
তুমি জানো, আমি কোনোদিন সংসার ভাঙতে চাই না। কারণ সেটাও ভালোবাসা নয়। কিন্তু আমি চাই, এই নির্দিষ্ট কিছু মুহূর্ত যেগুলো আমাদের আছে, তা যেন থেকে যায়… কল্পনার কোনো এক জায়গায়, অথবা… কোনো কাঠের ক্যাফের সেই টেবিলে, যেখানে তুমি বলেছিলে—‘সবচেয়ে সত্য লেখাগুলো অন্য কেউ পড়ে না।’
এই চিঠি আমি পাঠাবো না। কেবল লিখে রাখলাম, কারণ তুমি তো বুঝতেই পারো… না বলেও যা বলা যায়, তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
–রূপা”
চিঠিটা সে শেষ করল না। অর্ধেক লেখা রেখেই খাতা বন্ধ করল, এবং নিজের বুকের নিচে রেখে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল।
রাতের বুকে এভাবে লুকিয়ে থাকা চিঠিরা বোঝে—কে কাকে কতখানি ভালোবাসে, আর কে কাকে কতখানি মাফ করে বেঁচে থাকে।
পরদিন সকালে সে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরোবার সময় স্বামীর সাথে কেবল চোখাচোখি করেছিল। কোনো কথা হয়নি। রণদীপ তখন নিজের টাই পরে নিচ্ছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। রূপা দেখে, তাদের সংসারটা যেন আয়নার সামনে দাঁড়ানো দুটি মানুষ—কেউ কাউকে স্পর্শ করে না, কেবল প্রতিবিম্বের মতো পাশে থাকে।
কলেজে পৌঁছেই রূপা নিজের ডেস্কে বসে। ছাত্ররা তখন ক্লাসে, ক্যানটিনের দিকে যাচ্ছে, হালকা হাসির শব্দ ভেসে আসছে বাইরে থেকে। অথচ তার বুকের মধ্যে গুমোট জমে আছে। মোবাইলটা খুলে দেখে—অরিন্দমের একটি মেসেজ:
“একটা কবিতা পড়ছিলাম, তোমার মুখটা ভেসে উঠল। সন্ধ্যেবেলা তোমার সময় হবে?”
রূপার ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে ওঠে—এমন হাসি, যা সে রণদীপের জন্য বহুদিন হাসেনি।
সে উত্তর দেয় না সঙ্গে সঙ্গে। চুপ করে মোবাইলটা রাখে। সে জানে—এই চুপ করাটা নিজেকে বোঝার একটা অংশ।
সন্ধ্যাবেলা তাদের দেখা হয় না। কারণ রূপা অফিসের মিটিংয়ে আটকে যায়, আর অরিন্দমকেও ছেলের স্কুল থেকে ফিরিয়ে আনতে হয়। অদ্ভুতভাবে তারা এখন একে অপরের রুটিনে ঢুকে পড়েছে—এমন না যে কেউ তা দাবি করেছে, কিন্তু দুইজনে জানে, একে অপরের জীবন এখন সম্পূর্ণরূপে না হলেও আংশিকভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
তবে পরের বৃহস্পতিবার আবার দেখা। ক্যাফের সেই টেবিলে বসে।
এইদিন অরিন্দম রূপার জন্য নিয়ে আসে একটি খাম—তার মধ্যে একটি পুরনো পোস্টকার্ড, যেখানে লেখা—
“The world breaks everyone and afterward many are strong at the broken places.”
– Ernest Hemingway
রূপা চমকে ওঠে। সে একসময় এই লাইন নিজের ডায়েরিতে লিখেছিল। অরিন্দম কীভাবে জানল?
অরিন্দম হেসে বলে, “তোমার ক্লাসে একবার বলেছিলে—একটা ছাত্রী বলছিল। আমি পাশে দিয়ে গিয়েছিলাম। শুনে মনে রেখেছিলাম।”
রূপা কেবল তাকিয়ে থাকে ওর দিকে—চোখে একধরনের নীরবতা।
সে ধীরে বলে, “তুমি আমার ভেতরের শব্দগুলোও মনে রাখো?”
অরিন্দম বলে, “তোমার মুখের কথাগুলোই তো এত সুন্দর হয় না রূপা। তোমার নিঃশব্দ কথাগুলোই আসল।”
সেইদিন তারা খুব একটা কথা বলে না। দুজনে কফি খায়, কেবল চোখে চোখ রেখে বুঝে নেয়—এই সম্পর্কের নাম নেই, কিন্তু গভীরতা আছে।
এই সম্পর্ক কোনো দিন পত্রিকায় ছাপা হবে না, কেউ তাদের নিয়ে গুজব ছড়াবে না। কিন্তু তারা নিজেরাই জানে—এই সম্পর্ক যদি কেবল মাত্র কয়েকটি বৃহস্পতিবার বাঁচে, তাহলেও সেটা বেঁচে থাকার মতো।
রাত বাড়ে, আবারও রূপা নিজের খাতাটা খুলে। আজ সে আরেকটা চিঠি লেখে—কিন্তু অরিন্দমকে নয়, এবার নিজের জন্য।
“প্রিয় রূপা,
তুমি যদি কখনো ভাবো যে তুমি একা, তাহলে মনে রেখো—তোমার ভিতরে একটা জায়গা আছে, যেটা কেবল তোমার। সেখানে কেউ আসে না, এমনকি অরিন্দমও না। সেই জায়গাটায় তুমি যেদিন পৌঁছতে পারবে, সেদিন ভালোবাসা বলতে আর বাইরের কাউকে খুঁজবে না। সেদিন তুমি নিজেকেই ভালোবাসবে। আর ওই ভালোবাসার ছায়াতেই তোমার সমস্ত অসম্পূর্ণতাগুলো পুষে রাখবে।
ভেব না, তুমি পাপ করছ। তুমি কেবল বাঁচার চেষ্টা করছ—যেখানে দমবন্ধ সংসারে কেউ শোনে না, কেউ বোঝে না, সেখানে একজন যদি বোঝে, তবে তার হাতটা ধরাই তো স্বাভাবিক।
তুমি বাঁচো। কফির গন্ধে, শব্দহীন কবিতায়, এবং সেইসব চিঠিতে—যা তুমি কাউকে দেবে না, কিন্তু কোনো এক ভোরবেলায়, নিজের বুকের ভিতর পড়ে ফেলবে।”
চিঠিটা শেষ হয়।
রূপা জানে, জীবনের কিছু সম্পর্ক চিঠির মতোই হয়—লেখা হয়, কিন্তু কখনো পোস্ট করা হয় না।
তবে তার মানে এই নয়, তারা সত্য নয়।
অধ্যায় ৩:
রাত্রি সাড়ে দশটা।
অরিন্দম ধীরে ধীরে ছেলের ঘরের আলো নিভিয়ে দরজাটা টেনে দিল। সাত বছরের রুদ্র তখন গড়াগড়ি খাচ্ছিল লাল কম্বলের নিচে, এক হাতে একটা ছোট্ট খেলনার স্পাইডারম্যান আঁকড়ে ধরা। ও ঘুমোলে পৃথিবীটা একটু ধীর হয়, একটু বেশি নিঃশব্দ।
ছেলের কপালে চুমু খেয়ে অরিন্দম উঠে আসে নিজের ঘরে। বিছানার একদিকে স্ত্রীর ছড়ানো মেকআপ ব্রাশ, মোবাইল চার্জার, হেয়ার স্ট্রেটনার। অন্যদিকে সযত্নে রাখা তার বই—কাজের নোট, আর কিছু কবিতার সংকলন।
স্ত্রী, অমৃতা তখন ফোনে ব্যস্ত। TikTok-এর স্ক্রোলিং চলছে। চোখে ক্লান্তি নেই, কেবল উদাসীনতা।
তাকে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করে না অরিন্দম। কেবল জামা বদলে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
আলো-আঁধারিতে রুফটপে দেখা যায় পাশের বাড়ির ছেলেটা সিগারেট ধরাচ্ছে, আর আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে।
তার মাথার ভিতরে একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—এই যে জীবন চলছে, এটা কি সত্যিই জীবন?
অরিন্দমের বিবাহিত জীবনটা আর পাঁচজনের মতোই শুরু হয়েছিল—প্রেম নয়, বরং ছকে বাঁধা নিরাপদ একটা জোট।
অমৃতা ছিল চটপটে, সুন্দরী, আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু তাদের সম্পর্কটা কখনো “ভালোবাসা” শব্দটা ছুঁয়ে যায়নি।
রুদ্র জন্মানোর পর সমস্ত আবেগ যেন তাদের মাঝে ছড়িয়ে গেল, আর প্রত্যেকেই নিজের নিজস্ব কোণে গুটিয়ে নিল সব অনুভব।
অমৃতা এখন নিজের লাইফস্টাইল ব্লগ চালায়, ইনস্টাগ্রামে রিল তোলে।
অরিন্দম এক ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজার, দিনভর খাতা আর কম্পিউটারের মাঝে জট খোলে।
কিন্তু একদিন…
কলেজের সেই সেমিনারে রূপার সঙ্গে হঠাৎ দেখা।
সেই নার্সারি রঙের শাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর একরাশ চুল।
একটা অদ্ভুত শান্তির ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়েছিল তাকে—যা বহুদিন কোনো নারী দেয়নি।
রূপার সঙ্গে প্রথম কথা হয়েছিল এক লাইন চায়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময়।
সে বলেছিল, “আপনার কাছে কলম আছে? একটা নোট নিচ্ছিলাম।”
সেই কলমে লেখা হয়েছিল বহুদিন পর এমন কিছু কথা, যা কেবল মনে রাখা যায়—চিরকাল।
এখন রোজকার সকালে অফিস যাওয়ার আগে, সে চেষ্টা করে একটা মেসেজ করার।
“রুদ্র আজ নিজে নিজে টিফিন প্যাক করল”
“আজ খুব ক্লান্তি, কিন্তু কাল দেখা হবে?”
“আজ হেমিংওয়ের একটা লাইন মনে পড়ছে, শুনবে?”
রূপা জবাব দেয় ধীর গতিতে। কোনোদিন সকালে, কোনোদিন দুপুরে।
কিন্তু তারা জানে, এই যোগাযোগটাই যথেষ্ট।
তারা চায় না সংসার ভাঙুক, বা অন্য কোনো নাটকীয় পরিবর্তন হোক।
তারা শুধু চায়—একজন বুঝুক।
আজ রাতে, অরিন্দম নিজের ডেস্কে বসে লিখছে।
“রূপা,
আজ রুদ্র আমাকে জিজ্ঞেস করল—‘বাবা, তুমি হাসো না কেন?’
আমি থমকে গিয়েছিলাম।
বাচ্চারা সব দেখে ফেলে। তারা বোঝে—কে সত্যি খুশি, কে শুধু মুখোশ পরে।
তুমি জানো?
তুমি যখন লেখ, আমি সেই শব্দগুলো কেবল পড়ি না—আমি শুনি।
তোমার লেখার মধ্যে একটা নিঃশব্দ পিয়ানোর মতো সুর থাকে, যা বাড়ির কোলাহলের মাঝেও আমাকে শান্ত করে দেয়।
তুমি না থাকলে আমি হয়তো ভুলে যেতাম—ভালোবাসা আসলে কেমন অনুভব।
রুদ্র ঘুমোচ্ছে।
আমিও একটু পরেই চোখ বন্ধ করব।
কিন্তু জানি, তুমি থাকো আমার চিন্তার ভিতর—একটা আলো হয়ে।
– অ”
চিঠিটা সে সেভ করে রাখে নিজের নোট অ্যাপে। পাঠায় না।
তাদের সম্পর্কটা চিঠির মতোই—লেখা হয়, কিন্তু পাঠানো হয় না।
তবুও প্রতিটা শব্দ জীবিত থাকে।
রাত গভীর হলে, হঠাৎ স্ত্রীর আওয়াজে চমকে ওঠে অরিন্দম।
“কাল রুদ্রকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে পারবে?”
সে জবাব দেয়, “হ্যাঁ, অফিস থেকে বেরিয়ে যাব।”
“আর একটা কথা—তুমি একটা লাল শার্ট কেনো না? কাল আমি একটা রিল তুলব, দুজনে একই রঙের জামায়।”
অরিন্দম হেসে ফেলে।
এই জন্যই কি এখন তাদের কথা হয়?
কোথাও একটা ক্যামেরার সামনে নিজেদের সাজাতে?
সে কিছু বলে না। শুধু জানে, সে এখন একটা দ্বৈতজীবন যাপন করছে—
একটা তার সংসারের জন্য, আর একটা নিজস্ব ভালোবাসার নিঃশব্দ ছায়ার মধ্যে।
পরদিন সকালে রুদ্র স্কুলে যাওয়ার সময় বাবাকে আঁকড়ে ধরে বলে,
“বাবা, তুমি আজ আমার স্কুলে আসবে তো?”
অরিন্দম মাথা নাড়ে, “আসব রে। তুমি ভালো করে পড়া শোনাবে কিন্তু।”
রুদ্র হেসে বলে, “আর বলো না! মিস বলেছে আমার লেখা সুন্দর, ঠিক তোমার মতো।”
ছেলেটা হাসে, তারপর বাসে উঠে যায়।
অরিন্দম দাঁড়িয়ে থাকে রোদের মধ্যে।
ভাবতে থাকে—এই বাচ্চা ছেলেটার হাসির মধ্যে হয়তো তার একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আছে।
আর রূপার মধ্যে?
সেখানে আছে বোঝা, আছে অন্তরঙ্গতা, কিন্তু কোনো দাবি নেই।
এই দাবিহীন ভালোবাসা—সেটাই তাকে টেনে নিয়ে চলে প্রতিদিন। রাতের দিকে তারা ফোনে কথা বলে।
দুজনে নিঃশব্দে থাকে অনেকক্ষণ।
তারপর অরিন্দম বলে, “আজ একটা কবিতা লিখেছি, পাঠাবো?”
রূপা বলে, “না। তুমি আমাকে পড়ে শোনাও। শব্দের চেয়ে স্বরটা দরকার।”
অরিন্দম পড়ে শোনায়—
“আমরা দেখা করি অচেনা শহরের মোড়ে,
কোনো নাম নেই আমাদের, কেবল একটা সাদা ছায়া।
তুমি বলো, ভালোবাসা মানে বুঝে নেওয়া—
আর আমি কেবল চোখ বুজে বসে থাকি,
শব্দহীন জ্যোৎস্নার পাশে।”
রূপা চুপ থাকে।
তারপর ধীরে বলে,
“তোমার কবিতাগুলো আমায় জেগে রাখে।
ছেলেটা ঘুমোয়, কিন্তু মেয়েটা জাগে… কারণ তোমার লেখা আছে।”
অরিন্দম আর কিছু বলে না। শুধু শুনে যায়। এইভাবেই চলতে থাকে।
তাদের মাঝে কোনো শারীরিক ছোঁয়া নেই, কোনো বেআইনি কাজ নেই—
আছে কেবল দুটি হৃদয়, যারা একে অপরের নিঃশব্দ পাঠ করে চলে প্রতিদিন।
একটা শহরে, এক বাসার ঘরের এক প্রান্তে,
একজন পুরুষ ছেলে ঘুমোনোর পরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে লেখে—
আর এক নারী, তার নিভে যাওয়া সংসারে, সেই লেখা পড়ে আবার বেঁচে ওঠে।
অধ্যায় ৪:
শহরটা সেদিন একটু অন্যরকম ছিল।
সন্ধ্যা যেন চেনা রঙে রাঙেনি।
আকাশ ছিল হালকা বাদামি ছায়ায় ঢেকে, রাস্তায় অজস্র কুয়াশা আর ফেলে রাখা শিউলির মতো কিছু আবছা শব্দ।
রূপা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল—কলেজ থেকে ফিরে শাড়ি খোলেনি, কেবল চুলের ক্লিপ খুলে দিয়েছিল।
তার চোখে সেই চেনা ক্লান্তি ছিল না, বরং একটা শীতল উত্তেজনা—আজ অরিন্দম এসেছে শহরের এই দিকটায়, কাজে নয়, দেখা করতে।
এই প্রথম তারা নিজেদের সম্পর্ককে চার দেওয়ালের বাইরের আলোতে নিয়ে আসতে চলেছে।
কফি শপ নয়, ক্যাম্পাস নয়—
আজ তারা দেখা করবে “রবীন্দ্র সরোবর”-এ, সন্ধ্যার শেষে, বসে থাকবে লেকের ধারে।
রূপার মনে পড়ছিল সেই গান—
“এই সন্ধ্যার রং যে আলাদা…”
ছেলেকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর, রূপা নিজের স্বামী রণদীপকে ফোন করেছিল—
“আজ একটা সাহিত্যসভায় যাচ্ছি। হয়তো দেরি হবে।”
রণদীপ শুধু বলেছিল, “ঠিক আছে। কিন্তু রুদ্রকে খাওয়ানোর আগে ফোন কোরো।”
তার স্বর ছিল না রাগের, না ভালোবাসার—কেবল একটি যান্ত্রিক অভ্যাসের মত।
অরিন্দম আগে পৌঁছেছিল।
সাদা সোয়েটার পরা, চোখে হালকা চশমা, আর হাতে একটি বই—পল অস্টারের “Invisible”।
রূপা যখন এল, তখন তার হাতে ছিল একটি ছোট্ট নীল থলে, তার ভেতরে একটা কাঠের পেন, একটি চিঠি আর একটি ছোট্ট টিপ ইনসেন্স স্টিক—যার গন্ধ অরিন্দম পছন্দ করে।
তারা পাশাপাশি বসল—
একটা বেঞ্চে, পাশে জলের কণা ছিটে থাকা, পেছনে ঝাউগাছের ছায়া।
তারা কিছুক্ষণ কিছু বলল না।
তাদের কথা না বলার ভিতরেই বহু কিছু বলা হয়ে যাচ্ছিল।
অরিন্দম চুপ করে বলল,
“তোমার চোখে আজ আলো কেমন অন্যরকম।”
রূপা হেসে বলল, “আলো বদলায় সময় বুঝে। আজকের আলো আমাদের জন্য।”
হঠাৎ অরিন্দম নিজের পকেট থেকে একটি ছোট্ট কাগজ বের করল।
একটি কবিতা।
সে পড়তে শুরু করল—
“ভালোবাসা কেবল ছোঁয়ার বিষয় নয়,
ভালোবাসা হলো এমন একজন,
যার সঙ্গে চুপ করে বসেও মন কথা বলে।
যার একটুখানি দৃষ্টি—
তোমাকে তোমার নিজের কাছে ফিরিয়ে দেয়।”
রূপা তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
চোখে জল এসে যাচ্ছিল, কিন্তু সে তা লুকোল না।
সে ধীরে বলল,
“তুমি যদি একদিন হারিয়ে যাও, আমি আর কাউকে খুঁজব না জানো?”
অরিন্দম একটু থমকে বলল,
“আর তুমি যদি চলে যাও, আমি আর কোনোদিন ভালোবাসা লিখতে পারব না।”
তারা ওই সন্ধ্যেয় হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বটগাছের নিচে, যেখানে একটা পুরনো কাঠের ব্রিজ।
ওখানে দাঁড়িয়ে রূপা বলল,
“আমরা তো কোনোদিন একে অপরকে ছুঁইনি, তবু এত কাছে লাগছে কেন?”
অরিন্দম বলল,
“কারণ ছোঁয়ার আগেই যদি কারও স্পর্শ অনুভব হয়, সেটা শরীরের নয়—আত্মার ছোঁয়া।”
তারা একে অপরের দিকে তাকায়,
তাদের চোখে ছিল বহু না বলা কথা,
কিন্তু তারা কিছু বলে না।
এই মুহূর্তটা চিৎকারের জন্য নয়, এটা নীরব প্রেমের মুহূর্ত। রাত নেমে এল। তারা চলে এল মেট্রোর দিকে। রূপা বলল,
“আমার যেতে হবে… রুদ্র খাবে না না হলে।”
অরিন্দম বলল,
“আমি জানি। আমি তোমার পুরোটা চায়নি কোনোদিন… কেবল এই মুহূর্তগুলো।”
তারা হাত মেলাল না।
কেবল চোখে চোখ রেখে একটি নীরবতা ভাগ করে নিল।
রূপা ট্রেনে উঠে চলে গেল।
অরিন্দম জানত—এই সম্পর্ক কোনো চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাবে না।
তবুও সে দাঁড়িয়ে রইল প্ল্যাটফর্মে।
সে অনুভব করল—
সন্ধ্যার এই রংটা অন্যরকম…
যেখানে দুটি মানুষ দূরে থেকেও একে অপরের মধ্যে মিশে যায়।
সেদিন রাতে রূপা তার ডায়েরিতে লিখল—
“ভালোবাসা যদি চিৎকার না হয়, তবে তা গান।
যদি ছোঁয়া না হয়, তবে তা হাওয়া।
আর যদি দখল না চায়, তবে তা মুক্তি।”
অন্যদিকে অরিন্দম, তার ছেলের পাশে বসে শুইয়ে শোনাল—
“আজকের সন্ধ্যেটা ছিল একটু আলাদা রে… জানিস?”
রুদ্র ঘুমিয়ে পড়ল।
অরিন্দম জানত, তার জীবনে বহু সম্পর্ক আসবে না।
এই একটাই থাকবে—
একটি সম্পর্ক, যার নাম নেই, দাবি নেই, ছোঁয়া নেই,
তবুও… অমোঘ টান।
অধ্যায় ৫:
ভোরবেলা শীতের হালকা কুয়াশা ছিল জানালার ধারে।
রূপা তখনও বিছানায় বসে, এক হাতে কফির কাপ, আর এক হাতে তার খাতাটা—যেখানে সে কবিতা লেখে, চিঠি লেখে, অরিন্দমকে উদ্দেশ করে কিন্তু পাঠায় না।
রণদীপ তখন ঘরে না থাকলেও, তার উপস্থিতির এক ধূসর ছায়া সর্বত্র।
রুদ্র ঘুমোচ্ছে, তাই রূপা একটু নিঃশব্দে, একটু নিশ্চিন্তে লিখছিল—
“তুমি আর আমি, একটাই ট্রেনের দুটো জানালা।
একই রাস্তায় চলি, কিন্তু জানি, ছুঁতে পারব না।”
কবিতাটা লিখে রেখে সে উঠে পড়ল। চায়ের কাপে শেষ চুমুক, বিছানার ধারে রাখা ছোট্ট কাঠের ফ্রেমে চোখ পড়তেই থমকে গেল।
ফ্রেমে ছিল রুদ্রর ছোটবেলার ছবি—কিন্তু তার পেছনে লুকিয়ে রাখা ছিল অরিন্দমকে লেখা একটা পুরনো চিঠি, একটা ছোট কাগজ, তাতে লেখা:
“রূপা,
তুমি যদি কবে হারিয়ে যাও, আমি তোমাকে মনে রাখব কফির গন্ধে,
ট্রেনের চিৎকারে, ছেলের হাসিতে।”
হঠাৎ পেছন থেকে দরজার শব্দ—রণদীপ।
সে অফিসের ফাইল খুঁজতে গিয়ে ফ্রেমটা তুলতেই চিঠিটা হাত থেকে পড়ে গেল।
রূপা দেখল—তার চোখে প্রশ্ন নেই, ছিল কেবল দীর্ঘ নীরবতা।সকালে তারা মুখোমুখি চা খেল না।
রণদীপ খুব স্বাভাবিকভাবে অফিসের ব্যাগ গুছিয়ে বলল,
“তুমি কি কবিতা লিখছ?”
রূপা উত্তর দিল না। সে জানে, এই মুহূর্তে কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়োজন নেই।
রণদীপ বলল, “চিঠিটা কার জন্য?”
রূপা বলল, “একজন বন্ধু। যার সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই, কোনো শারীরিক সম্পর্ক নয়, কেবল কিছু কথা ভাগ করে নেওয়া।”
রণদীপ তাকিয়ে বলল, “বন্ধুতা এমন হয়?”
রূপা এবার একটু কাঁপা গলায় বলল,
“বন্ধুতা মানে যে কেবল গল্প নয়, কেউ যদি তোমার হৃদয়ের অলিন্দে নিঃশব্দে বসে থাকে, তাকেও বন্ধু বলে।”
রণদীপ আর কিছু বলল না।
শুধু বলে গেল, “আজ রাতে দেরি করে ফিরব।”
তার গলায় অভিমান ছিল না, ছিল একরকম পরাজয়—নিজেকে বুঝে নেওয়ার।
অপরদিকে অরিন্দম সেই দিন অফিসে বসেই অস্বস্তি অনুভব করছিল।
রূপার কোনো মেসেজ আসেনি, কোনো চিঠি, কোনো কথাও না।
একসময় সে নিজেই লিখল—
“আজ খুব শূন্য লাগছে রে… তুই কথা বলবি না?”
সারাদিন কোনো উত্তর এলো না।
অরিন্দম জানত—এটা প্রথমবার।
তাদের নিঃশব্দ যোগাযোগের মধ্যে প্রথম ফাঁক।
সে বাড়ি ফিরে ছেলেকে খাইয়ে, শুইয়ে, আবার জানালার পাশে দাঁড়াল।
রূপার সেই আগের মেসেজগুলো পড়তে লাগল, বারবার।
“তুমি আছো বলেই আমি নিজের মতো হতে পারি।”
“তুমি আমার ভিতরের আলাদা মেয়েটাকে চিনতে পেরেছ।”
“তুমি যদি একদিন চলে যাও, আমি আর কোনোদিন পুরো হব না।”
এত শব্দ, এত অভ্যন্তরীণ অনুভব… আজ হঠাৎ নিঃস্ব।
রাত দশটা পেরিয়ে গেল।
অরিন্দম কিছু না ভেবে ফোন করল।
রূপা ধরল না।
তবে ঠিক ১০:৪৫-এ একটা মেসেজ এলো—
“আজ কথা বলা যাবে না।
সবকিছু ঠিক আছে, শুধু মনে হচ্ছে, কিছু সময় দূরে থাকা দরকার।”
এই ছেঁড়া শব্দগুলোর ভিতরে কী লুকিয়ে আছে, অরিন্দম বোঝে।
কোনো না বলা কথা, কোনো দুঃখ, কোনো চাপে মুখ বন্ধ করে থাকা।
সে জবাব দিল না। কেবল নিজের চিঠির খাতাটা খুলে লিখল—
“রূপা,
তুমি না বললেও আমি বুঝি, আজ তোমার ভিতরে একরাশ দ্বিধা জমে আছে।
তোমার সংসারের কাছে আমার এই নীরব সম্পর্ক হয়তো অপরাধ মনে হচ্ছে।
কিন্তু জানো?
আমার ভালোবাসা কখনো দখল চায়নি।
শুধু চেয়েছে, তুমি জানো—তুমি একা নও।”
সে সেই চিঠিটাও পাঠাল না।
তাদের সব চিঠিই লেখা হয়, কিন্তু কখনো পাঠানো হয় না।পরদিন রূপা সকালে ছেলে স্কুলে পাঠিয়ে ফিরে আসে চুপচাপ। রণদীপ তখন বসে কফি খাচ্ছিল। তার পাশে রাখা রূপার ডায়েরি।
সে বলল,
“তুমি যদি কখনো চলে যেতে চাও, আমি বাধা দেব না।
কিন্তু রুদ্র যেন কোনোদিন আমাদের দূরত্ব না বোঝে।”
রূপা চুপ করে বসে থাকল।
তার চোখে জল এসেছিল, কিন্তু সে ফেলেনি।
সে বলল,
“আমি যাব না।
কারণ তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা দোষে-দোষে তৈরি হয়নি।
কিন্তু এটাও ঠিক, আমার ভিতরের যে মেয়েটা ছিল—সে হয়তো এখন অন্য কারও ছায়ায় শান্তি পায়।”
রণদীপ বলল,
“তোমাদের কি কিছু হয়েছে?”
রূপা জবাব দিল,
“না। কোনো শরীর নয়।
শুধু কিছু কথোপকথন, কিছু আত্মা স্পর্শ… যা আমি কখনো তোমার সঙ্গে ভাগ করতে পারিনি।”
সেই দিন বিকেলে রূপা মেসেজ করল—
“আজ তোমার কাছে না এলেও, আমি থাকি… এই আকাশের নিচেই, যেখানে তুমি হাঁসো, আমি নিঃশব্দে দেখি।ভালোবাসা হয়তো দূরত্বেও বাঁচে।
তুমি ভালো থেকো, অরিন্দম।”
অরিন্দম বুঝতে পারল—এটা ছেঁড়ার শুরু নয়।
এটা কিছু সময়ের জন্য নিঃশব্দে চলে যাওয়ার মতো।
সে লিখল—
“আমি কোথাও যাইনি, রূপা।
তুমি ফিরে আসবে, আমি জানি।
কারণ আমাদের সম্পর্কটা কোনো ফ্রেমে বাঁধা নয়—
ভেঙে গেলেও, ছবি থেকে যায়।”
সন্ধ্যার আলো নিভে এলো।
অরিন্দমের ঘরে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল।
সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই পুরনো চেনা আকাশ—
যেখানে রূপা নেই,
তবুও তার নিঃশ্বাসের শব্দ যেন বাতাসে লেগে থাকে।
অধ্যায় ৬:
কলেজটা বহুদিন পর আবার চেনা চেহারায় ফিরেছিল।
সেই পুরনো সবুজ গেট, সাদা-হলুদ ভবন, লাইব্রেরির সামনে থাকা অশ্বত্থ গাছ—সবই একরকম রঙিন হয়ে উঠেছিল আজ, “২৫ বছর পূর্তি রিইউনিয়ন” উপলক্ষে।
রূপা কলেজে এসেছিল অনেক দ্বিধা নিয়ে।
অনেক দিন কেটে গেছে।
তার একদমই আসার ইচ্ছে ছিল না।
তবু কলেজের সহপাঠী রুমা ফোন করে বলেছিল—
“শুনেছি অরিন্দম আসছে, একবার দেখা করেই যাস না হয়!”
এই কথাটাই মনে গেঁথে গিয়েছিল।
সে এসেছিল, তবে নিঃশব্দে, কোনো সাড়াশব্দ না দিয়ে।
অন্যদিকে অরিন্দম এসেছিল একেবারে আলাদা মনের অবস্থায়।
তার একহাতে ছিল লাল কাপড়ের পোটলা—যেখানে ছিল একটি পুরনো চিঠি, রূপার লেখা কবিতা, আর একটা কলম, যার ক্যাপ নেই।
সে জানত, আজ যদি রূপাকে দেখে, কিছু বলবে না।
শুধু তাকিয়ে থাকবে।
সন্ধ্যার আলো নিভছিল ধীরে।
কলেজ ক্যাম্পাসে জ্বলছিল ফেস্টুন, আলো, বাজছিল সুমনের গান—
“ভবঘুরে যায় জানে না তো কোথায় তার থামা…”
রূপা তখন লাইব্রেরির পেছনের বাগানে বসেছিল।
হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে ডেকে উঠল—
“তুমি কি এখনও কবিতা লেখ?”
চেনা গলা।
মাথা ঘুরিয়ে রূপা তাকালো।
অরিন্দম।
তারা দুজনেই কয়েক সেকেন্ড একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল—
না হেসে, না বলেই।
এই মুহূর্তটায় যেন সব ফ্রেম থেমে গেল। পেছনের সব আওয়াজ, লোকজন, ক্যামেরা—সব নিস্তব্ধ।
অরিন্দম পাশে এসে বসল। রূপা বলল না, তুমি কেমন আছো।
অরিন্দমও জিজ্ঞেস করল না, কেমন চলছে সংসার।
তারা একসাথে চুপ করে থাকল। এই চুপ করে থাকা যেন নতুন ভাষা।
না বলা সব প্রশ্নের উত্তর তারা চোখে চোখ রেখে খুঁজছিল।
অরিন্দম হঠাৎ বলল,
“তোমার ছেলেটা এখন কত বড়?”
রূপা একটু হাসল,
“সে এখন ক্লাস সেভেনে। দারুণ আঁকে। কিন্তু আমার মতো গুছিয়ে লিখতে পারে না।”
অরিন্দম বলল,
“তোমার লেখাগুলো আমি আজও রেখে দিয়েছি।
তোমার হাতে লেখা কবিতাগুলো… জানো?
তোমার অক্ষরগুলোও অনুভব করতাম। মনে হতো, প্রতিটি হরফের নিচে তুমি লুকিয়ে আছো।”
রূপা হেসে ফেলল।
কিন্তু সেই হাসি ঠোঁট পর্যন্ত এসেই থেমে গেল।
চোখে জল ভরে উঠল।
সে বলল,
“তুমি কি জানো, তোমার চিঠিগুলো আমি কখনোই ফেলিনি?
ছাদে দাঁড়িয়ে পড়তাম একা।
যখন রুদ্র ঘুমিয়ে যেত, আমি শুধু তোমার শব্দে নিজেকে খুঁজতাম।”
বাতাস একটু ঠান্ডা হয়ে এসেছিল।
হঠাৎ মাইক্রোফোনে কেউ ডেকে উঠল,
“সবাই আসুন, এখন গ্রুপ ফটো তোলা হবে!”
রূপা উঠে দাঁড়াল।
অরিন্দম বলল,
“এক মিনিট, এটা তোমার জন্য। শুধু তুমি বুঝবে এর মানে।”
সে পোটলা খুলে রূপার হাতে দিল সেই পুরনো কবিতার খাতা,
আর সেই কলম—যার ক্যাপ নেই।
রূপা একটুও অবাক হলো না।
সে বলল,
“তুমি জানো, ভালোবাসার যেমন পরিণতি হয় না, তেমন কিছু কিছু জিনিস অসম্পূর্ণ থাকলেই পুরো হয়ে ওঠে।”
অরিন্দম চুপ করে থাকল। তার চোখে ছিল একরাশ জ্যোৎস্না।গ্রুপ ফটো তোলার সময় রূপা আর অরিন্দম পাশাপাশি দাঁড়াল না।
তারা দূরে দূরে ছিল—
তবু একজন ক্যামেরাম্যান হঠাৎ বলে উঠল,
“এই দুজনের চোখে তো অন্য আলোর ঝলকানি!”
লোকজন হাসাহাসি করল।
কেউ বুঝল না, তাদের ভালোবাসা কোনো তীব্রতা নয়—
একটা নীরব সম্পর্ক, যেটা চোখে বলে, কথায় নয়।
সন্ধ্যার শেষে যখন সবাই ফিরে যাচ্ছিল,
রূপা আর অরিন্দম লাইব্রেরির সামনে একটু দাঁড়াল।
রূপা বলল,
“তুমি কি জানো, একটা ফোঁটা বরফ যখন হঠাৎ গলায় পড়ে, তখন যা হয়—এক ধাক্কা, ঠান্ডা, গিলে ফেলা যায় না—ঠিক সেই অনুভবটাই আমি পাই তোমার সামনে দাঁড়ালে।”
অরিন্দম হেসে বলল,
“তুমি তো নিজেই একটা কবিতা।”
তারা এবার হাত মেলাল। প্রথমবার।
কোনো হঠাৎ উত্তাপ ছিল না— ছিল এক গভীর নরম স্পর্শ,
যেটা দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ভাষার মত।
রূপা বলল,
“আমি ফিরছি।
কিন্তু তোমার দেওয়া কলমটা আমার ব্যাগেই থাকবে।
হয়তো কোনোদিন আমার ছেলে দিয়ে দিচ্ছে তোমার হাতে… কে জানে!”
অরিন্দম বলল,
“আমি অপেক্ষায় থাকব না, কিন্তু জানব—
তুমি আছো, এই শহরেরই কোথাও,
হয়তো এক জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছো,
যেখানে আমিও তাকিয়ে আছি।”
রূপা যখন গাড়িতে উঠে পড়ল,
তার বুকের মধ্যে কিছু একটা দোলা দিল—
নাকি ভেঙে পড়ল?
সে জানে না। তবে জানে, একফোঁটা বরফ কখনো কখনো গলায় পড়ে না… মনেও পড়ে।
অধ্যায় ৭:
শীতকালের শেষ দিনগুলো ছিল তখন।
কলকাতার বুকের ওপর নরম আলো পড়ছে, যেন সূর্য নিজেই একটু ক্লান্ত, একটু কুয়াশায় ঢাকা।
রূপা সেইদিন রুদ্রকে নিয়ে নন্দনে গিয়েছিল—একটা ছোট বইমেলা হচ্ছিল।
প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা, মোটা কাপড়ে ঢাকা স্টল, বাতাসে পুরনো বইয়ের গন্ধ—সব মিলিয়ে একটা অন্য রকম ছুটির বিকেল।
রুদ্র ঘুরে বেড়াচ্ছিল কমিকস আর সায়েন্স ফিকশনের স্টলে।
রূপা তখন একটা নীল কাপড় পাতা টেবিলে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে “স্থানীয় কবিদের স্বতন্ত্র প্রকাশনা” লেখা একটা সাদা পোস্টার টাঙানো।
তার চোখ একটা বইয়ের ওপরে থেমে গেল।
বইয়ের নাম: “চুপচাপ চিঠি”
লেখক: অরিন্দম ভট্টাচার্য
মূল্য: ১৮০ টাকা
আর তার নিচে লেখা:
“উৎসর্গ – R কে,
যে জানে, কীভাবে শব্দ চুপ করলেও ভালোবাসা কথা বলে।”
রূপার ঠোঁট শুকিয়ে গেল।
সে বইটা ধীরে ধীরে উল্টে দেখতে লাগল।
প্রথম পাতায় অটোগ্রাফ নয়, কিন্তু ছিল একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো, ছাপানো অক্ষরে নয়—নিজের হাতে লেখা।
“রূপা,
এই বইটা যদি একদিন তোমার হাতে আসে,
তবে জানবে, আমার লেখা সব কবিতা আসলে তোমাকেই উদ্দেশ করে।
আমি জানি, তুমি কোনোদিন ফেরো না,
তবু আমি লিখি, যেন তুমি পাশে বসে পড়ছো।”
– অ.”
রূপা বইটা বন্ধ করল।
তার বুকের ভিতর কাঁপছিল।
হাঁটুর কাছে একটা অদ্ভুত কম্পন।
এই চিঠিটা কখনোই ডাকঘরে যায়নি।
এটা ঠিক করে লেখা হয়নি,
কিন্তু এসে পড়েছে তার হাতে—অসীম কাকতালীয়তায়।
হয়তো সবই লেখা থাকে।
হয়তো ভালোবাসার কিছু চিঠি সময় পেরিয়ে পৌঁছায়।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা রূপা ব্যাগে বইটা নিয়ে ফিরে এলো বাড়ি।
রুদ্র তার স্কুল হোমওয়ার্ক নিয়ে বসে গেছে।
রণদীপ অফিস থেকে ফেরেনি।
ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। সে জানালার পাশে বসে বইটা আবার খুলল।
প্রথম কবিতা: “তুমি বলেছিলে, চিঠি বোকারা লেখে,
তবু আমার শব্দেরা তোমার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে।
তুমি বলেছিলে, ভালোবাসা শরীরের ছায়া,
তবু আমি তোমায় ছুঁইনি—
শুধু শব্দের বুকে বসিয়ে রেখেছি।”
তারপর আরেকটি কবিতা—
“তুমি ফেরো না ঠিকই,
তবে আমি এখনও এক ঘর ভরা তোমার জন্য জানালা খুলে রাখি।”
রূপা খাতাটা পাশে রাখে।
সে জানে, অরিন্দম এই বইটা তার হাতে পৌঁছনোর জন্য রাখেনি—
সে শুধু লিখেছে, যেন নিজেকে বাঁচাতে পারে।
কিন্তু সময়, যাকে আমরা ফাঁকি দিতে পারি না—সে মাঝে মাঝে এমন খেলাও খেলতে পারে।
পরদিন সকালে রূপা ছেলেকে স্কুলে দিয়ে একটা পুরনো ঠিকানায় গেল।
হলদে রঙের একতলা বাড়ি, বালিগঞ্জের অদূরে।
কোনো নামফলক নেই, শুধু দরজার পাশে “ভট্টাচার্য” লেখা প্লেট।
রূপা হালকা কাঁপা হাতে কলিং বেল টিপল। দরজা খুলল অরিন্দম। তার চোখে বিস্ময় নেই,
কেবল একরাশ আশ্চর্য স্বাভাবিকতা—যা কেবল প্রতীক্ষা করতে করতে আসে।
রূপা বলল,
“তোমার বইটা পেলাম। আর সেই চিঠি।”
অরিন্দম একটু হেসে বলল,
“আমি জানতাম, একদিন তুমি পাবে।”
“কিন্তু তুমি লিখেছিলে—‘তুমি কোনোদিন ফেরো না’।
আমি তো ফিরে এলাম…”
অরিন্দম বলল,
“সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো চলে যায় না,
তাই সে ফিরে আসে না।
সে শুধু একভাবে টিকে থাকে।”
রূপা চুপ করে বসে রইল সোফায়।
টেবিলের ওপর রাখা এক কাপ কফি, এক খানা লেখা কাগজ—যেখানে অরিন্দম লিখছিল নতুন কবিতা।
সে একটু থেমে বলল,
“তুমি কি জানো, এই গল্পটা কোনোদিন শেষ হয় না।
শুধু চরিত্ররা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।”
রূপা বলল,
“তবে চরিত্ররাও তো একদিন লেখকের ওপর অভিমান করে।”
অরিন্দম চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।
তার চোখে ছিল এমন এক নীরব দৃষ্টি—যেটা চিৎকার করে বলে,
“তুমি গেলে না, তবু আমি হারালাম।”
একটা দীর্ঘ নিঃশব্দ মুহূর্তের পর রূপা বলল,
“এই বইটা আমি রুদ্রকে দেব একদিন।
বলব, এটা এক বন্ধুর লেখা, যে কেবল শব্দ দিয়ে ভালোবাসত।
যার কাছে স্পর্শের চেয়ে বেশি ছিল নীরব চিঠি।”
অরিন্দম বলল,
“তোমার ছেলেই তো একদিন বুঝবে—
ভালোবাসা মানে কেবল পাওয়া নয়,
ভালোবাসা মানে একটা জানালার পাশে বসে থাকা,
যেখানে কেউ কখনো ফিরবে না,
তবু তুমি তাকিয়ে থাকো।”
রূপা যখন ফিরছিল, তার চোখে জল ছিল না। তার বুক হালকা হয়ে গিয়েছিল। সে জানত, কিছু সম্পর্ক দোষের নয়, শুধু সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা— একটা পকেট ঘড়ির মতো, যার কাঁটা থেমে গেছে,
তবু যার মধ্যে একটা অদ্ভুত সুর বাজে।
অধ্যায় ৮:
কলকাতায় সেদিন ছিল এক অদ্ভুত রকম বৃষ্টি।
জানালার কাঁচের ওপর টিপ টিপ করে জল পড়ছিল,
আর তার তলায় কফির কাপে উঠে আসছিল হালকা ধোঁয়া।
রূপা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল।
পরনে একটা হালকা ধূসর শাল,
চোখে ক্লান্তি আর মনের ভিতর জটলা।
রুদ্র ঘুমিয়ে পড়েছে।
তার চুলে হাত বুলিয়ে সে বলেছিল,
“আজকের রাতটা যেন একটু ধীর হয়।”
আর রান্নাঘরে তখন গরম দুধ গরম হচ্ছিল।
রূপার স্বামী রণদীপ অনেক রাতে বাড়ি ফিরল।
পেছনে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, চুপচাপ মুখ।
গলা নামিয়ে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়েছো?”
রূপা বলল,
“না, এই বৃষ্টিতে ঘুম আসে না।”
রণদীপ জামাকাপড় পাল্টে সোফায় এসে বসে।
তার চোখের নিচে কালচে ছাপ, যেন কয়েক রাত ঘুম হয়নি।
সে এক চুমুক কফি খেয়ে হঠাৎ বলল—
“তুমি কিছু লুকাচ্ছো?”
রূপা থমকে যায়।
সে জানে না, এই প্রশ্নের উত্তর কী।
সে কিছু বলার আগেই রণদীপ নিজেই বলল—
“আমি লুকাইনি। শুধু চুপ করে ছিলাম।
তোমার আর অরিন্দমের ব্যাপারে আমি জানতাম বহু বছর আগে থেকেই।”
রূপা এতদিনে প্রথমবার স্বামীকে এভাবে কথা বলতে শুনল।
একটুও রাগ নেই,
একটুও অভিমান নয়,
শুধু এক গভীর, নরম সত্যের মতো।
সে বলল,
“তুমি জানলে কীভাবে?”
রণদীপ হাসল,
“আমরা যারা একসাথে থাকি, তারা চেহারা পড়ি না—চোখ পড়ি।
তুমি যখন জানালার ধারে বসে কবিতা লিখতে,
যখন হঠাৎ একা হেসে ফেলতে,
আমি জানতাম, তুমি কাউকে মনে করছো।
আর একদিন তোমার বইয়ের ভেতরে একটা চিঠি পেয়ে যাই, নামহীন,
তবু আমি বুঝে নিই—তোমার ভেতর একটা গল্প লুকিয়ে আছে।”
রূপা চুপ করে থাকে।
তার চোখে জল নেই,
তবু তার বুক যেন ভারী হয়ে উঠছে।
রণদীপ বলল,
“তুমি জানো, আমি তোমাকে কোনোদিন প্রশ্ন করিনি কেন?”
“কারণ, আমি চেয়েছিলাম তুমি যা হারিয়েছো—তা না হারাও।
আমি বুঝতাম, তুমি একা নও,
তবু আমি চেয়েছি তুমি শান্ত থাকো।”
রূপা ফিসফিস করে বলে—
“আমি কোনো অন্যায় করিনি,
তবু নিজেকে অপরাধী মনে হতো।
তুমি এত ভালো যে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে সত্য বলতে সাহস পেতাম না।”
রণদীপ এবার একদম ধীরে বলল—
“ভালোবাসা কখনো অন্যায় হয় না,
যদি সে কাউকে ভাঙে না, ছিঁড়ে না ফেলে।
তুমি কখনো আমাকে ঠকাওনি।
শুধু একটা গল্প বাঁচিয়ে রেখেছিলে নিজের ভেতরে,
যার শেষে আমি ছিলাম না।”
বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে পড়ে। জানালার কাঁচ ধোঁয়াটে হয়ে ওঠে।
রূপা এবার ধীরে ধীরে বলে—
“কাল বইমেলায় অরিন্দমের কবিতার বই পেয়েছিলাম।
তার চিঠিও…
সে আজও আমাকে মনে রাখে।”
রণদীপ একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল—
“তুমি কি চাও, একদিন ওকে চিঠি লেখো?”
রূপা বিস্ময়ে তাকায়।
এই প্রশ্ন সে আশা করেনি।
সে বলে—
“তুমি কি চাইছো আমি…?”
রণদীপ বলল,
“আমি চাই তুমি হালকা হও।
ভালোবাসা কেবল শরীরের চুক্তি নয়—এটা আত্মার অভিসার।
তুমি যদি চিঠি লিখে শান্তি পাও, তবে লেখো।
আমি চাই তুমি নিজেকে বুঝে নাও—আমার কাছেও, তার কাছেও।”
রূপা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
এক ফোঁটা জল জানালার কাচ বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে—ঠিক তার মতোই।
সে জানে, এই বৃষ্টি শুধু বাইরের নয়,
মনের মধ্যেও একটা দীর্ঘ অপেক্ষার পর বারি পড়ে।
রাত্রি তখন গভীর। রুদ্র ঘুমিয়ে আছে, রান্নাঘর নিঃসাড়।
রূপা ডেস্কে বসে একটা নতুন চিঠি লিখে—
“প্রিয় অ,
আজ আমি স্বামীকে তোমার কথা বলেছি।
সে আমাকে চিঠি লিখতে দিয়েছে,
তাই এই চিঠি।
তুমি জানো, ভালোবাসা যখন অপরাধ মনে হয়, তখন বেঁচে থাকা কঠিন হয়।
তুমি আমায় আজও ভালোবাসো কিনা জানি না,
তবে আমি জানি—তুমি আমার শব্দ।
যদি কোনোদিন আমরা একসাথে না-ও থাকি,
জানো, আমি জানালার ধারে বসে থাকব—
ঠিক যেমন তুমি ভেবেছিলে।
তোমার – র”
চিঠি শেষ হয়, কিন্তু অনুভব শেষ হয় না।
সে জানে, জীবনটা হয়তো নতুন কোনো গল্প খুঁজবে না,
তবু একবার চিঠি লেখা মানে নিজেকে ছুঁয়ে ফেলা—
তাকে নয়, নিজেকে।
সেই রাতটা তাদের জীবনে খুব সাধারণ রাত ছিল।
তবু পরদিন সকালে সূর্য উঠল এক নতুন আলো নিয়ে।
রূপা রান্নাঘরে গরম চা করে,
রণদীপের পাশে বসে বলল—
“আজ আমি চিঠিটা পোস্ট করব।”
রণদীপ বলল,
“পোস্ট করো, এবং নিজেকেও একটা চিঠি লেখো।
ভালোবাসার চিঠি কেবল কাউকে নয়, নিজের প্রতিও লেখা যায়।”
রূপা এবার জানালার পাশে বসল। বৃষ্টি থেমে গেছে।
শুধু কুয়াশা ভেসে উঠছে, আর এক অদ্ভুত শান্তি।
এই প্রথমবার, সে নিজেকে অপরাধী মনে করল না।
ভালোবাসা, সম্পর্ক, সংসার—সবই পাশাপাশি চলে যেতে পারে—
যদি সেখানে সত্য, শ্রদ্ধা আর কিছু শব্দ থাকে…
যেগুলো চুপ করেও বলে যায়।
অধ্যায় ৯:
শীতের মধ্যভাগে কলকাতা যেন এক বর্ণহীন পটচিত্র।
নির্বাক আলো এসে পড়ে জানালার কাচে,
আর সেই আলোয় রূপা প্রায় প্রতিদিন একঘণ্টা বসে থাকে — কিছু না বলে, কিছু না করে।
রুদ্র এখন স্কুলে যায় সকালবেলা।
রণদীপ অফিসে ব্যস্ত, সকালে খবরের কাগজের পাতায় ডুবে থাকে।
আর রূপা?
সে এক অদ্ভুত দ্বৈতজগতে বাস করে —
একদিকে সংসারের কাপ-প্লেট-তরকারি,
আরেকদিকে মনের গভীরে একটা অদৃশ্য চিঠির অক্ষর।
সেদিন সকালে ডাকবাক্সে একটা খাম এসে পৌঁছল।
সাদা খাম, তার ওপরে লেখা —
“রূপা ব্যানার্জী, ব্যক্তিগত”
পেছনে কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু এক লাল কালি দিয়ে লেখা ছোট্ট “অ”।
রূপার বুক ধকধক করে ওঠে।
সে দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খামটা খুলে।
ভেতরে একটা খাতার পাতার মতো পাতলা কাগজ,
আর সঙ্গে একটা কবিতার বইয়ের খসড়া — হাতে বাঁধা, এখনও মুদ্রিত নয়।
কাগজে লেখা:
রূপা,
আমি জানি, তুমি কোনোদিন উত্তর দেবে না।
তবু এই বইটা পাঠালাম — এখনও শেষ হয়নি।
তবু তোমার জন্যই লিখছি।
এটা ‘আলো-আঁধারির ডায়রি’ — সেইসব অনুভবের জন্য, যাদের মুখ নেই, অথচ গন্ধ থাকে।
পৃষ্ঠা ১৭, ২৩, ৩১ — এই তিনটি কবিতা তোমার।
বাকিগুলো আমি এখনও লিখে চলেছি।
ভালো থেকো।
– অ
রূপা বইটা নিয়ে জানালার ধারে বসে।
মেঘলা সকাল, আলো নরম, কফির কাপ পাশেই।
সে পৃষ্ঠা ১৭ খুলে পড়ে:
“আলনা”
তুমি ছিলে আমার প্রতিদিনের আলনা,
যেখানে আমি ভিজে চুল মেলে রাখতাম সন্ধেবেলা।
তুমি ছিলে আমার গলার হালকা লাজুক দড়ি,
যেটা খুলতে গিয়ে আমি নিজেকে খুঁজি।
তুমি ছিলে না,
তবু আমি তোমায় ছুঁয়ে থাকি,
আমার রোজকার কাপড়ের ভিতর।
রূপার চোখে জল এসে যায়।
এই কবিতাটা শুধু তার জন্য,
শুধু তার জানালার ধারে বসে থাকা দুপুরগুলোর জন্য।
সে পৃষ্ঠা ২৩ খুলে:
“অপ্রকাশিত চিঠি”
তোমার নামে কোনোদিন চিঠি লেখিনি,
তবু প্রতিটি শব্দে তুমি ছিলে।
তোমার জানালায় আলো এলেই,
আমার কলম জেগে ওঠে।
আমি ভাবি—
ভালোবাসা চিঠিতে আসে না,
সে আসে এক ফাঁকা লাইনে—
যেখানে কেউ কোনো শব্দ লেখেনি,
তবু কেউ কিছু পড়ে ফেলে।
এটা সেই কবিতা যা রূপার ভিতরের নিঃশব্দ অনুভব বলে দেয়।
তার মনে পড়ে, কতদিন সে ডায়েরিতে লেখা শুরু করত,
আর শেষ না করে কেবল অর্ধেক বাক্যে থেমে যেত।
আর এখন—অরিন্দম ঠিক সেসব বুঝে ফেলেছে।
শেষে পৃষ্ঠা ৩১:
“নিঃশব্দ চায়ের কাপ”
তুমি যদি কোনোদিন ফিরে এসো,
তবে এসো সন্ধের আলোয়,
যখন আমি কেবল একটা চায়ের কাপ পাশে রেখে বসে থাকি।
তুমি যদি কোনোদিন ফিরে এসো,
তবে বলো না কিছু,
শুধু বসে থেকো—
আমি তোমার জন্য দ্বিতীয় কাপটা ঢেলে দেব।
ভালোবাসা মানে হয়তো কথার বাহুল্য নয়,
ভালোবাসা মানে দুই কাপ চায়ের নিঃশব্দতা।
রূপার মনে হলো, এই বইটা যেন তার নিজস্ব আয়না।
প্রতিটি পংক্তি যেন তাকে টেনে নিচ্ছে এক নিঃশব্দ ব্যাকরণে—
যেখানে ভালোবাসার কোনো নিয়ম নেই,
শুধু অনুভবের ক্ষীণ চিহ্ন।
সন্ধ্যায় রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রূপা রণদীপকে বলল,
“আজ একটা চিঠি পেয়েছি।
অরিন্দম তার নতুন কবিতার খসড়া পাঠিয়েছে।”
রণদীপ এক মুহূর্ত থেমে বলল,
“তোমার মুখে শান্তি দেখছি আজ।
তা ভালো।”
রূপা জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি রাগ করো না?”
রণদীপ উত্তর দিল,
“রাগ করতাম যদি তুমি আমায় ঠকাতে—
কিন্তু তুমি শুধু নিজের এক টুকরো গল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছো।
সেটা কোনো অপরাধ নয়।”
রূপা জানে, এমন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের।
তবু তার ভিতরে কোথাও একটা স্নিগ্ধ অনুরণন বাজে।
রাতের অন্ধকারে সে আবার সেই খসড়া বইটা হাতে নেয়।
প্রথম পাতায় নিজের হাতে লিখে:
“এই বই আমি নিজের কাছে রাখলাম,
কারণ এর প্রতিটি শব্দে আমি আছি,
আর তুমি।
আমরা যাঁরা একে অপরকে হারাইনি,
তাঁরা কেবল একটু দূরে গিয়ে বসেছি।”
সে বইটা তার বুকশেলফের ঠিক মাঝে রেখে দেয়—
সেই জায়গায় যেখানে সে প্রতিদিন চোখ রাখে।
আর জানালার ধারে বসে সে একটা চিঠি লিখে—
প্রিয় অ,
এই বইটা কেবল কবিতা নয়,
আমার নিজস্ব এক আলো-আঁধারির যাপন।
তুমি জানো, ভালোবাসা মানে কেবল একে অপরের পাশে থাকা নয়,
ভালোবাসা মানে দূরত্বেও হাত ছুঁয়ে থাকা।
তুমি যদি কোনোদিন এই বইয়ের সব কবিতা শেষ করো,
তবে জানিও—আমি অপেক্ষা করব শেষ পাতায়।
সেই পৃষ্ঠায়, যেখানে লেখা থাকবে—
‘এই গল্প শেষ নয়’।
– র.”
সেই রাতটা বড় নিঃশব্দ ছিল। তবু অদ্ভুতভাবে, জানালার কাচে একটাও বৃষ্টি পড়ে না,
শুধু শীতের হালকা কুয়াশা,
আর এক অজানা আলো।
ভালোবাসা, হয়তো সত্যিই কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা মানে না।
এটা কেবল একটা অনুভব—
যা আলো-আঁধারির মধ্যেও জ্বলে থাকে।
অধ্যায় ১০:
বইমেলার সেই শনিবার, রূপা একাই গেল।
রণদীপ অফিসে, রুদ্র স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেছে।
তার ব্যাগে ছিল একটা ছোট্ট চিঠি—নিজের লেখা, নিজের কাছে।
আর মনে ছিল অদ্ভুত এক কৌতূহল—
অরিন্দম কি সত্যিই সেই কবিতার বইটা ছেপেছে?
কলকাতার বইমেলা এক আলাদা ঘ্রাণে ভরে থাকে—
মাটির গন্ধ, নতুন কাগজের শব্দ, আর মানুষের স্রোত।
রূপা একটার পর একটা স্টলে ঘোরে,
শেষে এক কোণে ছোটো একটা ডেস্কে চোখ পড়ে—
সেখানে লেখা:
“আলো-আঁধারির ডায়রি – অরিন্দম চক্রবর্তী”
তার বুক ধড়াস করে ওঠে।
একটা বুক সেলফ থেকে সে ধীরে বইটা তোলে।
চেনা কভার, সাদামাটা, তার মতোই শান্ত।
ভিতরে পাতা উল্টে দেখে—
পৃষ্ঠা ১৭, ২৩, ৩১… সব আছে।
কিন্তু এবার এক নতুন চমক—
শেষ পাতায় একটা কবিতা, যা আগে ছিল না।
শেষ পৃষ্ঠার কবিতা
(কোনো নাম নেই)
“তুমি যদি একদিন
নিজের চোখ দিয়ে পড়ো এই বই,
তবে জেনো—
প্রতিটি পঙক্তিতে আমি তোমাকে ডাক দিয়েছি।
তুমি যদি কোনোদিন
জানালার ধারে বসে থাকো নিঃশব্দে,
তবে বুঝে নিও—
এই কবিতার প্রতিটি ফাঁকে আমার নিঃশ্বাস লুকোনো।
তুমি যদি এই বইয়ের
শেষ পাতায় এসে চুপ করে যাও,
তবে জানো—
ভালোবাসা কোনোদিন ফুরোয় না।
সে শুধু কাগজ ফুরিয়ে গেলে
মনের মধ্যে লিখে যায়।”
রূপা পড়ে থমকে যায়।
তার বুকের ভেতর যেন এক পাথর গলে জল হয়ে যাচ্ছে।
বইটা সে বুকের কাছে টেনে ধরে।
চারপাশের কোলাহলে সে নিজেকে হারায় না—
বরং ভিতরে ভিতরে যেন একটা নীরব সংগীত বেজে চলে।
সে স্টল-এ দাঁড়িয়ে বইটা কিনে নেয়।
বইয়ের ভিতরে, খুব নীচের কোণায় অরিন্দম নিজের হাতে লিখেছে—
“রূপার জন্য,
যাকে আমি কোনোদিন চাইনি,
তবু ভালোবেসে ফেলেছি —
বিনা প্রতিদানে,
বিনা শর্তে।”
রাত তখন গভীর।
রুদ্র ঘুমিয়ে গেছে।
রণদীপ বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে।
রূপা তার কাছে এসে বসে, আর বইটা তুলে ধরে।
রণদীপ পাতা উল্টে শেষ পাতার কবিতা পড়ে।
একটু চুপ থেকে বলল,
“তুমি এই কবিতা পড়ার পর কাঁদলে না কেন?”
রূপা মৃদু হাসে—
“কারণ, এটা কান্নার কবিতা নয়।
এটা বুঝে নেওয়ার কবিতা।”
রণদীপ মাথা নাড়ে,
“তুমি জানো, আমি কখনো অরিন্দমকে দেখিনি।
তবু তার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই।
সে তোমাকে ভালোবেসেছে এমনভাবে, যা অন্যায় নয়—শুধু অসময়ে।”
রূপা ধীরে বলে—
“ভালোবাসা কোনোদিন সময় দেখে আসে না।
সে শুধু থেকে যায়… কাগজের ফাঁকে, জানালার পাশে,
নিঃশব্দতাকে জড়িয়ে।”
রণদীপ বলল,
“তুমি কি চাও, আমি তাকে একদিন চা খেতে ডাকি?”
রূপা চমকে যায়।
“তুমি ডাকবে?”
রণদীপ মুচকি হেসে বলে—
“যে পুরুষ তোমার ভিতরটা বুঝতে পেরেছে,
তার সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই।
বরং সে আমার সেই অংশ,
যাকে আমি চিরকাল বুঝে উঠতে পারিনি।”
রূপা বিছানায় শুয়ে পড়ে। বইটা বুকের কাছে চেপে ধরে।
চোখে জল নেই, তবু মনে এক আলো জ্বলে।
সে জানে, এই জীবন, এই সংসার, এই সম্পর্ক— সবটাই তার নিজস্ব কবিতার মতো। আর সেই কবিতা… শেষ পৃষ্ঠায় গিয়েও শেষ হয় না।
***
তিন বছর পেরিয়ে গেছে।
বইটা এখন অনেকের হাতে ঘুরেছে — “আলো-আঁধারির ডায়রি”
তার লেখক এখন একজন খ্যাতিমান কবি, অরিন্দম চক্রবর্তী।
পত্রপত্রিকায়, অনুষ্ঠানে, পাঠচক্রে তার নাম শোনা যায়।
তবে তিনি এক Interviews-এ সবসময় বলেন,
“এই বইটা আসলে এক নারীর নামে উৎসর্গ করা —
যাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম, নিঃশব্দে, অপ্রকাশ্যে।”
আর সেই রূপা?
সে এখনও সেই আগের মতোই—
বেলা তিনটেয় চা বানায়,
রুদ্রকে নিয়ে বইমেলায় যায়,
রণদীপের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে।
তবে তার বুকের ভিতরে একটা বই এখনও কাঁপে মাঝে মাঝে—
একটা পাতা খুলে, আবার বন্ধ হয়ে যায়।
সেই বিকেলে হঠাৎ রণদীপ বলল,
“তুমি বলছিলে অরিন্দম আবার কলকাতায় এসেছে।
একটি পাঠচক্রে তার সেশন ছিল আজ।
চলো, তাকে একদিন আমাদের বাড়িতে ডাকি।
চা খাব সবাই মিলে।”
রূপা থমকে গেল।
তিন বছর ধরে যাকে সে চিঠি লেখেনি, ফোন করেনি, দেখেনি —
আজ সেই মানুষকে নিমন্ত্রণ করতে হবে চায়ের কাপ হাতে?
তবু সে চুপ করে মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে, ডেকে নাও।
চা আমি নিজে বানাব।”
সেদিন সন্ধেয় অরিন্দম এল।
হালকা ধূসর পাঞ্জাবি পরা, চোখে পুরোনো চশমা।
মুখে অল্প দাড়ি, কিন্তু অভ্যস্ত এক গাম্ভীর্য।
দরজা খুলে তাকে দেখে রূপা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে।
তারপর শুধু বলে,
“ভিতরে এসো। রুদ্র বাড়ি নেই।
তুমি নিশ্চিন্তে চা খেতে পারো।”
অরিন্দম মাথা ঝুঁকিয়ে বলে,
“তিন বছর হয়ে গেছে,
তবু মনে হয়, কাল বিকেলে শেষ দেখা হয়েছিল।”
রণদীপ উঠে এসে হাত বাড়ায়—
“অরিন্দম, আমি রণদীপ।
রূপার স্বামী।
তোমার লেখা আমি পড়েছি।
অসাধারণ।”
অরিন্দম একটু থতমত খেয়ে বলল,
“তুমি জানো?”
রণদীপ হেসে বলে,
“রূপা লুকায় না কিছু।
সে তার অনুভবগুলো আমাকে বলে—যতটুকু পারে।
তোমার জায়গাটা আমি বোঝি।”
অরিন্দম বসে।
রূপা এসে সামনে তিনটা কাপ রাখে—দুইটা পোরসেলিন, একটা স্টিল।
রণদীপ সেটা দেখে বলে,
“এইটা অরিন্দমের কাপ?”
রূপা মাথা নাড়ায়,
“এইটা সেই কাপ, যেটা আমি একা থাকলে ব্যবহার করি।
আজ সেটা ওকে দিলাম।”
চা পড়ে ধীরে ধীরে বাষ্প উঠতে থাকে।
তিনজন মানুষ, এক চুপচাপ ঘরে বসে।
তাদের মধ্যে বলা কিছু নেই,
তবু সময় যেন তাদের বুকের মধ্যে হেঁটে বেড়ায়।
অরিন্দম বলল,
“তোমাদের দেখে ভালো লাগছে।
অনেকটা শান্তির মতো লাগে।”
রণদীপ বলল,
“তুমি জানো অরিন্দম, রূপার জীবনে তুমি একটা দরজা খুলেছিলে—
যেটা আমি নিজে খুঁজেও পাইনি।
তাই আমি কৃতজ্ঞ।
আর আমি চাই তুমি মাঝে মাঝে এসো।”
অরিন্দম একটু থেমে বলল,
“আমি এসেছিলাম যাওয়ার জন্য না।
আমি এসেছি থেকেও চলে যাওয়ার জন্য।”
রূপা এবার প্রথমবার চেয়ে বলল,
“তুমি যাবে?”
অরিন্দম জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ।
আজকের এই সন্ধ্যাটা চিরকাল মনে থাকবে।
তুমি এখন পরিপূর্ণ।
তোমার ভালোবাসা একসময় আমার ছিল,
আজ সেটা পূর্ণতা পেয়েছে—রণদীপের মাধ্যমে।”
রূপা চা শেষ করে ধীরে বলল,
“ভালোবাসা কখনো চলে যায় না।
সে রূপ বদলায়।
তুমি আমার প্রথম কবিতা।
রণদীপ আমার শেষ অধ্যায়।
তোমরা দুইজন—আমার একটাই উপন্যাস।”
অরিন্দম উঠল।
তার হাতে একটা প্যাকেট।
রূপাকে দিয়ে বলল,
“এইটা তোমার জন্য।
আমার দ্বিতীয় কবিতার সংকলন—
‘নিঃশব্দের দরজায়’।
শেষ পাতায় একটা কবিতা আছে,
তুমি বুঝে যাবে।”
রণদীপ বলে,
“যাবে?”
অরিন্দম বলে,
“না, আমি এখনো আছি।
তবে এবার যেতে হবে।
তুমি আর রূপা দুজনেই এই শহরের গল্প হয়ে গেছো—
আর আমি একজন পাঠক।”
রাত্রে রূপা বইটা খোলে।
শেষ পৃষ্ঠা।
কবিতার নাম—
“এক কাপ চা, তিনজন মানুষ”
প্রথম কাপ—সে একা ছিল,
দ্বিতীয় কাপ—দুজন মিলে ভাগ করে নিয়েছিল,
আর তৃতীয় কাপ,
সেই কাপ কেউ খায়নি—
কিন্তু তার বাষ্প এখনও জানালায় ধোঁয়া তোলে।
রূপার চোখ বুজে আসে।
বিছানায় শুয়ে পড়ে রণদীপ পাশে।
সে ধীরে বলে,
“আজ শান্তি লাগছে।”
রণদীপ উত্তর দেয়,
“তিনটা কাপ ছিল, তিনজন মানুষ। কেউ কাউকে ঠকায়নি। সবাই একটু করে ভালোবেসেছে।”
রূপা হেসে বলে,
“তবু আমি কৃতজ্ঞ,
কারণ কেউ আমার ভালোবাসার সামনে দাঁড়িয়ে দেয়াল হয়নি।”
বাইরে শীত। জানালার ধারে রাখা সেই স্টিলের কাপটা এখনও উষ্ণ। ভেতরে কেউ নেই, তবু তাতে রাখা আছে এক নিঃশব্দ অনুভব। এইভাবেই গল্প শেষ হয় না। সে থেকে যায়।
এক কাপ চা হয়ে, তিনজন মানুষের নীরব সম্মতিতে।
—
[শেষ]