শৌনক বসু
১
পুরনো দিল্লির অন্ধগলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে ড. অনির্বাণ চক্রবর্তী প্রথমবারের মতো অনুভব করল যেন সময়ের চামড়া একটু একটু করে খসে পড়ছে। চকবাজারের ঘিঞ্জি পথ, পানের দোকানের কড়া গন্ধ, আর মাটির উপরে গড়াগড়ি দেওয়া জ্যান্ত মশাগুলোর মধ্যেও কিছু ছিল, যা তাকে এই জায়গাটার দিকে ফের টেনেছিল বহু বছর পর। সে একবার এখানে এসেছিল ২০০৯ সালে, তখন সে এম.ফিল ছাত্র। আজ ২০২৫—আরও পরিণত, আরও ক্লান্ত, কিন্তু সেই পুরোনো আগ্রহটা আবার যেন জেগে উঠেছে। তার ব্যাগে ছিল পাণ্ডুলিপির মতো পুরনো এক নকশা—এক মুঘল কেল্লার অংশবিশেষ, যা কোনও সরকারি দলিলেও নেই, কিন্তু আগ্রহী কেউ কেউ বলেন, ওটা “মেহরআলী কেল্লা”—একটা হারিয়ে যাওয়া স্থাপত্য যার নামও হারিয়ে গেছে সাধারণ ইতিহাসে। এই কেল্লাটির কথা প্রথম সে পড়েছিল এক পারসিক সফরনামায়, যেখানে লেখা ছিল: “যদি সময় আটকে যায়, তা হলে তা আটকে এই মেহরআলী দরজার ভেতরে।” কথাটা তখন মনে হয়নি গুরুতর, কিন্তু এখন যেন সেই অদেখা দরজার ছায়া মাথার ভিতরেই বাজতে থাকে। সে পুরনো নকশা মেলাতে মেলাতে পৌঁছায় এক পরিত্যক্ত ইমারতের সামনে—ইটখসে পড়া দেওয়াল, অর্ধেক ভাঙা মিনার, আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকানো এক সময়ের সাক্ষী। অথচ আশেপাশে কেউ এই জায়গাটার গুরুত্ব বোঝে না, এমনকি স্থানীয় দোকানিরাও শুধু বলে, “ওটা তো ভূতের বাড়ি, বাবু। কেউ যায় না।”
দেয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে অনির্বাণ টের পায়, যেন পুরনো ইতিহাসের ধূলো উঠে এসে তার আঙুলে জমেছে। সে ব্যাগ থেকে বের করে পুরনো নকশাটি, যেখানে লাল কালিতে একটি গোপন “দ্বার” চিহ্নিত করা—দেয়ালের একদম দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে দেখে, বাস্তবের দেয়ালেও একটা জায়গা একটু আলাদা—ইটগুলো অন্যরকম, যেন চাপ দিলেই নড়ে উঠবে। চারপাশে কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে সে ইটগুলো স্পর্শ করে। প্রথমে কিছুই হয় না, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে একটা গুঞ্জন শোনা যায় দেয়ালের গভীর থেকে, ঠিক যেন বাতাস গড়িয়ে যাচ্ছে পুরনো গুহার মধ্য দিয়ে। হঠাৎ একটা ফিসফিস শব্দ—একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো, আর তারপর একটা অংশ সামান্য চাপা পড়ে—মাটির কাছ ঘেঁষা একটা ফাটল, যা হয়তো এককালে দরজা ছিল। সে নিচু হয়ে দেখে এক আঁধার গলি—ধুলোমাখা, সরু, কিন্তু কিছুটা চলার মতো। এই মুহূর্তে তার চোখে যেন সময় দাঁড়িয়ে যায়। যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক বলে—”ফিরে যাও”, কিন্তু ইতিহাসের নেশাগ্রস্ত মন বলে—”ভিতরে ঢুকো”। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে সে হাঁটু মুড়ে ঢুকে পড়ে সেই ফাটলের ভিতর, যেখানে বাতাসটা এত ঠান্ডা যে মনে হয়, কেবল এই গলির মধ্যেই শীত টিকে আছে বছরের পর বছর।
ভেতরে ঢুকতেই যেন পৃথিবী বদলে গেল। আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলও বন্ধ হয়ে গেল, আর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারল—এই গলি কোনও সাধারণ গলি নয়। পেছনের দেয়ালটা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ হয়ে গেল, আর সে যেন একটা নতুন বৃত্তে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ কেবল নিঃশ্বাস আর হৃদস্পন্দন ছাড়া কিছু শোনা যায় না, তারপর চোখের সামনে আলো ফুটে ওঠে—কিন্তু সেই আলো কোনও বিদ্যুৎবাতির নয়, বরং টিমটিমে প্রদীপের আলো, আর সেই আলোয় দেখা যায় সাদা-পাথরের কারুকার্য করা ছাদ, যেটা স্পষ্টতই মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে গড়া। দেওয়ালে ঝোলানো ফারসি হরফ, পিতলের তৈরি তোরণ, আর দূরে শোনা যায় ঘোড়ার খুরের শব্দ। অনির্বাণ চিৎকার করে উঠতে চায়, কিন্তু শব্দ আটকে যায় তার গলায়। সে জানে না সে কিভাবে এখানে এসেছে, কিন্তু বুঝতে পারে—সে আর তার সময়ে নেই। সময় যেন নিজেই তাকে ডেকে এনেছে। পুরনো দিল্লির এক ফাটল ভেদ করে সে পৌঁছে গেছে সেই যুগে, যে যুগে ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতা নয়—চোখের সামনে জীবন্ত, নিঃশ্বাস নেয়, ছুরি ধরে, প্রেম করে, আর বিশ্বাসঘাতকতাও করে। অনির্বাণ নিজের ঠোঁটে হাত রেখে ফিসফিস করে—“আমি কোথায় এলাম?”… আর দূরে, একটা রাজকীয় কণ্ঠ বলে ওঠে—“আহলে দিল, তুমি কি পলাতক?”
২
অন্ধকার থেকে আলোয় পা রাখার মুহূর্তটাতেই যেন অনির্বাণ বুঝল—তাকে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। ভেতরের গলি পেরিয়ে সামনে এক প্রশস্ত চত্বর খুলে গেল, যার এক প্রান্তে রাজকীয় দালান, অন্য প্রান্তে সুরম্য ময়দান আর ঘোড়ার পালের শব্দে ভরপুর আঙ্গিনা। চারপাশে চলছিল কিসব ব্যস্ততা—জামদানি চাদর গায়ে কর্মচারীরা দৌড়োদৌড়ি করছে, শিরস্ত্রাণ-পরা অশ্বারোহীরা চকচকে তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে, আর দেওয়ালজুড়ে খচিত ছিল নানা অলংকরণ—যেমনটা সে কেবল ছবিতে দেখেছে, বইয়ের পাতায় পড়েছে। সে কাঁপা পায়ে পেছনে ফিরে দেখে দরজা—যেটা দিয়ে সে প্রবেশ করেছিল—আর নেই, যেন সময় নিজেই নিজের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার কপালে ঘাম, কিন্তু চোখে বিস্ময়ের দীপ্তি। হঠাৎ কেউ পিছন থেকে জিজ্ঞেস করল—“তুমি কে? তোমার পোশাক তো মুসাফিরের মতো নয়।”
ঘাড় ঘুরিয়ে অনির্বাণ দেখে তিনজন সিপাহী তাকে ঘিরে ধরেছে। তাদের পাগড়ি, তলোয়ার, আর চোখের ভাষা স্পষ্টতই বলে—সে এখানে অতিথি নয়, অপরিচিত। আধুনিক পোশাকে থাকা অনির্বাণ উত্তর দিতে চায়, কিন্তু মুখে কথা জোটে না। একজন সিপাহী তার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়, আর মোবাইলটা দেখে চোখ কুঁচকে ফিসফিস করে—“জিনের বস্তু…?” আরেকজন বলে, “একে নিয়ে চৌকিতে নিয়ে চলুন, খানসামা সাহেব দেখবেন।” অনির্বাণ কোনো প্রতিবাদ না করেই, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের সঙ্গে চলে যায়। তার পায়ের নিচে পাথরের ধাপ, মাথার উপরে ময়ূরের পালকে সাজানো উঁচু গম্বুজ। ঘুরে ঘুরে তার সামনে খুলে যায় মুঘল দিল্লির এক জীবন্ত শহর—যেখানে বাতাসে মিশে আছে আতরের ঘ্রাণ, ও কড়ানাড়া রাঁধুনির হাঁড়ির শব্দ। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গরিব ভিখারি, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি, আর উপরে উড়তে থাকা পায়রার দল—সব মিলিয়ে সে বুঝে ফেলে, সে শুধু অন্য সময়ে আসেনি, সে অন্য পৃথিবীতে এসেছে।
চৌকির ভেতরে প্রবেশ করিয়ে তাকে বসানো হয় এক কারুকার্য করা কাঠের চেয়ারে। একটু পরে, এক বয়স্ক ব্যক্তি প্রবেশ করেন—তার পোশাকে জমকালো চাদর, হাতে লাঠি, কপালে রক্তিম তিলক—তিনি খান বাহাদুর মুজতবা আলি, এই কেল্লার নিরাপত্তা ও তদন্ত বিভাগের প্রধান। তিনি বসেই বলেন, “তোমার নাম কি, মুসাফির? তুমি কোন দরবারের লোক?” অনির্বাণ কিছু বলতে চায় না, কারণ সে জানে তার সত্য কেউ বিশ্বাস করবে না। সে বলে, “আমি ইতিহাসের ছাত্র, খোঁজ করতে করতে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম…”। মুজতবা চোখ সরু করে তাকান—“ইতিহাস? তুমি তো নিজেই এক ইতিহাস, হুজুর।” একজন সিপাহী তার ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেয় মুজতবার হাতে। তিনি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর বলেন, “এটা… আয়না? না কোনো যাদুকরের বস্তু?” অনির্বাণ বুঝতে পারে, তার ব্যাখ্যা এই যুগে মূল্যহীন। তার আশেপাশে শুরু হয় কানাঘুষো—জিনের চর? তুর্কিদের গুপ্তচর? অথবা ফার্সি দুনিয়ার বানানো দানব? অনির্বাণের গলা শুকিয়ে আসে, চোখে-মুখে ঘাম, তবুও সে নিজেকে সামলে নেয়। এই মুহূর্তে সে জানে, তাকে ইতিহাসের ভিতর টিকে থাকতে হবে, নাহলে কেবল সময় নয়, জীবনও গিলে খাবে তাকে।
৩
দরবারের অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ড. অনির্বাণ চক্রবর্তী বুঝতে পারল, এখানে প্রতিটি মুহূর্তই তার জন্য এক অজানা বিস্ফোরণ। চারপাশে শুধু ভাষার অচেনা টান নয়, মানুষগুলোর চোখেও ছিল একধরনের শঙ্কা আর সন্দেহ। মুজতবা আলির নির্দেশে তাকে আনা হয়েছে কেল্লার অভ্যন্তরীণ ‘মেহরাব কক্ষে’—যেখানে সাধারণত অভ্যাগতদের জেরা করা হয়। মেহরাবের দেয়ালে ঝোলানো আছে পুরনো রুপালি খঞ্জর, দেওয়ালে ফারসি হরফে খোদাই—”সতর্কতা ঈমানের অঙ্গ”। অনির্বাণের চারপাশে এই ইতিহাস এত জীবন্ত যে তার নিজের বাস্তবটাই অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। হঠাৎ পর্দার আড়াল থেকে এক নারী কণ্ঠ শোনা যায়—ধীর, মৃদু কিন্তু দৃঢ়, “তাকে একবার দেখতে দিন।” মুহূর্তেই যেন কক্ষের বাতাস বদলে যায়। সবার দৃষ্টি সেদিকে ঘোরে। পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করেন এক তরুণী—হালকা জাফরান রঙের পোশাক, মাথায় হাল্কা ওড়না, কপালে মৃদু টিপের মতো চন্দনের দাগ। তার চোখ দুটি গভীর—যেন বহু কিছু দেখে ফেলেছে, অথচ নিজের কিছু বলেনি কারো কাছে।
তার নাম জারিনা বেগম, সম্রাট শাহজাহানের দরবারের শিক্ষিতা নারীদের অন্যতম, এবং বিখ্যাত কবি আলতাফ মির্জার কন্যা। সে কেবল কবিতায় নয়, ইতিহাসেও প্রগাঢ় আগ্রহী—ফারসি ও সংস্কৃত দুটোতেই সমান দক্ষ। অনির্বাণকে সে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণের পর বলে, “তোমার পোশাক বলে তুমি পরদেশি, কিন্তু তোমার চোখ বলে তুমি সত্য জানো।” তার কণ্ঠে কোনও ভীতি নেই, বরং ছিল এক রহস্যময় আগ্রহ। অনির্বাণ প্রথমে চুপ করে থাকে, কিন্তু এই মেয়েটির কথা শুনেই সে একটু স্বস্তি পায়। জারিনা মুজতবার দিকে ফিরে বলে, “আমি কথা বলতে চাই একা এই আগন্তুকের সঙ্গে।” মুজতবা কিছুটা অনিচ্ছা নিয়ে অনুমতি দেয়। সবাই সরে গেলে, জারিনা ধীরে ধীরে অনির্বাণের সামনে এসে বলে, “তুমি যে যুগের লোক নয়, আমি তা জানি। কিন্তু তুমি কে, কেন এসেছ—তা কি নিজেও জানো?” অনির্বাণ প্রথমে কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে তার চোখের দিকে। তারপর ধীরে বলে, “আমি একজন ইতিহাসবিদ… ভবিষ্যতের লোক… ভুল করে সময়ের সীমানা পেরিয়ে এসেছি।” জারিনা কিছুক্ষণ স্থির থাকে, তারপর হেসে ফেলে—“তোমরা ভবিষ্যতের লোকেরা কি এখনো বিশ্বাস করো ইতিহাসের দরজায় প্রেমের হাওয়া আসে?”
তাদের কথোপকথন ধীরে ধীরে আরও গভীর হতে থাকে। অনির্বাণ বুঝতে পারে, এই নারীর মধ্যেই রয়েছে একমাত্র পথ—যে তাকে সাহায্য করতে পারে এই কেল্লার জটিল সময় থেকে পালিয়ে যেতে, কিংবা বুঝে নিতে—কেন সে এখানে এসেছে। জারিনা বলে, “এই কেল্লার গায়ে সময় জমে আছে, আগেও কেউ কেউ এসেছিল… আমি শুনেছি এক সুফি সাধকের কথা, যিনি বলেছিলেন—‘একদিন ভবিষ্যতের মানুষ এসে ইতিহাসে ভুল খুঁজবে, আর নিজের পথ হারাবে।’ হয়ত সেই মানুষ তুমি।” অনির্বাণ প্রথমবারের মতো অনুভব করে, এখানে কেউ তাকে সত্যি বিশ্বাস করছে। তারা দুজন ধীরে ধীরে সময়ের বাইরের এক বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে থাকে—যেখানে ভাষা, যুগ, রীতি কোনো বাঁধা নয়। কিন্তু তাদের এই গোপন কথা শুনে ফেলেছে কেউ—এক ছায়া, এক গোপনচর—যে জারিনার আস্থা ও অনির্বাণের আগমনের সংবাদ পৌঁছে দেবে সেই ভয়ঙ্কর রহমত উল্লাহ খানের কানে। সময়, প্রেম আর বিশ্বাস—তিনটি বিপরীত স্রোত মিলছে, আর অনির্বাণ জানে না, ইতিহাস তার পক্ষে আছে, না বিপক্ষে।
৪
পুরনো কেল্লার রাত্রিগুলো নিঃশব্দ, কিন্তু নিস্তব্ধতা যেন এখানে কথা বলে। অনির্বাণ সেই রাতে ঘুমোতে পারেনি। কেল্লার এক পুরাতন কক্ষে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে তার জন্য—কথিতভাবে অতিথিদের থাকার জায়গা, কিন্তু এখন নির্জন ও ভুতুড়ে। দেয়ালে দেওয়ালিকায় আঁকা ফুল, ফারসি ছাপ, কাঠের জানালায় উঁকি মারে সোনালি চাঁদের আলো। শুয়ে থাকতে থাকতে অনির্বাণের মাথায় ঘুরছে একটাই কথা—এই সময় থেকে কীভাবে ফেরা সম্ভব? আর যদি ফেরাও যায়, তবে কি ফিরে গিয়ে সে আবার একই মানুষ থাকবে? তার ব্যাগে রাখা একমাত্র সমকালীন বস্তু—মোবাইল ফোন—আগেই কেড়ে নিয়েছে সিপাহীরা। অনির্বাণ জানে, এখানে বাঁচতে হলে তাকে বিশ্বাস করতে হবে তাদের, যাদের সে কেবল বইয়ের পাতায় চিনত—জারিনা, দারা শিকোহ, অথবা হয়তো আরও কেউ… সেই রহস্যময় সুফি সাধক, যার কথা জারিনা বলেছিল। হঠাৎ করেই রাতের স্তব্ধতা চিরে এক সুর ভেসে আসে জানালার ওপার থেকে—একটা বাঁশির মতো শব্দ, সঙ্গে উচ্চারিত কিছু মন্ত্রের মতো ধ্বনি। অনির্বাণ উঠে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে—কেল্লার নিচের ঘন গুল্মের মধ্য দিয়ে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে, হাতে এক অদ্ভুত লণ্ঠন, চোখের দিকে হালকা সোনালি আলো।
সেই রহস্যময় আলোর টানেই অনির্বাণ দরজা খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে। চাদর গায়ে দিয়ে সে অন্ধকার পথে হাঁটতে থাকে। পুরনো পাথরের গলি, ভেজা কুয়াশা, আর রাতের বাতাসের মধ্যে একধরনের অলৌকিকতা মিশে আছে। পেছনে পাহারার শব্দ ক্ষীণ হয়ে যায়, আর সামনে এক অদ্ভুত পথ তার জন্য খুলে যায়—যেখানে দেয়ালের ফাটলের ভেতর দিয়ে দেখা যায় পেছনের এক শ্মশানের ধ্বংসাবশেষ। অনির্বাণ সেখানে গিয়ে দেখে—এক বৃদ্ধ বসে আছে এক গাছের নিচে। সাদা দাড়ি, চোখে ধ্যানে-ডুবে থাকা শান্তি, আর পায়ের কাছে রাখা আছে এক পুরোনো ভাঙা ঘড়ি—যেটা এখনও চলছে, কিন্তু উল্টো ঘোরে কাঁটা। বৃদ্ধ চোখ মেলে তাকায়, যেন সে জানত অনির্বাণ আসবেই। “তুমি এসেছো,” বলে ওঠে সে, “যেমন এসেছিলো আরও দু’জন—পাঁচচল্লিশ বছর আগে, আর তারও আগে। কিন্তু কেউ ফিরতে পারেনি নিজের রূপ নিয়ে। ফিরে গেছে ছায়া হয়ে।” অনির্বাণ শিউরে ওঠে—“আপনি কে?” বৃদ্ধ হেসে বলে, “আমি বাবাজান—সময়চক্রের প্রহরী। আমি পাহারা দিই সেই দরজাকে, যা খোলে নিজের নিয়মে, আর বন্ধ হয় নিজের নিয়মে। মানুষের ইচ্ছেতে নয়, সময়ের সংকেতেই খুলে সে পথ।”
বাবাজান ধীরে ধীরে অনির্বাণকে জানান—এই দরজা কেবলমাত্র সেই মানুষদের জন্য খোলে যাদের মনে থাকে অতীতের টান, কিন্তু ভবিষ্যতের ভয়। সে বলে, “তুমি এসেছো কারণ ইতিহাস তোমাকে ডেকেছে। এখন ইতিহাসের ভিতরে থেকেও তোমাকে বুঝতে হবে—তুমি দর্শক থাকবে, না অংশগ্রহণকারী হবে।” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে, “আমি কি ফিরে যেতে পারব?”—বাবাজান মাথা নাড়ে, “ফেরার পথ আছে, কিন্তু তার মূল্য আছে। তুমি যাকে ভালোবাসবে, তাকে হয়ত এখানে ফেলে যেতে হবে। তুমি যা বদলাবে, তার জন্য ভবিষ্যতে মূল্য দেবে তোমার জাতি। ইতিহাস শুধরে নিতে চায় না, সে কেবল স্মরণ করায়।” বাতাসে কুয়াশা ঘন হয়। অনির্বাণ সেই মুহূর্তে অনুভব করে—এই যাত্রা কেবল শারীরিক নয়, আত্মিকও। বাবাজান বলে, “তোমার পথ আজ খুলবে, কিন্তু তা কখন বন্ধ হবে, আমি বলতে পারি না। যতদিন ইতিহাস তোমাকে নিজের ভিতর রাখবে, তুমি তারই অংশ।” সেই মুহূর্তে দূরে কেল্লার মীনার থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি—দিন শুরু হতে চলেছে, আর অনির্বাণ বুঝে যায়—এই ভোর তার জীবনের সবচেয়ে অচেনা ভোর।
৫
পুরোনো দিল্লির সেই কেল্লা এখন শুধুই ইট-সুরকির স্মৃতিসৌধ নয়, বরং যেন একটা জীবন্ত দুনিয়া হয়ে উঠেছে অনির্বাণের কাছে। গত কয়েক দিন ধরে সে বুঝে গেছে—এই পৃথিবী বইয়ের পাতায় যা লিখে রেখেছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রাণবন্ত, রাজনৈতিক, বিপজ্জনক, আর মায়াবী। মুজতবা আলির সন্দেহ এখনও কাটেনি, তবে জারিনার মধ্যস্থতায় তার ওপর নজরদারির মাত্রা কিছুটা কমেছে। ঠিক এই সময়েই এল এক বিস্ময়কর সংবাদ—দারবারের যুবরাজ দারা শিকোহ কেল্লায় ফিরেছেন! এক বিশেষ সভায় তার উপস্থিতি প্রয়োজন, এবং কেল্লার প্রান্তরের শ্রেষ্ঠ চিন্তক, কবি, দার্শনিকদের সঙ্গেই দেখা করতে চান তিনি। মুজতবা, যদিও মুখে কিছু বলে না, কিন্তু এই ‘অদ্ভুত পরদেশি’র সাক্ষাৎকে যুবরাজের কৌতূহলের বিষয় বলে অনুমোদন দেয়। অনির্বাণের বুকের ভিতর তখন কেবল একটা ধ্বনি—”আমি কি সত্যিই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোনো মুহূর্তে এসে পৌঁছেছি?”
দারা শিকোহ—এই নামটা অনির্বাণের কাছে কোনও সাধারণ রাজনৈতিক চরিত্র নয়। সে জানে, মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক যুবরাজ ছিলেন তিনি। যিনি হিন্দু-মুসলিম দার্শনিক মিলনের পক্ষে কথা বলেছিলেন, উপনিষদ অনুবাদ করেছিলেন ফারসিতে, এবং এক নতুন দার্শনিক ধারার পথিকৃৎ ছিলেন। অথচ এই মানুষটিকেই ইতিহাস খুব শীঘ্রই বলি করে দেবে—তার নিজের ভাই আওরঙ্গজেবের ক্ষমতালোভী তলোয়ারের নিচে। সেই ভবিষ্যৎ জেনে থাকা সত্ত্বেও, অনির্বাণ ঠিক করে সে মুখোমুখি হবে দারার—তাকে জানাবে, ভবিষ্যতে কী ভয়াবহ ইতিহাস অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—সে কি পারবে ইতিহাস বদলাতে? আর ইতিহাস কি বদলাতে দেয় কাউকে?
যুবরাজের সঙ্গে দেখা হয় এক সাদামাটা পাথরের চাতালে। অনির্বাণ প্রথমে কিছুটা হতবাক—দারা শিকোহ কোনও সিংহাসনে বসে নেই, বরং মাটিতে বসে আছেন, তার সামনে উন্মুক্ত কয়েকটি পুঁথি—একদিকে সংস্কৃত উপনিষদ, অন্যদিকে ফারসি অনুবাদ। তিনি অনির্বাণকে বসতে বলেন, এবং বলেন, “তুমি আগন্তুক, তোমার চোখে আমি উত্তর খুঁজছি। বলো তো, ঈশ্বর কি কেবল একটি জাতির, একটি ভাষার, একটি ধর্মের হতে পারেন?” অনির্বাণ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করে—এই মানুষটার মৃত্যু শুধু একজনের নয়, বরং এক সম্ভাবনার মৃত্যু। সে বলে ওঠে, “না, ঈশ্বরের পথ বহুমুখী। আপনার জীবনটাই সেই প্রমাণ।” দারা একটু চমকে তাকান, “তুমি আমাকে চিনো?” অনির্বাণ আর গোপন করতে পারে না। ধীরে ধীরে সে খুলে বলে—“আমি ভবিষ্যতের মানুষ, যেখানে আপনার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা, কিন্তু যেখানে আপনি বেঁচে নেই। আপনাকে আপনারই ভাই—আওরঙ্গজেব—ধোঁকা দিয়ে হত্যা করবে। আপনার ধর্মমিলনের ভাবনাই একদিন রাজনীতির হিংস্র থাবায় দগ্ধ হবে।” এই কথাগুলো বলে অনির্বাণ থেমে যায়। দারার চোখে তখন এক বিস্ময়ের রেখা, কিন্তু তার ঠোঁটে এক শান্ত হাসি—“আমি জানতাম, আমার পথ সহজ নয়। আর যদি ঈশ্বর আমাকে এই দায়িত্ব দেন, তবে মৃত্যু নয়, আমার ভাবনাই বাঁচবে চিরকাল।”
অনির্বাণ ফিরে আসে সেই কক্ষে, যেখানে সে এখনকার মতো ‘বাস’ করছে, আর ভাবে—এই মুহূর্তেই সে ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করতে পারত। দারাকে পালাতে বলত, ভবিষ্যৎ বদলে দিত। কিন্তু বাবাজান বলেছিলেন—“যে ইতিহাসে তুমি এসেছ, সেটি তোমার তৈরি নয়। তুমি হয়তো তার সাক্ষী হতে পার, তার নিয়ন্তা নয়।” অনির্বাণ জানে, তার হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছে এই জ্ঞান রাখার ভারে, কিন্তু তার দায়িত্ব এখন আরও বেশি—যতক্ষণ সে এই যুগে আছে, তাকে সেই সমস্ত সত্য খুঁজে পেতে হবে, যা হারিয়ে গেছে, যা বিকৃত হয়েছে, যা ইতিহাসের পাঁজর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, দরজার নিচ দিয়ে ঢোকে এক কাগজের টুকরো, জারিনার হস্তাক্ষরে লেখা—
“তোমার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কেউ আমাদের কথোপকথন শুনেছে। রাত বারোটায় পশ্চিম চত্বরের ফোয়ারার পাশে এসো। আমি তোমাকে কিছু দেখাবো… এমন কিছু, যা সময়কেও ভয় দেখায়।”
৬
পুরনো দিল্লির আকাশে তখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কেল্লার দেয়ালে সাপের মতো লেপ্টে থাকা রাত যেন নিজেই ফিসফিস করে কথা বলছে। ঠিক সেই সময়েই পশ্চিম চত্বরের একটি খোলা ফোয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ অপেক্ষা করছিল জারিনার জন্য। তার বুকের ভিতরে তীব্র ধুকপুকানি, কারণ সে জানে—জারিনার হাতে কিছু এমন তথ্য আছে, যা শুধু তার নিজের ভবিষ্যৎ নয়, হয়তো ইতিহাসের গতিপথও বদলে দিতে পারে। রাতের হালকা আলোয় সে দেখতে পেল—জারিনা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, তার হাতের আঙুলে পুরনো কেল্লার ম্যাপের মতো কিছু একটা। “এটা মেহরআলী কেল্লার মূল নকশা,” সে ফিসফিস করে বলে। “এই নকশার ভিতরেই আছে সেই দ্বিতীয় দরজার হদিস—যা সময়ের গভীরে আরও ভেতরে নিয়ে যেতে পারে, হয়তো ফিরিয়েও দিতে পারে তোমার যুগে।” অনির্বাণ চমকে ওঠে, “তুমি কিভাবে জানলে?” জারিনার চোখে অদ্ভুত মায়া—“আমার বাবা বলতেন, এই দরজাগুলো কেবল গুহা বা পাথরের নয়, ওগুলো বিশ্বাস আর ক্ষয়িষ্ণু ভবিষ্যতের পেছনের ছায়া। তুমি যদি সময়কে পার করতে চাও, তবে তার ভেতরের চিহ্নগুলো বুঝতে শিখো।” অনির্বাণের প্রশ্ন জমতে থাকে, আর সেই মুহূর্তে অন্ধকারে এক ছায়া নড়েচড়ে ওঠে—তাদের কথা কেউ শুনছে।
রহমত উল্লাহ খান—সম্রাটের গুপ্তচর বিভাগের প্রধান, যাকে কেউ দেখে না, কিন্তু যার ছায়া সবখানে পৌঁছায়। সে সেইদিন থেকেই সন্দেহ করে আসছিল অনির্বাণকে—তার অদ্ভুত পোশাক, দুর্বোধ্য কথাবার্তা, কেল্লার গোপন জায়গায় গমনাগমন, আর সবশেষে জারিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সে মনে করে, হয়তো এই ‘পরদেশি’ আসলে দাক্ষিণাত্যের কোন গুপ্তচর, কিংবা পারস্যের রাজদূত ছদ্মবেশে। সে তার সিপাহীদের মাধ্যমে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে থাকে অনির্বাণকে, তার কথোপকথন, তার চলাফেরা। সেই রাতে, যখন জারিনা অনির্বাণকে ফোয়ারার পাশে নিয়ে এসেছিল, সেই মুহূর্তে দূরে একটি দেয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল রহমত উল্লাহ। তার ঠোঁটে ঠাণ্ডা হাসি, চোখে এক ঝলক শকুনের ধৈর্য—সে জানত, তার জালে মাছ ঢুকে পড়েছে, এখন দরকার শুধু সময়মতো ফাঁসটা টানার।
সকালে কেল্লায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে—জারিনার কামরায় চুপিচুপি ঢুকে কেউ তল্লাশি চালিয়েছে। তার ব্যক্তিগত কবিতার খাতা, কিছু মানচিত্র, এবং একটি নীলচে রংয়ের ব্রোচ গায়েব। জারিনা বুঝতে পারে—তাদের উপর নজরদারি তীব্র হচ্ছে। সে অনির্বাণকে সাবধান করে দেয়, “রহমত উল্লাহ শুধু গুপ্তচর নয়, সে সময়কে নিজের মতো করে বাঁকাতে চায়। তোমার আসা তাকে অস্থির করে তুলেছে।” অনির্বাণ জানে—সময়ের ভেতর থাকা যতটা আশ্চর্য, তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সময়ের প্রহরীদের হাত থেকে বাঁচা। এই মুহূর্তে সে বুঝে যায়, আর সময় নেই। তাকে খুব তাড়াতাড়ি সেই দ্বিতীয় দরজার হদিস পেতে হবে—যা কেবল তাকে ভবিষ্যতের দিকে নয়, হয়তো ইতিহাসের সত্যের দিকেও নিয়ে যাবে। কিন্তু সে জানে না—রহমত উল্লাহ ইতিমধ্যেই তার জন্য এক গোপন ফাঁদ তৈরি করে ফেলেছে, যেখানে একবার পা রাখলে, সে হয়তো আর কোনও যুগেই নিজের নাম লিখতে পারবে না।
৭
পুরনো দিল্লির গরম রাতগুলোয় বাতাস যেন ভারী হয়ে থাকে আতর, ষড়যন্ত্র আর ঘামে ভেজা গোপন ইচ্ছায়। অনির্বাণ জানে না, ঠিক কোন সময়ের দোরগোড়ায় সে দাঁড়িয়ে আছে—কিন্তু সে জানে, এটাই সেই সন্ধিক্ষণ, যখন ভালোবাসা আর ভয় একসঙ্গে তার শ্বাস নিতে শুরু করেছে। সেই রাত, যখন সে গিয়েছিল জারিনার সঙ্গে দেখা করতে ফোয়ারার পাশে, তখন থেকেই কেল্লার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদৃশ্য উত্তেজনা। জারিনার কামরায় তল্লাশি, তার ব্যক্তিগত সামগ্রীর হদিস না থাকা, এবং রহমত উল্লাহ খানের অস্বাভাবিক নীরবতা—সব মিলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ঝড় আসতে চলেছে। অনির্বাণ বুঝে যায়—আর সময় নেই। তাকে এখনই খুঁজে বের করতে হবে সেই দ্বিতীয় দরজাটি—যেটি কেবল সময় নয়, এই ভয়ঙ্কর ছায়া থেকে পালানোর পথও।
জারিনা তাকে নিয়ে যায় কেল্লার দক্ষিণ দিকের সেই পুরনো শাহী স্নানাগারের দিকে—যেখানে এককালে মহারানীদের জন্য তৈরি হয়েছিল গোপন স্নানঘর। সেই স্নানঘরের নিচে রয়েছে এক বিস্মৃত সুড়ঙ্গ, যার মানচিত্র শুধুমাত্র জারিনার বাবা রেখে গিয়েছিলেন তার কবিতার পাতায়। অনির্বাণ জানে, এই সুড়ঙ্গের গভীরেই লুকিয়ে আছে সেই ‘দ্বিতীয় দরজা’—যা সময়ের মূর্ছনার ভেতরে ঢোকার একমাত্র পথ। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঘটে যায় সেই রাতের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা। চিৎকার, ধোঁয়া, আগুন। কেল্লার পূর্বাংশে আগুন লেগে গেছে—কেউ কেউ বলে বিদ্রোহ, কেউ বলে গুপ্তচরের হাত। কিন্তু জারিনা জানে—এ আগুন রহমতের পরিকল্পনার অংশ। শত্রুকে বিভ্রান্ত করো, তারপর আঘাত করো—এটাই তার কৌশল। আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে দোতলা, রাজপুরুষদের থাকার কক্ষ, সৈন্যদের অস্ত্রাগার—আর সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে অনির্বাণ আর জারিনা ঢুকে পড়ে সেই পুরনো স্নানঘরের অভ্যন্তরে। কুয়াশায় ভরা সেই জীর্ণ হলঘরে, সময়ের স্তম্ভের গায়ে হাত রেখে তারা নামতে থাকে সিঁড়ির পর সিঁড়ি।
সেই সুড়ঙ্গ সরু, স্যাঁতসেঁতে আর ভয়ানক নীরব। দেওয়ালের গায়ে বহু পুরনো আঁকিবুঁকি, কোথাও কোথাও ফারসি হরফ—“যে সময়কে ভালোবাসে, সে মরতেও ভয় পায় না।” হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে আসে আওয়াজ—তলোয়ারের ঘষা, ধাতব পদক্ষেপ। রহমতের লোকেরা টের পেয়ে গেছে। একটা অন্ধকার মোড়ে দাঁড়িয়ে জারিনা বলে—“তুমি দৌড়াও। দরজাটা যদি পেয়ে যাও, ফিরে যেও না। আমি পথচিহ্ন রেখে দেব।” অনির্বাণ কিছু বলতে চায়, কিন্তু সময় নেই। তারা ছুটে চলতে থাকে—সুড়ঙ্গের এক প্রান্তে বেরিয়ে আসে খোলা আকাশের নিচে, যেখানে এক ভাঙা মসজিদের পাশে ধুলোয় চাপা সেই দ্বিতীয় দরজার কাঠামো। হঠাৎ জারিনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক সৈন্য, আর অনির্বাণ তার দিকে ছুটে যেতে গিয়েও দেখে—আরও পাঁচজন সৈন্য তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেই মুহূর্তে, সে শেষবারের মতো চিৎকার করে—“জারিনা!” আর তার কানে আসে সেই মেয়েটির গলা—“তুমি ফিরো! আমি থাকব! ভবিষ্যতে আমার নামের পাশে যেন লেখা থাকে—সে এক স্বপ্নকে সময়ের গায়ে লিখে দিয়েছিল।”
তারপর একটা তীব্র ধোঁয়া, একটা ধাতব শব্দ, আর চোখের সামনে খুলে যায় সেই দ্বিতীয় দরজা—শ্বাস নিতে না নিতে অনির্বাণ তার ভিতরে ঢুকে পড়ে। সময় যেন তার শরীরের চারপাশে ঘূর্ণি তৈরি করে। ঝড়ের গর্জন, রক্তের গন্ধ, প্রেমের কান্না আর আগুনের শিখা মিলেমিশে তৈরি করে এক মহাকাব্যিক মুহূর্ত। সে জানে না দরজা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিংবা আদৌ ফিরিয়ে দেবে কিনা। শুধু জানে—এই দরজার ওপারে সে একজন ভিন্ন মানুষ হয়ে উঠবে, যে ভালোবেসেছিল ইতিহাসকে, আর এক নারীকে—যার নাম ছিল জারিনা।
৮
যখন অনির্বাণ চোখ খুলল, প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারল না—সমস্ত কিছু কুয়াশার মতো ঘোলা, মাথায় যেন কয়েকশো ঘণ্টা একসঙ্গে বাজছে। তার গায়ে তখনও মাটি লেগে, চুলে ঝড়ো হাওয়ার গন্ধ, আর বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক করে চলেছে সেই মুহূর্তের ছায়া—শেষবার জারিনার মুখ দেখা, সেই দ্বিতীয় দরজা, সেই পালানোর চিৎকার। সে বুঝতে চায়—সে কি ফিরেছে তার সময়ে? সে কি এখনও ২০২৫-এ, সেই আধুনিক দিল্লিতে রয়েছে, যেখানে পাথরের কেল্লা কেবল ধ্বংসস্তূপ? কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে সে দেখে, সে এক অদ্ভুত ঘরে—আধুনিক নয়, মুঘল যুগেরও নয়—বরং এক ধরনের বিমূর্ত ঘর, যার দেয়ালে সময়ের প্রতিটি চিহ্ন খোদাই হয়ে আছে। দেওয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িগুলো সব চলছে উল্টো দিকে। মাঝখানে রাখা এক বিশাল আয়না, যেটা শুধুমাত্র মুখ দেখায় না, বরং স্মৃতি, বেদনাও দেখায়।
এখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় সেই চূড়ান্ত চরিত্রের—এক বৃদ্ধ, যার নাম কেউ জানে না, কিন্তু যাকে সবাই বলে “ইতিহাসরক্ষক”। তিনি বসে আছেন এক কাঠের চেয়ারে, সামনে রাখা অসংখ্য পাণ্ডুলিপি। তার কণ্ঠ নিঃশব্দ অথচ গম্ভীর—“তুমি সময়কে পার করেছ, অনির্বাণ। কিন্তু তুমি কি জানো, সময় পার করা মানে কেবল নিজের জীবন নিয়ে যাওয়া নয়—সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাওয়া স্মৃতি, দুঃখ, রক্ত আর ভালোবাসাও?” অনির্বাণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন প্রশ্ন বুঝতে পারলেও উত্তর দিতে পারে না। ইতিহাসরক্ষক বলেন, “তুমি ইতিহাস পাল্টাওনি, কিন্তু ইতিহাস তোমাকে পাল্টেছে। বলো, তুমি কাকে বেশি ভালোবেসেছ—তোমার নিজের সময়কে, না সেই মেয়েটিকে, যে একটা প্রাচীন কেল্লার দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল?” অনির্বাণের মুখ শুকিয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলে, “আমি তার চোখে দেখেছিলাম আমার ভবিষ্যৎ—আর আমার চোখে ছিল তার অতীত। আমরা পরস্পরের আয়নায় নিজেদের দেখেছিলাম।”
তখন ইতিহাসরক্ষক তাকে একটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখানে রাখা এক মোটা বই—অনির্বাণের নিজের নাম লেখা তার মলাটে। সে বই খুলে দেখে, তার জীবনের সব কিছু লেখা—কবে সে জন্মেছে, কবে ইতিহাসে প্রবেশ করেছে, কবে জারিনার সঙ্গে প্রথম দেখা, আর… কোথায় তার শেষ হয়েছিল সেই যাত্রা। কিন্তু আশ্চর্য, বইয়ের শেষ অধ্যায় ফাঁকা। ইতিহাসরক্ষক বলেন, “এই অধ্যায় তুমি নিজে লিখবে। যদি চাও, তুমি ফিরে যেতে পার ভবিষ্যতে—তোমার পরিচিত জগতে। কিন্তু তুমি যদি চাও, তুমি থেকেও যেতে পার—তোমার সেই ভালোবাসার কাছে। কিন্তু মনে রেখো, ইতিহাস কখনো পুনরাবৃত্তি পছন্দ করে না। তুমি থাকবে হয় ছায়া হয়ে, নয়তো পুরাণ হয়ে।” অনির্বাণের হাতে একবার তুলে দেওয়া হয় একটা পুরোনো কলম—যেটা দিয়ে সে নিজের ভাগ্য লিখবে। সে জানে না সে কী লিখবে, কিন্তু চোখে তখন জারিনার সেই শেষ মুহূর্তের চোখ—ভরা জল, ভরা সাহস, আর ভরা বিসর্জন।
৯
কলমটা হাতে নেওয়ার পর অনির্বাণের মনে হয়েছিল, সে যেন স্রেফ কালি নয়, সময়কেই ছুঁয়ে ফেলেছে। কাগজের সাদা পাতার দিকে তাকিয়ে সে যেন দেখতে পেল—ফেলে আসা মুহূর্তগুলো ছবির মতো ভেসে উঠছে। জারিনার চোখে ভয়, বিশ্বাস, বিদায়; সুড়ঙ্গের দেয়ালে সেই ফারসি শব্দ; বাবাজানের মুখে সময়ের রহস্যময় সাবধানবাণী; আর দারা শিকোহের শান্ত দৃষ্টি, যিনি মৃত্যুর ভিতর দিয়েও মিলনের দর্শনকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। অনির্বাণ জানে, বইয়ের শেষ অধ্যায় লেখার সুযোগ সবাই পায় না। এই সুযোগ একটা ‘ফিরে যাওয়া’—কিন্তু তার নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব বাজতে থাকে। সে যদি ফিরে যায়, তবে সে কি সত্যিই বাঁচবে? নাকি শুধু শরীরটাই ফিরবে, মন আর আত্মা থেকে যাবে সেই ফেলে আসা যুগে, সেই মেয়েটির কাছে?
হঠাৎ ঘরের এক কোণে থাকা আয়নাটার ভেতরে সে দেখতে পেল—তার নিজের বর্তমান, আধুনিক জামাকাপড় পরে ক্যাম্পাসে হাঁটছে, ছেলেমেয়েরা হেডফোনে গান শুনছে, কেউ কেউ মোবাইলে রিল বানাচ্ছে—আর সে নিজে, হাঁটছে সেই চেনা কিন্তু এখন অচেনা হয়ে যাওয়া শহরের মধ্যে। সব কিছু খুব পরিচিত, তবু খুব ফাঁকা। আরেকটা আয়নায় দেখা গেল অন্য দৃশ্য—জারিনা সেজে উঠেছে সেই ময়ূর খচিত ওড়নায়, দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো কুয়াশামাখা জানালার পাশে, তার সামনে পাতা এক ছিঁড়ে ফেলা কবিতার খাতা। মেয়েটি তাকিয়ে আছে এক গভীর, নিঃশব্দ প্রশ্ন নিয়ে—তুমি কি ফিরবে? না আমাকে এই সময়ে একা রেখে যাবে?
অনির্বাণ চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি একজন ইতিহাসবিদ। কিন্তু ইতিহাস কেবল লেখা হয় না—জীবন দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, অপেক্ষা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আমি ফিরে যাব না।” ইতিহাসরক্ষক তখন ধীরে মাথা নাড়ে। “তুমি জারিনাকে ভালোবেসেছ,” তিনি বলেন, “এবং সে তোমাকে এমন এক দরজা খুলে দিয়েছিল, যেটা কেবল প্রেম নয়, আত্মা দিয়েও খোঁজা যায়।” সে মুহূর্তে ঘরের মধ্যেই খুলে গেল এক অদ্ভুত আলোয় মোড়া সিঁড়ি—যেটা নামছে নিচে, সময়ের এক গূঢ় প্রকোষ্ঠের দিকে, যেখানে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে কোনো একটি স্মৃতি। অনির্বাণ সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়—জারিনার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য, ফিরে না আসার জন্য।
কয়েক সপ্তাহ পরে, ২০২৫ সালের এক কুয়াশাঘেরা সকালে পুরনো দিল্লির কেল্লায় একদল প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করতে গিয়ে খুঁজে পায় এক পুরনো বই—যার মলাটে লেখা “Itihasher Agantuk”, লেখক: Dr. Anirban Chakraborty। আর পাতার নিচে অদ্ভুত এক লিপিতে লেখা—
“আমি ফিরে যাইনি, কারণ কিছু ভালোবাসা ফিরে গেলে মরে যায়। আমি থেকে গেছি, কারণ সে চোখ দুটো ইতিহাসের চেয়েও সত্য ছিল।”
১০
সময়, এই শব্দটা হয়তো কেবল ঘড়ির কাটার নিরবিচার চলাফেরা নয়। এটা অনেকটা নদীর মতো—যে নিজে কখনও থামে না, কিন্তু মাঝে মাঝে কারও জন্য একটা ঘূর্ণি তৈরি করে, তাকে ডেকে নেয় তার গভীরে। অনির্বাণ চক্রবর্তী, ইতিহাসের এক শিক্ষক, এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষে পড়ান না। তিনি এখন আছেন এক কাল্পনিক যুগে, এক বাস্তব মুঘল দরবারের ছায়ার ভেতরে, যেখানে তার নাম নেই, পরিচয় নেই—তবে আছে গভীরভাবে জীবিত এক অস্তিত্ব।
তার ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল প্রেমের জন্য ছিল না—তাই নয় যে জারিনার চোখে প্রেম খুঁজে পেয়েছিল বলেই সে রয়ে গেল। বরং সে বুঝেছিল—ভবিষ্যতের মানুষ হয়ে ইতিহাসকে বুঝতে হলে ইতিহাসের ভেতরে থাকতে হয়, জীবনের মতো করে। জারিনার পাশে সে পেয়েছিল সেই ‘অস্মরণীয় স্পর্শ’, যা ইতিহাসবিদের পাণ্ডুলিপি ছুঁয়ে যেতে পারে না। জারিনা তাকে নিয়ে যায় সেই সব গোপন স্থানে, যেখানে কেল্লার সত্য লুকানো, যেখানে রাজার খোলা দরবারের আড়ালে জমে আছে হাজার জনের কষ্ট, নারীর চোখে অসমাপ্ত কবিতা, এবং সাধুদের মৌন বার্তা। অনির্বাণ সেইসব মুহূর্তে বুঝে নেয়—তাকে রক্ষা করতে হবে এ কেল্লার ইতিহাস, কেবল বইয়ের জন্য নয়, ভবিষ্যতের সত্যিকারের মানবতার জন্য।
কিন্তু সেই সময়ও চিরস্থায়ী নয়। একদিন, গভীর রাতে, জারিনা এসে জানায়—“তুমি যেটা এড়িয়ে যেতে চাইলে, সেটাই আবার ফিরে এসেছে। রহমত উল্লাহ বেঁচে নেই, কিন্তু এখন তার জায়গায় এসেছে নতুন রাজ-উপদেষ্টা, যে জানে—তুমি এই সময়ের লোক নও।” অনির্বাণের চারপাশে আবার আঁধার জমতে শুরু করে। তার আশ্রয় নেয়া কক্ষ তল্লাশি শুরু হয়, জারিনার ওপর উঠে আসে নিষেধাজ্ঞা। এবং তখনই ইতিহাস তার শেষ দরজাটা খোলে।
এক সন্ধ্যায়, বাবাজান আবার দেখা দেন। এবার আর কোনও ধোঁয়ার ভেতর নয়, নয় কোনও তপস্যাময় ভাবভঙ্গিতে—তিনি আসেন এক প্রবীণ, ক্লান্ত, অথচ নির্ভীক ভবিষ্যদ্রষ্টার রূপে। তিনি বলেন, “তোমার গল্প এখানে শেষ হবে না, অনির্বাণ। তুমি হয় চিরকাল অচেনা থেকে যাবে এই কেল্লার ইতিহাসে—নাকি তোমার নাম একদিন পাওয়া যাবে মাটি খুঁড়ে বের করা কোনও কবিতার পাশে, কেউ জানবে না তুমি কে, কিন্তু অনুভব করবে তুমি কী রেখে গেছো।” তিনি অনির্বাণকে দেখান এক গোপন প্রবেশপথ—মাটির নিচে, কেল্লার পুরনো শস্যাগারের পেছনে—যেখানে রাখা আছে সেই ‘শেষ দরজা’। এটা সময়ের না, প্রেমেরও না—এটা ‘বিচারের দরজা’। কেউ যদি এর ভেতর দিয়ে যায়, সে আর নিজের মতো থাকে না। সে হয়ে যায় ইতিহাসের রক্তমাংস, সে হয়ে যায় কোনো বংশপরম্পরার গোপন গল্প, কোনো লোকগীতির রহস্যময় চরিত্র।
জারিনাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে অনির্বাণ বলে, “তুমি জানো তো, আমি কে?”
জারিনা হেসে বলে, “তুমি ছিলে এক আগন্তুক, এখন তুমি আমার দেশের লোক, আমার হৃদয়ের ইতিহাস।”
সে সিঁড়ি দিয়ে নামে, মাটির নীচে, শেষ দরজার দিকে। চারপাশে নিঃশব্দ। দরজাটা খুলে যায় ধীরে, যেন আত্মা ছুঁয়ে দিচ্ছে অন্য আত্মাকে। আর দরজার ওপাশে—না, আলো নেই, অন্ধকারও না—শুধু একটা অনুভব… যে সে হারিয়ে যাবে না, সে রয়ে যাবে—কখনও একজন নামহীন কবির ছায়ায়, কখনও জারিনার রেখে যাওয়া কোনো চিঠির ভাঁজে, অথবা হাজার বছর পরে কারও আবিষ্কৃত একটি সুরে।
—




