অনিন্দ্য দাশগুপ্ত
পর্ব ১: যে মানুষটি নিখোঁজ
পুজোর ঠিক আগের বিকেল, আকাশে হালকা সোনালি রোদ। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়ার এক ফ্ল্যাটবাড়িতে চার তলায় হঠাৎ কোলাহল—”নয়নবাবু কোথায়? ফোন ধরছেন না!” ফ্ল্যাটের দারোয়ান রবীন, পাশের ফ্ল্যাটের মৌসুমীদির সঙ্গে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছে।
নয়ন ঘোষাল, ৬৮ বছর বয়স, অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কেরানি। প্রতিদিন সকালে বারান্দায় বসে চা খেয়ে ‘আনন্দবাজার’ পড়তেন। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হতো না, নাতির পড়াশোনা তদারকি করতে হতো না, এমনকিছুই ছিল না তাঁর জীবনজুড়ে। স্ত্রী সুপর্ণা গতবছর চলে গেছেন—স্তব্ধতা ও অভ্যাসের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি যেন হঠাৎ নেই।
“ফোন বন্ধ, দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ নয়। মানে উনি নিজের হাতে বন্ধ করেননি সম্ভবত!”—মৌসুমীদির কণ্ঠে শঙ্কা।
“তাহলে ওনি বেরিয়ে গেছেন?”
“কিন্তু চাবি তো ডোরম্যাটের নিচে।”
রবীন সাবধানে ডোরম্যাট সরিয়ে চাবিটা তুলল। সত্যিই, বাড়ির চাবি মাটিতে ফেলে রেখে গেছে কেউ।
“পুলিশে জানানো দরকার, অরিন্দমবাবুকে ফোন করুন।”
অরিন্দম—নয়নবাবুর একমাত্র ছেলে, সল্টলেকে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করে। স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে রুদ্র নিয়ে থাকেন গড়িয়ার ওই ফ্ল্যাটেই।
“আমি আসছি,” বলেই ফোন কেটে দেয় অরিন্দম।
একঘণ্টার মধ্যে অরিন্দম পৌঁছে যায়। নয়নের ঘরটা খুলে দেখা যায়—সবকিছু গোছানো। বিছানার চাদর ভাঁজ করা, কাপড় ধোয়া, পেনশন বই ড্রয়ারে, পুরনো রোলেক্স ঘড়িটাও টেবিলে রাখা।
চশমাটাও নেই, স্টিকটাও নেই।
“বাবা সব রেখে কোথায় গেল?”
অরিন্দম তাকায় জানালার দিকে। বারান্দায় চায়ের কাপ শুকিয়ে উঠেছে।
“কোনো চিঠিপত্র বা লেখা কিছু রেখেছেন?”—মৌসুমীদি জিজ্ঞেস করেন।
“না তো… না… কিছুই নেই।”
রবীন বলে, “কাল বিকেল ৫টার দিকে ওনাকে বেরোতে দেখেছিলাম—সাদা পাঞ্জাবি, একটা ব্যাগ কাঁধে। ওনার মুখে অদ্ভুত এক শান্তি ছিল। এমন মুখ আমি আগে কখনও দেখিনি।”
“শান্তি?”
“হ্যাঁ, যেন কারও দায়িত্ব নেই আর ওনার কাঁধে।”
সন্ধ্যা গড়ায়। থানায় জেনারেল ডায়রি করা হয়।
নয়ন ঘোষাল—৬৮ বছর, উচ্চতা ৫ ফুট ৬, রং শ্যামলা, হালকা গোঁফ। নিখোঁজ।
ফ্ল্যাটে ফিরে অরিন্দম তাকিয়ে থাকে বাবার খালি বিছানায়। এতদিন যাঁকে শুধু “বাবা” বলে দেখা, আজ মনে হয়, তিনি হয়তো তাঁর পরিচয়ের বাইরেও কিছু ছিলেন। হয়তো নিজেকে কোথাও খুঁজতে গেছেন।
টেবিলের ড্রয়ার খুলে, হঠাৎ একটা পুরনো খাম পায় সে। খামের গায়ে লেখা—“আমার খোঁজে যেও না। শুধু জানো—আমি নেই মানেই আমি হারিয়ে যাইনি।”
অরিন্দম স্তব্ধ।
বাবা নিজেই লিখেছেন।
নিজের অনুপস্থিতিকে ঘোষণা করেছেন এক অদ্ভুত শান্ত ভঙ্গিতে।
তবে প্রশ্ন জাগে—তাহলে তিনি কোথায়? কেন?
পর্ব ২: জমা দেওয়া চাবি
ফোনটা কানে চেপে ধরে অরিন্দম ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। “হ্যাঁ দাদা, আমি বুঝি… কাল সকালে থানায় আবার যাব। না, কিডন্যাপ মনে হচ্ছে না। কিছু লেখা রেখে গেছেন উনি… হ্যাঁ, খামে… না না, পুলিশের কিছু জানাইনি ও ব্যাপারে। ঠিক আছে, কথা বলব পরে।” ফোনটা কেটে সে চুপ করে বসে পড়ে বাবার খাটের ধারে।
ড্রয়ারে রাখা খামটা আবার হাতে নেয়—বাবার লেখা সে চিনে, বাঁকানো কিন্তু স্পষ্ট, যেন আত্মবিশ্বাসের ছায়া আছে প্রতিটি অক্ষরে।
“আমার খোঁজে যেও না।
শুধু জানো—আমি নেই মানেই আমি হারিয়ে যাইনি।
নিজেকে পাওয়ার চেষ্টা করছি। যদি পারি, চিঠি দেব।
– নয়ন ঘোষাল”
অরিন্দম এই মানুষটিকে কখনও এমন কথা বলতে শুনেনি। স্কুলে ওর কোনও অ্যাসাইনমেন্টে সহায়তা, টিউশন খোঁজার তাগিদ, মা মারা যাওয়ার পরে সংসার সামলে রাখা—সবসময় দায়িত্বমুখী এক বাবাকে দেখে এসেছে সে। কিন্তু এই ‘নিজেকে পাওয়ার চেষ্টা’ কথাটা যেন তার জন্য একেবারেই অচেনা।
পরদিন সকালে থানার ইনস্পেক্টর বসু জিজ্ঞেস করেন, “কোনও ঝগড়া-বিবাদ ছিল পরিবারে?”
“না, কিছু না। উনি অবসরের পর থেকে খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন।”
“কোনও মানসিক সমস্যা, ডিপ্রেশন?”
“তেমন কিছু চোখে পড়েনি। তবে গত কয়েক মাস ধরে উনি কিছু লেখালিখি করতেন। রাতেও জেগে থাকতেন মাঝে মাঝে।”
ইনস্পেক্টর বললেন, “আজকাল এই বয়সে লোকেরা হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়, এটা নতুন নয়। কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে। কেউ কেউ… নিজেকে খুঁজে পেতে বেরিয়ে পড়ে। আমরা নজরে রাখছি।”
ফেরার পথে অরিন্দম হঠাৎ বাবার পুরনো বন্ধু অপূর্বকাকুকে ফোন করে।
“কাকু, বাবা কিছু বলেছিলেন আপনাকে কিছুদিন আগে?”
“হ্যাঁ রে অরিন্দম… একদিন সন্ধ্যায় বলেছিল, ‘জীবনটা কেবলই অন্যের হিসেব মেটাতে মেটাতে কেটে গেল।’ আমি তখন খুব পাত্তা দিইনি। ভেবেছিলাম বুড়ো বয়সের হতাশা। কিন্তু এখন… ভাবছি, উনি যেন ঠিকই ছিলেন।”
অরিন্দম বাড়ি ফিরে বাবার টেবিলে বসল। একটা পুরনো খাতার পাতায় চোখ পড়ে—সেখানে লেখা:
“একটা চাবি ফেলে দিয়ে এসেছি আমি,
যা দিয়ে সবাই আমায় খোলার চেষ্টা করত।
এবার দরজা নেই, তালাও নেই।
শুধু আমি আছি—একটা বন্ধ জানালার সামনে।”
কবিতা? নয়ন ঘোষাল কবিতা লিখতেন?
অরিন্দম যেন ধীরে ধীরে একটা অচেনা মানুষকে চিনতে শুরু করছে—যিনি ছিলেন তার খুব কাছেই, অথচ কেবলই ‘বাবা’ নামক অভিধায় আটকে ছিলেন। এক সময়ে যাঁর নিজের নাম, স্বপ্ন, আলাদা গন্ধ ছিল, তিনিও ক্রমশ শুধু পরিচয়পত্র হয়ে উঠেছিলেন।
বিকেলে অরিন্দম ডায়রির ভাঁজে একটা পুরনো রশিদ পায়—“হস্টেল ৩৪, ভবানীপুর।”
কোন হস্টেল? কে থাকে সেখানে?
পাশে লেখা আছে ছোট করে—“অগস্ট থেকে অগ্রহায়ণ অবধি”
অরিন্দমের বুকের ভিতর ঠকঠক করে ওঠে।
বাবা কি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন কোথায় যাবেন? তবে এ নিখোঁজ হওয়া নয়—এ যেন পালানোও নয়।
এ যেন… পরিকল্পিত অব্যাহতি।
রাত বাড়ে। অরিন্দম ঘরে ঢোকে, টেবিলের আলোটা জ্বালায় না। অন্ধকারেই বসে থাকে চুপচাপ।
তার বাবার অনুপস্থিতি যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ঘুরে ঘুরে আসে।
বাবা নেই, কিন্তু প্রথমবার মনে হয়—নয়ন ঘোষাল সত্যিই কোথাও আছেন।
পর্ব ৩: আমার নাম নয়ন ঘোষাল
পেছনে ফেলে আসা শহরটা যেন দিনদিন হালকা হয়ে আসছে তাঁর মনে। আজ পনেরো দিন হয়ে গেল নয়ন ঘোষাল ‘নিখোঁজ।’
আর আজ পনেরো দিন ধরে তিনি একজন নতুন মানুষ। একজন যিনি আর কারো বাবা, দাদা, কাকু, কিংবা মেন্টর নন।
তিনি শুধু ‘নয়ন’—হস্টেল ৩৪-এর ছোট্ট ঘরের এক নম্বর খাটের মানুষ।
হস্টেল ৩৪—ভবানীপুরের এক পুরনো বাড়ি। একসময় কলেজ হোস্টেল ছিল, এখন তা বয়স্ক পুরুষদের রিটায়ারমেন্ট রুম। যাঁরা কেউ একা, কেউ পরিবার থেকে স্বেচ্ছায় দূরে, কেউ কেউ পরিবার থেকেই সরিয়ে দেওয়া।
বাড়িটার ছাদে সবুজ শ্যাওলার গন্ধ, কাঠের সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে কড়কড় শব্দ। কিন্তু ভিতরে একটা প্রশান্তি আছে।
নয়ন এখন সকালে নিজে চা বানান। জানালার পাশে বসে সূর্য ওঠা দেখেন। হাতে থাকে একটা খাতা—সাদা পৃষ্ঠা, বিনা হিসেবের দিন।
আজ সকালে প্রথমবার কেউ তাঁকে প্রশ্ন করল না, “আজ বাজারে গেলে একটু মুড়ি নিয়ে এসো না?”
না বলল না, “রুদ্রর প্রজেক্টটা দেখে দেবে একটু?”
তিনি নিজে থেকে নিজের কাজের তালিকা ঠিক করেছেন। আর প্রথমবার মনে হলো—এই না কি স্বাধীনতা?
হস্টেল ম্যানেজার হরেকৃষ্ণবাবু, যিনি নিজেও একসময় বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন, এক সন্ধ্যায় বললেন,
“নয়নদা, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি—সেটা মুখ দেখেই বোঝা যায়।”
নয়ন হেসে বলেছিলেন, “এখন লিখছি, কিন্তু কাউকে দেখাই না।”
“তাহলে তো আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন! আমরা এখানে একে অপরের পাঠক। আপনাকে পড়তেই হবে!”
এই প্রথম নয়ন নতুন বন্ধুদের সামনে নিজের কবিতা পড়ে শোনাল—“নামহীন কেউ”।
কবিতার শেষে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর করতালি।
“এটা আপনি?”
“আমি, যখন আমি নিজেকে চিনেছিলাম। কিন্তু তারপর এই সমাজ… আমায় ছেঁটে ফেলেছিল।”
রাত নেমে এলে নয়ন একা একা হাঁটেন ছাদে। ভাবেন, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ কি জানেন?
নিজের পরিচয়টাকে নিজের মত করে সাজানো।
সারাজীবন তিনি “সুপর্ণার বর,” “অরিন্দমের বাবা,” “রেলওয়ের কেরানি” হয়েই কেটে দিয়েছেন।
কিন্তু “নয়ন ঘোষাল”—এই নামটার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি কখনও।
এখন সে নামটা তিনি দিনে দিনে নতুন করে আবিষ্কার করছেন।
নিজের কথাগুলো আবার নিজের কণ্ঠে শোনার চেষ্টা করছেন।
এ যেন আত্মার কাগজে নিজের নাম লেখা, প্রথমবারের মতো।
পরদিন সকালে হরেকৃষ্ণবাবু একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে এলেন,
“আমরা একটা ছোট সাহিত্যপত্রিকা বের করব হস্টেলের ভিতর থেকে। আপনি থাকবেন সম্পাদক!”
নয়ন হেসে বললেন, “আমি তো কারো দায়িত্ব আর নিতে চাই না।”
হরেকৃষ্ণ হেসে বললেন, “এই দায়িত্ব নিলে কেউ আপনাকে ধন্যবাদ দেবে না।
বরং আপনি নিজেকেই খুঁজে পাবেন—আর এটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার।”
নয়ন আবার জানালার দিকে তাকান।
এই শহরটা তাঁর কাছে এখন নতুন।
এই জানালাটা—আরেকটা জীবন।
পর্ব ৪: বাবার ডায়েরি
রাত সাড়ে দশটা। রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া ওঠা থামলেও, অরিন্দমের মাথার ভেতরটা এখনও ঝাঁঝালো।
চুপচাপ বসে আছে বাবার ঘরে, বুকশেলফের সামনে। নিচের তাকে একগুচ্ছ পুরনো ডায়েরি—ধুলো জমে আছে, পাতাগুলোর গায়ে বয়সের গন্ধ।
পড়ার সময় হয়নি কখনও।
প্রয়োজন হয়নি।
ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—
“যদি কোনোদিন নিজেকে ভুলে ফেলি,
এই পাতাগুলো আমায় মনে করিয়ে দেবে—
আমি কে ছিলাম, কে হতে চেয়েছিলাম।”
— নয়ন ঘোষাল
অরিন্দম স্তব্ধ।
একটা স্বর যেন উঠে আসে শব্দের ফাঁকে—বাবার নয়, এক মানুষের কণ্ঠ, যিনি এতদিনে নিজের পরিচয়ের মাটি খুঁড়তে চেয়েছিলেন।
ডায়েরির ভেতর লেখা তারিখ ধরে—২০১৪, ২০১6, ২০১৮।
প্রতিটি বছরের কিছু পৃষ্ঠা বাবার ভেতরকার এক গোপন নিজস্ব জগৎ খুলে দেয়।
এক পাতায় লেখা—
“আজ রুদ্র স্কুলে প্রথম অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়াল।
আমি দেখলাম, কিন্তু কেউ আমাকে ডাকল না।
আমি ছিলাম ছায়ার মতো—উপস্থিত, কিন্তু অদৃশ্য।”
আরেক পাতায়—
“সুপর্ণা মারা যাওয়ার পর, চারদিক থেকে শুধু দায়িত্বের আওয়াজ।
‘চুপ করে থাকো, তুমি বড়। ছেলে সামলাও, সংসার টিকিয়ে রাখো।’
আমি কি কাঁদতে পারতাম না একবার?
আমি কি শুধু ছায়ামূর্তি?”
অরিন্দমের বুক কেঁপে ওঠে।
এই সব লেখা তো কখনো সে ভাবেনি।
তারা ভাবেনি, বাবারও থাকতে পারে নিজস্ব ক্লান্তি, নিজের একান্ত নিঃশ্বাসের স্থান।
ডায়েরির ভেতর এক পাতায় শুধু নাম—
“হস্টেল ৩৪”
তার নিচে ছেঁড়া পাতায় লেখা—
“ওখানে কেউ বাবু নয়। সবাই নিজের নামে পরিচিত।”
অরিন্দম হঠাৎ বুঝতে পারে, নয়ন ঘোষাল নিখোঁজ হয়নি তিনি মুক্ত হয়েছেন।
সেই লোকটার নাম ‘বাবা’ ছিল,
কিন্তু যিনি ডায়েরি লিখেছেন, যিনি হস্টেল ৩৪-এ গিয়ে উঠেছেন—
তিনি নিজেকে ‘নয়ন ঘোষাল’ বলে বাঁচাতে চেয়েছেন।পরদিন সকাল।
অরিন্দম অফিসে মেইল করে এক সপ্তাহের ছুটি নেয়।
তারপর এক কাপ কফি নিয়ে বাবার শেষ পাওয়া খামটা আবার পড়ে—
“আমার খোঁজে যেও না…”
কিন্তু আজ সে জানে, খোঁজ মানেই জোর করে টেনে আনা নয়।
খোঁজ মানে বোঝা, যে মানুষটা আমাদের চেনা ছিল, তিনি আসলে কতটা অচেনা হতে পারেন।
সকালের কুয়াশায় গাড়ি ছাড়ে ভবানীপুরের দিকে।
সে এখন বাবাকে খুঁজতে যাচ্ছে না।
সে সেই মানুষটিকে দেখতে যাচ্ছে, যাঁকে সে এতদিন চেনেইনি।
পর্ব ৫: হস্টেল ৩৪
ভবানীপুরের গলিগুলো এখনও ঘুমিয়ে থাকে সকালবেলা। পুজোর আগে, কিন্তু শহর জাগে না এত সহজে।
অরিন্দম গাড়ি থামায় একটা পুরনো লোহার গেটের সামনে গেটের ওপরে আধমুছে যাওয়া নেমপ্লেট: Hostel ৩৪ – A Community for Independent Seniors.
এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করে ভিতরের দিকে।
বাড়িটা যেন পুরনো রেলওয়ে কোয়ার্টারের মতো—ভাঙা পলেস্তারা, হলদেটে রঙের দেয়াল, লাল রঙের কুঁচকে যাওয়া জানালা।
দরজায় কড়া নাড়তেই এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন—চোখে পুরু চশমা, হাতে কফির কাপ।
“আপনি?”
“আমি… আমি নয়ন ঘোষালের ছেলে। উনি কি এখানে আছেন?”
বৃদ্ধটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর একটু হেসে বললেন—
“নয়নদা তো এখন ছাদে। আজকে উনি নতুন একটা কবিতা লিখেছেন। শুনাবেন বলে বলছিলেন সবাইকে।”
“উনি জানেন না আমি আসছি।”
“জানলেও আপনি এসেছেন। এটাই আসল।”
ছাদের পাড় ঘেঁষে নয়ন দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা ধুতি আর একটা সস্তা সোয়েটার গায়ে। হাতে খাতা।
চোখে চশমা, ঠোঁটে হালকা হাসি।
অরিন্দম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তার বাবাকে সে বহুবার দেখেছে—কিন্তু এমনভাবে নয়।
এই মানুষটা শান্ত, নির্ভার, নিঃসঙ্গ কিন্তু নির্মল।
“তুমি চলে এসেছো?”
নয়ন তাকালেন, অবাক হলেন না। শুধু মৃদু কণ্ঠে বললেন।
“হ্যাঁ।”
“ডায়েরি পেয়েছিলে?”
“পেয়েছিলাম।”
“তাহলে তো জানো, আমি হারিয়ে যাইনি।”
দু’জনে ছাদের কোণায় এসে বসল। পাশে একটা লোহার চেয়ার আর ছোট টেবিল।
“তুমি আমায় নিতে এসেছো?”
“না… আমি বুঝতে এসেছি।
তুমি কেন এইভাবে চলে গেলে, কেন কিছু না বলেই… সবকিছু ফেলে দিলে?”
নয়ন ধীরে উত্তর দেন,
“সবকিছু ফেলা যায় না রে অরিন্দম। অনেক কিছু মনেই থেকে যায়।
কিন্তু আমি একটা বয়সে এসে বুঝলাম—আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না আমি কে।
আমি নিজেই আমার সঙ্গে পরিচিত হতে পারিনি।”
“তুমি কি আমাদের জন্য অসুখী ছিলে?”
“না, শুধু… অপরিচিত হয়ে গেছিলাম নিজের কাছে।
তোমরা সবাই দায়িত্বের মুখ খুঁজছিলে। আর আমি একটা মুখ খুঁজছিলাম আয়নার সামনে, যেটা আমি নিজে চিনি।”
নয়ন তার খাতা খুলে পড়ে শোনান সেই কবিতা—
“আমি আর কেউ নই
আমি আমি
একটা নামহীন জায়গা
যেখানে কেউ ডাক দেয় না বাবু বলে।”
অরিন্দম চুপ করে শোনে।
তার মনে হয়, যেন বাবার চোখে নতুন আলো।
একটা গোপন জানালা খুলে গেছে—যেটা এতদিন বন্ধ ছিল। ফেরার আগে নয়ন বললেন,
“চাইলে মাঝে মাঝে দেখা করতে পারো।
কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেও না।
এই প্রথমবার নিজেকে আপন করে পেয়েছি।”
অরিন্দম মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।
সে বাবাকে এবার মানুষ হিসেবে দেখতে শিখেছে—শুধু সম্পর্ক নয়, একজন পরিপূর্ণ সত্তা।
পর্ব ৬: বিপিনবাবুর গল্প
“তুমি জানো নয়নদা, একেক সময় মনে হয় আমরা যেন লাইব্রেরির পুরনো বই… কেউ খোঁজে না, কেউ খোলে না। শুধু ধুলোর স্তরে জমে থাকি।”
বিপিনবাবুর কণ্ঠ ছিল নরম, কিন্তু চোখদুটো তীক্ষ্ণ।
নয়ন তখন উঠোনে বসে ছাতা মেরামত করছিলেন।
পেছনের বারান্দায় ছোট একটা মঞ্চে হোস্টেলের ‘স্বাধীন সন্ধ্যা’র আয়োজন চলছে—যেখানে প্রত্যেকে নিজের লেখা, গান, স্মৃতি ভাগ করে নেয়।
“তোমার জীবনে কি কেউ কখনো তোমাকে এমন করে ফেলে রেখে দিয়েছিল?”—নয়ন জিজ্ঞেস করেন।
“তোমার মতো করে না। কিন্তু ফেলা তো ফেলাই। নাম করে হোক বা নিঃশব্দে।”
বিপিন সেন—৭৪ বছরের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল। স্ত্রী মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগে। দুই ছেলে আমেরিকায়। শেষ বয়সে যাঁর হাতে ছিল বিশ্বকোষ, এখন হাতে আছে থার্মাস আর এক কৌটো অ্যালমন্ড বিস্কুট।
“আমি একদিন ঠিক করেছিলাম, ছেলেরা যখন বলে ‘বাবা, তুমি আমাদের সঙ্গে এসো’—তখন বলব, ‘না, এবার আমি আমার সঙ্গে থাকব।’”
নয়ন বললেন, “ভয় লাগেনি?”
“ভয়? ভয় তো আরও বেশি লেগেছিল ওই বিশাল বাংলোয় একা বসে থাকতে।
যেখানে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না, শুধু প্রয়োজন হলেই ডাক পড়ে।
আমার নাম ছিল না, ছিল ‘বাবা’, ‘ক্লাসের প্রিন্সিপাল’, ‘হিসেব রাখো’…”
বিপিন থামলেন, তারপর হঠাৎ উঠে গিয়ে টান দিয়ে একটা পুরনো খাতা বের করলেন।
“এই দেখো, এটা আমার লেখা আত্মজীবনী—‘নামের বাইরেও আমি’। কেউ পড়বে না জানি, কিন্তু লিখে ফেলার পর মনে হয়—আমি নিজেকে আবার চিনলাম।”
সন্ধ্যায় যখন সবাই উঠোনে জড়ো হল, বিপিনবাবু নিজের লেখা পড়তে উঠলেন।
একটা ছোট টুকরো, নাম—”ছায়ার জন্মদিন”
“বছরটা কবে যেন ভুলে গেছি।
ছেলেরা আমায় উইশ করে WhatsApp-এ।
আমি নিজের জন্মদিন পালন করি এক কাপ চা দিয়ে, এক কুড়ো বিস্কুট আর এই উঠোনে সূর্যের আলো দিয়ে।”
শ্রোতারা নিশ্চুপ। নয়ন জানেন, শব্দগুলো কেবল লেখা নয়—এটা একেকটা জীবন, একেকটা না-বলা কান্না, একেকটা স্বীকারোক্তি।
সেদিনের রাতটা নয়নের কাছে একটা সীমানা টেনে দিল—
তাঁর নিজের ভেতরেও এমন বহু গল্প জমে আছে, যেগুলো হয়তো কেউ শোনেনি, এমনকি তিনি নিজেও না।
বিপিনবাবু ফিরে যাওয়ার আগে একবার শুধু বললেন,
“নয়নদা, এই হোস্টেল আমাদের শেষ আশ্রয় নয়, এটা আমাদের নিজেকে নতুন করে পাওয়ার ক্লাসরুম।
জীবনের শেষ অধ্যায়ে আমরা প্রথমবার নিজেরা নাম রাখছি—এমন নাম, যেটা বাকি পৃথিবী কখনো জানেনি।”
নয়ন আর কিছু বলেননি। শুধু মনে মনে প্রতিশ্রুতি দেন—
এই সন্ধ্যার আলোর নিচে তিনি আর কখনও নিজেকে অন্ধকারে রাখবেন না।
পর্ব ৭: নয়নকে খোঁজে অরিন্দম
অফিসে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল আজ।
কিন্তু অরিন্দম আর যেতে পারল না।
কম্পিউটারের স্ক্রিনে অ্যাক্সেল শিট খুলে থাকলেও চোখ ছিল জানালার বাইরে—
যেখানে বাবার সেই চুপ করে বসে থাকা মুখখানা বারবার ফিরে আসছিল।
নয়ন ঘোষাল—যিনি একসময় সকালবেলা রেলওয়ের টাইমশিট নিয়ে হিসেব কষতেন, এখন ছাদের মাথায় দাঁড়িয়ে কবিতা লেখেন।
কিন্তু প্রশ্নটা এখনও অরিন্দমকে ছাড়ে না—
সে কি এতদিন বাবাকে শুধু ‘একজন দায়িত্বের মানুষ’ হিসেবেই দেখেছে?
একজন “তুমি এটা করো”, “ওটা কেন করলে না”, “ছেলেকে স্কুলে নিতে হবে”—এইসব শব্দে বেঁধে রাখা মানুষ?
বাড়ি ফিরে সে বাবার ঘরে ঢোকে। এবার আর চোখে জল নয়, বরং চোখে অনুসন্ধান।
আলমারির একটা খোপে ছোট একটা প্যাকেট দেখতে পায়—তাতে লেখা “আলাদা আমি”।
খুলে দেখে ছোট ছোট চিরকুট—
“গান গাইতে ইচ্ছে করত, ভয় পেতাম।
সবাই বলত কণ্ঠ ভালো না।
আমি কাউকে বলিনি, আমি শুধু গাইতাম চুপ করে।”
“অফিস থেকে ফেরার পথে এক বৌদি বেগুনভাজা বিক্রি করতেন।
তাঁর হাসিটা দেখলেই মনে হতো, জীবন এত কঠিন নয়।”
“রুদ্রকে কোলে নেওয়ার পর আমি কেঁদেছিলাম।
কিন্তু সবাই বলেছিল, ‘ছেলেকে শক্ত হাতে ধরো’।
আমি নিজের কান্না আটকে রেখেছিলাম তখন থেকে।”
অরিন্দম দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে।
তার বাবার ভিতরে যে এতোদিন ধরে অচেনা এক নদী বইছিল, সে তো জানত না।
সে শুধু একটা কাঠামো দেখেছিল—একজন ‘বাবা’, যিনি বাড়ি চালান, রাগ করেন, টিভির রিমোট কুড়োতে গিয়ে নালিশ করেন।
কিন্তু সেই কাঠামোর ভিতরে যে একজন ‘রাগী কবি’, ‘অপ্রকাশিত গায়ক’, ‘কান্না চেপে রাখা মানুষ’ ছিলেন, তাকে তো কেউ খোঁজেনি।
পরদিন অরিন্দম হস্টেল ৩৪-তে আবার যায়—এইবার কোনো অভিমান, অনুরোধ কিংবা যুক্তি নিয়ে নয়।
শুধু একটা ছোট ব্যাগে করে কিছু জিনিস নিয়ে—বাবার পুরনো বাঁশির বাক্স, একটা রেকর্ড প্লেয়ার আর এক বোতল নারকেল তেল।
“এইগুলো তোমার,”
নয়ন অবাক হয়ে তাকান।
“আমি ভেবেছিলাম ফেলে দিয়েছো।”
“তুমি তো ফেলে দেওয়ার জন্য কিছুই রাখো না।
সবই জমান, শুধু আমরা বুঝিনি।”
নয়ন মৃদু হাসেন।
“তোমার রুদ্র জানে, তুমি কোথায়?”
“জানে না। এখনো সময় হয়নি বোঝানোর।
তবে একদিন ওর বয়স হবে আমার মতো, তখন ও নিজেই খুঁজে নেবে।”
সন্ধেবেলায় দু’জনে ছাদের কোণে বসে থাকেন।
নয়ন বলেন,
“এই বয়সে এসে যদি কেউ নিজের নাম না পায়—তাহলে গোটা জীবনটাই ধার করা হয়ে যায়।
আমি সেই ধার শোধ করছি এখন।”
অরিন্দম বলেন না কিছু।
তবে তাঁর চোখে একটা দৃঢ়তা ফুটে ওঠে—
সে হয়তো এবার রুদ্রকে শেখাবে,
‘তোমার ঠাকুরদা হারিয়ে যাননি, তিনি নিজের ভিতর ফিরে গিয়েছিলেন।’
পর্ব ৮: মায়ের কান্না ও মেয়ে
হস্টেল ৩৪-র পুরনো ঘড়িটা রাতে একটায় টং করে বেজে ওঠে।
নয়ন তখন খাটে শুয়ে, চোখ বন্ধ, কিন্তু ঘুম নেই।
আলো নিভে গেছে, জানালায় নেমেছে কলকাতার শেষ বাসের হেডলাইট,
আর নয়নের বুকের মধ্যে বাজছে আরেকটা আওয়াজ—
সুপর্ণার।
স্মৃতির ভেতর থেকে ফিরে আসে এক গলা—
“তুমি সবসময় পালাতে চাও, নয়ন। আমি জানি।”
“আমি পালাতে চাই না, আমি খুঁজে পেতে চাই… নিজেকে।”
“তুমি নিজেকে খুঁজতে গিয়ে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছিলে তখনও। আজও দিচ্ছো।”
নয়ন চোখ খুলে বসে পড়ে।
ড্রয়ার থেকে সুপর্ণার একটা পুরনো শাড়ির আঁচল বের করে।
এটা সে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল—কারণ এটাই ছিল তাঁদের শেষ ঝগড়ার দিন পরা শাড়ি।
সেই ঝগড়ার দিনটা এখনও মনে পড়ে নয়নের—
সুপর্ণা বলেছিলেন,
“তুমি শুধু বাবা হতে পারো, স্বামী হতে পারো না।
আমি যখন কেঁদেছি, তুমি কাগজ পড়েছো।
আমি যখন ভালোবাসা খুঁজেছি, তুমি ক্লান্তি দেখিয়েছো।”
নয়ন তার উত্তরে শুধু বলেছিল,
“তুমি যদি জানতে, আমি কেমন করে নিজেকে প্রতিদিন খুঁজে বেড়াই…
তুমি জানলে না, আমি প্রতিদিন আড়ালে কাঁদি।”
সুপর্ণা জানতেন না।
আর জানার সুযোগও পাননি।
সকালে নয়ন হাঁটতে বেরোয় হোস্টেলের ছাদে।
পাশে বসে থাকেন ইন্দ্রানীদি—একজন অবসরপ্রাপ্ত গায়িকা, যিনি আজকাল আর গান করেন না।
“তোমার চোখে আজ কিছু ভারি ভাব,” বলেন তিনি।
“স্মৃতি আজ হঠাৎ কাঁদিয়েছে,” উত্তর দেন নয়ন।
“স্মৃতি কখনও ক্ষমা চায় না।
আমরাই ভাবি, হয়তো ক্ষমা করে দেবে।
কিন্তু স্মৃতি শুধু বসে থাকে—দেখে, শোনে, ছুঁয়ে থাকে।
তুমি যদি ভেবে থাকো সুপর্ণা নেই, তাহলে ভুল।
তিনি আছেন তোমার প্রতিটি নির্জনতায়।”
নয়ন মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মত হয়।
“আমি জানি… আমি শুধু চাই, তিনি যেন জানেন—আমি ওঁকে ভুলিনি।
আমি নিজেকে খুঁজতে গিয়ে ওঁকে ত্যাগ করিনি,
আমি ওঁর মধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
এখন শুধু আলাদা করে চিনতে চাই—আমার ছায়া, আমার আলো।”
সন্ধেবেলায় নয়ন সুপর্ণার শাড়ির আঁচল একটা ছোট কাঠের বাক্সে রাখেন।
সঙ্গে একটা চিরকুট রাখেন:
“তুমি আমার মধ্যে থেকো,
যখন আমি নিজেকে ফিরে পাই।”
সে জানে—স্বাধীনতা মানে ভোলা নয়,
স্বাধীনতা মানে স্মৃতির সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে তোলা।
সুপর্ণার অভাব সে মুছে দিতে চায় না,
সে চায়, তাঁর অস্তিত্বকে নিজের নতুন জীবনের এক অনুপম সঙ্গী করে তুলতে।
পর্ব ৯: সংলাপের সন্ধ্যা
হস্টেল ৩৪-এর উঠোনে আজ সাজ সাজ রব।
কাঠের পুরনো চেয়ারগুলো পরিষ্কার করে গোল হয়ে সাজানো হয়েছে, মাঝে রাখা ছোট্ট মঞ্চ—একটা টেবিল, একটা চেয়ার, আর একটা মাইক।
আজ সংলাপের সন্ধ্যা—বছরের এক দিন, যখন প্রত্যেকে নিজের লেখা বা জীবন থেকে বেছে নেওয়া একটি সত্য উচ্চারণ করেন সকলের সামনে।
বিপিনবাবু ইতিমধ্যে একটা কবিতা পড়েছেন—নির্জনতায় থাকা কাঁপা কাঁপা শব্দ নিয়ে।
ইন্দ্রানীদি গেয়েছেন পুরনো ঠুমরি, যার প্রতিটি উচ্চারণে লুকিয়ে ছিল এককালের রেকর্ডিং স্টুডিওর প্রজ্জ্বলন আর এক নারীর নিঃশব্দ কান্না।
শেষে উঠে দাঁড়ান নয়ন ঘোষাল।
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, চোখে চশমা, হাতে নিজের খাতা।
চারপাশে যেন সময় থেমে যায়।
তিনি বলেন—
“আমার নাম নয়ন ঘোষাল।
একটা নাম, যা আমার বাবা রেখেছিলেন,
একটা নাম, যা আমার স্ত্রী উচ্চারণ করতেন,
একটা নাম, যা আমার ছেলে আজ নতুন করে খুঁজে পেয়েছে।
আজ আমি সেই নামটা উচ্চারণ করতে এসেছি, নিজের মুখে, নিজের মতো করে।”
তাঁর কণ্ঠ যেন শুরুতে কাঁপছিল।
কিন্তু খাতার পাতায় চোখ রাখতেই শব্দেরা যেন শক্তি পেল।
তিনি পড়তে শুরু করেন—
“নামহীন কেউ
আমি ক’জনের বাবা ছিলাম, ক’জনের বর
ক’জনের বস, আর ক’জনের ঠিকানার এক টুকরো সই।
কিন্তু আমি? আমি কে ছিলাম?
একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম—
আমার চোখে আমি নেই।
তখন আমি হাঁটতে শুরু করলাম—
না কোথাও যাওয়ার জন্য,
বরং নিজেকে খুঁজে পেতে
আজ আমি পেয়ে গেছি এক নামহীন চৌকাঠ
যেখানে কেউ আমায় চায় না,
কিন্তু আমিই নিজেকে চেয়ে বসেছি।”
শব্দ থেমে যায়।
কেউ হাততালি দেয় না সঙ্গে সঙ্গে—কারণ সবাই যেন ওই কবিতায় নিজেকেই খুঁজে পায় এক মুহূর্তের জন্য।
তারপর, ধীরে ধীরে করতালির শব্দ উঠে আসে।
কেউ দাঁড়িয়ে যায়, কেউ চোখ মুছে।
সন্ধ্যার পর নয়ন ছাদে বসে থাকেন চুপচাপ।
বিপিনবাবু এসে পাশে বসেন।
“আজ তোমার নাম অনেকেই মুখে মুখে বলছে।
আজ তুমি নেই নও, আজ তুমি ঠিক আছো।”
নয়ন হাসেন, মৃদু এক শান্ত হাসি।
তিনি জানেন, নিজেকে চিনে নেওয়ার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি।
কিন্তু আজ প্রথমবার, তিনি নিজেকে বলতে পেরেছেন—
আর সেটাই শুরু।
পর্ব ১০: নতুন ঠিকানা
শহরের শীতের সকাল।
হস্টেল ৩৪-এর ছাদে আজ নতুন রোদ উঠেছে।
নয়ন ঘোষাল জানালার পাশে বসে চায়ের কাপ হাতে চুপ করে দেখছেন—একদল পায়রা উড়ছে হঠাৎ, যেন আকাশে কারও অদৃশ্য নির্দেশে তারা ছড়িয়ে পড়েছে।
আজ তিনি ঠিক করেছেন, হোস্টেলের অভ্যন্তরীণ বার্তাপত্রে তাঁর নিজের একটা নোট লিখবেন।
শিরোনাম হবে—“একটি অদৃশ্য ঠিকানা থেকে”
তিনি খাতা খুলে লেখেন—
“এই জায়গাটিকে আমি ঠিকানার মতো দেখি না।
এটা আমার ভিতরের একটা খালি ঘর—যেখানে আমি আস্তে আস্তে নিজেকে সাজিয়েছি।
এখানে আমার কোনো পদ নেই, দায়িত্ব নেই, সম্পর্কের শর্ত নেই।
আমি এখানে শুধু একজন মানুষ হয়ে থাকতে শিখছি।
নাম, বয়স, পরিবারের অবস্থান—এসব পেরিয়ে আমি নিজের সঙ্গে এক নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলছি।
কেউ যদি কখনও খোঁজে, বলো—
নয়ন ঘোষাল নেই।
তিনি নিজেকে খুঁজতে গিয়েছেন।
আর সেই যাত্রায়, তিনি আর কারো ‘চেনা’ মানুষ নন—
তিনি তাঁর নিজের ‘অচেনা’ মানুষ হয়ে উঠেছেন।”
অরিন্দম আজ আবার এসেছিল, রুদ্রকে নিয়ে।
রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল,
“ঠাকুমা কোথায়?”
নয়ন বলেছিল,
“তোমার ঠাকুমা আকাশ হয়ে আছেন। সব দেখে যাচ্ছেন।”
রুদ্র হেসেছিল,
“তাহলে তুমি আকাশে কথা বলো?”
“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কানে কানে।”
অরিন্দম তাকে জড়িয়ে ধরেছিল হালকা করে।
আজ সে ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু এই প্রথম সে বুঝতে পেরেছে—
ছেলে হিসেবে দায়িত্ব মানেই একজোড়া চাবি হাতে তুলে দেওয়া নয়।
দায়িত্ব মানে—একজন মানুষকে মানুষ হিসেবেই বুঝতে শেখা।
সন্ধ্যাবেলায় হস্টেলের উঠোনে সবাই আবার মিলে বসে।
এইবার নয়ন বললেন,
“আমাদের একজন বৃদ্ধ সদ্য ভর্তি হয়েছেন।
যিনি আজ সকালেই নিজের স্ত্রীকে শেষকৃত্য করে এখানে এসেছেন।
চলুন, আমরা সবাই তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই—
কেননা, আমরা কেউই আর ছায়া নই।
আমরা আছি—নামহীন অথচ উজ্জ্বল।”
বিপিনবাবু বললেন,
“তোমার কথাগুলো যেন আজকাল পাথর ছুঁয়ে জল বের করে।”
নয়ন মাথা নিচু করে হেসে ফেলেন।
“আসলে আমরা তো এতদিন শুধু পাথর সঞ্চয় করেছি।
এবার সময় এসেছে তাতে জল নামানোর।”
রাতে ঘুমোনোর আগে নয়ন তার চিঠির খাতা বন্ধ করেন। বাইরে বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ, যেন কোনও পুরনো ঋতু ফিরে এসেছে নিঃশব্দে।
বিছানার পাশে রাখা ছোট কাঠের বাক্সটা খুলে দেখেন—
সুপর্ণার শাড়ির একটুকরো আঁচল, রুদ্রর ছোট্ট আঁকা একটা ছবি, আর অরিন্দমের সেই পুরনো চিঠি—যেখানে সে প্রথমবার বাবাকে মানুষ হিসেবে চিনেছে।
তিনি একটা নতুন চিরকুট লেখেন, গুছিয়ে বাক্সে রাখেন।
তাতে লেখা—
“আজ আমি কাউকে না বলে, নিজের ঠিকানা পাল্টে ফেললাম না।
আজ আমি রয়ে গেলাম, থেকেও নিজের মতো হলাম।
নয়ন ঘোষাল এখন নেই—
কারণ তিনি আর নিখোঁজ নন।
তিনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন।”
চোখ বুজে নয়ন ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েন।
হয়তো স্বপ্নে দেখেন, একটা ছোট্ট ছেলেকে, যিনি নিজের পরিচয়ের খোঁজে হাঁটছেন মেঘের ভিতর দিয়ে—
কেউ তাকে ডাকছে না বাবা বলে, কেউ চাবি দিচ্ছে না দায়িত্বের,
শুধু একটা নাম বাতাসে ভাসছে—
নয়ন। শুধু নয়ন।