প্রজ্ঞা সেনগুপ্ত
এক
সূর্য তখন পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতিতে, আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে কমলা রঙের ছায়া। গ্রামের শেষপ্রান্তের কাঁচা রাস্তাগুলো ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসছে। গরু-বাছুর ফিরেছে খুঁটির কাছে, ধোঁয়া উঠেছে রান্নার চুলায়। এমন সময় একটা ছায়ামূর্তি—কোনওমতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, কাপড় ছেঁড়া, হাঁটা কাঁপা কাঁপা। তার মুখটা ঢাকা, কিন্তু চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ স্পষ্ট। কেউ জানে না কোথা থেকে এল, বা কী ঘটেছে। অনেকে জানতেও চায় না। গ্রামের মধ্যে কানাঘুষো শুরু হল, “ওই তো সরকারবাড়ির পেছনের পথ দিয়ে আসছে! ওই তো রাধার কনিকা… বাঁচাও বাবা, আবার নাম জড়াবে গ্রামের।” কেউ জল এগিয়ে দিল না, কেউ তাকে জিজ্ঞেসও করল না কিছু। একটা মেয়ে, রক্তাক্ত শরীর নিয়ে, শুধু এগিয়ে চলল একদৃষ্টিতে—যেন কেউ ডাকছে, যেন কোথাও যেতে হবে… এখনই। হঠাৎ কেউ চুপিচুপি বলল, “ও… ওদিকে যদি যায়, তবে তো সোজা মন্দিরের দিকে যাচ্ছে।” এক বৃদ্ধা তখন মাথা নাড়লেন, “এই মন্দিরে দেবী থাকেন। তাঁর কাছে যায় না কেউ এখন… শুধু শোনা যায়, তিনি নারীদের ডাকে সাড়া দেন। কিন্তু সে ডাক যদি বুক ফাটিয়ে আসে, তবেই…”
কনিকা তখন সেই প্রাচীন, প্রায় পরিত্যক্ত মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, শরীর কাঁপছে, কিন্তু চোখদুটো যেন আগুনে জ্বলছে। এই মন্দিরটা গ্রামে আছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে, পাথরের ছোট মন্দির, ভেতরে অন্ধকারে একটা দেবীর রূপ—কিন্তু মুখ নেই, কোনও চিহ্ন নেই। শুধু মাথার উপর লাল সিঁদুর লেপা মুকুটের মতো আকৃতি, আর সামনে চিরকাল জ্বলতে থাকা একটা প্রদীপ, যেটা নাকি কোনওদিন নিভে না। জয়ন্তী পিসি, বৃদ্ধা সেবায়েত, সেই মন্দিরে থাকেন একা। আজ সন্ধ্যায় তিনি দেখলেন, সেই রক্তাক্ত মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল দেবীর সামনে। কনিকা কিছু বলল না, শুধু মাটিতে বসে কপাল ঠেকাল ঠাকুরের থামের গায়ে। তারপর ধীরে ধীরে গলা দিয়ে একটাই কথা বেরোল—“দেবী মা… ওরা আমার সব কিছু নষ্ট করে দিল… তুমি কি শুনছো?” জয়ন্তী পিসি ভেতর থেকে কাঁপা গলায় বললেন, “মা শুনবেন… কিন্তু যখন ডাকবে বুক ফাটিয়ে। ভয় পাস না মা… দেবী চোখে দেখেন না, তিনি মনে শোনেন। তুই ডেকেছিস, মা তোদের ডাক শোনেন।” হঠাৎ যেন বাতাস ভারী হয়ে এলো, মন্দিরের ভেতর আলোটা একবার কেঁপে উঠল, আর কনিকা যেন ঝিমিয়ে পড়ে গেল পাথরের মেঝেতে। তখনই প্রথমবার… একটা ঝড়ের শব্দ শুনতে পেল পিসি—যেটা কেবল মন্দিরের চূড়ায় ধাক্কা মারল, বাইরে কিছুই নড়ল না।
রাত বাড়ল। মন্দিরের ভেতরে নিঃস্তব্ধতা। কিন্তু সেই নীরবতার ভিতরেও যেন কিছু চলছে—প্রাচীন কোনও নাড়া, দীর্ঘকাল ঘুমিয়ে থাকা কোনও শক্তির ক্রমাগত সাড়া। কনিকা তখন স্বপ্নে দেখছে এক নারীকে—সে আগুনের মতো, সাদা পাথরের শরীরে জ্বলে উঠছে সিঁদুরের মতো রক্তরেখা, তাঁর চোখে আগুন, কণ্ঠে বজ্রনিনাদ—“তুই ডেকেছিস। আমি এসেছি।” সেই স্বপ্নে ঘুম ভেঙে কনিকা উঠে বসে, ঘামে ভেজা গায়ে দেখে, মন্দিরের সামনে রাখা প্রদীপটা আগুনের শিখার মতো জ্বলছে, যেন কোনও দেবশক্তি তার ভেতরেই প্রবেশ করেছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, গ্রামে কিছু দূরে, সরকারবাড়ির ভেতর গজেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে চেঁচিয়ে ওঠে। তার শরীরে লাল আঁচড়ের দাগ, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পায়, তার মুখে যেন কেউ ঘুষি মেরেছে—কিন্তু সে তো কারও মুখও দেখেনি! কে যেন তার ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল, সাদা কাপড় পরা, চোখে আগুন। গজেন জানে না, মন্দিরের প্রদীপ থেকে এখনই এক নতুন প্রতিশোধের আলো ছড়িয়ে পড়ছে—শুধু সবার অজান্তে, কেবল সেই মেয়েটার কান্নার ডাকে সাড়া দিয়ে। আর সেই ডাকে সাড়া দিচ্ছেন এক দেবী—যিনি কেবল নারীর ডাকেই জেগে ওঠেন।
দুই
কনিকা মন্দিরের পাথরের মেঝেতে শুয়ে আছে। রাত অনেকখানি গড়িয়ে গেছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা—শুধু কুয়াশা ঢেকে রেখেছে পাহাড়ের গায়ে লাগানো গ্রামটিকে। দূরের কুকুর ডেকে ওঠে মাঝে মাঝে, আর মন্দিরের ঘরে বাতাস ঢুকে কাঁপিয়ে দেয় আগুনের শিখা। প্রদীপটা জ্বলছে, কিন্তু শিখাটা স্থির নয়—চঞ্চল, যেন কিছু কথা বলার চেষ্টা করছে। জয়ন্তী পিসি নিজের কাঠের দরজার পাশের চৌকিতে বসে আছেন, চোখের সামনে ছড়ানো কয়েকটা পুরনো সুতোর মালা আর একটা লাল কাপড়, যেটা তিনি বছরে একবার মাত্র দেবীর মাথায় বাঁধেন। তিনি কনিকাকে দেখছেন স্থির চোখে। বৃদ্ধার চোখে বিস্ময় নেই, শুধু গভীর উপলব্ধির ছাপ—যেন এই মেয়েটার আগমনের কথা তিনি আগেই জানতেন। ধীরে ধীরে উঠে এসে একটা পাতলা কম্বল কনিকার গায়ে বিছিয়ে দেন। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন, “তুই এখন নিজের মাটিতে এসে পড়েছিস মা। ভয় পাস না। তোর কান্না কেউ শোনেনি, কিন্তু তিনি শুনেছেন। সব শুনেছেন।” বাতাসের শব্দ যেন জবাব দেয় সেই কথার—একটা হালকা ঘূর্ণি এসে ছুঁয়ে যায় কনিকাকে। তার নিঃশ্বাস তখন ধীরে ধীরে ভারী হচ্ছে, যেন ঘুম নয়—একটা অন্তর্গত শক্তির ছোঁয়ায় সে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে।
মন্দিরটা বড় নয়, কিন্তু তার চারদিকে ছড়ানো প্রাচীনতা যেন কোনও যুগলিপির গল্প বলে। কালি পড়া পাথরের গায়ে আজও লেখা আছে কিছু নাম, কিছু দিন-তারিখ, যেগুলো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও পাথর তা ভুলে যায়নি। এই মন্দির নিয়ে এক সময় গ্রামে বহু কাহিনি চালু ছিল। ছোটবেলায় কনিকা শুনেছিল—দেবী এক সময় এক বিধবা রমণীর আর্তনাদ শুনে জেগে উঠেছিলেন, আর গ্রামের এক দুর্বৃত্তকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই কেউ সাহস করে মন্দিরে আসত না—বিশেষ করে পুরুষরা। দেবীর প্রতিমা নেই, মুখ নেই, হাত নেই—শুধু একটা গড়নের মতো রূপ, লাল চুন্দির ঢাকায় ঘেরা, চোখের জায়গায় দুটি সাদা পাথর বসানো—যার দিকে তাকালে মনে হয়, কেউ যেন তোমাকে দেখে ফেলছে ভেতর অবধি। জয়ন্তী পিসি বলেন, “দেবী নিজের মতো করেই আছেন এখানে। তিনি কথা বলেন না, কিন্তু সব বোঝেন। তিনি সেই শক্তি, যিনি কেবল নারীর অন্তরের জ্বালায় জেগে ওঠেন।” কনিকা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। তার শরীরে এখনো ব্যথা, কিন্তু মনটা অদ্ভুতভাবে স্থির। সে উঠে বসে, চারপাশ দেখে—তার চোখে কোনও ভয় নেই, কেবল একরাশ শূন্যতা আর ক্ষোভ। পিসি তাকে জলের গ্লাস এগিয়ে দেন, তারপর চুপ করে বসে থাকেন তার পাশে। ভোরের আলো আসতে শুরু করেছে, আর সেই আলোয় দেবীর সাদা চোখদুটি যেন আরও জ্বলজ্বল করে উঠছে—যেন তারা কনিকাকে দেখে বলছে, “এখনও কিছু শুরু হয়নি…”
সেই দিনটা গ্রামের অন্য দিনের মতোই শুরু হয়, কিন্তু বাতাসে এক অদ্ভুত ভার অনুভব করে অনেকেই। সরকারবাড়িতে গজেন অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে শোনা যায়—ঘুম থেকে উঠে চিৎকার করেছে, তারপর গলায় দাগ, চোখে রক্ত, আর গলা ভাঙা আওয়াজে বলে গেছে, “একটা সাদা কাপড় পরা মেয়েমানুষ আমার ঘরে ঢুকেছিল…” কেউ প্রথমে বিশ্বাস করে না, কিন্তু গজেনের মা চমকে যায়—তার বউমা আগেই বলেছিল, রাতে ঘরে কেউ ঘোরাফেরা করছে, অথচ দরজা বন্ধ। ওদিকে কনিকা মন্দিরের সামনে বসে, ধ্যানমগ্ন। জয়ন্তী পিসি এবার তার হাতে তুলে দেন এক লাল চুড়ি, বলেন, “এটা আমাদের মাতৃশক্তির প্রতীক। তুই একে শুধু অলংকার ভেবে নিস না। এই চুড়ি শুধু হাতে নয়—মনের ভেতর পরতে হয়।” কনিকা সেই চুড়ি পরার সময় বলে, “আমি চাই না কেউ ভয় পেয়ে পালিয়ে যাক। আমি চাই তারা জানুক কেমন লাগে যখন একটা মেয়েকে ভাঙা হয়…” পিসি শান্তভাবে বলেন, “তুই চাইলে—তুই ডাকলেই, দেবী আসবেন। তিনি এখনও ঘুমিয়ে নেই, কেবল অপেক্ষা করছেন…” সূর্য ওঠার সময়, মন্দিরের ছায়া গ্রামজুড়ে এক অদৃশ্য চক্রের মতো বিস্তার পেতে থাকে—কারণ দেবী এখন আর শুধুই পাথরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তিনি একজন মেয়ের চোখে, একজন বৃদ্ধার বিশ্বাসে, আর এক ন্যায়হীন সমাজের প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হচ্ছেন। আর সেই রূপ যে কতটা ভয়ংকর, তা এখন কেবল সময়ই বলে দেবে।
তিন
গজেন সরকারের কথা ভাবলেই গ্রামের মানুষের মনে ভেসে ওঠে এক পচে যাওয়া অহঙ্কারের গন্ধ। জমিদারবাড়ির রক্ত বইছে তার শরীরে, আর সেই রক্ত যেন ক্ষমতার সাথে মিশে গিয়ে জন্ম দিয়েছে এক ধর্ষক, এক অত্যাচারী, যার ভয় নেই—লজ্জা নেই। শৈশবেই তার হাতে ছিল বন্দুক, যৌবনে শরাব আর মেয়েদের গায়ের গন্ধ। গজেন জানত, গ্রামে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলবে না। পঞ্চায়েত তার পকেটে, থানা তার কাকার বন্ধু, আর মেয়েরা—মেয়েরা তো কেবল শরীর। এর আগে সে আরও তিনটি মেয়ের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছে। একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল, একটি চলে গিয়েছিল অন্য গ্রামে, আর একটি এখনো পাগলের মতো হেসে বেড়ায়। কনিকা ছিল চতুর্থ। কিন্তু এই কিশোরী মেয়েটার চোখে একটা ব্যাপার ছিল—যেটা গজেনকে অস্বস্তিতে ফেলত। সে ভয় পেত না, সে চুপ থাকত, কিন্তু তাকিয়ে থাকত সোজা চোখে। সেই দৃষ্টি তাকে ক্রমশ উত্তপ্ত করে তুলেছিল—একদিন রাতে, তার গেটম্যানের সঙ্গে মদ্যপান করে, সে সিদ্ধান্ত নেয়: “আজ রাতে তাকে শিখিয়ে দিতে হবে—এই চোখ, এই চুপ করে থাকা—সব ভেঙে ফেলতে হবে।”
ঘটনাটা ঘটেছিল বৃষ্টির রাতে। চারপাশে কেবল কাদা, গজেনের গাড়ি কনিকার বাড়ির পেছনের রাস্তায় থেমেছিল। সে জানত, কনিকার বাবা শহরে, মা অসুস্থ শুয়ে আছে ঘরে। বৃষ্টি আর মদের ঝোঁকে সে জানলা পেরিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরে। কোনও চিৎকার হয়নি, কোনও গলা ফাটেনি—শুধু একটা চাপা কান্না, যেটা ঘরের বাইরে এসে পৌঁছায়নি। গজেনের শরীর থেকে এখনও ঝরে পড়ছিল শরাবের গন্ধ, চোখে ছিল উন্মাদ হাসি। “এটা আমার অধিকার,” সে বলেছিল, “আমার পছন্দ তোকে, তাই তোকে পাবো, বুঝলি?” যখন সে ঘর থেকে বেরোয়, তখন কনিকার শরীর নিথর—কিন্তু চোখে সেই একই দৃষ্টি, সোজা তাকানো। সেই দৃষ্টিই গজেনের মনকে প্রথমবার কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সে ভাবে—“কী ছিল ওই চোখে? ভয় না ঘৃণা?” কিন্তু এতদিন যাদের উপর সে অত্যাচার করেছে, কেউ তো কিছু করেনি। কনিকা করবে? হাস্যকর। গজেন আবার তার জীবনে মগ্ন হয়ে পড়ে—খেলাধুলা, মেয়েমানুষ, আর ক্ষমতার মোহ। তার ধারণা ছিল, এই ঘটনাটাও সময়ের স্রোতে মুছে যাবে। কিন্তু সেই রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে দেখতে পায় একটা ছায়ামূর্তি তার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে—ভিজে চুল, পেছনে বৃষ্টির শব্দ, আর চোখে আগুন। তারপর সে জেগে উঠে দেখল, তার মুখে আচমকা আঁচড়, বিছানার চাদরে রক্তের ছোপ। ভেবেছিল দুঃস্বপ্ন, কিন্তু পরের রাতে সেটা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল।
তৃতীয় রাত। গজেন শুয়ে ছিল মশারির ভিতর। জানালা বন্ধ, দরজা লাগানো, পাহারাদার বাইরে বসে। রাত তিনটের সময় আবার একটা শব্দে তার ঘুম ভাঙে—দরজায় কে যেন খুব ধীরে ধীরে আঁচড় কেটে যাচ্ছে, যেন নখ দিয়ে। উঠে বসে, শোনে, বাতাস থেমে গেছে, কিন্তু দরজার বাইরে হাঁটুর ওপর ছায়া পড়ছে—কে যেন দাঁড়িয়ে। সে চিৎকার করে পাহারাদারকে ডাকতে চায়, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ। দরজাটা অদ্ভুতভাবে খুলে যায় নিজে থেকেই। ভিতরে আসে এক নারী—তার মুখ নেই, কিন্তু শরীর জ্বলছে আগুনে, চোখের জায়গায় লাল লাল আলোর মতো জ্বলে ওঠে। গজেন বিছানা থেকে পালাতে গিয়ে পড়ে যায়। নারীর সেই অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলে, “ভুলে গেছিস আমি কে? তোর রাতের আনন্দ ছিলাম? আজ আমি তোর বিচার।” সে আর কিছু দেখতে পায় না, শুধু বুকে প্রচণ্ড চাপ, যেন কেউ গলা টিপে ধরেছে। সকালে গজেনের মা দৌড়ে গিয়ে দেখে, ছেলে মেঝেতে পড়ে আছে, চোখ রক্তবর্ণ, কণ্ঠ সাদা হয়ে গেছে। ডাক্তার ডাকে—বলে হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু গ্রামের কয়েকজন বয়স্কা নারী বলে ওঠে—“এ তো দেবীর কাজ। এমন মৃত্যু তো আর দেহের নয়—এ তো আত্মার জ্বালা।” গ্রামের আকাশ ভারী হয়ে ওঠে, আর দূরে বসে থাকা এক কিশোরী মেয়ের চোখে একটা নির্মম, নিঃশব্দ হাসি ফুটে ওঠে—সে জানে, এ তো কেবল শুরু। দেবী এখনও জেগে আছেন, এবং রক্তের প্রতিটি ফোঁটায়, আঘাতের প্রতিটি স্মৃতিতে তিনি ন্যায় ফেরাবেন—তাঁর নিজের পথে, তাঁর নিজের রূপে।
চার
রাত যত গভীর হয়, মন্দিরে বাতাস তত ভারী হয়ে ওঠে। কনিকা বসে আছে দেবীর সামনে, চোখ বন্ধ, ঠোঁটে স্তব্ধতা। পাথরের সেই অবয়বের চোখে আজ যেন অন্যরকম দীপ্তি, যেন তারা কনিকাকে পর্যবেক্ষণ করছে, ভিতর অবধি, রক্তের ঘা থেকে আত্মার ফাটল পর্যন্ত। মাটিতে বসে থাকা মেয়েটা আর আগের মতো নিঃসহায় নয়—তার ভেতর কিছু একটা বদলে গেছে, না-দেখা এক আগুন ধীরে ধীরে গুঞ্জরন করে উঠছে বুকের গভীরে। জয়ন্তী পিসি তাকে দেখে—চোখে মায়া, কিন্তু কণ্ঠে গভীরতা। “তুই এখন আর কেবল মেয়ে না মা,” তিনি বলেন, “তুই এখন এক শরীর যার ভিতর দেবী শ্বাস নিচ্ছেন।” কনিকা কথা বলে না, শুধু মাথা ঝাঁকায়। তার স্বপ্নে গতকাল রাতে আবার এসেছিলেন সেই নারী—আগুনের মতো দীপ্তিময় শরীর, চোখে সিঁদুর রঙের তেজ, হাত থেকে আলো বেরোচ্ছে যেন। সেই নারীর কণ্ঠে ছিল বজ্রের কম্পন, “তোরা কেউ চাইলি না, আমি আসি। কিন্তু যখন একজন মেয়ে বুক ফাটিয়ে ডাকে, আমি থেমে থাকতে পারি না।” এই স্বপ্ন আর স্বপ্ন নয়, কনিকা বুঝতে পারছে—এ এক পরম সত্য, যেটা এখন তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং তার ভেতর থেকেই মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। দেবী তাকে আর আশীর্বাদ দিচ্ছেন না—তিনি কনিকাকে বেছে নিয়েছেন বাহক হিসেবে।
তবে কেবল স্বপ্নে নয়, বাস্তবেও এই দেবী-উপস্থিতি ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। গ্রামের মেয়েরা এই কয়দিনে মন্দিরমুখো হতে শুরু করেছে। কারও মুখে স্পষ্ট কিছু নেই, কিন্তু চোখে রয়েছে এক চাপা আকাঙ্ক্ষা, এক নিঃশব্দ বিশ্বাস। তারা বুঝতে পারছে, কোনও এক গোপন আলো ছড়িয়ে পড়ছে এই প্রাচীন পাথরের গা বেয়ে। বৃদ্ধা রাধা, যিনি অনেক বছর আগে তার স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছিলেন, এক রাতে এসে বসে থাকেন মন্দিরের সামনে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোর চোখে আমি আমার ফেলে আসা সময় দেখছি… আমি তো ডাকতে পারিনি, তুই ডাকলি।” অন্যদিকে, গজেন সরকার আগের মতো নেই। দিনের পর দিন দুঃস্বপ্নে পীড়িত সে এখন দিনের আলোতেও ভয় পায়। তার ঘরে জ্বলে ওঠে বাতি, একা থাকলে দরজা খোলে আপনাআপনি। এক রাতে সে দেখে, দেয়ালের আয়নায় তার পিছনে এক মুখ—ভিজে চুল, চোখে রক্তিম আভা, আর ঠোঁটে জ্বলে ওঠা আগুনের রেখা। সে পাগলের মতো চেঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু কেউ তাকে বিশ্বাস করে না। গ্রামের লোকজন এখন তাকে নিয়ে ফিসফিস করে—“তার ওপর আসছে দেবীর দৃষ্টি। বাঁচার সময় ফুরিয়ে গেছে।” গজেন নিজের কাকাকে বলে, “পুলিশে খবর দাও। ওই মেয়ে… ওই মেয়ে কিছু করছে।” কিন্তু পুলিশ কি পারবে এক অলৌকিক বিচারকে থামাতে?
এই সময়েই গ্রামের থানার অফিসার বিকাশ দত্ত প্রথম মন্দিরে আসেন। সাধারণত সে বিশ্বাস করে না এইসব অলৌকিকতায়। কিন্তু ঘটনাগুলো তার চোখের সামনে ঘটছে—প্রমাণ নেই, কিন্তু উপস্থিতি আছে। মন্দিরে এসে সে দেখে, কনিকা দেবীর পাশে বসে আছে, চোখ বন্ধ, নিঃশব্দে। জয়ন্তী পিসি তাকে দেখে বলেন, “তোমার মতো লোকেরা যা বোঝে না, তা অস্বীকার করে। কিন্তু মাটি বোঝে, বাতাস জানে, আগুন চেনে।” বিকাশ কিছু না বলে আশপাশটা লক্ষ্য করে। তার কাঁধে কাঁটা দেয়, হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে আসে, যেন অদৃশ্য কোনো সত্তা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সেই রাতে সে ঘরে ফিরে গিয়ে কেবল একটা জিনিস দেখতে থাকে বারবার—কনিকাকে ঘিরে থাকা সেই অদ্ভুত আলো, যেটা মোমবাতির আলো নয়, সূর্যের নয়, কিন্তু খুব চেনা… যেন কোনও আদিম নারীর শক্তি, যেটা কেবলমাত্র অবজ্ঞা, আঘাত ও অপমান থেকে জন্ম নেয়। পরদিন সকালে, গ্রামের এক উঠোনে হঠাৎই মেলে এক মৃতদেহ—গজেনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী কেশব। শরীরের উপর বিদ্যুৎপিষ্ট হওয়ার মতো দাগ, চোখদুটো জ্বলন্ত অবস্থায় খোলা। আর তার হাতের তালুতে লেখা—“সে আমার ছিল না, তুই ছিলি সাক্ষী।” বিকাশ মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। কনিকা দূর থেকে দেখে, আর তার ঠোঁটে ধীরে ধীরে এক নির্মম, কঠিন হাসি ফুটে ওঠে। কারণ স্বপ্ন শেষ হয়নি, দেবী এখনও তার চোখ দিয়ে দেখছেন, আর প্রতিশোধ কেবল শুরু।
পাঁচ
গ্রামটা যেন এক অন্য রূপে ঢলে গেছে—পুরনো সুনামিত শান্তির বদলে এখন ভয়ের স্রোত বইছে চারিদিকে। গজেন সরকারের অদ্ভুত অসুস্থতা আর তার ঘরের রহস্যময় ঘটনা নিয়ে কেবল গুজব ছড়ানোই নয়, এখন গ্রামের অনেকেই কনিকার মন্দিরমুখী হওয়া দেখেই বুঝতে পারছে যে কিছু একটা বড়, ভয়ংকর কিছু ঘটে যাচ্ছে। সকাল বিকেল মন্দিরের সামনে জমায়েত বাড়ছে—মেয়েরা, বৃদ্ধা-বৃদ্ধরা, এমনকি কিছু পুরুষও টলটলে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে মন্দিরের দিকে, যেন দেখছে এক অদৃশ্য শক্তিকে। জয়ন্তী পিসি মাঝে মাঝে পাড়ার নারীদের সাথে কথা বলেন, সবাই কনিকার সাহসের প্রশংসা করে, কিন্তু ভয়ে মুখ ভার। কেউ কেউ বলছে, “দেবী মায়ের রাগ নেমেছে, আর কেউ কেউ বলে, ‘যাদের গরু মারা গেছে, তাদের ভাগ্যটাই বুঝি বদলে যাচ্ছে।’” গ্রামের ছোট্ট দোকানে এক মেয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, “যদি আমি ডাকি, কি দেবী আসবে? আমারও তো একটা বিচার দরকার।” এই বাষ্পাত্মক বাতাসে গ্রামের মেয়েরা জেগে উঠছে, তাদের কণ্ঠে ছন্দ নেই, কিন্তু সংকল্প জোরালো। কিন্তু গজেনের চুপচাপ থাকা গ্রামের পুরুষরা ভয় পাচ্ছে—নিজেদের ওপরেও যেন একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে।
গজেনের অসুস্থতা দিন দিন জোরালো হচ্ছে। রাতের দুঃস্বপ্নগুলো তাকে বারবার ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসে। সে দেখতে পায় এক অদ্ভুত নারী তার পাশে বসে আছে—সাদা পোশাকে, লম্বা কালো চুল, আগুনের মত চোখ। সেই নারী মাঝে মাঝে কথা বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে—তার চোখে অগাধ ক্রোধ আর মনের গভীরে এক দাহক তেজ। গজেন নিজেও জানে, এটা স্বপ্ন নয়। এক রাতে সে তার ঘরের জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখল, গ্রামের মেয়েরা এক অদ্ভুত শৃঙ্খলা নিয়ে মন্দিরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে, তাদের মুখে অশ্রু আর এক অজানা সংকল্প। ভয়ে তার শরীরে কাঁপন ধরে, কিন্তু ক্ষমতা তার গলায় বাঁধা। সে পুলিশে অভিযোগ করতে চায়, কিন্তু ওখানেও তার ভয়—কারণ পুলিশ কর্মকর্তাদের চোখেও তখন সন্দেহ ও ভয়ের মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে। বিকাশ দত্ত, যিনি আগে অলৌকিকতার বিষয়গুলো নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, এখন বদলে গেছেন। সে মন্দিরের কাছাকাছি থেকে পাওয়া এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করছে—একটি শক্তি যা কেবল কনিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং পুরো গ্রামের ওপর একটা বদল আনছে।
গ্রামের মানুষরা মনে করতে শুরু করে যে এই শক্তি ‘দেবী’ একেবারে নতুন নয়, বরং কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। কেউ বলছে, “দেবী মানে শুধু পুরনো কাহিনি নয়, তিনি যেন এই গ্রামটার আত্মা।” আর কনিকার বদলাও চোখে পড়ার মতো—সে আর গৃহবন্দী মেয়েটি নয়। তার কথা বলার ভঙ্গি পরিবর্তিত, চোখের জ্বালায় একটা অদ্ভুত তেজ কাজ করছে। একদিন সন্ধ্যায় মন্দিরের সামনে সে দাঁড়িয়ে গ্রামের মেয়েদের সামনে বলে উঠল, “তোমাদের সবাইকে জেগে উঠতে হবে। আমরা চুপ করে থাকতে পারি না। আমরা লড়াই করব, আমরা ন্যায় চাইব।” মেয়েদের চোখে তখন জল, কিন্তু সেই জল নয়—তার পরিবর্তে ছিল এক অনন্য সাহস আর বিশ্বাসের স্রোত। জয়ন্তী পিসি তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে নীরবে কনিকার হাতে হাত রাখলেন। সে দিন থেকে, গ্রামের ভেতর একটা নতুন আলো জ্বলতে শুরু করল—দেবীর সেই শক্তি যেন ঘুম থেকে উঠে গ্রামটাকে নতুন করে গড়ে তুলছে, একটা শক্তি যা পুরুষশাসিত সমাজের ভয়ে থমকে যাওয়া নারীদের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করছে। আর এই শক্তির নাম ছিল কেবল একটাই—‘দেবী’।
ছয়
গ্রামের প্রত্যেকটি ছিটেফোঁটাও এখন কনিকার নাম শুনেই বদলে যাচ্ছে। সে আর সেই অদৃশ্য মেয়েটি নয়, যাকে সবাই অবলীলায় উপেক্ষা করত। কনিকা নিজেই যেন বদলে গিয়েছে—তার চোখের দীপ্তি শক্তির আলো হয়ে উঠেছে, আর ভেতরের সেই নির্জন ক্ষোভের আগুন ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। সকালে যখন গ্রামের মন্দিরের উঠোনে দাঁড়ায়, তখন তার ভেতর থেকে একধরনের নতুন শব্দ ফোটে, যা একেবারে অন্যরকম। সে কথা বলল—কিন্তু এবার তার গলার স্বর নেই কোনো ভয়, নেই কোনো কম্পন, বরং যেন দেবীর সুর, যেটা শুনে গ্রামের মেয়েরা মুখ খুলে ওঠে। জয়ন্তী পিসি বুঝতে পারলেন, এই কনিকা এখন আর নিরীহ মেয়ে নয়, তিনি সেই শক্তি, যাকে কেউ থামাতে পারবে না। তিনি নিজেও জানেন, কনিকার রূপান্তর একেবারে শূন্য থেকে শুরু হয়নি; বরং বহু দিনের চুপচাপ আর বিষাদের জলের নিচে লুকিয়ে থাকা এক বিষ্ফোরণ।
একদিন বিকালে, কনিকা মন্দিরের পাথরের মেঝেতে বসে ছিল। বাতাস হালকা বইছিল, কিন্তু যেন মন্দিরের চারপাশে একটা অবিশ্বাস্য শক্তি ঘুরপাক খাচ্ছিল। কনিকা তার হাত মুখে নিয়ে কাঁদছিল, কিন্তু সেই কান্নায় কোনো দুর্বলতা ছিল না—তাতে ছিল একরাশ অগ্নি, একরাশ প্রতিশোধের দীপ্তি। জয়ন্তী পিসি এসে বসে তার পাশে, বললেন, “তোর আর্তনাদ শুনছে হাজার বছর আগের সেই নারীর আত্মা। তার রাগ, তার ব্যথা, তার শক্তি—সবই এখন তোর রক্তে।” কনিকা চোখ মুছে দিয়ে বলল, “আমি চাই না কেউ আর আমাকে ভয় দেখাক, কেউ আর আমার মত মেয়েদের ভাঙুক।” তখন পিসি তার হাতে তুলে দিলেন এক লাল চুড়ি—“এই শুধু অলংকার নয়, এই তোর অস্ত্র। যখন তুই চাইলেই, এই চুড়ি দিয়ে তুই তোর যুদ্ধে নামতে পারবি।” কনিকা যখন সে চুড়ি হাতে নিল, মনে হলো কাঁটা লাগানো একটি শিকল কেটে গেল তার হৃদয় থেকে। সে এবার পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী, নিজের শক্তির ধারক।
গ্রামে হঠাৎ একটি পরিবর্তন এসে পৌঁছলো। মেয়েরা কনিকার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করল, তাদের চোখে এক নতুন আগুন জ্বলছে। তারা বুঝতে পারছে, তাদের মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে ছিল, সেটা একবার জেগে উঠলেই কেউ তাকে থামাতে পারবে না। কনিকা তাদের বলে, “এখন আমাদের আওয়াজ ম্লান নয়। এখন আমাদের পায়ের তলে জাগুক এই পৃথিবী।” সেই সন্ধ্যায় মন্দিরের মেঝেতে একত্রিত হয় গ্রামের মেয়েরা, তাদের হাতের তালুতে লাল চুড়ি, মুখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। জয়ন্তী পিসি দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে বলে ওঠেন, “দেখো, এখন তুই আর কেবল কনিকা নও, তুই নতুন যুগের দেবী—শক্তির, ন্যায়ের, প্রতিরোধের। আর আমি জানি, আজ থেকে তোর সঙ্গে সবাই জেগে উঠবে।” মন্দিরের প্রাচীন পাথর যেন কাঁপতে শুরু করল, বাতাসে নতুন এক ধ্বনি গুঞ্জরিত হলো—‘দেবীর আগমন’। কনিকার রূপান্তর হল এক নারীর যাত্রা, যার মধ্যে লুকানো শক্তি ক্রমশ বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছে, যে শক্তি শুধু তাকে নয়, পুরো গ্রামটাকেই বদলে দিচ্ছে। আর সেই শক্তি থেকে শুরু হলো এক নতুন প্রতিশোধের পথচলা—দেবী কনিকা হয়ে উঠছে অপরাজেয়।
সাত
গ্রামের মানুষ এক অদ্ভুত নীরবতায় মন্দিরের চারপাশে জমায়েত হচ্ছিল—মেয়েরা, বৃদ্ধা-বৃদ্ধরা, এমনকি কিছু পুরুষও যেন রহস্যময় সেই শক্তির সম্মান জানাতে ছুটে এসেছে। মন্দিরের পাথরের মেঝেতে বসে থাকা কনিকার চোখে তখন এক আলাদা দীপ্তি—এক শক্তি যা আর কেউ অবজ্ঞা করতে পারবে না। সেই রাতে, মন্দিরের অন্ধকার ঘরে প্রথমবারের মতো এক অদ্ভুত শব্দ ওঠে—কিছুটা শব্দ নয়, বরং এক ধরনের স্পন্দন, যা মন্দিরের চারপাশের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। জয়ন্তী পিসি সেই স্পন্দন শুনে মাথা নেড়ে বলেন, “এখনো তো শুরু মাত্র, মা… আজ থেকে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠবে।” গ্রামের বাইরে, গভীর অন্ধকারে, গজেন সরকারের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু অচেনা হাতে ধর্ষণের অভিযোগে নিখোঁজ হয়ে পড়ে। তাঁর মৃতদেহ মেলে পুড়ে যাওয়া অবস্থায়, মন্দির থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। দেহের ওপর রয়েছে অদ্ভুতভাবে পোড়া চিহ্ন, যেন আগুন নয়, বরং কেউ অতিপ্রাকৃত শক্তি দিয়ে বারবার আঘাত হেনেছে। গ্রামের পুরনো বুড়োরা বলে ওঠে—“দেখেছ? দেবী বলেছে, আর কেউ অবিচার করবে না।” পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে, কিন্তু কোনো যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ তারা পায় না। গ্রামে তখন অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, কেউ কথা বলতে ভয় পায়, কেউ অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস পায় না।
কনিকার মধ্যে তখন এক অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন এসেছে। সে নীরব থেকে এক নির্বিকার, শক্তিশালী প্রতিরোধক। এক রাতে সে শহরের এক গলির মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখানে গজেন সরকারের লোকেরা এক অসহায় মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। কনিকার চোখে তখন আগুন জ্বলে ওঠে, সে এক এক করে ছিটকে দেয় তাদের সবাইকে। মেয়েটির হাত ধরে সে বলে, “তোমরা ভয় পেও না। এই শহরেও দেবী জেগে উঠেছে।” কনিকার শক্তি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, গ্রামের সীমার বাইরে দুঃশাসনকারীরা আতঙ্কিত হতে শুরু করে। পুলিশ ও প্রশাসন জোর চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারে না, কারণ তার শক্তির পেছনে ছিল গ্রামবাসীর বিশ্বাস ও সহানুভূতি। এই বিশ্বাস থেকেই কনিকা রূপান্তরিত হয়েছিল ‘দেবী’ তে—একজন যোদ্ধা, যিনি অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিশোধ নেবেন।
সেই রাতে, মন্দিরের সামনে বিজড়িত মোমবাতির আলোয় কনিকা দাঁড়িয়ে থাকে, আর জয়ন্তী পিসি কাছে এসে ফিসফিস করে বলেন, “তুই এই যাত্রায় একা না, মা। আমরা সবাই আছি। তোর সঙ্গে সেই সমস্ত নারীরা আছেন, যারা তোর মতো চুপ করতেছিল, কিন্তু এখন জেগে উঠেছে।” কনিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত কঠোরতা ফুটে ওঠে। সে জানে, প্রতিশোধের এই পথ সহজ নয়, কিন্তু এটাই তার এবং গ্রামের মেয়েদের মুক্তির একমাত্র পথ। আগুনের মতো চোখে, সে নতুন করে ন্যায়ের অঙ্গীকার করে—এই শহর, এই গ্রাম আর কখনো অন্যায় ও বঞ্চনার কাছে মাথা নত করবে না। এই ছিল প্রতিশোধের প্রথম আগুন, যা অম্লান হয়ে থাকবে সারাজীবন।
আট
মন্দিরের চারপাশে রাতের অন্ধকার যেন আরও ঘনিয়ে এলো। কনিকা মাটির ওপর বসে ছিল, তার চোখে গভীর এক চিন্তা আর আগুনের মতো তেজ। এক রাত সে হঠাৎ অনুভব করল যে, তার চারপাশে অদ্ভুত একটি ছায়া ঘোরাঘুরি করছে — অশরীরী, নিঃশব্দ, অবিচল। এই ছায়াটি যেন দেবীর অন্য রূপ, যা দিনের আলোয় দেখা যায় না, কিন্তু রাতে এসে তার প্রতি প্রহরী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই ছায়ার উপস্থিতি কনিকার মনের ভেতর এক নতুন শঙ্কার আগুন জ্বালিয়ে দিল, কারণ সে বুঝতে পারল, যে প্রতিশোধের যাত্রায় শুধু শক্তিই নয়, অন্য কিছু রহস্যময় শক্তিও তার সঙ্গে লেগে গেছে। জয়ন্তী পিসি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “এই ছায়া দেবীর রূপ, কিন্তু সে সব সময় সাহায্য করে না। কখনো কখনো সে পরীক্ষাও দেয়, যেন তুই নিজের শক্তিকে আরও কঠোর করে বুঝতে পারিস।”
একদিন রাতে, কনিকা যখন মন্দিরের প্রাচীরে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই অশরীরী ছায়াটি তার সামনে আসল। সে ঘুরে দাঁড়াল, কিন্তু দেখতে পেলো কোনো মানুষের আকৃতি নেই—শুধু একটা কুয়াশার মত ধোঁয়ার ছায়া, যা কনিকার চোখের সামনে ভাসছে। ছায়াটি যেন বলল, “তুই শক্তিশালী, তোর সাহস অদ্ভুত, কিন্তু প্রতিশোধের পথে তুই কতটুকু হারাতে পারবি? তোর অন্তরের সেই অংশ, যা ভয় আর সন্দেহে ভরা, সেটাও তোর শক্তির অংশ।” কনিকা প্রথমবার ভয় পেয়ে গেলো, কারণ সে বুঝতে পারল যে, প্রতিশোধ শুধু বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেও লড়াই। সে কাঁপতে লাগল, কিন্তু নিজের ভেতরের সেই অন্ধকার ও আলোকে একসঙ্গে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হল। সে বলল, “আমি হারাবো না। আমি আমার ভয় আর সন্দেহকে শক্তিতে পরিণত করব।”
গ্রামে তখন কনিকার জনপ্রিয়তা বাড়ছে, কিন্তু সেই সাথে বেড়েই চলেছে তার শত্রুদের সংখ্যা। গজেন সরকার পাগলের মতো গ্রাম ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলেও, তার ঘর, ব্যবসা আর বন্ধুদের ওপর একের পর এক আঘাত এসে পড়ছে। গ্রামের পুরুষরা কনিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেছে। তারা মনে করছে, এই নতুন ‘দেবী’ তাদের পুরনো অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু কনিকা আর গ্রামের মেয়েরা ভয় পায় না। তারা জানে যে, এই অশরীরী ছায়াটাও তাদের পথে বাধা দিচ্ছে, কিন্তু তার মুখোমুখি হয়ে জেগে থাকার জন্য তারা প্রস্তুত। এক রাতে, কনিকা এবং তার সঙ্গীরা সেই ছায়ার উপস্থিতি মেনে নিয়ে একত্রিত হলেন, আর মন্দিরের ভেতরে একটি প্রাচীন শ্লোক পড়তে শুরু করলেন, যা বীর নারীদের শক্তি জাগ্রত করার জন্য ছিল। সেই রাতেই তাদের মনোবল আরও বেড়ে গেলো, আর অশরীরীর ছায়াও যেন ধীরে ধীরে কমে আসল, যেন বুঝল যে এই শক্তির সামনে সে দাঁড়াতে পারবে না। দেবীর মন্দিরে সেই রাত ছিল এক নতুন সূর্যোদয়ের মতো, যেখানে অন্ধকার ও আলো মিশে এক নতুন যুগের সূচনা করল—নারীর ক্ষমতায়নের এক যুগ।
নয়
গ্রামের আকাশ যেন ভারী হয়ে উঠল এক অদ্ভুত গর্জনে। বিকেলের ধীরে ধীরে কমতে থাকা আলো যেন একেকটু করে গাঢ় কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। মন্দিরের প্রদীপগুলো আজ যেন আরও উজ্জ্বল জ্বলছে, আর কনিকার চোখে জ্বলছে আগুনের মতো এক প্রবল বেদনা আর অগ্নিশক্তি। গ্রামের সবাই বুঝতে পারছিল—দেবী মায়ের রাগ আর শান্ত হওয়া মানে নয়। দীর্ঘদিন ধরে যে নির্যাতন, অবিচার, এবং লজ্জায় ভরা যন্ত্রণার ভাণ্ডার জমে ছিল, তা আজ যেন এক মুহূর্তে ফেটে পড়ার মতো। কনিকা তার পায়ের নীচে মাটির কণাকে অনুভব করছিল—মাটির শক্তি তার শক্তি, আর সেই শক্তি তাকে বলছিল, “এখন প্রতিশোধের সময়।”
মন্দিরের বাইরে গ্রামের পুরুষদের মধ্যে হিংসার বাতাস বইতে শুরু করেছিল। তারা কনিকার বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে কাঁথা ও লাঠি নিয়ে চেঁচাচ্ছিল—“এই মেয়েটা গ্রামের শান্তি নষ্ট করছে!” কিন্তু গ্রামের মেয়েরা দাঁড়িয়েছিল একমুখো, অটল হয়ে, তাদের চোখে নির্ভীকতা। কনিকা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা আর ভয় পব না। আমরা এই মাটির সন্তান, যাদের রক্তে লুকিয়ে আছে এক অবিচল শক্তি। আজ থেকে কেউ আর আমাদের নির্যাতন করবে না।” তার কথায় যেন মাটির গভীর থেকে এক গর্জন উঠল, যা পুরো গ্রামকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সেই রাতেই, গ্রামের একটি পুরনো গুদামে আগুন লাগল। পুলিশ বলল—এটা দুর্ঘটনা, কিন্তু গ্রামের কেউ বিশ্বাস করল না। আগুনের রেখা যেন এক অদৃশ্য হাত থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল, যা পুরুষদের অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল।
কনিকা তখন গ্রামের বুকে দাঁড়িয়ে ছিল, তার হাতে সেই লাল চুড়ি, আর তার মুখে এক অদ্ভুত অঙ্গীকার। “আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পাব,” সে বলল, “এই মাটির প্রতিটি নারীর জন্য। আজ থেকে আমরা নিজেদের ‘দেবী’ করব।” সে জানত, প্রতিশোধের এই পথ কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু আর পিছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। গ্রামের চারপাশে দেবীর গর্জন শোনা যাচ্ছিল—একটা শক্তির যা অপ্রতিরোধ্য, এক প্রতিজ্ঞার যা অমলিন। সেই রাত থেকে গ্রামের প্রতিটি নারী নিজের ভেতর এক নতুন শক্তি খুঁজে পেল, আর সেই শক্তি ছিল—দেবীর শক্তি।
দশ
সেই রাতেই আকাশ যেন সারা গ্রামটাকে ঢেকে দিল এক নিঃশব্দ আগুনে। বাতাসে যেন জ্বলন্ত ধোঁয়ার গন্ধ, আর মাটির নিচে জমে থাকা কান্নাগুলো একে একে উঠে এসে আঘাত করছিল আকাশের বুকে। কনিকা মন্দিরে বসে ছিল, তার চোখে ক্লান্তি, তবু অনড় এক দৃষ্টি। দেবীর প্রতিমার সামনে সে চুপচাপ, কিন্তু তার আত্মা তখন কথা বলছে—না কণ্ঠে, না শব্দে, বরং স্পন্দনে। জয়ন্তী পিসি পেছনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “তুই তোর কাজ শেষ করলি মা… এখন তোকে ফিরে আসতে হবে জীবনের পথে।” কিন্তু কনিকা জানত, প্রতিশোধ একটা বৃত্ত—তার শুরু আছে, শেষ নেই। সে তার ভেতরের সেই গর্জনকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করছিল, কারণ প্রতিশোধের আগুন যখন বারবার জ্বলে, তখন নিজের পরিচয়ও ছাই হয়ে যেতে পারে। কিন্তু গ্রামের মানুষ জানত, কনিকা আর কনিকা নেই—সে এক দেবী, যার চোখে ন্যায়বিচার, যার হাতে প্রতিশোধ।
তবে প্রতিশোধের চূড়ান্ত রূপ তখনও আসেনি। গজেন সরকার, যে এতদিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছিল, সে একদিন নিজের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু মৃত্যুর আগে সে একটি চিঠি রেখে যায়—লাল কালি দিয়ে লেখা, যেন রক্ত দিয়ে আঁকা। সেই চিঠিতে লেখা, “আমি জানি, আমি যা করেছি, তার জন্য বিচার হয়েছে। কিন্তু আমার মতো যারা এখনও অন্ধ, তাদের জন্য এই বিচার যেন শেষ না হয়।” সেই চিঠি পেয়ে পুলিশ একরকম চুপসে যায়। গ্রামে আর কোনও পুরুষ কখনও চোখ তুলে কনিকার দিকে তাকাতে সাহস পায় না। মন্দিরে সেই রাতে একটানা মোমবাতি জ্বলে থাকে, আর গ্রামের মেয়েরা, যারা এতদিন নিজেকে কেবলই ছায়া ভেবেছিল, তারা একে একে এসে দেবীর পায়ের কাছে বসে, প্রণাম করে, কেঁদে ফেলে। কনিকা তখন বলে, “আমরা সবাই দেবী। তোমরা যদি নিজেদের বিশ্বাস করো, তাহলে আর কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই।”
শেষ রাত। আকাশে ঝলকানো তারা, বাতাসে ধূপের গন্ধ, আর মন্দিরে কনিকা একা বসে। এবার আর তার সামনে যুদ্ধ নেই—শুধু এক শূন্যতা, এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস। জয়ন্তী পিসি কাছে এসে বসে বলেন, “তোর ভেতরে যে আগুন ছিল, সেটা তুই ভাগ করে দিলি আমাদের মধ্যে। আমরা এখন সেই আগুনে পথ দেখব।” কনিকা চুপ করে থাকলেও, তার চোখে জল আসে না—সে জানে, এই কান্নার সময় পেরিয়ে গেছে। সে জানে, রক্ত একদিন ঘাম হয়, আর ঘাম একদিন আলো। দেবী শুধু প্রতিশোধ নেন না—তিনি শিক্ষাও দেন, জাগরণ আনেন, শক্তি ছড়িয়ে দেন। সেই রাতেই, কনিকা মন্দিরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়, পেছনে মেয়েরা, সামনে খোলা পৃথিবী। সে জানে, দেবীর রূপ সে ধারণ করেছিল মাত্র, কিন্তু দেবী তো ছিল চিরকাল—এই মাটিতে, এই বাতাসে, এই মেয়েদের চোখে। আর ন্যায়? ন্যায় সবসময় রক্ত চেনে—আর রক্তই একদিন ইতিহাস লেখে।
— সমাপ্ত —




