বর্ণালী দত্ত
১
রোদ তখন নরম, বিকেলের আভায় রাঙা আকাশ ছুঁয়ে আছে বাঁকুড়ার পাহাড়ি রেখা। চারপাশে পলিমাটির গন্ধ আর ধুলোয় মেশা পুরনো সময়ের গল্প, ঠিক যেমনটা চেয়েছিল অর্ণব সেনগুপ্ত। কলকাতার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের গবেষক সে, বিশেষত পূর্বভারতের রাজপরিবারের কিংবদন্তি ও লোকবিশ্বাস তার গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। বহুদিন ধরে সে খুঁজছিল এমন এক জায়গা যেখানে ইতিহাস আর লোককথা মিশে আছে রক্তমাখা কোনো অভিশাপে। বহু পুরনো দলিলপত্র ঘেঁটে, এক তাম্রলিপিতে সে জানতে পারে বাঁকুড়ার সীমান্তবর্তী এক পরিত্যক্ত রাজবাড়ির কথা — যেখানে রয়েছে “নাগকক্ষ” নামে এক গোপন ঘর। কিংবদন্তি বলে, শত বছর আগে এক তান্ত্রিক নারী, যার নাম ছিল নাগবসুন্ধরী, সেই ঘরের ভেতরেই অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে সেই ঘর তালাবদ্ধ, আর যারাই তাকে খোলার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে অদ্ভুতভাবে। অর্ণব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, কিন্তু ইতিহাসের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা এই রকম প্রাচীন ভয় যেন তাকে চুম্বকের মতো টানছিল। রুদ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর কাছ থেকে চিঠিতে অনুমতি পেয়ে, সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা দেয় রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে — হাতে শুধু একটি নোটবুক, একগুচ্ছ পুরনো মানচিত্র আর তার বাবার পুরনো নিকন ক্যামেরা। রাজবাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই তার চোখে পড়ে প্রবল জীর্ণ প্রাসাদ, যার ভাঙাচোরা বারান্দায় কেবল বাতাসের কাঁপুনি আর একরাশ সময় জমে রয়েছে। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েই সে দেখে রুদ্রনারায়ণ অপেক্ষা করছেন — গম্ভীর মুখে, যেন একটি ভয়ের প্রহরায় বসে আছেন তিনি।
রুদ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে, কিন্তু চোখদুটো এখনও চঞ্চল, কৌতূহলী নয় — বরং দুঃসহ স্মৃতির ভারে নুয়ে থাকা। অর্ণবকে বসতে দিয়ে তিনি বলেন, “বাবু, আমি আপনাকে প্রাসাদে আসতে দিয়েছি, কারণ আপনাকে দেখে মনে হয়েছে আপনি কেবল কাগজে কালি ঘষেন না, সত্যি খুঁজে বের করতে চান। কিন্তু এই বাড়ি… এই বাড়ি নিঃসন্দেহে অভিশপ্ত।” অর্ণব হেসে ওঠে, “অভিশাপ শব্দটা একটু বড় হয়ে গেছে, মশাই। আসলে সব গল্পেরই উৎস থাকে। হয়তো এই কক্ষটি ছিল বন্দিদের জন্য, হয়তো কেউ ভুলবশত মারা পড়েছিল… তা নিয়েই তৈরি হয়েছে এই লোককথা।” রুদ্রনারায়ণ কিছু বলেন না, শুধু কফির কাপে চুমুক দেন। বিকেলের আলো তখন আরও গাঢ়, দেয়ালে ঝুলে থাকা এক পুরনো তেলচিত্রের ছায়া যেন সামান্য দুলে ওঠে। অর্ণব বুঝতে পারে, এই বাড়ির ইতিহাস কেবল বইয়ে লেখা শব্দ নয় — এখানে সময় জমে রয়েছে ধুলোর আড়ালে, নিঃশব্দে, অপেক্ষায়।
সন্ধ্যাবেলায় অর্ণব একাই ঘুরে দেখে রাজবাড়ির বিভিন্ন অংশ। এক প্রাচীন পরিচারিকা, গীতালির কাছ থেকে সে জানতে পারে, “নাগকক্ষ” তিনতলার এক কোণায়, যেটি চিরকাল তালাবদ্ধ। অনেকেই বলে, মাঝেমধ্যে রাতে সেখানে ফিসফিস শব্দ শোনা যায়। কৌতূহলবশত পরদিন দুপুরে অর্ণব ক্যামেরা হাতে নিয়ে উঠে যায় সেই তালাবদ্ধ দরজার সামনে। দরজাটি ভারী কাষ্ঠ নির্মিত, কাঁটাযুক্ত লোহার কাজ করা। সে দরজার ছবি তোলে, চোখ ঘুরিয়ে দেখে, পাশে পাথরে খোদাই করা এক ত্রিশূলের চিহ্ন — মাঝখানে একটি সাপের আকৃতি, যেন বৃত্তাকারে ঘুরছে। হঠাৎ করেই তার মনে হয়, যেন পেছন থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। সে ঘুরে দাঁড়ায় — কেউ নেই। বাতাস নিস্তব্ধ, কেবল একটা শিউলি গাছ থেকে পড়ে পড়ছে সাদা ফুল। নিচে নামতে না নামতেই রাজবাড়ির এক কর্মচারী — কার্তিক — হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাতেই মৃত্যু হয় তার। শরীরে সাপের কামড়ের কোনো চিহ্ন নেই, কিন্তু চোখদুটো বিস্ফারিত, মুখ থমথমে। স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক জানান, “হার্ট ফেল” — কিন্তু গীতালি ফিসফিস করে বলে, “কার্তিক সেদিন দুপুরে নাগকক্ষের সামনে গিয়েছিল, বাবু… আপনি ছবি তোলার সময় ও দাঁড়িয়ে ছিল। বলেছিল, কিছু যেন তাকে ডাকছিল ঘরের ভেতর থেকে।” অর্ণবের মনে সন্দেহের ছায়া পড়ে, কিন্তু সে নিজেকে স্থির রাখে। সে ভাবতে থাকে, মৃত্যু কেবল কাকতাল নয়, অথবা এই কাহিনির পেছনে আছে কোনো সুপরিকল্পিত হত্যা? তার মাথার ভেতর প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। কিন্তু সেদিন রাতেই ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পায় এক নারী — কালো চুলে আবৃত, লাল শাড়ি, চোখে অদ্ভুত আলো — দাঁড়িয়ে আছে সেই কক্ষের সামনেই, যেন কিছু বলছে, অথচ কোনো শব্দ নেই। ঘুম ভেঙে গেলে তার কপাল ঘামে ভিজে, বুক ধড়ফড় করে ওঠে। অর্ণব জানে, কিছু একটা শুরু হয়ে গেছে। আহ্বান এসে গেছে। এখন আর পেছনে ফেরা যাবে না।
২
ভোরবেলা রাজবাড়ির সদর দরজায় যখন একটা ধূসর শালের মতো ওড়না মাথায় জড়ানো নারী দাঁড়ায়, তখন প্রাসাদটা যেন হঠাৎ থমকে যায়। সে যেন ঠিক রাজবাড়ির এই মৃতপ্রায় নিঃশব্দতার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশে থাকা কেউ — অপরিচিত, অথচ পরিচিত। তার চোখ দুটো ছিল যেন বহু জন্মের জ্ঞান ছুঁয়ে আসা; তার মুখে ক্লান্তি, কিন্তু ললাটে এক তীক্ষ্ণ দীপ্তি। প্রহরী প্রথমে তাকে ঢুকতে দিতে চায়নি, কিন্তু সে নিজের নাম বলতেই অর্ণবকে ডেকে পাঠানো হয়। নিচে নেমে এসে অর্ণব প্রথমেই অবাক হয় — এক আধুনিক তান্ত্রিক নারী? সে নিজের নাম বলে, “আমি বৈদেহী। আপনার নাম শুনেই এসেছি, অর্ণববাবু। আপনি নাগকক্ষ নিয়ে গবেষণা করছেন শুনে আমারও মনে হলো, সময় এসেছে আপনাকে দেখা দেওয়ার। নাগবসুন্ধরী আমারও স্বপ্নে আসেন, বহু বছর ধরে।” অর্ণব প্রথমে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় — এ কি আবার নতুন কোনো পাগল উপাসক? কিন্তু মেয়েটির চোখে কোনো অস্থিরতা নেই। সে শান্ত। যেন কোনো আদিগন্ত সত্য জানে, যেটা এখনও বাকিরা জানে না। বৈদেহী জানায় সে কামাক্ষ্যার উপাসকী, উত্তর অসমের এক গোপন তান্ত্রিক আশ্রমে বড় হয়েছে। “নাগবসুন্ধরী শুধুই ইতিহাস বা কিংবদন্তি নন,” সে বলে, “তিনি আজও এখানে আছেন, আপনার আশপাশেই।” অর্ণব হেসে ফেলে — এমন কথা বহুবার শুনেছে। কিন্তু তার হৃদয়ের কোথাও একটা হালকা শিউরে ওঠে — যেন বৈদেহীর উপস্থিতিই কোনো শক্তি জাগিয়ে তুলছে।
বৈদেহী তার সঙ্গে থাকা পুঁথি ও মুদ্রা, তাম্রচক্র, রুদ্রাক্ষ আর একটা ছোট লোহা-তামার মিশ্রণে তৈরি সাপের মূর্তি বের করে দেখায়। সে বলে, “এই চিহ্নগুলো শুধু তন্ত্র নয়, আত্মার পথচিহ্ন। যাদের আত্মা মুক্তি পায়নি, তারা এই চক্রে বন্দী থাকে। নাগবসুন্ধরী অমরত্বের সন্নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে ঠকানো হয়েছিল — সেই অসম্পূর্ণ যাত্রা আজও পূর্ণ হয়নি।” অর্ণব এসব যুক্তি মানতে চায় না, কিন্তু বৈদেহী তাকে জানায় — গত রাতে তার যে স্বপ্ন এসেছিল, যেখানে এক নারী দাঁড়িয়ে ছিল সেই দরজার সামনে, সেটি তারও দেখা ছিল। “আমি দেখেছিলাম,” সে বলে, “সে তোমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল — এবার সময় এসেছে।” অর্ণব অবাক হয় — এই নারী কিভাবে জানে তার ঘুমের স্বপ্ন? বৈদেহী বলে, নাগবসুন্ধরী কোনো এক ভাবে তার আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত। সে জন্ম থেকেই অনুভব করে কেউ তাকে ডাকছে — কখনো রাত্রে, কখনো ধ্যানের মাঝে। রাজবাড়ির কাছাকাছি এলেই তার শরীরের ভেতর কাঁপুনি আসে, পায়ের নিচে মাটি দুলে ওঠে। রাজবাড়ির গৃহকর্তা রুদ্রনারায়ণ প্রথমে বিরক্ত হন, কিন্তু বৈদেহীর দৃপ্ততা দেখে এবং অর্ণবের আগ্রহ দেখে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে এক সপ্তাহ থাকার অনুমতি দেন।
সন্ধ্যাবেলায়, অর্ণব ও বৈদেহী একসঙ্গে উঠে যান “নাগকক্ষ”-এর সামনে। দরজার সামনে দাঁড়ালে, বৈদেহী চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ সে বলে ওঠে, “এই দরজার ওপারে শুধু কক্ষ নয়, এখানে আটকে আছে সময়। আর রয়েছে এমন একটি আত্মা, যা অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক তন্ত্র।” অর্ণব এই কথা শুনে নিঃশব্দে ছবি তুলতে থাকে, কিন্তু এবার তার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করে। বৈদেহী দরজার সামনে বসে পড়ে তন্ত্রজপে — ঠোঁটে জপ, কপালে রক্তিম তিলক, আর চারপাশে বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে আসে। হঠাৎ কক্ষের তালা নিজে থেকেই নড়ে ওঠে — কিন্তু খুলে না। বৈদেহী চোখ খুলে তাকায় অর্ণবের দিকে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “ও আমাদের কথা শুনছে… ও জেগে উঠছে।” সেই রাতে আবার মৃত্যু হয় প্রাসাদের এক পুরনো রক্ষীর — এবারও গলায় সাপের ছাপ, চোখ বিস্ফারিত। ইন্সপেক্টর বিবেক এসে মৃতদেহ দেখে মাথা নেড়ে বলেন, “বিষক্রিয়া নয়, কিন্তু দেহে চিহ্ন সাপের কামড়ের মতো।” অর্ণব এবার বুঝতে পারে, বিষয়টা কেবল ইতিহাস নয় — এটা জড়িয়ে আছে আত্মা, শক্তি আর অতীতের এমন কোনো সূত্রে, যা যুক্তিবাদ দিয়ে বোঝা যাবে না। বৈদেহীর সঙ্গে তার এই যাত্রা শুধু রহস্যভেদ নয় — এটা হতে চলেছে নিজের মধ্যেই এক অন্বেষণ, এক ভয়ংকর আত্মজিজ্ঞাসা।
৩
রাজবাড়ির দেয়াল যেন নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। মৃত্যুর ভয় আর অলৌকিক অস্বস্তির ছায়া ছড়িয়ে আছে প্রত্যেক করিডোর, জানলা আর সিঁড়ির কিনারে। অর্ণব আজ সকাল থেকেই অদ্ভুত এক মনোযোগে প্রাসাদের পুরনো নকশাগুলো খতিয়ে দেখছিল। তার হাতে থাকা শতবর্ষ প্রাচীন নীল-কালিতে আঁকা মানচিত্রটি বলছে, প্রাসাদের নিচে এক সুড়ঙ্গ ছিল — সেই সুড়ঙ্গ যা সরাসরি নাগকক্ষের তলায় গিয়েই শেষ হত। এই তথ্য নতুন নয়, কিন্তু কেউ কোনোদিন তার সত্যতা যাচাই করেনি। বৈদেহী তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “যদি সত্যিই সেই পথটা থাকে, তাহলে শুধু দরজা দিয়ে নয়, ভেতরে পৌঁছানোর অন্য পথও থাকতে পারে। আর সেখানেই লুকিয়ে থাকতে পারে সত্যের মুখ।” গীতালিকে জিজ্ঞেস করতেই সে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমার ঠাকুর্দা বলতেন, রান্নাঘরের পুরনো চুলার পেছনে একটা গোপন দরজা ছিল একসময়… খুব ছোট, কিন্তু ভেতর দিয়ে কোথাও যাওয়া যেত।” রান্নাঘরটি এখন ব্যবহার হয় না — জং ধরা কড়াই, মাকড়সার জাল, আর ছাদের এক কোণায় শুকনো বাদুড়ের দেহ পড়ে রয়েছে। অর্ণব আর বৈদেহী এক লণ্ঠন জ্বালিয়ে খোঁজ করতে থাকে দেয়ালের গায়ে। হঠাৎ করেই তারা অনুভব করে, একটি অংশ অন্য অংশের তুলনায় ফাঁপা — ধাক্কা দিতেই দেয়ালের পলেস্তারার নিচ থেকে বেরিয়ে আসে একটি সঙ্কীর্ণ ফাঁক, যা মানুষ হাঁটুভাঙা হয়ে প্রবেশ করতে পারে।
সুড়ঙ্গপথে নামতেই গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে — বাসি মাটি, সাপের খোলস, আর আর্দ্র ঘামের মতো একটি ছেঁদানো গন্ধে ঘিরে থাকে চারপাশ। হাতের আলো ফেলে তারা দেখে প্রাচীন ইঁটের গাঁথুনি, দেয়ালে খোদাই করা চক্রাকার চিহ্ন, আর মাঝে মাঝে মোমবাতির গলিত মোম জমে রয়েছে পাথরের ওপরে। বৈদেহী থমকে দাঁড়ায় — তার চোখে আতঙ্ক নয়, বরং যেন এক স্বীকৃতি। “এই চিহ্নগুলো… এগুলো তামসিক শক্তির কেন্দ্র। এখানে তন্ত্রচর্চা হত। অনেক আত্মা এখানে একসময় বন্দী ছিল। এই জায়গা শুধু কক্ষ নয়, এটি এক শক্তির কূপ।” অর্ণব চমকে উঠে বলে, “তুমি কি বলতে চাও, এই জায়গা এখনো জীবিত?” বৈদেহী চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নেয়, তারপর মাথা নাড়ে, “না, ও এখানে নেই… কিন্তু ওর ছায়া এখনো রয়ে গেছে। এই শক্তি শান্ত নয়, নিঃশব্দ ঘুমোচ্ছে — এবং কেউ যদি তা জাগিয়ে তোলে…” হঠাৎ এক বিশাল পাথরের পিঁড়ি দেখা যায়, যেখানে লালসালু দিয়ে ঢাকা এক বেদি। বেদির পাশে অর্ধেক গলিত একটি কাঠের বাক্স, যার ভেতরে তারা পায় কিছু পুরনো পুঁথি, একটি সাপ-আকৃতির তামার মূর্তি, আর এক চিঠি — অর্ণব তা পড়তে গিয়ে থমকে যায়। চিঠিতে লেখা: “আমি নাগবসুন্ধরী, এই কক্ষে আমার আত্মা থাকবে, যতক্ষণ না আমার অপূর্ণ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়। রাজা আমায় প্রতারিত করেছে, আমি ফিরবো, আমি দাবী করবো আমার পূর্ণতা।”
অর্ণবের মনের ভেতর চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন ঝড় তুলে দেয় — অভিশাপ, প্রতিশোধ, অপূর্ণতা। বৈদেহী চিঠিটা হাতে নিয়ে কপালে ঠেকায়, তারপর বলে, “এই নারী শুধু অভিশপ্ত নয়, ওর আত্মা ব্যাকুল — মুক্তির জন্য। তুমি কি জানো, তান্ত্রিক শক্তির সবচেয়ে গভীর স্তরে আত্মার জাগরণ সম্ভব, যদি কেউ তার যন্ত্রণা ভাগ করে নেয়?” অর্ণব জিজ্ঞেস করে, “তবে কি তুমি বিশ্বাস করো — তার আত্মা এখনও এখানে আছে?” বৈদেহী বলে, “আমি শুধু বিশ্বাস করি না, আমি তা অনুভব করি। আমি ওর ডাক পেয়েছি… বহুবার।” হঠাৎ এক প্রবল কাঁপুনি হয় মাটির নিচে — যেন সুড়ঙ্গের কোনও গভীর অংশে হাওয়া ধাক্কা খেয়ে উঠছে। আলো ঝিমিয়ে ওঠে, আর বাতাসে ভেসে আসে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস। অর্ণব প্রথমবারের মতো ভয় অনুভব করে — ইতিহাসের পাতা থেকে যেন কোনো শক্তি আজ সত্যিই জেগে উঠেছে। তারা দুজনে দ্রুত উপরে উঠে আসে, কিন্তু অর্ণবের হাতে তখন সেই চিঠি, আর তার কাঁধে যেন অদৃশ্য কোনো হাতের স্পর্শ — ঠান্ডা, মসৃণ, সাপের গায়ের মতো। সে জানে, কিছু একটা সামনে অপেক্ষা করছে — যা তার জ্ঞানের বাইরে, যুক্তির বাইরে, কিন্তু তার নিয়তিকে ছুঁয়ে আছে গভীরভাবে। সেই রাতেই বৈদেহী তাকে বলে, “এই রাজবাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে। তুমি শুধু এক গবেষক নও, তুমি তারও উত্তরাধিকার।” অর্ণব স্তব্ধ হয়ে শোনে — তার মধ্যে এক অজানা ভয়, আর সেই ভয়ই তাকে ঠেলে নিয়ে যাবে অভিশপ্ত অতীতের আরও গভীরে।
৪
পরদিন সকালটা শুরু হয় নিস্তব্ধতায়। চারদিকে একটা ভারী হাওয়া — যেন বাতাসও সতর্ক হয়ে গেছে। গীতালি আতঙ্কে সারা রাত ঘুমোতে পারেনি, আর রান্নাঘরের পুরনো পরিচারক ধীরেন বলছিলেন, “মহারাজ, কাল রাতে আবার সেই সিঁড়ির দিক থেকে কাঁদার আওয়াজ শুনলাম… কেউ যেন জলের নিচ থেকে ডেকে বলছে, ‘আমায় ফেরাও।’” অর্ণব আর বৈদেহী চুপচাপ বসে শোনে, কেউ কথা বলে না। সুড়ঙ্গ থেকে ফিরে আসার পর থেকেই বৈদেহীর চোখে একটা অন্যরকম ছায়া — কখনও শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকে, আবার কখনও নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখে। অর্ণব বুঝতে পারে, ওর ভেতরে কিছু চলছে। কিন্তু সে নিজেও স্থির থাকতে পারছে না — গত রাতের সেই ঠান্ডা স্পর্শ, সেই চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন এখনও গায়ের উপর লেগে আছে। বেলা গড়াতে না গড়াতেই হঠাৎ প্রাসাদের দক্ষিণ দিক থেকে চিৎকার ভেসে আসে। সবাই দৌড়ে যায় পুরনো জলকাঠির দিকটায় — সেখানে মাটিতে পড়ে আছে রাজবাড়ির আরও এক কর্মচারী, বেণীমাধব। চোখদুটো বিস্ফারিত, মুখ ফাঁকা, আর গলায় কাঁচাপাকা দাগ — একেবারে সাপের ছোবলের মতো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আশেপাশে কোথাও সাপের দেখা নেই, কোনও কামড়ের চিহ্ন নেই।
স্থানীয় থানা থেকে ডাকা হয় ইন্সপেক্টর বিবেক ভট্টাচার্যকে — মধ্যবয়সী, কঠোর, শহরের শিক্ষা পাওয়া হলেও মাটির গন্ধে মিশে থাকা একজন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি প্রাসাদের আগের মৃত্যুর খোঁজখবর আগে থেকেই জানতেন, এবং এই নতুন মৃত্যুর পেছনে যুক্তির সন্ধান করতে উঠে-পড়ে লাগেন। “সাপের ছোবল হলেও, এখানে কোনও বিষক্রিয়া নেই। শরীরের রঙ বদলায়নি, হৃদযন্ত্র থেমে গেছে হঠাৎ,” ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে নিয়ে বিবেক বলেন। অর্ণব তাকে সুড়ঙ্গের কথা বলতে চায়, কিন্তু বৈদেহী তাকে ইশারায় থামিয়ে দেয়। বৈদেহী পরে বলে, “সব কিছু বলা যাবে না এখনই। মানুষ যুক্তি দিয়ে শুধু যে জিনিস দেখে তা-ই বোঝে, কিন্তু যেটা অনুভব করতে হয়, সেটাকে তারা ভয় পায়। ইন্সপেক্টরকে এখন বোঝানোর সময় নয়।” কিন্তু বিবেক নিজেই বুঝতে পারে, কিছু একটা গোলমাল আছে — রাতের পর রাত, মানুষের মৃত্যু, অথচ কোনো প্রমাণ নেই। তিনি অর্ণবকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি তো ইতিহাস খুঁজতে এসেছিলেন? এখন কি মনে হচ্ছে, এ ইতিহাস শুধু কাগজে বাঁধা থাকবে?” অর্ণব সোজাসুজি উত্তর দিতে পারে না — তার মনে ভেসে ওঠে সেই চিঠির কথা, বেদির কথা, আর বৈদেহীর মুখে উচ্চারিত সেই শব্দগুলো — “তান্ত্রিক শক্তির চক্র”।
রাত গভীর হলে, বৈদেহী একা একা ধ্যানস্থ হয় নাগকক্ষের পাশে বসে। তার সামনে পাঁচটা প্রদীপ জ্বলছে, আর মাঝখানে রাখা সেই সাপের তাম্র মূর্তিটি। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “তুমি এসেছো… আমি জানি তুমি এসেছো। তুমি এখনও পূর্ণতা পাওনি। কিন্তু আমি জানি, তুমি কাকে খুঁজছো।” হঠাৎ বাতাসে গন্ধ আসে চন্দনের, সঙ্গে আগরবাতির মতো একটা ধোঁয়া, যা ঘরের কোণে ঘুরপাক খায়। অর্ণব দূর থেকে দেখে — বৈদেহীর মাথার চারপাশে ধোঁয়ার রেখা যেন একটি সর্পিল আকৃতি নিচ্ছে। সে দৌড়ে আসে, বৈদেহীর কাঁধ ধরে টান দেয় — আর তৎক্ষণাৎ সে চোখ মেলে বলে, “আরেকজন প্রাণ চাইছে সে। সে জেগে উঠেছে, এবং এখন সে নিজের অপূর্ণ যজ্ঞ পূর্ণ করতে চাইছে।”
অর্ণব তবু যুক্তি খোঁজে — “কে এই ‘সে’? আত্মা কি সত্যিই ফিরে আসতে পারে?”
বৈদেহী চুপ করে তাকিয়ে থাকে, তারপর নিচু গলায় বলে, “হ্যাঁ, যদি তার যাত্রা অসম্পূর্ণ হয়। যদি তার প্রতারণা হয়। আর যদি কোনো আত্মা তার নিজস্ব ছায়াকে খুঁজে পায়…”
অর্ণব প্রশ্ন করে, “ছায়া মানে?”
বৈদেহী এবার অর্ণবের চোখে চোখ রেখে বলে, “যে তারই রক্ত — রক্তের উত্তরাধিকার। হয়তো… তুমি।”
৫
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে রাজবাড়ির চারদিকে। হাওয়া যেন আজ আরও ভারী, দরজার খোলা-বন্ধে শব্দ হয় দীর্ঘশ্বাসের মতো। বৈদেহী ও অর্ণব চুপচাপ বসে রয়েছে প্রাসাদের সেই গোপন ঘরটিতে, যেখানে তারা আগের দিন খুঁজে পেয়েছিল বেদি, পুঁথি আর সেই কুখ্যাত চিঠি। অর্ণব চিঠিটা আবার পড়ে — প্রতিটি অক্ষর যেন আগুনে পোড়া দাগ ফেলে মনে। বৈদেহী এবার তার সঙ্গের পুঁথি খুলে বসে — পাতায় পাতায় আঁকা ত্রিভুজ, চক্র, শঙ্খ, নাগমুদ্রা। এরপর সে এক পুরনো কাঠের বাক্সের নিচে রাখা একটি ক্ষয়প্রাপ্ত তাম্রশাসনের পেছনে খুঁজে পায় আরেকটি অর্ধেক লেখা কাহিনি — যা লেখা হয়েছিল তৎকালীন রাজা মহেন্দ্রনারায়ণ রায়ের হাতেই।
সেই ডায়েরির পাতায় লেখা রয়েছে এক অভিশপ্ত সন্ধ্যার কাহিনি।
এক শতাব্দী আগের কথা। রাজবাড়ির গৌরব তখন চরমে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তান্ত্রিক, পণ্ডিত, শিল্পী, বাউল — সবাই আসতেন রাজপ্রাসাদে অতিথি হয়ে। তখনই এক নারী এসে হাজির হন কামাক্ষ্যার অঞ্চল থেকে — তার নাম ছিল সুন্ধরী, পরবর্তীতে যার নাম হয়ে ওঠে নাগবসুন্ধরী। তিনি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী, চোখে ছিল অলৌকিক শক্তির দীপ্তি। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক ছিল তার তন্ত্রবিদ্যা। রাজা তাকে সাদরে গ্রহণ করেন, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন — এই নারীর শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি নাকি অমরত্বের উপায় আবিষ্কার করেছেন, যেখানে আত্মা শরীর ছাড়িয়ে যেতে পারবে এক ‘চক্র’–এর মাধ্যমে।
রাজা ভয় পেয়ে যান — যদি এই নারী চিরজীবী হয়ে ওঠেন, তবে তার শাসনের ভবিষ্যৎ কি হবে? তখনই তিনি সুন্ধরীকে ছলনা করে বন্দি করান — প্রাসাদের গোপন কক্ষে, যেখানে সূর্যের আলো ঢোকে না। সেই কক্ষেই, যে কক্ষ আজ “নাগকক্ষ” নামে অভিশপ্ত। সুন্ধরীর যজ্ঞভূমি ভেঙে দেওয়া হয়, তার তৈরির সমস্ত তান্ত্রিক উপকরণ ধ্বংস করা হয়। কিন্তু ঠিক যেদিন তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার আদেশ হয়, তার আগেই সে তান্ত্রিক চক্রের মধ্যে নিজেকে উৎসর্গ করে অভিশাপ দেয় — “আমি ফিরে আসবো, যখন আমার শক্তি পূর্ণ হবে, আর তোমার রক্তই তখন হবে আমার যজ্ঞের অর্ঘ্য।” এরপর থেকে প্রতি প্রজন্মে রাজপরিবারের অন্তত একজন সদস্য রহস্যময় মৃত্যুতে মারা যায়। কেউ জলে ডুবে, কেউ অস্বাভাবিক জ্বর, কেউ আবার অজানা আতঙ্কে। ডায়েরির শেষে লেখা — “আমি জানি, আমার উত্তরসূরিরা এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে না… যতক্ষণ না কেউ তাকে মুক্তি দেয়, অথবা তার যজ্ঞ শেষ করে।”
অর্ণব আর বৈদেহী চুপ করে বসে থাকে — চারপাশে যেন শব্দহীন সময় থেমে গেছে। বৈদেহী নিচু গলায় বলে, “এই চক্রটা বন্ধ হয়নি অর্ণব। এটা এখনও ঘুরছে। অভিশাপ এখনও প্রবাহমান। আর তুমি… তুমি সেই রক্তরেখার অন্তর্ভুক্ত।”
অর্ণব যেন অসাড় হয়ে যায়। তার মাথায় ভেসে ওঠে নিজের শৈশবের ছবি — বাবা সবসময় ঠাকুরঘরের দেয়ালে একটা লাল-সাপের প্রতিকৃতি রেখে দিতেন। আর বাড়িতে এক পুরনো গল্প চলত — তাদের পূর্বপুরুষ কেউ এক রাজবাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল। সে কখনও পাত্তা দেয়নি এসব। এখন সে চুপ করে বসে থাকে — মাথায় ভিড় করে নানা কথা। বৈদেহী বলে, “তোমার শরীরে ওই চক্রের রক্ত আছে বলেই তুমি এখানে এসেছো, বলেই ও তোমায় স্বপ্নে পেয়েছে। এ কেবল ইতিহাস নয়, এ তোমার আত্মীয়তা।” অর্ণব ভয় পায়, কিন্তু সে পালায় না। সে বলে, “তাহলে এখন কী করতে হবে?” বৈদেহী একটানা তাকিয়ে বলে, “আমাদের এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে হবে — অথবা অভিশাপ চিরকাল চলবে। আত্মাকে মুক্তি না দিলে, সে প্রাণ নিতে থাকবে, একে একে।”
হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে আসে, যেন কোথাও থেকে কেউ দেখছে, শুনছে। বৈদেহী চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হয় — আর এক পলকে বলে ওঠে, “আগামী পূর্ণিমার রাতে যজ্ঞ শুরু করতে হবে। সেদিন চক্র শক্তিশালী হবে। যদি সেদিন ওর আত্মা মুক্তি না পায়… তবে আর কারও রেহাই থাকবে না।”
অর্ণব চুপ করে বসে — তার হৃদয়ের গহীনে কিছু গর্জে ওঠে। তার যাত্রা এখন কেবল গবেষণা নয়। এ যাত্রা তাকে নিয়ে যাবে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে নিজের শিকড়ের গভীরে — যেখানে সত্য, আত্মা, বিশ্বাস আর রক্তের অভিশাপ একসঙ্গে মিশে আছে।
৬
রাত তখন গভীরতম পর্যায়ে। রাজবাড়ির পুরনো দেয়ালে জোনাকি পোকাদের আলোর মতো ঝলমলে ছোট ছোট প্রদীপগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বৈদেহী নিজের হাতে গড়া পুরনো তাম্রচক্রটি হাতে নিয়ে তান্ত্রিক যজ্ঞ শুরু করতে বসে। অর্ণব চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, মনে পড়ছে গোপন চিঠির কথাগুলো — ‘অভিশপ্ত আত্মার মুক্তি… রক্তের বিনিময়ে পূর্ণতা।’ বাতাস নিস্তব্ধ, যেন পৃথিবীও তাদের পবিত্রতা অনুভব করছে। বৈদেহীর মুখ থেকে ওঠে কম্পমান জপ, ঠোঁটে সাপের মন্ত্র আর চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। একের পর এক প্রদীপ জ্বলে ওঠে, চারপাশে মোমের গলিত মোমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, আর ঘরে কেমন এক অপূর্ব শক্তির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
হঠাৎ, বৈদেহী নিজের হাতে থাকা ছুরি দিয়ে কব্জিতে গভীর ক্ষত করে রক্ত ঝরাতে শুরু করে। রক্তের ফোঁটা পড়ে তাম্রচক্রের উপর, আর সেখান থেকে সূক্ষ্ম আলো ফোটে ওঠে। সে চেঁচিয়ে ওঠে, “এ আমার আত্মাহুতি, মুক্তির পথ!” অর্ণব ছুটে এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়, “বৈদেহী! থামো, এটা ভুল — আমরা একসঙ্গে এই অভিশাপ ভাঙ্গবো!” কিন্তু বৈদেহীর চোখে তখন শুধুই সংকল্প আর শান্তি। তার স্পর্শ যেন পবিত্র, আর ধমকেও সে নড়াচড়া করে না। তখন হঠাৎ গর্জনের মতো শব্দ হয়, বাতাসে নাচতে থাকে সাপের মতো ধোঁয়া। বৈদেহী ঢাল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি আছি, আমি সঙ্গী, আমি তোমার মুক্তি!”
অর্ণবের মনে হয়, যেন এক পৃথিবী হারিয়ে গেছে, আর অন্য এক জগত খুলে গেছে। সে বুঝতে পারে, শুধু সাহস নয়, ঐ আত্মত্যাগ ছাড়া অভিশাপ ভাঙা যাবে না। সে নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ তান্ত্রিক যজ্ঞে — তার রক্ত ও বিশ্বাস মিশে যায় ঐ পুরনো তন্ত্রের সঙ্গে। রাজবাড়ির দরজা বাইরে থেকে জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়া শুরু হয়। কেউ আছড়ে পড়ছে দরজায়, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারছে না।
বাইরে তখন ইন্সপেক্টর বিবেক এবং রুদ্রনারায়ণ, তাদের দেহে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তারা তাড়া করে ভিতরে ঢুকতে চায়, কিন্তু কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের আটকায়। ভিতরে বৈদেহীর কণ্ঠে উঠে ধ্বনি, আর বেদিতে জ্বলতে থাকে এক অসাধারণ তেজ। সেই সঙ্গে নীচু গলায় কেউ বলে ওঠে, “আমিই নাগবসুন্ধরী, তোমরা যারা চাও আমাকে বাধা দিতে, জানো না তোমাদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে।” অর্ণব নিজের শরীরের ভেতরে সেই অতীতের নীল-সাপের চিহ্ন অনুভব করে, আর বুঝতে পারে এই লড়াই শুধু ইতিহাসের নয়, তার নিজের জীবনের লড়াই। বাতাস ঝাঁকুনি খেয়ে উঠে, আর হঠাৎ চমকপ্রদ এক আলো ঝলসে ওঠে, যা রাজবাড়ির প্রতিটি প্রাচীর স্পর্শ করে এক অদৃশ্য বন্ধন ভেঙে দেয়।
পরের মুহূর্তেই বেদি থেকে ধোঁয়া উঠে তার সাথে একটি মৃদু শিখা হয়ে আবর্তিত হয়, এবং ধীরে ধীরে সেই ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসে একটি নারীর আত্মা — কালো চুল, লাল শাড়ি, চোখে আগুনের দীপ্তি। সে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আমার উত্তরাধিকারী, তুমি আমার মুক্তিদাতা।” বৈদেহী থেমে যায়, এবং অর্ণবের হাত ধরে বলে, “এখন আমরা মুক্ত। তোমার অভিশাপ আর নেই।” বাতাস নীরব হয়ে আসে, আর রাজবাড়ির প্রতি কোণায় যেন এক শান্তির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে।
অর্ণবের চোখে অশ্রু এসে পড়ে — ইতিহাসের ভারমুক্তি, আত্মার মুক্তি — সব মিলিয়ে এক মহৎ যজ্ঞের সমাপ্তি।
তাদের পথ এবার নতুন, কিন্তু সেই অভিশাপের স্মৃতি চিরকাল হৃদয়ে থাকবে।
৭
রাজবাড়ি আবার নিঃশব্দ, কিন্তু এবার সেই নীরবতা যেন মুক্তির নিঃশ্বাসে ভরা। দিনের আলো এসে পড়ছে প্রাচীন জানলার রঙচঙে কাঁচে, আর তার ছায়া ছড়িয়ে আছে বৈদেহীর কপালের তিলকে, যেন আশীর্বাদের আলো। তিন দিন কেটে গেছে সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির পর, যখন বৈদেহী নিজের রক্ত দিয়ে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করেছিল, আর অর্ণব প্রথমবারের মতো চক্রের মধ্যে নিজের উত্তরাধিকারের সত্য উপলব্ধি করেছিল। বৈদেহী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে, যদিও তার শরীরে ক্লান্তি, চোখে এক গভীর অনন্তশূন্যতা। অর্ণব তার পাশে বসে থাকে — যতবারই বৈদেহীর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেছে, তার মনে হয়েছে যেন পৃথিবীর গভীর কোনো শক্তির স্পন্দন শুনছে। কিন্তু এখন, মুক্তির পর, অর্ণবের মনে প্রশ্ন জাগে — নাগবসুন্ধরীর আত্মা কি সত্যিই বিদায় নিয়েছে? নাকি সে কেবল অপেক্ষা করছে পরবর্তী পূর্ণিমার, পরবর্তী যজ্ঞের, নতুন কোনো অভিশপ্ত উত্তরাধিকারীর জন্য?
বিকেলের আলো গড়িয়ে এলে রুদ্রনারায়ণ প্রাসাদের ঘরে ঢোকেন। তার মুখে আশ্চর্য এক শান্তি। “প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আমি এই রাজবাড়ির অভিশাপ বয়ে বেড়িয়েছি, প্রতিটি প্রজন্মকে হারাতে দেখেছি, অথচ কিছুই করতে পারিনি,” তিনি বলেন। “আজ তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে — কেউ তো এগিয়ে এসেছিল সত্যকে জাগাতে। কেউ তো সাহস দেখিয়েছিল অভিশাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।” তিনি একটি পুরনো বাক্স অর্ণবকে দেন — তার ভিতর কিছু পাণ্ডুলিপি, একটি হাতঘড়ি ও একটি তাম্রমুদ্রা, যার গায়ে সাপের দুই ফণা চক্রাকারে খোদাই করা। “এটা তোমার,” বলেন রুদ্রনারায়ণ, “কারণ তুমি শুধু ইতিহাসের ছাত্র নও — তুমি এখন ইতিহাসের উত্তরসূরি।” অর্ণব বাক্স খুলে তাম্রমুদ্রাটি হাতে নেয়, তার আঙুল যেন কেঁপে ওঠে — মুদ্রার ঠান্ডা গায়ে তার দেহে বয়ে চলে এক পুরনো কম্পন। বৈদেহী পাশে এসে দাঁড়ায়। “এই চক্র এখনও শেষ হয়নি,” সে বলে। “শুধু বিশ্রাম নিচ্ছে। অভিশাপের দানব এখন ঘুমোচ্ছে, কিন্তু চক্র যেদিন আবার দুর্বল হবে — সেই দিন তুমি-আমি হয়তো আবার তার সামনে দাঁড়াবো।”
সন্ধ্যে নেমে আসে। আকাশের লালচে আভা যেন রক্তের মতো ছড়িয়ে পড়ে প্রাসাদের বারান্দায়। বৈদেহী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পুরনো নাগকক্ষের দরজার সামনে — দরজাটি এখনো বন্ধ, যদিও তার ভেতরকার শক্তি স্তব্ধ। অর্ণব পাশে এসে দাঁড়ায়। “তুমি কি এখানেই থাকবে?” সে জিজ্ঞেস করে। বৈদেহী মাথা নাড়ে, “না, আমাকে যেতে হবে। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে আত্মা অপেক্ষা করে মুক্তির জন্য। আমি তাদের পাশে থাকি।”
“আর আমি?” অর্ণব জিজ্ঞেস করে।
বৈদেহী হেসে বলে, “তুমি থেকো এখানেই। কিন্তু মনে রেখো — ইতিহাস শুধু কাগজে লেখা নয়। সে রক্তে বাঁচে, চোখে ফোটে, ঘুমে ডাকে। তোমার স্বপ্ন যদি আবার কাঁপে… বুঝে নিও, চক্র আবার ঘুরছে।”
তারপর ধীরে ধীরে বৈদেহী চলে যায়। তার পদধ্বনি মিলিয়ে যায় সন্ধ্যার বাতাসে।
অর্ণব একা দাঁড়িয়ে থাকে, হাতে সেই তাম্রমুদ্রা।
আর ঠিক তখনই, দূরে — অনেক দূরে, আকাশের গাঢ় নীল অন্ধকারে — এক অদৃশ্য সাপের ফণা যেন মৃদু ঢেউ তুলে বলে ওঠে, “আমার গল্প এখনো শেষ হয়নি…”
৮
সময় গড়িয়ে যায়। প্রাসাদে শোকের ছায়া সরে গিয়ে আসে একধরনের ভারমুক্তি, কিন্তু তার সঙ্গে থেকেই যায় কিছু অদৃশ্য স্পন্দন, কিছু অপূরণীয় প্রশ্ন। বৈদেহীর চলে যাওয়ার পরে অর্ণব যেন একা এক অভিযাত্রায় নামছে — নিজের শিকড়ের সন্ধানে, এবং আরও গভীরতর ইতিহাসের স্তরে। নাগকক্ষের দরজাটি আর কেউ খোলে না, কিন্তু অর্ণব প্রতি রাতে সেই দরজার সামনে বসে থাকে হাতে তাম্রমুদ্রাটি নিয়ে। সে চোখ বন্ধ করে শোনে, অনুভব করে বাতাসে মিশে থাকা অজানা শব্দ — কখনো ফিসফিস, কখনো দীর্ঘশ্বাস, আর কখনো যেন তার নিজের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিশে যাওয়া স্নায়ুবিক আওয়াজ। একরাতে তার স্বপ্নে আবার সেই চেনা মুখ — লাল শাড়ির নারী, চোখে আগুন, ঠোঁটে অভিশাপ — বলে, “পূজো এখনও অসম্পূর্ণ… আত্মা তখনই মুক্ত হয়, যখন স্মৃতি তাকে স্বীকৃতি দেয়।”
জেগে উঠে অর্ণব বুঝতে পারে — শুধু যজ্ঞ নয়, তাকে এক পূর্ণ আরাধনার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। ইতিহাস শুধু অধ্যয়নের বিষয় নয়, তা শ্রদ্ধা, স্বীকৃতি, আর আত্মত্যাগের পথ। পরদিন সকালে, সে রাজবাড়ির পুরনো আঙ্গিনায় তৈরি করে একটি অনন্য বেদি — পাথর, মাটি ও ফুলের মিশ্রণে। সে একত্র করে সেই সমস্ত পুঁথি, তাম্রচক্র, সাপমূর্তি, বৈদেহীর ব্যবহৃত তান্ত্রিক উপকরণ — এবং শুরু করে এক অদ্ভুত আরাধনা — যেখানে বৈজ্ঞানিক ও আত্মিক চেতনার সংমিশ্রণ ঘটে।
এই পূজায় কোনো মন্ত্র নেই, নেই কোনো ধর্মগ্রন্থ। এটি এক নীরব আরাধনা — যেখানে অর্ণব শুধু বসে থাকে, চোখে চোখ রাখে অতীতের সঙ্গে, হৃদয়ে ডাকে নাগবসুন্ধরীর নাম। সে প্রতিদিন প্রদীপ জ্বালায়, একটি করে পৃষ্ঠা পড়ে ডায়েরির, আর স্মরণ করে সেই নারীকে — যিনি কখনো দেবী ছিলেন, কখনো অভিশপ্ত, কখনো বিদ্রোহিনী। সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। একরাতে, পূর্ণিমার আলোয়, হঠাৎ সেই বেদির সামনে একটি চেনা ছায়া ভেসে ওঠে — ধোঁয়া নয়, স্পষ্ট রক্ত-মাংসের মতো স্পর্শযোগ্য। নাগবসুন্ধরীর আত্মা দাঁড়িয়ে, তার চোখে নেই আগুন, আছে শুধুই প্রশান্তি। সে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আমার জন্য যা করেছো, তা কোনো প্রজন্ম করেনি। তুমি আমাকে মানুষ হিসেবে স্বীকার করেছো, তান্ত্রিক নয়, অভিশপ্ত নয় — একজন নারী হিসেবে।”
অর্ণবের চোখে জল আসে। সে কিছু বলতে পারে না।
নাগবসুন্ধরী বলে, “আজ আমি যেতে পারি। কারণ আমার গল্প আর কারও ভিতরে আটকে নেই — তুমি আমাকে গল্পে ফিরিয়েছো। তুমি আমাকে স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রেখেছো।”
তারপর এক মৃদু বাতাসে সে মিলিয়ে যায় — যেন নিজেই ধূপের ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিশে যায়।
সেই রাতে রাজবাড়ির আকাশে বজ্র হয় না, বাতাসে গন্ধ থাকে বেলফুলের, আর হঠাৎ করেই প্রাসাদের প্রত্যেকটা জানলা খুলে যায় একসঙ্গে — যেন শতাব্দী পুরনো বন্দিত্বের দরজা খুলে গেছে। অর্ণব চুপচাপ বসে থাকে, হাতে সেই তাম্রমুদ্রা — এবার সেটি আর ঠান্ডা নয়, উষ্ণ। তাতে স্পষ্ট খোদাই হয় — “মুক্তি সম্পূর্ণ”। সকালে রুদ্রনারায়ণ এসে বলে, “আজ আমার মনে হচ্ছে, যেন আমার দেহ থেকে কয়েক প্রজন্মের পাপ সরে গেছে। এই রাজবাড়ি এখন শুদ্ধ।”
অর্ণব কিছু বলে না। তার চোখে তখন এক জেদ — সে শুধু ইতিহাস লিখবে না, সে ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখবে। তার পরবর্তী পথ এখন স্পষ্ট — অন্য অভিশপ্ত ইতিহাসের দিকে যাওয়া, যেখানে অন্ধকার এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে নারী, আত্মা, বিদ্রোহ, আর চক্রের গোপন সত্যকে।
তার যাত্রা আবার শুরু হয় — এবার বৈদেহী ছাড়াই, কিন্তু তার ছায়া নিয়ে।
৯
রেলগাড়ির জানালার বাইরে লাল মাটি, পলাশগাছ, আর একটানা ছুটে চলা ধানখেতের রেখা। অর্ণব একা বসে, কোলে রাখা চামড়ার পুরনো ব্যাগ — তার মধ্যে সেই তাম্রমুদ্রা, কিছু পাণ্ডুলিপি, বৈদেহীর ফেলে যাওয়া রুদ্রাক্ষের মালা, আর একটা চিঠি, যার খামে লেখা — “দ্বিতীয় চক্র।” সে এবার পাড়ি দিয়েছে বাঁকুড়ার ছোট্ট এক গ্রামে, যার নাম ‘ঘোড়ামারা’। সেখানকার মাটি ঘিরে বহুদিন ধরে ছড়িয়ে আছে কিংবদন্তি — এক নারী যিনি মাটির মূর্তি তৈরি করতেন, আর যাঁর তৈরি প্রতিটি মূর্তিতে প্রাণ প্রবেশ করত। সেই নারীর নাম ‘কামিনী’ — আর স্থানীয়রা তাকে এখনও ‘মাটির মা’ নামে ডাকে। কিন্তু কথা আছে, তার মৃত্যুর পরে একের পর এক শিল্পী পাথর হয়ে যায় — সত্যিকারের পাথর। অর্ণব সেই গ্রামে পৌঁছে দেখে, শোক আর ভয় মিশে থাকা একটা স্তব্ধতা — মানুষ কথা বলে ফিসফিস করে, আর চোখ মেলে তাকায় না। সে বুঝতে পারে, এখানেও ইতিহাস একটা অভিশাপের রূপ নিয়েছে — এবং হয়তো, এখানেই দ্বিতীয় চক্রের শুরু।
গ্রামের মাটি রক্তিম, যেন আগুন লেপে দিয়েছে ধুলোর উপর। এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, হরিবাবু, তাকে বলেন — “তুমি শহর থেকে এসেছো তো? তোকে বলি, এখানে যা ঘটছে তা তুই বইতে পারবি না। কামিনী মাটি দিয়ে প্রাণ দিতেন, কিন্তু একদিন সে প্রাণ তার ইচ্ছেমতো চলতে শুরু করে। তখন কামিনী নিজেই নিজের তৈরি মূর্তির মধ্যে আটকে পড়ে, আর সেই রাত থেকে গ্রামের শিশুরা মূর্তি হয়ে যায়।”
অর্ণব প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু সেই রাতে, গ্রামের এক পুরনো পাটকাঠির বাড়িতে যখন সে একা শুয়ে, তখন তার ঘরের কোণায় রাখা একটি অর্ধেক তৈরি মুখহীন মাটির মূর্তি একবার নড়ে ওঠে।
তারপর দেয়ালের ছায়া থেকে ভেসে আসে এক চাপা স্বর — “তুমি এসেছো… সে বলেছিল তুমি আসবে… চক্র ঘুরছে।”
অর্ণব উঠে বসে পড়ে, তার বুক ধুকপুক করতে থাকে, কিন্তু সে জানে — ভয় পেলে চলবে না।
সে জানে, এই দ্বিতীয় চক্র হয়তো ততটা সহজ নয়। নাগবসুন্ধরীর অভিশাপ ছিল আত্মার, কিন্তু এখানে ইতিহাস নিজেই শরীর হয়ে উঠেছে। এখানে ইতিহাস শুধু লিখিত নয়, সে আকার পেয়েছে মাটির টুকরোয়, প্রতিমার চোখে, মৃত শিশুদের মুখে।
পরদিন সকালে, সে ঘুরে ঘুরে দেখে গ্রামের ছোট্ট মন্দির — যেখানে কামিনীদেবীর শেষ যজ্ঞ হয়েছিল বলে কথিত। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে হাত রাখে মৃত মাটির মূর্তির গায়ে — এবং হঠাৎ করে তার মাথায় বিদ্যুতের মতো এক দৃষ্টি জ্বলে ওঠে। সে দেখে — এক নারী, কপালে সিঁদুর, হাতে মাটি, চোখে বিদ্রোহ — যিনি বারবার কাঁদছেন, বলছেন, “আমায় বিশ্বাস করো না, আমায় মাটি বানিয়ে রেখো… আমি নিজেই অভিশাপ হয়ে উঠেছি।”
অর্ণব বুঝতে পারে, দ্বিতীয় চক্র শুরু হয়ে গেছে।
এখানে মুক্তি পেতে হলে তাকে মাটি ছুঁতে হবে, প্রতিটি মৃত শিল্পীর চোখে তাকাতে হবে, এবং খুঁজে পেতে হবে সেই এক বিন্দু বিশ্বাস — যা কামিনী রেখে গিয়েছিলেন।
রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তার যাত্রা ছিল ইতিহাসের মুক্তির জন্য। এখন সে বুঝছে — মুক্তি শুধু আত্মার নয়, মুক্তি প্রয়োজন স্মৃতির, প্রতিমার, শিকড়ের।
আর এই যাত্রা শেষ হবে না — যতক্ষণ না সব চক্র বন্ধ হয়, যতক্ষণ না সব অভিশাপের পেছনের নারীরা ‘অভিশপ্ত’ থেকে পরিণত হয় ‘নবীনের প্রতীক’-এ।
১০
ঘোড়ামারা গ্রামের নির্জনতা ছিঁড়ে আসে এক নতুন পূর্ণিমা। আকাশে চাঁদ উঠেছে, যেন এক টুকরো তপ্ত রূপোর অভিশাপ, নেমে এসেছে মাটির ওপরে। অর্ণব সেদিন সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছে কামিনীর তৈরি প্রতিটি মূর্তি খুঁজতে — যার মুখ নেই, চোখ নেই, অথচ যেন প্রাণ আছে। রাত গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই মূর্তিগুলোর চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন তারা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। গ্রামের বয়স্কা মহিলারা ভয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়, শিশুদের গালে হলুদ ফোঁটা দিয়ে শোয়ায় — যেন অতৃপ্ত আত্মার থেকে রক্ষা পাবে।
কিন্তু অর্ণব জানে, এবার পালাবার সময় নয়। সে নিজেই তৈরি করেছে বেদি — গ্রামের কেন্দ্রস্থলে একটি পুরনো বটগাছের নিচে, যেখানে এককালে কামিনী নিজের শেষ প্রতিমা বানিয়েছিলেন। বেদির চারপাশে সে বসিয়েছে সেই সব অঙ্গবিহীন মূর্তি, আর মাঝখানে রাখে সেই তাম্রমুদ্রা — যা একসময় নাগবসুন্ধরীর ছিল। আজ, এই চক্রে, সেই পুরোনো অভিশাপ হবে পরিত্রাণের অস্ত্র।
মাঝরাতে, মাটির মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে উঠতে থাকে গন্ধ — সোঁদা মাটি, কাঁচা রক্ত, আর কিছু পুরনো ফুলের মতোন সুগন্ধ। বাতাসে বাজে ঘুঙুরের শব্দ, কারো নূপুর বেজে উঠছে অদৃশ্য পথ দিয়ে। হঠাৎ করেই অর্ণব দেখে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কামিনী — মাটির চোখে জল, কপালে ফাটল, কাঁধে শিকল। সে কিছু বলে না, শুধু অর্ণবের দিকে চেয়ে থাকে — দৃষ্টিতে অনুরোধ, আহ্বান, আর এক অমোঘ সত্যের ভার।
অর্ণব তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি এসেছি তোমার অভিশাপ ভাঙতে, কিন্তু তোমার ইতিহাস জানতে চাই।”
কামিনীর আত্মা কেঁপে ওঠে, আর তার চারপাশে শুরু হয় ছবি জাগ্রত হওয়ার দৃশ্য — একের পর এক মুহূর্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে অর্ণবের সামনে।
সে দেখে — কামিনী ছিল একজন সমাজচ্যুত নারী, যাকে গ্রামবাসীরা ডাইনি বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, কারণ সে নিঃসন্তান ছিল, আর মাটি ছুঁয়ে জীবন্ত প্রতিমা বানাতে পারত। এক রাতে, কিছু শিশু হারিয়ে যায়, আর মানুষ বিশ্বাস করে — কামিনী-ই তাদের মূর্তিতে রূপান্তর করেছে। তাকে পিটিয়ে গ্রামের এক কোণে পুঁতে দেওয়া হয় জীবন্ত অবস্থায়। কিন্তু সত্য ছিল — সে শিশুদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছিল। তার আত্মা মুক্তি পায়নি, বরং বন্দি হয়ে যায় নিজের তৈরি প্রতিমার মধ্যে।
অর্ণব চোখ বুজে বলে, “তুমি অভিশপ্ত নও, তুমি নারী — যাকে ভুল বোঝা হয়েছিল। আজ আমি তোমাকে সেই স্বীকৃতি দিচ্ছি, যে তুমি প্রাপ্য।”
সে মাটিতে বসে পড়ে, রক্ত দিয়ে আঁকে এক নবরূপী চক্র — যেখানে নারীর প্রতিটি রূপ — মা, সৃষ্টিকর্ত্রী, রক্ষাকর্ত্রী — একসঙ্গে জেগে ওঠে। সে উচ্চারণ করে, “মাটি মুক্ত হোক। স্মৃতি জাগ্রত হোক।”
এক অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ে সেই বেদি থেকে — প্রতিটি মূর্তির গায়ে কম্পন শুরু হয়। কামিনীর মুখে মৃদু হাসি ফোটে, এবং সে এগিয়ে এসে অর্ণবের কপালে ছোঁয় —
“তুমি আমাকে মানুষ করেছো।”
শেষ যজ্ঞ তখন শেষ পর্যায়ে। প্রতিমাগুলো ধীরে ধীরে গলে গিয়ে মাটিতে মিশে যায় — আর তার মধ্য থেকে জন্ম নেয় নতুন একচিলতে আলো।
কামিনী মিলিয়ে যায় বাতাসে, কিন্তু চারদিকে পাখির ডাক শুরু হয়, আর এক শিশু — যাকে সবাই পাথর ভেবে রাখত — আচমকা কেঁদে ওঠে।
গ্রামের মানুষ দৌড়ে আসে — কেউ বিশ্বাস করে, কেউ অশ্রু ফেলে।
অর্ণব তখন উঠে দাঁড়ায় — পেছনে রেখে যায় এক পূর্ণ ইতিহাস, সামনে নেয় আরেক যাত্রার পথে নিজেকে।
সমাপ্ত
				
	

	


