আরিত্র সান্যাল
১
মুর্শিদাবাদ। ইতিহাস আর নদীর গন্ধে ভেজা এক প্রাচীন শহর। যেখানে প্রতিটি দেওয়াল ফিসফিস করে বলে ফেলে অতীতের গোপন কথা। সেই শহরে নতুন ডিসি হয়ে এসেছেন ঈশান চট্টোপাধ্যায়—ত্রিশের কোঠায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক, এরপর আইএএস। কিছুটা আদর্শবাদী, কিছুটা কৌতূহলী। আর তার এই কৌতূহলই একদিন তাকে দাঁড় করিয়ে দেবে ইতিহাসের এক অন্ধকার গলির সামনে, যেখান থেকে ফেরা আর কখনো ঠিকভাবে সম্ভব নয়।
গাড়ি যখন লালবাগ ডিসি বাংলোর সামনে থামে, তখন ভরা বর্ষা। আকাশ মেঘলা, রাস্তায় পিচ্ছিল কাদা। ব্যাগ হাতে নামতে গিয়ে ঈশানের চোখ পড়ে বাংলোর ঠিক ডানদিকে, মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বিশাল ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদে। গায়ে লালচে শ্যাওলা, জানালায় কাঠের পাল্লা ঝুলে পড়েছে, ছাদের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। পুরো জায়গাটা যেন একটা মৃত হাতির হাড়গোড়ের মতো—গৌরব হারানো, অথচ এখনো ভয়ঙ্কর।
“ওটাই নবাবি কোঠা,” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়সী এক কেয়ারটেকার বললেন, “শেখ সিরাজ, এই বাংলোর পুরনো লোক আমি। অনেক দিন ধরে এখানেই কাজ করি।”
ঈশান কিছু না বললেও তার মুখের কৌতূহল লুকিয়ে থাকেনি।
সিরাজ স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলেন, “ও বাড়িটায় কেউ যায় না, স্যার। দিনের বেলাও না। রাত হলে… শব্দ আসে। কেউ হাঁটছে, দরজা টানছে, হাসছে… অনেকে বলেছে, ভেতরে আলো জ্বলতে দেখেছে। কিন্তু কেউ গিয়ে আর ফেরেনি ঠিকমতো।”
ঈশান হেসে বলেন, “আপনারা অতিরিক্ত ভাবেন, এইরকম ভাঙা বাড়ি থেকে শব্দ আসা স্বাভাবিক। তবে ইতিহাসটা শুনলে মন্দ হবে না।”
সিরাজ একটুখানি চুপ করে থেকে বললেন, “শোনা যায়, নবাব মিরজাফরের শেষ দিকে ব্রিটিশরা ওখানে নথি রাখত। একবার এক ইংরেজ অফিসার—লেফটেন্যান্ট ফিঞ্চ—ওখানে কী একটা দলিল নিয়ে ঢুকেছিল। তারপর সে আর ফিরে আসেনি। তার খোঁজে যারা গিয়েছিল, তারা কেউ পাগল, কেউ নিখোঁজ। তারপর থেকেই ও বাড়িটা তালা মারা, শুধু এখন তালা নেই, ভয় আছে।”
ঈশান ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে বাংলোর দিকে হাঁটতে শুরু করেন, কিন্তু কোঠার ছায়া তার পেছনে লেপ্টে থাকে।
সন্ধ্যা নামতেই ঘরের জানালায় হালকা বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। ঈশান বসেছে বাংলোর পুরনো লাইব্রেরিতে, পাতা ওল্টাচ্ছে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস ঘিরে নানা নথি। পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ, মাঝে মাঝে বাদুড়ের পাখার শব্দ। হঠাৎ একটা পুরনো খাম চোখে পড়ে। চিঠির গায়ে ইংরেজিতে লেখা—Lt. Edward Finch। খামটা খুলতেই একটা পাতলা কাগজ পড়ে বেরিয়ে আসে।
“In the year of 1760, during the monsoon, a confidential letter was hidden beneath the southern stone floor of the Nawabi Kotha. This message contains knowledge too dangerous for any empire. If found, do not read aloud. Deliver directly to Fort William, Calcutta.”
চিঠির নিচে বড় হরফে লেখা—“To Whom It May Concern.”
ঈশানের কপালে ভাঁজ পড়ে। দক্ষিণ পাথরের ফ্লোর? মানে দক্ষিণ অংশের নিচে কিছু একটা লুকোনো আছে? চিঠিটা হয়তো আসল নয়, একটা প্রতিরূপ। কিন্তু ব্রিটিশরা যদি সত্যিই কিছু গোপন নথি এখানে লুকিয়ে রাখে, তাহলে সেটা খুঁজে বের করাটা শুধু প্রশাসনিক কৌতূহল নয়, বরং ইতিহাস উদ্ধার।
পরদিন সকালে সে ডেকে পাঠায় শহরের একজন প্রবীণ ইতিহাস গবেষককে—দীনবন্ধু মুখোপাধ্যায়। তিনি নব্বই ছুঁই ছুঁই, চশমার পেছনে চোখে আগুন, গলায় ঝুলছে রাবারের টিউব দিয়ে শ্বাসযন্ত্র।
“Lt. Finch?” দীনবন্ধু হালকা হেসে বলেন, “বেশ নামকরা অফিসার ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর ঠিক আগের বছর একবার তিনি মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন। বলা হয়, তিনি নবাবের গোপন দলিল সংগ্রহ করে কলকাতায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। সেই দলিল আজও পাওয়া যায়নি। আর উনিও… নিখোঁজ।”
“আপনি কি জানেন, নবাবী কোঠার দক্ষিণ প্রান্ত কোথায়?” ঈশান জানতে চায়।
দীনবন্ধু বলেন, “হ্যাঁ, একবার আমি গিয়েছিলাম সেখানে। শেষ কক্ষে একটা পাথরের ফ্লোর ছিল, যার ঠিক মাঝখানে গোল দাগ। পাথরটা আলাদা দেখতে ছিল। আমি তখন ছাত্র, তাই সাহস করিনি। কিন্তু আপনি গেলে… সাবধানে যাবেন।”
সন্ধ্যায় ঈশান flashlight নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু আকাশে বজ্রের গর্জন রয়ে গেছে। নবাবী কোঠার দরজায় পা রাখতেই বাতাসটা বদলে যায়। কেমন একটা হিমেল স্রোত নেমে আসে গায়ে, যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে তার কানে কানে।
প্রথম ঘরটা ফাঁকা। দ্বিতীয় ঘরে এসে দেখে, ঠিক যেমন দীনবন্ধু বলেছিলেন—মাঝখানে বিশাল এক পাথর, যার গায়ে গোল দাগ। সে জুতো খুলে হাঁটু গেড়ে বসে, হাত রাখে পাথরে। ঠান্ডা, শিরশিরে। ধীরে ধীরে চাপ দেয়। পাথরটা এক চুল নড়ে যায়।
সে উঠে দাঁড়িয়ে পাথরটা ঠেলতে ঠেলতে সরিয়ে ফেলে। নিচে অন্ধকারে ঢাকা গহ্বর। flashlight নীচে ধরতেই দেখা যায়—একটা পুরনো চামড়ার ব্যাগ। যত্নে তুলতে গিয়ে দেখে, ব্যাগের গায়ে লাল দাগ। শুকনো রক্ত?
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা খুলে দেখে—ভেতরে একটাই খাম। পরিষ্কার হাতের লেখা—To Whom It May Concern — Murshidabad, 1760
চোখ বড় হয় ঈশানের। এই কি সেই চিঠি?
ঠিক সেই মুহূর্তে flashlight নিভে যায়। চারপাশ অন্ধকার। কোনো বাদুড়ের ডানা নয়, স্পষ্ট কারো নিঃশ্বাসের শব্দ পেছনে।
তার কাঁধে ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া। কেউ ফিসফিস করে বলে—
“খুঁজলে, পাবে। কিন্তু পড়তে পারবে তো?”
২
ঈশান গলা শুকিয়ে ফেলে। flashlight নিভে গেছে, মোবাইলের টর্চ চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সিগন্যাল নেই, ব্যাটারিও প্রায় শেষ। অন্ধকার চারদিক চেপে ধরে যেন। পিছনে নিঃশ্বাসের শব্দ কি বাতাসের খেলা, না কি… সত্যিই কেউ আছে?
সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর সাহস করে ব্যাগটা হাতে করে কোঠার বাইরে দৌড় দেয়। পেছনে কিছু নেই, কিন্তু বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করছে। কোঠা থেকে বেরিয়ে আলোয় আসতেই যেন ধমনীতে রক্ত চলাচল শুরু হয়।
ডিসি বাংলোয় ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে ব্যাগটা বিছানার উপর রাখে। বাইরে বজ্রপাত শুরু হয়েছে। জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে হাওয়া। ঈশান চুপচাপ বসে পড়ে, ব্যাগ খুলে খামটা আবার বের করে। “To Whom It May Concern — Murshidabad, 1760” — খামের কালি অক্ষত, কিন্তু স্পষ্টই পুরনো। সে ধীরে ধীরে খামটা খোলে।
চিঠির কাগজটা কেমন যেন অদ্ভুত। রঙ সাদা নয়, হালকা নীলচে। ছুঁলেই বোঝা যায়, এটা কোনো সাধারণ কাগজ নয়। প্রাচীন রকমের পেপার বার্ক।
লেখা শুরু হয়েছে—
“I, Lieutenant Edward Finch, in fear of my life, document what I was forced to see in the Southern Quarters of the Nawabi Kotha on the night of August 19, 1760…”
ঈশান টান টান হয়ে বসে পড়ে।
“…It was not just ink and paper they hid. It was knowledge. Forbidden knowledge. I was a fool to think I could simply take it back to Fort William. What I saw was… unspeakable.”
চিঠির লেখার পর পরই অস্পষ্ট কিছু দাগ, যেন কেউ কালি ছিটিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে করে। তারপর কিছুটা অংশ ছেঁড়া। সে যতই কাগজটা চোখের সামনে ধরে, পরবর্তী বাক্য পড়া যায় না।
ঈশান ভাবে, এটি কী কোনো গোপন ধর্মীয় তথ্য? না কি কেবলই আতঙ্কগ্রস্ত এক ব্রিটিশ অফিসারের প্রলাপ?
চিঠির শেষ লাইনে লেখা—
“If you have found this, you are already part of the curse. Burn it. Forget it. Or follow the path through the mirror on the East Wing. May God help you.”
ঈশান থমকে যায়—“curse?” এবং “mirror on the East Wing?” অর্থাৎ নবাবী কোঠার পূর্ব দিকের ঘরে একটি আয়না?
সে চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে আবার ব্যাগে রাখে। রাত তখন প্রায় দুটো। চোখে ঘুম নেই, অথচ চোখে ক্লান্তির ছায়া।
পরদিন সকালে উঠে সে অফিসে গিয়ে নিজের চেম্বারে ফাইল খুঁজতে থাকে। মুর্শিদাবাদের প্রত্নতাত্ত্বিক মানচিত্র, নবাবি আমলের কুঠির নকশা—কিছুই পরিষ্কার নয়। একমাত্র যেটা জানা যায়, তা হলো নবাবী কোঠার মূল কাঠামো ছিল একটি ইউ-আকৃতির ভবন। পূর্বাংশে ছিল নারী মহল এবং একটি ‘রূপদর্পণ’ কক্ষ—যেখানে নবাবের প্রিয়তমা আয়নার সামনে সঙ্গীতচর্চা করতেন।
ঈশান স্থির করে বিকেলে আবার যাবে। পূর্বাংশ খুঁজে দেখতে হবে।
বিকেলে কোঠার দিকে এগোতে গিয়ে সে দেখে মাঠে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে মোটা চশমা, হাতে ছড়ি। লোকটা তাকে দেখে বলে, “আপনি ঐ পাথরের নিচের জিনিসটা তুলে এনেছেন?”
ঈশান চমকে ওঠে। “আপনি কে?”
লোকটা হেসে বলে, “আমার নাম মোল্লা ফারুক। এই কোঠার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল আমার পূর্বপুরুষেরা। আপনার মতো অনেকেই এসেছিলেন, সাহস নিয়ে। কেউ পাগল, কেউ নিখোঁজ। আপনি এখনো ঠিক আছেন, কারণ আপনি চিঠি পুরোটা পড়েননি।”
ঈশান কাঁধ সোজা করে বলে, “আমি কোনো ভূতের গল্পে বিশ্বাস করি না।”
মোল্লা ফারুক মৃদু হাসেন, “এটা ভূতের গল্প নয়, এটা অভিশাপের দলিল। সেই চিঠিতে একবার চোখ পড়লেই তোমার আর নিজস্ব চিন্তা থাকে না। কোঠার ইতিহাস তোমার ভিতরে ঢুকে পড়ে। তুমি আর তুমি থাকো না।”
ঈশান কিছু না বলে চলে যায় কোঠার ভেতরে। এবার পূর্ব দিকের দিকে এগোয়। কাঠের দরজাগুলো পচে গিয়েছে, দেওয়ালের গায়ে বুনো লতা জড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে একটা ঘরে ঢোকে, যেখানে এখনো এক কোণায় একটা ভাঙা আয়না রাখা।
আয়নাটা প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা, কাঠের ফ্রেমে নবাবি খোদাই। কিন্তু কাঁচে কালচে দাগ—যেন আগুনের ছ্যাঁকা পড়েছে। ঈশান আয়নার সামনে দাঁড়াতেই তার চোখ আটকে যায়—নিজেকে সে ঠিক নিজের মতো লাগছে না। মুখে যেন হালকা কালি লেগে, চোখে গাঢ় ছায়া।
তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে, কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতেই কিছুই নেই। আয়নার দিকে আবার তাকায়—সেখানে এক নারী মুখ, লাল ঘোমটায় ঢাকা, ঠোঁটে ফিসফিস হাসি।
ঈশান পিছিয়ে আসে, হঠাৎ পিছনের দেয়ালে একটা শব্দ—“টক!”
সে হাতের flashlight দিয়ে ঘষে দেখে, দেয়ালের পেছনে ফাঁপা গর্জ। গায়ে হাত দিতেই সেটা খসে পড়ে। ভিতরে ছোট একটা গর্ত। ঈশান flashlight ঢুকিয়ে দেখে—একটা কাঠের বাক্স।
সে ধীরে ধীরে বাক্সটা বের করে। খোলার সঙ্গে সঙ্গেই একটি নীল কালি-লেপা কাগজ বেরিয়ে আসে। কাগজের ওপরে আরেকটি চিঠি, কিন্তু লেখার শিরোনাম অন্য রকম—
“The Second Letter: The Eyes of the Palace”
৩
বাক্সের ভিতর থেকে বের হওয়া কাগজটা হাতে নিয়েই ঈশান অনুভব করে একটা কাঁপুনি, যেটা ঠান্ডায় নয়—অজানা কিছু কাছে আসছে, এই আশঙ্কা থেকে। কাগজের রঙ নীলাভ, প্রাচীন এবং মোলায়েম। গন্ধটা অদ্ভুত—জলে ভিজে থাকা পুরনো কফিনের মতো।
খামটা খোলা ছিল না, তবে সিল ভাঙা। কাগজের উপরে লেখা—
“The Second Letter: The Eyes of the Palace”
ঈশান এক গভীর নিশ্বাস নিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে।
“August 21, 1760. It has been two days since I entered the Nawabi Kotha. What I found was not treasure nor paper—it was sight. Eyes that watched from the walls, ears hidden in marble statues, and mouths that whispered across rooms even in silence.”
ঈশান গলা শুকিয়ে ফেলে। চিঠির শব্দগুলো যেন তার আশেপাশে ফিসফিস করছে।
“The East Wing hides more than the mirror. There is a room—a circular one—where twelve arches stand. Each arch represents a watcher. The Watchers of the Kotha. They are not human. Not anymore.”
চিঠির বাকি অংশ কালি ছোপে ঢেকে গেছে। কেবল একটা বাক্য স্পষ্ট—
“If you see eyes where none should be, do not blink.”
ঈশান মাথা নিচু করে আবার আয়নার দিকে তাকায়। এবার সে বুঝতে পারে, আয়নার ফ্রেমের চারপাশে খোদাই করা ফুল-পাতার ভেতর ছোট ছোট চোখ আঁকা। আগে কখনো লক্ষ করেনি। মনে হয়, এগুলো নকশা নয়, কিছু একটা আরও গভীর কিছু। একটা চোখে যেন কালি পড়ে আছে—অন্ধকারে তাকিয়ে।
সে ব্যাগে চিঠিটা রেখে দেয়। তার মনে হতে থাকে, এই কোঠা শুধু ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে না, বরং নিজেই একটা জীবন্ত কাঠামো—যার চোখ আছে, কান আছে, স্মৃতি আছে।
পরদিন সকালে ডিসি অফিসে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এক কনস্টেবল, যিনি কোঠার পাশের গার্ড পোস্টে ছিলেন রাতে, এসে জানায়—“স্যার, আমি রাতে এক মহিলা দেখেছি, লাল শাড়ি পরে, কোঠার পেছনের বাগানে হাঁটছিল। আমি ডাক দিতেই সে ঘুরে তাকাল। চোখে কালি আর মুখে হাসি। তারপর এক ঝটকায় উধাও!”
ঈশান শিউরে ওঠে। সে চুপচাপ বলল, “তোমার কোনো অসুস্থতা আছে? হ্যালুসিনেশন?”
“না স্যার। আমি মিথ্যে বলছি না,” কনস্টেবল জোর গলায় বলে।
ঈশান আর কিছু না বলে অফিসের ফাইল ঘাঁটতে শুরু করে। নবাবী কোঠার ইতিহাসে কি কোনো মহিলা চরিত্র আছে যাকে ঘিরে রহস্য তৈরি হতে পারে?
একটা পুরনো ফাইল তার চোখে পড়ে—“Begum Nazneen’s Quarters — Report 1891”
নজর বুলিয়ে দেখে—
“Begum Nazneen, third wife of Nawab Ameen-ud-Daula, was kept in isolation after she was accused of treason—passing secrets to the British. She disappeared in the East Wing in 1760. Her room was sealed. It is said that she left behind a mirror that reflects more than the body.”
ঈশান তখনই সিদ্ধান্ত নেয়, আজ রাতেই সে কোঠার পূর্ব অংশের আরও ভিতরে প্রবেশ করবে।
রাত দশটা। চাঁদের আলো মেঘে ঢাকা। ঈশান ব্যাগে flashlight, নোটবুক আর রুমাল নিয়ে কোঠার ভিতরে ঢোকে। এবার সে একেবারে পূর্ব দিকের শেষ ঘরটায় যায়। দেয়ালের গায়ে আয়নার পেছনে সে হাত বুলিয়ে কিছু খুঁজে পায় না।
তবে নিচের মেঝেতে হালকা ঢালু একটা পাথর আছে। সে হাতের ব্যাগ থেকে ছোট স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে পাথরটা খোঁচা দেয়। খট করে কিছু একটা নড়ে যায়। মেঝের নিচ থেকে একটা চাপা শব্দ—গিয়ারের মতো কিছু ঘুরছে।
মেঝের মাঝখানটা হঠাৎ ফেটে গিয়ে ধীরে ধীরে এক গোপন দরজা খুলে যায়।
নিচে নামার জন্য এক সরু সিঁড়ি। আলো ফেলতেই দেখা যায় সিঁড়ির গায়ে গায়ে আঁকা চিত্র—আয়নার সামনে বসা এক নারী, চারপাশে চোখ, মুখহীন সৈনিকরা দাঁড়িয়ে আছে।
ঈশান নেমে যায় ধীরে ধীরে। নিচে নামতেই গন্ধটা বদলে যায়—ধূপ, আতর, আর কিছু পচা জিনিসের গন্ধ মিশে এক ধরনের বমি উদ্রেককারী আবহ তৈরি করে।
নিচে নেমে সে পৌঁছায় এক গোল ঘরে—যার দেওয়ালে বারোটি খোলা খিলান। প্রতিটি খিলানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তি। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে, যেন তত্ত্বাবধায়ক।
মেঝেতে খোদাই করা একটা লাইন চোখে পড়ে—
“Their eyes see the past. Their tongues shall speak only to the one who dares.”
ঠিক সেই মুহূর্তে বাতি নিভে যায়।
ঈশান থমকে যায়। অন্ধকার ঘরের গভীর নিস্তব্ধতায় হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে ওঠে—
“তুমি কি প্রস্তুত জানার জন্য, না ছুঁয়ে ফেলেছ ভুল করে?”
ঈশান flashlight অন করার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যাটারি ডেড।
আবার সেই কণ্ঠস্বর—এবার নারীকণ্ঠ—“আমার আয়নার কুয়াশা সরাও। সত্যকে স্পর্শ করো। কিন্তু মনে রেখো, চোখ বন্ধ করলে আর ফিরে পাবে না নিজেকে।”
৪
অন্ধকার, স্তব্ধতা আর এক নারীকণ্ঠ—এই তিনটি উপাদানে ঘেরা সেই প্রাচীন গোল কক্ষটা যেন ধীরে ধীরে তার নিজের সত্তা দিয়ে ঈশানকে গ্রাস করতে থাকে। হাতের flashlight কাজ করছে না, মোবাইলের আলো নিভে গেছে, আর গলার স্বর শুকনো হয়ে এসেছে। ঘরের প্রতিটি খিলানের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তিগুলো যেন নিঃশ্বাস ফেলছে। বাতাস ভারী, নোনা ঘাম ঈশানের কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
ঈশান নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে—“তুই ভয় পাবার লোক না। ভূত নেই, ভয় নেই। এটা কোনো প্রাচীন রিচুয়াল রুম হতে পারে। যারা বিশ্বাস করত কিছু দেবতা এই মূর্তির ভেতর বাস করে। হয়তো এগুলো নৃতত্ত্বের নিদর্শন।”
তবু মন মানে না।
সামনের দেওয়ালে যে আয়নাটা টাঙানো ছিল, তা এখন ঝাপসা। কাচের ওপরে জমে আছে ধুলোর স্তর, আর তার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে যেন কুয়াশা ঢুকে আছে আয়নার গায়ে। আয়নাটা এমন ভাবে কাত হয়ে আছে, যেন কেউ ইচ্ছে করে সরিয়েছে দৃষ্টি থেকে কিছু আড়াল করতে।
ঈশান এগিয়ে যায়। হাতের রুমাল দিয়ে আয়নার কাচ মুছতে শুরু করে।
প্রথমে কেবল নিজের ছায়া দেখা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে কুয়াশা সরতেই আয়নার মধ্যে ফুটে উঠতে থাকে এক ঘোর লাগা দৃশ্য—একটি মেয়ের মুখ। গভীর চোখ, লাল টিপ, মুখে ভয় আর অভিমান মেশানো ছায়া।
সে ফিসফিস করে বলে, “তুমি কি এসেছো মুক্তি দিতে, না শুধু জানতে?”
ঈশান চুপ। মেয়েটির ঠোঁট নাড়িয়ে চলেছে, কিন্তু বাইরে কোনো আওয়াজ নেই। যেন নিঃশব্দ ভাষায় কথা বলছে সে।
হঠাৎ আয়নার ভিতরেই বদলে যেতে থাকে দৃশ্য। প্রাসাদের ভেতরে এক কক্ষ—বেহালা, তবলা আর এক মহিলা—লাল ঘোমটা টানা। তিনি গান করছেন।
“না জানি কোন জন্মে ছিল দেখা,
এই চোখে আজ তারই রেখা…”
তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসার। একজন তাদের মধ্যে থেকে উঠে এসে মেয়েটির ঘাড়ে হাত রাখে। মুহূর্তেই দৃশ্যটা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে—মেয়েটি ছুরি বের করে সেই অফিসারের বুক চিরে দেয়। চারপাশে আতঙ্ক, চিৎকার, আর তারপর এক বিকট আগুনের শিখা—যেটা সব গিলে নেয়।
ঈশান হঠাৎ পেছনে পড়ে যায়। আয়নাটা কাঁপছে, ঘরের মাটিতে একটা বিকট কম্পন অনুভব করে সে। পাশের একটি খিলানের মূর্তির চোখ থেকে যেন অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
ভয়ে আর কৌতূহলে ভীত ঈশান দেয়ালের গায়ে হেলান দেয়। সেই মুহূর্তে তার পেছনের পাথরের দেওয়ালটা একটু সরে যায়। একটা গোপন দরজা।
ঈশান ভেতরে ঢোকে।
এটা একটা ছোট ঘর। মাঝখানে একটি পাথরের বিছানা, যার ওপর মেলে রাখা এক মহিলা কঙ্কাল। পরনে লাল শাড়ির ছিন্নভিন্ন অংশ, কপালে ঝাপসা টিপের দাগ। তার মাথার পাশে রাখা একটা ছোট কাঠের বাক্স। ঈশান ধীরে ধীরে বাক্সটা তোলে। ভেতরে আবার একটি খাম। এবার বাংলা ভাষায় লেখা—
“নাজনীন বেগমের শেষ ইচ্ছা”
ঈশান খাম খুলে পড়ে—
“যে আয়নায় আমি প্রতিদিন নিজের মুখ দেখেছি, সেখানেই আমি দেখেছি আমার পরিণাম। তারা বলেছিল আমি বিশ্বাসঘাতক, অথচ আমি শুধু সত্য চেয়েছিলাম। ইংরেজ অফিসার ফিঞ্চ চেয়েছিল আমার হাতের নকশা—নবাবের গুপ্তচিত্র। আমি মানিনি। আমি জেনেছিলাম, তারা চায় কুঠির নিচের নীলরেখা। সেই নীলরেখা যা দিয়ে লেখা হয়েছিল গোপন চুক্তি—মীরজাফর আর ব্রিটিশদের মধ্যে। আমি সেই চিঠি পুড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। তারা আমাকে বন্দি করে, আগুনে পোড়ায়। আমার শরীর গেল, কিন্তু আমার চোখ রয়ে গেছে আয়নায়। যদি কখনো কেউ সাহস করে আয়নার কুয়াশা সরাতে পারে, তবে তাকে বলো—নীলরেখার নিচে আরও একখানা দলিল লুকিয়ে আছে। সেটা পেলে সত্য প্রকাশ পাবে। কিন্তু সাবধান, যেই সেই সত্য জানে, সে আর আপন মানুষ থাকে না। তাকে নজর রাখে ‘প্রাসাদের চোখ।’”
চিঠিটা পড়ে ঈশান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথার ভেতর এখন কেবল একটাই শব্দ—“নীলরেখা…নীলরেখা…”
এটা কি শুধুই কালি? না কি কোনো চিহ্ন?
সে ঘর থেকে বেরিয়ে আবার সেই আয়নার সামনে আসে। এবার আয়নার পাশের দেয়াল ঘেঁষে খুঁজে পায় এক গর্ত। তার মধ্যে নীলচে রঙের কিছু যেন হালকা ঝিলমিল করছে। সে মাটির ওপর হাত রাখে—ঠান্ডা, তীব্র কিছুর ছোঁয়া। সে বুঝতে পারে, এটা জল না, এটা কোনো রাসায়নিক পদার্থ—হয়তো সেই ‘নীল কালি’—যা দিয়ে প্রাচীন দলিল লেখা হতো।
তবে এই জায়গার ভিতর আরও গভীর কিছু আছে। দেয়ালের গায়ে একটা ম্যুরাল আঁকা—যেখানে এক বেগম এক হাতে আগুন, আর এক হাতে আয়না ধরে আছে। তার পেছনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে বারোটা চোখ।
ঈশান হঠাৎ শুনতে পায় ওপরে মানুষের শব্দ। কেউ হয়তো কোঠায় ঢুকেছে। গলার আওয়াজ ভেসে আসে—
“ভিতরে কেউ আছে? ডিসি সাহেব?”
ঈশান চুপ করে থাকে। সে জানে এই সন্ধিক্ষণে বাইরে যাওয়া মানেই সত্যের পথ থেকে পিছিয়ে যাওয়া।
সে আবার সেই ম্যুরালের সামনে দাঁড়ায়। এবার গায়ে হাত দিতেই ম্যুরাল নড়ে যায়, আর নিচে দেখা যায় আরেকটি ছোট পাথরের দরজা।
তার গায়ে খোদাই করা—
“এখানেই ছিল চুক্তি, এখানেই জন্ম সত্যের।”
৫
দেয়ালের সেই ম্যুরালের নিচের পাথরের দরজাটা খুব বড় নয়, তবে বেশ মজবুত। ঈশান তার হাতের স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে আস্তে আস্তে খোঁচাতে থাকে চৌকাঠের প্রান্তে। একসময়ে দরজাটা একটু কাঁপে, আর ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায়। তার ওপাশে একটা সঙ্কীর্ণ করিডর—কেমন একটা দম বন্ধ করা পথ, যার ভিতর দিয়ে বাতাস বয়ে আসে অতীতের গন্ধ নিয়ে।
করিডরের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে ঈশানের মনে পড়ে নাজনীন বেগমের সেই চিঠির কথা—”নীলরেখার নিচে লুকানো রয়েছে সত্যের দলিল।” এই করিডর কি তাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে?
পাঁচ-ছয় পা হাঁটার পর করিডরটা শেষ হয় এক গোলাকার ছোট ঘরে। ছাদের উপরে ছোট একটি ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে, আর দেওয়ালের চারপাশে ঘিরে আছে ধবধবে সাদা পাথরের ফলক। ঠিক মাঝখানে একটি পাথরের স্তম্ভ, যেটা যেন মঞ্চের মতো করে তৈরি। স্তম্ভের গায়ে খোদাই করে আঁকা—
“ঈশ্বরের নামেই চুক্তি, রক্তে লেখা বিশ্বস্ততা, আর নীলরেখায় আঁকা বিশ্বাসঘাতকতা।”
ঈশানের চোখ কপালে ওঠে। সে এবার পাথরের স্তম্ভের চারপাশে ঘুরে দেখতে থাকে কিছু লুকোনো অংশের সন্ধানে। স্তম্ভের পেছনের দিকটা একটু নিচু, সেখানে কিছু খাঁজ দেখা যায়। হাত দিলেই টের পায়—একটা স্লাইডিং প্যানেল। সে চাপ দিতেই প্যানেলটা খুলে যায়।
ভেতরে কাঠের পাতলা বাক্স, মোড়ানো মসলিন কাপড়ে। কাঠ খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা দলিল—তামার পাতার ওপরে খোদাই করে লেখা। কিন্তু সেই খোদাই ঢাকা পড়ে আছে ঘন নীল কালি দিয়ে। কালি এমনভাবে দেওয়া যেন কেউ ইচ্ছা করেই ঢেকে রেখেছে পাঠযোগ্যতা।
পাশেই একটা ছোট নোট পাওয়া যায়—পুরানো ফারসি আর বাংলার মিশ্র ভাষায় লেখা:
“এ হল সেই চুক্তিপত্র, যেখানে মীরজাফর তার রক্তে স্বাক্ষর করেছেন। ক্লাইভের সঙ্গে মিলেমিশে নবাব সিরাজের পতনের বন্দোবস্ত হয়েছিল এই পাতাতেই। নীল কালি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সত্য, কারণ কিছু সত্য পৃথিবীর জন্য নয়। যদি কেউ এটি পড়তে চায়, তাকে চাই ছায়ার আলো এবং আয়নার কুয়াশা।”
ছায়ার আলো এবং আয়নার কুয়াশা—মানে? ঈশান কিছুই বুঝতে পারে না। সে দলিলটা ব্যাগে রাখে, আর বুঝতে পারে, এই জিনিস যদি সত্যিই বাইরে প্রকাশ পায়, তাহলে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে।
হঠাৎ পেছনে আওয়াজ—ধাপে ধাপে কেউ নিচে নামছে। ঈশান flashlight বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে যায়। করিডরের দিক থেকে মৃদু আলো এসে পড়ছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে কারো পায়ের শব্দ।
কণ্ঠস্বর শোনা যায়—“স্যার, আপনি ভেতরে আছেন?”
শেখ সিরাজের গলা।
ঈশান হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। “আমি এখানে, নিচে।”
সিরাজ নেমে এসে বলে, “আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না স্যার। কোঠায় লোকে বলাবলি শুরু করে দিয়েছে—আপনি হয়তো… হারিয়ে গেছেন।”
ঈশান গম্ভীর মুখে বলে, “সিরাজ, তুমি জানো মীরজাফর কী করেছিল?”
সিরাজ মাথা নিচু করে, “জানি স্যার। এ শহরের মানুষ সেই অভিশাপ এখনও বইছে। কেউ উচ্চারণ করে না, কিন্তু জানে—এই কোঠা সেই বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী।”
ঈশান ব্যাগটা শক্ত করে ধরে বলে, “তবে সেই বিশ্বাসঘাতকতার দলিল আমি পেয়েছি। কিন্তু এখন প্রশ্ন—এটা কি আমি প্রকাশ করব?”
সিরাজ বলে, “আপনি যদি সত্য জানেন, তবে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এই সত্য আপনাকে রক্ষা করবে, না ধ্বংস করবে।”
ঈশান মাথা নাড়ে। সে বুঝতে পারছে, শুধুমাত্র ইতিহাসের ভার সে বহন করছে না, বরং একটা শহরের আবেগ, গৌরব এবং যন্ত্রণাও তার কাঁধে।
পরদিন সকালে শহরের একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সে যান। মিউজিয়ামের কিউরেটর মীনাক্ষী রায়, যিনি পুরনো দলিল পড়ায় পারদর্শী, তার কাছে দলিলটা নিয়ে যান। চুপচাপ একটা ঘরে বসে দলিল খুলে দেখান।
মীনাক্ষী প্রথমে দলিল দেখে চমকে ওঠেন। তারপর কালি ঘষে পরীক্ষা করে বলেন, “এইটা তাম্রলিপি, কিন্তু উপরটা রঞ্জিত কালি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এটা সাধারণ কালি নয়—নীলরেখা বলা হয় এর নাম। এটা ভারতবর্ষে কিছু গোপন নথি ঢাকতে ব্যবহৃত হতো—বিশেষত বিদেশি শক্তি এবং রাজাদের মধ্যে চুক্তির সময়।”
ঈশান চুপ করে বলেন, “তাহলে আপনি পড়তে পারবেন?”
মীনাক্ষী চোখ সরু করে বলেন, “পারব, তবে সময় লাগবে। তবে আপনি জানেন কি, এমন কালি সাধারণ আলোয় দেখা যায় না? এর জন্য বিশেষ আলো প্রয়োজন। আপনি যদি ‘ছায়ার আলো’ বলার মানে বুঝে থাকেন, তবে বুঝতে পারবেন—এটা ইনফ্রারেড স্পেকট্রামে পড়ে।”
ঈশান বুঝতে পারে। আয়নার কুয়াশা মানে ইনফ্রারেড হিট বা থার্মাল রিফ্লেকশন। তার মানে আয়নাটা শুধু প্রতিচ্ছবি দেখায় না, বরং উষ্ণতার ভিত্তিতে তথ্য ফাঁস করে।
সে মীনাক্ষীকে বলে, “আমাকে একবার থার্মাল ক্যামেরা সহ আয়নাটার সামনে নিয়ে যেতে হবে। আমি একটা সত্য প্রকাশ করতে চাই—যা দুইশো বছর চাপা পড়ে আছে।”
রাত নামার আগে আবার নবাবি কোঠায় যায় ঈশান, সঙ্গে মীনাক্ষী এবং একটি বিশেষ থার্মাল স্ক্যানার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে দলিলটি উঁচু করে আয়নার দিকে তোলে।
স্ক্যানার অন করা মাত্রই কাঁচে ফুটে ওঠে গোপন খোদাই—ফারসি ও ইংরেজিতে লেখা:
“I, Mir Jafar Ali Khan, do hereby commit under oath with the East India Company, to withdraw support from Nawab Siraj, and facilitate British entry into Murshidabad on the promise of power and pension.”
সত্য স্পষ্ট। ইতিহাস চেঁচিয়ে বলে উঠে—দেশদ্রোহিতার প্রমাণ এইখানেই আছে।
ঈশানের বুক ভারী হয়ে ওঠে।
মীনাক্ষী চোখ তুলে বলে, “আপনি কি চাইলে এটা সংবাদে দিতে? নাকি… চিরতরে এটাকে কোঠার বুকেই সমাধি করে রাখবেন?”
ঈশান আয়নার দিকে তাকায়। সেই মেয়েটির মুখ যেন আবার একবার ভেসে ওঠে—নাজনীন বেগম, যার মুখে এখন আর অভিমান নেই, বরং প্রশান্তি।
ঈশান আস্তে করে বলে, “না। আমি চাই সত্য বাঁচুক। কিন্তু সেটা যেন শুদ্ধতার সঙ্গে আসে, উত্তেজনার সঙ্গে নয়। আমি এটাকে ইতিহাসের অংশ করব, চিৎকার নয়।”
৬
ঈশান নবাবী কোঠার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, রাত তখন গভীর। শহরের ভেজা বাতাসে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন প্রাচীন কোনো ক্লান্ত দেহ এখন বিশ্রামে গেছে। পেছনে পড়ে আছে একরাশ পাথর, এক ব্যাগ ভরা গোপন দলিল, আর তার চোখে-মনেও বয়ে চলেছে ইতিহাসের ঢেউ।
সত্য পাওয়া গেছে। চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে মীরজাফরের সেই বিশ্বাসঘাতকতার দলিল, ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সূচনা, আর তার ফলশ্রুতিতে এক দীর্ঘ পরাধীনতার সূচনা। তবে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এটা কী করা উচিত? কীভাবে ব্যবহার করা উচিত?
পরদিন সকালেই ঈশান মুর্শিদাবাদের জেলা প্রশাসনের বৈঠকে বসেন। জেলাশাসক হিসেবে তার মতামত গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেই সঙ্গে সে জানে কিছু সিদ্ধান্ত তার একার পক্ষে নেওয়া ঠিক নয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলার কিছু বয়স্ক ইতিহাসবিদ, প্রশাসনিক অফিসার, এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংস্থার প্রতিনিধি। কাগজপত্র ছড়িয়ে রাখা হলো টেবিলের ওপর, দলিলটা বিশেষ কাচের কেসে রাখা হয়েছে, যাতে ছোঁয়া না যায়।
মীনাক্ষী রায় শুরু করেন, “এই দলিল ভারতের ইতিহাসে একটা যুগান্তকারী প্রমাণ হতে পারে। আমরা এতদিন যেটা ধারণা করতাম, সেটা এবার দলিলভিত্তিক সত্য। কিন্তু এই প্রকাশে ঝুঁকিও আছে। এটা কেবল মীরজাফর বা ক্লাইভের নামে নয়, এটা নবাবি শাসনের একটি গভীর কলঙ্ক।”
ঈশান শান্ত গলায় বলেন, “আমি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটাকে ‘heritage sensitive classified document’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার কথা ভাবছি। যেন এই দলিল আর্কাইভে থাকে, গবেষকেরা দেখার অনুমতি পান, কিন্তু একে নিয়ে পাবলিক হুল্লোড় না হয়।”
এক প্রবীণ শিক্ষক প্রশ্ন তোলেন, “তবে কি আমরা সত্যকে আড়াল করবো, শুধু শান্তির জন্য?”
ঈশান চুপচাপ উত্তর দেন, “সত্যকে নয়, চিৎকারকে নিয়ন্ত্রণ করবো। শহরের আত্মার ভার আরও চেপে বসুক, এটা আমি চাই না। বরং এই দলিল যেন আমাদের শিক্ষা দেয়—ইতিহাস শুধু রাজার নয়, প্রজারও হয়।”
সবাই একমত হয়—দলিলটি থাকবে ডিসি অফিসের একটি নির্দিষ্ট কক্ষের ভেতরে, যেখানে থার্মাল কাচ ও নিরাপত্তা থাকবে। এটিকে বলা হবে ‘Murshidabad Confidential Archive Room’। আর তার সঙ্গে থাকবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং নাজনীন বেগমের আত্মত্যাগের বিবরণ।
—
তবে ঈশান জানে, কাজ এখানেই শেষ নয়।
সে চুপচাপ একদিন সন্ধ্যায় আবার নবাবি কোঠায় যায়। সঙ্গে নেয় সাদা গোলাপ, একটি ধূপকাঠি, আর সেই চিঠিটা—যেটা নাজনীন বেগম তার মৃত্যুর আগে লিখেছিলেন।
পূর্ব প্রান্তের সেই আয়নার সামনে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। চারপাশে পাথরের দেয়াল, নীরবতা, বাতাসে ধূপের গন্ধ। আয়নাটা ঝাপসা হয়ে আছে, কিন্তু আর ভয় করে না।
ঈশান বলে, “আমি তোমার কণ্ঠ ছিলাম। তুমি যা চেয়েছিলে, আমি তা করেছি। তুমি অভিশাপ হয়ে থেকেছো বহু বছর, আজ তোমাকে মুক্তি দিলাম।”
সে ধূপ জ্বালায়, আয়নার সামনে সাদা গোলাপ রাখে। আয়নার গায়ে আবার একবার ঝিলিক ওঠে—হালকা কুয়াশার ভেতর সেই মুখটা দেখা যায়, নাজনীন বেগমের। এবার মুখে হাসি।
তারপর আয়নার কাঁচে ধীরে ধীরে এক লাইন ভেসে ওঠে—
“ধন্যবাদ। ইতিহাস এবার নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।”
ঈশান পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে। কোঠার দরজায় দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকায়—আলো নিভে গেছে, আয়নাটার প্রতিচ্ছবি মুছে গেছে, যেন কালের গর্ভে সেই নারীমুখ, সেই অভিমান আর অপেক্ষা চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে।
এর কয়েক সপ্তাহ পর, মুর্শিদাবাদের ডিসি অফিসে একটি ছোট আকারের স্থায়ী প্রদর্শনী শুরু হয়—“The Hidden Letters of Nawabi Kotha”। মীনাক্ষী রায়ের তত্ত্বাবধানে সেখানে রাখা হয় প্রাচীন কাগজপত্র, নবাবি আমলের দলিলের কপি, থার্মাল ফটোগ্রাফি, এবং নাজনীন বেগমের কণ্ঠে লেখা সেই অন্তিম চিঠির প্রতিলিপি।
শহরের মানুষ আসতে শুরু করে। কেউ ইতিহাস দেখতে আসে, কেউ শুধু জানতে চায় ‘ঐ বাড়িটা কি সত্যি অভিশপ্ত ছিল?’
তবে সবাই একমত—ঐ কোঠার দেয়ালের ভেতর যেন নিঃশব্দে কেউ আজও হেঁটে বেড়ায়। হয়তো নাজনীন নিজে, হয়তো অতীতের এক ছায়া, যা চুপচাপ দেখে, বলে না কিছুই।
ঈশান এখন আর ডিসি নন। বদলি হয়ে গেছেন অন্য রাজ্যে। কিন্তু তার টেবিলের ড্রয়ারে একটা পুরনো নীলচিঠি আছে, যেটা কখনো সরকারীভাবে নিবন্ধিত হয়নি। সাদা খামে মোড়া, চিঠির ওপরে লেখা—
“To Whom It May Concern — Murshidabad, 1760”
সে আজও সেটা মাঝে মাঝে পড়ে, আয়নার দিকে তাকায়, আর ভাবে—আমরা যা ইতিহাস বলি, তার অনেকটা জলের নিচে থাকা বরফের মতো। অদেখা, অথচ প্রবল।
৭
ডিসি পদ থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার প্রায় ছয় মাস পর ঈশান চট্টোপাধ্যায় আবার ফিরলেন মুর্শিদাবাদে। তবে এবার সরকারি সফরে নয়, নিঃশব্দে, একজন আগন্তুকের মতো। গরমের ছুটি পড়েছে, কলকাতা থেকে রাতের ট্রেনে উঠে সরাসরি সকালবেলায় পৌছলেন লালবাগ স্টেশনে। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক টান, যেন কারও ডাক শুনে এসেছেন।
গাড়ি নিয়ে সোজা চলে এলেন নবাবি কোঠার সামনে। কোঠাটিকে ঘিরে এখনো একটা সুনসান, ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ বিরাজমান। যদিও এখন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাসাদ সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে, খিলানগুলোতে কাঠামো সংরক্ষণের রেলিং বসানো হয়েছে, প্রবেশদ্বারে একটা ছোট ফলক লাগানো হয়েছে:
“Nababi Kotha — Classified Historical Zone. Entry by permission only.”
ঈশান জানেন, তিনিই এই ফলক বসানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তার প্রবেশের জন্য কোনো অনুমতি দরকার হয় না। কোঠার ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো, যেন জায়গাটা তাকে চিনে ফেলেছে। বাতাস একই রকম, কুয়াশার গন্ধও।
তবে এবার তার উদ্দেশ্য ভিন্ন।
তার হাতের ছোট ব্যাগে আছে একটি নতুন চিঠি—মীনাক্ষী রায়ের লেখা। তাতে বলা হয়েছে, ডিসি অফিসের আর্কাইভ রুমে রাখা সেই তাম্রলিপির নীলরেখার নিচে দেখা গেছে আরও এক লাইন খোদাই—এবার রক্তের দাগের মতো কিছুর চিহ্ন। ইনফ্রারেড ক্যামেরায় পরিষ্কার হয়েছে। লাইনটি ফারসিতে লেখা, কিন্তু বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়:
“এই চুক্তির সাক্ষী একজন নয়, চারজন। চতুর্থজন এখনও অদৃশ্য।”
ঈশান থেমে গেলেন আয়নার ঘরের ঠিক আগে। পুরনো কাঠের দরজাটা একটু ভাঙা, কিন্তু ভেতরের আয়নাটা আজও অক্ষত। তার প্রতিচ্ছবির পাশে কুয়াশার ভেতর যেন এক মুহূর্তের জন্য কেউ হাসল, তারপর মিলিয়ে গেল।
তিনি ভিতরে ঢুকে সেই আয়নার সামনে দাঁড়ালেন, হালকা চাপ দিয়ে দেয়ালের খিলান সরিয়ে নিচে নামলেন সেই ‘Watchers Room’-এ, গোলাকৃতি বারোটি খিলান ঘেরা ঘর।
সবই আগের মতো, কিন্তু এবার কিছুটা পরিষ্কার—দেওয়াল ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে, পাথরের মূর্তিগুলোতে নম্বর বসানো হয়েছে, নোট লেখা হয়েছে প্রতিটি খিলানের পাশে। কিন্তু ঈশান জানেন, এই প্রক্রিয়াকরণে ইতিহাস ধুয়ে মুছে যায় না। বরং লুকিয়ে যায় আরেক স্তরে।
তিনি ফিরে এলেন সেই ‘তাম্রচুক্তি’র কাছে। পাথরের স্তম্ভের নিচে রাখা কাচের কেসের ভিতরে আজও সেই কালি-ঢাকা খোদাই। তার পাশে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া সেই ইনফ্রারেড চিত্রের কপি লাগানো হয়েছে। যেখানে ‘চতুর্থজন’-এর কথা বলা হয়েছে।
চতুর্থজন কে?
মীরজাফর, ক্লাইভ, আর একজন অনুলিপিকার—এই তিনজনের নাম তো আছে। তবে চতুর্থজন?
এই প্রশ্নই এখন পাগলের মতো তাড়া করছে ঈশানকে।
—
ঈশান বিকেলে গিয়ে হাজির হন মীনাক্ষী রায়ের কাছে, বর্তমানে মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ কমিটির প্রধান। তার অফিস ভরে আছে ধুলো ধূসর বই, থার্মাল স্ক্যানের প্রিন্টআউট আর পুরনো ফাইল।
মীনাক্ষী বলেন, “এই চতুর্থজনকে নিয়ে কোনো নথি কোথাও নেই। আমরা একমাত্র অনুমান করতে পারি—এটা হয়তো একজন অনামা চর, অথবা কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।”
ঈশান একটু চুপ করে বলেন, “তুমি বলেছিলে সেই আয়নাটা ‘উষ্ণতার প্রতিফলন’ ধরে রাখতে পারে। কেউ যদি তার স্মৃতি আয়নার সামনে প্রকাশ করে—তাহলে কি কিছু ফুটে উঠবে?”
মীনাক্ষী বিস্মিত, “তুমি কি বলতে চাও… কেউ যদি জানে সেই সময়ের কিছু গোপন কথা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো সেটা প্রতিফলিত হতে পারে?”
“হ্যাঁ,” ঈশান চোখে একাগ্রতা নিয়ে বলেন, “আমি সেই চেষ্টা করতে চাই।”
—
রাত দশটা। নবাবী কোঠার দরজা আবার একবার খুলে যায়। ঈশান একাই প্রবেশ করেন আয়নার ঘরে, সঙ্গে একটি বিশেষ ইনফ্রারেড রেকর্ডার, যা মীনাক্ষী তাকে দিয়েছেন।
তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করেন।
“আমি ঈশান, ২০২৩ সালের ডিসি। আমি জানতে চাই—চতুর্থজন কে? তুমি যদি পারো, দেখাও তাকে। তার ছায়া, তার নাম, তার সই—যা কিছু রেখে গেছে সে।”
আলো নিভে যায়। ইনফ্রারেড ক্যামেরা কাজ করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর আয়নার কাচের ওপরে একটা নতুন ছবি ফুটে ওঠে। একটি পুরুষ মুখ—মাথায় রেশমি পাগড়ি, চোখে গভীরতা, আর ঠোঁটে চাপা এক চিহ্ন। তার নিচে লেখা নাম—“Hakim Meer Faheem.”
ঈশান চমকে ওঠে।
এই নামটা আগে কোথাও পড়েননি। তবে এত কিছু জানার পর এটা স্পষ্ট—এই হাকিম ছিলেন প্রাসাদের কেউ, সম্ভবত নবাবের বিশ্বস্ত চিকিৎসক, যিনি হয়তো মীরজাফরের গোপন সহযোগী ছিলেন।
নিচে ইনফ্রারেড প্রতিফলনে দেখা যায় তার লেখা সই, আর লেখা—
“আমি চার নম্বর সাক্ষী। আমার কাজ ছিল নীল কালি তৈরি ও প্রয়োগ। সত্যকে ঢেকে রাখা আমার শর্ত ছিল। কিন্তু আমি জানি, একদিন কেউ এ আয়নার সামনে এসে প্রশ্ন করবে—সেই দিন আমি নিজেকে প্রকাশ করব।”
ঈশান স্তম্ভিত হয়ে বসে পড়েন। এতদিন যা শুধু অনুমান ছিল, এখন তা চোখের সামনে লেখা—রক্তের সই, চতুর্থ সাক্ষী, আর সত্য চাপা দেওয়ার স্বীকৃতি।
—
পরদিন শহরের সবচেয়ে পুরনো কবরখানায় যান ঈশান। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক কোণায় পাথরচাপা কবরের ওপর ভাঙা এক ফলক—ঝাপসা লেখা, তবু বোঝা যায়—“Hakim Meer Faheem, 1767”
কবরের সামনে ঈশান মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। হাতে একটি সাদা খাম। ভেতরে সেই চতুর্থ সই-এর অনুলিপি, ইনফ্রারেড ফটোগ্রাফ, আর একটি হাতে লেখা চিঠি—নিজের। যাতে লেখা—
“তোমাকে ধন্যবাদ, হাকিম সাহেব। তুমি সত্য চাপা দিয়েছিলে, কিন্তু চিরতরে নয়। আমি তোমার সেই উত্তরসূরি, যে সত্যটা জানলো—বুঝে শুনে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। ইতিহাস আজ চুপচাপ, কিন্তু চিরকাল নয়।”
সে চিঠিটা কবরের পাশে পাথরের নিচে রেখে দেয়। বাতাসে যেন একটা হালকা গন্ধ ভেসে আসে—আতরের, নাকি মাটি ভেজা সত্যের?
৮
মুর্শিদাবাদের রাত গভীর হলে তার বাতাস বদলে যায়। মনে হয়, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি গলি, প্রতিটি ইট যেন নিঃশব্দে কিছু বলতে চায়। ঈশান চট্টোপাধ্যায় সেই নীরব ভাষা শুনতে শিখে গেছেন। আজ তিনি জানেন, প্রাসাদের ভাঙা দেওয়ালও কথা বলে—যদি কেউ তাদের কানে কানে শোনে।
হাকিম মীর ফাহিমের কবর থেকে ফিরে এসে ঈশান চুপচাপ বসে ছিলেন লালবাগের এক পুরনো গেস্ট হাউসে। তার সামনে ছড়ানো ছিল একটি খাতা, থার্মাল ফটোর কপি, আর তার নিজের হাতে লেখা কয়েকটি নোট। এক একটি শব্দ, এক একটি ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়া দংশন।
কিন্তু প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত—হাকিম কেন এই সত্য চাপা দিয়েছিলেন? তিনি তো কেবল একজন হাকিম ছিলেন, চিকিৎসক। অথচ তিনিই ছিলেন সেই নীল কালি প্রস্তুতকারী, যিনি চুক্তির উপর সত্য চাপা দিয়েছিলেন।
ঈশান গভীর রাতে আবার খুললেন সেই নীলচিঠি—Lt. Edward Finch-এর চিঠি, যেটি তাঁকে প্রথম পথ দেখিয়েছিল।
চিঠির প্রথম অংশে তো আগেই পড়া হয়েছে—কিন্তু এবার সে মনোযোগ দিল সেই অংশটিতে যেটা তখন ছেঁড়া ছিল। কাগজের সেই অংশ বিশেষ আলোয় তুলে ধরে এবার একটি শব্দ স্পষ্ট দেখা গেল—“Hakim…”
তার নিচে ভগ্ন ভাষায় লেখা—
“…he knows the formula. He is not just a healer. He’s a chronicler.”
ঈশান থমকে যায়। ক্রনিকলার? মানে ইতিহাস রক্ষাকারী?
পরদিন সকালে ঈশান গিয়ে হাজির হন মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ আর্কাইভে, মীনাক্ষী রায়ের কাছে। এবার সে শুধু কাগজ নয়, সত্যের রসায়ন খুঁজতে চায়।
“মীনাক্ষী, যদি হাকিম মীর ফাহিম সত্যিই একজন chronicler হয়ে থাকেন, তাহলে তার নিজের কোনো লেখা কি আমাদের হাতে আছে?”
মীনাক্ষী ভ্রু কুঁচকে বলেন, “তা তো নেই। তবে লালবাগের দরবার লাইব্রেরিতে এক অদ্ভুত পুঁথি আছে, যার লেখক নামহীন। সবাই বলে, সেটা নকশা, অথচ ভাষা মেলে না। কেউ বুঝতেও পারেনি সেটা কী।”
ঈশান অনুরোধ করেন সেই পুঁথি দেখতে।
দুপুরে তিনি পৌঁছান লালবাগ দরবার লাইব্রেরিতে। বিশাল কাঠের তাকভর্তি ধুলোপড়া চামড়ার খাতা, পুঁথি আর শ্বেতপত্র। লাইব্রেরির রক্ষণাবেক্ষণকারী এক বৃদ্ধ, মাওলানা করিমউদ্দিন, তাকে ভিতরে নিয়ে যান।
একটা নির্দিষ্ট তাক থেকে বের করে আনেন সিল্কে মোড়ানো এক পুঁথি, যার গায়ে লেখা নেই কিছুই। খুলতেই দেখা যায় কালি দিয়ে আঁকা কিছু চিহ্ন, লিপি নয়, যেন সাংকেতিক চিত্র। প্রতিটি পাতায় এক একটি প্রতীক—চক্র, চোখ, আগুন, আয়না—এবং একটি নির্দিষ্ট ‘নীল রেখা’ যা পাতার মাঝ বরাবর চলে গেছে।
ঈশান চোখ সরু করে দেখে।
“এটা হাকিম ফাহিমেরই লেখা,” সে নিশ্চিত হয়, “কারণ তিনিই এই চিহ্ন ব্যবহার করেছেন আয়নার ঘরের ম্যুরালে।”
মীনাক্ষী বলেন, “তুমি বলতে চাও, এটা একটা সাংকেতিক পুঁথি? তবে কোড কার কেটে দেবে?”
ঈশান হালকা হাসে। “আয়না। আয়নাই খুলতে পারে তার রহস্য।”
রাত। কোঠা আবার একবার ঈশানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে নিঃশব্দে প্রস্তুত।
সে আয়নার ঘরে এসে দাঁড়ায়, হাতে সেই পুঁথি। পাতা উল্টে উল্টে আয়নার সামনে ধরতে থাকে প্রতিটি চিত্র।
তখনই ঘটতে শুরু করে বিস্ময়কর কিছু।
আয়নার কাচে প্রতিফলিত হতে থাকে নতুন দৃশ্য। প্রতিটি চিত্রের পেছনে লুকিয়ে থাকা মানে ফুটে ওঠে। চক্র মানে ছিল একদিন—’চুক্তির সময় চক্রাকার কক্ষে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন’, চোখ মানে—’তারা যাঁরা দেখেও চুপ ছিলেন’, আগুন—’সেই আগুন যা সব পুড়িয়ে দেয়নি’, আয়না—’যা কেবল শরীর নয়, ইতিহাসও দেখায়’।
তখনই দেখা যায় শেষ পাতাটি আয়নার কাচে এক বিশেষ ছায়া ফেলছে। আয়নার কাচে ঝিলমিল করে ফুটে ওঠে একটা রক্তাক্ত তালিকা। এক একটি নাম, তার পাশে সই, এবং তারপর—“Language: Dead”
মীনাক্ষী বিস্ময়ে বলেন, “এরা সবাই তো আদালতের কোনো রেকর্ডে নেই!”
ঈশান চুপ করে দাঁড়িয়ে বলেন, “কারণ, ইতিহাস লিখেছিল জয়ীরা। যারা হারিয়ে গিয়েছিল, তারা চুপ থেকেছিল। এই পুঁথিটা মৃতদের ভাষা—যারা নিজেদের কথা কোনোদিন বলতে পারেনি।”
তালিকার একেবারে নিচে লেখা—“The one who sees this becomes the new chronicler.”
ঈশানের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে যায়।
তাহলে কি এখন থেকে তার কাজ শুধু একজন প্রশাসক নয়—একজন রক্ষাকর্তাও?
একজন নতুন ইতিহাস লেখক, যার লেখায় থাকবে না শুধু বিজয়ীদের গান, থাকবে পরাজিতের কান্না, নিঃশব্দ বেগমদের অভিমান, এবং সেই হাকিমের নাম—যিনি নিঃশব্দে রচনা করে গিয়েছিলেন ইতিহাসের ছায়া ভাষা।
সকালে ঈশান মীনাক্ষীকে বলেন, “এই পুঁথির দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। এটাকে শুধু মিউজিয়ামের ভেতর কাচে বন্দি রাখা চলবে না। এটাকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে—চুপচাপ, অবিরত।”
মীনাক্ষী মাথা নাড়েন, “তুমি জানো তো, তুমিই এখন সেই ‘Eyes of the Palace’। প্রাসাদের চোখ এখন তোমার মধ্যেই। দেখবে তুমি, বলবে তুমি, লিখবে তুমি।”
ঈশান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, নবাবি কোঠার ছায়া-ভেজা কাঠামোর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
তার চোখে এখন আর শুধু অতীত নয়, সেখানে ভবিষ্যতের রেখাও স্পষ্ট।
৯
ঈশান চট্টোপাধ্যায় আবারও দাঁড়িয়ে আছেন সেই জানালার পাশে, যেখান থেকে নবাবী কোঠা দেখা যায়। বাইরে সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, কুয়াশার চাদর সরিয়ে পুরনো ইট আর শ্যাওলার গায়ে উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে দিচ্ছে। অথচ তার চোখে ঝিলমিল করে ভেসে উঠছে আয়নার ঘরে দেখা সেই রক্তাক্ত তালিকার নামগুলো। একেকটা নাম মানে একেকটা কবর, একেকটা হারিয়ে যাওয়া গলা।
এই শহরের বুকের নিচে একটা সমান্তরাল ইতিহাস চলেছে, স্রোতের নিচে জমে থাকা বালির মতো—স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু টের পাওয়া যায়।
ঈশান জানেন, তিনি এখন আর কেবল একজন প্রশাসক নন, একজন ‘চরনিকর’ হয়ে উঠেছেন। সেই মানুষ, যাঁর কাজ মৃতদের ভাষা বাঁচিয়ে রাখা। এবং এখন সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন—এই সত্য কাকে দেওয়া হবে?
একটা সত্যের চিঠি যেমন পরিবর্তন এনে দিতে পারে, ঠিক তেমনই একটা ভুল হাতে পড়লে এই দলিল হতে পারে এক ভয়ানক অস্ত্র।
সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই পুঁথি আর নীলচিঠিগুলি প্রকাশ্যে আনবে না এখনই। তার বদলে সে তৈরি করবে এক ‘ঐতিহাসিক গোপন আর্কাইভ’, যেখানে সত্য থাকবে, কিন্তু প্রহরাও থাকবে। শুধু নির্বাচিত গবেষক, ইতিহাসবিদ, এবং ভবিষ্যতের চরনিকররাই পাবে সেখানে প্রবেশের অনুমতি।
এই ভাবনা নিয়ে সে যোগাযোগ করে ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে, পাঠায় বিস্তারিত রিপোর্ট, আয়নার মাধ্যমে উদ্ভাসিত রক্তাক্ত তালিকা, হাকিম মীর ফাহিমের ভূমিকাসহ প্রতিটি তথ্য।
দু’সপ্তাহ পর দিল্লি থেকে একটি টিম আসে। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডঃ অনুপম রাও, ইতিহাসবিদ ডঃ রিচা অগ্রবাল, এবং থার্মাল টেকনোলজির বিশেষজ্ঞ রাজীব সুরেশ।
ঈশান তাঁদের নিয়ে যান কোঠার আয়নার ঘরে। ঘরটা এখন নতুনভাবে সংরক্ষিত, মেঝে পরিষ্কার, আয়না ঘেরা কাচে, আর তার সামনের ম্যুরাল গুলোকেও থার্মাল ও ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ডঃ রিচা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “এই আয়না আসলে একটা ডকুমেন্ট রিফ্লেকশন সিস্টেম হিসেবে কাজ করে। এক ধরনের পুরনো পদ্ধতির ‘smart mirror’, যার পেছনে হয়তো কোনো লেন্স বসানো ছিল। এর মাধ্যমে তারা কিছু কোডিং চিত্র বা প্রতিচ্ছবি লুকিয়ে রেখেছিল। অবিশ্বাস্য।”
রাজীব সুরেশ ব্যাগ থেকে তার যন্ত্রপাতি বের করে আয়নার চারপাশে স্ক্যান শুরু করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি নতুন প্রতিফলন দেখা যায়—একটি বৃত্তাকার মানচিত্র, যেটার কেন্দ্রে লেখা “Darbar-e-Khaas”।
ঈশান চোখ বড় করে বলেন, “এটা কি মানচিত্র? তাহলে কিসের?”
ডঃ অনুপম বলেন, “আমার ধারণা, এটা মুর্শিদাবাদের সেই পুরাতন এলাকা—যেটা আজ মাটি চাপা পড়ে গেছে। নবাবি আমলের গোপন বৈঠকখানা, যেটা পরবর্তীতে ব্রিটিশরা নিশ্চিহ্ন করে দেয়।”
রাজীব বলেন, “এই আয়নার মধ্যে ডিপ-স্ক্যান করলে আরও কিছু আসতে পারে, তবে ঝুঁকি আছে। আয়নার গ্লাস স্ট্রাকচার খুব দুর্বল। একবার ফাটল ধরলে সবকিছু চিরতরে হারিয়ে যাবে।”
ঈশান দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।
তারপর বলেন, “আমি চাই না, আয়নাটা ভেঙে ফেলা হোক। আমাদের যা জানা দরকার, তার অনেকটাই আমরা পেয়েছি। আর এখন সময়, এই তথ্যগুলোকে ভবিষ্যতের মানুষের জন্য সুরক্ষিত করার।”
ডঃ রিচা মাথা নাড়েন, “তুমি একজন প্রশাসক হয়ে ইতিহাসের প্রতি এই দায়িত্ববোধ দেখালে, সত্যিই প্রশংসনীয়।”
ঈশান হাসে না। কেবল বলে, “আমি কেবল একজন মানুষ, যে ভুলে যেতে পারিনি এক নারীর অভিমানী চোখ। আয়নার ভেতরের সেই চোখ আমাকে আজও ডাক দেয়।”
কয়েকদিন পর এক গোপন সভা বসে মুর্শিদাবাদের প্রশাসনিক ভবনে। সভায় ঠিক হয়—
১. নবাবী কোঠার একটি অংশ সংরক্ষিত থাকবে জনসাধারণের জন্য, তবে আয়নার ঘরসহ কয়েকটি ঘর সীমিত প্রবেশাধিকারযুক্ত হবে।
২. “Murshidabad Silent Archive” নামে একটি স্বাধীন গবেষণা প্রকল্প শুরু হবে, যেখানে এই পুঁথি, নীলচিঠি ও ইনফ্রারেড ফটোগ্রাফের প্রতিলিপি থাকবে।
৩. আর একজন প্রধান Chronicler নিয়োগ করা হবে, যিনি ভবিষ্যতের গবেষকদের এই ঐতিহাসিক তথ্য ব্যাখ্যা ও লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব নেবেন।
সবাই একসঙ্গে বলে, “ঈশান চট্টোপাধ্যায়ই হোন প্রথম ক্রনিকলার।”
ঈশান চমকে ওঠে। তার চোখে জল চলে আসে, যদিও সে কোনোদিন প্রকাশ করে না নিজের আবেগ। শুধু মাথা নিচু করে বলে, “আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম সত্যের। আজ সেই সত্য আমায় নিজেই বেছে নিয়েছে।”
রাতের শেষ প্রহর। ঈশান কোঠার ভেতর শেষবারের মতো হাঁটছেন, আয়নার ঘরে, ম্যুরাল ঘরে, আর সেই গোপন তাম্রচুক্তির স্তম্ভ ঘরে।
সব ঘরেই যেন তিনি একেকটা কণ্ঠ শুনছেন—নাজনীন বেগমের গান, লেফটেন্যান্ট ফিঞ্চের কাঁপা কণ্ঠ, হাকিম ফাহিমের সাদা পোশাকে নীল কালি মেশানো হাত।
সবাই যেন চুপ করে বলছে, “ধন্যবাদ…”
ঈশান আকাশের দিকে তাকান।
তার চোখে জ্বলছে একটাই কথা—
“ইতিহাস শুধু যা ঘটেছে তা নয়, ইতিহাস যা আমাদের বাঁচায়।”
১০
জুলাই মাসের শেষ সকাল। মুর্শিদাবাদের আকাশে হালকা বৃষ্টির ছিটেফোঁটা, শহর যেন ধুয়ে যাচ্ছে—কেবল ধুলো নয়, গোপনতাও। আজ ‘Murshidabad Silent Archive’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। ছোট পরিসরে, প্রচারবিহীন, অথচ তাৎপর্যপূর্ণ।
নতুনভাবে রঙ করা ডিসি অফিসের পেছনের একটি নির্জন অংশে গড়ে তোলা হয়েছে সেই সংরক্ষণাগার। ভেতরে কাঠ আর কাচের চমৎকার ভারসাম্যে সাজানো এক নিঃশব্দ কক্ষ, যেখানে রাখা আছে ইনফ্রারেড স্ক্যান করা নীলচিঠি, হাকিম ফাহিমের পুঁথি, নাজনীন বেগমের চিঠি, Lt. Finch-এর খাম, এবং সেই তাম্রচুক্তি—যেটা যুগান্তকারী দলিল হয়ে উঠেছে ইতিহাসের চোখে।
চোখে পড়ার মতো কোনো সাইনবোর্ড নেই। শুধু দরজার ওপরে ছোট্ট খোদাই করা একটি বাক্য—“Let those who listen, learn.”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাত্র সাতজন উপস্থিত। কেউ প্রেস নয়, কেউ রাজনৈতিক নয়। কেবল প্রশাসক, ইতিহাসবিদ, গবেষক, এবং ঈশান চট্টোপাধ্যায়।
তাঁর গলায় কোনও ভাষণ নেই। শুধু একটুকরো কাগজ এগিয়ে দেন তিনি, যেখানে লেখা—
“আজ যা প্রকাশিত হল, তা কারও জন্য ইতিহাস, কারও জন্য পরিত্রাণ, আবার কারও জন্য জবাবদিহি। আমরা আজ চুপচাপ এক পাথরের নিচে রাখা সেই কাগজটাকে সম্মান জানাই, যার একটি বাক্য ছিল আমাদের ইতিহাস বদলে দেওয়ার মতো। সত্যের শেষ শব্দগুলো যেন কখনও কণ্ঠরোধ না হয়। নবাবী কোঠার আয়না আমাদের শিখিয়েছে—চুপ করে থাকাটাও এক ধরনের ভাষা। আর সেই ভাষাকে বোঝার দায় আমাদের।”
এই সাদামাটা কথাগুলো শুনে মীনাক্ষী রায় মৃদু মাথা নাড়েন। তিনিই এখন আর্কাইভের নীতিগত তত্ত্বাবধায়ক, এবং ঈশানের উত্তরসূরি ‘Second Chronicler’ হিসেবে নির্বাচিত।
উদ্বোধনের পর ঈশান একাই কোঠার দিকে হাঁটলেন। আজ তার মনে হচ্ছিল যেন প্রত্যেকটা পাথর একটু হালকা হয়েছে, যেন অতীত নিজেই শ্বাস ফেলছে ধীরে ধীরে।
তিনি আবার সেই আয়নার ঘরে যান। এবার ঘরের মধ্যে ঢুকতেই তার নজরে পড়ে নতুন একটি পরিবর্তন—আয়নার নিচে রাখা হয়েছে এক ছোট্ট কাঠের ফলক, যাতে লেখা—
“This mirror remembers. Handle with care.”
তিনি আয়নার সামনে দাঁড়ান, নিজের মুখ দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে থাকেন।
তার মনে পড়ে প্রথমবার আয়নার দিকে তাকিয়ে তিনি দেখেছিলেন এক অচেনা চোখ, এক ছায়া, এক নারীমুখ। আজ সেখানে কিছু নেই, শুধু নিজের প্রতিবিম্ব। তবে এই প্রতিচ্ছবির পেছনে যেন প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে—
“তুমি আমাদের কথা বলেছো, এবার তোমার পালা।”
ঈশান ব্যাগ থেকে একটি খাম বের করেন। খামটি সাদা, তবে সেই পুরনো স্টাইল—হাতে লেখা কালিতে। চিঠির ওপরে লেখা—
“To Whom It May Concern — Murshidabad, 2025”
তিনি সেটি আলতো করে আয়নার সামনে একটি ছোট কাঠের বাক্সে রেখে দেন, যেখানে আগের সব চিঠি রাখা আছে।
চিঠির ভিতরে লিখেছেন—
“আমি ঈশান চট্টোপাধ্যায়, একদা প্রশাসক, পরবর্তীকালে এক নীরব চরনিকর। আমি আজ এই চিঠিতে রেখে যাচ্ছি আমার দেখা মুর্শিদাবাদ, আমার চোখের ইতিহাস। আমি দেখেছি কীভাবে সত্য চাপা পড়ে যায়, কীভাবে কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় চুক্তি, আর কীভাবে আয়না হয়ে ওঠে মুখপাত্র। আমি বিশ্বাস করি, এই চিঠি হয়তো কখনো খোলা হবে না, তবুও রেখে যাচ্ছি, কারণ ভবিষ্যৎ যদি শুনতে চায়, তাহলে তাদের জানার অধিকার থাকা উচিত। সত্যকে লুকানো যায়, কিন্তু সে মরে না।”
চিঠি রাখার পর ঈশান নিঃশ্বাস ফেলেন।
তারপরে একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। আয়নার কাচ হালকা কেঁপে ওঠে, যেন বাতাসের দোলায়। কাঁচের ওপরে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে সেই পুরনো, চেনা ফিসফিস কণ্ঠ—“শেষ বাক্যটি তোমার…”
ঈশান একটু কেঁপে ওঠেন, তারপর সামনে এগিয়ে এসে কাচে নিজের হাত রাখেন।
চুপচাপ বলে ওঠেন—
“আমাদের ইতিহাস যেন আর কেবল বিজয়ীর ভাষায় না লেখা হয়। পরাজিতদেরও জায়গা থাকুক, ছায়ায় নয়, আলোয়।”
তারপর আয়নার কাচ আবার ঝাপসা হয়ে যায়।
তিনি ফিরে আসেন কোঠার বাইরে, জানেন, এই ভেতরের অংশে আর কখনও কারও প্রবেশ দরকার নেই। যথেষ্ট বলা হয়েছে। যথেষ্ট শোনা হয়েছে।
বছরখানেক পর, এক তরুণ গবেষক নাম লেখান ‘Murshidabad Silent Archive’-এ। নাম—মায়াঙ্ক সেন, দিল্লির জেএনইউ-র ইতিহাস বিভাগ থেকে সদ্য এমফিল শেষ করেছেন।
তাঁকে দেয়া হয় প্রথম ‘Archive Fellowship’, শর্ত একটাই—তিনি পড়বেন, লিখবেন, কিন্তু কখনো শোরগোল করবেন না।
প্রথমদিন তিনি আর্কাইভে বসে হাতে পান একটি খাম।
“To Whom It May Concern — Murshidabad, 2025”
তিনি চিঠিটা খুলে পড়েন, কাঁপা গলায়।
পরে তার ডায়েরিতে লেখেন—
“আমি দেখেছি একটি চিঠি, যেখানে একজন প্রশাসক ইতিহাসের ভার কাঁধে নিয়েছিলেন। আমি দেখেছি, সত্য কতটা নিঃশব্দ, আর কীভাবে একটি আয়না, একটি কালি, আর একটি চুক্তি পুরো জাতির বেদনা হয়ে ওঠে। আমি এই আর্কাইভের নতুন অভিভাবক হতে চাই না, আমি হতে চাই একজন নীরব শ্রোতা—যেন এই শহরের মৃতরাও নিশ্চিন্ত থাকে।”
নবাবি কোঠা আজও দাঁড়িয়ে আছে। শ্যাওলার ভেতর লুকিয়ে থাকা সত্যকে হয়তো কেউ দেখে না। তবে কেউ কেউ জানে—সেখানে একটা আয়না আছে, যেটা প্রতিচ্ছবির চেয়েও বেশি কিছু দেখায়।
আর সেই আয়নার নিচে রাখা চিঠিতে লেখা রয়েছে—
“History doesn’t sleep. It waits.”
(সমাপ্ত)