ঐশী মুখার্জী
পর্ব ১: আগমন
রাত্রি নামে ধীরে ধীরে, যেমন করে কোনও চেনা মুখে অচেনা ছায়া নেমে আসে। নবগ্রাম যেন শহরের এক ভুলে যাওয়া বাঁক—আলপথে মোড়া, কুয়াশার ভিতর ঢাকা, আর কোনো এক অসমাপ্ত অভিশাপের ভিতর আটকে থাকা একটি গ্রাম। এখানেই থামল ছ’জন তরুণ নাট্যদলের সদস্য—সাগ্নিক, শ্রেয়সী, ঋদ্ধি, অয়ন, তুরীণ আর জয়িতা। তারা এসেছে একটা নাটকের রিহার্সাল করতে, যার জন্য দরকার ছিল এক নির্জন জায়গা, দূরে শহরের কোলাহল থেকে।
এই ‘রাতবাড়ি’র কথা জানিয়ে দিয়েছিল তুরীণের মামা, যিনি স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাড়ির নাম শুনেই একটা কাঁটার মতো কিছু গাঁথা ছিল সাগ্নিকের মনে—“রাতবাড়ি”—মানে কি? রাত হলে বাড়ি জেগে ওঠে, না কি রাতেই শুধু এর অস্তিত্ব?
যাত্রাপথে রিকশাচালক, যাকে শেষমেশ রাজি করানো গিয়েছিল ওদের নিয়ে যেতে, বহুবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিল, যেন এদের নিয়ে একটা অলৌকিক বোঝাপড়ায় সে ঢুকে পড়েছে। নবগ্রামের শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল, আকাশ যেন লালচে একটা পর্দা টেনে নিল গ্রামের ওপর।
রাতবাড়ির প্রথম দর্শনেই অস্বস্তি হয়েছিল সকলের। বড় একটা দোতলা পোড়ো বাড়ি, যার জানালায় কাচ নেই, কাঠের প্যানেলগুলো অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, বাড়ির মূল দরজাটা মজবুত কাঠের, আর একদম তালাবদ্ধ। তুরীণ যখন চাবি বের করল, তখনই জয়িতা ফিসফিস করে বলল, “এতদিন কেউ ছিল না এখানে?”
“না, প্রায় কুড়ি বছর বন্ধ,” তুরীণ জানাল। “এই বাড়িতে নাকি একসময় গ্রামের বিখ্যাত যাত্রাদল ‘অগ্নিবীণা’ রিহার্সাল করত। তারপর… কিছু একটা হয়েছিল। কেউ কিছু বলেনা খোলসা করে।”
ঋদ্ধি হেসে বলল, “অবশ্যই! ভূত!”
সবাই হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে একটা চাপা আতঙ্ক লুকিয়ে ছিল। বাড়ির ভেতর ঢুকেই একটা গন্ধ পেল শ্রেয়সী—পুরনো, ভিজে কাঠ আর মাটির গন্ধ, যার সঙ্গে মিশে আছে হালকা আগুনে পোড়া কাপড়ের মতো গন্ধ।
“গন্ধটা… অদ্ভুত না?” শ্রেয়সী বলল।
“ইতিহাসের গন্ধ,” সাগ্নিক বলল, নিজের ভয় ঢাকতে ঢাকতে।
তারা ঘর গুছিয়ে নিল। উপরের ঘর হবে মেয়ে সদস্যদের, নিচের দুটো ঘর ছেলেদের। রান্নাঘরে গ্যাসের ব্যবস্থা নেই, তবু একটা চুল্লি আছে, আর পাশের ঘরে কয়েকটা পুরনো কাঠের চেয়ার, কিছু আলমারি।
রাত্রির খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই বসে নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করছিল। নাটকটি—‘অরিন্দমের প্রতিবাদ’—এক রাজন্য সমাজের বিরুদ্ধে এক সাধারণ শিল্পীর প্রতিরোধের গল্প। আশ্চর্যভাবে বাড়ির পরিবেশের সঙ্গেই যেন একরকম মিল খুঁজে পেলেন সবাই।
অয়ন বলল, “জানো, আমার মনে হচ্ছে এই বাড়ির ভেতরেও কেউ ছিল, কেউ আছে, যে নিজের গল্প বলতে চায়। আমরা শুধু ভুল স্ক্রিপ্ট পড়ছি।”
তুরীণ বিরক্ত হয়ে বলল, “ধুর! ওসব বলে আমাদের ভয় দেখাস না। পাঁচদিন আমরা এখানে থাকব, কাজ শেষ করে চলে যাব।”
সেই রাতে ঘুম আসছিল না সাগ্নিকের। সে বিছানা ছেড়ে উঠল, বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। দূরে মাঠের ওপর কুয়াশার স্তর জমে আছে, মাঝে মাঝে কোনো অদৃশ্য পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ সে কানে পেল একটা শব্দ—কোনো মিহি গলার গান—কীর্তনের মতো, কিন্তু ভেতরে যেন বিষণ্নতা।
“কে গান গাইছে?” সে ফিসফিস করে।
নিচে নেমে এল, আলোর উৎস খুঁজতে। বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই সে দেখতে পেল—বাড়ির পেছনের ছোট মঞ্চটার দিকে একটা আলো নড়ে উঠছে। কেউ একজন দাঁড়িয়ে, লাল আলখাল্লা পরা, আর মঞ্চের একপাশে মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে একটি হাত—যা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে।
“আয়ন?” সাগ্নিক ডাকল।
কেউ সাড়া দিল না।
সে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল, কাঁধের পেছনে যেন ঠাণ্ডা একটা শ্বাস লাগছে। মঞ্চের কাছে যেতেই আলো নিভে গেল। পায়ের নিচে পাতা খসখস করে উঠল, কিন্তু আর কোনো শব্দ নেই। শুধু অন্ধকার আর কুয়াশা।
ঠিক তখনই তার কানে এলো—এক নারীর গলা, স্পষ্ট, ক্ষীণ, যেন ভেসে আসছে দূর অতীত থেকে—
“আমরা থামিনি, আমাদের থামানো হয়েছিল।”
সাগ্নিক পেছনে ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু মঞ্চের নিচে, মাটিতে, যেন কিছু একটা খোঁড়া হয়েছে। সে ভালো করে তাকিয়ে দেখে—একটা ছেঁড়া নীল পাড়ের শাড়ির অংশ বেরিয়ে আছে মাটির ফাঁক দিয়ে।
সে পেছনে হঠাৎ একটা শব্দ শুনল—জোরে হাঁচির মতো কিছু একটা। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল অয়ন, ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই এখানে কী করিস?”
সাগ্নিক তাড়াতাড়ি বলল, “তুই কিছু দেখলি? গান, আলো?”
“আরে না! আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম তুই বাইরে যাচ্ছিস।”
সাগ্নিক কিছু না বলে তার ঘরে ফিরে এল। মনে হচ্ছিল, এই বাড়ি যেন শুধু আস্তে আস্তে তার শরীরে নয়, মাথার ভিতরেও ঢুকে যাচ্ছে।
ঘুমের আগে শেষবার সে জানালার বাইরে তাকাল। মঞ্চ অন্ধকার। সব নিস্তব্ধ।
তবুও তার মনে হচ্ছিল, কোনো এক গলা যেন বলছে—
“এই নাটক এখনো শেষ হয়নি।”
পর্ব ২: নাটকের বাইরের সংলাপ
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সাগ্নিক বুঝে গেল, রাতের অভিজ্ঞতা স্বপ্ন ছিল না। বিছানা ছাড়িয়ে তার পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে কয়েকটি শুকনো পাতার টুকরো, আর প্যান্টের নিচে লেগে আছে মাটি—সেই মাটির রং, যেটা সে দেখেছিল মঞ্চের নিচে। আয়নাকে সে কিছুই বলেনি, কিন্তু তার মাথার ভেতর বেজে চলেছে সেই একটি লাইন—“আমরা থামিনি, আমাদের থামানো হয়েছিল।” কারা থামিয়েছিল? কেন?
তুরীণ রান্নাঘরের পেছনে কাঠ খুঁজতে গিয়ে ফিরে এসে জানাল, “তোমরা জানো? বাড়ির পেছনের কাঠের ঘরটায় একটা পুরনো মুখোশ পাওয়া গেছে। মাটি চাপা দেওয়া ছিল। কেউ যেন সেটা লুকিয়ে রেখেছিল।”
সবার কৌতূহল বাড়ে। জয়িতা মুখোশটা ধুয়ে এনে রাখে ছেলেদের ঘরের সামনে। সেটি যেন এক অর্ধেক মুখ—মুখের একপাশ গাঢ় রঙে আঁকা, অন্য পাশে কিছুই নেই, যেন অনস্তিত্বের প্রতীক। ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করে, “এটা কি কোনো চরিত্রের প্রতীক?”
তুরীণ বলে, “আমার মামা একবার বলেছিলেন, এই বাড়িতে একসময় এক মহিলা যাত্রাদলের নেতৃত্ব দিতেন। তাঁর নাম ছিল সৌভাগ্যশ্রী। খুব কড়া মানুষ ছিলেন, কিন্তু অসাধারণ অভিনেত্রী। নাকি একদিন হঠাৎ করে নাটক চলাকালীন স্টেজেই অজ্ঞান হয়ে যান… তারপর আর কখনও কারও চোখে পড়েননি।”
শ্রেয়সী ফিসফিস করে বলে, “তাহলে কি তিনি… এখনও এই বাড়িতেই…?”
সবাই চুপ করে যায়।
সেই দুপুরে তারা রিহার্সাল শুরু করে উঠোনে। ‘অরিন্দমের প্রতিবাদ’ নাটকটির চতুর্থ দৃশ্যে একটি বিক্ষোভদৃশ্য রয়েছে, যেখানে প্রধান চরিত্র রাজসভায় দাঁড়িয়ে বলে, “আমার কণ্ঠ আমার অস্ত্র। তাতে যদি শাসকের ভয় হয়, তো ভয় করুক!”
সাগ্নিক যখন এই সংলাপটি উচ্চারণ করল, তখনই বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে এলো একটি চাপা হাসি—এক মহিলার গলা, কর্কশ নয়, কিন্তু যেন চিড় ধরে যাওয়া বাঁশির মতো।
সবাই চুপ করে গেল। কে হাসল?
তুরীণ বলল, “শ্রেয়সী, তুমি কি ভেতরে গিয়েছিলে?”
“না তো,” শ্রেয়সী বলল। “আমি তো এখানেই ছিলাম।”
অয়ন বলল, “তাহলে ওটা এল কোথা থেকে?”
ঋদ্ধি ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমরা যদি এই নাটকের মধ্যেই ঢুকে যাই? যদি এই বাড়ির ইতিহাসই আমাদের নাটক হয়ে ওঠে?”
কেউ আর কোনো কথা বলল না। শুধু এক ঝলক বাতাস এল—তাতে শুকনো পাতাগুলো মঞ্চের দিকে উড়ে গিয়ে থেমে গেল মুখোশটার গায়ে। মুখোশটি হঠাৎ করেই সামান্য নড়ে উঠল।
রাতের খাওয়ার পর সবাই নিজেদের ঘরে চলে গেল, কিন্তু সাগ্নিক ঘুমোতে পারছিল না। মাথার মধ্যে নাটকের সংলাপ আর সেই অদৃশ্য মহিলার হাসি বারবার ফিরে আসছিল। সে চুপিচুপি উঠল, পকেটে ল্যাম্প নিয়ে বেরোল।
সে সোজা গেল সেই কাঠের ঘরটার দিকে যেখানে মুখোশটি পাওয়া গিয়েছিল। দরজাটা আধখোলা, বাতাসে দুলছে। ভিতরে একটা পুরনো কাঠের তাক, সেখানে গাদা গাদা পুরনো যাত্রার স্ক্রিপ্ট, কিছু ফটো, আর একটি কাঁসার থালা।
সাগ্নিক স্ক্রিপ্টগুলোর পাতা ওল্টাতে থাকে। একটি পাতায় লেখা—“নাটকের নাম: ‘রাতবাড়ির রাত’। নাট্যকার: সৌভাগ্যশ্রী দেবী”।
সে চমকে ওঠে। এ কি সত্যিই? তবে কি এই বাড়িতে একসময় এই নামের একটি নাটক হয়েছিল? আর তার লেখিকা ছিলেন সেই রহস্যময় নারী?
সে যখন পাতাগুলো উল্টোচ্ছিল, তখন হঠাৎ করেই পেছনের জানলায় এক টোকা শব্দ। সে পিছনে তাকাল—কেউ নেই। আবার একটা টোকা—এইবার দরজার দিকে।
সে এগিয়ে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা—চুলে খোঁপা, লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, চোখ দুটো অসাধারণ গভীর।
সাগ্নিক ফিসফিস করে বলল, “আপনি কে?”
মহিলা বললেন না কিছুই। শুধু একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন তাঁর হাতে। তারপর অদৃশ্য।
সাগ্নিক হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এল, চারপাশ খুঁজে দেখল। কেউ নেই। হাওয়ায় পাতাগুলো উড়ছে, কিন্তু কোথাও কোনো পায়ের শব্দ নেই।
সে নিচে ফিরে এসে আলো জ্বালিয়ে কাগজটি পড়ল।
লেখা:
“তোমরা নাটক করতে এসেছ, তাই না? তবে একটা কথা মনে রেখো—সব গল্প অভিনয়ের জন্য নয়। কিছু গল্প স্বরূপ প্রকাশেই ভয়ঙ্কর। ‘রাতবাড়ির রাত’ সেই রকম। সেই নাটক যেদিন শেষ হয়নি, সেদিন থেকেই রাত থেমে গেছে। আজও।”
তার শরীর হিম হয়ে আসে। সে জানে না কেন, কিন্তু এবার তার মনে হতে থাকে—এই নাটক, এই বাড়ি, এই মুখোশ—সব এক সূত্রে বাঁধা।
সে ধীরে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে—কাঠের ফ্রেমে পেরেক দিয়ে গেঁথে রাখা একটা পুরনো নামফলক। আগে কেউ খেয়াল করেনি।
লিখা: “রাত্রি ঘোষালের স্মৃতিতে—এই নাট্যমঞ্চ উৎসর্গীকৃত।”
সাগ্নিক পেছনে তাকিয়ে বলে উঠল, “তাহলে আপনি ছিলেন রাত্রি? আপনি কি সেই নাটিকার শেষ চরিত্র?”
আলো নিভে গেল।
পর্ব ৩: রাত্রি ঘোষালের অনুপস্থিত প্রবেশ
রাতবাড়ির কাঠের ফ্রেমে ঝোলানো সেই নামফলক যেন হঠাৎ ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়। রাত্রি ঘোষাল—এমন এক নাম, যা নাট্যজগতের কোনো পরিচিত সূত্রে নেই, অথচ এই বাড়ির ছায়া ছুঁয়ে সে যেন জেগে থাকে প্রতিটি বাতায়নে। সাগ্নিক সেই মুহূর্তে স্পষ্ট বুঝতে পারে, তাদের আগমনের পর থেকে যা কিছু ঘটছে—তা কেবল অতৃপ্ত আত্মার কল্পিত ছায়া নয়, বরং এক অসমাপ্ত নাটকের পুনর্জাগরণ।
সে খাতায় লিখে নেয় প্রতিটি শব্দ, যেন এসব হারিয়ে না যায়—“রাত্রি ঘোষাল, ‘রাতবাড়ির রাত’ নাটকের প্রধান চরিত্র? না কি তিনি নিজেই সেই নাটক?”
পরদিন সকালে বাকিদের সঙ্গে নাস্তা খেতে খেতে সাগ্নিক ঘটনা বলতে চাইল। কিন্তু মুখ খুলতেই জয়িতা বলে উঠল, “গতকাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। একটা মঞ্চ, মাঝখানে একটা বড় আলো, আর আমি একা দাঁড়িয়ে। কেউ একজন ডায়লগ বলছিল, কিন্তু ঠোঁট নড়ছিল না। গলা যেন অন্য কারও ছিল।”
তুরীণ বলল, “সত্যি কথা বলছিস?”
জয়িতা বলল, “হ্যাঁ। আর আশ্চর্যের কথা, সেই গলা বলছিল—‘তোমরা থামাতে পারবে না। এই নাটক আবার শুরু হবে।’”
ঋদ্ধি তখন হেসে বলল, “আমিও স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু আমারটা ভয়ানক ছিল। আমি একটা ঘরে বন্দি, চারপাশে পুরনো মুখোশ, তারা সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।”
সাগ্নিক বুঝল, এবার আর এটা একা তার অভিজ্ঞতা নয়। এই রাতবাড়ি, এই নাট্যদল, এই মঞ্চ—সব এক জায়গায় এসে যেন এক আত্মার প্রেতছায়া তৈরি করছে।
তাদের নাটকের রিহার্সাল শুরু হয় দুপুরবেলায়। আজ দৃশ্য ছিল সেই অংশ, যেখানে মূল চরিত্র অরিন্দম তার মৃত্যুর আগমুহূর্তে স্বীকারোক্তি দেয়—“আমাকে যে থামাতে চেয়েছিল, সে নিজেই ইতিহাস হয়ে যাবে।”
সাগ্নিক এই সংলাপ উচ্চারণ করতেই হঠাৎ পেছনের ঘরে থেকে একটা শব্দ—চেয়ারের হঠাৎ উল্টে যাওয়ার মত। সবাই ছুটে গেল। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখে—মুখোশটা মাটিতে পড়ে আছে, তার পাশেই একটি পুরনো আলমারি হালকা খোলা, ভিতর থেকে ঝুলে আছে একটি শাড়ির আঁচল। কেউ যেন ভিতর থেকে টানছিল সেটাকে।
শ্রেয়সী বলল, “দরজা খুলে দেখি কি আছে।”
তুরীণ সাহস করে আলমারির দরজা টেনে খোলে। ভিতরে একটি বাক্স, তার ওপর লাল কালি দিয়ে লেখা—
“রাত্রি। চূড়ান্ত দৃশ্য।”
বাক্সটা খুলতেই একটি খাতা, কিছু পোড়ানো স্ক্রিপ্ট, আর একটি চিঠি।
সাগ্নিক চিঠি পড়তে শুরু করল—
“যদি কখনও কেউ আসে, যে বুঝতে চায়, তবে তাকে বলো—এই নাটক কখনও শেষ হয়নি। আমি মঞ্চে বলেছিলাম, ‘আমি মরিনি, আমার কণ্ঠকেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ সেই রাতেই তারা আগুন লাগিয়েছিল। আমায় বলে দেওয়া হয়েছিল—এই নাটক যদি শেষ হয়, তবে আর কোনো মেয়েকে এই দেশে মঞ্চে উঠতে দেওয়া হবে না।”
চিঠিতে লেখা নেই কে এই ‘তারা’। কিন্তু সাগ্নিক জানে—তারা মানে ক্ষমতাধর পুরুষেরা, যারা ভয় পায় নারীর কণ্ঠকে, নারীর প্রতিরোধকে।
সে বাক্সে আরও খোঁজ করতেই একটি মুখোশ দেখতে পায়—আগের মুখোশটির বিপরীত রূপ। একপাশ কালো, আরেকপাশে স্বচ্ছ কাচের মতো ফাঁকা। মুখোশটি হাতে নিয়েই সাগ্নিক চমকে ওঠে। যেন তার আঙুলের ভেতর দিয়ে এক ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়।
ঋদ্ধি বলে, “এই মুখোশটাই কি সেই নাটকের শেষ দৃশ্যের প্রতীক?”
জয়িতা তখন ফিসফিস করে বলে, “আমার মনে হয় রাত্রি ঘোষাল শুধু একজন চরিত্র নন, উনি নিজেই নাটক হয়ে গেছেন। উনি চাইছেন আমরা আবার সেই নাটক মঞ্চস্থ করি, যাতে তাঁর গল্প একদিন পূর্ণ হয়।”
তুরীণ বলে, “কিন্তু আমরা তো জানি না নাটকের শেষ কী হয়েছিল। স্ক্রিপ্ট তো নেই।”
সাগ্নিক পেছনের খাতা থেকে একটি পাতার নিচে ভাঁজ করা কাগজ খুলে দেখায়।
“এই যে, ওখানে লেখা—‘শেষ দৃশ্য: রাত্রি একা দাঁড়িয়ে, সবাই চলে গেছে। সে বলে—আমি থাকব, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আমাকে আবার বলে না, ‘তুমি পারো।’”
শ্রেয়সীর চোখে জল চলে আসে। “আমরা কি পারি না, ওনার গল্পটা শেষ করতে?”
তারা সিদ্ধান্ত নেয়—নতুন নাটকের রিহার্সালের পাশাপাশি, তারা ‘রাতবাড়ির রাত’-এর সেই দৃশ্যটিও মঞ্চস্থ করবে, যেটা কোনোদিন হয়নি।
রাতবেলায় প্রস্তুতি চলে। সবাই আলাদা আলাদা সংলাপ তৈরি করে, চরিত্র আঁকে। জয়িতা রাত্রির চরিত্রে অভিনয় করবে—তার চোখের ভেতর ইতিমধ্যেই লেগে আছে সেই অভিজ্ঞতার ছাপ।
রিহার্সালের শেষপর্বে, সাগ্নিক যখন মঞ্চের আলো জ্বালাতে যাচ্ছে, তখন সে দেখে—পেছনে বসে রয়েছে একজন নারী, যাকে সে চেনে না। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, চোখে গভীর জল, কিন্তু শান্ত।
সে কিছু বলার আগেই নারীটি উঠে দাঁড়ায়, মঞ্চের দিকে এগোয়, আর বলেন—
“আজ শুধু নাটক নয়, আজ বিচার হবে।”
আলো নিভে যায়।
পর্ব ৪: আলোর নিচে ছায়া
যে মুহূর্তে সেই নারী বলল, “আজ শুধু নাটক নয়, আজ বিচার হবে,” তখন যেন রাতবাড়ির বাতাসেও ছন্দ থেমে গেল। সাগ্নিক নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না—আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরজুড়ে এক অদৃশ্য চাপ, যেন মঞ্চের এক অদৃশ্য ওজন নামছে তার পিঠে।
আলো আবার আস্তে আস্তে জ্বলল, কিন্তু কেউ আর মঞ্চে ছিল না। চারপাশে নিঃস্তব্ধতা, আর সেই মহিলার ছায়া মিলিয়ে গেছে বাতাসে। জয়িতা কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “তুমি দেখেছ ওনাকে, তাই না?”
সাগ্নিক মাথা নাড়ল। “তোমার মনে আছে উনি কী বললেন?”
“হ্যাঁ,” জয়িতা জবাব দিল, “বিচার। কিন্তু কার বিচার? কিসের বিচার?”
ঋদ্ধি ও তুরীণ তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, নাটকের শেষ দৃশ্য কীভাবে সাজানো যায়। কেউ কিছু বোঝাতে পারছিল না, কিন্তু সকলের মধ্যে অদ্ভুত এক উপলব্ধি হচ্ছিল—এই নাটকটা তারা নিজেরা ঠিক করেনি। এটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, বরং এটি যেন তাদের ভেতর থেকেই উঠে আসছে, ভিতরের কোনো ভাঙাচোরা ইতিহাসের স্তর ছিঁড়ে।
শ্রেয়সী বলল, “রাত্রি ঘোষাল যদি মঞ্চে মারা গিয়ে থাকেন, তবে তাঁর মৃত্যু কি দুর্ঘটনা ছিল, না পরিকল্পিত?”
সেই প্রশ্নে ঘরটা হিম হয়ে গেল।
তখনই তুরীণ বলল, “তোমরা কেউ লক্ষ্য করেছ? পেছনের খাজাঞ্চিঘরের দরজাটা গতকালও বন্ধ ছিল, কিন্তু আজ সকালে খোলা দেখেছি।”
সাগ্নিক একবার ভাবল কিছু বলবে না, কিন্তু নিজেকে থামাতে পারল না।
“আমি গতকাল সেখানে গিয়েছিলাম,” সে বলল, “সেখানে একটা নামফলক আছে—‘রাত্রি ঘোষালের স্মরণে’। আর একটা বাক্স পেয়েছিলাম, যাতে লেখা ছিল ‘চূড়ান্ত দৃশ্য’। খোলার পর একটা চিঠি পেয়েছিলাম। চিঠিতে লেখা ছিল—‘আমার কণ্ঠ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ ”
ঋদ্ধি গলা নামিয়ে বলে, “তবে কি সত্যিই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল?”
তুরীণ বলল, “তবে কি আমরা… ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছি?”
সাগ্নিক বলল, “না। হয়তো এটাই ঠিক জায়গা। আমাদের মধ্যে দিয়ে কেউ তার অপূর্ণ নাটক শেষ করতে চাইছে। এটা শুধু ভূতের গল্প নয়। এটা ইতিহাসের কাছে আত্মসমর্পণের মুহূর্ত।”
সেই রাতে তারা প্রস্তুতি নেয় একটি ছোট্ট রিহার্সালের। মঞ্চের সামনে ছড়ানো কিছু বাতি, কুড়োনো লাল কাপড়ের পারদ দিয়ে বানানো পোশাক, আর মুখোশের সেই দুটি রূপ—একটি অর্ধেক সত্য, আর একটি অর্ধেক নিরবতা।
জয়িতা রাত্রির ভূমিকায় ওঠে মঞ্চে। তার গলায় তখন শুধু সংলাপ নয়, যেন কিছু এসে জড়িয়ে ধরছে তাকে ভিতর থেকে।
সে বলে উঠল—“তোমরা কেউ শোনোনি। আমি যা বলিনি, তা-ই আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছ। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর তোমরা আলো নিভিয়ে দিয়েছিলে। কিন্তু আমি হারাইনি। আমি কেবল চুপ করে গিয়েছিলাম, কারণ আমার কণ্ঠ তখন মঞ্চের বাইরে ছিল।”
তার কণ্ঠে এমন এক আবেগ, এমন এক ভয় আর দৃঢ়তা মিশে গেল যে সবার শরীর কাঁপতে লাগল।
ঠিক তখনই, পেছনের মঞ্চের কাঠের দরজা ভেঙে পড়ল। একটা ঝাঁকুনি, একগাদা ধুলো, আর পেছনের অন্ধকার থেকে উঠে এল এক ছায়া—একটা নারীমূর্তি, সাদা শাড়িতে, মাথায় লাল টিপ, চোখে হাহাকার আর আগুন।
সে বলল—“এই সংলাপ আমার। আমি লেখা হয়নি কোনো স্ক্রিপ্টে, কিন্তু আমিই শেষ দৃশ্য। আমি বলেছিলাম—‘যদি আমি হারিয়ে যাই, তবুও আমার প্রতিধ্বনি থাকবে।’ তোমরা কি তা শুনতে পেয়েছ?”
জয়িতা অবাক হয়ে বলে, “তুমি… তুমি রাত্রি ঘোষাল?”
ছায়া একপলক তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর বলল, “তোমরা সত্যি বললে না। তোমরা অভিনয় করছ। কিন্তু আমি সত্যি।”
এই বলে সে মিলিয়ে গেল।
সবাই স্থবির। শ্রেয়সী কাঁপা গলায় বলল, “আমরা কী করছি? আত্মাদের নিয়ে খেলছি না তো?”
তুরীণ বলল, “না। আমরা তাদের গল্প বলছি। যারা কোনোদিন সুযোগ পায়নি। যে কণ্ঠগুলো শুধু অন্ধকারের মধ্যে মঞ্চ তৈরি করেছিল।”
ঋদ্ধি বলল, “আমরা যদি শেষ দৃশ্য অভিনয় করি, তাহলে ওরা কি মুক্তি পাবে?”
সাগ্নিক চুপ করে থেকে বলল, “হয়তো। কিন্তু অভিনয় করতে হবে মন থেকে। কারণ রাত্রির আত্মা শুধু সংলাপ নয়, সত্য চায়।”
রাতবাড়ি সেই রাতে নিঃশব্দ ছিল না। বাতাসে মিশে ছিল কোনো এক হারিয়ে যাওয়া নাটকের সংলাপ, যার প্রতিটি শব্দ এখন উঠে আসছিল এই ছয়জন তরুণের মুখে।
তারা তখনও জানত না—পরদিন সকালে, যখন তারা সেই নাটক শেষ দৃশ্য পর্যন্ত মঞ্চস্থ করবে, তখন সেই মঞ্চে উঠে আসবে এমন এক সত্য, যা তাদের জীবনকেই নাটক করে তুলবে।
পর্ব ৫: শেষ দৃশ্যের আগে
রাত্রি ঘোষাল চলে গেছেন—বা হয়তো মঞ্চের আড়াল থেকে তাকিয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন। পরদিন সকালের আলো যখন রাতবাড়ির দোতলার জানলা ছুঁয়ে ভিতরে আসে, তখন মনে হয়—বাড়িটাও যেন একটু হালকা হয়েছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে। যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে যার অপেক্ষা ছিল বহু বছর ধরে।
সাগ্নিক ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে—সামনের মাঠটা আগের চেয়ে বেশি নীরব। তবুও আজ ভয় নয়, বরং ভিতরে একটা চাপা তৎপরতা কাজ করছে। নিচে নামতেই জয়িতা বলে, “আজ আমরা শেষ দৃশ্যটা করব। ঠিক নাটক নয়, বরং যেটা হয়নি, সেটাই করে দেখাব।”
তুরীণ কাপড় গুছিয়ে রাখছিল। মুখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি, কিন্তু চোখে যে চাপা উত্তেজনা, সেটা কারও নজর এড়ায় না। শ্রেয়সী রান্নাঘরে ঢুকে কিছু চা তৈরি করছিল—তার কাঁপা হাত কেউ টের না পেলেও চায়ের পেয়ালায় কাঁপুনি ফেলে দিয়েছিল।
ঋদ্ধি একটা কাঠের প্যানেল ঝাড়ছিল, বলে উঠল, “আজকের রিহার্সাল শুধু নাটকের নয়। আমাদের নিজেদেরও একটা পরীক্ষা।”
সবাই জানে—এই নাটক তারা লিখেনি। এই দৃশ্য তাদের সৃষ্টি নয়। তারা শুধু সেই শব্দের বাহক, যারা একসময় কথা বলার সুযোগ পায়নি। হয়তো আজও না।
বেলা দশটার দিকে তারা মঞ্চে দাঁড়ায়। বাড়ির পেছনের উঠোনে বানানো অস্থায়ী মঞ্চ, চারপাশে পাতা গাছের ডাল, মাঝখানে একটা কাঠের পাটাতন। তার ওপর রাখা পুরনো মুখোশ, লাল পাড়ের শাড়ি, আর রাত্রি ঘোষালের চিঠির প্রতিলিপি।
প্রথম সংলাপ বলবে জয়িতা।
সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায়। বাতাস থেমে যায়। যেন পুরো গ্রাম নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে।
জয়িতা বলে—
“আমি যখন কথা বলতাম, তোমরা বলতে মেয়েরা চিৎকার করে। আমি যখন চুপ করে থাকতাম, তোমরা বললে, মেয়েরা কিছু বোঝে না। আজ আমি দাঁড়িয়েছি তোমাদের সামনে, শুধু একটি প্রশ্ন নিয়ে—আমার কণ্ঠ কি তোমাদের কাছে অস্ত্র, না আত্মা?”
তার কণ্ঠ থেমে গেলে পেছন থেকে মৃদু শব্দ—পাতার ঘর্ষণ, না কি হাততালি? কেউ বুঝে উঠতে পারে না।
সাগ্নিক তার সংলাপ বলে—
“আমরা মঞ্চে উঠে বলি যা, তা নাটক নয়। তা সেই সত্য, যা আমাদের ভিতর থেকে উঠে আসে। যদি তাতে কারও ভয় হয়, তবে তারা আমাদের নাম মুছে ফেলে। কিন্তু আমরা ফিরি। প্রতিধ্বনির মতো।”
ঋদ্ধি মুখোশ পরে নাট্যকারের চরিত্রে উঠে আসে। সে বলে—
“আমি শুধু দৃশ্য লিখি না। আমি প্রতিবাদের জন্য প্ল্যাটফর্ম বানাই। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার কলমই আমার অস্ত্র।”
তখনই পেছনের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
একটা চাপা, গাঢ় আওয়াজ মঞ্চের পেছনের দরজা থেকে ভেসে আসে। দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যায়।
তাদের কেউ কিছু বলে না। তারা জানে, রাত্রি ঘোষাল ফিরেছেন। তিনি এসেছেন তার শেষ দৃশ্য দেখতে।
জয়িতা বলে—
“রাত্রি ঘোষাল, আপনি যদি থাকেন, তবে আজ আমরা আপনার দৃশ্য শেষ করতে চাই। আপনি আমাদের ব্যবহার করছেন, আমরা জানি। কিন্তু আমরা আপনার কথা বলছি। তাই আপনাকে সামনে আসতে হবে।”
সেই মুহূর্তে বাতাসের মধ্যে এক পায়ের শব্দ—নরম, কিন্তু স্থির। একজন নারী এগিয়ে আসে মঞ্চে, কিন্তু তার পা মাটিতে লাগে না। যেন হাঁটছেন বাতাসে ভর দিয়ে। মুখে শান্তি, কিন্তু চোখে জ্বলছে অপেক্ষার দাবানল।
তিনি সামনে দাঁড়ান, মুখোশটা তুলে নেন, আর জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলেন—
“তুমি আমার কণ্ঠকে শরীর দিয়েছ। এখন আমাকে বিদায় দাও।”
সাগ্নিক তখন বলে—
“শেষ সংলাপ তোমার। তুমি বলো। আমরা শুনব।”
রাত্রি ঘোষাল ধীরে ধীরে চারপাশে তাকিয়ে বলেন—
“আমি বলেছিলাম—আমাকে জ্বালিয়ে দাও। কিন্তু আমার শব্দ বাঁচিয়ে রেখো। তোমরা সেই প্রতিজ্ঞা পালন করেছ। এখন আমার যাবার সময়।”
তারপর তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেন। বাতাস কাঁপে। ছায়া ছুঁয়ে যায় মঞ্চের গায়ে।
তার মুখ হাসিতে ভরে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে, আলোয় মিলিয়ে যায় তার শরীর।
চারপাশ নিঃস্তব্ধ। কেবল গাছের ডালে একটি শালিক এসে বসেছে, যেন সে-ই এই নাটকের শেষ দর্শক।
জয়িতা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। সাগ্নিক তার পিঠে হাত রাখে। কেউ কিছু বলে না।
তারা সবাই জানে—নাটক শেষ হয়েছে। এবং সেই সঙ্গে, এক আত্মাও।
পর্ব ৬: মুক্তি অথবা যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি
রাত্রি ঘোষালের মিলিয়ে যাওয়ার পর বাড়িটা যেন নিঃশ্বাস ফেলল। ঠিক যেন একটা দীর্ঘ দিনের অসুখ সারিয়ে উঠে দাঁড়ানোর প্রথম মুহূর্ত। সকালের আলো উঠোন ছুঁয়ে যায় না, কিন্তু ছায়াগুলো হালকা লাগে, যেন তাদের রঙ ফিকে হয়েছে, ওজন কমে গেছে।
তবে ভিতরে ভিতরে কিছু একটা বদলে যাচ্ছে—এই অনুভূতি স্পষ্ট হয়ে উঠল দুপুর নাগাদ, যখন তুরীণ রান্নাঘরের পাশে টুলে বসে ডায়েরি লিখছিল। হঠাৎ সে কেমন কাঁপা গলায় ডেকে উঠল, “সাগ্নিক, এখানে আয় তো!”
সাগ্নিক ছুটে গেল। তুরীণের হাতের ডায়েরির পাতা হাওয়ায় ওড়ে। কাঠের দেয়ালের ওপর সাদা চক দিয়ে লেখা—“আমি এখনও এখানে“। লেখাটা একেবারে ওপরে, এমন জায়গায় যে কেউ সাধারণভাবে পৌঁছতেই পারে না।
“কে লিখল?” তুরীণ ফিসফিস করে।
সাগ্নিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে পড়ে যায় রাত্রির চোখ—শেষ দৃশ্যে তার মুখে শান্তি থাকলেও সেই চোখে ছিল এমন কিছু, যেন সব শেষ হয়নি।
ঋদ্ধি আসে, দেয়াল দেখে বলে, “এটা রাত্রি লেখেনি। এটা অন্য কারো লেখা।”
শ্রেয়সী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলে, “কাল রাতে আমি একটা শব্দ শুনেছিলাম… কারো কাঁদার মত, কিন্তু যেন অনেকগুলো গলা একসঙ্গে।”
তারা সবাই আবার একসঙ্গে বসে পড়ে। কেউ কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে চারদিকে।
অয়ন, যে এতদিন খুব একটা কিছু বলেনি, ধীরে গলা খোলে। “রাত্রি ঘোষাল তো শুধু একক কাহিনি ছিলেন না। ওনার পাশে আরও কেউ ছিল না কি? হয়তো আরও কণ্ঠ, যারা কথা বলতে পারেনি, অভিনয় করতে পারেনি। এই রাতবাড়ি শুধু একটা আত্মার ছিল না।”
সাগ্নিক মাথা নিচু করে বলে, “আমরা জানি না ঠিক কাকে মুক্তি দিলাম। আমরা যেটা করেছি, সেটা একটা চিহ্ন—যে এই জায়গায় কেউ আবার মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছে। সেই জায়গাটা হয়তো আরও অনেকের।”
ঋদ্ধি বলে, “আমরা একটা ভুল করেছি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, ভূত মানে একজন, একটা চেহারা। কিন্তু এখানে যারা আটকে, তারা সবাই… অসমাপ্ত কণ্ঠ।”
সেই রাতে কিছুই রিহার্সাল হয়নি। সবাই একভাবে চুপ করে ছিল। কিন্তু ঠিক রাত আড়াইটে নাগাদ, তুরীণ জেগে ওঠে। তার মনে হয়, পেছনের ঘরে কেউ ধীরে ধীরে গান গাইছে—যাত্রার গলা, কিন্তু লয়ের ভেতর চাপা কান্না।
সে ধীরে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দূরের মঞ্চে কেউ দাঁড়িয়ে। আলো নেই, কিন্তু আবছা রূপের রেখা বোঝা যায়। মাথায় সাদা ওড়না, পেছন ঘাড়ে বাঁধা লম্বা চুল। সে সোজা তাকিয়ে আছে ঘরের দিকে।
তুরীণ দৌড়ে গিয়ে সাগ্নিককে ডাকে। সবাই জেগে ওঠে। তারা যখন মঞ্চের দিকে দৌড়ায়, তখন কাউকে দেখা যায় না। শুধু মঞ্চের মাঝখানে একটি মুখোশ পড়ে—নতুন মুখোশ। আগের মুখোশগুলো ছিল চিরচেনা, কিন্তু এটাতে মুখ নেই। কেবল শূন্যতা।
সাগ্নিক মুখোশটা হাতে নেয়। ভিতরে লেখা—“কোনোদিন অভিনয় করতে পারিনি।”
“এ কার মুখোশ?” জয়িতা ফিসফিস করে।
ঋদ্ধি বলে, “রাত্রির সহচরী? কন্যা? সহঅভিনেত্রী? না কি… সেই সব মেয়েরা, যারা মঞ্চে উঠতেই পারেনি?”
সাগ্নিক জানে, আর চুপ করে থাকা যাবে না। এই নাট্যযাত্রা শেষ নয়। এক আত্মা চলে গেলে, অন্যরা তার জায়গা নেয়। রাতবাড়ি এখন এক থিয়েটার, যেখানে প্রতিদিন রাত হয়, আর প্রতিদিন কেউ অভিনয় না করেই কাঁদে।
সেই রাতেই তারা আবার বসে।
সাগ্নিক বলে, “আমরা একটি প্রজেক্ট শুরু করব। ‘রাতবাড়ির না-বলা গল্প’—এমন একটি নাট্যপাঠ, যেখানে আমরা শুধু সেইসব চরিত্র গড়ে তুলব, যারা কোনোদিন লিখিত হয়নি। যাদের নাম কেউ রাখেনি। যাদের কণ্ঠ কেউ শোনেনি।”
তুরীণ বলে, “আমরা যদি আবার অভিনয় করি, তবে ওরা কি আমাদের ক্ষতি করবে না?”
“না,” সাগ্নিক বলে, “ওরা অপেক্ষা করছে। আমরা যদি শ্রদ্ধা দিয়ে তাদের নাম বলি, তাদের দৃশ্য লিখি, তারা সাথেই থাকবে। ওরা ক্ষতিকর নয়। ওরা শুধু অসম্পূর্ণ।”
শ্রেয়সী সেই মুখোশটা নিয়ে বলে, “এটা দিয়ে নাটক শুরু হবে।”
অয়ন মুখে হালকা হাসি এনে বলে, “এবার আমরা নয়, তারাই মঞ্চে উঠবে। আর আমরা… শুধু আলো জ্বালিয়ে দেব।”
রাত তখন গাঢ় কালো নয়, বরং ধূসর। দূরের মাঠে কুয়াশার আস্তরণ নেমেছে, কিন্তু বাতাসে ভয়ের গন্ধ নেই। কেবল অপেক্ষার।
পরদিন সকালে, নবগ্রামের হাইস্কুল মাঠে নাটক মঞ্চস্থ হয়। ছোট, বিনা ঘোষণার এক প্রদর্শন। দর্শক খুব কম—কয়েকজন স্কুল ছাত্র, এক আধজন গ্রামবাসী।
কিন্তু মঞ্চের আলো জ্বলে ওঠে।
নাটকের নাম দেওয়া হয়—“নামহীন”।
প্রথম সংলাপ—
“আমি জন্মেছিলাম দর্শক হয়ে। কেউ আমায় চরিত্র দেয়নি। আজ আমি নিজেই উঠে এসেছি। আমায় আর ভয় দেখানো যাবে না।”
মাঠে বাতাস বয়, আর রাতবাড়ির ছায়াগুলো হালকা হয়।
পর্ব ৭: যারা চরিত্র পায়নি
নাটক শেষ হওয়ার পরে কেউ হাততালি দেয়নি, কেউ উঠে এসে প্রশংসাও করেনি। মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন দর্শকের চোখে যেন একরাশ অস্বস্তি, কেউ কেউ নীরব, কেউ অন্যমনস্ক। কিন্তু যারা অভিনয় করছিল, তাদের ভেতরে যেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি। জয়িতা মঞ্চের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুঝেছিল, এই ‘নামহীন’ নাটকের প্রথম সংলাপ তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসেনি—কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে।
ঋদ্ধি মুখোশটা রেখে দিয়ে বলে, “আজকের নাটকটা আমি মনে রাখব, কারণ এটা আমি লিখিনি। আমি কেবল ধার দিয়েছিলাম আমার শরীর, আমার কণ্ঠ।”
তুরীণ পাশে বসে ছিল। তার হাতে একটা ছোট নোটবুক, যেখানে সে সারাদিনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি কথা লিখছিল। মুখে বলল, “এই নাটকের দর্শক হয়তো কম ছিল, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি—তারা কেউই সত্যিকারের মানুষ ছিল না।”
সাগ্নিক চুপ করে ছিল। সে জানত, এখন কিছু বলার সময় নয়। রাতবাড়ি ফিরছে তার পুরনো ছায়ায়। ফিরে আসছে তারা, যারা কোনোদিন সুযোগ পায়নি। ফিরে আসছে না-বলা সংলাপ।
রাত্রি ঘনিয়ে এলো। সবার মধ্যে আবার সেই অনুরণন। “আজ রাতে কি আবার কেউ আসবে?”
ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছিল। খাবার তৈরি হচ্ছিল। হঠাৎ জয়িতা বলল, “তোমরা জানো, আমি আজ একটা পায়ের ছাপ দেখেছি রান্নাঘরের মেঝেতে। একজোড়া ছোট পা, বাচ্চার মতো, কিন্তু আমাদের কেউ তো শিশুর মতো পায়ের ছাপ ফেলতে পারে না।”
ঋদ্ধি বলল, “আমিও একটা ছায়া দেখেছিলাম, দোতলার বারান্দা ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু তার উচ্চতা… বলতে পারো, একটা কিশোরীর মতো।”
তুরীণ মুখ তুলে বলল, “তাহলে কি এবার অন্য কেউ এসেছে? রাত্রি ঘোষাল তো চলে গেছেন, তাই না?”
সাগ্নিক তখন চুপ করে ছিল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি টের পাচ্ছিল—একটা চাপা কষ্ট, যেন কাউকে অনেকদিন পর চিঠি লেখা শুরু করা, আবার থেমে যাওয়া, কারণ জানো না কীভাবে শেষ করবে।
সে উঠে গেল বারান্দায়। ঠান্ডা বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যায়। চাঁদের আলোয় মঞ্চটা অস্পষ্ট দেখা যায়, কিন্তু আজ সেখানে কেউ নেই। কেবল সেই মুখোশটা পড়ে আছে, যেটার মুখ ছিল না।
ঠিক তখন সে শুনতে পেল একটা শব্দ—গলায় কিছু নেই এমন এক কণ্ঠ। কেবল নিঃশ্বাস। ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দে কেউ বলছে,
“আমি দেখতে পাইনি আলো, কিন্তু আমি মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলাম। কেউ আমাকে ঠেলে নামিয়ে দিয়েছিল।”
সে পেছনে তাকায়—কেউ নেই। আবার সেই কণ্ঠ—
“আমার নাম ছিল না, আমি শুধু অন্যদের জন্য নাচতাম।”
সাগ্নিক নিচে নেমে এল। সে আজ আর ভয় পায় না। সে জানে, এই বাড়ি তাকে ভয় দেখানোর জন্য নয়—এই বাড়ি তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, গল্প তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন প্রতিটি চরিত্র সুযোগ পায় তার নিজস্ব দৃশ্য অভিনয় করার।
রাতবাড়ির একতলার পুরনো স্টোররুমে ঢুকে সে খোঁজ শুরু করে। আলমারি, খালি বাক্স, ধুলো, পোকামাকড়। হঠাৎ একটা কাঠের তক্তার নিচে দেখতে পায় মাটির দেয়ালে কালি দিয়ে লেখা কয়েকটি নাম—ছেঁড়া ছেঁড়া, কেউ কেউ মুছে গেছে।
একটি নাম স্পষ্ট—‘চাঁদনী’। আরেকটি—‘তুলসী’। তৃতীয়টি আধা লেখা—‘বী…’
তার নিচে লেখা—
“আমরা সবাই একবার rehearsal-এ দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু মুখোশ উঠল না। আমাদের বদলে অন্যরা অভিনয় করল। তারপর… আমরা আর ডাক পাইনি।”
সাগ্নিকের গা শিউরে ওঠে না। তার বুক ভারী হয়ে যায়।
সে বাড়ির সবাইকে ডাকে। ডেকে বলে, “এই বাড়িতে শুধু একজন নয়, বহু আত্মা আটকে আছে। রাত্রি ঘোষাল ছিলেন একটি প্রতীক। কিন্তু এই নামগুলো—চাঁদনী, তুলসী—এরা সবাই সেইসব মেয়ে, যারা কখনও গল্প হয়নি, সংলাপ পায়নি, মুখোশও না। আমরা যদি সত্যি এই আত্মাদের মুক্তি দিতে চাই, তবে আমাদের তাদের জন্য নাটক করতে হবে। প্রতিটি নামের জন্য একটি দৃশ্য।”
তুরীণ বলে, “কিন্তু এরা কারা? কোথা থেকে আসত?”
শ্রেয়সী ধীরে ধীরে বলে, “সম্ভবত এরা সবাই যাত্রাদলে থাকত। হয়তো গাওয়ার জন্য, নাচের জন্য, শুধু দর্শক আকর্ষণের জন্য। কিন্তু নাটকে চরিত্র পায়নি।”
ঋদ্ধি ফিসফিস করে, “তাহলে তো ওরা এখনও ‘রিহার্সাল’-এ আটকে আছে।”
সাগ্নিক বলল, “হ্যাঁ। আমাদের এবার সেই ‘রিহার্সাল’ শেষ করতে হবে। প্রতিটি নামের জন্য একেকটা ছোট দৃশ্য। আমরা বলব না সত্যি কি ঘটেছিল—আমরা বলব, যদি সুযোগ পেত, তারা কী বলত।”
পরদিন থেকে শুরু হল নতুন কাজ। নামহীনদের নাম পুনরুদ্ধার। চারদিকে খোঁজ, মুখোশ তৈরি, পোষাক বানানো। জয়িতা একটা ছোট গান লিখল, গলায় কষ্টের ছায়া রেখে—“আমি চরিত্র নই, আমি ছায়া। তবুও মঞ্চে উঠেছি, শেষবার জানাতে—আমিও একদিন নাচতাম।”
তুরীণ প্রতিটি মুখোশের পাশে রেখে দিল সেই নামের নিচে লেখা ছোট সংলাপ।
ঋদ্ধি বলল, “আমরা যখন নাটক করতাম, ভাবতাম নাট্যকার সব জানে। এখন বুঝছি, কণ্ঠ যদি না ওঠে, চরিত্র লেখা হয় না।”
মঞ্চে সেদিন সন্ধেবেলায় দশটি মুখোশ। দশটি দৃশ্য। দশটি নাম।
আর প্রতিটি দৃশ্য শেষে বাতাসে শোনা যায়—একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস, কখনও কান্না, কখনও হাসি।
তবে আর কেউ ফিরে আসেনি।
পর্ব ৮: তারা আর নামহীন নয়
নবগ্রামের বাতাসে এই প্রথম শান্তির গন্ধ। না, সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। কিন্তু এক ধরনের সমাপ্তির স্পর্শ লেগেছে মঞ্চের কাঠে, বাতাসে, এমনকি সেই পুরনো ভাঙা আয়নাতেও যার সামনে বসে কেউ কোনোদিন সংলাপ মুখস্থ করত। দশটি মুখোশের সামনে দশটি জ্বলন্ত মোমবাতি, প্রতিটি নামের পাশে তাদের নিজস্ব ‘অভিনয়’—ছোট দৃশ্য, সংলাপ, গান, কখনো শুধু একটি নিঃশব্দ উপস্থিতি।
যাত্রাদলের ছায়াগুলো একে একে যেন বিদায় নিয়েছে, কোনো ঘোষণা ছাড়া, কোনো আতঙ্ক ছাড়াই। সাগ্নিক ভেবেছিল, হয়তো শেষ দৃশ্য হবে আতঙ্কের, নৈরাশ্যের, কান্নার। কিন্তু শেষ দৃশ্য অনেকটা যেন বর্ষার শেষ বৃষ্টির মতো—শব্দহীন, ধুয়ে দেওয়া, আলগা আলোয় ভেজা।
রাত্রি ঘোষালের নামে তারা একটি ছোট্ট ফলক লাগায় নাট্যমঞ্চের পাশের ইটের গায়ে—
“এই মঞ্চ উৎসর্গ—তাদের নামে, যারা কোনোদিন নাম পায়নি, তবুও মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছিল।”
শ্রেয়সী একটা থালা ভর্তি ফুল নিয়ে রাখে ফলকের নিচে। জয়িতা মুখোশগুলো যত্ন করে বাক্সে রাখে, যেন পরবর্তী নাট্যকাররা একদিন এই চরিত্রদের আবার ডাকবে।
ঋদ্ধি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে সেই বাড়িটার ছাদ, যেখানে তারা প্রথমদিন রাতে আলো দেখতে পেয়েছিল। আজ সেই ছাদে কিছুই নেই। কেবল এক টুকরো আকাশ, পরিষ্কার, নিঃশব্দ।
তুরীণ বলে, “আমরা কি এবার ফিরে যাব?”
সাগ্নিক মাথা নাড়ে। “হ্যাঁ। কিন্তু এবার আমরা ফাঁকা হাতে ফিরছি না।”
তুরীণ প্রশ্ন করে, “আমরা তো ভূতের গল্প লিখতে আসিনি। তাহলে আমরা কী নিয়ে ফিরছি?”
সাগ্নিক হাসে। “আমরা ফিরছি নাম নিয়ে। যাদের নাম ছিল না, তাদের নাম। তাদের ইতিহাস। আমরা যারা থিয়েটার করি, তারা গল্প বলি না—গল্পকে মঞ্চে দাঁড়াতে সাহায্য করি।”
সেই রাতে শেষবারের মতো তারা একসঙ্গে বসে। খাবার তৈরি হয়—সাধারণ খিচুড়ি আর আলুভাজা। আলো কম। কেউ কিছু বলে না, যেন এই নিরবতাটাই শ্রদ্ধা।
তাদের ঘুম আসে গভীর। স্বপ্ন আসে না। কেবল এক শান্ত নিঃশ্বাসে ভেসে থাকে রাতবাড়ি।
ভোররাতে পাখির ডাক শোনা যায়। নীচে নেমে এসে জয়িতা দেখে—দরজার সামনে একটা ছোট পিসে লেখা চিরকুট।
“তোমাদের অভিনয় আমাদের গল্প হয়ে উঠেছে। আমরা আর কেউ থামিয়ে দেবে না।”
পাশে একটা মুখোশ—তিন ভাগে বিভক্ত মুখ। এক ভাগে কান্না, এক ভাগে হাসি, আর মাঝখানে—শান্তি।
তারা সবাই জানে, এটা কার লেখা নয়। কেউ রেখে যায়নি। এটা যেন রাতবাড়ির নিজের বিদায়চিঠি।
তারা সেই মুখোশটা রেখে দেয় আলমারির উপর, সামনে রেখে দেয় এক গ্লাস জল, কিছু ফুল, আর খোলা খাতা। খাতায় লেখা—
“যারা পরে আসবে, তারা যেন জানে, আমরা এখানেই ছিলাম।”
বাড়ি ছাড়ার আগে তারা পেছন ফিরে একবার তাকায়। দোতলার জানলায় হালকা হাওয়া দুলে দেয় পর্দা। যেন বাড়িও বিদায় জানায়, মাথা নাড়িয়ে বলে—“থ্যাঙ্ক ইউ।”
ট্রেনের জানলার পাশে বসে সাগ্নিক লিখছে তার শেষ নোট—
“রাতবাড়ি একটি ভূতের বাড়ি নয়। ওটি একটি মঞ্চ। এবং প্রতিটি মঞ্চে কিছু কণ্ঠ থাকে, যারা কখনো আলো পায় না। আমরা কেবল সেই আলোটা জ্বালাতে এসেছিলাম। যাদের ভয় বলে মনে করা হয়, তারা আসলে শুধু একটি সুযোগ খুঁজছিল নিজেদের কথা বলার।”
দূরে মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে, বাঁশঝাড়, ধানক্ষেত, নদী। কেউ আর পেছনে ফিরছে না। কিন্তু মন ফিরছে বারবার—যেখানে কণ্ঠহীন আত্মারা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত এক দৃশ্যের, এক সংলাপের, এক রিহার্সালের।
তারা তা পেয়েছে।
শেষ।