Bangla - ভূতের গল্প

দূর্গাপুরের কয়লা খনি

Spread the love

রাতটা ছিল ভয়ংকর, দূর্গাপুরের আকাশজুড়ে ঘন কালো মেঘ জমে উঠেছিল, যেন প্রকৃতিই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করছিল আসন্ন বিপর্যয়ের। পুরোনো কয়লা খনিটি দিনের পর দিন ক্লান্ত শরীরের ঘাম শুষে নিয়েছে, হাজারো হাতুড়ির আঘাতে প্রতিদিন মাটির গা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে কালো রুটি, কিন্তু সেই রাত যেন ভিন্ন ছিল। শ্রমিকরা কাজ শেষ করে অন্ধকার টানেলের গভীরে শিফট পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, হঠাৎ ভূগর্ভ থেকে গম্ভীর গর্জন উঠতে লাগল। মনে হচ্ছিল, মাটি যেন কেঁপে উঠছে, দেয়ালের কাঠের পাটাতন ভেঙে পড়ার মতো শব্দ উঠছিল, বাতাসে ভেসে আসছিল ধুলো আর কয়লার গন্ধে ভারী নিঃশ্বাসরোধ করা পরিবেশ। শ্রমিকরা চিৎকার করল, “ধস হচ্ছে, বাইরে বেরোও!” কিন্তু বেরোনোর আগে অনেকেই পথ হারিয়ে ফেলল অন্ধকারে। বিদ্যুতের আলো বারবার নিভে যাচ্ছিল, শুধু মোমবাতি আর ছোট্ট লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোতে ছুটে চলা শ্রমিকদের চোখে ভয়ের ছায়া ফুটে উঠছিল। যে টানেল দিয়ে বাইরে আসার কথা, সেখানেই হঠাৎ শিলাখণ্ড গড়িয়ে পড়ে পথ আটকে দিল, কিছু মানুষ চাপা পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। তাঁদের বুকফাটা আর্তনাদ অন্ধকারের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যেন মাটি নিজেই কেঁদে উঠছে।

বাইরে তখন ঝড় তাণ্ডব চালাচ্ছে। বজ্রপাতের আলোয় মাঝে মাঝে খনির মুখ ঝলসে উঠছিল, গ্রামের মানুষ দৌড়ে এসে খনির সামনে জড়ো হল। শ্রমিকদের পরিবার, স্ত্রী, সন্তানরা কান্নায় ভেঙে পড়ছিল, কেউ কেউ খনির ভেতরে ঢুকতে চাইছিল প্রিয়জনকে খুঁজতে, কিন্তু পুলিশ আর নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দিচ্ছিল। ভেতর থেকে তখনও ভেসে আসছিল হাতুড়ির শব্দ, যেন কেউ শেষ চেষ্টা করছে দেওয়াল ভেঙে বেরোতে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল কাশির শব্দ, মাটির ধুলোয় শ্বাসকষ্টে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের কণ্ঠ। কিছু শ্রমিক বাইরে ছুটে আসতে পেরেছিল, তাদের মুখে আতঙ্ক আর হতভম্বের ছাপ, তারা শুধু বারবার বলছিল—“সব শেষ হয়ে গেল, সব চাপা পড়ে গেছে।” বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা কানে হাত দিয়ে শুনতে পাচ্ছিল মাটির গভীর থেকে আসা মৃদু সুরের মতো—এমন এক লোকগান, যা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে গাইত, হয়তো মৃত্যুর মুখেও সেই গানই তাঁদের ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসছিল শেষ আশার মতো। আকাশের গর্জন আর মানুষের আর্তনাদ মিশে এক অদ্ভুত শোকগাথা তৈরি করছিল।

সকাল হল, কিন্তু রাতের সেই রক্তক্ষরণ আর ভয়ঙ্কর ধসের চিহ্নগুলো মাটির ওপর স্পষ্ট হয়ে রইল। খনির প্রবেশপথ পাথর আর ধ্বংসস্তূপে সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গেল, উদ্ধারকারীরা চেষ্টা করেও একফোঁটা আলো পৌঁছে দিতে পারল না ভেতরে। কয়েকজন শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হলেও অধিকাংশ মানুষ সেই কালো অন্ধকারের ভেতর চিরতরে হারিয়ে গেল। গ্রামের উপর নেমে এলো এক অচিন্তনীয় শোকের ছায়া, যেন সকলে একসাথে শতাধিক প্রাণ হারাল। প্রশাসন এল, তদন্তের নামে কয়েকজনকে জেরা করল, কিন্তু খুব দ্রুতই ঘোষণা করা হল যে খনিটি আর চালানো যাবে না। সরকারী সিল মারা হল প্রবেশপথে, আর গ্রামের মানুষ বুঝে গেল, এ শুধু এক খনি নয়—এ এক কবরস্থান, যেখানে চাপা পড়ে আছে স্বপ্ন, রুটি-রুজি আর অগণিত কান্না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, ভোরের আলো ফুটতেই মাটির নিচ থেকে ভেসে আসা সেই আর্তনাদ, হাতুড়ির শব্দ আর গানের সুর যেন একেবারে থেমে গেল। মনে হল, রাতের অন্ধকারে খনি শেষবারের মতো তার ভেতরে চাপা পড়া মানুষগুলোর ব্যথা প্রকাশ করেছিল, আর সকালের আলোয় সব স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষজন বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল, কেউ কেউ অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইল কালো ধোঁয়ায় ঢাকা প্রবেশপথের দিকে। সেই দিন থেকেই দূর্গাপুরের ওই পুরোনো খনি হয়ে গেল ভয়ের প্রতীক, যেখানে রাতের আতঙ্ক সকালের নীরবতায় মিলিয়ে গেল, কিন্তু রেখে গেল এক অমোঘ প্রশ্ন—সেই আর্তনাদগুলো কি সত্যিই থেমেছিল, নাকি অন্ধকার মাটির গভীরে এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল অশরীরী কণ্ঠে?

ধসের রাতের পর অনেক বছর কেটে গেল, কিন্তু দূর্গাপুরের সেই পুরোনো কয়লা খনির নাম আজও কেউ মুখে আনে না। প্রশাসন দ্রুতই খনির চারপাশে উঁচু বেড়া তুলে দিল, লোহার গেট তালা দিয়ে বন্ধ করে দিল ভেতরে যাবার সমস্ত রাস্তা। সাইনবোর্ডে বড় হরফে লেখা হলো—“প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বিপজ্জনক এলাকা।” অথচ যতবারই মানুষ সেই বেড়ার পাশ দিয়ে যায়, তাঁদের মনে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে আসে। গ্রামের শিশুরা খেলতে খেলতে খনির দিকে দৌড়াতে চাইলে তাঁদের বাবা-মায়েরা আতঙ্কে চিৎকার করে ডাকেন, যেন অদৃশ্য কোনো হাত ছেলেদের টেনে নিতে পারে ভেতরে। বছরের পর বছর ধরে গাছপালা বেড়ে উঠেছে বেড়ার ধারে, লতাগুল্ম আর ঝোপঝাড়ে প্রায় ঢেকে গেছে সাইনবোর্ড, কিন্তু তাতে ভয়ের কোনো পরিবর্তন আসেনি। আশেপাশের গ্রামবাসীরা সবসময়ই খনির রাস্তা এড়িয়ে অন্য পথে হাঁটেন, এমনকি সেই পথ যদি দ্বিগুণ দীর্ঘ হয় তবুও। তাঁরা বিশ্বাস করেন, খনির চারপাশে এক অশরীরী অন্ধকার বসবাস করছে, যে অন্ধকার এখনও খুঁজছে তার চাপা পড়া মানুষদের সঙ্গ।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, খনির মুখ সিল করে দেওয়ার পর থেকেই লোকজন রাতে অদ্ভুত শব্দ শুনতে শুরু করল। অনেকেই বললেন, মাঝরাতে হঠাৎ করে কাশির শব্দ ভেসে আসে, যেন শতাধিক শ্রমিক একসাথে ধুলোবালিতে হাঁপিয়ে কাশছে। কেউ কেউ শপথ করে বলল, ভেতরে মেশিনের গর্জন এখনও শোনা যায়, ট্রলি ঠেলার শব্দ, হাতুড়ির ছন্দময় আঘাত—যেন খনি এখনও চালু রয়েছে। সবচেয়ে ভয়ানক হলো শ্রমিকদের গাওয়া গান। এক গ্রীষ্মরাত্রিতে গ্রামের কয়েকজন যুবক সাহস করে খনির বেড়ার কাছে বসে থাকল, এবং স্পষ্ট শুনতে পেল ভেতর থেকে ভেসে আসা লোকগানের সুর। সেই সুর ছিল করুণ অথচ শক্তিশালী, যেটা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে গাইত মন শক্ত রাখার জন্য। গান শুনে তাঁদের বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, আর পরের দিন থেকেই কেউ আর খনির কাছে দাঁড়ায়নি। পরিবারের বয়স্করা বলতেন—“ওরা এখনও ভেতরে আছে। মৃতরা শান্তি পায়নি। খনি শুধু মাটির কবর নয়, ওটা হয়ে গেছে আত্মাদের বন্দিশালা।” প্রশাসনের কাছে এইসব কথা পৌঁছালেও তাঁরা সবকিছু কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিল। স্থানীয় কর্তারা ঘোষণা করলেন—“এ সব গুজব ছড়ানো বন্ধ করুন, খনিতে কোনো শব্দ নেই। বাতাসের দিক, মাটির ফাঁপা গহ্বর, আর মানুষের ভয়ের কল্পনা—এসব মিলেই এমনটা মনে হয়।” কিন্তু তাঁদের যুক্তি গ্রামবাসীদের একটুও শান্তি দিল না। বরং, সরকারি লোকেরা যখন হাসাহাসি করে বলল যে এসব কল্পনা ছাড়া কিছু নয়, তখন গ্রামের মানুষদের রাগ আর ভয় আরও বেড়ে গেল।

কিছুদিন পর খনির পাশের মাঠে কৃষকরা খেতে নেমে নতুন আতঙ্কের কথা ছড়ালেন। তাঁরা বললেন, মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে তাঁদের চোখে দেখা যায় ম্লান আলো, যেন লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো দুলছে খনির ভেতর। কখনও কখনও মনে হয় কেউ একজন বেড়ার ওপারে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। গ্রামের কয়েকজন মেয়ে শপথ করে বলেছিল যে সন্ধ্যার পর তাঁরা স্পষ্ট দেখেছে খনির কাছে ধুলোয় ঢাকা শ্রমিকের ছায়া হাঁটছে, তার কাঁধে হাতুড়ি, মুখে ক্লান্তি, চোখে অন্ধকার। এইসব ঘটনার পর থেকেই খনির নাম উচ্চারণ করা হয়ে উঠল নিষিদ্ধ। মানুষ বিশ্বাস করল, সেই রাতের ধসে যারা চাপা পড়ে গিয়েছিল, তাঁদের আত্মা এখনও গহ্বরের ভেতরে বন্দি। তাঁদের কান্না, কাশি আর গান ভেসে আসে বাতাসে, আর সেটাই গ্রামের নিঃশব্দ রাতগুলোকে ভয়ের অতল অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। শিশুদের ঘুম পাড়াতে মায়েরা সতর্ক করত—“ভালো বাচ্চা না হলে খনির ভূত এসে ডাকবে।” কিন্তু ভয়ের গল্প হয়ে উঠল বাস্তবের ছায়া, যা কেউ অস্বীকার করতে পারল না। দিনের আলোয় হয়তো খনির চারপাশ নিস্তব্ধ মনে হত, কিন্তু সূর্য ডুবলেই দূর্গাপুরের মানুষরা নিশ্চিত হয়ে যেত—মাটি কাঁপছে, গান ভেসে আসছে, আর কয়লা খনি আবার জেগে উঠছে মৃতদের কণ্ঠে।

কলকাতার ব্যস্ত শহর থেকে আসা তরুণ সাংবাদিক অরিন্দমের মন সবসময় টানত অজানা রহস্য, যেগুলোতে অন্যরা পা দিতে ভয় পায়। সংবাদপত্রে কাজ শুরু করার পর থেকেই সে ছোট ছোট বিশেষ প্রতিবেদন দিয়ে পাঠকদের নজর কাড়ছিল, কিন্তু তার অন্তরে লুকিয়ে ছিল আরও বড় কিছুর তৃষ্ণা—এমন একটি গল্প যা শুধু পত্রিকার পাতায় নয়, মানুষের স্মৃতির ভেতরও কাঁপন ধরিয়ে দেবে। দূর্গাপুরের পুরোনো কয়লা খনির নাম সে বহুবার শুনেছিল; খবরের আর্কাইভ ঘাঁটতে গিয়ে ধসের ঘটনাও পড়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, সেই ঘটনার খুব সামান্য খবর প্রকাশ হয়েছিল, বেশিরভাগ তথ্য চাপা পড়ে গিয়েছিল সরকারি বিজ্ঞপ্তি আর কারিগরি রিপোর্টের আড়ালে। তবুও গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে খনিকে ঘিরে যে গল্পগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তা অরিন্দমের কৌতূহলকে আরও উসকে দিল। সে শুনেছিল, রাত নামলেই খনির ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে, শ্রমিকদের কণ্ঠে গান শোনা যায়। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগত তার এই শুনে যে মৃতদের নাম কেউ উচ্চারণ করে না—যেন নাম উচ্চারণ করলেই অশরীরী ছায়ারা ডেকে নেবে। অরিন্দমের সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল আর ব্যক্তিগত দুঃসাহস মিলেমিশে এক অদম্য ইচ্ছা তৈরি করল: সে নিজেই যাবে সেই গ্রামে, খনির সত্যটা উন্মোচন করবে, আর পাঠকদের সামনে তুলে ধরবে এক লুকানো ইতিহাস।

ট্রেনের জানালা দিয়ে দূর্গাপুরের প্রান্তর দেখতে দেখতে অরিন্দম বুঝতে পারছিল, শহরের কোলাহল থেকে কতটা ভিন্ন এই জনপদ। খনির কথা ভাবতে ভাবতেই তার মনে হচ্ছিল, এ শুধু একটি দুর্ঘটনার গল্প নয়, এর ভেতরে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে অন্য কোনো সত্য, যেটি ইচ্ছে করে চাপা দেওয়া হয়েছিল। গ্রামে পৌঁছে প্রথম কয়েক ঘণ্টাতেই সে সেই ভয়ের ছায়া টের পেল। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁরা খনির নাম শুনেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন, কেউ হঠাৎ করে বিষয় বদলে দিলেন, কেউবা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন—“ওই জায়গার নাম নিয়ো না বাবু, অশুভ ডাক নেমে আসে।” কয়েকজন বৃদ্ধ শ্রমিকের স্ত্রী ভাঙা গলায় জানালেন, ধসে যাওয়া রাতে তাঁদের স্বামী চিরতরে অন্ধকারে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রশাসন কাউকেই উদ্ধার করতে পারেনি। দেহ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি অনেকের। তাই আজও তাঁদের আত্মা মুক্তি পায়নি। গ্রামজুড়ে এক অলিখিত নিয়ম তৈরি হয়েছে—কোনো শিশুদের নাম রাখা হয় না মৃত শ্রমিকদের নামে, কোনো আড্ডায় বা সংসারে তাঁদের নাম উচ্চারিত হয় না। যেন নামই হয়ে উঠেছে এক অভিশপ্ত আহ্বান, যা ভেঙে দিতে পারে মাটির নিচের নীরবতা। অরিন্দম একদিকে শিহরিত হচ্ছিল, অন্যদিকে তার কৌতূহল আরও গভীর হচ্ছিল।

রাতে, গ্রামে এক ভাড়া করা কুঁড়েঘরে বসে অরিন্দম তার নোটবুকে দ্রুত লিখে যাচ্ছিল অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় তার চোখে ভাসছিল খনির চারপাশে উঁচু বেড়া, কাঁটাতারের ওপারে অন্ধকার, আর সেই অন্ধকারের ভেতরে চাপা কান্নার প্রতিধ্বনি। তার মনে হচ্ছিল, এই গ্রামবাসীরা ভয় আর কুসংস্কারের আড়ালে এমন কিছু সত্য লুকিয়ে রেখেছে যা ইতিহাস জানে না। “যদি মৃতদের আত্মা সত্যিই আটকে থাকে, তবে আমি তাঁদের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দেব বাইরের পৃথিবীতে,” অরিন্দম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল। সে জানত না, এই যাত্রা তাকে শুধু এক সাংবাদিক হিসেবেই নয়, একজন মানুষ হিসেবেও পরীক্ষা নেবে। ভয়, রহস্য আর মৃত্যুর গন্ধ মিশে থাকা সেই খনি তাকে ডাকছিল। খনির দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলল—“যা-ই হোক না কেন, আমি তোমার সত্যি খুঁজে বের করব।”

অরিন্দমের কৌতূহল প্রথম রাতেই তাকে খনির কাছে টেনে নিয়ে গেল। দিনের বেলায় গ্রামটা নিস্তব্ধ ছিল, যেন খনির ভয়ের ছায়া সকলকে চেপে ধরে রেখেছে, কিন্তু রাত নামতেই সেই ছায়া যেন আরও ঘন হতে লাগল। চাঁদের আলোয় অন্ধকারের রেখাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, আর খনির চারপাশে থাকা লোহার বেড়াগুলো যেন মৃতের শিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। অরিন্দম একটি পুরোনো লণ্ঠন সঙ্গে নিয়েছিল, যদিও শহরের ছেলে হওয়ায় এমন অন্ধকারে হাঁটতে তার শরীর শিউরে উঠছিল। তবুও তার ভিতরে এক অদ্ভুত শক্তি কাজ করছিল, যা ভয়কে জিতিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অজানার দিকে। খনির কাছে এসে সে বসে পড়ল একটা শুষ্ক গাছের পাশে, বেড়ার ওপারটা ভালোভাবে দেখার জন্য। বাতাসে কয়লার গন্ধ এখনও যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল, যদিও দশ বছর ধরে খনিটা বন্ধ। দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর কাছের পুকুরে ব্যাঙের শব্দ রাতটাকে স্বাভাবিক মনে করালেও খনির দিকটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে স্তব্ধ। ঠিক তখনই, হঠাৎ করে তার কানে এল এক অদ্ভুত শব্দ—মনে হল যেন হুইসেলের মতো লম্বা একটা ধ্বনি ভেসে আসছে গভীর থেকে।

অরিন্দমের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। শব্দটা আবারও ভেসে এলো, এবার আরও স্পষ্ট, যেন কোনো পুরোনো যন্ত্র বা মেশিন হঠাৎ চালু হয়ে গেছে। সে কান খাড়া করে বসে রইল, আর দেখতে পেল বেড়ার ওপার থেকে মাটির নিচে হালকা কাঁপন হচ্ছে। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল ট্রলি ঠেলা হচ্ছে, চাকার ঘর্ষণের শব্দ, ধাতব যন্ত্রের ঠকঠকানি, আর ফাঁপা গহ্বরের ভেতর প্রতিধ্বনি। অরিন্দম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না—খনি তো বহু বছর আগে সিলমোহর করা হয়েছিল, সেখানে কোনো যন্ত্র থাকার কথা নয়, তাহলে এই শব্দ কিসের? তার শরীর কেঁপে উঠল যখন হঠাৎ করেই শব্দের ফাঁকে সে শুনতে পেল শ্রমিকদের একসাথে ছন্দে গাওয়া গান। সেটা ছিল করুণ অথচ শক্তিশালী এক সুর, যেন অন্ধকারে আটকে পড়া মানুষরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি হাতুড়ির আঘাতের সঙ্গে গানের তাল মিলছে। অরিন্দম শিহরিত হয়ে গেল, কণ্ঠগুলো এত বাস্তব শোনাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল মাটির নিচেই শতাধিক শ্রমিক এখনো খুঁড়ে চলেছে অদৃশ্য সুড়ঙ্গ। সুরের গভীরে ছিল দুঃখ, আবার ছিল এক অদম্য প্রতিবাদের সুর—যেন তারা জানাতে চাইছে, “আমরা হারাইনি, আমরা এখনো বেঁচে আছি।”

অরিন্দম ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু তার সাংবাদিক মন সেই ভয়কে সরিয়ে দিল। সে দ্রুত নোটবুক বের করে শব্দগুলো লিখে রাখল, এমনকি কানের কাছে লণ্ঠনটা ধরে রাখতে চেষ্টা করল যাতে শব্দ আরও স্পষ্ট ধরা পড়ে। মাটির নিচ থেকে আসা গান ক্রমে গভীরতর হতে লাগল, কখনও যেন দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, আবার কখনও বেড়ার একেবারে কাছে চলে আসছিল, এত কাছে যে মনে হচ্ছিল বেড়ার ওপার থেকে হাত বাড়ালেই কোনো অদৃশ্য শ্রমিক তার কাঁধ ছুঁয়ে দেবে। ঘাম জমে উঠছিল অরিন্দমের কপালে, তার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছিল, কিন্তু চোখ সরাতে পারছিল না খনির দিক থেকে। হঠাৎ শব্দের সঙ্গে এক প্রবল ধাক্কা অনুভূত হলো, যেন কেউ ভেতর থেকে দরজায় আঘাত করছে। সে আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে গেল, আর তখনই গান হঠাৎ থেমে গেল। চারদিক আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল, শুধু রাতের হাওয়া আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কিন্তু অরিন্দম জানত, সে ভুল শোনেনি। সেই গান, সেই মেশিনের গর্জন, সেই হুইসেলের মতো ডাক—সবকিছুই বাস্তব ছিল। তার বুকের ভেতর জোরে ধুকপুক করতে লাগল, আর মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করল, যত ভয়ই থাকুক, সে সত্যিটা উন্মোচন করবেই, কারণ এই শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন এক ইতিহাস যা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা জরুরি।

অরিন্দম যখন খনির সেই গভীর রাতের ইতিহাস জানার জন্য স্থানীয় গ্রামে পৌঁছালো, তখন তাকে অভ্যস্ত, তবুও অচেনা কিছু মুখের সামনে দাঁড়াতে হলো। গ্রামের ছোট-বড় কিছু পরিবার, যাদের পুরুষেরা সেই ভীষণ রাতে খনিতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মারা গিয়েছিল, তারা সবসময়ই অরিন্দমের মতো সাংবাদিকদের কথা শুনতে এসেছে। কিন্তু এদিনের আলাপ অন্যরকম—এবার তারা শুধু গল্প বলছিল না, তারা তাদের যন্ত্রণার গল্প বয়ান করছিল, যেটা বছরখানেক ধরে তাদের ঘরে, মনের মধ্যে নিঃশব্দে জমে আছে। তারা বলল, কিভাবে ওই রাতে খনিতে কাজ করা শ্রমিকরা অপ্রত্যাশিতভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এবং কিভাবে তাঁদের মৃতদেহ যথাযথভাবে উদ্ধার করা হয়নি। প্রত্যেকটি মুখে ছিল গভীর বিষাদ, চোখে—অদৃশ্য অশ্রু, আর কণ্ঠে—হাহাকার। অরিন্দম শোনার সময় বারবার মনে হলো, এই পরিবারের চোখের ভাষা আর কথার ভারের মধ্যে লুকিয়ে আছে খনির ভয়ংকর অতীতের এক অবিচ্ছিন্ন ছবি।

প্রত্যেক পরিবারেই ছিল ভিন্ন গল্প, ভিন্ন স্মৃতি, কিন্তু মিল ছিল একই। একজন বয়স্ক মহিলা বলল, তাঁর স্বামী এবং দুই সন্তান সেই রাতে কাজ করছিল। খনির অভ্যন্তরীণ দুর্ঘটনার পর কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই উদ্ধারকারীরা চলে গিয়েছিল। তাঁদের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি, এবং যেটুকু খোঁজা হয়েছিল, তাতেও ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশগুলোকে যত্নসহকারে সযত্নে রাখা হয়নি। সে দিন থেকে প্রতি রাতে মহিলা স্বপ্নে তাঁর স্বামী ও সন্তানদের কান্না শোনে। আরেকটি পরিবার জানিয়েছিল, তাদের বাবা ও ভাইকে খনির কোলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এবং কালের সাথে সঙ্গে দেহ মাটি ও ধুলোয় মিলিয়ে গেছে। সন্তানরা বলেন, “আমরা তাদের শেষবার দেখা যেদিন করেছিলাম, সেই স্মৃতি আমাদের সঙ্গে আছে, কিন্তু তাঁদের শান্তি আজও পাইনি।” অরিন্দম অনুভব করলেন, মৃত্যুর পরেও মানুষের আত্মা শান্তির জন্য নির্ভর করে জীবিতদের সংবেদনশীলতার উপর, এবং সেই সংবেদনশীলতা যদি হারিয়ে যায়, তবে কষ্ট ও ব্যথা নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে প্রবাহিত হয়।

অরিন্দমের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল সেই মুহূর্ত যখন সব পরিবার একত্রে বসে, দেহের অবস্থা, খনির গভীর গোপনীয়তা, আর প্রশাসনের অগোছালো পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছিল। তারা বলল, প্রতিটি মৃত শ্রমিকের জন্য কোনো শোকসভা হয়নি, কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি, এমনকি সরকারের তরফে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা তুচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হল একটাই দাবি—“আমাদের বাবা, ভাই, স্বামীদের মৃত্যু যেন অবহেলিত না হয়; তাঁদের আত্মাকে শান্তি দিতে হবে।” অরিন্দম লিখছিল, কিন্তু সে শুধু তথ্য নোট করছে না; সে অনুভব করছিল সেই নিরবে জমে থাকা দুঃখ, যা বহু বছর ধরে পরিবারগুলোর হৃদয়ে লুকিয়ে ছিল। প্রতিটি গল্পে, প্রতিটি চোখের চোখে, প্রতিটি শব্দে, সে বুঝতে পারছিল যে খনি শুধু ধাতুর জন্য নয়, এখানে জীবনকেও চূর্ণ করেছিল। এই দিনের সাক্ষাৎকার ও আলাপ শেষে অরিন্দমের মনে দৃঢ় হয়েছিল যে, সে শুধু রিপোর্ট লিখছে না—সে মৃতদের নীরবতা, তাদের বঞ্চিত শান্তি এবং জীবিতদের আর্তনাদকে কাগজে বেঁধে রাখছে, যেন একদিন এই বঞ্চিত আত্মাগুলো অন্তত চিরশান্তি পেতে পারে।

অরিন্দম যখন পুরনো সরকারি নথির হেফাজত স্থানটিতে পৌঁছালেন, তখন কেবল অচেনা কাগজপত্রের গন্ধই নয়, বরং অতীতের ভীতিকর ইতিহাসের এক গোপন আলোয় হাঁটার অনুভূতিও তার চারপাশে ঘুরছিল। নথিগুলো অতি প্রাচীন ফাইল এবং ভিজে যাওয়া কাগজে ভরা, যা বহু বছর ধরে ধুলো জমে রেখেছে। সে একে একে পাতাগুলো উল্টে দেখতে থাকলেন, এবং প্রথমেই চোখে পড়ল খনির সেই যন্ত্রপাতির তালিকা, যা ধসের আগের রাতে অকারণে চালু ছিল। যন্ত্রপাতিগুলো কোনো জরুরি কাজ বা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়নি, বরং ঠিক সেই সময়েই, এমন কিছু যন্ত্র সচল রাখা হয়েছিল যা খনিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে—যেমন পাম্প, লিফট, এবং হাওয়া সরবরাহের যন্ত্র। কাগজে চিহ্নিত ছিল সময়সূচি, যন্ত্রের চালু থাকার সময়কাল, এবং নির্দেশিকা, যা কোনো সাধারণ দুর্ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি পরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছিল। অরিন্দমের মনে হলো, এখানে এমন সূক্ষ্ম পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে যা কেউ সাধারণভাবে লুকাতে পারবে না, এবং এই নথি হতে পারে সেই প্রমাণ যা পুরো ঘটনার ধাঁচ পরিবর্তন করতে পারে।

পাঠক্রমে অরিন্দম আরও এক ধাপ এগোলেন এবং দেখলেন কিছু খসড়া চুক্তি ও দুর্নীতির নথি, যা সরকারি কর্মকর্তাদের নামসহ সরাসরি খনির মালিক এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে যুক্ত। কাগজপত্রে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যে এই চুক্তিগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যজনিত বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, এবং বিপদের কোনো ঝুঁকি থাকলে তা গোপন রাখার কথাও লেখা ছিল। একটি বিশেষ নথিতে উল্লেখ ছিল, যে ধসের ঘটনার আগের দিনই খনির একটি বড় অংশে তদারকির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেউ আসেননি। এই নথি অনুযায়ী, কোনো কর্মী যন্ত্রপাতি চালু করতে চাইলেও তিনি বাধা দেননি, বরং চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অরিন্দম যখন এইসব তথ্য একত্র করলেন, তখন মনে হলো, যে ধস একেবারেই দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত, এমনকি সম্ভবত লোভ, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার ছাপ রেখেছিল। নথিগুলো পড়তে পড়তে সে অনুভব করল, শুধু খনির শ্রমিকরা নয়, পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাই এই বিপদের জন্য দায়ী।

এরপর অরিন্দম আরও গভীরভাবে নথিগুলো বিশ্লেষণ করলেন এবং খুঁজে পেলেন একাধিক অঙ্গীকারপত্র ও গোপন তহবিলের হিসাব, যা খনির মালিক এবং স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে লেনদেনের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, যে দুর্ঘটনার পর কোনো মূল তথ্য ফাঁস হলে তা রোখার জন্য নির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর অর্থ, খনির ধস এক ধরনের “সুবিধাজনিত দুর্ঘটনা” হতে পারে, যাতে দায় কেউ নেয় না, ক্ষতিপূরণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি বজায় থাকে এবং কেউ বিচারপ্রক্রিয়ায় যেতে না পারে। অরিন্দম যখন এই নথিগুলো চোখের সামনে সাজালেন, তখন তার হৃদয় মিশ্র অনুভূতিতে ভরে উঠল—একদিকে তিনি সাংবাদিক হিসেবে সত্য উদঘাটনের উত্তেজনা অনুভব করছিলেন, অন্যদিকে, মানুষের লোভ, অমর্যাদা ও ন্যায়ের প্রতি অবহেলার ভয়ংকর চিত্রে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। শেষমেশ সে বুঝল, নথিগুলো শুধু তথ্যের ভাণ্ডার নয়, বরং মৃত শ্রমিকদের নীরব আকণ্ঠ আর মানবিক ইতিহাসের এক অদৃশ্য সাক্ষ্য, যা যদি প্রকাশ পায়, তবে শুধু ধসের প্রকৃত কারণ উদঘাটিত হবে না, বরং সমাজের চোখেও একটা কঠিন প্রশ্ন চিহ্ন রেখে যাবে—মানব জীবনের মূল্য কোথায় এবং কতটা সংরক্ষণ করা হয়।

রাত্রির নির্জনতা যখন চারপাশকে ঘিরে ধরেছিল, অরিন্দমের মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয় মিশ্র অনুভূতি জাগ্রত হল। দিনের আলোতে খনি শুধু ধূলোমাখা দেয়াল আর বন্ধ কক্ষের ভীতিকর দৃশ্য দেখালেও রাতের নিঃশব্দতা, অন্ধকারের চাদরে ঢাকা অগোছালো যন্ত্রপাতি ও অদ্ভুত গন্ধ তার সাহস পরীক্ষা করতে শুরু করেছিল। একটানা চেষ্টার পর সে সিদ্ধান্ত নিল, আজ রাতে, নথি ও পরিবারের বয়ানের পরিপ্রেক্ষিতে, নিজে খনির ভেতরে প্রবেশ করবে এবং সেই রহস্যময় স্থানটির প্রকৃত ছবি নিজের চোখে দেখবে। ভেতরে প্রবেশের মুহূর্তে তাকে প্রথমেই ধাক্কা দিল যন্ত্রপাতির ভাঙাচোরা অবস্থা। ভাঙা ট্রলি, টলাগুলি, ঝুঁকিপূর্ণ সাপোর্ট, এবং ধুলোমাখা খাঁচা—সবই এক অদ্ভুত নিঃশব্দতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন সময় সেখানে থমকে গেছে। বাতাসে ভেসে আসা শ্বাসরোধ করা কাশির শব্দ, প্রতিটি কোণে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারের সঙ্গে মিশে এক অদৃশ্য ভয়ের অনুভূতি জাগাচ্ছিল। অরিন্দমের মনে বারবার প্রশ্ন উঠছিল, সত্যিই কি এই জায়গায় মানুষের জীবন এত সহজেই চূর্ণ হয়ে যেতে পারে?

যত গভীরে সে এগোল, তত অদ্ভুত অনুভূতি বৃদ্ধি পেল। দেওয়ালে চোখ পড়ল এক অদ্ভুত বার্তায়—“আমরা এখনও খুঁড়ছি।” কয়লার ধুলোয় লেখা এই অক্ষরগুলো শুধু অশান্তি নয়, বরং এক ধরণের নীরব আহ্বান, যেন মৃত শ্রমিকরা নিজেরাই এখনও কোনো অজানা দিক নির্দেশ করছে। অরিন্দমের হৃদয় কেঁপে উঠল, কারণ সে জানত এই খনি শুধু মৃত মানুষের স্মৃতি নয়, বরং এখনো যেন তাদের আত্মা ভেতরে আটকে আছে, নিরব নিঃশ্বাসে, অন্ধকারে। সে খেয়াল করল, প্রতিটি কোণেই যেন ধূলোমাখা অন্ধকার নিজস্ব গল্প বলছে—যন্ত্রপাতির ভাঙা অংশ, কেঁপে থাকা দেয়াল, ভেঙে যাওয়া কাঠের সাপোর্ট এবং বাতাসে ভেসে আসা কাশির প্রতিধ্বনি—সবই এক অদৃশ্য জীবনের চিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন্দম একদিকে লিখছিল, অন্যদিকে অনুভব করছিল, এখানে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ যেন অতীতের এক জীবন্ত স্মৃতি স্পর্শ করছে, যেখানে সময় থেমে গেছে এবং মৃতের আর্তনাদ এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

ভেতরের অন্ধকারে প্রতিটি মুহূর্ত অরিন্দমকে আরও গভীরে টেনে নিল। সে খেয়াল করল, খনি শুধু শারীরিক দুর্ঘটনার স্থল নয়, বরং এক অদ্ভুত জায়গা, যেখানে অতীত, অস্থির আত্মা এবং লোভের প্রতিফলন একত্রিত হয়ে আছে। ধুলোমাখা মাটির মধ্যে হালকা আলোর খোঁজে সে এক অদৃশ্য গলিতে প্রবেশ করল, যেখানে বাতাস আরও ভীষণ হয়ে নেমে এসেছে, আর কাশির শব্দ আরও ঘন হয়েছে। অরিন্দম বুঝল, এই খনি শুধু রিপোর্ট বা নথি দিয়ে উদঘাটিত হবে না—এখানে প্রবেশের সাহস এবং চরম সতর্কতার সঙ্গে প্রতিটি পদক্ষেপই সত্যের দরজা খুলতে সাহায্য করবে। দেয়ালে লেখা বার্তাটি বারবার তার মনে বাজছিল—“আমরা এখনও খুঁড়ছি।” তা যেন এক অদৃশ্য সঙ্গী, যা মৃত শ্রমিকদের অমর আত্মাকে আজও জীবিত রাখছে, আর অরিন্দমের মনের ভেতরে সে অনুভূতি জাগাচ্ছিল, যে একদিন এই অন্ধকারের ভেতর লুকানো রহস্য সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত হবে, এবং তাদের শান্তি হয়তো ফিরে পাবে।

অরিন্দম যত গভীরে খনির ভেতরে প্রবেশ করল, ততই তার চারপাশের পরিবেশ যেন এক অদ্ভুত জগতে রূপান্তরিত হতে শুরু করল। অন্ধকার কেবল চোখকে ঢেকে রাখছিল না, বরং শুনতে পাচ্ছিল সে অদ্ভুত শব্দ, যা বাস্তব এবং অতীতের এক মিলিত ছায়ার মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। হঠাৎ করে, বাতাসের মধ্যে মিলেমিশে শ্রমিকদের একসাথে গাওয়া লোকগান বেজে উঠল। গানটি কেবল শব্দ নয়; এটি যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত আত্মার আর্তনাদ, যা বছরগুলো ধরে খনির দেওয়াল, মাটি এবং বাতাসে মিশে আছে। অরিন্দম যখন এগোলেন, তখন শুনতে পেলেন অদৃশ্য হাতুড়ির আঘাত, যেন কেউ অনবরত কয়লা খনির পাথর ভাঙছে। প্রতিটি আঘাতের প্রতিধ্বনি যেন তার কানে একটি গভীর, অমর শোকের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছিল। মাটির ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে এবং বাতাসে মিশেছে তীব্র কয়লার গন্ধ, যা মনে করাচ্ছিল—যদিও খনি কয়েক বছর ধরে বন্ধ, এখানে এখনও যেন কাজ চলছে। অরিন্দম বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ গানের প্রতিধ্বনি নয়; এটি এক প্রেতাত্মার অভিশপ্ত সুর, যা তাদের জীবন ও মৃত্যুর স্মৃতি একসাথে বাঁধছে।

যতক্ষণ অরিন্দম এগোচ্ছিলেন, ততই গানের ছন্দ আরও ঘন হয়ে উঠল। এটি ছিল শ্রমিকদের একসাথে গাওয়া গান, যেখানে তাদের একান্ত আনন্দ, কষ্ট, এবং শেষমেশ বিপদের অনুভূতি মিলেমিশে এক প্রকার মর্মস্পর্শী সুর সৃষ্টি করেছিল। গানের মধ্যে লুকানো ছিল সেই রাতে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের কাহিনী—যন্ত্রপাতির অকারণে চালু থাকা, পর্যবেক্ষকের অবহেলা, এবং মাটির নিচে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাণের যন্ত্রণা। হাতুড়ির অদৃশ্য আঘাত যেন সেই স্মৃতিকে আরও জীবন্ত করে তুলছিল, যেন অরিন্দম দেখতে পাচ্ছিল, শ্রমিকরা এখনও খনির গভীরে তাদের দৈনন্দিন কাজ করছিল, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মতো, অথচ মৃত্যুর সঙ্গী হিসেবে। ধোঁয়া, কয়লার গন্ধ, এবং প্রতিধ্বনিত হাতুড়ির আওয়াজ একত্রে অরিন্দমকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেল যেখানে বাস্তব ও অতীত মিলেমিশে গেছে, এবং সে বুঝতে পারল, খনি কেবল মৃতদের স্মৃতি নয়; এটি যেন একটি জীবন্ত, অভিশপ্ত স্থল।

গানের অভিশপ্ত সুর অরিন্দমের মনকে আঘাত করছিল, কারণ সে জানল যে এই খনি শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিক ও আত্মিকভাবে শ্রমিকদের বঞ্চিত শান্তির প্রতীক। প্রতিটি ফাঁক, প্রতিটি ধূলোমাখা দেয়াল, প্রতিটি ঘর থেকে বের হওয়া ধোঁয়া যেন মৃত শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর বহন করছিল। অরিন্দম অনুভব করলেন, এই অভিশপ্ত গান শুধু অতীতের স্মৃতি নয়; এটি একটি সতর্কতা, একটি বার্তা, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বলছে—এই খনি একবার ধ্বংস করেছে, আবারও করতে পারে যদি সত্য উদঘাটন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা না হয়। সে লিখতে লিখতে শিহরণ অনুভব করছিল, প্রতিটি শব্দের মধ্যে যেন গানটি তার হৃদয়ের ভেতরে প্রবেশ করছিল, এবং সে বুঝতে পারল যে এই অভিশপ্ত সুরের মধ্য দিয়ে খনির সমস্ত গোপন রহস্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে, এবং মৃত শ্রমিকদের আত্মা হয়তো একদিন শান্তি পাবে, যদি মানুষ তাদের ইতিহাস এবং বঞ্চনার মুখোমুখি হয়।

অরিন্দম যখন খনির ভেতরে দীর্ঘ সময় কাটালেন, তখন ধীরে ধীরে সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করল। প্রতিটি ভাঙা ট্রলি, ধুলোমাখা যন্ত্রপাতি, বাতাসে ভেসে আসা কাশির প্রতিধ্বনি—সবই যেন একটি একক বার্তা বহন করছিল: এখানে শুধুই মৃত্যু নয়, এখানে আছে ন্যায়ের অভাবের দীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন। নথি ও পরিবারের বয়ান থেকে অরিন্দম বুঝলেন, ধসে যাওয়া শ্রমিকদের দেহ কখনো সঠিকভাবে উদ্ধার করা হয়নি; দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানি তাদের মৃতদেহ গোপন করে মাটির নিচে চাপা দিয়েছিল। কোনো শোকসভা বা সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা হয়নি; কেউ তাদের আত্মার শান্তির কথা ভাবেনি। এর ফলে শ্রমিকদের আত্মা খনির ভেতরে আটকে থেকে, অদৃশ্য সুর ও যন্ত্রের শব্দের মাধ্যমে বারবার মানবজগতে চিৎকার করছে। অরিন্দমের জন্য এটি ছিল এক ভয়ানক উপলব্ধি—যে শুধুমাত্র শারীরিক মৃত্যু ঘটেছে তা নয়, বরং ন্যায়বিচারের অভাবে আত্মার দুঃখও জীবন্ত থেকে গেছে।

প্রতিটি পদক্ষেপে অরিন্দম অনুভব করছিল, যে শ্রমিকদের আত্মা তাদের অসন্তুষ্টি ও বঞ্চনার প্রতিফলন প্রকাশ করছে। ভাঙা যন্ত্রের ধ্বনি, খাঁচার কেঁপে ওঠা, বাতাসে ভেসে আসা কাশির শব্দ, এবং দেয়ালে লেখা “আমরা এখনও খুঁড়ছি”—সবই এক সঙ্গে মিলেমিশে একটি অভিশপ্ত বার্তা তৈরি করেছিল। তিনি বুঝলেন, তারা কোন শারীরিক অস্তিত্বে নেই, কিন্তু আত্মার স্তরে তারা খনির মধ্যেই প্রবেশ করেছে। এই আত্মার প্রতিবাদ কেবল একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা নয়; এটি একটি সতর্কতা, যা মানব সমাজকে বলছে যে লোভ, অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে যন্ত্রণা ও মৃত্যু কখনো সত্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখা যায় না। শ্রমিকরা ন্যায্য সম্মান ও মুক্তি না পেলে, তাদের আত্মা এমন অদৃশ্যভাবে আন্দোলন চালাতে পারে, যা কখনো শান্ত নয়, বরং প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়—নিষ্পত্তি বা ভুল পথে চলা সমাজের চোখে ন্যায় ও মানবিকতা অম্লান থাকা উচিত।

অরিন্দমের মনে ক্রমেই দৃঢ় হলো, যে খনির ইতিহাস শুধু রিপোর্ট বা নথি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়; এখানে প্রবেশের সাহস, সময় এবং পর্যবেক্ষণ জরুরি। তিনি বেছে নিলেন সমস্ত প্রমাণ, নথি এবং নিজের পর্যবেক্ষণ একত্রিত করে সত্যকে প্রকাশ করা, যাতে মৃত শ্রমিকরা অন্তত সমাধি ও সম্মান পেতে পারে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া শুধু সাংবাদিকতার দায়িত্ব নয়, বরং মানবিক কর্তব্যও—যেখানে লোভ, দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তার প্রতিকার সম্ভব হতে পারে। শ্রমিকদের আত্মা যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, সেটি শুধুমাত্র অতীতের স্মৃতি নয়; এটি একটি শক্তিশালী বার্তা, যা অরিন্দমের কলমের মাধ্যমে সমাজের সামনে আসতে চলেছে। তিনি অনুভব করলেন, একদিন এই ইতিহাস এবং আত্মাদের আর্তনাদ সমুদ্রের মতো প্রবাহিত হয়ে ন্যায় ও মানবিকতার দিকে সমাজকে ঠেলে দেবে, এবং খনির অভিশপ্ত সুর থেকে এক শান্তির সুর জন্ম নেবে।

১০

অরিন্দম যখন সমস্ত সত্য প্রকাশ করলেন, তখন তিনি ভাবলেন যে হয়তো এবার শ্রমিকদের আত্মারা শান্তি পাবে। তিনি রিপোর্ট লিখলেন, নথি উন্মুক্ত করলেন, এবং পরিবারগুলোকে জানালেন যে কতটা পরিকল্পিতভাবে দুর্ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। তিনি সাংবাদিকতার সমস্ত দায়িত্ব পালন করলেন, কোম্পানির দুর্নীতি, প্রশাসনিক অবহেলা এবং শ্রমিকদের অবহেলিত মৃত্যু—সবকিছুর মুখোমুখি সমাজকে দাঁড় করালেন। কিন্তু খনির ভেতরকার অদৃশ্য সঙ্গীরা যেন তাঁর প্রত্যাশাকে অস্বীকার করল। রিপোর্ট যতই প্রকাশ হোক, যতই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হোক, শ্রমিকদের আত্মারা শান্ত হয়ে যাচ্ছিল না। অরিন্দম বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ মানবিক দায় বা প্রশাসনিক দায়িত্বের বিষয় নয়; এটি এক অতীতের যন্ত্রণার অমোচনীয় চিহ্ন, যা কেবল সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে না। ধুলোমাখা খাঁচা, ভাঙা যন্ত্রপাতি, প্রতিধ্বনিত কাশির আওয়াজ—সবই আজও যেন নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

রাতের নিঃশব্দতায় দূর্গাপুরের খনির পরিবেশ এক অদ্ভুত জীবন্ততা ধারণ করছে। অরিন্দম একবার আরও গভীরে প্রবেশ করলে অনুভব করলেন, যন্ত্রপাতির প্রতিটি ঘূর্ণন, বাতাসে ভেসে আসা ধোঁয়া, এবং কাশির শব্দ—সবই একটি চিরন্তন সুরের অংশ। শ্রমিকদের গান, যা একসময় তাদের দৈনন্দিন শ্রমের সঙ্গী ছিল, এখন এক অভিশপ্ত সুরে রূপান্তরিত হয়েছে। এই সুর যেন বলছে—“আমাদের মৃত্যু ভোলার নয়, আমাদের ইতিহাস ভুলে যাওয়ার নয়।” অরিন্দম দেখলেন, যে খনির ভেতরে প্রবেশ করেছেন, সেখানে শুধু মৃতদেহ নয়, বরং অতীতের সমস্ত আর্তনাদ, আশা, লোভ, বঞ্চনা এবং মানবিক ব্যর্থতা একত্রিত হয়ে একটি চিরন্তন কাব্য তৈরি করেছে। সে বুঝতে পারলেন, সত্য প্রকাশ করা মানে সবসময় শান্তি পাওয়া নয়; কখনো কখনো, সত্যের সাথে আরও গভীর বেদনা ও অভিশপ্ত প্রতিধ্বনি জড়িয়ে থাকে।

অরিন্দমের মন এখন অন্যভাবে খনিকে দেখছে। তিনি লিখছেন, ছবি তুলছেন, নথি সংগ্রহ করছেন, কিন্তু সবকিছু যতই প্রকাশ হোক না কেন, খনির গোপন সুর আজও নীরবতার আড়ালে বাজছে। দূর্গাপুরের নিঃসঙ্গ রাতগুলোতে, বন্ধ খনির ভেতর থেকে এখনও মেশিনের আওয়াজ, কাশির প্রতিধ্বনি এবং শ্রমিকদের গান ভেসে আসে—এক চিরন্তন কবর থেকে। অরিন্দম বুঝতে পারলেন, এই খনি কেবল শারীরিক মৃত্যু নয়; এটি একটি অদৃশ্য স্মৃতি, যা অতীত ও বর্তমানকে একসাথে বেঁধে রেখেছে। প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি শব্দে, খনির গান সমাজকে সতর্ক করছে—ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন লোভ, অবহেলা ও দুর্নীতির মাধ্যমে মানুষের জীবন বিনষ্ট না করে। অরিন্দমের রিপোর্ট একদিকে সত্য উদঘাটন করল, কিন্তু অন্যদিকে খনির চিরন্তন সুর, চিরন্তন বেদনা, চিরন্তন গান—সবই যেন জীবন্ত থেকে গেছে, যেন মৃত শ্রমিকরা আজও জানাচ্ছে যে, তাদের কাজ, তাদের জীবন এবং তাদের মৃত্যু কখনো মাটি ও সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে না।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *