পুরবী রায় শর্মা
অধ্যায় ১: পুরনো মানচিত্রের ছায়া
কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। জানালার ফাঁক গলে সোনালি রোদের রেখা ছুঁয়ে যাচ্ছে পুরনো কাঠের টেবিলের ধূলো জমা পৃষ্ঠ। সেই টেবিলে বসে অভীক ঘোষ ডুবে ছিল একটা ছেঁড়া বইয়ের পাতায়। বইটি এক ব্রিটিশ অভিযাত্রীর লেখা—১৮৭০ সালের মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত। অভীক এসব নিয়ে আগেও কাজ করেছে, তবে আজকের সন্ধান তার সমস্ত আগ্রহকে এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করে ফেলেছে। কারণ, পাতার প্রান্তে আঁকা একটি ছোট, অদ্ভুত মানচিত্র, তার মনোযোগ টেনে নিয়েছে।
“এইটা কোনো সাধারণ নক্সা না…” সে নিজের মনেই ফিসফিস করে বলে। বইয়ের পাশে রাখা মাগে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে ততক্ষণে, কিন্তু অভীক সেটা খেয়াল করেনি। মানচিত্রে সাদা কালির হালকা দাগে আঁকা ছিল একটা নদী, তার ধারে কয়েকটি চিহ্ন—একটি তারার মতো, একটি ত্রিভুজ আর একটি বৃত্ত। পাশেই লেখা ছিল একটি বাংলা পংক্তি:
“ছায়ার ঘরে কাঁচের দরজা, ধূলোর নিচে সোনা ভরা।”
অভীক বুঝতে পারছিল, এটি কোনো গানের লাইন নয়। এ যেন এক ধাঁধা। আর এমন ধাঁধার প্রতি তার বরাবরই দুর্বলতা।
“এইটা একটা কোড হতে পারে,” সে বলে। “কাঁচের দরজা মানে কি—আয়না? না কি গোপন দরজা? আর ছায়ার ঘর বলতে কি ভূতের কথা বলছে, না পুরনো কোন বন্ধ কক্ষ?”
তার চোখে চকচক করছে সেই পুরনো উন্মাদনা, যেটা কেবলমাত্র একটি সত্যিকারের অভিযানে বের হওয়ার আগ মুহূর্তেই দেখা যায়।
হঠাৎ দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে মীরা সেন—তার বন্ধু, সহ-গবেষক ও প্রায়-অফিসিয়াল অংশীদার। গাঢ় নীল টপ, কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ, আর চোখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
“তুই আবার কোনো গুপ্তধনের পেছনে লাগছিস না তো?” মীরা বলে।
অভীক হাসে, সেই চেনা দুষ্টু হাসি।
“এইবারটা সত্যিই কিছু পেয়েছি মীরা। দেখ তো এই ম্যাপটা। এটা হয়ত ওই হারিয়ে যাওয়া জাফরগঞ্জ জমিদারির একটা মানচিত্র।”
“জাফরগঞ্জ?” মীরা কৌতূহলী। “ওটা তো সেই জমিদারবাড়ি যেখানে এক সময় নাকি নবাব সিরাজের দুধ ভাইদের একটা গুপ্তচুক্তি হয়েছিল। আর লোকজন বলে ওখানে রাতে ছায়ারা হাঁটে।”
অভীক মাথা নেড়ে বলে, “ঠিক তাই। আর এই মানচিত্রে দেখ তো—এই নদীটা ভাগীরথী বলেই মনে হচ্ছে। তার ধারে এই চিহ্নগুলোর মানে হতে পারে একটা ট্রেইল। আর এই পংক্তিটা দেখেছিস?”
মীরা পংক্তিটি পড়ে, ঠোঁট টিপে ধরে।
“তুই বলতে চাইছিস, ওই বাড়ির নিচে কিছু একটা লুকোনো আছে?”
“ঠিক তাই,” অভীক উত্তেজিতভাবে বলে। “আর আমি যাচ্ছি সেটা খুঁজতে। তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।”
মীরা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। বাইরে তখন সূর্যটা প্রায় অস্ত যাচ্ছে।
“আচ্ছা, ধর আমরা যাই। ধরেই নিলাম ওখানে সত্যিই কিছু আছে। কী ধরনের জিনিস হতে পারে?”
“পুরনো মুদ্রা, সোনার অলংকার, জমিদারি দলিল, ব্রিটিশ আমলের অস্ত্র, হয়তো কিছু প্রমাণ—যা ইতিহাস বদলে দিতে পারে,” অভীক বলে, যেন স্বপ্ন দেখছে।
“তাহলে প্রস্তুতি নে। তবে সাবধান—এগুলো মিথও হতে পারে। বেশি আশা কোর না।”
দু’দিনের মধ্যেই তারা কলকাতা থেকে রওনা দিল। মুর্শিদাবাদের দিকে, ভাগীরথীর পাড় বরাবর ছোট্ট একটা বাসস্ট্যান্ড থেকে নামতে হলো। সেখান থেকে ভ্যান রিকশা করে যেতে হয় জাফরগঞ্জ গ্রামে। অভীক আগেই স্থানীয় সূত্রে এক গাইড ঠিক করেছিল—কুশল নামের এক যুবক, যে এই অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে বেশ জানে।
জাফরগঞ্জ পৌঁছানোর পর প্রথম চমক ছিল সেই জমিদার বাড়িটা। ভগ্নপ্রায়, কিন্তু বিশাল। লাল ইটের গায়ে জং ধরা লতাপাতা, ভেতরের কাঠের জানালা ভাঙা। পেছনের দিকটা পুরোপুরি ঝোপঝাড়ে ঢাকা।
“এই বাড়িতে শেষ লোক এসেছিল প্রায় তিরিশ বছর আগে,” কুশল বলল। “সেই সময় থেকেই লোকেরা বলে, এখানে রাতে কেউ হাঁটে। তবে আমি বিশ্বাস করি না। ইতিহাস লুকিয়ে থাকলে, ভূত নয়—মানুষই সেটা লুকিয়ে রাখে।”
ভবনের ভেতরে ঢুকে তারা প্রথমে একটা পুরনো দালানঘর খুঁজে পেল। মেঝেতে সাপের খোলস, মাকড়সার জাল, আর বাতাসে জমে থাকা সোঁদা গন্ধ। দেয়ালে হালকা গাঢ় রঙের প্যাঁচ, যেটা দেখে মনে হলো, আগে কিছু ঝোলানো ছিল।
হঠাৎ মীরার চোখে পড়ল একটা ফাটল। “অভীক, এই দেয়ালটা অদ্ভুত ঠেকছে না?”
অভীক হাত রাখল ফাটলের ওপর, টোকা দিলো। ভেতরটা খালি খালি শব্দ করল।
“মনে হচ্ছে ভেতরে একটা গোপন কক্ষ আছে,” সে বলল।
তারা মাটি সরিয়ে সরিয়ে একটা পাথরের ঢাকনা পায়। সেটি এক প্রাচীন কূপের মুখ, তবে ভিতরে আর জল নেই। বরং এক গহ্বর। অভীক টর্চ ফেলে দেখে নিচে সিঁড়ি!
“এটা তো যেন সিনেমা!” মীরা বলে।
কুশল হেসে বলে, “আমার ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলাম, এই জমিদারবাড়ির নিচে একটা তলঘর আছে। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত তা খুঁজে পায়নি। হয়তো তোমরা পেয়েই গেছো।”
তিনজন নেমে পড়ে। নীচে গিয়ে তারা দেখে ছোট্ট একটি পাথরের কক্ষ, দেয়ালে আঁকা কিছু লিপি। লিপিগুলো অচেনা হলেও, এক কোণায় পাওয়া যায় একটা ছোট্ট আয়নার ফ্রেম—ভাঙা হলেও এখনও চকচক করছে।
মীরা চিৎকার করে ওঠে, “এটাই তো ‘কাঁচের দরজা’!”
তবে আরেকটি বিষয়ের দিকে সবার চোখ পড়ে—দেয়ালের একপাশে আঁকা সেই একই মানচিত্র, যেটা অভীক পেয়েছিল বইয়ে!
এখন আর কোনো সন্দেহ ছিল না—গল্পটা মিথ নয়, এখানে সত্যিই কিছু লুকিয়ে আছে।
কিন্তু হঠাৎই ছাদ থেকে পড়ে একটা কালো বাদুড়, আর সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের পেছনের দরজায় একটা শব্দ—মৃদু চাপা ধাক্কা।
তিনজন থেমে যায়। কুশল ফিসফিস করে বলে, “আমরা একা নই।”
আশেপাশে তাকিয়ে অভীক দেখতে পায়, সেই ছায়া—দেয়ালে পড়ে আছে যেন কারো উপস্থিতি। ছায়ার ঘরে তারা প্রবেশ করেছে, কিন্তু কাঁচের দরজার ওপারেই অপেক্ষা করছে ইতিহাসের কুয়াশা, আর হয়তো কারা যেন…
গল্পের ঠিক এখানেই থেমে যায় প্রথম অধ্যায়। শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস রহস্যভেদের যাত্রা—ধূলোর নিচে সোনার ছায়ার খোঁজে।
অধ্যায় ২: জমিদার বাড়ির অন্ধ গলি
অন্ধকারে অভীকের হাতে ধরা টর্চের আলো যেন কাঁপছিল তার নিজের শ্বাসের ছন্দে। নিচের সেই পাথরের কক্ষে কেবল বাতাসের সোঁদা গন্ধ, দেয়ালের ভেজা কাঁচ এবং তাদের নিঃশব্দ পায়ের শব্দ। তারা থেমে গিয়েছিল হঠাৎ পড়া ছায়ার কারণে। অভীক আয়নার ফ্রেমটা তুলে হাতে নেয়, টর্চের আলো ফেলে দেখে—ফ্রেমের পেছনে কী যেন খোদাই করা।
“দ্যাখো, এখানে কী লেখা আছে,” সে বলে।
মীরা কাছে এসে চোখ বুলায়। খোদাইটা আধভাঙা, তবে স্পষ্ট তিনটি শব্দ:
“তিন দরজা, এক পথ।”
“এটা নতুন ধাঁধা?” মীরা ফিসফিস করে।
“হয়তো সেই গুপ্তধনের প্রবেশপথের চাবিকাঠি,” অভীক বলে।
কুশল তখন একটা দিক ঘেঁষে দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করে।
“এই দেয়ালটা খেয়াল করেছ? পাথরের ধরনটা আলাদা। মনে হচ্ছে, এটা একটা খোলা দরজার পথ ছিল যা ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
অভীক হাত রাখে দেয়ালে। টর্চের আলোয় দেখা যায় চুনচাপা করা ইটের রেখা।
“এটা ভেঙে দেখা দরকার। ওদিকে আমার কাছে ছোট একটা হাতুড়ি আছে ব্যাগে।”
সে ব্যাগ খুলে জিনিস বের করে, আর তিনজনে মিলে ধীরে ধীরে ইটগুলো খুলতে শুরু করে।
পনেরো মিনিটের মাথায় এক ফাঁকা গহ্বরের মুখ দেখা যায়। মীরা টর্চ ফেলেই বলে, “এখানে একটা সিঁড়ি নিচে গেছে, আরও অন্ধকারে।”
তারা টর্চ নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকে। নিচে নেমে দেখে ঘরের মাপ বড়, কিন্তু দেয়ালের গায়ে গায়ে পাথরের খোপ, যেন দানবাক্স। প্রতিটি খোপে কিছু নেই, শুধু কড়ার মতো পাথরকুচি। তবে এক কোণে একটিতে চকচকে কিছু দেখা যাচ্ছে।
অভীক সেটি তোলে—একটি ব্রোঞ্জের গোল ডিস্ক, তাতে ত্রিকোণ চিহ্ন।
“এইটা সেই মানচিত্রের চিহ্নের একটি!” সে বলে। “তার মানে আমরা একদম ট্রেইলেই আছি।”
মীরা তখন বলে, “তাহলে এখন এই ত্রিকোণ চিহ্নের অর্থ বুঝতে হবে। সেই পুরনো পংক্তিতে বলা ছিল—’ছায়ার ঘরে কাঁচের দরজা, ধূলোর নিচে সোনা ভরা।’ ছায়ার ঘর মানে হয়তো এটাই। কাঁচের দরজা পেছনের দরজার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ‘তিন দরজা, এক পথ’ কথাটা মনে আছে তো? হয়তো আমাদের সামনে এখন তিনটি বিকল্প থাকবে।”
ঠিক সেই সময় দেয়ালের পাশের আরেকটি পথ খুলে যায়—নিজে থেকেই।
“এটা কি কোনো গিয়ার সিস্টেম? আমাদের ইট খোলার ফলে কী একটিভ হলো?” কুশল ভাবে।
তারা সামনে এগিয়ে দেখে তিনটি পথ আলাদা হয়ে গেছে—একটা বাঁ দিকে, একটা সোজা, একটা ডান দিকে।
“তিন দরজা!” অভীক বলে।
প্রতিটি দরজার উপরে খোদাই করা চিহ্ন—একটিতে সূর্য, একটিতে চোখ, একটিতে হাত।
“এই চিহ্নগুলোর মানে কী হতে পারে?” মীরা বলে।
“সূর্য মানে আলো, হয়তো সবচেয়ে সহজ পথ। চোখ মানে নজরদারি—সম্ভবত বিপদ বেশি। হাত মানে হয়তো বুদ্ধি বা প্রয়াসের পথ,” অভীক ভাবে।
তারা সিদ্ধান্ত নেয়—প্রথমে বামদিকের ‘হাত’ চিহ্নের পথ দিয়ে এগোবে।
সেই গলিপথ ছিল সংকীর্ণ, নিচু মাথা করে হাঁটতে হয়। দেয়ালের গায়ে কাঁটাযুক্ত শিকের মতো ঝুলন্ত কিছু ছিল—পুরনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা!
মীরা একবার অসাবধানে ধাক্কা খায়, তার স্কার্টে এক ফাঁক!
“এই গলি তো ফাঁদে ভরা,” সে চিৎকার করে ওঠে।
“সাবধানে চল,” কুশল বলে। “প্রতিটি ধাপে হয়তো কিছু লুকিয়ে আছে।”
পথের শেষে একটা ছোট দরজা—তাতে ঝুলছে একটা তালা, কিন্তু চাবি নেই। অভীক ঘেঁটে দেখে সেই ব্রোঞ্জের ডিস্কটা, সেটি এই তালার গায়ে রাখতেই “টিক” শব্দ করে দরজা খুলে যায়।
তার মানে, প্রতিটি পথে একটি করে চিহ্ন আছে, এবং প্রতিটি তাদেরকে আরও গভীর রহস্যের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
ভেতরে ঢুকে তারা দেখে—একটা খালি কক্ষ, যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি খোলা কুয়ো। এবং কুয়োর ভিতর থেকে এক ধাতব গন্ধ ভেসে আসছে।
“এই কুয়োটা আসলে একটা বায়ুচলাচল চেম্বার, নিচে আরেকটি তলা আছে,” অভীক ব্যাখ্যা করে।
তারা তখন কুয়োর চারপাশে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। হঠাৎ কুশল দেয়ালে হালকা চাপ দিতেই পাশের দেয়াল খুলে যায়—স্লাইডিং মেকানিজম! আর সেখানে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি, মুখে কাপড় বাঁধা, হাতে লম্বা ছুরি!
“পিছনে যাও!” অভীক চিৎকার করে।
কিন্তু ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। কুশল ব্যাগ থেকে দ্রুত একটি টর্চ ছুঁড়ে মারে—তার আলোয় মুখ উন্মোচিত হয়।
এক মধ্যবয়সী লোক, চোখে রক্তচোখা ঘৃণা। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু তার কণ্ঠস্থ কেবল একটি শব্দ—
“ফিরে যাও… ওটা তোমাদের জন্য নয়।”
এর পরেই ছায়ামূর্তি এক ধাক্কায় পাশের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং অদৃশ্য হয়ে যায় গোপন পথ দিয়ে।
তিনজন স্তব্ধ।
“এখন এটা পরিষ্কার, আমরা একা নই,” মীরা বলে।
“আর কেউ চায় না আমরা এগোই,” কুশল বলে।
“অথচ আমি জানি আমরা সঠিক পথে আছি,” অভীক বলে দৃঢ়স্বরে। “এই খেলাটা এখন থামানো যাবে না।”
সেই রাতে তারা অস্থায়ীভাবে গ্রামের এক পরিত্যক্ত লাইব্রেরিতে ঘাঁটি গড়ে। সেখানে অভীক মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখে ও খেয়াল করে—আগে চোখে পড়েনি এমন একটি অতি ক্ষুদ্র চিহ্ন—‘∞’ চিহ্নের মতো, একটি খোলা রশ্মির ইঙ্গিত।
“এটা তো অনন্তের প্রতীক… নাকি একটি গোপন গলিপথের?”
তারা সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন সূর্য ওঠার আগেই আবার প্রবেশ করবে জমিদার বাড়িতে।
কিন্তু তার আগেই, রাত তিনটেয় কেউ দরজায় ধাক্কা দেয়।
একটি ছেঁড়া কাগজ—তাতে লেখা কেবল একটি লাইন:
“তোমরা যা খুঁজছ, সেটি যদি জাগে, সে কাউকে বাঁচতে দেবে না।”
তিনজনে একে অপরের মুখের দিকে চায়।
গল্প এখন আর কেবল ইতিহাসের নয়, এখন তা হয়ে উঠেছে প্রাণের, বিশ্বাসের, আর অজানা কোনো শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষের।
অধ্যায় ৩: ছায়াদের রাত
রাত তখন গভীর। জাফরগঞ্জ গ্রামের উত্তর প্রান্তের সেই পুরনো লাইব্রেরি ঘরটি নিস্তব্ধ, শুধু জানালার বাইরের বাঁশঝাড়ে বাতাসের সুর। ভেতরে অভীক, মীরা আর কুশল বসে আছে ছোট টেবিল ঘিরে। টেবিলের উপর ছড়ানো মানচিত্র, ব্রোঞ্জের ডিস্ক, ভাঙা আয়না আর সেই অদ্ভুত কাগজ—যেটিতে লেখা:
“তোমরা যা খুঁজছ, সেটি যদি জাগে, সে কাউকে বাঁচতে দেবে না।”
মীরা একবার কাগজের দিকে, একবার দরজার দিকে তাকায়।
“কে রেখে গেলো এটা? কেউ আমাদের অনুসরণ করছে,” সে ফিসফিস করে।
“আমাদের রুটিন, এমনকি আমাদের ঘাঁটি—সব জানে কেউ,” অভীক বলে।
কুশল চুপচাপ একটা খাতা টেনে নেয়।
“এই লাইব্রেরিটা আগে জমিদার পরিবারের ব্যক্তিগত আর্কাইভ ছিল। এখানে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে,” সে বলে।
পুরনো খাতা, দলিল আর বিবরণ ঘেঁটে তারা সন্ধান পায় ১৮৩৯ সালের একটি বিবরণে—যেখানে জমিদার রঘুনাথ রায়ের এক ‘আন্তরিক অতিথি’ রাত্রিকালে নিখোঁজ হয়েছিল। বিবরণে লেখা ছিল—
“তাঁর শেষ অবস্থান ছিল পশ্চিম দালানে, যার নীচে একটি কাচঘেরা প্রকোষ্ঠ ছিল। সে রাতের পর, প্রতিদিন সেই ঘরের দেয়ালে ছায়া দেখা যেত, কারও না থাকা সত্ত্বেও। কর্মচারীরা বলত, রাত তিনটেয় কেউ হাঁটে, মুখ নেই, কেবল ছায়া।”
“এটাই তো ছায়াদের গল্প,” মীরা কাঁপা গলায় বলে।
অভীক ফাইলটা বন্ধ করে, টর্চ হাতে নেয়।
“কাল রাতের আগেই আমাদের জমিদার বাড়ির পশ্চিম দালানে যেতে হবে। ওটাই আসল সূত্র।”
তারা আবার যায় বাড়িতে—এইবার মধ্যরাত পেরিয়ে। গ্রামের সবাই তখন নিদ্রামগ্ন, কেবল তাদের পায়ের ধুপধাপ শব্দ ভেসে আসে।
জমিদার বাড়ির পশ্চিম পাশটা আগের থেকে বেশি নিঃসাড় লাগে। ছাদের কাঠ ভেঙে পড়েছে কিছু অংশে, দেয়ালের চুন খসে পড়েছে। কিন্তু একটি জানালা হালকা খোলা, যেন কেউ সেদিক দিয়েই বেরিয়েছে।
“ভিতরে চল,” কুশল ইশারা করে।
তারা দেয়াল ঘেঁষে ঢুকে পড়ে। ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে একটি হলঘরে—যেখানে মেঝেতে জং ধরা আয়না ছড়িয়ে, চারপাশে পুরনো মোমবাতির স্ট্যান্ড। হঠাৎ অভীক থেমে যায়।
“ওই আয়নাটার পাশের ছায়াটা খেয়াল করছো?”
তারা তিনজনই একসঙ্গে ঘুরে তাকায়—দেয়ালে তাদের তিনটি ছায়া থাকার কথা, কিন্তু আছে চারটি।
চতুর্থ ছায়াটা চলেছে একটু আলাদা ছন্দে, যেন দুলছে বাতাসে। মুখ নেই, চোখ নেই, কেবল একটা মানুষের মতো আকার।
মীরা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “এইটা কী… আমাদের মধ্যে কেউ না?”
ছায়াটা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়—আয়নার দিকে। আর আয়নার কাচে দেখা যায় কিছু—একটি মেয়ের মুখ, চোখ বন্ধ, কপালে একটি লাল বিন্দু। কিন্তু আয়নার সামনে কেউ নেই।
“এই জায়গাটা একটা টাইম ফাঁদ!” অভীক হঠাৎ চিৎকার করে।
“মানে?” কুশল বলে।
“আয়নার পিছনে সময় আটকে গেছে। এটাই সেই ‘কাঁচের দরজা’। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সংযোগস্থল।”
তখনই আয়নার পাশ থেকে এক ধাতব শব্দ—টিক টিক টিক…
একটি পুরনো ঘড়ি নিজে থেকে চলতে শুরু করে। তার কাঁটা চলছে উলটোদিকে। আর দেয়ালে ভেসে উঠছে সেই চেনা লাইন—
“তিন দরজা, এক পথ। তবে যাহারা ছায়া নড়ে, তাহাদের ফেরার পথ নেই।”
ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয় ৩টার ঘরে। আবার ছায়াটা ভেসে ওঠে—এইবার অনেক স্পষ্ট। মেয়েটির মুখটা এবার দেখা যায় পুরোটাই, তার চোখ খোলা, এবং তারা সরাসরি অভীকের দিকে তাকানো!
“অভীক,” মীরা চাপা স্বরে বলে, “তুই কি ওকে চেনিস?”
অভীক স্তব্ধ। তার মনে পড়ে, বহু বছর আগে, এক প্রত্নতত্ত্ব প্রতিযোগিতায় সে একজন রহস্যময় ছাত্রীর সাথে দেখা করেছিল—নাম ছিল ঈশিতা। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতো। হঠাৎই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। অভীক পরে জানতে পারে, ঈশিতা এক গুপ্ত স্থানের খোঁজে এসেছিল।
“এটা কি ঈশিতা…?” অভীক ফিসফিস করে।
“হয়তো তার আত্মা আটকে আছে এই বাড়ির কোথাও,” কুশল বলে। “এটাই হয়তো সেই ছায়াদের একজন।”
ঘরের মধ্যে হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস বইতে থাকে। আয়নার ওপর ধোঁয়া জমে, এবং তাতে লেখা ভেসে ওঠে:
“অতীতকে জাগিও না, যা ঘুমিয়ে গেছে…”
মীরা চিৎকার করে বলে, “চলো এখান থেকে বের হই!”
তারা দৌড়ে ঘর ছাড়ে। তবে এবার দরজা বন্ধ। পেছন থেকে ছায়ার পদধ্বনি শোনা যায়।
“ঘরের এক কোনায় খোলা গলি আছে, ঐটাই আমাদের শেষ রাস্তা,” কুশল বলে।
তারা সেই পথ ধরে দৌড়ে বের হয়ে পড়ে দক্ষিণ পাশের ছাদঘরে, যেখানে চাঁদের আলোয় দেখা যায়—একটি খোলা পাথরের ফলক, যার নিচে লেখা—
“ধূলোর নিচে সোনা ভরা।”
“এইটাই তো সেই জায়গা!” অভীক বলে।
তারা মাটি খুঁড়তে শুরু করে। এক ফুট নিচেই ঠোকা লাগে ধাতবে। কুশল সাবধানে মাটি সরিয়ে তোলে একটি আয়তাকার লোহার বাক্স।
মীরা ধীরে বাক্স খুলে দেখে—তার মধ্যে আছে কয়েকটি সোনার মুদ্রা, একটি প্রাচীন সিল, ও একটি খাতা।
খাতার পাতায় লেখা এক লাইন:
“যারা সত্যি জানে, তারাই মৃত্যুকে জয় করতে পারে। বাকিরা ছায়া হয়ে যায়।”
ঠিক তখনই একটা আর্তচিৎকার ছাদঘরের পেছন থেকে। তারা ফিরে দেখে, সেই ছায়ামূর্তি আবার এসেছে—এইবার হাতে আগুনের টর্চ।
“সব বন্ধ করে দাও। ওকে জাগিও না।”
আভীক সে মুহূর্তে বুঝে যায়—ওটা ঈশিতার আত্মা নয়, বরং কাউকে আটকে রাখতে চায় সেই শক্তি।
“আমরা যদি সবটা জাগাই, হয়তো অতীত বদলে যাবে।”
মীরা ধীরে বাক্স বন্ধ করে।
“তাহলে এখন?”
অভীক চোখ তুলে দেখে—চাঁদের আলোয় ছায়া আর নেই। সেই অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি যেন ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু তারা জানে—খেলা এখনই শুরু।
অধ্যায় ৪: কবিতার ছন্দে লুকানো পথ
ভোরের আলো যখন মুর্শিদাবাদের দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন অভীক, মীরা ও কুশল বসে ছিল সেই পুরনো লাইব্রেরির কাঠের টেবিলে, যার গায়ে জং ধরা নখ, আর ফাঁকা তাক। রাতের ছায়া কেটে গেলেও তাদের চোখে এখনও ভয়ের ছায়া রয়ে গেছে। কিন্তু তাদের সামনে পড়ে আছে সে বাক্স, যার ভেতর লুকানো ছিল সময়ের আটকে থাকা ইতিহাস—আর একটি কবিতার খাতা।
অভীক ধীরে পাতাটি খুলে পড়ে—
“যে শ্বাস রাখে নিরালায়,
সে দেখে দেয়ালে জ্যোৎস্না।
যে আলো পায় না দিনের,
সে রচে রাত্রির পথ।
তিনটি চিহ্ন—সূর্য, চোখ, আর হাত,
একটি রাখে জীবন, দুটি মৃত্যু বরাত।”
মীরা ধীরে বলে, “এটা তো এক ধাঁধার মতো কবিতা। তবে চিহ্ন তিনটি তো আমরা দেখেছিলাম সেই তলঘরের তিন দরজায়।”
“ঠিক,” অভীক মাথা নেড়ে বলে। “এই কবিতাই বলে দিচ্ছে, তিনটির মধ্যে মাত্র একটি সঠিক পথ।”
কুশল মনে করে, “আমরা গতকাল যে ‘হাত’ চিহ্নের পথ দিয়েছিলাম, সেটা ছিল সঠিক। কারণ আমরা সেখানেই পেয়েছিলাম সোনার বাক্স।”
“মানে আমরা ‘জীবন রাখার পথ’ পেয়েছিলাম। এখন প্রশ্ন, বাকি দুটি চিহ্নের অর্থ কী?” মীরা বলে।
অভীক টেবিলের ওপর মানচিত্র বিছিয়ে দেয়। তারপর সোনার সিলটি তুলে ধরে।
“এই সিলের উপর খোদাই আছে একটি মুকুট এবং একটি আড়াআড়ি তরবারি—এটি মুর্শিদাবাদের নবাবদের গোপন রাজচিহ্ন। এই চিহ্ন শুধুমাত্র ব্রিটিশ যুগের শেষদিকে ব্যবহার করা হতো, বিশেষ করে এক গুপ্তচুক্তির সময়, যখন জমিদারদের সঙ্গে এক অংশীদারিত্ব তৈরি করা হয়েছিল।”
“কোন অংশীদারিত্ব?” মীরা জিজ্ঞাসা করে।
“যেখানে কিছু জমিদার মুকুট ও গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিলো ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর না করার জন্য। এই কবিতার ছন্দ সেই লুকিয়ে রাখার নির্দেশাবলী।”
কুশল তখন তাদের শোনায় একটি গল্প—তার দাদুর মুখে শোনা, “নবাব হুমায়ুন জানের আমলে, এক গুপ্তদল তৈরি হয়, যাদের কাজ ছিল ঐতিহাসিক বস্তু গোপন রাখা। তাদের ‘ছায়ারা’ বলা হতো, কারণ তারা দিনের আলোয় দেখা যেত না—রাত্রেই কেবল কাজ করত।”
“এই ছায়ারা বাস্তব হতে পারে,” মীরা বলে, “আর সেই আয়নার মেয়েটি… হয়তো তাদের একজন।”
তারা খাতার পাতায় আবার চোখ রাখে। কবিতার ঠিক নিচে আরেকটি লেখা:
“যদি সন্ধ্যা হয় পূর্বে,
আর সূর্য অস্ত যায় দক্ষিণে,
তবে যে স্থির চোখ রাখে পশ্চিমে,
সে খোঁজে মৃত্যুহীন পথ।”
“এই পংক্তি একটা দিক নির্দেশ করছে,” অভীক বলে। “পূর্বে সন্ধ্যা, মানে পূর্বে আলো আসে না, দক্ষিণে সূর্য ডুবে, পশ্চিমেই ‘মৃত্যুহীন পথ’। হয়তো জমিদারবাড়ির পশ্চিম অংশে আবার কোনো চিহ্ন আছে।”
“আর ‘স্থির চোখ’ মানে—চোখের চিহ্ন। সেই চোখ চিহ্নের পথই হয়তো পশ্চিম দিকে,” মীরা অনুমান করে।
তারা আবার রওনা দেয়। এইবার তাদের গন্তব্য জমিদারবাড়ির পশ্চিম পাথরের দালান, যেখানে আগের রাতে প্রথমবার ছায়াটি দেখা গিয়েছিল। বাড়ির পেছনের দিকটা ভেজা কাদামাটিতে ঢাকা, সেখানে পা ফেলা মানেই দেবে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু মীরা হঠাৎ থেমে যায়—একটি পাথরের ব্লকে খোদাই চিহ্ন।
“এই দেখো!” সে ডাকে।
একটি চোখ চিহ্ন, তার নিচে খোদাই লাইন:
“যে দেখায় না আলো, সে জানে পথ।”
“মানে, আমাদের আলো ছাড়া ভেতরে ঢুকতে হবে?” কুশল বলে।
“নিশ্চিতভাবে একটা ফাঁদ,” অভীক মুখ শক্ত করে বলে। তবে তারা প্রস্তুত ছিল।
তারা মোবাইল, টর্চ—সব বন্ধ করে দেয়। শুধু মীরা হাতে রাখে একটি ইমার্জেন্সি হালকা-আলো যন্ত্র, যার আলো লাল ও ক্ষীণ।
ভেতরের ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার। দেয়ালে হালকা হালকা আঁচড়, একধরনের ম্যুরাল—কিন্তু তাতে মানুষ নেই, কেবল ছায়ার চলাচল। যেন সময়ের ফ্রেমে ধরা পড়েছে।
“এই ঘরে ইতিহাসের ছায়া আটকে আছে,” অভীক ফিসফিস করে। হঠাৎই মাটিতে লেগে যায় তার পা—একটি গর্ত।
সে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে মীরা ধরে ফেলে। তারা নিচে ফেলে দেয় সেই লাল আলো, যাতে দেখা যায়—নিচে ছোট্ট সিঁড়ি, এক কুঠুরি।
তারা নামতে শুরু করে। নীচে একটি ঘর, যার মাঝখানে একটি পাথরের পাত্র, তার মধ্যে কিছু মুদ্রা আর পুথির পাতা।
অভীক তুলে পড়ে:
“সন্ধ্যাপত্র ১৮৫৭ —
আজ রাতে ইংরেজ বাহিনী আসবে।
রাজা রঘুনাথ তাঁদের বিশ্বাস করেন না।
সোনার ভাগ যাবে না রাজনীতির গিলে,
তাই আমরা লুকিয়ে রাখছি ‘হৃদয়চিহ্নে।’”
“হৃদয়চিহ্ন?” কুশল বলে।
“মানে, আমাদের পরবর্তী চিহ্ন সম্ভবত একটি হৃদয়, বা ভালোবাসা—অথবা বিশ্বাসের প্রতীক,” মীরা ব্যাখ্যা করে।
তারা নিচের দেওয়াল ঘেঁষে আবার এক দরজা খুঁজে পায়। তাতে খোদাই, একটি খোলা হৃদয় আর তার নিচে লেখা—
“যেখানে বিশ্বাস ভাঙে, সেখানে রক্ত পড়ে না—পড়ে ইতিহাস।”
ভেতরে ঢুকতেই এক ঝাপসা গন্ধ—পুরনো কাঠ, ধাতু, আর কিছুমাত্র আগরবাতির ধোঁয়া।
তারা টর্চ জ্বালায়। সামনে এক টেবিল—তাতে একটি রক্তমাখা কাগজ।
মীরা পড়ে—
“আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ঈশিতা কোথায়? কেউ জানে না। ছায়ারা ওকে নিয়েছে।”
“ঈশিতা?” অভীক শ্বাস নেয় গভীরভাবে।
“এই বাড়ির ইতিহাসের মধ্যে ঈশিতাও হারিয়ে গেছে।”
তখনই আবার সেই ধোঁয়ায় তৈরি মুখ ভেসে ওঠে দেয়ালে—চোখ দুটি বন্ধ, ঠোঁট একটু নড়ে:
“যদি হৃদয়ের পথ ধরো, তবে সত্যকে পোড়াতে হবে। নাহলে ছায়ারাই বেঁচে থাকবে, মানুষ হারিয়ে যাবে।”
হঠাৎ পেছনের দরজা থেকে শোনা যায় পায়ের শব্দ। এইবার সে ছায়া নয়—এক লোক, মুখে মুখোশ, হাতে ধাতব রড।
“এইখানেই শেষ হবে তোমাদের খেলা। বেশি দেখেছো, এখন ফিরে যাও, নাহলে কেউই ফিরবে না।”
তিনজন প্রস্তুত থাকে। অভীক সোজা এগিয়ে গিয়ে ঘুষি মারতেই লোকটা ছিটকে পড়ে। তার মুখোশ খুলে যায়।
এটা একজন স্থানীয় পুরাতত্ত্ব কর্মী—নাম ছিল কৌশিক মিত্র, যাকে বছরখানেক আগে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
কুশল বলে, “এই লোকতো ইতিহাস চুরি করত, খোদ পুরনো দলিল বিক্রি করত কালোবাজারে।”
মুখোশটা ধুলোয় পড়ে গড়ায়। কিন্তু তার মুখের শেষ বাক্য:
“গুপ্তধন তোমাদের নয়। ছায়ারা তোমাদের ছাড়বে না। আমার কাজ ছিল পাহারা দেওয়া, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া। এখন আগুন আসবে।”
তিনজন চমকে ওঠে। দেয়ালের ফাটল দিয়ে ধোঁয়া ঢুকছে। কেউ আগুন লাগিয়েছে বাড়ির নিচতলায়!
“চলো! যত তাড়াতাড়ি পারি, বাইরে যেতে হবে!” অভীক চিৎকার করে।
তারা সেই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে ওঠে। বাইরের উঠোনে পৌঁছে দেখে—পশ্চিম দিক থেকে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। তাদের চোখে জল।
তবে ঠিক সেই সময়, জ্বালিয়ে দেওয়া দরজার ধারে, আগুনের শিখায় দেখা যায়—এক মুহূর্তের জন্য ঈশিতার ছায়া, তার মুখে একবারের জন্য হাসি।
“ও আমাদের পথ দেখিয়ে দিয়েছে,” মীরা বলে।
“গল্প এখন শেষ হয়নি। আরও আছে। সোনার চেয়েও দামি কিছু,” অভীক বলে।
পেছনে বাড়ি জ্বলছে, সামনে ইতিহাসের ছায়া গা ছুঁয়ে যাচ্ছে—আর তারা জানে, পরের কবিতাটিই পথ দেখাবে সত্যের গহীনে।
অধ্যায় ৫: সিঁড়ির নিচে রক্ত
আগুন যখন জাফরগঞ্জের জমিদারবাড়ির পশ্চিম প্রান্তকে গ্রাস করছিল, তখন ভোরের আকাশ লাল হয়ে উঠছিল, কিন্তু সেই রং সূর্যের নয়—জ্বলন্ত ইতিহাসের ছায়া। অভীক, মীরা এবং কুশল যখন উঠোনের ভাঙা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে, তখন তাদের পেছনে ছায়ার মতো অতীত ভস্ম হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আগুনের মধ্যে দেখা সেই মুখ—ঈশিতা—তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, খেলাটা এখনও শেষ হয়নি।
“ও একটা সংকেত দিয়েছে,” মীরা বলল, চোখ মুছে।
“হয়তো যা পুড়েছে, তার নিচে লুকানো ছিল আরেকটি পথ,” অভীক কাঁপা গলায় বলে।
“সিঁড়ির নিচে কিছু লুকানো ছিল, যা ও চেয়েছিল আমরা খুঁজে বের করি। আর এই আগুন সেই কুপ্রবৃত্তির কাজ—যারা চায় ইতিহাস চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাক,” কুশল যোগ করে।
তারা সেদিন সকালে গ্রাম থেকে একটি জলবাহক এবং কয়েকজন স্থানীয় মজুর নিয়ে ফিরে আসে পুড়ে যাওয়া জমিদারবাড়ির পশ্চিম প্রান্তে। আগুন নিভে গেছে, কিন্তু ধোঁয়ার কুন্ডলী এখনও উঠে আসছে দেয়ালের ফাটল দিয়ে।
অভীক প্রথমে খুঁজতে শুরু করে সেই পুরনো সিঁড়ির ভিত্তিটা—যা আগের রাতে তারা ব্যবহার করেছিল। তবে আগুনে সিঁড়ির কাঠি পুড়ে ছাই, কিন্তু পাথরের বেসমেন্ট তখনও টিকে আছে।
মজুরদের সাহায্যে তারা সেখানে নেমে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। প্রায় একঘণ্টা কাটে। ধুলোর ভেতর এক সময় স্পর্শ পায় কিছু ধাতব—একটা ছোট বাক্স, পাথরের গায়ে ধাতব ফ্রেমে আটকানো।
মজুররা চমকে ওঠে।
“এইটা তো যেন কেউ ভিতরে আটকে রেখে গিয়েছে,” একজন বলে।
অভীক নিজে হাত দিয়ে বাক্সটা তোলে। সিল ভাঙে।
ভেতরে পাওয়া যায় এক পুরনো রক্তমাখা কাগজ। আর পাশে একটা ছোট ছুরি, যার ফলতেও জমে থাকা লাল-বাদামি দাগ।
“এইটা খুনের প্রমাণ,” মীরা কাঁপা গলায় বলে।
“এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে ওই ছায়াদের জন্ম হয়েছে একটা হত্যার মাধ্যমে,” কুশল ফিসফিস করে।
অভীক কাগজটা পড়তে শুরু করে—চিঠির মতো লেখা:
“১৮৫৭, মার্চ ২২
আমার নাম হরিমোহন বসু। আমি এই বাড়ির গুপ্ত দলিল রক্ষক। আজ রাতে রঘুনাথবাবু তার ভ্রাতুষ্পুত্র নিরঞ্জন রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন—সে ইংরেজ বাহিনীর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, সে ব্রিটিশ মেজর বার্নসের হাতে সেই মানচিত্র তুলে দেয়, যার ছায়ায় লুকানো আছে রাজচিহ্ন ও সোনার গহ্বরের খবর। আমি প্রতিবাদ করলে সে আমার দিকে ছুরি তোলে। শেষপর্যন্ত আমি তাকে বাধা দিতে গিয়ে নিজের হাতে করলাম হত্যা।
এই পাপের রক্ত এই সিঁড়ির নিচেই পুঁতে দিলাম, যাতে ভবিষ্যৎ কেউ তা জানার আগে ইতিহাসকে বোঝে।
যদি কেউ এই দলিল পড়ে, জানো—ছায়ারা জন্মায় শুধু শাস্তির জন্য নয়, রক্ষার জন্যও। ঈশিতা জানত… ও ছিল সেই সত্যের শেষ রক্ষক।
– হরিমোহন”
তিনজন একসঙ্গে চুপ করে থাকে।
“ঈশিতা হয়তো এই চিঠি খুঁজতে গিয়ে সেই ছায়ার জালে আটকে পড়ে,” মীরা ফিসফিস করে।
“আর হরিমোহন যে খুনটা করেছিল, তা ছিল আত্মরক্ষার্থে। কিন্তু সেই রক্তের গন্ধই হয়তো এই বাড়িকে অভিশপ্ত করে তোলে,” অভীক বলে।
কুশল এবার মাটির নিচে হাত দিয়ে টেনে তোলে একটা ছোট টালি-পাটির বাক্স, যা বাক্সটির নিচে লুকানো ছিল।
তাতে পাওয়া যায়—
– একটি শঙ্খনকৃত নেকলেস, যার মাঝে লেখা ‘ই’—সম্ভবত ঈশিতার।
– একটি ছোট পুঁথি—যাতে ঈশিতার হাতে লেখা কিছু নোট।
মীরা খুলে পড়ে—
“আমি দেখেছি ছায়া। আমি শুনেছি তাদের ডাক—‘যা চুরি হয়, তা ফেরাতে হয়, নইলে আগুন লাগবে ইতিহাসে।’ আমি আরেক দরজা খুঁজে পেয়েছি—বাড়ির উত্তর দিকের কূপঘর। সেখানেই আসল সত্য। সেখানে আছে রঘুনাথ রায়ের আসল মানচিত্র, যা কেউ এখনও পায়নি। আমি ওখানেই যাব। যদি ফিরে না আসি, জানবে—আমি ইতিহাসের হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।”
“উত্তর দিকের কূপঘর?” অভীক অবাক হয়ে বলে।
“আমরা তো দক্ষিণ আর পশ্চিম ঘুরেছি এতদিন। উত্তর একেবারে ভাঙাচোরা, কেউ যাই না। গ্রামের লোকেরা বলে সেখানে ভূত থাকে,” কুশল স্মরণ করিয়ে দেয়।
“তবে ঈশিতা সেখানে গেছে। হয়তো এখনো ওর কিছু চিহ্ন বেঁচে আছে,” মীরা দৃঢ়স্বরে বলে।
তারা সেদিন বিকেলেই পৌঁছে যায় জমিদারবাড়ির উত্তর প্রান্তে। বহু পুরনো একটা কূপ—পাথরের চৌকাঠে ফাটল, পাশেই ছোট্ট ইটের ঘর। দরজা ভাঙা, ভেতরে জং ধরা হাঁড়ি, শুকনো লতা, আর একপাশে ধুলোর স্তূপে চাপা কাঠের বাক্স।
অভীক আবার খোঁড়ে। এবার মাটির নিচে পায় এক গোলাকার পাথরের স্ল্যাব, যার গায়ে খোদাই করা—
“আশ্রয় চেয়ো না ছায়ার কাছে, কারণ সে তো শুধুই চিহ্ন।”
তারা সেই স্ল্যাব খুলে দেখে নিচে একটা সরু সিঁড়ি।
তিনজন একসঙ্গে নিচে নামে। আলো আর শব্দ কমতে থাকে। এই কুঠুরিটা আগেরগুলোর থেকে ভিন্ন—এটা অনেকটা উপাসনাঘরের মতো।
দেয়ালের গায়ে কালী রংয়ের হাতে আঁকা প্রতীক, মাঝখানে একটি ধাতব বস্তু—যা ঈশিতার চিহ্নের মতো দেখতে। পাশে একটা পুরনো কাঠের টেবিল, তাতে পড়ে থাকা সেই আসল মানচিত্র।
অভীক টর্চের আলো ফেলে দেখে—এটাই আসল ট্রেইল ম্যাপ, যেটি রঘুনাথ রায় নিজে তৈরি করেছিল। ব্রিটিশদের থেকে রক্ষার জন্য।
মানচিত্রে দেখানো তিনটি চিহ্নের পরেও আছে আরেকটি স্তর—একটা গোল ঘর, যার মাঝে লেখা—
“শুদ্ধ করো ইতিহাসকে, তবে খুলবে শেষ দরজা।”
এই শব্দগুলোতেই অভীক বুঝে যায়—ঈশিতা এখানেই পৌঁছেছিল।
আর সম্ভবত এখানেই শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিল।
পেছনে, দেয়ালের ছায়ায় আবার একবার ভেসে ওঠে ঈশিতার মুখ। এবার সে বলে—
“তোমরা প্রমাণ পেয়েছো। এখন সত্যকে ইতিহাসে ফিরিয়ে দাও। নয়তো ছায়ারা জেগে থাকবে।”
এক ঝটকায় মুখ মিলিয়ে যায়।
তিনজন সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে বাইরে। কূপঘরের বাইরে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। কিন্তু তাদের মুখে ক্লান্তি নয়—একরাশ সাফল্যের শ্বাস।
মীরা ধীরে বলে,
“ঈশিতার শেষ কথা—তাকে মুক্ত করতে হলে প্রমাণগুলো সবাইকে জানাতে হবে।”
অভীক মাথা হেঁট করে।
“আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ওর নামে আমি সবটা লিখব। ইতিহাস ভুলে গেছে তাকে, কিন্তু আমরা ভুলবো না।”
তখনই কুশল পেছনে তাকায়—দূরে সেই ছায়া একবার চোখে পড়ে।
একবার তাকায়, আর তারপর মিলিয়ে যায় বাতাসে।
ঈশিতা মুক্ত।
অধ্যায় ৬: শেষ দরজার ছায়া
সন্ধ্যা নামছে মুর্শিদাবাদের আকাশে। কূপঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অভীক, মীরা আর কুশল চোখ রেখে আছে সেই মানচিত্রের শেষ রেখায়, যা এখন তাদের এক এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে ফিরে আসা হয়তো আর সম্ভব নয়।
অভীক ধীরে কাঁপা গলায় পড়ে—
“শেষ দ্বার, যেখানে ইতিহাস নীরব,
সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ন্যায় আর প্রতারণার চূড়ান্ত সাক্ষী।
তিনটি চিহ্নের পরে, যখন হৃদয় জেগে ওঠে,
তখন একটিই পথ—ছায়ার ভেতর দিয়ে আলোয় ফিরে আসা।”
মীরা ফিসফিস করে, “আমাদের এখন ছায়ার ভেতর দিয়েই যেতে হবে।”
“কিন্তু এই শেষ দরজা কোথায়?” কুশল মানচিত্রে চোখ রাখে।
মানচিত্রে একটি বৃত্তাকার অঞ্চল, যার মাঝখানে লেখা ‘শ্রাদ্ধপুকুর’—যা বহু বছর আগে গ্রামবাসীদের মৃত্যু ও দাহ সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে বহু বছর ধরে সেই অঞ্চল নিষিদ্ধ, কেউ সেখানে যায় না। গ্রামের শিশুদের ভয় দেখানো হতো এই পুকুরের গল্প দিয়ে—যেখানে নাকি রাত হলে ছায়া জেগে ওঠে।
“সেই পুকুরের নিচে কিছু একটা আছে,” অভীক দৃঢ়স্বরে বলে।
তারা সিদ্ধান্ত নেয়, মধ্যরাতের ঠিক আগে সেই অঞ্চল ঘিরে দেখতে যাবে, যখন ছায়ারা সক্রিয় হয়।
রাত্রি ১১টা ৪৭।
তিনজন চুপচাপ পৌঁছে যায় সেই পরিত্যক্ত শ্রাদ্ধপুকুর-এর পাড়ে। আজ আর সেখানে জল নেই, শুধু কাদামাখা মরা ঘাস, আর মাঝখানে শুকিয়ে যাওয়া কূপের মতো গর্ত।
তারা নামতে শুরু করে নিচে। কূপের তলায় এসে দেখে একটি বড় পাথরের চাকা, তাতে ঘুরানোর মতো খাঁজ। আর পাশে ছোট একটা পাথরে খোদাই—
“তিনজন মিললে এক হবে পথ,
রক্ত ও বিশ্বাসেই খুলবে শেষ সত্য।”
“তিনজন—আমরা?” মীরা বলে।
অভীক বুঝে যায়—তিনজনকেই একসঙ্গে ঘোরাতে হবে সেই চাকা।
তারা তিনজনে হাতে রাখে তিন দিক থেকে। একসঙ্গে ঘোরাতে শুরু করে।
প্রথমে কিছুই হয় না।
তারপর, ধীরে ধীরে শব্দ—
ঘর… ঘর… ঘর…
এক ঝাঁকুনি।
কাদার নিচে ঢেকে থাকা এক বিশাল পাথরের ফাটল খুলে যায়। নিচে দেখা যায় সিঁড়ি, আর সেই পুরনো আতর ও ধুলোর গন্ধ।
তারা টর্চ জ্বালিয়ে নামে।
ভিতরে, একটি গোলাকৃতি গুহা, চারদিক ঘিরে আয়না। আর মাঝে এক পাথরের টেবিল, তাতে রাখা রয়েছে—
– সোনার মুকুট
– একটি রক্তমাখা দলিল
– একটি ছাইয়ের বাটি
– এবং একটি চিঠি
অভীক চিঠিটা তুলে নেয়:
“যদি এই চিঠি কেউ পায়, জেনে রেখো—
তোমরা শেষ সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে।
এই সোনার মুকুট, এই রাজচিহ্ন, এই দলিল—সবই ছিল ইংরেজদের ছলনায় ফেলা এক প্রহসনের কেন্দ্র।
রঘুনাথ রায় বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেয়নি। সে বিশ্বাস করেছিল—তার ইতিহাস রক্ষা করবে কেউ।
আমরা সেই কাজ করেছিলাম। আমরা ছায়া হয়েছিলাম—মানুষের ছায়া।
কিন্তু কিছু ছায়া জেগে ছিল, দুঃস্বপ্ন হয়ে।
ঈশিতা ছিল আমাদের মধ্যে শেষ আলো।
ওকে আমরা হারাইনি। ও এখন তোমাদের মধ্যে, এই গুহার অন্তরে।
তবে এই সত্যকে প্রকাশ করতে হলে তোমাদের দিতে হবে নিজের কিছু।
এই শেষ দরজা তোমাদের দেবে শুধু একবারের সুযোগ।”
ঘরের এক কোণে আবার দেখা যায় সেই অদৃশ্য ছায়া, এইবার আরও প্রকট।
এবারে কথা বলে—
“তোমরা পেয়েছো যা হারিয়ে গিয়েছিল। এখন ফিরিয়ে দাও ইতিহাসে। না হলে আমরা থাকবে এই ভেতরেই… চিরকাল।”
মীরা চোখে জল নিয়ে বলে, “ঈশিতা, আমরা কথা দিচ্ছি—তোমার সত্য আমরা প্রকাশ করব।”
কুশল পেছন থেকে বলে, “আমরা মিডিয়ায় দেব এই সোনার প্রমাণ, সেই হত্যার ইতিহাস, সেই দলিল—সবকিছু।”
অভীক তখন টেবিলের ছাইয়ের বাটির মধ্যে একটা ছোট কাঠির মত কিছু দেখে। টেনে তোলে—একটা অস্থি।
“এটাই ঈশিতার দেহাবশেষ… ও যেন আমাদের জানায়—‘আমার শরীর মরে গেছে, কিন্তু সত্যটা বেঁচে আছে।’”
তিনজন একসাথে উঠে দাঁড়ায়।
ঠিক তখনই গুহার শেষ দেয়াল ফেটে যায়—আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আলো, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় ছায়া।
গুহার মুখে উঠে এসে তারা পেছনে তাকায়—এক মুহূর্তের জন্য, অন্ধকারে দাঁড়ানো ঈশিতা, এবার মুখে তৃপ্তির হাসি।
“তোমরা পারলে… আমার কথা কেউ ভুলবে না,” সে বলে হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে যায়।
দু’সপ্তাহ পরে — কলকাতা।
সংবাদপত্রের শিরোনাম:
“ঐতিহাসিক রহস্যের সমাধান: মুর্শিদাবাদে আবিষ্কৃত গুপ্তধন ও আত্মার নোটবুক”
“ঈশিতা সেনের অদৃশ্য রহস্য উন্মোচিত—শিক্ষার্থী নয়, ইতিহাসের রক্ষক ছিলেন তিনি”
আভীক, মীরা আর কুশল এখন আলাদা, কিন্তু বন্ধন অটুট। অভীক লিখছে নতুন বই—”ধূলোর নিচে সোনার ছায়া”—একজন নারী ইতিহাসরক্ষকের গল্প, এক আত্মার চিরজাগ্রত পথচলার কাহিনী।
গল্প শেষ নয়। ইতিহাস শেষ হয় না।
কারণ সত্য যতদিন অজানা, ততদিন ছায়ারা বেঁচে থাকে।