Bangla - রহস্য গল্প

নকশাল বাড়ির নোটবুক

Spread the love

কৌশিক দে


সকাল নয়টা বাজতেই টয় ট্রেন-এর চেনা বাঁশির শব্দে কেঁপে উঠেছিল দার্জিলিং শহর, কিন্তু সেই শব্দও যেন পৌঁছাতে পারেনি কুয়াশার মোটা চাদর ভেদ করে। পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে ওঠা রাস্তার দু’পাশে পাইন গাছের সারি যেন দিনের আলোকে আড়াল করে রেখেছিল। শীতে জমে যাওয়া আঙুলগুলো পকেটেই রাখা থাকলেও, ঈশান চট্টোপাধ্যায়ের মন ছিল উত্তেজনায় গরম। এই শীতে পাহাড়ে আসা পর্যটকেরা হয়তো ঘোরাঘুরি আর হট চকোলেটে মশগুল, কিন্তু ঈশানের ভ্রমণ ছিল একেবারেই অন্যরকম। সে ইতিহাসের ছাত্র, এখন গবেষক—কলকাতার প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার। তার থিসিস: “নকশাল আন্দোলনের আঞ্চলিক বিস্তার ও অপ্রকাশিত স্মৃতি”। এই বিষয়েই তথ্য খুঁজতে সে পৌঁছেছে ডার্জিলিংয়ের কাছে, ঘন বন আর ছায়াঘেরা একটি কলোনিয়াল বাড়িতে, যেটি এখন সরকারি রেকর্ডে “পরিত্যক্ত” আর স্থানীয় লোকের কাছে “অভিশপ্ত”। সেবছরের নভেম্বরের সকাল ছিল নির্জন, পাখিরাও হয়তো পাহাড় ছেড়ে অন্য কোথাও উড়ে গেছে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে ঈশানের গাড়ি যখন সেই পুরনো ‘লালবাড়ি’র সামনে এসে দাঁড়াল, তার কাঁধের ব্যাগের ভেতরে ইতিহাসের পাতাগুলো যেন নিজেদের খুলে ধরতে চাইছিল।

বাড়িটা ছিল পুরনো ব্রিটিশ আমলের—দোতলা কাঠের ফ্রেমে বানানো, খোঁজে পাওয়া গেছে ১৮৮৩ সালের এক আর্কিটেকচারের খসড়া। বাড়ির বাইরে রঙ চটে যাওয়া রেলিং, ভেঙে পড়া বারান্দা আর জানালাগুলো বন্ধ, তবু তার ভিতর থেকে যেন কোনো চোখ তাকিয়ে আছে। ঈশান জানত এই বাড়িটিকে আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করত ৭০-এর দশকে পাহাড়ি অঞ্চলে কাজ করা কিছু নকশালপন্থী তরুণ—তাদের মধ্যে কিছু বাঙালি ছাত্রও ছিল। সরকারি বাহিনী যখন এই বাড়িতে অভিযান চালায়, তখন বলা হয় কেউ ছিল না—তবে ঈশান তার গবেষণার সূত্রে পেয়েছে এমন কিছু চিঠি ও অননুমোদিত রিপোর্ট, যা বলছে ঠিক তার উল্টো কথা। তার কাছে এই বাড়ি শুধুমাত্র এক ভগ্নদশা বাড়ি নয়—এ এক দল চাপা পড়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরের হাহাকার। বাড়ির দরজা ঠেলে ঢোকার সময় তার গায়ে কেমন একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেল, যেন দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা ছত্রাক আর ধুলো মিলে একধরনের অস্পষ্ট অতীতের গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই সে খেয়াল করল—একটা কাঠের টেবিল এখনও দাঁড়িয়ে আছে, ধুলোয় ঢাকা, কিন্তু কোন একদিনের মতো যেন ঠিক অপেক্ষা করছিল তার জন্যেই। ঈশান ধীরে ধীরে চারপাশে তাকাল, আর তার চোখ গিয়ে ঠেকল ঘরের এক কোণে—অর্ধেক খোলা একটা কাঠের আলমারি।

আলমারির ভেতর কিছুই নেই বললেই চলে—কয়েকটা পুরনো জীর্ণ শাল, ছেঁড়া খবরের কাগজের টুকরো, আর ঠিক তলানিতে রাখা একটি কালচে লাল রঙের চামড়ার বাঁধাই খাতা। ঈশান যখন সেটা হাতে তুলল, তখন তার পাতাগুলোর গন্ধে একটা পুরনো ঘামের গন্ধ ভেসে এল, আর খাতার মলাট খুলতেই সে বুঝল—এটা কোনো সাধারণ ডায়েরি নয়। প্রথম পাতায় লেখা—“এই কাহিনি যদি কেউ কখনো খুঁজে পায়, জেনে রাখিস, আমরা ভুল পথে যাইনি। ইতিহাস আমাদের ভুলে যাবে, কিন্তু রক্ত ভুলে না।” লেখাটা ছিল বাংলা আর ইংরেজির মিশেলে, তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল লেখকের নামের জায়গায় কেবলমাত্র একটি অক্ষর লেখা—‘R’। ঈশান দ্রুত কয়েকটি পাতা উলটে দেখতে লাগল। নোটবুকে লেখা রয়েছে তারিখ, স্থান, এমনকি পরিকল্পনার খসড়া পর্যন্ত। কোথাও লেখা—”ডিআইবির এক এজেন্ট আমাদের ভিতরে ঢুকেছে”, আবার কোথাও—”শোভার ঘরেই কেবল নিরাপদ কথা হয়”। ঈশান বুঝতে পারছিল, এ এক ধ্বংসপ্রাপ্ত যুগের সাক্ষ্যপত্র, যার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে গোপন রক্তপাত, বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতিশোধের পাঁজর ভাঙা শব্দ।

নোটবুকটা হাতে নিয়েই যেন ঈশান সময়ের অন্য এক মাত্রায় পা রাখল। ঘরের দেয়ালগুলো যেন তার দিকে এগিয়ে আসছিল, নীরবতার ভেতরে কোথাও এক অশরীরী পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। সে জানত, এখানে থাকার মানে শুধুই অতীতকে পর্যবেক্ষণ করা নয়—বরং তার মধ্যে ঢুকে পড়া, তার ভেতরের লুকোনো শব্দগুলোকে জীবন্ত করা। এমন সময় হঠাৎ এক দমকা বাতাস জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকল, আর ঘরের কোণের ভাঙা আয়নাটা কেঁপে উঠল। সেই আয়নায় ঈশান নিজেকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গেল—সে দেখতে পেল যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি ছায়া, যার চোখ নেই, মুখ নেই—শুধু একটানা তাকিয়ে রয়েছে তার দিকেই। সে জানে, যা সে খুঁজতে এসেছে, তা কেবল ইতিহাস নয়—বরং একটি অসমাপ্ত চিৎকার, যা এতদিন পাহাড়ের গায়ে পাথরের মতো চেপে ছিল। ডার্জিলিংয়ের কুয়াশা ধীরে ধীরে বাড়ির দেয়ালের ভেতর ঢুকে পড়ছিল, আর ঈশান বুঝতে পারছিল, তার এই যাত্রা কেবল গবেষণার নয়—এ এক অভিযাত্রা, যার শেষে আছে এক গোপন সত্যের চিৎকার।

বাড়ির ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে অনিয়মিত ছন্দে—তবে যেন তাতে এক ধরনের অস্থিরতা লুকিয়ে ছিল। ঈশান রাতে ঘুমোতে পারেনি, নোটবুকটা তার বিছানার পাশেই রাখা ছিল, আর তার চোখ তখনও ডুবে ছিল পাতায় পাতায় লেখা অস্পষ্ট ভাষার মধ্যে। কিছু কিছু জায়গায় লাল কালিতে টানা দাগ—যেন লেখক রাগে বা ভয়ে জোরে লিখে ফেলেছে। কিছু শব্দ ছিল এভাবেই লেখা: “ঘিরে ফেলেছে”, “ও বিশ্বাসঘাতক”, “আজ রাতেই শেষ করতে হবে”। তারিখগুলো খেয়াল করলে বোঝা যায়, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়িটিতে কিছু বড় ঘটনা ঘটেছিল—শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর বেঁচে থাকার লড়াইও তাতে মিশে গিয়েছিল। ঈশানের মনে হল, এই ডায়েরির লেখক শুধু একজন নকশালপন্থী নয়, বরং একজন ভাঙা মানুষ, যার ভেতরে প্রতিনিয়ত ছিন্নভিন্ন হচ্ছিল আদর্শ আর বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। সকালে, এক কাপ গরম লেবু চা হাতে নিয়ে যখন সে বাড়ির পেছনের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন পাহাড়ের নিচে শহরের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল—এই পুরনো বাড়ির দেওয়ালের ভেতরে এমন এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে, যেটা শুধু কাগজে লেখা নেই, বরং আজও নিঃশব্দে চিৎকার করে।

ঈশান সেই দিন নোটবুকের লেখাগুলো সঙ্গে নিয়ে বাইরে বের হলো স্থানীয় রেকর্ড অফিস আর লাইব্রেরির খোঁজে। দার্জিলিংয়ের পুরনো প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে সে খুঁজতে লাগল ১৯৭০–৭৫ সালের খবরের কাগজ, পুলিশ রিপোর্ট, ও ভূমি রেকর্ড। কিন্তু অধিকাংশ তথ্য হয় হারিয়ে গেছে নয়ত ‘সুরক্ষিত’ বলে লুকিয়ে রাখা। একজন প্রবীণ কর্মচারী—কামরুজ্জামান—তাকে জানালেন যে, “লালবাড়ির” বিষয়ে অনেকেই আগ্রহ দেখিয়েছে, কিন্তু ফাইলের পাতাগুলো সব একসময় ‘রক্ষণাবেক্ষণের জন্য’ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কলকাতার রাজ্য আর্কাইভে—তারপর আর ফেরত আসেনি। ঈশান যখন রীতিমতো হতাশ, তখন সেই কামরুজ্জামানই ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এসে বললেন, “একটা জিনিস দেখাতে পারি, কিন্তু আমার নাম যেন কোথাও না আসে।” পুরনো চায়ের কৌটোর ভেতর থেকে তিনি বের করলেন একটি হলুদ হয়ে যাওয়া নিউজ ক্লিপিং—তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। হেডলাইন: “ছয় যুবক নিখোঁজ: দার্জিলিংয়ে সন্দেহের বাতাবরণ।” আর তার নিচে ছোট করে লেখা ছিল, “গভীর রাতে অভিযানের খবর অস্বীকার করল জেলা পুলিশ”। ঈশান রীতিমতো শিউরে উঠল—কারণ এই দিনটি ঠিক মিলিয়ে যায় নোটবুকের সেই পাতার সঙ্গে, যেখানে লেখা ছিল, “আজ রাতেই নামবে তারা, একটাও বাঁচবে না যদি আমাদের চিহ্ন পায়।”

রাত নামার আগে ঈশান আবার সেই নোটবুক হাতে নিয়ে ঘুরতে লাগল বাড়ির একতলার ঘরগুলো—তার লক্ষ্য: সেই ঘর, যেখানে ডায়েরির লেখক লিখেছিল, “শুধু শোভা’র ঘরে কথা বলি। জানলা থেকে পাহাড় দেখা যায়।” অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে একটি ঘর খুঁজে পেল যার জানলা দিয়ে সোজা তাকালে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার গা ছুঁয়ে থাকা সাদা মেঘ। সেই ঘরের এক কোণে একটি কাঠের ট্রাঙ্ক পড়ে ছিল—দেওয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা, ধুলো ও জালপড়া অবস্থায়। ঈশান দম বন্ধ করে ট্রাঙ্কটা খুলে দেখল—ভিতরে কিছু পুরনো কাগজ, হাতে আঁকা ম্যাপ, আর একটা ছোট্ট খাম—যার গায়ে লেখা: “বি-কে বিশ্বাস করিস না।” ভিতরে ছিল একটা পুরনো নীল ইস্কুল ব্যাজ, আর সঙ্গে একটি ছেঁড়া ছবি—তিনজন তরুণ, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে, পিছনে পাহাড়। তাদের একজন সম্ভবত ছিল সেই ‘R’। ঈশান জানত না সে ঠিক কাকে খুঁজছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়ি তাকে কিছু একটা দেখাতে চাইছে—বাড়ি যেন তার ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে চায়, কিন্তু নিজের ভাষায় নয়, বরং অস্পষ্ট ছায়া ও ঘ্রাণের মাধ্যমে।

রাতটা ছিল অস্বাভাবিক ঠান্ডা, অথচ ঈশানের শরীরের মধ্যে এক অজানা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছিল—একধরনের চেতনা, যা গবেষকের থেকে বেশি একজন সাক্ষীর মতো করে ভাবতে বাধ্য করছিল তাকে। তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়িতে এখনো কেউ আছে। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ জানালায় কিছু শব্দে—সে ছুটে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল, কিন্তু বাইরের অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। তবে ফিরে এসে খেয়াল করল, নোটবুকটা ঠিক যেমন করে সে রেখেছিল, তেমন নেই—পাতা উলটে গেছে, আর যেখানে সে শেষ পড়েছিল তার থেকে দুই পৃষ্ঠা পর একটা নতুন লাইন দেখা যাচ্ছে: “যদি তুই শুনতে পাচিস, জানবি আমি মরিনি—আমাকে খুঁজে পাবি পাহাড়ের নিচে।” ঈশান বুঝতে পারল, ইতিহাসের সঙ্গে সে আর দূর থেকে কথা বলছে না—সে এখন তার অংশ হয়ে গেছে। লালবাড়ি তাকে টেনে নিচ্ছে এক ভয়ংকর গভীরতায়, যেখানে সত্য শুধু গোপন নয়, বরং জীবিত।

সকালের রোদ যখন ধীরে ধীরে কুয়াশা সরিয়ে ফেলছে, তখন লালবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঈশান ভাবছিল—কে এই ‘R’? কে বা কারা ছিল সেই নিখোঁজ ছয়জন? আর কেনই বা কেউ চাইছে না এই ইতিহাস সামনে আসুক? তার মাথায় তখনও ঘুরছিল সেই শেষ লাইনের কথাগুলো—“আমাকে খুঁজে পাবি পাহাড়ের নিচে।” এই ‘পাহাড়ের নিচে’ কি শুধুই রূপক? না কি সত্যিই কোথাও কিছু পুঁতে রাখা আছে? ঈশান ঠিক করল, আজই সে বের হবে বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে—দেখবে পুরনো কোনও গোপন কুঠুরি, পথ, না হয় বাংকারের মতো কিছু আছে কি না। সঙ্গে নোটবুক, ম্যাপ আর সেই ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া ছবি। সে বুট পরে, শাল মুড়ি দিয়ে, খাতা ব্যাগে নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল—সেই জায়গায় যেখান থেকে এককালে লোকজন বলত ‘বিপদের চিহ্ন’ আছে। সেখানেই একসময় নিয়মিত পাহারা বসত। এখন শুধুই আগাছা, ঝোপঝাড়, আর মৃত পাথর।

পাহাড়ের নিচে নামার সময় ঈশান এমন এক জায়গায় পৌঁছল, যেখানে মাটির ওপর অদ্ভুত ছোপ ছোপ দাগ, ঘাস বেড়ে উঠেছে অনিয়মিতভাবে, আর একপাশে পাইন গাছের গুঁড়ির কাছে কিছু ইট, যা দেখে মনে হয় কোনও নির্মাণ একসময় ছিল—বা ধ্বংস হয়েছিল। সে নোটবুকে টোকা দিয়ে মিলিয়ে দেখল—একটি স্কেচ ছিল যেখানে এ ধরনের গাছ, ইট ও একটি ছোটো পাথরের চূড়ার উল্লেখ ছিল। সে ধীরে ধীরে ঘাস সরিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল—প্রথমে শুধু কৌতূহল, কিন্তু মিনিট দশেকের মধ্যেই তার হাতে এল একটি মরিচা ধরা লোহার ঢাকনা। ঢাকনার গায়ে খোদাই করে লেখা তিনটি অক্ষর—R.S.B. ঈশান ঢাকনাটা খুলে দেখে, নিচে একটা সরু গর্তের মতো পথ, যেন জলের ট্যাংকের মতো গভীর, ভেতরে নেমে যাওয়ার মতো সিঁড়ি নেই, কিন্তু একটা রশি বাঁধা। তার হাত কাঁপছিল, অথচ তার চোখ বলছিল, “তুই যেতে পারবি।” সে ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে সেই গর্তের মধ্যে আলো ফেলল—ভেতরটা শুষ্ক, তবে পুরনো, অনেক দিনের ধুলো আর স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ ভরা। কিছু একটা যেন পড়ে আছে নিচে—হয়তো নথি, না হয় কিছুর চিহ্ন। ঈশান নিজের শরীরটা নামাতে শুরু করল ধীরে ধীরে, পা রাখল রশির গাঁটে গাঁটে—আর একসময় সে পৌঁছাল এক বন্ধ ঘরের ভেতর, যেখানে শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ আর টর্চের আলোই চলাফেরা করছিল।

ঘরের চারপাশে তাকিয়েই ঈশান বুঝল—এটা ছিল একটা বাংকার, খুব সম্ভবত কোনও গোপন মিটিং বা অস্ত্র লুকানোর জায়গা। দেওয়ালে ঝুলে থাকা একটা পুরনো মানচিত্রে কয়েকটি মার্কিং—জায়গার নাম: চোখা গ্রাম, কালিম্পং, জলঢাকা। আর ঠিক তার নিচে একটা বাক্সে রাখা ছিল কয়েকটা পুরনো রেকর্ড প্লেয়ার, কিছু হ্যান্ডবিল, আর একগুচ্ছ টাইপরাইটারে লেখা চিঠি। সেগুলো খুঁজতেই ঈশানের চোখ আটকে গেল একটি হলুদ খামে—তার ওপর লেখা: “If found, take it to Kolkata.” ভিতরে ছিল একটি লাল সুতায় বাঁধা প্যাকেট—যার মধ্যে সাদা কাগজে লেখা: “Operation Lahar: Classified — Confession from inside.” ঈশান বুঝতে পারল, এ কেবল একটি হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি নয়—এ ছিল এক সরকারি ষড়যন্ত্র, যার সমস্ত তথ্য কেউ জানলেও চুপ করে গেছে। সে জানে, এত গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে সে পাহাড়ে বেশিদিন নিরাপদ নয়। বাইরে বেরিয়ে আসতেই সে দেখল, পাহাড়ের ওপরে ভেসে আসছে কুয়াশার নতুন ঢেউ, আর অনেক দূরে দাঁড়িয়ে কেউ একটানা তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ঈশানের বুকের মধ্যে ভয় আর উত্তেজনা একসাথে কাঁপছিল। সে যত দ্রুত সম্ভব সেই ঢাকনাটা আবার লাগিয়ে জায়গাটা আগের মতো করে রেখে দেয়। পাহাড় বেয়ে ওঠার সময় তার মনে হচ্ছিল কেউ তার পেছনে পা ফেলছে ঠিক তার পরেই—যেন নীরব পাহারাদার। বাড়িতে ফিরে সে ডায়েরির সেই অংশ আবার পড়ল—“তারা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে, কিন্তু আমি শেষ চিঠিটা রেখে যাচ্ছি। যদি কেউ খুঁজে পায়, তাকে কলকাতায় পৌঁছতেই হবে। সত্য পাহাড়ে জন্মালেও, শহরের আলোতেই মুখ দেখায়।” ঈশান জানে, এখন তার কাজ শুধু গবেষণা নয়, বরং সে এক ন্যায়ের বাহক—যে ইতিহাস মুছে দেওয়া হয়েছে, তাকে আবার তুলে ধরতে হবে। কিন্তু সে বুঝে গেছে, শুধু কাগজে কলমে নয়—তাকে লড়তে হবে জীবিতদের সঙ্গে, যারা আজও এই ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রাখতে চায়। আর সেই যুদ্ধ শুরু হবে…কলকাতায়।

ট্রেন যখন হাওড়া স্টেশনে ঢুকল, তখন সন্ধে নামছে শহরের ওপর। ছেলেবেলার শহর আবার যেন অচেনা ঠেকছিল ঈশানের কাছে—এত দিন সে শহরকে দেখেছে ইতিহাসের বইয়ের পাতায়, চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে বক্তৃতার ছায়ায়। কিন্তু আজ সে ফিরছে হাতে এক গোছা বিস্ফোরক তথ্য নিয়ে—যা সামনে এলে শুধু একাত্তরের অন্ধকার রাতই নয়, বরং আজকের দিনের মুখোশও খুলে যেতে পারে। সে প্রথমে গেল কলেজ স্ট্রিটের সেই পুরনো বইয়ের দোকানে, যেখানে তার এক বন্ধু—রুদ্রজিৎ—একসময় আর্কাইভের নকল কাগজ কেনাবেচা করত। ঈশান জানত, সরকার যে কাগজ গায়েব করেছে, তার কিছু ছায়া প্রতিলিপি এখনও কলকাতার ভূগর্ভে ঘুরে বেড়ায়। রুদ্রজিতের দোকান এখন আর নেই, কিন্তু পেছনের ঘুপচি গলির এক মেসবাড়িতে সে থাকত—ঈশান ওখানে গিয়ে জানতে পারল রুদ্রজিৎ দুমাস আগেই নিখোঁজ। শুধু রেখে গেছে একটি খাতা, যেখানে লেখা—“ওরা এখনও পাহারা দেয়… খবরদার। যদি কখনও ‘লহর’ শব্দটা শুনিস, পালিয়ে যা।” ঈশান বুঝতে পারল—সে যা নিয়ে ফিরেছে, তা নিছক তথ্য নয়, বরং এক ভয়ানক নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেছে সে, যেটা আজও সক্রিয়।

সে সিদ্ধান্ত নিল—পরের গন্তব্য হবে নন্দীতা সেন–এর বাড়ি, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ইতিহাস বিভাগের প্রধান, আর যিনি একসময় নকশালপন্থীদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল বলে প্রশাসনিকভাবে নজরদারিতে ছিলেন। নন্দীতাদির সঙ্গে ঈশানের পূর্বপরিচয় ছিল—একটা গবেষণার সময়েই তার সাহচর্যে এসেছিল। দক্ষিণ কলকাতার এক পুরনো অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন তিনি, চারদিকে বইয়ের স্তূপ, ছাদে পাখা চলে না, আর কুকুরের ঘেউ-ঘেউ ডাক কানে ভেসে আসে। ঈশান প্রথমে একটু দ্বিধায় ছিল, কিন্তু যখন নন্দীতা নোটবুক আর অপারেশন ‘লহর’–এর কথা শুনলেন, তার চোখের কোণ জ্বলে উঠল। “এইসব জিনিস যে এখনো কেউ খুঁজছে, ভাবতেই পারি না,” তিনি বললেন। তারপর ধীরে ধীরে খুলে ধরলেন এমন সব স্মৃতি, যেগুলো মুখে না বললেও চোখে লেখা ছিল। তিনি জানালেন, ‘লহর’ ছিল এক আভ্যন্তরীণ অভিযান, যার আদেশ এসেছিল খুব উঁচু মহল থেকে। “তারা শুধু নকশাল নিধন করেনি ঈশান, তারা ইতিহাসকে শুদ্ধ করতে চেয়েছিল, নিজের মতো করে। এই শহরে আরও কেউ আছে, যারা আজও সেই আক্রমণের সাক্ষী।”

নন্দীতাদি ঈশানকে একটি নাম বললেন—বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, যিনি একসময় পুলিশে কাজ করতেন, কিন্তু পরে সাসপেন্ড হন ‘পলিটিক্যাল রিলেশন’ রাখার অভিযোগে। এখন তিনি বেলগাছিয়ার এক প্রান্তে একা থাকেন, প্রায় নির্বাসিতের মতো। ঈশান গেল তাঁর কাছে। বিশ্বজিৎবাবুর চোখে তখনও কিছু না বলা ভয়ের রেখা। প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিলেন না, কিন্তু ঈশান যখন নোটবুকের কয়েকটি পাতার কপি দেখাল, তখন হঠাৎ তিনি চুপচাপ উঠে গিয়ে একটা পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে কিছু কাগজ বের করে দিলেন—অপারেশন ‘লহর’–এর আসল ফাইল। “আমি এগুলো রেখে দিয়েছিলাম, জানতাম একদিন কেউ আসবেই।” ফাইলে লেখা ছিল, ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে একটি অঘোষিত অভিযান হয়েছিল দার্জিলিংয়ে, ছয়জন তরুণকে ‘স্টেট এজেন্ট’ সন্দেহে ‘নিষ্পত্তি’ করা হয়, এবং পরদিনই সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে চমকে দেওয়ার মতো কথা ছিল এই যে, এই অভিযানের নায়ক ছিলেন একজন বর্তমানে প্রবল প্রতিষ্ঠিত মন্ত্রী—রঞ্জন ঘোষাল, তখন সিআইডি ইনচার্জ। ঈশানের মাথা ঘুরে গেল। সে জানত, এই সত্য সামনে এলে শুধু ইতিহাস নয়, আজকের রাজনীতি, প্রশাসন—সব কেঁপে উঠবে।

ফিরে আসার পথে ঈশান বুঝে গেল, সে আর শুধু একজন গবেষক নয়—এখন সে হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত সাক্ষী, যাকে সরিয়ে দিতে চাইবে অনেকেই। সে ব্যাগের ভিতরে লুকিয়ে রাখল সব নথি, ফাইল আর ক্যামেরায় তোলা ছবি। তার মনে তখন শুধু একটা সিদ্ধান্ত—এই সত্য সে থামাবে না। হয়তো কেউ তাকে থামানোর চেষ্টা করবে, হয়তো অনেক দরজা বন্ধ হবে, কিন্তু লালবাড়ির নোটবুক যেমন ধুলো চাপা থেকেও চিৎকার করেছিল, ঈশানও সেই ইতিহাসকে এবার শহরের কোলাহলের মাঝখানে দাঁড় করাবে। সে ঠিক করল—এই সব নিয়ে তৈরি করবে একটি ডিজিটাল আর্কাইভ, যেখানে কেউ হাত দিতে পারবে না। আর সেইসঙ্গে ছুটে যাবে সংবাদমাধ্যমে—এইবার যুদ্ধ হবে সত্য আর ক্ষমতার মাঝখানে।

কলকাতা শহরের ট্রাম যেমন ধীরে চলে, ঈশানের চিন্তাও এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে। সে জানে, হাতে থাকা তথ্যগুলো শুধু ইতিহাস নয়, এক ভয়ংকর জীবন্ত ক্ষমতার বিরুদ্ধে অস্ত্র। সে সিদ্ধান্ত নেয়—প্রথম পদক্ষেপ হবে একটি অনলাইন ব্লগ বানানো, যেখানে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি ডকুমেন্ট, চিঠি, ও ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া চিত্র প্রকাশ করা হবে। বন্ধু দেবল এবং অরিত্র—দুজনেই সফটওয়্যারে কাজ করে—তারা তাকে সাহায্য করে ‘OperationLahar.org’ নামের একটি নোন-ডিসক্লোজার আর্কাইভ তৈরি করতে, যেখানে গোপনীয়ভাবে অ্যাক্সেস দেওয়া যায় নির্দিষ্ট গবেষকদের। তবে ঠিক সেদিন রাতেই ঘটল কিছু অস্বাভাবিক—ঈশান যখন টেবিলের ওপর থেকে নোটবুক নিয়ে আবার পাতা উল্টোচ্ছিল, তখন সে লক্ষ্য করল, বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা একটা পাতায় আর্দ্রতা জমে গেছে—আর তার ওপরে আঙ্গুল চালাতেই ভেসে উঠল অদ্ভুত হ্যান্ডরাইটিং: “Ranjan is not the only one. Look at what glitters too much.” ঈশান হতবাক—এই বাক্য তার কাছে যেন সাইফার, যেন কে যেন জানিয়ে দিচ্ছে, সে যা জানে, তার চেয়েও বেশি কিছু লুকিয়ে আছে।

পরদিন সকালে সে সংবাদ সংস্থা প্রথম দৃষ্টির রিপোর্টার শালিনী দত্তর সঙ্গে যোগাযোগ করে, যিনি অতীতে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির খবর সামনে এনেছিলেন। শালিনী প্রথমে উৎসাহ দেখালেও যখন ফাইলগুলোর নাম, ‘লহর’, ‘রঞ্জন ঘোষাল’ ইত্যাদি শুনলেন, তখন কেমন যেন চুপ করে গেলেন। তার গলা নিচু হয়ে এল—“তুমি বুঝতে পারছ না, ঈশান। এই সব নাম শুধু ইতিহাসে নয়, এখনও সক্রিয়, প্রভাবশালী। তুমি যদি এটা প্রকাশ করো, তোমার জীবন নিরাপদ থাকবে না। মিডিয়া চাইলেও সব বলতে পারে না।” ঈশান বলল, “তাহলে কি চুপ করে বসে থাকব? শুধু লেখাপড়া করব, বইয়ের পাতায় মরে যাব?” শালিনী বললেন, “তাহলে একটাই রাস্তা আছে—তুমি মুখোশ না খুলে তথ্য ফাঁস করো। জনসাধারণ জানুক, কিন্তু তুমি ছায়ার মধ্যে থাকো।” ঈশান প্রথমে দ্বিধায় পড়ে গেল, কিন্তু মনে পড়ল সেই কুঁয়োর নিচের অন্ধকার ঘর, বিশ্বজিৎবাবুর ভয়াল মুখ, আর নোটবুকের সেই পাতাগুলো—যেগুলো আজও রক্তমাখা। সে ঠিক করল, মুখোশ পরেই সে সত্যির সৈনিক হবে।

কিন্তু রাত বাড়তেই চারদিক অস্থির হয়ে উঠল। ফোনে অচেনা নম্বর থেকে আসা কণ্ঠস্বর—“তোমার বই পড়া দরকার, ঈশান। কিন্তু বেশি গভীরে গেলে, বইয়ের পাতাও ছিঁড়ে যায়।” ঈশান ভেবেছিল ফোন রেখে দেবে, কিন্তু কণ্ঠ বলল, “আমরা জানি তুমি কোথায় থাকো। তোমার কলেজের রেকর্ড, ট্রেনের টিকিট, সব আমাদের কাছে আছে।” তখনই সে বুঝে গেল—এরা শুধু তাকে অনুসরণ করছে না, বরং ছায়ার মতো তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। রাত দেড়টার দিকে তার ঘরের জানালায় একটি পাথর ছুঁড়ে কেউ পালিয়ে গেল, আর বাইরে দেখা গেল একটি অচেনা সাদা স্করপিও গাড়ি ঘোরাফেরা করছে। সে বুঝতে পারল, সময় এসেছে ঘর ছাড়ার। সে ব্যাগে শুধু নোটবুক, ফাইল, পেনড্রাইভ ও ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে—লক্ষ্য অজানা, কিন্তু মন স্থির। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার পাশের ছায়া হয়ে আছে।

ঈশান রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাল গড়িয়া ব্রিজের নিচে, যেখানে আগে অনেক গোপন সাহিত্য বিতরণ হতো। এখানে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল একটি ছদ্মনামে ব্লগ লেখেন এমন এক কর্মীর—নাম “Mukhosh”—যিনি নাকি নকশাল-পরবর্তী ইতিহাসের অনেক অপ্রকাশিত দলিলের সংরক্ষক। কিন্তু সে যা ভাবেনি, তা হলো এই কর্মীর পরিচয়—মুখোশ পরা লোকটি যখন মুখ খুলল, তখন ঈশান কেঁপে উঠল। কণ্ঠস্বর চেনা। খুব চেনা। হঠাৎ লোকটা মুখোশ খুলল—আর ঈশান দেখে, এটা কেউ নয়, তার বন্ধু অরিত্র, যে ‘OperationLahar.org’ বানাতে সাহায্য করছিল। “আমার দাদা মারা গেছিল সেই অভিযানে, ঈশান। আমিই ছিলাম প্রথম যে এই তথ্যগুলো খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম, কেউ যেন নিরপেক্ষভাবে এই তদন্ত করে। তুমি করছ, তাই আমি চুপ করে ছিলাম।” ঈশান বুঝতে পারল—তার যাত্রা একা নয়। কিন্তু এই নতুন তথ্য নিয়ে যুদ্ধ আরও ভয়ংকর হবে। অরিত্র বলল, “কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস—ওরা মুখোশ পরেই ঘুরে বেড়ায়, আলোয় এলে তবেই চিনবি। আর সময় হয়ে এসেছে, সত্যকে আলোর মুখ দেখানোর।”

কলকাতার ভোরবেলা যেন বিষণ্ণ রঙে রাঙানো এক চিঠির মতো। ঈশান এবং অরিত্র বসেছিল শিয়ালদহের পাশের এক নির্জন রেলওয়ে ক্যাফেতে। হাতে ধরা সেই পেনড্রাইভ, যার মধ্যে ছিল ‘লহর’–এর সমস্ত অপারেশন রিপোর্ট, নোটবুক স্ক্যান, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের দেওয়া আসল কাগজ, এমনকি একটি গোপন নথি—যার শিরোনাম ছিল ‘অসুরের খাতা’। ঈশান প্রথমে ভেবেছিল এটা কেবল একটি সাংকেতিক নাম। কিন্তু নথির প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই বুঝল—এই খাতা ছিল এক অঘোষিত লিস্ট, যেখানে বিভিন্ন ‘রাষ্ট্র-বিরোধী উপাদান’ চিহ্নিত ছিল, শুধু নাম নয়, তাদের অভ্যাস, রাজনৈতিক আস্থা, এমনকি কার কখন কোন চায়ের দোকানে বসে তর্ক করে তাও লিখে রাখা। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এই নথি গোপনে আপডেট হয়েছে। ঈশান প্রশ্ন করল, “কে সংকলন করত এসব?” অরিত্র বলল, “জানি না। শুধু এটুকু জানি, এই নথি যতবার সামনে আসার চেষ্টা করেছে, ততবার কেউ না কেউ মারা গেছে। তাই একে বলা হয় ‘অসুরের খাতা’—যাকে স্পর্শ করলে মানুষ নিঃশব্দে হারিয়ে যায়।”

তারা ঠিক করল, আজই এই তথ্যের একাংশ OperationLahar.org–এ আপলোড করা হবে। ঈশান ভেবেছিল হয়তো এবার তাদের লড়াই শুরু হবে তথ্য দিয়ে, আদালতে বা মিডিয়ায়। কিন্তু নিয়তি যেন আরও ভয়ংকর কিছু সাজিয়ে রেখেছিল। দুপুরে যখন তারা ওয়ার্লিন্ড স্ট্রিটের এক ছোট অফিসে ওয়াইফাই সংযোগ নিয়ে কাজ করছিল, তখন হঠাৎ করেই ভবনের নিচতলায় বিকট বিস্ফোরণ হয়। মুহূর্তে ধোঁয়া, কাচ ভাঙা শব্দ, আর চারদিকে ছুটোছুটি। ঈশান পড়ে যায় ফ্লোরে, মাথা ঘুরে ওঠে, অরিত্র তাকে টেনে ধরে বারান্দার দিকে নিয়ে আসে। তারা দেখে, নিচতলার সাইবার ক্যাফেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস, ফায়ার ব্রিগেড ঢুকছে, আর পুলিশ তাদের অফিস ঘেরাও করে ফেলেছে। কোনও কিছু প্রকাশ হওয়ার আগেই যেন কাউকে জানিয়ে দেওয়া হলো—“তোমরা যা করছ, সেটা মেনে নেওয়া হবে না।” অরিত্র ফিসফিস করে বলল, “ওরা শুধু আমাদের ওয়েবসাইট থামাতে চায় না। ওরা চায়, ইতিহাস না উঠুক কবর থেকে।”

সন্ধেবেলা তারা ছদ্মবেশে চলে আসে এক পরিত্যক্ত প্রেস–এ, যেখানে আগেও বিপ্লবীরা লুকিয়ে থাকত। সেখানে বসে তারা খুঁজতে থাকে ‘অসুরের খাতা’র শেষ পাতাগুলো। সেখানে হঠাৎ তারা দেখে একটি নাম—প্রণবেশ মিত্র—যিনি আজকের এক বিখ্যাত লেখক, ইতিহাসবিদ ও সরকারের ঘনিষ্ঠ নীতি–পরামর্শদাতা। অথচ সেই নামের পাশে লেখা—“ex-Naxal recruiter turned intelligence double agent.” ঈশান প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তার প্রবন্ধে যার উৎস উল্লেখ করেছে বহুবার, যার লেখা বই তার গবেষণার ভিত্তি—সে-ই কিনা এই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি? অরিত্র বলল, “তুই যাকে বিশ্বাস করিস, সে-ই হয়তো সবচেয়ে বড় মুখোশ।” তখনই তারা ঠিক করল—সত্য যত বড় হোক, মুখোশ যদি আলোয় আসে, তাকেও টেনে আনতেই হবে। তারা আবার চেষ্টা করে ফাইল আপলোড করতে, এবার TOR ব্রাউজারে, গোপন সার্ভার ব্যবহার করে। একটানা ঘণ্টা দুই পরে কিছু তথ্য উঠে যায় সাইটে, ঠিক তখনই হঠাৎ ঈশানের ফোনে আসে অচেনা নাম্বার থেকে একটি ভিডিও—অরিত্রর মায়ের ছবি, বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক লোক বলছে, “আর এক কদম বাড়াও, খাতা নয়, তোমার কাছের লোকদের পাতাও ছিঁড়ে যাবে।”

ঈশান বুঝে গেল, এটা শুধু তথ্য যুদ্ধ নয়, এটা এক মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাস। সে এবার দ্বিধায় পড়ে যায়—নিজের জন্য নয়, অরিত্রর পরিবারের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ঠিক তখনই অরিত্র বলে ওঠে, “জীবনে প্রথমবার ভয় পেয়েছিলাম, আজ নয়। আমার দাদার মৃত্যুর পর মা আমায় বলেছিল, ‘যার সত্যির ভর থাকে, তার ভয় হালকা হয়।’ তোকে যদি থামতেই হয়, কর কিন্তু একটা শর্তে—শেষ ফাইলটা আমাকে দিয়ে যা।” ঈশানের চোখে জল এসে যায়। সে জানে, এই লড়াইয়ের দাম অনেক বেশি। কিন্তু সে এও জানে, ইতিহাস যদি পেছন ফিরে না তাকায়, ভবিষ্যতের দৃষ্টিও অন্ধ হয়ে যায়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, অপারেশন ‘লহর’ এবং ‘অসুরের খাতা’র চূড়ান্ত তথ্য নিয়ে তারা যাবে এক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে—যেখানে দেশের চাপ পৌঁছাতে পারবে না। রাতভর তারা ট্রেনে চেপে বেরিয়ে পড়ে, পেছনে রয়ে যায় ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া সত্যের এক ঝলক—যা আবার আলোয় ফিরবে, এক নতুন দিনের প্রতীক্ষায়।

টয় ট্রেনের মতো ধীরে ধীরে দার্জিলিং ফিরে আসা ঈশানের কাছে যেন এক অনিবার্য নিয়তি। শহরের মেঘমাখা বাতাস, পাহাড়ের ঢালে হিমেল নীরবতা, আর সেই পুরনো লালরঙা বাড়ি—সবই যেন অপেক্ষা করছিল ফের একবার ইতিহাসকে জাগাতে। অরিত্রর চোখেমুখে ক্লান্তি স্পষ্ট, কিন্তু তার ভেতরে ছিল এক নির্ভীক সংকল্প। তারা সোজা পৌঁছে যায় সেই বেসমেন্ট ঘরে, যেখানে আগে পাওয়া গেছিল নোটবুকটি। মাটির নিচের ঘন ঘন শীতলতায় ঈশানের মনে পড়ে গেল সেই পুরনো ইটের দেয়াল, যার এক কোণে একসময় একটি কুয়ো ছিল, আর যেখান থেকে এক নারীকণ্ঠে ভেসে আসত গানের টুকরো। তারা শুরু করে দেয়াল পরীক্ষা—টর্চের আলো ফেলতেই অরিত্র চিৎকার করে ওঠে: “দেখ!” একটি সাদা কাপড়ে মোড়া ছোট বাক্স, যা গুঁজে রাখা ছিল খোলস-চাপা ইটের পেছনে। খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল পুরনো কালি আর পচা চুনের গন্ধ—আর তার মধ্যেই একখানা ডায়েরি, গাঢ় নীল কালিতে লেখা, যার ওপরে কেবল একটি শব্দ: “জ্যোৎস্না”।

ঈশান ডায়েরিটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল। এই ডায়েরির লেখক ছিলেন জ্যোৎস্না নাথ, একজন তরুণী নকশালপন্থী, যিনি ১৯৭৩ সালে লালবাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। তার লেখার ভাষা যেন কবিতার মতো, কিন্তু তাতে ভরপুর ছিল রক্ত, দ্বন্দ্ব, ও মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন। এক পাতায় লেখা ছিল, “আমরা যারা অস্ত্র হাতে নিই, তারা ভুলে যাই যে বুলেটের আগে চলে চোখের ভাষা। আমি রঞ্জনের নির্দেশে এসেছিলাম, কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, সে নিজেই এক অন্ধ শক্তির দাস।” আর এক পাতায় ছিল ভয়াবহ স্বীকারোক্তি—“আমি দেখেছি রঞ্জন কিভাবে একজন বন্দিকে মারতে মারতে বলেছিল, ‘তুই বাঁচলে আমাদের আন্দোলন মরে যাবে।’ আমি বুঝলাম, ওর কাছে প্রাণ নয়, প্রচার বড়। আমি আজ রাতে পালাতে চাই। যদি মরে যাই, কেউ যেন আমার এই খাতা পড়ে বোঝে, সত্য আর আদর্শ এক নয়।” ঈশান স্তব্ধ হয়ে গেল। রঞ্জন ঘোষাল, যাকে একসময়ের বীর মনে করা হয়, যার নামে আজও শহিদ মিনার গড়ে ওঠে—সে-ই যদি হয়ে থাকে এক ছায়া-অসুর, তবে ইতিহাসের বিচার কোথায় দাঁড়াবে?

অরিত্র বলল, “এই ডায়েরি শুধু নকশাল ইতিহাস নয়, এটা নারী-স্বাধীনতারও এক দলিল। কত নারীর কণ্ঠ হারিয়ে গেছে ‘আন্দোলনের পর্দা’য়।” ঈশান ডায়েরির শেষ পাতায় দেখতে পেল একটি স্যাঁতসেঁতে চিঠি, যেখানে লেখা: “যদি কেউ কখনো খুঁজে পায় এই লেখা, সে যেন বলে দেয়, আমি শুধু বিপ্লবী ছিলাম না—আমি একজন মানুষ ছিলাম, যার ভয়, ভালোবাসা, আর নিজেকে খোঁজার তাগিদ ছিল।” এই চিঠি যেন এক আত্মার মিনতি, যেন ইতিহাসকে নিজের দিকে তাকাতে বলছে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এই চিঠি এবং ডায়েরির পাতাগুলো সাইটে আলাদা করে প্রকাশ করা হবে, শিরোনাম হবে—“A Girl Named Jyotsna”। কিন্তু এই সিদ্ধান্তই আবার টেনে আনে বিপদ। ঠিক সেই রাতে তারা শুনতে পায় বাড়ির আশপাশে পায়ের শব্দ, আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক জিপ, যার কাচে ধোঁয়াটে আলোয় দেখা যায় কালো কোট পরা এক লোক ধীরে ধীরে সিগারেট টানছে।

ঈশান জানে, সময় ফুরিয়ে আসছে। হয়ত ওদের এখনই চলে যেতে হবে, হয়ত এটাই শেষবারের মতো দেখা যাচ্ছে ‘লালবাড়ি’কে। অরিত্র টর্চ হাতে নিয়ে ছাদে ওঠে, যেখানে এককালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পতাকা উড়ত। ঈশান তাকিয়ে থাকে দার্জিলিংয়ের জ্যোৎস্নায় ভেসে থাকা পাহাড়ের দিকে, আর তার মনে পড়ে যায় জ্যোৎস্না নাথের সেই লেখা—“আলো আসলে ছায়া ছোট হয়, আর সত্য স্পষ্ট হয়।” তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এবার তারা প্রকাশ করবে সম্পূর্ণ অসুরের খাতা এবং জ্যোৎস্নার ডায়েরি, একসাথে—একই রাতে। তারা জানে, এই যুদ্ধের পর হয়ত তারা থাকবে না, কিন্তু ইতিহাস থাকবে। পাহাড়ে লাল আলো জ্বলতে শুরু করে, আর সেই রাতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক চুপচাপ, পরিত্যক্ত বাড়ি—যেখানে লেখা হয়েছিল এমন কিছু, যা আজও মানুষ পড়ে কাঁপে।

দার্জিলিং ছেড়ে ঈশান ও অরিত্র ফিরে আসে শিলিগুড়ি হয়ে কলকাতায়, আর তাদের গন্তব্য একটি অদ্ভুত জায়গা—বহু পুরনো উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে অবস্থিত একটি ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার, নাম “আলোকপুঞ্জ আর্কাইভ”। এই লাইব্রেরি জনসাধারণের জন্য নয়; এখানে প্রবেশের জন্য দরকার সুপারিশ, অথবা নিখুঁত ইতিহাস জ্ঞানের ছাপ। অরিত্রর এক পুরনো শিক্ষক, যিনি এক সময় সরকারী ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রজেক্টে ছিলেন, তিনিই তাদের নাম দিয়েছেন ‘আর্কাইভ মাস্টার’-এর কাছে। বাড়িটি ছিল ধ্বংসপ্রায়, অথচ তার ভেতর যেন সময় থেমে আছে—ভিতরে প্রবেশ করতেই বোঝা যায়, এখানে বছর ধরে কেউ না কেউ বই ও দলিল যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে। এক কোণে বসে ছিলেন সেই মানুষটি—ধবধবে সাদা ধুতি, পাতলা গায়ে চাদর, চোখে গাঢ় ফ্রেমের চশমা, কিন্তু মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। তিনি বললেন, “তোমরা যারা এসেছো সত্য খুঁজতে, তার প্রস্তুতি আছে তো সত্য সহ্য করার?”

ঈশান তার সামনে রাখল জ্যোৎস্না নাথের ডায়েরি, ‘অসুরের খাতা’র এক কপি প্রিন্ট, এবং রঞ্জন ঘোষালের নাম যুক্ত করা পাতাটি। আর্কাইভ মাস্টার চুপ করে সব পড়ে গেলেন, তারপর হঠাৎ বললেন, “জ্যোৎস্না, হ্যাঁ… ও এক অগ্নিকন্যা ছিল। আমি তাকে চিনি।” ঈশান ও অরিত্র থমকে গেল। তিনি বললেন, “আমি তখন তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের গোপন ইউনিটে ছিলাম। আমাদের কাজ ছিল কারা বিপজ্জনক, তাদের চিহ্নিত করা। কিন্তু আমি নিজেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি—যখন দেখি যাকে দেশদ্রোহী বলা হয়, সে-ই নিজের প্রাণ দিচ্ছে দেশের ভবিষ্যতের জন্য। আমি সেই সময় সব নথি জমাতে শুরু করি—কারা কাকে মারল, কেন সত্যকে চেপে রাখা হলো, কিভাবে ইতিহাস বিকৃত হলো। আমি নিজেই হয়ে উঠি এক অদৃশ্য লেখক—‘দ্য আর্কাইভ মাস্টার’।” ঈশান জিজ্ঞাসা করে, “তাহলে আপনি জানতেন রঞ্জন ঘোষালের আসল রূপ?” তিনি মাথা নেড়ে বলেন, “ও ছিল দুটি শক্তির দালাল—একদিকে সরকার, অন্যদিকে চরমপন্থী সংগঠন। ওর কাজ ছিল আন্দোলনের ভিত ভেঙে দেওয়া—সন্দেহ, ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতা ছড়িয়ে।”

এই স্বীকারোক্তি যেন ঈশানের মনে ভূমিকম্প ডেকে আনে। সে এতদিন ধরে যে ইতিহাস বিশ্বাস করেছিল, তা আসলে ছিল এক নির্মিত সত্যের মুখোশ। আর্কাইভ মাস্টার তখন একটি সিন্দুক খুলে, বের করলেন একটি ফাইল—শিরোনাম: “Operation Keshto: Shadow Network of Darjeeling Cell”। এই নথিতে ছিল রঞ্জনের সমস্ত রিপোর্ট, তার নিয়োগপত্র, এমনকি সেই কর্মকর্তাদের নাম, যারা তাকে সুরক্ষা দিয়েছিল। অরিত্র ফিসফিস করে বলল, “এটা ফাঁস হলে শুধু রঞ্জন নয়, গোটা ব্যবস্থার মুখোশ খুলে যাবে।” কিন্তু আর্কাইভ মাস্টার বললেন, “আমি এতদিন এসব লুকিয়ে রেখেছিলাম, কারণ সময় হয়নি। আজ তোমাদের চোখে দেখছি আগুন—তোমরা পারবে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু মনে রেখো, যারা মুখোশ পরে থাকে, তাদের মুখও ভয়াবহ।” তিনি তাদের হাতে একটি প্যাকেট দিলেন, যাতে সেই সমস্ত আসল ফাইল, ক্যাসেট টেপ ও ফিল্ম রীল ছিল। “আর একটা কথা,” তিনি ধীরে বলে ওঠেন, “জ্যোৎস্না মরে যায়নি। সে আজও বেঁচে আছে। অন্য নামে, অন্য শহরে। চাইলে তোমরা তার খোঁজ পেতে পারো।”

রাত গভীর হয়, কলকাতার বাতাসে ভেসে আসে পুরনো শালপাতার গন্ধ, আর ঈশান ও অরিত্রের চোখে জ্বলে ওঠে এক আলো—যেটা কেবল ‘পোস্ট-ট্রুথ’ যুগের নয়, বরং সেই সময়ের সত্য, যা লুকোনো ছিল একটা সিন্দুকের ভিতর। তারা এবার তৈরি হয় এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফাঁস করার জন্য। ঈশান জানে, এই মুহূর্তে ফিরে তাকালে শুধু ছায়া দেখা যাবে, কিন্তু যদি সামনে এগোয়, তাহলে তার আলোর রাস্তাটা সে নিজেই তৈরি করতে পারবে। তারা এবার ছড়িয়ে দিতে চায়—মুখোশের নিচে মুখ—যাতে ভবিষ্যতের চোখে আর কোনও ধোঁয়াশা না থাকে।

তথ্য প্রকাশ পায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়, মানবাধিকার ফোরামে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত আলোচনার মঞ্চে—“The Shadow Files of Naxalbari Movement” নাম নিয়ে ফাঁস হয় সেই ভয়াবহ সত্য। ঈশান ও অরিত্র তৈরি করেছিল একটি ডেডিকেটেড ওয়েবসাইট, যেখানে রাখা হয় জ্যোৎস্না নাথের ডায়েরির পাতাগুলি, অসুরের খাতা, আর্কাইভ মাস্টারের দেওয়া নথিপত্র, এবং একটি বিশেষ শ্রুতি-দলিল—রেকর্ড করা হয় ঈশানের কণ্ঠে পড়া জ্যোৎস্নার চিঠিগুলো। প্রথম সপ্তাহেই সাইটটি ভাইরাল হয়। শিলিগুড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে আমেরিকার বার্কলির গবেষণা কেন্দ্র পর্যন্ত আলোড়ন পড়ে যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নামহীন হুমকি শুরু হয়—“এই ইতিহাস মুছে ফেলো, নয়তো তুমিই হয়ে যাবে পরবর্তী ‘অসুর’।” মোবাইল নম্বর বদলাতে হয়, সামাজিক মাধ্যমে মুখ লুকাতে হয়। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, সাধারণ মানুষ, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের কিছু প্রবীণ মানুষ, হঠাৎ এগিয়ে আসতে থাকে। কেউ বলে, “আমি সেই রাতে রঞ্জনকে দেখেছিলাম।” কেউ বলে, “আমার পিসিমা ছিলেন জ্যোৎস্নার রুমমেট।” টুকরো টুকরো স্মৃতি যেন জেগে ওঠে, যেমন গন্ধ উঠে ধুলো মুছে ফেলা পুরনো কাপড় থেকে।

কিন্তু প্রতিক্রিয়া শুধু সহানুভূতির ছিল না। রঞ্জন ঘোষালের পরিবার তার নামে মানহানির মামলা ঠুকে দেয়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডাকে ঈশানকে ‘আত্মঘাতী তথ্য ফাঁস’-এর অপরাধে। বড় বড় মিডিয়া হাউস হঠাৎ করে নিরব হয়ে যায়, যেন কেউ অদৃশ্য সুতোয় টেনে নিয়েছে তাদের বিবেক। অরিত্রের বাবা-মা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন, কারণ তার ‘দেশবিরোধী কাজ’ নাকি সমাজে লজ্জা ডেকে এনেছে। এক সন্ধ্যায় তারা দেখে তাদের ফ্ল্যাটের দরজায় লেখা, “দেশদ্রোহী”। ঈশান কাঁপা কাঁপা হাতে খুলে দেখে তার গবেষণা প্রজেক্ট বাতিল করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, কারণ “তথ্যসূত্র অবৈধ”। অথচ সে জানে—এই তথ্যই সত্য, আর এই সত্য বলার জন্যই কেউ কেউ ইতিহাসে ফিরে আসে না, কেবল ছায়া হয়ে বেঁচে থাকে। তবু তারা হাল ছাড়ে না। তারা যোগাযোগ করে বিশ্ব হিউম্যান রাইটস কমিশনের সঙ্গে, একটি বিদেশি ডকুমেন্টারি সংস্থার সঙ্গে, যারা পাহাড়ি আন্দোলনের উপর কাজ করছে। কিন্তু এদিকে আর্কাইভ মাস্টার নিখোঁজ হন। সেই পুরনো গ্রন্থাগারে তালা পড়ে, এবং কেউ জানে না তিনি কোথায় গিয়েছেন।

ঈশান ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, সত্য প্রকাশ মানেই মুক্তি নয়, বরং এক দীর্ঘ সন্ন্যাস। তার প্রেমিকা ঋতা তাকে ছেড়ে যায়, তার একমাত্র সহপাঠীরাও তাকে অচেনা করে ফেলে। কিন্তু এক রাতে হাওড়ার স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন, এক অচেনা বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বলে, “তোমার পোস্টটা পড়েছি। জ্যোৎস্না আমার ছোট বোন ছিল। ওর জন্য লড়ো।” বৃদ্ধ হাত তুলে আশীর্বাদ করে চলে যান, আর ঈশান কাঁদে—প্রথমবার, নির্বাকভাবে, মানুষের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। যে মানুষগুলো ইতিহাসে স্থান পায় না, যারা ফিরে আসে না, তারা আসলে হারিয়ে যায় না। তারা থেকে যায় অন্য কারও চোখে, অন্য কারও সাহসে, অন্য কারও কলমে। ঈশান নিজের মুঠোফোনে আবার প্লে করে সেই অডিও রেকর্ডিং, যেখানে জ্যোৎস্না বলেছিল, “যদি আমি হারাই, আমায় মনে রেখো না বিপ্লবী হিসেবে। মনে রেখো একজন নারী হিসেবে, যে বিশ্বাস করেছিল ভালোবাসা দিয়েই পরিবর্তন সম্ভব।”

অরিত্র চলে যায় পাহাড়ে, হয়ত নতুন নামে নতুন জীবন শুরু করতে। ঈশান থেকে যায় কলকাতায়, এক নির্জন ঘরে, আর প্রতিদিন লিখে চলে আরও কিছু হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প। কেউ জানে না, এই লেখাগুলো কেউ কখনও পড়বে কি না। কিন্তু সে জানে, যারা সত্যের জন্য লড়াই করে, তারা চিরকাল ফিরেও আসে না। তারা একসময় হয়ে যায় ধুলোয় ঢাকা নাম, অসমাপ্ত ডায়েরির পাতা, অথবা শুধুই একটা প্রশ্নচিহ্ন—”আসলে ইতিহাস কার?”

১০

ঈশান ভাবেনি, শেষ পৃষ্ঠাটি এত সহজে চোখের সামনে এসে দাঁড়াবে। এক সকালে, কলকাতার রোডস লাইব্রেরির পুরনো পাঠাগার ঘরে সে একটি খাম পায়, ঠিক নিজের ডেস্কের উপর রাখা। ওপরে লেখা আছে—“To the one who didn’t stop.” সেই খামে ছিল একটি নীলচে ছোপ লাগা চিঠি, হাতে লেখা ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে, এবং নিচে সই—“Jyotsna Nath (now: Shabnam Rahman)”। ঈশান স্তব্ধ হয়ে যায়। জ্যোৎস্না বেঁচে ছিলেন? বেঁচে আছেন? সে চিঠিতে লিখেছেন, কিভাবে তিনি ১৯৭৬ সালে ফাঁসি থেকে রক্ষা পেয়ে এক সেনা চিকিৎসকের সাহায্যে দেশত্যাগ করেন, কিভাবে তিনি ঢাকায় গিয়ে এক নতুন পরিচয়ে জীবন শুরু করেন, সাংবাদিকতা শিখে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু সেই সব কাজের ফাঁকে তিনি একটা কাজ থামাননি—স্মৃতি সংরক্ষণ। তিনি লিখেছেন, “ঈশান, যদি তুমি এই চিঠি পাও, বুঝে নিও—তুমি ঠিক পথেই ছিলে। কিন্তু ইতিহাস শুধু দলিলে হয় না, সেটা হয় মানুষে। আমি আর ফিরব না, কারণ ফেরা মানেই সেই ভয়ঙ্কর আঁধারকে আবার জাগিয়ে তোলা। কিন্তু তুমি লিখো। তুমি লড়ো। কারণ আমি তোমার চোখ দিয়েই বাঁচতে চাই। এই নোটবুকের শেষ পৃষ্ঠা তুমিই।” চিঠির সঙ্গে ছিল একটি ছোট ক্যাসেট টেপ—এক সাক্ষাৎকার, যেটা জ্যোৎস্না দিয়েছিলেন একটি ব্রিটিশ রেডিও আর্কাইভে। সেখানে তিনি শান্তভাবে বলেছিলেন, “আমরা হারিনি। আমরা কেবল অন্য নামে বেঁচে আছি।”

ঈশান সে দিন বিকেলেই পৌঁছায় প্রেস ক্লাবে, এক স্বাধীন গবেষণা আলোচনাসভায়। সেখানে সে পড়ে শোনায় সেই চিঠি। উপস্থিত শতাধিক গবেষক, সাংবাদিক ও ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে করতালি দেয়। আর সেই সময় ঈশান ঘোষণা করে, “আজ থেকে এই নোটবুকের নাম ‘People’s Archive of Unwritten Revolutions’ হবে।” সে ওয়েবসাইট খুলে, যেখানে শুধু নকশাল নয়, ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী সব আন্দোলনের এমন নথি জমা থাকবে, যা সরকার ভুলে যেতে চায়। সেদিন অরিত্রও ফিরে আসে পাহাড় থেকে, তার হাতে আরেকটি ছোট নোটবুক—চোখে জলের রেখা, মুখে হাসি। “জ্যোৎস্না একবার আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মা বলল। আমি জানতাম না।” ইতিহাস এত ব্যক্তিগত হয়ে যাবে, কেউ ভাবেনি। তাদের লেখা, ডায়েরি, ফাইল, চিঠি—সব এখন মানুষের সামনে।

কয়েক মাস পর, লন্ডনের এক আর্কাইভ প্রকাশ করে “Shabnam Rahman Collection” নামে একটি সিরিজ, যাতে জ্যোৎস্নার সমস্ত আত্মকথা ও সাক্ষাৎকার রয়েছে। বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠে যায়—“Who gets to write history?” আর সেই সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকে ভারতের ইতিহাস বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জ্যোৎস্না নাথের নামে একটি নতুন রিসার্চ চেয়ার চালু করে। কিন্তু ঈশান জানে, এর কোনো অংশই ব্যক্তিগত বিজয় নয়। সে জানে, জ্যোৎস্নার মতো অনেকেই শেষ পৃষ্ঠায় পৌঁছতে পারেন না। তারা হারিয়ে যায় কুয়াশার দেশে, কিন্তু রেখে যায় কালি, শব্দ আর প্রশ্ন।

একদিন সন্ধ্যায়, ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে, ঈশান বসে ছিল সেই পুরনো বাড়িটার সামনে—ডার্জিলিংয়ের গা-ছোঁয়া ঝুপসি পাহাড়ে। তার হাতে সেই প্রথম নোটবুক, যেখানে পাতায় পাতায় আঁকা জ্যোৎস্নার হাতের লেখা, আঁচড়, রক্ত আর বিশ্বাস। সে চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে, “তুমি লিখেছো… আর আমি শুনেছি।” এবং সেই মুহূর্তে যেন আকাশে মেঘ কেটে একফোঁটা আলো পড়ে নোটবুকের শেষ পাতায়।

সমাপ্ত

 

 

1000030471.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *