Bangla - ভূতের গল্প

দেউড়ির আঙিনায়

Spread the love

সায়ন্তন বসু


অধ্যায় ১ : জমিদারবাড়ির নিস্তব্ধতা

প্রাচীন গ্রাম বাংলার বুক জুড়ে যে অট্টালিকা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়। সময়ের আঁচড়ে তার দেয়াল জীর্ণ হয়ে গেছে, ছাদের টালির ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে বৃষ্টির জল, দেউড়ির মোটা কাঠের দরজায় ঝুলছে মরচেধরা তালা, অথচ এখনো মনে হয়—এ যেন এক ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে। এ বাড়িটি এককালে ছিল রাজবাড়ির মতোই জাঁকজমকপূর্ণ জমিদারবাড়ি, যেখানে গরিব কৃষকদের ঘামে গড়া সম্পদ মজুত হতো, আর রাতে চলত রেশমি শাড়ি, নকশি পাঞ্জাবি, সোনার গয়নার রোশনাই। কিন্তু কালের নিয়মে জমিদারি প্রথা ভেঙে যাওয়ার পর বাড়িটি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। বংশধরেরা কেউ কলকাতায়, কেউ লন্ডনে চলে গেল, আর গ্রামে পড়ে রইল শুধুই পরিত্যক্ত এক দালান, যার চারপাশে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল কিসসা-কাহিনি। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত—রাত নামলেই ওই বাড়ির আঙিনা থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসে, কখনো কান্না, কখনো হাহাকার, আবার কখনো ঢাকঢোলের মতো গম্ভীর শব্দ। কারও কারও দাবি, পূর্ণিমার রাতে দেউড়ির ফটকের কাছে সাদা ধবধবে কাপড় পরা এক মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চোখদুটো শূন্য, যেন মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে। এসব গল্প এতদিনে কিংবদন্তি হয়ে উঠলেও গ্রামের মানুষ এখনও অকারণে ওই বাড়ির পথ মাড়ায় না। বাজার থেকে ফেরার সময় যদি কারও হেঁটে আসতে হয় ওই পথ দিয়ে, তবে সে দূর থেকে বাড়িটির দিকে একবার তাকিয়েই দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। যেন কারও নজর তাকে অনুসরণ করছে, কেউ ফিসফিস করে নাম ধরে ডাকছে—এমন অনুভূতি থেকে বাঁচতে মানুষ যতটা পারে ওই এলাকা এড়িয়ে চলে।
তবু সময়ের চক্রে মানুষের ভয় কখনও কখনও লোভের কাছে হেরে যায়। বহু বছর ধরে খালি পড়ে থাকা জমিদারবাড়িটি শেষ পর্যন্ত এক শহুরে ব্যবসায়ীর হাতে বিক্রি হয়। তাঁর নাম শিবাজি রায়, কলকাতার এক নামকরা হোটেল ব্যবসায়ী।

শহরে ইতিমধ্যেই তাঁর কয়েকটি রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ চলছে, আর এবার তিনি গ্রামে এসে পুরোনো ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন ব্যবসা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখলেন। গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশ, পাশে নদীর ধারা, আর তার মধ্যে এই প্রাচীন জমিদারবাড়ি—সব মিলে যেন একেবারে সিনেমার মতো দৃশ্য। শিবাজি ভাবলেন, এটিকে সংস্কার করে যদি একটি হেরিটেজ হোটেল বানানো যায়, তবে শহরের মানুষ ছুটে আসবে ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার জন্য। তাঁর চোখে তখন শুধু স্বপ্ন—দেউড়ির আঙিনা আলোয় ভরা, পর্যটকরা বসে কফির কাপ হাতে আড্ডা দিচ্ছে, ভাঙাচোরা দালান নতুন রঙে সাজানো। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেননি, এই বাড়ির সঙ্গে যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে, সেটি কেবল ইট-পাথরের ইতিহাস নয়; সেখানে আছে রক্ত, কান্না আর আত্মাদের অভিশাপ। তিনি গ্রামের কারও কথা শুনতে চাননি। কয়েকজন বয়স্ক মানুষ তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, “ওই বাড়ি ভাল নয় বাবু, ওখানে মানুষের কান্না মিশে আছে।” শিবাজি হেসে উড়িয়ে দেন সবকিছু, তিনি বলেন, “এগুলো কুসংস্কার, তোমরা এখনও অন্ধকার যুগে আছো। আমার হাতে পড়লে দেখবে, এই ভাঙাচোরা দালান একদিন সোনার খনি হয়ে উঠবে।” তাঁর আত্মবিশ্বাসে শ্রমিকরা কাজ শুরু করে দিল, যদিও তাদের চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট ছিল। সকালে যখন সূর্যের আলো ফুঁড়ে এসে আঙিনার ধুলোমাখা ইটকে ছুঁয়েছিল, তখন থেকেই কাজের সোঁদা গন্ধ ভাসতে শুরু করল। কিন্তু গ্রামবাসীর মনে কেমন যেন অশান্তি, যেন নিস্তব্ধতার বুক চিরে নতুন এক ঝড় আসছে।

প্রথম দিন থেকেই অদ্ভুত কিছু ঘটতে লাগল। শ্রমিকদের একজন যখন দেউড়ির ভারী দরজার মরচে ধরা তালা খুলতে গেল, হঠাৎ করেই হাত থেকে হাতুড়ি ছিটকে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে যেন অজানা এক ঠান্ডা বাতাস আঙিনা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই একে অপরের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু না বলে কাজ শুরু করল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই ভেতরের ঘর থেকে অচেনা এক শব্দ ভেসে এলো—মনে হলো যেন কেউ শিকল টেনে টেনে হাঁটছে। শ্রমিকরা থমকে দাঁড়ালেও শিবাজি গম্ভীর গলায় বললেন, “ওসব কিছু নয়, হয়তো ইঁদুর বা বাদুড়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” সেই রাতে যখন গ্রামের আকাশে চাঁদ উঠেছে, তখন বাড়ির দেউড়ি থেকে হঠাৎ ভেসে এল এক অদ্ভুত সুর, যেন বাঁশির মতো করুণ ধ্বনি, কিন্তু শোনার পর বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বইতে থাকে। যারা বাড়ির আশপাশে ছিল, তারা ভয়ে ছুটে পালাল। পরদিন সকালেই খবর এলো—শ্রমিকদের মধ্যে একজন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার জ্বর উঠেছে অস্বাভাবিক রকমের। কারও কারও মতে, সে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠছিল, আর বারবার বলছিল, “ওরা আমাকে ছাড়ছে না, ওরা মাটির নিচ থেকে ডাকছে।” গ্রামে তখন গুজবের আগুন ছড়িয়ে পড়ল—“আঙিনার তলায় কিছু আছে, যা শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না।” শিবাজি প্রথমে এসব কথাকে অবজ্ঞা করলেও, তাঁর মনের গভীরে এক অচেনা অস্বস্তি জায়গা করে নিতে শুরু করল। তিনি জানতেন না, এই নিস্তব্ধ জমিদারবাড়ির দেয়ালগুলো শুধু ইট দিয়ে তৈরি নয়; এর প্রতিটি ইটে লুকিয়ে আছে শতবর্ষের কান্না, দুঃখ আর অভিশাপ। এবং সেই কান্নার ধ্বনি আবারও ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে শুরু করেছে, কারণ দেউড়ির আঙিনা শান্ত থাকতে চায়নি।

অধ্যায় ২ : সংস্কারের উদ্যোগ

শিবাজি রায় কাজ শুরু করার পর দিনগুলো যেন এক অদ্ভুত ছন্দে কাটতে লাগল। সকালে শ্রমিকরা আসত, কাঠামো ভাঙার শব্দে আকাশ কেঁপে উঠত, আর বিকেল নামতেই কেমন যেন অচেনা নিস্তব্ধতা নেমে আসত আঙিনাজুড়ে। কাজ এগোচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটতে লাগল। কারও হাত থেকে হাতুড়ি ফসকে গিয়ে আঙুলে আঘাত লাগছে, কেউ অকারণে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে, আবার কেউবা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠছে। গ্রামবাসীরা এসব দেখেই মাথা নাড়ত—“বলেছিলাম তো, এ বাড়ি অভিশপ্ত।” কিন্তু শিবাজি এসব কুসংস্কারের তোয়াক্কা করলেন না। তিনি জানতেন, ব্যবসায় সাফল্য পেতে হলে ভয়কে জয় করতে হয়। তবে তাঁর স্ত্রী মেঘলা, যিনি মাঝে মাঝে গ্রামে এসে কাজ দেখতেন, তিনিও এক অদ্ভুত আতঙ্ক অনুভব করতেন। একদিন সন্ধ্যায় তিনি আঙিনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ লক্ষ্য করলেন ভাঙা দেউড়ির ছায়ায় যেন কারও দাঁড়িয়ে থাকা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছিল সাদা কাপড়ে ঢাকা এক মানুষ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। মেঘলা চমকে শিবাজিকে ডাকলেন, কিন্তু তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না। তিনি মুচকি হেসে বললেন, “তুমি হয়তো ভুল দেখেছো, ক্লান্তিতে এমনটা হয়।” অথচ মেঘলার বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কা বাসা বাঁধতে শুরু করল।

কাজ চলতে চলতে একদিন আঙিনার মাটিতে খনন করতে গিয়ে শ্রমিকরা অদ্ভুত কিছু খুঁজে পেল। প্রথমে তারা ভেবেছিল এটি হয়তো গাছের শিকড়, কিন্তু মাটি পরিষ্কার হতেই দেখা গেল—এটি মানুষের হাড়। আতঙ্কে তারা কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল। খবর ছড়িয়ে পড়ল পুরো গ্রামে। অনেক বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়ে রইল দেউড়ির সামনে, তাদের চোখেমুখে যেন কোনো অজানা স্মৃতি ভেসে উঠল। একজন বললেন, “এটাই তো হওয়ার ছিল। এই বাড়ির আঙিনায় বহু আগে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছিল।” গল্প শোনাতে শুরু করলেন তিনি—জমিদারের আদেশে গ্রামের কয়েকজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এখানে কবর দেওয়া হয়েছিল। তাদের রক্ত এই মাটিতে মিশে আছে, আর আত্মারা শান্তি পায়নি। শিবাজি তবুও দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “এগুলো পুরোনো গল্প। যা হয়েছে ইতিহাসে, তা এখন আর আমাদের আটকাতে পারবে না। আমি কাজ থামাব না।” তাঁর কথায় শ্রমিকরা আপাতত কাজে ফিরলেও তাদের মনে ভয় বাসা বাঁধল। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামতেই তারা তাড়াহুড়া করে বাড়ি ফিরে যেত। আর যে শ্রমিকরা রাতের পাহারায় থাকত, তারা মাঝেমাঝে শপথ করে বলত—দেউড়ির আঙিনা থেকে চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসে, যেন কারও বুকে হাহাকার জমে আছে।

শিবাজি এক রাতে একাই আঙিনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। চারপাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, বাতাসে ধূপের মতো এক গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। তিনি কানে খেয়াল করলেন—মৃদু মৃদু শব্দ হচ্ছে, যেন শিকল টেনে কেউ এগোচ্ছে। তাঁর চোখ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আঙিনার মাঝখানে চলে গেল, যেখানে কিছুদিন আগে হাড়গোড় পাওয়া গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো, মাটি যেন দপদপ করে উঠছে, যেন ভিতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে চাইছে। শিবাজি দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেললেন, আবার খোলার পর সব স্বাভাবিক লাগল। তিনি নিজেকে বোঝালেন, “এটা নিছক বিভ্রম, দিনের ক্লান্তির ফল।” কিন্তু তাঁর বুকের গভীরে যেন কেউ ভারি হাত রেখে দিল। সেদিন রাতেই তিনি স্বপ্ন দেখলেন—সাদা ধবধবে পোশাক পরা মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের চোখ দুটি গভীর শূন্য। তারা সবাই একসঙ্গে হাত তুলে যেন ইশারা করছে আঙিনার মাটির দিকে। ঘুম ভেঙে গিয়ে শিবাজি হাপাতে লাগলেন, ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেল তাঁর শরীর। ভোরের আলো ফুটতেই তিনি বাইরে গিয়ে দেখলেন, দেউড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের বৃদ্ধা কমলা কাকিমা। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “শোন বাবু, ওরা শান্তি চায়। যতদিন ওদের আত্মা মুক্তি না পাবে, ততদিন তুমি কিছুতেই সফল হবে না।” শিবাজি কিছু না বলে চুপ করে থাকলেন, তবে তাঁর চোখে সেই প্রথম ভয়ের আভা ধরা পড়ল। তিনি বুঝতে পারলেন, এই সংস্কারের উদ্যোগ হয়তো এত সহজে শেষ হবে না।

অধ্যায় ৩ : প্রথম অশুভ ইঙ্গিত

দিন কেটে যাচ্ছিল, আর কাজও এগোচ্ছিল ধীরে ধীরে, কিন্তু সেই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অশুভ ছায়া আরও স্পষ্ট হতে লাগল। আঙিনার ভেতরে খুঁড়তে খুঁড়তে যখন শ্রমিকরা পাথর আর ইটের স্তূপ সরাচ্ছিল, তখনই এক শ্রমিক হঠাৎ মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল। অন্যরা ছুটে গিয়ে তাকে জল খাওয়াল, কপালে হাত দিয়ে দেখল—শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে, অথচ কপাল জ্বলে যাচ্ছে জ্বরের মতো। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “ওরা ডাকছে আমাকে… আঙিনার ভেতর থেকে… শুনতে পাচ্ছো না?” বাকিরা হতবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল, কিন্তু তার মুখের আতঙ্ক এত সত্যি লাগছিল যে কেউ কিছু বলার সাহস পেল না। কাজ বন্ধ করে তাকে তাড়াতাড়ি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু সেদিন রাতেই সে আবার অদ্ভুত অবস্থায় পড়ল—ঘুমের মধ্যে বারবার উঠে বসছিল, আর ফিসফিস করে বলছিল, “আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি… ওরা সাদা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে।” গ্রামের লোকেরা ভয়ে তাকে দূরে রাখল, যেন সে অভিশাপগ্রস্ত। শিবাজি যদিও ডাক্তার ডেকে তাকে চিকিৎসা করালেন, কিন্তু মনের গভীরে এক অনির্বচনীয় চাপ অনুভব করলেন।

পরের দিন আরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সকালে একজন কাঠমিস্ত্রি যখন ভাঙা জানালার কাঠ মাপতে গেল, হঠাৎ তার করাত হাত থেকে ছিটকে গিয়ে আঙুলে গভীর কেটে দিল। রক্তে মাটি লাল হয়ে উঠল। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করতেই বাড়ির ভেতরে কোথাও যেন প্রতিধ্বনির মতো একই চিৎকার ভেসে এল, অথচ ভেতরে তখন কেউ ছিল না। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল, কেউ কথা বলল না। এই ঘটনার পর শ্রমিকদের মধ্যে ভয় আরও তীব্র হয়ে উঠল। বিকেলের পর থেকেই তারা কেমন অস্থির হয়ে উঠত, বারবার আঙিনার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করত, “এখানে কিছু আছে, যা আমাদের পছন্দ করছে না।” তাদের মুখে অদ্ভুত আতঙ্ক জমে থাকত, চোখে ভেসে উঠত অস্বস্তি। আর ঠিক সেই সময়ে গ্রামে আরও গুজব ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কেউ বলল, রাতের দিকে দেউড়ির ভেতর থেকে মৃদু ঢাকের শব্দ শোনা যায়, কেউ বলল, আঙিনার কুয়োর পাশে সাদা কাপড়ে ঢাকা এক ছায়ামূর্তি দেখা গেছে। এমনকি পাশের মাঠে কাজ করা কৃষকরাও শপথ করে বলল, দুপুরে রোদ মাথার উপর থাকা অবস্থাতেও তারা ওই আঙিনার দিক থেকে অচেনা কান্নার আওয়াজ শুনেছে। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হলো।

শিবাজি রায় প্রথমে এসব কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিলেও, মনের ভেতরে এক ধরনের দমচাপা অস্বস্তি জমে উঠছিল। রাতে বিছানায় শুয়ে তিনি বারবার শুনতে পাচ্ছিলেন, আঙিনার ভেতর থেকে আসছে মৃদু শব্দ, যেন শিকল ঘষে কেউ হাঁটছে। একদিন সাহস করে তিনি উঠলেন, লণ্ঠন হাতে দেউড়ির দরজা পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এক বরফশীতল হাওয়া তাঁকে আঘাত করল। চারপাশ নিস্তব্ধ, অথচ মনে হচ্ছিল শত শত চোখ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি ভেতরে ঢুকতেই লণ্ঠনের আলো হঠাৎ নিভে গেল। অন্ধকারের ভেতর তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন—একটা দীর্ঘশ্বাস, যেন বহুদিনের জমে থাকা কষ্টে ভরা। আতঙ্কে তিনি দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ভোর হওয়ার পর তিনি গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধকে ডেকে পাঠালেন। তখনই তারা তাঁকে বলল, “বাবু, আমরা তো প্রথম দিনই সতর্ক করেছিলাম। এই আঙিনা অভিশপ্ত। এখানে বহু বছর আগে জমিদারদের হাতে নিরীহ মানুষ খুন হয়েছিল। সেই রক্ত এখনও শুকোয়নি। ওরা শান্তি না পেলে তোমাকে ছাড়বে না।” শিবাজি চুপ করে শুনলেন, কিছু বললেন না। তাঁর আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরতে শুরু করল, কিন্তু তবুও ব্যবসায়ী মনের জেদ তাঁকে পিছু হটতে দিল না। তবে তিনি বুঝে গেলেন—এ ছিল কেবল শুরু, অশুভ ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অধ্যায় ৪ : শ্রমিকদের অসুস্থতা

দিন যেতে যেতে শ্রমিকদের অস্বাভাবিক অসুস্থতা যেন মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রথমে একজন-দু’জন অসুস্থ হচ্ছিল, কিন্তু এখন দেখা গেল প্রায় সবাই কোনও না কোনও সমস্যায় ভুগছে। কারও মাথা ভারী হয়ে আসছে, কেউ ঘাড়ে চাপা ব্যথা অনুভব করছে, আবার কেউ হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। কাজের ফাঁকে শ্রমিকরা একে অপরকে বলতে শুরু করল—“এটা সাধারণ অসুখ নয়, এটা ওই আঙিনার অভিশাপ।” শিবাজি ডাক্তার এনে সবার চিকিৎসা করালেও ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বললেন, “এদের শরীরে কোনও নির্দিষ্ট রোগের লক্ষণ নেই। এরা ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।” কিন্তু শ্রমিকরা ডাক্তারি ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করল না। তারা বলল, “রাতে আমাদের স্বপ্নে কেউ আসে, সাদা পোশাকে ঢাকা, চোখে আগুন। ওরা আমাদের নাম ধরে ডাকে, বলে—এই মাটি থেকে চলে যাও।” ধীরে ধীরে শ্রমিকদের মনোবল ভেঙে পড়তে লাগল। কেউ বলল, “আমি আর কাজ করব না, যাই হোক মাইনের দরকার নেই।” আবার কেউ ভয় পেয়েও কাজ চালিয়ে গেল, কিন্তু তাদের চোখে স্থায়ী আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল।

এরপর একদিন এমন ঘটনা ঘটল, যা সবাইকে শিউরে তুলল। দুপুরবেলা এক শ্রমিক খননকাজ করছিল, হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল—“ওরা আমাকে টানছে!” তার শরীর মাটির দিকে যেন টেনে নিচ্ছে কেউ, যদিও অন্যরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। সবাই মিলে টেনে তুলল তাকে, তার শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল আর চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকম লাল হয়ে উঠেছিল। কয়েক ঘণ্টা পর যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন সে হাপাতে হাপাতে বলল, “ওরা এখানে শান্তিতে ঘুমোতে দেবে না। আমাদের সবাইকে ওরা শাস্তি দেবে।” এই ঘটনার পর শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক এমন জায়গায় পৌঁছল যে অনেকে কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেল। শিবাজি যতই টাকা-পয়সার লোভ দেখান না কেন, কেউ আর ফিরতে চাইল না। যারা থেকে গেল, তারা কেবল বাধ্য হয়ে—দারিদ্র্যের কারণে কিংবা অন্য কোনও আশায়। কিন্তু তাদেরও মুখে প্রতিদিন আতঙ্ক জমে থাকত, আর হাতের কাজ ক্রমশ ধীর হয়ে যাচ্ছিল। কাজের অগ্রগতি প্রায় থমকে গেল, অথচ প্রতিটি রাত যেন আরও ভারী হতে লাগল। আঙিনার মাটি থেকে ভেসে আসা অচেনা শব্দ, হাহাকার আর চাপা কান্না এখন আর শুধু গুজব নয়—যারা ভেতরে কাজ করছিল, তারাই শপথ করে বলছিল, “আমরা নিজের কানেই শুনেছি।”

এই অবস্থায় শিবাজি নিজেই ক্রমশ ভেঙে পড়তে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন যে ভয় বা কুসংস্কারে তিনি পিছু হটবেন না, কিন্তু এখন তাঁর চোখেমুখে উদ্বেগ স্পষ্ট। রাতে তিনি ঘুমোতে পারতেন না। মেঘলা তাঁকে বোঝাতে চাইলেন, “চলো, এই কাজ ছেড়ে দিই। গ্রামবাসী এতদিন ধরে যা বলছে, তা হেসে উড়িয়ে দেওয়া উচিত হয়নি।” শিবাজি দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, “আমি পিছিয়ে গেলে আমার সর্বনাশ হবে। এত টাকা লগ্নি করেছি। তবে…” বাকিটা আর শেষ করতে পারলেন না। তাঁর বুকের ভেতর জমে থাকা আতঙ্ক ক্রমশ শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসছিল। সেই রাতে তিনি আবার এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন—দেউড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ, কারও শরীরে রক্ত, কারও চোখ ফাঁকা গহ্বরের মতো। তারা সবাই একসঙ্গে হাত তুলে বলছে, “আমাদের মুক্তি দাও।” ঘুম ভেঙে গিয়ে শিবাজি বিছানায় বসে রইলেন, বুক ধড়ফড় করছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, শ্রমিকদের অসুস্থতা কেবল কাকতালীয় নয়; এটি সেই অশান্ত আত্মাদের সতর্কবার্তা, যারা মাটির নিচে আটকে আছে। আর যদি তাঁদের শান্তি না দেওয়া যায়, তবে এ বাড়ির কোনও সংস্কার সম্ভব নয়।

অধ্যায় ৬ : গোপন কবর আবিষ্কার

শিবাজির জেদের সামনে কেউ কিছু বলতে সাহস পেল না। যদিও শ্রমিকদের আতঙ্ক প্রতিদিনই বাড়ছিল, তিনি জোর করে কাজ এগিয়ে নিতে লাগলেন। সেই সকালে আঙিনার এক কোণে মাটি খোঁড়ার কাজ চলছিল। মজুরেরা ফাঁক ফাঁক করে কুড়াল চালাচ্ছিল, আর শিবাজি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রথমে কুড়ালের আঘাতে শক্ত কিছুতে ঠেকল, সবাই ভাবল হয়তো পাথর। কিন্তু মাটি সরাতেই বেরিয়ে এল হলদেটে হাড়ের টুকরো। শ্রমিকরা আঁতকে উঠল। কেউ চিৎকার করে বলল, “এটা মানুষের হাড়!” মুহূর্তে কাজ থেমে গেল। সবাই ভয়ে সরে দাঁড়াল। শিবাজি নিজেও কিছুটা হতভম্ব হয়ে এগিয়ে গেলেন, হাতে মাটি তুলে ধরলেন—স্পষ্ট দেখা গেল মানুষের করোটির অংশ। সেই দৃশ্য দেখে আশেপাশের সবাই কেঁপে উঠল। আঙিনায় নেমে এল ভারী নীরবতা। বাতাসও যেন স্থির হয়ে দাঁড়াল।

কিছুক্ষণ পর সাহস করে আরও মাটি খোঁড়া হলো, আর তখন প্রকাশ পেল আরও ভয়াবহ সত্য। একটার পর একটা কঙ্কাল বেরোতে লাগল, যেন মাটির নিচে অগণিত মানুষ চাপা পড়ে আছে। কারও হাড় এখনও অক্ষত, কারও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কিছু কঙ্কালের মাথার খুলি ফাটলধরা, যেন লোহার আঘাতে ভেঙে গিয়েছিল। দৃশ্যটা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে শ্রমিকরা একে একে কাজ ফেলে পালিয়ে গেল। কেউ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “এখানে নিশ্চয়ই অভিশপ্ত কবর আছে।” যারা রইল, তাদেরও মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল। তারা দূর থেকে কাঁপা কণ্ঠে বলছিল, “দেখুন বাবু, এভাবে লাশ চাপা দেওয়া হয়েছিল? এরা সবাই অন্যায়ের শিকার। ওরা কি শান্তি পাবে?” শিবাজি এক অদ্ভুত অনুভূতিতে শিউরে উঠলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, গ্রামবাসীরা যা বলে আসছিল, সব সত্যি। তাঁর মনে পড়ল হরিমোহন কাকুর কথা—“রক্ত ঝরেছিল এই মাটিতে।” সেই রক্তের চিহ্ন যেন এখনও কঙ্কালের ভেতরে শুকিয়ে আছে।

কবরের আবিষ্কার কেবল শ্রমিকদেরই নয়, পুরো গ্রামকে কাঁপিয়ে দিল। সন্ধ্যা নামতেই মানুষ ভিড় জমাল আঙিনার বাইরে, কেউ ঢুকতে সাহস পেল না। ভেতরে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, কুয়াশার মতো ধোঁয়া জমে গিয়েছিল আঙিনার ওপর। শিবাজি সেই রাতে দেউড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর চোখ যেন হাড়ের স্তূপ থেকে সরছিল না। তিনি অনুভব করছিলেন, এই কঙ্কালগুলো কেবল ইতিহাসের চিহ্ন নয়—এরা এখনও বেঁচে আছে, তাদের অশ্রু এখনও মাটির ভেতরে ঘুমিয়ে আছে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ বাতাসের ঝাপটা বইল, আর তিনি শুনতে পেলেন চাপা গোঙানি। মনে হলো শত শত মানুষ একসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল, কিন্তু দৃষ্টি সরাতে পারলেন না। যেন অদৃশ্য শক্তি তাঁকে বাধ্য করছে এই ভয়ঙ্কর সত্যের সামনে দাঁড়াতে। তিনি বুঝে গেলেন—এ বাড়ির সংস্কার শুধু ইট-পাথরের কাজ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আত্মাদের মুক্তি। যদি তাদের শান্তি না দেওয়া যায়, তবে যে কোনো কাজ ব্যর্থ হবে, আর হয়তো তাঁর জীবনও বিপদে পড়বে।

অধ্যায় ৭ : আত্মাদের ক্রোধ

কঙ্কাল আবিষ্কারের পর থেকে শ্রমিকরা একে একে কাজ ছাড়তে শুরু করল। তবে যাঁরা বাধ্য হয়ে থেকে গেলেন, তাঁদের জীবনে নেমে এল ভয়ঙ্কর অস্থিরতা। রাত নামলেই তাঁরা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগলেন—কেউ দেখল, রক্তে ভিজে থাকা কৃষকরা তাঁদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে, কেউ দেখল আঙিনার মাটি থেকে রক্ত বেরিয়ে এসে পায়ের গোড়ালি ভিজিয়ে দিচ্ছে। এক শ্রমিক হঠাৎ ভোরবেলায় চিৎকার করে উঠল—তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে, চোখ লাল হয়ে আছে, আর সে কাঁপা কণ্ঠে বলছে, “ওরা আমাকে ডেকেছে… ওরা বলেছে আমাদের হাড় যেন কেউ না নেড়ে…” তার কথা শুনে বাকিরা ভয়ে ছটফট করতে লাগল। দিনের বেলায়ও দেখা গেল অদ্ভুত সব লক্ষণ—কেউ হঠাৎ কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, কারও হাতে গভীর দাগ পড়ছে অথচ কোনো আঘাতই লাগে নি, কেউবা কাজ ফেলে হু হু করে কেঁদে ফেলছে।

শিবাজি নিজেও এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেলেন না। এক রাতে তিনি ঘরের ভেতরে বসে নথিপত্র দেখছিলেন, হঠাৎ শুনলেন মৃদু কান্নার শব্দ। প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো কোনো শ্রমিক বাইরে কাঁদছে, কিন্তু জানালার বাইরে তাকাতেই দেখলেন—আঙিনায় ছায়ার মতো কয়েকটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। তারা একসঙ্গে মাথা নত করে অচেনা ভাষায় কিছু বলছে, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। শিবাজির শরীর অবশ হয়ে গেল, তিনি দাঁড়াতেও পারছিলেন না। সেই রাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি, চোখ বন্ধ করলেই হাড়ের স্তূপ আর রক্তাক্ত মুখ ভেসে উঠছিল। ভোরবেলায় তিনি আঙিনায় বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন, মনে হলো মাটির ভেতর থেকে অচিন সুর ভেসে আসছে—যেন কষ্টের গান। তিনি বুঝতে পারলেন, আত্মারা এখন কেবল উপস্থিতই নয়, ক্রমশ তাঁদের ক্রোধ প্রকাশ করছে। তারা আর মাটির ভেতরে বন্দি থাকতে চাইছে না।

গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মানুষজন বলাবলি করতে লাগল, “ওরা জেগে উঠেছে।” অনেকে শিবাজিকে অনুরোধ করল কাজ বন্ধ করতে, কিন্তু তাঁর মন দ্বিধায় ভরে গেল। একদিকে তিনি জানতেন, এত শ্রম আর টাকা খরচ করে এখন পিছিয়ে আসা অসম্ভব। অন্যদিকে তিনি বুঝছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে মৃত্যু কিংবা সর্বনাশ নিশ্চিত। ঠিক তখনই হরিমোহন কাকু এসে বললেন, “তুমি যদি আত্মাদের শান্তি না দাও, তাহলে তারা তোমাকে ধ্বংস করবে। ওরা তোমার কাছে মুক্তি চাইছে।” কথাগুলো শিবাজির মনে গেঁথে গেল। তিনি বুঝলেন, এ আর সাধারণ নির্মাণকাজ নয়, বরং এক অলৌকিক সংগ্রাম। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন—তিনি কি আত্মাদের শান্তি দেওয়ার দায়িত্ব নেবেন, নাকি লোভে পড়ে এই অভিশপ্ত ইতিহাসকে উপেক্ষা করবেন? চারদিকে ক্রোধে ভরা বাতাস বইছিল, যেন প্রতিটি মুহূর্তে ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। শিবাজি জানলেন, আর দেরি করা যাবে না।

অধ্যায় ৮ : তান্ত্রিকের আগমন

আতঙ্ক চরমে পৌঁছালে শিবাজি অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন একজন তান্ত্রিকের সাহায্য নেওয়ার। গ্রামে পুরোনো কাহিনি শোনা যেত—পাহাড়ঘেরা এক শ্মশানের কাছে এক শক্তিশালী তান্ত্রিক থাকেন, যিনি জীবিত আর মৃতের মাঝের পর্দা দেখতে পান। শিবাজি লোক পাঠালেন তাঁকে আনার জন্য। দুই দিন পর বিকেলের দিকে দেউড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলেন তিনি—কালো পোশাক পরা, দীর্ঘ দাড়ি, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ, আর হাতে ধূপ আর মন্ত্রলিপি ভরা তামার পাত। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত তেজ ছিল, যেন অন্ধকার ভেদ করে দেখতে পান। সবাই তাকে দেখে সরে দাঁড়াল, কেউ কেউ প্রণাম করল। তান্ত্রিক প্রথমেই মাটি স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করলেন, তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন, “এই মাটি রক্তে ভিজে আছে। শুধু মানুষের নয়, অত্যাচারের অভিশাপ এখানে ঘুমিয়ে আছে। যাদের আত্মা মুক্তি পায়নি, তারা প্রতিশোধ চাইছে।” শিবাজির গলা শুকিয়ে গেল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কি কিছু করা সম্ভব?” তান্ত্রিক মাথা নেড়ে বললেন, “করা সম্ভব, তবে সহজ নয়। আত্মারা অনেক বছর ধরে বন্দি, তাদের রাগ গভীর। তাদের শান্ত করতে হবে পূজা, অর্ঘ্য আর তপস্যার মাধ্যমে।”

সেই রাতেই তান্ত্রিক কাজ শুরু করলেন। আঙিনার মাঝখানে মাটির উপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে তিনি আগুন জ্বালালেন। ধূপের গন্ধে বাতাস ভরে উঠল, আর মন্ত্রপাঠ শুরু হতেই চারপাশ কেঁপে উঠল। শ্রমিকরা ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, গ্রামের প্রবীণরাও জড়ো হয়েছিল। তান্ত্রিক চোখ বন্ধ করে জপতে জপতে হঠাৎ কণ্ঠ উঁচু করলেন, “এখানে যারা কষ্ট পেয়ে প্রাণ দিয়েছো, তোমাদের আমি ডাকি! তোমাদের ব্যথা আমরা অনুভব করেছি!” সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ঘুরপাক খেতে লাগল, আগুনের শিখা লম্বা হয়ে উঠল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তার চারপাশে ঘুরছে। কয়েকজন শ্রমিক ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কারণ মাটির নিচ থেকে গুঙিয়ে ওঠার মতো শব্দ ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল, শত শত মানুষ একসঙ্গে কান্না করছে। শিবাজির বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু তান্ত্রিক নির্ভয়ে বসে রইলেন। তাঁর কণ্ঠ আরও শক্ত হলো, “তোমরা শান্তি পাও, আমরা তোমাদের অর্ঘ্য দেব। রক্ত নয়, আলো তোমাদের মুক্তি দেবে।”

ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই পূজা চলল। ধীরে ধীরে শ্রমিকদের ভয় কমতে শুরু করল, কিন্তু ঠিক তখনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আগুনের ভেতর হঠাৎ ছায়ার মতো কয়েকটি অবয়ব ভেসে উঠল—মাথা নত কৃষকেরা, রক্তমাখা মুখ, চোখে যন্ত্রণার ছাপ। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। অবয়বগুলো ধীরে ধীরে আঙিনার চারপাশে ঘুরতে লাগল, তারপর হঠাৎ এক ঝাপটা হাওয়া বইল, আর তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। তান্ত্রিক চোখ খুলে বললেন, “ওরা আমাদের কথা শুনেছে। কিন্তু এখনো শান্ত হয়নি। তাদের মুক্তি চাই, আর মুক্তি দিতে হবে সঠিক সময়ে, সঠিক অর্ঘ্য দিয়ে। তার আগে কেউ এই বাড়িকে স্পর্শ করতে পারবে না।” তাঁর কণ্ঠে গম্ভীর সতর্কতা, আর সেই মুহূর্তে সবাই বুঝল—এ লড়াই এখনও শেষ হয়নি। কেবল শুরু হলো আত্মাদের সঙ্গে আসল মোকাবিলা।

অধ্যায় ৯ : ক্রোধের বিস্ফোরণ

তান্ত্রিকের সতর্কবাণীর পরেও শিবাজি ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। একদিকে তিনি জানতেন, আত্মাদের শান্ত না করলে কোনো কাজ এগোবে না, অন্যদিকে তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থ তাঁকে বারবার তাড়িত করছিল কাজ দ্রুত শেষ করতে। ঠিক এই টানাপোড়েনের মাঝেই গ্রামের একদল কৌতূহলী যুবক রাতে আঙিনায় ঢুকে পড়ল। তারা ভাবল, “এইসব কুসংস্কার, ভয় দেখানোর জন্য বানানো গল্প।” তারা অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে খুঁড়ে রাখা মাটির ওপর দাঁড়াল, কেউ কেউ হাড় তুলে হাতে নিল, কেউ হাসাহাসি করল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই যেন চারপাশের নীরবতা বিদীর্ণ হলো। হঠাৎ ঠান্ডা ঝড়ের ঝাপটা এসে আগুন নিভিয়ে দিল, বাতাসে শোনা গেল চাপা চিৎকার। যুবকেরা আঁতকে টর্চ ফেলে দিল। অন্ধকারের ভেতর থেকে ছায়ার মতো অবয়ব বেরিয়ে এল, আর তাদের ঘিরে ধরল। ছেলেগুলো ভয়ে দৌড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু কারও পা কাদায় ডুবে গেল, কারও গলা চেপে ধরা হলো অদৃশ্য হাত দিয়ে। তাদের চিৎকারে চারদিক কেঁপে উঠল, আর সেই মুহূর্তে গ্রামবাসীরা ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে এল।

তান্ত্রিক তখনই দৌড়ে এসে মন্ত্র জপ শুরু করলেন। তাঁর হাতের তামার পাতে আগুন জ্বলে উঠল, তিনি উচ্চারণ করলেন, “অশান্ত আত্মারা, থেমে যাও! তোমরা তোমাদের ব্যথা জানিয়েছো, এখন শান্ত হও!” কিন্তু আত্মাদের ক্রোধ এতটাই প্রবল ছিল যে, মন্ত্রের শক্তিও তখন দুর্বল হয়ে পড়ল। ছায়াগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল—কখনো মানুষের মতো, কখনো জন্তুর মতো রূপ নিচ্ছিল। আঙিনার মাটি ফেটে যাচ্ছিল, হাড়ের স্তূপ কেঁপে উঠছিল। গ্রামবাসীরা চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাল, কেউ মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। শিবাজি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর চোখের সামনে ইতিহাসের রক্তাক্ত প্রতিশোধ যেন পুনর্জীবিত হলো। তিনি বুঝলেন, জমিদারের নিষ্ঠুরতায় যারা মারা গিয়েছিল, তাদের ক্রোধ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে আছে, আর আজ তা আগুনের মতো বিস্ফোরিত হয়েছে।

আতঙ্কের সেই রাতে পুরো জমিদারবাড়ি কেঁপে উঠল। ভাঙাচোরা দেওয়াল থেকে ধুলো ঝরে পড়ছিল, জানালা-দরজা হু হু করে কাঁপছিল। তান্ত্রিক প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন আত্মাদের শক্তি দমন করতে, তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হলেও তিনি থামলেন না। শিবাজি এগিয়ে এসে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলে তিনি কঠিন স্বরে বললেন, “দূরে থাকো! এখন যদি ভয় দেখাও বা বাধা দাও, সবাই মরবে।” কিন্তু তবুও শিবাজির মনে হলো—এই লড়াইয়ে কেবল তান্ত্রিকের মন্ত্র যথেষ্ট নয়। আত্মাদের মুক্তি চাই, তাদের কষ্টের স্বীকৃতি চাই। তিনি কাঁপা গলায় চিৎকার করে বললেন, “যারা অন্যায় সহ্য করেছো, আমি তোমাদের সামনে মাথা নত করছি! তোমাদের স্মৃতি চিরদিন এই আঙিনায় রইল!” তাঁর কণ্ঠ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, আর ঠিক তখনই ছায়াগুলো কিছুটা থেমে গেল। তান্ত্রিক সুযোগ বুঝে আরও জোরে মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন। আগুন আবার উঁচু হলো, আর একে একে ছায়াগুলো ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেতে লাগল। রাতটা কাটল এক ভীষণ ভয়ে, কিন্তু ভোর হতে না হতেই বোঝা গেল—যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, কেবল সাময়িকভাবে থেমেছে। আত্মাদের ক্রোধ দমন করা গেছে, মুক্তি এখনো আসেনি।

অধ্যায় ১০ : মুক্তির আলো

ভোরের আলো ফুটতেই তান্ত্রিক ক্লান্ত শরীরে উঠে দাঁড়ালেন। সারা রাতের যুদ্ধ তাঁর চেহারায় ক্লান্তি আর চোখে গাঢ় দাগ ফুটিয়ে তুলেছিল। তিনি আঙিনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ধীর গলায় বললেন, “ওরা এখনো শান্ত হয়নি। সামান্য থেমেছে মাত্র। যদি এখনই পূর্ণ অর্ঘ্য না দেওয়া হয়, যদি তাদের আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা না করা হয়, তবে ওরা আবার আসবে—আর তখন কেউ আটকাতে পারবে না।” শিবাজি তখন এক অদ্ভুত সংকল্পে ভরে উঠলেন। তিনি বুঝলেন, তাঁর ব্যবসার লোভে তিনি এতদিন অদৃশ্য মানুষের ব্যথাকে অস্বীকার করেছিলেন। এখন তাঁর সামনে একটাই পথ—যাদের আত্মা অশান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের শান্তি দিতে হবে। তিনি সবার সামনে ঘোষণা করলেন, “এই আঙিনার উপর আর কোনো প্রাসাদ গড়ে উঠবে না। এখানে তৈরি হবে স্মৃতিস্তম্ভ, যারা অন্যায় সহ্য করেছে, তাদের নামহীন আত্মাদের শ্রদ্ধা জানাতে।” গ্রামের মানুষ চমকে উঠল, কেউ চোখ ভিজিয়ে ফেলল। তান্ত্রিক মৃদু হাসলেন, যেন এই সিদ্ধান্তের জন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন।
পরের দিন থেকে পূজার আয়োজন শুরু হলো। আঙিনার চারপাশে প্রদীপ জ্বালানো হলো, গঙ্গাজল ছিটিয়ে মাটি শুদ্ধ করা হলো। তান্ত্রিক মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন, গ্রামের পুরোহিতরাও যোগ দিলেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সবাই মিলে ফুল আর অন্ন অর্ঘ্য হিসেবে মাটির নিচে কঙ্কালগুলোর কাছে নিবেদন করল। ঢাকের শব্দে, শঙ্খধ্বনিতে, ধূপ-ধুনোর গন্ধে আঙিনা ভরে উঠল। একসময় তান্ত্রিক হাত উঁচিয়ে উচ্চারণ করলেন, “যারা কষ্টে প্রাণ দিয়েছো, আজ তোমাদের মুক্তির অর্ঘ্য দেওয়া হলো। আলোয় মিলিয়ে যাও, শান্তি পাও।” সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল—আঙিনার ওপর দিয়ে হালকা সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ল, বাতাসে আর কোনো চাপা কান্নার শব্দ শোনা গেল না। যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা অনুভব করল যেন বুকের ভার হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। মাটির নিচের হাড়গুলো যেন নিঃশব্দে শ্বাস ফেলল, আর ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে এক হয়ে গেল।

সেদিন রাতে প্রথমবার জমিদারবাড়ির আঙিনা শান্ত রইল। কোনো ছায়া ভেসে উঠল না, কোনো চাপা গোঙানি শোনা গেল না। গ্রামবাসীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কয়েকদিন পর শিবাজির তত্ত্বাবধানে সেখানে সত্যিই একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হলো—সাদা পাথরের ছোট্ট স্তম্ভ, যেখানে লেখা হলো, “অন্যায়ের শিকার নামহীন আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।” মানুষজন ফুল দিয়ে প্রণাম করত, সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালাত, আর বিশ্বাস করত, আত্মারা এখন শান্তি পেয়েছে। শিবাজি দাঁড়িয়ে সেই স্তম্ভের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখে একধরনের প্রশান্তি ঝলমল করছিল। তিনি বুঝলেন, এই দেউড়ির আঙিনা আর শুধু ভয়ের জায়গা নয়, এটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের সাক্ষী, যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ চিরকাল বেঁচে থাকবে। তান্ত্রিক শেষবারের মতো বললেন, “মুক্তি এসেছে। অভিশাপের শেষ হলো।” আর গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করল—অবশেষে দেউড়ির আঙিনা পেয়েছে তার চিরন্তন শান্তি।

শেষ

1000070519.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *