ঋদ্ধিমান গুহ
১
বেঙ্গালুরুর ব্যস্ততার ভিড়ে অদ্বৈতের দিন শুরু হয় একঘেয়ে অফিসের কাজ দিয়ে, শেষ হয় আবার সেই অফিসেই জমে থাকা ফাইলের পাহাড়ে ডুবে থেকে। কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে রাত কেটে যায়, কফির কাপে ভর করে শরীর চালায়, কিন্তু ভেতরের শূন্যতাকে কিছুতেই পূর্ণ করতে পারে না। উত্তর কলকাতার ছেলেটি ছোটবেলা থেকে কখনো ভাবেনি—শহরের এত দূরে একা পড়ে থাকবে। কাজের চাপ, নতুন জায়গার অনিশ্চয়তা, আর নিঃসঙ্গতা মিলে তাকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে তোলে। তবু প্রতিদিন রাত নামলেই একটুখানি আলো জ্বলে ওঠে—সোহিনীর কল। ফোনের পর্দায় ভেসে ওঠা তার মুখই যেন অদ্বৈতের দিনের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়। কিন্তু এই দেখা শুধুই কাঁচের দেয়ালে আবদ্ধ—ভিডিও কল, যেখানে আলিঙ্গন নেই, স্পর্শ নেই, আছে শুধু চোখের চাহনি আর অনন্ত অপেক্ষা। অদ্বৈত জানে, ওদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার একমাত্র সেতু হলো এই ভার্চুয়াল মুহূর্তগুলো, আর সেই সেতুকেই আঁকড়ে ধরে সে প্রতিদিনের একঘেয়ে সময়কে সহ্য করে।
কলকাতার ভিড়ভাট্টা, বইয়ের দোকান আর সাহিত্য আসরের ভেতরে সোহিনী এক ভিন্ন জগতে থাকে। তার দিন কাটে লেখার টেবিলে বসে গল্প বুনে, রাত কাটে ডায়েরির পাতায় নিজের মন খোলা রেখে। কিন্তু যতই সে লেখালিখির ভুবনে ডুবে থাকুক না কেন, মনের ভেতরে এক অদ্ভুত অভাব সবসময় কুরে কুরে খায়। প্রতিদিন অদ্বৈতের অপেক্ষায় থাকা যেন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসলেও, শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটলেও বা বইমেলায় ঘুরলেও তার মনে হয়—যদি অদ্বৈত এখানে থাকত! ভিডিও কলে দুজনের হাসাহাসি, অভিমান, কিংবা হঠাৎ চুপ করে যাওয়া—সবই যেন মিশে যায় এক অদ্ভুত আবেগে। কখনো সোহিনী অদ্বৈতের ব্যস্ততায় রেগে যায়, ভাবে—ও কি সত্যিই তাকে সময় দেয়? আবার পরমুহূর্তেই হাসিমুখে মিলিয়ে নেয় ভুল বোঝাবুঝি। সে জানে, দূরত্বের সম্পর্ক মানেই হলো ভেতরে ভেতরে প্রতিদিন পরীক্ষা দেওয়া, যেখানে ভরসা আর ধৈর্যই একমাত্র হাতিয়ার। তার কলমে যত গল্প জন্মায়, তার ভেতরে ততবারই ফিরে আসে অদ্বৈতের মুখ, যে মুখ ছাড়া তার কোনো চরিত্রই যেন পূর্ণতা পায় না।
এই বছরগুলোই হলো তাদের ভালোবাসার সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়—যেখানে সম্পর্কের মাপকাঠি ছিল না একসঙ্গে কাটানো সন্ধ্যা বা হাতে হাত রাখা, বরং ছিল একে অপরের প্রতি অবিচল বিশ্বাস। সময়ের ব্যবধান, শহরের ভিড়, আর কাজের চাপ মিলে অদৃশ্য দেয়াল দাঁড় করালেও তারা বারবার সেই দেয়াল ভেঙে আবার ফিরে আসে একই জায়গায়—একটা চাহনি, একটা হাসি, আর অপেক্ষার প্রতিশ্রুতি। তাদের সম্পর্ক কখনো ছিল ঝগড়ার ভেতর দিয়ে মিল খোঁজা, কখনো বা নির্লিপ্ততায়ও ভালোবাসার স্পন্দন টের পাওয়া। দূরত্ব অনেক সময় তাদের কষ্ট দিয়েছে, আবার সেই দূরত্বই তাদের ভালোবাসাকে দিয়েছে গভীরতা, দিয়েছে বিশ্বাসের নতুন সংজ্ঞা। অপেক্ষার বছরগুলোতে তারা শিখেছে—ভালোবাসা শুধু একসঙ্গে থাকা নয়, বরং হাজার মাইল দূর থেকেও একে অপরের ভরসা হয়ে ওঠা। এই অধ্যায়ের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত যেন জমে রইল ভবিষ্যতের জন্য, যেখানে প্রতীক্ষার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন সূর্যোদয়, এক নতুন দেখা হওয়ার প্রতিশ্রুতি।
২
অদ্বৈতের জীবনে ব্যস্ততা যত বাড়তে থাকে, ততই তার ভেতরে জমতে থাকে এক অদ্ভুত ভয়। অফিসের অসংখ্য মিটিং, রাত জেগে চলতে থাকা প্রজেক্টের চাপ, আর নতুন শহরে গড়ে ওঠা অচেনা সম্পর্কগুলো তার ভেতরে এক ধরনের ফাঁক তৈরি করে। কাজের চাপে মাঝে মাঝে সোহিনীর কল রিসিভ করতে না পারলে বা সময়মতো উত্তর দিতে না পারলে অদ্বৈতের বুকের ভেতরটা হঠাৎ শূন্য হয়ে যায়। সে ভাবে—“যদি কোনো একদিন সোহিনী সত্যিই বিরক্ত হয়ে সব ছেড়ে চলে যায়?” যতই নিজেকে শক্ত করে রাখতে চায়, ততই যেন সন্দেহ আর ভয় তাকে গ্রাস করে। সম্পর্কের শুরুতে আত্মবিশ্বাসী ছেলেটি এখন আর আগের মতো নির্ভার থাকতে পারে না। কাজের জায়গায় তার মনের অস্থিরতা ধরা পড়ে না, কিন্তু একা ঘরে ফিরে সে স্পষ্ট টের পায়—ভালোবাসা যেমন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তেমনি এই ভয়ও ধীরে ধীরে তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছে। মনে হয়, তাদের সম্পর্কটা যেন কাঁচের তৈরি—অল্প আঘাতেই ভেঙে যাবে। তবুও সে কিছু বলতে পারে না, কারণ সোহিনীর সামনে সবসময় শক্ত, দায়িত্বশীল প্রেমিক হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরতে চায়।
অন্যদিকে, কলকাতার রাস্তাঘাট, বইমেলার ভিড় কিংবা ক্যাফের টেবিলের কোলাহলের মাঝেও সোহিনী এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা বয়ে বেড়ায়। বাইরে থেকে হাসিখুশি, প্রাণবন্ত সোহিনী আসলে ভেতরে ভেতরে বারবার ভেঙে পড়ে। অদ্বৈত সময় দিতে না পারলে, কলের ওপাশে উদাস শোনালে, বা দিনের পর দিন শুধু ব্যস্ততার গল্প করলে তার বুকের ভেতরে জমতে থাকে অপূর্ণতার বেদনা। সে বুঝতে পারে, দূরত্বের সম্পর্ক শুধু একে অপরকে ভালোবাসার নয়, বরং প্রতিদিন নতুন করে ভরসা করার লড়াই। প্রতিদিন রাতে ডায়েরির পাতায় সে লিখে রাখে নিজের অস্থিরতা—“ভালোবাসা যদি সত্যিই এত শক্তিশালী হয়, তবে কেন মনে হয়, একদিন হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে?” সেই ডায়েরির পাতাগুলোই তার নীরব সঙ্গী হয়ে ওঠে, যেখানে সে নিজের ভয়, নিজের দোটানা, নিজের অভিমান উজাড় করে দেয়। বাইরে থেকে যতটা খোলামেলা আর প্রাণবন্ত মনে হয়, আসলে সোহিনী ততটাই ভঙ্গুর। অনেক সময় সে ভাবে অদ্বৈতের সঙ্গে এভাবে দূরে থেকে ভালোবাসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব কি না, আবার মুহূর্তেই সেই চিন্তাকে তাড়িয়ে দিয়ে ভাবে—“না, ও আমারই, আর কোনোভাবেই আমি এই সম্পর্ক হারাব না।”
এই অব্যক্ত ভয়ই আসলে তাদের সম্পর্কের নতুন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। অদ্বৈত ও সোহিনী কেউ-ই একে অপরকে পুরোপুরি বলতে পারে না মনের কথা। দুজনেই ভাবে—যদি সত্যিটা বললে অন্যজন কষ্ট পায়? কিন্তু এই না-বলা কথাগুলোই ভেতরে ভেতরে তাদের আরও অস্থির করে তোলে। কখনো কলের ওপাশে নীরবতা তাদের সম্পর্কের সীমারেখা টেনে দেয়, আবার হঠাৎ একটা ছোট্ট হাসি বা চুপচাপ শোনানো গান সেই দেয়াল ভেঙে দেয়। এই দ্বন্দ্বে ভরেই তাদের সম্পর্ক চলতে থাকে—যেখানে ভালোবাসা আছে, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে হাজারটা ভয়, হাজারটা প্রশ্ন। তারা দুজনেই জানে, এ ভয় স্বাভাবিক, দূরত্বের এই নির্মম বাস্তবতাই এর জন্ম দিয়েছে। তবু এই ভয়ই তাদের ভালোবাসাকে আরও গভীর করে তোলে, কারণ প্রতিবার ভয় জেগে উঠলেই তারা নতুন করে একে অপরকে আঁকড়ে ধরতে শেখে। “অব্যক্ত ভয়” হয়তো তাদের কাঁপিয়ে দেয়, কিন্তু একইসঙ্গে শেখায়—ভালোবাসা মানে ভয়ের পরও থেকে যাওয়া, সন্দেহের পরও হাত না ছাড়ার প্রতিশ্রুতি।
৩
দূরত্বের দীর্ঘ পরীক্ষায় একসময় এসে দাঁড়াল সেই বহুল প্রতীক্ষিত মুহূর্ত—অদ্বৈত আর সোহিনী অবশেষে ঠিক করল তারা মুখোমুখি দেখা করবে, কলকাতায়। কথাটা শুনেই দুজনের ভেতর যেন অদ্ভুত এক স্রোত বইতে শুরু করল। বছরের পর বছর ধরে যাকে শুধু ফোনের পর্দায় দেখা, ভিডিও কলে কথা বলা বা মেসেজের শব্দে অনুভব করা—সেই মানুষকে অবশেষে সামনে দেখা মানেই যেন এক স্বপ্নের বাস্তব রূপ। অদ্বৈতের ভেতর আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতা ভর করে—কতবার ভেবেছে এই মুহূর্তের কথা, তবু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এবার সত্যিই সম্ভব হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে সোহিনীর মনে তৈরি হয় এক নতুন দ্বন্দ্ব। সে জানে, এতোদিন যে সম্পর্কটা শুধু শব্দ আর পর্দার ভেতরে বেঁচে ছিল, এবার সেটি মুখোমুখি পরীক্ষার সামনে দাঁড়াবে। অদ্বৈতের সামনে দাঁড়িয়ে সে কী বলবে? আলিঙ্গন করবে, নাকি চুপচাপ কেবল তাকিয়ে থাকবে? এতগুলো বছর জমে থাকা ভালোবাসা, অভিমান, প্রতীক্ষা—সবকিছু কি এক মুহূর্তেই ভাষা খুঁজে পাবে? নাকি তারা দুজনেই নীরব হয়ে যাবে? এই প্রশ্নই তাকে উত্তেজিত আর বিভ্রান্ত করে তোলে।
অদ্বৈতের দিনগুলো কাটতে থাকে নতুন প্রত্যাশার আলোয়। অফিসের নিরন্তর চাপ এবারও আছে, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা আনন্দ সেই চাপকে যেন হালকা করে দেয়। সহকর্মীরা তাকে আগের চেয়ে খুশি খুশি দেখে, অথচ কেউ জানে না—এই হাসির কারণ। নিজের মধ্যে সে পরিকল্পনা করে—কোন পোশাক পরবে, কোথায় প্রথম দেখা করবে, কীভাবে মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখবে। কিন্তু একইসঙ্গে ভয়ও তাকে তাড়া করে—যদি বাস্তবে সবকিছু তার কল্পনার মতো না হয়? যদি সোহিনী তাকে সামনে দেখে হতাশ হয়? ভিডিও কলে দেখা তার চেহারা, তার ব্যক্তিত্ব—সবকিছু কি সামনাসামনি দাঁড়ালে সমান আকর্ষণীয় থাকবে? এভাবেই আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরে জন্ম নেয় অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে সোহিনীও নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে থাকে। আড়াই বছর ধরে যাকে সে কেবল স্ক্রিনে দেখেছে, তার সামনে দাঁড়ানোর কথা ভাবলেই বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হয়। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে—“অদ্বৈত কি আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারবে? আমি কি আমার অনুভূতি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারব?” তার ডায়েরির পাতায় সেদিন লেখা হয় নতুন স্বীকারোক্তি—“এই দেখা শুধু আমাদের ভালোবাসার সাক্ষাৎ নয়, এটা হলো আমাদের সমস্ত অপেক্ষার জবাব।”
তবে এ দেখা হওয়ার পথে ছিল না কেবল আনন্দের উত্তেজনা; পরিবারের চাপ আর সামাজিক বাস্তবতাও যেন বারবার তাদের মনে সন্দেহের রেখা টেনে দেয়। অদ্বৈতের বাবা-মা চায় সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করে সংসার শুরু করুক, কিন্তু তারা জানে না সোহিনীর সঙ্গে তার এই সম্পর্কের কথা। সোহিনীও পরিবারের চোখ এড়িয়ে তাকে সময় দেওয়ার কথা ভেবেই শিউরে ওঠে। কলকাতার ভিড়ভাট্টা শহরে কোথায় দেখা করবে, যাতে পরিচিত কারও চোখে না পড়ে—এ নিয়ে তার মনে তৈরি হয় দ্বিধা। অথচ এই সব দ্বন্দ্বের মাঝেই তারা দুজনেই বুঝতে পারে—এই দেখা তাদের জন্য কতটা জরুরি। এই দেখা শুধু ভালোবাসার প্রকাশ নয়, বরং তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যতের প্রশ্নও জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। তাই ভয়, অস্থিরতা, লুকোচুরি—সবকিছুকে পাশে সরিয়ে তারা প্রতিজ্ঞা করে, “আমরা দেখা করব।” এ প্রতিশ্রুতিই হয়ে ওঠে তাদের হৃদয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি। রাতের পর রাত ফোনে তারা একই প্রশ্নে ফিরে আসে—“প্রথম দেখা হলে কী বলব?” হয়তো দুজনের কারও কাছেই উত্তর নেই, কিন্তু তবুও তারা জানে—ভালোবাসা সব ভাষাহীন মুহূর্তেরও উত্তর খুঁজে নিতে পারে। এই দেখা হওয়ার প্রতিশ্রুতি তাদের বুকের ভেতর নতুন স্বপ্নের আলো জ্বালিয়ে দেয়, আর প্রতিটি দিন যেন তাদের এক ধাপ করে নিয়ে যায় সেই মুহূর্তের কাছে।
৪
ক্যাফেটি ছিল কলকাতার মাঝখানে, এক পুরোনো রাস্তার মোড়ে। চারপাশে ট্রাম চলাচলের শব্দ, হর্নের আওয়াজ, রাস্তায় ছুটে চলা মানুষের ভিড়—সব কিছুর মাঝেই যেন এক অদ্ভুত শান্তি লুকিয়ে ছিল ভেতরে। সেদিন সোহিনী সকাল থেকে অদ্ভুতভাবে নার্ভাস ছিল। আয়নার সামনে বারবার দাঁড়িয়ে নিজের শাড়ি, চুলের খোঁপা, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক—সবই খুঁটিয়ে দেখছিল, যেন প্রতিটি খুঁটিনাটি নিখুঁত হতে হবে। কারণ এতদিন ধরে অনলাইনে দেখা, ভিডিও কলে হাসি আর কান্না ভাগ করে নেওয়া, সেই মানুষটার সামনে দাঁড়ানোর দিন এসেছে অবশেষে। অন্যদিকে, অদ্বৈত বেঙ্গালুরু থেকে রাতের ট্রেনে এসে সরাসরি ক্যাফেতে পৌঁছেছিল। তার মুখে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু চোখে এক ধরনের প্রত্যাশা। সে জানত না প্রথম দেখা কতটা স্বাভাবিক হবে, কিংবা তারা কি সহজভাবে কথা বলতে পারবে। চারপাশে কফির গন্ধ, হালকা মিউজিক আর নরম আলোয় ঢাকা সেই ক্যাফে যেন তাদের মিলনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সোহিনী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার পর চোখে চোখ পড়তেই সময় যেন থেমে গেল—যেন পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে শুধু দুজন মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখল এক অনন্ত মুহূর্তে।
অদ্বৈতের মনে হচ্ছিল, সোহিনী বাস্তবে আরো সুন্দর, আরো আলো ঝলমলে। ভিডিও কলে যে মেয়ে গল্প করত, হাসত, কখনো রাগ করত, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটি যেন সেই সমস্ত অনুভূতির মূর্ত রূপ। প্রথম মুহূর্তে কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা দ্বিধা ছিল তার ভেতরে—কি বলবে, কীভাবে শুরু করবে। কিন্তু সোহিনীর চোখের দৃষ্টি সব দ্বিধা ভেঙে দিল। তারা দুজনই চুপচাপ টেবিলে বসল, যেন অনেক কথা বলার ছিল, অথচ কিছুই বলার দরকার নেই। সোহিনী হালকা হাসি দিয়ে বলল, “তুমি ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম, তার থেকেও আলাদা।” অদ্বৈত একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “তুমি তো পুরো ঘর আলোকিত করে দিলে।” সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত সেতুবন্ধন তৈরি হলো—যেন এতদিনের অপেক্ষা, ভুল বোঝাবুঝি, ভয়, সবকিছুর সমাপ্তি হলো এই দেখা হওয়ার ভেতর দিয়ে। ক্যাফের জানালা দিয়ে রাস্তার ভিড় দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের টেবিলের চারপাশে যেন এক আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছিল, যেখানে শুধু তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।
সন্ধ্যার দিকে যখন তারা একসাথে ক্যাফে থেকে বের হলো, তখন কলকাতার ভিড় যেন নতুনভাবে অনুভূত হচ্ছিল। রাস্তায় গাড়ির ভিড়, ঠেলাগাড়ির শব্দ, মানুষের হাঁটাহাঁটি—সবই তাদের জন্য যেন এক সিনেমার দৃশ্য হয়ে উঠল। ফুটপাথে হাঁটার সময় সোহিনী হঠাৎ অদ্বৈতের হাত ছুঁয়ে ফেলল, আর সেই প্রথম স্পর্শ যেন বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রতীক হয়ে গেল। অদ্বৈত অনুভব করল, তার সমস্ত দুশ্চিন্তা, ভয় আর দ্বিধা মিলিয়ে যাচ্ছে সেই স্পর্শে। সোহিনীর হাতটা নরম, কিন্তু দৃঢ়, যেন সে বুঝিয়ে দিচ্ছে—এই সম্পর্ক কেবল ভার্চুয়াল নয়, এটি বাস্তব, স্পর্শযোগ্য। সেই মুহূর্তে তাদের দুজনের ভেতর যে আবেগ তৈরি হলো, তা ভাষায় বলা যায় না। শহরের ভিড়, আলো-আঁধারি, গাড়ির শব্দ—সবকিছুর ভেতরেও সেই এক মুহূর্তে সময় যেন থেমে গেল। তারা বুঝতে পারল, ভালোবাসা কখনো দূরত্ব মানে না, কখনো সময়ের অপেক্ষায় হারায় না—এটি স্পর্শের ভেতর দিয়ে, চোখের দৃষ্টির ভেতর দিয়ে, নিঃশব্দ বোঝাপড়ার ভেতর দিয়েই সত্যি হয়ে ওঠে। এই প্রথম স্পর্শ তাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় খুলে দিল—যেখানে আর কোনো স্ক্রিনের সীমাবদ্ধতা নেই, আছে কেবল দুজন মানুষের অনন্ত কাছে আসা।
৫
কলকাতার শহর যেন সেদিন একেবারেই অন্য রূপে সাজানো। শীতের হালকা কুয়াশায় ঢেকে থাকা রাস্তার ধারে বকুল গাছ, সান্ধ্য আলোয় ভিজে ওঠা ফুটপাত, আর সেই ভিড়ের মাঝখানে অদ্বৈত আর সোহিনীর হাত ধরে হাঁটা—সবকিছু যেন সময়কে থামিয়ে রেখেছিল। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সাদা গম্বুজ তাদের চোখে তখন নতুন এক প্রতীকে পরিণত হয়, যেন তাদের সমস্ত অপেক্ষার সাদা চাদরে মোড়ানো সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্বৈত বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে, সোহিনীর চোখে যেন শহর ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে—সে যেন প্রতিটি কোণ, প্রতিটি স্থাপত্যে তার শৈশব, তার স্বপ্ন, আর তার প্রেমের গোপন কথা খুঁজে বের করছে। ভিড়ের ভেতরেও দুজনের উপস্থিতি যেন আলাদা এক বৃত্ত তৈরি করেছিল, যেখানে বাইরের কোলাহল ঢুকতে পারছিল না। সোহিনী ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “এতদিন কীভাবে সম্ভব হলো, আমরা আলাদা থেকেও একসাথে ছিলাম?” অদ্বৈত শুধু হেসে তার হাত চেপে ধরে, উত্তর না দিয়ে সেই স্পর্শকেই উত্তর বানিয়ে ফেলে।
দিনটা যেন মিশে গেল এক অদৃশ্য যাত্রাপথে। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোয় ঢুকে তারা একে অপরকে খুঁজে দেয় প্রিয় লেখক, পুরনো পত্রিকা, আর অচেনা শব্দের ভেতরে লুকানো ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। সোহিনী ছোট্ট এক দোকান থেকে পুরনো এক কবিতার বই হাতে তুলে নেয়, যেখানে প্রথম পাতায় লেখা—“অপেক্ষাই একদিন সবচেয়ে বড় উপহার হয়ে ওঠে।” অদ্বৈতের মনে হলো, সেই লাইনটাই যেন তাদের গল্পের মর্মকথা। দুজনেই একে অপরের চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারল—হারানো সময়ের জন্য দুঃখ করা আর প্রয়োজন নেই, কারণ সেই হারানোর ভেতরেই জমে উঠেছিল এক গভীরতা, যা তাদের প্রেমকে আজকের এই মুহূর্তে নিয়ে এসেছে। গঙ্গার ধারে বসে তারা দীর্ঘ সময় কথা না বলে শুধু জলের স্রোত দেখল। সেই নীরবতাই যেন হাজার শব্দের চেয়েও বেশি কথা বলে গেল। ঢেউয়ের ভেতর অদ্বৈত যেন খুঁজে পেল তার ভয়, তার অস্থিরতা ধীরে ধীরে গলে গিয়ে সোহিনীর উপস্থিতিতে প্রশান্তিতে পরিণত হচ্ছে।
সূর্য যখন অস্ত যায়, আকাশটা কমলা আর নীলের অদ্ভুত মিশ্রণে ভরে ওঠে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে সোহিনী মনে মনে ভাবে—এত বছর দূরত্বের মধ্যে থেকে তাদের গল্প যেন এক অসম্পূর্ণ উপন্যাসের মতো চলছিল, যার প্রতিটি অধ্যায় তারা আলাদা আলাদা শহরে লিখছিল। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, সেই ছিন্ন পাতাগুলো একত্রিত হয়ে পূর্ণ বই হয়ে উঠছে। অদ্বৈত তাকে বলে ওঠে, “সোহিনী, জানো, আমি অনেকবার ভেবেছি—সময়কে যদি পেছনে নিয়ে যাওয়া যেত, আমি তোমাকে আগেই খুঁজে পেতাম।” সোহিনী মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “না অদ্বৈত, হয়তো এভাবেই হওয়ার ছিল। সময় আমাদের হারিয়ে দিয়ে আবার খুঁজে দিয়েছে। আর সেই হারানোর মধ্যেই আমরা আজকের এই মুহূর্তকে পেয়ে গেছি।” দুজনের চোখে অদ্ভুত এক আভা ছড়িয়ে পড়ে, যেন তাদের ভালোবাসা শহরের আলোয় মিশে গিয়ে অমর হয়ে রইল। সেই সন্ধ্যায় কলকাতা তাদের কাছে কেবল একটি শহর নয়, বরং এক অমূল্য স্মৃতির বই হয়ে উঠল, যার প্রতিটি পাতায় লেখা থাকবে হারানো সময়ের খোঁজ আর পাওয়া মুহূর্তের মহিমা।
৬
অদ্বৈত আর সোহিনীর সম্পর্ক যতই গভীর হোক, তবুও তার ভেতরে অদ্ভুত এক ভয় অদ্বৈতের মনকে কুরে কুরে খেতে থাকে। বেঙ্গালুরুর চাকরি, নিরন্তর ব্যস্ততা, পরিবারকে দেওয়া দায়বদ্ধতা—সব মিলিয়ে তার ভেতরে তৈরি হয় এক অচেনা অনিশ্চয়তা। রাতে ঘুম ভাঙলে সে ভাবে, সত্যিই কি এই ভালোবাসা সময়ের পরীক্ষায় টিকে যাবে? সোহিনী তো কলকাতায়—নিজের স্বপ্ন, নিজের আলাদা পৃথিবী নিয়ে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। তার লেখালিখি, বন্ধু-বান্ধব, নতুন অভিজ্ঞতা—সবকিছু মিলিয়ে সোহিনী যেন এক স্বতন্ত্র সত্তা হয়ে উঠছে। অদ্বৈত ভয় পায়, যদি এই দূরত্ব বাড়তে থাকে, যদি কোনো একদিন সোহিনী বুঝে যায় যে তার জীবনে অদ্বৈতের জায়গা এতটা অপরিহার্য নয়, তখন কী হবে? প্রতিদিনের কথোপকথন, ভিডিও কলে দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকা—সবকিছু সত্ত্বেও তার মনের ভেতর এই ভয় চাপা আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। সে অনেক সময় কথা বলতে গিয়েও থেমে যায়, নিজের অস্থিরতাকে আড়াল করে রাখে, কারণ সে চায় না সোহিনী বুঝুক তার দুর্বলতা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অদ্বৈতের এই নীরব দোটানা ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করতে শুরু করে।
অন্যদিকে, সোহিনী তার ডায়েরির পাতায় লিখতে থাকে নিজের অনুভূতির খুঁটিনাটি। সে ভালোভাবেই বুঝতে পারে—অদ্বৈত কখনো কখনো অকারণে চুপ হয়ে যায়, কথা মাঝপথে থেমে যায়, বা হঠাৎই বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। এই নীরবতা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে। সে ভাবে, ভালোবাসা কি শুধু উপস্থিতির ভরসায় টিকে থাকতে পারে, নাকি তার ভেতরে চাই আরও গভীর স্বচ্ছতা, আরও খোলামেলা আবেগ? অনেক সময় সোহিনী চায় অদ্বৈত তাকে নিজের ভেতরের সব কথা খুলে বলুক, কিন্তু অদ্বৈতের সংযত স্বভাব তাকে সেই জায়গাটা দেয় না। তাদের দেখা হওয়ার পর থেকে দুজনের ভেতরে যতটুকু নতুনত্ব, যতটুকু মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল, সেইসব আনন্দের মাঝেও এই সূক্ষ্ম দূরত্ব তাকে কষ্ট দেয়। ডায়েরির পাতায় সে লিখে রাখে—“ভালোবাসা কি শুধু হাত ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ, নাকি মনের সব ভেতরের দরজা খুলে দেওয়ায় এর পূর্ণতা?” সোহিনী বোঝে, অদ্বৈতের সংযম তার একধরনের ভরসা, কিন্তু সেই সংযমই তাকে মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে একা করে দেয়। তাদের একসাথে থাকা মুহূর্তগুলো কখনো ঝলমলে আলোয় ভরে ওঠে, আবার কখনো নিরবতার ছায়ায় আড়াল হয়ে যায়।
এভাবেই তাদের সম্পর্কের ভেতরে তৈরি হয় এক অদৃশ্য দেয়াল—যেটি তারা দুজনেই অনুভব করে, কিন্তু কেউ সরাসরি মুখে বলে না। শহরের ভিড়, একসাথে কাটানো দিন, মনের ভেতরের ভালোবাসা—সবকিছু থাকলেও, এই দেয়াল যেন ধীরে ধীরে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায়। অদ্বৈত নিজের অনিশ্চয়তার কথা স্বীকার করতে পারে না, কারণ সে ভয় পায়—যদি সোহিনী তাকে দুর্বল ভাবে। সোহিনীও সরাসরি প্রশ্ন করতে পারে না, কারণ সে ভয় পায়—প্রশ্ন করলেই হয়তো অদ্বৈত আরও দূরে সরে যাবে। অথচ তারা দুজনেই জানে, সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে হলে একে অপরের কাছে আরও বেশি খোলামেলা হতে হবে। এই অদৃশ্য দেয়ালই তাদের ভালোবাসার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়ে ওঠে—যেখানে একদিকে আছে অদ্বৈতের ভেতরের ভয়, অন্যদিকে আছে সোহিনীর চাওয়া-পাওয়া। কিন্তু সেই দেয়াল ভাঙার সাহস তারা এখনও খুঁজে পায়নি। ফলে ভালোবাসার গভীরে থেকেও এক অনিশ্চয়তা, এক নীরব অস্বস্তি তাদের প্রতিটি মুহূর্তে ছায়ার মতো ভর করে থাকে।
৭
গঙ্গার ধারে সেই সন্ধ্যাটা যেন এক ভিন্নতর আবহ তৈরি করেছিল। চারপাশে শহরের কোলাহল থাকলেও গঙ্গার বুকে ভেসে আসা হাওয়ার পরশে যেন সময় ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছিল। অদ্বৈত আর সোহিনী পাশাপাশি বসেছিল, দুজনের চোখে ছিল অদ্ভুত এক দ্বিধা—কীভাবে বলবে নিজেদের মনের কথা, কীভাবে উন্মোচন করবে এতদিন ধরে বুকের ভেতরে জমে থাকা ভয়ের স্তরগুলো? সোহিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বলল, “জানো অদ্বৈত, কতদিন এমন হয়েছে আমি একা ঘরে বসে থেকেছি, আর মনে হয়েছে হঠাৎ যদি সব শেষ হয়ে যায়! যদি একদিন তুমি আর আমার মধ্যে এই দূরত্ব এতটাই বেড়ে যায় যে আমরা একে অপরকে হারিয়ে ফেলি?” তার গলায় কাঁপন ছিল, কিন্তু সেই কাঁপনেই ছিল গভীর সত্য। অদ্বৈত চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের কোণে যেন হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করছিল, অথচ সে জানত, এ প্রশ্নগুলো শুধু সোহিনীর নয়, তার নিজেরও।
অদ্বৈত অনেকক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে গম্ভীর স্বরে বলল, “আমি-ও ভেবেছি এ কথা। কতবার মনে হয়েছে—আমি হয়তো তোমাকে যতটা ভালোবাসি, তার প্রকাশ করতে পারি না। আমার ভেতরের সংযম, আমার নীরবতা মাঝে মাঝে আমাকেই কুরে কুরে খায়। মনে হয়, আমি কি তোমাকে যথেষ্ট নিশ্চিন্ত করতে পারছি?” সোহিনী মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারো না অদ্বৈত, তোমার একেকটা শব্দ আমার কাছে কতটা মূল্যবান। তোমার নীরবতাও আমি অনুভব করতে পারি, কিন্তু সেই নীরবতার ফাঁকে যখন ভয় ঢুকে পড়ে, তখন আমার ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।” দুজনেই তখন নিঃশব্দে গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে ছিল—জল তখন নীলচে আলোয় চিকচিক করছিল, যেন তাদের অস্থির মনকে শান্ত করতে চাইছে। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল—শহরের ভিড়, জীবনের চাপ, দূরত্ব আর শূন্যতা সব মিলেমিশে এই জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
সন্ধ্যার সেই আলাপে তাদের সম্পর্ক যেন নতুন মাত্রা পেল। এতদিন যেসব অনিশ্চয়তা আর সন্দেহ গোপনে হৃদয়ের দেয়াল গড়ে তুলেছিল, সেগুলো একে একে ভেঙে পড়তে লাগল। অদ্বৈত সোহিনীর হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আমরা হয়তো ভিন্ন জায়গায় থাকি, আমাদের চারপাশে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা, কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—তুমি একা নও। আমি তোমাকে কখনও হারাতে চাই না।” সোহিনী সেই কথায় চোখ ভিজে উঠলেও তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল। সে বুঝল—ভয় প্রকাশ করলেই দুর্বলতা প্রমাণ হয় না, বরং সম্পর্ককে আরও গভীর করে তোলে। এই স্বীকারোক্তি ছিল তাদের যাত্রার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে ভালোবাসা শুধু আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অপরকে আরও গভীরভাবে বোঝার নামও ভালোবাসা। সেই সন্ধ্যার পর গঙ্গার ধারে তাদের দুজনের হৃদয়ের দূরত্ব যেন সত্যিই মিলিয়ে গেল, আর জন্ম নিল এক অবিচ্ছেদ্য বিশ্বাস।
৮
কলকাতার রাতটা যেন সেদিন আলাদা হয়ে উঠেছিল। শহরের আলো ঝলমলে রাস্তায় গাড়ির হর্ন, ক্যাফে থেকে ভেসে আসা গানের সুর আর মাঝেমধ্যে বইতে থাকা হাওয়া—সব মিলিয়ে শহরটা যেন নিজেকে সাজিয়ে রেখেছিল শুধু তাদের দুজনের জন্য। দিনভর ঘোরাঘুরির পর সোহিনী আর অদ্বৈত গঙ্গার ধারের একটি শান্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের চারপাশে কোলাহল থাকলেও, ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা তাদের গ্রাস করেছিল। সোহিনীর চোখে ছিল একধরনের ক্লান্তি, তবে সেই ক্লান্তি ভালোবাসার উষ্ণতায় ভেজা। অদ্বৈত কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে ছিল তার দিকে, যেন এই মুহূর্তটাকে সে সারাজীবনের জন্য আটকে রাখতে চায়। সোহিনীর আঙুলগুলো আস্তে করে তার হাতের ওপর রাখা মাত্রই অদ্বৈতের বুকের ভেতরে জমে থাকা সব দ্বিধা গলে যেতে শুরু করল। প্রথমবার মনে হলো—হয়তো ভালোবাসা আসলে এতটা সহজ, এতটা স্বাভাবিক, কেবল ছুঁয়ে থাকার মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করা যায়। শহরের রাতটা যেন তাদের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হয়ে উঠল, যে প্রতিজ্ঞা শব্দের দরকার ফেলে না, শুধু স্পর্শেই ভরে ওঠে।
হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে গেল কাছের এক ছোট্ট ক্যাফেতে। জায়গাটা খুবই সাধারণ, কিন্তু সেই রাতের আবহাওয়া আর তাদের অনুভূতি সেটিকে ভিন্ন মাত্রা দিল। জানলার ধারে বসে দুজনেই এক কাপ কফি হাতে নিল, কিন্তু কফির স্বাদ তারা কেউই আলাদা করে অনুভব করছিল না—কারণ তাদের আসল স্বাদ আসছিল একে অপরের উপস্থিতি থেকে। আলো-আঁধারির মাঝে সোহিনীর হাসিটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, আর অদ্বৈত বারবার তাকাচ্ছিল, যেন বুঝতে চাইছিল—সে আসলেই স্বপ্নে আছে না বাস্তবে। মাঝেমাঝে তারা কথা বলছিল—ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, অতীতের শূন্যতা, কিংবা খুব সাধারণ কোনো বিষয়। কিন্তু সেই কথার ফাঁকেই বারবার নেমে আসছিল নীরবতা। সেই নীরবতা কোনো অস্বস্তি আনছিল না, বরং মনে হচ্ছিল এই নীরবতাই আসল ভাষা, যা শব্দের থেকেও গভীর। অদ্বৈতের হাত ধীরে ধীরে সোহিনীর হাতের ওপর স্থির হলো, আর সোহিনী সেই স্পর্শে হালকা কেঁপে উঠল। তারা কেউ কিছু বলল না, কিন্তু দুজনের চোখের দৃষ্টি বলছিল—এই স্পর্শে জমা আছে বহু বছরের অপেক্ষা, বহু দিনের না বলা কথা। বাইরে শহরের কোলাহল চলছিল, অথচ ক্যাফের ভেতরে তারা যেন নিজেদের আলাদা এক জগতে ডুবে গিয়েছিল।
রাতটা শেষ হওয়ার আগে তারা আবার গঙ্গার ধারে ফিরে গেল। সেখানেই অদ্বৈত সোহিনীকে আস্তে করে কাছে টেনে নিল, আর প্রথমবারের মতো তাদের ঠোঁট একে অপরকে স্পর্শ করল। সেই মুহূর্তটা যেন জমে থাকা সমস্ত প্রতীক্ষার মুক্তি, যেন এক দীর্ঘ যাত্রার শেষ প্রান্তে এসে তারা খুঁজে পেল নিজেদের আশ্রয়। সোহিনী অনুভব করল—এতদিন ধরে যে ভালোবাসা শুধু চ্যাটের বার্তায় বা দূর থেকে চাওয়ায় আটকে ছিল, তা আজ বাস্তব হয়ে উঠেছে। অদ্বৈতের বুকের ভেতরেও জমে থাকা ভয় আর দ্বিধা মিলিয়ে গেল, জায়গা নিল এক অদ্ভুত শান্তি। শহরের রাত, গঙ্গার ধারের হাওয়া আর তারাদের আলো মিলে যেন এক নিখুঁত আবহ তৈরি করেছিল, যা তাদের সম্পর্ককে নতুন এক রূপ দিল। সেই রাতটা তাদের শেখাল—ভালোবাসা শুধু শব্দে নয়, তা স্পর্শে, নীরবতায়, আর একে অপরের পাশে থাকার সরল সত্যে লুকিয়ে থাকে। সেদিনের পর তাদের দুজনের সম্পর্ক যেন এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করল—যেখানে ভয় নয়, বরং উষ্ণতা, বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি তাদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৯
কলকাতার সেই উজ্জ্বল ভোরে, যখন শহরের রাস্তাগুলো ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল, সোহিনী এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে অদ্বৈতের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এতদিন তারা দূরত্ব, ভিন্ন শহরের ব্যস্ততা আর অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছে, কিন্তু আজ যেন সময় একটু থেমে গেছে। সোহিনীর মনে হচ্ছিল, এই ভালোবাসা শুধু কথার ভরসায় আর ধরে রাখা যাবে না; তাদের প্রয়োজন আরও দৃঢ় একটা প্রতিশ্রুতি। সে ভেবেছিল—জীবনটা তো এত ছোট, তবে কেন এখনো তারা আলাদা শহরে থেকে দিন গুনবে? গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটার সময় সোহিনী প্রথম সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলেছিল—”অদ্বৈত, এবার আমরা একসঙ্গে থাকার মতো একটা পথ খুঁজে বের করব না? শুধু ফোনকল বা অপেক্ষা নয়, চাই প্রতিদিনের সঙ্গ।” অদ্বৈতের ভেতরে সেই কথা বজ্রপাতের মতো নেমেছিল, কারণ এই প্রশ্নটা ওর নিজের ভেতরও দিনরাত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কিন্তু বাইরে সবসময় যে সংযমের মুখোশ পরে থাকত, তার আড়ালে কত ভয়, কত সংশয় জমে ছিল, তা সে জানত। তবুও সেই সন্ধ্যায় অদ্বৈতের মুখে এক নীরব হাসি ফুটে উঠেছিল—যেন সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই সম্পর্ক আর শুধু সময়ের খেলা হবে না, এ এক ভবিষ্যতের যাত্রা।
পরবর্তী দিনগুলোতে তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল বাস্তবের হিসেব-নিকেশ। সোহিনী স্বপ্ন দেখত অদ্বৈতকে কলকাতার রাস্তায় পাশে পাবে, ভিড়ভাট্টার কফি শপে দু’জন মিলে গল্প করবে, কিংবা হাওড়া ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে রাতের আলো দেখবে। অন্যদিকে অদ্বৈত, তার স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ততায় সবকিছু ভেবেচিন্তে দেখতে লাগল। চাকরি বদলানো কি সম্ভব? যদি অন্য কোনো শাখায় বদলি হয়, তবে কি কলকাতায় থাকা যাবে? কিংবা অন্তত এমন একটা জায়গায় যেখানে প্রতি সপ্তাহে বা দু’সপ্তাহে একবার দেখা করা সম্ভব? এই সব ভাবনার ভেতরেও অদ্বৈতের চোখে ভেসে উঠত সোহিনীর মুখ, যে মুখে সে এতদিন ধরে কেবল অপেক্ষার ছায়া দেখেছে। অদ্বৈতের মনে হচ্ছিল—যদি এখনো সে কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তবে ভালোবাসা কেবল স্বপ্ন হয়ে থাকবে। তাই এক রাতে ফোনে সোহিনীকে বলল—”আমি চেষ্টা করব বদলির জন্য, আর যদি তাও না হয়, তবে এমন একটা সুযোগ খুঁজব যেখানে কলকাতায় থেকে কাজ করতে পারব। এবার আমি চাই না তোমাকে শুধু ফোনের স্ক্রিনে আটকে রাখতে।” সোহিনীর চোখে সেই রাতে অশ্রু ঝরে পড়েছিল, কিন্তু সেটা দুঃখের নয়—এ এক অদ্ভুত আশার অশ্রু, যে আশায় সে বহুদিন ধরে বেঁচে ছিল।
এই প্রতিশ্রুতি তাদের সম্পর্কে এক নতুন শক্তি এনে দিল। তারা বুঝল, ভালোবাসা মানেই কেবল আবেগ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিদ্ধান্ত, ত্যাগ, আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। সোহিনী তার দিনলিপিতে লিখতে শুরু করল—”ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে তার জায়গা কেবল হৃদয়ে নয়, বাস্তবের মাটিতেও হওয়া উচিত। আজ অদ্বৈত বলেছে সে চেষ্টা করবে, আর আমি বিশ্বাস করি আমাদের স্বপ্ন একদিন পূর্ণতা পাবে।” অন্যদিকে অদ্বৈত, যে এতদিন তার ভেতরের ভয়গুলোকে লুকিয়ে রেখেছিল, এবার প্রথমবার নিজেকে হালকা অনুভব করল। প্রতিশ্রুতির ভার কোনো বোঝা নয়, বরং এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিল তার ভেতরে—যেন সে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে। কলকাতার রাত, গঙ্গার ঢেউ, কিংবা শহরের ভিড়—সবকিছুই যেন নতুন করে আলোয় ভরে উঠল। তারা জানত, সামনের পথ সহজ হবে না, কিন্তু এবার অন্তত তাদের হাতে হাত রাখা আছে, আর আছে আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতিই হয়ে উঠল তাদের ভালোবাসার নতুন ভিত্তি, যেখানে দূরত্ব শুধু স্মৃতি, আর ভবিষ্যৎ এক আশার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
১০
গঙ্গার ধারের বিকেলটা যেন এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়া ছিল। হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল, দূরে নৌকা ভেসে চলছিল ধীরে ধীরে, আর অস্তগামী সূর্যের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল এক কোমল আভা। অদ্বৈত আর সোহিনী দু’জনেই হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন এ মুহূর্তে সমস্ত পৃথিবী তাদের থেমে থাকা নিঃশব্দতায় ডুবে গেছে। এতদিনের অস্থিরতা, অজানা ভয়, দূরত্ব আর অভাবের ক্ষতচিহ্ন আজ যেন মুছে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছিল। তবু তাদের চোখে ছিল বাস্তবতার ছাপ—ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সম্পর্কটা ভঙ্গুর, কারণ সময়, কাজ, দূরত্ব সবকিছুই এখনও তাদের পরীক্ষা নিচ্ছে। অদ্বৈতের ভেতরে কোথাও এক প্রবল দৃঢ়তা জন্ম নিয়েছে—যেভাবেই হোক সে আর এই সম্পর্ককে ভাঙতে দেবে না। সে জানে, যদি আজ তারা সাহস নিয়ে এগিয়ে যায় তবে আগামী দিনের পথ হয়তো মসৃণ হবে না, কিন্তু একসঙ্গে হাঁটার শক্তিটুকু তাদের যথেষ্ট। অন্যদিকে সোহিনী অনুভব করছিল এক অদ্ভুত শান্তি—যেন সব ভয়, সব অনিশ্চয়তা মিলেমিশে গেছে ভালোবাসার উষ্ণতায়। গঙ্গার স্রোত দেখে সে মনে মনে বলল, “যতদূরেই যাই, আমাদের ভালোবাসা একদিন ফিরিয়ে আনবেই।” এই বিশ্বাসই তার চোখে জল এনে দিল, তবে সেটা ছিল আনন্দ আর আশার অশ্রু।
অদ্বৈত সোহিনীর হাত আরও শক্ত করে ধরল, যেন এই হাত ছেড়ে দিলে সবকিছু ভেঙে পড়বে। সে জানে, চাকরি বদলানো সহজ নয়, জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলাও সহজ নয়। কিন্তু একবার যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা যায়, তবে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে। সে সোহিনীকে জানাল—তার মনে হয়েছে নতুন সুযোগ খুঁজতে হবে, হয়তো কলকাতাতেই নয়তো কাছের কোনো শহরে, যেখানে দূরত্ব আর দেয়াল তৈরি করবে না। এই কথায় সোহিনীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, কারণ প্রথমবার সে অদ্বৈতের কণ্ঠে এতটা নিশ্চয়তা শুনল। এতদিন ধরে যে ভয়টা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল—অদ্বৈত হয়তো শুধু কথাতেই থেমে থাকবে—সেটা আজ দূর হলো। সোহিনীও স্বীকার করল, তার ভেতরে যে ভয়গুলো কাজ করছিল, সেগুলো আরেকটু সাহস দিলে জয় করা যায়। দুজনেই বুঝতে পারল, ভালোবাসা কেবল সুন্দর মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া নয়, বরং প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে মোকাবিলা করা। তারা দুজনেই জানে পথ কঠিন, কিন্তু অন্তত এবার তারা সেই পথ ধরে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একে অপরের হাত না ছেড়ে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল, শহরের আলো জ্বলে উঠল, আর গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে তাদের গল্প যেন এক নতুন মোড় নিল। অদৃশ্য ভয়, দূরত্ব আর অনিশ্চয়তা সবকিছু এখনও রয়ে গেছে, কিন্তু তার চেয়ে বড় হয়ে উঠল একে অপরকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছা। সোহিনী মনে মনে ভাবল, এই সম্পর্কের শেষ যদি লিখতেই হয় তবে তা হবে একসঙ্গে লড়াই করে, কখনও হেরে গিয়ে নয়। অদ্বৈতের চোখেও ফুটে উঠল একই প্রতিজ্ঞা—দূরত্ব যতই হোক, ভালোবাসা দিয়ে সব জয় করা যায়। নদীর স্রোতের মতোই তাদের ভালোবাসা বয়ে চলবে, কখনও শান্ত, কখনও উত্তাল, কিন্তু সবসময় একসঙ্গে। তারা হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন এই দৃশ্যটাই তাদের জীবনের প্রতীক—একসঙ্গে, প্রতিকূলতার মাঝেও অটুট। গল্পটা শেষ হলো না, বরং শুরু হলো নতুন করে। শেষ প্রান্তে এসে তারা বুঝতে পারল, ভালোবাসার কোনো শেষ নেই, আছে শুধু নতুন পথ, নতুন আশা, আর প্রতিদিনের প্রতিশ্রুতি—দূরত্বকে জয় করে একসঙ্গে থাকার।
শেষ




