Bangla - রহস্য গল্প

নকশিকাঁথার গোপন কোড

Spread the love

সিদ্ধার্থ দে


শান্তিনিকেতনের ভোরবেলার আলোয় সবকিছু যেন অন্যরকম লাগে। কলকাতার ধূসর আকাশ, ধোঁয়া আর হর্নের ভিড় থেকে অনেক দূরে এই ছোট্ট শহরের গন্ধ আলাদা—সেগুনপাতার, শিউলির, আর লালমাটির ধুলো মিশে থাকা সেই গন্ধ। ঋজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব এই গন্ধের ভেতরেই কেটেছে। বাবা-মা কলকাতায় চাকরি করলেও পড়াশোনার সুবিধা আর নিরাপত্তার জন্য ঋজুকে রেখে গিয়েছিলেন দিদিমা অঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। অঞ্জনার ছিল এক ধরনের নিঃশব্দ শক্তি—তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা, যিনি দিনের বড় অংশটাই কাটাতেন পড়ার টেবিলে বা হাতের কাজ নিয়ে। শীতের বিকেলে উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসে হাতে সুই-সুতো নিয়ে কাজ করতেন তিনি, আর ঋজু এক পাশে বসে হয়তো বই পড়ত, নয়তো দিদিমার সেলাই করা রঙিন নকশির ফাঁকে ফাঁকে চোখ হারিয়ে ফেলত। সেই কাঁথাগুলোর মধ্যে একটির প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল—সাদা সুতির ওপর রঙিন সুতোয় ফুল, পাতা, পাখির নকশা, আর মাঝেমধ্যে অদ্ভুত জ্যামিতিক আকার। তখন সেগুলোকে কেবল অলংকরণ ভেবেছিল সে, কিন্তু তবুও কেন যেন মনে হতো, এই কাঁথায় একটা আলাদা গল্প আছে, যা কেউ বলেনি।

বছরের পর বছর কেটে গেছে। ঋজু এখন কলকাতার সল্টলেকের একটি সাইবারসিকিউরিটি কোম্পানিতে কাজ করে। দিন শুরু হয় কফি আর অসংখ্য মেইল দিয়ে, আর শেষ হয় মনিটরের আলোতে ক্লান্ত চোখ নিয়ে। কর্পোরেট জীবনের চাপে শৈশবের সেই শান্তিনিকেতনের দিনগুলো অনেকটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল তার কাছে। তবে ভেতরে কোথাও যেন লুকিয়ে ছিল একটুকরো লালমাটির গন্ধ, দিদিমার গল্প বলার সময়ের কণ্ঠস্বর, আর সেই পুরনো নকশিকাঁথার স্মৃতি। এমন সময় একদিন ফোন এল—মাসির কণ্ঠস্বরের মধ্যে আতঙ্ক, “ঋজু, তোর দিদিমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলেছে একটু সাবধানে থাকতে হবে। তুই যদি পারিস, চলে আয়।” অফিসের কাজ ফেলে পরদিন সকালেই ঋজু রওনা দিল শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে। জানালার বাইরে পাল্টাতে থাকা দৃশ্য—কংক্রিটের দেয়াল থেকে ধানক্ষেত, তারপর লালমাটির রাস্তা—তার মনে ফিরিয়ে আনছিল সেই ছেলেবেলার ছবি। স্টেশনে নেমে যখন বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করল, তখন শরতের নরম রোদে পাতা ঝরা রাস্তা আর টিপটিপ হাওয়ায় তার মনে হচ্ছিল, যেন বহু বছর পরে নিজের আসল ঠিকানায় ফিরছে।

দিদিমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে ঋজুর বুক কেঁপে উঠল। অঞ্জনার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে, চোখের কোণে ভাঁজ, কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনও একই রকম। তিনি হেসে বললেন, “এই বয়সে একটু-আধটু অসুখ তো হবেই, বাপু। এত ভাবছিস কেন?” ডাক্তার বলেছে আপাতত বিশ্রামই একমাত্র ওষুধ। তাই দিনভর দিদিমার ঘরে সময় কাটাতে লাগল ঋজু। এক বিকেলে, আলমারি গুছোতে গিয়ে চোখে পড়ল সেই কাঁথা—যেটি বহু বছর আগে তার শৈশবের সঙ্গী ছিল। ধুলোমাখা হলেও সুতোয় আঁকা নকশাগুলো এখনও স্পষ্ট। ঋজু সেটি বিছিয়ে দিল নিজের সামনে। প্রথমে সে নস্টালজিয়ায় ভেসে যাচ্ছিল—ফুলের পাপড়ির সেলাই, পাখির ডানার ছোপ, লাল আর নীলের মিশ্রণ। কিন্তু ধীরে ধীরে তার নজর পড়ল কিছু অদ্ভুত জ্যামিতিক বিন্যাসে—ত্রিভুজ, বর্গ, আর সরল রেখার পুনরাবৃত্তি, যেগুলো নির্দিষ্ট দূরত্বে বসানো। তার চোখে পড়ল, এই বিন্যাসে যেন একটা লজিক আছে, একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন, যা স্রেফ শিল্প নয়, বরং কোনো পরিকল্পিত বিন্যাস।

ঋজুর পেশাগত অভ্যাস হল সন্দেহপ্রবণ হওয়া। সাইবারসিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সে জানে, ডেটা লুকানোর হাজারো পদ্ধতি আছে—তার মধ্যে স্টেগানোগ্রাফি অন্যতম। কম্পিউটার ফাইল, ছবি, এমনকি শব্দের ভেতরেও গোপন বার্তা লুকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু কাপড়ের সেলাইয়ের মধ্যে? এই ধারণা তার কাছে নতুন, অথচ অসম্ভব নয়। সুতোয় রঙের বিন্যাস, সেলাইয়ের ফাঁক, পুনরাবৃত্তি—সবই হতে পারে কোডিংয়ের এক মাধ্যম। ঋজুর মনে হল, হয়তো দিদিমা নিজেও জানতেন না, এই নকশার মধ্যে কী লুকানো আছে। আবার এটাও হতে পারে, তিনি সবই জানতেন, কিন্তু গোপন রেখেছেন। কাঁথার এক কোণে কয়েকটি সেলাই অন্যগুলোর তুলনায় অদ্ভুতভাবে গাঢ়—সেটা তার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল। ল্যাপটপে ছবি তুলে সে ভাবতে লাগল, এই প্যাটার্ন কি আদৌ কোনো অর্থ বহন করে? আর যদি করে, তবে সেই অর্থ এত বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হলো কেন? শান্তিনিকেতনের এই নীরব বিকেলে, পুরনো কাঁথার সুতোয় বাঁধা সেই রহস্য যেন তার সামনে ধীরে ধীরে খুলে যেতে শুরু করল।

রাতটা কাটল অস্থিরতায়। শান্তিনিকেতনের নীরবতা, দূরের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর দিদিমার ঘুমন্ত শ্বাসের শব্দ—সবই যেন মিলেমিশে ঋজুর মনে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা তৈরি করছিল। খাওয়ার পর নিজের ঘরে ফিরে এসে কাঁথাটা আবার বিছিয়ে রাখল টেবিলে। হাতে মোবাইল তুলে একে একে পুরো কাঁথার ছবি তুলতে লাগল—প্রতিটি কোণ, প্রতিটি রঙের বিন্যাস, প্রতিটি পুনরাবৃত্ত সেলাইয়ের প্যাটার্ন। শৈশব থেকে তার এক বিশেষ অভ্যাস আছে—যখনই কোনো জটিল প্যাটার্ন চোখে পড়ে, সেটা ভেঙে ভেঙে বোঝার চেষ্টা করে। অফিসে সাইবারসিকিউরিটি প্রজেক্টে কাজ করার সময় অসংখ্য ছবির ভেতর লুকিয়ে থাকা ডেটা খুঁজে বের করার অভিজ্ঞতা আছে তার, কিন্তু কাপড়ের সুতোয় এমন কিছু দেখা—এটা তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বার করে কাঁথার ছবিগুলো ইমপোর্ট করল। স্ক্রিনে বড় করে ছবিগুলো দেখে বুঝতে পারল, সুতোয় রঙের বিন্যাস কোনো কাকতালীয় নয়—এগুলো আসলে নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সে সাজানো। চোখ সরু করে সে নোট করতে লাগল, কোথায় লাল, কোথায় নীল, কোথায় সবুজ, আর প্রতিটির মাঝে কত ফাঁক। মনে হচ্ছিল, যেন কাপড়ের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গোপন ভাষা।

সে ল্যাপটপে চালু করল নিজের ডেভেলপ করা এক স্টেগানোগ্রাফি ডিকোডার—যেটি সাধারণত ইমেজ ফাইল থেকে লুকানো ডেটা বের করতে ব্যবহৃত হয়। প্রোগ্রামটি ছবির পিক্সেল কালার ভ্যালু বিশ্লেষণ করে, কিন্তু এখানে কাপড়ের ছবিকে ডিজিটাল গ্রিডে ভেঙে রঙের মান নির্ধারণ করল সে। প্রতিটি সেলাই যেন একেকটা বিট—রঙের পার্থক্য এক ও শূন্যের মতো কাজ করছে। কোড চালু হতেই কিছু এলোমেলো বাইনারি সিরিজ স্ক্রিনে ভেসে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে সেটি রূপ নিল ASCII অক্ষরে। ফলাফল দেখে তার নিশ্বাস আটকে গেল—একটা অসম্পূর্ণ টেক্সট স্ট্রিং, যেখানে কিছু স্পষ্ট শব্দ চোখে পড়ছে: “SHAANTI-1971”, “PROJECT K”, আর কিছু ভাঙা অক্ষরের মধ্যে তারিখ এবং নাম। ঋজু অবাক হয়ে গেল—১৯৭১ মানেই মুক্তিযুদ্ধের বছর, কিন্তু ‘Project K’ কী? আর এই বার্তাটি কেন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল একটি কাঁথায়? মাথার ভেতরে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। সে বুঝতে পারল, এই প্যাটার্ন কোনো শখের শিল্প নয়—এটি ছিল একটি এনক্রিপ্টেড বার্তা, যেটি কাপড়ের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বহু বছর আগে।

কিন্তু একা এই রহস্য সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন হবে এমন কারো, যে কাপড়ের ইতিহাস ও টেক্সটাইলের গোপন কোডিং পদ্ধতি সম্পর্কে জানে। ঋজুর মনে পড়ল লাবণ্য সেনগুপ্তর নাম—বিশ্বভারতীতে গবেষক, যিনি বাংলার লোকশিল্প ও টেক্সটাইল ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। কয়েক মাস আগে এক কনফারেন্সে তাঁর বক্তৃতা শুনেছিল ঋজু, যেখানে তিনি বলেছিলেন কিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সময় গোপন বার্তা পাঠাতে কাপড় ও নকশিকাঁথা ব্যবহার করা হতো। তখন কথাবার্তা হয়েছিল সামান্য, কিন্তু তাঁর জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাস ঋজুর মনে দাগ কেটেছিল। রাত দশটার সময় কিছুটা দ্বিধা নিয়েই সে লাবণ্যের ইমেল খুঁজে বের করল, এবং কাঁথার কয়েকটি ছবি ও নিজের পর্যবেক্ষণ সংযুক্ত করে একটি বার্তা লিখল—“আমি হয়তো কিছু অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পেয়েছি। আপনি যদি সময় দেন, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। বিষয়টি হয়তো ১৯৭১ সালের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত।” পাঠিয়ে দেওয়ার পরও মনে হচ্ছিল, হয়তো এভাবে হঠাৎ যোগাযোগ করা বেমানান হয়ে গেল, কিন্তু কৌতূহল তাকে থামতে দিল না।

বার্তা পাঠানোর প্রায় পনেরো মিনিট পরই লাবণ্যের উত্তর এল—“ছবিগুলো খুবই আকর্ষণীয়। আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক হলে, এটি বিরল এক উদাহরণ হতে পারে টেক্সটাইল স্টেগানোগ্রাফির। আমি আগামীকাল সকাল দশটায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি, শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন ক্যান্টিনে। এই ধরণের প্যাটার্ন আমি আগে কখনো দেখিনি, তবে কয়েকটি ঐতিহাসিক সূত্রের সঙ্গে এর মিল রয়েছে।” উত্তর পড়ে ঋজুর মনে হল, হয়তো সে একা নয়—আর কেউ এই রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী, আর সেই কেউই হলেন সঠিক ব্যক্তি। জানালার বাইরে চাঁদের আলোয় কাঁথাটা তখন নিঃশব্দে পড়ে আছে, যেন তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা অর্ধশতাব্দী পুরনো গোপন কথাগুলো প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করছে। ঋজু জানে, কাল থেকে শুরু হবে এক যাত্রা, যেখানে প্রযুক্তি আর ইতিহাস মিলেমিশে তাকে নিয়ে যাবে অজানা এক সত্যের দিকে।

রবীন্দ্রভবনের ক্যান্টিনে সকালটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে আসা নরম রোদ টেবিলের ওপর লালচে ছোপ ফেলছিল। ঋজু আগেভাগেই এসে অপেক্ষা করছিল, আর হাতে ধরা ব্যাগের ভেতরে নিরাপদে রাখা ছিল সেই কাঁথা। দশটা বেজে কয়েক মিনিট পরে লাবণ্য সেনগুপ্ত ঢুকলেন—সাদা কটন শাড়ি, খোঁপায় লাল জবা, আর কাঁধে ঝোলানো ফাইলভর্তি ব্যাগ। তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, গবেষণার জন্য তিনি কতটা প্রস্তুত ও পেশাদার। “আপনি ঋজু?”—তিনি এগিয়ে এসে হাত বাড়ালেন। বিনিময়ে ঋজু মাথা নেড়ে হাসল। আনুষ্ঠানিকতার পর, তারা ক্যান্টিনের এক কোণে বসে পড়ল, আর ঋজু সাবধানে কাঁথাটি টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিল। লাবণ্য প্রথমে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন কাপড়ের টেক্সচার, তারপর সেলাইয়ের ধরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। চোখে তখন এমন এক মনোযোগ যা কোনো ইতিহাসবিদ বিরল বস্তু পেলে দেখায়। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি ধীরে বললেন, “আপনার সন্দেহ ঠিক। এই প্যাটার্ন কেবল অলংকার নয়—এটি গোপন বার্তা বহন করছে।”

তিনি ব্যাগ থেকে একটি ছোট্ট লুপ বের করে সেলাইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। “এই ধরনের কোড ব্যবহারের কৌশল নতুন নয়,” তিনি বলতে শুরু করলেন, “কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়, বিশেষত সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিবাহিনী ও তাঁদের সহযোগীরা প্রায়ই বার্তা পাঠাতে চিঠি বা টেলিগ্রাম ব্যবহার করতেন না—কারণ সেগুলো সেন্সর হয়ে যেত। পরিবর্তে, নারীরা কাপড়ের মধ্যে, বিশেষ করে নকশিকাঁথায়, নির্দিষ্ট সেলাই প্যাটার্নের মাধ্যমে তথ্য লুকিয়ে রাখতেন। এই তথ্যগুলো প্রাপকের হাতে পৌঁছানোর পর বিশেষ চাবি দিয়ে ডিকোড করা যেত।” ঋজু মন দিয়ে শুনছিল, কিন্তু লাবণ্যের পরের কথাগুলো তাকে আরও বিস্মিত করল। “তবে আপনার এই কাঁথার সেলাইয়ের ধরণ আমি আগে দেখিনি। এর বিন্যাস খুবই সিস্টেম্যাটিক, কিন্তু রঙ ও ফাঁকের ধরন অন্যসব উদাহরণ থেকে আলাদা। আমার সন্দেহ, এটি কেবল মুক্তিযুদ্ধের যোগাযোগ মাধ্যম নয়—পশ্চিমবঙ্গের কোনো রাজনৈতিক গোপন চক্রও এর সঙ্গে জড়িত ছিল।”

ঋজু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাজনৈতিক গোপন চক্র? মানে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে?” লাবণ্য মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে অনেক গোপন মিশন পশ্চিমবঙ্গে পরিচালিত হতো। সীমান্তের এপারে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় কিছু দল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ বামপন্থী বিপ্লবী, কেউবা গুপ্তচরবৃত্তিতে যুক্ত, তারা এই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করত। আপনার কাঁথার প্যাটার্নে কিছু রঙের বিন্যাস আছে যা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ‘স্বাক্ষর’ হিসেবে চিহ্নিত। এই গোষ্ঠীর সম্পর্কে আমার গবেষণায় অল্প কিছু তথ্য আছে, কিন্তু প্রমাণ হাতে পাওয়া কঠিন।” এখানে লাবণ্য একটু থামলেন, যেন নিজের ভেতরের দ্বিধা সামলাচ্ছেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, “এবং… আমার ধারণা, আমার নিজের পরিবারের কেউ হয়তো এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।” কথাটি যেন ক্যান্টিনের শান্ত বাতাস কেটে দিল। ঋজু তাকিয়ে রইল লাবণ্যের দিকে, তার চোখে তখন কৌতূহল আর বিস্ময়ের মিশ্রণ।

লাবণ্য কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে নিজের গল্প বলতে শুরু করলেন। “আমার ঠাকুরদা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। ১৯৭১ সালে তিনি প্রায়শই সীমান্তের কাছাকাছি যেতেন, সাহায্যের অজুহাতে। মা বলতেন, তাঁর কাছে অনেক অচেনা মানুষ আসত, আর ঠাকুরদা প্রায়ই তাদের সঙ্গে লম্বা আলোচনায় বসতেন। একদিন তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, আর আর ফিরে আসেননি। পরিবারের মধ্যে কেউ কিছু স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। কিছুদিন পর মা একটি পুরনো কাঁথা খুঁজে পান, যেটি পরে হারিয়ে যায়। তখন আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু মনে আছে, সেই কাঁথার প্যাটার্ন ছিল অদ্ভুতভাবে জটিল—যেমনটা আপনার এই কাঁথায় দেখা যাচ্ছে।” লাবণ্যের চোখে তখন হালকা কুয়াশা—অতীতের অজানা বেদনা। “হয়তো কাকতালীয়, হয়তো না,” তিনি বললেন, “কিন্তু আমি নিশ্চিত, যদি এই কাঁথার বার্তা পুরোপুরি ডিকোড করা যায়, তাহলে শুধু আপনার দিদিমার গল্পই নয়, আমার পরিবারের ইতিহাসের এক হারানো অধ্যায়ও উন্মোচিত হবে।” ঋজু তখন অনুভব করল, এই অনুসন্ধান কেবল প্রযুক্তি আর ইতিহাসের খোঁজ নয়—এটি ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্মৃতির গভীরে প্রবেশ করার এক যাত্রা, যা হয়তো কারও জীবন বদলে দিতে পারে।

দুপুরের দিকে ঋজুর ঘরে বসে লাবণ্য আর সে দু’জনে কাঁথার ছবিগুলো বিশ্লেষণ করছিল। জানালার বাইরে শান্তিনিকেতনের শিমুলগাছের ডালে পাখিরা ডাকছে, কিন্তু ঘরের ভেতরে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল প্রতিটি নতুন ডেটা লাইন স্ক্রিনে ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। ঋজুর ডিকোডিং সফটওয়্যার ধীরে ধীরে রঙের বিন্যাসকে বাইনারি ডেটায় রূপান্তর করছিল, আর লাবণ্য তার পাশে বসে প্রতিটি সিকোয়েন্সকে নোট করছিল। হঠাৎই ঋজুর চোখে পড়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে এক ঝলক অদ্ভুত মেসেজ—“Unauthorized access detected.” সে প্রথমে ভেবেছিল হয়তো সফটওয়্যার গ্লিচ, কিন্তু তারপরই নেটওয়ার্ক মনিটর খুলে দেখে একাধিক অচেনা IP ঠিকানা তার সিস্টেমে সংযোগের চেষ্টা করছে। লাবণ্য কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “এটা কি মানে কেউ আমাদের লাইভ ট্র্যাক করছে?” ঋজুর গলায় শুষ্কতা—“হ্যাঁ, আর খুব প্রফেশনাল লেভেলে।” তারা তাড়াহুড়ো করে ওয়াই-ফাই বন্ধ করে দিল, কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যেই মনে হল, হয়তো ইতিমধ্যে কেউ প্রয়োজনীয় ডেটা কপি করে নিয়েছে।

ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এল। ঋজু দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে এক লম্বা, গম্ভীর মুখের মানুষ—জিন্স আর শার্ট, হাতে ল্যাপটপ ব্যাগ, কিন্তু চোখে এমন সতর্ক দৃষ্টি যেন সবসময় আশেপাশের বিপদ হিসাব করছে। “ঋজু বন্দ্যোপাধ্যায়?”—তিনি প্রশ্ন করলেন। ঋজু মাথা নেড়েই বলল, আর অপরিচিত ব্যক্তি ভেতরে এসে ব্যাজ বের করলেন—“অরিন্দম ঘোষ, সাইবার ক্রাইম সেল। আমাদের আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।” লাবণ্য কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল, “আপনি কিভাবে জানলেন আমরা এখানে?” অরিন্দম গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন, “আমরা আপনার ল্যাপটপে চলমান অননুমোদিত প্রবেশচেষ্টা ট্র্যাক করছিলাম। আপনারা এখন এমন এক ডেটার দিকে হাত দিয়েছেন, যা শুধু ঐতিহাসিক নয়—রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরক। আজও সেই তথ্য ফাঁস হলে অনেকের ক্ষমতার চেয়ারে ধস নেমে আসবে।” তাঁর গলা নিচু হলেও প্রতিটি শব্দে যেন ইস্পাতের সতর্কতা।

ঋজু হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আমরা তো কেবল একটি পুরনো কাঁথার প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করছি!” অরিন্দম গভীর নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “আপনারা হয়তো বুঝতে পারছেন না—এই কাঁথায় লুকানো বার্তা কেবল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়, তৎকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক মহলের এক গোপন অপারেশনের সাথেও যুক্ত। ‘প্রজেক্ট কে’—যেটির নাম আপনার ডিকোডিংয়ে প্রথমবার উঠে এসেছে—এটি এমন একটি মিশন, যা দুই দেশের মধ্যে গোপনে চালানো হয়েছিল, এবং তাতে কয়েকজন উচ্চপদস্থ নেতা, গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি বিদেশি এজেন্ট জড়িত ছিল। এই তথ্য প্রকাশ পেলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব পড়তে পারে।” লাবণ্য কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তাঁর চোখে তখন ভয় ও উত্তেজনার মিশ্র ছায়া—যেন হঠাৎ করে তারা এমন এক খেলায় জড়িয়ে পড়েছে, যার পরিণতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অরিন্দম সোজা তাকিয়ে বললেন, “আমি আপনাদের আটকাচ্ছি না, কিন্তু সতর্ক করছি—আপনাদের ওপর নজরদারি চলছে। যাঁরা এটা করছে, তাঁদের ক্ষমতা আপনার ধারণার বাইরে। সতর্ক থাকুন, আর যদি কাজ চালিয়ে যান, তবে প্রতিটি পদক্ষেপ হিসাব করে ফেলুন।”

অরিন্দম চলে গেলে ঘরের ভেতরে কিছুক্ষণ নীরবতা নেমে এল। লাবণ্য ধীরে ধীরে বলল, “মানে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ কারও চোখে ধরা পড়ছে?” ঋজু জানালার বাইরে তাকাল—শিমুলপাতার ফাঁকে আকাশটা শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন অদৃশ্য ঝড় বইছে। “হ্যাঁ,” সে বলল, “এবং হয়তো এই ঝড় এখন থেকেই শুরু হচ্ছে।” তারা দু’জনই বুঝে গেল, এই অনুসন্ধান এখন আর কেবল গবেষণার বিষয় নয়—এটি ক্ষমতার রাজনীতির অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশের যাত্রা, যেখানে এক ভুল পদক্ষেপ তাদের জীবনই বদলে দিতে পারে। তবু কৌতূহল ও সত্য উদ্ঘাটনের তাগিদ তাদের থামাতে পারল না। লাবণ্য কাঁথাটির দিকে তাকাল—এখন আর সেটা নিছক কাপড়ের টুকরো নয়, বরং এমন এক চাবি, যা অতীতের সবচেয়ে বিপজ্জনক দরজাগুলো খুলে দিতে পারে। তারা সিদ্ধান্ত নিল, খেলা শুরু হয়ে গেছে, আর পিছু হটার আর কোনো পথ নেই।

শান্তিনিকেতনের সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে, পলাশ গাছের পাতাগুলোও যেন সোনালি আলোয় ভিজে উঠেছে। ঋজু সেই দিন বিকেল থেকে দিদিমা অঞ্জনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তিনি প্রতিবারই বিষয় ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন। চায়ের কাপের পাশে বসে অঞ্জনা একদিকে খেজুরগুড় মিশিয়ে রুটি বানাচ্ছিলেন, অন্যদিকে নাতির প্রশ্ন শুনে নির্বিকার মুখে বলছিলেন—“পুরনো কাঁথা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে? ও তো স্রেফ আমার যৌবনের সময়ের সেলাই।” কিন্তু ঋজুর চোখে পড়েছিল, এই কথাগুলো বলার সময় তাঁর আঙুলে হালকা কাঁপুনি। এমনকি সুঁই আর সুতো হাতে নিয়ে সেলাই করার ভঙ্গিমাও যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যাচ্ছিল। ঋজুর মনে হচ্ছিল, দিদিমা কিছু লুকাচ্ছেন—হয়তো এমন কিছু, যা তিনি বলতে ভয় পাচ্ছেন কিংবা বলতে চান না।

রাত গভীর হতে চলেছে। বাড়ির সব আলো নিভে গেছে, শুধু দিদিমার ঘরের দরজার নিচ দিয়ে সামান্য আলো বেরোচ্ছে। ঋজু নিজের ঘরে শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। হঠাৎ করিডোরে খুব হালকা পায়ের শব্দ পেল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, দিদিমা ধীরে ধীরে তাঁর ঘরের দিকে এগিয়ে আসছেন। হাতে ছোট্ট একটা ধাতব বাক্স, আর মুখে এক ধরনের চিন্তিত ছায়া। তিনি বিছানার পাশে এসে বসে খুব আস্তে বললেন, “সব জানতে চাও, তাই তো? কিন্তু যা জানতে চাইছ, সেটা তোমার জন্য নিরাপদ নয়।” ঋজু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অঞ্জনা হাত তুলে থামালেন। তারপর তিনি নিজের শাড়ির আঁচলের ভাঁজ খুলে এক পুরনো, জং ধরা চাবি বের করলেন। চাবিটি ছোট, কিন্তু তাতে খোদাই করা অদ্ভুত কিছু চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল—যেন অক্ষরের চেয়ে প্রতীক বেশি।

চাবির সঙ্গে তিনি ঋজুর হাতে একটি ছোট্ট কাগজও দিলেন, যেটি মোটা ধুলোমাখা কাপড়ের ভেতরে ভাঁজ করা ছিল। কাগজ খুলতেই ঋজুর চোখে পড়ল তির্যক অক্ষরে লেখা একটি মাত্র বাক্য—“সত্য কোথাও সেলাইয়ের মধ্যে নয়, রক্তের মধ্যে লুকানো।” শব্দগুলো যেন কাগজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বুকের মধ্যে ধাক্কা মারল। “এটার মানে কী?”—ঋজু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু অঞ্জনা শুধু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “একদিন বুঝবে। তবে মনে রেখো, সত্য সবসময় কাপড়ের মতো সুন্দর হয় না, অনেক সময় তা রক্তের মতো ভয়ঙ্কর।” তাঁর কণ্ঠে তখন এমন এক মিশ্রণ—মমতা, সতর্কতা, আর গভীর বেদনা—যা ঋজুকে আরও বিভ্রান্ত করে দিল। অঞ্জনা আর কিছু না বলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, তাঁর পায়ের শব্দ করিডোরে মিলিয়ে গেল।

ঋজু বিছানায় বসে রইল, হাতে ধরা চাবি আর কাগজের দিকে তাকিয়ে। মনে হচ্ছিল, এই দুটি বস্তু যেন দিদিমার অতীতের গোপন দরজার চাবি—যা খুললে বেরিয়ে আসবে এমন সব গল্প, যেগুলো কখনও বলা হয়নি। কিন্তু ‘রক্তের মধ্যে লুকানো’—এই কথার অর্থ কী হতে পারে? কি সে কথা ইঙ্গিত করছে কোনো পুরনো হত্যাকাণ্ডের দিকে? নাকি এটি প্রতীকী ইঙ্গিত—যে সত্য আসলে মানুষের বংশ, সম্পর্ক বা বিশ্বাসঘাতকতার গভীরে লুকিয়ে থাকে? জানালার বাইরে শান্তিনিকেতনের রাত তখন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে, কিন্তু ঋজুর মনের ভেতরে শুরু হয়েছে এক নতুন ঝড়। সে জানত, এই রহস্য উন্মোচন করতে হলে কেবল প্রযুক্তি আর কোড ভাঙা যথেষ্ট হবে না—এবার তাকে প্রবেশ করতে হবে অতীতের অন্ধকার স্মৃতির ভেতর, যেখানে দিদিমার নীরবতা হয়তো সবথেকে ভয়ঙ্কর উত্তর লুকিয়ে রেখেছে।

শান্তিনিকেতনের পুরনো পল্লীর সরু গলিপথ ধরে ঋজু ও লাবণ্য হেঁটে যাচ্ছিল। গ্রীষ্মের সকালের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, বাতাসে কাকের ডাক আর দূরের কোলাহল। তাদের গন্তব্য—ডঃ মাধব ঘোষালের বাড়ি, যিনি একসময় বিশ্বভারতীতে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। বাড়িটা ভেতরে বাইরে পুরনো, কিন্তু দেয়ালে সাজানো বইয়ের তাক, ফ্রেমে বাঁধানো বিরল ছবিগুলো জানিয়ে দেয় এখানে সময় যেন থেমে আছে। ডঃ ঘোষাল চশমা ঠিক করে তাঁদের বসতে বললেন, আর কৌতূহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কাঁথার প্যাটার্ন নিয়ে এসেছ?” ঋজু মাথা নেড়ে ল্যাপটপ খুলে সেই ডিজিটাল ইমেজ দেখাল। তিনি ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে ধীরে ধীরে বললেন, “এটা সাধারণ নকশিকাঁথা নয়… এটার ইতিহাস অনেক ভয়ঙ্কর।” লাবণ্য প্রশ্ন করল, “আপনি জানেন এটা কী বোঝাচ্ছে?” ডঃ ঘোষাল কণ্ঠ নিচু করে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, এই কাঁথার সেলাইয়ের মধ্যে লুকানো আছে ১৯৭১ সালের এক হত্যার নথি—এক উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতাকে সরিয়ে দেওয়ার কাহিনি।”

ঋজু ও লাবণ্য বিস্মিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। ডঃ ঘোষাল চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, “সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তীব্র ছিল। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু কাজ করলেও, গোপনে অনেক অপারেশন চলত, যেগুলো শুধু কয়েকজন বিশেষ রাজনীতিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার জানা ছিল। এই হত্যাকাণ্ডও তেমনই একটি ঘটনা। নিহত ব্যক্তি ছিলেন যুদ্ধের সমর্থক, কিন্তু তাঁর কিছু মতভেদ তৎকালীন ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁকে সরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল এক জটিল ষড়যন্ত্র—যেখানে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল এই ধরনের কাঁথা।” লাবণ্য ধীরে বলল, “মানে এই কাঁথা আসলে প্রমাণ?” ডঃ ঘোষাল মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক তাই। এতে লুকানো বার্তাগুলো যদি পুরোপুরি প্রকাশ পায়, তাহলে আজও সেই ঘটনার সাথে যুক্ত পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতা ধ্বসে পড়তে পারে।”

লাবণ্য ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী কে ছিলেন?” ডঃ ঘোষাল এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “তাঁর নাম আমি বলতে পারব না… অন্তত এখনই নয়। তিনি আজও বেঁচে আছেন, এবং পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারের একজন। তাঁর নেটওয়ার্ক এমনভাবে বিস্তৃত যে, কেউ যদি অতীত খুঁটিয়ে দেখতে যায়, সেটি জানার জন্য তাঁর লোকেরা মুহূর্তের মধ্যে হাজির হয়ে যায়।” ঋজুর গলা শুকিয়ে এল—অরিন্দম ঘোষের সতর্কবাণী তখন যেন আবার কানে বাজল। ডঃ ঘোষাল গম্ভীরভাবে যোগ করলেন, “তোমরা যদি এই কোড পুরোপুরি ভাঙতে চাও, তবে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা আগে করতে হবে। কারণ, এই তথ্য ফাঁস হওয়া মানে কেবল ইতিহাস লেখা বদলানো নয়—এটি এমন এক ক্ষমতার খেলা, যেখানে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান খুব সরু।”

সাক্ষাৎকার শেষ হয়ে এলে ঋজু ও লাবণ্য চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরোল। বাইরে রোদ তীব্র, কিন্তু তাঁদের মনে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এসেছে। লাবণ্য ধীরে বলল, “আমাদের কি সত্যিই এগোনো উচিত?” ঋজু কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “আমরা যদি না যাই, তাহলে এই গল্প চিরকাল চাপা থাকবে। কিন্তু ডঃ ঘোষাল যা বললেন, তাতে মনে হচ্ছে… আমরা যতটুকু ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক গভীরে ঢুকে গেছি।” হাঁটতে হাঁটতে তারা পিছনে তাকাল—দেখল, ডঃ ঘোষালের জানালার ফাঁক দিয়ে যেন কেউ তাদের চলে যাওয়া লক্ষ্য করছে। কে জানে, সেই চোখটা কেবল কৌতূহলী বৃদ্ধ অধ্যাপকের ছিল, নাকি ইতিহাসের ছায়া থেকে উঁকি মারা অদৃশ্য কোনো নজরদার।

শান্তিনিকেতনের সেই দুপুরটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে নীরব। আকাশে মেঘ জমে আছে, গাছের পাতায় হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, অথচ পাখিদের ডাকও যেন থেমে গেছে। ঋজু ও লাবণ্য স্থানীয় এক ক্যাফের কোণে বসে কাঁথার নতুন ডিকোডিং ফলাফল নিয়ে আলোচনা করছিল। ল্যাপটপে সেলাইয়ের রঙের বিন্যাসের ওপর চিহ্ন বসিয়ে তারা বুঝতে পেরেছে—এতে কিছু সমন্বিত স্থানের মানচিত্র ও তারিখ লুকানো আছে। ঠিক সেই সময়, দরজার ওপাশে দাঁড়ানো এক কালো দোপাটি মাথায় বাঁধা লোককে ঋজুর চোখে পড়ে। তার মুখ অর্ধেক ঢাকা, শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঝলসে উঠছে। লোকটি নিঃশব্দে ক্যাফের ভেতরে ঢুকল, আর তার সঙ্গে আরও দু’জন। তাদের আচরণে কোনো দ্বিধা নেই, যেন তারা জানে কার কাছে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে ঋজুর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল—এটাই কি সেই অজ্ঞাত প্রতিপক্ষ, যার কথা ডঃ ঘোষাল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?

লোকটি কোনো কথা না বলে হঠাৎ লাবণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তার হাতে থাকা কাঁথাটি টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। চেয়ার উল্টে গেল, কফি মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল, আর ক্যাফের অন্য ক্রেতারা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। লাবণ্য প্রতিরোধ করল, কিন্তু লোকটির শক্তি ছিল প্রচণ্ড। ঋজু চটজলদি উঠে তার বাহু ধরে টেনে সরিয়ে দিল, আর নিজের কাঁধ দিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে দূরে ঠেলে দিল। সেই ধাক্কায় কালো দোপাটি পরা লোকটি দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল, কিন্তু তার চোখে কোনো ভয়ের ছাপ নেই—বরং এক শীতল দৃঢ়তা। তখন তার সঙ্গীরা সামনে এসে দাঁড়াল, যেন যেকোনো মুহূর্তে তারা লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। হঠাৎ বাইরে পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। অজানা কারণে, কালো দোপাটির দল একে অপরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত সরে গেল, দরজা দিয়ে বেরিয়ে জনতার ভিড়ে মিলিয়ে গেল।

হামলার সময় লাবণ্যের কনুইতে গভীর ক্ষত হয়েছে, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঋজু আতঙ্কিত হয়ে তার ক্ষতস্থানে হাত চেপে ধরল, আর ক্যাফের এক কর্মী ফার্স্ট এইড কিট এনে দিল। “তুমি ঠিক আছ তো?” ঋজুর কণ্ঠ কেঁপে উঠল। লাবণ্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি ঠিক আছি… কিন্তু তারা কারা ছিল?” ঋজু গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “কালো দোপাটি… মনে হচ্ছে, এরা শুধু ইতিহাস চাপা দেওয়ার জন্য নয়, বরং এমন এক নেটওয়ার্কের অংশ যারা এখনও সক্রিয়।” লাবণ্য ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “মানে?” ঋজু বলল, “মানে আমরা শুধু অতীতের একটি হত্যাকাণ্ডের সূত্রই খুঁজছি না… আমরা এমন এক গোপন সংগঠনের মুখোমুখি হয়েছি, যেটা বর্তমানেও ক্ষমতা ধরে রেখেছে—আর এই রহস্য ফাঁস হলে তাদের পতন নিশ্চিত।” লাবণ্যের চোখে তখন ব্যথার পাশাপাশি দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল, যেন এই আঘাতই তার সংকল্পকে আরও শক্ত করেছে।

সেদিন রাতের দিকে ঋজু কাঁথা, চাবি আর অঞ্জনার দেওয়া নোট আবার টেবিলে রাখল। হামলার পর থেকে তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে—তারা কেন এত মরিয়া হয়ে এই কাঁথা নিতে চাইছিল? কালো দোপাটি শুধু একজন ভাড়াটে নয়, বরং এই ঘটনার মূল রক্ষক, যে যেকোনোভাবে প্রমাণ মুছে ফেলতে চায়। জানালার বাইরে অন্ধকারে মাঝে মাঝে সিলুয়েট নড়তে দেখা যাচ্ছে, যেন কেউ বাড়ির চারপাশে ঘুরছে। ঋজু বুঝল, এখন তাদের সময় খুব সীমিত—প্রতিটি পদক্ষেপ হিসেব করে নিতে হবে। লাবণ্য ঘরে এসে ধীরে বলল, “আমরা যদি পিছু হটি, তাহলে হয়তো তারা শান্ত হবে। কিন্তু আমি মনে করি, এবার থামা যাবে না।” ঋজু চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। দু’জনই জানত, কালো দোপাটির ছায়া এখন থেকে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে লেগে থাকবে, আর এই লড়াই শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়—সত্য উন্মোচনের জন্যও।

রাতের অন্ধকারে ঋজুর ঘরে শুধু ল্যাপটপের স্ক্রিনের নীলচে আলো ছড়িয়ে আছে। টেবিলের ওপর কাঁথাটি মেলে রাখা, আর তার পাশে নোটবুক ভর্তি কোড, চিহ্ন, ও অসম্পূর্ণ ডিকোডিং ধাপ। গত কয়েকদিন ধরে ঘুম ত্যাগ করে সে একটার পর একটা লেয়ার ভেঙেছে, কিন্তু শেষ স্তরটি যেন এক অদ্ভুত গোলকধাঁধা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল—লাল সুতোয় তৈরি এক ক্ষুদ্র পুনরাবৃত্ত সেলাই, যা আগে তার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। সেই প্যাটার্নটি একটি প্রাচীন সাইফার পদ্ধতির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে—‘Playfair Cipher’। ঋজু দ্রুত অ্যালগরিদম চালিয়ে কোডের পাঠোদ্ধার করল, আর লাইন বাই লাইন মিলিয়ে দেখতে দেখতে তার বুকের ধুকপুকানি বাড়ল। ডিকোডিং শেষে যে লাইনটি সামনে এল, তা ছিল এক ঠিকানা—শান্তিনিকেতনের প্রান্তে অবস্থিত বহু বছর ধরে বন্ধ একটি বাড়ির নাম ও অবস্থান, যা স্থানীয়রা ‘সদরপুর বাড়ি’ নামে চেনে।

পরদিন ভোরেই ঋজু ও লাবণ্য সেই স্থানের দিকে রওনা দিল। পথটি যত এগোতে লাগল, চারপাশে সভ্যতার চিহ্ন তত ক্ষীণ হয়ে এল—পাকা রাস্তা শেষ হয়ে মাটির সরু পথ, ঝোপঝাড়ে ঢেকে থাকা পুরনো গাছপালা, আর ভাঙা দেওয়ালের পাশ দিয়ে লতাপাতা ঝুলছে। সদরপুর বাড়িটি দূর থেকে দেখা যেতেই লাবণ্যের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল—দোতলা পরিত্যক্ত কাঠামো, জানালার কাচ ভাঙা, দরজার রঙ উঠে গেছে, আর ভেতরে ঢোকার পথে শ্যাওলায় ঢাকা সিঁড়ি। তালা লাগানো মূল দরজা ঋজুর হাতে থাকা অঞ্জনার দেওয়া চাবিতেই খুলে গেল, যেন এতদিন ধরে সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল। ভেতরে ঢুকে তারা লক্ষ্য করল—ঘরগুলো ধুলায় ঢাকা, তবুও এক অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া ভেতরে বইছে, যেন অতীতের ছায়া এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ঋজু কাঁথার নির্দেশ মতো ঘরের ভেতরের মেঝেতে চিহ্নিত টাইলস গুনতে শুরু করল। পঁচিশ নম্বর টাইলের কোণে দাঁড়িয়ে সে নিচের মেঝেতে একটি ফাঁপা শব্দ শুনল। তারা একসঙ্গে মেঝের পাত খোলার চেষ্টা করল, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি পুরনো কাঠের বক্স—ধুলায় আচ্ছাদিত, কিন্তু তালাবদ্ধ নয়। বক্সটি খুলতেই লাবণ্যের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। ভেতরে ছিল হলদেটে হয়ে যাওয়া কয়েকটি চিঠি, কিছু পুরনো অডিও টেপ, আর একটি ফটোগ্রাফ—যেখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সালের সেই রাজনৈতিক নেতা, যার হত্যার কথা ডঃ ঘোষাল বলেছিলেন। চিঠিগুলোর মধ্যে একটি ছিল নেতার নিজের হাতের লেখা, যেখানে তিনি তাঁর জীবনের ঝুঁকি ও ষড়যন্ত্রের কথা লিখেছেন। অডিও টেপে সম্ভবত তার শেষ কথোপকথন রেকর্ড আছে, যা প্রমাণ করে ঠিক কারা তার মৃত্যুর পরিকল্পনা করেছিল।

লাবণ্য বক্সের ভেতরের প্রতিটি জিনিস সাবধানে হাতে তুলে নিচ্ছিল, আর ঋজুর মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে তাদের হাতে শুধু ইতিহাস নয়, এক ভয়ঙ্কর শক্তির চাবিকাঠি এসে গেছে। কিন্তু আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে শীতল ভয়ের শিহরণও বইল—কারণ তারা জানে, কালো দোপাটি ও তার নেটওয়ার্ক এই প্রমাণ উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে আছে। লাবণ্য ফিসফিস করে বলল, “এগুলো প্রকাশ পেলে সব বদলে যাবে… কিন্তু আমরা কি নিরাপদে পৌঁছতে পারব?” ঋজু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল—দূরে মাটির পথের ধুলো উড়ছে, যেন কেউ দ্রুত এগিয়ে আসছে। তাদের সময় শেষ হয়ে আসছে, আর এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ হবে জীবন-মৃত্যুর বাজি।

বিকেলের শেষ আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল, যখন ঋজু ও লাবণ্য সদরপুর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা বক্স হাতে কলকাতার দিকে ফিরছিল। তারা জানত, প্রমাণ এখন পুলিশের হাতে পৌঁছে দিতে হবে, আর এই কাজে অরিন্দমই সবচেয়ে ভরসাযোগ্য। শহরে ফিরে এক নির্জন ফ্ল্যাটে, অরিন্দম সতর্ক দৃষ্টিতে বক্সের ভেতরের চিঠি ও অডিও টেপ পরীক্ষা করছিল। তার মুখে উদ্বেগ আর তীব্র মনোযোগ মিলেমিশে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি তৈরি করেছিল। “এগুলো নিখুঁত প্রমাণ,” সে বলল, “যদি ঠিকমতো প্রকাশ পায়, তাহলে পঞ্চাশ বছরের পুরনো মিথ্যা ভেঙে যাবে।” কিন্তু কথা শেষ হতেই হঠাৎ বাইরের সিঁড়িতে ভারী পদশব্দ শোনা গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঘরের চারপাশে অন্ধকার পোশাক ও মুখোশ পরা কয়েকজন ঢুকে পড়ল—কালো দোপাটির দল। হাতে ছুরি, লোহার রড, আর চোখে নির্দয় ঠাণ্ডা দৃষ্টি।

তাদের নেতা, মুখে কালো কাপড় জড়ানো, সরাসরি ঋজুর দিকে এগিয়ে এসে বলল, “বক্সটা দাও, আর সব ভুলে যাও। নইলে কেউ বাঁচবে না।” লাবণ্য প্রমাণ আঁকড়ে ধরে দাঁড়াল, আর অরিন্দম এগিয়ে এসে তাদের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল। সংঘর্ষ শুরু হল হঠাৎ, টেবিল উল্টে গেল, কাঁচ ভাঙল, আর ঘরের ভেতর এক বিশৃঙ্খল যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হল। কিন্তু সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই অরিন্দমের হাত মুখোশধারী নেতার গলায় গিয়ে পড়ল, আর এক টানে কাপড় খুলে গেল। মুহূর্তেই ঘরে নেমে এল নীরবতা—কারণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে অরিন্দম চেনে। চোখে বিস্ময় ও শোক নিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, “মীরা…?” ঘরের সবার শ্বাস আটকে গেল। মীরা ঘোষ, অরিন্দমের বহু বছর আগে নিখোঁজ হওয়া বোন, যাকে পরিবার মৃত ভেবেছিল, আজ দাঁড়িয়ে আছে তাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রুর রূপে।

মীরার চোখে ভাসছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা আক্রোশ। সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি জানো না, অরিন্দম, তোমার সেই নায়ক বাবা আসলে কেমন ছিলেন। এই প্রমাণ প্রকাশ হলে যা ঘটবে, তা শুধু আমাদের পরিবার নয়, অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের জীবন ধ্বংস করবে। তিনি যেভাবে মারা গেছেন, সেটাই ছিল ন্যায্য। কিন্তু যদি তোমরা এই মিথ্যে সত্যি বানিয়ে দাও, তাহলে আমাদের দেশের ইতিহাস ভেঙে পড়বে।” অরিন্দম অবাক হয়ে বলল, “তুমি কি বলছ? বাবা ভুলভাবে খুন হননি?” মীরা মাথা নেড়ে বলল, “তিনি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন, আর তাঁর মৃত্যু সেই শৃঙ্খল ভাঙার জন্যই প্রয়োজন ছিল।” ঋজু ও লাবণ্য নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল—তাদের হাতে ধরা প্রমাণ কি সত্যিই সত্য, নাকি ইতিহাসের আরেকটি কৌশল?

মুহূর্তটি ছিল ভারী, কিন্তু সময় ছিল না। কালো দোপাটির বাকি সদস্যরা আবার এগিয়ে এল, আর ঘরে ফের লড়াই শুরু হল। এবার অরিন্দম দ্বিধাহীন—সে তার বোনকে আঘাত করতে চায়নি, কিন্তু প্রমাণ রক্ষা করাও জরুরি। অবশেষে পুলিশের সাইরেনের শব্দ ভেসে আসতে লাগল, হয়তো অরিন্দমের আগে থেকে ডাকা ব্যাকআপ এসে গেছে। মীরা শেষবারের মতো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি সত্য খুঁজছ, কিন্তু মনে রেখো—সত্য সবসময় মুক্তি দেয় না, কখনও কখনও তা ধ্বংস আনে।” এই বলে সে ধোঁয়ার গ্রেনেড ছুড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, তার দলসহ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ঋজু বুঝল, তাদের সামনে এখন আরও জটিল খেলা অপেক্ষা করছে—যেখানে শত্রু শুধু ইতিহাস নয়, রক্তের বন্ধনও।

১০

শীতের এক ধূসর সকালে, কলকাতার সেশন কোর্টে ছিল অস্বাভাবিক ভিড়। প্রমাণের বক্স, পুরনো চিঠি, অডিও টেপ—সবই আদালতের নিরাপত্তা কক্ষে রাখা। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনের ঝলকানির মধ্যে ঋজু ও লাবণ্য দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে, আর অরিন্দম পুলিশের কনভয়ে প্রমাণ আদালতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বিচারপতি ধীর কণ্ঠে মামলার প্রাথমিক বিবরণ পড়লেন, যেখানে ১৯৭১ সালের সেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কথা উঠে এল—যা এতদিন গুজব বলে চাপা ছিল। অডিও টেপ চালু হতেই যেন অতীতের দরজা খুলে গেল; তাতে ধরা পড়ল ষড়যন্ত্রের স্পষ্ট পরিকল্পনা, যেখানে একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত। আদালতের ভেতর ফিসফিসানি ছড়িয়ে পড়ল, সাংবাদিকেরা নোট লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঋজুর মনে হচ্ছিল, যেন দিদিমার কাঁথার প্রতিটি সেলাই থেকে বেরিয়ে আসছে ইতিহাসের দীর্ঘদিনের বন্দি কণ্ঠস্বর।

সাক্ষ্যগ্রহণ চলতে থাকল, আর প্রমাণ একে একে প্রকাশিত হতে লাগল। লাবণ্য লক্ষ্য করছিল, কিছু মানুষের মুখে আতঙ্কের ছায়া—যেন তারা হঠাৎ করে প্রকাশ্যে আসা এই সত্য মেনে নিতে পারছে না। অরিন্দম দৃঢ়ভাবে সাক্ষ্য দিলেন, কীভাবে তদন্ত চলেছে, এবং কীভাবে সেই কাঁথার এনক্রিপশন থেকে এই প্রমাণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিচ্ছিলেন, যদিও ভিতরে ভিতরে হয়তো ভাই-বোনের সংঘর্ষের ভার এখনও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। আদালতের একপাশে বসে থাকা মীরা চুপচাপ সব শুনছিল, তার চোখে কোনো অনুতাপ নেই—শুধু এক অদ্ভুত স্বস্তি, যেন সে জানে সত্য প্রকাশ পেলেও ইতিহাস তার নিজের মতো করে বেঁচে থাকবে।

সব প্রমাণ আদালতে উপস্থাপিত হওয়ার পর, বিচারপতি তাঁর রায়ে বললেন—এই হত্যাকাণ্ড ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনা, যেখানে ক্ষমতার লোভ, যুদ্ধকালীন অস্থিরতা, এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা একসূত্রে গাঁথা হয়েছিল। একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলেন, আর ইতিহাসের এক লুকোনো অধ্যায় প্রকাশিত হল আনুষ্ঠানিকভাবে। কিন্তু বাইরে বেরোতেই ঋজু অনুভব করল, রাস্তায় দাঁড়ানো সাধারণ মানুষদের মুখে নেই বিজয়ের উল্লাস—বরং বিভ্রান্তি ও অস্বস্তি। লাবণ্য তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমরা কি সত্যিই সব উন্মোচন করলাম, নাকি শুধু এক মুখোশ সরিয়ে আরেকটা দেখালাম?” ঋজু উত্তর দিল না, কারণ তার নিজের মনেও একই প্রশ্ন ঘুরছিল।

সন্ধ্যার আলোয়, শান্তিনিকেতনের বাড়িতে ফিরে, অঞ্জনা ধীরে ধীরে পুরনো নকশিকাঁথা হাতে তুলে নিলেন। তাঁর আঙুলের ডগা প্রতিটি সেলাই স্পর্শ করছিল, যেন অতীতের প্রতিটি মুহূর্ত আবার অনুভব করছেন। চুপচাপ বসে থেকে তিনি হঠাৎ বললেন, “যতদিন ইতিহাসের ক্ষত সেলাই দিয়ে ঢাকা থাকবে, ততদিন নতুন কোডের জন্ম হবে।” তাঁর চোখে ঝলসে উঠল বেদনা ও জ্ঞানের মিশ্রণ। ঋজু ও লাবণ্য একে অপরের দিকে তাকাল—তারা বুঝল, সত্য কোনো সমাপ্তি নয়, বরং এক অনন্ত চক্র, যেখানে প্রতিটি উন্মোচনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে পরবর্তী রহস্যের বীজ। আর সেই মুহূর্তে, ঘরের এক কোণে রাখা কাঁথার নিচে, যেন আবার এক নতুন সেলাইয়ের রেখা চোখে পড়ল—যা হয়তো আরেকটি অজানা গল্পের শুরু।

শেষ

1000051290.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *