Bangla - প্রেমের গল্প

নক্ষত্রবাড়ি

Spread the love

ইরা বন্দ্যোপাধ্যায়


পর্ব প্রথম আলাপ

কলকাতার শরৎকাল। পুজোর ভিড়, আলোয় মোড়া রাস্তা, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে উলুধ্বনি আর ঢাকের তালে কেঁপে উঠছে শহর। অভ্রর মাথাটা অদ্ভুতভাবে ভারী লাগছিল। সে এক নামী বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। সারা বছর ধরে ক্লায়েন্টের চাপ, ডেডলাইনের ঝড়, কনসেপ্ট নিয়ে মিটিং আর টেনশনে ভরা রাতজাগা তার জীবনের রুটিন হয়ে উঠেছে। তবুও দুর্গাপুজো এলে কেমন এক ধরণের হাওয়ার পরিবর্তন হয়—শহর যেন অদৃশ্য আনন্দে ভেসে ওঠে।

সেদিন ছিল ষষ্ঠীর সন্ধ্যা। অভ্র অফিস থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুর টানে গেল ঢাকুরিয়ার কাছে এক বনেদি পরিবারের বারোয়ারি পুজো দেখতে। আলো, আলপনা, মণ্ডপে ঢোকার গেট—সবকিছুই যেন চমকপ্রদ। অথচ অভ্রর মন খারাপ। কানে বাজছিল মোবাইল ফোনের রিংটোন—ক্লায়েন্টের নতুন নির্দেশ। তার মনে হচ্ছিল, এই আনন্দ-হইচই তার জন্য নয়।

তখনই ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ল মেয়েটিকে। সাদা শাড়ি, লাল পাড়, খোলা চুলে হালকা বাতাসের নড়াচড়া। হাতে একটা ছোট্ট খাতা, যেখানে সে আঁকছে। প্রথমে অভ্র ভেবেছিল, হয়তো কোনো সাংবাদিক বা শিল্পকলার ছাত্রী। কিন্তু কাছে যেতেই সে শুনল মেয়েটি নিচু গলায় গাইছে—“একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ…”। আশেপাশের লোকজন হাসিমুখে তাকাচ্ছিল, কিন্তু মেয়েটি যেন নিজস্ব জগতে ডুবে আছে।

অভ্র দাঁড়িয়ে গেল। তার ভিতরে কোথাও যেন এক অচেনা টান অনুভব হলো। সে কোনোদিন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রেমিক ছিল না—বরং স্কুলজীবনে এসব গানকে বিরক্তিকর মনে করত। কিন্তু মেয়েটির গলার স্বরে যেন অদ্ভুত শান্তি।

“মাফ করবেন,” অভ্র হঠাৎই বলে উঠল, যখন মেয়েটির চোখ তার সঙ্গে মিশল, “আপনি কি আঁকছেন?”

মেয়েটি একটু চমকে তাকাল। চোখে সরলতা, ঠোঁটে হালকা হাসি।
“মণ্ডপটা। কিন্তু আলো-আঁধারে আঁকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”

অভ্র এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। এত সরল উত্তরে যেন তার শহুরে অভ্যাস ভেঙে গেল। সে বলল,
“আপনি কি আর্ট কলেজে পড়েন?”

“না, আমি শান্তিনিকেতন থেকে এসেছি। গান শিখি, আঁকতেও ভালোবাসি। আমার নাম ঈশা।”

অভ্র প্রথমবার হাসল। তার মনে হলো, নামটার মধ্যেই এক অদ্ভুত নরম শব্দ আছে, যেন শরতের হাওয়া।
“আমি অভ্র। বিজ্ঞাপনের কাজে আছি।”

ঈশা মাথা নেড়ে জানাল, “ওই কাজটা কঠিন বটে। আমি একবার ঢাকুরিয়ার এক বিজ্ঞাপন সংস্থায় গিয়েছিলাম—সবাই কত ব্যস্ত, কত চেঁচামেচি। আমার একদম ভালো লাগেনি।”

অভ্র হেসে ফেলল। সে বুঝল, মেয়েটির জগৎ আর তার জগৎ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একদিকে বাজার, প্রতিযোগিতা, টার্গেট—অন্যদিকে গান, ছবি, প্রকৃতি।

তবুও কথোপকথন থামল না। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজন মণ্ডপ থেকে বেরোল। আলো ঝলমলে রাস্তায় একসাথে দাঁড়িয়ে দুজনেই একটু নীরব হয়ে গেল।

“আপনি কলকাতায় কতদিন?” অভ্র জিজ্ঞেস করল।
“দশমী পর্যন্ত থাকব। তারপর আবার শান্তিনিকেতনে ফিরব। পুজোর সময় আমি এখানে আসি, কাকার বাড়িতে উঠি।”

অভ্র মনে মনে হিসেব কষল—মানে হাতে আছে মাত্র কয়েকটা দিন। অদ্ভুতভাবে তার ইচ্ছে হলো ঈশার সঙ্গে আরও সময় কাটানোর।

ঈশা হঠাৎ বলল,
“আপনার চোখে ক্লান্তি আছে। সারাক্ষণ কি কাজ নিয়েই ভাবেন?”

অভ্র চমকে গেল। কেউ কোনোদিন এভাবে তাকে বলেনি।
“হয়তো তাই। কাজ ছাড়া অন্যকিছু ভাবার সময়ই পাই না।”

ঈশা খাতাটা বন্ধ করে বলল,
“তাহলে এবার অন্যকিছু ভাবুন। আজ অন্তত। দেখুন, আকাশে কেমন নক্ষত্র জ্বলছে।”

অভ্র তাকাল রাতের আকাশের দিকে। মণ্ডপের আলো থেকে দূরে সরে আসতেই সত্যিই দেখা গেল—শহরের কোলাহলের আড়ালে ছোট ছোট তারারা জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হলো, দীর্ঘদিন পরে যেন শ্বাস নিচ্ছে।

সেদিনই অভ্র বুঝতে পারল—এই মেয়েটি আলাদা। তার জীবনের যান্ত্রিকতা ভেঙে অন্য এক জগতের দরজা খুলে দিয়েছে। অথচ সে নিশ্চিত নয়, এই জগত তার নাগালের ভেতর আছে কি না।

কোলাহলের মাঝে তাদের দুজনের চোখ আবার একবার মিলল। ঈশা হেসে বলল,
“আগামীকাল আবার আসবেন তো?”

অভ্র এক মুহূর্ত দেরি না করে মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।

এভাবেই শুরু হলো এক অদ্ভুত গল্প—যেখানে শহুরে অভ্র আর শান্তিনিকেতনের ঈশা প্রথমবার বুঝতে পারল, দুই ভিন্ন জগতের মধ্যে টানাপোড়েনের মাঝেও প্রেমের অদৃশ্য সেতু গড়ে ওঠে।

পর্ব শহর বনাম গ্রাম

শহর আর গ্রাম—এই দুই জগতের ফারাক যেন সেই ষষ্ঠীর রাতের মণ্ডপেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অভ্রর ভেতরে কোথাও একটা কৌতূহল জন্মেছিল ঈশাকে নিয়ে। শহুরে জীবনের টানা-হেঁচড়ার মধ্যে হঠাৎ যে শান্তিনিকেতনের বাতাস এসে ঢুকেছে, সেটা সে উপেক্ষা করতে পারল না। আর ঈশার চোখে-মুখে এমন এক ধরনের নির্ভারতা ছিল, যা অভ্র বহুদিন দেখেনি।

সকালে অভ্র ঘুম থেকে উঠেই অফিসের মেইল খুলল। ক্লায়েন্টের আবার নতুন দাবি—বিজ্ঞাপনের স্লোগান পাল্টাতে হবে, ভিজুয়াল কনসেপ্টে আরও রঙ চাই। অভ্রর মাথায় রক্ত চড়ল। মনে হলো, এ শহরের সব মানুষ যেন শুধু চাই, চাই, চাই—কিন্তু দেওয়ার মতো কিছু নেই। অথচ গতরাতের ঈশার হাসিটা হঠাৎ মনে পড়তেই মাথার ভেতরের রাগ একটু কমে এল।

দুপুরে অভ্র ফোন পেল বন্ধুর কাছ থেকে—“আজ সপ্তমী, চল আবার বেরোই।”
অভ্র অনেক ভেবে রাজি হলো। মনে মনে জানত, সে শুধু পুজোর ভিড় দেখতে যাচ্ছে না, ঈশাকে আবার দেখার টানেই বেরোচ্ছে।

সন্ধ্যার পর আবার মণ্ডপে গিয়ে সে দেখল ঈশা এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। এবার তার হাতে কোনো খাতা নেই, বরং সে ছোটদের সঙ্গে ঢাকের তালে তাল মেলাচ্ছে। মুখে সেই চিরচেনা হাসি। অভ্র এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আজ আঁকছেন না?”

ঈশা ঘুরে তাকাল। “আজ নয়। আজ শুধু গান আর নাচ দেখতে ইচ্ছে করল। আপনার অফিস কেমন চলছে?”

অভ্র একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “চলছে, তবে মনে হয় সবকিছু এক যান্ত্রিক খাঁচার ভেতরে। ঘড়ি, ডেডলাইন, ক্লায়েন্টের চাহিদা—সব মিলিয়ে যেন নিজের মতো বাঁচার সময়টাই নেই।”

ঈশা একটু থেমে বলল, “তাহলে নিজের জন্য সময় বার করেন না কেন? শান্তিনিকেতনে আসুন একদিন। দেখবেন, আকাশের রঙ আলাদা, বাতাসে অন্য গান।”

অভ্র হেসে ফেলল। “শান্তিনিকেতন মানে আমার কাছে ছুটি কাটানোর জায়গা। কিন্তু আপনি বলছেন, ওটা আপনার জীবনেরই একটা অংশ।”

“হ্যাঁ,” ঈশা মাথা নেড়ে বলল। “ওখানে সময়ের গতি অন্যরকম। আমরা প্রতিদিন ভোরে উঠি, গাছের পাতার ভেতর দিয়ে আলো ঢোকে, পাখির ডাক শোনা যায়, আর দুপুরে গান বা নাটকের মহড়া হয়। সবাই একসাথে বসে খাই, গল্প করি। আপনার শহুরে অফিসের মতো দৌড়ঝাঁপ নেই।”

অভ্রর মনে হলো, কথাগুলো শুনতে যেন অবাস্তব। অথচ মেয়েটির চোখে এত সত্যি আলো যে সেটা মিথ্যে মনে হয় না।

তারা দুজনেই তখন রাস্তার পাশে একটা ছোট কফির দোকানে বসল। দোকানের মালিক গরম চা আর জিলিপি এনে দিল। চারপাশে পুজোর ভিড়, আলো, উলুধ্বনি। অভ্র এক কাপ চা হাতে নিয়ে হঠাৎ বলল,
“আপনি কি কখনো ভেবেছেন, শহরে থাকলে কেমন হতো?”

ঈশা হাসল। “ভেবেছি। কিন্তু মনে হয়েছে আমি হয়তো মানিয়ে নিতে পারতাম না। এখানে সবাই সবসময় দৌড়োচ্ছে। আপনাদের চোখে যেন একটা ক্লান্তি থাকে, আর মুখে ব্যস্ততার ছাপ। আমাদের শান্তিনিকেতনে জীবন অনেক ধীর। সেখানে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটা সহজ।”

অভ্র একটু অবাক হলো। সত্যিই, এ শহরে মানুষ যেন একে অপরকে এড়িয়ে চলে। ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, ভিড়ের মেট্রো, অফিসের কোলাহল—সবকিছুই কেমন যান্ত্রিক।

সে বলল, “তাহলে কি আপনার মনে হয়, শহরের মানুষদের ভালোবাসা কম?”

ঈশা হালকা হেসে উত্তর দিল, “না, ভালোবাসা সবাই দেয়। শুধু এখানে প্রকাশের সুযোগ কম। আপনারাও ভালোবাসেন, কিন্তু সময় পান না। অথচ ভালোবাসা মানে তো সময় দেওয়া, মন দেওয়া। তাই না?”

অভ্র নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিল। এত সরল কথায় এত বড় সত্যি—এটা সে আগে কখনো ভাবেনি।

চা শেষ হওয়ার পর তারা দুজন আবার আলো ঝলমলে পথে হাঁটতে লাগল। ভিড়ের মাঝখানে ঈশা হঠাৎ থেমে বলল,
“দেখুন, ওই যে শিউলি গাছটা। ছোটবেলায় ভোরে উঠেই আমি শিউলি কুড়োতাম। এখনো ওই গন্ধ পেলেই মনে হয় পুজো এসে গেছে।”

অভ্র গাছটার দিকে তাকাল। ভিড়, আলো, শহরের শব্দের মাঝেও শিউলির গন্ধ যেন এক মুহূর্তে তাকে অন্য কোথাও নিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, শহরের কংক্রিটের ভেতরেও যদি কেউ খুঁজে নিতে জানে, তবে প্রকৃতি তার উপস্থিতি জানান দেয়।

ঈশা আবার বলল, “আপনারা শহুরে মানুষরা হয়তো এসব খেয়ালই করেন না।”

অভ্র চুপ করে রইল। কারণ মেয়েটি সত্যি বলছে। সে নিজের জীবনটা একেবারে অন্যভাবে দেখে ফেলল—একটা দৌড়ের মধ্যে, যেখানে প্রকৃতি, গান, কবিতা, এমনকি ভালোবাসার জন্যও জায়গা নেই।

কিন্তু ঈশার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত শান্তি, যেন ওর ভেতরেই উত্তর লুকিয়ে আছে।

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে অভ্রর ঘুম এল না। ঈশার কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল—“ভালোবাসা মানে সময় দেওয়া, মন দেওয়া।” তার মনে হলো, শহুরে জীবনের ভিড়ের ভেতর হয়তো সে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে, যা ঈশা সহজেই ধরে রেখেছে।

পর্ব অদ্ভুত টান

অভ্র ভেবেছিল এটা হয়তো কেবল সাময়িক মুগ্ধতা। শহরের ভিড়, আলো, গান—এই সবকিছুর মধ্যে কোনো অচেনা মুখ তাকে আকৃষ্ট করেছে, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে টের পেল, তার মাথার ভেতর ঈশার হাসি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অফিসের মেইল চেক করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো, ঈশা ঠিকই বলেছিল—সে সময় দিতে জানে না, শুধু সময় খরচ করতে জানে।

সপ্তমীর দিনটা ছিল অভ্রর জন্য ভীষণ ব্যস্ত। ক্লায়েন্টের নতুন ক্যাম্পেইনের মিটিং, প্রেজেন্টেশনের খসড়া, আর ডিজাইনারদের সাথে ঝগড়া—সবকিছুর পর সন্ধ্যায় তার আর কোথাও যাওয়ার শক্তি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ যেন ভেতর থেকে একটা অদৃশ্য টান টেনে নিয়ে গেল তাকে আবার সেই বনেদি বাড়ির মণ্ডপের দিকে।

ঈশা তখন ঢাক বাজনার সুরে ছোটদের শেখাচ্ছিল, কীভাবে তাল মেলাতে হয়। তার চোখ-মুখে এমন এক আলোর ছটা ছিল, যেন বাইরে চারপাশের ভিড়কোলাহল স্পর্শই করতে পারছে না। অভ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, আর মনে হলো—এই মেয়েটির কাছে পৃথিবীটা অন্য রঙে আঁকা হয়।

“আজ এত দেরি?” ঈশা চোখাচোখি হতেই হেসে বলল।

অভ্র সামান্য লজ্জা পেল। “অফিসের কাজ ছেড়ে আসা যায় না। তবু এসেছি।”

ঈশা মাথা নেড়ে বলল, “আপনি চেষ্টা করেছেন, সেটাই যথেষ্ট।”

কথাটা এত সরল, অথচ এত গভীর—অভ্রর বুকের ভেতর যেন চাপা উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল।

সন্ধ্যার ভিড় একটু কমতেই তারা দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করল। শহরের আলো ঝলমলে রাস্তা, দোকান থেকে বাজতে থাকা পুজোর গান, উলুধ্বনির মাঝে হঠাৎ ঈশা বলল,

“আপনি জানেন, আমি ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাস করি—প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা অদৃশ্য আলো থাকে। কিন্তু শহরে এসে দেখি, সেই আলোটা ধীরে ধীরে নিভে যায়। আপনারও মনে হয় না, আপনি নিজের আলো হারিয়ে ফেলছেন?”

অভ্র থমকে গেল। কেউ তাকে এরকম কথা কোনোদিন বলেনি। তার ভেতরে যেন সত্যিই একটা ফাঁকা জায়গা আছে, যেটা কাজের চাপ ঢেকে রাখলেও আলো ফোটাতে পারে না।

সে উত্তর দিল, “হয়তো তাই। আমার মনে হয়, আমি শুধু অন্যের স্বপ্নের জন্য কাজ করে যাই। নিজের জন্য কিছু করার সময়ই নেই।”

ঈশা নরম গলায় বলল, “তাহলে এখন থেকে নিজের জন্য বাঁচতে শিখুন।”

অভ্র হেসে ফেলল। “আপনি ভাবছেন এত সহজ?”

ঈশা তাকাল তার চোখের দিকে। “সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও নয়।”

সেদিন রাতে ঈশার কাকা বাড়ির বারান্দায় বসে তারা গল্প করছিল। চারপাশে শিউলির গন্ধ, দূরে বাজছে ঢাকের সুর। ঈশা হঠাৎ খাতাটা বের করে দেখাল, সে কী কী এঁকেছে গত কয়েক দিনে। মণ্ডপ, আলো, ভিড়, আর অভ্রকে আঁকতে গিয়ে তার চোখের নিচের ক্লান্তির দাগও ধরা পড়েছে।

অভ্র অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমায় এঁকেছ?”

ঈশা হেসে মাথা নেড়ে বলল, “তোমাকে দেখেই মনে হলো—তোমার চোখে কাজের চাপ, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে আছে অন্যরকম রঙ। সেই রঙটাই ধরা দিতে চেয়েছি।”

অভ্র অনেকক্ষণ খাতার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হলো, ঈশা এমন কিছু দেখে ফেলছে যা সে নিজেই দেখতে পায়নি।

পরদিন সকালে অফিসে বসেও অভ্রর মাথায় শুধু ঈশার ছবি ঘুরছিল। কনফারেন্স রুমে প্রেজেন্টেশন চলার সময় ক্লায়েন্ট কিছু বলছিল, কিন্তু অভ্রর কানে যেন পৌঁছাচ্ছিল না। সে শুধু ভাবছিল—আজ সন্ধ্যায় দেখা হবে তো?

দিনের শেষে সে নিজেকে বোঝাতে চাইল—এটা অদ্ভুত। একজনকে মাত্র দুদিন হলো চেনে, অথচ তাকে না দেখলে বুকের ভেতর কেমন অস্থিরতা জন্মাচ্ছে। এ কি তবে শুধু কৌতূহল, নাকি অন্য কিছু?

অভ্র জানত না, এ কেবল শুরু।

পর্ব শান্তিনিকেতনে যাত্রা

অভ্রর অফিসে হঠাৎই একটা প্রোজেক্ট এল—একটি হ্যান্ডলুম শাড়ির ব্র্যান্ডের ক্যাম্পেইন। ক্লায়েন্ট চাইছিল শান্তিনিকেতন আর শিলাইদহের টেক্সটাইল হেরিটেজকে ব্যবহার করে ব্র্যান্ডিং তৈরি হোক। মিটিং টেবিলে বসেই অভ্রর মাথায় প্রথমেই ভেসে উঠল ঈশার মুখ। শান্তিনিকেতন—ওর দুনিয়া। ভেতরে ভেতরে যেন কাকতালীয়ভাবে দু’জগতের সেতু তৈরি হতে চলল।

সেদিন রাতেই অভ্র ঈশাকে ফোন করল। “আমাকে শান্তিনিকেতন যেতে হবে কয়েক দিনের মধ্যে। কাজের সূত্রে। তুমি কি থাকবা তখন ওখানে?”

ঈশার গলায় খুশির সুর। “অবশ্যই। এসো, আমি তোমাকে সব দেখাব। তুমি শুধু মণ্ডপের আলো দেখেছ, এবার আমার আসল জগৎ দেখবে।”

অভ্রর বুকের ভেতর হঠাৎ ধক করে উঠল। অজান্তেই মনে হলো, এ যাত্রা শুধু কাজের জন্য নয়—এ যেন তার নিজের এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশের যাত্রা।

ট্রেনে চেপে অভ্র যখন শান্তিনিকেতনে নামল, চারপাশের হাওয়া যেন তাকে ঘিরে ধরল। শহরের কোলাহল নেই, ট্রাফিক সিগনালের হর্ন নেই, বিলবোর্ডের ঝলকানি নেই। চারদিকে গাছপালা, লাল মাটির রাস্তা, সাইকেলে চড়ে চলা ছেলেমেয়েরা। দূর থেকে ভেসে আসছে কোনো গানের সুর।

স্টেশনে ঈশা দাঁড়িয়ে ছিল। সাদা কুর্তা, নীল ওড়না, হাতে কয়েকটি শিউলি ফুল। হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল, “স্বাগতম শান্তিনিকেতনে। এখন থেকে কিছু সময় তুমি আমার অতিথি।”

অভ্র হেসে মাথা নোয়াল। মনে হলো, এত সহজ ভাষায় কেউ তাকে স্বাগত জানায়নি অনেক দিন।

ঈশা তাকে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। ছোট্ট আঙিনা, আমগাছের ছায়া, দেয়ালে আলপনা। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, ঈশার বাবা রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত শুনছেন আর মা হাতে আলপনা আঁকছেন। অভ্র এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে গেল—এ যেন অন্য দুনিয়া।

ঈশার মা হেসে বললেন, “শহরের ছেলে না? কলকাতার লোকেরা তো এত কাজের মধ্যে ডুবে থাকে যে আমাদের শান্তির দুনিয়া তাদের কাছে অচেনা লাগে।”

অভ্র বিনীতভাবে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের শহরে এমন দৃশ্য পাওয়া যায় না। এখানে এসে মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে পারছি।”

বিকেলে ঈশা তাকে নিয়ে গেল বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে। পথের দুই পাশে শিমুল-সোনাঝুরির গাছ। কোথাও গানের মহড়া চলছে, কোথাও ছোটরা নাটকের রিহার্সাল করছে। অভ্র অবাক হয়ে চারপাশ দেখছিল।

“এখানে সবাই শিল্পের মধ্যে বাঁচে,” ঈশা বলল। “আমাদের জীবনে প্রতিযোগিতা নেই, আছে কেবল সৃজন। তুমি কি বুঝতে পারছো পার্থক্যটা?”

অভ্র মাথা নেড়ে বলল, “বুঝছি। শহরে আমরা শিল্পকে ব্যবহার করি বাজার ধরার জন্য। কিন্তু এখানে শিল্পই জীবন।”

ঈশা হেসে তাকাল। “তাহলে এবার তুমি বুঝবে, কেন আমি শহরের কোলাহলে মানিয়ে নিতে পারি না।”

সন্ধ্যার দিকে তারা গেল শান্তিনিকেতনের মাঠে, যেখানে গান চলছে। চারদিকে মাটির প্রদীপ জ্বলছে, বাতাসে শিউলির গন্ধ। ঈশা গলা ছেড়ে গান ধরল—“আমার সকল রসের ধারা তুমি মিশাও…”।

অভ্র যেন অন্য জগতে পৌঁছে গেল। তার মনে হলো, এতদিন সে শুধু বিজ্ঞাপন লিখেছে, শব্দ সাজিয়েছে, কিন্তু এই শব্দের ভেতরের প্রাণ কখনো বোঝেনি।

গান শেষে ঈশা বলল, “কেমন লাগল?”

অভ্র চুপ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “মনে হচ্ছে, আমি এতদিন বেঁচেই ছিলাম না। তুমি আমায় অন্য রঙে পৃথিবী দেখালে।”

ঈশার চোখে আলো ঝলমল করল। “তাহলে এবার তুমি বুঝেছো, শহরের বাইরে এক অন্য আকাশ আছে।”

সেদিন রাতে অভ্র একা বারান্দায় বসে ছিল। আকাশভরা নক্ষত্র, চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মনে হচ্ছিল, এই জায়গায় থেকে গেলে হয়তো সে নিজের ভেতরের আলোটা খুঁজে পাবে। কিন্তু সে জানত, কয়েকদিন পরই আবার তাকে ফিরতে হবে সেই শহুরে কোলাহলে।

তবুও তার মনে হলো—হয়তো এই কয়েকদিনই তার জীবনের সবচেয়ে সত্যি সময় হয়ে উঠবে।

 

পর্ব অভ্রর দ্বিধা

শান্তিনিকেতন তাকে এমনভাবে গ্রাস করেছিল যে অভ্র বুঝতেই পারছিল না কতটা বদলে গেছে সে এই কয়েকদিনে। সকালে ঘুম ভাঙত শালিক আর দোয়েলের ডাক শুনে, দুপুরে আঙিনার ছায়ায় বসে গল্প, বিকেলে গান আর ছবি আঁকার আসর। অফিসের কাজের জন্য যে প্রেজেন্টেশনের ছবি তুলতে এসেছিল, সেগুলো করতে করতে হঠাৎ মনে হচ্ছিল—এই কাজও যেন তার জীবনের চাপ নয়, আনন্দ হয়ে উঠছে।

কিন্তু আনন্দের মাঝেও দ্বিধা ঘিরে ধরছিল। বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকালে অভ্রর মনে হতো—এই আলো, এই নক্ষত্র, এই শান্ত পৃথিবী তার জন্য কি চিরকাল থাকবে? সে জানে, কয়েকদিন পরেই আবার ফিরতে হবে সেই কলকাতার ভিড়, ক্লায়েন্ট মিটিং, ডেডলাইনের আগুনে ঝলসানো জীবন। আর ঈশা? সে তো এই লাল মাটির পৃথিবীরই সন্তান।

একদিন বিকেলে ঈশা অভ্রকে নিয়ে গেল কোপাই নদীর ধারে। শীতল হাওয়া বইছিল, দূরে বালুচরে কয়েকজন ছেলে খেলছিল। নদীর জল ধীর গতিতে বয়ে যাচ্ছিল, আকাশের নীল রঙ মিশে যাচ্ছিল পানির ভাঁজে।

ঈশা বলল, “দেখছো? এখানে সময় যেন থেমে থাকে। এই নদী আমাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়—জীবন মানে শুধু দৌড় নয়, কখনো কখনো থেমেও থাকা।”

অভ্র নরম গলায় বলল, “তোমাদের এই জীবনটা স্বপ্নের মতো লাগে। কিন্তু আমি জানি, আমার জীবনটা অন্যরকম। আমি যদি একদিন এখানে থেকেও যাই, আমার অফিস, কাজ, দায়িত্ব কি আমাকে ছাড়বে?”

ঈশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল, “ছাড়বে না। কিন্তু যদি তুমি সত্যিই চাও, তবে তোমার কাজ আর তোমার জীবনকে মেলাতে পারবে। আমাদের জীবন সহজ, কিন্তু আমরা শিল্পের মাধ্যমে কাজ করি। তোমরা কাজ করো বাজারের জন্য। আসলে দুটোই মানুষের সৃষ্টি। শুধু দৃষ্টিভঙ্গিটা আলাদা।”

অভ্র চুপ করে নদীর জলে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছিল, ঈশা এমন কিছু বলছে যা সে কখনো ভাবেনি।

সেদিন রাতে ঈশার বাড়ির আঙিনায় বসে সবাই মিলে গান গাইছিল। প্রদীপের আলোয় চারপাশে যেন এক অদ্ভুত শান্তি। ঈশার গলায় গান উঠল—“আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে…”। অভ্র শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিল, এই কণ্ঠস্বর তার ভেতরে অচেনা আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

গান শেষে ঈশা হেসে তাকাল। “তুমি কি আবার শহরে ফিরতে চাইছো?”

অভ্র দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল, “আমার তো ফিরতেই হবে। কিন্তু জানি না, ফিরলে আমি একই মানুষ থাকব কি না। মনে হয়, আমি ভেঙে পড়ব।”

ঈশা চুপ করে রইল। তার চোখে তখন কোনো জোরাজুরি নেই, শুধু এক নিঃশব্দ আস্থা—যদি সত্যিই কিছু হওয়ার থাকে, তবে তা হবেই।

কিন্তু অভ্রর মন শান্ত হচ্ছিল না। একদিকে ঈশার জগৎ, যেখানে সময় ধীর, যেখানে মানুষ গান গেয়ে সম্পর্ক তৈরি করে। অন্যদিকে তার শহরের দুনিয়া, যেখানে ক্লায়েন্টের একটা ই-মেইলই রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। সে ভাবতে লাগল—দুই জগৎ কি একসাথে বাঁচা সম্ভব? নাকি যেকোনো একটাকে বেছে নিতেই হবে?

সকালে ঘুম ভাঙতেই ফোন বেজে উঠল। অফিস থেকে মেইল—ক্লায়েন্ট তাড়াহুড়ো করছে, প্রেজেন্টেশন ফাইনাল করতে হবে। অভ্র মাথার ভেতর যেন হাতুড়ির আঘাত টের পেল। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, সে আবার আগের খাঁচায় ঢুকে পড়ছে।

কিন্তু পাশে বসা ঈশা খাতার পাতায় ছবি আঁকছিল। শান্ত মুখ, চোখে আকাশের ছায়া। অভ্র তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারল, এই মেয়েটি তার দ্বিধারও উত্তর।

পর্ব ঈশার ভয়

ঈশার মনে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা জমে উঠছিল। প্রথম যেদিন অভ্রর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মণ্ডপের আলোয়, তখন সে শুধু ভেবেছিল—একটা শহুরে ছেলেকে দেখে মনে হলো ভীষণ ক্লান্ত, তাই হয়তো একটু কথা বললেই তার ভালো লাগবে। কিন্তু এখন, শান্তিনিকেতনের আকাশের নিচে একসাথে এতগুলো দিন কাটানোর পর, ঈশা বুঝতে পারছিল—এটা আর শুধু মুগ্ধতা নয়। অভ্রর চোখে যে দৃষ্টিটা থাকে, তার হাসির ভেতরে যে নিঃশব্দ শূন্যতা, ঈশা তা পড়তে শিখে ফেলেছে। আর সেই শূন্যতা ভরিয়ে দিতে চাইছে তার নিজের মনের আলো দিয়ে।

কিন্তু ভয়ও তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।

এক সন্ধ্যায় আঙিনায় শিউলি গাছের নিচে বসে ঈশা খাতায় কিছু লিখছিল। অভ্র এসে পাশে বসল। হাওয়ায় ফুলের গন্ধ ভাসছিল, দূরে বাজছিল বাঁশি। অভ্র হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল,
“আজ কী লিখছো?”

ঈশা খাতা বন্ধ করে হেসে উত্তর দিল, “কিছু না, এভাবেই লিখতে ভালো লাগে।”

কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার হাত কাঁপছিল। কারণ সে লিখছিল—অভ্র চলে গেলে কেমন লাগবে, যদি সে আর ফিরে না আসে?

ঈশা জানত, অভ্রর দুনিয়া একেবারেই আলাদা। সকালে অফিস, রাত জাগা মিটিং, বিজ্ঞাপনের প্রতিযোগিতা—এই জীবন শান্তিনিকেতনের গাছপালা, গান, আলপনার সঙ্গে মানায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা, শহরের মানুষের ভালোবাসা অনেক সময় ক্ষণস্থায়ী হয়। হয়তো অভ্র এখন তার হাসি, গান, ছবি দেখে মুগ্ধ হচ্ছে, কিন্তু কয়েক মাস পর সেই মুগ্ধতা ফিকে হয়ে গেলে?

ঈশা ভয় পাচ্ছিল—সে যদি অভ্রকে নিজের মনের সব কথা বলে ফেলে, আর অভ্র যদি সেই টান ধরে রাখতে না পারে, তবে তার জীবনটা ভেঙে যাবে।

সেদিন রাতে অভ্রর সঙ্গে ছাদে বসে ঈশা হঠাৎ বলল,
“তুমি জানো, আমি শহরের মানুষের ভালোবাসাকে ভয় পাই।”

অভ্র অবাক হয়ে তাকাল। “কেন?”

ঈশা উত্তর দিল, “কারণ তোমরা অনেক কিছু একসাথে চাও। কাজ, স্বপ্ন, টাকা, সাফল্য—সবকিছুর ভিড়ে ভালোবাসা কি জায়গা পায়? আমার ভয় হয়, একদিন যদি আমি তোমার জীবনের প্রাধান্য হারাই?”

অভ্র অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“আমি জানি না উত্তর কী। আমি নিজেও লড়ছি। আমার জীবন শহরের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি সেই জীবনে শূন্যতা আছে। তোমাকে ছাড়া সেই শূন্যতা আরও স্পষ্ট। আমি চাই না তুমি হারিয়ে যাও।”

ঈশা মৃদু হেসে বলল, “তবুও আমার ভয় যায় না। আমি গান গাই, ছবি আঁকি, এটাই আমার পৃথিবী। তোমার বাজারি দুনিয়ায় কি আমার মতো মানুষ মানাবে?”

অভ্র তার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হলো, এই প্রশ্নের উত্তর এখনই তার জানা নেই।

পরদিন ভোরে ঈশা একা বেরিয়ে গেল কোপাই নদীর ধারে। সেখানকার লাল মাটি ভিজে ছিল, পায়ে লাগছিল কাদা। আকাশে সূর্যের প্রথম আলো উঠছিল। ঈশা দাঁড়িয়ে নদীর জলে তাকাল আর মনে মনে ভাবল—যদি সত্যিই অভ্র ফিরে গিয়ে ভুলে যায়? যদি এই কয়েকটা দিনের আলো শুধু ক্ষণিকের হয়ে থাকে?

ফেরার পথে তার চোখে জল জমে উঠল।

অভ্র বুঝতে পারছিল ঈশার ভেতরে কী চলছে। কিন্তু তাকে আশ্বস্ত করার মতো সঠিক ভাষা তার কাছে ছিল না। সে জানত, দ্বিধা শুধু তার নয়, ঈশারও। আর এই দ্বিধার মাঝেই তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে আরও গভীর হচ্ছিল।

পর্ব ঝড়

শান্তিনিকেতনের আকাশ সেদিন মেঘে ঢাকা ছিল। দুপুরবেলা কোপাই নদীর ধারে হাওয়া থেমে গিয়ে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা নেমে এসেছিল। ঈশার মনও কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে ছিল। কয়েকদিন ধরে অভ্রকে দেখছিল অদ্ভুতভাবে ফোনে ব্যস্ত থাকতে। রাতবেলা আঙিনায় গান গাওয়ার সময়ও তার চোখ চলে যায় মোবাইল স্ক্রিনে, মুখে অস্থিরতা।

ঈশা ভাবছিল—এ কি তবে সেই শহুরে জীবনের টান, যে জীবন থেকে অভ্র ছুটে পালাতে চেয়েছিল? নাকি সত্যিই অন্য কোনো টান আছে, যার নাম সে উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছে না?

দুপুরে যখন অভ্র বাজারে বেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ফোন এল। সে ব্যস্ত গলায় বলল,
“হ্যাঁ, অনন্যা, আমি কাল ফিরে এলেই প্রেজেন্টেশনটা দেখে নেব। তুমি চিন্তা কোরো না।”

শব্দটা যেন বাজের মতো কানে আঘাত করল—অনন্যা

ঈশা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল। তার বুকের ভেতরে তখন ঢেউ উঠছে। অনন্যা কে? সহকর্মী? বন্ধু? নাকি এমন কেউ, যে অভ্রর জীবনে তার জায়গা আগে থেকেই নিয়ে রেখেছে?

সন্ধ্যায় অভ্র ফিরল। মুখে ক্লান্তি, তবু চোখে আলোর ঝিলিক। ঈশা আঙিনায় বসে ছিল খাতা নিয়ে। অভ্র বসতেই সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“অনন্যা কে?”

অভ্র চমকে গেল। “কী বললে?”

“আজ দুপুরে শুনলাম তুমি ফোনে বলছো, অনন্যা চিন্তা কোরো না। কে সে?”

অভ্র একটু হেসে উত্তর দিল, “আমার সহকর্মী। অফিসে কপিরাইটার হিসেবে কাজ করে। ক্লায়েন্টের রিপোর্ট নিয়ে ভীষণ টেনশনে ছিল। আমি শুধু তাকে আশ্বস্ত করছিলাম।”

কিন্তু ঈশার মনে সেই হাসি ধাক্কা দিল। অভ্র এত সহজভাবে বুঝিয়ে দিলেও তার ভিতরে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। সে শান্ত গলায় বলল,
“তুমি কি নিশ্চিত শুধু কাজের সম্পর্ক?”

অভ্র বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো না?”

এই প্রথমবার তাদের কথোপকথনে গরম হাওয়া বইল। ঈশা চুপ করে গেল, কিন্তু তার চোখে জমে থাকা ভয়টা যেন অভ্রকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল।

রাত গভীর হলে ঈশা বারান্দায় একা বসে রইল। দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আকাশে ছিটেফোঁটা তারা। সে খাতায় লিখল—
যদি তার জীবনে ইতিমধ্যেই অন্য কেউ থাকে, তবে আমি কোথায় দাঁড়াই?”

অভ্র পাশের ঘরে অস্থিরভাবে হাঁটছিল। সে জানত, অনন্যা আসলেই শুধু সহকর্মী, কিন্তু ঈশার চোখে যে সন্দেহ আর ভয় দেখল, তা তার মনকে কাঁপিয়ে দিল। শহরের জগৎ আর শান্তিনিকেতনের জগৎ যেন প্রথমবার তীব্রভাবে ধাক্কা খেল।

পরদিন সকালে তারা প্রায় কথা বলল না। ঈশা গানের আসরে গেল, অভ্র ফটোগ্রাফার নিয়ে শাড়ির ছবি তুলতে ব্যস্ত হলো। তবু দুজনের ভেতরে জমে থাকা দ্বিধা আর অভিমান তাদের মুখের হাসি মুছে দিল।

পর্ব দূরত্ব

শান্তিনিকেতনের দিনগুলো হঠাৎই কেমন বদলে গেল। আগে যেখানে আঙিনার আলোয় গান, আঁকা আর একসাথে চায়ের আড্ডায় ভরে থাকত সন্ধ্যা, এখন সেখানে নেমে এসেছে নীরবতা। অভ্র আর ঈশা দুজনেই যেন ইচ্ছে করে একে অপরকে এড়িয়ে চলছিল।

অভ্র সকালে ক্যামেরাম্যান নিয়ে বেরিয়ে যেত—শাড়ির ছবি, লোকেশনের নোট, ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা খোঁজা—সব কিছুতেই ডুবে থাকত। অথচ প্রতিবার যখন ট্রিগার টিপত, মনে হতো ঈশার চোখের দিকে তাকালে আরও সুন্দর ছবি ধরা যেত। কিন্তু সেই চোখ এখন তার জন্য বন্ধ।

অন্যদিকে ঈশা গানের আসরে আরও বেশি সময় দিতে শুরু করল। দুপুরে যেখানে অভ্রর সঙ্গে বসে খাতায় আঁকাআঁকি করত, সেখানে এখন ছোটদের গান শেখাত, কিংবা একা বসে গুনগুন করত রবীন্দ্রসংগীত। মাঝে মাঝে তার মনে হতো অভ্র পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ঘুরে তাকালে দেখতে পেত খালি জায়গা।

রাতগুলোতে বারান্দার বাতাসে কেমন এক চাপা গুমোট ভাব ভাসত। অভ্র মাঝে মাঝে চেষ্টা করত কথা বলতে, কিন্তু ঈশার কণ্ঠে এক অদ্ভুত শীতলতা ছিল।

“তুমি এখনো মনে করো আমি তোমার কাছে কিছু লুকোচ্ছি?”—এক রাতে অভ্র জিজ্ঞেস করেছিল।

ঈশা উত্তর দেয়নি। শুধু খাতার পাতায় দাগ টেনেছিল বারবার। অভ্রর বুকের ভেতর যেন হাওয়ার মতো একটা ফাঁক তৈরি হলো।

এই দূরত্ব শুধু কথোপকথনে নয়, অনুভূতিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদিন বিকেলে অভ্রর ফোনে আবার অনন্যার কল এলো। অভ্র ভেবেই উঠতে পারল না ফোনটা কেটে দেবে নাকি ধরবে। অবশেষে ধরে ফেলল। ঈশা ঠিক সেই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের চোখ মিলল এক মুহূর্তের জন্য। ঈশার চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন—আবার সে?”

অভ্র কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু ঈশা তখনই চলে গেল।

ঈশার ভয় ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। সে অনুভব করছিল, হয়তো তাদের জগতের ফারাকই সব কিছুর মূল কারণ। শহুরে মানুষের কাছে সম্পর্কও বাজারের মতো—আজ আছে, কাল নেই। তার মনে হচ্ছিল, অভ্র একদিন ঠিকই এই ভিড়ের মধ্যে তাকে ভুলে যাবে।

অভ্রও নিজের মধ্যে দ্বিধায় ডুবে যাচ্ছিল। সে জানত, অনন্যা তার কাছে শুধুই সহকর্মী, কিন্তু ঈশার সন্দেহ ভাঙাতে পারছে না। আর ভাঙাতে চাইলেও যেন ভাষা হারিয়ে ফেলছে।

দূরত্বটা তখন এতটাই বেড়ে গেছে যে, সন্ধ্যায় একই আঙিনায় বসে থেকেও তারা যেন দুটো আলাদা দ্বীপে বসবাস করছে। মাঝে মাঝে বাতাসে শিউলির গন্ধ ভেসে আসত, কিন্তু সেই গন্ধও আর মিলনের প্রতীক হয়ে উঠত না, বরং মনে করিয়ে দিত বিচ্ছেদের ছায়া।

পর্ব ফিরে আসা

শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে আসার দিন সকালে আকাশ কেমন যেন ম্লান ছিল। অভ্রর মনও ঠিক তেমনই ধূসর। ট্রেন ছাড়ার আগে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সে বারবার ভেবেছিল, ঈশার কাছে আরেকবার ক্ষমা চেয়ে নেয়, বোঝায় যে অনন্যা শুধু সহকর্মী। কিন্তু ঈশার চোখে যে নীরব অভিমান জমে উঠেছিল, তা ভেদ করার সাহস খুঁজে পায়নি।

ট্রেন চলতে শুরু করল। জানালার বাইরে লাল মাটির ধুলো উড়ছিল, গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ছোট ছোট কুঁড়েঘর। অভ্রর বুকের ভেতর তখন শুধু একটাই শূন্যতা—ঈশাকে না বলেই চলে এল।

কলকাতায় ফিরে অফিসের চাপে আবার ডুবে গেল সে। ক্লায়েন্ট মিটিং, কনসেপ্ট রিভিউ, রাতজাগা প্রেজেন্টেশন—সব কিছু একই রকম চলছিল। কিন্তু এবার কাজের ভেতর কোনো আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। প্রতিটা শব্দের ভেতরে, প্রতিটা ভিজ্যুয়ালের ফাঁকে সে ঈশার হাসি খুঁজছিল, খুঁজছিল সেই শান্তিনিকেতনের হাওয়া।

রাত গভীর হলে একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারত—যে জীবনের জন্য এতদিন দৌড়েছে, সেই জীবনটাই এখন তাকে শূন্য করে দিচ্ছে।

অষ্টমীর দিন ফোন এল ঈশার কাছ থেকে না, বরং তার কাকার কাছ থেকে। তিনি বললেন, “অভ্র, ঈশা ঠিকমতো খাচ্ছে না, গানেও মন দিচ্ছে না। তোমাকে মনে করছে খুব।”

অভ্রর বুক হঠাৎ কেঁপে উঠল। সেদিনই সে ঠিক করল, আর দেরি নয়। কাজের সব ব্যস্ততা ফেলে দশমীর সকালে আবার রওনা দিল শান্তিনিকেতনের পথে।

শান্তিনিকেতনের আকাশে তখন পুজোর শেষের হাওয়া। মাঠে-মাঠে ঢাক বাজছে, গ্রাম জুড়ে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠছে মানুষ। অভ্র সরাসরি পৌঁছে গেল ঈশাদের বাড়ি। আঙিনায় দাঁড়িয়ে ঈশাকে দেখল—সে খাতা হাতে বসে আছে, কিন্তু চোখ যেন দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে।

“ঈশা…”

শব্দটা শুনেই ঈশা চমকে তাকাল। প্রথমে বিশ্বাসই হলো না অভ্র এসেছে। তারপর ধীরে ধীরে চোখে জল এসে ভিজে উঠল তার গাল।

অভ্র এগিয়ে এসে বলল,
“আমি ভুল করেছি। আমি সময়মতো কিছু বলতে পারিনি। অনন্যা শুধু আমার সহকর্মী, তার চেয়ে কিছু নয়। তুমি যদি আমাকে আরেকবার বিশ্বাস করো, আমি প্রমাণ করে দেব—আমার পৃথিবীতে তোমার বাইরে আর কেউ নেই।”

ঈশা দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব আস্তে বলল,
“আমার ভয় ছিল তুমি আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু আজ তুমি ফিরে এসেছো, সেটাই আমার উত্তর।”

অভ্রর বুক থেকে বোঝাই যেন নেমে গেল। সে হাত বাড়িয়ে ঈশার খাতা থেকে পেনটা তুলে নিল। “এবার থেকে আমাদের গল্প আমরা একসাথে লিখব।”

ঈশা হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

সেদিন সন্ধ্যায় কোপাই নদীর ধারে তারা দুজন একসাথে হাঁটছিল। আকাশে তখন নতুন চাঁদ উঠেছে, চারদিকে শিউলির গন্ধ। অভ্র জানত, তার সামনে এখনও অনেক পথ বাকি—শহরের জীবন, কাজের চাপ, দায়িত্ব—সবই আবার আসবে। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে সে নিশ্চিত হলো, ঈশাকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ।

পর্ব ১০নক্ষত্রবাড়ি

দশমীর সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতন ভরে উঠেছিল সিঁদুর খেলায়। লালপাড় সাদা শাড়ি পরা মেয়েদের কপাল, গাল, চুলে লালচে রঙের ছোঁয়া। বাতাসে শিউলির গন্ধ, ঢাকের তালে উন্মাতাল আনন্দ। অথচ এই ভিড়ের মাঝেও অভ্র আর ঈশার চোখ শুধু একে অপরকে খুঁজছিল।

ঈশা শিউলির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, সিঁদুরে রাঙা মুখে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল প্রদীপের শিখা থেকে। অভ্র এগিয়ে গিয়ে তার কপালে আলতো করে সিঁদুর দিল। সেই মুহূর্তে ঈশার চোখে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু ঠোঁটে ফুটে উঠল এক অনির্বচনীয় হাসি।

“এবার কি তুমি আমাকে ভুলে যাবে না?” ঈশার কণ্ঠ ভিজে যাচ্ছিল।

অভ্র দৃঢ় গলায় বলল,
“না। আমি আমার জীবন তোমার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চাই। শহরের দুনিয়া হোক বা এই লাল মাটির পথ—সব জায়গায় আমার পাশে চাই তোমাকে।”

রাত নামল। আঙিনার চারদিকে প্রদীপ জ্বলছে, আকাশভরা তারারা জ্বলজ্বল করছে। ঈশার বাবা-মা গান ধরলেন, “বলো দুর্জয় হও দুরন্ত…”। চারপাশে যেন ভেসে উঠল এক অদ্ভুত শক্তি।

ঈশা অভ্রকে নিয়ে বারান্দার কোণে দাঁড়াল। আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,
“দেখছো? এ বাড়িটা নক্ষত্রের মতো আলোকিত। তাই একে আমরা বলি—নক্ষত্রবাড়ি। এখানে যারা আসে, তারা নিজের আলো খুঁজে পায়। তুমি পেরেছো?”

অভ্র ঈশার হাত শক্ত করে ধরল।
“হ্যাঁ। তোমার চোখে আমি আমার আলো খুঁজে পেয়েছি। এতদিন যেটা শুধু ক্লায়েন্টের শব্দে হারিয়ে যাচ্ছিল, সেটা আজ তোমার গানেই ফিরে এল। আমি আর অন্ধকারে ফিরব না।”

ঈশা মৃদু স্বরে বলল, “তাহলে আমরাও এই বাড়ির মতো হব—আলোর নক্ষত্রবাড়ি।”

সেই রাতে আকাশভরা তারা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অভ্র বুঝল, জীবনের সব দ্বিধা, ভয়, ভুল বোঝাবুঝি মিলিয়ে গিয়ে এক নতুন সূচনা অপেক্ষা করছে। শহরের ভিড়, কাজের চাপ, বাজারের প্রতিযোগিতা আবার ডাক দেবে তাকে, কিন্তু এবার তার ভেতরে থাকবে শান্তিনিকেতনের এই নক্ষত্রবাড়ির আলো, থাকবে ঈশার হাতের স্পর্শ।

প্রথম আলাপের সেই অদ্ভুত টান থেকে শুরু করে ভুল বোঝাবুঝি, দূরত্ব, আর ফিরে আসা—সবকিছু মিলিয়ে যেন তারা দুজন সত্যিই খুঁজে পেল নিজেদের।

আঙিনার প্রদীপ নিভে আসছে, অথচ আকাশে তারার আলো ঝলমল করছে। ঈশা গান গাইছে—“আমার সকল রসের ধারা তুমি মিশাও প্রাণে…”। অভ্র চোখ বুজে শুনছে, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছে—এই গানই হবে তার জীবনের সত্য।

“নক্ষত্রবাড়ি”—এবার থেকে শুধু ঈশার বাড়ি নয়, তাদের দুজনের মিলনের ঠিকানা হয়ে উঠল।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-08-25-at-12.45.47-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *