গ্রামের কালীমন্দিরে দুর্গাপূজার অষ্টমীর রাত মানেই এক অন্যরকম আবহ। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই মন্দিরের পুজো দেখতে। সন্ধ্যা থেকেই মন্দিরের চত্বর আলোয় ভরে উঠেছিল, শঙ্খধ্বনি, ঢাকের শব্দ, কাশীর বাঁশির সুর আর ধূপকাঠির ধোঁয়া মিলেমিশে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করেছিল। গ্রামের ছোটো থেকে বড়ো সবাই নতুন কাপড় পরে এসেছিল, কেউ প্রণাম দিতে, কেউ আবার প্রতিমা দর্শন করে আনন্দ পেতে। মন্দিরের সামনের উঠোনে তখন নাচগানের আসর বসেছিল, কচিকাঁচারা ধুনুচি হাতে ঘুরছিল আর মায়ের আরাধনায় মেতে উঠেছিল। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুমুদিনী দেবী, গ্রামের জমিদারবাড়ির বিধবা, তাঁর চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন উৎসবের আনন্দের ভেতরও কোথাও এক অজানা ভয় তাঁর বুক চেপে ধরেছিল। পুরোহিত হরিদাস চক্রবর্তী পুজোর ব্যস্ততায় মগ্ন, বারবার মন্ত্রপাঠ করছেন, আর তাঁর কণ্ঠস্বর মাইকের আওয়াজকে ছাপিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। অর্ণব মুখার্জী, শহর থেকে আসা তরুণ গবেষক, হাতের নোটবইয়ে টুকে নিচ্ছিলেন গ্রামীণ আচার-অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি। তিনি খুব মন দিয়ে দেখছিলেন কীভাবে দেবীর আরাধনা হচ্ছে, কেমনভাবে মানুষ আস্থায় ডুবে আছে। সবকিছু এক অদ্ভুত জাদুময়তার আবরণে ঢাকা পড়েছিল।
কিন্তু সেই মুগ্ধ মুহূর্তেই হঠাৎ ঘটল অকল্পনীয় এক দৃশ্য। নাচগানের ভিড়ের ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল রত্না, গ্রামের কিশোরী নর্তকী। সে প্রথমে থমকে দাঁড়িয়ে, তারপর আঙুল তুলে কেঁপে ওঠা কণ্ঠে বলল—“দেখো! দেখো, মায়ের চোখ থেকে রক্ত ঝরছে!” সবাই একসঙ্গে দৃষ্টি ফেরাল মূর্তির দিকে। আর তারপর—স্তব্ধতা। চারদিকে আলো ঝলমল করছে, শঙ্খ বাজছে, কিন্তু সবকিছু যেন থেমে গেল, কারণ দেবীর কালো মুখমণ্ডলের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল গাঢ় লাল তরল। আলোয় সেটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, মনে হচ্ছিল রক্তের বিন্দুগুলো আস্তে আস্তে গড়িয়ে প্রতিমার গালে নেমে আসছে। মন্দিরে হট্টগোল শুরু হলো। কারও চোখ কপালে, কেউ আবার ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। বৃদ্ধারা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, কাঁপা গলায় জপ করতে শুরু করল, আর কেউ কেউ ভয়ে কাঁদতে লাগল। “মা রুষ্ট হয়েছেন… মা আমাদের শাস্তি দেবেন”—কেউ একজন কেঁদে উঠল। মুহূর্তের মধ্যেই এই আনন্দময় উৎসবের পরিবেশ রূপ নিল আতঙ্কে। পুরোহিত হরিদাস এগিয়ে এলেন, চোখে ভয়ের ঝলক লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর গলা কেঁপে উঠল—“এটি দেবীর অভিশাপ! বহু পুরোনো ইতিহাসের অগ্নিপরীক্ষা আবার ফিরে এসেছে।” মানুষের মনে শিহরণ বয়ে গেল, গ্রাম যেন এক অলৌকিক বিভীষিকায় আচ্ছন্ন হলো।
অর্ণব চোখ কুঁচকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন মূর্তির দিকে। তাঁর কাছে বিষয়টি অতিপ্রাকৃত নয়, বরং কোনো প্রকার রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া বা অন্য কৌশলের ফল। কিন্তু তখন সে কথাটা বলার মতো পরিবেশ ছিল না। চারদিক থেকে মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার, “জয় মা কালী” ধ্বনি আর আতঙ্কিত ভিড় মন্দিরের গাঢ় অন্ধকারকে আরও ভারী করে তুলেছিল। রত্না মূর্ছা গিয়েছিল, তাকে কয়েকজন মহিলা কোলে করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল, আর তার কণ্ঠে তখনও আধোচেতন স্বরে শোনা যাচ্ছিল—“মা… মা ডাকছেন…”। কুমুদিনী দেবী দূর থেকে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে তাকিয়ে রইলেন প্রতিমার দিকে, যেন এই রক্তাক্ত দর্শন তাঁকে তাঁর অতীতের কোনো অদৃশ্য শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছে। চারদিকের আলো, ধূপের ধোঁয়া, বাজনার শব্দ—সবকিছু মিলেমিশে এক বিভীষিকাময় নাট্যমঞ্চ তৈরি করেছিল। কেউ কেউ তখনই কানে কানে বলতে শুরু করল—“এ কি সেই অসম্পূর্ণ নরবলি, যার কথা পূর্বপুরুষেরা বলে গেছেন?” গ্রামের বুক কেঁপে উঠল সেই প্রাচীন গুজবের স্মরণে। আনন্দময় দুর্গাপূজা পরিণত হলো ভয়ের উৎসবে, আর গ্রামের ইতিহাসে নতুন এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা হলো সেই রাতে—যে অধ্যায় মানুষকে বারবার মনে করাবে, বিশ্বাস আর আতঙ্কের মিশ্রণ কখনো কখনো যুক্তির আলোকে ঢেকে ফেলতে পারে।
–
মন্দিরের উঠোনে তখনো ভয়ের ছায়া ভাসছে। অষ্টমীর রাতের আনন্দ নিমেষেই পরিণত হয়েছিল এক অচেনা আতঙ্কে। ধূপকাঠির ধোঁয়া যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল, বাতাসে কেমন একটা রক্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বলে অনেকেই শপথ করে বলতে লাগল। কেউ কেউ তখনো প্রতিমার দিকে তাকিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল, আবার কারও চোখে ছিল অন্ধ বিশ্বাসের আগুন। সেই সময় পুরোহিত হরিদাস চক্রবর্তী ধীরে ধীরে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তাঁর কাঁপা হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে উচ্চারণ করলেন—“দেবী রুষ্ট হয়েছেন। এ কেবল সাধারণ অলৌকিকতা নয়, এ এক অভিশাপ। বহু শতাব্দী আগে আমাদের এই গ্রামে অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া এক নরবলি আজ আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, দেবী আমাদের ক্ষমা করেননি।” তাঁর কণ্ঠস্বর গভীর, ভিড়ের ওপরে গর্জে উঠছিল। চারপাশের মানুষ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, কেউ কাঁপা হাতে প্রণাম করছিল, কেউ আবার হাউমাউ করে কাঁদছিল। গ্রামের বৃদ্ধারা তাঁর কথায় আরও জোরে জপ করতে শুরু করল, তরুণরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল, আর শিশুরা আতঙ্কে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফেলল। হরিদাসের কথায় যেন এক অদৃশ্য শেকল তৈরি হল, সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করল—এই অভিশাপ থেকে বাঁচতে হলে আবার দেবীর কাছে রক্তের অর্ঘ্য দিতে হবে।
অর্ণব মুখার্জী দূরে দাঁড়িয়ে প্রতিটি শব্দ শুনছিলেন। তাঁর চোখে পড়ল, হরিদাসের চোখে ভয় যতটা নেই, তার চেয়ে বেশি আছে নাটকীয়তা। যুক্তিবাদী মনের মানুষ হিসেবে অর্ণব জানতেন, ইতিহাসে নরবলি প্রথা ছিল, কিন্তু তা বহু আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে গ্রামের এই ভয়ার্ত মানুষগুলোর কাছে পুরোহিতের প্রতিটি কথা যেন শিলালিপির মতো সত্য হয়ে উঠছে। “অসম্পূর্ণ নরবলি”—শব্দটা চারদিকে গুঞ্জনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। মানুষজন কানে কানে বলতে শুরু করল, “সেই রাতে দেবীর খঞ্জর শেষবার আঘাত করতে পারেনি…”, “বলিরত মানুষের আত্মা আজও শান্তি পায়নি…”, “এই রক্ত সেই অসম্পূর্ণ বলির রক্ত…”। হরিদাস তাঁদের ভয়কে আরও উসকে দিয়ে বললেন—“দেবী আমাদের থেকে বলি দাবি করছেন। যদি না দিই, এই গ্রাম অভিশপ্ত হয়ে যাবে, ফসল নষ্ট হবে, শিশু মারা যাবে, আর আমাদের বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।” তাঁর প্রতিটি বাক্য গ্রামবাসীর মনের অজানা অন্ধকারকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কুমুদিনী দেবী, যিনি তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। সবাই ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরল, কিন্তু তাঁর ঠোঁট থেকে বেরোল অস্পষ্ট কয়েকটি শব্দ—“আমাদের… পাপ…”।
এই মুহূর্তে রক্তিমা, গ্রামের তরুণ শিক্ষিকা, সাহস করে সামনে এগিয়ে এসে বললেন—“পুরোহিতমশাই, ভয় দেখিয়ে কোনো সমাধান হবে না। মূর্তির চোখ থেকে রক্ত পড়ার পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে। এটা হয়তো কোনো রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, হয়তো কেউ ইচ্ছে করেই করেছে।” তাঁর কণ্ঠে যুক্তির দৃঢ়তা ছিল, কিন্তু জনতা চিৎকার করে উঠল—“চুপ করো! দেবীকে অপমান করো না! এভাবেই গ্রাম ধ্বংস হবে।” হরিদাস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রক্তিমার দিকে তাকালেন, যেন তাঁর সাহসিকতাকে দেবীর অবমাননা হিসেবে দেখাতে চাইছেন। অর্ণব এবার আর চুপ রইলেন না। তিনি এগিয়ে এসে বললেন—“ইতিহাসে নরবলি প্রথা ছিল, কিন্তু এখন নেই। দেবীর অভিশাপ বলে কিছু নেই। আমরা সবাই মিলে এর বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজতে পারি।” কিন্তু তাঁর যুক্তিবাদী বক্তব্য গ্রামবাসীর কানে গেল না। বরং অনেকেই চেঁচিয়ে উঠল—“এই শহুরে ছেলে কিছু বোঝে না! দেবী যদি রুষ্ট হন, ওঁকেই বলি দিতে হবে।” মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠল। অন্ধবিশ্বাসের ঘূর্ণি গ্রামবাসীদের এমন জায়গায় নিয়ে গেল যেখানে ভয়ই হয়ে উঠল একমাত্র সত্য। পুরোহিত হরিদাস তাঁর হাত তুলে আকাশের দিকে তাকালেন, মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন, আর ভিড় একসঙ্গে জপ করতে লাগল। সেই জপ, সেই আতঙ্ক আর সেই কণ্ঠস্বর মিলেমিশে অষ্টমীর রাতকে রূপ দিল এক অশুভ অগ্নিপরীক্ষায়। অর্ণবের চোখে তখন স্পষ্ট হয়ে উঠল—এ লড়াই শুধু অভিশাপের বিরুদ্ধে নয়, বরং বিশ্বাস বনাম যুক্তিরও এক ভয়ংকর সংগ্রাম।
–
রক্তাক্ত অষ্টমীর রাতের সেই বিভীষিকা গ্রামে যেন অচল সময়ের মতো থমকে গিয়েছিল। ভোর হয়ে এলেও কালীমন্দির ঘিরে মানুষের গুঞ্জন থামছিল না। কেউ বলছিল, দেবী রুষ্ট হয়ে গ্রাম ছেড়ে দেবেন, কেউ বলছিল, আবার নরবলি দিতে হবে। শিশুরা ভয়ে কেঁদে উঠছিল, আর গৃহস্থ বাড়ির দরজায় ছোট ছোট প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছিল যাতে অশুভ শক্তি ঘরে প্রবেশ না করে। এই চরম আতঙ্কের আবহে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অর্ণব মুখার্জী, শহরের অতিথি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষক, মূলত লোকবিশ্বাস আর প্রাচীন আচার নিয়ে পড়াশোনা করছেন। দুর্গাপূজার সময় গ্রামে আসার উদ্দেশ্য ছিল স্থানিক ইতিহাসের কিছু তথ্য সংগ্রহ করা, কিন্তু হঠাৎ ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাই তাঁকে এই কাহিনির কেন্দ্রে এনে ফেলেছে। অন্যরা যেখানে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল, অর্ণবের চোখে সেখানে ছিল কৌতূহল আর যুক্তির আলো। মূর্তির চোখ থেকে ঝরে পড়া রক্ত তিনি ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্য করেছিলেন, আর সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হয়েছিল—এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। রঙের প্রলেপে আর্দ্রতার প্রতিক্রিয়া, কিংবা মূর্তির ভেতরে থাকা কোনো রাসায়নিক মিশ্রণ, অথবা হয়তো কেউ ইচ্ছে করেই এই নাটক সাজিয়েছে।
কিন্তু এই যুক্তিগুলো গ্রামবাসীর কানে যায়নি। অর্ণব যখন প্রথমবার মন্দিরের উঠোনে দাঁড়িয়ে বললেন—“আপনারা ভয় পাবেন না। এটা দেবীর অভিশাপ নয়, বিজ্ঞান দিয়ে এর ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব,”—তখনই জনতা একযোগে তাঁকে শত্রুর মতো দেখতে শুরু করল। বৃদ্ধারা ফিসফিস করে বলতে লাগল—“এ শহরের লোক বিশ্বাস করে না, দেবীর শক্তিকে অপমান করছে।” যুবকেরা চোখ লাল করে তাঁকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল—“তুমি কিছু বোঝো না, এ অভিশাপ! দেবীর অপমান করলে সর্বনাশ হবে।” এমনকি কেউ কেউ হুমকি দিল, যদি অর্ণব দেবীর বিরুদ্ধে কিছু বলে তবে তাঁকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। সেই মুহূর্তে হরিদাস চক্রবর্তী, গ্রামের পুরোহিত, আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন—“এই ছেলেটি অশ্রদ্ধেয়। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে যদি অভিশাপ অস্বীকার করে, তবে সে-ই সর্বনাশ ডেকে আনবে।” তাঁর কথায় জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। কিন্তু অর্ণব একচুল নড়লেন না। শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বললেন—“দেবীর প্রতি আমার কোনো অবিশ্বাস নেই। কিন্তু প্রতিমার চোখ থেকে রক্ত পড়ার পেছনে কারণ খুঁজে বের করাই আমার কাজ। ভয়কে সত্য ভেবে মেনে নেওয়া মানে অন্ধকারকে শক্তিশালী করা।” গ্রামবাসীর বিরাগ তখন প্রবল হলেও, তাঁর চোখে ভয়ের পরিবর্তে সত্য উদ্ঘাটনের সংকল্প স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
এই অবস্থায় গ্রামের স্কুলশিক্ষিকা রক্তিমা এগিয়ে এসে অর্ণবকে সমর্থন করলেন। তিনি বললেন—“আমি বিশ্বাস করি দেবীর শক্তিতে, কিন্তু আমি এটাও জানি, অন্ধ কুসংস্কার মানুষকে ধ্বংস করে। অর্ণববাবু যদি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে চান, তাঁকে সুযোগ দেওয়া উচিত।” কিন্তু রক্তিমার এই যুক্তিবাদী অবস্থানও গ্রামের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বরং মহিলাদের একটি দল চেঁচিয়ে উঠল—“ওরা দুজনেই অশ্রদ্ধেয়, দেবীর শত্রু!” পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তবে এই বিরোধিতার মাঝেই কিছু মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের কচিকাঁচারা আর শিক্ষিত যুবকেরা, অর্ণবের কথায় যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল। তারা নিঃশব্দে ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, যদি সত্যিই এর বৈজ্ঞানিক কারণ থাকে? অর্ণব বুঝলেন, তাঁকে এখানে শুধু রহস্যের সমাধান করতে হবে না, বরং অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধকারের সঙ্গে লড়তেও হবে। তাঁর কাঁধের ব্যাগে রাখা নোটবইতে তিনি দ্রুত কিছু পর্যবেক্ষণ লিখে রাখলেন—মূর্তির গায়ের প্রলেপ, আর্দ্রতার মাত্রা, মন্দিরের ভেতরের তাপমাত্রা। তাঁর মাথায় তখন একটাই চিন্তা—এই রক্তাক্ত অলৌকিকতার আসল রহস্য খুঁজে বের করতেই হবে। না হলে এই গ্রাম ভয়, অভিশাপ আর প্রতারণার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। তিনি জানতেন, এই লড়াই সহজ হবে না। কারণ এখানে শুধু বিজ্ঞানের সঙ্গে কুসংস্কারের লড়াই নয়, বরং ক্ষমতার সঙ্গে সত্যেরও এক ভয়ংকর সংঘর্ষ অপেক্ষা করছে।
–
অর্ণব সেই বিকেলে কুমুদিনী দেবীর বিশাল প্রাসাদসদৃশ বাড়িতে পৌঁছেছিলেন। বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা ঐশ্বর্যপূর্ণ দেখায়, ভেতরে ঢুকতেই যেন এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। দেয়ালে ঝোলানো পুরোনো ছবিগুলো, কাঠের খোদাই করা দরজার গায়ে জমে থাকা ধুলো, আর ছাদ থেকে ঝুলে পড়া ভাঙাচোরা ঝাড়বাতি—সব মিলিয়ে পরিবেশটা যেন একটা সময়চ্যুত স্থবিরতার আভাস দিচ্ছিল। কুমুদিনী দেবী, যিনি গ্রামের মানুষের কাছে রহস্যময়ী রমণী হিসেবে পরিচিত, নিজে কোথাও উপস্থিত ছিলেন না, তবে তাঁর অনুমতিতে অর্ণব বাড়ির ভেতরে ঘোরাঘুরি করছিলেন। ভেতরের করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি পৌঁছে গেলেন এক পুরোনো নথিপত্রে ভরা ঘরে। তাকগুলো ভর্তি দলিল, ধূলোমাখা খাতা, আর তামার পেটিকায় তালাবদ্ধ রেকর্ড। অর্ণব বুঝতে পারলেন, এটাই হয়তো সেই জায়গা যেখানে পরিবারের অতীত ঘুমিয়ে আছে। তিনি ধীরে ধীরে কাগজপত্র উলটে পালটে দেখতে শুরু করলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর চোখে পড়ল এক চামড়ার মোড়কে বাঁধানো দলিল, যেখানে স্পষ্ট লেখা—“শ্রী শম্ভুনাথ মন্দির, ১৮৩৪।” পড়তে পড়তে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দলিলে বর্ণিত ছিল তাঁদের পরিবারের এক গোপন ইতিহাস—যেখানে প্রাচীন কালে দেবতার সন্তুষ্টির জন্য নিয়মিত পশুবলি দেওয়া হতো, কিন্তু কেবল পশুতে সীমাবদ্ধ থাকেনি তাঁদের রীতি। মাঝে মাঝে, বিশেষ পূর্ণিমার রাতে, নরবলিও দেওয়া হতো। অর্ণবের হাত কেঁপে উঠল। এ যেন কেবল কুসংস্কার নয়, বরং অমানবিক নিষ্ঠুরতা, আর তা জড়িয়ে আছে কুমুদিনী দেবীর পূর্বপুরুষদের সাথেই। তিনি চোখ বুজে একবার গভীর শ্বাস নিলেন, যেন দম বন্ধ করা অতীতের ছায়া তাঁকে গ্রাস করছে।
কাগজের স্তূপ আরও উলটে যেতে গিয়ে অর্ণব আবিষ্কার করলেন সেই ঘটনাটির বিবরণ, যা তাঁদের পরিবারের ইতিহাসে এক অভিশাপের মতো জায়গা করে নিয়েছে। দলিলে লেখা ছিল—একবার এক বিশেষ যজ্ঞের সময়, এক তরুণ ব্রাহ্মণকে বলি দেওয়ার জন্য বেদীতে আনা হয়েছিল। গ্রামের প্রবীণরা সেই রাতটাকে মনে রাখতেন কারণ সেই সময় আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল, বজ্রপাত হচ্ছিল, আর মন্দিরের চারপাশে অদ্ভুত সুর শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থেকে যায়—কারণ সেই তরুণ ভয়ে, প্রতিরোধে, আর মন্ত্রোচ্চারণের মাঝেই আচমকা পালিয়ে যায়। মন্দিরের পুরোহিতরা ও পরিবারের প্রধানরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর খুঁজে পাননি। অসম্পূর্ণ নরবলি দেবতাকে ক্রোধান্বিত করেছিল বলে ধারণা করা হয়, আর সেদিন থেকে শুরু হয় এক অদ্ভুত অভিশাপ। দলিলে স্পষ্ট লেখা ছিল, “এই অপরাধের পাপভার আমাদের বংশকে চিরকাল বহন করতে হবে। যতদিন না দেবতার কাছে সম্পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত হয়, ততদিন শান্তি আসবে না।” এই কথাগুলো পড়ার পর অর্ণবের গা শিউরে উঠল। তিনি ভাবলেন, হয়তো এই কারণেই এতদিন ধরে কুমুদিনী দেবীর পরিবারকে কেন্দ্র করে এত অদ্ভুত ঘটনার জন্ম হয়েছে। কেন গ্রামবাসী তাঁদের প্রতি একধরনের ভয় আর ঘৃণার মিশ্র অনুভূতি পোষণ করে—তার উত্তর লুকিয়ে আছে এই ইতিহাসে। মন্দিরে অসম্পূর্ণ রক্তবলির সেই ভয়ংকর রাত যেন আজও সময়ের অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, আর তারই অদৃশ্য ছায়া বর্তমান প্রজন্মের জীবনে নেমে এসেছে। অর্ণবের চোখে ভেসে উঠল সেই রাতের দৃশ্য—ভাঙা মন্দিরের ভিতর ছটফট করতে থাকা এক যুবক, হাতে রক্তমাখা কৃপাণ ধরা পুরোহিত, আর ভয়ে সন্ত্রস্ত জনতা। এই ভয়াবহ অতীত যেন তাঁর মনের ভেতর এক দগদগে চিহ্ন এঁকে দিল।
কিন্তু দলিলের শেষে যে কথাগুলো লেখা ছিল, তা অর্ণবকে আরও বেশি আলোড়িত করল। সেখানে উল্লেখ করা ছিল, প্রতিটি প্রজন্মেই পরিবারের প্রধান পুরুষ অথবা নারী এই অপরাধবোধের ভার নিজের কাঁধে বহন করবেন। এ এক অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা—যেন ভয়ংকর এক গোপন সত্য তাঁদের বংশধরদের বুকের ভেতর কবর দেওয়া আছে, অথচ ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। অর্ণব বুঝলেন, কুমুদিনী দেবী কেন এত রহস্যময়, কেন তাঁর চোখের ভেতর সর্বদা এক চাপা আতঙ্কের ছায়া খেলা করে। হয়তো তিনি জানেন এই ইতিহাস, হয়তো তিনি রাতের নির্জনতায় সেই অসম্পূর্ণ যজ্ঞের অভিশপ্ত প্রতিধ্বনি শুনতে পান। দলিলের শেষ লাইন অর্ণবকে যেন গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিল—“যে রাতে পূর্ণিমার চাঁদ রক্তাভ হয়ে উঠবে, সে রাতেই আবার দেবতার কাছে রক্ত উৎসর্গ সম্পূর্ণ করতে হবে। নইলে এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।” অর্ণবের কপালে ঘাম জমল। তিনি উপলব্ধি করলেন, শুধু অতীতের রহস্য নয়, বর্তমানেও এর ভয়ংকর প্রতিফলন ঘটতে পারে। বাড়ির বাইরে হঠাৎ একটা ঝোড়ো হাওয়া বইল, জানলার কপাট ধাক্কা খেয়ে জোরে বন্ধ হয়ে গেল, আর সেই শব্দে তাঁর বুকের ভেতর ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল, কুমুদিনী দেবীর গোপন অতীত শুধু অতীত নয়, বরং এখনো জীবিত, এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বাড়ির প্রতিটি অন্ধকার কোণে। অর্ণব বুঝলেন, এই সত্য জানার পর তাঁর যাত্রা আর আগের মতো থাকবে না—কারণ তিনি এখন জড়িয়ে গেছেন এমন এক অভিশাপে, যা বহু যুগ ধরে ছায়ার মতো লেগে আছে কুমুদিনী দেবীর রক্তস্রোতে।
–
রত্না প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো কেবলই অদ্ভুত এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পেরোতেই সে বুঝতে পারল—এটা নিছক স্বপ্ন নয়, যেন এক অদৃশ্য হাত প্রতিদিন তাকে একই দৃশ্য দেখাতে বাধ্য করছে। রাত গভীর হলে, গ্রামের নিস্তব্ধতা যখন কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরে কুকুরের ঘেউ-ঘেউ-এ ভাঙে, তখনই তার চোখ হঠাৎ খুলে যায় ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে এক অলৌকিক, ভীতিপ্রদ মঞ্চ—রক্তমাখা দেবীর আবির্ভাব, চোখ দুটি লাল অঙ্গারের মতো জ্বলছে, হাতে ঝলসে ওঠা খঞ্জর, আর সেই খঞ্জরের ধারালো মুখে রক্তের বিন্দু ঝরছে। বলির বেদীতে শুয়ে আছে একজন মানুষ—কখনো তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না, কেবল অসহায় দেহটা কাঁপছে, আর চারপাশে শোনা যায় গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণের আওয়াজ। রত্না ঘেমে-নেয়ে ওঠে, বুক ধড়ফড় করে, ঠোঁট শুকিয়ে যায়। সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু চারপাশে সব শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলেও বুকের ভেতরে আতঙ্কের চাপা ঢেউ থেকে যায়, তাকে অস্থির করে তোলে। কয়েকদিন ধরে এই একই দৃশ্য বারবার আসতে থাকে, আর প্রতিবারই রত্না বুঝতে পারে—তার ভেতর কিছু একটা বদলাচ্ছে। যে মেয়েটি একসময় গ্রামের অন্য মেয়েদের মতো স্বাভাবিক ছিল, হাসত, কাজ করত, মেলামেশা করত, সে ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে গম্ভীর, আতঙ্কিত আর অন্তর্মুখী। যেন অজানা এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অচেনা অন্ধকারের দিকে।
এই পরিবর্তন প্রথমে তার পরিবার খেয়াল করে। মা তাকে ডাকলেও সে চুপচাপ বসে থাকে, চোখ ফাঁকা, কখনো আবার নিজে নিজে বিড়বিড় করে অদ্ভুত কিছু বলতে থাকে—“মা এসেছে… ডাকছে আমাকে… আমি যাই…।” রাতের বেলা তার ঘরে আগুনের শিখার মতো আলো দেখা যায়, যদিও পরে বোঝা যায় সেটা কেবল কুয়াশার প্রতিফলন বা তার নিজের ভীত চোখের বিভ্রম। একদিন হঠাৎ করে সকালের বেলায় সে গ্রামের মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, খালি পায়ে, এলোমেলো চুলে, আর চিৎকার করে বলতে লাগল—“দেবী আমায় ডাকছে… আমি ছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না…।” গ্রামবাসীরা তখন চারপাশে জড়ো হয়ে গেল। কারও চোখে আতঙ্ক, কারও চোখে কৌতূহল। অনেকেই বলল, দেবী নিশ্চয়ই রত্নাকে বেছে নিয়েছেন বিশেষ বলির জন্য বা দেবীর ‘সেবায়’। পুরনো কুসংস্কারের গ্রামে এটা নতুন কিছু নয়—যখনই কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে বা অস্বাভাবিক আচরণ করে, তখনই ধরে নেওয়া হয় যে দেবতা বা দেবী তাকে নিজেদের দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন। রত্নার বাবা-মা অশ্রুসিক্ত চোখে গ্রামের পুরোহিতের কাছে গেল, সমাধান খুঁজতে। কিন্তু পুরোহিতও রহস্যময় গলায় বললেন, “দেবী যদি কাউকে বেছে নেয়, তাকে আটকানো যায় না। হয়তো ও-ই দেবীর প্রিয়পাত্র, ওর মাধ্যমেই গ্রামকে আশীর্বাদ বা শাস্তি দেবে।” কথাটা শুনে গ্রামবাসীর ভেতরে ভয় আরও গভীর হল। অনেকেই রত্নাকে সম্মান আর আতঙ্কের মিশ্র দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করল—কেউ ফুল দিয়ে পূজা দিল, কেউ আবার দূরে সরে গেল যেন ছোঁয়া লাগলেই অশুভ নেমে আসবে।
রত্না নিজেও বুঝতে পারছিল না সে আসলে কিসের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। প্রতিরাতে একই দৃশ্য, একই রক্তমাখা দেবীর আবির্ভাব, একই বলির বেদী। কখনো কখনো স্বপ্নে সে নিজেকেই দেখতে পেত বলির জায়গায় শুয়ে আছে, আর দেবীর হাতে খঞ্জর ঝলসে উঠছে তার বুকে নামার জন্য। ভয়ে কেঁপে উঠে সে দমবন্ধ হয়ে জেগে উঠত, কিন্তু ঘুমাতে গেলেই আবার সেই চক্র। তার ভেতরের বাস্তব আর স্বপ্নের সীমানা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। দিনের বেলায়ও সে হঠাৎ থমকে যেত, কারও সঙ্গে কথা বলার মাঝেই যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে যেত। সে বলত—“তোমরা কি শুনতে পাচ্ছো? দেবী ডাকছে…” আশেপাশের মানুষ ভয়ে সরে যেত। গ্রামের গুঞ্জন তখন তুঙ্গে—“দেবী নিশ্চয়ই শীঘ্রই রক্ত চান, নইলে শান্ত হবে না।” কেউ কেউ আবার ফিসফিস করে বলত, রত্নার স্বপ্নই নাকি আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত, হয়তো গ্রামে বড় কোনো দুর্যোগ আসতে চলেছে। রত্নার চোখে তখন কেবল আতঙ্কের ছায়া—কখনো সে চুপচাপ বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো হঠাৎ উঠে নাচতে শুরু করে দেবীর মূর্তির সামনে, যেন কোনো অদৃশ্য সুরের তালে তার শরীর দুলছে। তার মানসিক ভারসাম্য ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল, আর গ্রামবাসীরা ক্রমশ দৃঢ় বিশ্বাসে আবদ্ধ হচ্ছিল যে দেবী তাকে বেছে নিয়েছেন এক অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্যের জন্য। স্বপ্ন, ভীতি আর কুসংস্কারের জালে বন্দি হয়ে রত্না তখন এক অদৃশ্য অন্ধকারের গভীরে ডুবে যাচ্ছিল, যেখান থেকে ফেরার রাস্তা কেউ দেখাতে পারছিল না।
–
গভীর রাতের নিস্তব্ধতা গ্রামের উপর ভর করেছিল, কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেই চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছিল মানুষের মধ্যে। ডাহুকের ডাক আর বাঁশবনের অদ্ভুত শব্দ নিয়ে সকলে আতঙ্কিত হলেও, কেউ খোলাখুলি বলতে সাহস পাচ্ছিল না। ঠিক তখনই পঞ্চায়েত প্রধান গৌতম ঘোষালের ভূমিকা সামনে আসে। বাইরে থেকে তাঁকে যতটা দৃঢ়, যতটা প্রভাবশালী মনে হয়, ভেতরে তিনি ততটাই ভীত ও কাঁপা মানুষ। গ্রামের কয়েকজন সকলে মিলে তাঁকে প্রশ্ন করতেই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এসব নিয়ে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই। তাঁর যুক্তি—গ্রামের বাইরে খবর ছড়িয়ে গেলে, গ্রামকে মানুষ ‘অভিশপ্ত’ বলে চিনবে। এতে যেমন জমির দাম কমে যাবে, তেমনি বাইরের লোক আর ব্যবসায়ীরা এড়িয়ে চলবে। গ্রামীণ অর্থনীতি, বিয়ের সম্পর্ক, সামাজিক মর্যাদা সবকিছু ভেঙে পড়বে। এই যুক্তি অনেককেই চুপ করিয়ে দিলেও, অর্ণবের মনে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করে। সে বুঝতে পারছিল, গৌতম ঘোষালের ভয়টা কেবল সামাজিক অপমানের কারণে নয়—এর আড়ালে আরও গোপন কোনো রহস্য আছে। তাঁর চোখেমুখে, কথার ভঙ্গিতে এমন এক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছিল, যা সাধারণ ভয়ের প্রকাশ নয়। যেন তিনি এমন কিছু জানেন, যা প্রকাশ্যে এলে কেবল গ্রাম নয়, তাঁর নিজের অবস্থানও বিপন্ন হবে।
অর্ণবের সন্দেহ ক্রমশ গভীর হতে থাকে, বিশেষ করে যখন সে গোপনে দেখে গৌতম ঘোষাল বাঁশবনের দিকে রাতে যাতায়াত করছেন। লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে তিনি যেন কিছু খুঁজছেন, আবার কিছু লুকোচ্ছেনও। এক রাতে অর্ণব তাঁকে অনুসরণ করে দেখতে পায়, গৌতম হাতে একটি পুরোনো কাঠের বাক্স নিয়ে বাঁশবনের প্রান্তে পৌঁছলেন। আলো-আঁধারির ভেতরে দাঁড়িয়ে তিনি হঠাৎ চারপাশে তাকালেন, যেন নিশ্চিত হতে চাইছেন কেউ তাঁকে লক্ষ্য করছে কিনা। তারপর তিনি তাড়াহুড়ো করে মাটির নিচে কিছু পুঁতে দিলেন। অর্ণব দূর থেকে দৃশ্যটা দেখলেও কাছে গিয়ে প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি। কিন্তু তার মনে দৃঢ় ধারণা হয়—গৌতম ঘোষাল গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কোনো না কোনো সত্য গোপন করছেন। আর সেই সত্য ডাহুকের ডাকের রহস্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। পরদিন যখন তিনি প্রকাশ্যে বলেন, “এ সব কুসংস্কার, এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো ঠিক নয়,” তখন তাঁর কথার ফাঁকেই অর্ণব টের পায়—এই সরলীকরণ আসলে ঢাকনা দেওয়ার চেষ্টা। তিনি যত বেশি ঢাকতে চাইছেন, ততই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে কোনো অন্ধকার লুকিয়ে আছে। অর্ণবের মনে হয়, শুধু ভয় নয়—গৌতমের সঙ্গে হয়তো সক্রিয় ষড়যন্ত্রও জড়িয়ে থাকতে পারে।
অর্ণব সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সরাসরি মুখোমুখি হতে হবে। সে এক সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত কার্যালয়ে গিয়ে গৌতম ঘোষালের সঙ্গে আলাপ জমায়। সিগারেট হাতে গৌতম ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভান করছিলেন নির্ভারতার, কিন্তু তাঁর হাতের কম্পন, চোখে অন্যমনস্ক দৃষ্টি সবই ফাঁস করে দিচ্ছিল অন্তর্গত অস্থিরতা। অর্ণব ইচ্ছে করে তাঁকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে—গ্রামের পুরোনো ইতিহাস, বাঁশবনের প্রাচীন আচার, এমনকি ডাহুকের ডাক নিয়ে গোপন বিশ্বাস সম্পর্কেও। প্রথমে গৌতম এড়িয়ে যান, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই অজান্তেই তাঁর কথা থেকে বেরিয়ে আসে কয়েকটি ইঙ্গিত। তিনি বলেন, “কিছু জিনিস আছে, যা চাপা থাকাই ভালো। না হলে ভয়ংকর বিপদ আসবে।” এই কথার পর হঠাৎই তিনি চুপ করে যান, যেন নিজের মুখের উপর তালা বসালেন। অর্ণব বুঝে যায়, ষড়যন্ত্র কেবল গুজব নয়—এখানে বাস্তব কোনো অপরাধ বা গোপন ঘটনা চাপা দেওয়া হচ্ছে। গৌতম ঘোষালের মুখে এই অর্ধেক সত্যি আর লুকোনো ভয়ের মিশ্রণ এক ভয়াল আভাস ছড়িয়ে দেয়। অর্ণব তখনই স্থির করে, যত বড়ই বাধা আসুক, এই ষড়যন্ত্রের পেছনের সত্য তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। কারণ এখানে শুধু কুসংস্কার নয়, মানুষের লোভ, স্বার্থ আর অপরাধ লুকিয়ে আছে, যা গ্রামের ভবিষ্যৎকে গ্রাস করতে বসেছে।
–
দুলাল মাঝির মুখ শুকনো হয়ে গিয়েছিল, গলার স্বর বারবার কেঁপে উঠছিল, যেন তার ভেতরে জমে থাকা আতঙ্ক ধীরে ধীরে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে। অর্ণব আর রক্তিমা তাকে ঘিরে বসেছিল, চারদিকে জ্বলছিল কেবল একটি কেরোসিন লণ্ঠন—তার ম্লান আলোয় ঘরের দেওয়ালে ছায়ারা ভুতুড়ে নাচন করছিল। রক্তিমা বারবার সিগারেট ধরিয়ে তার ধোঁয়া বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছিল, আর অর্ণব ধীরে ধীরে কাগজে নোট নিচ্ছিল, চোখ এক মুহূর্তের জন্যও দুলাল মাঝির মুখ থেকে সরাচ্ছিল না। অনেক টানাপোড়েনের পর দুলাল মাঝি গলা নামিয়ে বলে উঠল, “বাবুরা, ওই মন্দিরের নিচে এক পুরোনো কক্ষ আছে। সেই কক্ষেই এক কালে অসম্পূর্ণ বলি হয়েছিল। গ্রামের বৃদ্ধদের মুখে শুনেছি, সেই বলির অসম্পূর্ণ রক্তাক্ত ক্রোধ আজো মাটির নিচে জমে আছে। আমি সেখানে একবার ভুলে ঢুকেছিলাম কিশোর বয়সে, কিন্তু তারপর থেকে আমার ভেতরে এক ভয় চিরকাল থেকে গেছে। অন্ধকার কক্ষটার ভেতরে এক অদ্ভুত ঠান্ডা আছে, শ্বাস নিতে গেলেই মনে হয় যেন কারও রক্তমাখা আঙুল গলায় চেপে বসেছে।” কথা বলতে বলতে তার হাত কাঁপছিল, ঘাম ঝরছিল, যেন স্মৃতিগুলো তার ভেতর থেকে টেনে বের করে নিচ্ছে। অর্ণবের ভ্রূ কুঁচকে গেল, সে ফিসফিস করে বলল, “মানে তাহলে সেই ‘অভিশাপ’-এর শুরু ওই কক্ষ থেকেই?” দুলাল মাঝি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সায় দিল, “হ্যাঁ বাবু, বলির কাজ অসম্পূর্ণ ছিল বলেই দেবীর রোষ এখনো শান্ত হয়নি। তাই এতদিন ধরে প্রতি অমাবস্যার রাতে ওই মন্দির থেকে ওই ভয়াল শব্দ বেরোয়—আপনারা শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
রক্তিমা হালকা হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে ব্যঙ্গের চেয়ে বেশি ছিল উদ্বেগ। “কিন্তু দুলাল কাকু, যদি বলিই অসম্পূর্ণ থাকে, তবে তো আসলে কারও প্রাণ নেওয়া হয়নি? তাহলে এই ভয়ের আসল উৎসটা কী?” দুলাল মাঝির চোখে একরাশ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। সে কাঁপা গলায় উত্তর দিল, “ওই রাতের ঘটনা কেউ পুরো বলতে সাহস পায়নি। তবে যা শোনা যায়, তখনকার রাজপুরোহিত এক তরুণীকে দেবীর নামে বলি দিতে চেয়েছিল। গ্রামের কিছু মানুষ বাধা দিয়েছিল, ঝগড়াঝাটি হয়েছিল, আর ঠিক সেই সময় ঝড়-বৃষ্টি নেমে আসে। বজ্রপাত পড়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে আগুন লেগে যায়। মেয়েটিকে মুক্ত করা হয়েছিল বটে, কিন্তু আগুনের ভেতরে রাজপুরোহিত আর কয়েকজন ভস্ম হয়ে যায়। তারপর থেকে গ্রামের বয়স্করা বলে এসেছে—সেই মেয়েটির চিৎকার, সেই অসম্পূর্ণ যজ্ঞের রক্তমাখা প্রতিজ্ঞা আজো ওই কক্ষের ভেতরে আটকে আছে। আমি যখন ঢুকেছিলাম, তখন দেয়ালে দেখেছিলাম শুকনো লাল দাগ—যেন মাটির ভেতর থেকে রক্ত গড়িয়ে উঠেছে। অন্ধকারে একটা গন্ধও পাই—পোড়া মাংস আর ধূপ-ধুনোর মিশ্রিত গন্ধ। বাবুরা, আমি শপথ করে বলছি, ওই জায়গায় কোনো মানুষ বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না।” তার কথা শেষ হতেই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, অর্ণবের মনে অদ্ভুত টান তৈরি হলো—যেন এই অন্ধকার ইতিহাসই তার তদন্তের পরবর্তী সূত্র হতে চলেছে। রক্তিমা ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে বলল, “অর্ণব, মনে হচ্ছে আমাদের ওই কক্ষটা একবার দেখতে হবেই। ভয় হোক বা অভিশাপ—সত্যিটা লুকোনো আছে সেখানেই।”
কিন্তু কথার পরমুহূর্তেই চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। লণ্ঠনের আলো আচমকা দপদপ করে উঠল, আর বাতাসে হালকা মৃদু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—কেউ যেন ধূপ জ্বালিয়েছে দূরে কোথাও। অর্ণব ও রক্তিমা দুজনেই স্থির হয়ে গেল, আর দুলাল মাঝি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “ওরা এসেছে! আমি জানতাম—এইসব কথা মুখে আনলেই ওরা শোনে।” তার শরীর কাঁপতে লাগল, চোখ উল্টে উঠল, যেন সে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। অর্ণব তৎক্ষণাৎ তার কাঁধ ধরে বসিয়ে দিল, আর রক্তিমা তাকে পানি খাইয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু দুলাল মাঝি হাপাতে হাপাতে শেষ কথাটা বলে উঠল, “ওই কক্ষের নিচে নামবেন না বাবুরা… ওখানকার অন্ধকার শুধু অভিশাপ নয়, ওখানে এমন কিছু আছে যা আপনাদের চোখে ধরা দেবে না… কিন্তু ওর হাত থেকে কেউ বাঁচে না।” এই বলে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল খাটের উপর। বাইরে তখন হাওয়া বইছে, নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে একটানা শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। অর্ণব সিগারেট ধরাল, গভীরভাবে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। তার চোখের গভীরে ঝিলিক দিচ্ছিল কৌতূহল আর ভয়—দুয়েরই মিশ্রণ। রক্তিমা ধীরে ধীরে বলল, “অর্ণব, আজ রাতটা মন্দিরের জন্যই লেখা আছে। ভয় পেলেও সত্য থেকে পালানো যাবে না। দুলাল কাকু যে গল্প বলল, তাতে উত্তর লুকিয়ে আছে।” অর্ণব নীরবে মাথা নেড়ে জানাল, “হ্যাঁ, এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। আমাদের নামতেই হবে অন্ধকারের ভেতরে।” সেই সিদ্ধান্তে যেন ঘরের দেওয়ালও সাড়া দিল—ছায়ারা আরও গাঢ় হয়ে উঠল, আর বাইরের রাত হয়ে উঠল আরও অশুভ।
–
রক্তিমা এবার একেবারে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে আতঙ্ক নয়, বরং এক ধরনের অনুসন্ধিৎসা। তিনি নিজের ব্যাগ থেকে একটি ছোট হ্যান্ড-ল্যাম্প, magnifying glass এবং কিছু রাসায়নিক দ্রব্য বের করলেন। মূর্তির চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হলো, আলো প্রতিফলনের ধরন অস্বাভাবিক। সাধারণ পাথরের চোখে এমন কেমন উজ্জ্বলতা আসতে পারে? তিনি হ্যান্ড-ল্যাম্পের আলো একেবারে কাছ থেকে ফেলতেই স্পষ্ট দেখা গেল—চোখের মণির ভেতরে যেন পাতলা এক স্তর ঝিলিক দিচ্ছে। তিনি magnifying glass দিয়ে আরও কাছ থেকে দেখলেন, আর তখনই খুঁজে পেলেন সেই প্রলেপ। এটি কেবল পাথর নয়, বরং তার ওপর একধরনের রাসায়নিক আবরণ বসানো হয়েছে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো মোমজাতীয় কিছু, কিন্তু একটু খোঁচা দিতেই বোঝা গেল সেটি কঠিন ও স্বচ্ছ, কাচের মতো। রক্তিমার মনে প্রশ্ন জাগল—এটা এখানে এল কীভাবে? এই প্রলেপ যদি সত্যিই কৃত্রিমভাবে লাগানো হয়ে থাকে, তবে এর উদ্দেশ্য কী? ভৌতিক কাহিনির আবহে আটকে থাকা মানুষ হয়তো বলবে, “দেবীর অলৌকিক শক্তি, রাতের বেলা চোখ জ্বলে ওঠে।” কিন্তু রক্তিমা জানতেন, বিজ্ঞানের নিয়ম ভাঙা যায় না। কিছুতেই না। তাই এই আলো আসছে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া কিংবা প্রতিফলনের কারণে। তিনি এক টুকরো কটন-সোয়াব দিয়ে চোখের কিনারা থেকে একটু নমুনা নিলেন। কটনেই লেগে রইল এক হালকা নীলচে আস্তরণ। তিনি সেটিকে কাঁচের ছোট শিশিতে ভরে রাখলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে একটা ঝড় উঠল—কে এই প্রলেপ লাগাল? গ্রামের সাধারণ মানুষদের পক্ষে এ রকম সূক্ষ্মভাবে রাসায়নিক ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাহলে কি কোনো বহিরাগত, কোনো গবেষক, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো ষড়যন্ত্রকারী?
এই প্রশ্নই তাঁকে ভেতরে ভেতরে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। তিনি ভাবলেন—এমনও হতে পারে, এই প্রলেপ আসলে ফসফরাস বা অন্য কোনো ফসফরাসজাত যৌগ, যা অন্ধকারে আলো ছড়ায়। অতীতে বিজ্ঞানীরা glow-in-the-dark প্রলেপ বানাতে যে উপাদান ব্যবহার করতেন, সেগুলোও অনেকটা এমনই কাজ করত। আবার অন্য একটি সম্ভাবনাও মাথায় এলো—কোনো শিল্পী বা রসায়নবিদ হয়তো বিশেষভাবে এই মূর্তিকে ভয়ঙ্কর করার জন্য এই আবরণ বসিয়েছে, যাতে রাতে গ্রামবাসীরা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে থাকে। মানুষের মনের মধ্যে যখন ভৌতিক আতঙ্ক ঢুকে যায়, তখন যুক্তি আর চলে না। সে সুযোগ নিয়ে কেউ যদি এই গ্রামে অন্য কোনো কুকর্ম চালাতে চায়, তবে খুবই সুবিধা হবে। রক্তিমা জানতেন, গ্রামের মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটছে—গবাদি পশু নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, রাতে কারও চিৎকার শোনা, আবার হঠাৎই মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলা। হয়তো এই সব কিছুর পেছনে একই সূত্র আছে। হয়তো কেউ ইচ্ছে করে দেবীর অলৌকিক শক্তির ভ্রান্ত ধারণা ছড়াতে চাইছে। তিনি মাথায় একেকটা সম্ভাবনার থ্রেড গেঁথে গেঁথে এক অদৃশ্য জালের ছবি আঁকতে লাগলেন। চারদিকে নিস্তব্ধ অন্ধকার, শুধু পেঁচার ডাক ভেসে আসছে। সেই ভয়াবহ পরিবেশেও তাঁর চোখে এক ঝলক আগুন। তিনি মূর্তির চারপাশ ঘুরে আরও খুঁটিনাটি খুঁজতে লাগলেন—পায়ের তলায় কোনো চিহ্ন আছে কি না, পেছনে কোনো খোপ বা ফাঁকা জায়গা লুকোনো আছে কি না। আর তখনই তিনি লক্ষ্য করলেন—মূর্তির বাঁ-চোখের নিচে এক ক্ষুদ্র ফাঁক। আঙুল দিয়ে খোঁচাতেই মনে হলো, সেটি খসখসে। অর্থাৎ, কেউ জোর করে ওই জায়গায় প্রলেপ বসিয়েছে। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো।
তবে প্রশ্নটা এখানেই—কে এই কাজ করল? কেন? যদি কেবল মানুষকে ভয় দেখানোই উদ্দেশ্য হয়, তবে তার লাভ কী? কার স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে এতে? নাকি এর আড়ালে আছে আরও গভীর কোনো রহস্য? হয়তো এই গ্রামকে কেন্দ্র করে চলছে অদৃশ্য এক খেলা—অর্থ, সম্পদ, অথবা জমি দখলের। আবার হয়তো এটি কেবল মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের উপায়, যেখানে ধর্ম আর ভয়ের আবহ মিলে মানুষকে বশ মানানো যায়। রক্তিমা হঠাৎই বুঝলেন, তাঁর অনুসন্ধান এখন দ্বিমুখী। একদিকে তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে রাসায়নিক প্রলেপের প্রকৃতি—কোন উপাদান, কোন প্রযুক্তি, কবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর অন্যদিকে খুঁজে বের করতে হবে এর নেপথ্যের মানুষটিকে। বিজ্ঞানের প্রমাণ তাঁকে সত্যের দিকে এগোতে সাহায্য করবে, আর সমাজ-মনস্তত্ত্বের প্রশ্ন তাঁকে নিয়ে যাবে ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচনের দিকে। তিনি জানতেন, এর উত্তর খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠল—এটি নিছক অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নয়। এখানে লুকিয়ে আছে মানুষের হাত, মানুষের বুদ্ধি, আর হয়তো মানুষের লোভ। অথচ গ্রামবাসী মনে করছে দেবীর ক্রোধ, অলৌকিক শক্তির প্রকাশ। এই দ্বন্দ্বই রক্তিমাকে আরও দৃঢ় করল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পরদিনই নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন এবং সাথে সাথে গ্রামের ইতিহাসও খুঁজে দেখবেন—কখন থেকে এই মূর্তি, কে প্রথম এটিকে পূজা শুরু করল, আর সাম্প্রতিক সময়ে কারা এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। রাত যত গভীর হলো, চারদিক ততই নিস্তব্ধ হয়ে এলো। মূর্তির চোখ থেকে ক্ষীণ আলো এখনো ঝিকমিক করছে, কিন্তু রক্তিমার চোখে তা আর ভয়ের নয়—বরং অনুসন্ধানের অঙ্গীকার। তিনি মনে মনে বললেন, “যতই রহস্য ঘনীভূত হোক, সত্যি একদিন বের হবেই। বিজ্ঞান থেমে থাকবে না।”
–
অর্ণব যখন মন্দিরের নিচের কক্ষে প্রবেশ করল, তখন গুহার মতো অন্ধকারে তার টর্চের আলো ছুরি-কাঁচির মতো আঁকিবুঁকি কাটছিল শ্যাওলা ধরা প্রাচীন প্রাচীরে। স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আর ইতিহাসের ভার যেন দেয়ালের গায়ে জমে আছে। সে প্রতিটি পাথরের দিকে গভীর দৃষ্টি দিল, কারণ সে জানত—এখানেই সেই রহস্যের উত্তর লুকিয়ে আছে, যা এতদিন ধরে গ্রামবাসীর মনে আতঙ্ক আর অজানার অন্ধকার তৈরি করেছে। বহু বছর ধরে চলে আসা সেই বিশ্বাস, যে মন্দিরের বলি অসম্পূর্ণ ছিল এবং দেবতার অভিশাপ এখনো গ্রামে ভর করে আছে—আজ তার পর্দা সরে যাবে। হঠাৎই টর্চের আলোয় সে দেখতে পেল দেয়ালের গায়ে খোদাই করা শিলালিপি, যেগুলো কালচে হয়ে গেলেও শব্দগুলো এখনো স্পষ্ট। অর্ণব হাত বুলিয়ে পড়তে শুরু করল, আর প্রতিটি বাক্য যেন অগ্নিশিখার মতো তার মনের সমস্ত প্রশ্ন জ্বালিয়ে উত্তর দিতে লাগল। জানা গেল, আসলে কোনো নরবলি অসম্পূর্ণ হয়নি—বরং এক সাহসী নারী সেই অমানবিক প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই নারী ছিলেন গ্রামেরই একজন, যিনি নিজের স্বামীকে বলি থেকে বাঁচাতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন দেবতার সামনে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন—দেবতা কখনো রক্ত চান না, দেবতা চান ভক্তির অর্ঘ্য, আর মানুষের প্রাণ নেওয়া পাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই একরাশ দৃঢ় উচ্চারণ, সেই বিরল প্রতিবাদ ছিল আসল বাঁকবদল। অথচ এই সত্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢেকে রেখেছিল পুরোহিত পরিবার, কারণ বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে গেলে তাদের হাতে থাকা ক্ষমতা, অর্থ আর প্রভাব সবকিছুই ভেঙে পড়ত।
অর্ণবের বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো। এতদিন ধরে ভয় আর কুসংস্কারের ছায়ায় যে গ্রাম অন্ধকারে ডুবে ছিল, সেখানে আসলে আলো লুকিয়ে ছিল একজন নারীর সাহসে। তার মনের চোখে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য—রাতের আঁধারে মশালের আলো, শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের আওয়াজে ভরে থাকা মন্দিরচত্বর, আর তারই মধ্যে এক গৃহবধূর অটল কণ্ঠে উচ্চারণ—“আমার স্বামীর প্রাণ নেবেন না, দেবতা মানুষ হত্যা চান না।” এ যেন সময়কে চ্যালেঞ্জ জানানো এক বিদ্রোহ, যা গ্রামের ইতিহাসে কোনোদিন লেখা হয়নি, কারণ একদল ক্ষমতালোভী পুরোহিত সেই ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রেখেছিল নিজেদের স্বার্থে। তারা দেবতার নামে ভয় ছড়িয়েছে, মানুষকে অন্ধবিশ্বাসে বেঁধেছে, আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিজেদের প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ রেখেছে। অর্ণব ভাবল, সত্য যদি এতকাল ধরে লুকোনো থাকে, তবে এই গ্রাম কেবল অভিশপ্তই নয়, প্রতারিতও। কিন্তু এখন এই শিলালিপিই হয়ে উঠবে সাক্ষ্য, প্রমাণ যে অভিশাপ বলে কিছু নেই—বরং আছে এক নারীসাহসের উত্তরাধিকার, যা পুরোহিতরা মুছে দিতে চেয়েছিল। সে অনুভব করল, তার হাতে উঠে এসেছে সেই চাবি যা গ্রামবাসীকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে বুঝল, এই সত্য প্রকাশ করা সহজ হবে না, কারণ আজও যারা পুরোহিত পরিবারের প্রভাবশালী উত্তরসূরি, তারা নিশ্চয়ই এই আলোকে নিভিয়ে দিতে চাইবে।
অর্ণব সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল, সত্যকে আর গোপন রাখা যাবে না। ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে ভয় নয়—আত্মমর্যাদা আর সাহস গ্রামবাসীর রক্তে সঞ্চারিত হয়। সে শিলালিপির প্রতিটি শব্দ ক্যামেরায় ধারণ করল, নিজের নোটবুকে লিপিবদ্ধ করল, যেন কোনো শক্তিই পরে এই প্রমাণকে ধ্বংস করতে না পারে। তার মনে হচ্ছিল, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই গ্রামের আত্মা যেন শৃঙ্খলিত হয়ে ছিল এক ভ্রান্ত বিশ্বাসে, আর আজ সেই শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। বাইরে হয়তো তখন রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, বাতাসে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি ঝুলছে, কিন্তু অর্ণব অনুভব করছিল তার হৃদয়ের মধ্যে এক বিদ্যুতায়িত স্রোত বইছে। সে জানত, এই আবিষ্কার শুধু এক রহস্যের সমাধান নয়, বরং এক মুক্তির দ্বার। আর সেই মুক্তি আনতে হলে তাকে সত্যের আলো সবার সামনে আনতেই হবে—যত বড়ো বাধাই আসুক না কেন। সত্যকে অস্বীকার করা মানে আরেকটি প্রজন্মকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখা, যা সে কখনোই মেনে নেবে না। অর্ণবের চোখে তখন দৃঢ়তার আগুন—আজ থেকেই শুরু হবে এক নতুন লড়াই, অন্ধবিশ্বাস আর মিথ্যের বিরুদ্ধে সত্যের ঘোষণা।
–
অষ্টমীর রাতের সেই রক্তাক্ত দর্শন থেকে শুরু হয়ে যে অস্থিরতা গ্রামকে গ্রাস করেছিল, তার পরিণতি এসে দাঁড়াল বিজয়ার প্রাক্কালে। চারিদিকে ভয়, সন্দেহ আর অন্ধকার যখন গ্রামবাসীর শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়েছে, তখন সিদ্ধান্ত হলো—শেষ রাতে দেবীকে শান্ত করার জন্য এক বিশেষ পূজার আয়োজন হবে। পূজার দায়িত্ব নিলেন পুরোহিত হরিদাস চক্রবর্তী, যিনি এতদিন ধরে ঘোষণা করে আসছিলেন—দেবী রুষ্ট, দেবী নরবলি চান। ঢাকঢোল, শঙ্খধ্বনি আর ধূপের গন্ধে ভরে উঠল মন্দিরচত্বর। মহিলারা আতঙ্ক আর ভক্তির মিশ্র আবেগে দেবীর সামনে দাঁড়ালেন, পুরুষরা নিজেদের শ্বাস আটকে রইলেন। বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল অদৃশ্য এক শক্তির ওজনে। কিন্তু অর্ণব, রক্তিমা আর কয়েকজন তরুণ-তরুণী জানতেন, আজকের রাত শুধু পূজার রাত নয়—আজকের রাত হলো সত্য প্রকাশের রাত। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ চলছিল, কিন্তু অর্ণব দাঁড়ালেন সবার সামনে এবং হঠাৎই উচ্চকণ্ঠে বললেন, “আজ আর কোনো ভয়ের পূজা নয়, আজ আমরা সত্যের পূজা করব।” তাঁর হাতে ধরা শিলালিপির প্রতিলিপি সবাইকে দেখাতে শুরু করলেন। গ্রামের মানুষ হতবাক হয়ে শুনতে লাগল সেই কথা—যে দেবী নরবলি চান না, বরং এক সাহসী নারী শত বছর আগে রক্তপাত বন্ধ করেছিলেন।
মুহূর্তেই পরিবেশ বদলে গেল। মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল, এতদিন তবে তারা কী বিশ্বাস করছিল? তাদের ভক্তির নাম করে কে তাদের ভয় দেখাচ্ছিল? সেই উত্তর যেন নিজের মুখ থেকেই বেরিয়ে এলো। হরিদাস চক্রবর্তীর চোখে তখন ভয়ের ছায়া। এতদিন যে মানুষ দেবতার অভিশাপ বলে ভয় দেখিয়ে তাঁর পায়ের নিচে নত হয়ে এসেছিল, সেই মানুষই আজ প্রশ্ন তুলছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো—“আপনি কেন এই সত্য গোপন করেছেন?”—কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। অর্ণব সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আপনারা এতদিন ধরে দেবীর নামে যে রক্তের অভিশাপ বহন করেছেন, তা মানুষ সৃষ্টি করেছে। দেবী কোনোদিন রক্ত চাননি। এই ভয়, এই অন্ধবিশ্বাসই তাঁকে আঁধারে বন্দি করে রেখেছিল।” চারিদিকে ফিসফাস শুরু হলো, আর তাতে যোগ দিলেন রক্তিমা, যিনি বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করলেন কীভাবে মূর্তির ভেতরে রাসায়নিক প্রলেপ লাগানো হয়েছিল, যাতে দেখে মনে হয় রক্ত ঝরছে। “এটি অলৌকিকতা নয়, এটি কারও পরিকল্পিত কাজ”—তিনি বললেন। হরিদাস তখন আর মুখ লুকোতে পারলেন না। স্পষ্ট হয়ে গেল—এই ষড়যন্ত্র তিনি করেছিলেন, নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য, গ্রামবাসীকে ভয় আর ভক্তির জালে বেঁধে রাখার জন্য। গ্রামবাসীর চোখে তখন শুধু রাগ আর হতাশা।
সেই মুহূর্তে ঘটে গেল আসল পরিবর্তন। গ্রামের প্রবীণ নারী, শিশু, যুবক—সবাই মিলে সশব্দে ঘোষণা করলেন—“দেবীকে ভয় নয়, ভক্তি দাও। দেবী রক্ত নন, আলো চান।” ধূপের ধোঁয়া আর শঙ্খের আওয়াজে ভরে উঠল বাতাস, কিন্তু এবার সেই আওয়াজ ছিল মুক্তির আওয়াজ। অজান্তেই মূর্তির চোখ থেকে ঝরে পড়া লাল তরল থেমে গেল। যেন দেবী নিজেই মুক্তি পেলেন অন্ধকারের শৃঙ্খল থেকে। মানুষের বুক থেকে সরে গেল শতবর্ষের চাপা আতঙ্ক। পূজার মঞ্চে হরিদাস চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে রইলেন নির্বাক, আর তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ আর তাঁকে পুরোহিত বলে মানতে চাইলো না। এ যেন এক যুগান্তরের সূচনা—যেখানে অন্ধবিশ্বাস ভাঙল, সত্য আর সাহস মাথা তুলল। রাতের আকাশে শঙ্খধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো, কিন্তু এবার সেটি অভিশাপ মোচনের ঘোষণা, মুক্তির ধ্বনি। গ্রামের মাটিতে প্রথমবার যেন হালকা হাওয়ার মতো শান্তি নেমে এলো। বার্তা স্পষ্ট হলো সবার মনে—দেবী কোনো রক্ত চান না; মানুষের ভয়, অন্ধবিশ্বাস আর মিথ্যাই তাঁকে আঁধারে আটকে রেখেছিল। আজ মানুষ সেই আঁধার ভেঙে দিয়েছে, আর দেবীও মুক্ত হয়েছেন মানুষের সাহস আর যুক্তির আলোয়।
—-



