রাজীব আচার্য
বিশ্বভারতীর লাল মাটির ছায়ায় ঘেরা প্রাচীন গ্রন্থাগারে বসে ছিলেন ড. অমৃতা সেন। তার চোখের সামনে খোলা একটি পুরোনো খাতা, যার পাতাগুলো এতটাই ভঙ্গুর ছিল যেন যেকোনও মুহূর্তে ধুলোয় পরিণত হবে। সকালটা ছিল ঠান্ডা, হালকা কুয়াশা ঘেরা জানালার ওপার থেকে ঝরে পড়া মহুয়া ফুলের গন্ধে ভরে উঠছিল চারপাশ। তবে ড. সেনের মন ছিল অন্যত্র। “তান্ত্রিক ভারতের নারী ইতিহাস” বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তিনি খুঁজে পান একটি অদ্ভুত নাম—নক্রচক্র। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এটি হয়ত কোনো লোককথা, কোনও সাধুর নাম বা গ্রাম্য আচার। কিন্তু যতই পাতাগুলো পড়ছিলেন, ততই তার বিশ্বাস ভাঙছিল। পুঁথিতে লেখা ছিল, “নক্রচক্র হ’ল সেই তান্ত্রিক প্রবাহ, যা কেবল অমরত্বই নয়, আত্মা পুনর্জন্ম, নারীর ঋতু রক্তের মাধ্যমে আত্মার নির্গমন ও বন্দনের পথ প্রকাশ করে।” প্রথমে বিষয়টি পড়ে হাসি পেয়েছিল, তবে পৃষ্ঠার শেষে লেখা কয়েকটি কথা তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল: “একাদশী রাত্রে যদি নারীর একাদশ রক্তবিন্দু চক্রে বন্ধ হয়, তবে পুনর্জন্ম ঘটবে গনেশপদ নাথের।” অমৃতা জানতেন, ইতিহাস কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। তবে এই পুঁথির ভাষা এতটাই দৃঢ়, আর রহস্যময় ছিল যে, তিনি বাধ্য হন এটি আরও গভীরে খুঁড়তে।
এই সময়ে তার ফোনে আসে একটি পরিচিত নাম—অনিরুদ্ধ ঘোষ। এককালে তার সহপাঠী, এখন রামপুরহাট পাবলিক লাইব্রেরির আর্কাইভ বিভাগের গ্রন্থাগারিক। কথার মাঝেই অনিরুদ্ধ বলে বসে, “তুই যদি নক্রচক্র নিয়ে সত্যিই সিরিয়াস হোস, তাহলে একটা জিনিস তোকে দেখাতে পারি।” সে জানায়, তার দাদু ছিলেন ব্রহ্মচারী তান্ত্রিক, আর মৃত্যুর আগে কিছু পাণ্ডুলিপি ও এক ‘রক্ত মানচিত্র’ রেখে গিয়েছিলেন—যা নাকি এই চক্রের কেন্দ্রবিন্দু চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। যদিও অমৃতা যুক্তিবাদী, এবং তন্ত্র-মন্ত্রকে সবসময়ই নারীকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে দেখে এসেছে, তবুও সে কৌতূহলী হয়ে পড়ে। কারণ তার গবেষণা কেবল তন্ত্র নয়, নারীর দেহ নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক আচার-আচরণের ঐতিহাসিক বিচারও। অনিরুদ্ধ জানায়, বীরভূমের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল—রঘুনাথপুর—একসময় নক্রচক্রের মূল কালীপীঠ ছিল বলে ধারণা। অমৃতা স্থির করেন, তিনি যাবেন রঘুনাথপুর, তবে গবেষক হিসেবে, যুক্তিবাদী হিসেবে, ভয়ের নয়—প্রমাণের খোঁজে।
পরদিন সকালে, কুয়াশার চাদর পেরিয়ে বাসে উঠে পড়েন অমৃতা। তার গন্তব্য—রামপুরহাট। সাথে শুধু তার নোটবুক, সেই পুরোনো পুঁথি, আর অনিরুদ্ধ ঘোষের দেওয়া কাগজের একটি মানচিত্র, যার উপরে লেখা ছিল: “যেখানে মৃতরা গান গায়, সেখানেই নক্রচক্র জন্মায়।” অদ্ভুত কথা, ভাবতে ভাবতেই বাস ছাড়ে। পথ জুড়ে লাল মাটির ঢিবি, ছোটো ছোটো চালা ঘর, আর মাঝে মাঝে কালো রঙের প্রাচীন কালীমূর্তি দেখা যায় রাস্তার ধারে। যেন ইতিহাস নিজেই দুলতে দুলতে চলেছে তার পাশে। বাস যখন রঘুনাথপুর ঢোকে, ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল ৪টা ছুঁই ছুঁই। গ্রামটা যেন থমকে থাকা সময়—ধোঁয়ায় মোড়া, সুনসান, আর মাঝে মাঝে শোনা যায় শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ। দাঁড়িয়ে থাকা এক চায়ের দোকানের বুড়ো বলে, “আপনি যদি ওই কালিপীঠ দেখতে যান, তবে সন্ধ্যার আগে ফিরুন… ওদিকে এখনো কুকুররা হঠাৎ করে হাওয়ায় চিৎকার করে ওঠে।” অমৃতা কিছু না বলে এগিয়ে যান। তার সামনে এখন শুধু ইতিহাস নয়—তার নারীত্ব, তার বিশ্বাস, আর এক ভয়ংকর চক্র—যা সম্ভবত শত বছর ধরে ঘুমিয়ে থেকেও আজ আবার জেগে উঠছে।
***
রামপুরহাট লাইব্রেরির পুরোনো অংশটা ছিল যেন এক নিঃসাড় নিঃশব্দ গুহা, যার ভেতরে সময় জমে থাকে ধুলো আর সোঁদা কাগজের গন্ধে। লাইব্রেরির সেই গোপন অংশে প্রবেশ করতে সাধারণ পাঠকের অনুমতি ছিল না, কিন্তু অনিরুদ্ধ ঘোষ অমৃতার জন্য সব ব্যবস্থা করেছিল। সে নিজেও ছিল অপেক্ষাকৃত নিঃসঙ্গ প্রকৃতির মানুষ, যাকে সহপাঠী হিসেবে কখনো অতটা চোখে পড়েনি—তবে অদ্ভুতভাবে সেই নিঃশব্দ মানুষটাই আজ যেন একমাত্র পথপ্রদর্শক। ঘরের এক কোণে সে এক পুরোনো কাঠের সিন্দুক টেনে এনে রাখল। অমৃতা নীচু হয়ে দেখলেন—সিন্দুকের মুখে তামার তালা, যেটা খোলার জন্য দরকার হয়েছিল এক পুরাতন চাবি আর একটি মন্ত্রপড়া কাগজ। “এই সিন্দুকটা আমার ঠাকুর্দা রেখে গিয়েছিলেন,” অনিরুদ্ধ বলল, “উনি বলতেন, এটার ভেতর আছে এমন কিছু যা মানুষের জন্য নয়।” ঢাকনা খোলার সঙ্গে সঙ্গে উঠল ধুলোর ঝাঁঝালো গন্ধ, আর তার নিচে পাওয়া গেল এক খাম—যার গায়ে লেখা: “গনেশপদ নাথ জাগবে, যদি রক্ত না থামে।” অমৃতার বুক কেঁপে উঠল, না ভয় থেকে নয়—অতীতের ইতিহাসের গভীরতা অনুভব করে। খামের ভেতর ছিল একটি চিঠি, লেখা কাঁপা হাতে, অনিরুদ্ধের ঠাকুর্দার ভাষায়। সেখানে বলা হয়েছিল, তিনি একসময় নিজেই নক্রচক্রের একটি আচার প্রত্যক্ষ করেছিলেন—যেখানে এক কিশোরীকে পূর্ণিমার রাতে রক্তপাত করিয়ে তার রক্ত দিয়ে তান্ত্রিক চক্র অঙ্কন করা হয়েছিল। চিঠিতে আরও লেখা ছিল, “আমরা কেউ জানি না গনেশপদ নাথ সত্যিই অমর হয়েছে কিনা, তবে তার বিদ্যা যে এখনও জীবিত, সেটা আমি নিজ চোখে দেখেছি।” এই বাক্যটাই অমৃতার যুক্তিবাদী চিন্তায় বুলেটের মতো আঘাত করল।
অনিরুদ্ধ জানান, তার দাদু সেই ঘটনার পর থেকেই মূক হয়ে যান একরকম, জীবিত থেকেও কণ্ঠহীন হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে তিনি এই চিঠিটা তার নাতিকে দিয়ে বলেছিলেন, “এই ইতিহাস কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু একদিন কেউ আসবে যে খুঁজবে—আর তখন তাকে এটা দিও।” অনিরুদ্ধ চুপ করে যায়। ঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নামে। অমৃতা জানতেন না—সে ভয় পাচ্ছে কিনা, কিন্তু তার চোখ, তার বুদ্ধি, সব কিছু তাকে বারবার বলছিল—এই তন্ত্র বিদ্যা শুধু অতীত নয়, বরং কোনো এক গোপন স্রোতের মতো আজও সক্রিয়। আর সবচেয়ে বেশি যেটা ভয়াবহ, সেটা হলো এই বিদ্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নারীর রক্ত। একজন নারীবাদী হিসেবে এটা তার কাছে শোকাবহ সত্য—তান্ত্রিক ইতিহাস নারীর শরীরকেই অমরত্বের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। চিঠির একদম শেষে লেখা ছিল: “তুই যদি কালীপীঠ খুঁজে পাস, তবে লক্ষ্য করবি—বাঁদিকে থাকবে তিন মাথার নকশা আর মধ্যখানে ‘শবচক্র’—যেখানে রাত হলে গাওয়া হয় গনেশপদের গান।” এই শব্দগুলো অমৃতার মনে বিদ্যুৎ গতিতে গেঁথে যায়। গান? মৃত তান্ত্রিকের নামে গান? কী ধরনের রীতি ছিল এটি?
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতে থাকে রামপুরহাট শহরে। লাইব্রেরির বাইরে থেকে আসছিল চায়ের দোকানের কথা বলার শব্দ, মাঝে মাঝে কিছু কুকুরের ঘেউ ঘেউ—সব কিছুই যেন স্বাভাবিক, অথচ অমৃতার মনে হচ্ছিল, সবটাই সাজানো এক ছায়া নাটক। অনিরুদ্ধ তখন একটা মানচিত্র তুলে ধরে, যা তার দাদু একদা এঁকেছিলেন। মানচিত্রে রঘুনাথপুর, ঝাড়গ্রাম, লাভপুর—এমন বেশ কিছু স্থানের নাম রয়েছে, আর তাদের চারপাশে লাল কালি দিয়ে আঁকা হয়েছে বৃত্ত, তার চারপাশে ত্রিকোণ, এবং সবশেষে শবদেহের মতো এক রেখা—যেটা শেষ হয়েছে এক কালো বিন্দুতে। অমৃতা বললেন, “এই কালো বিন্দুটা কী?” অনিরুদ্ধ গম্ভীর স্বরে বলল, “ওটাই চক্রের কেন্দ্রে থাকা কালীপীঠ।” অমৃতা চুপ করে বোঝার চেষ্টা করছিলেন—এই সমস্ত কিছু, এই পুরোনো কাহিনি, এক মৃত তান্ত্রিক, এক নিঃশব্দ লাইব্রেরি, এক রক্তপিপাসু চক্র—সব কিছু যেন এক জটিল রহস্যজালের অংশ। “আমাকে ওই পীঠে নিয়ে চল,” সে বলল, “এই গবেষণা এখন শুধু একাডেমিক নয়—এটা ইতিহাস ও নারীত্বের সম্মানের প্রশ্ন।” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ল। কালীপীঠে যাওয়ার সময় এসে গেছে।
***
১৮৫৬ সালের বীরভূম—ঘন বনের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে আছে এক কালীপীঠ, যার চূড়ায় নেই কোনো ঘণ্টা, শুধু রয়েছে ধূসর পাথরের কালো মূর্তি—ত্রিনয়নী, রক্তাভ। কালীমূর্তির পায়ের নিচে শুয়ে আছে এক মৃত শব, আর তার মাথার কাছে বসে রয়েছে এক পুরুষ—গেরুয়া বসনে, দেহে চন্দনের রেখা, চুল এলোমেলো, চোখদুটি ঠিক যেন মৃত গাঙচিলের মতো। তার নাম—গনেশপদ নাথ। এককালে ছিল এক সমাজ সংস্কারক, পুঁথি পাঠক, তবে পরে নিজেকে বলতেন “অন্তর্জাগ্রত সাধক”—যিনি বিশ্বাস করতেন মৃত্যু নিছক এক পর্যায়, আর রক্ত হলো আত্মার শুদ্ধতম ভাষা। গনেশপদের নেতৃত্বে জন্ম নেয় “নক্রচক্র”—একটি গোপন তান্ত্রিক গোষ্ঠী, যাদের বিশ্বাস ছিল কালী মা কেবল ভক্তির মাধ্যমে নয়, রক্তের মাধ্যমে সন্তুষ্ট হন। পীঠে নিয়মিত আসত বালিকা, কিশোর, পুরুষ, এমনকি গর্ভবতী নারী—তাদের দেহ থেকে সংগ্রহ করা হতো “ঋতুরক্ত”, যার মাধ্যমে অঙ্কিত হতো এক রহস্যময় চক্র। বলা হতো, যখন এই চক্র সম্পূর্ণ হবে, তখন গনেশপদ নিজে কালী মাতার দেহে প্রবেশ করতে পারবে—এবং অমর হয়ে উঠবে তার আত্মা। সাধক বিশ্বাস করতেন, মানব জন্মের সীমাবদ্ধতা তাকে আটকায়, তাই তাকে দরকার “রক্তের মুক্তি”—নারী শরীর, তারই দ্বার।
কিন্তু সময় যত এগোয়, গনেশপদ নাথের ক্রিয়াকলাপ শুধু গোপন আচারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ছড়িয়ে পড়ে গোটা বীরভূমে। বেশ কিছু কিশোরী নিখোঁজ হতে থাকে, এবং শেষমেশ গ্রামেরই এক দুঃসাহসী নারী—রায়মতী, গোপনে প্রবেশ করেন পীঠে, এবং দেখে ফেলেন গনেশপদের রক্তাচার। তিনি ফিরেই জানিয়ে দেন স্থানীয় জমিদারকে। জমিদার একদল লোক নিয়ে রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করেন পীঠে। কিন্তু কেউ পায়নি গনেশপদকে। মন্দির তখন রক্তে মাখামাখি, কিন্তু সাধক অনুপস্থিত। তার শিষ্যরা দাবি করে—“তিনি নিজেই হয়ে গেছেন চক্র”—তার দেহ অদৃশ্য হয়েছে, কিন্তু আত্মা রয়ে গেছে। এরপর থেকেই কালীপীঠ বন্ধ হয়ে যায়, আর গাঁয়ের লোকেরা সেই জায়গাকে ‘অভিশপ্ত’ ঘোষণা করে। বলা হতো, প্রতি বছর একাদশী রাতে পীঠের দিকে গেলে শোনা যায় ঢাকের শব্দ, আর দূর থেকে কানে আসে এক নিনাদ—“অগ্নির চেয়ে তেজী, রক্তের চেয়ে শুদ্ধ আমি… গনেশপদ আসছে…”।
বর্তমান সময়ে অমৃতা যখন এই ইতিহাস শুনছিলেন অনিরুদ্ধের কাছে, তখন তাদের সামনে ছিল সেই পীঠের পুরোনো মানচিত্র। মানচিত্রের মাঝখানে আঁকা ছিল এক বৃত্ত, তার মধ্যে তিনটি মাথা—একটি নারী, একটি পুরুষ, একটি কঙ্কাল। অমৃতা হতবাক হয়ে বলে, “এই কঙ্কালমুখটা… এটাই কি চক্রের শেষ ধাপ?” অনিরুদ্ধ জানায়, তার দাদুর মতে, চক্র শুরু হয় ঋতুরক্ত দিয়ে, শেষ হয় আত্মদানে। আর গনেশপদ বিশ্বাস করতেন, একজন নারী যদি নিজের ইচ্ছায় নিজ দেহ উৎসর্গ করে কালীপীঠে, তবে তিনিই হবেন “মহাশক্তি”—যার মাধ্যমে সাধক আবার জন্ম নেবেন। অমৃতা জানেন, এসব কল্পকথার চেয়ে বেশি কিছু নয়—তবে যেভাবে ইতিহাস বারবার এই ‘চক্র’ প্রসঙ্গ তোলে, তাতে একটা গভীর নিঃশব্দ সত্য থেকে যায়। সে বলে, “এটা শুধু ইতিহাস নয় অনিরুদ্ধ—এটা নারী শরীরের ওপর শতাব্দী ধরে চলে আসা এক নির্মম সংস্কৃতি। এটা আমাদের ভাঙতে হবে।” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে। বাইরে তখন অন্ধকার ঘনিয়েছে, লাইব্রেরির আলো নিভু নিভু, আর কোথা থেকে যেন ভেসে আসে এক কাকের ডাক—কোন পূর্বাভাস? তারা জানে না। কিন্তু গনেশপদের ছায়া এখন শুধু অতীতে সীমাবদ্ধ নয়—তাঁর পন্থীরা আবার জেগে উঠছে, আর সামনে আসছে সেই “একাদশী রাত”।
***