Bangla - ভূতের গল্প

দেওয়ালের আঁকিবুকি

Spread the love

জয়ন্ত চক্রবর্তী


অধ্যায় ১ – নতুন বাড়ি

অর্পিতা নতুন ভাড়া বাড়িতে ওঠার দিনটি ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির। শহরের রাস্তায় গাড়ি, মানুষ আর চেনা ভিড়ের মধ্যে থেকে বের হয়ে নতুন ঠিকানায় পৌঁছানো, মনে একধরনের অচেনা উত্তেজনা এবং অজ্ঞাত ভয়ের সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। বাড়ির বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, এটি যেন এক সাধারণ, পুরনো শহরের বাড়ি—সাদা দাগ, ছেঁড়া রঙের দেয়াল, এবং অল্প গাছপালার ছায়া—কিন্তু ভেতরে ঢুকেই সবকিছু বদলে যায়। লম্বা করিডর, ফাঁকা ঘরের নিস্তব্ধতা এবং ধুলোমাখা জানালার কাচের মাঝে ধীরে ধীরে রোদ পড়া, তার মনকে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি দিয়ে ভরিয়ে দেয়। অর্পিতা ভাড়া বাড়িতে ওঠার আগে যেমন অনেক সময় চিন্তিত ছিল, নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কতটা সহজ হবে—সেই ভয় তার মনে অবচেতনভাবে কাজ করছিল। করিডরের দেওয়ালে পুরনো ছবির ফ্রেম, ধুলোমাখা দরজা, বারান্দার কাঁচের ফাটল—সবকিছু যেন এক নির্জন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি প্রথমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালেন; পাশের বাড়ির ছাদে উঠতে থাকা ধোঁয়া, নীচের রাস্তায় খেলা করা শিশুদের হাসি—সবকিছু তার মনকে এক অদ্ভুতভাবে শান্ত করে। এই বাড়ি যেন শুধু চার দেয়াল নয়, বরং একটি গল্প, যা তার নতুন জীবন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আলিঙ্গন করছে।
ভেতরে ঢুকেই অর্পিতা অনুভব করলেন, ফাঁকা ঘরগুলো কেবল নিস্তব্ধ নয়, বরং যেন নিজের ভেতরের ছায়ার প্রতিচ্ছবি ধারণ করছে। তিনি একটি কোণে বসে দরজা বন্ধ করলেন এবং নিজের দৃষ্টির মাধ্যমে ঘরের প্রতিটি কোণ খুঁটিয়ে দেখলেন—দেয়ালের আভ্যন্তরীণ রঙ, ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক তার, পুরনো আলমারি, এবং মেঝেতে পড়ে থাকা সূর্যের আলো—সবকিছু যেন এক ধরণের নীরব পরিচয় তৈরি করেছিল। এই নিস্তব্ধতা তাকে প্রথমে অস্বস্তি দেয়, মনে হয় যেন ঘরটি তার প্রতি কোনো কথাই বলছে না। কিন্তু ধীরে ধীরে তার মন শান্ত হতে থাকে, তিনি ভাবতে থাকেন যে এই শূন্যতা তাকে নিজের ভেতরের কথা শোনার সুযোগ দিচ্ছে। তিনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালেন, যেখানে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে, এবং হঠাৎ করেই একটি ঝড়ের আগে বাতাসের হালকা কম্প—সবকিছু মিলিয়ে তার ভেতরের অস্থিরতা কিছুটা প্রশমিত হল। এই নতুন বাড়ি যেন তার জন্য একটি আত্মিক অবকাশ তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি কোণা, প্রতিটি খোলা জানালা তাকে নিজের চিন্তা এবং অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত করছে।
দিনের শেষের দিকে, অর্পিতা ঘরটি আরো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। প্রতিটি আলমারি খুলে দেখলেন, ফাইল ও কাগজের গন্ধ, পুরনো কাপড়ের গন্ধ—সবই তাকে অদ্ভুতভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বারান্দার ধুলোমাখা মাচায় বসে তিনি শহরের দূরের শব্দ শুনলেন—গাড়ির হর্ন, বাজারের কোলাহল, মানুষজনের কথোপকথন—এবং অনুভব করলেন, এই শহরও যেন তার নতুন জীবনের অংশ হয়ে উঠছে। কিন্তু ভেতরের শান্তি এতটাই গভীর যে এই বাইরের শব্দগুলো তার মনের মধ্যে ঢোকার আগে যেন থমকে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার আলো ভেতরের দেয়ালে পড়তে শুরু করলে ঘরটির পুরনো রঙ নতুন রূপে ফুটে ওঠে, আর অর্পিতার মনে এক ধরণের আভ্যন্তরীণ উচ্ছ্বাস জাগে। তিনি বুঝতে পারেন, নতুন বাড়ি শুধু একটি ঠিকানা নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত তাকে নতুনভাবে চিনতে সাহায্য করবে। এই প্রথম দিন শেষে তিনি তার বালিশে মাথা রেখে ভাবলেন, হয়তো এই নিস্তব্ধতা, এই ফাঁকা ঘর, এবং এই অচেনা পরিবেশই তার জীবনের নতুন গল্পের সূচনা—যা তাকে চ্যালেঞ্জ করবে, ভয় দেখাবে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।

অধ্যায় ২ – প্রথম আঁকিবুকি

নতুন বাড়িতে ওঠার পরের প্রথম ভোর অর্পিতার জন্য এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ালো। তিনি তার ঘুম ভেঙে উঠে খোলা জানালার দিকে তাকালেন, যেখানে ভোরের সূর্য ঢেউয়ের মতো কাচের খাঁচা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। ঠিক তখনই তাঁর নজর পড়ে দেয়ালে—একটি ছোট্ট আঁকা। চক দিয়ে অতি সরলভাবে আঁকা একটি ফুল এবং পাশে একটি হাসিখুশিপূর্ণ বল। প্রথমে তিনি হালকা হাসলেন, মনে করলেন হয়তো আগের ভাড়াটে পরিবারের শিশু বা পাশের বাড়ির ছোট কোনো ছেলে-মেয়ে খেলতে খেলতেই এই আঁকাটি করে গিয়েছে। ঘরের নিস্তব্ধতা এবং এই অপ্রত্যাশিত রঙের উপস্থিতি তার মনকে হঠাৎ করেই একটু হালকা করে দিল। তিনি ঘরে চারপাশ ঘুরে দেখলেন—কেউ না, কোনো খেলার উপকরণ নেই, শুধু সেই ছোট্ট আঁকা। অর্পিতা ভাবলেন, “শিশুরা কত সহজভাবে নিজের আনন্দ প্রকাশ করতে পারে,” এবং কিছুটা কৌতূহল নিয়ে এই ছবিকে খুব কাছ থেকে দেখলেন। কিন্তু এই প্রথম দেখা ছবিটিতে তার মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি জেগে উঠল—এক ধরনের অচেনা স্নেহময় এবং রহস্যময় স্নায়ু।
পরের দিন সকালে অর্পিতা আবার ঘুম থেকে উঠলেন। তার দৃষ্টিতে একটি অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল—আজও কি কোনো আঁকা থাকবে? তিনি ঘরে ঢুকে প্রথমে ফ্রেম, আলমারি, জানালা পরীক্ষা করলেন, কিন্তু সব কিছু আগের মতোই শান্ত। তারপর নজর পড়ল দেয়ালে—আরও একটি নতুন ছবি। এবার তা শুধু একটি ফুল বা বল নয়, বরং একটি পুরো ছোট্ট দৃশ্য—একটি ঘোড়া, আকাশের সঙ্গে সাদা মেঘ, এবং কিছু রঙিন ছোঁয়া যা আগের দিনের সরল চিত্রের তুলনায় অনেক জটিল। অর্পিতার মন হঠাৎ জোরে কৌতূহলে ভরে উঠল। তিনি ভাবলেন, “এটা কি কোনো শিশু করছে, নাকি কেউ অন্য কেউ? কেউ কি জানে আমি এখানে রয়েছি?” ঘরটি আগের চেয়ে আরও রহস্যময় মনে হতে লাগল। তিনি ধীরে ধীরে দেয়ালের কাছে গিয়ে ছবিগুলো দেখলেন, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ছোঁয়া গভীরভাবে মনোযোগ দিলেন। ছবিগুলো শুধু রঙ নয়, বরং যেন একটি গল্প বলছে—একটি গল্প যা কেউ বোঝাতে চাচ্ছে, কিন্তু সে নিজেই সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। অর্পিতা অনুভব করলেন, তার চারপাশের নিস্তব্ধতা এবং এই নতুন আঁকাগুলো এক অদৃশ্য সংযোগ তৈরি করছে, যা তার নিজের ভেতরের কৌতূহল এবং অজ্ঞাত অনুভূতির সঙ্গে মিলিত হচ্ছে।
তৃতীয় দিন, অর্পিতা ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারলেন, আজও কোনো নতুন আঁকা আছে। এবার তা আরও বিস্তারিত এবং জটিল—ছোট্ট একটি চাঁদের নীচে ফুলে ভরা বাগান, যেখানে দুটি ছোট পাখি উড়ছে। তিনি প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেন। ভেবে উঠলেন, কেউ কি তার ঘরে আসছে? কিন্তু আশেপাশে কোনো মানুষের উপস্থিতি নেই। তারপর ধীরে ধীরে তিনি বুঝলেন, এই আঁকাগুলো কেউ খারাপ ইচ্ছা নিয়ে করছে না, বরং এটি যেন একটি ছোট্ট প্রাণের অদ্ভুত ভালোবাসা এবং সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ। অর্পিতার মন জিজ্ঞাসায় ভরে গেল—কেউ কি প্রতিদিন তার জন্য এই চিত্র আঁকছে? তিনি ভাবলেন, “এখনই হয়তো সময় এসেছে বোঝার যে, এই বাড়ি শুধু চার দেয়াল নয়, বরং এখানে কিছু জীবনের উপস্থিতি আছে, যা শুধুমাত্র আমার চোখে ধরা দিচ্ছে।” তিনি কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে বসে পড়লেন, যেন নিজেও কোনো ছবি আঁকতে চায়, এই অদ্ভুত সংযোগকে আরও ঘনিষ্ঠ করতে। সেই প্রথম ভোরের আঁকিবুকি অর্পিতার জীবনকে এক রহস্যময় দিক দেখাল—যা তাকে ভয়ের মধ্যে আনন্দ, নিস্তব্ধতার মধ্যে companionship, এবং নতুন বাড়ির প্রতি এক অদ্ভুত প্রীতি অনুভব করাতে লাগল।

অধ্যায় ৩ – অদৃশ্য হাতের খেলা

নতুন বাড়িতে অর্পিতার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিটি ভোর তার জন্য এক অদ্ভুত রহস্য নিয়ে আসছিল। প্রতি সকালে ঘুম ভেঙে উঠে তিনি দেখতেন দেয়ালে নতুন নতুন আঁকিবুকি। কখনও চক দিয়ে আঁকা সরল ফুল, কখনও হাসিমুখের বল, আবার কখনও পুরো দৃশ্য—ছোট্ট একটি গাছ, লাল পাখি, কখনও আবার একটি খেলনা গাড়ি রাখা হয়ে যেত টেবিলের এক কোণে। প্রথম প্রথম অর্পিতা এগুলোকে সাধারণ শিশুর খেলার অংশ মনে করতেন। কিন্তু দিন যেতেই বিষয়টি ধীরে ধীরে অদ্ভুত হয়ে উঠল। কোনো খেলার উপকরণ, কোনো ছোট হাতের দাগ, বা আশেপাশে কোনো শিশু দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। অর্পিতার মন কৌতূহলে ভরে উঠল—এই সব অদ্ভুত চিহ্ন, এই নিঃশব্দ উপস্থিতি, সত্যিই কি কোনো শিশুর হাতের কাজ? কিংবা এটি কোনো অন্যরকম শক্তির খেলা? প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি যেন তাকে এক অদ্ভুত সংযোগের দিকে টানছিল, যেখানে সে নিজেই বুঝতে পারছিল না, এটি শুধুই খেলা নাকি এক ধরনের আহ্বান।
দিনের পর দিন একই ঘটনা ঘটতে থাকল। অর্পিতা ঘরে প্রবেশ করলেই দেয়ালের ছবিগুলোকে দেখতেন, আবার কখনও টেবিলের উপরে ছোট্ট খেলনা গাড়ি, কখনও আবার মাটিতে ছড়িয়ে থাকা রঙিন পেন্সিল। তিনি একরকম সতর্ক হয়ে উঠলেন, চারপাশ ঘুরে দেখলেন—কেউ কি তার ঘরে ঢুকছে? কিন্তু প্রতিবারই কিছুই পাওয়া গেল না। প্রথমে তিনি ভাবলেন, হয়তো পূর্বের ভাড়াটের শিশুরা এখনও এখানে আসে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তার সন্দেহ বাড়তে লাগল। কেউ না থাকলেও, প্রতিটি আঁকিবুকি আগের তুলনায় আরও জীবন্ত এবং বিস্তারিত হয়ে উঠছিল। ফুলের পাপড়ি যেন সত্যিই ঘ্রাণ ধরার মতো, পাখির চোখ যেন তার দিকে তাকাচ্ছিল। অর্পিতা বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ খেলার অংশ নয়। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ছোটো পদক্ষেপ যেন তার সঙ্গে কথা বলছে—একটি অদৃশ্য সঙ্গীর উপস্থিতি, যা তার দৈনন্দিন জীবনকে ধীরে ধীরে ভিন্ন রূপে ভরিয়ে দিচ্ছিল।
একদিন অর্পিতা ঠিক করলেন, এই রহস্যের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি পুরো ঘরটি এক নজরে পর্যবেক্ষণ করলেন—বারান্দা, করিডর, আলমারি, জানালা, ফ্লোর—সব জায়গা খুঁটিয়ে দেখা গেল। তারপর হঠাৎ চোখ পড়ল দেয়ালের এক কোণে নতুন আঁকা ছবির ওপর। এবার তা শুধু ফুল বা বল নয়, বরং একটি ছোট্ট হাতের চিহ্ন এবং কিছু অদ্ভুত অক্ষর। অর্পিতার হৃদয় দ্রুত ধুকপুক করতে লাগল। সে বুঝতে পারল, যে এই আঁকিবুকি আসলেই কোনো শিশুর কাজ নয়, বরং যেন এক অদৃশ্য শক্তি তার সামনে নিজেকে প্রকাশ করছে। সেই মুহূর্তে তিনি ভয়ে ভরপুর হলেও, কৌতূহল এবং একরকম মুগ্ধতাও অনুভব করলেন। মনে হচ্ছিল, এই অদৃশ্য হাত তার জীবনের সঙ্গে খেলছে, তাকে পরীক্ষা করছে, এবং একই সঙ্গে তার মনে এক ধরনের অদ্ভুত সঙ্গীতের ছন্দ তৈরি করছে। অর্পিতা সিদ্ধান্ত নিলেন, শুধু দেখলেই হবে না—তিনি এই রহস্যের সঙ্গে নিজের সংযোগ তৈরি করবেন। আর এই মুহূর্ত থেকে, তার প্রতিটি ভোর হয়ে উঠল এক অদ্ভুত খেলার স্থান, যেখানে অদৃশ্য শক্তি এবং তার কৌতূহল মিলিত হয়ে তৈরি করেছিল এক নতুন অধ্যায়—যা শুধুমাত্র তাকে নয়, বরং পুরো বাড়িটাকেও এক অদ্ভুত জীবন্ত রূপ দিচ্ছিল।

অধ্যায় ৪ – গোবিন্দর সতর্কবার্তা

নতুন বাড়ির রহস্য ক্রমে অর্পিতার মনে গভীর কৌতূহল এবং অল্প অস্বস্তি জাগাচ্ছিল। প্রতিদিন ভোরে নতুন আঁকিবুকি, কখনও ফুল, কখনও বল, আবার কখনও খেলনা—সবই যেন একটি অদৃশ্য উপস্থিতির নীরব আহ্বান। সেই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে, বাড়ির বৃদ্ধ সেবক গোবিন্দকে খুঁজে বের করা অর্পিতার কাছে জরুরি হয়ে উঠল। গোবিন্দ ছিলেন চেহারায় শান্ত, কিন্তু চোখে অতীতের অভিজ্ঞতা আর সময়ের ভারবহন করা মানুষের দার্শনিক ভাব। তিনি অর্পিতার কৌতূহল লক্ষ্য করেই ধীরে ধীরে বলেন, “ওগুলো শুধু আঁকিবুকি নয়, বাচ্চার ডাক।” প্রথমে অর্পিতা বুঝতে পারেননি—সে কি ঠিক শুনছে? কিন্তু গোবিন্দের স্বরে এমন এক গভীর সতর্কতা এবং দৃষ্টি ছিল, যা তার কৌতূহলকে ভয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিল। তিনি অর্পিতার কাছে বসে, ধীরে ধীরে বাড়ির ইতিহাস খুলে বলতে লাগলেন—অনেক বছর আগে এই বাড়িতে এক শিশু মারা গিয়েছিল, এক অল্প বয়সী শিশুর জীবন হঠাৎভাবে শেষ হয়েছিল, কিন্তু তার উপস্থিতি যেন বাড়ির প্রতিটি কোণে আজও মিশে আছে।
গোবিন্দের কথায় অর্পিতার হৃদয় কেঁপে উঠল। তিনি ভাবলেন, এতদিন ধরে সে যে শুধু নীরবতা এবং ফাঁকা দেয়াল দেখছিল, তা আসলে এক অদৃশ্য আত্মার উপস্থিতি। গোবিন্দ আরও বলেন, “এই বাচ্চা যে খুঁজে পাচ্ছে তার সঙ্গে খেলা করছে, সে চাইছে তার কল্পনা ও অনুভূতি দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে।” অর্পিতা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন, প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি এবং খেলনা কেবল একটি খেলার অংশ নয়, বরং এক ধরনের আহ্বান, যা তার দিকে পাঠানো হচ্ছে। অদ্ভুতভাবে তিনি অনুভব করলেন, ভয় এবং কৌতূহল একসাথে তার মনে বিরাজ করছে। গোবিন্দ বললেন, “সাবধানতা অবলম্বন করো, অর্পিতা। তবে ভয় পেও না। সে শিশুটি তোমাকে ভয় দেখাতে চাইছে না। তার দরকার শুধু মনোযোগ, বোঝাপড়া এবং একটু স্নেহ।” এই কথাগুলো অর্পিতার মনে নতুন এক দায়িত্বের বোধ জাগিয়ে দিল।
গোবিন্দের সতর্কবার্তার পরে অর্পিতা আরও খুঁটিয়ে বাড়ি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন। তিনি দেখলেন, প্রতিটি আঁকিবুকি, প্রতিটি খেলনা, এবং প্রতিটি ছোট ছোট চিহ্ন যেন তার সঙ্গে কথা বলছে। তিনি বুঝতে পারলেন, শুধু দেখলেই হবে না—তার উচিত এই অদৃশ্য শিশুর উপস্থিতিকে স্বীকার করা এবং তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। গোবিন্দ আরও বলেন, “পুরনো স্মৃতিগুলো কখনও মুছে যায় না, শুধু সময়ের আবরণে ঢাকা থাকে। তুমি যদি মনোযোগ দাও, তুমি তাদের শুনতে পারবে।” এই কথাগুলো অর্পিতার মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এবং কৌতূহল উভয়ই তৈরি করল। সে বুঝতে পারল, এই বাড়ি শুধু একটি স্থাপন নয়, বরং একটি জীবন্ত ইতিহাস, যেখানে অতীতের নীরব চিহ্নগুলি আজও তার সঙ্গে সংযুক্ত। অর্পিতা স্থিরভাবে অনুভব করলেন, সে শুধু একজন ভাড়াটে নয়—সে এক অদৃশ্য বন্ধুর উপস্থিতি এবং একটি জীবন্ত রহস্যের অংশ। সেই থেকে তার প্রতিটি দিন, প্রতিটি ভোর, এবং প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি হয়ে উঠল এক ধরনের অদ্ভুত, কিন্তু সৌন্দর্যপূর্ণ সংযোগের খেলা, যেখানে অদৃশ্য শিশুটি এবং অর্পিতার মন মিলিত হয়ে তৈরি করছিল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

অধ্যায় ৫ – অনিরুদ্ধর গল্প

গোবিন্দের সঙ্গে কথোপকথনের পর অর্পিতার মনে কৌতূহল এবং এক অদ্ভুত উদ্দীপনা জেগে উঠেছিল। সে চাইছিল সবকিছু বোঝার, সব রহস্যের মুখোমুখি হওয়ার। সেই সময় গোবিন্দ ধীরে ধীরে অর্পিতাকে অনিরুদ্ধের গল্প বললেন। “শিশুটির নাম অনিরুদ্ধ,” তিনি শুরু করলেন। অর্পিতার কণ্ঠে অবচেতনভাবে একটা থমথমে ভাব কাজ করতে লাগল। অনিরুদ্ধ—একটি নাম যা তার কানে প্রথমবারে সহজ মনে হলেও, গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে এক অদ্ভুত ভার বহন করছিল। গোবিন্দ বলেন, অনিরুদ্ধ সেই শিশু যে বহু বছর আগে এই বাড়িতে খেলতে খেলতে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। তার মৃত্যু একটি অপ্রত্যাশিত এবং মর্মান্তিক ঘটনা ছিল। কিন্তু এই মৃত্যুর মধ্যেও একটি অদ্ভুত শান্তি এবং নিরবতা বিরাজ করেছিল, যেন সে শুধু চলে গেছে না, বরং তার উপস্থিতি আজও বাড়ির প্রতিটি কোণায় বেঁচে আছে। অর্পিতা গোবিন্দের কথায় মনোযোগ দিয়ে শুনল, চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা আর কৌতূহল জেগে উঠল। সে বুঝতে পারল, প্রতিটি ভোরে দেয়ালে দেখা নতুন আঁকিবুকি শুধু খেলা নয়, বরং অনিরুদ্ধের নিজের উপস্থিতি এবং তার ভেতরের আবেগের প্রকাশ।
গোবিন্দ আরও বললেন, “অনিরুদ্ধ খুব খেলাধুলা ভালোবাসত। প্রতিটি ভোরে সে দেয়ালে খেলনার ছবি আঁকতে চাইছে, যেন সে আবারও খেলতে পারে, আবারও তার আনন্দের ছোঁয়া ছড়িয়ে দিতে পারে।” অর্পিতার মনে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল, এই ছোট্ট শিশুটি কেবল তার নিজের আনন্দের জন্য নয়, বরং অর্পিতার দিকে দৃষ্টি রাখছে, যেন সে তার সঙ্গী খুঁজছে। প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রঙিন ছোঁয়া যেন তাকে বলছে—“আমি এখানে আছি, আমি হারাইনি।” অর্পিতা প্রথমে ভয় পেলেও ধীরে ধীরে সে এই ভয়ের মধ্যে মুগ্ধতা এবং এক ধরনের দায়িত্ববোধ অনুভব করতে লাগল। অনিরুদ্ধের উপস্থিতি তার জীবনে এক অদ্ভুত রূপ নিয়েছিল—একদিকে রহস্যময়তা, অন্যদিকে মৃদু আনন্দের ঝিকিমিকি।
দিনের পর দিন অর্পিতা অনিরুদ্ধের এই অদৃশ্য খেলার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করল। প্রতিটি ভোরে দেয়ালে নতুন ছবি দেখলেই সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, অনিরুদ্ধের অনুভূতি এবং কল্পনা তার নিজের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। সে জানত, অনিরুদ্ধ আর ফিরে আসবে না, কিন্তু তার আত্মার ছোট্ট খেলা প্রতিদিন তাকে নতুনভাবে স্পর্শ করছে। অর্পিতা এই বিষয়টি নিজের মনে গোপনভাবে গ্রহণ করল—এই নতুন বন্ধুত্ব, এই অদৃশ্য সংযোগ, তার জীবনে এক ধরনের শান্তি এবং কৌতূহলের জন্ম দিচ্ছে। গোবিন্দের সতর্কবার্তার কথাগুলো মনে করছিল, “সাবধানতা রাখো, কিন্তু ভয় পেও না। সে শুধু খেলার জন্য এখানে আছে।” এই ভাবনা অর্পিতাকে অনিরুদ্ধের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিচ্ছিল, যেন প্রতিটি ভোর, প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি তাকে এক নতুন অধ্যায়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে—যেখানে অতীতের ক্ষত এবং অদৃশ্য শিশু কল্পনা মিলিত হয়ে তৈরি করছে এক নতুন মানসিক জগৎ, যা শুধুমাত্র অর্পিতার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে।

অধ্যায় ৬ – অর্পিতার মমতা

অনিরুদ্ধের গল্প শুনার পর অর্পিতার মন অদ্ভুতভাবে বদলে যেতে থাকে। আগে তিনি প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি দেখতে ভয়ের মধ্যে পড়ে যেতেন, তবে ধীরে ধীরে তার মনে এক ধরনের কোমলতা ও মমতা জাগে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই ছোট্ট অদৃশ্য শিশু শুধুই খেলার জন্য ছবি আঁকছে, কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য হলো সঙ্গী খুঁজে পাওয়া, কারো কাছে নিজের অনুভূতি পৌঁছে দেওয়া। একদিন ভোরে নতুন ছবি দেখে তিনি ভাবলেন, “আমি কি এটাকে ফেলে দিতে পারব? না, এটি শুধু ছবি নয়—একটি জীবনের স্পর্শ।” তাই তিনি প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি সরিয়ে ফেললেন না। বরং একটি খাতায় টুকে রাখলেন। প্রতিটি চিত্র, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি খেলনা—সবই যেন তার কৌতূহল এবং মমতার সঙ্গে এক ধরণের সংযোগ তৈরি করছিল। অর্পিতার মন ভাবতে লাগল, অনিরুদ্ধ যেন শুধু তার দিকে তাকিয়ে না, বরং তার আস্থা এবং অনুভূতির প্রতিফলন চাইছে। সেই অনির্দিষ্ট উপস্থিতি তার জীবনের নিঃশব্দ কণ্ঠকে স্পর্শ করছিল, এবং অর্পিতার মমতা এই স্নেহময়ী আহ্বানকে গ্রহণ করতে বাধ্য করছিল।
এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অর্পিতা নিজের মায়ের কথা মনে করলেন। ছোটবেলায় তিনি তার মায়ের কাছে শুনেছেন, “শিশুর হাসি বা কান্না কখনো অকারণ হয় না। প্রতিটি অনুভূতি একটি বার্তা বহন করে।” এই স্মৃতি তার মনের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে অনিরুদ্ধের দিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলল। সে বুঝতে পারল, প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি, প্রতিটি রেখা—সবই একটি বার্তা, একটি অনুভূতি যা সে শুধুমাত্র দেখলেই বা উপেক্ষা করলে বোঝা সম্ভব নয়। অর্পিতার মনে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি জাগল যে, এই শিশু হয়তো আজও জীবনের সঙ্গী খুঁজছে—কেউ যেন তার উপস্থিতি অনুভব করে, তাকে দেখে এবং তার খেলার অংশ হতে চায়। তাই অর্পিতা শুধু চুপচাপ খাতায় আঁকাগুলো সংরক্ষণ করছিলেন, যেন একদিন যখন সময় এবং সাহস মিলবে, সে আরও গভীরভাবে অনিরুদ্ধের গল্প এবং অনুভূতির সঙ্গে সংযোগ করতে পারে।
দিন দিন অর্পিতার মমতা আরও গভীর হয়। প্রতিটি ভোরে নতুন আঁকিবুকি দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। সে বোঝে, শুধু সংরক্ষণ করলেই হবে না, বরং একটি অদৃশ্য বন্ধুত্বের সংযোগ বজায় রাখা জরুরি। অর্পিতার জীবনের নিঃশব্দতা এবং একাকীত্বের মাঝে এই খাতার পাতাগুলো হয়ে উঠল নতুন আলো—একটি সংরক্ষিত উপস্থিতি যা তার হৃদয়কে অদৃশ্য শিশুর সাথে একত্রিত করে। সে বুঝতে পারে, কখনও কখনও মমতা কেবল অনুভূতি নয়, বরং এক ধরনের দৃষ্টি, একটি সংযোগ যা মানুষকে এবং অদৃশ্য আত্মাকে একত্রিত করে। এই উপলব্ধি অর্পিতাকে আরও দৃঢ় ও সাহসী করে তুলল, এবং প্রতিটি ভোর, প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি তার জন্য হয়ে উঠল এক ধরনের খোলা দরজা—যেখানে সে তার মমতা, স্নেহ এবং সংবেদনশীলতা দিয়ে অনিরুদ্ধের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।

অধ্যায় ৭ – প্রতীকের আগমন

নতুন বাড়ির অদ্ভুত রহস্য ক্রমে অর্পিতার মনকে উত্তেজনা এবং অস্বস্তি দুটোই দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিল। অনিরুদ্ধের প্রতিদিনের আঁকিবুকি, খেলনা গাড়ি এবং অদৃশ্য উপস্থিতি তার কাছে শুধুই কৌতূহলপূর্ণ নয়, বরং এক অদ্ভুত দায়িত্বের মতো হয়ে উঠেছিল। সে ভাবছিল, এই সবকিছুকে কেবল নিজের চোখে দেখলেই হবে না, বরং কাউকে জানানো দরকার—যে কেউ যুক্তিবাদী, বাস্তববাদী, যিনি হয়তো তার ভয়ের সঙ্গে যুক্তির আলোও দেখাতে পারবেন। সেই ভাবনায় অর্পিতা তার সহকর্মী প্রতীকের কথা মনে করল। প্রতীক ছিলেন মানুষিকভাবে যুক্তিবাদী, সবকিছু যুক্তি এবং বাস্তবতার আলোকে দেখার চেষ্টা করে। অর্পিতা প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়লেন, মনে করলেন, এই অদৃশ্য শিশু এবং তার আঁকাবুকি নিয়ে প্রতীকের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। কিন্তু একদিন সাহস জুগিয়ে, তিনি প্রতীককে সব কিছু জানালেন—অনিরুদ্ধের গল্প, প্রতিদিনের আঁকিবুকি, এবং সেই নিঃশব্দ খেলার উপস্থিতি।
প্রতীক প্রথমে কিছুটা অবাক এবং সন্দিহান হলো। সে প্রতিটি ঘটনা যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে চাইল—“এই সব কি প্রকৃত শিশুর কাজ না কোনো ভ্রমন? কেউ কি চুপচাপ ঢুকছে এবং ছবি করছে?” কিন্তু অর্পিতার সঙ্গে ঘরে এসে সে নিজ চোখে দেখল, প্রতিটি ভোরে দেয়ালে নতুন ছবি, খেলনা এবং রঙের ছোঁয়া অদ্ভুতভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। প্রতীক অবাক হয়ে ভাবল, “যদি এটি কেবল কোনো সাধারণ ঘটনা হতো, তাহলে এত নিখুঁত ও অবিচল ক্রম কি হয়?” তার যুক্তিবাদী মনকে অবলম্বন করেও সে বুঝতে পারল, এই ঘটনার পেছনে কিছু অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে, যা চোখে ধরা পড়ছে। সেই সঙ্গে তার মনে এক অদ্ভুত দায়িত্ব জাগল—কিভাবে এই অদৃশ্য শিশুর উপস্থিতিকে শান্ত করা যায়, যেন সে তার খেলার মাধ্যমে শান্তি খুঁজতে পারে। প্রতীক অর্পিতার সঙ্গে মিলিত হয়ে ভাবল, শুধু ভয় বা কৌতূহল দেখলে হবে না, বরং একটি কার্যকরী উপায় বের করতে হবে, যা অদৃশ্য শিশুটিকে নিরাপদ এবং সন্তুষ্ট রাখতে সাহায্য করবে।
অর্পিতা ও প্রতীক ধীরে ধীরে একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে লাগল। তারা বুঝতে পারল, অনিরুদ্ধ কেবল সঙ্গী খুঁজছে এবং তার খেলার মাধ্যমে বার্তা পাঠাচ্ছে। প্রতীকের যুক্তি ও অর্পিতার সংবেদনশীলতা মিলিত হয়ে একটি নতুন দিক তৈরি করল—কিভাবে অদৃশ্য শিশুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়, কিভাবে তার অনুভূতি বোঝা যায় এবং তাকে শান্ত করা যায়। প্রতীকের চোখে অদ্ভুত এক আস্থা এবং অর্পিতার মমতাময়ী মনোভাব একত্রে অদ্ভুত সাহস তৈরি করল। তারা বুঝতে পারল, প্রতিদিনের এই নতুন আঁকিবুকি শুধু নিছক খেলা নয়, বরং এক ধরনের আহ্বান—যার প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এই উপলব্ধি অর্পিতাকে আরও দৃঢ় এবং সচেতন করে তুলল, এবং প্রতীকের যুক্তিবাদী মনও প্রমাণ করল যে কখনও কখনও বাস্তবতা এবং অতীতের রহস্য একত্রে কাজ করে—মানুষ এবং অদৃশ্য শক্তি দুটোকে সংযুক্ত করতে। সেই দিন থেকে, অর্পিতা এবং প্রতীক মিলিতভাবে অনিরুদ্ধের উপস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল, প্রতিটি ভোরের নতুন আঁকিবুকি তাদের জন্য হয়ে উঠল এক অদৃশ্য আলো, যা রহস্য, সতর্কতা এবং সংযোগের নতুন অধ্যায় খুলে দিচ্ছিল।

অধ্যায় ৮ – খেলার আমন্ত্রণ

এক রাত অর্পিতার ঘুম ছিল গভীর, তবে অদ্ভুতভাবে স্বপ্নময়। ঘরটি নিস্তব্ধ, জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা চাঁদের আলো ভেতরে ঢুকছিল, এবং বারান্দার বাতাসে কেবল পাতা ও ফুলের মৃদু গন্ধ ভেসে আসছিল। হঠাৎ সে স্বপ্নে দেখে একটি ছোট ছেলে, অনিরুদ্ধ, তার ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে। তার চোখে এক অদ্ভুত সরলতা এবং নির্ভীকতা, যেন সে বলছে—“আমি এখানে আছি, আমাকে দেখ।” অর্পিতার মন হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও, শিশুটির কোমল উপস্থিতি এবং তার নীরব আহ্বান দেখে ধীরে ধীরে ভয়ের স্থান ছেড়ে কৌতূহল এবং এক ধরনের অন্তরের আনন্দ জাগতে লাগল। ছেলে তার হাত ধরল এবং বলল, “আমার সঙ্গে খেলবে?” অর্পিতা স্থির হয়ে তাকালেন। স্বপ্নের ভেতরে তার সমস্ত দ্বিধা, ভয়, এবং অজানা অনিশ্চয়তা মিলিত হয়ে এক মৃদু উত্তেজনায় রূপ নিল। অবশেষে তিনি ধীরস্বরে বললেন, “হ্যাঁ।” সেই এক কথায় যেন ঘরের নিঃশব্দ বাতাসও আনন্দের ছন্দে ভরে উঠল।
এই স্বপ্ন অর্পিতার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি এবং আনন্দের স্পন্দন জাগিয়ে দিল। সে বুঝতে পারল, অনিরুদ্ধ কেবল তার সঙ্গে খেলার আহ্বান জানাচ্ছে না, বরং তার নিজের অস্তিত্বের আনন্দ এবং সঙ্গী খোঁজার অনুভূতি প্রকাশ করছে। স্বপ্নে হাত ধরার মুহূর্তটি, শিশুটির চোখে অদ্ভুত বিশ্বাস এবং ঘরের নিঃশব্দতা—সব মিলিয়ে অর্পিতার মধ্যে এক ধরনের মমতা এবং দয়া জন্ম দিল। ঘুম থেকে উঠে সে দেখল, সেই রাতের পর থেকে দেয়ালের প্রতিটি আঁকিবুকি আরও প্রাণবন্ত, আরও রঙিন হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ফুল, প্রতিটি বল, প্রতিটি খেলনা যেন তার খুশির প্রতিফলন। অর্পিতা বুঝতে পারল, তার “হ্যাঁ” বলার সাহস অনিরুদ্ধকে উৎসাহিত করেছে, এবং সে আরও উচ্ছ্বাসিত হয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন চিত্র আঁকছে, যেন তার খেলার আনন্দ আরও প্রসারিত হচ্ছে।
পরবর্তী দিনগুলোতে অর্পিতার প্রতিটি ভোর হয়ে উঠল এক নতুন ধরণের আনন্দের উৎস। প্রতিটি নতুন আঁকিবুকি তার চোখে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল—ছোট্ট ফুলের পাপড়ি, উড়ন্ত পাখি, খেলনা গাড়ি—সবই এক অদৃশ্য খেলার অংশ হয়ে দাঁড়াল। অর্পিতা বুঝতে পারল, অনিরুদ্ধের সঙ্গে তার এই খেলা শুধুই নিছক আনন্দ নয়; এটি তার ভয়ের জায়গায় সাহস, একাকীত্বের মাঝে সঙ্গী, এবং নিঃশব্দতার মধ্যে সংযোগের জন্ম দিয়েছে। প্রতিটি নতুন চিত্র তাকে এক অদ্ভুত স্নেহময়ী সংযোগ অনুভব করায়, যা শুধুমাত্র চোখে দেখা নয়, বরং হৃদয়ে উপলব্ধি করা যায়। অর্পিতা জানল, এই খেলা তার জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে আনন্দ, রহস্য, এবং মমতা মিলিত হয়ে তার প্রতিটি দিনকে প্রাণবন্ত এবং আনন্দময় করে তুলছে। অদৃশ্য শিশুর খেলা এখন শুধু একটি অদ্ভুত ঘটনা নয়, বরং অর্পিতার জীবনের এক অদ্বিতীয় সঙ্গী হয়ে উঠেছে, যা তাকে স্বপ্নের এবং বাস্তবের সীমারেখা পার হয়ে এক অদ্ভুত শান্তি এবং আনন্দের অনুভূতি দিচ্ছে।

অধ্যায় ৯ – অসম্পূর্ণ খেলা

অনিরুদ্ধর সঙ্গে অর্পিতার অদৃশ্য খেলার আনন্দ ক্রমে গভীর হয়ে উঠল, কিন্তু ধীরে ধীরে অর্পিতা এবং প্রতীক বুঝতে পারলেন, এই খেলার মধ্যে কিছু অসম্পূর্ণতা আছে। প্রতিটি ভোরে দেয়ালে নতুন চিত্র, খেলনা গাড়ি, ফুল, বল—সবই আনন্দময়, প্রাণবন্ত, কিন্তু একরকম অস্পষ্টতা ও অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষা তাদের মনকে অবাক করছিল। প্রতীক যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলল, “হঠাৎ মৃত্যু তার জীবনের খেলার ধারাকে বন্ধ করে দিয়েছে। সে এখনও তার আনন্দ সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারছে না।” অর্পিতা প্রথমে কিছুটা দুঃখী হলেও ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল, অনিরুদ্ধ শুধু সঙ্গী খুঁজছে না, বরং তার জীবনযাত্রার অসম্পূর্ণতা, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া খেলার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে। তাদের মনোযোগ এখন শুধুই কৌতূহল বা ভয় নয়—এটি একটি দায়িত্ব, একটি দায়িত্ব যা তাদের অনিরুদ্ধকে তার খেলার আনন্দ এবং শান্তি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে।
প্রতীক এবং অর্পিতা মিলে একটি পরিকল্পনা তৈরি করলেন। তারা বুঝতে পারলেন, অনিরুদ্ধর জন্য একটি প্রতীকী খেলার আয়োজন করতে হবে, যেন তার মৃত্যুতে অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া আনন্দ কিছুটা পূরণ হয়। তারা প্রথমে ঘরের নানা জায়গা সাজাল—টেবিলে খেলনা গাড়ি, বারান্দায় ছোট্ট ফুলের বাগান, দেয়ালে রঙিন চিত্রের ছোঁয়া। প্রতীক যুক্তিবাদী হলেও সে বুঝতে পারল, কখনও কখনও অনুভূতি এবং নীরব আহ্বানকে যুক্তি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। অর্পিতা তার মমতা এবং সংবেদনশীলতা দিয়ে খেলার পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তুলল। ঘরে ভেসে এলো এক অদ্ভুত আনন্দময়, স্নিগ্ধ পরিবেশ, যেন অনিরুদ্ধকে এই খেলার আয়োজন এক নতুন আশা দিচ্ছে। তারা প্রতিটি পদক্ষেপ ধীরে ধীরে নিয়েছিল, যেন কোনো কিছুই শিশুটিকে ভয় না দেখায় এবং প্রতিটি মুহূর্তে তার আনন্দকে বর্ধিত করে।
পরের ভোরে অর্পিতার চোখ পড়ল দেয়ালে—অনিরুদ্ধর নতুন আঁকিবুকি আরও প্রাণবন্ত এবং আনন্দময় হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারল, প্রতীকী খেলার আয়োজন ইতিমধ্যেই তার প্রতি প্রভাব ফেলছে। অনিরুদ্ধ যেন প্রতিটি রঙ, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি খেলনা দেখে খুশি হচ্ছে, তার অসম্পূর্ণ খেলার অনুভূতি ধীরে ধীরে পূর্ণতা পাচ্ছে। অর্পিতার মমতা এবং প্রতীকের যুক্তিবাদ একত্রে এক নতুন সংযোগ সৃষ্টি করল—একটি সম্পর্ক যা জীবনের, মৃত্যুর এবং নীরব উপস্থিতির মধ্যে খেলার আনন্দ এবং শান্তি নিয়ে এসেছে। তারা জানল, এই প্রতীকী খেলা শুধু আনন্দ নয়, বরং এক ধরনের নিরাময়, যা অনিরুদ্ধকে তার খেলার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার সুযোগ দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে অর্পিতা এবং প্রতীকের মনেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি এবং আনন্দের সৃষ্টি করছে। এই অধ্যায়টি অর্পিতার জীবনে, অনিরুদ্ধর অনুপস্থিতির মধ্যে, খেলার এবং সংযোগের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

অধ্যায় ১০ – বিদায়ের আঁকিবুকি

অর্পিতা ঘরের এক কোণে বসে ছোট ছোট খেলনা, চক এবং রঙের পাত্র সাজালেন। দেয়ালের সামনে একটানা স্থির হয়ে বসে থাকা সে যেন অনিরুদ্ধের সঙ্গে খেলা করছে। প্রতিটি রঙের ছোঁয়া, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি খেলনা—সবই তার মনে আনন্দ এবং শিথিলতার ঢেউ ফেলছিল। সে চোখ বন্ধ করে ভাবল, “অনিরুদ্ধ, আজকে আমরা একসাথে খেলব।” নিঃশব্দ ঘরে রঙিন খেলনা এবং চক দিয়ে আঁকা রেখার মাধ্যমে একটি অদৃশ্য খেলার পরিবেশ সৃষ্টি হলো। অর্পিতা বুঝতে পারলেন, এই খেলা কেবল নিছক মজার নয়, বরং এটি অনিরুদ্ধকে শান্তি এবং পূর্ণতার অনুভূতি দিতে সাহায্য করছে। সে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছিল, যেন এই খেলা তাদের দুজনের মনকে সংযুক্ত রাখছে। প্রতীক পাশে বসে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তার যুক্তিবাদী মনও অবাক হয়ে দেখছিল কিভাবে নিঃশব্দ উপস্থিতি এবং মানবিক সংবেদন একসাথে কাজ করতে পারে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল, আর ঘরের মধ্যে ভেসে আসতে লাগল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। হঠাৎ দেয়ালে দেখা গেল এক শেষ আঁকিবুকি—একটি শিশুর ছবি, হাসিমুখে, সরল চোখে। অর্পিতা অবাক হয়ে তাকালেন। সে বুঝতে পারল, এটি অনিরুদ্ধর বিদায়ের চিহ্ন। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রঙের ছোঁয়া যেন বলছিল, “আমি শান্তি পেয়েছি। আমি খেলতে পেরেছি। আমি আর ভয় পাই না।” অর্পিতার হৃদয় ধীরে ধীরে মৃদু প্রশান্তিতে ভরে উঠল। ভোরবেলায় ঘরকে ঘিরে সব আঁকিবুকি মিলিয়ে গেল, যেমন সবকিছু এক স্বাভাবিক স্থিতিতে ফিরে এসেছে। ঘর ফাঁকা হয়ে গেলেও অর্পিতার মনে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিল—সে জানল, অনিরুদ্ধ আর নেই না, তবে তার উপস্থিতি, তার খেলার আনন্দ, এবং তার নিঃশব্দ বার্তা তার হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে।
পরবর্তী দিনগুলোতে অর্পিতার ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি এবং সতর্ক আনন্দ জন্ম নিল। সে বুঝতে পারল, কখনও কখনও নিঃশব্দ উপস্থিতি আমাদের জীবনে এমন সংযোগ তৈরি করে, যা কেবল চোখে দেখা যায় না, বরং হৃদয়ে অনুভূত হয়। অনিরুদ্ধর খেলার মাধ্যমে অর্পিতা নিজেও শিখল, খেলা, মমতা, সংযোগ এবং প্রেরণা কখনও শেষ হয় না, বরং তারা নতুনভাবে অন্যের জীবনে প্রবাহিত হয়। প্রতীক পাশে বসে তাকে দেখছিলেন, অদ্ভুতভাবে সে ওর চোখে শান্তি এবং সংযোগের গভীরতা দেখতে পেল। ঘর ফাঁকা হলেও অর্পিতার মনে এই অধ্যায়ের ছাপ চিরকাল অদৃশ্য শিশুর খেলার আনন্দ, শান্তি এবং বিদায়ের মৃদু হাসি হিসেবে বিরাজ করল। অর্পিতার প্রতিটি ভোর, প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি মুহূর্ত এখন অনিরুদ্ধর স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক নতুন জীবনের আলোকে প্রতিফলিত করছিল, যেখানে বিদায়ের অম্লান স্মৃতি তাকে জীবনের নিঃশব্দ আনন্দ এবং সংযোগের শিক্ষায় সমৃদ্ধ করল।

1000063173.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *