Bangla - ভূতের গল্প

ধোঁয়ার ভিতর এক মুখ

Spread the love

অদ্রীশা বন্দ্যোপাধ্যায়


দার্জিলিং, সেই পাহাড়ের শহর, যেখানে সকাল আর সন্ধ্যার মাঝের সময়টা যেন চুপচাপ কল্পনাগুলোকে জাগিয়ে তোলে—সেখানে ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় অতীতের কান্না, চা-বাগানের ঢাল বেয়ে নামে সোনালি আলো, আর পুরোনো ব্রিটিশ বাংলোর ছায়াগুলো নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কালের ইতিহাসে; এই শহরের বুকেই এসেছে অনির্বাণ ঘোষ, একচল্লিশ বছর বয়সি স্বাধীনচেতা ফটোগ্রাফার, কলকাতার নাগরিক, জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, শহরের কংক্রিটের অস্থিরতা আর মানুষের মুখে মুখে ঘোরাফেরা করা নাটক, কিন্তু পাহাড় তাকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে—সেখানে সময় যেন ধীরে চলে, প্রতিটি গন্ধ, প্রতিটি ছায়া নিজের ভাষায় কথা বলে, আর সেই ভাষা বোঝার তৃষ্ণাই তাকে টেনে এনেছে এখানে; তার কাছে একটা কাজ ছিল—এক প্রিমিয়াম রিসোর্টের জন্য নতুন ফটোগ্রাফি সিরিজ তৈরি, মূলত পাহাড়ের নিসর্গ, শীতকালীন হালকা কুয়াশা, স্থানীয় জীবনযাপন ও স্থাপত্য—এমন দৃশ্য যা শহরের মানুষের চোখে শান্তি এনে দেয়, এবং তাদের ছুটির প্ল্যান করাতে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু অনির্বাণের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পেশাগত নয়, সে কিছু হারানো খুঁজে পেতে চায় নিজের ভেতরেও, সেই অনির্বাণ, যে ছোটবেলায় মেঘের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করত সাদা ঘোড়ায় চড়া পরীরা রাতের বেলা পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়—এখন সেই অনির্বাণের চোখ আরও বাস্তব, আরও বিষণ্ণ, তবুও পাহাড়ের ডাক সে উপেক্ষা করতে পারেনি; লেবং কার রোড ধরে গাড়ি যখন উঠছিল, নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছিল ঘন কুয়াশা, আর গাছের ছায়া যেন আড়াল করে দিচ্ছিল কোনো গোপন রহস্য—গাড়িচালক পেম্বা চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল, মাঝে মাঝে আড়চোখে অনির্বাণের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু থেমে যাচ্ছে, মুখ খোলার আগেই; হঠাৎ পেম্বা বলল, “সাব, আপনি এলগিন কটেজে থাকবেন? একটু পুরনো জায়গা…খুব চুপচাপ…”—তার কণ্ঠে ছিল সতর্কতা, কিন্তু অনির্বাণের কানে তা রোমাঞ্চের মতো বাজে, সে শুধু মুচকি হেসে বলে, “পুরনো জায়গাই তো আসল জিনিস, গল্প থাকে, দম থাকে”—পেম্বা কিছু না বলে মাথা নেড়ে দেয়; এলগিন কটেজের গেট দেখা গেল, কালো রঙের কাঠের গেট, দু’পাশে ভাঙাচোরা পাথরের প্রাচীর, আর তার মাঝখানে পিতলের একটা ফলক—“Elgin Cottage – Estd. 1891”, গেটের ওপাশে দেখা গেল পুরনো কাঠের বাংলোটা, যার চালের ওপরে সাদা ছোপ ছোপ শ্যাওলা জমে আছে, জানালার কাঁচে জমে থাকা শিশিরে রোদ পড়লে ছোট ছোট রংধনু তৈরি হয়, বাংলোটা চারদিকে ঘেরা পাইন গাছ আর পাতাঝরা বাগান দিয়ে—একবারে যেন ব্রিটিশ আমলের নিঃসঙ্গ অভিজাততা; অনির্বাণ গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা বাতাস তার মুখে লাগে, নিঃশ্বাস নিতেই নাকে আসে পচা কাঠ, পাইন গাছ আর আর্দ্র পাতার গন্ধ—কেমন যেন অতীত আর ছায়ার গন্ধ; দরজা খুলে এগিয়ে এল এক বৃদ্ধ, বয়স সত্তরের কাছাকাছি, নাম বলল মিঃ লেপচা, সাথে তার স্ত্রী, শান্ত মুখ, চোখে ঘোলাটে চশমা—তারা বলল, এখন কটেজে আর কেউ নেই, শীতকাল বলে ভাড়াটিয়া কম, শুধু অনির্বাণের মতো দু-একজনই আসে ফটোগ্রাফি বা লেখালেখির কাজে, তাই পুরো কটেজই তার—তবে তারা নিচের স্টাফ রুমে থাকে, প্রয়োজনে ডাকলেই হয়; অনির্বাণকে নিয়ে যাওয়া হয় দোতলার ‘এলগিন রুম’-এ—বড় ঘর, চওড়া জানালা পাহাড়ের দিকে খোলে, কাঠের মেঝে, মাঝখানে একটা পুরনো বিছানা, চারপাশে দাগ লাগা দেয়াল, আর একটা ভারী কাঠের আলমারি—কিন্তু যা সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হলো ঘরের এক কোণে বসানো বিশাল আয়নাটা, কালো কাঠের কারুকার্য করা ফ্রেম, আয়নার গায়ে কোথাও কোথাও দাগ, ধুলোর আস্তরণ, তবু যেন এক অদ্ভুত টান, যেন তা শুধু প্রতিবিম্ব নয়, অন্য কিছু ধরে রাখতে চায়; অনির্বাণ ব্যাগ নামিয়ে ঘর দেখছিল, কিন্তু মনটা কোথাও যেন অস্থির, বাইরে মেঘ জমছে, বিকেলের রোদ আর কুয়াশা মিশে গিয়ে অদ্ভুত এক আলোর খেলা তৈরি করেছে, জানালার বাইরে চা-বাগানের ঢাল বেয়ে মেয়েরা কাজ করছে—ছবি তোলার এক অসাধারণ সুযোগ; কিন্তু ঘরে ঢুকেই সে প্রথমবার অনুভব করে, যেন তার আগমনের খবর কেউ আগে থেকেই জানত, যেন ঘরের বাতাসও তাকে জানে—রাতে খাওয়া শেষে সে নিজের ঘরে ফেরে, বিছানায় বসে ল্যাপটপ খুলে দিনের ছবিগুলো দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে—বাইরে তখন ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়া, আর পাহাড়ে রাত নামছে ধীরে ধীরে; ঘুমের মাঝে সে যেন স্বপ্ন দেখে—একটা হালকা কুয়াশার ভিতর, একটা মেয়ে হাঁটছে, সাদা গাউনে, পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না, কিন্তু অনির্বাণ নিশ্চিত, সে তাকে চেনে—ঠিক কোথা থেকে মনে করতে পারছে না—কিন্তু পরিচিত, অদ্ভুতভাবে পরিচিত; হঠাৎ চমকে উঠে বসে পড়ে অনির্বাণ—ঘড়িতে সময় তিনটা বেজে পঁচিশ, ঘরে নিঃস্তব্ধতা, কেবল ঘড়ির কাঁটার শব্দ, জানালার বাইরে কুয়াশা জমে গেছে পুরো গ্লাসে, ঠিক সেই মুহূর্তে, চোখ যেতেই যেন হৃদয় থেমে যায়—জানালার গায়ে ধূসর কুয়াশার মাঝে ফুটে উঠেছে একটা মুখ, নারী মুখ, যেন গায়ে আলোর ছোঁয়া নেই, চোখ দুটো অস্বাভাবিক ফাঁকা, ঠোঁট হালকা নড়ে, যেন কিছু বলছে, কিন্তু শব্দ নেই, চিৎকার নেই, শুধু নিঃশব্দে বলে চলেছে… যেন বলে, “এসো…”—অনির্বাণ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে না, চোখ কচলে দেখে, আলো জ্বালে—কিছু নেই, কেবল তার নিজের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু তার হৃদয়ের ভিতর গর্জে ওঠে একটা সুর—“কিছু একটা ছিল… কিচ্ছু একটা”; সে আয়নার দিকে তাকায়, তাতে তার চেহারাই, কিন্তু এক অদ্ভুত ছায়া যেন ঠিক পেছনে… আর তার ঘাড়ে হিম হাওয়া লাগে, যেমন লাগে কেউ পাশ দিয়ে ধীরে হেঁটে গেলে; সে দ্রুত বিছানায় ফিরে যায়, কম্বল মুড়ে নেয় নিজেকে, কিন্তু ঘুম আসে না—সকালে উঠে নিচে গিয়ে লেপচা দম্পতির সঙ্গে নাস্তা করতে করতে জিজ্ঞেস করে, “এই ঘরটা কি আগে কেউ ব্যবহার করতেন?”—বৃদ্ধা কাকিমা এক মুহূর্ত থেমে থেকে বলেন, “এলগিন রুম? ওটা আগে ছিল সাহেবের মেয়ের ঘর, এলিজা… অনেক বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছিল”—অনির্বাণ চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কীভাবে মারা যান?”—মিঃ লেপচা হেসে বলেন, “সে গল্প তো অনেক পুরোনো, কে জানে ঠিক কি হয়েছিল… কেউ বলে ছাদ থেকে পড়ে গেছিল, কেউ বলে নিজেই ঝাঁপ দিয়েছিল… তবে জানেন, অনেক অতিথি ওই আয়নার কথা বলে… ঘুমের মাঝে কেউ ডাকে বলে…”—অনির্বাণ কিছু না বলে চা হাতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে… এবং মনে মনে ভাবে—শুধু গল্প? না কি সত্যিই, কেউ একদিন ফিরতে চেয়েছিল এই কুয়াশার মধ্য দিয়ে?

***

পরের দিন সকালে পাহাড়ের কুয়াশা একটু পাতলা হলেও অনির্বাণের মনটা যেন ভারী হয়ে ছিল, গতরাতে দেখা মুখটা তার মনে স্থায়ী হয়ে গেছে, আর ঘরের আয়না, যেটা আগের দিনও শিল্পিত প্রতিফলনের মতো মনে হয়েছিল, এখন যেন মনে হচ্ছিল এক নিরবদ্রোহ কক্ষপাল, যার ভিতরে কোনো আত্মা সময়ের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখছে; সকালের নাস্তার সময় সে একটু সাহস করে মিসেস লেপচার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলে ফেলল, “কাল রাতে একটা মুখ দেখেছিলাম, জানালার কুয়াশার ওপারে… এক মেয়ের মুখ”—তার কথা শুনে বৃদ্ধা থেমে গেলেন, চা কাপটা কিছুক্ষণ ঠোঁটের কাছে ধরে রাখলেন, তারপর ধীরে বলে উঠলেন, “আপনি এলিজার কথা শুনেছেন?”—অনির্বাণের মাথা নাড়ে, “না, আপনি বলেছিলেন গতকাল শুধু… তবে কিছু জানার খুব ইচ্ছা”—লেপচা দম্পতির চোখাচোখি হলো একবার, তারপর মিসেস লেপচা ধীরে গল্প শুরু করলেন—“অনেক বছর আগে, তখন এখানে ব্রিটিশ সাহেবরা থাকত, এলগিন কটেজ ছিল এক সাহেবের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান, নাম ছিল মেজর টমাস হার্ডিং, তার একমাত্র মেয়ে ছিল এলিজা, উনিশ-বিশ বছরের মতো বয়স, খুবই শান্ত ও নিঃসঙ্গ প্রকৃতির, তার মা আগেই মারা গিয়েছিলেন, আর বাবা দিনভর ব্যস্ত থাকতেন, তাই এলিজা দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন জানালার ধারে বসে চা-বাগান আর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে… ওঁর ছবি আমরা ছোট থাকতে দেখেছি, ধবধবে সাদা গাউন, হাতে ডায়েরি, যেন ছবি নয়, কুয়াশার প্রতিচ্ছবি”—মিসেস লেপচার গলা একটু কেঁপে গেল—“এক বছর গ্রীষ্মে সাহেবের সঙ্গে এলো এক ব্রিটিশ যুবক, নাম ছিল এডওয়ার্ড বেনেট, এলিজা তার প্রেমে পড়ে যায়… কিন্তু এডওয়ার্ড ছিল একজন প্রতারক, সে চেয়েছিল সাহেবের জমিজমা ও কটেজ—এলিজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এক রাতে সে পালিয়ে যায়… আর পরদিন সকালে এলিজার মৃতদেহ পাওয়া যায় ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া অবস্থায়, মাথা ফেটে গিয়েছিল, কেউ বলে সে আত্মহত্যা করেছিল, কেউ বলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল… তদন্ত হয়েছিল, কিছুই প্রমাণ হয়নি, সাহেব ফিরে যান ইংল্যান্ডে… কিন্তু তখন থেকেই কটেজে রাতের বেলা এক মেয়ের কান্নার শব্দ শোনা যেত”—এই পর্যন্ত বলেই বৃদ্ধা চুপ করে গেলেন, কাঁপা হাতে কাপটা নামিয়ে রাখলেন; অনির্বাণ অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু তার ডায়েরি…?”—লেপচা কাকু বললেন, “অনেক বছর আগে এক সাহেবের ঘরে ওটা ছিল, কিন্তু কোথায় গেছে জানি না”—এই রহস্য যেন অনির্বাণকে আরও গভীরে টেনে নিচ্ছিল, যেন সেই মুখটা কেবল মুখ নয়, একজন অপেক্ষমাণ আত্মা, তার গল্প কেউ জানুক, এই আকুতি; দুপুরবেলা সে একা বাংলোর লাইব্রেরি রুমে ঢুকে পড়ে, যেখানে পুরোনো বই, ম্যাগাজিন আর কিছু চিঠিপত্র রাখা, কাঠের তাকের এক কোণে ধুলো জমে থাকা একটি চামড়ার বাঁধাই খাতা চোখে পড়ে, তার উপরে ইংরেজিতে লেখা: “E. Harding – Private Diary”; অনির্বাণের বুক কেঁপে ওঠে, সে ধীরে খাতা খুলে পড়ে—তার ভিতর লেখা রয়েছে এলিজার হাতের লেখা ইংরেজিতে, তার নিঃসঙ্গতা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, চা-বাগানের গন্ধ, এডওয়ার্ডের আগমন, তার ঠোঁটের হাসি, তার গলায় ধাতব ঘড়ির চেইন, প্রতিদিন দেখা হওয়া, গোপনভাবে চিঠি আদানপ্রদান, আর শেষে ধীরে ধীরে বিশ্বাসভঙ্গের অনুভূতি; এক জায়গায় লেখা—“He held my hand near the spiral staircase, and whispered – ‘My darling, I’ll come back for you’… but I saw his eyes. They had no return in them”—আরেক জায়গায় লেখা—“If I fall, let it be known – my soul shall never rest unless my story is told”—এই বাক্যগুলো অনির্বাণকে শিউরে উঠিয়ে দেয়, যেন সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে—এক কুয়াশাভেজা রাতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কিনারে, সাদা গাউনে, হাত ফাঁকা, বুকভাঙা দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে, তারপর সেই চিরন্তন পতন—আর থেমে যাওয়া; অনির্বাণ ডায়েরিটা নিজের ব্যাগে রেখে দেয়, ঠিক করে সে এই গল্প বলবে, হয়তো নিজের ফটো সিরিজের সঙ্গে যুক্ত করবে, তবে সে জানত না, তার এই ‘জানার আকাঙ্ক্ষা’ই হয়তো সেই আত্মাকে আবার জাগিয়ে তুলবে; রাত নেমে আসে, জানালার বাইরে সেই একই কুয়াশা, কিন্তু আজ আরও ঘন, আরও ভারী, যেন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়, সে ডায়েরিটা বিছানায় রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, নিজের মুখের দিকে তাকায়, কিন্তু ধীরে ধীরে যেন তার প্রতিচ্ছবি গলে গিয়ে অন্য এক মুখ হয়ে ওঠে—এক নারীর মুখ, চোখে শূন্যতা, ঠোঁটে একটুখানি কাঁপন, আর মুখটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, যেন আয়নার ভিতর থেকে বাহিরে আসতে চায়; অনির্বাণ পেছনে ঘুরে তাকায়, কেউ নেই, আবার সামনে তাকায়—মুখটা নেই, আয়না পরিষ্কার, শুধু তার নিজের চেহারা, কিন্তু ঘরের মধ্যে হিমশীতল বাতাস, আর ডায়েরির পাতা উলটে যাচ্ছে আপনাআপনি; সে পড়ে—“If someone reads this and believes me, I shall begin to breathe again”—তখনই জানালার কাঁচে আবার সেই মুখ—এবার আরও পরিষ্কার, চোখে যেন ধ্বংসের ছাপ, তবু এক করুণা—আর ঠোঁট পড়তে পারে অনির্বাণ—“Can you help me?”—সে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে কাঁচে, আর তখনই বাইরে বজ্রধ্বনি, পুরো কটেজ কেঁপে ওঠে, যেন ইতিহাস নিজেই শ্বাস নিচ্ছে এই গল্পের মাঝে—এক অসমাপ্ত প্রেম, এক ছিন্ন জীবন, আর এক চিরন্তন অপেক্ষা।

***

পরদিন সকালটা দার্জিলিং-এর চিরচেনা রূপে শুরু হলেও অনির্বাণের মনে যেন সবকিছু নতুনভাবে দেখা দিচ্ছিল—সূর্য যেমন পাহাড়ের মাথায় ঝুঁকে থাকে ঠিক ভোরবেলায়, তেমনি করে তার ভিতরে আলো ফেলছিল এলিজার ডায়েরির প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অসমাপ্ত বাক্য; সে যেন আজ আর পর্যটক নয়, এই কটেজের আত্মিক বাসিন্দা হয়ে উঠেছে, যেন এলিজার অনুরোধের ভার তার কাঁধেই তুলে দিয়েছে। বাইরে বাতাসে একটা আশ্চর্য রকমের নিস্তব্ধতা ছিল, যেন পাইন গাছগুলোও তার প্রতিধ্বনি শুনছিল। সকালে পেম্বার ছেলেকে দিয়ে সে তার ক্যামেরা, ট্রাইপড, ইনফ্রারেড স্যেন্সর আর রিমোট শাটার আনিয়ে নেয়, তার অভ্যাস হল জায়গার রাতের আলোর রেখা ধরতে, সেই থমকে থাকা আলো, যে আলো মানুষের চোখে ধরা পড়ে না কিন্তু সময়ের গভীরে জমে থাকে। সে আজ রাতের জন্য একটা এক্সপেরিমেন্ট ঠিক করল—এলগিন রুমের ভেতরে, ঠিক আয়নার সামনের কোণে একটা লং এক্সপোজার ক্যামেরা বসাবে, সঙ্গে ইনফ্রারেড ক্যাপচার ফিচার, যাতে হিউম্যান মুভমেন্ট থাকলে সে ট্রিগার করে অটোমেটিক ছবি তোলে। এমন ফ্রেমে সেট করল, যাতে জানালার কাচ, আয়না, এবং বিছানার একাংশ একসাথে কাভার হয়। মিসেস লেপচা অবাক হয়ে বললেন, “সাব, এই রুমে কি কোনো ছবি তুলবেন?”—সে মৃদু হেসে বলল, “হয়তো কিছু না হবে, হয়তো সবকিছু বদলে যাবে”—তার গলায় ছিল উত্তেজনা আর ভয়ের মিশ্র স্বর। রাত নামল পাহাড়ের গায়ে ধীরে ধীরে, কুয়াশা জমল জানালার চারপাশে, বাতাসে একটা ধাতব গন্ধ—পুরনো লোহার গেটের মতোন, আর অনির্বাণ বিছানায় শুয়ে থেকেও বুঝছিল, কিচ্ছু ঠিকঠাক নেই। ঘড়িতে রাত বারোটা পঁচিশ, সে জেগে বসে, ক্যামেরার লাল আলো দেখে—চলছে রেকর্ডিং। বাইরের নিঃস্তব্ধতা এমনই যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন ভারি মনে হয়। হঠাৎ বিছানার এক কোণ যেন একটু দুলে উঠল, সে বিশ্বাস করে না ভূতের অস্তিত্বে, কিন্তু শরীরের প্রতিক্রিয়া বলে অন্য কথা—ঘামছে, হাত ঠান্ডা, চোখ দুটো আড়ষ্ট। ঠিক তখনই ক্যামেরার সেন্সর ক্লিক শব্দে জানিয়ে দেয়—মুভমেন্ট ডিটেক্ট হয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে সে দেখে ক্যামেরার লাইভ ভিউতে, আয়নার সামনের হালকা কুয়াশায় একটা ছায়ামূর্তি—নারীমূর্তি, সাদা গাউন, চুল খোলা, মুখে শান্তি আর তীব্র বেদনার মিলিত ছাপ, আর যেন সে ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে সোজা তার দিকে চেয়ে আছে—অনির্বাণের দিকে। সে এক ঝটকায় উঠে পড়ে, চোখের সামনে কিছু নেই, কিন্তু ক্যামেরার স্ক্রিনে সেই মূর্তি স্পষ্ট, ফ্রেমে ধরা পড়ে এক মুহূর্ত, তারপর মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে, যেমন করে ধোঁয়া উড়ে যায় জানালার ফাঁক গলে। পরদিন সকাল, সূর্য উঠেছে, চায়ের কাপ হাতে অনির্বাণ ছাদে বসে, তার ল্যাপটপে গত রাতের ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, কিছু ছবি সাদাকালো, কিছু ইনফ্রারেড ব্লু ফিল্টারে। একটা ফ্রেমে স্পষ্ট ধরা, আয়নার কাঁচে এক নারীমুখ—চোখ দুটো খুলে তাকানো, যেন আত্মা ফুঁপিয়ে উঠেছে। সে ছবিটা বারবার জুম করে, বুঝতে পারে, চেহারার গঠন একেবারে মিলে যায় ডায়েরির পেছনে পাওয়া এলিজার পুরনো ছবি থেকে। সে কেঁপে ওঠে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়—এ তো একটা প্রত্যাবর্তন, এলিজা হয়তো নিজেই চায় তার কথা পৌঁছাক বাইরে, যেন তার অপমৃত্যুর কারণ কেউ খুঁজে বার করে। তখনই সে ঠিক করে—সে যাবে শহরের পুরনো রেকর্ড অফিসে, মিউনিসিপাল লাইব্রেরিতে, হয়তো কিছু কাগজ থাকবে—হার্ডিং সাহেবের কোনো রিপোর্ট, মৃত্যু সংক্রান্ত রেকর্ড, অথবা এডওয়ার্ড বেনেটের বিষয়ে কিছু নথি। দুপুরে সে রিকশা করে নেমে যায় শহরে, যেখানে পুরনো কাঠের দোতলা বাড়ি, গাঁয়ে গাঁয়ে ঝুলছে টেলিফোনের তার, আর পাহাড়ি ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসে দূর থেকে। রেকর্ড অফিসে ঘন্টা তিনেক খোঁজাখুঁজির পর সে একটা পুরনো ইনকুয়েরি রিপোর্ট পায়—তারিখ ১৯০২ সালের জুন, রিপোর্টে লেখা—“Miss Eliza Harding found dead near northern parapet of Elgin Cottage. Witnesses unclear. Mr. Edward Bennett missing from same date.” অনির্বাণ মুখে ফিসফিস করে পড়ে—“missing from same date…”—মানে সে পালিয়েছে, এলিজাকে ফেলে রেখে, আর হয়তো মৃত্যুর পিছনে তার হাত ছিল। অনির্বাণ তখনই স্থির করে, সে এলিজার কাহিনি তুলে ধরবে—একটা ডকুমেন্টারি বানাবে, একটা ফটো-প্রজেক্ট—“The Face in the Mist”—যেখানে শুধু ছবি নয়, ডায়েরির লেখা, ভুতুড়ে ঘটনা, সব কিছু থাকবে। কিন্তু যখন সে সন্ধ্যায় কটেজে ফেরে, তখন সে ভাবে, গল্প তো শুধু অতীত নয়, ভূতেরাও মাঝে মাঝে নিজেরাই বলে দিতে চায় নিজেদের কথা। রাতে আবার ক্যামেরা সেট করে, এবার অডিও রেকর্ডারও চালু রাখে। কিন্তু রাত দুইটা নাগাদ, একটা ফিসফিসে শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার—রেকর্ডারে বাজছে এক নারীকণ্ঠ, খুব নিচুস্বরে—“Edward… where… why…?” তারপর একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস, এবং সব চুপ। সে উঠে আয়নার দিকে তাকায়, আয়নায় আজ কিছু নেই, কেবল নিজের প্রতিবিম্ব—কিন্তু সে জানে, ক্যামেরার ভিতরে, লেন্সের মধ্যে, কেউ হয়তো থেকে গেছে—ধোঁয়ার ভিতর এক মুখ, যে চায় না শুধু ধরা দিতে, চায় মুক্তি, চায় শেষ কথা বলা হোক।

***

রাতের অন্ধকার পাহাড়ের কোলে জমে থাকা ধোঁয়ার মতোই আজ আরও ঘন, অনির্বাণ জানে সে যে কিছু আবিষ্কার করতে চলেছে তা শুধু একটি অতৃপ্ত আত্মার কাহিনি নয়, বরং শতাব্দী পেরিয়ে আসা এক ছায়ার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু—এডওয়ার্ড বেনেট, যার নাম পুরনো কাগজে শুধু একটি নিখোঁজের চিহ্ন হয়ে আছে, অথচ এলিজার ডায়েরিতে বারবার ফিরে আসে তার নাম, তার প্রতিশ্রুতি, তার মিথ্যে ভালোবাসা। পরদিন ভোরে উঠে সে ঠিক করল এবার যাবে গুম, যেখানে আগে একটি ছোট্ট গির্জা ছিল, আর তার পাশেই কিছু ব্রিটিশ সাহেবের কবর; শোনা যায়, এলিজার বাবা মেজর হার্ডিং সেখানে শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন এক পুরোহিতের সঙ্গে থেকে। ট্রেনে এক ঘণ্টা আর পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটার পর সে পৌঁছায় সেই গির্জার ধ্বংসাবশেষে—ছাদ নেই, কাঁচ ভাঙা, অথচ ভিতরে একটা ভাঙাচোরা কাঠের ক্রুশ এখনও টিকে আছে। চারপাশে পাথরের কবরফলক, বেশিরভাগই সময়ের সঙ্গে মুছে গেছে, তবুও একটায় স্পষ্ট লেখা: “Thomas Harding, 1843–1912. Father. Soldier. Lost.” অনির্বাণ ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে, যেন শ্রদ্ধা নিবেদন করে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে পাশের একটি অপরিচিত কবরফলকে—যেটার ওপর কিছু ক্ষতচিহ্ন, যেন কেউ ইচ্ছা করে ঘষে দিয়েছে নাম। তবে নিচে খুব ছোট করে খোদাই করা আছে: “E.B. – Died 1911.” অনির্বাণের বুক কেঁপে ওঠে—E.B. কি তাহলে এডওয়ার্ড বেনেট? কিন্তু সে তো নিখোঁজ ছিল? তাহলে… এখানেই মৃত্যু হয়েছিল? কে তাকে এখানে কবর দিল? এত গোপনে কেন?
সে স্থানীয় একজন প্রবীণ লেপচা বৃদ্ধকে খুঁজে পায়, নাম রিকজিন শেরপা, বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই, যিনি এখনও এই গির্জা ও পুরোনো কবরস্থান রক্ষণাবেক্ষণ করেন। অনির্বাণ তাকে ছবিটা দেখায়—এডওয়ার্ডের একমাত্র পরিচিত পোর্ট্রেট যা ডায়েরির পেছনের পাতায় আঁকা ছিল। বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ দেখে, তারপর চুপ করে বলে, “এই লোক এখানে এসেছিল একবার, সেই ১৯০৭ সালের দিকে… একরকম পাগল হয়ে গিয়েছিল… মুখ দিয়ে অদ্ভুত কথা বলত, বারবার বলত—’আমি ওকে ফেলিনি, আমি ফেলিনি’… তারপর কয়েক মাসের মধ্যে মারা যায়, গায়ে অনেক আঘাতের দাগ ছিল, কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে শাস্তি”—বৃদ্ধ থেমে গিয়ে আরও বলে, “আমার দাদু বলত, রাতে ছায়ার মতো এসে পাইন গাছের নীচে বসে থাকত সে, আর গুনগুন করত—‘Eliza, forgive me’… আমার বিশ্বাস, সেই এলিজার আত্মাই তাকে খুঁজে এনেছিল”—এই তথ্য অনির্বাণকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। সে নিজের মনে ভাবে, তাহলে এলিজার মৃত্যুর পর এডওয়ার্ড পালিয়ে যায়নি, বরং পিছুটানে ফিরে এসেছিল—কিন্তু তখন সে হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে গিয়েছিল, হয়তো এলিজার আত্মা তাকে তাড়া করেছিল, তার মিথ্যে, তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য।
সে গির্জার পেছনে এক জীর্ণ কক্ষে যায়, যেখানে পুরনো কাগজের আলমারি এখনও অর্ধেকভাবে দাঁড়িয়ে—একটা ধুলো ঢাকা রেজিস্টার খুলে পড়ে, তাতে লেখা: “Edward B. admitted for confession. Spoke of betrayal, a fall, and voices in the mist.” তার মানে, মৃত্যুর আগে বারবার সে নিজেই স্বীকার করছিল—কিছু ভুল হয়েছিল, আর হয়তো অপরাধবোধ তার সারা অস্তিত্ব ভেঙে দিয়েছিল। সেই রাতে ফিরে এসে অনির্বাণ আবার ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠাগুলো পড়ে, এক জায়গায় লেখা ছিল—“He thinks I didn’t know, but I saw the letter he wrote—how much my father was to give him for our marriage. I loved him. But he… he sold me”—এই বাক্য অনির্বাণকে ঝাঁকিয়ে দেয়—মানে, এডওয়ার্ড শুধু প্রতারক নয়, ও ছিল একপ্রকার বিক্রেতা, যে প্রেমের বিনিময়ে জমি, সম্পত্তি হাতাতে চেয়েছিল। কিন্তু এলিজা বুঝেছিল শেষ মুহূর্তে, এবং হয়তো সেই সংঘর্ষেই তার মৃত্যু ঘটে। পরদিন সকালে অনির্বাণ নিজের ক্যামেরা, ল্যাপটপ, অডিও ক্লিপ আর এলিজার ডায়েরি নিয়ে সোজা যায় সেন্ট পলস স্কুলের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষিকা মিসেস ডি’কোস্টার কাছে, যিনি দার্জিলিংয়ের ব্রিটিশ সময়কার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। তিনি সব শুনে বিস্মিত হন, বলেন, “এই গল্পটা কেউ কখনো লিখে রাখেনি… কেউ বিশ্বাস করত না এলিজা আর এডওয়ার্ড সত্যিকারের মানুষ ছিলেন… লোকমুখে থাকা এক ‘ghost tale’ ছাড়া কিছুই ছিল না”—অনির্বাণ তখনই স্থির করে, এই কাহিনি এখন শুধু তার প্রজেক্ট নয়, এলিজার ন্যায় বিচারের একটা পথ। সে শহরের ছোট একটা গ্যালারিতে তার ছবি, অডিও ক্লিপ, ডায়েরির পাতাগুলো স্ক্যান করে একটা প্রদর্শনী আয়োজন করে—নাম দেয় “The Mist Remembers”। উদ্বোধনের দিন সে দেখে, অনেক স্থানীয় মানুষ এসেছে, কেউ ছবি দেখছে, কেউ অডিও শুনছে—আর একটা অংশে সে ক্যামেরায় তোলা সেই মুখ—আয়নার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা, চোখে করুণা, ঠোঁটে চাপা যন্ত্রণার ছাপ—সেই ছবি সামনে দেখে অনেকেই থমকে যায়।
অনির্বাণ জানে, এ কোনো হরর নয়, এটা ইতিহাস, যেখানে এক মেয়ে শুধু ভালোবেসেছিল, বিশ্বাস করেছিল, আর মৃত্যুর পরও অপেক্ষা করে গিয়েছিল কেউ যেন তার গল্প শোনে। প্রদর্শনীর শেষ অংশে সে রাখে একটি চিঠি, যা সে নিজেই লিখেছে এলিজার উদ্দেশে—“You are not forgotten. I saw you, I heard you, and now the world will know.”
সেই রাতেই কটেজে ফিরে এসে সে শেষবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কুয়াশা আজও জমেছে জানালায়, বাইরে পাইন গাছের পাতায় বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, কিন্তু আজ আর ভয় করে না। আয়নায় আজ এলিজার মুখ নেই, শুধু নিজের প্রতিবিম্ব, আর একধরনের তৃপ্তি। সে জানে, হয়তো এবার এলিজা শান্তি পেয়েছে। জানালার কাচে এক বিন্দু জল জমে, ঠিক চোখের আকারে, যেন কেউ ধন্যবাদ জানিয়েছে, আর ভোরের আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে—একটি মুখ, ধোঁয়ার ভিতর থেকে উঠে এসে এখন শেষবারের মতো মুক্ত হচ্ছে।

***

দার্জিলিং-এর সেই কুয়াশাভেজা পাহাড়ি সকালগুলোতে এখন আর অনির্বাণ কোনো অতিপ্রাকৃত কিছুর জন্য অপেক্ষা করে না। এলিজা হার্ডিংয়ের গল্প শেষ হয়ে গেছে—না, ঠিক শেষ নয়—সে বিশ্বাস করে, তার আত্মা হয়তো এখন আর ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে ছুটে বেড়ায় না, আয়নার ওপারে দাঁড়িয়ে চোখে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে তাকায় না। কারণ তার কথা, তার যন্ত্রণা, তার নিঃশব্দ আর্তনাদ অবশেষে কেউ শুনেছে। কিন্তু এই বিশ্বাস নিয়েই হয়তো শুরু হচ্ছে এক নতুন অধ্যায়—যেখানে অতীত একটানা থেমে থাকে না, বরং বেছে নেয় নতুন নতুন মানুষকে, যারা তার অসমাপ্ত গল্পগুলো শেষ করতে পারবে।

প্রদর্শনীর শেষদিনে, যেখানে অনির্বাণ তাঁর প্রজেক্ট “The Mist Remembers”-এর প্রতিটি দিক তুলে ধরেছিল, সেখানে এক বয়স্ক ব্রিটিশ ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক কোণে। তাঁর চোখদুটো খুব উজ্জ্বল, অথচ চাহনিতে ছিল শতাব্দীর ভার। নাম বললেন—পিটার বেনেট। বয়স প্রায় সত্তর, ইংল্যান্ড থেকে আসা, ভাষায় পুরোনো কোলোনিয়াল ছোঁয়া, কিন্তু চিঠির মতো স্পষ্ট উচ্চারণ। তিনি কেবল একটি কথাই বললেন, “My great grandfather was Edward. They never told us what happened to him in India. Only that he went missing after some scandal.”

অনির্বাণ প্রথমে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মানে, সত্যি সত্যি একজন উত্তরসূরি বেঁচে আছেন—এডওয়ার্ড বেনেটের বংশধর। পিটার আরও বলেন, তিনি প্রদর্শনীর ফ্লায়ারটি অনলাইনে দেখে এসেছেন, আর বিশেষভাবে দেখতে চেয়েছিলেন সেই আয়নার ছবি—যেটাতে এলিজার মুখ ধরা পড়েছিল। অনির্বাণ তাঁকে ডায়েরির অনুলিপি, অডিও ক্লিপ এবং ক্যামেরা ফ্রেমগুলো দেখায়। একসময় পিটার চুপ করে একটা চিঠি বের করেন নিজের কোটের ভিতর থেকে—হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে লেখা, ইংরেজিতে কাঁপা হাতে লেখা কয়েকটি লাইন—

“If anyone ever finds this letter, know that I never meant to hurt her. I was weak, I was tempted, but I loved Eliza… And I deserve every shadow that follows me.”
— Edward B., 1910.

চিঠিটা সম্ভবত মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা হয়েছিল। কিন্তু কখনো পাঠানো হয়নি। অনির্বাণের চোখে জল চলে আসে। সে জানে, এই একটা কাগজের টুকরো হয়তো সেই মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না, কিন্তু তার স্মৃতি আজ আর একতরফা নয়। এখন সেটা ইতিহাসের অংশ।

কটেজে ফেরার সময় অনির্বাণ উপলব্ধি করল, সবকিছু বদলে গেছে। পাইন গাছগুলো আজ যেন একটু বেশি নুয়ে এসেছে, যেন নমস্কার জানাচ্ছে কাউকে। এলগিন রুমের আয়নাটা সে খুলে বসায় নিজের দিকে। আয়নায় কুয়াশা নেই, কিন্তু নিজেকে সে দেখতে পায় অন্য চোখে—একজন সত্যিকারের গল্প-বহনকারী হিসেবে। যে কেবল ভূতের ছবি তোলে না, বরং আত্মাদের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করে, মৃতদের অসমাপ্ত কথা শেষ করতে চায়।

সেই রাতে কটেজে কোনো অস্বাভাবিকতা ঘটে না। জানালার কাচে বৃষ্টির টপটপ শব্দ, গরম জলের পাত্রে ভেষজ চা আর বিছানায় এলিজার ডায়েরির পাশে এখন আর ভয় নেই। তবে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—ঘুমের ঘোরে হঠাৎ সে শুনতে পায় কারও কণ্ঠস্বর, একদম ক্ষীণ, মৃদু, মেঘের ফাঁকে যেন গলে যাওয়া সুরে—

“Thank you…”

সে উঠে বসে, ঘড়ি দেখে—রাত ঠিক তিনটে। বাইরে কুয়াশা গাঢ়, তবুও আজ তার বুক ধুকপুক করছে না। সে জানে, এ ভয় নয়। এ শান্তি। এ এলিজার শেষ বিদায়।

দুই সপ্তাহ পরে অনির্বাণ কলকাতায় ফিরে আসে। তার প্রজেক্ট আন্তর্জাতিক গ্যালারিতেও আগ্রহ তৈরি করে। BBC Radio তার অডিও ফাইল নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে চায়, আর সে নিজেই লেখে একটা বই—”The Face in the Mist: A True Haunting from Darjeeling”। বইটা শুধু একটি ভূতের গল্প নয়, বরং ব্রিটিশ রাজত্বের সময়ের এক নারী, যার কথা কেউ শোনেনি—তার আত্মার স্মরণিকা। বইটির ভূমিকায় সে লেখে—

“This is not a story of fear. This is a story of forgetting. Of how we forget those who were betrayed, those who died unheard. And sometimes, in the mist, they return—not to haunt, but to be remembered.”

আর যখন বইটি প্রকাশিত হয়, সেই আয়নার ছবিটি প্রচ্ছদে থাকে। নিচে একটি ছোট্ট উক্তি—”She is watching. Not for revenge, but for peace.”

আর সেই সময়ের মধ্যে, এলগিন কটেজকে সরকার হেরিটেজ ঘোষণার উদ্যোগ নেয়। মিসেস লেপচা জানান, এখন পর্যটকেরা শুধু পাহাড় দেখতে আসে না, তারা আসে এলিজার গল্প জানতে। আয়নার ঘরটি সংরক্ষিত, ছবি তোলার জায়গা নির্ধারিত। আর ঘরের পাশে একটি ছোট্ট ফলক বসানো হয়—

“Eliza Harding, 1888–1902. Not lost. Not forgotten.”

আর অনির্বাণ? সে আজও মাঝে মাঝে আয়নার ছবি তুলে। কিন্তু এখন ক্যামেরা শুধু ছায়া খোঁজে না—স্মৃতি খোঁজে, সত্য খোঁজে, আর সময়ের ভিতর থেকে উঠে আসা সেই এক মুখ, ধোঁয়ার ভিতর থেকে তাকানো এক প্রাচীন, ভাঙা কণ্ঠস্বর—যার একমাত্র চাওয়া ছিল, কেউ যেন তাকে সত্যি মনে রাখে।

1000026958.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *