তপোভন দত্ত
পর্ব ১: ফেরার প্রথম দৃশ্য
“ডাইরেক্ট নেমে যা বাস থেকে, তোকে কেউ ফুল নিয়ে স্বাগত জানাবে না!” — বাসের কন্ডাক্টরের চিৎকারে ঘুম ভাঙল দেবদাসের। চোখ খুলতেই সামনের দৃশ্য দেখে নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছিল না — এই তো তার চেনা গ্রাম, নারায়ণপুর। পঁচিশ বছর বাদে ফিরে এসেছে, চুলে পাক ধরেছে, পকেটে এখন আর প্রেম নেই, আছে একটা পুরোনো মোবাইল, দুটো হ্যাংওভার ট্যাবলেট, আর একগুচ্ছ ফুসকু কথা — যেগুলো সে পরোর উদ্দেশ্যে বলবে ঠিক করেছে।
ডান হাতের ছোট্ট ট্রলি টেনে টেনে সে যখন বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরোচ্ছে, তখন তার মাথায় সিনেমাটিক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে — অবশ্য সেটা কল্পনায়, বাস্তবে বাজছে পাশের পানের দোকান থেকে “ডিজে ওয়ালে বাবু”।
দেবদাস থামল, ধোঁয়ায় ভরা একটা বিড়ি ধরাল। বিড়ির ধোঁয়ার মধ্যেই যেন দেখা যাচ্ছে পরোর মুখ — তেজি, ফর্সা, হাতে চুড়ি, চোখে সেই পুরোনো অভিমান।
সে নিজেই বিড়িতে টান দিয়ে বলে উঠল, “পরো… আমি ফিরে এসেছি।”
পাস দিয়ে হাঁটতে থাকা একজন বলল, “দাদা, প্রেমে ধোঁকা খাইছেন নাকি? গলার সুরে মেলা দুঃখ!”
দেবদাস হেসে ফেলল। “না রে ভাই, এখনও প্রেমেই আছি। তবে ধোঁকা খাইনি, আমি নিজেই সিধে ফ্লাইট মিস করে প্রেমে নামছি।”
দেবদাস বাড়ি পৌঁছোল — মানে, তার মামাবাড়ি। কারণ পঁচিশ বছর আগে নিজের বাড়ি ছেড়ে সে গিয়েছিল কলকাতায়, নাটক করতে। তারপর প্রেমে পড়ে, ভেঙে পড়ে, দুধের বদলে হুইস্কিতে জীবন কাটিয়েছে। এখন ফিরে এসেছে, যেন একটা অসমাপ্ত নাটকের ক্লাইম্যাক্স করতে।
মামাবাড়ির গেট খুলতেই সে দেখে সামনে বসে আছেন তার ছোটমামা — টাক পড়েছে মাথায়, কিন্তু ঠোঁটে সেই পুরোনো তামাক চিবোনোর ছন্দ।
“দেবু? তুই? বাঁচা গেল রে, বাড়ির কুত্তা কয়দিন ধরে মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুই এলে হয়তো ওর মন ভালো হবে!”
দেবদাস হেসে বলল, “কুত্তাটাও কি প্রেমে পড়েছিল পরোর?”
“না রে, ও তো নন্দিনীর প্রেমে। তোর বিপরীতে!” ছোটমামা হেসে গড়াগড়ি খান।
রাতে খাওয়া শেষে, দেবদাস নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথায় ঘুরছে একটাই চিন্তা — পরো এখন কেমন আছে? কোথায় থাকে? তাকে দেখলে কি চিনবে?
সে জানে পরো বিয়ে করেছে — তাও এক সফল বিজনেসম্যানকে। তার ফেসবুক প্রোফাইলে ঝলমলে ছবি, বিদেশ ভ্রমণের সেলফি, আর একটা কালো কুকুরের সঙ্গে খোলামেলা হাসি।
“কালই যাব,” দেবদাস বিড়বিড় করল। “তাকে একবার দেখতে হবে। একবার যদি চোখে চোখ পড়ে, বুঝবে আমি এখনও আগুন!”
পরদিন সকাল।
সে পরে নিয়েছে এক জোড়া ধুতি-পাঞ্জাবি — যেন এক নতুন সংস্কৃতির রেনেসাঁ-ম্যান! সাইকেল ভাড়া নিয়ে সে পৌঁছে গেল বনমালী হাউজিং — পরোর বর্তমান ঠিকানা।
“এইখানে কি পরোমিতা সেন থাকেন?” — দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এল এক গৃহকর্মী।
“হ্যাঁ দাদা, থাকেন। কে বলবো এসেছেন?”
দেবদাস গলায় ব্যাসের আবেগ এনে বলল, “বলো, তার অতীত ফিরেছে।”
গৃহকর্মী চমকে বলল, “ভাই, সরাসরি বলে দেন নামটা। অতীত বলে কেউ থাকে না এখানে!”
“আচ্ছা বলো, দেবদাস এসেছে।”
ভেতর থেকে ভেসে এল এক চেনা হাসি, “ভেতরে এসে বসো দেবু। তোকে দেখেই বুঝলাম — আবার নাটক শুরু করবি!”
দেবদাস স্তব্ধ। সে জানত না পরো হাসবে না কাঁদবে, কিন্তু হাসছে! সেটা আরও ভয়ংকর!
সে ভেতরে ঢুকল। চোখে চোখ পড়ল। পরো সুন্দর, পরিণত, আধুনিক, এবং… বিন্দুমাত্র প্রেমে না!
“তুমি তো ভাবছো, আমি তোকে দেখে কেঁদে ফেলব, তাই তো?” পরো বলল।
দেবদাস কেমন অন্যমনস্কভাবে বলল, “না, মানে… আমি ভাবছিলাম একটা ভায়োলিন বেজে উঠবে।”
“ভায়োলিন না, আমার বাড়িতে এখন শুধু আমার স্বামীর গোলফ স্টিক বেজে ওঠে।”
দেবদাস বুঝল, সে একটা ভুল সময়ে ভুল স্ক্রিপ্ট নিয়ে ঢুকেছে এই মঞ্চে।
কিন্তু গল্প এখানেই থেমে থাকলে তো সেটা দেবদাসের নাম রাখার মানে থাকে না।
সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল — “পরোকে আবার হাসাতে হবে। নাহলে নাম বদলে ফেলব — দেবু দুঃখ নয়, দেবু দারুণ!”
পর্ব ২: কবিতা, কলঙ্ক আর কচুরি
পরোর বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেবদাস নিজের মামাবাড়ির বারান্দায় বসে এক কাপ চা খাচ্ছিল আর নিজেকে প্রশ্ন করছিল — “আমি কি সত্যিই ফিরেছি? নাকি এখনো কোনও মদঘোরে লন্ডনের বারে বসে আছি?”
হঠাৎই তার সামনে এসে হাজির হলেন পাড়ার পুরোনো রিকশাচালক — হারাধন কাকা।
“ওরে দেবু! ফিরেছিস রে? লন্ডনে কি সবাই গেঁড়ামি করে নাকি তোর মত?”
“হুম, করেই তো। তবে আমিই ওদের গুরু,” মুচকি হেসে বলল দেবদাস।
“তোর প্রেমিকার কথা শুনে অনেক কান্না কাটি হয়েছিল পাড়ায়। শুনি সে এখন বিশাল লোকের বউ?”
“হ্যাঁ কাকা, বিশাল লোকের… কিন্তু আমি তো এখনও তার কবিতার ছোট্ট লাইন!”
হারাধন কাকা ভেবেও বুঝলেন না কথাটা মানে কী। উনি চলে যেতেই দেবদাস নিজের মোবাইলটা হাতে নিল — সে ঠিক করেছে, পরোর জন্য কবিতা লিখবে। সেই কবিতা ছড়িয়ে দেবে শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে।
শুরু করল:
“যে চোখে ছিল বিষাদ ছোঁয়া
সে চোখ আজ কসমেটিক্সে ঢাকা।
তুই সুখে থাকিস পরো,
আমার গালে এখনও দাড়ি গাঢ়া!”
নিজের কবিতা পড়ে দেবদাস নিজেই হাসি চেপে রাখতে পারল না।
“আহা! এমন সাহিত্যে প্রেম না হলে কী হবে? অন্তত লাইক পাবে!”
তারপর সে ঠিক করল — এখন থেকে প্রতিদিন একটা করে কবিতা লিখে যাবে, পোস্ট করবে ফেসবুকে। প্রথম পোস্টেই ২টা লাইক — একটি তার নিজের, আরেকটি এক নাম না জানা বিদেশি স্প্যাম অ্যাকাউন্টের।
তবে হাল ছাড়ল না দেবদাস।
দুপুরবেলা সে গেল বাজারে। উদ্দেশ্য — পরোর জন্য কিছু স্মৃতি ফেরানো।
সে কিনল —
১. পরোর প্রিয় জলপাই আচার
২. তাদের প্রথম প্রেমের দিনে খাওয়া কচুরি
৩. আর একটি ছোট্ট সোনালি খাম — যাতে সে নিজের হাতে লেখা চিঠি দেবে।
চিঠিতে সে লিখল:
“প্রিয় পরো,
তোমার জন্য একটি আচার এনেছি।
যা একসময় তোমার ঠোঁটকে টক করত,
আজ তা দিয়ে আমি আমার প্রেমের স্মৃতি মেখেছি।
তুমি যদি পড়ো, হাসবে।
আর যদি না পড়ো, তাও জানবে — দেবদাস এখনো বেঁচে আছে, হজম ট্যাবলেট নিয়ে।”
চিঠি লিখে খামে ভরল।
তারপর সাহস করে আবার হাজির হল বনমালী হাউজিং।
গেট খোলা ছিল। সে খামটা স্লাইড করে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, এমন সময় দরজার সামনে এসে পরো দাঁড়িয়ে গেল। হাতে চায়ের কাপ, আর গলায় সেই চিরন্তন ঠোঁটের হাসি।
“তুই কি পোস্টম্যান হয়ে গেছিস?”
“না, আমি এখন প্রেমের ডেলিভারি বয়,” দেবদাস গম্ভীরভাবে বলল।
পরো হেসে বলল, “ভেতরে আয়, আজকে তোর জন্য কচুরি এনেছি। খাস?”
দেবদাস হতবাক।
“তুমি আমার জন্য কচুরি? এত বছর পর?”
“না, আসলে আমার ছেলের বন্ধুরা আসার কথা ছিল। তারা আসেনি। তোকে খাওয়াই।”
সে ভেতরে ঢুকল। দেখল, ঘরে অনেক বদল এসেছে — লাইটিং, পরার সাজপোশাক, দেয়ালে বড় বড় ছবির ফ্রেম — এবং একটি কুকুর, যার নাম লিও।
লিও এসে দেবদাসের পায়ের কাছে ঘষাঘষি করতে লাগল।
“এটা তো তোর ওপর ভীষণ খুশি মনে হচ্ছে,” পরো বলল।
“হ্যাঁ, বোধহয় লিও বুঝে গেছে আমি ওরও মতো — মালিকের কাছে ফিরতে চাওয়া এক আনুগত্যপূর্ণ প্রাণী।”
কথাটা শুনে পরো প্রথমবার একটু থমকে গেল।
“দেবু, তুই সত্যিই কি ফিরে এসেছিস আমার জন্য?”
“হ্যাঁ পরো, আমি শুধু তোমার জন্যই এসেছি। আমার জীবনে কোনো থিয়েটার ছিল না, সব নাটক ছিল তুই।”
পরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“তুই জানিস, আমি তোর ওপর রেগে ছিলাম এত বছর। কিন্তু আজকাল তোর অবস্থা দেখে… কেমন যেন মন ভালো হয়ে যায়। বিশেষ করে তোকে এইসব কচকচে কবিতা লিখতে দেখে।”
“মানে তুই আমায় দেখে হেসে ফেলিস?”
“হ্যাঁ,” পরো মুচকি হেসে বলল। “তুই এখন আমার মুড লিফ্টার।”
দেবদাস বুঝল — প্রেম হয়তো ফিরে আসেনি, কিন্তু হাসি এসেছে।
সে কচুরি মুখে পুরে বলল, “মুড লিফ্টার না, আমি হৃৎপিণ্ড ফাইটার!”
পর্ব ৩: সেলফি, সাবান আর সংসার
পরোর ড্রয়িংরুমে বসে দেবদাস ভাবছিল, জীবনটা ঠিক কোন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এতদিন ধরে যে প্রেমের ব্যথায় ছটফট করেছে, আজ সে নিজেই পরোর বাড়িতে বসে কচুরি খাচ্ছে আর তার পোষা কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এটা কি প্রগতি? না কি প্রেমের অবসরের বিজ্ঞাপন?
“তুই চাইলে এখানেই থাকতে পারিস কয়েকদিন,” পরো হঠাৎ বলে উঠল।
দেবদাস চমকে উঠল, “কি! আমি এখানেই থাকব?”
“হ্যাঁ। আমার ছেলেটা এখন দিল্লিতে, আর স্বামী অফিসে গ্লোবাল ট্যুরে। বাড়ি খালি খালি লাগে। তুই থাকলে একটু প্রাণ ফেরে।”
দেবদাসের মাথার মধ্যে সোজা বাজতে লাগল রোমান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর।
“তাহলে কি… তবে কি আমাদের আবার কিছু শুরু হতে পারে?” সে ভাবল।
কিন্তু পরো ইতিমধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ টাইপ করতে। সেদিকে তাকিয়ে দেবদাস হঠাৎ দেখতে পেল — পরো হঠাৎ ক্যামেরা অন করল আর একটা সেলফি তুলল। সে আর লিও কুকুর, মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেবদাস — মুখে হালকা বিভ্রান্তি।
“এইটা কোথায় যাচ্ছে?”
“ইনস্টাগ্রামে। ক্যাপশন দিচ্ছি — ‘Old friend, older chaos!’”
দেবদাস বলল, “আমার অনুমতি তো নিলে না?”
পরো হেসে বলল, “তোর প্রেম ছিল পাবলিক ডোমেইনে, এখন ছবি হবে সোশ্যাল মিডিয়ায়!”
সন্ধে নাগাদ, দেবদাস নিজেকে পরোর বাড়ির গেস্টরুমে আবিষ্কার করল। চেনা গন্ধ — কিন্তু নতুন বিছানা, নতুন সাবান, আর নতুন ধাঁচের বাথরুম। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাল। মুখে বয়সের ছাপ, চোখে একটা অনন্ত অভিমান — আর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উথালপাথাল।
স্নান সেরে বেরোতেই পরো তাকে এক জোড়া নতুন পায়জামা দিয়ে বলল, “তোর ওই ধুতি-পাঞ্জাবি দেখে আমার মনে হচ্ছিল যেন কেউ টাইম ট্রাভেল করে ফিরেছে।”
“আমি তো প্রেমে থেমে গেছি। সময় এগোলেও আমার প্রেম আটকে আছে সেই ২০০০ সালের গ্রীষ্মে,” দেবদাস বলল একটু নাটকীয় গলায়।
“হুম, আর আমার প্রেম এখন এলইডি লাইটে জ্বলছে। সময়টা বদলে গেছে দেবু।”
রাতের খাওয়ায় খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা। দেবদাস চমকে গিয়ে বলল, “তুই তো আগে খিচুড়ি খেলেই মাথাব্যথা করত!”
পরো বলল, “আগে ছিল প্রেম, এখন সংসার। সংসারে খিচুড়ি থাকে, প্রেমে পাস্তা। বুঝলি?”
খাওয়ার পর পরো এক কাপ চা এনে দিল বারান্দায়। সেখানে বসে তারা দুজন একসাথে চুপ করে থাকল।
হঠাৎ পরো বলল, “তুই কি এখনও আমাকে ভালোবাসিস?”
দেবদাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“ভালোবাসা তো সাবানের মতো — যদি ঠিকভাবে মাখানো না হয়, তা হলে ফেলে দিতেই হয়। আমি শুধু সাবানের গন্ধটা ধরে রেখেছি।”
পরো একটু থেমে বলল, “তুই যদি ভালোবাসিস, তবে তোকে আমার সংসারটাকেও ভালোবাসতে হবে। সেটাই পারবি?”
দেবদাস বলল, “আমি তো আগে শুধু তোকে ভালোবেসেছি। এখন তোমার সংসারের পেছনের গল্পকেও বুঝতে চাই।”
পরো বলল, “ভালো কথা। কাল আমার কাজের মাসি ছুটিতে আছে। তুই একটু ভোরে উঠে বাসন মাজবি?”
দেবদাস চমকে উঠে বলল, “আমি! বাসন মাজার দেবদাস? এটা তো চৈত্রের ঝড়!”
পরো হেসে উঠল। “প্রেমে যে হেরে গেছিস, সংসারে তো জিততে পারিস!”
রাতটা ঘুম এল না দেবদাসের। বিছানায় শুয়ে সে ভাবল, সংসার আসলে এক অন্যরকম নাটক — যেখানে হিরো না হলে চলেও যায়, কিন্তু কনট্রোলড কমেডিয়ান না হলে জমে না।
সে ঠিক করল — কাল সকাল থেকে একদম নতুন দেবদাস শুরু হবে।
বাসন মাজা, বাজার যাওয়া, ছাদে কাপড় মেলা — সব করবে।
কারণ সে প্রমাণ করতে চায়, সে শুধু ‘দুঃখ বিলাসী’ নয় — সে একজন হাউসফুল দেবদাস!
পর্ব ৪: বাজারের ব্যাগ আর বদলে যাওয়া ব্যাঙ্কব্যালেন্স
সকাল ছ’টা। নারায়ণপুরে তখনো সূর্য ওঠেনি, কিন্তু দেবদাসের ঘুম ভেঙেছে। কারও গলায় বাঁশির আওয়াজে নয়, বরং পরোর ঘরের মোবাইল অ্যালার্মে—“ও অন্তর আমার মুক্তি দাও…”
দেবদাস চমকে উঠে দেখে, তার সপাটে প্ল্যানমাফিক দিনের প্রথম কাজ শুরু হয়ে গেছে।
কাজের মাসি ছুটি নিয়েছে, পরো পায়ে তুলসী মালা পরে প্রাতঃরাশের ধ্যান করছে, আর দেবদাস… তার হাতে ভরা এক ঝুড়ি বাসন।
“সাবানটা কোনটা?”
“যেটাতে লেবুর ছবি আছে,”—পরো চোখ বন্ধ করেই উত্তর দেয়।
দেবদাস জীবনে প্রথমবার নিজের দুঃখে নয়, অন্যের থালায় মাখা ঘি পরিষ্কার করতে করতে ভাবল, ‘ভালোবাসা একসময় বেদনাময় ছিল, এখন তা বাটার সিঙ্কে ধুয়ে যাচ্ছে।’
সকালের প্রথম কাজ শেষে সে পেল একটি ছোট্ট পুরস্কার—এক কাপ লিকার চা আর সঙ্গে তিনটে মিক্সচার বিস্কুট।
পরো হেসে বলল, “এই বিস্কুটগুলো আমি শুধু খাস অতিথিদের দিই। তুই তো অতিথি, নয় কি?”
দেবদাস বলল, “না, আমি এক্স-প্রেমিক শ্রেণির গৃহপালিত কর্মী।”
পরো হেসে উঠল, আবারও সেই হাসি—যেটা দেখে দেবদাস আজকালও হৃদয় হালকা বোধ করে।
“আজকে একটা অনুরোধ আছে,” বলল সে।
“এই তো শুরু হলো,” পরো বলল, “বল, কী?”
“আমি তোমার সঙ্গে বাজারে যাব। ব্যাগ আমি বইব। তুমি শুধু দামাদামি করবে।”
পরো প্রথমে একটু অবাক হলেও রাজি হয়ে গেল।
দুজন বেরোল বাজারের দিকে।
দেবদাস হাতে নিয়ে বাজারের ব্যাগ—লাল রঙের কাপড়ের, উপরে ‘বৈষ্ণব সুপার মার্কেট’ লেখা, নিচে গোবিন্দ লোগো।
পরো এক এক করে সবজির দাম জিজ্ঞেস করছে—
“লাউ কত?”
“চল্লিশ।”
“দিবি বাইশে?”
“আপনি কি ম্যাজিক জানেন?”—সবজি বিক্রেতা হেসে ফেলল।
দেবদাস পাশ থেকে বলল, “এরা জানে না, এ তো সেই মেয়ে, যে একসময় আমার বুকভাঙা দুঃখ দশ টাকায় কাঁচকলায় বদলে দিতে পারত।”
সবজি কেনা শেষে তাঁরা গেলেন মাছের দোকানে।
পরো বলল, “আজকে কাতলা নেব। শ্যামা পূজা আছে রাতে।”
দেবদাস হেসে বলল, “আমি তোমার জীবনে কাতলা হতে পারলাম না, অন্তত বাজারের ব্যাগটা কাঁধে নিতে দাও।”
হাসাহাসির মধ্যেই একটা বৃদ্ধ মহিলা হঠাৎ পরোকে চিনে ফেলল।
“এই মেয়ে না তো সেই যে ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করত! কি যেন নাম ছিল… হ্যাঁ, দেবদাস!”
পরো হালকা হেসে বলল, “এই যে, এই তো সেই দেবদাস, এখন আমার বাজার সাথী।”
দেবদাস মাথা নুইয়ে নমস্কার করল।
বাড়ি ফিরে দেবদাস গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ভাবল, “এই তো জীবনের পূর্ণতা—এক সময় যার জন্যে কান্না করতাম, এখন তার পছন্দের ঢেঁড়স বাড়ি এনে দিতে পারছি।”
কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় ঘটে এক মোড়বদল।
পরো ফোনে কথা বলছিল—একটা সিরিয়াস টোনে।
দেবদাস যতটা শুনতে পেল—
“হ্যাঁ অরূপ, আমি ঠিক আছি… না না, ও শুধু বন্ধু… না, তুমি এলে আমি বুঝে নেব। হ্যাঁ, ডিনার আমার ওপর।”
অরূপ। স্বামী। ফিরছে। আজ রাতেই।
দেবদাস জানে তার সময় ফুরিয়ে আসছে।
সে চুপচাপ নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল।
পরো এসে বলল, “তুই যাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ। আমি এখানে যে নাটক করতে এসেছিলাম, সেটার স্ক্রিপ্ট শেষ।”
পরো চুপ করে রইল।
তারপর বলল, “তুই আসার পর আমার অনেকদিন পর একটা হাসির উপলক্ষ হয়েছে।”
দেবদাস হেসে বলল, “তাই তো আমি থাকতাম না, তাহলে তুমি আর হাসতে পারতে না।”
পরো বলল, “তুই থাক, দেবু। অরূপ জানে আমাদের ইতিহাস। আর তোর বর্তমানটা এত মজার, ও কিছু বলবে না।”
দেবদাস চমকে উঠল, “তোমার স্বামী জানে আমি তোমার এক্স?”
“হ্যাঁ, ও জানে তুই কবিতা লিখিস, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ড্রামা করিস। ও জানে তুই harmless।”
এই একটা শব্দ যেন আঘাত করল।
harmless — মানে বিষহীন। মানে আর প্রেমের পোকা নয়, এখন বোকা।
দেবদাস বলল, “তাহলে ঠিক আছে। আমি থেকে যাব। কিন্তু এবার ব্যাঙ্কব্যালেন্সের হিসেব দেবো না। শুধু বাজারের ব্যাগ নয়, মনটাও বইব।”
পর্ব ৫: রাতভর রাধা আর ফ্রিজে রাখা প্রেম
রাত দশটা। বনমালী হাউজিংয়ের নিচে হঠাৎই একটা সাদা সুইফট দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এলেন একজন সুদর্শন ভদ্রলোক — টাক ঝরা কপালে হালকা চশমা, হাতে একটা স্যুটকেস আর মুখে কোটির হাসি।
অরূপ সেন। পরোর স্বামী।
দেবদাস তখন রান্নাঘরে রাধার রান্না ভিডিও দেখে পেঁয়াজ কাটছিল। ইউটিউবে লেখা ছিল — “রাধার খিচুড়ি: স্বামীকে ভালোবাসার সহজ উপায়।”
সে কেটে কেটে কাঁদছিল — পেঁয়াজের জন্যে, বা হয়তো নিজের অবচেতন বেদনার জন্য।
পরো নিচে গিয়ে অরূপকে নিয়ে এল।
“অরূপ, চিনতে পারছো? এই যে দেবু। কলেজের বন্ধু। এসেছিল ঘুরতে। এখন কিচেনে রান্না শিখছে।”
অরূপ হাসলেন, “হ্যাঁ, আমি ফেসবুকে দেখি ওর কবিতা। অনেক গভীর, আর মাঝে মাঝে বেশ মজাও লাগে। তুমি কি ওটাই লিখেছিলে, ‘তোমার চুমু আজও আমার ডেটল হয়ে আছে’?”
দেবদাস লজ্জায় বলল, “হুম… সেটাই।”
“চমৎকার লাইন। আমি তো পরোকে বলি, তোমাদের প্রেমটা নিয়ে একটা ওয়েব সিরিজ বানানো যেতে পারে!”
পরো হেসে বলল, “তুমি প্রযোজনা করো, আমি পরিচালনা করব। দেবু স্ক্রিপ্ট লিখবে।”
দেবদাস বলল, “আমি শুধু ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে হেরে যাব। সেটা আমার স্পেশালিটি।”
রাতের খাওয়ার সময়, খিচুড়ি-লাউভাজা আর টমেটো চাটনি।
অরূপ প্রথম চামচ মুখে দিয়ে বললেন, “দেবু, তুমি এটা বানিয়েছো? অসাধারণ!”
“না না,” পরো বলল, “রাধা বানিয়েছে। ইউটিউবের রাধা। দেবু শুধু ভিডিওটা প্লে করে পেঁয়াজ কেটেছে।”
খাওয়ার পর সবাই বারান্দায় গিয়ে বসল।
অরূপ বলল, “তুমি তো এখন একা, দেবু? বিয়ে করোনি?”
দেবদাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বিয়ে করিনি, তবে কয়েকটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সব শেষে মনে হয়েছে, আমি মূলত ফ্রিজে রাখা প্রেমের মতো — পুরোনো, ঠান্ডা, কিন্তু নষ্ট হয়নি।”
পরো চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো।
“তাই তো বলি, ফ্রিজে রাখা প্রেমে একটাই সুবিধা — সেটা কখনও পচে না, শুধু গায়ে বরফ জমে যায়।”
দেবদাস বলল, “আর তুমি সেই মাইক্রোওয়েভ — সব বরফ গলিয়ে দাও। তারপরে আবার ঠান্ডা করে রাখো।”
এই কথায় পরো হেসে ফেলল।
“আসলে তোকে দেখে আমার সেই পুরোনো আমি-টা মনে পড়ে যায়, জানিস? যে আমি সাদামাটা ছিল, কচুরি ভালোবাসত, আর প্রেমে চোখ বড় করত। এখন আমি কিচেনে শুধু স্বাস্থ্যকর স্যুপ বানাই, আর মিটিংয়ে গম্ভীর মুখে বসি।”
অরূপ একটু চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন, “আমরা সবাই বদলাই। তবে দেবু, তুমি বদলাওনি দেখে ভালো লাগে। তুমি এখনো সেই এক্স-লাভার, যে বন্ধুর মতো বাসন মাজে। যাকে দেখে বোঝা যায়, ভালোবাসা সব সময় অধিকার চায় না — কখনও শুধু উপস্থিতি চায়।”
রাত বাড়ল। দেবদাস ছাদে উঠে এল। ওপরে চাঁদ, নিচে আলো-জ্বলা শহর, আর তার মাঝখানে তার নিজের নিঃশব্দ হৃদয়।
সে মোবাইলে একটা নতুন কবিতা টাইপ করল —
“তুমি সংসার গড়েছো, আমি স্বপ্ন সাজিয়েছি।
তোমার পাশে মানুষ আছে,
আমার পাশে আজও আমি।
তবু চুপচাপ, একসাথে আছি —
তুমি ব্যস্ত, আমি বোকা।
তুমি ঘুমাও, আমি রাতজাগা ছায়া।”
তারপর সেটি সে পোস্ট করল না।
সে শুধু পরোর ফ্রিজ খুলে এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেল, আর ভাবল —
“এই প্রেমটা হয়তো ফ্রিজেই থাক ভালো। কারণ বেরোলেই গলে যাবে।”
পর্ব ৬: প্রেমের পোস্টার আর পাড়ার প্রহসন
পরদিন সকালবেলা দেবদাস হাঁটতে বেরোল। সাদা পাঞ্জাবি, গলায় ছোট্ট তোয়ালে, হাতে একখানা কাপড়ের ব্যাগ — যেন এই শহরের নিঃশেষ প্রেমিকদের পোস্টার বয়।
পথে যেতে যেতে সে লক্ষ্য করল, পাড়ার মোড়ে একটা ঠেলাগাড়ির পাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে। এগিয়ে গিয়ে সে দেখল — সেখানে লাগানো আছে বিশাল একটা পোস্টার। উপরে বড় হরফে লেখা:
“বিস্মৃত প্রেমিক দেবদাস — ফিরে এসেছে!”
নীচে তার একখানা ঝাপসা ছবি — চোখে সানগ্লাস, পেছনে লিও কুকুর, পাশে দাঁড়িয়ে পরো — হাসিমুখে।
দেবদাস হাঁ করে চেয়ে রইল।
“কে লাগাল এইটা?” সে জিজ্ঞেস করল।
পাশ থেকে পানের দোকানদার বলল, “আপনার কবিতা তো ভাইরাল হইছে! লোকজন বলতেছে — আপনি হিরো! এত প্রেম করে কেউ এখন আর ফিরে আসে না। আপনার নামেই তো প্রেম দিবস পালনের কথা ভাবতেছি!”
“আমি তো কোথাও পোস্ট করিনি!”
“কিন্তু আপনার বন্ধুবান্ধব করেছে। আর আপনার কবিতা, সেই ‘ডেটল চুমু’, সেটা এখন ‘নারায়ণপুর লাভ কোয়েটস’-এর হেডলাইন।”
দেবদাস মাথায় হাত দিয়ে বলল, “এই না হলে বাংলা প্রেম!”
বাড়ি ফিরে পরোকে সব বলতেই সে হেসে কুটিকুটি খেয়ে ফেলল।
“তুই তো এখন পাড়ার সেলিব্রিটি! জানিস, মা আজ সকালেই বলছিল, তোর একটা বিয়ে দেওয়া দরকার।”
“কে দেবে বিয়ে?”
“আমার কাকিমা বলেছে, তার ভাইঝি আছে — হোয়াটসঅ্যাপে প্রেম করে, কিন্তু বাস্তবে খুব ভদ্র।”
“ধন্যবাদ,” দেবদাস মাথা নুইয়ে বলল। “আমি এখনও সেই মানুষ, যে বাস্তবে প্রেম খুঁজে, হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাস দেয়।”
দুপুরে একটা নতুন বিপত্তি ঘটল। পাড়ার ক্লাব থেকে লোক এসে বলল, “দাদা, আপনি আমাদের বার্ষিক নাটকে ‘দেবদাস’ চরিত্রে অভিনয় করবেন, ঠিক হয়েছে।”
“কিন্তু আমি তো নাটক ছেড়ে দিয়েছি।”
“আপনি তো নিজেই এখন এক জীবন্ত নাটক!”
“আর নায়িকা কে?”
“আপনার পাশের বাড়ির ঝুমকি। রিহার্সাল তো আজই শুরু!”
দেবদাস একবার পরোর দিকে তাকাল।
পরো বলল, “করেই ফেল। নিজেকে একটু বাইরে আন। শুধু তো আমার রান্নাঘরে প্রেমে পড়ে বসে থাকলে হবে?”
দেবদাস কেঁপে উঠল — রান্নাঘরের প্রেমিক থেকে নাট্য মঞ্চের দেবদাস!
সন্ধেবেলা সে ক্লাবঘরে হাজির।
ঝুমকি — এক তরুণী, চোখে গোল ফ্রেম, হাতে ইনস্টাগ্রামের প্রোফাইল খোলা।
সে এসে বলল, “তুমি যে আসল দেবদাস, সেটা সবাই বলেছে। আমি তোমার সঙ্গে রিল বানাতে চাই।”
“রিল?”
“হ্যাঁ, ফেসবুকে নয় ভাই, এখন প্রেম হয় রিলে!”
রিহার্সাল শুরু হলো।
দেবদাস বলল, “পরো, তুমি আমায় কেন ছাড়লে?”
ঝুমকি বলল, “কারণ আমি ফ্যাশনে বাঁচতে চাই, প্যাশনে নয়!”
পাশ থেকে একজন বলল, “ডায়ালগটা মোবাইলে লিখে রাখো, ভাইরাল হবে!”
দেবদাস মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাবল, সত্যি কি এটাই তার ভবিষ্যৎ?
যে মানুষ প্রেমে জীবন দিল, সে এখন পাড়ার লোকেদের হেসে খাওয়ানোর উপাদান?
সেই রাতে সে বাড়ি ফিরে আসে ক্লান্ত হয়ে।
পরো তাকে দেখে বলল, “কেমন লাগল রিহার্সাল?”
“মনে হল, আমি এখন আসল দেবদাস নই — আমি তার কমেডি সংস্করণ।”
পরো বলল, “আসলে, তুই যা ছিলি, তা কেউ বোঝেনি। এখন তোকে নিয়ে হাসছে, কারণ তুই ফিরে এসেছিস। তুইই সাহসী — পিছু ফিরে প্রেম খুঁজতে আসা একটা পাগলামি, কিন্তু সেই পাগলামি তোর মতো লোকেই করতে পারে।”
দেবদাস মুচকি হেসে বলল, “তাহলে বুঝি আমি এখন ‘প্রেমের পোস্টার বয়’?”
পরো বলল, “না রে। তুই এখনও আমার একটা স্মৃতি, যেটা আমি মন খুলে হাসতে পারি।”
পর্ব ৭: ঝুমকির চুমু আর জমে থাকা জল
সকালবেলা উঠেই দেবদাস চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচে ক্লাবঘরের সামনে আবারও ভিড়। তার ছবি দেওয়া পোস্টার আজ নতুন রংয়ে রঙিন হয়েছে—
“দেবদাস দ্য রিল—লাইভ ইন নারায়ণপুর মঞ্চ, এই শনিবার!”
সে এক কাপ চা খেতে খেতেই ভাবল, “আমি কি সত্যিই এতটা মজার হয়ে গেছি? নাকি মানুষ এখন কষ্টেও হাসির উপাদান খোঁজে?”
এমন সময় বারান্দায় পরো এসে দাঁড়াল। চোখে ঘুম, হাতে চুলের ক্লিপ।
“রাত জেগেছিস?”
“হ্যাঁ। নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে, আমি এখন নিজের জীবনটাই লিখে ফেলছি।”
“লিখে ফেল,” পরো বলল। “তোর জীবনটা নাটক না হলেও মঞ্চে ভালো চলে।”
বিকেলে ক্লাবঘরে রিহার্সালে গেল দেবদাস।
আজকের দৃশ্যটা ছিল সেই মুহূর্ত—যেখানে পরো, মানে ঝুমকি, দেবদাসকে বলে সে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চলেছে।
সিনেমার ক্লাসিক সংলাপ:
“আমাকে ভুলে যা দেবদা।”
কিন্তু ঝুমকি বলল, “আমাকে ব্লক করে দে দেবদা!”
সবাই হেসে গড়াগড়ি।
দেবদাস মাথা চুলকে বলল, “এই প্রেমে ক্লাসিক নেই, শুধু ক্লিপ আর কমেন্ট!”
রিহার্সাল শেষে ঝুমকি এক গ্লাস ঠান্ডা লেবু জল এগিয়ে দিল।
“তুমি আসলেই অন্যরকম। আমি ভাবতাম এক্স-বয়ফ্রেন্ড মানেই অ্যাংরি ভিলেন। কিন্তু তুমি তো পুরোটাই হাস্যকাব্য।”
দেবদাস বলল, “হাস্যকাব্য নয়, আমি অসমাপ্ত সনেট। যে প্রেমকে শেষ করতে পারল না, সে হাসতে শিখে গেল।”
ঝুমকি থেমে রইল। তারপর হঠাৎ বলে বসল, “তুমি চাইলে, একটা ছোট্ট চুমু দিতে পারি। কষ্ট কমবে।”
দেবদাস আঁতকে উঠে বলল, “এই কী বলছ! আমি তো মঞ্চে চুমুতে বিশ্বাস করি না!”
“কিন্তু দর্শক চায়,” বলেই ঝুমকি হাসল।
দেবদাস বুঝল, সে যে প্রেম খুঁজছে, সেটা এখনকার প্রেমের কন্টেন্ট ফর্ম্যাটের সঙ্গে মেলে না। সে প্রেম ছিল পোস্টকার্ডে, এখন প্রেম হয় রিলের ভেতর।
সে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমার প্রেমে চুমু ছিল, কিন্তু তা মুখে নয় — কবিতার লাইনে।”
ঝুমকি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি সত্যিই এখনকার প্রেমে বেমানান। তুমি বরফের মতো — নিঃশব্দে গলতে জানো, অথচ কেউ টের পায় না।”
ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি এল। সে দাঁড়িয়ে রইল এক পুরোনো শালগাছের নিচে।
মাথায় ছাতা নেই, হাতে একটা কাগজ—ঝুমকি দেওয়া সংলাপের কপি, এখন ভিজে কাগজের মতো চুপসে গেছে।
সে চেয়ে রইল পেছনে—পুরো গ্রাম যেন একটা বদ্ধ জলাশয়, যেখানে তার ভালোবাসা জমে আছে অনেক বছর ধরে।
সে নিজের ফোন বের করল, ক্যামেরা অন করল, আর নিজের মুখটা দেখে ফিসফিস করে বলল,
“এই চেহারাটা দেখলে পরো এখনো কি চিনবে?”
নিজেকে সে ছবি তোলার আগে আবার থেমে গেল।
না, সে আর পোস্ট করবে না।
এই প্রেম এখন তার নয়।
এই শহরের লোক হাসে, ক্লাব拍 aplods করে, পোস্টারে সে ‘ফান্টাস্টিক ফ্রেন্ড’, অথচ ভিতরে ভিতরে সে এখনও সেই একা ছেলেটা—যার হৃদয়ের ভেতরে পরোর ছবি, কিন্তু পাশে শুধুই ছায়া।
পর্ব ৮: দেবদাসের বিয়ে এবং একটি ভুল ঠিকানা
দেবদাস সকাল সকাল উঠে দেখল, মামাবাড়ির দরজায় লম্বা লাইন। কারা যেন সবাই এসেছে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে।
“বাহ, দেবু! তুই সত্যিই বিয়ে করতে চলেছিস?” — বলল গোপাল কাকা, যিনি ছোটবেলায় দেবদাসকে চোর বলেছিল কারণ সে লুকিয়ে পরোর আঁচল ছিঁড়েছিল।
“বিয়ে?” — দেবদাস হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
“হ্যাঁ! ফেসবুকে খবর বেরিয়েছে, তুই পাড়ার এক মেয়েকে বিয়ে করছিস। সবাই বলছে, এই তো সেই ‘রিয়েল দেবদাস’, যাকে প্রেমে পিষে আবার সংসারে উঠিয়ে আনা হল!”
দেবদাস মাথা চুলকে ভাবল, “এটা নিশ্চয় ঝুমকির কাণ্ড! একটা রিল করেছিলাম যেখানে সে বলেছিল ‘আমরা বিয়ের শপথ নিচ্ছি’ — আর সেটা সবাই সিরিয়াস ভেবে নিয়েছে!”
ততক্ষণে ঝুমকি এসে হাজির। হাতে ফোন, মুখে চওড়া হাসি।
“সরি রে দেবু, আমার ফলোয়ার বাড়াতে গিয়ে একটু বেশি বাজি খেলাম। এখন সবাই ভাবছে, তুই আমার বর।”
“এবং তুই কিচ্ছু বলিসনি?”
“বললে কি কেউ মানতো? তুই তো এমনিতেই প্রেমিক শ্রেণির জাদুকর!”
পরো এসে বলল, “তোর নতুন জীবনের জন্য আগাম শুভেচ্ছা। এতদিন আমার আশেপাশে ছিলি, এবার হয়তো তোরই নতুন রং লাগবে জীবনে।”
দেবদাস বলল, “তুই কি রাগ করেছিস?”
পরো মুচকি হেসে বলল, “না রে, তোর বিয়েতে আমি নাচতেও রাজি!”
তবে আসল সমস্যা শুরু হলো সন্ধেয়।
দেবদাসের কাছে ফোন এল — একটা স্থানীয় সংবাদমাধ্যম থেকে।
“আপনার প্রেমকাহিনি আমাদের জেলার গর্ব। আপনি কি জানেন, আপনার বিয়েটা আমরা লাইভ করতে চাই? আপনারা কোথায় বিয়ে করছেন?”
দেবদাস মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ভুলে যাচ্ছেন — আমি এখনো অবিবাহিত। আর যে বিয়ে হচ্ছে, সেটা একটা ভুল পিনকোডের পোস্ট!”
ফোন কেটে সে বসে পড়ল।
এই মিথ্যা নাটক, সোশ্যাল মিডিয়ার হাহাকার, মানুষের রসনা — সব মিলিয়ে সে যেন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
তারপর সে উঠল, নিজের ব্যাগ গোছাতে লাগল।
পরো এল, বলল, “তুই যাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ,” দেবদাস বলল। “আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি এই নাটকে। যে প্রেম একসময় কান্না দিত, এখন সে হাসির খোরাক। আমি ফিরছি না পালাতে, আমি ফিরছি নিজেকে খুঁজতে।”
ঝুমকি এল। মুখে ভেজা চোখ, বলল, “আমি মজা করতে গিয়ে সত্যিই তোকে হারিয়ে ফেললাম?”
দেবদাস বলল, “তুই কিছু হারাসনি। আমি হারাই না। আমি শুধু কাগজে লিখি — যারা পড়ে, তারা হাসে। আমি শুধু এক ভুল ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছিলাম। এখন সেই চিঠিগুলো ফিরিয়ে আনছি।”
রাতের ট্রেনে চেপে দেবদাস চলে গেল।
বগিতে বসে সে নিজের ডায়েরি খুলল, লিখল:
“ভুল ঠিকানায় যে চিঠি গিয়েছিল,
তা ফিরবে একদিন, হয়তো খামে চুমু নিয়ে নয়,
তবে মলিন হেসে —
বলবে, ‘তুইই ছিলি আমার হাসির আসল ঠিকানা।'”
পর্ব ৯: শেষ চিঠি আর নতুন নায়িকা
ট্রেনের জানালার পাশে বসে দেবদাস দূরের অন্ধকারে তাকিয়ে ছিল। গা-ঘেঁষে ছুটে চলেছে গাছপালা, ফসলের মাঠ, কিছু ফিকে আলো। তার ব্যাগে পড়ে আছে সেই ‘ভুল ঠিকানার বিয়ের রসিদ’, একটা পুরোনো কচুরি মোড়া, আর একটি আনফিনিশড কবিতা—যেটা সে শেষ করতে চায়নি।
মনে হচ্ছিল, এই যাত্রাটা যেন কোনো রিটার্ন জার্নি নয়—এ যেন প্রেমের একটা চূড়ান্ত ওভারটাইম, যেখানে ম্যাচ আগেই হেরে গেছে, এখন শুধু উইকেট টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।
হাওড়া স্টেশনে নেমে সে চলে গেল কলেজস্ট্রিটের কাছে একটা পুরোনো হোটেলে। চতুর্থ তলায়, একটা জানালাবিহীন ঘর—ঠিক তার মতোই নিঃশব্দ, নির্বাক।
পরদিন সকালে সে গেল সেই পুরোনো বইয়ের দোকানে, যেখানে তারা পরোর সঙ্গে একসময় ‘সাহিত্যে প্রেম খুঁজে’ ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত।
দোকানের কাচের তাক এখনো আছে, কিন্তু তার ভিতরের বইগুলো সব নতুন — অতীত কোথাও নেই।
তবে দোকানদার চিনে ফেলল।
“এই যে মশাই, আপনি না সেই কবি? দেবদাস বাবু? আপনি তো অনেকদিন পর!”
দেবদাস হাসল, “হ্যাঁ, ফিরে এলাম… ঠিকভাবে হেরেছি কিনা যাচাই করতে।”
তারপর সে একটা চিঠি লিখল।
লাল রঙের স্টেশনারি পেপারে, একদম হাতে লেখা।
প্রিয় পরো,
এই চিঠিটা কোনো উত্তর আশা করে লেখা নয়।
বরং এটা সেই প্রেমের অবশিষ্ট যা কবিতার পাতায় রয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জীবনে ঝরে যায়নি।
আমি জানি, আমরা আর একসঙ্গে হব না। কিন্তু জানি, আমরা আর আগের মতোও নেই।
তুই আজ সুখে আছিস, সেটা আমার জন্য যথেষ্ট।
আর আমি?
আমি একা নই।
আমি এখন সেই মানুষ, যাকে দেখে কেউ হয়তো হাসে, কেউ হয়তো ভাবে — “ভুল সময়ে প্রেমে পড়েছিল।”
কিন্তু জানিস, আমি এখন কবিতা লিখতে পারি, চোখে জল ছাড়াই।
ভালো থাকিস।
তোরই
দেবু
চিঠিটা সে এক সাধারণ খামে ভরল, আর পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজেই হাতে জমা দিল।
ঠিকানাটা লিখল — বনমালী হাউজিং, নারায়ণপুর।
কিন্তু নিচে জুড়ে দিল একটা লাইন —
“ফিরে এসো না, যদি না ফিরে আসতে চাও।”
সন্ধ্যায় সে গেল রবীন্দ্র সদনে — সেখানে চলছিল এক ছোট নাট্যদলের অডিশন।
দেবদাস বলল, “আমি কিছুদিন আগে ‘দেবদাস’-এর প্যারোডি করছিলাম। এখন একটু সিরিয়াস কিছু করতে চাই।”
ডিরেক্টর হাসলেন, “এক্সপ্রেশন ভালো আছে তো? প্রেমের ধাক্কা খেয়ে এসেছেন?”
দেবদাস বলল, “না, প্রেম আমার এক্সপ্রেশন। ধাক্কা নয়, সেটা আমার নাট্যগতি।”
তাকে একটা নতুন স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দেওয়া হল —
“অপরিচিতা: এক রাত্রির রাধা”
মঞ্চে উঠতেই পাশে এসে দাঁড়াল নতুন নায়িকা — চোখে গভীর দৃষ্টি, মুখে সংযত হাসি।
সে বলল, “আমি রাধা। আপনি নিশ্চয় দেবদাস?”
দেবদাস তাকিয়ে বলল, “না, আমি এখন আর দেবদাস নই। আমি এখন কেবল একজন চরিত্র, যে ভালোবাসা হারিয়ে নাটক পেয়েছে।”
রিহার্সাল শুরু হলো।
কিন্তু এইবার দেবদাসের চোখে এক নতুন আলো —
যেটা পরোর অভিমানে ছিল না, ঝুমকির রিলে ছিল না, কেবল এক নির্ভার ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে ছিল।
পর্ব ১০: শেষ দৃশ্য, হাসির আড়ালে যা রয়ে যায়
নাটকের দিন। রবীন্দ্র সদনের মঞ্চ আলোকিত। দর্শকসারিতে জায়গা নেই — সামনে বসে আছেন পাড়ার মানুষ, কলেজের পুরোনো বন্ধু, এমনকি নিউজ চ্যানেল থেকে এসেও কেউ কেউ।
সবাই একটাই কথা বলছে, “এই তো সেই দেবদাস! যে সত্যি প্রেমে হেরেও মঞ্চে জিতেছে!”
স্টেজের ওপারে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেবদাস। গায়ে সাদা ধুতি, কালো পাঞ্জাবি, হাতে এক খণ্ড কবিতা।
পাশে দাঁড়িয়ে নতুন সহ-অভিনেত্রী — রাধা, যে এখন শুধুই রাধা নয়, দেবদাসের জীবনের এক অদ্ভুত নিঃশব্দ সঙ্গিনী।
সে ফিসফিস করে বলল, “আজ ভয় লাগছে?”
দেবদাস মুচকি হেসে বলল, “না, আজ কিছু হারাবো না। কারণ আজ আমি কাউকে জিতিয়ে দিতে আসিনি — আমি শুধু বলবো, আমি আছি।”
নাটক শুরু হল।
অভিনয়ে না, যেন নিজের জীবনটাকেই অভিনয়ের পর্দায় রেখে দিল দেবদাস।
যখন তার চরিত্র বলে —
“তুমি চলে যাওনি, আমি নিজেই হারিয়ে গেছি। তুমি ভুল করোনি, আমি শুধু সময়টা ঠিক বেছে নিতে পারিনি।”
— হলঘর নিঃশব্দ। কেউ হাসছে না, কেউ কাঁদছেও না। শুধু শোনার মতো শোনার অভ্যাস ফিরিয়ে এনেছে সবাই।
শেষ দৃশ্যে দেবদাস স্টেজের এক কোণে বসে থাকে, চুপচাপ।
হালকা আলো পড়ে মুখে, আর শেষ সংলাপ—
“তোমরা যাদের ভালোবেসেছ, তারা হয়তো চলে গেছে।
কিন্তু যাদের ভেবেছো হারিয়ে গেছে, তারা এখনো তোমাদের ভালোবাসে—
তোমাদের অজান্তে, তোমাদের অনুপস্থিতিতে।”
পর্দা নামল।
তালির ঝড়।
নিউজ রিপোর্টাররা মাইক ঠেলে এগিয়ে এল, “দেবদাসদা, আপনার জীবনের গল্পটা কি আজ আপনি শেষ করলেন?”
দেবদাস মুচকি হেসে বলল, “না, আমি আজ শুরু করলাম। কারণ আমার জীবনের নাটকটা কেবল প্রেম নয় — সেটার মধ্যে হাসিও আছে, ব্যর্থতার ভিতরেও উচ্ছ্বাস আছে।”
ঠিক তখন, পিছন থেকে কেউ ডাকল —
“দেবু!”
সে ঘুরে দেখল — পরো।
সাদা শাড়িতে, চোখে সেই পুরোনো নরম চাহনি, পাশে অরূপ।
অরূপ এগিয়ে এসে বলল, “তুমি আমাদের জীবনে ফিরে এসে অনেকটা ফিরিয়ে দিয়েছ। অনেকটা হেরে গিয়েও তুমি শিখিয়েছো — ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়।”
পরো একটু এগিয়ে এসে বলল, “তুই জানিস, আমি সেই চিঠিটা পড়েছি।
যেটা তুই বলেছিলি — ফিরিস না, যদি না ফিরতে চাস।
আমি ফিরিনি। কারণ তুই নিজেই ফিরে গিয়েছিলি নিজের ভিতরে।
তুই এখন আর আমার প্রেমিক নোস — তুই এখন আমার গল্পের শেষ পৃষ্ঠা।”
দেবদাস মুচকি হেসে বলল, “আর তুই আমার গল্পের কভারে আছিস — প্রতিদিন দেখি, ছুঁই না।”
হলঘরের বাইরে সবাই ছবি তুলছে। ঝুমকি এসে একখানা নতুন রিল বানাতে চাইছে।
রাধা পাশে এসে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে দেবদাসের হাতটা ধরে বলল,
“এবার চল, একটা চায়ের দোকান খুঁজে নিই — যেখানে কেউ তোর পরিচয় জানে না।”
দেবদাস তাকাল তার দিকে।
হালকা চাওয়া, নির্জন ভরসা, কোনো তাড়া নেই।
সে হাঁটতে শুরু করল। একদম ধীরে, রাধার সঙ্গে।
চারপাশে আলো, ক্যামেরা, স্মৃতি।
আর ভিতরে ভিতরে শুধু একটা কথা:
“আমি দেবদাস — তবে সেই নয় যে মরেছিল ভালোবাসায়,
আমি সেই, যে বেঁচে গেছে—একটা হাসির আড়ালে, আর একটা প্রেমের অতিরিক্ত দৃশ্যের পরে।”
শেষ
				
	

	


