Bangla - ভূতের গল্প

নদীর ধারে ডাকিনী

Spread the love

মানস পাত্র


অজিত মুখার্জি ছিল একেবারেই সাধারণ এক গ্রামীণ স্কুলশিক্ষক। বয়স তার ছত্রিশ, মুখে পাতলা দাড়ি, চোখে এক ধরনের ধীরস্থিরতা। শহরের চাকচিক্যময় জীবনের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই—বরং গ্রামের মাটির গন্ধেই সে শান্তি খুঁজে পেয়েছিল। প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সে স্কুলের পড়া প্রস্তুত করত, তারপর ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে সাইকেলে চেপে স্কুলে যেত। সারাদিন ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানোই ছিল তার প্রধান কাজ। বাচ্চাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অসীম—তাদের হাসি, তাদের ছোট ছোট প্রশ্ন তাকে এক অদ্ভুত আনন্দ দিত। দিনের শেষে যখন পাঠ শেষ হতো, তখন তার ভেতরে একধরনের ক্লান্তি জমত, আর সেই ক্লান্তি দূর করার জন্যই সে প্রতিদিন হাঁটা পথে বাড়ি ফিরত। তবে সে হাঁটার জন্য অন্য কোনো রাস্তা বেছে নিত না—তার নির্দিষ্ট পথ ছিল, যেটি নদীর ধারে আঁকাবাঁকা পথে চলে গেছে। নদীটির নাম “চন্দ্রেশ্বরী নদী”—গ্রামের প্রাণ, গ্রামবাসীর সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সন্ধ্যা নামার সময় নদীর ঘাটে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য নেমে আসত—ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসে ভেসে আসা ভিজে মাটির গন্ধ, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের ছায়া যেন একে রহস্যময় করে তুলত।

অজিতের কাছে এই পথ ছিল শুধুই পথ নয়—বরং ধ্যানের মতো এক অভ্যাস। নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে সে দিনের সমস্ত চাপ, সমস্ত ক্লান্তি ভুলে যেত। তার মনে হতো, নদী তাকে যেন এক গোপন আশ্রয় দিচ্ছে, যেখানে সে নিজের ভেতরের সমস্ত দুঃখ, প্রশ্ন, বা অস্থিরতা নামিয়ে রাখতে পারে। সে হাঁটার সময় একবারও তাড়াহুড়ো করত না—ধীর পদক্ষেপে নদীর পাড় ধরে চলত, মাঝে মাঝে থেমে ঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকত। কখনো শিশুদের নদীতে নামতে দেখা যেত, কখনো মহিলারা কলসি নিয়ে জল তুলতে আসত, আবার কখনো একাকী মাঝি দাঁড় বেয়ে ঘাটের পাশে নৌকা বেঁধে রাখত। এসব দৃশ্য অজিতের কাছে ছিল জীবনের সহজ অথচ গভীর সৌন্দর্যের প্রতীক। তবু এই সৌন্দর্যের মাঝেই এক ধরনের নিঃসঙ্গতা ছিল—কারণ অজিতের নিজস্ব সংসার নেই। সে একাই থাকে, বাবা-মা বহুদিন আগে প্রয়াত, আর বিবাহ সে করেনি। ফলে দিনের শেষে তার এই হাঁটার সময়টাই হয়ে উঠত একমাত্র সঙ্গী—যেখানে সে নিজেকে, প্রকৃতিকে, আর জীবনের শূন্যতাকে একসঙ্গে অনুভব করত।

তবে অজিতের এই যাত্রা কেবল একঘেয়ে রুটিনে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং প্রতিদিনের হাঁটা ছিল তার কাছে এক ভ্রমণের মতো। সে হাঁটার সময় কখনো কবিতা ভাবত, কখনো জীবনের ছোট ছোট প্রশ্নের উত্তর খুঁজত। কোনো দিন গ্রামের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে চিন্তা করত, কোনো দিন ভাবত বাচ্চারা ভবিষ্যতে কী হবে। নদীর ঢেউ যেন তাকে বারবার মনে করিয়ে দিত, জীবনও আসলে এক প্রবাহ—যা থেমে থাকে না, কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। অজিতের মনে হতো, নদীর সঙ্গেই সে কথোপকথন করছে, নদীই তাকে কিছু অজানা জ্ঞান শোনাচ্ছে। সন্ধ্যার আবছা আলো, পাখিদের ডেকে ওঠা, দূরে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি—সব মিলিয়ে সেই সময়টা হয়ে উঠত এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, যা শুধু তার নিজের। গ্রামে অনেকেই আশ্চর্য হয়ে বলত—“অজিতবাবু কেন প্রতিদিন ওই অন্ধকার ঘনিয়ে আসা সময়ে নদীর ধারে হাঁটেন? ওখান দিয়ে তো সবাই এড়িয়ে চলে!” কিন্তু অজিত কোনো জবাব দিত না। তার কাছে এই পথের টান এমনই যে অন্য কোনো রাস্তা কখনো মনে আসেনি।

এইভাবেই বহুদিন ধরে অজিতের প্রতিদিনের জীবন চলছিল। স্কুল, পড়ানো, আর সন্ধ্যার নদীর ধারে হাঁটা—এটাই ছিল তার রুটিন। কিন্তু সে জানত না, এই নিস্তব্ধ হাঁটার পথ একদিন তার জীবনে অন্য রকম ভয় ও রহস্য ডেকে আনবে। নদী, যাকে সে এতদিন নিজের সঙ্গী ভেবেছে, সেই নদীই তার সামনে উন্মোচন করবে অচিন এক কাহিনি। আপাতত সে জানে না—নদীর অন্ধকারে শুধু জলের ঢেউ আর পাখির ডাকে ভরে থাকে না, সেখানে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য কান্না, এক অপূর্ণ জীবনের আক্ষেপ। প্রথম অধ্যায় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনে তাই প্রশ্ন জাগে—অজিতের প্রতিদিনের পথ কি শুধু শান্তির পথ, নাকি এই নদীর ধারে লুকিয়ে আছে অজানা কোনো অভিশাপ, যা তার জীবনকেই পাল্টে দেবে চিরকালের জন্য?

***

সেদিনও ঠিক আগের দিনের মতো অজিত স্কুল ছুটি করে নদীর ধারের পথে ফিরছিল। আকাশে তখন সূর্য ডোবার মুখ, লালচে আভা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। বাতাসে এক ধরনের ঠান্ডা ভাব, তালগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা আলো অদ্ভুত সব ছায়া ফেলে রাখছিল নদীর তীরে। হাঁটতে হাঁটতে সে দিনের পড়ানোর কথা মনে করছিল, কোন ছাত্র আজ ভালো লিখেছে, আর কার হাতের লেখা আরও খারাপ হয়ে গেছে—এইসব নিয়ে ভাবনায় ডুবে ছিল সে। হঠাৎই যেন চারপাশে এক অচেনা শব্দ ভেসে এল। অজিত থেমে গেল। প্রথমে মনে হলো হয়তো কোনো পাখির ডাক বা দূরে কোথাও বাচ্চাদের খেলার শব্দ। কিন্তু না, মনোযোগ দিয়ে শোনার পর সে স্পষ্ট বুঝল, শব্দটা অন্য কিছু। সেটা কোনো হাসি নয়, কোনো গান নয়—বরং এক দীর্ঘশ্বাস মেশানো মেয়েলি কান্না। নদীর জলের ভেতর থেকে যেন কেউ একা বসে কাঁদছে, আর সেই কান্নার ঢেউ ভেসে আসছে কানে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল তার। তবু সে নিজেকে সামলে নিল, বলল—“না, নিশ্চয়ই ভুল শুনছি। হয়তো বাতাসে গাছের ডাল ভাঙছে, অথবা কোথাও পশুর ডাক।” কিন্তু সে জানত, তার কানে ভুল আসছে না। সেই কান্নার সুর খুবই স্পষ্ট, আর অদ্ভুতভাবে হৃদয়ে একটা শীতলতা ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

পরদিন আবারও একই সময়ে যখন নদীর ধারে ফিরছিল, অজিত চেষ্টা করছিল আগের দিনের অভিজ্ঞতা ভুলে যেতে। সে নিজেকে বলছিল—“আজ কিছুই শুনব না, আমি শুধু হাঁটব।” কিন্তু নদীর ধারে পৌঁছাতেই তার কানে আবার সেই কান্না ধরা দিল। এবার যেন আরও কাছে, আরও তীব্র। অজিতের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। নদীর জলের ওপর হালকা কুয়াশার মতো কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল, আর সেই কুয়াশার আড়াল থেকেই কান্নার শব্দ আসছিল বলে মনে হচ্ছিল। সে দাঁড়িয়ে রইল, শোনার চেষ্টা করল। শব্দটা ছিল যেন এক তরুণীর—বেদনাভরা, ভাঙা গলার কান্না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, কণ্ঠস্বরটা নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে। হঠাৎই মনে হলো, সেই কান্নার সুরে যেন ডাকে—“শোনো, থামো, আমার কাছে এসো।” অজিত কেঁপে উঠল। তবু যুক্তিবাদী মন বলল, “না, হয়তো নদীর ঘূর্ণির শব্দে আমার ভুল হচ্ছে।” সে তাড়াহুড়ো করে হাঁটার গতি বাড়াল, যেন অদৃশ্য টান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। কিন্তু যতদূরে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কান্নার প্রতিধ্বনি তাকে পিছু ডাকছে, নদীর স্রোতের মতো তার সঙ্গেই বয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় দিন অজিতের ভেতরে এক অদ্ভুত দোলাচল তৈরি হলো। একদিকে ভয়, অন্যদিকে কৌতূহল। সে ভেবেছিল আজ আর নদীর ধারে হাঁটবে না—গ্রামের অন্য রাস্তায় ফিরবে। কিন্তু পা যেন আপনিই তাকে সেই পুরনো পথে নিয়ে গেল। মনের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা, আবার এক অদ্ভুত টান। সে যখন নদীর ধারে পৌঁছাল, তখন চারদিক ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। দূরে কেবল মন্দিরের ঘণ্টার ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ আবারও সেই কান্না। এবার এত স্পষ্ট, এত তীব্র যে অজিতের চোখ শিউরে উঠল। শব্দটা যেন কেবল কানেই নয়, বুকের ভেতরেও ঢুকে যাচ্ছে। অজিত দাঁড়িয়ে পড়ল। বুক ধড়ফড় করছে, ঘাম বেরিয়ে আসছে। সে কান্নাটাকে উপেক্ষা করতে চাইল, কিন্তু পারল না। কণ্ঠস্বর যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, নদীর ঘাটের ওপরে এক সাদা ছায়া নড়ছে—কিন্তু দৃষ্টি ফেরাতেই কিছুই দেখা গেল না। অজিত নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল, চোখের ভুল। তবুও মনের ভেতর এক প্রশ্ন উঁকি দিল—“এ কি শুধু শব্দ, নাকি সত্যিই কেউ আছে ওখানে?”

এরপর কয়েকদিন অজিত প্রতিদিন একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে লাগল। স্কুল থেকে ফেরার সময় নদীর ধারে পৌঁছালেই মেয়েলি কান্না তার কানে বাজতে থাকত। কখনো সেটা দূরে, কখনো কাছে। কখনো মনে হতো নদীর মাঝখান থেকে আসছে, কখনো মনে হতো ঘাটের ধারে কেউ বসে কাঁদছে। ভয় ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছিল কৌতূহলও। সে ভাবছিল, এ কি নিছক ভ্রম, নাকি সত্যিই নদীর ধারে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? অজিতের জীবন এতদিন ছিল একেবারেই সরল, নিয়মমাফিক—স্কুল, পড়ানো, আর নির্জন পথে হাঁটা। কিন্তু এই কান্না তার সেই সরল জীবনে অচেনা অন্ধকারের পর্দা টেনে আনল। দিনের বেলায় সে যতই যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা খুঁজতে চাইত, সন্ধ্যা নামলেই সমস্ত যুক্তি যেন ভেঙে পড়ত। অজিত বুঝতে পারল, নদীর ধারে প্রতিদিনের সেই হাঁটার অভ্যাস আর আগের মতো থাকবে না—এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে সেই অদ্ভুত কান্নার শীতল স্পর্শ, যা ধীরে ধীরে তার জীবনকেই এক ভয়ঙ্কর রহস্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

***

কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন নদীর ধারে সেই অদ্ভুত কান্না শোনার পর অজিত ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠল। তার স্বভাব ছিল শান্ত, যুক্তিবাদী, কিন্তু এই কান্নার রহস্য তাকে নানাভাবে নাড়া দিতে লাগল। স্কুলে পড়াতে বসেও সে মনোযোগ হারিয়ে ফেলত। ছাত্রদের কাগজে লেখা দেখলেও মনে হতো, প্রতিটি অক্ষরের আড়াল থেকে যেন সেই কান্নার প্রতিধ্বনি উঠে আসছে। দিনের বেলায় নিজের মনে সে বারবার যুক্তি খুঁজত—“এটা নিশ্চয়ই জলের শব্দ, হয়তো হাওয়ার স্রোত, কিংবা কোনো পাখি।” কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই সমস্ত যুক্তি ভেঙে পড়ত, আর কান্না যেন নতুন করে তাকে গ্রাস করত। অবশেষে একদিন অজিত ঠিক করল, কাউকে বিষয়টা বলতে হবে। সে বুঝতে পারছিল, এই রহস্য তার মনের ওপর প্রভাব ফেলছে, আর যদি একেবারেই নীরব থাকে তবে হয়তো পাগল হয়ে যাবে। তাই এক সন্ধ্যায়, স্কুল ছুটির পর সে গ্রামের এক প্রাচীন মানুষ—হরিদাস পালের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

হরিদাস পাল ছিলেন গ্রামের প্রবীণতম মানুষদের একজন। বয়স তার প্রায় পঁয়ষট্টি, কিন্তু এখনও সুস্থ-সবল। সাদা ধুতি আর গামছা পরা, কপালে টকটকে লাল চন্দনের টিপ, হাতে লাঠি—এই ভাবেই প্রায়শই তাকে গ্রামের বটতলায় বসে গল্প করতে দেখা যেত। ছোট থেকে বড় সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত, কারণ গ্রামের বহু পুরোনো ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। লোককথা, বিশ্বাস, ভূতের গল্প—সবকিছুতেই তার দখল ছিল প্রবল। অজিত যখন হরিদাসের বাড়ির উঠোনে ঢুকল, তখন সন্ধ্যা নেমেছে, আর লণ্ঠনের আলোয় উঠোন ভেসে আছে হলদে আভায়। হরিদাস খড়খড়ি চেয়ারে বসে বিঁড়ি ধরাচ্ছিলেন। অজিত ভদ্রভাবে প্রণাম করে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিকের কথা বলার পর অবশেষে সাহস করে অজিত তার অভিজ্ঞতার কথা খুলে বলল—কীভাবে কয়েকদিন ধরে নদীর ধারে সে মেয়েলি কান্না শুনছে, কীভাবে প্রতিদিন সেই শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কথা বলতে বলতে অজিত নিজেই কেঁপে উঠছিল, কারণ সে ভয় করছিল—হরিদাস হয়তো তাকে পাগল ভাববে।

কিন্তু হরিদাস কোনো অবাক হননি। তিনি ধীর চোখে অজিতের দিকে তাকিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “বাবা অজিত, তুমি যা শুনছ, তা নতুন কিছু নয়। ওটা ডাকিনীর কান্না।” কথাটা শুনেই অজিত স্তব্ধ হয়ে গেল। তার শিক্ষিত, যুক্তিবাদী মন প্রথমেই আপত্তি তুলল—“ডাকিনী! এসব কি সম্ভব? এ তো কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়।” কিন্তু হরিদাস শান্ত গলায় কথা চালিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, বহু বছর আগে, তাদের গ্রামেরই এক তরুণী মেয়ে—অপরাজিতা, এক অমানবিক ঘটনার শিকার হয়েছিল। অপরাজিতা ছিল রূপবতী, শিক্ষিতা, আর গান গাইতে ভীষণ ভালোবাসত। গ্রামের অনেক ছেলেই তাকে চাইত, কিন্তু সে কারো দিকে ঝুঁকেনি। হঠাৎই একদিন গ্রামের কিছু প্রভাবশালী লোক তাকে “ডাইনী” অপবাদ দিয়ে ফেলে। কারও সন্তান অসুস্থ হলে, কারও গরু হঠাৎ মারা গেলে, তারা সব দোষ চাপাল ওই মেয়েটির ওপর। হরিদাস বললেন, “ওই সময়ে কুসংস্কারের দাপট বেশি ছিল। সত্য মিথ্যা যাচাই করার বুদ্ধি কারও ছিল না। গ্রামের মোল্লা-পুরুত মিলে রায় দিল—অপরাজিতা ডাইনী। আর সেই রায়ের ফলেই এক ঝড়বৃষ্টির রাতে তাকে নদীর ধারে টেনে এনে সবার সামনে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলা হয়।” হরিদাসের গলা ভারী হয়ে উঠল। তিনি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “সেই দিন থেকে আজও নদীর ধারে ওর আত্মা ঘুরে বেড়ায়। অনেকেই তার কান্না শুনেছে, কেউ কেউ নাকি ছায়াও দেখেছে। তুমি প্রথম নও।”

অজিতের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। শিক্ষিত মানুষ হিসেবে তার পক্ষে এসব গল্প বিশ্বাস করা কঠিন ছিল, তবুও হরিদাসের কণ্ঠের দৃঢ়তা তাকে নাড়া দিল। হরিদাস আরও বললেন, “ডাকিনী মানে শুধু ভয়ানক আত্মা নয়, ও হলো অন্যায়ের শিকার, অপমানের বোঝা বয়ে বেড়ানো প্রাণ। তার কান্না মানে মুক্তির আর্তি। ও শান্তি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। তাই সন্ধ্যা নামলেই নদীর ধারে বসে কাঁদে।” এই কথা শুনে অজিত চুপ করে রইল। তার ভেতরে এক অদ্ভুত টান তৈরি হলো—ভয়ও আছে, আবার করুণাও আছে। সে ভাবতে লাগল, “যদি সত্যিই এমন কিছু ঘটে থাকে, তবে সেই মেয়েটির আত্মা আজও মুক্তি পায়নি।” কিন্তু অজিতের যুক্তি তাকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করল—“এ কি কেবল গল্প নয়? হয়তো হরিদাস শুধু কুসংস্কারের গল্প বলছেন।” তবুও তার মনে হলো, ঘটনাটা অবহেলা করার মতো নয়। কয়েকদিন ধরে সে যা শুনছে, তার কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই। গ্রামের প্রবীণের মুখ থেকে এই গল্প শোনার পর অজিত বুঝতে পারল, তার সামনে এক গভীর রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে, যার মধ্যে ভয়, ইতিহাস আর অন্যায় মিলেমিশে আছে। আর সেই রহস্যের সঙ্গে তার নিজের জীবনও অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছে।

***

হরিদাস পালের কণ্ঠস্বর যেন গ্রাম্য আখ্যানের ভারে গম্ভীর হয়ে উঠল। অজিত বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রামের অন্ধকার গলির নিস্তব্ধতা ভেদ করে যখন কেবল ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে, তখন সেই কাহিনির শুরুটা যেন সময়ের গহ্বর থেকে উঠে আসা এক দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনাল। হরিদাস বলল—“অপরাজিতা নাম ছিল মেয়েটির। নামের মতোই সে ছিল অপরূপ সুন্দরী। নদীর ধারে জন্ম, নদীর ধারে বড় হওয়া। কিন্তু তার ভাগ্য এতটা নির্মম হবে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।” হরিদাস থেমে এক চুমুক জল খেলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন কিভাবে গ্রামবাসীর ভ্রান্ত ধারণা আর কুসংস্কার এক নিষ্পাপ তরুণীর জীবন কেড়ে নিল। সেই সময়ে গ্রামে খরা দেখা দিয়েছিল, ফসল নষ্ট হচ্ছিল, গরু মারা যাচ্ছিল, আর মানুষ ক্ষুধায় দিশেহারা হয়ে উঠছিল। কেউ একজন গুজব রটালো যে, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো “অশুভ আত্মা” কাজ করছে। আর তখনই লোকের চোখ ঘুরে গেল অপরাজিতার দিকে। কারণ, সে ছিল ভিন্ন প্রকৃতির—নদীর ধারে একা বসে গান গাইত, ভেষজ গাছ চিনত, অসুখ-বিসুখ সারাত। তার জ্ঞান মানুষকে ভয়ের বদলে আশীর্বাদ দেওয়ার মতোই ছিল, কিন্তু কুসংস্কারের অন্ধকার সবকিছু উল্টে দিল।

অজিতের বুক কেঁপে উঠল হরিদাসের কথাগুলো শুনে। কাহিনি যতই সামনে এগোচ্ছে, অজিতের মনের ভেতর ততই দুঃখের মেঘ জমা হচ্ছে। হরিদাস জানাল, গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী লোক মিলে একদিন অপরাজিতাকে ডাইনী বলে ঘোষণা করে। সে যে গাছগাছড়া দিয়ে ওষুধ বানায়, সেটাকে তারা বলল জাদুটোনা। সে যে চাঁদের আলোয় নদীর ধারে বসে গান করে, সেটাকেও বলা হলো অশুভ শক্তিকে ডাকার মন্ত্রপাঠ। অথচ, অপরাজিতা কেবল প্রকৃতির সাথে মিশে থাকতে ভালোবাসত। হরিদাসের গলায় কষ্ট আর রাগ মিশ্রিত এক তীব্রতা শোনা গেল—“তখনকার দিনে কুসংস্কার ছিল এক ভয়ানক দানব, বেটা। যে যার ইচ্ছে মতো কাউকে পুড়িয়ে মারত, ডুবিয়ে মারত, তাড়িয়ে দিত।” গ্রামের মাতব্বররা সিদ্ধান্ত নেয় অপরাজিতাকে ‘ডাইনী’ প্রমাণ করে শাস্তি দিতে হবে, নয়তো গ্রামের দুর্দশা কাটবে না। এক অন্ধকার রাতে, অশুভ মন্ত্রোচ্চারণের মতো চিৎকারে গ্রাম জেগে ওঠে। নারীরা কাঁদছিল, কিন্তু পুরুষেরা গর্জন করছিল। কেউ চেয়েছিল তাকে বাঁচাতে, কিন্তু সংখ্যাগুরুদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা হয়ে দাঁড়াল।

অপরাজিতাকে নদীর ঘাটে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো। তার কণ্ঠে তখন আতঙ্কের বদলে ছিল এক অদ্ভুত স্থিরতা। সে জানত তার মৃত্যু আসন্ন, তবুও তার চোখে ভয়ের ছায়ার চেয়ে ছিল অপমান আর দুঃখের রঙ। হরিদাস বর্ণনা করছিলেন—“তাকে যখন জলে ডুবিয়ে মারা হচ্ছিল, তখন আকাশে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল। বজ্রপাত হচ্ছিল একের পর এক। যেন প্রকৃতিও প্রতিবাদ করছিল।” নদীর ঢেউ উন্মত্ত হয়ে উঠল, মানুষ ভয় পেল, কিন্তু হাত থামাল না। অপরাজিতার শেষ চিৎকার যেন জলের গহ্বরের ভেতর থেকে আকাশ ছুঁয়ে গিয়েছিল। তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নদীর বুকের ওপর ভেসে উঠেছিল শুধু লাল ওড়নার এক টুকরো অংশ, যা পরে কোথাও মিলিয়ে গেল। কিন্তু সেই রাতের পর থেকে নদীর ধারে অদ্ভুত কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল। গ্রামের অনেকেই প্রথমে ভেবেছিল বাতাসে পাতার শব্দ, কিন্তু বারবার একই কান্না শুনে সবাই বুঝল—অপরাজিতার আত্মা শান্তি পায়নি। কেউ কেউ বলত, অমাবস্যার রাতে তার ছায়া দেখা যায়, কখনও নদীর ধারে বসে কাঁদছে, কখনও চুল খোলা অবস্থায় হেঁটে বেড়াচ্ছে।

হরিদাসের চোখে জল এসে গেল সেই কাহিনি বলতে গিয়ে। এত বছর কেটে গেছে, কিন্তু অপরাধবোধ যেন এখনও তার বুকের ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটায়। “আমরা কেউ তাকে বাঁচাতে পারিনি, অজিত। আর তাই আজও নদী সেই কান্না বয়ে বেড়াচ্ছে। ওর আত্মা মুক্তি পায়নি।” অজিত গভীরভাবে চিন্তায় ডুবে গেল। তার মনে হলো, নদীর ধারে যেসব কান্না সে শুনেছে, সেগুলো নিছক কোনো কল্পনা নয়। এগুলো এক ভগ্ন ইতিহাসের সাক্ষ্য। অপরাজিতা যেন প্রতিরাতে নিজের ন্যায়ের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, নিজের নির্দোষ মৃত্যুর জন্য প্রতিকার চাইছে। চারপাশের অন্ধকার আর নদীর গর্জন যেন সেই মুহূর্তে আরও ভারী হয়ে উঠল। অজিতের মনে হলো, সে যদি সত্যিই অপরাজিতার আত্মার কথা শুনে থাকে, তাহলে হয়তো তার দায়িত্ব আছে সেই ইতিহাসকে সম্মান জানানো, কিংবা আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার উপায় খোঁজার। হরিদাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই যে ছায়া, এই যে ইতিহাস—এগুলো কখনও মরে না। নদীর জলে, বাতাসের শব্দে, মানুষের ভয়ে ওর অস্তিত্ব বেঁচে আছে।” অজিত নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল, তার হৃদয়ের গভীরে ইতিহাসের এই ছায়া ভারী হয়ে জমা হতে লাগল।

***

অজিত মুখার্জি ছিলেন শিক্ষিত মানুষ, একজন গ্রামের স্কুলশিক্ষক হিসেবে যুক্তি, বিজ্ঞান, আর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তার প্রধান কাজ। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিখেছেন—প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনার পেছনে একটি ব্যাখ্যা থাকে। হাওয়া বয়ে গেলে গাছ দুলবে, আকাশে মেঘ জমলে বৃষ্টি হবে, নদীর জলে ভাঁজ উঠলে তার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে—এসবই স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও, যখন তিনি পরপর কয়েকদিন নদীর ধারে সেই মেয়েলি কান্নার শব্দ শুনলেন, তার নিজের মনেই দ্বন্দ্ব শুরু হলো। তিনি ভাবলেন, হয়তো নদীর ঢেউ পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে এক অদ্ভুত শব্দ তুলছে, কিংবা সন্ধ্যার হাওয়া জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে অচেনা আওয়াজের মতো। মানুষ যখন ভয় পেতে শুরু করে, তখন তার কানে-চোখে অনেক কিছুই বিভ্রম তৈরি করে—এমন শিক্ষা তিনি বহুবার ছাত্রদের দিয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনাটি যেন সেই শিক্ষাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। গ্রামের প্রবীণ হরিদাস পাল যখন তাকে অপরাজিতার মৃত্যুকাহিনি শোনালেন, তখন যুক্তিবাদী শিক্ষক অজিতের ভেতরটা যেন কেঁপে উঠল। হরিদাসের গলার দৃঢ়তা, তার চোখের গভীর ভয়, আর গ্রামের মানুষদের নীরব আতঙ্ক—এসব কিছুর মধ্যেই যেন ইতিহাসের কোনো অনাবিষ্কৃত সত্য লুকিয়ে আছে।

পরের দিনগুলোতে অজিত নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তিনি বারবার নিজের কাছে যুক্তির ব্যাখ্যা হাজির করলেন—”ভূত বলে কিছু নেই, এসব কেবল অন্ধবিশ্বাস।” ক্লাসে তিনি ছাত্রদেরও বললেন—“আমাদের সবসময় প্রমাণ খুঁজতে হবে, কারণ যা দেখা যায় না, তা মানার কোনো যুক্তি নেই।” কিন্তু নিজের ভেতরের কণ্ঠস্বরকে দমন করা সহজ হলো না। সন্ধ্যা নামলেই তার বুক ধকধক করতে লাগল—আজ আবার সেই কান্নার শব্দ শোনা যাবে কিনা, সেই ভাবনা যেন মাথার ওপর কালো মেঘের মতো ভেসে বেড়াতে লাগল। কিছু সন্ধ্যায় তিনি সাহস করে নদীর ধারে গেলেন, কিন্তু চেষ্টা করলেন হাঁটাটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে। কান্নার শব্দ না পেলেও মনে হতো, বাতাস যেন এক অজানা সুর বয়ে আনছে, যা বুকের ভেতরে অস্বস্তি তৈরি করে। অন্য সন্ধ্যায় তিনি নিজের অজান্তেই হাঁটা এড়িয়ে গেলেন, যেন ভয়ে পিছিয়ে পড়ছেন। একদিকে নিজের যুক্তি আর শিক্ষার আলো, অন্যদিকে গ্রাম্য কাহিনির অদ্ভুত ছায়া—এই টানাপোড়েনে অজিতের জীবন যেন ভারী হয়ে উঠতে লাগল।

একদিন তিনি চুপচাপ নিজের ঘরে বসে নদীর গল্পের বই পড়ছিলেন। সেখানে লিখেছিল, প্রাচীনকালে বহু সভ্যতার সঙ্গে নদী যুক্ত ছিল—জীবনদাত্রী হিসেবে নদী, আবার মৃত্যুর সঙ্গেও তার গভীর সম্পর্ক। এই লাইনটা পড়ে অজিত থমকে গেলেন। সত্যিই তো, নদীর বুকে কত প্রাণের সমাধি হয়েছে! অপরাজিতার মতো কত নিরীহ মানুষ হয়তো সমাজের অন্যায়ের শিকার হয়ে নদীতে শেষ আশ্রয় নিয়েছে। তাহলে কি সেই অন্যায়ের আর্তনাদই আজও বয়ে বেড়াচ্ছে? এই চিন্তাটা তার যুক্তিকে ভাঙছিল না, বরং নতুনভাবে যুক্তিকে দাঁড় করাচ্ছিল। তিনি ভাবলেন—হয়তো প্রকৃতির বুকেই মানুষের অপরাধ লেখা থাকে, হয়তো সেই অপরাধের প্রতিধ্বনিই কান্নার মতো ভেসে আসে। তবুও মনকে পুরোপুরি শান্ত করতে পারলেন না। গ্রামের মানুষের চোখেমুখে যে ভয়ের ছাপ, তা তিনি বারবার স্মরণ করলেন। কেন সবাই একসঙ্গে এই কাহিনি বলে? কেন তাদের চোখে অদৃশ্য আতঙ্কের ছায়া লুকিয়ে থাকে? শুধু কি কাকতালীয়? না কি সত্যিই নদীর বুকে কোনো রহস্য জেগে আছে?

এভাবেই দিন কাটতে লাগল। একদিকে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন—“আমি প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করব না।” অন্যদিকে প্রতিদিন রাত নামলেই বুকের ভেতর ভয় গুমরে উঠত। ছাত্রদের সামনে দৃঢ়, যুক্তিবাদী শিক্ষক, আর নিজের অন্তরে ভীতু, দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ—এই দুই সত্তার টানাপোড়েন অজিতকে যেন ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে তিনি মনে করতেন, হয়তো কিছু রহস্যকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। হয়তো মানুষ যেটাকে ভয় বলে মানে, সেটাই প্রকৃতির অজানা এক ভাষা। কিন্তু তখনই আবার তিনি নিজেকে বোঝাতেন—এমন ভেবে বসা মানেই অন্ধবিশ্বাসকে শক্তি দেওয়া। অজিত জানতেন, তাকে হয়তো এই দ্বন্দ্ব নিয়েই এগোতে হবে, কারণ সত্য খুঁজে পাওয়ার আগে ভয়কে জয় করা সম্ভব নয়। তার ভেতরের এই লড়াই কেবল ভয় আর যুক্তির নয়, বরং মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার আর আলো—এই দুই শক্তির দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছিল।

***

সন্ধ্যার পরদিন স্কুল ছুটি হলে অজিত তার কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে নদীর পাড়ের পথ ধরে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল। গ্রামের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী ছিল অরুণী—বয়সে কেবল বারো, কিন্তু তার কৌতূহল, জিজ্ঞাসা আর সরল হাসি অজিতের মন ছুঁয়ে যেত। সেদিন অরুণী একাই নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে ছোট্ট মাটির খেলনা। অজিত কিছুটা অবাক হয়ে তাকে ডেকে বলল, “অরুণী, এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” মেয়েটি মৃদু গলায় উত্তর দিল, “স্যার, আজ আমি কিছু অদ্ভুত শুনেছি।” তার কণ্ঠে এমন এক কম্পন ছিল, যেন ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে এক অদ্ভুত চাপা স্বর তৈরি করেছে। অজিত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি শুনলি তুই?” অরুণী মুখ নিচু করে বলল, “কেউ কাঁদছিল, স্যার। একেবারে মেয়েলি কান্নার মতো… নদীর ওপার থেকে, আবার কখনও মনে হলো জলের ভেতর থেকে।” এই কথাগুলো শোনামাত্র অজিতের বুকের ভেতর ধকধক করে উঠল। গত কয়েকদিন ধরে যে অভিজ্ঞতা তার একান্ত ব্যক্তিগত বলে মনে হচ্ছিল, এবার তা যেন এক নির্দোষ শিশুর জবানিতে সত্যি হয়ে উঠল।

অজিত ঠোঁট কামড়ে নীরব দাঁড়িয়ে থাকল। সে মনে মনে যুক্তির আশ্রয় নিল—ভেবেছিল হয়তো বাতাসে বাঁশঝাড়ের শব্দ, অথবা জলের তীরের প্রতিধ্বনি। কিন্তু অরুণীর চোখের সোজাসাপ্টা ভয়ার্ত দৃষ্টি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, বিষয়টা আর অবহেলার নয়। অরুণী বলল, “স্যার, আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো নদীর ধারে ছিলেন, হয়তো কারও কণ্ঠস্বর ওখান থেকে এসেছে। কিন্তু যখন বারবার কান পাতলাম, মনে হলো, কণ্ঠটা আমার নাম ধরে ডাকছে।” অজিত হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার নিজের অভিজ্ঞতার সাথেও কি এ মিল পাওয়া যাচ্ছে? সে নিজে কান্নার শব্দ শুনেছিল, কিন্তু নাম ধরে ডাক শোনেনি। তবে যদি সত্যিই কারও আত্মা নদীর ধারে ঘোরাফেরা করে, তবে কি সে শিশুদেরও টানতে চাইছে? এই ভাবনা তার রক্ত হিম করে দিল। সে অরুণীর মাথায় হাত রেখে বলল, “শোন, এটা হয়তো তোর কল্পনা। ভয় পাবি না।” কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বরেই সে শুনল আশ্বাসের অভাব, যেন নিজের ভেতরের আতঙ্ককেও সে লুকোতে পারছে না।

রাতে অজিতের ঘুম এল না। সে চোখ বন্ধ করলেই অরুণীর কথাগুলো কানে বাজতে লাগল—“আমার নাম ধরে ডাকছে।” অজিত ভাবল, যদি সত্যিই এটা কোনো মনস্তাত্ত্বিক ভ্রম হয়, তবে কেন দু’জন আলাদা মানুষ একই অভিজ্ঞতা পেল? তাও আবার এক শিশু, যে মিথ্যা কল্পনা করার বয়সে নেই। এমনকি গ্রামে বহু প্রবীণও তো সেই অদ্ভুত কান্নার কাহিনি বলেছে। হয়তো সত্যিই অপরাজিতা নামের সেই তরুণীর আত্মা নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়। একবার মনে হলো, সে কালকেই গ্রাম ছাড়বে, কারণ এইসব অলৌকিক জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে চায় না। কিন্তু আবার ভাবল, এটাই তো তার দায়িত্ব—সে শিক্ষিত মানুষ, গ্রামের সন্তানদের ভয়ভীতি দূর করা তারই কাজ। যদি সে পালায়, তবে গ্রামের কুসংস্কার আরও গভীর হবে। আর যদি সে থাকে, তবে হয়তো সত্য উদঘাটন করতে পারবে। তবে সত্যি কথা বলতে গেলে, তার ভেতরে ভয় ঢুকতে শুরু করেছে, আর অরুণীর অভিজ্ঞতা সেই ভয়ের তীব্রতা দ্বিগুণ করেছে।

পরদিন সকালে অজিত অরুণীকে আবার ডাকল। মেয়েটি স্কুলে এসেছিল, কিন্তু কিছুটা বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। অজিত তাকে আলাদা করে বসিয়ে বলল, “কাল যা শুনেছিস, সেটা আর কারওকে বলবি না। গ্রামের লোকজন শুনলে আরও ভয়ে ভরে উঠবে।” অরুণী মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, কিন্তু ফিসফিস করে বলল, “স্যার, আমি সত্যিই ভয় পেয়েছি। মনে হলো কেউ আমার হাত টেনে নেবে জলের দিকে।” এই স্বীকারোক্তি শুনে অজিতের শরীর শিউরে উঠল। শিশুর সরল বর্ণনায় যেন এক হাড়হিম করা দৃশ্য ফুটে উঠল—অদৃশ্য হাত অরুণীকে টেনে নিচ্ছে অন্ধকার নদীর গহ্বরে। অজিত তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করল, বই হাতে দিল, মিষ্টি হাসি দিল, কিন্তু তার নিজের চোখের নিচে কালো ছাপ পড়তে শুরু করেছে। ভেতরের দ্বন্দ্ব আরও গভীর হলো—এ কি কেবল মানসিক চাপ, না সত্যিই কোনো অশরীরী ছায়া নদীর ধারে ঘোরাফেরা করছে? অরুণীর অভিজ্ঞতা যেন তাকে আর কোনো অজুহাতের জায়গা রাখল না। এখন সে জানে, যা ঘটছে তা বাস্তব—অন্তত এতটাই বাস্তব, যতটা একজন শিশুর কান্না, ভয় আর কাঁপতে থাকা কণ্ঠস্বর। এই উপলব্ধি অজিতকে অজান্তেই এক অজানা যুদ্ধের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।

***

গ্রামের মধ্যে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে, অরুণীর মতো নিরীহ শিশু পর্যন্ত এখন নদীর ধারে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এটি আর কেবল গুজব বা প্রবীণদের গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষজন একত্রিত হয়ে গ্রামের ওঝা, বিলাসী দেবীর দ্বারস্থ হলো। বিলাসী দেবী ছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী, কপালে লাল সিঁদুর, কানে ভারি কুন্ডল, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে রুপোর চুড়ি। গ্রামের লোকেরা তাকে শ্রদ্ধা করত, আবার ভয়ও পেত। বলা হয়, তিনি দেবীর আশীর্বাদপুষ্ট, আর অশুভ শক্তি নিবারণে পারদর্শী। অজিত প্রথমে দ্বিধায় পড়েছিল—একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে এই ধরনের অলৌকিক বিশ্বাসে তার আস্থা ছিল না। কিন্তু যখন দেখল গ্রামবাসীরা প্রায় সর্বসম্মতভাবে বিলাসী দেবীর কাছে সমাধান চাইছে, তখন আর প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। গ্রামের মাঝখানে পাকা উঠোনে সবাই জড়ো হলো, আর বিলাসী দেবী গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন—“এ যে সাধারণ আত্মা নয়, এ ডাকিনী। তাকে শান্ত করতে হলে পূজা-আচার চাই, না হলে সে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।” তার চোখদুটো তখন যেন আগুনের মতো জ্বলছিল, আর উপস্থিত জনতা গম্ভীর নীরবতায় ডুবে গেল।

বিলাসী দেবীর প্রস্তাবে গ্রামের মানুষজন বেশ স্বস্তি পেল, কারণ তারা বিশ্বাস করল এখন হয়তো মুক্তির পথ মিলবে। তবে পূজা-আচার সহজ ব্যাপার নয়। দেবী জানালেন, নদীর ধারে একটি বিশেষ যজ্ঞ করতে হবে, যেখানে প্রদীপ, ধূপ, ফুল, লাল সুতোর বাঁধন, এবং বিশেষ কিছু দানের আয়োজন করতে হবে। তিনি আরও বললেন, অপরাজিতা নামের মেয়েটির আত্মাকে ক্ষমা প্রার্থনা করে শান্তি দিতে হবে, নয়তো তার কান্না থামবে না। কথাগুলি শোনার পর মানুষজন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে লাগল—অনেকেই এই ধরনের আচার-অনুষ্ঠান আগেও দেখেছে, তবে এত বড় আয়োজন সচরাচর হয় না। অজিত তখনও চুপ করে শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই সব কুসংস্কার হয়তো গ্রামবাসীর ভয়কে আরও বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু যখন অরুণীর আতঙ্কিত মুখটি মনে পড়ল, তখন সে আর সরল যুক্তি দিয়ে বিষয়টিকে অস্বীকার করতে পারল না। সে ভাবল, “হয়তো এই পূজা যদি মানুষের ভয় দূর করে, তাহলে সেটাই মঙ্গল।”

পরবর্তী কয়েকদিন ধরে গ্রামে প্রবল প্রস্তুতি শুরু হলো। মহিলারা ধূপকাঠি বানাতে ব্যস্ত হলো, পুরুষেরা কাঠ জোগাড় করতে লাগল, আর শিশুরা কৌতূহল নিয়ে চারপাশে ঘুরে বেড়াল। বিলাসী দেবী কঠোর কণ্ঠে সবাইকে দায়িত্ব বণ্টন করলেন—কে প্রদীপ আনবে, কে দুধ-দই-চাল সংগ্রহ করবে, আর কে নদীর ঘাট পরিষ্কার করবে। তিনি নিজে প্রতিদিন গ্রামের মহিলাদের নিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, যাতে “অশুভ শক্তি দূরে থাকে।” অজিত তখনও দ্বিধায় ছিল। তার ভেতরের আধুনিক শিক্ষা তাকে বলছিল—“এ সব ভয়ের ফল, এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই।” কিন্তু একই সঙ্গে তার মনের গোপন কোণে ভয় আরও গভীর হচ্ছিল। সন্ধ্যা নামলেই নদীর ধারে অদ্ভুত চাপা শব্দ যেন তাকে তাড়া করত। সে নিজেকে বোঝাতে চাইত যে, এটা কেবল প্রকৃতির খেলা, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে এক অদৃশ্য আশঙ্কা ঘনীভূত হতে লাগল।

অবশেষে নির্ধারিত রাত এল। নদীর ঘাটে আগুন জ্বালানো হলো, মাটির প্রদীপ একে একে সাজানো হলো চারপাশে। মানুষজন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইল, যেন আসন্ন বিপদের বিরুদ্ধে শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিলাসী দেবী ত্রিশূল হাতে উপস্থিত হলেন, তার কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ নদীর বাতাসে ভেসে উঠল। ধূপের গন্ধ, আগুনের আলো, আর নদীর ঢেউয়ের শব্দ মিলেমিশে এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করল। মানুষজন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল—কেউ কেউ প্রণাম করছিল, কেউ আবার ভয়ে কাঁপছিল। অজিত সব দেখছিল, মনে হচ্ছিল সে যেন দুই জগতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে—একদিকে যুক্তি ও বিজ্ঞান, অন্যদিকে বিশ্বাস ও আতঙ্ক। আর নদীর কালো জলে তখন হঠাৎ যেন এক দীর্ঘশ্বাস ভেসে উঠল। সেই শব্দে অনেকেই চিৎকার করে উঠল, কিন্তু বিলাসী দেবী দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“ভয় পেও না, এ যে সংকেত, সে আমাদের কথা শুনছে।” এই দৃশ্য দেখে অজিত বুঝতে পারল, গ্রাম এখন সম্পূর্ণভাবে এক নতুন অধ্যায়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে, যেখানে যুক্তি আর অন্ধবিশ্বাসের লড়াই আরও তীব্র হবে।

***

সেদিন সন্ধ্যায় আকাশটা ছিল অদ্ভুতভাবে মেঘলা। দিনের আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, অথচ হাওয়ার মধ্যে এক ধরনের ভারী গুমোট ভাব জমে উঠেছিল। অজিত সারা দিন ক্লাস নেওয়ার পর নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিল, কিন্তু মন বারবার নদীর দিকেই ছুটে যাচ্ছিল। অরুণীর বর্ণনা, গ্রামের গুজব, আর বিলাসী দেবীর অস্থির উপস্থিতি তার চিন্তাকে আরও জটিল করে তুলছিল। যুক্তির মানুষ হয়েও সে অনুভব করছিল, কোনো এক অজানা শক্তি তাকে নদীর তীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামতেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। চারদিক অন্ধকার হতে শুরু করেছে, কেবল জোনাকির ক্ষুদ্র আলো আর দূরে শালিকের ডাক একটুখানি প্রাণের স্পন্দন দিচ্ছিল। কিন্তু নদীর ধারে পৌঁছতেই অজিতের বুকের ভেতর কেমন এক ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। হঠাৎ করেই হাওয়া যেন থেমে গেছে, জলের ঢেউ থেমে গিয়ে চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে।

অজিত দাঁড়িয়ে রইল নদীর তীরে, যেন কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায়। হঠাৎ করে তার কানে ভেসে এল সেই অচেনা, করুণ কান্নার শব্দ—যা সে আগে শুনেছে, কিন্তু এবার শব্দটা আরও কাছে, আরও স্পষ্ট। কান্নার মধ্যে এমন এক যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল, যা কোনো মানুষের ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অজিতের বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল, কিন্তু কৌতূহল তাকে থামাতে পারল না। ধীরে ধীরে সে নদীর জলে চোখ ফেলতেই দেখল, জলের ভেতর থেকে যেন এক অবয়ব ভেসে উঠছে। প্রথমে সে ভেবেছিল আলো-আঁধারির খেলা, কিন্তু চোখ সঠিকভাবে ফোকাস করতেই অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। ভেজা সাদা শাড়িতে মোড়া এক নারী—চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর ঝুলছে, শরীর জলে ভিজে কাঁপছে, আর চোখ দুটোতে জমে আছে শোক আর অভিমান। অজিতের পা যেন মাটিতে গেঁথে গেল। এ দৃশ্য কল্পনা বা ভ্রম নয়, একেবারে বাস্তব, নিঃসন্দেহে তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই ডাকিনী আত্মা।

মুহূর্তের জন্য ভয় তাকে আচ্ছন্ন করল। হৃদস্পন্দন এত জোরে চলছিল যে মনে হচ্ছিল বুক ফেটে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই নারীর চোখের দিকে তাকাতেই ভয়টা ধীরে ধীরে অন্য এক অনুভূতিতে রূপান্তরিত হতে লাগল। সেখানে ছিল না হিংসা বা ক্রোধ, বরং এমন এক যন্ত্রণা, যা মানুষের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তার চোখে অজিত স্পষ্ট দেখতে পেল অবিচারের ছায়া, অপমান আর মৃত্যুর নির্মম স্মৃতি। মনে হচ্ছিল, সে যেন নিজের দুঃখগাথা নিয়ে শত বছর ধরে কাঁদছে, অথচ কেউ তার কান্না শোনে না, কেউ তার যন্ত্রণা বোঝে না। অজিতের মনে হল, তার চারপাশের অন্ধকারটা যেন আরও ঘন হয়ে আসছে, অথচ সেই নারীর উপস্থিতি আলাদা এক জ্যোতির মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সে যেন একদিকে ভীতিপ্রদ, অন্যদিকে অজানা দুঃখে ভরপুর।

অজিত বুঝল, এই মুখোমুখি সাক্ষাৎ তাকে বদলে দেবে। হয়তো এর পর থেকে সে আর যুক্তি দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারবে না। সে বুঝল, এখানে বিজ্ঞান বা শিক্ষা কোনো উত্তর দিতে পারবে না, কারণ আত্মার যন্ত্রণা ভিন্ন মাত্রার সত্য। সেই মুহূর্তে অজিত ডাকিনীকে শুধু ভূত বা শত্রু হিসেবে দেখল না; সে দেখল এক নিষ্পাপ নারীকে, যাকে সমাজ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। তার চোখে জমে থাকা শোকের দীপ্তি অজিতকে নাড়িয়ে দিল ভিতর থেকে। ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে তার ভেতরে জন্ম দিল সহানুভূতির। সে নিজের অজান্তেই কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কে?” কিন্তু কোনো উত্তর এল না। কেবল নদীর ঢেউ হালকা কেঁপে উঠল, আর সেই অবয়ব ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের ভেতরে। তবুও, অজিত জানল—আজ সে এক অমোঘ সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে এসেছে, যাকে অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই। এই রাত, এই সাক্ষাৎ তার জীবনের পথ পাল্টে দেবে চিরতরে।

***

অজিতের মনের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব যেন এই মুহূর্তে গলতে শুরু করল। সে আর ভয় পাচ্ছিল না, বরং এক অদ্ভুত করুণ অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করছিল। প্রতিবার কান্নার শব্দ শোনার পর যে আতঙ্কে তার বুক কেঁপে উঠত, আজ সেই কান্নায় ভেসে উঠল অসহায়ত্ব আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। অজিত ভাবল, যদি সত্যিই অপরাজিতা নামের কোনো নারীর আত্মা এই নদীর ধারে আটকে থাকে, তবে সে কোনো অশুভ শক্তি নয়, বরং এক নিগৃহীতা, যে হয়তো জীবদ্দশায় প্রবল অবিচারের শিকার হয়েছিল। সাদা শাড়ির ভেজা কাপড়, এলোমেলো চুল আর চোখে জমাটবাঁধা অশ্রুজল তাকে ভয়ের চেয়ে বেশি সহমর্মিতা জাগাল। অজিত গভীরভাবে উপলব্ধি করল, সমাজের চাপে, কুসংস্কারের বোঝায় অথবা ক্ষমতাশালী মানুষের অন্যায়ে একটি জীবন্ত প্রাণ কিভাবে অসময়ে নিঃশেষ হতে পারে, আর সেই যন্ত্রণা মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে। এ এক অদৃশ্য ক্ষত, যা নিরন্তর কান্নায় রূপ নিয়ে বয়ে চলে নদীর স্রোতের মতো।

অরুণীর বর্ণনা, গ্রামবাসীর ফিসফাস, আর বিলাসী দেবীর কথাবার্তা মিলিয়ে অজিতের মনে ধীরে ধীরে একটি ছবি গড়ে উঠল। সে বুঝল, অপরাজিতা শুধু ভূতের গল্প নয়—সে এক বাস্তব নারী ছিল, যার জীবনের ওপর কোনো অমানবিক অধ্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হয়তো ভালোবাসায় প্রতারিত হয়েছিল, হয়তো পারিবারিক নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, কিংবা হয়তো সমাজ তাকে ভুলভাবে অপরাধী ভেবেছিল। অজিত ভাবতে লাগল, যে সমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে না, সেই সমাজের প্রতিটি নীরব মানুষ আসলে অপরাধীরই সহযাত্রী। অপরাজিতার আত্মা তাই শান্তি পাচ্ছে না—কারণ তার সত্য এখনো অন্ধকারে ঢাকা। কান্নার আর্তি আসলে তার মুক্তির আবেদন, তার চাওয়ার শেষ চেষ্টা—যেন কেউ অন্তত একবার তার কষ্টকে স্বীকার করে নেয়, তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে, এবং তাকে সেই সম্মান ফিরিয়ে দেয়, যা তার জীবনকালে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

অজিতের বুক ভরে উঠল এক ধরনের দায়বদ্ধতায়। সে জানত, ভয় বা অজ্ঞতায় ঢেকে রেখে এই কান্নাকে থামানো যাবে না। বরং, সত্যকে সামনে আনা জরুরি। অজিত সিদ্ধান্ত নিল, সে আর কুসংস্কারের ভয়ে চুপ করে থাকবে না। বিলাসী দেবীর মতো ওঝার পূজা-আচার হয়তো সাময়িকভাবে মানুষকে শান্ত করবে, কিন্তু অপরাজিতার আত্মাকে মুক্তি দেবে না। মুক্তি আসতে পারে কেবল তখনই, যখন তার কাহিনি আলোতে আনা হবে। তাই অজিত প্রতিজ্ঞা করল, সে অপরাজিতার ইতিহাস খুঁজে বের করবে। গ্রামবাসীর কাছে গল্প শুনবে, পুরোনো দলিল বা কাহিনি খুঁজে দেখবে, আর প্রমাণ করবে—এই কান্না আসলে প্রতিহিংসার নয়, বরং মুক্তির। হয়তো এই কাজ সহজ হবে না, হয়তো সমাজ তার বিরোধিতা করবে, কিন্তু একজন শিক্ষক হিসেবে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই তার কর্তব্য।

এভাবেই অজিতের ভয় রূপ নিল দৃঢ়তায়, আর কৌতূহল রূপ নিল দায়িত্বে। সে মনে মনে অপরাজিতাকে প্রতিশ্রুতি দিল—”তুমি দুষ্ট আত্মা নও, তুমি একজন মানুষ, যাকে অন্যায় গ্রাস করেছিল। আমি তোমার কাহিনি সকলের সামনে আনব। তোমার কান্না বৃথা যাবে না।” এই উপলব্ধি তাকে যেন নতুন করে জন্ম দিল। দীর্ঘদিনের আতঙ্ক দূরে সরে গিয়ে, তার মনে এক আশ্চর্য শান্তি এল। সে বুঝল, ভৌতিকতা আসলে মানুষের অজানা আর অস্বীকার করা যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। সত্যকে আলিঙ্গন করলেই ভয় ভেঙে যায়। তাই অজিত এখন প্রস্তুত—অপরাজিতার ইতিহাস উন্মোচন করে তাকে চিরশান্তি দেওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ নিতে।

***

অজিত গভীর রাতে একা নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল। চারপাশের নিস্তব্ধতা কেবলমাত্র নদীর ধীর স্রোতের শব্দে ভঙ্গ হচ্ছিল। সে জানত, আজ তাকে এক কঠিন কাজ করতে হবে—যে কাজের ভরসায় সে দিনরাত লড়াই করেছে নিজের ভয়, সন্দেহ আর সংশয়ের সঙ্গে। গ্রামের মানুষরা হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তার মনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ডাকিনী আত্মা আসলে কোনো দুষ্ট শক্তি নয়, বরং একটি অমানবিক যন্ত্রণার শিকার, এক নির্দোষ আত্মা, যার বুকফাটা কান্না আসলে মুক্তির আর্তি। তাই নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা শুরু করল—শুধু আত্মার মুক্তির জন্য নয়, গ্রামের মানুষদের চেতনার মুক্তির জন্যও। সে বলল, “তুমি যে যন্ত্রণার ভার বয়ে চলেছো, সেটি আর কোনোদিন যেন পৃথিবীর কেউ বহন করতে না হয়। তোমার যে অন্যায় হয়েছিল, তা যেন ভোলা না যায়, যেন এই গ্রাম তার দায় স্বীকার করে।” অজিতের কণ্ঠ ভিজে যাচ্ছিল আবেগে, নদীর ঢেউ যেন তার কথাগুলো কাঁপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দূরে, অজানা অন্ধকারের দিকে।

প্রার্থনা শেষ করে অজিত ঘাটে প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিল। প্রদীপটি ভেসে চলল ধীরগতিতে, অন্ধকার ভেদ করে ছোট্ট এক আলোকরেখা হয়ে। সেই আলোয় অজিতের মনে হলো যেন বাতাস ভারমুক্ত হয়ে উঠছে, চারপাশে দীর্ঘদিন ধরে ভেসে বেড়ানো কান্না ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষরা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল, কেউ কেউ আবার ওঝা বিলাসী দেবীর কথায় ভয় পাচ্ছিল যে, অজিত হয়তো গ্রামকে বিপদে ফেলছে। কিন্তু অনেকেই যখন কান্নার সেই পরিচিত শব্দ না শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, তখন তাদের মনে হতে লাগল—হয়তো সত্যিই মুক্তি ঘটেছে। তবে অজিতের মনে শান্তি এলেও তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হলো। অপরাজিতা, সেই অশান্ত আত্মা, তার যন্ত্রণার গল্পে যে শোকের আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি যেন চিরকালের জন্য অজিতের মনের ভেতর খোদাই হয়ে রইল। সে জানত, আজকের রাত শুধু আত্মার মুক্তির রাত নয়, তার নিজেরও এক নতুন জীবনের শুরু।

কিন্তু ভাগ্য যেন সবসময় মানুষকে দ্বিধার মুখে দাঁড় করায়। প্রার্থনা শেষ করে, নদীর ঘাট থেকে ফেরার সময়, অজিত আবারও এক অদ্ভুত স্রোতের শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে সে ভেবেছিল নদীর স্বাভাবিক ঢেউয়ের শব্দ, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটি যেন পরিচিত কণ্ঠে রূপ নিতে লাগল। হ্যাঁ—সেই একই মৃদু কান্না, যেটি বারবার তাকে পাগল করে দিয়েছিল। অজিত থমকে দাঁড়াল, তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সে ভাবল—তাহলে কি সব বৃথা গেল? অপরাজিতা কি সত্যিই মুক্তি পেল না? নাকি তার যন্ত্রণা এত গভীর ছিল যে প্রার্থনার আলোকেও তা মুছে ফেলা যায়নি? এক মুহূর্তের জন্য অজিতের মন কেঁপে উঠল—হয়তো বিলাসী দেবীর কথাই ঠিক ছিল, হয়তো আত্মা এত সহজে মুক্তি পায় না। কিন্তু আবার মনে পড়ল, সে যখন প্রার্থনা করছিল, তখন বাতাস হালকা হয়েছিল, কান্না মিলিয়ে গিয়েছিল। তাহলে এখন যে শব্দ সে শুনছে, তা কি আসলেই আত্মার কান্না, নাকি তার নিজের মনের প্রতিধ্বনি, এক অন্তর্দ্বন্দ্ব?

রাতের আঁধারে নদী যেন আরও গভীর রহস্যের পর্দা টেনে দিল। অজিত ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল, মনে হচ্ছিল প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্নগুলো তার মাথায় ভার হয়ে বসছে। মুক্তি নাকি অভিশাপ—এর উত্তর তার কাছে নেই। হয়তো অপরাজিতা আংশিক মুক্তি পেয়েছে, হয়তো তার যন্ত্রণা এখনও প্রবাহিত নদীর জলে গুঞ্জন তোলে। আবারও মনে হলো, আত্মারা শুধু অশান্তির প্রতীক নয়, তারা মানুষের স্মৃতিরও বাহক। অন্যায়, যন্ত্রণা, অভিশাপ—এসব কিছুই নদীর জলে, বাতাসের হাহাকারে বেঁচে থাকতে পারে। শেষ দৃশ্যে নদীর তরঙ্গের সঙ্গে মিশে আসা সেই কান্না অজিতকে মনে করিয়ে দিল—গল্পটি এখনও শেষ হয়নি। মুক্তি হয়তো এসেছে, কিন্তু রহস্য রয়ে গেছে। গ্রামও শান্ত, কিন্তু তার অন্তরে এক অনন্ত প্রশ্ন বেঁচে রইল—সত্যিই কি সব শেষ, নাকি এ কেবল নতুন শুরুর আহ্বান?

_____

 

1000054059.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *