Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প

দ্য চ্যাপলিন প্রজেক্টর

Spread the love

সৌরদীপ দত্ত


পর্ব ১: আলোয় ভেসে ওঠে সাদা-কালো

কলকাতার উত্তর দিকের এক অচেনা লাইব্রেরি—“জ্ঞানসাগর পাঠাগার”—এখন কেউ বিশেষ আসে না। একসময় বইপ্রেমিকদের আশ্রয় ছিল এই জায়গা, এখন সেখানে দিনের শেষে শুধু একটাই প্রাণী দেখা যায়—সত্যব্রত রায়। বছর বাহাত্তরের এই বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান প্রতিদিন সকাল দশটায় দরজা খোলেন, সাড়ে ছটায় বন্ধ করেন, আর মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙে কোনো পুরনো বইয়ের হেঁচকি কাশিতে। লাইব্রেরির পেছনের ঘরে তাঁর নিজের সাম্রাজ্য—দেয়ালে সিনেমার পোস্টার, একটা কুয়াশা ধরা রেডিও, আর মাঝখানে কাঠের টেবিলে রাখা এক পুরনো প্রজেক্টর, যার গায়ে লেখা—“Bell & Howell – Silent Series”।

এই প্রজেক্টরটিই ছিল সত্যব্রতের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। বহু বছর আগে কলেজের থিসিস করতে গিয়ে কলেজের ফিল্ম ক্লাবে পেয়েছিলেন এই যন্ত্রটি, আর তার ভিতরেই প্রথম দেখেছিলেন চার্লি চ্যাপলিনের The Kid। সেই থেকে চ্যাপলিন হয়ে ওঠেন তাঁর ঈশ্বর, বন্ধু, আত্মা। একা জীবনের নিঃশব্দ গলি পেরিয়ে যে হাঁটে, তাকে বুঝতে পারেন শুধু আরেকজন নিঃশব্দ যাত্রী। এবং চ্যাপলিন ছিলেন সেই যাত্রী।

সেদিন সন্ধের দিকে হঠাৎ কলকাতার বিদ্যুৎ দপ্তর নিজেদের মর্জিমতো কিছু এলাকা লোডশেডিংয়ের তালিকায় ফেলেছিল। লাইব্রেরিতে মাত্র চারজন পাঠক ছিল—দু’জন ঘুমোচ্ছিল, একজন মোবাইলে ঝিমোচ্ছিল, আর চতুর্থ জন প্রশ্ন করেছিল, “স্যার, পুরনো সিনেমার ওপর বই আছে?” সেই প্রশ্নে চমকে উঠেছিলেন সত্যব্রত। কিশোর বয়সে কেউ যদি চ্যাপলিনকে ভালোবাসে, তা হলে সত্যব্রত তার জন্য বাকি পৃথিবী বিসর্জন দিতে রাজি।

“চলুন আমার ঘরে,”—বলেছিলেন তিনি। ছেলেটির নাম ছিল নীল। বারো ক্লাসে পড়ে, পটুলীতলার একটি স্কুলে। ফিল্ম বানাতে চায়। সত্যব্রত তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন লাইব্রেরির পিছনের ঘরে। আলো তখন নিভে এসেছে, শুধু প্রজেক্টরের পাশের ছোট্ট টেবিল ল্যাম্পে হালকা হলুদ আলো। সত্যব্রত তাকিয়ে বলেছিলেন, “চল, আজ তোকে এক ম্যাজিক দেখাই।”

প্রজেক্টরের ভেতর পুরনো ফিল্ম রিল বসিয়ে, দেয়ালে একটি সাদা কাপড় টাঙিয়ে দেন তিনি। তারপর ল্যাম্প নিভিয়ে দেন। প্রজেক্টর ঘুরতে শুরু করে। একটানা শব্দ করে চলছে পুরনো যন্ত্রটি। কুয়াশা ভরা প্রজেকশনে দেখা যাচ্ছে Modern Times-এর একটি দৃশ্য—চার্লি স্ক্রু আঁটছে, তারপর স্ক্রু-র মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে সে। নীল হাসছে, চোখে বিস্ময়।

হঠাৎ, প্রজেক্টরের আলো একটু ঝিমিয়ে আসে, একটা অসংলগ্ন শব্দ করে ওঠে। সত্যব্রত একটু ভুরু কুঁচকে বলেন, “এটা মাঝে মাঝে এরকম করে, রিল পুরনো হয়ে গেছে।” কিন্তু পরের মুহূর্তে এমন কিছু ঘটে যা কোনো কল্পনায়ও ছিল না—সত্যব্রতের শরীরটা এক ঝলক আলোর ভিতর দিয়ে সরে গিয়ে উধাও হয়ে যায়। নীল চিৎকার করে ওঠে—“স্যার!!”

কিন্তু কেউ নেই।

অন্যপাশে, হঠাৎ সত্যব্রত আবিষ্কার করেন তিনি কোথায় যেন দাঁড়িয়ে আছেন—একটা কলকারখানার ভেতর। আশেপাশে বিশাল সব গিয়ার, বেল্ট, চলন্ত মেশিন। একটা মেকানিকাল শোরগোল। আর সামনে—চার্লি চ্যাপলিন নিজে! মুখে কালো গোঁফ, মাথায় টুপি, হাতে স্প্যানার, চোখে সেই চিরচেনা নিষ্পাপ অবাক বিস্ময়। সত্যব্রতের মুখ হাঁ হয়ে যায়।

“এই যে! আপনি… আমি তো আপনাকে সিনেমায় দেখতাম!”—বলেই ছুটে যান তিনি চ্যাপলিনের দিকে। চ্যাপলিন শুধু চোখ টিপে, হাসে, আর হাত দিয়ে ইশারা করে মেশিনের গায়ে উঠতে। সত্যব্রত বুঝে ওঠেন না কীভাবে সব এত বাস্তব! সে কি স্বপ্ন? না কি ভ্রম? তার পায়ে ধুলো, হাতে গিয়ার ছোঁয়ার গন্ধ, শরীরে ঘাম—সব কিছু বাস্তব।

চ্যাপলিন ও তাঁকে নিয়ে মেশিনের গায়ে ওঠে, দু’জনে একসঙ্গে স্ক্রু ঘোরাতে থাকে। হঠাৎ একটা জায়গায় স্ক্রু ঢিলা হয়ে যায়, আর দু’জনেই গড়িয়ে পড়ে একটি বিশাল প্যাটার্নে—ঠিক যেমন সিনেমায় হয়েছিল। কিন্তু এখানে হাসি নেই, ভয়ও নেই—আছে কেবল এক অদ্ভুত নির্ভার আনন্দ।

এদিকে লাইব্রেরিতে নীল ঘামতে ঘামতে সত্যব্রতকে খুঁজছে। দেয়ালে সিনেমার দৃশ্য চলছে, কিন্তু তাতে নেই আর চ্যাপলিন, নেই কোনো মেকানিক। শুধু ফাঁকা সেট, যেন কিছু বেরিয়ে গেছে ফ্রেমের বাইরে। নীল ভয় পেয়ে প্রজেক্টর বন্ধ করে দেয়, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

রাতে লাইব্রেরির কেয়ারটেকার এসে দেখে পেছনের ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে টেবিল-চেয়ার এলোমেলো, আর প্রজেক্টরের পাশে রাখা একটি চিঠি—সাদা কাগজে, টাইপরাইটারে লেখা একটাই লাইন:

“হাসির পেছনেই সব সত্য লুকিয়ে থাকে। আমি এখন ওর সঙ্গেই আছি। – S.R.”

লাইব্রেরির ওই পেছনের ঘর আজও কেউ ভাড়া নেয় না। অনেকে বলে, রাত গভীর হলে সাদা কাপড়ে ভেসে ওঠে দু’জন ছায়া—একজন গোঁফওয়ালা লোক টুপি পরে হাঁটে, আরেকজন তার পেছনে পেছনে, একটা স্ক্রু হাতে, হাসে।

এভাবেই সত্যব্রত রায় হারিয়ে যান Modern Times-এর ভিতর। একটা প্রজেক্টর খোলা রাখে সব চেয়ে পুরনো দরজাটা—যেখানে সত্যি আর সিনেমার মাঝের পার্থক্য হারিয়ে যায়।

পর্ব ২: দ্য কিডের কান্না

সত্যব্রত রায়ের অন্তর্ধানকে কেউ খুব গুরুত্ব দেয়নি। যারা লাইব্রেরিতে ছিল সেদিন, তাদের জিজ্ঞেস করা হলে কেউ কিছু বলতে পারেনি, শুধুমাত্র এক কিশোর—নীল—একটা বিস্ময়ের ভঙ্গিতে বলেছিল, “ওনি একটা প্রজেক্টরের আলো দিয়ে হারিয়ে গেলেন।”
অন্যরা হেসেছিল, লাইব্রেরির কেয়ারটেকার বলেছিল, “হয়তো বেরিয়ে কোথাও গিয়েছেন।”
কিন্তু সত্যব্রত কোথাও যাননি। তিনি ঢুকে পড়েছেন চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার ভিতরে—আক্ষরিক অর্থেই।

এইবার তিনি নিজেকে খুঁজে পান এক শীতের সকালে, নিউইয়র্কের মত কোনো শহরের ব্যাকড্রপে। চারপাশে ইটের দালান, ছেঁড়া জামা পরে হাঁটে লোকজন, আর বরফে ঢাকা রাস্তায় এক ছোট ছেলের কান্না। ছেলেটি আর কেউ নয়—The Kid ছবির সেই ছোট্ট বালক। তার চোখে জল, ঠোঁটে ঠান্ডার ফাটল, আর পাশে পড়ে আছে একটা কাঁচের ভাঙা জানালা।

সত্যব্রত জানেন এই দৃশ্য। তার শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি দেয়। কারণ তিনি জানেন, এই মুহূর্তেই চার্লি চরিত্রটি এসে ছেলেটিকে তুলে কোলে নেবেন, এবং শুরু হবে তাদের এক অভাবনীয় বন্ধুত্ব। কিন্তু বাস্তব এখানে সিনেমার মতো ধারাবাহিক নয়। সত্যব্রত হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পান—চ্যাপলিন দাঁড়িয়ে, কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে না। সে যেন অপেক্ষা করছে কিছু একটার জন্য।

“তুমি কি যাবে না?”—চিৎকার করে উঠলেন সত্যব্রত।

চ্যাপলিন ফিরলেন, হাসলেন, তারপর আঙুল তুলে দেখালেন—ছেলেটার দিকে তাকাও। সত্যব্রত তাকিয়ে দেখলেন—ছেলেটি এবার উঠছে নিজেই, চোখ মুছে দাঁড়াচ্ছে। যেন সিনেমার গল্প বদলে যাচ্ছে।

সত্যব্রত ধীরে ধীরে চ্যাপলিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। চ্যাপলিন এবার মুখ খুললেন না, কিন্তু তাঁর চোখে এক অনুচ্চার অনুরোধ—“এবার তুমি এগিয়ে যাও।”

সত্যব্রত এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির মাথায় হাত রাখলেন। তার কপাল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তিনি একটা কম্বল কোথা থেকে পেলেন মনে নেই, হয়তো সেটের কোনো কোণ থেকে, আর তাকে জড়িয়ে নিলেন। বাচ্চাটি মাথা তুলে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আমার বাবা?”

সত্যব্রত থমকে গেলেন। সেই চোখে যে ভাষা ছিল, তাতে কোনো সিনেমার সংলাপ দরকার পড়ে না। তিনি মাথা নাড়লেন, “না, আমি তোমার বাবাও নই, আবার একদম অচেনাও নই।”

বাচ্চাটি হেসে বলল, “তাহলে তুমি আমার বন্ধু?”

সত্যব্রত জবাব দিলেন না। শুধু পাশে হাঁটতে শুরু করলেন ছেলেটিকে নিয়ে। দূরে দাঁড়িয়ে চ্যাপলিন হাত নাড়লেন, তারপর চলন্ত ক্যামেরার পেছনে হারিয়ে গেলেন।

সিনেমার জগতে এবার সত্যব্রত একা নন, তাঁর সঙ্গী একজন শিশু—যার কান্না সত্যিকারের, ক্ষুধা সত্যিকারের, কিন্তু তার চারপাশে তৈরি হয়েছে কল্পনার লেন্স। তিনি বুঝলেন, এটা আর কেবল সিনেমা নয়—এটা তাঁর দ্বিতীয় জন্ম, আর চ্যাপলিন তাঁকে একটা অসমাপ্ত গল্পের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।

সেই রাতে, কল্প-শহরের এক গলির কোনায় তাঁরা আশ্রয় নিলেন। ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়লে সত্যব্রত মনে মনে ভাবলেন—এ কি একটা পুনর্জন্ম? একটা সুযোগ?
তাঁর নিজের জীবনেও তো কখনও কোনো সন্তান ছিল না। ছাত্ররা এসেছিল, গিয়েছিল, কেউ স্থায়ী হয়নি। আর আজ, সিনেমার ভেতর এক শিশুকে জড়িয়ে তিনি বুঝতে পারছেন—একটি অদ্ভুত শূন্যতা ভরছে।

অন্যদিকে, বাস্তব দুনিয়ায় নীল চুপচাপ লাইব্রেরিতে আসা শুরু করেছে প্রতিদিন। সে প্রজেক্টরের পাশে বসে থাকে, তাকে ছুঁয়ে দেখে, ফিল্ম রিলগুলো ঘুরিয়ে দেখে—কিন্তু কিছুই ঘটে না। সত্যব্রত যেন হারিয়েই গেছেন চিরতরে।
নীলের মনে হয়, প্রজেক্টরের আলোর কোনো গোপন ছন্দ ছিল, কিছু নির্দিষ্ট মুহূর্ত, যখন দরজা খুলে যায়।

সে খুঁজতে থাকে—পুরনো চিঠি, স্ক্র্যাপবুক, ফিল্ম নোটস। একদিন একটা পুরনো নোটবুকে সে পড়ে—
“এই প্রজেক্টরের আলোতে সময় থেমে যায়। ফ্রেমের ভিতরে ঢুকে পড়লে তুমি আর দর্শক নও, তুমি গল্পের শরিক।”
নীল বুঝে যায়, সত্যব্রত শুধু হারাননি—তিনি রয়ে গেছেন। হয়তো ফ্রেমের মধ্যেই কোথাও।

তবে কিভাবে তাকে ফিরিয়ে আনা যায়? আর ফিরিয়ে আনা উচিত কিনা?

সিনেমার সেই জগতে পরদিন সকালে সত্যব্রত এক নতুন সংকটে পড়েন। ছেলেটির শরীর ভালো না, খাবারও নেই। তিনি জানেন—সিনেমায় এখনই আসবে সেই দৃশ্য, যেখানে সমাজসেবীরা এসে বাচ্চাকে নিয়ে যাবে, আর চ্যাপলিন ছুটবে ছাদ বেয়ে—কান্না, উৎকণ্ঠা, প্রেম।

কিন্তু চ্যাপলিন নেই। এখন তাঁর জায়গায় তিনিই নায়ক। এবং তিনি জানেন না, কোনটা গল্প, কোনটা বাস্তব।

তখন হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “চার্লি, তুমি যা করতে চেয়েছিলে, আমি কি তা পারব?”

দূর থেকে সিনেমার সেই সাউন্ডট্র্যাকের মত হালকা সুর ভেসে আসে—Smile, though your heart is aching…
সত্যব্রত বুঝলেন, হ্যাঁ, এখানেই তাঁর পরীক্ষার সময়।

সে ছেলেটিকে কোলে নিলেন, আর একটা খড়ের চালার দিকে এগোলেন—যেখানে আগুন জ্বলে, লোকেরা গরম দুধ বানায়, ভিখিরিরা একে অপরকে আশ্রয় দেয়।

সত্যব্রতের মনে হলো—এটা শুধু সিনেমা নয়, এটা এক বিকল্প বাস্তবতা, যেখানে দয়ার কোনো ডায়ালগ নেই, শুধুই স্পর্শ, হাসি আর চোখের ভাষা।

আর সেই ভাষায়, তিনি হয়ে উঠলেন তাঁর প্রিয় নায়কের মতোই এক নীরব বিপ্লবী।

পর্ব ৩: নিঃশব্দ বিপ্লব

সত্যব্রত রায় খড়ের চালায় ঢুকেই বুঝলেন, এই সিনেমার জগত যতটা হাস্যরসপ্রবণ, ততটাই নির্মমও। এই যে কল্পনাজাত দুনিয়া, এখানে প্রতিটি রুটির টুকরো জোগাড় করাও একটা সংগ্রাম। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাগুলোতে যেটা থাকে—তা হল মানুষের প্রতি মানুষের উদারতা, সেইটুকু ভালোবাসা, যেটা মুখে নয়, চোখে কথা বলে। সেই ভালবাসার ভাষায় এখন তিনিও কথা বলছেন।

ছেলেটিকে একটা পুরনো কম্বলে জড়িয়ে, সে রাতটা কাটান এক কৃপণ বৃদ্ধের পাশে, যে নিজেও আগুনের উষ্ণতা ভাগ করে নেয় না কারো সঙ্গে। কিন্তু রাতের শেষে, ছেলেটির জ্বর দেখে, সেই বৃদ্ধ নিজের পকেট থেকে বার করে দেয় আধেক খাবার—এমনকি নিজের কম্বলটাও টেনে দেয় তার দিকে।

সত্যব্রতের মনে হয়, এখানে কেউ মুখে কিছু বলে না, কিন্তু সবাই কিছু একটা বলে ফেলে অঙ্গভঙ্গিতে, চোখের ইশারায়, হাঁটার ছন্দে। এ যেন এক জগৎ, যেখানে প্রতিটি চরিত্র নিজেই পরিচালকের কাছে অভিনেতাও, চিত্রনাট্যও।

পরদিন সকালে ছেলেটি একটু সুস্থ হয়ে উঠলে সত্যব্রত ভাবলেন—এখানে বসে থাকলে হবে না, তাঁকে বেরোতে হবে। তাঁর মনে পড়ল, চ্যাপলিনের প্রতিটি সিনেমা ছিল একটা পথচলা—ঘুরে বেড়ানো, কাজের খোঁজ, জীবনকে হাসিতে চিহ্নিত করা। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। ছেলেটির হাত ধরে শহরের দিকে হাঁটলেন।

এই সময় সিনেমা যেন নিজেই পটভূমি বদলাতে শুরু করে—ব্যাকড্রপে এসে গেল গরিবি-ছোঁয়া ক্যান্টিন, কারখানার প্রাচীর, আর কিছু হতভাগা মানুষ—সবাই সাদা-কালো, কিন্তু তাদের দৃষ্টি যেন অদ্ভুতভাবে রঙিন। সবাই চুপচাপ, কেউই কথা বলে না, তবুও প্রতিটি দৃশ্য যেন কিছু বলছে।

সত্যব্রত হঠাৎ একটি মজুরের লাইনে ঢুকে পড়েন। কিছু মানুষ রুটি ও স্যুপ পেতে দাঁড়িয়েছে। তিনি ছেলেটিকে কোলে তুলে দাঁড়িয়ে থাকেন, চোখে বিনয়। কিন্তু কেউ তাকে ঠেলছে না, ধাক্কা দিচ্ছে না—বরং একজন চুপচাপ তাকে জায়গা ছেড়ে দেয়।

এইভাবে সত্যব্রত উপলব্ধি করেন, এই দুনিয়ায় কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এখানে সবাই যেন একসঙ্গে একটা নাটকে অংশ নিচ্ছে। আর তাঁর ভেতর একটা ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে—এই সিনেমা কি আসলে বাস্তবের থেকে বেশি মানবিক?

সেইদিন দুপুরে, তাঁরা পৌঁছান এক পরিত্যক্ত সিনেমা হলে—‘The Globe Cinema’। ভেতরে ধুলো জমেছে, ছেঁড়া পর্দা দুলছে হাওয়ায়, কেঁচো আর ইঁদুর ঘোরাফেরা করছে মেঝেতে। সত্যব্রত কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।
তাঁর মনে পড়ে, অনেক বছর আগে ঠিক এমন এক হলে তিনি প্রথমবার The Kid দেখেছিলেন। তখন পকেটে মাত্র চার আনা ছিল, ফার্স্ট বেঞ্চে বসে কান ধরে বসে ছিল—আর হাসির পর হাসি চেপে রেখে একসময় হঠাৎ অশ্রু ঝরেছিল সেই বিখ্যাত মা-ছেলের বিচ্ছেদের দৃশ্যে।

তিনি তখনও জানতেন না—সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, সিনেমা এক চুপচাপ বিপ্লব। আজ, তিনি নিজেই সেই বিপ্লবের মধ্যে।

সিনেমা হলের ভেতরে গিয়ে তিনি কাগজ দিয়ে একটা স্ক্রিন ঝেড়ে নেন, একটা চেয়ার তুলে পর্দার সামনে বসে পড়েন। ছেলেটি তাঁর কোলের পাশে বসে বলে, “আমরা কি সিনেমা দেখতে পারব?”
সত্যব্রত একটু হেসে বলে, “আমরাই তো সিনেমার ভেতরে।”
ছেলেটি তখন বলে, “তুমি হাসতে জানো না, জানো?”
এই কথাটায় সত্যব্রত স্তব্ধ হয়ে যান। হ্যাঁ, এ কথা সত্যি। এতদিন তিনি শুধু চ্যাপলিনকে দেখে হাসতেন, কিন্তু নিজে কখনও চ্যাপলিনের মতো হাঁটার চেষ্টা করেননি, চোখ দিয়ে ইশারা করেননি, নিঃশব্দ অঙ্গভঙ্গি দিয়ে ভালোবাসা বোঝাতে শেখেননি।

সেই রাতে তিনি একটি নতুন সিদ্ধান্ত নেন—তিনি নিজেই এবার ‘ট্র্যাম্প’ হবেন, নিজের মতো করে।

পরদিন সকালে তিনি একটি পুরনো কোট, ছেঁড়া টুপি, এবং দুটো আলাদা মাপের জুতো জোগাড় করে পরেন। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে যান—এ তো একদম চ্যাপলিন! তিনি বাইরে বেরোন, ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন—কখনও ভিখিরিদের সঙ্গে বসে খাওয়েন, কখনও কাজ খুঁজতে যান, আবার কখনও ছোটদের নাচিয়ে তোলেন নকল বাঁশির সুরে।

লোকেরা তাকায়, মুচকি হেসে পাশে এসে বসে। এই সাদা-কালো দুনিয়ায় আজকাল আর কারও সময় নেই, তবু এই একজন পাগল সবার মুখে হাসি ফোটায়। তাঁর হাঁটার ছন্দ, তাঁর ঝুঁকে পড়া, তাঁর পকেট থেকে গড়িয়ে পড়া রুটি—সব কিছুই যেন মনে করিয়ে দেয় চ্যাপলিনকে।
তাঁকে ঘিরে লোক জমে, হাসি ফোটে। কে জানে, হয়তো ফ্রেমের বাইরেও কেউ দেখছে!

অন্যদিকে, বাস্তব জগতে, নীল একরকম পাগলের মতো হয়ে উঠেছে। সে প্রজেক্টরের সামনে বসে নতুনভাবে এক্সপেরিমেন্ট করছে। কখনো মোবাইলে “Smile” গান বাজায়, কখনো নির্দিষ্ট ছায়া ফেলে দেয়ালে একরকম প্যাটার্ন বানায়। সে বিশ্বাস করে—সত্যব্রত এখনো ফ্রেমের মধ্যেই কোথাও আছেন, এবং একমাত্র সঠিক রিল, সঠিক আলো আর সঠিক সময়ে ফেরানো গেলেই তাঁকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একদিন হঠাৎ সে আবিষ্কার করে—যখন সে The Kid চালায় এবং সেই নির্দিষ্ট দৃশ্য আসে—এক পিতা সুরক্ষা দিচ্ছে এক শিশুকে—তখন প্রজেক্টরের লেন্সে হালকা কুয়াশা জমে, আর ছায়ায় যেন দুটি অবয়ব দুলে ওঠে। সে বুঝে যায়—তারা ঠিক আছে, সিনেমার মধ্যেই আছে, এবং তারা কিছু একটা তৈরি করছে।

হয়তো একটা নতুন গল্প।
হয়তো একটা নতুন বিপ্লব—নিঃশব্দে।

পর্ব ৪: দ্য গোল্ড রাশের পথে

পাঁচদিন হয়ে গেল, সত্যব্রত রায় এই সিনেমার ভেতরে। তার আর কোনো প্রশ্ন নেই—এটা স্বপ্ন না বাস্তব, সেটা এখন তুচ্ছ। কারণ এই দুনিয়া তার চেনা পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি হৃদয়ের, অনেক বেশি নিঃশব্দে উচ্চারিত। আর সে নিজে—একজন বুড়ো মানুষ, যাকে বাইরের জগতে কেউ আর খুব একটা খোঁজ করে না—এখানে সে হয়ে উঠেছে একজন অভিনেতা, একজন আশ্রয়দাতা, একজন ‘ট্র্যাম্প’।

কিন্তু একটা প্রশ্ন তার মনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে: এই পৃথিবীতে সে কতদিন থাকতে পারবে? কিংবা থাকতে চাইলেও পারবে কি? চ্যাপলিন তো কোনো সিনেমায় চিরকাল ছিলেন না—প্রত্যেকটা গল্পের শেষ ছিল। তবে কি এই সিনেমাতেও তার একটা দৃশ্য আছে, যেটা তার জন্য লেখা হয়ে আছে?

সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, তবে তার পরদিনই দৃশ্যপট বদলে গেল। যেন কেউ ফিল্ম রিল ঘুরিয়ে দিল। শহরের রাস্তা মুছে গিয়ে চারপাশে ধূসর পাহাড়, বরফে মোড়া গাছ, আর দূরে কাঠের কেবিন। ঠিক যেন The Gold Rush সিনেমার সেট।
সত্যব্রত প্রথমে বুঝতেই পারেননি কী হচ্ছে। ছেলেটিও একপ্রকার স্তব্ধ। হাওয়া হিম, ঠোঁট ফেটে যাচ্ছে। তিনি ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “ভয় পাস না। এখন আমরা বরফের দেশে।”

তারা একটু এগোতেই এক পাথরের পাশে বসে থাকা এক অদ্ভুত চরিত্রকে দেখেন—শরীরে লম্বা কোট, পায়ে বরফে ডোবা জুতো, আর মুখে তীব্র হতাশার ছাপ। সত্যব্রত বুঝলেন, এ সেই চ্যাপলিনের সঙ্গী চরিত্র—যে একসময় না খেয়ে বন্ধু চ্যাপলিনকে স্যুপের বদলে নিজের বুট জুতো রান্না করে খাইয়ে দিয়েছিল।

সে মাথা তোলে, সত্যব্রত ওর সামনে দাঁড়ায়। তারপর কোনও কথাবার্তা ছাড়াই তিনজনে একটা পুরনো কেবিনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কেবিন ভেতরে প্রায় ফাঁকা, কেবল একটুকরো কাঠকয়লার উনুন, একটা কাঠের টেবিল, আর পুরনো কম্বল।
বরফ ঝরছে বাইরে। জানলা দিয়ে দেখা যায় পাহাড়ের খাঁজ, ভেড়ার মত চাদরের টুকরো উড়ছে হাওয়ায়।

সত্যব্রত জানেন এই দৃশ্য। তিনি দেখেছেন সেই বিখ্যাত সিকোয়েন্স—চ্যাপলিন নিজের জুতো সিদ্ধ করে খাচ্ছেন, আর প্রতিটি কামড়ের অভিনয় যেন সত্যি সত্যি সুস্বাদু খাবারের মত। কিন্তু এবার… এখানে তো চ্যাপলিন নেই। এখানে তিনিই আছেন, একটা ক্ষুধার্ত বাচ্চা, আর সেই সিনেমার চরিত্র—যে কি না হিংস্র হয়ে উঠেছিল।

তাঁর মনে পড়ে গেল—এই চরিত্র একসময় চ্যাপলিনকে খুন করতে চেয়েছিল, কারণ সে না খেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তখনি সত্যব্রতের শরীর টনটন করে উঠল।
সে লোকটি চুপ করে ছিল, কিন্তু হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল, তারপর সত্যব্রতের দিকে একরকম পাথুরে চোখে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি জানো, ক্ষুধা কতটা ভয়ানক?”

সত্যব্রত কিছু বলল না। শুধু ছেলেটিকে নিজের পিছনে রেখে বলল, “তুমি যা খুঁজছ, তা এখানে নেই। তুমি বরং একটু দরজা খুলে বাইরে তাকাও।”

লোকটি থেমে যায়। তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে দেয়। আর তখনই দেখা যায়—সামান্য দূরে এক খরগোশ দৌড়চ্ছে বরফের মধ্যে। সে ছুটে যায় খরগোশের পেছনে, আর সত্যব্রত ততক্ষণে উনুনে কিছু কাঠকয়লা জ্বালিয়ে, স্যুপ বানানোর অভিনয় করতে থাকে। ছেলেটি বলে, “তুমি জানো না কুকার কীভাবে চালাতে হয়!”

সত্যব্রত হেসে বলে, “জানি না। কিন্তু যদি বিশ্বাস করো, তাহলে এটা রান্না হবেই।”

আর তখনি… দরজার ফাঁক দিয়ে ফিরে আসে সেই লোকটি—হাতে একটা ছোট খরগোশ। চোখে হালকা আলো। সে কিছু বলে না, শুধু এক টুকরো লোহা দিয়ে খরগোশ সেদ্ধ করতে শুরু করে।
সত্যব্রতের মনে হয়—এ এক ধরণের মুক্তি। সিনেমার চরিত্র হয়তো এবার তার গল্পে একটু বদল এনেছে। হয়তো তাঁর উপস্থিতিতে চরিত্ররা নিজেদের পুরনো ভুল ভেঙে এক নতুন গল্পে ঢুকছে।

সেদিন রাতে সবাই একসঙ্গে খায়। ছেলেটির মুখে হাসি। সত্যব্রতের মনে পড়ে, বহু বছর আগে একটা শীতকালে সে একা এক ফ্ল্যাটে বসে চার্লির Gold Rush দেখছিল। তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল, হিটারও ছিল না। তার গায়ে ছিল একটিমাত্র কম্বল, আর পাশে একটা বন্ধ চিঠি—যেখানে তার প্রেমিকা লিখেছিল, “তুমি শুধু পুরনো সিনেমা নিয়ে থাকো, আমি এখন বাস্তব খুঁজি।”

সেই রাতে সে ভেবেছিল, ‘পুরনো সিনেমার হাসিই তো একমাত্র যা কখনও প্রতারণা করে না।’

আজ সেই বিশ্বাস যেন ফিরে এসেছে—তিনজন মানুষ, তিন ভিন্ন মানসিকতা—একটা গল্পের মধ্যে নিজেদের মত করে পথ খুঁজে নিচ্ছে।

সিনেমা আবার বদলাতে শুরু করে। রাতের শেষে, এক ঝলক আলোয় বরফ গলে গিয়ে দেখা যায়, তাঁরা একটা ট্রেনের কামরায় উঠে গেছেন। চারপাশে নতুন লোক, ছেলেটি জানালার ধারে বসে, খড়ের টুপিটা মাথায়, আর সত্যব্রত সামনে তাকিয়ে রয়েছেন।

এক পুরনো কাগজে লেখা—

“গন্তব্য: The Circus”

পর্ব ৫: সার্কাসের আলো আর এক সাদা পায়রা

ট্রেনের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে ছেলেটি চোখ বন্ধ করে আছে। সত্যব্রত জানে না ঠিক কত সময় কেটে গেছে—এই সিনেমার জগতে সময় বড়োই অদ্ভুত, কোনো ঘড়ি নেই, সূর্য আছে অথচ তার গতি নেই, আর মানুষের হাসি বা কান্না যেন একেকটা আবহ, যেগুলোর থেকে দৃশ্য পরিবর্তন হয়। এখন তারা ট্রেনে—একটা পুরনো কাঠের কামরা, যেটা ঠিক যেন The Circus ছবির কোনো দৃশ্যের মতো।

পেছনের দিক থেকে হঠাৎ করেই সার্কাসের ড্রাম বেজে ওঠে, এক এক করে পেছনের জানালায় রঙিন পতাকা ভেসে ওঠে। সত্যব্রত জানে—এই দৃশ্য সে দেখেছে। সার্কাসের তাবু, খেলনা ঘোড়া, একপায়ে ভরা দাঁড়ানো ক্লাউন, দড়ির উপর হাঁটা মেয়ে—সবকিছু কেমন যেন বাস্তব।

তারা নামলেন স্টেশনে। কিন্তু এটা কোনো সাধারণ স্টেশন নয়। এখানে রেল লাইন রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়া, প্রত্যেক কুলি একটা করে হাসির মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর যাত্রীদের মধ্যে বেশ কিছু লোক চরিত্রের মতো আচরণ করছে—কেউ একটা বেলুন মুখে আটকে রেখেছে, কেউ আবার হেঁটে চলেছে বাঁশির তালে।

এই দৃশ্য দেখে সত্যব্রত থমকে যান। “এ কি সার্কাস, না সিনেমার স্টুডিও?” ছেলেটি হাত টেনে বলে, “চলো! তারা আমাদের ডাকে!” সামনে দেখা যায় একটা রঙিন তাবু—মুখে লেখা ‘Welcome to the Laughing Show!’

তারা ভেতরে ঢুকতেই সারা জায়গাটা আলোর বন্যায় ভেসে ওঠে। মাঝখানে বিশাল একটা রিং, চারপাশে দর্শক, আর একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই চ্যাপলিন—মুখে পুরনো হাসি, হাতে বাঁশি। সত্যব্রত প্রথমবার এতটা স্পষ্ট দেখলেন তাঁকে—একটা জীবন্ত, হাসিমুখী দার্শনিক, যার পেছনে পৃথিবীর সমস্ত নিঃসঙ্গতা লুকানো।

চ্যাপলিন এবার ইশারা করলেন। সত্যব্রত বুঝলেন, এবার তাঁর পালা।
তিনি রিংয়ের মধ্যে এগিয়ে যান। দর্শক এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় চেয়ে আছে। হঠাৎ মাথার ওপর আলো এসে পড়ে—সত্যব্রত বুঝতে পারেন না ঠিক কী করবেন। কিন্তু তারপরই তিনি নিজের পকেট থেকে একখানা নকল রুটি বের করেন, ভাঙেন মাঝখান থেকে, ছিটিয়ে দেন চারপাশে।
একটা ছোট্ট পায়রা এসে বসে পড়ে তাঁর কাঁধে।

সার্কাসজুড়ে হালকা হাসির শব্দ।
তিনি তার জুতো খুলে একটাকে উল্টো করে মাথায় পরে নেন। শিশুরা হেসে ওঠে। ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়।

তারপর তিনি হাঁটতে থাকেন—নাক গুঁজে, কোমর বাঁকিয়ে, চেনা সেই ভঙ্গিমায়। একে একে পারফর্ম করেন জুতো বেঁধে দৌড়, একপায়ে দাঁড়ানো হাঁটা, ও শেষে সেই বিখ্যাত “ঘাড়ের ওপর বাঁশি রেখে হাসা”—যেটা ছিল চ্যাপলিনের ব্যক্তিগত চিহ্ন।

তাঁর অভিনয় শেষ হলে হঠাৎ চ্যাপলিন সামনে এগিয়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। শব্দ হয় না, ভাষা নেই—শুধু এক চুমু কপালে। তারপর বাঁশিতে একটা টানা সুর বাজিয়ে ইশারা করেন—আকাশের দিকে।

সেখানে, হালকা আলোয় ভেসে ওঠে একটা সাদা পায়রা, মুখে একটা রিল ধরে আছে।
চ্যাপলিন ইশারা করে বলেন—”এই রিলটা তোমার।”

সত্যব্রত সেটা হাতে নেন। ছেলেটি ছুটে আসে, বলে, “এটা দিয়ে কী হবে?”
সত্যব্রত ফিসফিস করে বলে, “হয়তো এর ভেতরেই আমার গল্পের শেষ দৃশ্য আছে।”

তারপর তারা সার্কাস ছাড়িয়ে মাঠের দিকে হাঁটেন। চারপাশে এখন রঙিন ব্যাকড্রপ ফিকে হয়ে আসছে, সূর্য ডুবে যাচ্ছে—কিন্তু সেটা ঠিক আমাদের দুনিয়ার সূর্য না, বরং সিনেমার আলো।

তাঁরা যখন একটু নির্জনে পৌঁছালেন, সত্যব্রত রিলটা প্রজেক্টরের মতো করে ঘুরিয়ে দেখতে শুরু করলেন। হঠাৎ চারপাশে হাওয়া বয়ে যায়। ধুলো উড়ে চোখে লাগে। ছেলেটি বলে, “আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?”

সত্যব্রত তখন বলে ওঠেন, “আমরা এবার ফাইনাল শট-এর দিকে এগোচ্ছি।”

আর তখনই হালকা ঝাপসা হয়ে আসে দৃশ্যপট। যেন কেউ স্ক্রিনে ফেড-আউট দিচ্ছে। সামনের মাঠটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে।

আবার তারা এক অজানা জায়গায়—এইবার অদ্ভুত নিঃশব্দ, যেন কোথাও কোনো শব্দ নেই, বাতাসও নেই, শুধু এক সাদা ঘর, যার মাঝখানে একটা চেয়ার রাখা, আর একটা প্রজেক্টর বসানো।

সত্যব্রত বুঝে যান—এই প্রজেক্টর সেই প্রজেক্টর, যা দিয়ে তিনি প্রথম ঢুকেছিলেন সিনেমার মধ্যে। কিন্তু এবার তার চারপাশে আর কিছু নেই—না চরিত্র, না দৃশ্য। শুধু তিনি, ছেলেটি আর সেই রিল।

তিনি রিলটা বসান প্রজেক্টরে। তারপর ঘুরিয়ে দেন।

চলতে শুরু করে এক নতুন ছবি—তাঁর নিজেরই।
সাদা-কালো পর্দায় দেখা যায় সত্যব্রত লাইব্রেরির ভিতরে বসে আছেন, কিশোর নীল তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। সময়ের সেই মুহূর্ত, যেদিন তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। নীল তখন ভয়ার্ত মুখে চিৎকার করছে—“স্যার!”

ছেলেটি এবার বলে ওঠে, “তুমি যদি চাও, তবে ফিরতে পারো।”
সত্যব্রত চমকে তাকায়, “তুমি জানো?”

ছেলেটি মাথা নাড়ে।
“এই সিনেমা কেবল তোমার না, এটা আমারও। তুমি যে পথ দিয়েছ, সেটা আমাকেও বদলে দিয়েছে।”

সত্যব্রত থমকে যায়। সে জানে—চ্যাপলিন যেমন তাঁর সিনেমা দিয়ে বাস্তবকে স্পর্শ করেছিলেন নিঃশব্দে, তেমনই তাঁর এই যাত্রাও কাউকে বদলে দিচ্ছে।

শেষবার ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “তুই আসলে কে, জানি না। কিন্তু তুই যদি সত্যি বাস্তবের কেউ হোস, তবে আমাকে মনে রাখিস। আর যদি তুই কল্পনা—তাহলে তুই আমার সবচেয়ে বড়ো গল্প।”

ছেলেটি কিছু বলে না, শুধু এগিয়ে গিয়ে প্রজেক্টরের বোতাম ঘুরিয়ে দেয়।
এক ঝলক আলো, এক মুহূর্তের ফ্রেমের ছায়া, আর সত্যব্রত রায় অদৃশ্য হয়ে যান।

লাইব্রেরির পেছনের ঘরে নীল প্রজেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
হঠাৎ শব্দ হয়। আলো ঝিমিয়ে ওঠে। আর তারপর ধীরে ধীরে ফ্রেমে ভেসে ওঠে সত্যব্রত রায়—চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে এক অপরিচিত শান্তি।

নীল চিৎকার করে ওঠে—“স্যার!”

সত্যব্রত ধীরে ধীরে তাকিয়ে বলেন, “আমি ফিরে এলাম। তবে… ভেতরের সেই ছায়া আর কখনও যাবে না।”

পর্ব ৬: ফ্রেমের বাইরে, হৃদয়ের ভিতর

সত্যব্রত রায় ফিরে এসেছেন। প্রজেক্টরের আলোর নিচে, পেছনের সেই ঘরে, তিনি বসে আছেন নীরবে। চারপাশে সেই পুরনো চেনা জিনিস—ছড়ানো রিল, ধুলো জমা বই, কফির দাগ, আর টেবিলের এক কোণায় পড়ে থাকা সেই নোটবুক যেখানে লেখা ছিল—”ফ্রেমের ভেতর ঢুকলে তুমি আর দর্শক নও, তুমি হয়ে ওঠো চরিত্র।”

নীল তাঁর পাশে বসে আছে। ঠোঁট কাপছে, চোখে জল, মুখে হাজারটা প্রশ্ন। সত্যব্রত চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলল, “তুই আমাকে ফিরিয়ে এনেছিস। কিন্তু আমি আর আগের আমি নেই।”

নীল আস্তে বলল, “আপনি কোথায় ছিলেন, স্যার? আমি তো… আমি তো ভেবেছিলাম আপনি…”

সত্যব্রত তাকিয়ে বললেন, “আমি ছিলাম গল্পের ভিতর। যেখানে সময় থেমে থাকে, আর হাসির ভিতরে লুকিয়ে থাকে কান্না। চার্লির সঙ্গে ঘুরেছি, একটা বাচ্চার হাত ধরে চলেছি, সার্কাসে অভিনয় করেছি, জুতো খেয়েছি, কাঁপতে কাঁপতে বরফে রাত কাটিয়েছি… আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।”

নীল চুপ করে শুনছিল। সেই চুপ করে শোনা যেন শ্রদ্ধার মত নিঃশব্দ। সত্যব্রত আবার বললেন, “তুই কি জানিস, আমি এত বছর লাইব্রেরির আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম? বাইরের জগৎ আমায় আর ডাকেনি। প্রেমিকাকে হারিয়েছি, বন্ধুরা চলে গেছে, ছাত্ররাও এসে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে একসময়। আমি থেকেছি শুধু একা—চ্যাপলিনকে আঁকড়ে। কারণ সে-ই ছিল একমাত্র, যে আমার মতই নীরব ছিল, আমার মতই একা ছিল, অথচ সে সবার হৃদয় ছুঁতে পারত—শুধু চোখ আর অঙ্গভঙ্গিতে।”

নীল মাথা নিচু করে বলল, “আপনি কী করে গেলেন… আপনি কি জানতেন যে এটা হবে?”

সত্যব্রত মাথা নেড়ে বললেন, “না। আমি শুধু প্রজেক্টর চালিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভিতরের আকাঙ্ক্ষা এতটা গভীর ছিল… হয়তো সেই আকাঙ্ক্ষাই আমায় টেনে নিয়েছিল ভেতরে। চার্লি কি জানত যে তার সিনেমা একদিন কাউকে এভাবে গ্রাস করে নেবে?”

নীল বলল, “আপনি কি আবার যেতে চান?”

এই প্রশ্নে সত্যব্রত থমকে গেলেন। তারপর ধীরে বললেন, “চাই। কিন্তু আর দর্শক হয়ে নয়। এবার আমি নিজের সিনেমা বানাতে চাই।”

নীলের চোখে উজ্জ্বলতা জ্বলে উঠল। “সিনেমা? আপনি? কিন্তু কীভাবে?”

সত্যব্রত হেসে বললেন, “তুই তো শিখছিস, না? সিনেমা বানাবি বলেছিলি… এবার তুই ক্যামেরা ধর। আমি অভিনয় করব। কিন্তু তুই শুধু ক্যামেরা চালাবি না—তুই গল্পটা ধরবি। গল্পটা, যেখানে কেউ একটা চ্যাপলিনের আদলে হারিয়ে যায়, আর ফিরে এসে ঠিক করে, সে নিজে একদিন সেই হাসির শরিক হবে।”

নীল উঠে দাঁড়াল, চোখে জল নিয়ে বলল, “আমি করব, স্যার। আমি আপনার গল্প শুট করব।”

সেই সন্ধ্যেবেলায়, কলকাতার অজস্র গলি-রাস্তায়, নীল আর সত্যব্রত একসঙ্গে হাঁটতে বেরোল। সত্যব্রতের পরনে সেই পুরনো কোট, মাথায় বাঁকা টুপি, আর হাতে একটা পকেট ঘড়ি—যেটা বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক সেই মুহূর্তে, যেদিন সে প্রজেক্টরের ভিতরে ঢুকেছিল।

তারা একটা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে অভিনয় শুরু করল—কেউ দেখছিল না প্রথমে, তারপর একজন এসে দাঁড়াল, তারপর আরেকজন। শিশুরা হেসে উঠল সত্যব্রতের হাঁটার ছন্দে, একটা মেয়ে ফোন বের করে ভিডিও করতে শুরু করল।

একটা কুকুর এসে বসে পড়ল তাঁর পাশে, আর সত্যব্রত অভিনয় করলেন—সে কুকুরকে চিনে ফেলেছে অনেকদিন পর। দর্শক হাসছে, কেউ কেউ হাততালি দিচ্ছে। নীল ক্যামেরায় ক্যাপচার করছে প্রতিটি মুহূর্ত।

এইভাবে কেটে গেল তিনদিন।

সত্যব্রত রোজ নতুন জায়গায় পারফর্ম করতেন—ট্রাম স্টপে, বাসস্ট্যান্ডে, পার্কে, নদীর ধারে। মানুষের মুখে হাসি ফুটত। তার কোনো সংলাপ নেই, কিন্তু তার চোখে ছিল জীবন। কেউ কেউ তাঁকে ‘কলকাতার চ্যাপলিন’ বলে ডাকত।

চতুর্থ দিন, এক ফিল্ম স্কুল থেকে একজন শিক্ষক এসে বলল, “আপনার ভিডিও দেখে তো বিস্ময়ে speechless হয়ে গেছি। আপনি যদি চান, আমাদের একটা স্টুডেন্ট শর্ট ফিল্মে আপনি অভিনয় করুন।”

সত্যব্রত হাসলেন। বললেন, “আমি অভিনয় করিনি, আমি শুধু জীবনের একটা গল্প বেঁধে রেখেছিলাম নিজের মধ্যে। তুমি যদি চাও, আমি সেটা তোমাকে দিয়ে দিতে পারি।”

নীল চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। তারপর সে বলে, “স্যার, এখন কি আপনি আবার সেই প্রজেক্টরে যাবেন?”

সত্যব্রত একটু চুপ করে বললেন, “না। এবার নয়। কারণ এবার আমি ফ্রেমের ভেতর থেকে ফিরেছি, আর ফ্রেমের বাইরে থেকেও গল্প বলতে পারি।”

সে রাতে লাইব্রেরির পেছনের ঘরে সত্যব্রত সেই প্রজেক্টরের পাশে বসলেন। রিলগুলো এক এক করে সাজিয়ে রাখলেন। তারপর একটা ছোট কাঁচের বাক্সে সেই প্রথম রিলটি—Modern Times-এর—বন্ধ করলেন।

নীল এসে বলল, “তুমি আর চালাবে না এটা?”

সত্যব্রত হেসে বলল, “না। এবার এটা দেখার নয়। এটা সংরক্ষণের সময়। এবার আমাদের গল্প তৈরি করার পালা।”

সত্যব্রত জানেন, মানুষ চাইলেই ফ্রেমের বাইরে গিয়ে বাঁচতে পারে। চার্লি চ্যাপলিনের মতই—যে নিজে ছিল এক ট্র্যাজেডির সন্তান, কিন্তু পৃথিবীকে দিয়েছে হাসির সঞ্চালন।

আর এই গল্পের শেষটা এখনো হয়নি। কারণ প্রতিটি দর্শক নিজের মধ্যে চ্যাপলিনকে বহন করে। যেদিন সে নিজেই নিঃশব্দে হাসিয়ে তুলতে শিখবে আর অশ্রুকে অঙ্গভঙ্গিতে মিশিয়ে দিতে পারবে—সেদিন সে নিজেই হয়ে উঠবে এক গল্প।

আর তখনই প্রকৃত অর্থে The End লেখা যাবে।

পর্ব ৭: নিঃশব্দ নায়কের প্রত্যাবর্তন

কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক পুরনো স্টুডিওতে ক্যামেরা বসেছে, লাইট জ্বলে উঠেছে, মাইক নিচে নামানো, আর মেঝেতে সাদা রঙে আঁকা একটা ছোট রিং—একেবারে সার্কাসের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু আজ এখানে সার্কাস নয়, বরং এক নীরব বিপ্লবের চিত্রায়ণ শুরু হচ্ছে। পরিচালক একজন তরুণ—নীল মজুমদার। আর মুখ্য চরিত্রে? সেই বুড়ো লাইব্রেরিয়ান, যিনি একদিন হারিয়ে গিয়েছিলেন প্রজেক্টরের ভিতর, আর ফিরে এসে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন নতুন ভূমিকায়।

সত্যব্রত রায় আজ ‘অভিনেতা’। যদিও তিনি নিজে বলেন, “আমি কিছু অভিনয় করছি না, আমি শুধু আমার ভিতরের চ্যাপলিনটাকে একটু হাঁটাচলা করাচ্ছি।” তাঁর পরনে সেই চিরচেনা কোট, পায়ে দুটো আলাদা মাপের জুতো, আর মাথায় ঘুরে পড়ে থাকা হ্যাট। মুখে কোনো মেকআপ নেই, তবু যেন চোখেই সব কথা লেখা।

ক্যামেরা চালু হলো। প্রথম দৃশ্য—একটা ফাঁকা রাস্তায় এক বৃদ্ধ ধীরে ধীরে হাঁটছেন। আশেপাশে কেউ নেই। তাঁর হাঁটার ছন্দে একটা তাল, তাঁর হাতের নাড়াচাড়ায় একটা গল্প। সে কিছু খুঁজছেন—কখনো হয়তো খুঁজছেন পকেটের চাবি, কখনো পকেটেই খুঁজছেন নিজের অতীত।

নীল পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছে। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ছে সেই অদ্ভুত জীবন্ত সংলাপহীন অভিব্যক্তি। সত্যব্রত সামনে তাকিয়ে একটা খোলা মাঠে ঢুকে পড়েন, যেখানে কিছু বাচ্চা খেলছে। তিনি হঠাৎ মাটিতে পড়ে যান, বাচ্চারা হেসে ওঠে। তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন, মুখে কৃত্রিম অপ্রস্তুতির হাসি। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান, নিজের ধুলো ঝাড়েন, আর পকেট থেকে বের করেন একটি ছোট্ট চকোলেট। বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে দেন।

এই দৃশ্যের কোনো স্ক্রিপ্ট নেই। সত্যব্রত বলেছিলেন, “আমাকে সময় দাও, আমি নিজের মত করেই বলব আমার গল্প।”

প্রথম দিনের শুটিং শেষে সত্যব্রত ক্লান্ত হয়ে একপাশে বসে পড়েন। তাঁর মুখে হাসি, চোখে একটু ঘাম। নীল এগিয়ে গিয়ে বলে, “স্যার, আপনি তো ম্যাজিক করছেন!”

সত্যব্রত ধীরে বলেন, “ম্যাজিক নয়, এটা শুধু কান্না আর নিঃসঙ্গতার একটা অনুবাদ—হাসির ভাষায়।”

নীল জানে, এই সিনেমা কেবল একটা শর্ট ফিল্ম নয়। এটা এক সাহসের গল্প। একজন মানুষ যিনি জীবনভর দর্শক ছিলেন, তিনি হঠাৎ একদিন ফ্রেমের ভিতর গিয়ে বুঝলেন, তিনি নিজেও গল্পের একজন হতে পারেন।

পরের দৃশ্যে সত্যব্রত অভিনয় করেন লাইব্রেরির পেছনের ঘরে। তিনি একা বসে আছেন, চারপাশে পুরনো রিল। হঠাৎ প্রজেক্টরের আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু এবার সে এগিয়ে যায় না তার দিকে, বরং সে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে, যেমন কেউ চাঁদকে দেখে—প্রেমে পড়ে নয়, বরং চাঁদের নিজেরই হয়ে ওঠার বাসনায়।

সত্যব্রত আলতো করে প্রজেক্টরের সুইচ বন্ধ করেন, তারপর রিল খুলে নিজের বুক পকেটে রেখে দেন। যেন তিনি বলছেন—“গল্প শেষ নয়, আমি এটা সঙ্গে নিয়ে চলেছি।”

এরপর তারা শুট করে একটি দৃশ্য, যেখানে সত্যব্রত একটা পার্কে বসে আছেন, পাশে একজন বৃদ্ধা। দুজনেই চুপচাপ। কেউ কথা বলে না। মাঝে মাঝে চা-ওয়ালা আসে, দুটো কাগজের কাপ রেখে যায়। তাঁরা শুধু মাথা নেড়ে নেয়। তারপর সত্যব্রত পকেট থেকে বের করেন একটা সাদা গোলাপ। বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে দেন। তিনি নেন না, শুধু তাকিয়ে থাকেন।
তাঁদের চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যা ভাষাহীন, অথচ উচ্চারিত। ঠিক যেমন চ্যাপলিন আর তাঁর প্রেমিকা সিনেমার শেষে ট্রেনে ওঠে—চোখে সেই অব্যক্ত প্রেম, যে প্রেম কোনোদিন বলা হয়নি, তবু থেকে গেছে।

এই দৃশ্য শুট করার সময় স্টুডিও নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আলো-টেকনিশিয়ান হঠাৎ চোখ মুছছিল। একজন জুনিয়র আর্টিস্ট বলছিল, “এই মানুষটা কথা না বলেও যেন সব বলছে।”

নীল বুঝতে পারে—তাঁর সিনেমা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে একটা বেদনার সেতু, যার দুদিকে জীবন আর গল্প।

সপ্তাহখানেক চলার পর শুটিং শেষ হয়। নাম ঠিক হয়: “ফ্রেমের বাইরে”।
নীল পোস্ট-প্রোডাকশনে বসে, রাত জেগে এডিট করে, মিউজিক বসায়—সব জায়গায় সে চায় একটাই জিনিস: চুপ করে বলা গল্প।

সিনেমা শেষ হয় সেই দৃশ্যে—সত্যব্রত একটি মাঠের একদম শেষ মাথায় হাঁটছেন। পেছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তার ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে, আর একসময় সেটি মিলিয়ে যায় আলোতে। শেষে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে:

“Smile, though your heart is aching…”

সিনেমাটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠানো হয়। প্রথমদিকে কেউ বেশি আশা করেনি। কিন্তু একদিন সকালে নীল চিৎকার করে ফোন করে বলল, “স্যার! আমরা নির্বাচিত হয়েছি! মুম্বই ফেস্টিভ্যালে ফ্রেমের বাইরে স্ক্রিনিং হবে!”

সত্যব্রত হাসলেন। বললেন, “তুই তো বলেছিলি সিনেমা বানাতে চাস… এবার তুই সেটা করলি।”

নীল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আপনি না থাকলে এটা হতো না। আপনি তো নিজেই সিনেমা হয়ে উঠেছেন।”

সত্যব্রত বললেন না কিছু। শুধু আকাশের দিকে তাকালেন। যেন চার্লি কোথাও একটা বসে দেখছেন। আর ইশারায় বলছেন—“Bravo, my friend. You learned to laugh in silence.”

পর্ব ৮: শেষ রিলের নীরবতা

মুম্বইয়ের সেই শীতল সন্ধ্যায় নরিম্যান পয়েন্টের একটি ছোট্ট অথচ মর্যাদাপূর্ণ স্ক্রিনিং হলে বসে আছেন সত্যব্রত রায়। তাঁর ডান পাশে নীল, বাঁ পাশে একদল অচেনা দর্শক—সিনেমার ছাত্র, বোদ্ধা, সাংবাদিক, কিছু বয়স্ক মানুষ যারা এখনও সাদা-কালো চলচ্চিত্র ভালোবাসেন। সকলে চুপ করে। আলো নিভে যায়। স্ক্রিন জ্বলে ওঠে।

সিনেমার প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় একটি খালি রাস্তায় একজন বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছেন, পায়ের ছায়া সোজা পড়ে যাচ্ছে রাস্তার টালিগুলোয়। ঠিক সেই মুহূর্তে হলে কেউ কাশিও দেয় না। এক নিঃশব্দে সব মুখ যেন থমকে গেছে। সত্যব্রতের নিজের মুখেও কোনো ভাবান্তর নেই। শুধু চোখ তার গাঢ় হয়ে উঠেছে, যেন প্রতিটি ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে সে নিজের জীবনেরই গল্প দেখছেন।

এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের ছবি। কোথাও কোনো সংলাপ নেই। শুধু অভিব্যক্তি, সুর আর নীরবতা।
ছবির মাঝে মাঝে হাসির হালকা ছোঁয়া, বাচ্চাদের খিলখিল, একটা বকুনির অভিনয়, চোখের ইশারায় প্রেম, আর বৃদ্ধ বয়সের এক নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার মত একা একা পার্কে বসে থাকা।

ছবির শেষে, যখন দেখা যায় চরিত্রটি একা হেঁটে চলে যাচ্ছে রেললাইনের দিকে, আর সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তখন হলে নেমে আসে এক রহস্যময় স্তব্ধতা। ছবি শেষ হলেও কেউ উঠে দাঁড়ায় না। যেন সবাই কিছু একটা অনুভব করছে, যেটা বলা যায় না।

তিন সেকেন্ড, চার সেকেন্ড… তারপর কারও হাত থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসে করতালির শব্দ। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে—আস্তে, শান্ত অথচ গভীরভাবে। যেন শব্দের মধ্যেও একটা চুপ থাকা শ্রদ্ধা মিশে আছে।

নীল সত্যব্রতের দিকে তাকায়। তাঁর চোখে জল। তিনি কিছু বলেন না। শুধু হাসেন—চ্যাপলিনের সেই বিখ্যাত দমবন্ধ হাসি, যেটা চোখ দিয়ে হাসে, ঠোঁট দিয়ে নয়।

এরপর সংবাদমাধ্যম, প্রশ্ন, শংসাপত্র, ফটোশুট—সব কিছুর মধ্যেও সত্যব্রত চুপচাপ। কেউ জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো পেশাদার অভিনেতা নন, এটা কীভাবে সম্ভব?”
তিনি হালকা হাসেন, বলেন, “আমি শুধু আমার নিঃশব্দকে ব্যবহার করেছি। বাকিটা দর্শক নিজের মত বুঝেছে।”

নীল নিজেই সাক্ষাৎকারে বলে, “এই মানুষটা আমার কাছে কেবল একটা চরিত্র নয়, উনি এক চলন্ত প্রজেক্টর। যিনি নিঃশব্দ আলোর মধ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাস, যন্ত্রণার, ভালোবাসার ছবি দেখিয়েছেন।”

পরদিন কলকাতায় ফিরে লাইব্রেরির সামনে কিছু ছাত্র-ছাত্রী দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বলল, “স্যার, আপনি কি আমাদের একটা ওয়ার্কশপ করাবেন?”

সত্যব্রত এক মুহূর্ত থেমে বললেন, “আমি পড়াতে পারি না, শুধু দেখাতে পারি।”

এইভাবেই তৈরি হলো “Chaplin Collective”—একটা ছোট ফিল্ম ক্লাব, যেখানে সত্যব্রতের নেতৃত্বে যুবকরা সাইলেন্ট ফিল্ম বানাতে শুরু করল। ভাষাহীন গল্প, চোখের অভিনয়, শহরের রাস্তার ব্যাকগ্রাউন্ডে ছোট ছোট দৃশ্য। এই সব গল্পগুলো গল্প হলেও যেন জীবনের থেকেও জীবন্ত।

আর সেই পুরনো প্রজেক্টর?
সত্যব্রত সেটা তুলে রেখেছেন লাইব্রেরির পেছনের ঘরে। ধুলো পরিষ্কার করে, একপাশে রাখেন। তিনি সেটা আর চালান না। কারণ এখন তিনি জানেন—ওটা আর দরকার নেই।
তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন এক প্রজেক্টর। তাঁর চোখই এখন রিল, আর স্মৃতি হলো আলোর রেখা—যার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে মানুষের মুখ, হাসি, কান্না, সংলাপহীন প্রেম।

একদিন বিকেলে নীল এসে বলে, “স্যার, নতুন একটা সিনেমার প্লট মাথায় এসেছে। একজন বৃদ্ধ, যিনি ভুলে যেতে থাকেন… কিন্তু তার মনে থাকে কেবল একটি চরিত্র—চার্লি চ্যাপলিন। তিনি প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চার্লির মত সাজান। জানেন না কেন, শুধু জানেন এটাই তাঁকে জীবিত রাখে।”

সত্যব্রত হালকা হেসে বলেন, “ভালো। এবার তুমি করো। আমিও একদিন একজনের গল্প ছিলাম, এখন তুমি আমার গল্প হয়ে ওঠো।”

নীল জিজ্ঞেস করে, “তাহলে আপনি আর অভিনয় করবেন না?”

তিনি মাথা নেড়ে বলেন, “আমি তো এখনও করছি। প্রত্যেক সকালেই যখন কাউকে দেখে মুচকি হেসে হাঁটি, আমি তখনও ট্র্যাম্প। আমার অভিনয় চলছেই, শুধু ক্যামেরা বন্ধ।”

সত্যব্রতের বয়স বেড়েছে, হাঁটা ধীর হয়েছে। কিন্তু চোখ এখন আরও উজ্জ্বল। প্রতি রবিবার তিনি লাইব্রেরির ভেতর বসে নতুনদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করেন। কেউ কাঁদে, কেউ হাসে, কেউ চুপ করে থাকে—সবাই গল্প বলে। কেউ বলে ভাষায়, কেউ বলে ছায়ায়।

আর একপাশে, টেবিলের ওপরে রাখা সেই বাক্সে, প্রজেক্টরের পাশে, এখনও বন্ধ অবস্থায় শুয়ে আছে একটি রিল।

রাত হলে, সব চলে গেলে, সত্যব্রত চুপ করে একা বসে পড়েন। একসময় লাইট নিভিয়ে দেন। শুধু জানালার পাশে রাখা সেই পুরনো রিলটা হাতে নিয়ে বলেন—

“চার্লি, তুমি যা শুরু করেছিলে, সেটা শেষ হয়নি। আমি শুধু কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেলাম। এবার বাকিটা এরা বলবে—চুপ করে, হাসিমুখে।”

বাইরে চাঁদ ওঠে। আলো পড়ে লাইব্রেরির দেয়ালে। সেখানে এক ছায়া ভেসে ওঠে—একজন বৃদ্ধ, টুপি মাথায়, বাঁকানো লাঠি হাতে, হাঁটছেন একা।
কেউ হয়তো দেখে না।
কিন্তু যারা একবার সিনেমার ভেতর ঢুকেছে, তারা জানে—এই ছায়া চিরকাল থাকবে।

শেষ

1000025083.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *