অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ১: সন্ধ্যাবেলা এক অদ্ভুত দেখা
দুমগাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এক বিশাল নদী, যেটি ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তের দৃষ্টান্ত—একটি জলপথ, যা কখনো কখনো জীবনের সেতু, আবার কখনো বিভাজক হয়ে ওঠে। নদী তার স্রোত নিয়ে চলে, কিন্তু মাঝখানে থাকে কাঁটাতার, দেয়াল—যা মানুষের সম্পর্ককে ভেঙে দেয়।
এখন সন্ধ্যা। নদী পাড়ে বসে থাকে রিনা, তার পা বালির মধ্যে গাঁথা। চোখ দুটি যেন নদীর ওপারে, যেখানে তার প্রিয় ভিটে—বাংলাদেশ। এখানে সে অবৈধভাবে চলে এসেছে, তবে এখন নদীই তার জায়গা, নদীই তার আবেগের সমুদ্র।
অপর পাড়ে, মাধুপুর গ্রামের এক তরুণ ছেলে—অর্জুন। সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে আসে, কিছুটা নিঃসঙ্গতা আর কিছুটা শান্তি খোঁজে। সে জানে, নদী তাকে কিছু বলবে, আবার কিছু ছেড়ে যাবে।
আজ সন্ধ্যেবেলায়, যখন সুর্য ডুবে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, তাদের প্রথম দেখা হয়।
রিনা প্রতিদিন সন্ধ্যায় নদী পাড়ে আসত। কিন্তু আজ তার কিছু আলাদা অনুভূতি হচ্ছিল—যেন কেউ তাকে দেখছে। রিনা তাকিয়ে দেখে, অন্য পাড়ে এক তরুণ বসে আছে। প্রথমে একটু ভয়ে ভয়ে, তারপর কিছুটা নিশ্চিত হয়ে সে তাকে দেখে, আর তখনই অর্জুনের চোখ তার চোখে এসে পড়ে।
“হ্যালো,” অর্জুন ধীরে ধীরে ডাকলো।
রিনা হঠাৎ ভয়ে একটু চমকে ওঠে, তবে পরে নরম কণ্ঠে বলে, “হাই।”
অর্জুন একটু হাসলো, “আমি এখানে মাঝে মাঝে আসি। শান্তি পাই। আপনি?”
“আমি রিনা,” সে ধীরে ধীরে বলল, তার চোখ ভেঙে যায় নদীর পানির দিকে। “আমি মাঝে মাঝে আসি… কিছু খুঁজে।”
অর্জুন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তার মনে হচ্ছিল, এই অচেনা মুখটা কেন যেন খুব পরিচিত, অনেক দিনের মতো মনে হচ্ছিল। নদী তাকে, দুজনের মাঝে কোনো এক সুপ্ত সম্পর্ক তৈরি করে দিল।
“আপনি এখানকার নন, তাই তো?” অর্জুন কিছুটা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল।
“না,” রিনা একটানা নদী পাড়ে তাকিয়ে উত্তর দিল। “আমি ওপারে।”
অর্জুনের হৃদয় এক চমক খায়। ওপারে—তাকে সে শোনেনি কখনো, তবে আজ যেন তার নিজের চোখে দেখা হলো সেই পৃথিবী। রিনা কোন এক অস্পষ্ট কারণে তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল।
“নদী আমাদের আলাদা করেছে,” অর্জুন নরম কণ্ঠে বলে, “কিন্তু একে অপরকে বুঝতে শিখতে তো কিছু না কিছু করতে হয়।”
রিনা তাকে একটু অবাক হয়ে দেখল। নদী তো শুধু পানি নয়, তার মধ্যে রয়েছে জীবন, আর সেই নদীর মাঝেই তো তারা একে অপরকে অনুভব করছে।
“শুরুতে আপনার ভাষা,” অর্জুন একটু হাসতে হাসতে বলে। “আপনার ভাষা শেখাতে হবে আমাকে।”
রিনা একটু ধাক্কা খায়, তবে চোখের ভিতর এক অদ্ভুত কিছুর অনুভব হয়। পরক্ষণে সে বলে, “শুরুতে আপনার ভাষা, তাহলে আমি শিখব।”
অর্জুন আবারও হাসে। “বাহ, তো বেস… ঠিক আছে!”
এবং এমনভাবেই, নদী দুটি পৃথক পৃথিবীকে এক করতে শুরু করে। দুই ভিন্ন প্রান্তের মানুষ বসে একে অপরের ভাষা শিখতে শুরু করে, কিছু অনুভূতি শেয়ার করতে শুরু করে, আর সেই নদী যেন তাদের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করতে সাহায্য করে।
পর্ব ২: ভাষার সেতু
রিনা আর অর্জুনের প্রতিদিনের দেখা এক নতুন অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী পাড়ে, সেদিনের প্রথম আলাপের পর, তারা ঠিক করেছিল যে একে অপরকে তাদের নিজস্ব ভাষা শিখাবে। রিনা বাংলা শিখাবে অর্জুনকে, আর অর্জুন তাকে হিন্দি। কিন্তু, একে অপরকে ভাষা শেখানো শুধু একটি বাহানা ছিল। আসলে, দুইটি আত্মা একে অপরকে বুঝতে চাইছিল, নদীর মাঝে একটি অসম্ভব দূরত্ব, আর সেই দূরত্বকে পার করে এগিয়ে আসার একটি কৌশল ছিল ভাষা।
অর্জুন প্রথমদিনই রিনা থেকে শেখা কিছু শব্দ মনে রাখতে চেষ্টা করছিল। “কেমন আছো?”—এই সাধারণ প্রশ্নটাই তার কাছে কঠিন মনে হচ্ছিল। সে প্রতিদিন মনে করতো, “আজ আমি রিনাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাব।”
রিনা হাসতে হাসতে বলল, “ওই! হিন্দি তে সহজে বলবে না। সঠিক উচ্চারণ শিখতে হবে।”
অর্জুন একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তোমার বাংলা শুনলে আমার মনে হয়, সব শব্দ যেন একেকটা সুরের মতো। একদম মিষ্টি।”
রিনা তীব্রভাবে কিছুটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। অর্জুনের চোখে কোনো ধরণের জল্পনা ছিল না, তার ভাষায় শুধুই শুদ্ধতা ছিল। এমনকি সে মনে করল, হিন্দির মতো উঁচু শব্দের শিখনেও যে আনন্দ থাকতে পারে, তা কি সে আগে জানতো?
তারা কথা বলার সময় হঠাৎ দুজনের মাঝখানে এক অসম্ভব বিস্ময় এসে দাঁড়ালো। নদী, যে কখনো তাদের মাঝে সীমারেখা তৈরি করতো, সে আজ তাদের সংযোগের পথ দেখিয়ে দিতে শুরু করেছিল। প্রথম দিনেই অর্জুন অনুভব করেছিল যে, কথায়-কথায় সে প্রায় সব শিখে ফেলেছে। রিনার চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে ভাষায় বাঁধতে চাইলেও একভাবে সে বুঝতে পারছিল, শর্তহীন ভাবে বর্ণিত মধুরতাও কোনো ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু, নদীর পাড়ে কোনো এক অচেনা অনুভব, কোনো এক অন্তর্দৃষ্টি তারা গভীরভাবে শেয়ার করছিল। ভাষা শেখানো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। কিন্তু, আরো কিছু ছিল, কিছু গভীরতর—যে সম্পর্ক ভাষার চেয়ে অনেক বেশি পবিত্র, ঐশ্বরিক কিছু।
একদিন, রিনা আর অর্জুন নদীর পাড়ে বসে নিজেদের ভাষা শিখছিল। অর্জুন বলল, “রিনা, তুমি জানো, এই নদী আমাদের একে অপরকে শিখিয়ে দিলো। কিছু দিক থেকে, নদী আমাদের কাছে শুধু জল নয়—সে একটি শিক্ষা, একটি পরীক্ষার মতো, যে পরীক্ষায় আমাদের পরস্পরকে জানতে হয়।”
রিনা একটু খেয়াল করে বলল, “ঠিক বলেছো, অর্জুন। নদী, এই নিরব জল, যা যেন একটা চোখের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে দুজন মানুষ একে অপরকে বুঝবে? কীভাবে আমরা পরস্পরকে গ্রহণ করবো, একে অপরের সংস্কৃতি, আমাদের বাস্তবতা? একে অপরকে ভালোবাসা, জানার অর্থ হয়তো এভাবেই আসে।”
অর্জুন শোনার পর আবার হাঁপ ছেড়ে বলল, “তবে নদী যেন আমাদের মাঝে এক অবাস্তব সীমারেখা টেনে দিয়েছে—তাকে মেনে নেয়ার একটা উপায় তো দরকার ছিল। এভাবে একে অপরের ভাষা শিখে, আমরা একে অপরকে বুঝতে পারছি, এই সরলতা কোথাও যেন হারিয়ে যায়!”
রিনা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, “তুমি ভাবো না, অর্জুন। নদী একদিকে আমাদের দূরত্ব বাড়ায়, কিন্তু অন্যদিকে আমাদের কাছাকাছি এনে দেয়। যেন এক অদ্ভুত উপায়ে এটা সম্ভব!”
তাদের কথা শোনার পর, নদী যেন আরও গভীর হয়ে উঠলো। এই কথা শুনে রিনার মনে হল, কিছু অনুভূতি জীবনের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়—যা কেবল হৃদয়ে শোনা যায়, যা ভাষার বাইরে থাকে, যা কোন শব্দের মধ্যে আটকা পড়তে চায় না।
এদিন, দুজনের মাঝে শান্তি বয়ে গেল। তারা একে অপরের কাছ থেকে তাদের ভাষার কথা শেখার মধ্য দিয়ে, নিজেদের কাছে ফিরে আসছিল। নদী যেমন শান্তভাবে বয়ে চলে, তেমনই তাদের সম্পর্কও, অজানা পথে, এক অচেনা অনুভবে প্রবাহিত হতে লাগল। কিন্তু, সে প্রবাহের মাঝে এক কঠিন সত্য লুকিয়ে ছিল—নদী তাদের মাঝে শুধু জল নয়, এক প্রাচীরও হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যা শিখছিল, যা বলছিল, তাও শুধুই সীমাবদ্ধতা—কাঁটাতারের ছায়ায় ভরা সীমান্তের ভাষা।
অর্জুন একদিন, রিনাকে বলল, “দেখো, আজকে আমি আরও একটু শিখলাম। তবে, তবুও আমি জানি, এই ভাষা শুধুই একটা কৌশল। আসল কথাগুলো হয়তো মুখে বলার প্রয়োজন নেই।”
রিনা চোখে একটু বিষণ্ণতা নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তেমনি, নদীও কেবল জল নয়, সীমারেখা, কঠিন দুঃখ, ভয়। হয়তো তাই আমাদের কথা বলার উপায় ঠিক কখনোই আসবে না।”
কিন্তু আজ, নদী তাদের মাঝে এক নতুন সমঝোতা তৈরি করেছিল। তারা যেমন ভাবতে লাগল, তাদের মধ্যে ভাষা শিখানো আসলে কোনো এক নতুন সম্পর্কের খোঁজ ছিল—যা নদী যেমন গোপনভাবে নিয়ে গেছে, তেমনি একদিন ফিরে আসবে।
পর্ব ৩: কাঁটাতারের জাল
রিনা আর অর্জুনের প্রতিদিনের দেখা এখন এক অভ্যাস হয়ে গেছে। নদী তাদের সম্পর্কের সেতু, আর ভাষার এই অদ্ভুত খেলা তাদের হৃদয়ের প্রগাঢ়তা তৈরি করছে। তারা একে অপরকে শিখিয়ে যাচ্ছে শব্দ, অর্থ, এবং কখনো কখনো, সেই শব্দের মধ্যে লুকানো অনুভূতি। তবে, কিছু কথা ছিল যা তারা একে অপরকে বলতে পারে না—যেগুলো ছিল তাদের অন্তরের সবচেয়ে গভীর স্থানগুলোতে, যা কাঁটাতারের ওপারে চলে যেত।
আজকের মতো, নদীর পাড়ে বসে, তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল। অর্জুন রিনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কেমন যেন কিছু চুপচাপ বাঁধা পড়েছিল তার মুখে। নদী যেমন নীরব, তেমনই তাদের মধ্যে এক স্নিগ্ধ স্তব্ধতা। ঠিক যেন কাঁটাতারের ছায়া তাদের কথা বলার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“অর্জুন,” রিনা প্রথম কথা শুরু করে, “তুমি জানো, কিছু কিছু কথা বলা যায় না, বলার মতো হয় না। কিছু সীমা থাকে, যেখানে ভাষা ব্যর্থ হয়ে যায়।”
অর্জুন একটু সময় নিয়ে, হালকা হেসে বলল, “আমি জানি, রিনা। তবে, কেন যেন মনে হয়, নদী এই সীমাকে ছুঁতে পারবে না। এই সীমা সবসময় থাকবে—এই কাঁটাতার, এই নিরাপত্তা।”
রিনা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমরা যা শিখছি, তা ঠিক কি? আমি কি কখনো বুঝতে পারব, কী বলার চেষ্টা করছে তুমি?”
অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা ভাষায় আটকা পড়েছি, রিনা। সব কিছু বলা সম্ভব নয়।”
তারা একে অপরকে খুব গভীরভাবে বুঝতে চাইছিল, কিন্তু এভাবে একে অপরকে চিনে যাওয়ার কিছু জায়গা ছিল যেখানে ভাষা সঙ্গী হতে পারছিল না। তারপরে নদী তাদের মাঝে এক নতুন অনুভূতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। একদিকে, তারা শিখছিল একে অপরকে, আর অন্যদিকে, তাদের মাঝে কিছু ভেদাভেদ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই ভেদাভেদ নদীর মতো চুপচাপ, কিন্তু অদৃশ্য—যার কোন শেষ ছিল না।
“তুমি তো জানো, অর্জুন, আমি যদি ফিরে চলে যাই, তবে এই নদী, এই সীমান্ত—এগুলো আমাদের কখনো এক হতে দেবে না। আমি যদি ফিরে যাই, তাহলে আমাদের দেখা শেষ।”
অর্জুন চুপ হয়ে যায়। তার মুখের দিকে তাকালে যেন একটা মেঘের ছায়া পড়েছিল। “তুমি কি বলছো, রিনা? তুমি কি আবার চলে যাবে?”
রিনা চোখ সরিয়ে নিল। “আমি জানি, আমি যা বলছি তা সহজ না। কিন্তু, নদী যেভাবে আমাদের একে অপরের থেকে আলাদা করেছে, সেইভাবে কিছু কথা এড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব।”
অর্জুন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি যদি চলে যাও, তবে আমি কখনোই তোমাকে ভুলব না। তোমার কাছে আমি যা শিখেছি, তা আমার কাছে সবকিছু। কিন্তু নদী তো আমাদের একে অপরের থেকে দূরে রাখে, তুমি জানো।”
রিনা একটু নড়েচড়ে বসে। “হ্যাঁ, কিন্তু নদী যে শুধু জল নয়, সেটাও তো জানি। নদী যে সীমান্ত তৈরি করেছে, তার মধ্যে আমরা কি কখনো একে অপরকে ছুঁতে পারব?”
এখন তারা দুজনই গভীর ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল। নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার—এই সব কিছু তাদের মাঝে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করেছিল। তারা যখন একে অপরকে ভাষা শিখাচ্ছিল, তখনও তারা জানত, একে অপরের কথা পূর্ণভাবে শোনা সম্ভব নয়। কোথাও না কোথাও সীমাবদ্ধতা ছিল।
অর্জুন আবার কিছু বলল, “তবে, রিনা, আমি জানি, সীমা যাই হোক না কেন, নদী কিন্তু আমাদের বন্ধন তৈরি করতে পারে। যদি আমরা চেষ্টাও করি, তবে আমাদের মাঝে কিছু না কিছু থাকবে যা নদী দূর করতে পারবে না।”
রিনা তাকে উদাসীন চোখে দেখে বলল, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, অর্জুন। কিন্তু নদী যেভাবে সব কিছু আটকে রাখে, তেমনি আমাদের অনুভূতিও আটকে যায়।”
অর্জুন একটু দাঁড়িয়ে, তার পায়ের কাছে বসা কিছু শুঁড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তবে, যদি তুমি ফিরে যাও, তাহলে আমি তো জানি যে, নদী আমাদের মাঝে একটা সেতু রেখে যাবে।”
রিনা তার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ ছিল। “একদিন, হয়তো আবার এই নদী আমাদের এক করবে। কিন্তু এখন… এখন আমি জানি, আমাদের সীমানা এখানেই।”
তারা একে অপরকে কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখল। নদী তখনও ভাসছে, কিন্তু যেন এই মুহূর্তটি তাদের মধ্যে না-থাকা কিছু তৈরি করেছে।
পর্ব ৪: কাঁপানো হাওয়া
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে আসছে। নদী যেন আরও গভীর, আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। রিনা আর অর্জুন আজও একে অপরকে দেখে যাচ্ছে, তবে তাদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ভাষার মাধ্যমে একে অপরকে জানা, কিছুটা পথ পেরিয়ে আসা—তবে এখনও দুজনের মাঝে একটা অদ্ভুত দূরত্ব ছিল। সেই দূরত্ব যেন নদীর পাড়ে থাকা কাঁটাতারের মতো, যে যেকোনো মুহূর্তে ছুঁতে পারবে না, অথচ সবসময় উপস্থিত।
আজ রিনা আর অর্জুন দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেন কোনো কিছু বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। নদীর কুলকুল শব্দ আর হালকা ঠান্ডা বাতাস তাদের অনুভূতির মাধুর্যতা নষ্ট করছে না, বরং আরও গভীর করছে।
অর্জুন একসময় ধীরে ধীরে তার হাত এগিয়ে বলল, “রিনা, আমরা তো শুধু ভাষা শিখছি না, একে অপরের মনও শিখতে চেষ্টা করছি, তাই না?”
রিনা একটু বিরতি নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, অর্জুন, কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়, ভাষা শিখলে কি সব কিছু বুঝে ফেলা যায়? মনে হয়, কিছু কথাই তো কখনো বলা যায় না।”
অর্জুন চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যদি কিছু না বলো, তাহলে আমি কি কখনো বুঝতে পারব, তোমার ভেতরের অনুভূতি?”
রিনা মুখ নামিয়ে নিল। “কখনো কখনো, অনুভূতি কিছু বলার উপায় চায় না। নদীর মতো, যা শুধু চলে যায়, তার কোনো শব্দ নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু তাকে শুনলে, সে তো অনেক কিছু বলে যায়।”
অর্জুন তাকে নিবিড়ভাবে দেখে বলল, “তুমি কি বলতে চাও, রিনা?”
রিনা চুপ করে রইল। নদী যেন তাদের মধ্যে কথার অন্তর্ভুক্ত না হওয়া এক অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুজনের মাঝে কোনো কিছু বলা না হওয়ার মতো এক অসীম শূন্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
“তুমি জানো,” অর্জুন ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “এই সীমান্ত, এই নদী, যা আমাদের একে অপর থেকে দূরে রাখে, তা শুধু শারীরিক সীমাবদ্ধতা নয়। এটি আমাদের অনুভূতির মাঝে একটি দেয়াল তৈরি করেছে। আমরা একে অপরকে ভাষায়, চোখে, হাতের স্পর্শে বুঝতে পারলেও, অন্তরে কোথাও একটা দেয়াল রয়েই যায়।”
রিনা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “আমি জানি, অর্জুন। তবে, আমরা যদি কিছু বলতে না পারি, তাও কি নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার এ সমস্ত কিছু আমাদের ভালোবাসা কাটিয়ে যেতে পারে?”
অর্জুন চোখ বন্ধ করে কিছুটা সময় নিল। “আমি জানি না, রিনা। কিন্তু, কিছু অনুভূতি, কিছু ভালোবাসা এমন হয়, যা শুধু কথায় প্রকাশিত হয় না। হয়তো আমাদের ভালোবাসা এমনটাই। আর, হয়তো কিছু ভালোবাসা শুধু নিরবতায় থেকেই যায়। “
রিনা আজকাল একটু বেশিই ভাবছে। অর্জুনের কথাগুলো তাকে নতুন ভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেছিল। তাদের মধ্যে, ভাষার বাইরে, কিছু ছিল—একটি অনুভূতির চিরন্তন স্থিতি, যা সীমান্ত বা নদী কখনোই আটকাতে পারবে না। তবুও, সেই অনুভূতি কেমন যেন গভীর হয়ে যাচ্ছে, অথচ ছুঁয়ে নেওয়ার কোনো পথ নেই।
আজ তারা আর একে অপরকে শব্দ শিখাতে বসে নি। তারা শুধু একে অপরের পাশে বসে রইল, নদীকে চুপচাপ দেখছিল। ঝিরঝিরে হাওয়া যেন তাদের দুজনের মাঝে কিছু কথা বলছিল—যে কথাগুলো নদীও জানে, কিন্তু কোনদিন উচ্চারণ করবে না।
“তুমি কি জানো?” অর্জুন হঠাৎ বলল, “আমার মনে হয়, আমরা শুধু ভাষাই নয়, কিছু গভীর সম্পর্কও শিখছি। আমরা দুইজন এমন একটি জগতের মধ্যে প্রবেশ করেছি, যেখানে কোনও বাধা নেই। কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে—আমাদের চোখের ভাষা, আমাদের হৃদয়ের ভাষা।”
রিনা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তবে সে ভাষা কেউ বুঝতে পারে না, অর্জুন। এই সীমান্ত, এই নদী, আমাদের মাঝে যে কোনো অনুভূতিকে বুঝতে দিতে চায় না।”
অর্জুন আবার একবার নদীকে চুপচাপ দেখল। “তবে যদি একদিন, একে অপরকে ভেঙে ফেলতে চাওয়া হয়, তবে কি জানো, নদী আমাদের সহায়তা করবে?”
রিনা যেন কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু তার উত্তর দিতে ইচ্ছা করছিল না। “আমরা কি একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারব? জানি না, অর্জুন। কিন্তু নদী যেভাবে আমাদের দুজনকে একত্রিত করেছে, তাতে হয়তো একদিন এটি আমাদের পথ দেখাবে।”
এটি তাদের মধ্যে এক নতুন বন্ধন তৈরি করেছে—একটি সম্পর্ক, যা ভাষায় নয়, বরং অনুভূতিতে গড়া। কিন্তু সেই অনুভূতি এখনো ঠিক স্থির ছিল না, যেখানে কখনো কোনো পরিবর্তন আসতে পারে।
অর্জুন রিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা নদীকে কখনোই হারাতে পারব না, রিনা। তবে, একদিন, হয়তো তার স্রোত আমাদেরকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে সীমান্তের কোনো প্রভাব থাকবে না।”
রিনা নীরবে তাকে শুনে গেল। জানতো, নদী যেভাবে তাদের একে অপরকে ছুঁতে দেয়, তেমনি একদিন এমন কিছু আসবে যা এই সীমান্তের সব বাধা টপকে যাবে।
পর্ব ৫: অদৃশ্য সীমান্ত
রিনা আর অর্জুনের মধ্যে এখন আর শুধু ভাষা শেখানো নয়, এক ধরনের অদ্ভুত বন্ধন তৈরি হয়েছে। নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার—এই সব কিছু তাদের শিখানো সম্পর্কের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তারা একে অপরকে শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে নয়, অনুভূতি দিয়ে জানছে। তবুও, একদিন নদী তাদের মাঝে এক অনুপ্রবেশী হয়ে দাঁড়াবে—যে নদী তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সীমান্ত তৈরি করেছে, সেই নদী একদিন তাদেরকে সেই সীমান্ত পেরিয়ে নিয়ে যাবে কি না, কে জানে।
আজ সন্ধ্যা একটু দেরিতে আসছে, নদীর পাড়ে আসার সময়, রিনা অনুভব করছিল, কিছু একটা বদলে যাচ্ছে। অর্জুনের সাথে প্রতিদিনের কথা আর ভাষা শিখানোর মাঝে এমন কিছু মূহূর্ত গড়ে উঠেছিল, যা ভাষায় বলা সম্ভব নয়।
“অর্জুন,” রিনা একদিন বলল, “আজকাল মনে হয়, এই নদী আমাদের কাছে শুধু জল নয়, অনেক কিছু। এই নদী আমাদের মধ্যে, আমাদের ভাষা, আমাদের অনুভূতি, সবকিছুকে আলাদা করে দিয়েছে। কিন্তু কেমন জানি, আমাদের মাঝে যেন কোনো কিছু ঘুরে গেছে—যে সীমান্তের কথা আমরা বলছিলাম, সে সীমান্ত কখনো শেষ হবে না কি?”
অর্জুন চুপ করে রিনার দিকে তাকাল। তার চোখে একধরনের অব্যক্ত প্রশ্ন ছিল। “রিনা, আমি জানি, আমরা অনেক কিছু শিখছি। তবে, আমাদের মধ্যে সীমান্ত কোথায় আছে, সেটা তো কোনো এক দিন নদী ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু, সেই দিন কি আসবে?”
রিনা চোখ নামিয়ে নিল। “মনে হয়, সেই দিন আসবে না, অর্জুন। আমাদের ভালোবাসা, এই নদী, এই সীমান্ত, সব কিছু মিলিয়ে একটা মিথ হয়ে যাবে। হয়তো, একদিন যদি নদী আমাদের এক জায়গায় নিয়ে আসে, তবে আমাদের কোনো সীমান্ত থাকবে না।”
তাদের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। একদিকে, নদী তাদের মাঝে অদৃশ্য একটি প্রাচীর তুলে দিচ্ছিল, আর অন্যদিকে, সেই প্রাচীরকে ভেঙে একে অপরকে জানতে তারা চেষ্টা করছিল।
“তবে, অর্জুন,” রিনা হঠাৎ বলল, “একটা কথা বলতে চাই। আমি জানি, আমি এখানে দীর্ঘ সময় ধরে আছি। কিন্তু, এই সীমান্ত তো আমাদের সম্পর্ককে বাঁধে। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা জায়গা আছে, যেখানে আমি তো আর পৌঁছতে পারব না।”
অর্জুন রিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বলছো তুমি? আমরা তো একে অপরকে জানছি, ভালোবাসছি। তবে সীমান্ত যে আমাদের কাছ থেকে একে অপরকে দূরে রাখবে না, সেটা আমি জানি।”
রিনা হাসল, কিন্তু সেটা ছিল একটু করুণ হাসি। “তুমি জানো, অর্জুন, নদী, সীমান্ত, সবকিছু শোনার পরও, কিছু কথা, কিছু অনুভূতি বলার সুযোগই পাওয়া যায় না। এবং হয়তো এটা কখনো হবে না।”
অর্জুন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তবে, একদিন, যদি আমরা সত্যিই একে অপরকে ছুঁতে পারি, যদি একদিন সীমান্ত উঠে যায়, তবে এই নদী আমাদের ভালোবাসা, আমাদের সম্পর্কের পরীক্ষা হবে।”
রিনা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। কিন্তু, এখন, সীমান্ত ভাঙার শক্তি আমাদের হাতে নেই। তবে, এই নদী, আমাদের মধ্যে যেটা অদৃশ্যভাবে রয়েছে, সেটাই হয়তো একদিন আমাদের সাহায্য করবে।”
তাদের মধ্যে আজকের এই আলাপ যেন কোনো রহস্যময় বোধ তৈরি করেছে। তাদের সম্পর্ক কোনো এক প্রকারের স্থিরতা পেয়েছে, যেখানে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো ঘড়ির কাঁটাও চলছে না। তারা শুধু একে অপরকে অনুভব করছে—যা নদী কখনোই বুঝতে দেয়নি।
একদিন, অর্জুন নদী পাড়ে বসে রিনাকে বলল, “তুমি জানো, রিনা, আমি মনে করি, এই নদী আমাদের মধ্যে সেতু তৈরির চেষ্টা করছে, কিন্তু কখনোই সীমান্তকে ভাঙতে পারবে না। কিন্তু, কিছু অনুভূতি, কিছু ভালোবাসা নদীর মতোই স্থায়ী থাকে।”
রিনা ঠান্ডা হাওয়া মাথায় নিয়ে, চোখ বন্ধ করে বলল, “হ্যাঁ, অর্জুন, ঠিক বলেছো। নদী সেতু তৈরি করেছে, তবে সেই সেতু শুধু একে অপরের কাছে আসার পথ। কিন্তু, আসল সেতু তো আমাদের মধ্যে—যেখানে ভাষা, অনুভূতি, সীমান্ত সব কিছু মিলিয়ে একে অপরকে বোধ করতে পারা যায়।”
আজকের আলাপ শেষে, নদী তাদের মাঝে এক অদৃশ্য বাঁধ তৈরি করেছে, যা কখনো সরে যাবে না। তবে, সেই বাঁধের ওপারে ভালোবাসার কিছু কথা ছিল—যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু যা তারা একে অপরের চোখে বুঝতে পেরেছিল।
পর্ব ৬: চুপচাপ ভালোবাসা
নদী প্রতিদিনের মতো ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। রিনা আর অর্জুনের মাঝে সম্পর্কটি এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা ভাষা শিখছে, নিজেদের পরিচয়কে আরও গভীরভাবে জানছে, কিন্তু কাঁটাতার আর সীমান্তের যে প্রাচীর তাদের মধ্যে রয়েছে, তা অব্যাহত। সীমান্ত, নদী—এসবের মাঝে তাদের ভালোবাসা বেঁচে থাকে, কিন্তু তা প্রকাশের কোনো পথ নেই। তারা একে অপরকে চুপচাপ ভালোবাসে, একে অপরকে নীরবে অনুভব করে।
আজও তারা নদীর পাড়ে বসে রয়েছে, তবে আজকের আলাপ একটু ভিন্ন ছিল। তারা একে অপরের চোখে এমন কিছু খুঁজছিল, যা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। এই নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার—সব কিছুই ছিল তাদের মধ্যে, কিন্তু কিছু ছিল যা তাদের মাঝে সর্বোত্তম সংযোগ তৈরি করেছিল, তা ছিল তাদের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের স্রোত।
“অর্জুন,” রিনা আজ একটু বেশিই ভাবনায় ডুবে বলল, “যখন আমি এখানে বসি, নদীকে দেখি, তখন মনে হয়, কি জানি, এই নদী কখনো আমাদের কাছ থেকে কিছু নেবে না। এই নদী আর সীমান্তের মাঝে এক ধরনের বোঝাপড়া ছিল—এক অদৃশ্য বোঝাপড়া। হয়তো, আমরা শিখছি, কিন্তু নদী আমাদের শিখতে দিতে চায় না।”
অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল, তবে ভাষা তার কাছে মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল। “তুমি কি বলছো, রিনা? তুমি কি ভেবেছো, এই নদী আমাদের আটকে রাখবে? নদী তো সব সময় প্রবাহিত হয়, এবং আমাদের সম্পর্কও স্রোতের মতো বহমান থাকবে। সীমান্ত তো শুধু একটা বাধা—যা হয়তো একদিন ভেঙে যাবে।”
রিনা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তবে, অর্জুন, এই বাধা শুধু শারীরিক নয়। সীমান্ত আমাদের মানসিক পরিসরেও রয়েছে। আমরা যতই একে অপরকে জানি, তবুও এই সীমান্ত কখনো আমাদের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি তৈরি করতে দেয় না।”
অর্জুন তার মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ, রিনা, হয়তো তুমি ঠিক বলছো। কিন্তু, নদী তো আমাদের কাছে, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের সম্পর্কের শিক্ষা দিয়েছে। ঠিক যেমন আমরা একে অপরকে ভাষা শিখাচ্ছি, তেমনি আমরা একে অপরকে বুঝতেও শিখছি।”
রিনা সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর বলল, “তবে, অর্জুন, আমি জানি, একদিন, এই নদী, এই সীমান্ত আমাদের ভালোবাসাকে একদম পরিবর্তন করে দেবে। আমাদের মধ্যে কোনো কিছু থেকে যাবে, যা আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”
অর্জুন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হয়তো, কিন্তু যদি সত্যিই একদিন সীমান্ত ভেঙে যায়, তবে আমাদের মাঝে এমন কিছু থাকবে যা কখনো হারাবে না—আমাদের অনুভূতি, আমাদের অন্তরঙ্গতা।”
রিনা তার কথা শুনে হাসল। হাসি ছিল মিশ্র, একদিকে কিছু দুঃখ, আর অন্যদিকে আশার আলো। “আমরা কেবল ধারণা করে যাই, অর্জুন। কিন্তু, কি জানি, একদিন হয়তো নদী আমাদের সেই কিছু দেবে—যা কখনো ভাষায় বলার সুযোগ হয়নি।”
তারা আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ নদীকে দেখছিল। হালকা বাতাস নদীর জল ছুঁয়ে গেল। সেই বাতাস যেন তাদের কথার মধ্যে সুর মিশিয়ে দিয়েছিল। নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার—এগুলো কিছু সময়ের জন্য তাদের মাঝে অস্থিরতা তৈরি করেছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল, একে অপরের পাশে বসে থাকলে, তারা সব কিছু সহ্য করতে পারবে।
“তুমি জানো, রিনা,” অর্জুন বলল, “আমি ভাবছিলাম, একদিন হয়তো আমাদের এই সীমান্ত একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। যদি এমন কিছু হয়, আমরা কি একে অপরকে একে অপরের দেশে নিয়ে যাব?”
রিনা তার চোখে এক নরম হাসি নিয়ে বলল, “এটা একটা স্বপ্ন, অর্জুন। কিন্তু আমাদের মাঝে ভালোবাসা যে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে, তা আমি জানি। একদিন, যদি আমাদের পথে কোনো বাঁধা থাকে, সেই বাঁধাকেও আমরা ভেঙে ফেলব।”
অর্জুন তাকে দেখে কিছুটা হেসে বলল, “তুমি জানো, রিনা, তোমার কথাগুলো সবসময় আমাকে একটা নতুন পৃথিবী দেখায়। তুমি আমার জন্য নদী হয়ে আছো—যেখানে আমি প্রবাহিত হতে চাই, যেখানে আমি চাই, এই সীমান্ত আমাদের কোনো একদিন এক করে দেবে।”
রিনা তার কথা শোনার পর কিছুটা সময় নীরব রইল। তারপর হাসিমুখে বলল, “তুমি যখন নদীর মতো বলো, তখন মনে হয় সবকিছু এক সঙ্গে চলতে চলতে একদিন মিলিয়ে যাবে। কিন্তু সেই দিন, অর্জুন, যদি আসে, তাহলে আমাদের একে অপরকে আরও ভালোভাবে জানার জন্য সব বাধা কাটিয়ে যেতে হবে। নদী শুধু জল নয়, স্রোতও—এবং সেই স্রোতে বয়ে চলে আমাদের ভালোবাসা।”
এভাবে, তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে এক নতুন রূপ নিচ্ছিল। তারা যা ছিল, তা হয়ে থাকলেও, তাদের মধ্যে এক গভীরতা ছিল যা সীমান্ত, নদী, কাঁটাতার—সবকিছুকে ছাপিয়ে চলছিল।
পর্ব ৭: সীমান্তের ওপারে
নদী তার স্রোত পরিবর্তন করছে, কিন্তু তার গতি যেন কখনো থামবে না। রিনা আর অর্জুন দুজনেই জানত, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের সম্পর্ক, তাদের ভালোবাসা, ঠিক তেমনই থেমে থাকবে—এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, যে নদী তাদেরকে একসঙ্গে এনেছিল, সেখানেই তারা এখনও দাঁড়িয়ে ছিল।
আজকের সন্ধ্যায়, রিনা আর অর্জুন নদীর পাড়ে বসে আছেন। আজকের আকাশটা অন্য রকম, গা dark ় নীল হয়ে উঠেছে, তবে সেখানে ছিল কিছু বিশেষ ঝলক, যা তাদের মাঝে এক নতুন আলো ঢেলে দিয়েছে। রিনা কিছুটা বিভ্রান্ত চোখে নদীকে দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, আজ কোনো কিছু বদলে গেছে।
“অর্জুন,” রিনা প্রথম কথা বলে, “তুমি কখনো ভেবেছো, এই সীমান্ত যদি একদিন একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কেমন লাগবে?”
অর্জুন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হ্যাঁ, আমি অনেক ভাবি, রিনা। আমি জানি, নদী, সীমান্ত—এসবের মাঝে কিছু একটা রয়েছে। তবে, যদি একদিন সীমান্ত কেটে যায়, নদী যদি একে অপরকে মিলিয়ে দেয়, তবে কি আমরা আমাদের জায়গা পেয়ে যাবো?”
রিনা সেদিনের মতো বেশ চিন্তিত হয়ে গেল। “হয়তো, কিন্তু সীমান্ত তো শুধু শারীরিকভাবে নেই। কোথাও না কোথাও, ভেতরে, আমাদের মনে একটা দেয়াল আছে। সীমান্ত মুছে গেলে, সেই দেয়ালও উঠে যাবে কি?”
অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা আমি জানি না, রিনা। তবে, হয়তো একদিন এই নদী আমাদের ভালোবাসাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করানোর সুযোগ দেবে। আমি জানি, এই নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার—সবকিছু একে অপরকে আলাদা করলেও, সে একদিন আমাদের কাছে এনে দেবে।”
রিনা তন্ময় হয়ে তাকে দেখে। “তুমি কি মনে করো, অর্জুন, নদী আমাদের কাছ থেকে কিছু দিতে পারে? যদি সীমান্ত চলে যায়, নদী আমাদের ভালোবাসার স্রোতকে কিভাবে চালু করবে?”
অর্জুন তার মাথা নিচু করে কিছুটা সময় নিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “এটা যে শুধু নদীর কল্পনা নয়, এটা আমাদের অনুভূতির কথা। সীমান্ত থাকবে না, আর নদী আমাদের একে অপরকে সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। কিন্তু সে দিন আসবে কি না, কে জানে?”
রিনা মৃদু হাসল, “হ্যাঁ, একদিন হয়তো, কিন্তু এখন যা আছে, সেটাকেই ভালোবাসি। সীমান্ত তো কেবল সেই স্রোত নয়, যা আমাদের পাশে থাকছে।”
অর্জুন একটু বুঝতে পারল, “তুমি ঠিক বলছো। এই সীমান্ত, নদী—এসবের মাঝে যেসব কথাও বলা যায় না, সেগুলো ঠিক একইভাবে মনের মধ্যে বাঁধা হয়ে আছে। তবে, একদিন, হয়তো আমরা সব কিছু বুঝতে পারব।”
রিনা কিছু সময় চুপ থেকে বলল, “তবে যদি একদিন আমাদের এই নদী ধরে অন্য কোথাও নিয়ে যায়, যদি একদিন নদী আমাদের এক করে দেয়, তবে আমি জানি, সেখানে কোনো সীমান্ত থাকবে না। যে নদী আমাদের আলাদা করে রেখেছে, সে নদী একদিন আমাদের ভালোবাসাকে এক করবে।”
অর্জুন সেদিন একটু গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি, রিনা। সীমান্ত, নদী, সবকিছু একসময় অদৃশ্য হয়ে যাবে, এবং আমরা একে অপরকে পুরোপুরি বুঝতে পারব। কিন্তু সে দিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
রিনা এক চুপচাপ নিঃশ্বাস নিল, তারপর বলল, “এটা সত্যিই অদ্ভুত, অর্জুন। নদী যেভাবে আমাদের মাঝে বাধা সৃষ্টি করেছে, তেমনই স্রোতের মতো একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে—যে সম্পর্ক বাচ্চাদের মতো নিরীহ, কিন্তু সে সম্পর্কের মধ্যে অনেক শক্তি।”
অর্জুন তার কথাগুলো শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তবে, সীমান্তের ওপারে, নদী সবকিছু ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আমাদের ভালোবাসা সে দিনকে ছুঁতে দেবে।”
রিনা মনে মনে জানতো, একদিন নদী তাদেরকে সেই সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাবে—যেখানে কিছু বাধা, কিছু কাঁটাতার আর থাকবে না। তবে সে দিন আসতে সময় লাগবে, অনেক সময়। তাদের সম্পর্ক, যে নদীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল, সে নদী একদিন তাদের ভালোবাসার স্রোতকে বহন করবে।
তারা একে অপরকে চুপচাপ দেখতে লাগল। নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার—সব কিছুই তাদের সম্পর্কের অংশ হয়ে উঠেছিল। এই সম্পর্ক ছিল চুপচাপ, নিরব, কিন্তু গভীর। আজ তারা জানতো, তাদের ভালোবাসা নদীর মতো প্রবাহিত হচ্ছে—এবং একদিন, সীমান্ত ছুঁতে গেলে, তারা একে অপরকে সেখানে পাবেই।
পর্ব ৮: এক নতুন সেতু
রিনা আর অর্জুনের সম্পর্ক আজ এক অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছেছে। নদী তাদের মাঝের দূরত্বগুলোকে ছোট করেছে, কিন্তু সীমান্ত—যা ছিল তাদের জীবনের এক বড় অংশ—তাকে দূরে সরাতে কেউ সক্ষম হয়নি। তবে, কিছু অনুভূতি ছিল, যা একে অপরের চোখে, নীরব ভাষায় বলা সম্ভব হয়ে উঠেছিল। এই শেষ দিনেও, যখন তারা নদীর পাড়ে বসে, সেই সীমান্ত, সেই কাঁটাতার, সবকিছুই যেন এক আশ্চর্য সেতু হয়ে উঠেছিল।
আজকের সন্ধ্যা একেবারে আলাদা ছিল। আকাশ ছিল অন্ধকার, কিন্তু নদীর জল যেন স্নিগ্ধভাবে টলমল করছিল। হালকা বাতাস নদীর ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছিল। রিনা আর অর্জুন দুজনেই একে অপরকে চুপচাপ দেখছিল। আজ, তারা শুধু একে অপরের পাশে বসে ছিল, কোনো কথা না বলে।
অর্জুন প্রথমে তার মুখ খুলল, “রিনা, আমি আজকের সন্ধ্যায় কিছু ভাবছিলাম। তুমি জানো, নদী আমাদের একে অপরকে কত কিছু শিখিয়েছে, কত কিছু বোঝাতে সাহায্য করেছে। তবে, আমি জানি, সীমান্ত, নদী, কাঁটাতার—এসব আমাদের কখনো পুরোপুরি একে অপরের কাছে নিয়ে আসবে না।”
রিনা তার চোখে একটা আর্দ্রতা নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, অর্জুন, কিন্তু তুমি জানো, নদী আমাদের সেই সেতু তৈরি করেছে, যেটা কখনোই টুটবে না। যে সীমান্ত আমাদের সম্পর্ককে আটকে রেখেছিল, সেই সীমান্ত একদিন ভেঙে যাবে—কিন্তু আমরা তার অপেক্ষা করছি, নীরবে।”
অর্জুন মাথা নেড়ে বলল, “তবে আমি জানি, রিনা। এই সীমান্ত, এই নদী—সব কিছু যেন আমাদের ভালোবাসাকে সঠিক সময়ে নিয়ে যাবে। হয়তো একদিন আমরা একে অপরকে ছুঁতে পারব, যেখানে সীমান্ত থাকবে না।”
রিনা একটু হাসল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ছিল এক ধরনের হতাশা। “এটা সত্যিই অদ্ভুত, অর্জুন। আমরা দুজনেই জানি, আমাদের সম্পর্ক কী, কিন্তু কীভাবে এই সম্পর্কটি সঠিক পথে এগোবে, সেটা জানি না। এই সীমান্ত, এই নদী—সবকিছু কখনোই আমাদের একে অপরের কাছে পৌঁছানোর পথে বাঁধা হয়ে থাকবে।”
অর্জুন একটু থেমে গিয়ে বলল, “তবে, রিনা, একদিন, আমাদের মধ্যে যা কিছু আছে—ভালোবাসা, অনুভূতি—সব কিছু এক জায়গায় এসে মিলিত হবে। নদী সেই সেতু তৈরি করবে, যেটি সীমান্তের ওপারে আমাদের ভালোবাসা পৌঁছে দেবে।”
রিনা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা আমি জানি, অর্জুন। কিন্তু, কখনো কখনো, আমরা যে বাঁধাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছি, তা আমাদের মাঝে চিরকাল থাকবে। নদী আর সীমান্তের মাঝে দাঁড়িয়ে, আমরা হয়তো কিছু একটা খুঁজে পাবো। কিন্তু কোথাও না কোথাও, আমাদের কাছে এমন কিছু ছিল যা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।”
অর্জুন চুপ হয়ে গেল। সে জানত, রিনার কথাগুলো ঠিক। তবে, তার চোখে ছিল সেই অদম্য আশা, যা তাদের সম্পর্কের অদৃশ্য সেতু তৈরি করেছে। সীমান্ত, নদী, কাঁটাতার—এসব কিছু একদিন তাদের ভালোবাসার পথে বাধা হতে পারবে না। তারা একে অপরকে জানে, ভালোবাসে—এবং সেটা ছিল তাদের সঠিক পথ।
“রিনা,” অর্জুন বলল, “আমি জানি, একদিন, এই নদী আমাদের এক করে দেবে। তবে, ওই দিন পর্যন্ত, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের সম্পর্ক সীমান্তের ওপারে পৌঁছবে—তবে তার জন্য কিছু সময় লাগবে।”
রিনা সজাগ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, অর্জুন, আমরা জানি, একদিন আমাদের সম্পর্ক এই সীমান্তকে পেরিয়ে চলে যাবে। তবে, এখন যে যা আছে, তা নিয়েই আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।”
অর্জুন রিনার হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। “এই নদী, এই সীমান্ত—সব কিছু দিয়ে আমরা একে অপরকে বুঝতে পারছি। একদিন, হয়তো নদী আমাদের এক জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে সীমান্ত থাকবে না, আর আমরা একে অপরকে পুরোপুরি অনুভব করতে পারবো।”
রিনা তার হাতের ওপর হাত রেখে বলল, “তবে, অর্জুন, একদিন, এই নদী আমাদের ভালোবাসার স্রোত নিয়ে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবে। হয়তো, একদিন, সীমান্ত ভেঙে যাবে, এবং আমরা একে অপরকে শুধু ভালোবাসা দিয়ে চিহ্নিত করব।”
নদী তখনো বয়ে চলছিল, তবে তার স্রোত যেন তাদের দুজনের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করছিল—যে সেতু একে অপরকে ছুঁয়ে দিতে পারবে। সীমান্ত, নদী—এসব কিছু তাদের সম্পর্কের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের হৃদয়ের ভাষা।
আজ, নদী তাদের ভালোবাসার পথ দেখিয়ে যাচ্ছে, আর সেই পথে তারা একে অপরকে পূর্ণভাবে অনুভব করছে।
পর্ব ৯: নদী ও ভালোবাসার অমলিন স্রোত
এখন রাত গভীর হয়ে এসেছে, কিন্তু নদীর পাড়ে অদ্ভুত এক নীরবতা বিরাজ করছে। রিনা আর অর্জুন এখন আর কেবল কথা বলছে না; তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে, চুপচাপ একে অপরকে অনুভব করছে। নদী তাদের মাঝে কথা বলছে, কিন্তু সেই কথা কোনো শব্দে ছিল না। নদীর স্রোত যেন তাদের অনুভূতির কথা বলছিল—যে অনুভূতি ভাষার চেয়ে অনেক গভীর।
আজকের সন্ধ্যায় কিছু একটা পরিবর্তন এসেছে। সীমান্ত, নদী, কাঁটাতার—এসব কিছুই আজ তাদের ভালোবাসাকে বাঁধতে পারছে না। একে অপরকে চেনার, ভালোবাসার, অনুভব করার যে পথ ছিল, তা যেন এখন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
রিনা প্রথমে কথা বলে, “অর্জুন, জানো, আজকের রাতে আমার মনে হয়, নদী, সীমান্ত, সব কিছু এখন আমাদের কাছে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা একে অপরকে চুপচাপ অনুভব করতে পারছি। মনে হচ্ছে, এই নদী আমাদের কাছে এমন কিছু দিয়েছে, যা ভাষায় বলা সম্ভব নয়।”
অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে, “হ্যাঁ, রিনা। নদী আমাদের এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। সীমান্ত, কাঁটাতার—এই সব কিছুই আমরা ছাপিয়ে গেছি। আজ আমরা একে অপরকে বুঝতে পারছি, আমাদের ভালোবাসা এখন সব সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে গিয়েছে।”
রিনা চোখ বন্ধ করে, কিছু সময় চুপ থাকে। তারপর আবার বলল, “তবে, অর্জুন, একদিন, এই নদী আমাদের স্রোত নিয়ে আমাদের ভালোবাসাকে এক জায়গায় পৌঁছাবে, যেখানে সীমান্ত থাকবে না। তখন আমরা একে অপরকে এমনভাবে অনুভব করব, যেন সারা পৃথিবী এক হয়ে গেছে।”
অর্জুন নীরব থেকে কিছু সময় পর বলল, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। একদিন, এই নদী আমাদের একে অপরকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। তখন সীমান্ত কিছুই হবে না, কাঁটাতার কিছুই হবে না।”
রিনা সেদিন স্রোতের দিকে তাকিয়ে বলল, “তবে, জানো, অর্জুন, এই নদী আমাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করেছে। আমরা সীমান্তের ওপারে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু ঠিক কোন পথে যাবো, তা জানি না। তবে, এই নদী আমাদের কখনো হারাবে না।”
অর্জুন তার হাত রিনার হাতে রেখে বলল, “এই নদী যে কোনো কিছু থেকে আমাদের সম্পর্ককে এক স্রোতে বয়ে নিয়ে যাবে, সেটা আমি জানি। একদিন, সীমান্ত, কাঁটাতার, সব কিছু ভেঙে যাবে।”
রিনা গম্ভীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তবে, অর্জুন, সেই দিন আসার আগ পর্যন্ত, আমরা জানি, আমাদের ভালোবাসা কেবল সীমান্তের মধ্যে বন্দী থাকবে না। নদী, সীমান্ত, কাঁটাতার—এই সব কিছু ছড়িয়ে আমাদের সম্পর্ক এক নতুন স্রোত ধরবে।”
অর্জুন এক মুহূর্ত চুপ করে, তারপর বলল, “তুমি জানো, রিনা, আমি বিশ্বাস করি, একদিন, এই নদী আমাদের এক সঙ্গে নিয়ে যাবে, যেখানে সীমান্ত কিছুই হবে না। আমাদের অনুভূতি, আমাদের ভালোবাসা সবকিছু ভেদ করে এক হয়ে যাবে।”
রিনা নীরব হয়ে বসে ছিল। তার চোখের কোণে এক অদ্ভুত মৃদু হাসি ছিল, যেন সেই ভালোবাসার গোপন স্রোত একদিন তাদের সমস্ত সীমান্ত ভেঙে নতুন জীবনের পথে নিয়ে যাবে।
আজ তাদের সম্পর্ক, নদী, সীমান্ত—সব কিছু যেন এক নতুন দিকে গড়াচ্ছে। এক অদৃশ্য শক্তি তাদের মাঝে এক সংযোগ তৈরি করেছে। সীমান্ত যতই শক্তিশালী হোক, নদী তাকে ভেঙে ফেলে তাদের কাছে এনে দেবে। তাদের ভালোবাসা, যে নদীর মতো একে অপরকে বয়ে নিয়ে চলেছে, একদিন সীমান্তের ওপারে পৌঁছাবে, যেখানে কোনো বাধা থাকবে না।
নদী তাদের মধ্যে কথা বলছিল, কিন্তু সে কথা কখনোই উচ্চারিত হয়নি। তারা একে অপরকে ভালোবাসে, একে অপরকে অনুভব করে—এবং তাদের ভালোবাসা অমলিন স্রোতের মতো চলে যাবে, যেখানেই হোক না কেন।
পর্ব ১০: নদীর ওপারে এক নতুন জীবন
নদী বয়ে চলেছে, যেন সময়ের সঙ্গে এক অসম্ভব মিল রেখে। এটি সেই নদী, যা রিনা আর অর্জুনকে একে অপরের থেকে দূরে রেখেছিল, কিন্তু একই নদী তাদের একে অপরের কাছে নিয়ে আসছে। সীমান্ত ছিল, কাঁটাতার ছিল—কিন্তু তারা একে অপরকে অনুভব করছিল, যেমন নদী তার জলকে অনুভব করে। কিছু অনুভূতি শুধু নিরবতায় থাকে, কিছু কথা মনের গভীরে লুকিয়ে থাকে, তবে সেই অনুভূতিগুলো কখনো হারিয়ে যায় না।
আজকের রাত একটু আলাদা ছিল। আকাশে সূর্যের আলো একেবারে নিভে গেছে, কিন্তু নদী এখনও স্নিগ্ধভাবে টলমল করছে। নদী পাড়ে বসে, রিনা আর অর্জুন একে অপরকে দেখছিল, কিন্তু আজ তাদের মধ্যে কোনো বিরতি ছিল না, কোনো সীমান্ত ছিল না—শুধু এক গভীর অনুভূতি যা তারা একে অপরকে দিল।
“অর্জুন,” রিনা তার গলা একটু শুকিয়ে গিয়ে বলল, “আমাদের সম্পর্ক আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে জানি না। তবে, যখন আমি এই নদীকে দেখি, তখন মনে হয়, এই নদী আমাদের ভালোবাসা নিয়ে এক নতুন দিকে নিয়ে যাবে।”
অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, রিনা। আমি জানি, সীমান্ত, নদী, কাঁটাতার—এগুলো আমাদের ভালোবাসার পথে একসময় বাধা ছিল। কিন্তু এখন, আমি মনে করি, এই নদী আমাদের একে অপরের কাছে নিয়ে আসছে। একদিন, সীমান্তের কোনো মূল্য থাকবে না। তখন আমাদের ভালোবাসা, আমাদের সম্পর্ক এক স্রোতের মতো চলে যাবে।”
রিনা কিছু সময় চুপ হয়ে গেল। তারপর, গভীর এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “তবে অর্জুন, এই নদী যে কেবল আমাদের একসাথে নিয়ে আসবে, তা আমি জানি। কিন্তু এই নদী, সীমান্তের ওপারে যে নতুন পথ তৈরি করবে, তার দিকে এগোতে আমাদের সময় লাগবে। সীমান্ত তো স্রোতের মতো সহজে ভেঙে যায় না।”
অর্জুন নীরব হয়ে কিছুক্ষণ নদীকে দেখল, তারপর বলল, “তবে রিনা, আমরা জানি, যে সীমান্ত আমাদের একে অপর থেকে দূরে রেখেছে, তার চেয়ে বড় কিছু আমাদের মধ্যে রয়েছে। আমাদের অনুভূতি, আমাদের ভালোবাসা—এগুলো কোনো সীমান্তে আটকে থাকে না। এটা সত্যি যে নদী, সীমান্ত আমাদের মাঝে ছিল, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কখনো একে অপরের থেকে দূরে যায়নি।”
রিনা তার চোখে এক মৃদু হাসি নিয়ে বলল, “তুমি ঠিক বলেছো, অর্জুন। হয়তো নদী আমাদের সেই স্রোত দিয়েছে, যেটি আমাদের একে অপরকে একভাবে দেখার সুযোগ দিয়েছে। তবে, এখনো আমাদের অনেক কিছু শিখতে হবে, অনেক কিছু অনুভব করতে হবে।”
অর্জুন তার হাতের ওপর রিনার হাত রাখল। “তুমি জানো, রিনা, আজ আমরা এখানে আছি, নদী আমাদের এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। সীমান্ত হয়তো আমাদের মাঝে কিছু সময়ের জন্য ছিল, কিন্তু আজ আমরা বুঝতে পারছি—এই নদী আমাদের ভালোবাসাকে স্রোতের মতো নিয়ে যাবে, যেখানে কোনো বাধা থাকবে না।”
রিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, নদীকে গভীরভাবে দেখল। তারপর, এক বিরতি নিয়ে বলল, “তবে, অর্জুন, একদিন হয়তো আমরা এই নদী পার হয়ে এক নতুন জায়গায় পৌঁছাবো। সীমান্ত, নদী সব কিছু ভুলে গিয়ে, আমরা আমাদের সাথী হয়ে থাকব।”
অর্জুন এক মুহূর্তের জন্য কিছুটা হতাশ হয়ে বলল, “আমি জানি, রিনা। তবে, সীমান্তের ওপারে, নদী আমাদের ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে, তা জানি না। হয়তো একদিন, আমাদের এই ভালোবাসা অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু সেই দিনটা আসতে অনেক সময় লাগবে।”
রিনা তার দিকে তাকিয়ে, একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ, অর্জুন, সেই দিন আসবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকতে হবে, আমাদের ভালোবাসার মতো স্রোতের মতো বয়ে চলতে হবে। নদী একদিন আমাদের সেই পথ দেখাবে, যেখানে সীমান্ত, কাঁটাতার কিছুই থাকবে না। আমাদের সম্পর্ক, আমাদের ভালোবাসা স্রোতের মতো এক হয়ে যাবে।”
অর্জুন রিনার চোখে তাকিয়ে, তার হাতে হাত রেখে বলল, “আমি জানি, রিনা। আমরা হয়তো এখনও সীমান্তে আটকে আছি, কিন্তু আমাদের ভালোবাসা স্রোতের মতো চলে যাবে। একদিন, আমাদের সম্পর্কের কোনো বাধা থাকবে না। সীমান্ত ভেঙে, আমরা একে অপরকে এক জায়গায় পাবো, যেখানে শুধুই ভালোবাসা থাকবে।”
রিনা তার চোখ বন্ধ করে বলল, “এটি সত্যি, অর্জুন। নদী আমাদের স্রোত নিয়ে যাবে। একদিন, সীমান্তের ওপারে, আমরা একসাথে থাকবো। তখন, নদী আমাদের ভালোবাসাকে পূর্ণ করবে, স্রোতের মতো বহমান করে দিয়ে।”
নদী তখনও বয়ে চলছিল, কিন্তু আজ সে যেন তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। সীমান্ত ছিল, কাঁটাতার ছিল, কিন্তু নদী জানত, একদিন তারা একে অপরকে ছুঁয়ে ফেলবে। তাদের ভালোবাসা, নদীর স্রোত হবে, যে স্রোত একে অপরকে সম্পূর্ণ করবে, একত্রিত করবে, এবং এই নদী তাদের সঙ্গী হবে।
নদী বয়ে চলল, আর রিনা আর অর্জুন তাদের ভালোবাসাকে এক নতুন পথ দেখিয়ে চলে গেল—এক স্রোতের মতো, সীমান্তের ওপারে।