প্রিয়াঙ্কা শীল
পর্ব ১: লাল আলোয় ধরা
দোতলার ছাদে বসে থাকা বাড়িটায় একসময় মানুষের কোলাহল ছিল, এখন পাখির ডাক ছাড়া কিছু শোনা যায় না। অনুষ্কা জানে এই বাড়িটার প্রতিটি ইট, প্রতিটি জানালার শব্দ—কারণ এখানে তার শৈশব কেটেছে। কিন্তু এবার ফিরে এসেছে অন্য কারণে—দাদু মারা গেছেন। আর দাদুর রেখে যাওয়া সব জিনিস গুছিয়ে দেওয়া এখন তার দায়িত্ব।
দাদুর ঘরটা যেন সময়ের মধ্যে আটকে আছে। ছিটেফোঁটা ধুলো, পুরনো কাঠের ঘ্রাণ, একটা ঘড়ি যা এখনও টিক টিক করে। জানলার পাশে রাখা কাঠের আলমারিতে পুরনো বই, ফ্রেমে বাঁধানো সাদা-কালো ছবি আর মাঝখানে একটা বড় কাঠের বাক্স।
বাক্সটা খুলতেই কেমন একটা ঘর অন্ধকার হয়ে এলো। ভেতরে একটা পুরনো ক্যামেরা—দেখলেই বোঝা যায় এটা কোনও আধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরা নয়। ধাতব বডি, ওপরে চামড়ার মোড়ানো। ফ্ল্যাশের জায়গায় একটা গোল লেন্সের মতো কিছু, কিন্তু সেটা থেকে বেরিয়ে আছে একটা লাল কাঁচের ছোট্ট ডোম।
অনুষ্কা ক্যামেরাটা হাতে তুলে নিতেই পেছনে খসখস শব্দ—দাদুর পুরনো ডায়েরি।
সে ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—
“এই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার আগে ভাবো। যাকে দেখো, সে আর আগের মতো থাকবে না।”
অনুষ্কা হেসে ফেলল।
“দাদু তো বরাবর একটু বেশিই নাটুকে ছিলেন।”
কিন্তু কৌতূহল থামল না। সে নিজেই ক্যামেরাটা তাক করে, একটা রংচটা আয়নার সামনে দাঁড়ায়, আর ক্লিক করে।
লাল আলোটা ঠিক ফ্ল্যাশের মতো নয়—জ্বলে উঠল এক ঝলক, তারপর নিভে গেল।
কোনও আওয়াজ নেই, শুধু একটা গন্ধ—চুল পোড়ার মতো। আয়নায় নিজের মুখটা কেমন যেন অচেনা লাগল। চোখের দিকে তাকিয়ে সে কেঁপে উঠল—নিজের চেনা চোখের মধ্যে কিছু অচেনা।
সন্ধ্যায় খাওয়া শেষ করে বারান্দায় বসে অনুষ্কা একবার নিজের ছবি দেখে মোবাইলে—কিছু অস্বাভাবিক তো নয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেমন অস্বস্তি। আগের সেই হালকা নার্ভাস মেয়েটা যেন কোথায় চলে গেছে। সে আজ হঠাৎ গৃহকর্ত্রীর মতো কাজের মাসির ভুলগুলো ঠিক করে দিয়েছে গম্ভীর গলায়। এমনিতে সে এসব বলে না কখনও।
রাতের বেলা ঘুমানোর আগে আবার ডায়েরি খুলে পড়ে অনুষ্কা।
“একেকটা ছবি একেকটা সত্যি খুলে দেয়। কেউ নতুন হয়ে ওঠে, কেউ ফাঁস হয়ে যায়। ক্যামেরা কোনও পক্ষ নেয় না—সে শুধু সত্যি চেনে।”
অনুষ্কা উঠে দাঁড়ায়, আয়নার সামনে যায়। আজ তার চোখে একটা দৃঢ়তা—যেটা সে আগে দেখেনি। তার মাথায় ঘোরে একটা প্রশ্ন—
সে কি সত্যিই বদলে যাচ্ছে? নাকি এই ক্যামেরা কিছু খুলে দিচ্ছে, যেটা চিরকাল চাপা ছিল?
কিছু একটা শুরু হয়েছে, সেটা বোঝে অনুষ্কা। কিন্তু শেষ কোথায়, তা এখনও আঁধারে ঢাকা।
পর্ব ২: আয়নায় অন্য আমি
সকালবেলা বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে অনুষ্কা তাকিয়ে ছিল সামনের শিউলি গাছটার দিকে। গাছটা দুলছে না, অথচ পাতার ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ আলো-ছায়া লেগে যাচ্ছে। রাতের ঘটনাটা তার মাথা থেকে যাচ্ছিল না।
সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আগেও তো এই আয়নাতেই নিজেকে দেখেছে। কিন্তু আজ তার চোখদুটো একেবারে অন্যরকম লাগে—চোখে এক ধরনের স্থিরতা, একরকম গোপন আত্মবিশ্বাস।
তার মা নিচে থেকে ডাকলেন, “অনু, একটু বাজারে যাবে? আমাদের দুধ শেষ হয়ে গেছে।”
অনুষ্কা একটু দ্বিধায় পড়ল। এই গ্রামে বাজার মানে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটে যাওয়া, গ্রামের লোকের ভিড়, অজানা মুখ। ছোটবেলায় ওর এই ভিড়, প্রশ্ন, তাকিয়ে থাকা ভালো লাগত না। কিন্তু আজ যেন কাঁধে এক নতুন শক্তি—সে বলল, “হ্যাঁ মা, যাচ্ছি।”
বাজারের পথে হাঁটতে হাঁটতে সে টের পায়, গ্রামের লোক তাকে চিনতে পারছে না ঠিকভাবে। এক বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি নতুন এসেছো?”
অনুষ্কা অবাক হয়ে বলল, “আমি অনুষ্কা, গোবিন্দ কাকার নাতনি। মনে নেই?”
বৃদ্ধা একটু চমকে উঠে বলল, “আরে! মুখ তো চেনা লাগছে…কিন্তু…কী যেন… বদলে গেছো।”
এই ‘বদলে গেছো’ কথাটাই যেন আজ সব কিছু জড়িয়ে আছে।
দুধ কিনে ফেরার পথে, একটা ছোট ছেলেকে দেখে সে হঠাৎ থেমে যায়। ছেলেটা রাস্তার পাশে পাটপাতা কুড়াচ্ছে, তার গায়ে ছেঁড়া জামা। আগেও এমন দৃশ্য দেখেছে অনুষ্কা, কিন্তু আজ তার ভিতরে অদ্ভুত এক দোলা লাগে। সে ব্যাগ থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বার করে ছেলেটিকে দেয়। তার নিজের হাত কাঁপছে না, গলার স্বর সোজা—একটা স্বাভাবিক সহানুভূতি।
বাসায় ফিরে দাদুর ঘরে ঢোকে সে আবার। ক্যামেরাটা যেখানে রেখেছিল, সেটা এখনও ঠিক জায়গাতেই আছে। পাশে পড়ে থাকা ডায়েরির দ্বিতীয় পাতাটা খোলে সে।
“ছবি যখন তোলো, ক্যামেরা শুধু বাহ্যিক চেহারা ধরে না—ভেতরের ছায়াটাও খুলে ফেলে। সেই ছায়া তোমার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাই সাবধান। ক্যামেরা কেবল মুহূর্ত ধরে রাখে না, মানুষটাকেই গড়ে তোলে।”
অনুষ্কা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, তার বদলটা সে নিজেই চায়নি—তবু হচ্ছে। তবে এটাও বোঝে, এই বদল ভয়ংকর নয়। বরং একধরনের মুক্তির মতো।
রাতের দিকে, সে তার ছোটবেলার একটা পুরনো ছবি খুঁজে পায়। ছবিটা দাদু তুলেছিলেন—ছোট অনুষ্কা, চোখে ভয়, ঠোঁটে একটা কাঁচা হাসি। পাশে সেই দাদু, গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন।
অনুষ্কা এবার নিজের নতুন ছবি তোলার কথা ভাবে। আবার সেই ক্যামেরা তুলে নেয় হাতে। আঙুলে ক্লিক করার সময় বুকের মধ্যে হালকা ধুকপুকানি, কিন্তু ভয় নয়।
লাল আলো আবার জ্বলে ওঠে। এবার সে চোখ বন্ধ করেনি। পুরোটা দেখেছে। নিজের চোখে।
ঘরের মধ্যে লাল আলোর প্রতিফলন হয় আয়নায়, দেওয়ালে, তার চোখে।
ক্লিকের পরে একটা শব্দ হয়—জানলার বাইরের গাছের ডালে একটা পাখি হঠাৎ উড়ে যায়।
সে আয়নায় নিজের দিকে তাকায়। এবার আর অচেনা লাগেনি। বরং মনে হচ্ছে—এই মেয়েটা অনেক আগে থেকেই ছিল। শুধু ধরা দেয়নি।
পর্ব ৩: ছবির মানুষেরা
পরদিন সকালে, ঘর গুছাতে গিয়ে অনুষ্কা একটি প্রাচীন অ্যালবাম খুঁজে পায়—চামড়ার মোড়া, পাতলা পাতায় আঁকা নাম, তার নিচে তারিখ। বেশির ভাগ ছবিতেই গ্রামের লোকজন—চেনা মুখ, অচেনা চাহনি। কেউ বসে আছে খাটের কোণে, কেউ রাস্তায় হাটছে, কেউবা দাঁড়িয়ে ঝোলানো কাপড়ের পাশে।
প্রথম ছবিটার নিচে লেখা—“মাধবী, ১৯৭২। ছবি তোলার একদিন পরেই সে তার স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়। কেউ জানে না কেন।”
অনুষ্কার হাতের তালুতে হঠাৎ ঘাম জমে ওঠে। সে ডায়েরির সেই পাতাগুলো মনে করার চেষ্টা করে যেখানে দাদু বলেছিলেন, “ছবি শুধু মুখ ধরে না, মনের ছায়াও নিয়ে ফেলে।”
সে ঠিক করে ক্যামেরাটা আরেকবার ব্যবহার করবে—এইবার নিজে নয়, কারো ওপর। পরীক্ষা।
তার প্রথম ‘বিষয়’ হয় মায়ের পুরনো বান্ধবী কল্যাণী কাকিমা—যিনি চিরকাল একরকম, রীতিবদ্ধ, সব কিছুতে মতামত দেওয়া অভ্যেস। তিনি এসেছেন পুজোর চাঁদার খাতা নিয়ে। অনুষ্কা তাকে হাসিমুখে বসতে বলে। ক্যামেরা বার করে বলে,
“একটা ছবি তুলব, কাকিমা। দাদুর ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছি।”
কল্যাণী কাকিমা হেসে বললেন, “হায় হায়, এখনো চলে এই ক্যামেরা? আমাকে বুড়ি দেখাবে না তো?”
ক্লিক।
লাল আলো।
দু’সপ্তাহ পর, কল্যাণী কাকিমাকে দেখা গেল, রঙিন শাড়ি পরে নিজের হাতে তৈরি করা পটচিত্র বিক্রি করছেন মেলার স্টলে। তিনি বলছেন, “কতদিন ধরে ভাবছিলাম এসব করব, কিন্তু সাহস পাইনি। এখন মনে হচ্ছে আর বাকি জীবন না বাঁচলে চলবে না।”
অনুষ্কা স্তব্ধ। সে বুঝতে পারে—ছবিটা তাকে পাল্টে দিয়েছে। ভালোর দিকে।
এরপর সে আরেকটি ছবি তোলে—সুভাষদা, একজন দাম্ভিক, স্বার্থপর প্রাক্তন নেতা, যার গলা বরাবর উঁচু, চোখে অবহেলা। ক্লিক।
তিনদিন পর, সুভাষদার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়। বেঁচে যান ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ বদলে যান। তিনি এখন চুপচাপ মন্দিরে বসে শিশুদের পড়ান। অনুষ্কা তার মা’র মুখে শুনে চমকে যায়, “তুমি বিশ্বাস করবে না অনু, উনি নিজে এসে ক্ষমা চাইলেন! এমন বদল তো অলৌকিক!”
অনুষ্কা বুঝতে পারে—এই ক্যামেরা যাকে স্পর্শ করে, তাকে পাল্টায়। তবে সেটাও আগেই ঠিক করা যায় না—কে ভালো হবে, কে ধ্বংস হবে।
তবে সবার বদল একইরকম নয়। অনুষ্কা একদিন গলির এক নেশাগ্রস্ত ছেলেকে দেখে, যার নাম বাবলু। সে বলেছিল, “দিদি, আমার একটা ছবি তুলে দেবে?”
অনুষ্কা একবার দ্বিধায় পড়লেও ক্যামেরাটা তোলে।
লাল আলো।
সেই রাতে বাবলুকে পাওয়া গেল পুকুরের ধারে—সে নিজের ছায়াকে দেখে ভয় পাচ্ছিল। “ছবি তোলার পর থেকে কেমন সব অন্ধকার লাগে… আমি কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারি না…” সে বলছিল।
এইবার অনুষ্কার মন কেঁপে উঠল। সে কি কারও জীবন নষ্ট করে ফেলছে? না কি সত্যিটা চোখে আনছে?
তার মাথায় ঘুরতে থাকে একটি প্রশ্ন—এই ক্যামেরা দাদু কীভাবে পেয়েছিলেন? তিনি কেন এই ছবি তুলতেন? এবং… শেষ ছবিটা কি কখনো তোলা হয়েছিল দাদুর নিজের?
সেই উত্তর বোধহয় আছে ডায়েরির শেষ পাতায়… যেটা এখনও সে খুলে দেখেনি।
পর্ব ৪: ক্যামেরার বিচার
অনুষ্কার মনে এক ধরনের দ্বন্দ্ব জন্ম নিচ্ছে—সে যা করছে, তা কি ন্যায়ের কাজ? না কি একরকম ঈশ্বরের খেলা? কেউ মুক্তি পাচ্ছে, কেউ ভয়াবহ ছায়ার দিকে এগোচ্ছে। ক্যামেরা কি বিচার করছে? নাকি শুধু সত্যিটা দেখিয়ে দিচ্ছে?
এই প্রশ্নটা আরও তীব্র হয়ে উঠল সেদিন, যখন সে ক্যামেরা হাতে বেরিয়েছিল গ্রামের শেষপ্রান্তের একটা পুরনো ঘরের দিকে। সেখানে থাকে হরিপদ—এক বৃদ্ধ, কেউ বলে পাগল, কেউ বলে ভবঘুরে, কেউ বলে জ্যোতিষী।
অদ্ভুত চোখদুটো—যেন সব জেনে গেছে, সব ভুলে গেছে।
অনুষ্কা তাকে ছবি তোলার কথা বলতেই হরিপদ হাসলেন—একটা শান্ত, স্থির হাসি।
“তোলো মা,” বললেন তিনি, “কিন্তু আমি তো আর বদলানোর কিছু রাখিনি।”
ক্লিক।
লাল আলো।
পরদিন ভোরে হরিপদ মারা যান—একদম ঘুমের মধ্যে, মুখে সেই একই শান্তির হাসি।
গাঁয়ের লোক বলল, “ভাগ্যিস, কষ্ট ছাড়াই চলে গেলেন।”
কিন্তু কেউ জানে না—এই শান্তির পেছনে ছিল এক ঝলক লাল আলো।
অনুষ্কা ডায়েরির আরও কিছু পৃষ্ঠা পড়ে।
এক জায়গায় লেখা—
“যার যা প্রাপ্য, ক্যামেরা তা-ই তুলে আনে। কেউ ত্যাগ করে শান্তি পায়, কেউ জিতেও হেরে যায়। এই বিচার মানুষের নয়, আলোর।”
এরপর সে আবার ক্যামেরা তোলে—এইবারের ছবি একদম ভিন্ন ধরনের। নিজের এক দূরসম্পর্কের কাকা—সুনীল, একসময় বাবার ব্যবসা থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। সেই ব্যাপারে বাড়িতে কেউ মুখ খোলে না, শুধু ফিসফিসানি।
অনুষ্কা সোজা গিয়ে বলল,
“একটা ছবি তুলব কাকু, নতুন ক্যামেরা দিয়ে। দাদুর স্মৃতিচারণ করছি।”
সুনীল একটু ঘাবড়ে গেলেও রাজি হয়ে গেল। ছবি তোলার পরই অনুষ্কা বুঝল—এই ঝলকে অন্য কিছু আছে। ক্যামেরা ক্লিক করার সময় ঘরটা যেন হালকা কেঁপে উঠেছিল।
পরদিন থেকেই কাকু বদলে যেতে থাকেন—অকারণে চিৎকার, নিঃসঙ্গতা, শেষে একদিন সমস্ত আত্মসাৎ করা টাকার হিসেব হাতে নিয়ে বাবার সামনে হাজির।
“আমি জানি না কী হয়ে গেল… কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না,” কাকু বললেন কাঁদতে কাঁদতে।
বাবা স্তম্ভিত, মা হতবাক। অনুষ্কা জানে—এটা ক্যামেরার বিচার।
কিন্তু তখনই তার মনে হয়—জাজমেন্ট কি সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত হয়? নাকি কখনো কখনো অত্যাচার? যদি কেউ শুধু ভুল করেও ফেলেছে—তাকে কি এমন বিচার দেওয়া উচিত?
এই দ্বিধা আরও বাড়ে যখন সে খুঁজে পায় সেই অ্যালবামের একটা পাতা—সেখানে আছে তার ঠাকুমার ছবি। নিচে লেখা—
“তুলেছিলাম, কারণ একমাত্র উনিই জানতেন আমার সত্যি… কিন্তু ছবি তোলার পর সে আর আমায় চিনতেই পারেনি।”
অর্থাৎ? দাদু নিজেই একবার ঠাকুমার ছবি তুলেছিলেন? আর তার পরিণামে…?
অনুষ্কা এবার থমকে যায়।
যদি এই ক্যামেরা কেবল মানুষ বদলায় না, সম্পর্কও ভেঙে দেয়?
সে জানে, এখন একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসছে। ক্যামেরা হাতে রেখে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, চুপচাপ নিজের চোখে চোখ রাখে।
ক্যামেরা যেন তাকিয়েই আছে—আরো এক ছবির অপেক্ষায়।
পর্ব ৫: দাদুর গোপন স্টুডিও
দাদুর ঘরের ঠিক পিছনে একটা ছোট্ট কাঠের দরজা আছে, যেটা সবসময় বন্ধ থাকত। ছোটবেলায় একবার সেই দরজার কাছে গিয়েছিল অনুষ্কা—তখন দাদু বলেছিলেন, “ওটা অন্ধকার ঘর, ঢোকা বারণ।” এরপর আর কখনো সে যায়নি।
কিন্তু এখন, সবকিছু বদলে গেছে। হাতে সেই ক্যামেরা, মাথায় অনেক প্রশ্ন, আর হৃদয়ে কেমন একটা টান।
চাবিটা খুঁজে বের করে সে দরজার কাছে দাঁড়ায়। খুলতেই ধুলোর একটা স্রোত যেন নাকে এসে লাগে। একটা গন্ধ—পুরনো কাগজ, পুরনো অ্যালকোহল আর কাঁচের ভাঙা রিমের মতো তীব্র কিছু।
ঘরের ভিতরটা ছোট, কিন্তু দেওয়ালজুড়ে সারি সারি তাক। তাতে অসংখ্য নেগেটিভ, ফ্রেমবন্দি ছবি, আর নিচে কিছু নাম-লেখা বাক্স—“রোহিনী (১৯৮০)”, “মুকুন্দ (১৯৮৭)”, “সতীশ (১৯৯২)”—এই নামগুলো সবই গ্রামের মানুষ, কেউ হয়তো আর বেঁচে নেই, কেউ হারিয়ে গেছে কোথাও।
একটা বাক্স খুলে দেখে অনুষ্কা—একটা নোট, দাদুর হাতের লেখা:
“ছবিটা তুললাম ১৯৮৭-তে। মুকুন্দ তখন সদ্য খুন করে এসেছিল। তার চোখে আমি একটা রক্তিম ছায়া দেখেছিলাম। ক্যামেরা শুধু সেই ছায়াটাকে স্থায়ী করে দিয়েছিল। পরে লোকটা নিজেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তার আগেও সে ঘুমোতে পারত না।”
অনুষ্কার হাত ঠান্ডা হয়ে আসে।
ক্যামেরাটা শুধুই ম্যাজিক নয়, যেন কোনো এক নৈতিক চাবি—যে মানুষটাকে তার সত্য রূপে টেনে আনে।
সে আরও একটা বাক্স খোলে—“গায়ত্রী (১৯৯৯)”
ছবিটা একটা মেয়ের—চোখে জল, মুখে অভিমান।
নোটে লেখা—
“সে বলেছিল, সে বাবার ছায়ার নিচে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ছবিটা তোলার পর সে শহরে পালিয়ে যায়, নিজের দোকান খোলে। আজ তার নাম শুনি—‘গায়ত্রী বুটিক’। হয়তো ক্যামেরাই তাকে সাহস দিয়েছিল।”
এই ঘরটা দাদুর জীবনের গোপন স্টুডিও ছিল—কেবল ছবি নয়, পরিণতি সংরক্ষণের ঘর।
ঘরের কোণে একটা ডাস্ট কভার দিয়ে ঢাকা আয়না ছিল। অনুষ্কা কভারটা সরাতেই একটা লাল ফিতা বাঁধা প্যাকেট পড়ে গেল।
ভেতরে একটা পুরনো চিঠি—
“অনুষ্কা, যদি তুই এই চিঠি পড়িস, তাহলে বুঝে নিস—তোর ভিতরেও এই ক্যামেরার ডাকে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু খেয়াল রাখিস, এই ক্ষমতা ভারী। সবকে পাল্টে দেওয়া যায় না—কখনও শুধু দেখা আর বোঝার মাঝেই থেমে যেতে হয়। ক্যামেরা দিয়ে যা ধরা পড়ে, তা চিরস্থায়ী। তাই ব্যবহার করার আগে ভাবিস—ভীষণভাবে।”
– দাদু
চিঠিটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে অনুষ্কা। নিজের প্রতিচ্ছবি আজ যেন এক নতুন ভিন্ন মানুষ।
সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে—এই ক্যামেরা সে আর খেলনার মতো ব্যবহার করবে না। এই আলোর সামনে সে শুধু সত্যই আনবে, প্রতিশোধ নয়। বদল নয়, হয়তো মুক্তি।
তখনই ক্যামেরার লেন্স হালকা ঝকঝকে হয়ে ওঠে—যেন বুঝতে পারল অনুষ্কা কী ঠিক করল।
পর্ব ৬: রূপকথার ফাঁদে
একদিন দুপুরবেলা। চারপাশে গরমে ঝিম ধরা ঘর। অনুষ্কা একা বসে আছে বারান্দার কাঠের দোলনায়, দাদুর চিঠিটা পাশে রাখা, ক্যামেরাটা সামনে রাখা চায়ের টেবিলে। পাখার আওয়াজে মাঝে মাঝে ফাঁকা ঘরে একরকম রহস্যময় ছন্দ তৈরি হচ্ছে।
হঠাৎ ফোন আসে, পুরনো বন্ধু ঋষভের।
“অনু, আমি গ্রামে এসেছি, শুনলাম তুইও ফিরেছিস। দেখা হবে?”
অনুষ্কা একটু থমকে যায়। ঋষভ, তার স্কুলজীবনের একমাত্র বন্ধু, যে হঠাৎ একদিন শহরে চলে গিয়েছিল। আর কখনো দেখা হয়নি। ওর চলে যাওয়ার মধ্যে যে আঘাত ছিল, সেটা অনুষ্কা সেসময় বুঝে উঠতে পারেনি—শুধু ভেবেছিল, ঋষভের মতো বন্ধুরা কি সত্যি হারিয়ে যায়?
তবু সে বলে, “আয়। দাদুর বাড়িতে আছি।”
বিকেলে আসে ঋষভ। ছেলেটা অনেক বদলে গেছে। মুখে দাড়ি, চোখে রোদচশমা, কিন্তু হাসিটা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। সঙ্গে এনেছে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স—ভেতরে কিছু পুরনো পোস্টকার্ড, যেগুলো তারা একসময় নিজেদের বানিয়েছিল।
“তুই এখনও ছবি আঁকিস?” অনুষ্কা জিজ্ঞেস করে।
ঋষভ হেসে বলে, “না, এখন শুধু বাস্তবতা আঁকি—ক্যামেরায়, কিন্তু ডিজিটাল।”
“আমি দাদুর ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছি,” বলে অনুষ্কা। “চাইলে তোর একটা ছবি তুলি?”
ঋষভ রাজি হয়ে যায়। ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ায় কাঠের দরজার সামনে, যেখান থেকে হালকা রোদ আসছে।
ক্লিক। লাল আলো।
কিন্তু এইবার ঝলকটা অন্যরকম।
অনুষ্কা চোখ বন্ধ করেনি। ক্যামেরার ভেতর থেকে একটা শব্দ আসে—ধ্বংস হয়ে যাওয়া কাচের মতো।
ঋষভ চুপ করে যায়। তারপর হঠাৎ বলে,
“অনু, জানিস, আমি তোকে সেইদিন বলতেই পারিনি… আমি আসলে… তোকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম। তোকে হারিয়ে ফেলব ভেবে। তাই চলে গিয়েছিলাম।”
অনুষ্কা থমকে যায়। এই স্বীকারোক্তি যেন হাওয়ায় ভেসে আসে।
“এতদিন পর?”
“না, আসলে এতদিন ধরা দিতেই পারিনি—নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না। আজ তোর ছবি তোলার সময়, হঠাৎ সব খুলে গেল। যেন সেই আলোয় আমি নিজের ছায়াটাকে দেখতে পেলাম।”
অনুষ্কা বোঝে—এই ক্যামেরা শুধু সত্যি তুলে আনে না, মানুষকে নিজের অজানা অধ্যায়গুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
ঋষভ বিদায় নেয়। সে যায়, কিন্তু একটা চিঠি রেখে যায় অনুষ্কার জন্য—তিন পাতার, দীর্ঘ স্বীকারোক্তি। ভালোবাসা, ভুল, ভয়, পালিয়ে যাওয়া—সব।
রাতে অনুষ্কা একা ঘরে বসে ডায়েরির পাশে সেই চিঠি রাখে। তারপর আবার একবার তাকায় সেই পুরোনো ক্যামেরার লাল কাঁচটার দিকে।
এই যন্ত্রটা কি আসলে একধরনের রূপকথার ফাঁদ? যেখানে সবাই নিজের চেহারা নয়, নিজের অন্ধকার দেখে ফেলে?
তবু সে জানে—এমন ফাঁদে পা দিয়ে পড়লে তবেই না সত্যিকারের মুক্তি সম্ভব।
পর্ব ৭: শেষ ছবি
রাতে ঘুম আসে না অনুষ্কার। খাটের পাশের টেবিলে রাখা দাদুর ডায়েরিটা যেন চোখে চোখে রেখেছে তাকে। মাথার ভিতরে ঘুরপাক খায় কয়েকটা দৃশ্য—হরিপদর শান্ত মুখ, সুনীল কাকার অনুশোচনা, ঋষভের স্বীকারোক্তি… আর ক্যামেরার সেই লাল আলো।
ডায়েরির শেষ পাতায় এখনও পৌঁছায়নি সে। দাদু যেন জেনে রেখেছিলেন, এই পাতাটায় পৌঁছাতে সময় লাগবে।
অনুষ্কা ধীরে ধীরে পাতাগুলো উল্টায়। শেষ পৃষ্ঠায় বড় অক্ষরে লেখা:
“শেষ ছবিটা তুই তুলবি। নিজের। কারণ ক্যামেরা কখনও তার বাহকের বিচার না করে থাকতে পারে না। সাহস থাকলে তুলিস—তুই কি নিজেকে মেনে নিতে পারিস?”
তার বুক ধকধক করতে থাকে। নিজের ছবি? মানে নিজের রূপান্তর?
তবু সে জানে—এই পথের শেষ মোড় এখানেই।
সে ক্যামেরা তোলে। আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আজ আর কাঁপুনি নেই, শুধু নিঃশ্বাস ভারী।
ক্লিক।
লাল আলো।
আলোটা আজ অন্যরকম। নিঃশব্দে ঘরটাকে এক ধরণের অদৃশ্য আলোয় ভরে দেয়। আয়নায় অনুষ্কা দেখতে পায় নিজের মুখ—কিন্তু যেন ভিতরে ভিতরে আরও একজন। সেই ছোট্ট অনুষ্কা, ভয় পাওয়া, চুপ করে থাকা, দাদুর পেছনে লুকিয়ে থাকা… আর আজকের সে—নিজের হাতে জীবন বদলে দেওয়া এক কন্যা।
আলো নিভে যায়।
কিন্তু কিছু রয়ে যায়—একটা অনুভব। নিজেকে বুঝে ফেলার, নিজের চোখে চেয়ে মেনে নেওয়ার শক্তি।
তার মনে পড়ে যায় দাদুর সেই কথা—“যদি চোখে চোখ রেখে নিজেকে দেখতে পারিস, তাহলে তুই তৈরি।”
সকালবেলা মা এসে দেখে, অনুষ্কা স্টুডিও ঘরের দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে। বাইরে বড় করে একটা কাগজ সাঁটানো—“এই ঘরটা এখন ঘুমোচ্ছে। খুব দরকার না হলে জাগিও না।”
অনুষ্কা জানে, ক্যামেরা তার কাজ শেষ করেছে। এখন ওটা শুধু স্মৃতি।
সে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ক্যামেরা আর ডায়েরি রাখে সেই বাক্সে, লাল কাপড়ে মুড়ে।
তবু মাঝে মাঝে, একলা দুপুরে, তার মনে পড়ে যায় সেই লাল আলোর ঝলক।
কারণ একবার যে নিজেকে দেখে ফেলে, সে আর আগের মানুষ থাকে না।
পর্ব ৮: লাল আলো নিভে গেলে
একটা নিস্তব্ধ দুপুর। চারপাশে শুধু জোনাকি রোদের গন্ধ। অনুষ্কা বসে আছে দাদুর বারান্দায়, দোলনার হালকা দুলুনিতে পা ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঝের ঠান্ডা, ধুলোতোলা টালি। স্টুডিও ঘরের দরজাটা এখন বন্ধ, তালা পরানো, দরজার বাইরে ধুলোপড়া সাদা কাগজে দাদুর মতো হাতের লেখা:
“এই ঘর ঘুমোচ্ছে।”
সেই ক্যামেরা, সেই লাল আলো, সেই বদলে দেওয়া মুহূর্তগুলো—সব এখন অতীত, অথচ এখনও যেন নিঃশ্বাসের মধ্যে রয়ে গেছে।
গ্রামের লোকেরা আস্তে আস্তে জানতে পেরেছে কিছু। কেউ বলে “বদল হয়েছে অনুষ্কার,” কেউ ফিসফিসিয়ে বলে, “ও নাকি ছবি তুলে মানুষ পাল্টে দেয়!”
কিন্তু অনুষ্কা আর কোনও ছবি তোলে না।
সে জানে, বিচার করা ক্যামেরার কাজ হতে পারে—তবু প্রতিটি মানুষের ভিতরেই সত্য ও মিথ্যার সহবাস থাকে। কখনো কখনো মানুষকে পাল্টাতে হয় নিজের ভেতর থেকেই—not through any red light, but through facing the darkness quietly.
একদিন সন্ধ্যায়, ছোট্ট এক মেয়ে এল—নতুন প্রতিবেশী। তার হাতে একটা সাদা কাগজ। আঁকা একটা ফুলের ছবি, তার নিচে কাঁচা হাতে লেখা:
“তোমার জন্য। তুমি কি ম্যাজিক জানো?”
অনুষ্কা হেসে বলল, “আমি একটা সময় জানতাম। এখন শুধু গল্প বলি।”
মেয়েটি বলল, “তুমি আমাকে একটা ছবি তুলবে? আমার নতুন জামার?”
অনুষ্কা তাকাল তার দিকে। তারপর ঘাড় নাড়ল—“চলো, মোবাইলে তুলব। এই ক্যামেরাটা এখন ঘুমোয়।”
অনুষ্কা মোবাইলে একটা হাসিমুখের ছবি তোলে, সাধারণ আলোয়। আর সেই ছবিতেও থাকে গল্প, কিন্তু কোনও রূপান্তরের শাস্তি নেই—শুধু স্মৃতি।
রাতে অনুষ্কা আবার খোলে দাদুর চিঠিটা। চোখ বুজে বলে,
“আমি বুঝেছি, দাদু। আলোটা বাইরের নয়। সেটা আমাদের ভেতরে ছিল—আর থাকবে। তুমিই শিখিয়েছিলে দেখতে।”
চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে স্টুডিওর দরজার গায়ে। বাতাসে হালকা গন্ধ—পুরনো কাগজ, পুরনো কাঠ, আর এক ফোঁটা নিঃশব্দ লাল আলো।
আর ক্যামেরাটা?
ওটা বাক্সে ঘুমোয়। তবু হয়তো, কোনও একদিন, কোনও এক অনুষ্কা আবার সেটা জাগাবে।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত…
লাল আলো নিভে গেছে।
আর সত্যিটা তার ছায়া রেখে গেছে—একজন মানুষের ভিতরে।
সমাপ্ত