সুজয় দেবনাথ
পর্ব ১
কলকাতার বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাগুলোতে শহরের ভিড়ও যেন ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সেদিনের সন্ধ্যাও কিছুটা তেমনই ছিল। অন্বেষা ল্যাপটপের সামনে বসে, কানে হালকা সঙ্গীত চালিয়ে, ডায়েরির শেষ পাতাটা ঘাঁটছিল। সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এই ছায়াময় দুনিয়ার সঙ্গে। সাংবাদিকতা, বিশেষ করে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং, তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে গত পাঁচ বছরে। চোখে-মুখে তীব্র কৌতূহল আর লেখার গভীরে যে তীক্ষ্ণতা, তা তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয় সহকর্মীদের ভিড়েও। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে নামটা ভেসে উঠল—সুব্রতদা।
‘শুন অন্বেষা, তোকে একটা জায়গায় যেতে হবে। একটু স্পর্শকাতর কেস। দার্জিলিংয়ের কাছাকাছি চিমলিং নামে এক গ্রামে গত কয়েক মাস ধরে কিছু মেয়ে নিখোঁজ হচ্ছে। পুলিশের রিপোর্টেও অনেক অসঙ্গতি আছে। কেউ ফিরছে না, কেউ ফিরলেও কথাই বলছে না। কেবল ঘরের কোণে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।’
অন্বেষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সুপ্রতিষ্ঠিত মিডিয়া হাউসে কাজ করার সুবিধা হলো, এমন কেসের হদিশ প্রায়ই আসে। কিন্তু এই কেসটা যেন অন্যরকম। কিছু একটা অজানা আঁধার যেন ইতিমধ্যেই তার চারপাশে ধীরে ধীরে ছায়া ফেলছে।
‘আরো মজার বিষয় আছে,’ সুব্রতদা আবার বললেন, ‘স্থানীয় লোকেরা বলছে, এটা নাকি ডাকিনিদের কাজ। তারা নাকি ফিরে এসেছে পাহাড়ে। তাদের চোখে নাকি আগুনের ভাষা।’
অন্বেষা মুচকি হাসল। কুসংস্কার আর আতঙ্ক মিশিয়ে সমাজ বহু গল্প রচনা করে। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে সে খুঁজে ফিরেছে যুক্তি, খোঁজে সত্য। এবারও তার লক্ষ্য সেই। তবে এ সত্য কতটা প্রমাণযোগ্য, সেটাই প্রশ্ন।
পরদিন ভোরে অন্বেষা যখন ট্রেনে উঠল, তখন শহর ঘুমিয়ে। হাওড়ার প্ল্যাটফর্মে অদ্ভুত এক নীরবতা। তার কাঁধে স্লিং ব্যাগ, হাতে পুরোনো ডায়েরি, সঙ্গে ছোট একটা ব্যাকপ্যাক আর ক্যামেরা। কামরায় বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ট্রেন যখন গড়াতে শুরু করল, ঠিক তখনই পাশের সিটে বসা একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সাংবাদিক?’
সে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। বুঝলেন কীভাবে?’
‘চোখে এক ধরনের খোঁজার লালসা থাকে। আপনাদের ক্ষেত্রে সেটা খুব স্পষ্ট।’
অন্বেষা কিছু বলল না। ভদ্রলোক নিজে থেকেই পরিচয় দিলেন—তপন সিংহ, আগে দার্জিলিংয়ে পত্রিকায় লিখতেন। এখন লেখেন না, শুধু পাহাড় দেখেন।
‘চিমলিং যাচ্ছেন?’ তপন হঠাৎ প্রশ্ন করলেন।
‘আপনি জানেন?’
‘এমন খবর বাতাসে ছড়ায়। পাহাড় চুপ থাকে, কিন্তু তার গায়ে লেখা থাকে অনেক কথা। সাবধানে থাকবেন। ওখানে রাত হলে শব্দ বদলে যায়।’
ট্রেন পৌঁছালো নিউ জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিল চিমলিংয়ের উদ্দেশে। পাহাড়ি রাস্তায় চলার সময় কুয়াশা ধীরে ধীরে ভর করল চারদিক। গাছেদের ছায়া যেন রাস্তাকে ঢেকে রাখছিল। মোবাইলে সিগনাল নেই, আর গুগল ম্যাপও থেমে গেছে অনেক আগেই। গাড়িচালক লোকটা নাম কম বলে, কিন্তু চোখে একটা অস্বস্তি স্পষ্ট। এমনভাবে তাকায় যেন জানে, যাত্রীটা ঠিক কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু বলছে না কিছু।
চিমলিং গ্রামে পৌঁছাতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। পাহাড়ঘেরা সেই গ্রাম যেন ছায়ায় ঢাকা, ঘরগুলো পাথরের, ছাদ টিনের, চারদিকে মেঘের স্তর আর পাখির ডাক নেই বললেই চলে। হোমস্টে খুঁজে পেতে সময় লাগল না। নাম “তিমি থাংকা”—স্থানীয় ভাষায় যার মানে কিছু একটা গোপন রাখার জায়গা।
দরজা খুলে দিলেন এক মধ্যবয়সী লেপচা মহিলা—জুয়েলা। গম্ভীর মুখ, চোখের ভেতরে প্রশান্তির ছায়া, কিন্তু কেমন যেন একটা অব্যক্ত ভয় লুকানো।
‘আপনি সেই রিপোর্টার?’ তিনি জানতে চাইলেন।
‘হ্যাঁ। আপনি জানলেন কীভাবে?’
‘পাহাড় বাতাসে খবর বয়ে আনে। এখানে সবাই জানে আপনি আসবেন। কিন্তু রাতে বেরোবেন না। পাহাড় জেগে ওঠে।’
অন্বেষা হেসে ফেলল। এইসব লোককথা আর তার বাস্তব জগতে অনেক ব্যবধান। সে ঘরে ঢুকল, ব্যাগ নামাল, ডায়েরিটা খুলে লেখায় মন দিল।
“চিমলিং গ্রামে পৌঁছালাম। জায়গাটা নীরব, পাহাড়ের ভাঁজে ঢুকে থাকা এক রহস্য। আজ রাতে বিশ্রাম, কাল থেকে কাজ শুরু। আমি জানি, সত্যটা এখানে কোথাও আছে। শুধু খুঁজে বের করতে হবে।”
রাত এগোতে থাকল। ঘরের বাইরের জানালা হালকা শব্দ করছিল বাতাসে। অন্বেষা ঘুমোনোর আগে হঠাৎই শুনতে পেল খুব হালকা একটা আওয়াজ, যেন দূরে কোথাও কেউ ডাকছে—
‘ইরা… ইরা…’
সে জানালার কাছে গিয়ে তাকাল। বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঘন অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। বুকের মধ্যে কেমন যেন অচেনা একটা চাপ। হয়তো পথ চলা শুরু হলো ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই।
পর্ব ২
রাতটা খুব একটা ভালো কাটেনি। চিমলিংয়ের হোমস্টের বিছানাটা নরম হলেও, জানালার পাশে বসে থাকা অন্ধকার যেন সারাক্ষণ তাকে দেখছিল। মাঝরাতে কয়েকবার ঘুম ভেঙেছিল অন্বেষার। অন্ধকার ঘরে কোনো শব্দ না থাকলেও তার মনে হচ্ছিল, যেন বাইরে কেউ হাঁটছে—নরম পায়ের শব্দ, আবার থেমে যাওয়া। মাঝে মাঝে হালকা কাশি, যেন কেউ ইচ্ছে করেই তাকে শুনিয়ে যেতে চাইছে সেই উপস্থিতির ইঙ্গিত।
সকালে উঠেই সে ডায়েরি বন্ধ করে ব্যাগে ভরল, ক্যামেরা আর রেকর্ডার সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের রাস্তায়। চিমলিং ছোট, ছিমছাম এক গ্রাম, মূলত লেপচা আর নেপালি পরিবারের বাস। পাথরের পথ, দু’পাশে বাঁশ আর রডোডেনড্রনের ঝাড়। হালকা কুয়াশা পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে আছে, আর রাস্তার মোড় থেকে মোড় চোখে পড়ে ধূপের ধোঁয়া—কোনো এক অদৃশ্য আশীর্বাদের মতো ভেসে আসে চারপাশে।
সে প্রথমে গেল গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে। সেখানে প্রধান শিক্ষিকা রিনচেন লামা, একটি তীক্ষ্ণ চোখওয়ালা মেয়ে, যার চোখে ছিল একধরনের অস্বস্তি। অন্বেষা সোজাসুজি প্রশ্ন করল, “এই গ্রামের কয়েকজন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে বা ফিরে এসে কথা বলছে না, সে বিষয়ে আপনি কিছু জানেন?”
রিনচেন ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “আমরা জানি। পুলিশ এসেছিল। তারা এসে কিছু লিখে গেল, আবার ফিরে গেল। কিন্তু কিছু হয়নি। ওরা যে ফিরেছে, তারা আর সেই আগের মানুষ নেই। যেন একটা পর্দা পড়ে গেছে ওদের আত্মার ওপর। আপনি যদি সত্যি জানতে চান, তাহলে আপনাকে পাহাড়ের গভীরে যেতে হবে।”
“কোথায়?” অন্বেষার গলা খানিকটা কাঁপল।
“পূর্ব দিকে একটা জঙ্গল আছে, নাম হিমতেরা। ওখানে গেলেই সব শুরু হয়। রাতের বেলা অনেকেই দেখেছে, কয়েকটা নারী ছায়া ওই জঙ্গলের দিক থেকে আসছে। গায়ে লাল শাড়ি, মাথায় চুল খোলা, চোখে আলো জ্বলে।”
“আপনারা বিশ্বাস করেন এটা ডাকিনিদের কাজ?” অন্বেষা বলল।
রিনচেন হালকা হেসে বললেন, “আমি একজন শিক্ষিকা। কিন্তু পাহাড়ের মাটিতে জন্ম আমার, আমি জানি এখানকার বাতাস, গাছ, ছায়া—সব কিছুর একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আপনি না চাইলে ওরা কিছু বলে না, কিন্তু আপনি যদি খোঁজেন, তাহলে আপনাকে দেখাবে।”
অন্বেষা স্কুল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, এমন কথা আগে সে বহুবার শুনেছে, কিন্তু এবার যেন কথাগুলো কেমন ঘন হয়ে আসে। ঠিক সেই সময়েই সে দেখতে পেল একজন মেয়েকে—অত্যন্ত শান্ত মুখ, ফ্যাকাশে গাল, চোখে কোনো ভাব নেই, পাথরের গায়ে বসে আছে। কাছে যেতেই মেয়েটি মাথা তুলল। তার নাম জানা গেল—সেতোং।
সেতোং সেই মেয়েদের একজন, যে হারিয়ে গিয়েছিল তিন দিন, তারপর হঠাৎ ফিরে এসেছিল। কিন্তু এখন সে কথা বলে না। ঘর থেকে বেরোয় না বললেই চলে। আজ সকালে কেবল একা এসে বসেছে পাথরের ধারটায়।
অন্বেষা ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বসে বলল, “তুমি কি আমার সঙ্গে একটু কথা বলবে?”
সেতোং কিছু বলল না, শুধু দূরে তাকিয়ে রইল। অন্বেষা আবার বলল, “আমি জানি তুমি অনেক কিছু দেখেছ। তুমি যা বলবে, আমি লিখব না যদি না তুমি চাও। আমি শুধু জানতে চাই কী হয়েছিল।”
মেয়েটি এবার মুখ ফিরিয়ে অন্বেষার চোখের দিকে তাকাল। সেই চাহনিতে ভয় ছিল না, বরং ছিল নিঃসঙ্গতা। সে হঠাৎ ধীরে ধীরে কাঁপা গলায় বলল, “তারা আসে বাতাসে। একরাত ছিল নতুন চাঁদ। আমি জঙ্গলে গিয়েছিলাম এক বান্ধবীর সঙ্গে। সে তখন বলল, এই জায়গাটা বারণ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। সেখানে একটা পাথর ছিল, গোল আকারের। তার গায়ে রক্তের দাগ ছিল। আমি ছুঁয়ে ফেলি। তারপর সব অন্ধকার। কেবল গলায় একটা শব্দ শুনি—আমাদের ডাকিনি, আমাদের নারী, আমাদের দৃষ্টি হবে তোমার চোখে।”
অন্বেষার গলা শুকিয়ে এল। সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, শুধু সেতোং-এর চোখে তাকিয়ে রইল। সেই চোখ এক সময় স্বাভাবিক ছিল হয়তো, এখন তাতে কেবল এক অদ্ভুত খালি ঘর।
সন্ধ্যে নামতে থাকল পাহাড়ে। ফিরে এসে সে হোমস্টেতে বসে ডায়েরি খুলল, কিন্তু আজ আর লেখার মতো কিছু মনে হচ্ছিল না। মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরছিল সেতোং-এর সেই কথাগুলো, আর সেই জায়গার নাম—হিমতেরা।
জুয়েলা এসে চুপ করে এক কাপ লাল চা এগিয়ে দিল। তারপর বলল, “আপনি সেখানে যাবেন না। হিমতেরা সবকিছু নেয়, কিছু ফেরায় না।”
অন্বেষা চুপ করেই থাকল। সেই রাতে, ঘুমের ভেতরে, সে দেখতে পেল লাল শাড়ি পরা নারীদের মিছিল, যারা মাটির গা বেয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের চোখে কোনো তারা নেই, কেবল লাল আলো। তারা একসঙ্গে বলছে—ইরা… ইরা…
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই অন্বেষা জানত, তার আজ হিমতেরার দিকে যেতে হবে। আর তার যাত্রা এখন সত্যিকারের এক ডায়েরির খাতায় ঢুকে গেছে—যেখানে সত্য আর মিথ্যের সীমারেখা কেবল কুয়াশা।
পর্ব ৩
অন্বেষা ভোর বেলা ঘুম ভাঙতেই অনুভব করল শরীরের কোথাও যেন অদ্ভুত ভারী একটা ক্লান্তি জমে আছে। রাতের ঘুমে সে ঘুরে ফিরে এক স্বপ্ন দেখেছে—কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে, সামনে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাথরের বেদি, যার গায়ে রক্ত লেগে আছে। আর তার পেছনে লাল কাপড় পরা নারীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে—তাদের মুখ স্পষ্ট নয়, শুধু চোখ দুটো যেন আগুনের মতো জ্বলছে। অন্বেষা একসময় দৌড়ে পালাতে চাইছে, কিন্তু পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে যাচ্ছে বারবার।
জুয়েলা সেই সময় দরজায় টোকা দিলেন। হাতে গরম জল, সঙ্গে কিছু শুকনো ফল আর নরম ব্রেড। মুখে কোনো কথা নেই, চোখে আজ যেন একটু বেশি গাঢ় ভাব। অন্বেষা ধন্যবাদ দিয়ে ট্রেকিং ব্যাগ গোছাতে লাগল। তার ঠিক হয়েছে—আজ সকালেই সে হিমতেরা জঙ্গলের দিকে যাবে। সত্যি বলতে, ওটাই এই কেসের মূল সূত্র হয়ে উঠেছে। সে জানে, ভয় তার পেশার অঙ্গ নয়, বরং ভয় যেখানে জন্মায়, সেই শিকড় খুঁজেই তার পেশা।
চিমলিংয়ের শেষ দোকান থেকে সে একটা ছোট কম্পাস আর স্থানীয় একটি মানচিত্র কিনল। দোকানদার, এক বৃদ্ধ নেপালি, নাম বলল—পাসাং। চোখের কোণে দাগ, ভ্রু কুঁচকে সব সময় কিছু না বলা চিন্তায় থাকেন। অন্বেষা যখন হিমতেরার কথা বলল, পাসাং মুখ নিচু করে বলল, “ওখানে গেলে ফিরে আসা কঠিন। কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু কিছু হারিয়ে যায়।”
‘কী রকম?’
“জানেন তো মিস, অনেক বছর আগে আমার বোনও সেই জঙ্গলে গিয়েছিল। তখন সে মাত্র ষোলো। সকালে বেরিয়ে ছিল বুনো অর্কিড তুলতে। সন্ধ্যা নামার পরও ফেরেনি। এক সপ্তাহ পর মিলেছিল—দূরে, ঝরনার পাশে। কিন্তু সে আর আগের মতো ছিল না। কথা বলত না। শুধু কাঁদত। তারপর এক রাতে নিজেই চলে গেল… চুপিচুপি… যেন কারো ডাকে সাড়া দিয়েছিল।”
পাসাংয়ের কণ্ঠে কিছু একটা কেঁপে উঠল। অন্বেষা কিছু বলল না, ব্যাগে জিনিস ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হিমতেরা যেতে হলে গ্রামের পেছনের রাস্তা ধরে যেতে হয়, যেখানে ঘন বাঁশের ঝাড়, তারপরে শুরু হয় পুরনো পাইন বন। সেখানে দিনের আলো ঢোকে না ঠিকমতো। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা ছোট পাথরের তোরণ, যা দেখতে পুরনো বৌদ্ধ স্তূপের মতো। পাথরে খোদাই করা আছে কিছু অচেনা প্রতীক। একজন বৃদ্ধা বসে ছিলেন ওখানে, চোখ বন্ধ করে, মাথায় শাল জড়ানো। অন্বেষা যখন সেখানে পৌঁছাল, বৃদ্ধা চোখ খুলে তাকালেন।
“তোমার চোখে আগুন আছে, কিন্তু মন ঘোলা। তুমি কি সত্যি জানো কী খুঁজছ?”
অন্বেষা অবাক হয়ে তাকাল। এই মহিলা কে, তা সে জানে না। কিন্তু চোখে যেন একটা গভীর শান্তি।
“আমি একজন সাংবাদিক। জানতে চাই এখানে কী ঘটছে।”
বৃদ্ধা হেসে বললেন, “ডাকিনিরা শুধু রক্ত খোঁজে না, তারা মন খোঁজে। যাদের মনে ভয় থাকে, তারা ওদের জন্য সহজ শিকার। তোমার মন কাঁপছে, কিন্তু তবু যাচ্ছ। তবে মনে রেখো, ওরা ডাকে না, ওরা আকর্ষণ করে। আর যখন টান পড়ে, তখন পিছিয়ে যাওয়া যায় না।”
এমন কথা শুনে অন্বেষা একটু থমকে গেল। কিন্তু তারপর মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল।
জঙ্গলে ঢোকার পর চারপাশে বাতাসের শব্দই যেন অন্যরকম লাগছিল। পাখির ডাক নেই, পায়ের শব্দও যেন মাটিতে চাপা পড়ে যায়। মাঝে মাঝে গাছের গায়ে সে দেখল কিছু আঁচড়ের দাগ, কিছু পুরনো কাপড়ের ছেঁড়া অংশ, আর কিছু জায়গায় যেন কেউ ধূপ জ্বালিয়ে গেছে অনেক আগেই। কাঠের গুঁড়িতে বসে থাকা একটি কালো পাহাড়ি কাক হঠাৎ ডেকে উঠল—তীব্র, কর্কশ এক আওয়াজ।
জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে প্রায় আধ ঘণ্টা চলার পর সে দেখতে পেল সেই জায়গাটা—একটা গোল পাথরের বেদি, তার গায়ে লালচে দাগ, আশেপাশে কদম গাছ, নিচে শুকনো পাতা। সে ক্যামেরা বের করল, ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ পেছনে কিছু একটা খসখস শব্দ শুনল। ঘুরে তাকাতেই কুয়াশার ভেতর কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল—চুল খোলা, সাদা কাপড় পরা একটা ছায়ামূর্তি। সে কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে।
অন্বেষা ভয় পায়নি, বরং ক্যামেরা তাক করল তার দিকে। ঠিক তখনই সেই ছায়া ধীরে ধীরে সরে গেল গাছেদের আড়ালে।
অন্বেষা দৌড়ে গিয়ে দেখতে পেল কিছুই নেই, শুধু পড়ে আছে একটা পুরনো চুড়ি, যার গায়ে কিছু খোদাই করা—ইরা।
সে চুড়িটা হাতে নিয়ে পাথরের বেদির কাছে গিয়ে বসে পড়ল। মাথার মধ্যে অনেক প্রশ্ন—ইরা কে? কীভাবে এই সবকিছু এই গ্রামে লুকিয়ে আছে? মানুষগুলো কেন ফিরে এসে চুপ করে যায়? কীসের জন্য এই সব? তার মনে হলো, এই জঙ্গলের গায়ে সময় থেমে আছে—যেখানে অন্ধকার নিজেই কথা বলে।
ঘড়িতে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অন্বেষা সিদ্ধান্ত নিল, আজই আর নয়। সে এখনই ফিরে যাবে, তারপর আবার আসবে প্রস্তুতি নিয়ে। কিন্তু পেছনে ঘুরতেই সে দেখে, রাস্তা যেটা দিয়ে সে এসেছিল, সেটা নেই। শুধু কুয়াশা আর গাছ।
পায়ের নিচে শুকনো পাতায় চাপা শব্দ, আর কোথাও খুব নিচু গলায় কেউ বলছে—ইরা… ইরা…
পর্ব ৪
অন্বেষা এক মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারছিল না, কীভাবে সবকিছু এত দ্রুত বদলে গেল। সে যখন ঢুকেছিল হিমতেরায়, তখন স্পষ্ট একটা পথ ধরে হাঁটছিল। কিন্তু এখন, বিকেলের দিকে, পেছনে তাকিয়ে দেখে সবদিক সমান—গাছ, কুয়াশা, আর শ্বাসরোধ করা নিস্তব্ধতা। যেন জঙ্গল তাকে গিলে নিয়েছে। পাথরের বেদি যেখানে ছিল, সেটাও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তার মনে হলো, সে যতই দৌড়ায় বা এগোয়, ঘূর্ণির মতো তাকে ঘিরে ঘোরাতে থাকে চারপাশ।
জঙ্গলের গভীর থেকে একটা দীর্ঘ, মৃদু ঘুঘুর ডাক ভেসে এলো। সেই ডাকে ভয় নেই, কিন্তু একরকম বিরক্তিকর স্থিরতা আছে—যা কোনো জায়গাকে জীবন্ত মনে করায় না, বরং মৃত। অন্বেষা তার কম্পাস বার করল, কিন্তু সুই ঘুরতে ঘুরতে থেমে রইল উত্তর-দক্ষিণ ছাড়াও মাঝখানে কোনো এক অদ্ভুত দিকে। মনে হলো, জঙ্গল নিজেই দিশা বদলে দিয়েছে। মোবাইলে সিগন্যাল নেই, জিপিএস কাজ করছে না। এই মুহূর্তে তার মাথায় ঘুরতে লাগল প্রশ্ন—এটাই কি সেই ‘টান’ যার কথা গ্রামে সবাই বলেছিল?
হঠাৎ তার সামনে একটি গাছের নিচে বসে থাকা কাউকে দেখতে পেল। সাদা চাদর জড়ানো, মুখ নিচু, চোখ বন্ধ। প্রথমে মনে হলো এটা হয়তো কোনো সাধু বা পাহাড়ি সন্ন্যাসিনী। কিন্তু কাছে যেতেই সে বুঝতে পারল, এই চেহারায় কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। গায়ের ভাঁজ থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছে—যেন আগুনে পোড়া মোম আর পুরোনো ধূপের মিলিত ধোঁয়া।
“আপনি কি… এখানে থাকেন?” অন্বেষা ধীরে জিজ্ঞেস করল।
সেই নারী চোখ খুললেন। চোখের মণি নেই, শুধু সাদা। কিন্তু চাহনিটা যেন অন্বেষার শরীর ভেদ করে মনে গেঁথে গেল। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠল।
“তুমি এসেছো অবশেষে। এতদিন ধরে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। ইরার নাম নিয়েছ তুমি। এখন সে তোমার মধ্যে ঢুকবে।”
অন্বেষা পেছনে সরে এল। “কে ইরা? আমি তো… শুধু একটা চুড়ি পেয়েছিলাম…”
“চুড়ি নয়, সেটা ছিল তার চিহ্ন। তুমি সেটা তুলে নিয়েছ। এখন তুমি তার বাহক। ডাকিনিরা যাকে চিহ্নিত করে, তার শরীর আর নিজের থাকে না।”
এরপর যা ঘটল, তা যেন একটা ছায়া-নাটক। হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া উঠল। চারপাশে শিস বাজতে লাগল বাতাসে। পাতার শব্দের মধ্যে মিশে গেল মেয়েদের হাসির মতো গলা—তীক্ষ্ণ, কর্কশ, অথচ মাদক। গাছের আড়াল থেকে এক এক করে বেরিয়ে এলো পাঁচটি নারী-মূর্তি—সবাই লাল কাপড় পরে, খোলা চুল, গলায় হাড়ের মালা। তারা ধীরে ধীরে অন্বেষার দিকে এগিয়ে এল।
অন্বেষা পেছাতে চাইল, কিন্তু পায়ের নিচে মাটি নরম হয়ে উঠছিল, যেন দেবে যাচ্ছে। তার চোখে ঝাপসা দেখছিল, বুকের মধ্যে কান ফাটানো শব্দে বেজে চলেছে হৃৎস্পন্দন। একটা অচেনা ভাষার স্তবগান শুনতে পাচ্ছিল সে—বস্তুত শব্দগুলো বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু অর্থ তার শরীর বুঝে নিচ্ছিল। এক ভয়ঙ্কর শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল বুক থেকে কাঁধ পর্যন্ত।
“তুমি আমাদের হয়ে লিখবে,” একজন ডাকিনি বলল, “তুমি আমাদের গল্প লিখবে। যুগের পর যুগ ধরে পুরুষেরা আমাদের ভয় পায়, আমাদের পুড়িয়ে দেয়, আমাদের ডাকে পাপ বলে। এখন সময় এসেছে তাদের ভয়কে ভাষা দেওয়ার। আমরা চাই তুমি বলো—আমরা কে, কেন এসেছিলাম, কী নিয়ে ফিরি…”
অন্বেষা দিশেহারা হয়ে পড়ে গিয়েছিল পাথরের ওপর। তার ব্যাগের ভিতর থেকে ডায়েরি নিজে থেকেই পড়ে গিয়েছিল মাটিতে, খুলে গিয়েছিল মাঝখানের পৃষ্ঠাগুলো। বাতাসে সেগুলো উড়ছিল, আর এক এক করে পৃষ্ঠায় ফুটে উঠছিল আগুনের মতো লেখা—ইরা… ইরা… ইরা…
তারপর, হঠাৎ, অন্ধকার।
অন্বেষা যখন আবার চোখ খুলল, তখন নিজেকে আবিষ্কার করল এক পুরনো কাঠের ঘরের ভেতর। জানালায় হালকা আলো ঢুকছে। মাথায় যেন কেউ চেপে ধরেছিল অনেকক্ষণ। পাশের চেয়ারে বসে জুয়েলা, হাতে পানি। দেখে মুখে একটা অবাক হালকা হাসি।
“আপনি ফিরে এসেছেন। তিন দিন হয়ে গেল।”
“তিন দিন?” অন্বেষার কণ্ঠে কাঁপুনি।
জুয়েলা ধীরে বলল, “হ্যাঁ। আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকজন খোঁজাখুঁজি করেছিল। তারপর একদিন ভোরে আপনি নিজেই ফিরে এলেন, পায়ে হেঁটে, কিন্তু চুপ করে। আমরা কিছু জিজ্ঞেস করিনি।”
অন্বেষা তাকাল জানালার বাইরে। কুয়াশা এখনো ঘোরাফেরা করছে পাহাড়ে। কিন্তু তার মনে হলো, এবার তার চোখের ভেতরেই কুয়াশা জন্মেছে। কিছু একটা এখন বসে আছে তার ভিতরে—ইরার ছায়া, বা তার নিজের ভয়।
সেই রাতে সে ডায়েরি খুলে লিখল—”আমি ওদের দেখেছি। তারা ফিরে এসেছে। এই পাহাড়ের শরীরে ওরা বাস করে। আর আমি এখন শুধু সাংবাদিক নই, আমি এখন তাদের লেখক।”
পর্ব ৫
অন্বেষা এখন বুঝে গেছে, এই কাহিনি কেবল একটি পাহাড়ি গ্রামের অতৃপ্ত আত্মাদের নিয়ে নয়। এটা সেইসব স্তরের গল্প, যেখানে ইতিহাস আর মিথ, বিজ্ঞান আর বিশ্বাস, ভয় আর অধিকার—সব এক জায়গায় এসে মিশে যায়। তিন দিন হিমতেরার জঙ্গলে কাটিয়ে ফিরে আসার পর সে যেভাবে নিজেকে দেখেছে, সেই চেহারা যেন আগে কখনো দেখেনি। তার চোখের নিচে কালি, কথা বলার ধরনে গাম্ভীর্য, আর সবচেয়ে বড় কথা—তার ভিতরে এখন যেন আরেকটা কণ্ঠ বাস করছে।
সেই কণ্ঠ তাকে বারবার বলছে—তুমি ফিরে যাও, লিখে ফেলো আমাদের গল্প, জেনে ফেলো আমাদের অতীত।
তিন দিন পরে সে রওনা দিল দার্জিলিং শহরের দিকে। পাহাড়ের রাস্তা ধরে হিমতেরা থেকে ল্যান্ডলাইন জিপে উঠে সে পৌঁছাল শহরের এক পুরনো অংশে—দার্জিলিং লাইব্রেরির পাশেই এক পরিত্যক্ত টিলা। সেখানে নাকি একজন বৃদ্ধা থাকেন—মোহিনী দেবী। শোনা যায়, তিনি একসময় নেপাল ও উত্তরবঙ্গ জুড়ে ডাকিনিবিদ্যা গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ একদিন সব ছেড়ে দিয়ে একা বসবাস করতে শুরু করেন। তার নাম অনেকেই মুখে আনতে চায় না।
যখন অন্বেষা সেই বাড়িতে পৌঁছাল, তখন বিকেলের আলো যেন টিলার গায়ে বসে ছিল রক্তের মতো। বাড়িটা ছিল কাঠের, দোতলা, জানালায় নীল কাচ। দরজায় শব্দ করতেই একজন বৃদ্ধা ধীরে খুললেন। চোখে মোটা চশমা, সাদা চুল, কিন্তু চাহনিতে এমন এক কৌতূহল, যেন তিনি অনেক আগেই জানতেন অন্বেষা আসবে।
“তুমি হিমতেরা গিয়েছিলে, তাই না?”
অন্বেষা চমকে উঠল, “আপনি জানলেন কীভাবে?”
“ওরা আমায় জানিয়েছে। ইরা জানিয়েছে। এই পাহাড়ের বাতাসে যদি কান পেতে থাকো, সব কথা শুনতে পাও।”
অন্বেষা ভিতরে ঢুকল। বাড়ির ভেতরটা পুরনো কাঠের গন্ধে ভরা, দেওয়ালে নানা পুরনো ছবি—কিছু অদ্ভুত চিত্রলিপি, কিছু মুখহীন নারীর ছায়া। একটা ঘরে মোহিনী তাকে বসালেন, আর সামনে চা এনে বললেন—“তুমি যা দেখেছ, তার ইতিহাস বহু পুরনো। ডাকিনিরা আসলে নারীশক্তির এক প্রবল প্রতিরূপ। সমাজ যখন নারীর মধ্যে দেবী খুঁজতে গিয়ে তাদের আসল স্বরূপকে গলা টিপে ধরে, তখন সেই দমে যাওয়া আত্মারা রূপ নেয় ডাকিিনিতে। এই পাহাড়, বিশেষ করে হিমতেরা, এমন নারীদের আত্মার আশ্রয়স্থল যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, অথচ কখনো বিচার পায়নি। তাদের রক্ত, তাদের কান্না, তাদের ভাষাহীনতা জমে গিয়ে এক অদ্ভুত শক্তি তৈরি করেছে। তুমি এখন তারই বাহক।”
অন্বেষা ধীরে বলল, “তারা চায় আমি লিখি। আমি জানি না কেন। কিন্তু তারা যেন আমাকে দিয়ে কিছু বলাতে চাইছে।”
মোহিনী বললেন, “তুমি একমাত্র পারবে। কারণ তোমার মন আর যুক্তির মাঝখানে একটা ফাঁক আছে। সেই ফাঁক দিয়ে তারা ঢুকে পড়েছে। তোমার ভিতরে এখন শুধু সাংবাদিকতা নেই, আছে অনুভব। তুমি ভয় পাও না, আর ওরাও সেই সাহসীদের পছন্দ করে। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিটি গল্প লেখার সময় তুমি একটু করে বদলে যাবে। সেই বদলই ওদের শক্তি। তুমি যদি শেষ পর্যন্ত লিখে ফেলতে পারো, তাহলে এই ডায়েরি একদিন কেবল সাহিত্য নয়, ইতিহাস হয়ে উঠবে।”
সেই রাতে অন্বেষা হোটেলে ফিরে এসে নিজের ডায়েরির মাঝের পাতায় লিখল—“হিমতেরা কেবল একটি জায়গা নয়, এটা এক দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস। আর সেই নিঃশ্বাস যারা ধরতে পারে, তারাই বোঝে নারীর অভিশপ্ত ইতিহাস কতটা জ্বলন্ত।”
তারপর থেকে সে প্রতি রাতে লিখতে লাগল। তার কলম চলে যেত নিজে থেকেই, যেন হাত চালাচ্ছে অন্য কেউ। এক রাতে সে লেখার মাঝেই বুঝতে পারল, তার লেখা শব্দগুলো অনেক সময় সে নিজেও পড়তে পারছে না—অদ্ভুত এক লিপি, যেটা সে কোনোদিন শেখেনি, কিন্তু হাত নিজে লিখে চলেছে।
পরদিন সকালে হোটেলের দরজার বাইরে পাওয়া গেল একটি প্যাকেট। তার মধ্যে একটি পুরনো চিঠি আর একটি কাঠের খোদাই করা মুখোশ। চিঠির ভাষা নেপালি, কিন্তু তার নিচে ইংরেজিতে ছোট করে লেখা—“Return to where the fire was. You left something behind.”
অন্বেষা বুঝল, হিমতেরার বেদির কাছে সে কিছু রেখে এসেছে। হয়তো নিজেরই এক অংশ। অথবা কিছু যার উত্তর সে জানে না।
সে বুঝল, এই ডায়েরি এখানেই শেষ নয়। বরং শুরু।
পর্ব ৬
দার্জিলিং শহরের ঘন কুয়াশা পেরিয়ে যখন অন্বেষা আবার হিমতেরার পথে রওনা দিল, তখন পাহাড় যেন তার আগমনের অপেক্ষায় জেগে ছিল। সকালের আলো পাহাড়ের গায়ে ধীরে ধীরে ফুঁটে উঠছিল, আর অন্বেষার মনে হচ্ছিল, যতই সে এগোচ্ছে, ততই হাওয়ার শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যেন বাতাস কথা বলছে, পাথর মনে রাখছে সবকিছু, আর গাছেরা ঝুঁকে পড়ছে তার দিকে—“তুমি ফিরেছো, এবার বুঝবে সত্যি কী।”
সে সোজা হাঁটতে লাগল সেই বেদির দিকে, যেখানে প্রথম দেখেছিল সাদা চাদর-পরা সেই নারীমূর্তিকে। এইবার সে আর পথ হারাল না। যেন হিমতেরা নিজে তাকে দিক দেখাচ্ছিল। পথের ধারে শুকনো পাতার ওপর তার পায়ের শব্দ কেমন একঘেয়ে আর অস্বাভাবিক শোনাচ্ছিল।
যখন সে বেদির কাছে পৌঁছাল, তখন সূর্যের আলো আড়মোড়া ভাঙছিল পাহাড়ের চূড়ায়। বেদির ঠিক সামনে সে দেখতে পেল সেই মুখোশটা, যেটা তার কাছে পাঠানো হয়েছিল—কাঠের মুখোশ, যেটার চোয়াল অদ্ভুতভাবে চওড়া আর চোখ ছিল ফাঁপা, যেন এক তীব্র চাহনির প্রতীক। সে মুখোশটা হাতে তুলে নিতেই বাতাস হঠাৎ বদলে গেল। চারপাশে যেন ছায়া ঘনিয়ে এল, আর শীতলতা তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল পায়ের আঙুল পর্যন্ত।
তারপর ধীরে ধীরে সে দেখতে পেল, বেদির চারপাশে মাটি আলগা হয়ে কিছু বেরিয়ে আসছে। চারজন নারী, যাদের মুখ স্পষ্ট নয়, শরীর ধোঁয়ায় ঢাকা, আর চোখ—একদম সাদা। তারা একসাথে বলে উঠল—“তুমি এসেছো সত্য জানার জন্য? তবে শুনো। ইরার গল্প শোনো।”
বাতাস থমকে গেল। আর অন্বেষা যেন ঢুকে পড়ল এক অন্য সময়ে। সামনে একটা দৃশ্য খুলে গেল—একটা পুরনো সময়, হয়তো স্বাধীনতার আগেকার দার্জিলিং। গাছগুলো ছোট, রাস্তাগুলো সরু, আর পাহাড়ে তখনও মানুষের পদচিহ্ন সেভাবে পড়েনি।
এক পাহাড়ি বাড়ির বারান্দায় বসে আছে এক কিশোরী—ইরা। তার গায়ে হালকা লাল চাদর, চোখে কৌতূহল, ঠোঁটে একরকম না বলা বিষণ্ণতা। তাকে ডাকছে তার মাসি, যার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর চোখে পাথরের মতো কঠিন দৃষ্টি।
“তোকে বাঁচতে হলে শিখতে হবে। মেয়েদের জন্য দুনিয়ায় কোনো জায়গা নেই—তারা তৈরি করতে হয় নিজের জায়গা।”
ইরা মাসির সঙ্গে চলে যাচ্ছিল পাহাড়ের এক গোপন গুহায়। সেখানে আগুনের চারপাশে বসে ছিল আরো চারজন নারী, তারা কেউ কথা বলছিল না, কিন্তু সবার মুখে এক অদ্ভুত সংকল্প। সেদিনই ইরা প্রথম জানল ‘ডাকিনি’ শব্দের মানে—নির্যাতিতা নারীর পুঞ্জীভূত প্রতিশোধ।
ইরা শিখেছিল আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে, বাতাসে কথা শুনতে, অন্ধকারে পথ খুঁজে নিতে। কিন্তু সে চেয়েছিল কিছু লিখে রাখতে, কিছু বলে যেতে, যাতে ভবিষ্যতের কেউ যেন এইসব নারীর মুখ না ভুলে যায়। মাসি বাধা দিয়েছিল—“ডাকিনিরা লিখে না, তারা কেবল অনুভব করায়।”
কিন্তু ইরা শুনল না। সে গোপনে একটি ডায়েরি শুরু করল, যেটা সে মাটির নিচে পাথরের এক ফাঁকে লুকিয়ে রাখত। এবং শেষ পর্যন্ত যখন গ্রামের লোক জানতে পারল, হিমতেরার জঙ্গলে কিছু ‘অস্বাভাবিক’ হচ্ছে, তখন ইরাকে পাথর বেঁধে ফেলে দেওয়া হয় জঙ্গলের গভীরে। সেই রাতে আকাশ কালো ছিল, আর পাঁচটি ডাকিনি সেই আগুন ঘিরে শপথ করেছিল—যদি কেউ কখনো ইরার গল্প শোনে, তাকে ফিরিয়ে আনা হবে।
হঠাৎ সব দৃশ্য মিলিয়ে গেল।
অন্বেষা আবার বেদির সামনে, হাতের মুখোশ মাটিতে পড়ে গেছে, আর শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। সে বুঝে গেল, ইরার ডায়েরি এখনো এই জঙ্গলে কোথাও আছে। আর সেই ডায়েরি উদ্ধার করা মানে হবে একটি ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনা।
সে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল বেদির পিছন দিকে। ছোট্ট একটা গুহার মুখ তার নজরে পড়ল। গুহার ভিতরটা অন্ধকার, কিন্তু একেবারে ভিতরে একটা জায়গায় হালকা আলো ঝলমল করছে। অন্বেষা গা ঘেঁষে ভিতরে ঢুকল, হাত বাড়িয়ে তুলে নিল একটা পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা জিনিস—একটি পুরনো, ছেঁড়া চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি।
সে প্রথম পাতা খুলে পড়ল—
“আমার নাম ইরা। আমি জন্মেছিলাম বোবা এক সময়ে, কিন্তু আমি চুপ থাকিনি। এই ডায়েরিতে রয়েছে সেই শব্দ, যেগুলো আগুন খেয়েছিল। যদি তুমি এটা পড়ো, বুঝবে—আমরা কোনোদিন হারাইনি, আমরা অপেক্ষা করছিলাম।”
অন্বেষা কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখের ভিতরে ছিল তীব্র এক দীপ্তি। এখন তার হাতে কেবল ডায়েরি নয়, তার হাতে একটা ইতিহাস, একটা অভিশাপ, একটা উত্তরাধিকার।
পর্ব ৭
অন্বেষা যখন দার্জিলিং শহরে ফিরে এল, হাতে ছিল ইরার ডায়েরি, যেটা প্রাচীন কাগজ আর ছেঁড়া চামড়ার বাঁধাইয়ে মোড়ানো। দেখল, এই ডায়েরি পড়তে হবে, কিন্তু ভাষা একদম অপরিচিত, যেন কেউ অজানা লিপিতে লিখেছে। সে জানত, একাই এই কাজটা করতে পারবে না।
সে তখন সবার কাছে খোঁজ করল—বিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ, এমনকি স্থানীয় লোকজন যারা পুরনো জায়গার কথা জানে। কেউই ঠিক সমাধান দিতে পারল না। কেউ বলল, “ডাকিনিরা লেখা রাখে না, শুধু মনের কথা ঢেকে রাখে।” কেউ বলল, “এই ভাষাটা নেপালি ভাষার পুরনো রূপ হতে পারে, কিন্তু ঠিক নয়।”
শেষ পর্যন্ত, অন্বেষার পরিচিত এক অধ্যাপক, ডক্টর কিরণ মজুমদার, যিনি দার্জিলিংয়ের ঐতিহাসিক ভাষাবিদ, তাকে সাহায্য করার জন্য রাজি হলেন। কিরণ একজন নিবিড় গবেষক, যার সংগ্রহশালা পুরনো লেখার বই আর ম্যানুসক্রিপ্টে ভরা।
তারা একসাথে ডায়েরি খুলে পড়া শুরু করল। প্রথম পৃষ্ঠাগুলোতে ছিল নানান কবিতার মতো ছন্দ, অদ্ভুত সংকেত আর চিহ্ন। এক পর্যায়ে কিরণ বলল, “এটা আসলে একটি সংমিশ্রণ—তাত্ত্বিক ভাষা, যেখানে নেপালি, সানথালি, আর কিছু ক্ষুদ্র উপজাতির ভাষার ছোঁয়া আছে। এটা শুধুমাত্র ডাকিনি সম্প্রদায়েরই বোঝার মতো।”
অন্বেষা অবাক হল, “তাহলে কি এমন একটা গোপন সম্প্রদায় এখনও এই পাহাড়ে আছে?”
ডক্টর কিরণ মাথা নেড়ে বলল, “আছেই। এবং তারা নিজেদের ইতিহাস ধীরে ধীরে লিখেছে। কিন্তু তারা কাউকে বিশ্বাস করে না। তোমার ডায়েরি পাওয়া মানে হয়তো তারা তোমাকে তাদের একজন মনে করছে।”
পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা জানতে পারল, এই ডায়েরিতে বর্ণিত হয়েছে একটি প্রাচীন পাথরের চাবি, যেটা ‘অগ্নি বেদি’র নিচে গোপন ছিল। পাথরটি খুললেই এক অজানা শক্তির প্রবাহ মুক্ত হবে। সেই শক্তি শুধুমাত্র নারীর অধিকার রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, কিন্তু এখনো অনেকের জন্য তা ভয়ঙ্কর।
অন্বেষা অনুভব করল, তার কাছে একটি বড় রহস্যের চাবি এসেছে। কিন্তু সেই রহস্য যেন একেক ধাপে তার সামনে আরও গা ছমছমে প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে।
ডক্টর কিরণ বলল, “এই ডায়েরির শেষ অংশ এখনো অনুবাদ করা হয়নি। সেখানে সম্ভবত সবচেয়ে বড় সঙ্কেত আছে।”
রাত গভীর হলো, তারা একসাথে ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগল। আর প্রতিটি পাতা যেন তাদেরকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সেই অদৃশ্য ইতিহাসের অন্ধকারে।
অন্বেষার মনে হল, এই গল্পের শেষ হবে না যতক্ষণ না সে ‘অগ্নি বেদি’র পাথর খুঁজে পায়, আর সেই শক্তির আসল উদ্দেশ্য জানে।
শহরের আলো আঁধারের মাঝে অন্বেষার চোখে জ্বলে উঠল এক অদ্ভুত আশা—যে এই ডায়েরি শুধু অতীতের বৃত্তান্ত নয়, ভবিষ্যতের এক নতুন যাত্রার সূচনা।
পর্ব ৮
অন্বেষার হাত কাঁপছিল। ডায়েরির শেষ পাতাগুলো ছিল অন্যরকম—ভাষা আরও জটিল, অক্ষরগুলো যেন এক ধরনের গোপন সংকেত, যেগুলো শুধু ডাকিনি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত মানুষেরাই বুঝতে পারত। কিরণ মজুমদার আর অন্বেষা একসঙ্গে সেই অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করল। প্রতিটি শব্দ যেন পাহাড়ের গহীনে চুম্বকের মতো শক্তি ছড়াচ্ছিল।
“এই ‘অগ্নি বেদি’র কথা কি মনে আছে?” কিরণ জিজ্ঞেস করল। “ডায়েরির শেষ অংশে বলা হয়েছে, সেখানে লুকিয়ে আছে এমন এক শক্তি, যা সঠিক হাতে গেলে পৃথিবীর নিয়ম বদলে দিতে পারে।”
অন্বেষার মনে পড়ল মোহিনী দেবীর কথা—‘ডাকিনিরা কেবল অনুভব করায়’। কি অনুভব করানো হয়েছিল? কী সেই শক্তি? আর কার হাতেই তা খারাপ অর্থে পড়তে পারে?
পরের দিনই তারা বেরোল হিমতেরার পথে, ডায়েরির সূত্র ধরে ‘অগ্নি বেদি’র সন্ধানে। পাহাড়ের পথে বৃষ্টি শুরু করল, শীতল বাতাস মুখে লাগল, যেন প্রকৃতিও তাদের সতর্ক করছে। কিন্তু অন্বেষা জানত, এই সন্ধানই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
হিমতেরার জঙ্গল গা ছমছমে, বন্যপ্রাণীর আওয়াজে ভরা। ডায়েরি থেকে পাওয়া সূত্র অনুযায়ী, ‘অগ্নি বেদি’ পাহাড়ের এক গুহার মধ্যে, যেখানে আগুনের আরাধনা হতো শতাব্দী আগে। পথ চলতে চলতে তারা দেখতে পেল মাটি কিছুটা খোঁড়া, পাথরের নিচে চাপা পড়া এক কাঠের বাক্স।
বাক্স খুলতেই যেন সময় থেমে গেল। তার মধ্যে ছিল এক রহস্যময় ছড়ানো দাগের মানচিত্র, যা পাহাড়ের গোপন স্থানের দিক নির্দেশ করছিল। সাথে ছিল একটি অদ্ভুত আকৃতির নীল রঙের ক্রিস্টাল, যা স্পর্শ করতেই ঠাণ্ডা লাগছিল।
“এই ক্রিস্টালটা কি এই শক্তির উৎস?” অন্বেষা ভাবল।
ডায়েরির লেখা অনুযায়ী, এই ক্রিস্টাল ও মানচিত্র একসাথে ‘অগ্নি বেদি’র মূল চাবি। তারা এগিয়ে চলল মানচিত্র অনুসারে। ধীরে ধীরে গাছপালা কমে আসল, পাহাড় যেন আরও কঠিন হয়ে উঠল। এমন এক জায়গায় পৌঁছল, যেখানে চারপাশে শুধু পাথর আর ধোঁয়ার মতো কুয়াশা।
হঠাৎ, আগুনের মতো গরম একটা বাতাস বইতে লাগল। অন্বেষা বুঝল, এটা কোনো সাধারণ জায়গা নয়। সে ক্রিস্টাল হাতে নিয়ে চিন্তা করল, হয়তো এই শক্তি ব্যবহার করে ডাকিনি সম্প্রদায় নিজেদের রক্ষা করত। কিন্তু এখন, সেই শক্তি ভুল হাতে পড়লে বিশাল বিপদ ডেকে আনতে পারে।
তাদের সামনে গুহার মুখ—ঢাকা পড়েছিল বিশাল এক পাথরের ঢাকনা, যার উপর ছিল অদ্ভুত চিহ্ন আর লেখা। অন্বেষা ও কিরণ একসঙ্গে পাথর সরাতে লাগল। প্রচণ্ড চেষ্টা শেষে পাথর সরল, গুহার ভিতরে প্রবেশ করল তারা।
গুহার ভেতরে ছিল এক বিশাল চেম্বার, যার মাঝখানে জ্বলছিল এক ক্ষীণ আগুন, যেন শতাব্দী ধরে নিভে যায়নি। চারদিকে ছিল পুরনো প্রতীক আর নারীর নানা প্রতিকৃতি, যেগুলো থেকে স্পষ্ট ডাকিনি সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও শক্তি প্রতিফলিত হচ্ছিল।
ইরার লেখা অনুযায়ী, এই আগুন হলো ‘জীবনের অগ্নি’, যেটি শুধু প্রকৃত বীর নারীর জন্যই জ্বলে থাকে। যাদের হৃদয় নিঃস্বার্থ, সাহসী আর প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদেরই কাছে এই শক্তি আসে।
অचानक, গুহার দরজা কড়কড় করে বন্ধ হয়ে গেল। বাতাস তীব্র হল, আর গুহার কোণে ধোঁয়ার মাঝে আবির্ভূত হলো চারটি ছায়ামূর্তি—সেই ডাকিনি নারীরা, যাদের চোখে আগুন, আর মুখে ছিল সতর্কবার্তা।
“তুমি এসেছে, অন্বেষা,” তাদের মধ্যে একজন বলল, “তুমি বেছে নিয়েছো ইতিহাসের ভার বহন করতে। এই শক্তি শুধুমাত্র প্রকৃত বীরেরই অধিকার। তুমি কি প্রস্তুত?”
অন্বেষা ধীর কণ্ঠে বলল, “আমি এসেছি সত্যের জন্য, বিচার ও মেয়েদের শক্তির জন্য।”
তাদের মুখে হাসি ফুটল, ধোঁয়া মিশিয়ে তারা ধীরে ধীরে গুহার বাইরে মিলিয়ে গেল।
গুহার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে অন্বেষার মনে হল, সে শুধু এক গুহা বা এক শক্তি আবিষ্কার করেনি, সে আজ এক নতুন যাত্রার শুরু করেছে—যা হবে নারীর ইতিহাসকে পুনর্লিখন, নির্যাতিতাদের ক্ষমতায়ন এবং সমাজের অন্ধকার ভাঙার।
সে জানত, তার কাছে যে ডায়েরি, মানচিত্র আর ক্রিস্টাল, তা নিয়ে তাকে আরও অনেক যুদ্ধ লড়তে হবে। কিন্তু আজ সে শক্ত, কারণ তার হৃদয়ে জ্বলছে ‘অগ্নি বেদি’র আগুন।
দার্জিলিংয়ের কুয়াশা সেই রাতে যেন আরও দীপ্তিময় হয়ে উঠল, আর পাহাড়ে বাতাসে বয়ে গেল এক নতুন আশা—এক নতুন ইতিহাসের শুরু।
শেষ