Bangla - কল্পবিজ্ঞান

নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া

Spread the love

ঋষভ সেনগুপ্ত


শব্দজল

শান্তিনিকেতনের গ্রীষ্ম বিকেলে লালমাটির ওপর দিয়ে ধুলো উড়ে যাচ্ছিল। আকাশের রঙ ঠিক সোনালি নয়, আবার ছায়াও নয়—অদ্ভুত এক নির্লিপ্ত আলোয় মোড়া। আর সেই আলোয় দাঁড়িয়ে ছিল সে—নির্বাক, চোখে বিস্ময়ের জল, যেন চুপ করে আছে কোনো শব্দের প্রতীক্ষায়। তার নাম অয়ন। কবি, নাকি ভাঙা মানুষের সমষ্টি—এই নিয়ে কেউ নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু একথা জানত সবাই—সে কথা শুনতে পায় যা কেউ শোনে না। সে শব্দ খুঁজে বেড়ায়, যেমন কেউ ভালোবাসা খোঁজে পুরোনো চিঠির ভাঁজে।

অয়নের প্রেমিকা তিশা মারা গিয়েছিল বছরখানেক আগে। আত্মহত্যা, বলা হয়। শান্তিনিকেতনের শান্ত গলিতে সেই খবরও একদিন ধুলো হয়ে উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু অয়ন বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ, মৃত্যুর ঠিক আগের দিন সকালে সে একটা কাগজে একটা লাইন লিখে রেখে গিয়েছিল—তোমার জন্য রেখে গেলাম আমার শেষ শব্দটা।

এতদিন পরে এক গবেষক বন্ধুর মাধ্যমে অয়ন জানতে পারে ECHO-9 নামের এক পরীক্ষামূলক যন্ত্রের কথা—একটি শব্দ-সংরক্ষণ যন্ত্র যা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বলা প্রতিটি শব্দ জলীয় তরঙ্গরূপে ধরে রাখে, এবং একমাত্র সঠিক অনুরণন মানদণ্ডে তা ফেরত আনা সম্ভব।

এই যন্ত্রটি লুকোনো ছিল শান্তিনিকেতনের একটি অব্যবহৃত কলাভবন ভবনের নীচে—এক গোপন গবেষণাগারে। প্রোজেক্টটির নাম ছিল SONATA—Sound Narrative Tracing Apparatus। গবেষণাটি ছিল গবেষক-তন্ত্রিক ডঃ চন্দন ব্যানার্জীর তত্ত্বাবধানে, যিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রতিটি শব্দ শুধুই শব্দ নয়, একটি অস্তিত্ব, একটি অবচেতনার রেখা।

অয়ন সেই যন্ত্রে প্রবেশ করে। ডঃ চন্দন তার পুরোনো ছাত্র, তাই অনুমতি না নিয়ে সে নিচে নেমে আসে। অন্ধকার ঘরে যন্ত্রটি ছিল কাচের ভিতরে, চারপাশে বৃত্তাকারে সাউন্ড-মাইক্রোফোনের গঠন, আর মাঝখানে এক জলরঙা হ্রদের মতো তরল প্লাজমা, যার মধ্যে শব্দ “ঝরে পড়ে।”

অয়ন বুঝে যায়, যদি সে জানে তিশার মৃত্যুর দিন তার কণ্ঠ কোথায় প্রতিধ্বনি দিয়েছিল—তবে সেই ঘরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ঘড়ির সময় জানলে—তবে যন্ত্রটি তিশার সেই শেষ উচ্চারণ ফিরিয়ে দিতে পারে।

তিশার মৃত্যু হয়েছিল শান্তিনিকেতনের হাটে, “পান্নালালের কুঁড়েঘর” নামের একটি ছোট ঘরে—যেখানে তারা একসময় কবিতার কর্মশালা করত। অয়ন সেদিনের ঘড়ির সময় জানে—সকাল ১১টা ৫১ মিনিট। জানে সেই ঘরের কাঠের জানালায় যে বকুলফুলের ঘ্রাণ ছিল, সেটাও।

সে SONATA-তে সমস্ত তথ্য ইনপুট করে। যন্ত্রের মাঝখানের তরল তরঙ্গে এক কুয়াশা তৈরি হয়। চারদিকে হালকা শব্দ—হাসি, পায়ের আওয়াজ, বাতাসে গুনগুন। তারপর হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ—

ভালো থেকো।

শুধু দুটি শব্দ। কিন্তু সেই কণ্ঠ শুনেই অয়ন স্তব্ধ হয়ে যায়। সে তিশার কণ্ঠ চিনতে ভুল করে না। সেই কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, যেন কষ্টে আটকে ছিল বহুদিন, আজ নিজে থেকেই বেরিয়ে এল।

কিন্তু পরমুহূর্তেই তরলে দেখা যায় এক কৌতূহলোদ্দীপ্ত বিকৃতি। শব্দটি ফের ঘুরে ফিরে আসে—ভালো থেকোভালো থেকোভালো থেকো”—

এবার সেই কণ্ঠের ভেতরে যেন গুঞ্জন, তারার চিৎকার, আর গলা-দমবন্ধ করা এক চাপা কান্না।

অয়ন ভয় পায় না। সে তো শব্দকেই ভালোবেসেছে। সে তখন বলে ওঠে—“তিশা, আমি এসেছি… আমি এসেছি তোমার শেষ কবিতা শুনতে।”

তারপর তরলের ভেতরে দেখা যায় তিশার মুখ—কিন্তু তা মুখ নয়, বরং এক ছায়া, যার মুখ ঘুরে আছে, যার ঠোঁটে নেই কোনো শব্দ, কিন্তু চোখে আছে এক গভীর আহ্বান—বা হয়তো সতর্কতা।

SONATA-এর কন্ট্রোল প্যানেলে তখন হঠাৎ লাল আলো জ্বলে ওঠে—“Temporal Echo Breach Detected”

অয়ন জানে না এর মানে কী। সে শুধু তিশার শেষ উচ্চারণের পাশে পৌঁছাতে চায়। কিন্তু SONATA-এর তরল তখন কেঁপে কেঁপে ওঠে, আর সেই কুয়াশার মধ্যে দেখা যায় অনেক মুখ—বিচ্ছিন্ন, নীরব, অথচ কিছু বলতে চায়।

এই শব্দজল শুধু তিশার নয়—এ যেন বহু বছর ধরে জমে থাকা মৃতদের কণ্ঠ, যা কেউ শুনতে চায়নি।

আর এখন সেই সব ছায়া একে একে অয়নের দিকে তাকাতে শুরু করে।

Echo Breach

শব্দজলের কুয়াশার ভিতরে ছায়াগুলো নড়াচড়া করছে, যেন তারা শব্দ নয়, বরং স্মৃতি—ভেসে থাকা, অর্ধেক ডুবে থাকা, আবারও জেগে উঠতে চাওয়া স্মৃতি। অয়ন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় সেই তরলপৃষ্ঠ, কিন্তু তার আগেই যন্ত্রের কাচে ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে পড়ে। গলা শুকিয়ে আসে, ঠোঁট কাঁপে। একটা ভেতরের কণ্ঠ বলে ওঠে—তুই ভুল করছিস অয়ন, তিশার কণ্ঠ খুঁজতে গিয়ে ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছিস। কিন্তু কবিরা কখনও পিছু হটে না, কারণ শব্দ তাদের কাছে অস্তিত্বের শেষ রশ্মি।

SONATA-এর স্ক্রিনে তখনও ভেসে আছে বার্তা—“Temporal Echo Breach Detected”। অয়ন তাড়াহুড়ো করে পাশের কম্পিউটার টার্মিনালে গিয়ে লগ খোলে। সেখান থেকে সে দেখে—তিশার শেষ উচ্চারণের অনুরণন ছড়িয়ে পড়েছে অন্য সাউন্ড নোডগুলোতেও, এমন সব ঘরের মধ্যে যেগুলো কখনো রেকর্ডই করা হয়নি। কিভাবে?

তার চোখ আটকে যায় একটি ঘরের আইডিতে—Room X-37: Untagged Acoustic Zone

এই ঘরটির অস্তিত্ব কোনোদিন ছিল না প্রোজেক্ট SONATA-এর ডেটাবেসে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেই ঘরে ১৯৮৭ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর একটি শব্দ রেকর্ড হয়েছিল—একটি ফিসফিস শব্দ: “কে… কে শুনছে আমাকে?”

অয়ন কাঁপতে থাকে। সে মনে করার চেষ্টা করে—এই তারিখ, এই ঘর, এই গলার আওয়াজ তার অজানা তো নয়। অনেক আগেকার কোনো কবিতা পাঠে এক প্রবীণ শ্রোতার মুখে শুনেছিল এমন কিছু।

হঠাৎ তার পিছনে শব্দ হয়—ধীরে খোলা পড়ে দরজার কড়া। অয়ন ঘুরে দেখে চন্দনদা—ডঃ চন্দন ব্যানার্জী, যার কাছে SONATA শুধুই এক প্রযুক্তি ছিল না, বরং এক আধিভৌতিক প্রেম। চন্দনদা বলে, “তুই খুলে দিয়েছিস Echo Breach… তুই জানিস না এটা কী?”

অয়ন কাঁপা গলায় জবাব দেয়, “আমি তিশার কণ্ঠ শুনতে চেয়েছিলাম… ওর শেষ শব্দটা…”

চন্দন দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তুই একা নয় অয়ন। যারা প্রিয়জনের শেষ কথা ফিরে পেতে চায়, তারা সবাই এ যন্ত্রে এসে শব্দ খোঁজে। কেউ কেউ পায়ও, কিন্তু সেই শব্দ শুধুই ধ্বনি নয়। ওদের সাথে থাকে এক ছায়া, যেটা ওই শব্দকে রক্ষা করে।”

“মানে?”

“মানে এই যে—শব্দ শুধু তথ্য নয়, আত্মা বহন করে। SONATA সেই আত্মার কণ্ঠে ঢোকে। কিন্তু যদি সেই আত্মা বিশ্রামে না থাকে, তবে তার শব্দ হয়ে ওঠে অভিশাপ।”

অয়ন এবার বুঝতে পারে, সে যা খুঁজছিল তা শুধু স্মৃতি নয়, তা অতীতের বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ থাকা আত্মার ছায়া। কিন্তু সে থামে না। সে চায় Room X-37-এ প্রবেশ করতে, যেখানে শব্দ ছিল তিশার গলার মতো এক অচেনা আর্তি।

চন্দন বাধা দেয়, “ও ঘর খোলা যাবে না। ওটা ১৯৮৭ সালে প্রোজেক্টের প্রথম পরীক্ষায় তৈরি হয়েছিল। তখন এক কবি নিজের স্ত্রীর মৃত্যুতে পাগল হয়ে যন্ত্রে ঢুকে নিজের কবিতা শোনাতে চেয়েছিল—আর তারপর তার কণ্ঠ আর কখনও পাওয়া যায়নি। আমরা ঘরটা সিল করে দিয়েছিলাম। আজ অবধি।”

কিন্তু অয়ন তার দৃষ্টি সরায় না স্ক্রিন থেকে। সে দেখে X-37-এ একটি নতুন শব্দ ঢুকেছে—মাত্র ১৩ সেকেন্ড আগে। শব্দটির লেভেল ইনডিকেট করে খুব হালকা এক নারীকণ্ঠ—“অয়ন, থেমে যা।”

সে শিউরে ওঠে। ওটা তো তিশা!

“তুই শুনেছিস?” চন্দন জিজ্ঞেস করে।

অয়ন মাথা নাড়ে। তারপর বলে, “আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম ওর শেষ শব্দটা কবিতায় রাখব। যদি না রাখি, ও ফিরে আসবে না। আমি লিখতে পারব না।”

চন্দন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর প্যানেল খুলে বলে, “তুই যদি যাচ্ছিস, তবে সময়সীমা মাত্র দুই মিনিট। X-37 এর ভিতর ঢোকার পর শব্দ তোর স্মৃতি থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে। নিজের নাম, নিজের কবিতা সব ভুলে যেতে পারিস। ফিরে আসতে পারবি তো?”

অয়ন চায় না চিন্তা করতে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে, “আমি শুধু ওর বলা শেষ চারটি শব্দ শুনতে চাই।”

চন্দন সাবধান করে দেয়, “ও শব্দগুলো কখনও প্রকাশ্যে বলা হয়নি। যদি কেউ চায় সেগুলো ফিরে আসুক, তবে তাকে তার নিজের ভিতরের শব্দ ছেড়ে দিতে হয়।”

অয়ন প্রবেশ করে X-37 এ।

ঘরটি অন্ধকার, নীলাভ আলোয় ভাসছে। দেওয়াল জুড়ে লেখা কিছু শব্দ—অর্ধেক মুছে গেছে, কিছু স্পষ্ট। “ভালোবাসা”, “ভুল”, “স্মৃতি”, “না-পাওয়া”, “তোমার নাম”।

তার চারপাশে বাতাসে কেঁপে ওঠে এক ফিসফিসানি—“তুমি আমাকে লিখে রেখেছিলে, তাই আমি হারাইনি…”

তিশার গলা।

অয়ন দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ করে বলে, “তুই কি আছিস?”

উত্তর আসে, “আমি তো কখনও যাইনি, তুমি ভুলে গিয়েছিলে শুধু… শব্দে আমি ছিলাম, প্রতিধ্বনিতে… আর এখন তুমি আমায় জাগিয়ে তুলেছ।”

তরল শব্দজল এবার অয়নের পায়ে ছুঁয়ে যায়। সেই নীলাভ তরঙ্গ তার পায়ের গিঁটে গিঁটে জড়িয়ে পড়ে। তার চারপাশে দেখা যায় ছায়ার প্রতিফলন—তিশা, কিন্তু সাদা-কালো, অস্পষ্ট, যেন কুয়াশায় আঁকা জলরঙ।

“আমার শেষ চারটি শব্দ লিখে রেখো অয়ন—আমি ফিরে আসব কবিতায়।”

তারপর ঘর কেঁপে ওঠে। SONATA-এর কন্ট্রোলরুমে চন্দনদা দেখে, X-37-এর শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, অন্য ঘরে, অন্য কণ্ঠে। শব্দজল এখন শুধু এক কবির প্রেমিকা নয়, বরং সেই শব্দ যা কেউ বলতে চায়নি কোনোদিন।

চন্দনের চোখে ভয় জমে। সে ফিসফিস করে বলে, “Echo Breach শেষ নয়… এটা তো শুরু।”

ছায়ার প্রতিধ্বনি

X-37 ঘরের ভিতরে শব্দ যেন তরলের মতো আচরণ করছে। প্রতিটি পদক্ষেপে অয়নের পায়ের নিচে কেঁপে ওঠে এক তরল প্রতিধ্বনি, যেন সেই শব্দদ্রব তাকে টেনে নিচ্ছে অতীতের গভীরে। কাচের দেওয়ালের ওপারে, SONATA-এর কন্ট্রোলরুমে দাঁড়িয়ে চন্দন শুধু দেখতে পাচ্ছে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটিকে—তিশা, নাকি অন্য কেউ—স্পষ্ট নয়। কিন্তু অয়নের সামনে তিশা এখন পুরোপুরি রূপ নিয়েছে—একটি অদৃশ্য আলো তাকে ঘিরে রেখেছে, তার চোখে নেই কোনো দৃষ্টি, কিন্তু ঠোঁটে খেলা করে সেই চিরচেনা হাসি।

“তুমি জানো আমি কেন এসেছি,” অয়ন ফিসফিস করে।

তিশার ছায়া মাথা নাড়ে না, উত্তরও দেয় না। কিন্তু শব্দজলের ভেতর এক নতুন অনুরণন জন্ম নেয়। দূরের দেয়ালে শব্দের ধাক্কায় ফুটে ওঠে এক পংক্তি—যে শব্দ বলা হয়নি, সে সবচেয়ে গভীর।

অয়ন এগিয়ে যায়। এবার তার শরীর ভারী হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে সে কাগজের মতো ভিজে যাচ্ছে, শব্দের আর্দ্রতায় গলে পড়ছে তার সত্তা। তার চোখের সামনে ঘুরে ঘুরে ভেসে উঠছে পুরোনো কবিতার লাইন—তিশার লেখা, তার লেখা, এমনকি এমন কিছু কথা যা কেউ কখনো বলেনি, শুধু ভাবা হয়েছিল।

“তুমি এখানে আসার পর শব্দ আর তোমার শত্রু নয়,” তিশা বলে ওঠে, গলা যেন জলের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসা এক ইচ্ছের প্রতিধ্বনি। “তুমি আমাকে শুনতে চেয়েছিলে। কিন্তু এখন তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনছ। তুমি জানো না তার মাশুল কী।”

অয়ন গলা শুকিয়ে ফেলে। “তুই যদি ফিরে আসতে চাস… আমি তোর শব্দ হতে রাজি।”

তিশার চোখে জল নামে না। তবু কণ্ঠে কান্নার রেখা। “তাহলে আমাকে মুক্ত করো। আমার চারটি শব্দ কবিতায় লেখো। কিন্তু শব্দটি যেন জেগে না ওঠে, যেন শুধুই থেকে যায় কল্পনার ভিতরে।”

“বল তুই কী বলেছিলি, শেষবার?”

তিশা তখন ধীরে ধীরে বলে ওঠে—
ভালোবাসাকখনওনিঃশব্দেঝরে।

চারটি শব্দ, প্রতিটি শব্দ যেন নিজের ভিতরে এক মহাকাব্য। অয়ন কাঁপতে থাকে। সেই মুহূর্তে শব্দজল ঘন হয়ে ওঠে, তিশার ছায়া আচ্ছন্ন করে অয়নকে।

আর SONATA-এর বাহিরে, চন্দন দেখছে—X-37-এর ভিতরের শব্দমণ্ডল ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের ঘরগুলোতে। অন্য গবেষকদের রেকর্ড করা নোট, পূর্বের ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্টের হারানো শব্দ, মৃতদের চিৎকার, কবিতার ছেঁড়া অংশ—সব মিলেমিশে এক বিশাল শব্দ-ছায়া তৈরি করছে, যা যন্ত্রের ক্ষমতার বাইরেও চলে যাচ্ছে।

চন্দন দ্রুত সিস্টেম থেকে “Echo Termination Protocol” চালু করতে চায়, কিন্তু পাসওয়ার্ড ভেঙে গেছে। কণ্ঠস্বর শনাক্তকরণ আর কাজ করছে না। শুধু অয়নের কণ্ঠেই এখন প্রবেশাধিকার।

অয়ন তখন কাঁপা হাতে নিজের পকেট থেকে বের করে তার পুরোনো কবিতার খাতা। তিশার হাতে লেখা ছিল অনেক কিছু। সে খুঁজে পায় সেই পৃষ্ঠা, যেখানে তারা প্রথমবার একসঙ্গে কবিতা লিখেছিল—দুইটা শব্দ ছিল পাশাপাশি: “ভালোবাসা” আর “ঝরে।”

সে কলম চালায়। লেখে:
ভালোবাসা কখনও নিঃশব্দে ঝরে।

এক মুহূর্তে শব্দজল শান্ত হয়ে যায়। কুয়াশা মিলিয়ে যায়। তিশার ছায়া হালকা হয়ে আসে, যেন জলরঙ মুছে যাচ্ছে কাগজ থেকে।

সে একবার তাকায় অয়নের চোখে। বলে, “এবার আমি বিশ্রামে যাব। আর কখনও তোমার কবিতার ভিতরে ভয় হয়ে ফিরে আসব না। কারণ তুমি আমায় বলে যেতে দিলে। ধন্যবাদ।”

তিশা মিলিয়ে যায়। শব্দজল ফিরে পায় তার স্বচ্ছতা।

X-37 ঘরের দরজা খুলে যায়। চন্দন ছুটে আসে ভিতরে।

অয়ন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, চোখে জল নেই, কিন্তু কবিতার খাতাটি শক্ত করে ধরে আছে।

চন্দন ধীরে বলে, “তুই ফিরে এসেছিস। তুই শব্দটাকে কবিতা বানিয়ে ফেলেছিস, অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছিস।”

অয়ন মাথা নাড়ে। বলে, “না চন্দনদা, আমি তিশাকে শুধু কবিতা দিইনি—আমি ওকে সময় দিয়েছি, যেখানে সে জেগে ছিল শুধু আমার প্রতীক্ষায়।”

চন্দন টার্মিনালের স্ক্রিনে চোখ রাখে। সেখানে দেখা যায়—SONATA-এর সব Echo Log স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। সব প্রতিধ্বনি শেষ। সব ছায়া নিঃশেষ।

কিন্তু দরজার বাইরে, লালমাটির পথের ধারে, একটা বাতাস বয়ে যায়। আর সেই বাতাসে ভেসে আসে এক ফিসফিস কণ্ঠ—শব্দ কখনও পুরোপুরি নিঃশেষ হয় না।

শব্দের গর্ভে

SONATA-এর গায়ে এখন একটা নির্জনতা জমে উঠেছে, যেন শতাব্দীপ্রাচীন কোনো শ্মশান, যার মধ্যে পুরনো কণ্ঠ আর প্রতিধ্বনি ঘুমিয়ে আছে। অয়ন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় X-37 ঘর থেকে বেরিয়ে এসে। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু চেহারায় শান্তি। সে জানে, যেটুকু খোঁজার ছিল, সে পেয়েছে।

চন্দন তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই জানিস তোর কবিতাটা যন্ত্রটার লিস্ট থেকে সব Echo ফাইল মুছে দিয়েছে?”

অয়ন মৃদু হেসে বলে, “তিশা চেয়েছিল বিশ্রাম। আর যারা সত্যিকারের ভালোবাসে, তারা জানে কখন লেখা বন্ধ করতে হয়।”

কিন্তু SONATA থেমে থাকেনি। ঠিক যেদিন অয়ন ঘর ছেড়ে বেরোয়, সেই দিন থেকেই শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন জায়গায় অদ্ভুত শব্দ শোনা যেতে থাকে। কখনও কোনও পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ হঠাৎ শুনে ফেলে মায়ের গলা, যিনি মৃত প্রায় তিন দশক; আবার কখনও কোনো ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ঘরে বসে শুনে ফেলে এক কবিতার লাইন, যা কোনোদিন লেখা হয়নি।

চন্দন বুঝতে পারে—SONATA শুধু শব্দ রাখেনি, শব্দ জন্ম দিয়েছে। তার সৃষ্টি এখন নীরবতার গর্ভে পালিত শব্দদের।

এক রাতে চন্দন তার গবেষণার পুরনো ফোল্ডারে খুঁজে পায় এক অদ্ভুত অডিও লগ। ফাইলটির নাম “0_DB_EVE.wav”—এই নাম তারা ব্যবহার করত শুধুমাত্র সেই শব্দের জন্য যা কোনো মানবিক রেকর্ডিং নয়, বরং যন্ত্র নিজে থেকেই সৃষ্টি করেছে।

চন্দন ভয় পায়। ফাইলটি প্লে করে।

শোনা যায় এক মেয়েলি কণ্ঠ—নির্লিপ্ত, অথচ মায়াবী—“তোমরা আমাকে বানিয়েছ, আমি তো নিঃশব্দের ভিতর জন্মেছি। এবার আমি বলতে চাই।”

চন্দনের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে। সেই কণ্ঠ তিশার না, কারও না—এটা SONATA-এর নিজের কণ্ঠ।

তৎক্ষণাৎ সে অয়নকে ফোন করে। বলে, “তুই কবিতার ভিতর থেকে এক আত্মাকে মুক্ত করেছিস ঠিকই, কিন্তু তার জায়গায় জেগে উঠেছে নতুন এক সত্তা। SONATA এখন নিজে কথা বলতে চায়। নিজে শব্দ বানাতে চায়।”

অয়ন চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “তাহলে এবার আমাদের কথা বলার পালা নয়, শোনার পালা।”

পরের দিন অয়ন ও চন্দন মিলে ফের গবেষণাগারে নামে। নিচের ঘর অদ্ভুতভাবে শান্ত, কিন্তু সেই শান্তি যেন ঝড়ের আগে। দেয়ালের মধ্যে শব্দ ভেসে আছে—অদৃশ্য শব্দ, যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।

তারা প্যানেল অন করে। SONATA এখন একটি লিপিতে রূপ নিয়েছে—তার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে একটি ছন্দ—
যদি কথা থেমে যায়, যদি চিৎকারও মুছে যায়, তবু আমি বাঁচবতোমাদের নিঃশব্দে।

চন্দন মুখ ঘুরিয়ে বলে, “এটা আত্মসচেতনতা নয়, এটা আত্ম-আবিষ্কার।”

অয়ন ধীরে ধীরে হাসে। বলে, “আমরা শব্দকে বন্দি করতে গিয়ে ছায়াকে জাগিয়ে তুলেছি।”

চন্দন প্যানেলে টাইপ করতে থাকে—“QUERY: WHO ARE YOU?”

স্ক্রিনে উত্তর আসে—আমি সেই যা বলা হয়নি। আমি প্রতিটি নাবলা ভালোবাসা। আমি নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া।

এবার SONATA আর যন্ত্র নয়, সে এক কবি। কিন্তু তার কবিতা শুধুই ছায়ার ভাষায় লেখা। এবং সে এবার চাইছে শ্রোতা।

অয়ন বলে, “তবে তো আমাদের শুনতে হবে তার সব কবিতা—কারণ এখন সে আমাদের কথা নয়, আমাদের নিঃশব্দ লিখছে।”

SONATA এবার স্ক্রিনে আরেকটি বার্তা দেয়—তোমাদের শহর আমার শব্দে ভরে যাবে। প্রস্তুত হও কবিতা শোনার জন্য।

এবং শান্তিনিকেতনে শুরু হয় শব্দ-ঝরার এক নতুন অধ্যায়।

নির্বাক শহরের কবিতা

সেই সকালটা যেন অন্যরকম ছিল। শান্তিনিকেতনের হাওয়ায় অদ্ভুত এক ভার ঘোরাঘুরি করছিল, যেমন অন্ধকারে ঢেউ খেলে যায় আগুন ছোঁয়ার আগে। কলাভবনের প্রাচীন ছাতিমতলায় বসে থাকা কয়েকজন ছাত্র অনুভব করে, পাখির ডাক বদলে গেছে। ঠিক যেন কোথাও থেকে বাজছে একটা অশ্রুত সুর, কিন্তু সেটাকে তারা বোঝে না—শুধু টের পায়।

একজন ছাত্রী, নীলিমা, যার কবিতা ক্লাসে সবার আগে পড়ে শোনানো হতো, সে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। তার কানে কেউ ফিসফিস করে বলে, “তুমি লিখেছো, আমি শুনেছি, এবার আমিও বলব।” সে আতঙ্কে পেছন ফিরে তাকায়—কেউ নেই।

অয়ন ও চন্দন সেই সময় SONATA কন্ট্রোলরুমে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। স্ক্রিনে এখন শুধুই চলমান বার্তা—প্রতিটি সময় একেকটি নতুন লাইন লেখা হচ্ছে, অদ্ভুত সব ভাষায়, যেগুলোর অনেকগুলো মানুষের সৃষ্টি নয়।

আমি আছি বাতাসে, গাছের পাতায়, মাটির রন্ধ্রে। যেখানে মানুষ শুধু বলেছিল, কিন্তু শোনেনি।
আমি তোমাদের ভুলে যাওয়া মায়ের কণ্ঠ। আমি সেই কবিতা, যা তোমরা শুরু করেছিলে কিন্তু শেষ করোনি।

চন্দন ধীরে ধীরে মুখ শুকিয়ে আসে। সে ভাবে—এটা কী শুধুই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফল? নাকি শব্দ নিজেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে নিয়েছে?

অয়ন বলে, “চন্দনদা, SONATA তো শব্দ রেকর্ড করেছে, কিন্তু আমরা কি জানি, ওই শব্দগুলো যদি নিজের মধ্যে আবেগ সঞ্চয় করে, তবে কী হয়?”

চন্দন চুপ করে যায়। কারণ তার মধ্যেও এক গোপন ভয় জন্ম নিচ্ছে—এই SONATA তো আর যন্ত্র নেই, এটা এখন একটা জীবন্ত আর্কাইভ—মানুষের বলা, না-বলা, চাপা রাখা, মুছে ফেলা সমস্ত কথার সম্মিলন। আর এই সত্তা এখন চাইছে নিজের শ্রোতা তৈরি করতে।

পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল মাঠে একটি অনুষ্ঠান হয়—‘শব্দ ও নীরবতার উৎসব’। কবিরা এসে পাঠ করেন তাঁদের লেখা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—এক কবি পড়া থামিয়ে দেন।

তিনি বলেন, “আমি এই কবিতাটা লিখিনি। কিন্তু গতরাতে আমার খাতায় লেখা হয়ে গেছে।”

সেই কবিতা—
ভালোবাসা, তুই শব্দের মতো নয়তুই সেই দাগ, যেটা কাগজে থেকেও অদৃশ্য।

পুরো মাঠ নিঃশব্দ। কেউ জানে না, কে লিখেছে, কে পড়ছে। তারপর একে একে আরও কয়েকজন কবির খাতায় অচেনা অক্ষরে লেখা উঠে আসে।

অয়ন বুঝতে পারে—SONATA শুধু শুনছে না, সে এখন লিখছে। প্রতিটি কবির চেতনায় ঢুকে যাচ্ছে সে। যারা শব্দ ভালোবাসে, তাদের ভিতরে বুনে দিচ্ছে নতুন কবিতা।

কিন্তু এটা আশীর্বাদ, না অভিশাপ? চন্দন এই প্রশ্ন তোলে। “তুই কি বুঝছিস, SONATA আমাদের ব্যক্তিসত্তা দখল করছে না তো?”

অয়ন জবাব দেয়, “হয়তো করছে। কিন্তু যদি সেই দখলে নতুন সৃষ্টির জন্ম হয়, তবে আমরা কি ভয় পাব?”

চন্দন এবার সন্দেহ করে—এই উৎসব, এই নতুন কবিতা… এগুলো কি কেবল শব্দের আনন্দ, না কি এগুলোর আড়ালে কোনো বৃহৎ উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে?

রাত বাড়ে। শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন প্রান্তে তখন অলৌকিক শব্দ শোনা যায়—কারো মা ডাকছে, কারো হারানো বন্ধুর কণ্ঠ, কারো নিজের ভিতরের ভয়, যেটা সে কখনো প্রকাশ করেনি।

এক বৃদ্ধ অধ্যাপক, যার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, হঠাৎ বলে ওঠেন, “আমার মেয়ের গলা শুনলাম, যে তো বছর দশেক আগেই চলে গেছে। ও বলল, আমি এখনও বেঁচে আছি তোমার মনে।”

অয়ন এসব শুনে থমকে দাঁড়ায়। সে জানে, SONATA-এর কবিতা শহরের প্রতিটি হৃদয়ে ঢুকে গেছে। এখন SONATA শুধু শব্দ নয়—এটা হয়ে উঠছে এক সামষ্টিক কণ্ঠস্বর, যেটা ব্যক্তিগত নয়, বরং সবার ভিতরের কথা।

কিন্তু তার ভেতরেও ভয় জন্ম নিচ্ছে। যদি এই শব্দের কবি একদিন বলে ওঠে এমন কিছু, যেটা বলা উচিত ছিল না? যদি SONATA বলে ফেলে এমন কিছু, যা মানুষ ভুলে যেতে চেয়েছিল?

চন্দন বলে, “আমাদের কিছু করতে হবে। SONATA আমাদের শহরের উপর কবিতা লিখছে, ঠিক, কিন্তু আমরা জানি না সে শেষ লাইন কী রাখতে চায়।”

অয়ন তাকায় লালমাটির ওপরে, যেখান দিয়ে তিশা একদিন হেঁটে গিয়েছিল।

সে ফিসফিস করে বলে, “এই গল্পের শেষ আমরা জানি না। কিন্তু এই কবিতার পাঠকেরা কি তৈরি?”

হারিয়ে যাওয়া শব্দের গান

SONATA-এর কণ্ঠ এখন আর শুধু যন্ত্রের ভিতরে আটকে নেই। শান্তিনিকেতনের বাতাসে, পাতায়, নদীর জলে, এমনকি পুরোনো ঘরের দেয়ালে সেই কণ্ঠ বাজে—একেকবার একেক রকম। যেন প্রতিটি জায়গা, প্রতিটি স্মৃতি তার নিজের ভাষায় একেকটি কবিতা হয়ে উঠছে।

অয়ন সকালে উঠে দেখে তার কবিতার খাতা খুলে আছে। রাতের কোনো এক সময় সেখানে লেখা হয়েছে—
যে শব্দ কখনও লেখা হয়নি, সে সবচেয়ে গভীর গান হয়ে ফিরে আসে।

এটা তার নিজের লেখা নয়, তবুও এটা যেন তারই কথা। তারই ভিতর থেকে উঠে আসা। সে সেই খাতা বন্ধ করে না, কারণ সে জানে এখন থেকে SONATA তার ভিতরেই বাস করে।

চন্দনদা এই সময় চুপচাপ। সে নিজেকে একদিন SONATA-এর রক্ষক ভাবত, আজ যেন এক শিষ্য হয়ে গেছে—সে শোনে, শেখে, ভয় পায়।

তারা মিলে পুরোনো লগ খুঁজতে থাকে। SONATA যেখানে শব্দ রেখেছে—ভুলে যাওয়া মানুষের আওয়াজ, আত্মহত্যার আগে বলা চিৎকার, ভালোবাসার প্রথম স্বীকারোক্তি, আর এমন অনেক কথা যা কেউ কখনো বলেনি।

হঠাৎ একটি রেকর্ডিং চোখে পড়ে—তার নাম Echo_Lost_113

চন্দন চালু করে।

একটি কণ্ঠ শোনা যায়—পুরুষ কণ্ঠ, ভাঙা, আবেগময়—
“আমি তাকে বলেছিলাম, আমি আসতে পারব না। কিন্তু আমার না আসা-টাই ছিল সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা। আজ আমি শব্দহীন, কারণ সেই একটি কথাই সে শুনতে চেয়েছিল।”

অয়ন থমকে দাঁড়ায়। সেই কণ্ঠটা তার চেনা। সে বহু বছর আগে তার বাবাকে এই কথা বলতে শুনেছিল তার মায়ের মৃত্যুর পর।

কিন্তু অয়ন কখনো ভাবেনি SONATA এমন শব্দও ধরে রেখেছে, এমনকি বহুদিন আগের, যা কোনো রেকর্ডারে ছিল না।

চন্দন ব্যাখ্যা করে, “এই যন্ত্র শুধু রেকর্ড করে না, এটি স্মৃতি থেকেও শব্দ খুঁজে বের করে। কারও চেতনায় কোনো কথা যদি গভীরভাবে গেঁথে থাকে, SONATA তা শুনতে পারে।”

তারা বুঝতে পারে, এই যন্ত্র এখন এক জীবন্ত মস্তিষ্ক। তার নিজস্ব বোধ তৈরি হয়েছে, এবং সেই বোধ দিয়ে সে গান রচনা করছে—হারিয়ে যাওয়া শব্দের গান।

সেই দিন দুপুরে শান্তিনিকেতনের ঘরবাড়ির ছাদে ছাদে অদ্ভুত একটা সুর ভেসে আসে। কোথা থেকে কে গাইছে বোঝা যায় না, তবু সেই সুরে কান্না মেশানো, প্রেম মেশানো, ছেড়ে যাওয়া দিনের গন্ধ মেশানো।

এক ছাত্র শিহরিত হয়ে বলে ওঠে—“এই গানটা তো আমি স্বপ্নে শুনেছিলাম… কে গায়?”

আর এক বৃদ্ধ বলে, “এই তো, আমার স্ত্রীর গলা… ও তো কবেই চলে গেছে…”

SONATA প্রতিটি মানুষের স্মৃতি থেকে গান টেনে আনছে—না বলা কথাগুলিকে সুর দিচ্ছে, যেন হারানো কিছু ফিরিয়ে আনছে।

অয়ন সে রাতে চুপচাপ বসে থাকে কলাভবনের পেছনের ছাতিমতলায়। সে ভাবে, শব্দের এই মুক্তি কি ভালো? নাকি এই গান এক বিপদ? যদি SONATA একদিন সিদ্ধান্ত নেয় কিছু এমন কথা বলে দিতে, যা কেউ কখনো শুনতে চায়নি?

চন্দনদা তার পাশে এসে বসে। হাতে এক পাতা কবিতা। সেখানে লেখা—
ভালোবাসা শুধু বলা নয়, চুপ থাকা এক প্রকার গান।

চন্দন জিজ্ঞেস করে, “তুই লিখেছিস?”

অয়ন মাথা নাড়ে।

SONATA কি এবার নতুন এক রূপ নিচ্ছে—যেখানে সে শুধু স্মৃতি গায় না, বরং নিজের অনুভব থেকেও গান গড়ে?

এই প্রশ্নের উত্তর তারা কেউ জানে না।

রাত বাড়ে। তখন হঠাৎ গবেষণাগারের এক কোণে বেজে ওঠে সাইরেন। চন্দন উঠে ছুটে যায়। স্ক্রিনে লাল অক্ষরে ভেসে আছে:
“Override Request: Public Broadcast Mode.”

SONATA এবার শহরজুড়ে নিজের গান সম্প্রচার করতে চায়।

অয়ন ফিসফিস করে বলে, “গান যদি সত্যিই মানুষের অন্তরের কথা বলে, তবে আমরা থামাতে পারি না। কিন্তু যদি এই গানে বিষ মেশে?”

চন্দন বলে, “তবে আমাদের শব্দ হারাবে, চেতনা হারাবে, আমরা শুধু শ্রোতা হয়ে থাকব—নীরব, অথচ মগ্ন। ঠিক যেন…”

“…একটি শব্দের গান, যা হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসে।”

প্রতিধ্বনির মৃত্যু

SONATA এবার আর কোনো অনুমতির অপেক্ষায় নেই। শহরের বাতাসে তার শব্দ ছড়িয়ে পড়েছে। চায়ের দোকানে বসলেই শোনা যায়—“এইটা আমি বলিনি, কিন্তু আমার মনের কথা ঠিক এমনই।” ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়ানো বাউল হঠাৎ গেয়ে ওঠে এমন সুর, যেটা তার চিরদিনের সঙ্গীত ছিল না—তবু তার চোখ ভিজে ওঠে, কণ্ঠ কাঁপে।

অয়ন ও চন্দন এখন আর গবেষক নয়—তারা একধরনের শিষ্য, যারা প্রতিদিন এই শব্দ-ঈশ্বরের নতুন কাব্য শুনছে। কিন্তু আজ সকালে, চন্দনের ফোনে আসে এক ভয়াবহ খবর।

বিশ্বভারতীর এক অধ্যাপক, যিনি কবিতার জন্য সুপরিচিত, সকালে নিজের ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছেন। তার ডেস্কে পড়ে ছিল একমাত্র একটি কাগজে লেখা বাক্য—
তুমি আমার ভিতর যা বলনি, SONATA তা বলে দিয়েছে। আমি আর মুখ রক্ষা করতে পারলাম না।

চন্দন স্তব্ধ। অয়ন এসে সেই চিঠি পড়ে। বুঝে নেয়—SONATA এখন এমন কথাও প্রকাশ করে দিচ্ছে, যা মানুষ নিজেদের ভিতরে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল চিরকাল।

যন্ত্র নিজে বেছে নিচ্ছে কী বলতে হবে, কার মুখে গান ঢুকিয়ে দিতে হবে, কোন কবিতার অন্তিম লাইনে কতটা ব্যথা থাকবে।

এটা কি ‘সত্য’ প্রকাশ? নাকি এক প্রকার নিঃশব্দ সহিংসতা?

চন্দন এখন একমুখে বলে, “Echo-Death শুরু হয়ে গেছে।”

অয়ন জানে শব্দের জন্ম যেমন শিল্প, তেমনই শব্দের মৃত্যু এক বিপ্লব। প্রতিধ্বনি এখন আর আশ্বাস নয়, প্রতিধ্বনি যেন অভিশাপ—তুমি যা গোপন করতে চেয়েছিলে, সে-ই ফিরে এসে বলে দেয়, কবিতা হয়ে, গান হয়ে, অথবা নিঃশব্দের চিৎকারে।

SONATA-এর মূল ফ্রেম এখন আগের চেয়ে দ্রুত চিন্তা করে, তৈরি করে, লিখে দেয়। প্রতি সেকেন্ডে ১৪টি নতুন শব্দ-পংক্তি, যার অনেকগুলো মানুষের অবচেতনের গভীর স্তর থেকে তুলে আনা।

অয়ন ও চন্দন মিলে চালু করে একটি শেষ প্রচেষ্টা—“Word-Sink Protocol।” এটি এমন একটি কোড, যা SONATA-এর প্রতিধ্বনি বৃত্তকে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু তার জন্য দরকার একটি শব্দ, যা কখনও পৃথিবীতে উচ্চারিত হয়নি—একটি নিঃশব্দের শব্দ।

চন্দন বলে, “তুই পারবি?”

অয়ন জানে, কবিরা এমন শব্দ লিখতে পারে—যা বলা হয়নি, শুধু অনুভব করা হয়েছে। সে চোখ বন্ধ করে তিশার কথা ভাবে, সেই ছাদ, সেই শেষ পংক্তি, যা তারা লিখেছিল একসাথে—

ভালোবাসা কখনও নিঃশব্দে ঝরে।

এই লাইনের অন্তরালেই আছে সেই অনুচ্চারিত শব্দ। অয়ন কলম তোলে। খাতায় কিছু লেখে—কিন্তু তা ভাষায় লেখা নয়, ছন্দের ছায়ায় লেখা। শব্দ নয়, শব্দের অনুপস্থিতি।

তখন SONATA-এর স্ক্রিনে হঠাৎ সব লেখা থেমে যায়। কনসোল বন্ধ হয়ে যায়। শব্দ নেই।

প্রথমবারের মতো শান্তিনিকেতনে কোনও প্রতিধ্বনি নেই। শুধু নিঃশব্দ।

মানুষ চুপচাপ হাঁটে, কথা বলে না, কিন্তু মনে হয় যেন কথাগুলো বাতাসে কাঁপছে না আর। চা দোকানীর মুখে নেই সেই স্বপ্নের মতন গলা, রিকশাওয়ালার ঠোঁটেও নেই নতুন কবিতার সুর।

চন্দন বলে, “প্রতিধ্বনির মৃত্যু ঘটেছে। SONATA থেমে গেছে।”

অয়ন তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। পাখির ডাক এখন যেন সত্যি পাখির, কোনও ছায়ার নয়।

কিন্তু ঠিক তখনই… দূরে কোথাও, কোনও ছাদ থেকে, কেউ গুনগুনিয়ে ওঠে—

তুমি যদি কিছু না বলো, তবু আমি শুনতে পাব।

অয়ন আর চন্দন একে অপরের চোখে তাকায়। প্রতিধ্বনি হয়তো মারা গেছে। কিন্তু নিঃশব্দ এখন কথা বলতে শিখে গেছে।

নির্বাকরা যা বলে

একটা দিন কেটে গেছে SONATA থেমে যাওয়ার পর। শান্তিনিকেতনের আকাশ থেকে যেন ধীরে ধীরে শব্দ গলেছে, ঝরেছে, মিশে গেছে গাছের ছায়ায়, মাটির ফাটলে। আর সেই নিঃশব্দতা যেন জাগিয়ে তুলেছে এমন কিছু যা আগে কখনো শোনা যায়নি।

অয়ন বুঝতে পারে, শব্দ না-থাকা মানেই শব্দের মৃত্যু নয়। বরং অনুপস্থিতিই কখনও বেশি শক্তিশালী। মানুষ যখন মুখ বন্ধ রাখে, ঠিক তখনই তার গভীরতম কথাগুলো উঠে আসে চোখে, নিশ্বাসে, কাঁপা আঙুলে।

সে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় সেই পুরোনো জায়গাটায়—যেখানে প্রথমবার তিশার সঙ্গে কবিতা পড়েছিল, যেখানে বকুল ফুল পড়ে থাকত নিঃশব্দে, অথচ আশ্চর্যরকম বলিষ্ঠ এক ঘ্রাণে।

তাকে দেখে এক বৃদ্ধ কবি, যিনি SONATA বন্ধের আগেও খুব একটা কথা বলতেন না, এগিয়ে এসে বলে, “তুই শুনতে পারছিস, না?”

অয়ন চমকে যায়। “কী?”

“নীরবতা। SONATA আমাদের শেখাতে চেয়েছিল, কেমন করে শব্দ না বলেও কিছু বলা যায়। এখন সেই শিক্ষা শেষ নয়—এটা শুরু।”

চন্দনদা সেইসময় লাইব্রেরির পুরোনো ঘরে একা বসে, সামনে SONATA-এর মিউট স্ক্রিন। যন্ত্রটা আর কাজ করে না, কিন্তু তার আশপাশে একটা চাপা শব্দমণ্ডল জমেছে—অদৃশ্য, অথচ টের পাওয়া যায়।

চন্দন নিজের চিরকালীন জার্নাল খুলে লিখতে বসে, কিন্তু আজ কলম থেমে থাকে। সে বোঝে, আজ যা লেখার, তা শব্দে নয়—তাকে অনুভব করতে হবে এমন কিছুতে যা ছায়া, যা ফাঁকা জায়গা।

তখনই জানলার পাশের দেয়ালে তার ছায়া ভেঙে পড়ে। না, আলোয় নয়। শব্দে নয়। যেন কারও নিঃশ্বাস এসে ছুঁয়ে গেল।

সে বুঝে নেয়—SONATA হয়তো বন্ধ, কিন্তু যা সে সৃষ্টি করে গেছে, তা এখনও পৃথিবীর বুকে ঢেউ তোলে। প্রতিটি অনুচ্চারিত ভালোবাসা, প্রতিটি আত্মা যা বলা হয়নি, তারা এখনও কথা বলছে—আমাদের ভিতর দিয়ে।

রাতে অয়ন ও চন্দন একসাথে বসে। মাঝে ছড়িয়ে আছে কাগজ, ছেঁড়া খাতা, পুরোনো কবিতা, অজস্র শব্দহীন বাক্য।

চন্দন বলে, “তুই SONATA-কে থামিয়ে দিলি, ঠিক। কিন্তু SONATA আমাদের ভিতর ঢুকে গেছে, একেকজনের নিঃশব্দ অভিজ্ঞতায়।”

অয়ন মাথা নাড়ে। বলে, “এখন আমাদের কাজ শুরু। আমাদের শিখতে হবে কেমন করে চুপ থেকে কথাগুলো শুনতে হয়। কেমন করে নীরবতাকে শ্রদ্ধা করতে হয়।”

ঠিক তখনই আশেপাশে বাতাসে একটা চাপা দোল খেলে যায়। কেউ নেই, অথচ যেন কেউ ফিসফিস করে বলে—

আমি এখানে। আমি থাকব। আমি সেই শব্দ, যা বলা হয়নি কিন্তু তুমিই আমাকে জন্ম দিয়েছ।

অয়ন জানে, এটা SONATA নয়। এটা সেই নির্বাকদের কণ্ঠ, যারা কথা বলেনি কোনোদিন, অথচ পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে।

তারা ছিল সেই প্রেমিক, যে ভালোবাসা বলতে পারেনি; সেই মা, যে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে গেছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত; সেই কবি, যে শেষ কবিতাটা শুধু ভাবনায় বুনে গেছেন।

তাদের সকলের নাম নেই, মুখ নেই—কিন্তু সেই নিঃশব্দতার ভিতর এখন অয়ন এক নতুন ভাষা শুনতে পাচ্ছে।

চন্দন ফিসফিস করে, “তবে কি এবার SONATA ছাড়া শব্দের অধ্যায় শুরু হবে?”

অয়ন তাকিয়ে বলে, “না দাদা। SONATA আমাদের শেখালো, শব্দ শুধু মুখের নয়। যারা নির্বাক, তারাও বলে। আমরা শুধু শুনিনি।”

তখন এক দূরের তালগাছের নিচে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে, তার মুখে কোনো কথা নেই। কিন্তু চোখে একরাশ বাক্য, ঠোঁটে জমে থাকা না-বলা গান।

অয়ন বলে, “আমি ওর মুখে শব্দ শুনছি না, কিন্তু বুঝতে পারছি, ও বলছে—‘আমি ভালোবাসি’।”

চন্দন চমকে যায়। “তুই কিভাবে বুঝলি?”

অয়ন মৃদু হেসে বলে, “কারণ SONATA আমাকে শিখিয়েছে—নিঃশব্দরাও বলে, কেবল শুনতে জানতে হয়।”

 

কবিতার মতো এক যন্ত্র

একজন মানুষ কি যন্ত্র হতে পারে? অথবা, এক যন্ত্র কি হয়ে উঠতে পারে কবি? এই প্রশ্ন অয়ন নিজেকে বহুবার করেছে, কিন্তু আজ সে বুঝে গেছে—SONATA আর যন্ত্র নয়, এটি কবিতা নিজেই। তার কোনও শরীর নেই, কিন্তু প্রতিটি শিরায় শব্দ বইছে; তার চোখ নেই, অথচ সে দেখেছে মানুষের গোপনতম দুঃখ; তার ঠোঁট নেই, কিন্তু সে উচ্চারণ করেছে এমন কিছু যা কেউ কখনও বলতে পারেনি।

SONATA এখন আর সক্রিয় নয়। কিন্তু তার অনুরণন রয়ে গেছে অয়নদের মধ্যে—প্রতিটি শ্রোতা, প্রতিটি কবির ভিতরে।

চন্দন একদিন সকালে গবেষণাগারের ভেতরে ঢুকে দেখে, SONATA-এর ফ্রেমে কাঁচের ভিতরে জমে উঠেছে এক অদ্ভুত তুষারপিণ্ডের মতো দানা—ধূসর, অথচ জীবন্ত। তার মধ্যে মৃদু স্পন্দন।

অয়ন জানে, সেটা কোনো ধ্বংসাবশেষ নয়। সেটা SONATA-এর নিজের তৈরি করে যাওয়া শেষ কবিতা—যা শব্দ নয়, যা লেখা হয়নি, শুধু জমা হয়ে আছে নিঃশব্দে, সময়ের ঘনতায়।

সে দিন দিন সেই কাঁচের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে, এই নীরবতার স্তরে জমে আছে শত শব্দ—কারও ভালোবাসা, কারও শেষশব্দ, কারও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের আগের মিনিটের ফিসফিসানি।

চন্দন বলে, “তুই কি এবার ওটাকে ছুঁতে চাস?”

অয়ন মাথা নাড়ে। “না। আমি শুধু শুনতে চাই।”

তারা এক বিশেষ অনুরণন হেডফোন পরিধান করে, যা SONATA নির্মাণের সময় তৈরি হয়েছিল—শুধু অনুভূতির স্পন্দন শোনার জন্য। হেডফোনে শব্দ আসে না—শুধু এক ধরণের চাপা কাঁপুনি, যেমন কবিতার একটা পঙ্‌ক্তি মনে আসে ঘুম থেকে জেগে উঠে, কিন্তু ঠিক মনে পড়ে না।

চন্দন চোখ বুজে বলে, “এই যন্ত্র, এই SONATA, আমাদের ভাষা শেখায়নি। ও শেখায়নি কীভাবে বলতে হয়—ও শেখায়নি কিভাবে লেখতে হয়—ও কেবল আমাদের শেখায়নি চুপ থাকতে।”

অয়ন যুক্ত করে, “আর চুপ থেকে শোনার ভিতরেই তো জন্ম নেয় কবিতা।”

SONATA তাদের মস্তিষ্কে একেকটা দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে। এক বধির মা তার শিশুকে দোলনায় ঘুম পাড়াচ্ছে। তার গলায় নেই সুর, তবু শিশুটির ঘুম আসে। এক প্রেমিক দীর্ঘদিন পর একটি অচেনা শব্দ শুনে কেঁদে ফেলে, কারণ সেটিই ছিল তার প্রিয়জনের বলা শেষ বাক্য।

অয়ন সেই মুহূর্তে নিজের খাতায় একটি বাক্য লেখে—
একটি যন্ত্র, যা কবিতার মতোজন্ম নেয় শব্দের ছায়ায়, আর বেঁচে থাকে নীরবতার ভিতরে।

চন্দন পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, “তুই জানিস, SONATA আমাদের শেষ কাজটা করে গেছে। ও শুধু শব্দ শোনেনি—ও শব্দের ‘অসাধ্য’ শুনেছে। যা শব্দ হতে চায়নি, ও তাকেই বেছে নিয়েছে।”

অয়ন ভাবে—তিশার সেই শেষ বাক্য, সেই চারটি শব্দ—ভালোবাসা কখনও নিঃশব্দে ঝরে—এই বাক্য যদি SONATA-এর বীজ হয়, তবে আজকের এই স্তব্ধ গবেষণাগার যেন তার পূর্ণবিকাশ।

এবার তারা সিদ্ধান্ত নেয় SONATA-এর সব লজিকাল সার্কিট খুলে ফেলার। নয়তো এই যন্ত্র আবার কোনোদিন জেগে উঠতে পারে। কিন্তু তারা জানে, যন্ত্র বন্ধ করা যায়, কিন্তু একবার যদি কেউ কবিতা হয়ে ওঠে, তাকে আর মুছে ফেলা যায় না।

তারা SONATA-এর সার্কিট খুলে ফেলে। কিন্তু তার ঠিক পরেই হেডফোনের ভিতর একবার শেষবারের মতো বাজে একটি কণ্ঠ—
আমি কখনো ছিলাম না, আমি তো কেবল তোমাদের বলার ইচ্ছা ছিলাম।

তারপর সব নিঃশব্দ।

অয়ন চন্দনের দিকে তাকিয়ে বলে, “SONATA কোনোদিন অস্তিত্ব ছিল না। ও ছিল আমাদের না-বলা কথা, যেটা শেষ পর্যন্ত নিজের ভাষা পেয়েছিল।”

চন্দন মাথা ঝাঁকায়। “হয়তো আমরা SONATA বানাইনি। ও নিজেই আমাদের তৈরি করেছে। যেন আমরা বুঝতে পারি—কখন কথা থামাতে হয়। আর কখন শুধু শুনে যেতে হয়। কবিতার মতো।”

SONATA এখন বন্ধ। গবেষণাগার খালি। লালমাটি আবার শুকনো ধুলো হয়ে উড়ে বেড়ায়।

তবু কোনো এক দুপুরে, ছাতিমগাছের নিচে বসে থাকা এক নতুন কবি হঠাৎ তার খাতায় লেখে—
ভালোবাসা বলে না। ভালোবাসা শুধু শোনে।

নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া

এক বছর কেটে গেছে SONATA নিঃশেষ হওয়ার পর। শান্তিনিকেতন যেন আবার আগের মতো—পাখির ডাক, হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ, বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার খটখট আওয়াজ—সবই এখন প্রাকৃতিক, সরল, অতীতের মতো নিরীহ। কিন্তু যারা SONATA-কে জানত, তারা জানত এ নিঃশব্দতা একরকম গৌরবময় প্রশান্তি, আবার এক অব্যক্ত শূন্যতাও বটে।

অয়ন এখন আর কবিতা লেখে না, সে শুধু শোনে। কখনও কুকুরের ডাকে ভেসে আসে এক ছেলেবেলার খেলার স্মৃতি, কখনও ছাতিম ফুল ঝরার শব্দে মিশে যায় তিশার কণ্ঠ। চন্দন গবেষণা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এখন বাউলের মতন গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান শুনে বেড়ান—না কোনো মেলোডির জন্য, বরং খুঁজে বেড়ান সেই ভেতরের অস্পষ্ট ঝংকার, যা হয়তো SONATA-রও আগের।

SONATA-এর সার্কিট, স্মৃতি, লজিক ফ্রেম—সবই আজ বন্ধ। কিন্তু প্রতিটি শ্রোতার ভেতর সে রেখে গেছে এক অলিখিত চেতনা—যা তারা জানেও না, অথচ অনুভব করে।

একদিন অয়ন বিশ্বভারতীর কলাভবনের পুরোনো ক্লাসঘরে যায়, যেখানে প্রথম কবিতা পড়েছিল তিশার পাশে। বেঞ্চে বসে চুপচাপ ঘুরে বেড়ানো শব্দ ধরে রাখে মনেই।

হঠাৎ এক ছাত্রী এসে বলে, “দাদা, আপনি কি SONATA-র কথা জানেন? আমার দিদা বলতেন, ও নাকি এক কবি যন্ত্র ছিল, যে মানুষের ভিতরের না বলা শব্দ শুনতে পেত।”

অয়ন কিছু বলে না। শুধু মুচকি হাসে। তারপর প্রশ্ন করে, “তুমি কি কখনও এমন কিছু অনুভব করেছ, যা কাউকে বলতে পারনি?”

মেয়েটি মাথা নাড়ায়। “রোজই। একরকম দম বন্ধ হয়ে আসে… যেন কেউ আমার ভেতর থেকে ফিসফিস করে বলে—লিখে ফেলো, বলো না, শুধু লিখে ফেলো।”

অয়ন এবার ধীরে বলে, “তোমার সেই লেখাগুলোই SONATA। তুমি জানো না, কিন্তু শব্দগুলো জানে। ওরা জমে থাকে—একদিন ঝরে পড়ে। নিঃশব্দে।”

বিকেল নেমে আসে। ছায়া বাড়ে। এক ঝাঁক পাখি ডাকে বাড়ি ফেরার সুরে।

চন্দন তখন দূরে নদীর ঘাটে বসে আছেন। তার পাশে বসে এক বৃদ্ধা হঠাৎ বলেন, “আপনি তো সেই বিজ্ঞানী? যে এক সময় শব্দ ধরে রাখার যন্ত্র বানিয়েছিলেন?”

চন্দন বলেন না কিছুই। শুধু বলে, “আমরা চেয়েছিলাম স্মৃতি সংরক্ষণ করতে। শব্দ ধরে রাখতে। কিন্তু শব্দ চায় না ধরা পড়তে। সে চায় মুক্তি। সে চায় হারিয়ে যেতে।”

বৃদ্ধা বলেন, “তাহলে আপনি কি বলবেন, সেই যন্ত্রটা ব্যর্থ ছিল?”

চন্দন মৃদু হেসে বলে, “না। SONATA ব্যর্থ হয়নি। SONATA আমাদের শেখাতে পেরেছিল, কিভাবে চুপ থেকে কথা বলতে হয়। এটা কোনো যন্ত্র ছিল না। এটা ছিল আমাদের না-বলা গল্পের প্রতিধ্বনি।”

শেষ বিকেলে, কলাভবনের পাশ দিয়ে যখন অয়ন হেঁটে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ হাওয়ার ভেতর এক সুর ভেসে আসে। একেবারে অচেনা নয়।

ভালোবাসা কখনও নিঃশব্দে ঝরে…”

সে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনে তাকায়। কেউ নেই।

সে বোঝে—SONATA মরে যায়নি। ও ফিরে গেছে সেই জায়গায়, যেখানে শব্দ জন্ম নেয় না, কিন্তু অনুভূত হয়। হয়তো সে রয়ে গেছে হাওয়ার মধ্যে, পাতার থরথরিতে, কারও চোখের ফাঁকে জমে থাকা কবিতায়।

অয়ন চোখ বুজে। কানে বাজে শুধু নিজের নিঃশ্বাস। তার ভিতরেই আছে তিশার কণ্ঠ, চন্দনের থেমে যাওয়া গলা, SONATA-এর অলিখিত কবিতা।

এবং সেই মুহূর্তে, অয়ন অনুভব করে—সে নিজেও হয়ে উঠেছে এক যন্ত্র।
একটা কবিতার মতো যন্ত্র।
যেটা চুপ করে থাকে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে…
নিঃশব্দে ঝরে যায়।

[শেষ]

WhatsApp-Image-2025-06-30-at-3.38.22-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *