শুভেন্দু মুখোপাধ্যায়
১
সকাল সাতটার ঠিক আগেই, গলির মাথার সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে যেন জীবনের রিহার্সাল শুরু হয়। শিবুর দোকান—আসলে এক বাঁশের ফ্রেমে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে বানানো, একটা মোড়া আর তিনটে বেঞ্চ, পাশে একটা রেডিও ঝুলছে সুতোর টানে—এইখানেই বসে ভবানী কাকু তাঁর রাজত্ব চালান। পাঞ্জাবি-ধুতি পরা, সাদা চুলে হালকা তেল, আর সেই চিরচেনা গোল চশমার আড়ালে মুখভর্তি আত্মবিশ্বাস। হাতে এক কাপ লাল চা নিয়ে বসে থাকেন সবার অপেক্ষায়, যেন এই পাড়ার সকল কথোপকথনের তিনি কর্ণধার। চা-র তাপ, পত্রিকার খবর আর ফুটবল-রাজনীতি-সিনেমা নিয়ে তাঁর ধ্রুপদী বিশ্লেষণ—সব মিলে এক নিখুঁত সকাল তৈরি হয়। “শিবু, চিনি কম নিস! কালও চাপে পড়ে রেণুদি বলল, ‘ভাবনীদা, আপনার মিষ্টি কথায় ওজন বাড়ছে’, হাহা!” — এই রকম হাস্যরস ঝরিয়ে ঘুমজড়ানো পাড়ার ঘরদোর জেগে ওঠে। আশপাশের লোকেরা জানে, ভবানী কাকুর সকাল না হলে যেন পাড়ার দিনটাই ঠিকভাবে শুরু হয় না। শিবু, যে দশ বছর ধরে দোকান চালায়, একরকম গর্ব করেই বলে, “কাকু আসেন বলে দোকানে আলো আসে।” এমনও দিন গেছে, যখন ভোরের বৃষ্টি ঝরছে টিনের ছাউনি ভেদ করে, তবু ছাতা হাতে কাকু পৌঁছে গেছেন, যেন এক দায়বদ্ধ নাগরিক।
ভবানী কাকুর গল্প বলার ধরণটাই আলাদা। কোনো ঘটনা যদি খোকনের জীবনে ঘটে, সেটা ঘুরে দাঁড়ায় ‘পড়শীর সঙ্গে সম্পর্কের ইতিহাসে যুগান্তকারী মুহূর্ত’-এ; আর কোনো সাধারণ বৃষ্টির দিনে কাকুর বক্তব্য—“এই রকম ভিজেছিলুম একচল্লিশে, তখন আমি প্রথম পোস্টম্যানের চাকরিতে উঠেছি…”—এই বলে গল্পের ফাঁকে ঢুকে পড়ে ইতিহাস। চায়ের কাপের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে একের পর এক কাহিনি—কখনো স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উঠানোর ভুল নিয়ে, কখনো স্কুলে পড়া মেয়েটির প্রথম প্রেমপত্র কিভাবে ভুল ঠিকানায় গিয়ে ফাঁস হয়েছিল, আবার কখনো ডাক বিভাগের হেড অফিসে একবার কীভাবে ভুলবশত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি গিয়ে পড়েছিল কাকুর হাতে। কাকুর জীবনের গল্পের যেন শেষ নেই, আর শোনার মানুষও কম নয়। তুষার, যে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে, সে বলে—“কাকুর মুখে গল্প শুনে মনে হয় জীবনের সিনেমা দেখছি।” রেণুদি, যাঁর স্বামী মারা গেছেন বছর তিনেক, বলেন—“ভাবনীদা আসেন বলেই এখনও দোকানে বসা যায়, নইলে মেয়েরা আর কি জায়গা পায়?” এমনকি পাড়ার কুকুরটাও যেন কাকুর পায়ের কাছে বসে থাকে নিঃশব্দে, যেন তিনিও কিছুর অপেক্ষায়। ভবানী কাকুর জন্য কারো ভালোবাসা নীরব নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনচর্চার অংশ। একদিন সকাল আটটা পেরিয়ে গেলেও কাকু না এলে শিবু চিন্তায় পড়ে যায়—তখনই বোঝা যায়, ‘সাধারণ’ ভবানী কাকুর জায়গাটা ঠিক কতটা ‘বিশেষ’।
কিন্তু এই চায়ের দোকানের সকালটা শুধু হাস্যরস নয়, তার নিচে লুকিয়ে থাকে কাকুর জীবনের অব্যক্ত অতীতও। স্ত্রীর চলে যাওয়ার পর জীবনের ছন্দটাকে ধরে রেখেছেন এই সকালগুলোয় এসে। একমাত্র ছেলে অর্ঘ্য ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে, বছরে হয়তো একবার আসে, আর ফোনে বলে—“বাবা, তুমি ঠিক আছো তো? ওষুধ নিয়েছো?” কাকু হেসে বলেন, “আমি তো একদম ফিট, পাড়ার লোক বলছে আবার পোস্ট অফিসে ফিরে যাই।” অথচ সেই কথার অন্তরালে রয়ে যায় এক শূন্যতা—ছেলেকে ছুঁতে না পারার, স্মৃতির মধ্যে আটকে থাকার। এই চায়ের দোকান, এই পাড়া—এইগুলোই এখন কাকুর পরিবার। তাঁর হাসি, তাঁর ঠাট্টা, তাঁর পুরনো দিনের গল্প—সবটাই যেন একটা বর্ম, যেটার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক প্রৌঢ় মানুষের না বলা কথা। তিনি জানেন, সময় পাল্টেছে, মানুষ বদলেছে, কিন্তু তিনি নিজেকে বদলাননি—কারণ কাকু বিশ্বাস করেন, “এই পাড়া যদি ঘড়ি হয়, আমি তার কাঁটা—যতক্ষণ আমি চলি, ততক্ষণ পাড়া টিকটিক করে।” সেই বিশ্বাসেই তিনি প্রতিদিন আসেন, হাসেন, চা খান, গল্প বলেন—আর পাড়া জুড়ে ছড়িয়ে দেন এক ধরনের অদৃশ্য জাদু।
২
সেদিন সকালটা ছিল একটু গম্ভীর। আকাশের মুখ ভার, বাতাসে হালকা ঠান্ডা। ভবানী কাকু আসতেই শিবু বলল, “কাকু, আজ কিন্তু খবরের কাগজে কিছু নেই, একেবারে ঠান্ডা দিন।” কাকু হেসে বললেন, “আরে ওটাই তো খবর! যে দিন কাগজে কিছু নেই, সেই দিনটাই সবচেয়ে নির্ভেজাল।” কাকু বসেই চোখ রাখলেন পাড়ার মোড়ের এক কোণায়, যেখানে একটা লাল রঙের পুরোনো পোস্টবক্স দাঁড়িয়ে আছে—রং চটে গেছে, নিচে মরচে ধরেছে, কেউ আর চিঠি ফেলে না তাতে। “শিবু, জানিস, ঐ পোস্টবক্সটা একসময় কত কথা শুনত! এখন তো সবাই ফোনে বলে—কিন্তু তখন প্রতিটা চিঠির ভেতর ছিল নিঃশব্দ কান্না, ভাঙা স্বপ্ন, প্রেম, আশা। আমি তো নিজে হাতে কত প্রেমপত্র বিলি করেছি জানিস?” শিবু হেসে বলল, “তা হলে তো কাকু প্রেমের দূত ছিলেন একসময়!” চারপাশে যারা ছিল, হেসে উঠল, কিন্তু কাকুর চোখে জ্বলজ্বল করছিল এক অন্য আলো—স্মৃতির আলো। তিনি ধীরে ধীরে শুরু করলেন এক গল্প, যেটা শোনার জন্য সবাই সেদিন টানটান হয়ে রইল।
“সালটা ১৯৮৪, আমি তখন শ্যামবাজার পোস্ট অফিসে। একদিন দুপুরে একটা চিঠি আসে—ছোট্ট সাদা খামে, গোলাপি কালি দিয়ে লেখা—‘প্রিয় দোলন, আমি তোমার বিনায়ক।’ ভেতরে লিখেছে, ‘যদি ভালোবাসো, উত্তর দিও—তোমার ঠিকানায় নয়, উত্তর দিও ভবানী কাকুর পোস্ট অফিসের বক্সে, খামের উপরে শুধু লিখে দিও “তুমি”।’ তখন তো ছিল না আজকের মতো ফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ। আমি প্রথমে খুব হাসলাম—ভাবলাম, প্রেমিকলোকের বুদ্ধি দেখি! তারপর কী হল জানিস? দুদিন পর একটা খাম এল, সেই একই কালি, লেখা—‘তোমার দোলন।’ আমি বুঝে গেলাম—কাজ হয়েছে। তারপর প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি, নাম-ঠিকানা কিছু নেই, শুধু আদান-প্রদান সেই লাল পোস্টবক্স হয়ে। আমি নিঃশব্দে সেই প্রেমের সাক্ষী হয়ে গেলাম। প্রায় বছরখানেক চলল ওদের লেখা-পড়া। একদিন হঠাৎ বিনায়ক এসে বলল—‘কাকু, আজ আর চিঠি নয়, আমি বিয়ের নিমন্ত্রণ দিতে এসেছি।’ হাতে তুলে দিল একটা লাল কার্ড। চিঠি যাদের লেখা হত, তারা এখন জীবনের পাতায় একে অপরের নাম হয়ে গেছে।” কাকু একটু থামলেন, গভীর শ্বাস ফেললেন। চারপাশ নীরব—রেণুদি চোখ মুছছিলেন, তুষারের মুখে বিস্ময়।
“এই যে পোস্টবক্সটা আজ মরচে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, জানিস, এটা কেবল চিঠি রাখার জায়গা নয়—এটা একটা মন্দির ছিল কারও জন্য, যুদ্ধক্ষেত্র কারও জন্য, আবার কারও প্রথম সাহস। কেউ তার বাবাকে মাফ চাইত এইখানে চিঠি ফেলে, কেউ তার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিত। আমি শুধু বিলি করতাম না, আমি এই শহরের গল্পগুলোকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিতাম। আর এই করতে করতেই আমার নিজের জীবন কেটে গেল।” কাকুর গলা কেঁপে উঠল, কিন্তু হাসি থামল না। “আচ্ছা, জানিস, একবার এক ছেলে তার মাকে চিঠি লিখে বলেছিল—‘মা, আমি চাকরি পেয়েছি। কিন্তু তুই খাবি কিনা চিন্তা হয়। আমি এখনো ভাতের সঙ্গে তোর বানানো আলুপোস্ত মিস করি।’ আমি খামটা দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম—কারণ আমিও তখন সদ্য মা হারিয়েছি। সেই ছেলে আর চিঠি লেখেনি, হয়তো শহরের চাপে চাপা পড়ে গেছে।” এক নিঃশব্দ মুহূর্ত কেটে গেল। হঠাৎ শিবু বলল, “কাকু, আমরা তো ভাবতাম পোস্টম্যান শুধু ঘণ্টি বাজিয়ে চিঠি দিয়ে চলে যায়। কিন্তু আপনি তো দেখি একজন জীবন্ত চিঠির থলি!” কাকু হেসে বললেন, “আমরা কেবল বার্তাবাহক নই, আমরা মানুষের জীবন বয়ে নিয়ে যেতাম। তোমরা বুঝতে পারো না, একটা হাতে লেখা চিঠি কী পরিমাণ অনুভব বহন করে।”
গল্প শেষ হয়, কিন্তু চারপাশে একটা আবছা অস্থিরতা থেকে যায়। ভবানী কাকুর মুখে ওইসব চিঠির গল্প শুনে অনেকেই যেন ফিরে যায় নিজেদের অতীতে। অঞ্জলি, পাড়ার স্কুল টিচার, বলে—“কাকু, আমি ক্লাসে আজ বাচ্চাদের চিঠি লেখানো শুরু করব, হোয়াটসঅ্যাপে তো শুধু ইমোজি, কিন্তু চিঠি তো মনের ছাপ!” সেই পুরোনো পোস্টবক্সটা হঠাৎ যেন চওড়া হয়ে যায় চেহারায়—এতদিন যেটাকে মরচেধরা ধাতু ভাবা হতো, এখন সেটা এক জীবন্ত স্মৃতিস্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভবানী কাকুর গল্প শুধু হাসায় না—ভেতরে কোথাও নরম করে দেয়, নড়ে দেয়। কেউ একজন মনেমনে ভাবে তার বাবাকে একটা চিঠি লিখবে; কেউ হয়তো তার পুরোনো প্রেমপত্রগুলো খুঁজে বের করবে। সেদিন সেই চায়ের দোকানের মোড়টা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছিল—যেন একটা লাল পোস্টবক্সের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই নিজেকে খুঁজে নিচ্ছিল পুরোনো অক্ষরে লেখা শব্দে। আর ভবানী কাকু? তিনি ধীরে ধীরে চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে উঠে দাঁড়ান, বলেন, “চলো, আজ আর গল্প নয়—কিন্তু যদি কখনো মনটা ভার হয়, একটা চিঠি লিখে দিও। আমি ঠিক পড়ে নেব।”
৩
রবিবার সকাল, কিন্তু আজ চায়ের দোকানে হাসি নেই, রসিকতা নেই। শিবু নিঃশব্দে চা ঢালছে, রেণুদি মুখ ভার করে বসে আছেন, আর পাশের বেঞ্চে ছায়াদেবী বারবার ঘড়ি দেখছেন। পাড়ায় গণ্ডগোল হয়েছে—এটা সবাই জানে, কিন্তু কে আগে বলবে, সেটা কেউ ঠিক করতে পারছে না। ভবানী কাকু আসতেই যেন সব মুখ ঘুরে তাঁর দিকেই তাকাল। “কি গো, আজ এত চুপচাপ কেন?”—কাকু হাসিমুখে বললেন, কিন্তু কণ্ঠে একটু উৎকণ্ঠা টের পাওয়া গেল। শিবু এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলল, “কাকু, আপনি ছাড়া এই জট খুলবে না।” পাশে বসে থাকা তুষার ফিসফিস করে জানাল—রেণুদি আর ছায়াদেবীর মধ্যে ভয়ানক ঝামেলা হয়েছে গত রাতে, কারণ রেণুদি বলছেন ছায়াদেবী নাকি তাদের বারান্দা থেকে জামা কাচা জল ফেলে দিয়েছেন ইচ্ছে করে। ছায়াদেবী উল্টো বলছেন, রেণুদি নাকি গায়ে পড়ে ঝগড়া করছেন। এইটুকু ঘটনা, কিন্তু পাড়ার মধ্যে যেন আগুন লেগে গেছে। কাকু প্রথমে কিছু না বলে এক ঢোক চা খেলেন, তারপর বললেন, “আচ্ছা, আমি রেণুদি আর ছায়াদেবী দুজনকে একটু হাঁটার নাম করে রেল লাইনের ধারের ফাঁকা মাঠে নিয়ে যাব, সেখানে না হয় একটা ‘বৈঠক’ হোক, তবে অফিসের মতো না, মনখোলা গল্পের মতো।”
বিকেলে সেই কথাই বাস্তবায়িত হলো। কাকু দুজনকে নিয়ে গেলেন মাঠের পাশে একটা পুরোনো পাথরের বেঞ্চে। সেদিন কাকু বিশেষভাবে ধুতি-পাঞ্জাবি বদলে সাদা পাঞ্জাবির উপর পাড় দেওয়া একটা চাদর জড়ালেন—যেন একটা মাঝারি আদালতের বিচারক। তিনি দুজনকে পাশে বসিয়ে বললেন, “রেণুদি, ছায়াদেবী, তোমরা দুজনেই পাড়ার রত্ন, একজন ভালো রান্না করেন, আর একজন ভালো সেলাই করেন। আমি দুজনের হাতেই খেয়েছি, কাপড়ও কেটেছি। আজ যদি তোমরা এমন করে, তবে বাকিরা কি শিখবে?” রেণুদি একটু নরম স্বরে বললেন, “ভাবনীদা, আমি কিছু বলতাম না, কিন্তু উনি বললেন আমি নাকি বুড়ো বয়সে লোক দেখাতে ভালো সাজি।” ছায়াদেবী বললেন, “আমি কখনো এমন কিছু বলিনি ভাবনীদা, আমি শুধু বলেছিলাম জল পড়ে গেছে, আমি দুঃখিত।” কাকু হাত তুলেই বললেন, “এই যে দেখো, জল যেমন মাটিতে পড়ে যায়, রাগও তেমন পড়তে দাও। শুকিয়ে যাবে, মিশে যাবে। কথার ভুল তো হতেই পারে, কিন্তু সম্পর্ক যদি শুকিয়ে যায়, সেটা তো ফেরানো যায় না।” রেণুদি চুপ করে থাকেন, চোখ নামিয়ে নেন। ছায়াদেবীও ধীরে ধীরে বললেন, “আমি রেণুদিকে চা খাওয়াবো কালকে, বাড়িতে নতুন চাল এসেছে—তাঁর পছন্দ মতো পাতলা।” কাকু হাসলেন, যেন মনের মধ্যে লাল বাতি নিভে গেল।
মাঠের এই ‘পঞ্চায়েত’ সফল হয়। কিন্তু এই ঘটনায় কাকুর একটা গভীর দর্শন প্রকাশ পায়। তাঁর জন্য ‘ঝগড়া’ মানে ব্যক্তিত্বের সংঘাত নয়, বরং আবেগের ভুল বোঝাবুঝি। মানুষ যতই বয়সে বড় হোক না কেন, তর্ক-আবেগ-স্নেহ—সবই থাকে। ভবানী কাকুর চরিত্রের এই দিকটাই পাড়াকে আলাদা করে। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে থানায় যায় না—ভবানী কাকুর কাছে আসে। তিনি কাউকে অপমান করেন না, কাউকে ছোট করেন না। বরং প্রতিটি সমস্যার মধ্যে মানুষের ভয়, কষ্ট, অথবা নিঃসঙ্গতা খুঁজে পান। সেই নিখুঁত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে পাড়ার কাছে একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ করে তোলে, একজন পরামর্শদাতা নয়, একজন সহচর। সেইদিন বিকেলে রেণুদি আর ছায়াদেবী একসঙ্গে কাকুর বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটতে গেলেন। কাকু বারান্দায় বসে হেসে বললেন, “পাড়া মানেই তো পরিবার, আর পরিবারে মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়ই। তবে ক্ষমা করলে সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।” শিবু দোকানে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল, “এই কাকুর মতো যদি দুটো নেতা পেত দেশ, তবে সংসদেও কেউ চেয়ার ছুঁড়ত না।”
৪
সকালটা অন্যরকম ছিল সেদিন। আকাশ একটানা ধূসর, বাতাসে অদ্ভুত একটা চাপা অস্বস্তি। পাড়ার লোকজন অপেক্ষায় ছিল—শিবু একের পর এক চা বানাচ্ছিল, কিন্তু তার চোখ বারবার গলির দিকে। ভবানী কাকু আজও আসেননি। সকাল সাড়ে আটটা বেজে গেছে, অথচ তিনি নেই—এটা যেন কারও সহ্য হচ্ছে না। রেণুদি গম্ভীর গলায় বললেন, “কাল সারাদিন খুঁটি গুনছিলেন জানেন তো! হয়তো বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছেন।” ঠিক তখনই খবর আসে—ভবানী কাকু নিজেই তাঁর পুরনো ট্রাঙ্ক খুলতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান। পাশের বাড়ির খোকন গিয়ে তাঁকে আধচেতনা অবস্থায় দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলে তুলেই নিয়ে যায় ডাক্তার বাগচীর চেম্বারে। বাগচীবাবু তাঁকে দেখে প্রথমেই বললেন, “বয়স হয়েছে ভবানীদা, এত ধকল নিলে শরীর বলবে তো না। কিছু পরীক্ষা করতে হবে।” পাড়ায় খবর ছড়াতে দেরি হয়নি—চায়ের দোকানে, মুদি দোকানে, এমনকি রিকশাওয়ালার মুখেও ঘোরে একটাই নাম: ভবানী কাকু। যিনি প্রতিদিন সবার জীবনের শুরুর সূর্য হয়ে উঠতেন, তিনি হঠাৎ যেন এক বিকল মেশিন হয়ে গেছেন। সেদিন সন্ধেবেলা, শিবু দোকান বন্ধ করেছিল সময়ের আগেই—কেন জানে না, কিন্তু মনটা ভার হয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার বাগচীর চেম্বারে বসে ভবানী কাকু হাসার চেষ্টা করলেন, বললেন, “বাগচী, এই শরীর তো ট্রাঙ্ক নয় যে যত খুশি খুলে ফেলব! এবার বুঝলাম, বয়স আমাকে পেরিয়ে যাচ্ছে।” ডাক্তার হালকা হেসে বললেন, “শরীরের কিছু প্যারামিটার ঠিক নেই—প্রেশার ওঠানামা করছে, হেমোগ্লোবিনও কম। কিন্তু যেটা বেশি চিন্তার, সেটা হল একা থাকা… মানে, মানসিক চাপ।” কথাটা শুনে কাকুর মুখ কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইল। তারপর বললেন, “তুই জানিস, আমি আর একা থাকি না… এই পাড়ার লোকগুলো আমার ছেলেমেয়ের মতো। রেণুদি কড়া চা খাওয়ায়, খোকন মাঝে মাঝে আম দিয়ে পরোটা দেয়। অর্ঘ্য তো বছরে একবার আসে, তার খবর আর ওই ফোনেই সীমাবদ্ধ।” বাগচীবাবু সংবেদনশীলভাবে বললেন, “আমি বুঝি, ভাবনীদা। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে বলছি, আপনার শরীর আর মন—দুটোই বিশ্রাম চায়।” কাকু একটু চুপ থেকে বললেন, “কিন্তু আমি বিশ্রাম নিলে তো পাড়া থেমে যাবে। শিবু চা দেবে কাকে, তুষার খবর শুনবে কার মুখে? আমি তো যেন একটা অদৃশ্য ঘণ্টা—আমি না বাজলে পাড়ার ঘড়ি চলে না।” কাকুর কথায় এক অদ্ভুত ক্লান্তি ছিল—যেটা শরীরের ক্লান্তি নয়, সেটা সময়ের, দায়িত্বের, সম্পর্কের ক্লান্তি। তিনি বুঝছিলেন—যাকে সবাই অবিচল ভাবছে, সে-ও আসলে ভিতরে ভিতরে কাঁপছে।
সন্ধ্যা নামতেই পাড়ায় ছোটখাটো এক জোয়ার আসে। রেণুদি নিজের হাতে বানানো সুজির হালুয়া পাঠান কাকুর বাড়ি, তুষার দুধ আর ফল নিয়ে আসে, আর শিবু পুরো দোকান বন্ধ করে কাকুর ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসে। কেউ কিছু বলেনা, কেউ জোর করেনা, শুধু সবাই চুপচাপ পাশে বসে থাকে। ভবানী কাকু বিছানায় শুয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেন—পাশে বসা মানুষগুলোর চোখে কতটা ভালোবাসা, অথচ তারা কাউকেই ‘রক্তের সম্পর্ক’ দিয়ে বাঁধা নয়। এটাই তো সত্যিকারের পরিবার—যেখানে মানুষ একে অপরের পাশে থাকে বিনিময়ের আশায় নয়, ভালোবাসার ইচ্ছায়। রাতে অর্ঘ্যের ফোন আসে—বাবার অসুস্থতার কথা শুনে একটু ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, “বাবা, তুমি ভালো আছ তো? ডাক্তার কী বলেছে? আমি ট্রিপে আছি, ফিরেই দেখি।” কাকু হালকা গলায় বলেন, “হ্যাঁ, আমি ভালো আছি রে, সবাই আছে পাশে। তুই কাজ কর।” ফোন কেটে কাকু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন—চোখের কোণ বেয়ে জল নামে, কিন্তু ঠোঁটে তবু সেই চেনা হাসি লেগে থাকে।
সে রাতে পাড়ার বাতাসে যেন কিছুটা ভারীতা ছিল, যেন সবাই বুঝেছিল—ভবানী কাকু শুধু একজন চা-খোর বৃদ্ধ নন, তিনি এক জীবন্ত বাতিঘর। আর যদি সেই আলোই নিভে যায়, তবে পথ খুঁজে পাবে কে?
৫
বাড়ির ভেতর আজ একটা অদ্ভুত নিঃশব্দতা। জানালার ফাঁক গলে রোদ এসে বিছানার চাদরে পড়েছে, কিন্তু সেই আলোর মধ্যে কোনো উষ্ণতা নেই—শুধু শুকনো, কাঠখোট্টা এক পঁচিশ বছরের পুরনো নিঃসঙ্গতা। ভবানী কাকু বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন, পাশের টেবিলে পুরনো চশমা, একটা ছোট ট্রাঙ্ক খোলা—তার ভেতর গোছানো আছে কিছু অদ্ভুত জিনিস: পুরোনো এক রেডিও, স্ত্রীর হাতের লেখা একটা নোটবুক, কিছু পোস্টকার্ড, আর অর্ঘ্যর ছোটবেলার আঁকা একটি ছবি—নীল রঙা একটা ঘুড়ি আর তার নিচে লেখা “বাবা”। সেই নোটবুকের পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে কাকুর আঙুল কাঁপে, মুখটা কেমন হালকা গম্ভীর হয়ে ওঠে। তিনি নিচু গলায় বলেন, “তুই তো বলতিস, আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবে। থাকিস কোথায় এখন?” স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। দুপুরের সেই ঘন নিরবতায় টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। এমন সময় পাশের বাড়ির বাচ্চারা খেলা করতে করতে বলে ওঠে, “ভবানী কাকু এবার বোধহয় মারা যাবে। বড়দের কথা শুনেছি।” কথাটা কানে যেতেই কাকুর মুখে হাসি ফোটে—হালকা কষ্টমাখা এক রকমের মজা। “এই যে দেখো, আমি এখন গুজবের মুখ, মানে আমি কিছু না করেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।” তবু সে হাসির আড়ালেও যে একটা হাহাকার আছে, সেটা কাকু ছাড়া কেউ জানে না।
দুপুরের খাবারটা আজ আর রাঁধেননি ভবানী কাকু। পাশের বাড়ির অঞ্জলি একটা থালায় ভাত, ডাল আর পটলের তরকারি পাঠিয়েছেন। খাবারটা ছুঁয়ে তিনি শুধু বলেন, “অঞ্জলি ছোটবেলা থেকে চেনে আমায়, এখন মা হয়ে গেছে।” খাওয়ার ফাঁকে রেডিওটা চালু করেন, কিন্তু চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে থেমে যান এক জায়গায়—পুরনো দিনের গান বাজছে—“এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়…”। হঠাৎই চোখ বেয়ে জল পড়ে যায়—যেমন করে পড়ে মন ভিজে গেলে, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এলে, আর দম বন্ধ হয়ে আসলে। “এই গানটা ওর খুব প্রিয় ছিল—রানু, তুই কি শুনছিস?” বিছানার পাশে টানিয়ে রাখা সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন—যেখানে স্ত্রীর এক অল্পবয়সী মুখ, সাদা সুতির শাড়ি, চুড়ির টুংটাং বাজনার মতো এক চিরকালীন আত্মীয়তা। কাকুর কণ্ঠস্বর তখন যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে—একটাই কথা, “এত চুপচাপ কেন চারদিক?” তিনি জানেন—মানুষ যত বড় হয়, তার বন্ধু কমে যায়, আত্মীয়রা দূরে চলে যায়, আর যাদের সঙ্গে কিছু বলার থাকে, তাদের মুখেই সময় থাকে না। কাকুর বাড়ির ঘড়িটা আটকে আছে—ক্লাসিকাল ধাঁচের, গোল কাঠের ঘড়ি, আর প্রতিবার সে বেজে ওঠে ঠিক বেলা তিনটেয়। কাকু বলেন, “এই ঘড়ি তো থেমে গেলেও ঠিক সময় বলে। আমি না হয় তার মতোই হলাম।”
সন্ধে নামার আগে শিবু, রেণুদি আর তুষার আসে খোঁজ নিতে। কিন্তু কাকু বলেন, “আজ না রে, আজ শুধু রানুর সঙ্গে কথা বলি।” বন্ধ দরজার ভেতর আবারও সেই পোস্টকার্ডগুলো ঘাঁটতে থাকেন—একটায় লেখা:
“বাবা, তুমি আমার সেরা বন্ধু। তোমার সঙ্গে প্রতিদিন খেলা করব—তোমাকে ছেড়ে কখনো যাব না।”
কাকু হেসে বলেন, “অর্ঘ্য, তুই কথা রাখিসনি রে।”
তারপর নিজে হাতে লেখেন একটা চিঠি—যেটা কাউকে পাঠানো হবে না:
“রানু, আজ খুব ইচ্ছে করছে তোকে ছুঁয়ে দেখতে। তুই নেই, অথচ তুই সবখানে আছিস। আমি হয়তো ভুল করে ফেলেছি—এই সবটুকু দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ নিজের হৃদয়ের কথা কাউকে বলিনি। কিন্তু জানিস, এখনও কেউ এসে যদি বলে—‘ভবানী কাকু, আপনি ছাড়া এই পাড়া চলে না’, তখন আমি হেসে বলি, ‘আমি চললে পাড়াও চলে।’ তুই বল তো, আমি কি সত্যিই পেরেছি তোদের মতো হয়ে উঠতে?”
চিঠিটা শেষ করে তিনি ট্রাঙ্কের মধ্যে রেখে দেন—আর তার মুখ বন্ধ করে দেন এক দীর্ঘশ্বাসের বোতাম দিয়ে। বাইরে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, আকাশে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে ঘরে। ভবানী কাকু জানালার দিকে তাকিয়ে বলেন, “সবাই ফিরছে… আমি তো কোথাও যাইনি, তাও যেন কোথাও ফিরছি।”
৬
রাত সাড়ে ন’টা। বাড়িটা নিস্তব্ধ। ভবানী কাকু বিছানায় আধশোয়া, মাথার পাশে একটা ছোট টেবিলে লাল আলোয় জ্বলছে পুরনো বেডল্যাম্প। রেডিওর আওয়াজ বন্ধ, জানালার কাচ বন্ধ, কেবল একটা ফোন তার ভেতরে বেজে ওঠে—একটু আধুনিক সুরে, অদ্ভুত ভাবে এখানকার চারপাশে বেমানান। অর্ঘ্য—স্ক্রিনে ছেলের নাম দেখে কাকু হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ফোনটা ধরেই বললেন, “হ্যাঁ রে অর্ঘ্য?” ওপাশ থেকে একটা ক্লান্ত, কৃত্রিম উত্সাহে ভরা গলা—“বাবা, ভালো আছো? শরীর কেমন?”
কাকু বললেন, “ভালোই, এই তো, বাগচী একটা-দু’টো ওষুধ দিয়েছে, কিছু বিশেষ নয়। তুই অফিসে ব্যস্ত তো?”
অর্ঘ্য উত্তর দেয়, “হ্যাঁ বাবা, এখন একটা নতুন প্রজেক্ট নিয়ে টানাটানি… মন চায়, কিন্তু ছুটি ম্যানেজ করা যাচ্ছে না। আমি ভাবছি পরের মাসে আসব, তুই কিছু দরকার হলে বলিস।”
এইসব কথা হয় কিছুক্ষণ। কাকুর গলা যথারীতি নরম, শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। অথচ কথাগুলোর ভিতরে জ্বলে ওঠে অনেক না বলা কথা।
ফোনটা কেটে গেলে কিছুক্ষণের জন্য তিনি স্থির থাকেন। তারপর বলেন, “অর্ঘ্য তো এখন আর সেই অর্ঘ্য নেই। আগে যেটা বলত, ‘বাবা, তুই খেয়েছিস তো?’, এখন সেটা বলে অফিসের ভেতর থেকে, আধো মন দিয়ে, আধো দায়িত্বে।”
তিনি জানেন, এই ফাঁকটা সময় তৈরি করেনি, তৈরি করেছে অভ্যাস আর দুরত্ব। ছেলের প্রতি অভিমান নেই তাঁর, বরং একটা ভীষণ স্বাভাবিক বেদনা—যেটা হয় তখন, যখন কেউ আপন হয়েও অচেনা হয়ে যায়।
পরদিন সকালে চায়ের দোকানে গিয়ে ভবানী কাকু আগের মতোই হাসলেন, আগের মতোই বললেন, “শিবু, আজ একটু কড়া দিস।” কিন্তু চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তুষার জিজ্ঞেস করল, “কাকু, কাল রাতে আলো জ্বলছিল… ঠিক আছেন তো?” কাকু হেসে বললেন, “আরে হ্যাঁ! ছেলের ফোন এসেছিল—একটু কথাবার্তা হল। এখন ছেলে তো আর পাশের বাড়িতে থাকে না, কথা বলাটাও বিশেষ অনুষ্ঠান।” শিবু বলল, “কাকু, আপনি ওকে বললেন না যে আমরা সবাই চিন্তায় আছি?”
কাকু মাথা নেড়ে বললেন, “না রে। ছেলেকে চিন্তা দেওয়ার থেকে না দেওয়া ভালো। এখনকার ছেলেমেয়েরা সময় আর দুশ্চিন্তার মধ্যে যে সময় বাঁচায়, সেটাই বড় কথা।”
তাঁর কণ্ঠে ছিল না কোনো অভিযোগ, বরং একধরনের জীবনবোধ, যা সময়কে মেনে নেওয়ার নামান্তর। পাড়ার কেউ কেউ ফিসফিস করে বলে, “ভবানী কাকুর মতো মানুষ কম হয়—ছেলের অভাব মনে হয়, অথচ মুখে বলে না।”
কিন্তু সেটা তো তাঁর শক্তি।
তাঁর জীবনটা যেন এখন এক গানের মতো—সুর আছে, কিন্তু কথা হারিয়ে গেছে।
সন্ধ্যায় কাকু একাই হাঁটতে বের হন। রেলের লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে একসময় পুরনো লাইব্রেরির সামনে দাঁড়ান। এককালে যেখান থেকে অর্ঘ্য বই ধার নিত, আর এসে বাবার কাছে গল্প করত—‘বাবা, এটা পড়েছিস?’, ‘বাবা, এটা আমার থেকে তুই ভালো বুঝবি।’
আজ লাইব্রেরির দরজা বন্ধ, ভেতর অন্ধকার। ভবানী কাকু দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন দরজার ওপাশে ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, একটা বই হাতে।
তারপর ধীরে ধীরে বলেন, “তুই তো বলতিস, আমি তোর জীবনের হিরো। হিরোরা কি এমন একা হয়ে যায় রে অর্ঘ্য?”
পেছনে সাইকেলের বেল বাজে—খোকন পাশ কাটিয়ে বলে, “কাকু, কাল আপনার জন্য ডিম আনব, বলেছিলেন না তো?”
কাকু হেসে বলেন, “আরে হ্যাঁ, আনিস। ডিমের ঝোল খেলে মনে হয় ঘর আছে।”
কথাটা শুনে খোকন হাসে, কিন্তু সে বুঝতে পারে না—এই কথার ভিতর লুকিয়ে আছে এক অতল শূন্যতা।
রাত বাড়ে। কাকু জানালার ধারে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলেন—একদম নরম গলায়, যেন সময় না শুনে ফেলে।
“আমার ছেলেও আছে, আমার কেউ নেইও—এই দুইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, ভবানী কাকু হয়ে।”
৭
সকাল হতেই কাকুর বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেল। কেউ দুধ নিয়ে এসেছে, কেউ ফল, কেউ আবার পাউরুটি। ভবানী কাকুর অসুস্থতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু এবার কিছু যেন বদলে গেছে—এবার মানুষ শুধু কৌতূহলবশত নয়, দায়িত্ববোধ থেকে আসছে। রেণুদি বলেন, “ভাবনীদা ছাড়া এই পাড়া যেমন চলেনা, তেমনি কাকুকে না দেখে আমার চা-ই সাদা লাগে।” তুষার চুপচাপ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে, হাতে একটা ছোট খাম—ভিতরে একটা চিঠি। সে শিবুকে দেয়, বলে, “চিঠিটা দাও, আমি তো ওঁকে মুখে কিছু বলতে পারি না।” খামে লেখা—“ভবানী কাকুর জন্য—আপনার কথা শুনে আমরা মানুষ হতে শিখি।”
এই যে ভালবাসা—কেউই জোর করে দেয়নি, কাকুও চায়নি কখনও; তবু তিনি হয়ে উঠেছেন আশ্রয়, পরামর্শ, সাহস আর স্মৃতির প্রতীক।
চায়ের দোকানে কাকু না থাকলেও, আজ শিবুর দোকানে ভবানী কাকুর ছবি টাঙানো হয়েছে—পেছনে ছোট একটা কাগজে লেখা, “আমাদের পাড়ার হৃদস্পন্দন।”
পাশের পাড়ার কেউ এসে জিজ্ঞেস করে, “উনি কি কাগজের লোক? নামকরা কেউ?”
শিবু মাথা নাড়িয়ে বলে, “তিনি আমাদের সবচেয়ে আপনজন। এর থেকে বড় নাম আর কী?”
বিকেল গড়াতে গড়াতে রেণুদি, খোকন, ছায়াদেবী, তুষার সবাই ঠিক করে—একটা করে ডিউটি হবে, ভবানী কাকুর ওষুধ-খাবার-স্নান-ঘুম—সব কিছু দেখে রাখবে তারা পালা করে। এক রকম চুপিচুপি একটা “ভবানীবৃদ্ধ সেবাদল” তৈরি হয়ে যায়, যার সদস্য সংখ্যা বাড়তেই থাকে। তুষার রাতে এসে খবরের কাগজ পড়ে শোনায়, শিবু চা বানিয়ে টার্মোসে দিয়ে আসে, খোকন বাইরে থেকে ফল কিনে রেখে যায় বারান্দায়। এমনকি অঞ্জলি নিজের স্কুল ছুটি করেও দুপুরে এসে দেখে যায়, কাকু খেয়েছেন কি না। কাকুর চোখে জল আসে—তিনি বলেন, “আমি তো কিছুই চাইনি কারও কাছ থেকে, তবু সবাই দিল এতো। মানুষ এতটা দিতে পারে, যদি শুধু একটু ভালোবাসা দাও।”
পাড়ার ছোট ছেলেরা প্রতিদিন এসে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, একজন বলে, “কাকু, তোমার গল্প চাই। ডাক্তারবাবু বলেছে, গল্প শুনলে শরীর ভালো হবে।” কাকু হেসে বলেন, “আমি তো নিজেই একটা গল্প রে, বোধহয় শেষ অধ্যায় চলছে।”
শুনে একজন বলে ওঠে, “শেষ নয়, এটা দ্বিতীয় খণ্ড। এবার আমাদের পালা—আমরা লিখব।”
এই জবাবে ভবানী কাকু যেন জীবনের নতুন এক বাঁক খুঁজে পান।
এতদিন যিনি ছিলেন সকলের পথপ্রদর্শক, এখন তিনি হয়ে উঠছেন সকলের দায়িত্ব।
তিন দিন পরে, ডাক্তার বাগচী এসে চেকআপ করে বলেন, “ভাবনীদা, এই কয়েকদিনে যা উন্নতি দেখছি, সেটা শুধু ওষুধে হয় না—এটা ভালোবাসার কাজ।” কাকু মুচকি হেসে বলেন, “ভালোবাসা তো সবচেয়ে সস্তা ওষুধ, অথচ মানুষ আজকাল তা কিনতেই ভুলে যায়।”
অর্ঘ্যর ফোন আসে সেদিন রাতে। গলায় একটু হাহাকার, একটু সংকোচ, “বাবা, আমি শিগগির আসছি। খোকনের ফোনে সব শুনলাম। সবাই তো তোমার পাশে দাঁড়িয়েছে… আর আমি?”
কাকু হেসে বলেন, “তুই আসিস, কিন্তু তুই বুঝবি রে, আমি তো একা নই। আমি একজনে থেকেও পুরো পাড়া নিয়ে বাঁচি।”
সেই রাতে তিনি আবার খুলে বসেন পুরনো চিঠির বাক্স। এবার আর চোখে জল নয়, ঠোঁটে এক নরম শান্তি—যে শান্তি পাওয়া যায় তখন, যখন কেউ বোঝে—সে শূন্য থাকলেও, ভালোবাসার কারণে পূর্ণ হয়ে গেছে।
তাঁর চিঠির নিচে লেখা থাকে—
“আমি ভবানী কাকু। আমি আজও পাড়ার ঘড়িতে কাঁটা হয়ে আছি—যতক্ষণ ভালোবাসা আছে, ততক্ষণ আমি চলি।”
৮
সকালবেলায় পাড়ার গলির ধুলোর মতো করে উঠে আসে এক নতুন আলোর ঝলকানি। ভবানী কাকুর বাড়ির বারান্দায় বসে থাকা তাঁর চিরচেনা হাসি যেন সে সকালকে স্বাগত জানাচ্ছে। আজ আর তিনি একা নন—পাড়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের ভালোবাসা, তাদের গল্প আর তাদের অমোঘ বন্ধুত্ব। কাকু এখন শুধু একজন বৃদ্ধ নন, তিনি হয়ে উঠেছেন জীবন্ত ইতিহাস, পাড়ার স্মৃতিপুঞ্জের ছায়া, যিনি অতীত আর বর্তমানের সেতুবন্ধন। তাঁর চোখে আজ এক অন্য রকম দীপ্তি—যে দীপ্তি দেখিয়ে দেয়, জীবনের শেষ দিকেও মানুষের হৃদয় ভালবাসায় কতটা জ্বলজ্বল করতে পারে। চারপাশে বাচ্চারা দৌড়ে বেড়ায়, আর কাকু তাদের সঙ্গে মিশে যায় যেন কোনো নাচের ছন্দের মতো, স্মৃতির সুরের মতো। আজ তাঁর গলায় কোনো বিষাদের ছাপ নেই, শুধু এক গভীর প্রশান্তি।
পাড়ার মানুষ একত্রিত হয়ে বসে তাঁকে ঘিরে—কারো হাতে গরম চায়ের কাপ, কারো হাতে কাগজের খামে লেখা নতুন চিঠি। “কাকু, বলো তো, তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ কী?” শিবুর প্রশ্নে কাকু একটু থেমে উত্তর দিলেন, “সুখ? সুখ বলতে আমার মনে হয়, মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা। যখন তুমি জানো, তোমার পাশে কেউ আছেন, তখন যে নিঃশব্দ ভালোবাসাটা তুমি অনুভব করো—সেটাই আমার সুখ।” তিনি আরও বললেন, “আমি সবসময় চেয়েছি, আমার ছোট ছোট কথা যেন কারও মনে আলো জ্বালায়, তাদের মন খোলে, তাদের জীবন সুন্দর করে। কেউ যদি আমার গল্প শুনে হাসে, কাঁদে, বা ভাবতে পারে, তাহলে আমার জীবনের কাজটা হয়েছে।” পাড়ার সবাই তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে, যেন এই কথাগুলো তাদের জীবনের সব বোঝা হালকা করে দিয়েছে। রেণুদি বলে উঠল, “আমাদের জন্য তুমি শুধু ভবানী কাকু নও, তুমি আমাদের পরিবারের প্রধান।”
শুধু কথায় নয়, কাজেও এই বার্তা স্পষ্ট হয়েছিল। কাকু জানতেন, তাঁর সময় কম—কিন্তু ভালোবাসার পরিধি অসীম। তিনি একে একে সবাইকে উৎসাহিত করলেন, “পাড়ায় আমরা সবাই একে অপরের আশ্রয়। যত দুঃখ আসুক, যত ঝগড়া হোক, আমাদের ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। আজ তোমরা যা করেছ, তা শুধু আমার জন্য নয়, একে অপরের জন্য।” চারপাশ থেকে তুষার বলল, “কাকু, আমরা তো শুধু শিখলাম ভালোবাসা ছড়াতে, কিন্তু তুমি আমাদের শিখিয়েছো কীভাবে মানুষের অন্তর জিতে নেয়া যায়।” কাকুর চোখে তখন জল, কিন্তু তিনি লুকাতেন না। বললেন, “আমার জীবনের সব বড় শিক্ষা হলো—ভালোবাসার ভাষা কেবল কথায় নয়, কাজেও প্রকাশ পায়। আর পাড়ার মানুষই সেই ভাষার সেরা অভিধান।”
সন্ধ্যার আলো যখন হালকা হরিণের মতো গলে যায়, পাড়ার রাস্তা আলোয় ভরে ওঠে, তখন ভবানী কাকু জানালার কাছে বসে গভীর এক নিশ্বাস নেন। তাঁর হাতে শেষ চিঠি—অর্ঘ্যর লেখা, “বাবা, আমি ফিরছি। তুমি অপেক্ষা করো।” কাকু হাসলেন, “তুই আসছিস তো রে, এইবার সত্যিই।” তাঁর মনের মাঝে একটা শান্তি, একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে—যা জীবন জুড়ে কোনো কষ্টকে পার হওয়ার শক্তি। তিনি জানতেন, সময় তার পথেই চলছে, কিন্তু তিনি গিয়েও থাকবেন পাড়ার মুখে মুখে, চায়ের দোকানের গল্পে, এবং বিশেষ করে মানুষের হৃদয়ে।
তারপর কাকু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “নমস্কার, আমি ভবানী কাকু। যারা আমাকে চিনে, যারা আমাকে ভালোবাসে—তাদের জন্য আমি আছি। আর যারা এখনও চিনিনি, তাদের বলি, সময় কখনো বাঁচিয়ে রাখে না। কিন্তু ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখে, চিরকাল।”
***




