Bangla - ভূতের গল্প

দোতলার লাল আলো

Spread the love

অধ্যায় ১ —

উত্তর কলকাতার পুরনো পাড়াগুলোর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে—গলির ভেতর ঢুকলেই সময় যেন কয়েক দশক পিছিয়ে যায়। আধুনিক শহরের ব্যস্ততার বাইরে, এখানে এখনো ছিমছাম পুরনো দোতলা-তিনতলা বাড়ি, কার্নিশে শ্যাওলা জমে থাকা দেওয়াল, এবং ধুলো জমা বারান্দার খিলান। সেই রকমই এক সরু, বাঁকানো গলি—যেখানে দিনের বেলাতেও আলো ঠিকমতো ঢোকে না। গলির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন দোতলা বাড়ি, যার লোহার গেট মরচে পড়ে বাদামি হয়ে গেছে, আর তার ওপরে গাছের লতা-পাতা জট বেঁধে পড়ে আছে। লোকজন দিনের বেলায়ও বাড়িটির দিকে তাকাতে সাহস পায় না, রাতের কথা তো বাদই দিলাম। কারণ গুজব বলে, রাত নামলেই দ্বিতীয় তলার এক জানালায় জ্বলে ওঠে গাঢ় লাল আলো—অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল, যেন ভেতর থেকে কোনো অদৃশ্য সত্তা তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এই আলো শুধুমাত্র মধ্যরাতের পরে দেখা যায়, আর ঠিক তখনই গলির অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ শুনতে পায় ক্ষীণ, কিন্তু স্পষ্ট, এক নারীকণ্ঠের গান। গানটি পুরনো দিনের বাংলা আধা-শাস্ত্রীয় সুরের, কিন্তু সুরের মধ্যে এক অদ্ভুত বেদনা মিশে থাকে, যা শোনার পর বুকের ভেতর শীতল হিম নেমে আসে। আশ্চর্যের বিষয়, ওই তলায় বহু বছর ধরে কেউ থাকে না—বাড়ির নিচতলায় পুরনো কাঠের দরজা তালাবদ্ধ, জানালার কাচ ভাঙা, আর বারান্দায় জমে আছে ধুলো ও শুকনো পাতা। তবুও, রাতের অন্ধকারে সেই লাল আলো ঠিক সময়ে জ্বলে ওঠে, যেন সময়ের কোনো নিয়ম না মেনে।

এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের মধ্যে হরিদাস দত্ত হলেন একমাত্র মানুষ, যিনি নির্ভয়ে এই বাড়ির গল্প বলতে পারেন। বয়স তার প্রায় বাহাত্তর, কিন্তু গলার স্বর এখনো শক্তিশালী, আর চোখে মুখে এক ধরনের স্থায়ী রহস্যের ছাপ। চা-দোকানের বেঞ্চে বসে তিনি প্রায়ই নতুন প্রজন্মকে শোনান—কীভাবে এই বাড়িটি একসময় ছিল প্রাণবন্ত, কোলাহলপূর্ণ, আর সঙ্গীতের স্বর্গরাজ্য। তিনি বলেন, “প্রিয়া দত্ত নামের এক তরুণী গায়িকা থাকতেন ওই দ্বিতীয় তলায়। গলির লোকজন এখনো মনে রেখেছে—তার গলা ছিল অনন্য, আর তার গান শোনার জন্য নাকি বাইরে দাঁড়াতো অচেনা মানুষও। কিন্তু সেই জৌলুস টিকল না বেশিদিন।” তারপর হরিদাস একটু থামেন, চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়তে থাকলেও তার দৃষ্টি চলে যায় ফাঁকা গলির দিকে। ফিসফিস করে তিনি যোগ করেন, “এক শীতের রাতে হঠাৎ লাল আলো জ্বলে ওঠে, আর প্রিয়ার কণ্ঠস্বর শোনা যায় শেষবারের মতো। পরদিন সকালে লোকজন খুঁজে পায় তার মৃতদেহ—ঘরের ভিতরে, গলায় ওড়নার ফাঁস। পুলিশ বলে আত্মহত্যা, কিন্তু আমরা যারা কাছ থেকে দেখেছি, তারা জানি—ওর চোখে তখনো ছিল ভয়, আর হাতের কাছে পড়ে ছিল ভাঙা হারমোনিয়াম।” এই পর্যন্ত এসে হরিদাস প্রায়শই চুপ করে যান, যেন এর পরের কথা মুখে আনতে চান না। তবে তার অঙ্গভঙ্গি, থেমে যাওয়া শ্বাস আর চোখের কৌণিক ভয়ের রেখা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়—এই মৃত্যুর পিছনে ছিল আরও কিছু, যা কখনো প্রকাশ্যে বলা হয়নি।

গলির ছেলেমেয়েরা এই গল্প শোনার পর রাতে ওই বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটতে গিয়েছে কতবার—কেউ সাহস করেছে গেটের কাছে দাঁড়াতে, কেউ আবার দৌড়ে পালিয়েছে অল্প শব্দ পেলেই। সময় যতই এগিয়েছে, প্রিয়ার মৃত্যুর কাহিনি ততই মিশেছে গুজব, ভয় আর অলৌকিক ঘটনার সাথে। কিছু লোক বলে, লাল আলো আসলে পুরনো কোনো বৈদ্যুতিক ত্রুটি, আবার কেউ শপথ করে বলেছে—তারা নিজের চোখে দেখেছে জানালার ভিতর থেকে সাদা শাড়ি পরা এক নারীর ছায়া হাত নাড়ছে। কয়েকজন তো দাবি করে, গানের সাথে সাথে বাড়ির কাছাকাছি এলে কানে ফিসফিস শব্দ শোনা যায়, যা অচেনা ভাষায় কিছু বলতে থাকে। এইসব কাহিনি যেন গলির বাতাসে মিশে আছে—নতুন কেউ ভাড়াটে হিসেবে বাড়িতে উঠতে চাইলে প্রতিবেশীরা কেমন করে যেন তাকে নিরুৎসাহিত করে দেয়। আর হরিদাস দত্ত? তিনি এখনো প্রতিটি নতুন মুখকে চায়ের আড্ডায় বসিয়ে বলেন, “এই বাড়ি শুধু ইট-চুনের নয়—এখানে লুকিয়ে আছে কারও অসমাপ্ত গল্প, কারও অপূর্ণ সুর… আর সেই সুরের সাথে বাঁধা আছে লাল আলোর অভিশাপ।” তার কণ্ঠের ভার ও চোখের গভীরতা শোনার পর সহজে কেউ আর ওই বাড়িকে সাধারণ পরিত্যক্ত বাড়ি ভাবতে পারে না। গল্পটা যেন সত্যি হোক বা মিথ্যে, তার ভয়ঙ্কর রূপ সবাইকে টেনে নিয়ে যায় সেই জানালার দিকে, যেখানে রাত নামলেই আবার জ্বলে ওঠে সেই অশুভ লাল আলো।

অধ্যায় ২ —

অর্ণব মুখার্জী পেশায় একজন অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক। শহরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত গল্প, অমীমাংসিত রহস্য, কিংবা শহুরে কিংবদন্তি নিয়ে রিপোর্ট করতে তার বরাবরই আগ্রহ। সে জানে, এ ধরনের কাহিনির মধ্যে যতটা না সত্যি থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে মানুষের কল্পনা, ভয় আর অতিরঞ্জন। কিন্তু এই গল্পগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে কিছু বাস্তব সূত্র, যা বের করতে পারলে পাঠকদের সামনে হাজির হয় নতুন এক দুনিয়া। এক শীতের সন্ধ্যায় কফি শপে বসে এক সহকর্মীর কাছ থেকে সে প্রথম শোনে ‘দোতলার লাল আলো’র কাহিনি। সহকর্মী একেবারে দৃঢ় কণ্ঠে বলে—“তুমি যদি সাহসী হও, একবার ওই বাড়ির গলিতে গিয়ে দাঁড়াও। রাত বারোটার পর দেখবে, জানালায় গাঢ় লাল আলো জ্বলে উঠবে, আর শোনা যাবে এক নারীর গান।” অর্ণবের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল—‘এ তো স্রেফ গুজব।’ সে জানে, আলো জ্বলার ঘটনা বৈদ্যুতিক গোলযোগের ফল হতে পারে, আর গান শোনা হয়তো কারও রেডিও বা মোবাইল থেকে ভেসে আসছে। কিন্তু সাংবাদিকতার স্বভাব অনুযায়ী কৌতূহল তার মনের ভেতরে জায়গা করে নিল। বাড়িটি যেহেতু উত্তর কলকাতায়, আর এলাকার মানুষ যেভাবে ঘটনাটি এড়িয়ে চলছে, তাতে অর্ণব নিশ্চিত—এখানে কিছু না কিছু খুঁজে বের করার মতো আছে। পরদিনই সে ঠিক করল, বিষয়টি অনুসন্ধান করবে এবং যদি প্রমাণ হয় গুজবের পিছনে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে, তবে তা প্রকাশ করবে বড়সড় রিপোর্ট আকারে।

অর্ণব জানে, একটি পুরনো বাড়ির ইতিহাস বোঝার জন্য শুধুমাত্র রাতের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়—এটির অতীত, স্থাপত্য, এবং পূর্বের বাসিন্দাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও জানা দরকার। তাই সে যোগাযোগ করল রূপা সেনের সাথে, যিনি একজন আর্কিটেক্ট এবং পুরনো স্থাপত্য পুনর্নির্মাণে বিশেষজ্ঞ। রূপা এই শহরের অলি-গলির অগণিত প্রাচীন বাড়ি ঘুরে দেখেছেন, আর প্রতিটি ইটের গায়ে জমে থাকা সময়ের চিহ্ন পড়তে পারেন যেন বইয়ের পাতার মতো। অর্ণব যখন ফোনে রূপাকে বিষয়টি বলল, প্রথমে রূপা একটু চুপ করল। তারপর নরম গলায় বলল, “এই বাড়িটাকে আমি চিনি… খুব ভালো করেই চিনি। ছোটবেলায় আমার মামাবাড়ি ছিল ওই রাস্তার এক প্রান্তে। আমি নিজে চোখে দেখেছি সেই লাল আলো… আর শুনেছি গানও।” অর্ণব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিশ্চিত, তখন অন্য কোনো উৎস থেকে আলো বা শব্দ আসেনি?” রূপার উত্তরে ছিল শুধুই একটি দীর্ঘশ্বাস। ফোনের ওপারে সেই মুহূর্তের নীরবতায় অর্ণব বুঝতে পারল—এই কেসে তার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ কেউ থাকলে, সে রূপা সেনই। তাই প্রস্তাব দিল, দু’জনে মিলে বাড়িটি তদন্তে নামবে—দিনের বেলায় বাড়ি ঘুরে দেখা, এলাকার মানুষের সাথে কথা বলা, আর রাতে বাড়িটির আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করা।

রূপা প্রথমে দ্বিধায় ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হল, কারণ তারও মনে প্রশ্ন—শৈশবে যা দেখেছিল, তা কি সত্যিই অতিপ্রাকৃত কিছু, নাকি শুধুই তার কল্পনা? পরের সপ্তাহের এক দুপুরে তারা দেখা করল শ্যামবাজার মোড়ে, হাতে নোটবুক, ক্যামেরা, আর কিছু জরুরি সরঞ্জাম। গলির ভেতরে পা রাখতেই অর্ণব লক্ষ্য করল—এখানকার পরিবেশ যেন পুরো আলাদা। চারদিকের বাড়িগুলো পুরনো হলেও মানুষের উপস্থিতি আছে, কিন্তু মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দোতলা বাড়িটির চারপাশে এক ধরনের অদ্ভুত শূন্যতা। রূপা বাড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো, এই বাড়ির দ্বিতীয় তলার জানালাটার কাঠের ফ্রেম একবার রং করা হয়েছিল গাঢ় লাল রঙে… প্রিয়ার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। লোকজন বলে, সেই রঙই পরে হয়ে ওঠে অভিশাপের প্রতীক।” অর্ণব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি খিলান, দেওয়ালের ফাটল, গেটের মরচে পড়া অংশ নোট করছিল। তার মনে হচ্ছিল—গল্পটা যতই অলৌকিক শোনাক, এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো মানবিক কারণ লুকিয়ে আছে। কিন্তু একই সাথে সে বুঝতে পারছিল, রূপার চোখে অদ্ভুত এক অস্বস্তি—যেন সে এখনো ওই বাড়ির স্মৃতির মধ্যে আটকে আছে। অর্ণব ঠিক করল, এই রহস্য উদ্ঘাটন করা শুধু সাংবাদিকতার জন্য নয়, বরং রূপার সেই পুরনো আতঙ্কও মুছে ফেলার জন্য প্রয়োজন। আর এর প্রথম ধাপ হবে, রাত নামার পর এখানে ফিরে আসা… লাল আলো সত্যিই জ্বলে কি না, তা নিজের চোখে দেখা।

অধ্যায় ৩ —

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই অর্ণব আর রূপা গলির মুখে এসে দাঁড়াল। শীতকাল বলে আলো দ্রুত কমে আসছে, আর গলির ভেতর ঢুকতেই অর্ণব বুঝতে পারল—এখানে দিনের বেলাতেও অদ্ভুত এক স্থিরতা বিরাজ করছে। বাড়িটি গলির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে, যেন গলির দুই দিককে আলাদা করে রেখেছে তার নিঃসঙ্গ উপস্থিতি। বিশাল লোহার গেট মরচে পড়ে বাদামি হয়ে গেছে, আর তাতে ঝোলানো ‘প্রবেশ নিষেধ’ বোর্ড হালকা বাতাসে দুলছে। গেটের ওপারে বাড়ির আঙিনায় জঙ্গল বেড়ে গেছে, বুনো গাছপালা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে ভেতরের অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অর্ণব গেটের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল—একটি ভাঙা পাথরের সিঁড়ি কুঁজো হয়ে উপরের বারান্দায় উঠেছে, যেখানে একসময় হয়তো বসে চা খাওয়া যেত, কিন্তু এখন কেবলই ধুলো আর শ্যাওলায় ভরা। রূপা ধীরে ধীরে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, যেন অতীতের কোনো স্মৃতিকে স্পর্শ করছে। সে গেটের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে মরচে ধরা লোহার ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করল, আর তার চোখের দৃষ্টি দূরে, সেই দ্বিতীয় তলার জানালার দিকে স্থির হয়ে রইল। অর্ণব হালকা হাসি দিয়ে বলল, “এতটা সিরিয়াস হওয়ার কী আছে? দিনের বেলা তো কিছুই ঘটছে না।” কিন্তু রূপার গলায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—“তুমি জানো না, আমি ছোটবেলায় এখান থেকে লাল আলো দেখেছিলাম… তারপর বহু বছর ধরে দুঃস্বপ্নে কাঁপতাম।”

তারা গলির দু’পাশ ঘুরে বাড়িটিকে চারদিক থেকে দেখার চেষ্টা করল। একপাশে একটি সরু গলিপথ রয়েছে, যা বাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে শেষ হয়েছে ভাঙা ইটের দেয়ালে। দেয়ালের ওপরে ঝুলে আছে বটগাছের শিকড়, যা প্রায় মাটিতে ছুঁয়ে গেছে। সেই শিকড়গুলোর ফাঁকে ফাঁকে কাক বসে আছে, আর হালকা ডাক দিয়ে যেন পুরো পরিবেশটিকে আরও ভারী করে তুলছে। অর্ণব তার ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি দিকের ছবি তুলছিল, ফাঁকা জানালার গা ছমছমে চেহারা ফ্রেমে বন্দি করছিল। বাড়ির দেয়ালে অসংখ্য ফাটল, কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে ইট বেরিয়ে এসেছে। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পেতে তারা গলির এক প্রান্তে থাকা স্থানীয় দোকানদারের সাথে কথা বলল, কিন্তু সে কেবল মাথা নেড়ে বলল, “ভিতরে কেউ ঢুকতে পারে না, চাবি কারও কাছে নেই। আর থাকলেও… ওখানে ঢোকার ইচ্ছে আপনারা করবেন না।” তার কণ্ঠে ছিল সতর্কবার্তার সুর, তবে চোখে ছিল একধরনের ভয়, যা অর্ণব সহজেই টের পেল। রূপা এই কথাগুলো শুনে কেমন যেন কেঁপে উঠল, যদিও মুখে কিছু বলল না। সে বরং অর্ণবকে নিয়ে গেটের কাছে ফিরে এল, আর জানাল—“তুমি জানো, আমি যখন সেই লাল আলো প্রথম দেখি, তখন আমার বয়স মাত্র দশ। আমি মামাবাড়িতে থাকতাম, আর এক রাতে বাথরুমে যাওয়ার পথে হঠাৎ জানালা দিয়ে এই বাড়িটা দেখি। তখনই আলো জ্বলে উঠেছিল—গাঢ়, রক্তের মতো লাল। আর সেই আলোতে আমি দেখেছিলাম এক নারীর ছায়া, যেন গান গাইছে।”

অর্ণব রূপার চোখে তাকিয়ে দেখল—সে কথাগুলো বলার সময় যেন এখনও সেই দৃশ্যের ভেতরে ফিরে গেছে। রূপা ধীরে ধীরে যোগ করল, “তারপর বহুদিন আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে আমি ওই বাড়ির ভেতর আটকে থাকতাম, লাল আলো আমাকে ঘিরে ধরত, আর গলা শুকিয়ে যেত চিৎকার করতে গিয়ে। আমার বাবা-মা ডাক্তারও দেখিয়েছিল, কিন্তু কেউ কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।” অর্ণব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, কারণ সাংবাদিক হিসেবে সে জানে—কোনো গল্পের আসল শক্তি লুকিয়ে থাকে সাক্ষীদের অনুভূতিতে। তবে সে নিজের সন্দেহটাও মনের ভেতরে রাখল না। “হয়তো তুমি যা দেখেছিলে, সেটা আলো-ছায়ার খেলা বা পাশের কোনো বাড়ির জানালার প্রতিফলন ছিল। ছোটবেলায় কল্পনা অনেক বেশি প্রভাবিত করে,” সে বলল। রূপা মাথা নাড়ল, “হয়তো… কিন্তু গান? সেই সুর আমি আজও ভুলতে পারিনি।” অর্ণব আর তর্ক করল না, শুধু তার নোটবুকে লিখে রাখল—রূপার দেখা আলো এবং শোনা গান, ২০ বছরেরও বেশি পুরনো ঘটনা, কিন্তু আজও স্মৃতি স্পষ্ট। বাড়িটির চারপাশ ঘুরে দেখার পর তারা সিদ্ধান্ত নিল—দিনের বেলায় ভেতরে ঢোকা যদি না হয়, তবে রাতের বেলায় অন্তত বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করতেই হবে। অর্ণবের মনে তখন একটাই ভাবনা—এই বাড়ির সত্য উদঘাটন হবে কিনা জানা নেই, কিন্তু এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে রূপার অতীতের সাথে, আর শেষটাও হয়তো সেই অতীতেই গিয়ে মিশবে।

অধ্যায় ৪ —

অর্ণব আর রূপা সেদিন বিকেলের দিকে গলির কোণে ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করছিলেন হরিদাস দত্তের জন্য। হরিদাস এই এলাকার জন্মসূত্রে বাসিন্দা, বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি, আর গলির মানুষদের কাছে তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। তাঁর সাদা ধবধবে চুল, কুঁচকে যাওয়া ত্বক, আর ধীর গতি—সবই বলছে সময় তাকে ধীরে ধীরে মুছে দিচ্ছে, কিন্তু চোখের গভীরে এখনো লুকিয়ে আছে বহু গল্প। এক কাপ চা হাতে নিয়ে হরিদাস ধীরে ধীরে বসে পড়লেন, আর অর্ণব তাঁর রেকর্ডার চালু করল। কথার শুরুতেই হরিদাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এই বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করছ? তাহলে শোনো, ১৯৮০ সালের শীতের রাত ছিল সেটা… তখন প্রিয়া দত্ত এখানে থাকত।” প্রিয়া দত্ত—নামটি উচ্চারণ করার সময় তাঁর কণ্ঠে এক ধরনের শ্রদ্ধা ও শোক মিলেমিশে ছিল। তিনি বললেন, “ও ছিল অসাধারণ গায়িকা, রেডিওতেও গান বাজত, আশপাশের লোকজন ওর গানের জন্য পাগল ছিল। সেদিন রাতে বাড়ির দ্বিতীয় তলার বড় জানালার সামনে বসে ও গান গাইছিল, জানালা খোলা ছিল, আর গলির মানুষ থেমে থেমে শুনছিল। হঠাৎ আমরা দেখলাম, ঘরের ভেতর গাঢ় লাল আলো জ্বলে উঠল… ঠিক যেন রক্তের রঙ। কারও বোঝার আগেই গান থেমে গেল।”

হরিদাস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন স্মৃতির গভীরে ডুবে যাচ্ছেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “পরদিন সকালে খবর এল—প্রিয়াকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকানো ছিল, জানালাগুলো বন্ধ। পুলিশ এল, পোস্টমর্টেম হল, আর কেস বন্ধ করে দিল ‘আত্মহত্যা’ বলে। কিন্তু আমি জানি, ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না।” রূপা তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেন বলছেন এটা আত্মহত্যা ছিল না?” হরিদাসের চোখে তখন এক অদ্ভুত কঠোরতা। “কারণ,” তিনি বললেন, “ওর গলায় ফাঁসের দাগ থাকলেও, চেয়ার বা কোনো আসবাবপত্র উল্টানো অবস্থায় পাওয়া যায়নি। ঘরের মধ্যে কোনো চেয়ারও ছিল না, যেটা দিয়ে ফাঁস লাগানো সম্ভব। আর একটা কথা—প্রিয়ার ডান হাতে তখনও মেহেন্দির নকশা ছিল, যেটা আগের দিন রাতেই আঁকা হয়েছিল। আমি বলি, যে মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, সে এরকম সাজগোজ করে গান গাইতে বসে না।” তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ স্পষ্ট ছিল, যেন তিনি আজও এই রহস্য মেনে নিতে পারছেন না। অর্ণব তৎক্ষণাৎ নোট নিচ্ছিল, প্রতিটি কথাই যেন রিপোর্টের জন্য অমূল্য তথ্য।

শেষে হরিদাস নিচু গলায় বললেন, “সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার জানো কী? সেই ঘটনার পর থেকে প্রতি শীতের রাত, যখন বাতাস ঠাণ্ডা আর নিস্তব্ধ হয়, ঠিক একই সময়ে সেই জানালায় লাল আলো জ্বলে ওঠে। আর ভেসে আসে গান—প্রিয়ার প্রিয় গান, যেটা সে সেই শেষ রাতে গেয়েছিল। আমি নিজে বহুবার শুনেছি… আর দেখেছি অনেককে পালিয়ে যেতে।” রূপা তখন স্থির হয়ে বসেছিল, যেন তাঁর শৈশবের স্মৃতি ও হরিদাসের গল্প মিলে যাচ্ছিল এক ভয়ঙ্কর বাস্তবে। অর্ণব একসময় রেকর্ডার বন্ধ করে বলল, “আপনি যদি চান, আমরা সত্যটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।” হরিদাস শুধু মাথা নাড়লেন, “যদি পারো, করো। তবে সাবধান—এই বাড়ি কারও মঙ্গল ডেকে আনে না।” কথাগুলো বলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, আর তাঁর হাঁটার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল—প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই রাত আজও তাঁর মনে এক জীবন্ত আতঙ্ক হয়ে বেঁচে আছে।

অধ্যায় ৫ —

সেই রাতে ঠান্ডা আরও তীব্র ছিল, আকাশে অর্ধচন্দ্র, আর গলির বাতাসে একধরনের নিস্তব্ধতা যা অর্ণবকে একইসাথে উচ্ছ্বসিত ও অস্বস্তিতে ফেলছিল। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে সে রূপার সাথে বাড়ির বিপরীতে দাঁড়ানো এক পুরনো চায়ের দোকানের বারান্দায় বসে সব সরঞ্জাম সাজিয়ে নিল—একটি হাই-রেজোলিউশন ক্যামেরা ট্রাইপডে স্থাপন করা, ভয়েস রেকর্ডার চালু, আর নোটবুক হাতে। রূপা অবশ্য একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল, কারণ সে এখনও এই বাড়ির রাতের দৃশ্যের সামনে আসতে ভয় পাচ্ছিল। অর্ণব বারবার ঘড়ি দেখছিল, মাঝে মাঝে ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে বাড়ির দ্বিতীয় তলার জানালাটিকে লক্ষ্য করছিল। হরিদাস দত্ত যেমন বলেছিল, জানালাটি আংশিক খোলা, আর ভেতরে কালো অন্ধকার। রাস্তার আলোও সেদিকে পৌঁছোয় না, ফলে সবকিছু যেন আরও অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। ঠিক মধ্যরাত ঘনিয়ে এলে, অর্ণব অনুভব করল গলির বাতাস হঠাৎ থেমে গেছে, যেন চারপাশে এক অদৃশ্য আবরণ নেমে এসেছে। দূরে কোনো কুকুরের ডাক নেই, কোনো মানুষের পায়ের শব্দ নেই, শুধু নিঃশ্বাসের মতো ক্ষীণ বাতাসের শব্দ।

বারোটা বাজতে না বাজতেই হঠাৎ অর্ণবের চোখ পড়ল—দ্বিতীয় তলার সেই জানালার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে এক গাঢ়, রক্তিম আলো। প্রথমে মনে হচ্ছিল হয়তো কারও হাতে ধরা কোনো লণ্ঠন বা লাল কাপড় ঢাকা টর্চের আলো, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই আলো ঘরের পুরোটা ভরিয়ে দিল, জানালার কাঠের ফাঁক দিয়ে বাইরে এসে গলির অন্ধকারের সঙ্গে এক অস্বাভাবিক কনট্রাস্ট তৈরি করল। আলো এতটাই গাঢ় যে মনে হচ্ছিল যেন কোনো তরল আগুন জানালার পেছনে জ্বলছে। অর্ণব তাড়াতাড়ি ক্যামেরায় শাটার টিপে ছবি তুলতে লাগল, আর রেকর্ডারের লাল বাতি জ্বলে উঠল, ইঙ্গিত দিচ্ছিল শব্দ ধরা পড়ছে। সেই সময় হঠাৎই রূপা ফিসফিস করে বলল, “শুনছো?” অর্ণব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল—হ্যাঁ, খুব ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল বাতাসের মৃদু গুঞ্জন, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই সুর স্পষ্ট হয়ে উঠল—এ এক নারীকণ্ঠ, দীর্ঘায়িত টান, যেন এক পুরনো রাগের মিশ্রণ। গানটি একেবারেই অপরিচিত নয়, হরিদাসের বর্ণনার সাথে মিল আছে। কণ্ঠে ছিল এক ধরনের হাহাকার, যা ঠান্ডা রাতের বাতাস চিরে এসে কানে লাগছিল।

অর্ণব হাতের রেকর্ডারের লেভেল চেক করল—শব্দ ধরা পড়ছে, কিন্তু খুব নিচু ভলিউমে। আশ্চর্যের বিষয়, আশেপাশে কোনো মানুষ নেই, এমনকি গলির বাড়িগুলির জানালাও বন্ধ। কেউ এই গানের উৎস জানে বা শুনছে—এমন কোনো চিহ্ন নেই। আলো যেমন হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল, প্রায় পাঁচ মিনিট পরে তেমনই ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে গানও থেমে গেল। মুহূর্তের মধ্যে গলিতে আগের মতো নীরবতা ফিরে এল, যেন কিছুই ঘটেনি। রূপা অর্ণবের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “এটাই সেই আলো… সেই গান…” তার চোখে ভয়ের সঙ্গে বিস্ময় মিশে ছিল। অর্ণব নোটবুকে লিখে রাখল—ঘটনা নিশ্চিতভাবে ঘটেছে, দৃশ্যমান প্রমাণ ক্যামেরায়, শব্দ প্রমাণ রেকর্ডারে। উৎস অজানা। মানবিক উপস্থিতি নেই। তবে মনের ভেতরে তার সাংবাদিক-সত্তা তখনও বলছিল—হয়তো কোনো প্রযুক্তিগত প্রভাব, হয়তো কোনো অজানা আলো-ছায়ার খেলা। তবুও, সেই লাল আলোর তীব্রতা এবং কণ্ঠের আবেগ তাকে অস্বস্তিতে ফেলল, যেন কেউ বা কিছু এই পর্যবেক্ষণকে ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য করছিল।

অধ্যায় ৬ —

পরের দিন সকালে রূপা নিজের ছোট্ট স্টাডি রুমে বসে পুরনো নথি আর সংবাদপত্রের কাটিং সাজাতে লাগল। অর্ণবের সঙ্গে রাতের পর্যবেক্ষণের পর থেকেই তার মন যেন অদ্ভুত এক টান অনুভব করছিল—যেন সত্যটা ক্রমশ কাছে চলে আসছে। কাঠের পুরনো আলমারির ভেতর থেকে সে বের করল কিছু বিবর্ণ ফাইল, যা তার বাবা একসময় শখ করে জমিয়ে রেখেছিলেন। সেখানে ধুলো-মাখা কিছু বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকের কাটিং পাওয়া গেল, তারিখ ডিসেম্বর ১৯৮০। খবরের শিরোনামগুলো যেন নিজেই চিৎকার করে উঠছিল—“খ্যাতনামা গায়িকা প্রিয়া দত্তের রহস্যমৃত্যু”, “আত্মহত্যা নাকি খুন?”। প্রতিবেদনে লেখা ছিল, প্রিয়ার ব্যক্তিগত জীবনে নানা টানাপোড়েন চলছিল—এক অচেনা পুরুষের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা, যা পরিবার ও সমাজের চোখে ‘গ্রহণযোগ্য’ ছিল না। কিছু প্রতিবেদনে ইঙ্গিত ছিল, এই সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর গুজব ছড়িয়েছিল, আর প্রিয়ার শেষ রেকর্ডকৃত গান ছিল বিশেষভাবে আবেগময়, যেন নিজের জীবনের গল্প বলছে। এক প্রতিবেদনে এমনকি উল্লেখ ছিল—শেষ রাতে জানালার কাছে বসে গান গাওয়ার সময় এক প্রতিবেশী নাকি দেখেছিল একজন পুরুষের ছায়া, কিন্তু পুলিশ এই সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়নি।

এই সময়েই রূপার দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলতেই দেখা গেল, এক মধ্যবয়স্ক মহিলা, গায়ে হালকা শাল, মুখে কৌতূহল আর কিছুটা দ্বিধা। তিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন—শর্মিষ্ঠা দে। রূপা নামটা শুনেই চমকে উঠল, কারণ হরিদাস দত্তের কাছ থেকে শুনেছিল শর্মিষ্ঠার নাম—তিনি এই গলিরই মানুষ ছিলেন, আর ছোটবেলায় প্রিয়ার শেষ রাতের কিছু দেখেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। রূপা তাকে বসতে বলল, আর এক কাপ চা দিল। শর্মিষ্ঠা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “সেদিন আমি ছিলাম মাত্র দশ বছরের মেয়ে। মা ঘুমোচ্ছিলেন, আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ দূরের বাড়িটার দ্বিতীয় তলার জানালায় লাল আলো জ্বলে উঠল। আমি থমকে গেলাম, কারণ আলো আসার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, জানালার ভেতর দিয়ে কারও ছায়া নড়ছে। কিন্তু সেটা প্রিয়াদির ছায়া নয়—সে সময় উনি বসে গান গাইছিলেন। ছায়াটা দাঁড়িয়ে ছিল তার পেছনে… লম্বা, পাতলা গড়ন, মাথায় টুপি, আর কেমন যেন অচেনা।” কথা বলতে বলতে শর্মিষ্ঠার চোখে আতঙ্ক ভেসে উঠল, যেন সেই দৃশ্য এখনও তার চোখের সামনে ভাসছে।

রূপা নোট নিচ্ছিল, আর মনে মনে অনুভব করছিল, এই নতুন তথ্য প্রিয়ার মৃত্যুর কেসে বড় মোড় আনতে পারে। শর্মিষ্ঠা বললেন, “আমি মা-কে ডাকতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরে এসে দেখি জানালায় আলো নেই, গানও থেমে গেছে। পরদিন সকালে খবর এল প্রিয়াদি নেই।” তিনি আরও যোগ করলেন, “পুলিশ তখন বলল এসব ‘শিশুর কল্পনা’, কিন্তু আমি জানি আমি কী দেখেছি।” রূপা বুঝতে পারছিল, হরিদাসের বর্ণনা, সংবাদপত্রের রিপোর্ট আর শর্মিষ্ঠার সাক্ষ্য—সব মিলে যেন একটা অদৃশ্য ফাঁদ তৈরি করছে, যা ক্রমশ তাদের টেনে নিচ্ছে প্রিয়ার মৃত্যুর রহস্যের গভীরে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সময়, রূপার হাতে তখন একগাদা প্রমাণ—সংবাদপত্রের কাটিং, ব্যক্তিগত সাক্ষ্য, আর অর্ণবের রেকর্ড করা লাল আলো ও সঙ্গীতের অডিও। কিন্তু সে জানত, এই সব প্রমাণ যতই জমুক, এই রহস্যের ভেতর ঢুকতে হলে আরও বড় ঝুঁকি নিতে হবে—কারণ যে অতীত একবার ফাঁস খুলে দিলে, হয়তো আর ফিরে আসা যায় না।

অধ্যায় ৭ —

সকালের রোদ তখনও গলির অন্ধকার ভেদ করে পুরোপুরি ঢোকেনি, তবুও অর্ণব, রূপা আর হরিদাস দত্ত হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দিনের বেলায় বাড়িটি কম ভয়ংকর দেখালেও, তার ভগ্নপ্রায় অবস্থা এবং নিস্তব্ধতা এখনও চাপা আতঙ্ক তৈরি করছিল। গেটের তালা হরিদাসের পুরনো চাবি দিয়ে খোলা হল—তার কাঁপা হাত আর চোখের কোণে জমে থাকা অভিজ্ঞতার ছায়া এই অভিযানের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ভেতরে ঢুকতেই ধুলো আর পুরনো কাঠের গন্ধে যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝে কেঁপে উঠছিল, আর ভাঙা কাঁচের টুকরো পায়ের নিচে খসখস শব্দ তুলছিল। বাড়ির নীরবতার মধ্যে মাঝে মাঝে ছাদের ফাঁক দিয়ে আসা আলো যেন অতীতের কিছু লুকানো দৃশ্যকে মুহূর্তের জন্য উন্মোচন করছিল। রূপা চোখ মেলে স্থাপত্যের খুঁটিনাটি দেখছিল—মোটা কাঠের দরজা, জটিল কারুকাজ করা জানালার কাঠামো, আর সিঁড়ির পাশে সিংহমূর্তি-খচিত রেলিং, যা একসময় গৌরবের প্রতীক ছিল। অর্ণব নোট নিচ্ছিল, মাঝে মাঝে ক্যামেরায় ছবি তুলছিল, আর হরিদাস ধীরে ধীরে তাদের গাইডের মতো পথ দেখাচ্ছিল, যেন সে বাড়িটির প্রতিটি কোণ চেনে।

তারা প্রথমে পৌঁছাল বড় ঘরটিতে, যেখানে একসময় প্রিয়া দত্ত অতিথিদের নিয়ে সঙ্গীত আসর বসাতেন বলে শোনা যায়। সেই ঘরে এখন ভাঙা ফার্নিচার—কিছু উল্টে থাকা চেয়ার, কাঠের আলমারির হিঞ্জ খুলে পড়া দরজা, আর এক কোণে একদম নষ্ট হয়ে যাওয়া কার্পেট। কিন্তু যা তাদের দৃষ্টি সবচেয়ে বেশি টানল, তা হল ঘরের এক পাশে রাখা একটি ভাঙা হারমোনিয়াম। ধুলো জমে আছে এতটাই যে, হাত দিলে আঙুলে এক পুরু স্তর লেগে যায়। রূপা কাছে গিয়ে সেটির চাবি চাপল—একটা ভাঙা, কর্কশ শব্দ বেরোল, যা মুহূর্তে সবার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিল। “এটাই প্রিয়াদির,” হরিদাস ফিসফিস করে বলল, “শেষ রাতে এই হারমোনিয়ামেই গান করছিলেন।” অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলল, তারপর চারপাশের দেয়ালে নজর দিল। পুরনো রঙ চটে পড়েছে, কাঠের প্যানেলে সাদা দাগ, আর কিছু জায়গায় অদ্ভুত কালচে আভা। কিন্তু আসল অস্বস্তির মুহূর্ত এল যখন তারা সিঁড়ির দিকে এগোল।

সিঁড়ির প্রথম কয়েক ধাপ অতিক্রম করতেই রূপার দৃষ্টি আটকে গেল সিঁড়ির পাশে দেয়ালে। সেখানে ছিল কিছু শুকনো লালচে দাগ—যেন কেউ রঙ ছিটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আকার আর ছোপের ধরন দেখে রূপার মনে হল, এটা কোনো শিল্পসৌন্দর্যের অংশ নয়। সে হাত বাড়িয়ে হালকা করে ছুঁয়ে দেখল, তারপর আঙুলে ঘষে নিল। চোখ বড় করে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা রঙ নয়… অনেক পুরনো রক্তের মতো দেখাচ্ছে।” অর্ণব কপাল কুঁচকাল, কারণ তার যুক্তিবাদী মনও মুহূর্তে অস্বস্তি অনুভব করল। হরিদাস চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ—সে যেন এই দাগগুলির ইতিহাস জানে, কিন্তু বলতে চাইছে না। উপরের তলায় যাওয়ার আগে সবার মনেই তখন এক অদ্ভুত ভার জমে উঠেছিল। তারা জানত, এই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ মানে শুধু ইট-কাঠের গঠন দেখা নয়—এটা অতীতের এক অন্ধকার, রক্তমাখা গল্পে পা রাখা, যার শেষ কী হবে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

অধ্যায় ৮ —

দিনের দীর্ঘ প্রস্তুতি, সরঞ্জাম গুছিয়ে নেওয়া, আর মানসিকভাবে নিজেকে শক্ত করে তোলার পর অবশেষে সেই রাত এল। অর্ণব, রূপা ও হরিদাস ঠিক করেছিল তারা আজ দ্বিতীয় তলায় রাত কাটাবে—যেখানে বছরের পর বছর ধরে কেউ সাহস করে ওঠেনি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির ভেতর একটা শীতল ভাব নেমে এল, যেন দেয়ালগুলোও বুঝতে পারছে কিছু অস্বাভাবিক ঘটতে চলেছে। অর্ণব ক্যামেরা, ট্রাইপড, ভয়েস রেকর্ডার, নাইট ভিশন ডিভাইস সব সাজিয়ে রাখল, আর রূপা জানালার কাছে একটা ছোট্ট টেবিলে নোটবুক খুলে বসল। হরিদাস এক কোণে চুপচাপ বসে পুরনো দিনের কথা ভাবছিল, মাঝে মাঝে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের গলির দিকে তাকাচ্ছিল। সময় যেন অদ্ভুত ধীরে চলছিল—ঘড়ির কাঁটা যত ১২টার দিকে এগোচ্ছিল, বাতাসও তত ভারী হয়ে উঠছিল। একসময় মনে হল যেন বাইরের সব শব্দ থেমে গেছে—না কুকুরের ডাকা, না গাড়ির হর্ন, না মানুষের চলাচল। নিস্তব্ধতার মধ্যে সবাই নিঃশ্বাস চেপে ঘড়ির কাঁটার শব্দ শুনছিল।

ঠিক রাত ১২টা ১০ মিনিটে হঠাৎ পুরো ঘর যেন লাল আলোর স্রোতে ভেসে গেল। আলোর উৎস কোথায়, কেউ বুঝতে পারছিল না—এমনকি বাইরে রাস্তা থেকেও কোনো রিফ্লেকশন আসার সম্ভাবনা ছিল না। সেই আলো একেবারে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো হারমোনিয়ামের ওপর পড়ছিল, আর মুহূর্তের মধ্যে শোনা গেল এক নারীকণ্ঠ—প্রিয়ার কণ্ঠস্বর, স্পষ্ট, মধুর কিন্তু তাতে গভীর বেদনার সুর। প্রথমে গানটা ছিল ধীরলয়ের, সুরে ছিল অদ্ভুত এক টান, যেন কাউকে ডাকছে, তারপর ক্রমশ করুণ হয়ে উঠল, গলায় জমল কান্না। রূপার হাতের নোটবুক কাঁপছিল, অর্ণব ক্যামেরা ফোকাস করার চেষ্টা করছিল কিন্তু লেন্সে কেবল এক অদ্ভুত ধোঁয়াটে আভা ধরা পড়ছিল। হরিদাসের ঠোঁট কাঁপছিল, সে যেন নিজেকে সামলাতে পারছিল না—চোখে জল এসে গিয়েছিল, যেন সে বহু পুরনো কোনো পরিচিত দৃশ্যের পুনর্জন্ম দেখছে।

গান যখন একদম তীব্র শোকে রূপ নিল, ঠিক তখনই সব রেকর্ডিং ডিভাইস একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। স্ক্রিনে লাল আলো ঝলসে উঠল, তারপর সব নিভে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ইচ্ছে করেই তাদের যোগাযোগ ছিন্ন করে দিল। অর্ণব ডিভাইস রিস্টার্ট করতে গিয়ে বুঝল ব্যাটারি একদম ফাঁকা—যা সম্ভব নয়, কারণ কিছুক্ষণ আগেই চার্জ দেওয়া হয়েছিল। এর মাঝেই দরজাটা হঠাৎ জোরে ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল, আর ভেতর থেকে লক হয়ে গেল। তারা একসঙ্গে দরজা ধাক্কাতে লাগল, কিন্তু কোনো ফল হল না—দরজা যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। লাল আলো তখনও পুরো ঘর ঢেকে রেখেছে, আর প্রিয়ার কণ্ঠস্বর যেন দেয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। সেই গানের তীব্রতা এমন ছিল, যেন প্রতিটি নোট তাদের বুকে ভারী পাথর চাপিয়ে দিচ্ছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বাইরে থেকে কোনো সাহায্য চাওয়ার উপায় ছিল না—এখন তারা সম্পূর্ণভাবে আটকে গেছে সেই অভিশপ্ত ঘরে, যেখানে অতীত আর বর্তমান এক ভয়ঙ্কর আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছে।

অধ্যায় ৯ —

দরজা অবশেষে খুলে যাওয়ার পর তিনজনই হাপাতে হাপাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। বাইরে এসে তারা গলির ঠাণ্ডা বাতাসে গভীরভাবে শ্বাস নিল, কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না—হরিদাসের চোখে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আর ভয়ের মিশ্রণ ছিল। রূপা ও অর্ণব লক্ষ্য করল, সে বারবার হাত মুঠো করে ধরে আছে, যেন নিজেকে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত করছে। অবশেষে, গলির নির্জন এক কোণে দাঁড়িয়ে হরিদাস গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাদের কিছু জানার আছে… যা এতদিন কাউকে বলিনি।” তার কণ্ঠস্বর থরথর করে কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিল একধরনের দৃঢ়তা। অর্ণব, যিনি এতদিন কেবল যুক্তি দিয়ে রহস্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন, এবার মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য চুপ করে দাঁড়ালেন। হরিদাস বলল, সেই ১৯৮০ সালের শীতের রাতে, যখন প্রিয়ার মৃত্যু হয়, তখন সে নিজে ওই বাড়িতে ছিল—কেবল সাক্ষী হিসেবেই নয়, বরং ঘটনার প্রত্যক্ষ অংশীদার হিসেবে।

তার কাহিনিতে বেরিয়ে এল এক শীতল সত্য—প্রিয়া দত্তের মৃত্যু কোনো আত্মহত্যা নয়, বরং পরিকল্পিত খুন। খুনি ছিলেন এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার নাম উচ্চারণ করতেও হরিদাস ইতস্তত করছিল। এই মানুষটির রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা এতটাই ছিল যে পুলিশ তাকে আড়াল করেছিল, এমনকি সংবাদপত্রেও খবর চাপা পড়ে যায়। হরিদাস বলল, “প্রিয়াকে শেষবার আমি দেখেছিলাম… তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ওই লোকটা। প্রিয়া তখন খুব ভয় পেয়েছিল, আর আমাকে কেবল একবার পেছন ফিরে দেখেছিল, যেন কিছু বলতে চাইছিল।” হরিদাস জানত, ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে প্রিয়ার প্রতি আকৃষ্ট ছিল, কিন্তু প্রিয়া তাকে ঘৃণা করত। সেই রাতে গানের অনুষ্ঠানের সময় আচমকাই লাল আলো জ্বলে ওঠে—যা তখন বাড়ির ভেতরের লোকদের কাছে ছিল এক সিগন্যাল, কিছু ঘটতে চলেছে। হরিদাস জানত, এটা কোনো রহস্যময় ভূতুড়ে ঘটনা নয়—এটা ছিল খুনির চিহ্ন, যাতে সহযোগীরা প্রস্তুত হয়।

গভীর নীরবতার মধ্যে হরিদাস তার শেষ কথাগুলো বলল, “আমি ভয় পেয়েছিলাম… তাই কিছু করিনি। পুলিশকে সত্যি বলার সাহস পাইনি। সেই রাতের পর থেকে প্রতিবার লাল আলো দেখলেই মনে হয়, প্রিয়ার আত্মা যেন আমায় জিজ্ঞেস করছে—‘তুমি কিছু বললে না কেন?’” তার গলায় কান্না জমে গিয়েছিল, আর চোখ ভরে উঠেছিল জল দিয়ে। রূপা ও অর্ণব বুঝতে পারল, এই রহস্যের কেন্দ্রে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি থাকুক বা না থাকুক, মানুষের লোভ, ক্ষমতা আর ভয়ই এই বাড়িকে অভিশপ্ত করে তুলেছে। অর্ণব মনে মনে স্থির করল, এখন সে এই সত্য প্রকাশ করবে—কারণ যদি খুনিকে বিচার না দেওয়া যায়, তবে অন্তত প্রিয়ার আত্মা যেন জানে, তার গল্প আর লুকিয়ে নেই। সেই মুহূর্তে তিনজনের ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল, আর দূরে বাড়ির জানালায় ক্ষণিকের জন্য এক ফোঁটা লাল আলো জ্বলে উঠল—যেন অতীতের কোনো অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতির সাক্ষী।

অধ্যায় ১০ —

পরদিন সকালের আলো ফোটার আগেই অর্ণব তার নোট, রেকর্ডিং, আর হরিদাসের স্বীকারোক্তি একত্রিত করে রিপোর্ট লেখা শুরু করল। সে জানত, এই লেখাটি শুধু একটি ভৌতিক রহস্যের কাহিনি নয়, বরং চার দশকের পুরনো এক খুনের সত্য প্রকাশের সাহসী পদক্ষেপ। লেখার প্রতিটি বাক্যে সে সেই রাতের ভয়, অন্ধকার, আর প্রিয়ার গানের করুণ সুরকে আঁকতে চেষ্টা করল। নাম প্রকাশ করল খুনির—এক সময়ের প্রভাবশালী, এখন বৃদ্ধ ও অসুস্থ, কিন্তু অপরাধের দায় যিনি কখনও স্বীকার করেননি। অর্ণব জানত, এর ফল ভয়ঙ্কর হতে পারে, তবুও মনে মনে অনুভব করল—এই গল্পটি পৃথিবীর সামনে আনা দরকার। দুপুরের মধ্যে রিপোর্ট অনলাইনে ছাপা হল, আর সামাজিক মাধ্যমে তীব্র আলোড়ন উঠল। বহু পুরনো গোপন আঘাত যেন হঠাৎ প্রকাশ্যে চলে এল, আর মানুষের মুখে আবার ভেসে উঠল প্রিয়া দত্তের নাম। তবুও অর্ণবের মনে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা রয়ে গেল—যেন কিছু শেষ হয়নি, বরং আরও কিছু ঘটতে বাকি আছে।

সেই রাতের শেষ প্রহরে, রিপোর্ট প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পর, অর্ণব, রূপা, আর হরিদাস আবার সেই বাড়ির সামনে দাঁড়াল। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, চাঁদের আলো আড়াল হয়ে ছিল, আর বাতাসে এক ধরণের চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। রাত ১২টা পেরিয়েই, ঠিক আগের মতো, দ্বিতীয় তলার জানালা লাল আলোয় ভেসে উঠল। কিন্তু এবার আলোটা আরও কোমল, যেন আগের মতো ভয়ঙ্কর নয়—বরং একধরনের বিষণ্ণ উজ্জ্বলতা। হঠাৎ ভেসে এল সেই চেনা সুর—প্রিয়ার কণ্ঠ, কিন্তু এবার গানে আর তীব্র কান্না নেই, বরং মুক্তির ছোঁয়া আছে। শব্দগুলো ধীরে ধীরে পরিষ্কার হল—“এবার আমি যাচ্ছি…”। গানের শেষ লাইনটি যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে লাল আলো ধীরে ধীরে নিভে গেল। পুরো বাড়ি আবার অন্ধকারে ডুবে গেল, আর আশেপাশের বাতাসও হালকা হয়ে উঠল, যেন বহুদিনের এক অদৃশ্য বোঝা অবশেষে সরল। রূপার চোখে জল এসে গেল—সে বুঝল, প্রিয়া হয়তো অবশেষে শান্তি পেয়েছে। হরিদাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, তার ঠোঁট নড়ছিল, হয়তো কোনো প্রার্থনা বলছিল।

কিন্তু সেই শান্তির মাঝেই অর্ণবের কাঁধে এক ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভূত হল। সে ঘুরে তাকাল—কেউ নেই। পরদিন সকালে ফুটেজ পরীক্ষা করতে গিয়ে সে দেখল, ক্যামেরার লেন্সে শেষ মুহূর্তে কিছু ধরা পড়েছে। জানালার ভেতর, লাল আলো নিভে যাওয়ার ঠিক আগে, এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে—সাদা শাড়ি, খোলা চুল, ঠোঁটে শান্ত হাসি। সেটি নিঃসন্দেহে প্রিয়া দত্ত। তার সেই হাসি যেন কৃতজ্ঞতায় ভরা, যেন বলছে—“এখন আমার গল্প শেষ।” কিন্তু অর্ণব যতবার ফুটেজটা দেখল, তার মনে হল সেই হাসিতে একটুখানি রহস্যও আছে—যেন প্রিয়া সম্পূর্ণ চলে যায়নি, কেবল অপেক্ষা করছে… হয়তো অন্য কোনো গল্পের জন্য। সেই রাতের পর থেকে আর কখনও জানালায় লাল আলো জ্বলেনি। কিন্তু গলির মানুষরা বলে, গভীর রাতে, বাতাসের দমকা হাওয়ায়, দূর থেকে কারও গুনগুন গানের সুর ভেসে আসে—যেন প্রিয়া দত্ত এখনও জানে, তার নাম আবার ভুলে যাওয়া যাবে না।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *