প্ৰদীপ্ত গুহ
১
অভিজিৎ ও মীরা যখন নিউটাউনের নতুন ফ্ল্যাটে প্রথম দিন পা রাখল, তখন তাদের চোখে ছিল একেবারে অন্যরকম আলো। দীর্ঘদিন ধরে যেই মুহূর্তের অপেক্ষায় তারা ছিল—নিজেদের একান্ত ঘর, নিজেদের সাজানো সংসার, অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তব হলো। ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দু’জনেই কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মীরা প্রথম হাসল, তার চোখে ছিল আনন্দ আর আবেগের মিশেল। লিভিং রুমে ঢুকেই বড় বড় জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া সকালের রোদ তাদের গায়ে পড়ল, যেন সেই আলোও তাদের নতুন সূচনার সাক্ষী হতে চাইছে। অভিজিৎ সবকিছু লক্ষ্য করে মনে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পেল, এতদিনের পরিশ্রমের পর অবশেষে সে নিজের স্ত্রীর হাত ধরে একটি ঘরে প্রবেশ করছে, যা শুধুই তাদের। মীরা ইতিমধ্যেই ঘরের সাজসজ্জা নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে—কোথায় কোন আসবাব থাকবে, কোন রঙের পর্দা ঝুলবে, কেমন কার্পেট বিছানো হবে—সবকিছু যেন তার কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা হয়ে আছে। নতুন ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে, প্রতিটি আসবাবে তার হাতছানি যেন স্পষ্টভাবে ধরা দিচ্ছে। তারা যখন প্রতিটি ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছিল, শোবার ঘর থেকে বারান্দা, রান্নাঘর থেকে স্টাডি কর্নার, তখন তাদের ভেতরে এক গভীর আনন্দ জমা হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি আর অবসাদ এই চার দেওয়ালের বাইরে ফেলে এসেছে।
কিন্তু যতই আনন্দ আর উত্তেজনা ভরে উঠছিল, ততই অদ্ভুতভাবে একটা চাপা নিস্তব্ধতা যেন প্রতিটি ঘরের ভেতরে লুকিয়ে ছিল। বাইরের নিউটাউনের ব্যস্ততা, গাড়ির শব্দ, মানুষের কোলাহল এখানে এসে যেন থেমে যায়, যেন এই ফ্ল্যাটের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠেছে যা বাইরের পৃথিবী থেকে সব শব্দ আটকে দেয়। প্রথমে মীরা ভেবেছিল এটা হয়তো ভালো, কারণ অন্তত এখানে শান্তি থাকবে। কিন্তু সেই শান্তি ধীরে ধীরে অস্বস্তির রূপ নিতে লাগল। তাদের পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনির মতো ফিরে আসছিল, আর ফ্ল্যাটের ভেতরে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল—যেন বহুদিন ধরে জানালা বন্ধ রাখা জায়গার গন্ধ, অথচ সব জানালা তো খোলা। রান্নাঘরে ঢুকে মীরা লক্ষ্য করল আলমারিগুলোর ভেতর অদ্ভুতভাবে আঁধার জমে আছে, যেটা দিনের আলোয়ও ভাঙতে পারছে না। অভিজিৎ এসব ব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দিল না, সে সবকিছুকেই নতুন ফ্ল্যাটের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ভেবে এড়িয়ে গেল। কিন্তু মীরার মনে কোথাও একটা কাঁটা বিঁধল, আনন্দের মাঝেও সে বুঝতে পারল, এই ঘরের ভেতরে এমন কিছু আছে যা পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়।
তবু, সেদিনের আবহাওয়া আর সাজানো ঘর তাদের মন থেকে সেই শঙ্কাকে সাময়িকভাবে মুছে দিল। বিকেলে তারা বারান্দায় বসে চা খেল, দূরে ছড়িয়ে থাকা আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর হালকা বাতাসে দুলতে থাকা গাছ দেখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে লাগল। মীরা বারবার বলছিল—“এই ঘরে আমাদের সবকিছু হবে, হাসি, কান্না, আনন্দ, ঝগড়া—সব। আমরা এই দেওয়ালের ভেতর আমাদের জীবন আঁকব।” অভিজিৎ মৃদু হাসল, তার মনে ভেসে উঠল মীরার প্রতি তার দায়বদ্ধতার কথা, তাকে রক্ষা করার, তাকে সুখে রাখার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তারা জানত না, যেই দেওয়ালের ভেতর তারা সুখের ছবি আঁকার স্বপ্ন দেখছে, সেই দেওয়ালের গা ঘেঁষেই লুকিয়ে আছে অচেনা এক চোখ, যা নিঃশব্দে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত লক্ষ্য করছে। আলো-আঁধারির মাঝে, নতুন আসবাবের গন্ধ আর চায়ের কাপে জমে থাকা ধোঁয়ার আড়ালে, সেই অদৃশ্য উপস্থিতি চুপচাপ থেকে যাচ্ছে, যেন সুযোগের অপেক্ষায়। আনন্দময় দিনের শেষে যখন ঘর নিস্তব্ধ হলো, তখন সেই চাপা নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে ফ্ল্যাট যেন নিজেই নিঃশ্বাস ফেলল—একটা দীর্ঘ, গভীর আর অস্বস্তিকর নিঃশ্বাস, যেটা অভিজিৎ ও মীরা কেউ শুনতে পেল না।
২
নতুন ফ্ল্যাটে কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর মীরা ঘর গোছগাছ করতে করতে হঠাৎ লক্ষ্য করল শোবার ঘরের দেওয়ালের এক কোণে ছোট্ট একটি ছিদ্র। প্রথমে মনে হলো হয়তো পেরেক লাগানোর চিহ্ন কিংবা নির্মাণকাজের ত্রুটি। সাদা রঙ করা দেওয়ালে ছিদ্রটা খুব একটা বড় নয়, কিন্তু কাছ থেকে তাকালে বোঝা যায় ভেতরটা অস্বাভাবিক গভীর। মীরা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ছিদ্রটার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হলো অন্ধকার গহ্বর থেকে হালকা একটা ঠান্ডা হাওয়া বেরিয়ে আসছে। সে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল, মৃদু ধুলো জমে আছে, কিন্তু তাও যেন পুরোপুরি পরিত্যক্ত নয়। প্রথম দিন সে বিষয়টা খুব একটা গুরুত্ব দিল না, নিজেকে বোঝাল এটা হয়তো সাধারণ ত্রুটি, যা রঙ করার সময় ঠিকমতো বন্ধ করা হয়নি। কিন্তু সেই রাতেই যখন ঘরে আলো নিভে গেল আর চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এল, তখন অদ্ভুতভাবে মনে হলো দেয়ালের ভেতর থেকে কেউ যেন তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করার পরও সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি মাথায় ঘুরছিল, যেন কোনো অচেনা দৃষ্টি তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। সে পাশ ফিরে ঘুমোতে চাইল, কিন্তু ছিদ্রটার অবস্থান মনে পড়তেই আবার শিউরে উঠল।
পরদিন সকালে মীরা অভিজিৎকে ছিদ্রটা দেখাল। অভিজিৎ প্রথমে হেসে উঠল, যেন এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। সে দেয়ালটা পরীক্ষা করে বলল, “দেখো, কন্সট্রাকশনে কত ভুল হয়। এগুলো সারাই করতে হয়। কিছুই হয়নি।” তার কণ্ঠে যুক্তির দৃঢ়তা থাকলেও মীরা বুঝতে পারছিল, এই যুক্তি তার ভেতরের অস্বস্তি দূর করতে পারছে না। মীরার চোখে ভয় আর সন্দেহের ছাপ স্পষ্ট। সে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না, আমি মনে করি এখানে কেউ তাকাচ্ছে। কাল রাতে মনে হচ্ছিল দেয়ালের ওধার থেকে চোখ আমাকে দেখছে।” অভিজিৎ মৃদু বিরক্তি নিয়ে হেসে উত্তর দিল, “তুমি অতিরিক্ত কল্পনা করছ। হয়তো আলো-আঁধারি বা ছায়ার কারণে এমন লেগেছে। আমরা নতুন জায়গায় উঠেছি, স্বাভাবিকভাবে একটু অস্বস্তি হবেই।” তারপর সে ছিদ্রটা আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে বলল, “ভেতরে কিছুই নেই, স্রেফ ফাঁকা।” কিন্তু মীরা তাকিয়ে রইল গভীর মনোযোগে, যেন তার ভেতরের অনুভূতি অন্য কিছু বলছে।
দিন যত এগোতে লাগল, ছিদ্রটা মীরার মনে ভয় তৈরি করতে লাগল। দিনের আলোয় ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হলেও রাত নামলেই ছিদ্রটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে মীরা চমকে উঠে দেখল ছিদ্রটার ভেতর থেকে হালকা আলো ঝলকানি বেরোচ্ছে, হয়তো বাইরের কোনো প্রতিফলন, কিন্তু তার কাছে মনে হলো যেন চোখের মণির ঝিলিক। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, সে উঠে বসে অভিজিৎকে জাগাতে চাইল, কিন্তু অভিজিৎ তখন গভীর ঘুমে। মীরা কাঁপতে কাঁপতে ছিদ্রটার কাছে গিয়ে কান পাতল, কিন্তু কোনো শব্দ পেল না। তবুও মনে হচ্ছিল এক অদৃশ্য উপস্থিতি তার দিকে তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে। সেই মুহূর্তে তার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল, ভয়ে সে এক ধাপ পিছিয়ে এল। শোবার ঘরের আলো জ্বালাতেই কিছুই দেখা গেল না, কেবল দেওয়ালের সাদা রঙের ভেতর কালো দাগের মতো একটি ছিদ্র। সকাল হলে সে আবার অভিজিৎকে বলল, কিন্তু অভিজিৎ বিষয়টাকে স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিল। তবুও মীরা জানত, ওটা কোনো সাধারণ ছিদ্র নয়—ওখানেই লুকিয়ে আছে এক অজানা দৃষ্টি, এক অদৃশ্য চোখ, যেটা তাদের নতুন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করছে।
৩
রাত গভীর, শহরের আলো দুর্দুরান্ত আকাশের নীচে ম্লান হয়ে গেছে। মীরা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ অনুভব করে। প্রথমে সে ভাবল হয়তো তার কল্পনা, হয়তো নিখুঁত নিস্তব্ধতার মাঝে ফ্ল্যাটের পাইপলাইনের মধ্যে থেকে আসা শব্দ। কিন্তু যতবার সে তার কান মুড়িয়ে দেয়, শব্দটি তত স্পষ্ট হয়। ফিসফিস, ক্রমশ একটি ছোঁয়াচে নিঃশ্বাসের মতো। সে বেডের পাশে বসে দেয়ালে হাত রেখেই শোনার চেষ্টা করে, যেন দেয়ালের ভেতর থেকে কোনো কথা তার দিকে আসে। অভিজিৎ ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে দেখে, মৃদু প্রশ্ন করে—“কী হয়েছে?” মীরা নীরব থাকে, শুধু মাথা নাড়ায়। অভিজিৎ হয়তো ভাবল এটি তার কল্পনা, বা হয়তো রাতে ফ্ল্যাটের প্রকৃতির সঙ্গেই খেলা করছে তার মন। কিন্তু মীরা নিশ্চিত, এটি কেবল ফ্ল্যাটের শব্দ নয়; কেউ আছে, এবং সে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, শ্বাসফুসফুসের প্রতিটি শব্দ যেন তার মন খোঁচা দিচ্ছে।
মীরা পুরো রাত জেগে থাকে। ঘরটি অন্ধকারে ডুবে আছে, কিন্তু দেয়ালের সেই কোণ যেন আরও ঘন অন্ধকার সৃষ্টি করছে। শব্দটি ক্রমশ ঘনিয়ে আসে, কখনও যেন ভেতরের কেউ বলছে—“আমি এখানে আছি।” মীরা চুপচাপ শুয়ে থাকে, হৃদয়ের স্পন্দন শোনা যাচ্ছে মনে। সে অভিজিতকে জাগাতে চায় না; জানে, হয়তো সে তাকে হাসাবে বা বিষয়টিকে হালকা ভাবে নেবে। সে নিজে প্রমাণ করতে চায় যে, এই ফিসফিস শব্দ বাস্তব। কখনও কখনও মনে হয়, শব্দটি শুধু শুনা নয়, বরং এটি একটি ধাঁধার মতো যা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেয়ালের ভেতরে, যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি তার মনকে পরীক্ষা করছে। ঘুম এবং জাগরণের মধ্যে মীরা যেন হারিয়ে যাচ্ছে, শব্দের খেলা তার মস্তিষ্ককে অচেনা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, রাতের এই নিস্তব্ধতা নয়, বরং শব্দের খেলা তাকে ভেতর থেকে চাপে ফেলছে, প্রতিটি ফিসফিস যেন একটি প্রশ্ন, একটি চ্যালেঞ্জ যা সে উত্তর দিতে বাধ্য।
সকাল হয়ে আসে, সূর্যের হালকা আলো ফ্ল্যাটে ঢোকে, কিন্তু মীরার মনে ভয় এখনও ম্লান হয়নি। অভিজিৎ সকালে নাস্তা সাজাচ্ছে, অজান্তে মীরার নিঃশ্বাসের দ্রুততা লক্ষ্য করছে। মীরা এখনো সেই ফিসফিসের শব্দের কথা মনে করছে, এবং তার মনে অদ্ভুত শঙ্কা দানা বাঁধছে। অভিজিৎ বলে, “তুমি হয়তো শুধু ঘুমে ভয় পেয়েছ।” কিন্তু মীরা জানে, এটি শুধু ঘুমের স্বপ্ন নয়। দেয়ালের সেই কোণ এখনও যেন একটি রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, এবং সে নিশ্চিত—শব্দের খেলা এখানেই শেষ নয়। তার দৃষ্টি দেয়ালের সেই দিকে স্থির, এবং মনে হয় যেন কেউ চোখে চোখ রাখছে। অভিজিৎ হয়তো বোঝেনি, কিন্তু মীরা জানে, ফ্ল্যাটের ভেতর একটি অদৃশ্য উপস্থিতি আছে, যা শুধু রাতে শোনা যায়, যা তার মনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং তার ভেতরের কিছু অংশকে চ্যালেঞ্জ করছে। শব্দের খেলা শুধুই শুরু, এবং মীরা প্রস্তুত হতে চায়, যদিও তার ভেতরের ভয় তাকে একাগ্রতার সঙ্গে প্রতিটি ফিসফিস শোনার সাহস দিচ্ছে।
৪
সকালে মীরা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বসে থাকে, মনে মিশ্র অনুভূতি—উদ্দীপনা, শঙ্কা, এবং অদ্ভুত কৌতূহল। গত রাতের ফিসফিস শব্দ এখনও তার কানে বাজছে, এবং এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এ বিষয়ে কারো সঙ্গে কথা বলবেই। অভিজিৎ তার পাশে বসে চা নিয়ে এসেছে, কিন্তু মীরার মন অন্যত্র। ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার সোমনাথ দত্তের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করতে চায়, ‘এই দেয়ালে ছোট ছোট ছিদ্রগুলো কী?’ সোমনাথ প্রথমে অস্বস্তি প্রকাশ করে, চোখ কিছুটা নীচু করে এবং হালকা করে গলা ফুঁকে বলে, “এগুলো শুধু পুরনো ফ্ল্যাটের গুণগত সমস্যা, কিছুই নয়।” মীরা মনে মনে বুঝতে পারে এটি সঠিক উত্তর নয়; তার অভিজ্ঞতা বলে, কোনো ফ্ল্যাটে এমন নিখুঁতভাবে ছিদ্র থাকা স্বাভাবিক নয়। সে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি ছোট অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করতে থাকে। সোমনাথের চোখে অদ্ভুত দ্বিধা, একরকম আড়াল করা সত্য, যা সে প্রকাশ করতে চাইছে না। মীরা বুঝতে পারে, কেয়ারটেকার হয়তো জানে, তবে জানার পরও কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মীরা তার ভেতরের শঙ্কা ও কৌতূহলকে একত্রিত করে আরও জিজ্ঞাসা করে। সে জানতে চায়, “আপনি কি কখনও রাতের অদ্ভুত শব্দ শুনেছেন?” সোমনাথের হাত অস্থির হয়ে ওঠে, সে চুপ করে থাকে, যেন একটি অদৃশ্য ভার তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। সে হালকা করে মাথা নাড়ে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। মীরা দেখল, কেয়ারটেকারের চোখে রহস্যের ছাপ আছে—যেন বহু বছর ধরে সে ফ্ল্যাটের অজানা কাহিনী লুকিয়ে রাখছে। সে বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ ফ্ল্যাট নয়; এখানে অতীতের ছায়া, অজানা উপস্থিতি বা একধরনের গোপন তথ্য লুকিয়ে থাকতে পারে। সোমনাথের প্রতিটি ছোট নড়াচড়া মীরার জন্য তথ্যের মতো। তার চোখের নীচে হালকা চাপ, মুখে অদ্ভুত আঁচ, এমনকি মুখের লাইনগুলোও যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। মীরা হঠাৎ উপলব্ধি করে, যে মানুষটা প্রতিদিন তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, সেই সোমনাথ জানে, এই ফ্ল্যাটে কিছু আছে যা সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে।
দিনের আলো ফ্ল্যাটে ঢোকে, কিন্তু সোমনাথের দৃষ্টি এখনও মীরার দিকে অদ্ভুতভাবে টিকিয়ে থাকে। মীরা সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে সে আরও কিছু খুঁজবে, আরও গভীরে প্রবেশ করবে। সে জানে, কেয়ারটেকারের অস্বস্তি, তার আড়াল করা সত্য, সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ফ্ল্যাটে এমন কিছু আছে যা সাধারণ মানুষের চোখে দেখানো যায় না। মীরা ভাবতে থাকে, হয়তো এই ফ্ল্যাটের দেওয়াল, তার ছিদ্র, এবং শব্দের খেলা—সবই এক দীর্ঘ রহস্যের অংশ। সে বুঝতে পারে, সোমনাথের চোখে লুকানো রহস্য, তার নীরবতা, সবই তাকে এক নতুন ধাঁধার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যা হয়তো একদিন সে সমাধান করতে পারবে। অভিজিত হয়তো এখনো কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু মীরা জানে, আজকের দিনটি শুধু রাতের ফিসফিসের উত্তেজনা নয়, এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা—যেখানে কেয়ারটেকারের চোখের আড়াল, তার অস্বস্তি, এবং ফ্ল্যাটের অদ্ভুত ছিদ্র মিলে এক গভীর গোপন রহস্যের সন্ধান দেবে।
৫
সকালের রোদ ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে ঢোকে, অভিজিৎ এবং মীরা রিয়েল এস্টেট এজেন্ট রাহুল ভট্টাচার্যের জন্য অপেক্ষা করছে। রাহুল সময়মতো আসে, সাদা শার্ট এবং নিখুঁত টাই পড়ে, হাসিমুখে অভিজিৎকে হাত মেলায়। প্রথম দৃষ্টিতে সে সম্পূর্ণ পেশাদার এবং ভদ্র মনে হয়। সে বলল, “ফ্ল্যাটে কোনো সমস্যা নেই, সব ঠিক আছে। পুরনো ফ্ল্যাট, তাই কিছু শব্দ শোনা স্বাভাবিক।” তার হাসি এবং মৃদু কণ্ঠের স্বর সবকিছু স্বাভাবিক মনে করানোর চেষ্টা করছে। অভিজিৎ এবং মীরা প্রথমে আশ্বস্ত মনে হলেও, কিছুতেই তারা পুরোপুরি শান্ত হতে পারল না। মীরার মন এখনো সেই রাতের ফিসফিস শব্দ এবং দেয়ালের ছোট ছিদ্র নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে খেয়াল করে, রাহুলের চোখে এক অদ্ভুত ঝলক আছে, হাসির আড়ালে এক কৃত্রিমতা লুকিয়ে আছে, যা সহজে নজরে আসে। অভিজিৎ হয়তো তা প্রথমে উপেক্ষা করতে চায়, কিন্তু মীরার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সবকিছু চোখে পড়ে।
রাহুল ফ্ল্যাটের প্রতিটি কক্ষ দেখাতে শুরু করে। সে খোলামেলা ভদ্রতায় সব কিছু দেখাচ্ছে, কিন্তু প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি কথা যেন পরীক্ষামূলক। সে জানায়, “এখানে কোনো সমস্যা নেই, পুরনো ফ্ল্যাটের শব্দ শুধু কাঠের ক্রিকিং, পাইপের শব্দ।” তবে তার কথার মধ্যে আছে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা—যেন সে জানে, মীরা কিছু খুঁজছে, এবং সে তার মনোযোগ অন্য দিকে সরাতে চাইছে। মীরা লক্ষ্য করে, রাহুল কখনও কখনও দেওয়ালের দিকে চোখ দেয়, যেন সে জানে কোনো দৃশ্য গোপন আছে। সে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কখনও রাতে অদ্ভুত কিছু শুনেছেন?” রাহুল হালকা করে হাসে, “না, ভদ্রতাজনক ফ্ল্যাট, সব স্বাভাবিক।” কিন্তু সেই হাসিতে আছে এক অদৃশ্য চাপ—এক প্রকার কৃত্রিমতা, যা বলছে, তার ভদ্রতা প্রকৃত বিষয় লুকিয়ে রাখছে। অভিজিৎ হয়তো আরও নিশ্চিত হয় যে, রাহুলের হাসি শুধু ভদ্রতা নয়, বরং এটি একটি ছদ্মবেশ, যা তাকে বোঝাচ্ছে যে, ফ্ল্যাটে যে রহস্য আছে, সে জানে কিন্তু প্রকাশ করতে চায় না।
দুজন শেষে লিভিং রুমে আসে, এবং রাহুল চেয়ার এড়িয়ে বসে। তার হাসি এখনও আছে, কিন্তু মীরার জন্য তা আর স্বাভাবিক মনে হয় না। সে বুঝতে পারে, রাহুলের ভদ্রতা একটি মুখোশ, এবং তার ভেতরে লুকিয়ে আছে কিছু অজানা—একটি তথ্য যা ফ্ল্যাটের ইতিহাস, শব্দ এবং ছিদ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। অভিজিৎ এখনো কিছুটা সন্দেহ করলেও, মীরা বোঝে যে ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি দেয়ালের ফাঁক, রাহুলের এই হাসি এবং তার কৃত্রিম ভদ্রতা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তারা জানে, আজকের এই সাক্ষাৎ শুধুমাত্র একটি সাধারণ এজেন্টের দেখাশোনা নয়, বরং এটি ফ্ল্যাটের গভীর, অদৃশ্য গোপন তথ্যের প্রথম ইঙ্গিত। রাহুল যতই স্বাভাবিক হাসি দেখাক, মীরার মন জানে, ভদ্রতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ধরণের সতর্কতা এবং গোপনজ্ঞানের প্রতিফলন, যা তাকে এক নতুন প্রশ্নের দিকে টেনে নেবে—এই ফ্ল্যাটের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছিদ্র এবং রাহুলের হাসি কি কোনো এক দীর্ঘ, অদৃশ্য খেলার অংশ?
৬
রাত নেমেছে, ফ্ল্যাটের কোণগুলো অন্ধকারে ঢাকা। অভিজিৎ নিজে একাকী দিয়ে দেয়ালগুলো পরীক্ষা করছে, মীরার চোখে এখনও ভয় ও কৌতূহলের মিশ্রণ আছে। হঠাৎ সে দেয়ালের একটি ফাঁক লক্ষ্য করে, হাত দিয়ে স্পর্শ করলে কিছু কঠিন কিছু টেকসই বস্তুর মতো লাগে। ধীরে ধীরে সেটি বের করে আনে—একটি ছোট, লুকানো ক্যামেরা। হৃদয়ের রক্ত দ্রুত স্পন্দিত হতে থাকে। সে বুঝতে পারে, এটি আর কোনো সাধারণ ফ্ল্যাট নয়। দেয়ালগুলো, ছোট ছোট ফাঁকগুলো, এবং ঘরের নিস্তব্ধতা—সবই শুধুই নজরদারির একটি অবকাঠামো। অভিজিৎ মীরাকে ডাকছে, তাদের চোখে এক ধরনের আতঙ্ক, কারণ এই ক্যামেরা শুধু ছবি তোলার জন্য নয়, এটি তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিশ্বাস, এমনকি রাতের অদ্ভুত ফিসফিস শব্দ পর্যন্ত মনিটর করছে। তারা বুঝতে পারে যে, ফ্ল্যাটের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য দৃষ্টি, যা সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে।
মীরা আতঙ্কে হয়তো প্রথমবার ভেবে পায় যে, তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন। সে অভিজিতকে বলল, “আমাদের এটা পুলিশকে দেখাতে হবে।” অভিজিৎ ফোন ধরল, ঠিক তখনই লাইন থেকে অদ্ভুত শব্দ আসে—একটি ফিসফিস, যেন কেউ তাদের কথার প্রতিটি শব্দ শুনছে। তার শরীর কাঁপতে থাকে, ফোনটি ঝুলিয়ে রাখা যায় না। তাদের চারপাশের অন্ধকার এখন আরও ভয়ানক মনে হয়। কেমন যেন এমন মনে হচ্ছে, যেন দেওয়ালের ভেতর থেকে কোনও অদৃশ্য চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অভিজিত চেষ্টা করে শান্ত থাকার, কিন্তু তার হৃদয় এখনও দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। মীরা হাত ধরা অভিজিতকে বলল, “আমরা একা নই, কেউ আমাদের দেখছে।” ফোনের শব্দ এবং দেয়ালের লুকানো ক্যামেরার ধারণা একসাথে তাদের মনের ভিতরে এক অদৃশ্য আতঙ্ক তৈরি করে।
রাত্রি গভীর হচ্ছে, কিন্তু দম্পতির মনের ভেতর ভয় ক্রমশ ঘন হচ্ছে। তারা বুঝতে পারে যে, ফ্ল্যাটটি কোনো সাধারণ আবাস নয়; এটি এক ধরণের গোপন নজরদারি কেন্দ্র, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি পদক্ষেপ এক অজানা মানুষের জন্য পর্যবেক্ষণযোগ্য। অভিজিত ও মীরা একে অপরের দিকে তাকায়, চোখে এক ধরনের সংকেত—এখন আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফোন লাইন থেকে যে ফিসফিস শব্দ আসে, তা তাদের মনে ভয় ও শঙ্কা তৈরি করছে, যেন কেউ তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে নজর রাখছে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, রাতে এখানে থাকা সম্ভব নয়, কিন্তু এর বাইরে বেরিয়ে আসলেও ভয় থাকবে—কারণ ফ্ল্যাটের দেয়ালগুলো, লুকানো ক্যামেরা এবং ফোন লাইনের অদ্ভুত শব্দ একে একে বোঝাচ্ছে যে, এটি শুধু বাসস্থান নয়; এটি একটি চতুর, পরিকল্পিত, এবং গোপন নজরদারির খেলা, যা তাদের প্রতিটি মুহূর্তকে পরীক্ষা করছে এবং এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করছে।
৭
রাতের নিস্তব্ধতায় মীরা ফ্ল্যাটের লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে আছে, সামনে দেয়ালের ভেতরে লুকানো ক্যামেরা। হৃদয় ব্যথা এবং উত্তেজনার মিশ্রণে দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। অভিজিৎ তার পাশে থাকে, কিন্তু সে জানে মীরার সিদ্ধান্ত অপরিবর্তনীয়—এবার সে চুপচাপ বসে থাকতে চাইছে না। মীরা তার চোখে দৃঢ়তা নিয়ে বলল, “যে তাকিয়ে আছিস, সামনে আয়।” তার কণ্ঠে কোনো ভয় নেই, বরং এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ, যেন সে এই অদৃশ্য দৃষ্টিকে মুখোমুখি হওয়ার সাহস জোগাচ্ছে। ঘরের অন্ধকার, দেয়ালের ফাঁক, এবং ক্যামেরার লুকানো লেন্স—সবকিছু যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু কোনো শব্দ আসে না, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শুধুই নীরবতা, যা ক্রমশ তাদের মনকে চাপ দিচ্ছে। অভিজিৎ তার হাত ধরে রাখে, যেন বলছে—“আমরা একসাথে আছি।” মীরা তার ভেতরের ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে, জানে যে, কেউ তাদের প্রতি নজর রাখছে, কিন্তু সে এবার পিছু হটতে চায় না।
পরের সকাল, সূর্যের হালকা আলো ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢোকে। অভিজিৎ এবং মীরা ঘুম ভাঙার পর লক্ষ্য করে যে, ফ্ল্যাটের দরজার নিচে একটি ছোট কাগজ রাখা আছে। কাগজটি ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হয়, এবং সেখানে লেখা আছে: “তোমরা এখন আমাদের চোখের ভেতরে।” মীরার হাত কাঁপতে শুরু করে, কিন্তু সে এখন আর ভয় পায় না, বরং তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আসে। এটি একটি প্রতিশ্রুতি, এক ধরনের চ্যালেঞ্জ, যে তারা এক অদৃশ্য শক্তির নজরদারিতে বন্দি। অভিজিৎ কাগজটি দেখার পর হতাশ বা শান্ত নয়, বরং সে বুঝতে পারে যে, ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছিদ্র, প্রতিটি লুকানো ক্যামেরা—সবই এক দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। তারা বুঝতে পারে, এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শব্দ, এমনকি প্রতিটি নিঃশ্বাসও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
ফ্ল্যাটের ভেতরে বাকি দিনের সময় ধরে তারা যেন এক ধরণের অদৃশ্য দৃষ্টি অনুভব করে। প্রতিটি ঘরের কোণ, জানালা, এবং দেয়ালের ফাঁক তাদের মনে চাপ তৈরি করে। মীরা এবং অভিজিৎ একে অপরের দিকে তাকায়, চোখে এক ধরনের সংকেত—এখন তারা জানে, এই গোপন নজরদারি শুধু রাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দিনেও চলমান। “তোমরা এখন আমাদের চোখের ভেতরে”—এই লেখা তাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, যেন এক অদৃশ্য কৌতূহল এবং এক অদৃশ্য ভয় তৈরি হচ্ছে একসাথে। তারা জানে, ফ্ল্যাটটি তাদের নিরাপদ আশ্রয় নয়, বরং এক ধরনের খেলায় তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যেখানে প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি নিঃশ্বাস পরীক্ষিত হচ্ছে। মীরা এখন আরও দৃঢ়, জানে যে যে কেউ বা যা কিছু তাদের নজর রাখছে, তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে—এবার শুধু নিজের জন্য নয়, বরং এক অদৃশ্য খেলায় অংশ নেওয়ার সাহস দেখানোর জন্য।
৮
রাত নেমে আসে, কিন্তু ফ্ল্যাটের বাতাসে অদ্ভুত চাপ বেড়ে যায়। অভিজিৎ এবং মীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসাই সবচেয়ে জরুরি। তারা লিফটের দিকে এগোতে চেষ্টা করে, কিন্তু লিফটের বোতাম চাপালেও কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না। বিদ্যুৎ চলে গেছে, ফ্ল্যাটের সব আলো নিভে গেছে, এবং অন্ধকার ক্রমশ তাদের চারপাশ ঢেকে নিচ্ছে। অভিজিৎ হাতের মোবাইল জ্বালাতে চায়, কিন্তু সিগনাল অদৃশ্যভাবে কেটে গেছে। মীরা তার হাত ধরে বলে, “আমরা একসাথে থাকব, কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ বা কিছু আমাদের এখানে আটকে রাখতে চাইছে।” তারা জানে, যে ফ্ল্যাটটি এতদিন তাদের জন্য নিরাপদ মনে হয়েছিল, এখন তা এক ভয়ঙ্কর জালে পরিণত হয়েছে। দেয়ালের ফাঁক, লুকানো ক্যামেরা, এবং আগের অদ্ভুত ঘটনার সব মিলিয়ে তারা বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ কমপ্লেক্স নয়; এখানে যেন অদৃশ্য শক্তির দ্বারা এক পরীক্ষা চলছে, যা তাদের মন ও শরীর দুটোকে একসাথে পরীক্ষা করছে।
চারপাশে অচেনা মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথমে মনে হয়, কেউ হঠাৎ এসে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু তাদের মুখে কোনো স্বাভাবিকতা নেই। তারা নিঃশব্দ, যেন শুধুই পর্যবেক্ষক। দম্পতি চেষ্টা করে তাদের পাশ দিয়ে বেরোতে, কিন্তু প্রতিটি কোণায় যেন অদৃশ্য বাধা। দরজা বন্ধ হয়ে যায়, লিফট কাজ করে না, এবং অন্ধকারে তারা একা হয়ে পড়েছে। অভিজিৎ এবং মীরা বুঝতে পারে, কমপ্লেক্সের প্রতিটি অংশ—দেয়াল, দরজা, জানালা—সবই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক খেলার অংশ। তারা একে অপরের দিকে তাকায়, চোখে আতঙ্ক, কিন্তু মন শক্ত। মনে হয় যেন তারা একটি ভয়ঙ্কর পরীক্ষাগারে প্রবেশ করেছে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শব্দ, এমনকি নিঃশ্বাসও নজরদারির আওতায়।
অন্ধকার ও ছায়ার মধ্যে তারা এক অপরিচিত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ফাঁক, প্রতিটি অদ্ভুত শব্দ তাদের ভেতর থেকে চাপ তৈরি করছে। মীরা অভিজিতকে ধরে বলে, “আমরা একসাথে থাকব, কিন্তু কি জানি আমরা কোথায় আছি।” অভিজিৎ মনে মনে বুঝতে পারে, এটি শুধু একটি ফ্ল্যাট নয়; এটি এক অদৃশ্য জালের মধ্যে তৈরি, যেখানে তাদের মনস্তাত্ত্বিক সীমা পরীক্ষা করা হচ্ছে। চারপাশের অচেনা লোকজন, লিফটের ব্যর্থতা, বিদ্যুতের অনুপস্থিতি—সবই তাদেরকে ভয় এবং অনিশ্চয়তার এক অদ্ভুত জগতে বন্দি করেছে। তারা বুঝতে পারে, যদি তারা সংযম, কৌশল এবং সাহস না দেখায়, তবে এই জাল থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি মুহূর্ত ক্রমশ তাদের মনকে শক্তিশালী করতে থাকে, এবং এই ভয়ঙ্কর পরীক্ষাগার তাদের এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে, যেখানে অদৃশ্য শক্তি তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে নজর রাখছে, এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তকে পরীক্ষা করছে।
৯
ফ্ল্যাটের ভেতর এক অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করার পর অভিজিৎ এবং মীরা খুঁজে পায় লুকানো একটি রেকর্ডিং রুম। ঘরটি ছোট হলেও প্রতিটি কোণে বসানো ক্যামেরা, মাইক্রোফোন এবং মনিটর যন্ত্র তাদের চোখে ভয় তৈরি করে। অভিজিৎ বুঝতে পারে, শুধু ফ্ল্যাটের দেওয়াল বা ফিসফিস শব্দ নয়—এখানেই হচ্ছে পুরো নজরদারি চক্রের মূল কেন্দ্র। তার হাতে থাকা ল্যাপটপে একাধিক ফোল্ডারে ব্যক্তিগত ভিডিও ফুটেজ সাজানো। ধীরে ধীরে এক ফোল্ডার খুলতে খুলতে দেখা যায়, সেখানে তাদের মতো বহু দম্পতির গোপন মুহূর্ত সংরক্ষিত এবং হয়তো বেচা হচ্ছে। অভিজিৎ ও মীরার বুক ধড়ফড় করছে, কারণ তারা এখন বুঝতে পারে, ফ্ল্যাটটি শুধুই আবাসন নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর ব্যবসার কেন্দ্র, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন বাজারে বিক্রি করা হয়।
এই আবিষ্কারের পর সোমনাথ দত্তকে মুখোমুখি করা হয়। প্রথমে সে চুপচাপ থাকে, চোখে ভয় ও দ্বিধা প্রকাশ পায়। মীরা তাকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন সত্য বের করে আনতে চাপ দিচ্ছে। সোমনাথ প্রথমে অস্বীকার করতে চায়, কিন্তু অভিজিত ও মীরার নির্দিষ্ট প্রমাণ দেখে সে চুপ থাকে না। শেষ পর্যন্ত সে স্বীকার করে, “হ্যাঁ, আমি জানতাম। রাহুল সব দেখাশোনা করত। আমি ভয় পেতাম, তাই কিছু বলতে পারিনি।” সোমনাথের কণ্ঠে ভয়, লজ্জা, এবং হালকা প্রশান্তি মিশে আছে—কারণ অবশেষে সত্য সামনে এসেছে। এই মুহূর্তে মীরা বুঝতে পারে, রাহুলের ভদ্র হাসি ও কৃত্রিমতা শুধুই একটি মুখোশ, যা চক্রের ভেতরের অন্ধকারকে ঢাকতে ব্যবহার করা হতো।
অভিজিৎ মীরা দুজন একসাথে সেই রেকর্ডিং রুমের প্রতিটি যন্ত্র পরীক্ষা করে, প্রতিটি ফুটেজ নিশ্চিত করে। তারা বুঝতে পারে, ফ্ল্যাটের ভেতরের অদৃশ্য নজরদারি কেবল তাদের নয়, বরং বহু দম্পতির জীবনের গোপন অংশ সংগ্রহ ও বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য চালানো হচ্ছে। সোমনাথের স্বীকারোক্তি এবং রাহুলের মুখোশ—সবই একটি ভয়ঙ্কর চক্রের অংশ। মীরা অভিজিতকে বলে, “এখন আমরা শুধু বেঁচে নেই, আমরা সত্যের মুখোমুখি।” তাদের চোখে দৃঢ়তা, মনে নতুন সাহস—যা এই ভয়ঙ্কর এবং অদৃশ্য জালের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য প্রয়োজন। তারা জানে, রাহুলের খেলায় ধরা পড়া সহজ নয়, কিন্তু সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে প্রস্তুত।
১০
ফ্ল্যাটের অন্ধকার কক্ষে দম্পতি দ্রুত তাদের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। অভিজিৎ এবং মীরা হাত ধরে একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এগোতে থাকে, মনে চাপা আতঙ্ক আর হঠাৎ লেগে থাকা উত্তেজনা মিশে। লিফট ও সিঁড়ির প্রতিটি কোণ তারা তল্লাশি করে, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাদের ধীরেসুস্থে পরীক্ষা করছে। হঠাৎ বোঝা যায়, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি শব্দ আগেই রেকর্ড হয়ে গেছে। ফ্ল্যাটের লুকানো ক্যামেরা, দেয়ালের ফাঁক, এবং সোমনাথ দত্তের স্বীকারোক্তি সবকিছু মিলিয়ে এই ভয়ঙ্কর চক্রের ধাঁধা আরও স্পষ্ট হয়। তারা এখন বুঝতে পারে, শুধু পালানো যথেষ্ট নয়; প্রতিটি পদক্ষেপের তথ্য ইতিমধ্যেই চক্রের হাতে চলে গেছে। ফোনে পুলিশে খবর দিলে কোনো প্রভাব নেই—কেননা আসল “চোখের মালিক” কখনো ধরা পড়ে না। অভিজিৎ মীরাকে চুপ করে ধরে রাখে, যেন বলছে—“আমরা একসাথে আছি, তবে আমরা এখন আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।”
পালানোর চেষ্টার মাঝেও মনস্তাত্ত্বিক চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তারা জানে, যতটা শারীরিকভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে, ততটাই এই নজরদারি তাদের মানসিকভাবে ঘিরে রাখছে। ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে তারা রাস্তায় আসে, মনে হয় মুক্তি এসেছে, কিন্তু বাস্তবতা আরেক ধাপ সামনে নিয়ে আসে। হোটেল রুমে পৌঁছে, তারা কিছুটা আরাম অনুভব করার চেষ্টা করে। কিন্তু মীরার চোখের কোণ থেকে একটি ছোট ছিদ্র খুঁজে বের হয়—দেয়ালের ভিতরে, ঠিক আগের ফ্ল্যাটের মতোই। হৃদয়ের রক্ত দ্রুত স্পন্দিত হতে থাকে। তারা বুঝতে পারে, নজরদারি শেষ হয়নি; এমনকি নতুন জায়গাতেও তারা অদৃশ্য দৃষ্টির আওতায়। মীরা অভিজিতকে চুপচাপ ধরে রাখে, চোখে এক ধরনের উদ্বেগ, কিন্তু একই সঙ্গে এক নতুন শক্তি ও দৃঢ়তা।
শেষ দৃশ্যে মীরা এবং অভিজিত একসাথে বসে থাকে, চারপাশের অন্ধকার ও হালকা আলো তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বাস্তবতা তৈরি করে। দেয়ালের ছিদ্র যেন এক সতর্কবার্তা, যে নজরদারি শেষ নয়, এটি কেবল নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। তারা বোঝে, সারাজীবন হয়তো কেউ বা কিছু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করবে। তবে এই ভয় এবং অবিশ্বাসের মাঝেও তাদের মধ্যে এক নতুন দৃঢ়তা আসে—যে তারা সচেতন, যে তারা সত্য জানে, এবং যে কোনো অদৃশ্য চোখের বিরুদ্ধে একে অপরকে সমর্থন করবে। ফ্ল্যাট বা হোটেল—প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ছিদ্র, প্রতিটি অদৃশ্য দৃষ্টি তাদের জীবনকে এক নতুন বাস্তবতায় বন্দি করেছে। কিন্তু তারা জানে, তারা একসাথে থাকলেই এই অদৃশ্য জালের মধ্যে নিজেদের মানসিক শক্তি খুঁজে পাবে, এবং শেষ পর্যন্ত, চোখের মালিককে মোকাবিলা করার সাহস অর্জন করবে।
___




