সুচেতনা দত্ত
অধ্যায় ১: আসর
কলকাতার নবাববাড়ি সেই সন্ধ্যায় যেন স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল—ঝাড়বাতিতে আলো, আতরের সুবাস, পানের স্বাদে ভারী ঠোঁট, আর আড়ম্বরপূর্ণ শেরওয়ানিতে মোড়ানো অতিথিদের মৃদু গুঞ্জন। মাঝে মাঝে চামচ-চামচির শব্দ, কাঁচের গ্লাসে লেবুর জল, আর পেছনের দিক থেকে সেতারের টানা সুর—সব মিলে এক অভিজাত রাত্রির উপসংহার রচনা করছিল। এই ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন নবাব আহসান উল্লাহ নিজে, তাঁর পাশে সংস্কৃতিভাজন গুণিজনেরা, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবিগণ। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করছিলেন যার জন্য, সে তখনও পর্দার ওপারে। কেউ বলছিল, “আজ নাকি নতুন বাঈ এসেছে, লক্ষ্মী নামে।” কেউ মৃদু হাসছিল—“নাম শুনেই তো বোঝা যাচ্ছে, লক্ষ্মী সে বটে। তবে সে কি শুধু নাচবে, না গাইবেও?” একজন বৃদ্ধ হেঁচকি তুলে বলে উঠলেন, “শুনেছি, কবিতা লেখে। ওই বয়সে কবিতা! ধৃষ্টতা নয়?” এর মাঝে নবাব হাত তুললেন—আসর শুরু হোক। মৃদু আলোর ভিতর পর্দা সরল, আর এক রক্তরাঙা শাড়ি পরিহিতা যুবতী প্রবেশ করল মঞ্চে। গায়ের রং উজ্জ্বল নয়, চোখে দীপ্তি, মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে নমস্কার করল সকলকে, তারপর বসে পড়ল তবলার পাশে। কেউ চমকে উঠলেন—সে নিজে তবলা বাজাবে? তারপর তার গলাটি যেন গড়িয়ে এল বাতাসে, “আমি তো নটী, মঞ্চ আমার ঠিকানা, কিন্তু আমার কথা শুধু চোখ দিয়ে নয়, কান দিয়ে শুনুন।”
লক্ষ্মীর গান মুগ্ধ করেছিল অনেককে, কিন্তু তার চোখের ভাষা, আর কথার ফাঁকে ফাঁকে লুকানো ব্যঙ্গ—তা ছিল শাণিত। “আমি গাই, কিন্তু গান দিয়ে প্রশ্ন করি,”—এই কথাটি সে উচ্চারণ করল গানের মাঝে, যেন এক কবিতার ছন্দে। নবাবের মুখে হাসি, কিন্তু চোখে বিস্ময়। সৈয়দ নওশাদ আলী, যিনি নবাববাড়ির সংস্কৃতিশিক্ষক, মুখ গম্ভীর করে বসেছিলেন। তিনি লক্ষ্মীর প্রতিভাকে আনন্দ নয়, বিদ্রোহ মনে করতেন। গান শেষে হাততালির মাঝে তিনি বললেন, “সুন্দর গান, কিন্তু নটিরা যদি কবিতা লেখে, তবে আসরের গরিমা কোথায় থাকে?” লক্ষ্মী মাথা নিচু করল না, বরং শান্তভাবে উত্তর দিল, “সাহিত্য যদি কেবল ব্রাহ্মণ বা পণ্ডিতের প্রাপ্য হয়, তবে আমি মানুষই নই।” এই উত্তর সভার বুকে শোরগোল তুলেছিল। কেউ হতভম্ব, কেউ অস্বস্তিতে। নবাব মৃদু হাসলেন, কিন্তু মনে মনে ভাবলেন—এই মেয়েটি কেবল সুরের কন্যা নয়, সে বোধের দাবিদারও। সেই রাতে লক্ষ্মীর গান শেষ হলেও তার কথার রেশ থেকে গেল অনেকের মনে। রুবিনা বাঈ, যিনি প্রবীণ গায়িকা, লক্ষ্মীকে পেছনের ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, “তুই ঠিক করেছিস, মেয়ে। তবে সমাজ তো তোকে ক্ষমা করবে না। তোকে ভাবতে হবে, তোর গান, তোর কবিতা, কতটা পথ পেরোতে পারবে।”
ঘরের কোণে রাখা পুরনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মী নিজের চোখে চোখ রাখল। বাইরে আজও বাজছে সেতার, ঘুঙুর, কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন—সে কি নটী? নাকি এক বিদ্রোহী কবি? তার মুখে তখন সেই কবিতার পংক্তিগুলো কাঁপছিল, যা সে আজ গাইতে সাহস পায়নি—“আমি মাটি, আমি জল, আমারও ভাষা আছে। আমি নটী বলে যদি চুপ থাকি, তবে ইতিহাসে আমার নাম কীভাবে লেখা হবে?” সে জানে, এই নবাববাড়ির আসর তাকে খ্যাতি দেবে, হয়তো কিছু সম্মানও। কিন্তু স্বাধীনতা? না, তা আসবে না গানে, তা চাইলে লাগবে কলম, লাগবে ভাষা, যা সমাজ ভয় পায়। লক্ষ্মী জানে, আসরের বাহিরেই তার সত্যিকারের লড়াই। সেদিন রাতের শেষে, যখন সবাই চলে গেছে, নবাব তার কাছে এসে বললেন, “তুমি অন্যরকম, লক্ষ্মী। তুমি শুধু গান গাও না, তুমি আমাদের প্রশ্ন করো। আমি ভয় পাই এই প্রশ্নকে, কিন্তু সম্মানও করি।” লক্ষ্মী মাথা নিচু করে বলল, “আমার গান আপনারা মনে রাখবেন না, কিন্তু যদি কিছু প্রশ্ন থাকে—তবে আমি ভুলে যাব না, নবাব সাহেব।” নবাব একটু চমকে উঠলেন। ওই প্রথম লক্ষ্মী, নটি লক্ষ্মী, তার জায়গা তৈরি করল শুধু সুর দিয়ে নয়, ভাষা দিয়ে—যা সমাজ তাকে দিতে চায়নি, কিন্তু সে নিজে কাড়তে শিখে গেছে।
অধ্যায় ২: আড়ালের কাব্য
নবাববাড়ির উৎসব শেষে যখন আসর নিভে যায়, তখন বাড়ির পেছনের হাওয়াখানায় লক্ষ্মী একা বসে। চারিদিকে স্তব্ধতা, দূরে ঝোপের আড়াল থেকে কোনো বাদুড়ের ডানার শব্দ, মাঝে মাঝে কুকুরের হুঁকহুঁক—এই একাকীত্বেই লক্ষ্মী নিজেকে খুঁজে পায়। সামনে খোলা আছে এক পুরনো খাতা, যেখানে তামিল আর বাংলা হরফে লেখা কবিতার পঙ্ক্তি। তার কলম আজও থামেনি। গানের আসরে সে যা বলতে পারে না, তা এই শব্দে বলে ফেলে। “আমি নটি, আমি গাই। তবে যখন আমি লিখি, আমার মুখ নেই, আমার চোখ নেই—শুধু আমার ভাষা আছে।” এই ছিল তার কবিতার মর্মবাণী। সৈয়দ নওশাদের চোখে সে শুধু একজন দেহে সাজানো বিনোদনের পাত্র। নবাব হয়তো স্বীকৃতি দেন, কিন্তু সমাজ তাকে চায়নি কবি হিসেবে। অথচ লক্ষ্মী জানে—সে পুঁথিপড়া জানে, সংস্কৃত ব্যাকরণ মুখস্থ, গীতগোবিন্দ তার শোণিতে মিশে গেছে। এই আত্মজ্ঞান তার অহং নয়, অস্তিত্বের মূল। খাতায় কলম চালিয়ে সে লিখল—“যার গলায় ঘুঙুর, তার ঠোঁটে শব্দ কেবল ছন্দের নয়, তা প্রতিবাদেরও।” এইসব কবিতা সে কারও কাছে পড়ে না, না রুবিনার, না নবাবের। এগুলো কেবল তার, একান্ত তার।
রুবিনা বাঈ প্রতিদিন সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর সঙ্গে বসে সুর তোলেন। বয়সে অনেক বড়, কিন্তু লক্ষ্মীর প্রতিভায় তিনি মুগ্ধ। একদিন রুবিনা প্রশ্ন করেন, “তুই কবে থেকে এত লেখিস? আগে তো দেখতাম শুধু নাচগান।” লক্ষ্মী মৃদু হেসে বলে, “নাচ তো আমার জীবিকার জন্য। কিন্তু লেখা আমার বাঁচার জন্য।” রুবিনা চিন্তিত হন। “মেয়েরা অত ভাবলে বিপদ বাড়ে। তুই এখন জনপ্রিয়, সাবধানে চল।” লক্ষ্মী জবাব দেয়, “সাবধানতা দিয়ে যদি বাঁচা যায়, তবে ইতিহাসে শুধু পুরুষদের নাম থাকত না।” এ কথায় রুবিনার চোখ ভিজে ওঠে। তিনি জানেন, লক্ষ্মী অন্যরকম। লক্ষ্মীর ঘরে জিনাত নামে এক কিশোরী আসে প্রতিদিন, সেতার শেখে। সে লক্ষ্মীর গানের ভক্ত, তবে আরও বেশি মুগ্ধ তার লেখায়। একদিন সে দেখে ফেলে লক্ষ্মীর খাতার পৃষ্ঠা—সেখানে লেখা, “নটী কেবল নৃত্য নয়, সে সময়ের সাক্ষী।” জিনাত মুগ্ধ হয়ে বলে, “দিদি, এসব তুমি মঞ্চে বল না কেন?” লক্ষ্মী হাসে, “কারণ আমি জানি, সমাজ কান পেতে গান শোনে, কথা নয়। আমার কথা কানে গেলে ওদের ভয় হবে।” এই ভয়ই লক্ষ্মীর শক্তি। সে জানে, নিজের ভাষা দিয়ে সে যা বলছে, তা শোনা না হলেও থেকে যাবে—কোনো না কোনো পাঠকের হাতে, কোনো না কোনো ভবিষ্যতের মেয়ের বুকের ভিতরে।
এক রাতে, লক্ষ্মী তার তক্তপোশে শুয়ে আছে, ছাদের দিকে তাকিয়ে। বাতাসে আজ যেন অন্য রকম একটা কাঁপুনি। ঘর অন্ধকার, শুধু তার মুখে চাঁদের আলো পড়ে আছে। সে মনে মনে ভাবছে—তার কবিতা, তার লেখা, কি কোনোদিন সমাজ মানবে? সে কি শুধু আসর মাতাবে, না কি একদিন স্কুলের বইয়েও থাকবে তার নাম? হঠাৎ সে শুনতে পায় দূরে কোথাও কেউ গাইছে, “ধীরে বহে মেঘনা, তোরে বলি হেন কথা…”। সে বুঝতে পারে, এই সমাজে কিছু শব্দ হারায় না, তারা সময় পেরিয়ে থেকে যায়। সেদিন সে সিদ্ধান্ত নেয়, যতদিন গাইবে, ততদিন লিখবেও। আসর শেষ হলেও, খাতা যেন চলতেই থাকবে। তার শব্দ হবে আগুন, তার কবিতা হবে বাতাস—যা ছুঁয়ে যাবে চারপাশ, নিঃশব্দে, অথচ দৃঢ়তায়। সেই রাতেই খাতার পাতায় সে লেখে—“আমি লক্ষ্মী, নবাববাড়ির নটী, কিন্তু আমার নাম একদিন থাকবে সেই ইতিহাসে, যেখানে নটীরাও কবি হতে পারে।”
অধ্যায় ৩: নবাবের দোটানা
নবাব আহসান উল্লাহ সেই সন্ধ্যায় একা বসেছিলেন তার ব্যক্তিগত পাঠশালার ঘরে, যেখানে দেওয়ালের তাকজুড়ে সাজানো পুরনো ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃত সাহিত্যের বই। আশপাশে হাকিম, মুন্সী, সঙ্গীতজ্ঞ, কাব্যরসিক কেউ ছিল না। তার সামনে রাখা একটি পানপাত্র অর্ধেক খালি, আর পাশে ছড়িয়ে কিছু খাতা—লক্ষ্মীর লেখা। হ্যাঁ, লক্ষ্মী, সেই আসরের নটী, যাকে প্রথমে তিনি শুধু নাচের জন্যই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, এখন তার কলমে এমন কিছু লিখে গেছে যা নবাবের চিন্তার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। একদিন সে নিজেই একখানা কবিতা গেয়ে শোনায়, পরে সেটা হাতে তুলে দেয় নবাবকে। “আমার গলায় শুনলেন, এবার কাগজে দেখুন,” বলেছিল লক্ষ্মী। কবিতাটির নাম ছিল ‘পরিচয়ের পালা’। তাতে লেখা, “আমার ঠোঁটে যে হাসি, তা বিক্রির নয় / আমার চোখে যে জল, তা করুণা নয় / আমি কেবল কন্যা নই, আমি ইতিহাসের সাক্ষী।” এইরকম উচ্চারণ একজন নটীর কলমে? নবাবের কপাল ভাঁজ হয়ে যায়। তিনি জানেন, এ কবিতা প্রকাশ পেলে সমাজ, সভাসদ, এমনকি পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যরাও রুষ্ট হবেন। কিন্তু তিনি নিজেও অস্বীকার করতে পারছেন না—লক্ষ্মীর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্য কারো নেই। সেই তীব্রতা, সেই অনুভব, সেই সাহস।
এই দ্বিধার মধ্যেই নবাব ডেকে পাঠালেন সৈয়দ নওশাদ আলীকে। নওশাদ প্রবীণ, শিক্ষিত, কিন্তু রক্ষণশীল। নবাব তাকে লক্ষ্মীর কবিতা পড়ে শোনালেন। কবিতা শেষ হওয়ার আগেই নওশাদ থেমে বললেন, “এটা কি তার লেখা?” নবাব জবাব দিলেন, “সে দাবি করে, তারই লেখা। আমি বিশ্বাস করি।” নওশাদ ঠান্ডা গলায় বললেন, “তবে মাফ করবেন, নবাবজান, আপনি হয়তো ভুল করছেন। যেসব নারী বেহালায় সুর তোলে, তারা যদি কলম হাতে নেয়, তবে সভ্যতা হুমকিতে পড়ে।” নবাব হেসে ফেললেন—“সভ্যতা যদি এক নারীর কবিতায় ভেঙে পড়ে, তবে সেই সভ্যতার ভিত্তিই দুর্বল।” কিন্তু এই হাসির আড়ালে তিনি নিজেও কাঁপছিলেন। কারণ তিনি জানেন, লক্ষ্মী এখন আর শুধুই এক গায়িকা নয়, সে তার আঙিনায় প্রবেশ করা এক চিন্তার ঢেউ। সেই ঢেউ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়? যদি অন্যান্য নারীরাও উৎসাহিত হয়? সমাজ তখন তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে—নটীর প্রতিভাকে প্রশ্রয় দিয়ে তিনি সমাজবিরোধিতা করছেন, এই অপবাদ আসবে। নবাব সেই দ্বন্দ্বে দগ্ধ হচ্ছিলেন—একদিকে মনের টান, অন্যদিকে সমাজের চোখ। তিনি বুঝলেন, সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতি ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে।
এর মাঝেই লক্ষ্মী আরেকটি অনুরোধ করে বসে। সে নবাবকে বলে, “আমি আসরে গাইব, ঠিক আছে। কিন্তু আমি চাই, এবার একদিন আমার লেখা কবিতাও পাঠ করব সভায়।” নবাব থমকে যান। “সামনে সকলের?” লক্ষ্মী মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, কারণ গান দিয়ে মন পায়, কিন্তু কথা দিয়ে চিন্তা জাগে।” নবাব কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। মনে পড়ে যায় নবীনকালে তার নিজের কিছু স্বপ্ন—নারীশিক্ষার প্রচলন, আচারবিরোধী চিন্তা, সংস্কার ভাঙার প্রয়াস। কিন্তু বয়স ও দায়িত্ব তাকে পেছনে টেনে এনেছে। এখন লক্ষ্মীর কণ্ঠে যেন সেই পুরনো নবাবকে আবার শুনতে পান। তিনি কেবল বলেন, “তুমি জানো, আমি চাই তুমি লেখো। কিন্তু সবাই তা শুনতে চায় না।” লক্ষ্মী শান্ত গলায় জবাব দেয়, “আমি গান না গাইলেও, বাতাসে গুঞ্জন থাকে। আপনি না চাইলেও, আমি লিখে যাব।” নবাব জানেন, তিনি এক স্ফুলিঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে, যা হয় নিভে যাবে সমাজের অভিশাপে, নয়তো জ্বলে উঠবে ইতিহাসের প্রদীপ হয়ে। সেই রাতে, অনেক ভেবে তিনি শুধুই বললেন, “লক্ষ্মী, তুমি লিখে যাও। কিন্তু সাবধানে চলো।” লক্ষ্মী চোখ নামিয়ে বলল, “সাবধান তো সারাজীবন ছিলাম, নবাব সাহেব। এবার একটু সাহস করে বাঁচতে চাই।”
অধ্যায় ৪: বাহিরের বাতাস
নবাববাড়ির পাথরের বারান্দা পেরিয়ে, উত্তর কলকাতার চুপচাপ গলিগুলিতে সেই সময় নতুন এক বাতাস বইতে শুরু করেছিল। বাইরের দুনিয়ায় ব্রাহ্ম সমাজের সভা, সাহিত্য সম্মেলন আর নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন মাথা তুলছিল। তারুণ্য মুখরিত হয়ে উঠছিল নতুন চিন্তায়, প্রশ্নে, প্রতিবাদে। লক্ষ্মীর কানে প্রথম এই খবর আসে এক পুরনো পরিচারিকার কাছ থেকে, যে সপ্তাহান্তে চুপি চুপি এক ব্রাহ্ম সভায় যায়। সে বলে, “দিদি, ওইখানে মেয়েরাও কথা বলে, কবিতা পড়ে, এমনকি পত্রিকাও বের করে।” লক্ষ্মী বিস্মিত হয়, আবার আশার আলোও জাগে। সে তখনই জানতে চায় গগন ঠাকুর নামের এক যুবক কবির কথা, যে ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে কথা বলে এবং মেয়েদের শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। বলা হয়, সে লিখেছে, “নটীর ঠোঁটেও যদি প্রশ্ন উঠে, তা শোনার সাহস সমাজের আছে কি?” লক্ষ্মী অনুভব করে—তার চিন্তা এই গগনের সঙ্গে মিলে যায়, তাদের দেখা না হলেও তারা যেন একই স্রোতের দুই পার। কৌতূহল তাকে পেয়ে বসে। সে ভাবতে শুরু করে, গগনকে দেখতে হলে কোথায় যেতে হবে? রুবিনা বাঈ যখন তাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, “তোর চোখে এই ক’দিন ধরে অন্য আলো কেন?” তখন লক্ষ্মী শুধু বলে, “আলো নয় রুবিনা, এটা আগুন।”
তবুও ভয় আছে। কারণ বাইরে যেখানে আলো জ্বলছে, ভিতরে সেই আলোকে ভয় দেখানোর লোকেরও অভাব নেই। সৈয়দ নওশাদ লক্ষ্মীর পরিবর্তন লক্ষ করছেন। তাকে মাঝে মাঝে একাকী লিখতে, গভীর কিছু পড়তে দেখেন। একদিন তিনি লক্ষ্মীর ঘরে গিয়ে তর্জনী তুলে বলেন, “তোমার ভাষায় আগুন দেখি। গান হলে ভালো, কিন্তু কাগজে আগুন ছড়ালে, তা বিপজ্জনক। সাবধান হও।” লক্ষ্মী কোনো জবাব দেয় না, শুধু মাথা নিচু করে থাকে, কিন্তু মনে মনে ভাবে—সে আর থামবে না। এরপরেই সে সিদ্ধান্ত নেয়—সে গগন ঠাকুরের সভায় যাবে। ছদ্মবেশে। রুবিনা বাধা দেয়, বলে, “ওরা তোমাকে নটি বলেই দেখবে। ওদের সভা অভিজাতদের, তুই অপমান পেতে পারিস।” লক্ষ্মী হাসে, “অপমান তো আমায় প্রতিদিনই পায়। আজ একটু সত্য খোঁজে অপমান পেলে ক্ষতি কী?” এই প্রথম সে নবাববাড়ির অন্দরমহলের বাইরে চিন্তা করতে শুরু করে, সমাজের চোখ উপেক্ষা করে সাহস নিয়ে চলতে চায়।
সেদিন এক বিকেলে, হালকা ঘোমটা টেনে, লক্ষ্মী পৌঁছয় হেয়ার স্কুলের কাছাকাছি এক ব্রাহ্ম সভায়। জিনাত তার সঙ্গে যায়। সভার সামনে জমায়েত—ছাত্র, সাহিত্যিক, তরুণ তরুণী। কেউ কারো দিকে অস্বস্তির চোখে তাকায় না। সভা শুরু হয়। বক্তা হিসেবে উঠে দাঁড়ায় এক লম্বা, ধবধবে পোশাকপরা যুবক—গগন ঠাকুর। তার চোখে দীপ্তি, কণ্ঠে আশ্বাস, এবং মুখে কবিতা। সে বলে, “আমরা শুধু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে ইতিহাস গড়তে এসেছি। আর ইতিহাস নারীকে ভুলে গেছে অনেকবার। এবার সময় হয়েছে তাকে মনে রাখার।” লক্ষ্মীর বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। এই তো সেই মানুষ, যার ভাবনায় সে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছে। সভার শেষে সে সাহস করে গগনের কাছে যায়। নিজের পরিচয় না দিয়ে কেবল একটি কবিতার পঙ্ক্তি পড়ে শোনায়—“আমি নটি, আমার ছন্দে প্রশ্ন আছে।” গগন তাকিয়ে বলে, “কে আপনি? আপনি তো একজন কবি!” লক্ষ্মী একটুও হাসে না, কেবল বলে, “আপনি কি এমন একজন কবিকে মঞ্চে জায়গা দেবেন, যিনি নটি?” গগনের চোখে বিস্ময়, তারপর সম্মান। সে শুধু বলে, “শব্দ যদি সত্য হয়, তাহলে নাম কোনো বাধা হতে পারে না।”
সেই রাত লক্ষ্মীর মনে গভীর ছাপ ফেলে। নবাববাড়ির ঘরে ফিরে এসে, সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—আকাশের যেমন ধর্ম নেই, রঙ নেই, তেমনি কবিতারও তো পরিচয় আলাদা হয় না। গগন ঠাকুর হয়তো তাকে চিনল না, কিন্তু তার ভাষাকে চিনেছে। আর সেটাই তো তার সবচেয়ে বড় জয়। সেই দিনই লক্ষ্মী প্রতিজ্ঞা করে, এবার শুধু গানের আসরে নয়, ভাবনার মঞ্চেও সে পা রাখবে। যত বাধা আসুক, যত নোংরা উপহাস হোক, সে লিখবে, পড়বে, ছড়িয়ে দেবে সেই আগুন যার আঁচ সমাজ একদিন বুঝবে না হলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। সে জানে, সেই দিন খুব দূরে নয়, যেদিন ‘নবাববাড়ির নটী’ শুধু এক গায়িকা নয়, এক সাহসী লেখিকার নাম হবে।
অধ্যায় ৫: আগুনের রাত
লক্ষ্মীর জীবন বদলে যেতে থাকে নবাব আলি জহিরউদ্দিনের গোপন লাইব্রেরির দরজা তার জন্য খোলা হবার পর থেকে। দাসী হালিমার মাধ্যমে সন্ধ্যার পর সে চুপিচুপি পৌঁছে যেত সেই রাজকীয় কক্ষে, যেখানে মুঘল ইতিহাস, পারস্য কবিতা, আর বেদ-উপনিষদের অনুবাদ একসাথে ঠাঁই পেয়েছে। নবাব তাকে একদিন বলেছিলেন, “একটা নাচ দিয়ে মন জয় করা সহজ, লক্ষ্মী। কিন্তু এক পৃষ্ঠা কবিতা লিখে মন জয় করা? তা তোমায় কেউ শেখায়নি।” সেই থেকে লক্ষ্মীর চেতনায় যেন অন্যরকম জ্বালানি জাগে। সে রাতের পর রাত পড়ে—শিখে—লিখে। কবিতা, গজল, এমনকি তামিল থেকে অনূদিত এক প্রাচীন নাটকের অংশও তার ঠোঁটে উঠে আসে। কিন্তু এই শিক্ষার আলো তার চারপাশের অন্ধকারকে যেন আরও বেশি স্পষ্ট করে তুলতে থাকে। একদিন, রাজসভায় সবার সামনে লক্ষ্মী নিজস্ব লেখা এক কবিতা আবৃত্তি করে ফেলল। সেই কবিতায় ছিল নারীর মুখ খোলা স্বাধীনতার কথা। নবাব প্রথমে মুচকি হেসে ওঠেন, কিন্তু তার চারপাশের ঠাকুরদার গম্ভীর মুখ বলে দেয়—এই সমাজ এখনও লক্ষ্মীদের কথা শুনতে শেখেনি।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই আসে সেই ভয়ানক রাত—নবাববাড়ির অগ্নিকাণ্ড। সেই রাত যেন লক্ষ্মীর জীবনে এক চিরন্তন বিভাজনরেখা টেনে দেয়। কেউ বলে রান্নাঘরের হুঁকোয় আগুন লেগেছিল, কেউ বলে তা নাকি পরিকল্পিত ছিল—কারণ, আগুন লেগেছিল ঠিক সেই দিকটায়, যেখানে লক্ষ্মী থাকত। হালিমা লক্ষ্মীকে বাঁচিয়ে আনে, কাপড়চোপড় ছিঁড়ে, চোখে মুখে ধোঁয়ার ছায়া। লক্ষ্মী দেখে তার রত্নখচিত ঘুঙুর, তার প্রিয় বইগুলো, এমনকি তার হাতে লেখা কবিতার খাতা—সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নবাববাড়ির অন্যরা নিরাপদ, কিন্তু লক্ষ্মীর কক্ষ যেন ছায়ার চেয়েও কালো হয়ে উঠেছে। সেই রাতেই সে বুঝে যায়—জ্ঞান, বুদ্ধি, সৃজন—এসবকে সমাজ তখনো নারীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়। নবাব চুপ ছিলেন, শুধু বলেছিলেন, “তুমি চাইলে চলে যেতে পারো লক্ষ্মী। এই শহর তোমার জন্য নিরাপদ নয়।” লক্ষ্মী উত্তর দেয়নি তখনই, কিন্তু চোখে তার স্পষ্ট ছিল—সে পুড়ে ছাই হয়নি। সে এখন আরও তপ্ত, আরও আগুন।
এরপরের দিনগুলো ছিল ভাঙা ঘর, পুড়ে যাওয়া শৌখিনতার ধ্বংসস্তূপ, আর নতুন বিকল্প পথের সন্ধানে ঘোরাঘুরি। লক্ষ্মী নিজের জন্য নতুন এক পথ খুঁজে নেয়। সে আর গানে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং কলকাতার এক নবগঠিত নারীকেন্দ্রিক নাট্যগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করে। তারা প্রথমে দ্বিধা করে, কারণ লক্ষ্মী একজন নটী। কিন্তু লক্ষ্মী যখন তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ পাঠ করে, তখন তাদের চোখে কান্না নামে। তার কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা, তার ব্যক্তিত্বের দীপ্তি—সব কিছু মিলিয়ে সে হয়ে ওঠে এক বিপ্লবের প্রতীক। কলকাতার নাট্যমঞ্চে প্রথমবার এক প্রাক্তন নটী, সমাজের অবজ্ঞার মুখে দাঁড়িয়ে নারীজাগরণের নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করল। দর্শক অভিভূত—কেউ চমকায়, কেউ অনুপ্রাণিত হয়, কেউ আবার নাক কুঁচকোয়। কিন্তু লক্ষ্মী জানে, সে আর পিছনে ফিরবে না। পুড়ে যাওয়া নবাববাড়ির ছাই থেকে সে নিজেকে নতুন করে গড়েছে। ইতিহাস যাকে ভুলে যেতে চেয়েছিল, সেই লক্ষ্মী এখন নিজেই ইতিহাস রচনার পথে।
অধ্যায় ৬: আঁধারের ভিতর শব্দ
আলোর নিচে ছায়া পড়ে। আর সেই ছায়ার আড়ালেই কখনো কখনো সত্য রয়ে যায় নিরব, রয়ে যায় অপ্রকাশিত। লক্ষ্মীর জীবনেও ছিল সেই অদৃশ্য ছায়া—নবাবের মনোরম গৃহের গোপন অলিন্দে যে শব্দহীন অভিমান জমা হতো দিনের পর দিন, সেইসব শূন্যতা শব্দ পেত তার গানে, তার কবিতায়। এখন আর শুধু নাচ নয়—লক্ষ্মী হয়ে উঠেছে এক সংস্কৃতিকেন্দ্র, তার কাছে এসে দীক্ষা নিচ্ছে নবীন বাউল, বেদান্ত পড়ছে নবাবের বোনের কাছ থেকে। নবাববাড়ির অন্দরমহলে এখন লক্ষ্মীর রচিত পদাবলীর গন্ধ, কাশ্মীরী মশলার মতো ছড়িয়ে পড়েছে তার সাহসী চিন্তার সুগন্ধ। কিন্তু বাইরে, কলকাতার নবজাগরণের বিস্তার যতই হোক, অভিজাত সমাজে এখনও লক্ষ্মীর উপস্থিতি ‘প্রদর্শনযোগ্য’ হলেও ‘গ্রহণযোগ্য’ নয়। তার ‘নটি’ পরিচয় ছাপিয়ে আরেকটি ‘লক্ষ্মী’ তুলে ধরতে চাইলে, ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপ ছাড়া কিছুই মেলে না।
একদিন গভীর রাতে, নবাব নিজে এসে বললেন লক্ষ্মীকে, “তুমি যে আলো ছড়াও, তা আমি অনুভব করি। কিন্তু সেই আলোতে পুড়ে যাওয়ার ভয়ও তো থেকে যায়।” লক্ষ্মী তির্যক হেসে উত্তর দিল, “তবে আমার আলো শুধু দেখার নয়, সাহস করে স্পর্শ করারও। আমি কোনোদিন কারও পেছনে আশ্রয় খুঁজিনি, আমি বরং নিজের ছায়া খুঁজি।” সে রাতে তাদের কথোপকথন ছিল এক দীর্ঘ দর্শনচর্চার মতো—সাহিত্য, নারী, ধর্ম, সমাজ ও সৃষ্টির সীমা নিয়ে। নবাব, যিনি ইংরেজিতে শিক্ষিত হলেও ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে গভীর প্রগাঢ়, অবাক হয়ে লক্ষ্মীর বাংলা কবিতা ও সংস্কৃত শ্লোকের মধ্যে খুঁজে পেলেন অন্যরকম শক্তি। তিনি বুঝলেন, লক্ষ্মী কেবল রূপ বা রস নয়—সে এক বিপ্লব, যে বিপ্লবের ভাষা নাচের চেয়ে গভীরতর।
সেই সময়েই ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষানীতিতে নতুন ঢেউ এসেছে, এবং সংস্কৃতির পরিধি নতুন করে বিবেচিত হচ্ছে। লক্ষ্মী চায় তার মতো নারীদের জন্য একটি সাহিত্য চক্র গড়ে তুলতে—যেখানে দাসী থেকে গায়িকা পর্যন্ত যে কেউ নিজের অভিজ্ঞতা কবিতায়, কথায় প্রকাশ করতে পারবে। নবাব খানিক দ্বিধায় পড়লেন—সমাজে এ এক বিরাট রকম বিপরীত স্রোত। কিন্তু লক্ষ্মীর জেদ, চোখের মধ্যে দুরন্ত আগুন দেখে তিনি চুপ করে গেলেন। অবশেষে নবাববাড়িরই একটি চুনকাম করা কক্ষকে ‘আঁধারঘর’ থেকে রূপান্তরিত করা হল ‘আলোঘর’-এ। সেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে আয়োজন হতো ‘সাহসী নারীদের সভা’—শুধু লেখা নয়, গান, পাঠ, নাট্যাভিনয় ও আত্মজিজ্ঞাসা নিয়েই চলতো মননের উৎসব। লক্ষ্মী সেই ঘরে বসে প্রথম বলেছিল, “আমি ইতিহাসের পাদটীকায় নয়, মূল পাঠ্যে জায়গা চাই।” আর সেই দাবির প্রতিধ্বনি অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, হয়ত তখনও অনুপস্থিত পত্রিকার পাতায়, কিন্তু শব্দের ভিতর দিয়ে সমাজে।
অধ্যায় ৭: কাব্যের কান্না
গ্রীষ্মের সেই দুপুরে লক্ষ্মীর গলার সুর যেন হঠাৎ করে থেমে গেল। না, গলায় সুর ছিল, কিন্তু অন্তরের কাব্য যেন শুকিয়ে গেল। আসরে কেউ তা বুঝতে পারল না, কিন্তু ভেতরে লক্ষ্মী জানত—কিছু একটার মৃত্যু হয়েছে আজ। আজ আর সেই লক্ষ্মী নেই যে চোখে বালি দিয়ে হাসতে পারে, সেই লক্ষ্মীও নেই যে নৃত্যের ছন্দে জীবনকে ভুলে যেতে পারে। বালকৃষ্ণ রায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার জীবনের ছন্দ বদলে গেছে। সে মানুষটা ছিল লক্ষ্মীর জীবনে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম—তিনি কখনো তাকে ভোগের দৃষ্টিতে দেখেননি। বরং তার কবিতা শুনে চোখ ভিজে উঠেছিল, তার গাওয়া ঠুমরিতে বিমুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “তোমার কণ্ঠে যেন শব্দ নয়, আত্মার ভাষা।” সেই প্রথম কেউ লক্ষ্মীকে শুধু শরীর দিয়ে চিনেনি। কিন্তু সেই ভালোবাসা ছিল অসম্ভব—একজন পণ্ডিত ব্রাহ্মণ এবং একজন নটী। সেই অসম সম্পর্ক সমাজে তো নয়ই, নিজের মনেও বহুদিন জায়গা পায়নি। তাই আজ যখন বালকৃষ্ণ রায় তাকে চিঠিতে লিখেছেন যে তিনি কাশীতে গিয়েছেন সন্ন্যাস নিতে, তখন লক্ষ্মী বুঝে গেল, তার জীবনের সব গান আজ নিঃশব্দ হয়ে গেল।
নবাববাড়ির বেগমজান আজ লক্ষ্মীকে ডেকে পাঠিয়েছেন। হাতে এক কোরআনের কপি, চোখে চিরন্তন অভিজাত নিঃসঙ্গতা। তিনি লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে ধীরে বলেন, “তুই আমার মেয়ের মতো, লক্ষ্মী। কিন্তু তোর কথা উঠলে দরবারে কটুক্তি ওঠে, কাসিদের মুখে কানাঘুষো শোনা যায়। এমন একদিন আসবে, যেদিন তোকে এখানে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।” লক্ষ্মীর মুখ সেদিন পাথরের মতো ছিল, কিন্তু ভেতরে ঝড়। নবাববাড়ি যে তাকে আশ্রয় দিয়েছিল, সেই আশ্রয়ও আজ টলছে। লক্ষ্মী জানে, কেবল গান আর কবিতা দিয়ে সমাজের চোখে নিজেকে পুণ্যবতী করে তোলা যায় না। সে গভীর রাতে নিজের ছোট্ট কক্ষের এক কোণে বসে নিজের কাব্যসংগ্রহ খুলে বসে। প্রত্যেকটি কবিতার পেছনে তার একটি গল্প, একটি রাত্রি, একটি অশ্রু। সে নিজেকে জিজ্ঞাসা করে—তাহলে এই সব লেখার কি কোনো মূল্য নেই? সে কি কেবলই নাচগানের পাত্র? তার কবিতা, তার আত্মার যন্ত্রণা কি কেউ কোনোদিন বুঝবে না? সেই রাতে লক্ষ্মী তার জীবনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কবিতাটি নিজেই আগুনে ফেলে দিল, একটিমাত্র পঙক্তি রেখে—“একদিন আমি শুধু শরীর ছিলাম, আজ আমি শব্দ।”
এই পরিবর্তন লক্ষ্মীকে ভেঙে দিল না, বরং নতুন করে গড়ে তুলল। সে নতুন করে লিখতে শুরু করল, কিন্তু এবার নিজের নাম না দিয়ে ছদ্মনামে। “মহাশ্বেতা” নামে সে এক কাব্যসংকলন প্রকাশ করল—ব্রাহ্মসমাজের তরুণ সাহিত্যচক্রে সাড়া পড়ে গেল। কেউ জানল না এই কবিতা কার, শুধু একদিন রায়চৌধুরী পরিবারের এক যুবা কবি আলোচনা সভায় বলে উঠলেন, “মহাশ্বেতা নামক এই ছায়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো মহীয়সী নারী আছেন, যিনি শুধু শব্দ দিয়ে নয়, সাহসে বাঁচেন।” লক্ষ্মী সেই কথাটি শুনে রাতভর কাঁদল, আর সকালে উঠে একটি সিদ্ধান্ত নিল—সে এখন নিজের জন্য লিখবে, নিজের জন্য বাঁচবে। বালকৃষ্ণ রায় সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন, নবাববাড়ি তাকে আর নিরাপত্তা দিতে পারবে না, সমাজ কখনোই তাকে স্বীকৃতি দেবে না—কিন্তু সে নিজেকে নিজে দেবে। সে নিজের মধ্যে এক নতুন ‘লক্ষ্মী’ তৈরি করতে শুরু করল, যে আর নটী নয়, শুধু শরীর নয়, সে এক কাব্যের কান্না, এক সাহসের ছায়া।
অধ্যায় ৮: নবাবের প্রেতছায়া
নবাব আলতামাশ মির্জা’র মৃত্যুর পর নবাববাড়ি যেন হঠাৎ করেই শূন্য হয়ে যায়, অথচ লক্ষ্মীর চারপাশে তার অনুপস্থিতিও এক ধরনের উপস্থিতি হয়ে উঠতে থাকে। নবাবের শেষ দিনের মুছে না-ফেলা গন্ধ, তাঁর রেখে যাওয়া সেই সাদা চাদরের উপর কালির ছাপ, এবং পুরনো হারমোনিয়ামের কণ্ঠে ধরা পড়ে তার ছায়া—লক্ষ্মীর রাতগুলি যেন আবার ভরে ওঠে নতুন ভয়ে, নতুন সাহসে। প্রাসাদে যারা ছিল—দরবানের দল, রান্নাঘরের বুড়ি রাধু, এমনকি পেছনের বাগানে থাকা বুড়ো মালীও ফিসফিস করে বলে, “নবাব সাহেব রাত্তিরে ঘোরা শুরু করেছেন আবার।” লক্ষ্মী প্রথমে হেসে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু একরাতে, আয়নায় সে দেখে নিজের পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। নবাব নয়, তার স্মৃতি। সে স্মৃতি যা ভালোবাসা আর ঘৃণার মাঝখানে টলোমলো দাঁড়িয়ে আছে। সেই রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয়—সে এই বাড়ি ছাড়বে না। সে বাড়িটিকে ভাঙতে দেবে না। সে তার শরীরে বহন করে বেড়াবে নবাবের ছায়া, কিন্তু দাসীবৃত্তিতে নয়—একজন রক্ষাকর্ত্রীর মতো।
নতুন ঝড় আসে শহরে। ইংরেজ কোম্পানির শাসনকর্তারা নবাবদের বিতাড়িত করে শহরের কর্তৃত্ব নিতে চাইছে। বাড়ির বাইরে তখন নতুন ইতিহাসের বুনন শুরু হয়ে গেছে। লক্ষ্মী বুঝতে পারে, ইতিহাস শুধু রাজাদের জন্য নয়—নটীদের হাতেও সে তৈরি হতে পারে। সে পুরনো কাগজ ঘাঁটে, নবাবের কবিতার পাণ্ডুলিপি, তার নিজের লেখা গানের খাতা, শিষ্যদের তালিমের খসড়া—সব গুছিয়ে রাখতে থাকে। কেউ যেন ভুলে না যায় এই বাড়ির গৌরব, এই ঘরের মেয়েদের কণ্ঠ, এবং সেই মানুষটিকে যে নটীর প্রেমে পড়েও তার সন্মান নষ্ট হতে দেয়নি। সে শহরের বিদ্বজ্জনদের আমন্ত্রণ জানায় নবাববাড়ির আসরে, কিন্তু এবার লক্ষ্মী গায় না, সে পাঠ করে। ইতিহাস, ভাষা, সাহস আর স্বাধীনতার পাঠ। অনেকেই উঠে যেতে চায়, কিন্তু কেউ পারে না। এক নটী, যে তার সৌন্দর্যের জন্য নয়, তার বুদ্ধির জন্য মানুষকে বসিয়ে রাখে—এই প্রথম সেই অভিজ্ঞতা শহর দেখে।
অধ্যায়ের শেষে, যখন এক সন্ধ্যায় লক্ষ্মী একা বসে, পুরনো আসরে চুপচাপ, নবাবের শেষ দেওয়া রুদ্র বেহাগ সুরে হারমোনিয়াম টেনে নেয় তাকে অন্য এক জগতে। সে মনে মনে নবাবকে বলে, “তুমি যেও না। আমি তোমার স্মৃতি হয়ে থাকব। আর আমার কণ্ঠে তুমি বাজবে, যেমন আজও বাজছো।” বাহিরে তখন শহরের বাতাসে ভেসে আসে নতুন ইংরেজ আইনের ঘোষণা। কিন্তু নবাববাড়ির ভেতরে, এক নটীর কণ্ঠে, আর এক নবাব বেঁচে থাকে।
অধ্যায় ৯: সিংহাসনের ছায়া
চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা নবাববাড়ির উঠোন যেন আজ কোনও উত্সব নয়, এক যুদ্ধক্ষেত্র। লক্ষ্মী জানে, এই গানের আসর, এই নাচের অঙ্গন, এখন তার জন্য কেবল এক প্রতীক—প্রতিপত্তির, প্রতিবাদের, এবং প্রতিক্রিয়ার। নবাব সাহেবের মৃত্যু ঘটেছে রহস্যজনকভাবে, এবং শহরের গুজব তুঙ্গে। কেউ বলছে বিষক্রিয়া, কেউ বলছে ষড়যন্ত্র। কিন্তু লক্ষ্মী জানে—এই মৃত্যুর শিকড় অনেক গভীরে। একদিন যে পুরুষ তাকে কিনে নিতে চেয়েছিল, আজ সে নিজেই হারিয়ে গেল গোপন এক রাজনীতির খেলায়। কিন্তু এই মৃত্যু শুধুই ক্ষমতার অবসান নয়—এ এক অজস্র নারীর ঘোমটার ফাঁক দিয়ে বয়ে আসা কান্নার ইতি। লক্ষ্মী এখন আর নিছক এক নটী নন—তিনি নবাববাড়ির এক ‘ছায়া শাসক’, যিনি জানেন, ক্ষমতা সবসময় সিংহাসনে বসে না, কখনও সেটা গান হয়ে ভেসে আসে বাতাসে, আর কখনও তা এক নারীর মৌন উপস্থিতিতে বিদ্ধ করে পুরুষতান্ত্রিক অহংকারকে।
নবাবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারের প্রশ্ন ওঠে। আশেপাশের জমিদার পরিবার, শাসকগোষ্ঠী, এমনকি নবাবের দূরসম্পর্কের আত্মীয়রাও এসে জড়ো হয়—কারা এবার নবাববাড়ির নিয়ন্ত্রণ পাবে, তার হিসেব কষতে। কিন্তু এই বিভ্রান্তির মধ্যে লক্ষ্মী নীরবে এগিয়ে আসেন। তিনি জনসমক্ষে নবাবের রেখে যাওয়া চিঠি প্রকাশ করেন—যেখানে লেখা আছে, নবাব তাঁর জীবনের একমাত্র বিশ্বাসভাজন রূপে লক্ষ্মীকেই চিহ্নিত করেছেন। শহরের মাথারা হতবাক—এক নটী? ক্ষমতার উত্তরসূরি? কিন্তু নবাববাড়ির পুরোনো কর্মচারী, সেনাদের একাংশ, এবং বহু সাধারণ মানুষ লক্ষ্মীর পক্ষে দাঁড়ায়। কারণ তারা জানে—এই বাড়ির সংস্কৃতি, সুর, সম্মান বাঁচিয়ে রেখেছেন একমাত্র লক্ষ্মী। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়, যেখানে এক নারী নিজের প্রজ্ঞা ও সাহস দিয়ে গড়ে তোলেন প্রশাসনের কাঠামো। জমিদারদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয় একের পর এক। কুচক্রীদের মাঝে কানাঘুষো শুরু হয়—”লক্ষ্মী দেবী নাকি তান্ত্রিক, নইলে এত ক্ষমতা এল কোথা থেকে?”—কিন্তু লক্ষ্মী জানেন, তার শক্তি শব্দে, সাহসে, এবং আত্মসম্মানে।
নতুন শাসনব্যবস্থা চালু হয়। লক্ষ্মী রেওয়াজঘরকে আবার প্রাণবন্ত করেন, যেখানে শুধু নাচ নয়, মেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। নতুন প্রজন্মের নারীরা আসতে শুরু করে—তাদের কেউ চিত্রশিল্পী, কেউ গীতিকার, কেউ নাট্যকার। একেকজন হয়ে ওঠে লক্ষ্মীর সাহচর্যে নবাববাড়ির ‘নতুন ভবিষ্যৎ’। কিন্তু এই জয়যাত্রার মাঝে একদিন গভীর রাতে আসেন এক চিঠি বাহক—মুছে যাওয়া অতীত থেকে একটি খবর নিয়ে। সেই চিঠি বলে, লক্ষ্মীর একসময়ের প্রেমিক—মৃণাল—আছেন জীবিত, এবং তিনি আজও খুঁজছেন ‘লক্ষ্মী’কে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এই নারী আজও ভাবেন, কে ছিল তাঁর জীবনের আসল ভরসা—নবাব, না কি সেই কবি যে একদিন তাঁকে নাম দিয়েছিল, “প্রমীলার পদ্মফুল”? শেষ অধ্যায়ের দিকে এগোতে থাকে গল্প, যেখানে নারী শুধু ইতিহাসে ঠাঁই পায় না—তার ইতিহাস সে নিজেই লেখে।
অধ্যায় ১০: শেষ আসর
নবাব আলী রেজা বাহাদুরের মৃত্যুর পরে লক্ষ্মীর গানের আসর যেন ধীরে ধীরে একটি নিঃশব্দ ঘূর্ণিতে বিলীন হয়ে যেতে লাগল। নবাববাড়ির সিংহদুয়ার খুলে থাকলেও আগের সেই উজ্জ্বলতা, সেই রসিক শ্রোতামণ্ডলীর কোলাহল আর ফিরে এল না। চারদিকের রাজনৈতিক বদলের ছাপ পড়েছিল সংস্কৃতির উপরেও। নবাবি পৃষ্ঠপোষকতা উঠে যেতে লাগল, জমিদারির অবসান, ব্রিটিশ প্রশাসনের নতুন আইন—সব মিলিয়ে লক্ষ্মীর গানের আকাশে মেঘ জমছিল ক্রমশ। কিন্তু লক্ষ্মী তবু হার মানেনি। সে স্থির করেছিল, এই শেষ সময়টুকু সে ব্যবহার করবে নিজের মতো করে—নাচের, গানের, কবিতার, আর আত্মস্মরণের মধ্য দিয়ে। নবাবের ছোট ভাই কুতুব সাহেব এবং কিছু পুরনো অনুরাগী এখনো তার পাশে দাঁড়ালেন। তারা লক্ষ্মীর জন্য শহরের প্রান্তে একটি ছোট নাটমন্দির গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন। এই নাটমন্দিরই হয়ে উঠল লক্ষ্মীর নতুন আশ্রয়, যেখানে সে নিজের হাতে নবীন নটী, গায়িকা ও কবিদের তৈরি করতে লাগল।
লক্ষ্মীর জীবনের শেষ পর্বটি ছিল ইতিহাসের বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ। যারা তাকে শুধুই “নটি” বলে অবজ্ঞা করত, তাদের ভুল প্রমাণ করে সে গড়ে তুলল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তার লিখিত কবিতা ও গানগুলো কেবলমাত্র রসাত্মক বিনোদন ছিল না—তাতে ছিল সমাজে নারীর অবস্থান, স্বাধীনতা, এবং নিজের ইচ্ছার প্রতি দায়বদ্ধতার গভীর বার্তা। এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টিস্নাত কলকাতার আকাশের নিচে, নাটমন্দিরে সে গাইল একটি নতুন গান—যেখানে সে বলেছিল, “আমি কোনো নবাবের অলঙ্কার নই, আমি শব্দের অধিষ্ঠাত্রী।” সেদিন দর্শকাসনে বসে থাকা একজন তরুণী, যার নাম ছিল হরিমতী, লক্ষ্মীর চোখে এক নবজন্মের দীপ্তি দেখতে পেয়েছিল। হরিমতী পরে লিখেছিল, “লক্ষ্মীদি শুধু একজন নর্তকি ছিলেন না, উনি এক বিদ্রোহ। যিনি আমাদের শিখিয়েছেন—যে নারী সমাজে একবার হারিয়ে যায়, সে শব্দের পথ বেছে নিলে ইতিহাস তাকে উপেক্ষা করতে পারে না।”
একদিন হঠাৎ করে লক্ষ্মীর শরীর ভেঙে পড়ে। কলকাতার একমাত্র হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক, যিনি আগেও বহুবার তাকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন, এবার বলেন—“অধিক ক্লান্তি, এবং বয়সের ভার।” নাটমন্দিরে সেই শেষবারের মতো এক আসর বসেছিল। লক্ষ্মী সেই রাতে গাইল তার নিজের লেখা এক পদ—“শেষ ধ্বনি যদি হয়, তবে তা হোক জয়গান।” গানের পর যখন সে দর্শকদের দিকে তাকাল, কেউ কেউ চোখ মুছছিল। সেদিন উপস্থিত ছিলেন কিছু বিশিষ্ট লেখক, ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধি, এমনকি এক ইংরেজ শিক্ষাবিদও। শেষ গান শেষে সে মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাথা নত করল, তারপর নিঃশব্দে চলে গেল মঞ্চপিছনে। সেই রাতেই, গভীর রাত্রে, লক্ষ্মী তার কক্ষে চিরনিদ্রায় গেল—কিন্তু তার শব্দ রয়ে গেল। পরদিন সংবাদপত্রে শিরোনাম ছিল: “নটি নয়, ইতিহাসের এক কবি প্রয়াত।” নাটমন্দিরের পাশেই তৈরি হলো একটি ছোটো স্মৃতিস্তম্ভ—“লক্ষ্মী মঞ্চ”—যেখানে আজও প্রতি বছর একবার করে, সেই শেষ গানের স্মরণে একটি আসর বসে, আর কেউ একজন গেয়ে ওঠে—“আমি শব্দের অধিষ্ঠাত্রী… আমি ইতিহাসের ছায়ায় রক্তাক্ত আলো।”
সমাপ্ত