ঋতুপর্ণা দাশগুপ্ত
পর্ব ১: নদীর ডাক
গাঁটা যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মোড়ানো ছিল। শীতল দমকা হাওয়া ভোরের আকাশে নীলচে ছাপ রেখে দিত আর দূরে শাল-সেগুনের বনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসত নদীর গুঞ্জন। এই নদীর নাম ছিল কুলেশ্বরী। তবে মাধুরী ছোটবেলা থেকেই জানত, নামটা পুরোটা নয়—এই নদীর আরেকটা নাম আছে, একেবারে গোপন নাম, যা শুধু রাতের আঁধারেই ফিসফিস করে শোনা যায়।
মাধুরী তখন দশ বছরের মেয়ে। প্রতিদিন বিকেলে সে বাঁশের ডাল দিয়ে বানানো কঞ্চির দোলনা নিয়ে নদীর ধারে যেত। নদীর পাড়ে বসেই তার পড়াশোনা, খেলাধুলো সবকিছু। কিন্তু এক পূর্ণিমার রাতে, হঠাৎ করেই সে শোনে অদ্ভুত একটা আওয়াজ—যেন নদী গুনগুন করছে। প্রথমে ভেবেছিল ব্যাঙ ডাকছে কিংবা মাছ লাফাচ্ছে। কিন্তু শিগগিরই বুঝল, ওটা গলা। নারীর গলা।
গলা যেন গান গাইছে আবার কাঁদছে। কখনো শোনায়—“আমাকে কেউ দেখে না…” আবার কখনো শোনায় নিঃশ্বাসের মতো দীর্ঘশ্বাস। মাধুরীর বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে থাকে। তবু ভয় তাকে গ্রাস করতে পারে না। সে নদীর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে—
“কে তুমি?”
উত্তর আসে না, শুধু ঢেউয়ের ভিতর এক দমকা বাতাস। কিন্তু সেই রাত থেকেই নদী আর মাধুরীর মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পরের দিন সকালে সে ঠাকুমার কাছে সব বলল। ঠাকুমা অঞ্জনা দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন,
“ওই কুলেশ্বরী নদীর তলায় অনেক কন্যার আত্মা ঘুমিয়ে আছে। কারও গায়ে সমাজের বোঝা চাপানো হয়েছিল, কারও কপালে বাল্যবিবাহ, কারও ভাগ্যে নির্যাতন। ওরা কারও কাছে কিছু বলতে পারেনি, শুধু নদীকে দিয়েছে তাদের শেষ কান্না। নদী তাই আজও কথা বলে।”
মাধুরী হতভম্ব হয়ে যায়। তার মনে প্রশ্ন জাগে—
“কিন্তু দাদু? বাবা? গ্রামের অন্য পুরুষেরা কেন এসব জানে না?”
ঠাকুমা নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
“ওরা জানলেও শুনতে পায় না। মেয়েদের কানেই ওসব শব্দ আসে। কারণ কান্নার ভাষা মেয়েরাই বোঝে।”
সেই দিন থেকে মাধুরী বুঝতে পারে, সে আলাদা। অন্য মেয়েরা যেমন নদীতে নেমে খেলাধুলো করে, সে তেমন করে না। সে নদীর জলে হাত রাখে, শোনে ঢেউয়ের সুর। কখনো নদীর জলে ভেসে আসে শাড়ির টুকরো, কখনো লাল কাঁচের চুড়ি। মাধুরী মনে করে, এগুলো নদী তার কাছে রেখে যাচ্ছে—অতীতের সাক্ষ্য।
তার মা ইন্দ্রাণী এসব গল্পে বিরক্ত।
“এতসব ভুতুড়ে চিন্তা মাথায় ঢুকিও না, মাধু। মেয়েদের জন্যে সংসারই যথেষ্ট। পড়াশোনা করো, রান্না শিখো, এটাই ঠিক।”
কিন্তু মাধুরী জানত, তার পৃথিবী অন্যরকম। রাত গভীর হলে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, সে চুপচাপ উঠোন পেরিয়ে নদীর ধারে চলে যায়। নদীর কাছে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর প্রতিবারই নতুন কিছু শোনে।
একদিন হঠাৎ নদী থেকে ভেসে এল এক অচেনা শব্দ—“বাঁচাও…”
মাধুরীর বুক হিম হয়ে গেল। সে বুঝল, এই নদীর গোপন নামটা হয়তো সারা জীবন তাকে খুঁজতে হবে।
পর্ব ২: ছায়ার ফিসফিস
রাতটা ছিল শ্রাবণের পূর্ণিমা। সারা গ্রাম ঘুমিয়ে আছে, শুধু গাছের ফাঁক দিয়ে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। মাধুরী জানলার ফাঁক দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন কুলেশ্বরীর জলে সাদা আলো জ্বলে উঠেছে। টের পেল, আজ নদী তাকে ডাকছে আরও গভীরভাবে।
সে চুপিচুপি উঠোন পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। পায়ে কাঁকর বিঁধছিল, কিন্তু সে খেয়াল করল না। নদীর ধারে এসে দাঁড়াতেই বাতাস হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। কেবল জলের গা বেয়ে শোনা গেল এক দীর্ঘশ্বাস।
মাধুরী পা বাড়াতেই তার মনে হলো কেউ যেন তার পাশে হাঁটছে—অদৃশ্য ছায়া, সরে আসছে ঢেউয়ের ছন্দে। হঠাৎ স্পষ্ট একটা কণ্ঠস্বর কানে এলো, খুব নিচু স্বরে, যেন ফিসফিস করে—
“আমাদের কথা লিখে রাখিস…”
মাধুরী কেঁপে উঠল। চারদিকে কেউ নেই, অথচ গলা এত কাছ থেকে এল যেন কারও ঠোঁট তার কানের কাছে ছুঁইছে। সে হাঁটু গেড়ে নদীর জলে হাত রাখল। মুহূর্তে জলের তলায় যেন এক অদ্ভুত দৃশ্য ফুটে উঠল—শাড়ি পরা এক মেয়ে, সিঁথিতে লাল সিঁদুর, মুখে আতঙ্ক। জলে ডুবে যাচ্ছে, দু’হাত ছুঁড়ছে, চোখদুটো যেন সাহায্য চাইছে।
মাধুরী শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ল। সে হাত বাড়িয়ে টানতে চাইল, কিন্তু ছায়াটা মিলিয়ে গেল ঢেউয়ের ভেতরে। তার আঙুলে রয়ে গেল কেবল এক ফোঁটা শীতল লালচে রঙ, যা জলে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সে ভয়ে পিছু হটতে চাইল, কিন্তু আবার সেই গলা—এবার একসঙ্গে অনেকগুলো।
“আমাদের নাম কেউ জানে না… আমাদের কথা কেউ লেখে না…”
মাধুরীর বুকের ভেতরটা দপদপ করে উঠল। মনে হলো, এই নদী শুধু জল নয়—এটা যেন এক বিশাল কবরস্থান, যেখানে চাপা পড়ে আছে শত শত মেয়ের দুঃখ, আর্তনাদ, অস্বীকৃত জীবন।
ঠিক তখনই হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এলো। শিউলি গাছের ডাল দুলে উঠল, আর নদীর ওপরে তৈরি হল ঢেউয়ের বৃত্ত। সেই বৃত্ত যেন এক অদৃশ্য কণ্ঠকে আরও জোরে গেয়ে তুলল—
“তুই যদি শোনিস, তুই যদি লিখিস, আমরা বাঁচব…”
মাধুরীর চোখ ভিজে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল—
“আমি লিখব। আমি কারও নাম মুছতে দেব না।”
কিন্তু সেই মুহূর্তেই পেছন থেকে তার মায়ের কড়া গলা ভেসে এলো—
“মাধু! এ রাতে আবার নদীর ধারে কী করছিস?”
চমকে দাঁড়িয়ে গেল সে। মা এসে টেনে নিয়ে গেল ঘরে। ঠাকুমা তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন। চোখেমুখে অদ্ভুত এক ভয়ের ছায়া।
সেই রাতে বিছানায় শুয়ে মাধুরীর মনে হলো—নদী আজ তাকে বেছে নিয়েছে। একদিন না একদিন তাকে এই নদীর গোপন নাম উচ্চারণ করতেই হবে।
পর্ব ৩: নদীর গোপন নাম
পরদিন সকালটা অন্য রকম ছিল। রোদ উঠেছিল, কিন্তু হাওয়ায় যেন অদ্ভুত একটা ভার। মাধুরীর মনে হচ্ছিল, আগের রাতের সেই ফিসফিসানি এখনো বাতাসে মিশে আছে। বারবার কানে বাজছিল সেই কথাগুলো— “তুই যদি লিখিস, আমরা বাঁচব…”।
সে পড়ার খাতা খুলে বসল, কিন্তু অক্ষরগুলো যেন চোখের সামনে নাচতে লাগল। কলম হাতে নিতেই মনে হলো, নদীর ঢেউয়ের আওয়াজ এসে মিশছে তার খাতার পাতায়। হঠাৎ কলম থেমে গেল, আর সে আঁকতে শুরু করল অচেনা মুখ—নারীদের মুখ, যাদের চোখে ভয়, কপালে সিঁদুর, ঠোঁটে অর্ধেক শব্দ আটকে গেছে।
মা ইন্দ্রাণী এসে দেখে বিরক্ত হলেন।
“আবার এসব আঁকছিস? পড়াশোনার সময় গল্পকথা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?”
মাধুরী চুপ করে গেল। ঠাকুমার দিকে চাইল, কিন্তু ঠাকুমা কিছু না বলে শুধু মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। তার চোখে যেন লুকোনো আতঙ্কের ছাপ।
সন্ধেবেলা মাধুরী একা বেরোল। আকাশে মেঘ জমেছে, নদীটা যেন অস্বাভাবিকভাবে অন্ধকার। সে আবার পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই কানে ভেসে এল অসংখ্য ফিসফিসানি—যেন মাটির নিচ থেকে শেকড় ভেঙে উঠছে।
“আমাদের নাম…”
“আমাদের নাম লুকিয়ে আছে…”
“তুই যদি খুঁজিস…”
মাধুরী হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “তোমাদের নাম কী? আমি লিখতে চাই।”
হঠাৎ জলের ভেতর থেকে উঠল ভেসে আসা কয়েকটা জিনিস—একটা লাল চুড়ির টুকরো, কালি-ধরা মাটির হাঁড়ি, আর এক টুকরো কাগজ। মাধুরী কাগজটা তুলে নিল। অক্ষরগুলো প্রায় মুছে গেছে, তবু একটুকরো শব্দ এখনো স্পষ্ট—“সুবর্ণা”।
মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। এ কি তবে নদীর গোপন নামগুলোর একটি? কত শত নারীর নাম চাপা পড়ে আছে এই জলের নিচে!
সে ফিসফিস করে বলল, “আমি লিখব সুবর্ণার নাম। তোমাদের সবার নাম লিখব।”
নদী যেন গর্জে উঠল। ঢেউয়ের ভেতর থেকে আবার ভেসে এল শত কণ্ঠ—“তুই যদি লিখিস, নাম মুছে যাবে না। নদীর নাম আর শুধু কুলেশ্বরী নয়, নদীর নাম হবে আমাদের।”
সেই রাতে ঘরে ফিরে মাধুরী কাগজটা বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল। ঘুম আসছিল না। হঠাৎ ঠাকুমার কণ্ঠ ভেসে এল—
“নদীকে বেশি বিশ্বাস কোরো না, মাধু। ওর ডাক শোনার পর থেকে অনেক মেয়েই আর ফেরেনি।”
মাধুরী প্রশ্ন করল, “তাহলে তুমি কেন ভয় পাও, ঠাকুমা?”
ঠাকুমা কেঁপে উঠলেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“কারণ আমারও একটা নাম নদী জানে, যেটা আজও আমি কারও কাছে বলিনি…”
পর্ব ৪: ঠাকুমার গোপন নাম
মাধুরী সারারাত ঘুমোতে পারল না। ঠাকুমার বলা শেষ কথাটা মাথায় বাজছিল— “আমারও একটা নাম নদী জানে…”। সে বারবার ভাবছিল, এ কী রকম কথা! নাম তো সবারই থাকে, কিন্তু নদী যদি বিশেষ কোনো নাম জানে, তবে তার মানে কী?
ভোরে ঘুম ভাঙতেই সে ঠাকুমার ঘরে ছুটে গেল। জানলার পাশে বসে অঞ্জনা তখন মাটির প্রদীপে সলতে কাটছিলেন। মুখে গভীর ছায়া।
“ঠাকুমা,” মাধুরী ধরা গলায় বলল, “তুমি কাল রাতে যে কথাটা বললে… সত্যি নাকি?”
অঞ্জনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—
“আমার নাম অঞ্জনা, সবাই জানে। কিন্তু নদী আমাকে আরেক নামে চেনে। সেই নাম আমি ছোটবেলায় শুনেছিলাম, তখন তোমার বয়সী ছিলাম।”
মাধুরী বিস্ময়ে চোখ বড়ো করল।
অঞ্জনা জানালেন, একসময় তিনিও এই কুলেশ্বরীর ধারে খেলা করতেন। প্রতি পূর্ণিমার রাতে তিনি শোনাতেন নারীকণ্ঠের গান। এক রাতে নদী তাকে ফিসফিস করে ডেকেছিল—‘মেঘলা’।
“কেন মেঘলা?”—মাধুরীর প্রশ্ন।
“কারণ হয়তো আমি তখনো জানতাম না, আমার জীবন কেমন হবে। বিয়ের পর যে আকাশটা মেঘে ঢেকে যাবে, সেই আকাশের নাম নদী অনেক আগে বলে দিয়েছিল।”
অঞ্জনার চোখ ভিজে উঠল।
“আমাদের জীবনের সত্যিকার নাম আমরা নিজেরা বেছে নিই না, সমাজ আমাদের জন্য যেটা বানিয়ে রাখে, আমরা সেটা বয়ে বেড়াই। নদী সেই লুকোনো নাম ফিসফিস করে জানায়, যেন মনে করিয়ে দেয় আমরা আসলে কারা।”
মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। সে হঠাৎ ঠাকুমার হাত চেপে ধরল।
“তাহলে নদী আমাকেও একটা নাম বলবে?”
অঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“হয়তো বলবে। তবে সাবধান, মাধু। সেই নাম শোনার পর আর আগের মতো থাকা যায় না। যারা শোনে, তারা বদলে যায়। অনেক সময় তারা বেঁচে থাকলেও সমাজ তাদের মৃত মনে করে।”
দিনগুলো গড়াল। মাধুরী কাগজে কাগজে নাম লিখতে শুরু করল। সুবর্ণা, অচেনা মুখগুলো, ঠাকুমার মেঘলা। যেন নদীর গোপন ভাণ্ডার তার হাত ধরে খুলে যাচ্ছে।
একদিন সন্ধ্যায়, পড়ার টেবিলে বসে লিখছিল সে। হঠাৎ বাতাসে প্রদীপ নিভে গেল। ঘর অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে ফিসফিস করে ভেসে এল এক অচেনা গলা—
“তুই শোনার জন্য প্রস্তুত?”
মাধুরীর হাত কাঁপতে লাগল। সে চোখ বন্ধ করল। হঠাৎ মনে হলো, ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা বাতাস। আর কানে বাজল একটা নাম—
“অশ্রিতা।”
চমকে উঠল সে। এ নাম তো তার নয়। কিন্তু কেন যেন মনে হলো, এই নামই তার ভেতরের সত্য। যেন বহু জন্মের কান্না, দুঃখ, প্রতিবাদ এক হয়ে এই নাম হয়ে উঠেছে।
রাতে মা ইন্দ্রাণী খেয়াল করলেন, মাধুরী চুপচাপ বসে আছে।
“কি হলো? শরীর খারাপ?”
মাধুরী শুধু বলল, “আমার নাম মাধুরী নয়, মা। নদী আমাকে অন্য নামে ডেকেছে।”
ইন্দ্রাণী ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
“কি আজেবাজে কথা বলছিস? এসব ভুলে যা। মেয়েদের জন্যে নাম মানে শুধু সংসারের ঠিকানা।”
কিন্তু মাধুরীর চোখে তখন নতুন আগুন জ্বলছে। সে জানে, এখন থেকে তার জীবন বদলে যাবে। কারণ সে নদীর দেওয়া গোপন নাম শুনে ফেলেছে।
নদীর দেওয়া নামের ভার যেন মাধুরীর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে জানত—যখন থেকে নদী তাকে “অশ্রিতা” নামে ডেকেছে, তখন থেকেই তার ভেতরের সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃশ্য নতুন অর্থে ভরপুর হয়ে উঠছে।
সে আর আগের মতো পড়াশোনার খাতায় কেবল অঙ্ক কষতে বা রচনা লিখতে পারছিল না। এখন খাতার পাতায় ফুটে উঠছিল নদীর মুখ, ভেসে আসা হাত, নামহীন কণ্ঠের অক্ষর। মাঝে মাঝে সে থেমে ভাবত—এ কি তবে পাগলামি? নাকি সত্যিই তার ভেতর দিয়ে কথা বলছে অদৃশ্য মেয়েদের ইতিহাস?
একদিন দুপুরে মা তাকে ডাকলেন।
“মাধু, বাজার থেকে কিছু আনতে হবে। তোর হাতে সময় আছে তো?”
মাধুরী মাথা নাড়ল। হেঁটে রাস্তায় বেরোল। বাজারটা নদীর পাশেই। পথে যেতে যেতে সে খেয়াল করল, গ্রাম্য মেয়েরা হাসিঠাট্টা করছে, কারও হাতে আঁচল ভিজে আছে, কারও চোখে চাপা দুঃখ। হঠাৎই মনে হলো, এরা সবাই নদীর ভেতরের সেই কণ্ঠগুলোর মতো। বেঁচে আছে, অথচ গোপন কান্নায় চাপা।
বাজার থেকে ফেরার পথে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। ঢেউ তখন স্বাভাবিক। হঠাৎ আবার ভেসে এল সেই ফিসফিসানি—
“অশ্রিতা… তুই তোদের হয়ে লড়বি?”
মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু ভিতর থেকে একটা গলা বেরিয়ে এল—
“হ্যাঁ, আমি লড়ব।”
সেদিন রাতে ঠাকুমা কাছে ডেকে বললেন,
“শোন, মাধু। নদী তোকে নাম দিয়েছে, মানে তোকে দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু মনে রাখিস, দায়িত্ব মানে কেবল গৌরব নয়, অভিশাপও হতে পারে।”
“অভিশাপ?”
অঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“যখন আমি ‘মেঘলা’ নাম শুনেছিলাম, তার পর থেকেই আমার সংসার ভেঙে যেতে শুরু করে। স্বামী আমাকে অকারণ মারত, শ্বশুরবাড়ি আমাকে অশুভ মনে করত। হয়তো নাম জানলে সমাজ আর সহ্য করতে পারে না।”
মাধুরী ঠাকুমার চোখে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু তুমি লড়োনি কেন?”
ঠাকুমার মুখে একটুখানি হাসি ফুটল।
“আমার সময় ছিল না, মাধু। তখন মেয়েদের কাছে প্রতিবাদ মানে ছিল আরও শাস্তি। কিন্তু এখন তোরা পারবি।”
পরদিন স্কুলে গিয়েও মাধুরীর মনে অদ্ভুত অস্থিরতা। ক্লাসে বসে হঠাৎ কানে এল এক সহপাঠিনীর ফিসফিসানি—
“কাল রাতে বাবা আবার মাকে মেরেছে…”
শব্দটা বিদ্যুতের মতো লাগল। মাধুরী খাতার কোণে লিখে ফেলল—“সে-ও অশ্রিতা।”
সে বুঝতে শুরু করল—অশ্রিতা নাম কেবল তার একার নয়, এটা এক প্রতীক। প্রতিটি মেয়ে, প্রতিটি নারী, যাদের কণ্ঠ চেপে দেওয়া হয়েছে, তাদের সবার নাম অশ্রিতা।
সন্ধ্যায় নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াল সে। এবার আর ভয় পেল না। দু’হাত ছুঁয়ে বলল—
“তোমাদের নাম আমি লিখব। তোমাদের কণ্ঠ আমি বহন করব। যদি সমাজ না শোনে, আমি শোনাব।”
নদী যেন তার প্রতিশ্রুতিতে সাড়া দিল। ঢেউ উঠে পাড় ছুঁয়ে গেল। জলের গা বেয়ে শোনা গেল একসাথে অসংখ্য কণ্ঠ—
“আমাদের নাম আর চাপা পড়বে না।”
মাধুরী বুঝল—অশ্রিতার যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
পর্ব ৬: নদীর প্রতিশোধ
বর্ষা সেই বছর যেন অন্য রকম হয়ে এল। আকাশ প্রতিদিনই কালো মেঘে ভরে উঠত, আর কুলেশ্বরী নদীর ঢেউ দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছিল। গ্রামবাসী বলছিল—এমন ভরা বর্ষা তারা বহু বছর দেখেনি। কারও ঘর ভেসে গেল, কারও ধানক্ষেত ডুবে গেল, কিন্তু মাধুরীর মনে হচ্ছিল, নদী শুধু পানি আনছে না—সে আনছে প্রতিশোধের স্রোত।
এক রাতে ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে সে একা দাঁড়িয়েছিল নদীর ধারে। দূরে বাজ পড়ছিল, আর মাটির ঘরগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছিল। তখনই নদীর ভেতর থেকে গর্জনের মতো একসাথে অনেক কণ্ঠ শোনা গেল—
“আমাদের কথা কেউ শোনেনি… আমাদের কান্না কেউ দেখেনি… এখন সময় এসেছে।”
মাধুরীর গা কাঁপছিল, কিন্তু বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলছিল। সে হাঁটু গেড়ে বসে ফিসফিস করল—
“কি করতে হবে আমাকে?”
নদীর ঢেউ গর্জে উঠল। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকটা ছবি—
- বাল্যবিবাহের আসরে কাঁদতে থাকা এক কিশোরী।
 - শ্বশুরবাড়িতে আগুনে পুড়ে যাওয়া এক তরুণী।
 - স্বামীর লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত এক মা।
 
সব ছবি মিশে একাকার হয়ে গেল। নদীর কণ্ঠ তখন বলল—
“তুই আমাদের গল্প ছড়িয়ে দে। তুই আমাদের কান্না শোনাক সব গ্রাম।”
পরদিন সকালে গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল। নাকি পূর্ণিমার রাতে নদীতে অচেনা মেয়েদের ছায়া ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে। কেউ বলল তারা দেবী, কেউ বলল অশুভ আত্মা। কিন্তু মাধুরী জানত—ওরা মৃত নয়, ওরা চাপা পড়া কণ্ঠ।
সে স্কুলে গিয়ে খাতার পাতা ছিঁড়ে সবার হাতে দিল। পাতাগুলোয় লেখা ছিল—
“আমি সুবর্ণা, নদীতে হারিয়ে গেছি।”
“আমি মেঘলা, সমাজে হারিয়ে গেছি।”
“আমি অশ্রিতা, তবু এখনো বেঁচে আছি।”
প্রথমে ছেলেরা হাসাহাসি করল। কিন্তু মেয়েরা পাতাগুলো পড়তে পড়তে চুপ হয়ে গেল। কারও চোখে জল, কারও হাতে কাঁপুনি। মনে হলো, তারা বুঝতে পারছে, এই গল্প কেবল নদীর নয়, এ তো তাদের নিজেদেরও।
সন্ধ্যায় মা ইন্দ্রাণী খুব রেগে গেলেন।
“এ সব আবার শুরু করেছিস? খাতার পাতা ছিঁড়ে বাজে কথা লিখে সবাইকে দিচ্ছিস? তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি?”
মাধুরী শান্ত গলায় বলল,
“না মা, আমি শুধু সত্যি বলছি। যে সত্যি সবাই চেপে রাখে।”
ইন্দ্রাণী চুপ করে গেলেন, কিন্তু তার চোখে ভয়। যেন তিনি নিজেও একসময় সেই নদীর ফিসফিসানি শুনেছিলেন, অথচ চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।
রাত গভীর হলে মাধুরী আবার গেল নদীর ধারে। এবার নদীর গলা আর নরম ছিল না। এবার সেটা ঝড়ের মতো চিৎকার—
“তুই আমাদের মুক্তি দিবি না? তুই আমাদের বিচার আনবি না?”
আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল। নদীর ঢেউ পাড় ভাঙতে লাগল। মাধুরী বুঝল—এ শুধু গল্প লেখা নয়, এ এক যুদ্ধ। নদী চাইছে, তার কণ্ঠ হয়ে মাধুরী দাঁড়াক।
সে চিৎকার করে বলল—
“হ্যাঁ! আমি তোমাদের বিচার আনব। তোমাদের প্রতিশোধ আমি বহন করব।”
মুহূর্তেই বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল। নদীর জল শান্ত হলো, যেন তার প্রতিশ্রুতির পর নদী শান্তি পেল।
কিন্তু সেই রাতেই গ্রামে ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। হঠাৎ একজন প্রভাবশালী গ্রামের জমিদারের ছেলে নদীর ঘাটে ডুবে মরল। গ্রাম কাঁপল। সবাই বলল—নদী রেগে গেছে।
মাধুরীর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল—
এ কি তবে নদীর প্রতিশোধের শুরু?
পর্ব ৭: রক্তজল
জমিদারের ছেলের মৃত্যুতে সারা গ্রাম তোলপাড় হয়ে উঠল। সকলে নদীর দিকে ভয়ে তাকিয়ে থাকল, কেউ আর রাতের বেলা ঘাটে নামল না। পুরোনো কাহিনি আবার নতুন করে ছড়িয়ে পড়ল—“কুলেশ্বরী রুষ্ট হয়েছে, মেয়েদের কান্না তাকে রক্তপায়ী করে তুলেছে।”
কিন্তু মাধুরীর মনে হচ্ছিল, এটা শুধু দৈব নয়। নদী যেন হিসেব কষে প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। আর সেই প্রতিশোধের সঙ্গেই জড়িয়ে যাচ্ছে তার নিজের প্রতিজ্ঞা।
সকালের স্কুলে গিয়ে মাধুরী দেখল, মেয়েদের চোখে আতঙ্ক। গোপনে ফিসফিস চলছে—
“কাল রাতেও নদীর জল লাল হয়ে উঠেছিল।”
“চাঁদের আলোয় দেখেছি, ঢেউয়ের ভেতর যেন রক্ত গড়াচ্ছে।”
মাধুরী নিজের খাতায় লিখল—“রক্তজল।”
ওই শব্দটার ভেতরে ছিল ইতিহাস, ছিল কান্না, ছিল বিদ্রোহ।
রাতে বিছানায় শুয়ে সে শুনতে পেল নদীর ডাক। ফিসফিস নয়, এবার গর্জন—
“রক্তজল থামবে না, যতক্ষণ না বিচার আসে।”
সে উঠে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখল, নদীর বুকে সত্যিই লালচে আলো ফুটে উঠেছে। যেন কারও রক্ত ভেসে এসেছে, আবার যেন শত কণ্ঠ মিশে গেছে জলের স্রোতে।
পরদিন গ্রামে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। গোপাল কাকা, যিনি বহু বছর আগে নিজের কিশোরী বউকে নির্যাতন করে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন—লোকমুখে শোনা যায়, মেয়েটি আর কখনো ফেরেনি—তিনি হঠাৎ নদীর ধারে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলেন। চোখ উল্টে আছে, শরীর শুকনো, যেন জল তাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি।
গ্রাম শিউরে উঠল। সবাই বলল, “এ তো নদীর প্রতিশোধ!”
মাধুরীর মা ইন্দ্রাণী ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। রাতে মেয়েকে কোলে টেনে বললেন,
“মাধু, আর নদীর কাছে যাস না। ও তোকে টেনে নেবে।”
কিন্তু মাধুরীর চোখে তখন অদ্ভুত দীপ্তি।
“না মা, নদী আমাকে নেবে না। নদী আমাকে ব্যবহার করবে।”
ইন্দ্রাণী চমকে উঠলেন। তার মনে হল, হয়তো মাধুরী আর আগের মতো নেই।
সেই রাতে ঠাকুমা ধীরে ধীরে এসে বললেন,
“মাধু, শোন, নদী যখন রক্তজল হয়ে ওঠে, তখন ওকে থামানো যায় না। তবে যদি তোরা নামের তালিকা শেষ করতে পারিস, হয়তো শান্তি মিলবে।”
“তালিকা?”
“হ্যাঁ, যে নামগুলো চাপা পড়েছে, যাদের আত্মা নদীতে বাঁধা, তাদের নাম লিখতে হবে। সব নাম একসাথে উচ্চারণ করতে হবে। না হলে প্রতিশোধ চলতেই থাকবে।”
মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। তার খাতার পাতাগুলো যেন হঠাৎ অগ্নিপর্বতের মতো জ্বলতে লাগল। সে জানল, তাকে এখন শুধু লেখা নয়—সবাইকে জড়ো করে নদীর সামনে দাঁড়াতে হবে।
পরদিন রাতে, পূর্ণিমার আলোয়, সে মেয়েদের নিয়ে নদীর ধারে দাঁড়াল। প্রতিটি মেয়ের হাতে একটি করে খাতার পাতা। পাতায় লেখা একেকটি নাম—সুবর্ণা, মেঘলা, অশ্রিতা, আর অসংখ্য অচেনা নাম।
নদী গর্জে উঠল। ঢেউ লালচে হয়ে ছুটে এলো।
মেয়েরা একসাথে নাম উচ্চারণ করতে লাগল।
“সুবর্ণা… মেঘলা… অশ্রিতা…”
প্রতিটি নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নদীর লাল জল যেন একটু একটু করে স্বচ্ছ হতে লাগল।
কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ো হাওয়া উঠল। নদী চিৎকার করে উঠল—
“সব নাম কি লিখেছিস? সব নাম কি মনে রেখেছিস?”
মাধুরী ভয় পেয়ে খাতার শেষ পাতায় চোখ রাখল। সেখানে অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছে নতুন একটা নাম—“ইন্দ্রাণী।”
সে চমকে গেল। এ তো তার নিজের মায়ের নাম!
পর্ব ৮: ইন্দ্রাণীর নাম
মাধুরীর হাত কাঁপছিল। খাতার শেষ পাতায় অক্ষরগুলো যেন রক্ত দিয়ে লেখা—“ইন্দ্রাণী”।
সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, কিন্তু নামটা মিলল না। তার নিজের মা—ইন্দ্রাণী—জীবিত, সংসারের নিত্যকার রুটিনে ব্যস্ত। তবে নদী কেন এই নামটাকে চাপা কণ্ঠদের তালিকায় টেনে আনল?
নদীর ঢেউ তখনো গর্জে উঠছে।
“সব নাম উচ্চারণ কর, না হলে রক্তজল থামবে না।”
মাধুরী দ্বিধায় পড়ে গেল। মেয়েরা একসাথে চিৎকার করছিল নামগুলো, কিন্তু শেষ নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে তার কণ্ঠ শুকিয়ে গেল।
সেই রাতে বাড়ি ফিরে সে মায়ের দিকে তাকাল অন্য চোখে। ইন্দ্রাণী তখন ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত, হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘামের ফোঁটা মুছছেন। কিন্তু তার মুখে এক অদ্ভুত ছায়া, যেন ক্লান্তির আড়ালে লুকোনো ভয়ের চিহ্ন।
“মা,” মাধুরী ধরা গলায় বলল, “নদী কেন তোমার নাম ডাকছে?”
ইন্দ্রাণী থমকে গেলেন। হাতের কাজ থেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তিনি নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
“আমি ভেবেছিলাম, তোরা কোনোদিন জানবি না।”
তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন।
“যখন আমি তোমার চেয়ে একটু বড়ো, তখন আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বয়স তখন মাত্র ষোলো। স্বামীর বাড়িতে গিয়ে প্রথমদিনই বুঝেছিলাম, ওরা আমাকে মানুষ মনে করে না। প্রতিদিন গঞ্জনা, প্রতিদিন মারধর। এক রাতে আমি পালিয়ে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হয়েছিল, এক লাফ দিলেই সব শেষ। তখনই নদী আমাকে ডাকল—‘ইন্দ্রাণী’ নামে নয়, এক অন্য নামে।”
মাধুরীর চোখ ছলছল করে উঠল।
“কোন নামে?”
“‘চিরাশ্রিতা।’ মানে যে সারাজীবন অন্যের দয়ায় বাঁচতে বাধ্য। আমি ভয় পেয়ে ফিরে এলাম। বাঁচলাম বটে, কিন্তু সেই নামটা আমাকে গ্রাস করে রাখল। আমি কারও কাছে কিছু বলিনি। কিন্তু নদী জানে।”
মাধুরীর বুক হিম হয়ে গেল। মা, যাকে সে সবসময় শক্ত আর নির্লিপ্ত ভেবেছিল, আসলে তার ভিতরেও চাপা কান্না আছে, যেটা নদী ধরে রেখেছে।
ইন্দ্রাণী বললেন,
“তুই যখন খাতায় আমার নাম দেখেছিস, তার মানে নদী চাইছে আমি আর লুকিয়ে না থাকি। তুই যদি আমার নাম উচ্চারণ করিস, তবে হয়তো মুক্তি পাব।”
পরদিন রাতে আবার মেয়েরা জড়ো হলো নদীর ধারে। খাতার শেষ পাতা মাধুরী হাতে নিয়ে দাঁড়াল। নদী তখন অস্থির, ঢেউয়ের গর্জন আকাশ কাঁপাচ্ছে।
মাধুরী বুক ভরে চিৎকার করল—
“ইন্দ্রাণী! চিরাশ্রিতা!”
মুহূর্তেই বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নদীর লাল জল ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে উঠল। ঢেউ থেমে গেল, আর অন্ধকারে শোনা গেল এক মধুর কণ্ঠ—
“ধন্যবাদ…”
মাধুরীর চোখে জল এসে গেল। সে জানত, সেটা তার মায়ের ভেতরের কান্নার কণ্ঠস্বর, যেটা এতদিন নদী বয়ে এনেছিল।
কিন্তু শান্তি বেশিক্ষণ টিকল না। দূরে মেঘ গর্জে উঠল, আর নদী ফিসফিস করে বলল—
“শেষ নাম এখনো বাকি।”
মাধুরী চমকে উঠল।
“শেষ নাম?”
খাতার পাতাগুলো ঝট করে উলটে গেল। আর একেবারে শেষ পাতায় ফুটে উঠল এক শব্দ—
“অঞ্জনা।”
ঠাকুমার নাম।
পর্ব ৯: অঞ্জনার নাম
খাতার শেষ পাতায় ঠাকুমার নাম দেখে মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল।
“অঞ্জনা।”
কালি-লাল অক্ষরে লেখা, যেন রক্তের ফোঁটা জমে গেছে।
সেই রাতেই মাধুরী দৌড়ে গেল ঠাকুমার ঘরে। অঞ্জনা তখন প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় পুঁথি পড়ছিলেন। মুখে শান্তি, কিন্তু চোখে গভীর ক্লান্তি।
“ঠাকুমা,” মাধুরী কেঁপে কেঁপে বলল, “নদী এবার তোমার নাম ডাকছে।”
অঞ্জনা ধীরে ধীরে চোখ তুললেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি ভেবেছিলাম, এ নাম চাপা পড়েই থাকবে। কিন্তু নদী তো কাউকে ভুলতে দেয় না।”
তিনি শুরু করলেন বহুদিনের পুরোনো কথা।
“আমি তখন সতেরো। তোমার বাবার জন্ম হয়নি। আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক ধনী ঘরে। স্বপ্ন ছিল—একদিন আমি পড়াশোনা করব, শিক্ষক হব। কিন্তু বিয়ের পর সেই স্বপ্নগুলো ভেঙে গেল। স্বামী রোজ রাতে মদ খেয়ে ফিরত, আর আমাকে দাসীর মতো ব্যবহার করত। একদিন আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। তার পরদিন ভোরে আমাকে নদীর ঘাটে নিয়ে গিয়ে ফেলে রেখে এসেছিল। বলেছিল, ‘মরে যা।’
আমি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলাম। তখনই কুলেশ্বরী আমার কানে ফিসফিস করল—‘তুই মেঘলা।’ মেঘের মতো অন্ধকার, যাকে কেউ ধরে রাখবে না।”
অঞ্জনার গলা কেঁপে এল।
“আমি মরিনি, ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু সেই দিন থেকে আমি আমার আসল নাম হারালাম। সবার কাছে অঞ্জনা, কিন্তু নদীর কাছে আমি কেবল মেঘলা।”
মাধুরীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।
“তাহলে, ঠাকুমা, তোমার নামও উচ্চারণ করতে হবে?”
অঞ্জনা মাথা নেড়ে বললেন,
“হ্যাঁ। আমার নাম না বললে নদী শান্ত হবে না। কারণ আমি শুধু নিজের কান্না লুকোইনি—আমার নীরবতায় আরও কত মেয়ের কণ্ঠ চাপা পড়েছে। আমি অপরাধী।”
পরদিন রাতে মাধুরী আবার মেয়েদের নিয়ে দাঁড়াল নদীর ঘাটে। আকাশে কালো মেঘ জমেছে, বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে। খাতার শেষ পাতা হাতে তুলে সে উচ্চারণ করল—
“অঞ্জনা! মেঘলা!”
নদী গর্জে উঠল। ঢেউয়ের বুকে যেন ভেসে উঠল ঠাকুমার যুবক বয়সের মুখ—ভয়, কান্না, আর হারানো স্বপ্ন। মেয়েরা একসাথে নামটি পুনরাবৃত্তি করতে লাগল—
“মেঘলা! মেঘলা! মেঘলা!”
হঠাৎ আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামল। নদীর জল ফুলে উঠল, কিন্তু রক্তজল মিলিয়ে গেল। ঢেউ শান্ত হয়ে কুলে এসে ঠেকল।
মাধুরীর মনে হলো, ঠাকুমার অদৃশ্য কান্না আজ মুক্তি পেল।
সেই রাতে অঞ্জনা মাধুরীর হাত ধরে বললেন,
“তুই যা করেছিস, সেটা আমার প্রজন্ম কোনোদিন করতে পারেনি। কিন্তু সাবধান, মাধু—নদী এখনো পুরোপুরি শান্ত হয়নি। একটা নাম এখনো বাকি।”
মাধুরী বিস্ময়ে তাকাল।
“আরেকটা নাম?”
অঞ্জনার চোখে ছায়া নেমে এলো।
“হ্যাঁ। সেই নাম, যেটা তুই ভাবছিস তোর নিজের নয়। অথচ সেটাই নদীর শেষ গোপন নাম।”
পর্ব ১০: নদীর শেষ নাম
গ্রামের আকাশে ঝড়ের ছায়া নেমেছে। কুলেশ্বরীর জল আবার অস্থির, ঢেউ গর্জে উঠছে। সারা গ্রাম আতঙ্কে—কেউ নদীর ধারে যায় না। শুধু মাধুরী জানে, এ আতঙ্কের পেছনে আছে এক অমোঘ ডাক—শেষ নামের ডাক।
ঠাকুমার কথাগুলো তার কানে বাজছে—
“যে নামটাকে তুই ভাবছিস তোর নিজের নয়, অথচ সেটাই নদীর শেষ গোপন নাম।”
মাধুরী সারাদিন খাতার দিকে তাকিয়ে রইল। পাতাগুলো উল্টে গেল বারবার, কিন্তু শেষ পাতা ফাঁকা। শুধু মাঝেমধ্যে অদৃশ্য কালির দাগ ফুটে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। রাতে সে বুঝল—এবার তাকে একাই যেতে হবে।
পূর্ণিমার আলোয় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে মাধুরী হাত বাড়াল। চারপাশ নিস্তব্ধ। হঠাৎ ঢেউয়ের ভেতর থেকে ভেসে এল শত শত কণ্ঠ, একসাথে ফিসফিস করছে—
“শেষ নাম… শেষ নাম…”
মাধুরী বুক ভরে বলল, “কে সেই শেষ নাম?”
ঢেউ উঠে তার পায়ের কাছে এসে ঠেকল। আর অন্ধকারে ভেসে উঠল তার নিজের ছায়া। চোখে জল, ঠোঁটে কান্না। নদীর কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল—
“অশ্রিতা!”
মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু সে চমকাল না। সে জানত, নদী বহুদিন ধরেই তাকে এই নামে ডেকেছে। অশ্রিতা—যে আশ্রয় খোঁজে, আবার আশ্রয় দেয়। যার কণ্ঠ শুধু তার নিজের জন্য নয়, অসংখ্য হারানো মেয়ের জন্য।
সে দু’হাত মেলে দাঁড়াল।
“হ্যাঁ, আমি অশ্রিতা। আমি তোমাদের কণ্ঠ। আমি তোমাদের নাম।”
মুহূর্তেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। নদীর জল লাল হতে হতে হঠাৎ স্বচ্ছ হয়ে গেল। ঢেউ থেমে শান্ত হল। বাতাসে ভেসে এল অসংখ্য কণ্ঠ, এবার আর কান্না নয়—গান। যেন মুক্ত আত্মারা আনন্দে মিলিয়ে গেল।
মাধুরী খাতার পাতায় লিখে গেল প্রতিটি নাম—সুবর্ণা, মেঘলা, চিরাশ্রিতা, অশ্রিতা। শেষ পাতায় লিখল—“কুলেশ্বরী নয়, এই নদীর গোপন নাম ‘নারী’।”
ভোর হলে গ্রামবাসী নদীকে দেখে হতবাক। আর কোনো রক্তজল নেই, বরং কুলেশ্বরীর বুক ভরে আছে শান্ত ঢেউয়ে। অনেকে বলল—নদী নাকি দেবীর মতো শান্ত হয়ে গেছে।
কিন্তু শুধু মাধুরী জানত, নদী আর আগের মতো নেই। তার গোপন নাম আর চাপা নেই, পৃথিবীর সামনে প্রকাশিত।
সে ঠাকুমা ও মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। তাদের চোখে আর ভয়ের ছায়া নেই। যেন তারাও মুক্ত।
সন্ধেবেলায় মেয়েরা আবার নদীর ধারে জড়ো হলো। এবার ভয় নয়, তাদের কণ্ঠে গান—
“আমরা কেউ আর নামহীন নই… আমাদের নদীর নাম নারী…”
মাধুরী তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে বুঝল, তার যাত্রা শেষ হয়নি। বরং শুরু হলো নতুন পথ—যেখানে প্রতিটি কণ্ঠ, প্রতিটি গল্প সে বহন করবে।
কারণ সে এখন শুধু মাধুরী নয়।
সে হলো অশ্রিতা—নারীর নামের রক্ষক।
শেষ
				
	

	


