অপর্ণা দে বিশ্বাস
১
পৌষের হিমেল হাওয়া বইছে। ছোট শহরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে শিউলিদের সিঁড়িওলা দোতলা বাড়ি। বারান্দার গ্রিলে শুকোতে দেওয়া উলের সোয়েটার, গামছা, চাদর—সবকিছুই মায়ের যত্নে সারি করে লটকানো। ঘরের ভেতর দিয়ে একমুখী রোদ এসে পড়েছে মেঝের গায়ে, সেই রোদের উপর খেলা করছে ধুলোবালি, যেন সোনার কণা। শিউলি সবে সাত বছর পেরিয়েছে, চুলদুটো বেণী করে বাঁধা, কপালে ছোট্ট টিপ। ওর চোখে-মুখে শিশিরের মতো জড়াজড়ি করা কৌতূহল।
সকালবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যায় শিউলি। বাবা একজন স্কুলশিক্ষক, নাম নারায়ণ সরকার। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মাস্টারি করেন। সাদামাটা মানুষ, পড়াশোনা আর নীতিনিষ্ঠার বাইরে ওনার জীবনে খুব বেশি কিছু নেই। মাকে নিয়ে যত্ন আর ভালোবাসার ঘর। শিউলির মা, সুলেখা সরকার, গৃহবধূ। সাদা থান পরে, সিঁথিতে সিঁদুরের রেখা আর হাতে শাঁখা-পলা—মায়ের মধ্যে যেন একরাশ শান্তি লেগে থাকে।
তবে শান্তির আড়ালে কেমন যেন এক চাপা ভয় মায়ের মুখে প্রায়ই দেখা যায়। বিশেষ করে দুপুরবেলা, বাবা অফিসে গেলে মা হঠাৎ জানলার পর্দা টেনে দেয়, দরজার ছিটকিনি এঁটে দেয়—কেন যেন এক অজানা আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকেন। শিউলি তখনো সেসব বুঝত না, ভাবত, হয়তো বাঘ-ভালুক আসবে—তাই মা দরজা বন্ধ করে রাখছে!
বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরেই শিউলি দৌড়ে ছুটে যেত উঠোনে। আমগাছের নিচে একটা বড় দড়ির দোলনা বাঁধা ছিল, সেটাতে দোল খেতে খেতে আকাশের মেঘের ভেলা গোনার কাজ ওর সবচেয়ে প্রিয়। বেলগাছ, পেয়ারাগাছ, শিউলিগাছ—সব মিলিয়ে উঠোনটা যেন এক রঙিন বাগান। মা সকালে ভাত রান্না করতে করতে ওই গাছগুলোতে জল দিতেন, গাছগুলোও যেন ওদের পরিবারেরই কেউ।
একদিন, শিউলি দোলনায় বসে দুলছে—হঠাৎ তার মনে হলো, দোলনাটা যেন হাওয়ায় ভাসছে, পাখির মতো। হালকা বাতাসে চোখ বন্ধ করে শিউলি ভাবল—আমি যদি পাখি হতাম! পাখি হয়ে আকাশে উড়ে যেতাম। মা বলতেন—“মেয়ে মানুষের এত স্বাধীনতা নেই, ওড়ে গেলে ডানা ছেঁটে দেবে।” শিউলি সেদিন মায়ের কথার মানে বুঝতে পারেনি, শুধু হেসে ফেলেছিল।
একদিন বিকেলে শিউলির মা রান্নাঘরে লুকিয়ে কাঁদছিলেন। শিউলি চুপিচুপি রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল। মায়ের চোখে অজানা আতঙ্ক, ঠোঁটদুটো কাঁপছে—যেন ভীষণ কোনো দুঃখ লুকিয়ে রাখতে চাইছে। শিউলি ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে মায়ের আঁচল ধরে বলল, “মা, তুমি কাঁদছো কেন?” মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, “না রে মা, ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা করছে।” শিউলি সেদিন প্রথম বুঝেছিল—বড়রা সবসময় সত্যি কথা বলেনা।
তখনো শিউলি বুঝতে পারেনি, মায়ের ভয়গুলো কত বড়। বাবা মাস্টারি করে, তাতে সংসার চলে। কিন্তু কাগজপত্রে অনেক ঝামেলা, স্কুলের রেজিস্টার, মাস্টারমশাইয়ের কাজ—এসবের ফাঁকে বাবার ভেতরে রাগ জমে থাকত। সেই রাগের ছিটেফোঁটা মায়ের গায়ে পড়ত, তবে শিউলির গায়ে কখনো নয়। শিউলি যতবার বাবাকে রাগতে দেখেছে, মা সেই রাগ নিজের মধ্যে টেনে নিতেন—শিউলির সামনে সবকিছু আড়াল করে রাখতেন।
একদিন রাতে বাবা একটু বেশি রেগে গিয়েছিলেন। কোনো কাগজপত্রে সই হয়নি, স্কুলের ফান্ড থেকে টাকা কমে গেছে—বাবা ক্ষুব্ধ। মাকে ডেকে বললেন, “তুমি তো সব জানো না, ওই কমিটি মিটিংগুলো কীভাবে চলে!” মায়ের চোখে সেই ভয়ের রেখা, ঠোঁটে থরথর কাঁপুনি। শিউলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। হঠাৎ বাবা মায়ের দিকে হাত তুলেছিলেন—শিউলির মনে হয়েছিল পৃথিবী যেন উল্টে যাচ্ছে! কিন্তু ঠিক সেইসময় বাবা থেমে গিয়েছিলেন। মায়ের দিকে চেয়ে রাগ কমিয়ে ফেলেছিলেন। সেদিন শিউলি বুঝেছিল—ভালোবাসা মানে কেবল হাসি নয়, ভয়ও থাকে।
শিউলির বন্ধুরা ছিল পাড়ারই। কুটির, মুন্নি, পিয়া—সবাই শিউলির বয়সি। বিকেলবেলা পাড়ার গলিতে গুটি খেলত, লুকোচুরি খেলত। কখনো কখনো কুটিরের মা খেঁজুরগুড়ের পায়েস দিয়ে দিত, মুন্নির মা মুড়ি-চানাচুর মাখিয়ে দিত—ওদের সেই মেলামেশার দিনগুলো ছিল স্বর্গ।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মা হঠাৎ শিউলিকে বলতেন, “তোমার জামা একটু বড় করে পরো, পেছনের হুক ঠিক করে পরো—ছেলে মানুষেরা ঠিক ভালো চোখে তাকায় না।” শিউলি অবাক হতো—ছেলে মানুষের চোখে আবার আলাদা কেমন?
একদিন বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে পাড়ার এক দাদার কুমিরের ছানা নিয়ে শিউলিদের ভয় দেখাচ্ছিল। সবাই দৌড়ে পালালেও শিউলি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছিল। সেই দাদা এসে শিউলির গায়ে হাত দিয়ে বলেছিল—“তুই এত সুন্দর, ভয় কিসের?” শিউলির বুকের ভেতর যেন কাঁপুনি ধরেছিল। বাড়ি ফিরে মা সেই দাগ মুছিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, “মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দিলে দাগ পড়ে, সেই দাগ সহজে যায় না।”
সেইদিন থেকে শিউলির মনে গেঁথে গিয়েছিল—দাগ মানে ভয়, দাগ মানে লজ্জা, দাগ মানে গোপনীয়তা।
মাঘের শীতে রাতবেলা কুয়াশা পড়ত। মা উনুনের কাছে বসে সুতো বুনতেন, হাতমোজা বুনতেন। শিউলি মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত। মায়ের আঙুলের আলতো ছোঁয়া আর শীতের কাঁপুনি মিলে ওর মনে হতো—এই ছায়াঘেরা পৃথিবীই ওর জন্য নিরাপদ।
একদিন রাতে মায়ের কোলেই শিউলি জিজ্ঞেস করেছিল, “মা, তুমি বলেছিলে মেয়ে মানুষের জীবন কষ্টের। কেন কষ্ট, মা?”
মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, “মেয়ে মানুষের শরীরটা যেন এক মাটির হাঁড়ি—সবাই দাগ ফেলতে চায়, ফাটল ধরাতে চায়, ভাঙতে চায়। সেই দাগ মুছতে গিয়ে কষ্ট হয়।”
শিউলি তখনও বুঝতে পারেনি, তবে মায়ের কণ্ঠের কষ্ট গেঁথে গিয়েছিল মনে।
শিশুকালের সেইসব দুপুর, বিকেল, শীতের রাত আর মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে রাখা দিনগুলোতে শিউলি শিখে গিয়েছিল—দাগ মানে ভয়, লজ্জা আর বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা কান্না।
আর তখনো সে জানত না—এই দাগ নিয়েই ওকে একদিন বাঁচতে শিখতে হবে।
২
শিউলির বয়স এখন পনেরো। হাইস্কুলের শেষ বছর। জীবনের ভাঁজে ভাঁজে নতুন রঙের ছোঁয়া, নতুন গন্ধ। কিশোরী মেয়েটার বুকের মধ্যে ঝড় বইছে—না বোঝা ভালোবাসার ঝড়, স্বপ্নের ঝড়। স্কুলের পথে হেঁটে যেতে যেতে শিউলি টের পায়, কত ছেলেদের চোখে ওর জন্য কিছু আছে—কখনো কৌতূহল, কখনো অন্যরকম দৃষ্টি। কিছু কিছু দৃষ্টি কেমন যেন শরীরের ভেতর পর্যন্ত ঢুকে যায়। শিউলি তবু রোজই হাসতে হাসতে সবকিছু এড়িয়ে যায়।
মায়ের বকুনি একটু বেড়েছে এখন। “মেয়ে মানুষ রাতে একা বাইরে যাস না।” “জামাটা ঢেকে পর, ওড়নাটা গায়ে ঠিকমতো রাখ।” “কখনো কারো গাড়িতে ওঠা যাবে না।” শিউলি জানে, মায়ের কথাগুলো কড়া শোনালেও ওর মঙ্গলের জন্যই। তবু মনের ভেতর কেমন যেন বিদ্রোহের ঢেউ ওঠে। কবে থেকে যেন সে আয়নায় নিজেকে নতুন করে দেখতে শুরু করেছে।
স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলছে। মেয়েদের দৌড়, ছাতা-দৌড়, বল-ছোড়া, আর ছেলেদের ফুটবল ম্যাচ। শিউলিও দৌড়ে অংশ নেবে। সকালবেলা মাঠে রিহার্সাল হচ্ছে, শিউলির পিঠে ব্যাগ, পরনে নীল সালোয়ার-কামিজ, চোখে একরাশ স্বপ্ন। হঠাৎ পাশের ক্লাসের প্রদীপ এসে দাঁড়াল। প্রদীপ, উঁচু ক্লাসের ছেলে, ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন, চওড়া বুক, তীক্ষ্ণ চাহনি। “এই শিউলি, দৌড়ের রিহার্সালে আমি তোমাকে দেখে অবাক হলাম। তুমিও তো বেশ ভালো দৌড়াও!” শিউলি একটু হেসে বলল, “তা হয়তো। তবে আমার তেমন স্পোর্টস-ম্যানশিপ নেই।” প্রদীপ হেসে বলল, “তুমি চেষ্টাটা চালিয়ে যাও। আমি দেখছি তোমায়।”
শিউলির গাল লাল হয়ে ওঠে। কেমন যেন এক অজানা অনুভূতি। প্রদীপের চোখে যে দৃষ্টি, তা মায়ের চোখের ভয়ের চেয়ে আলাদা। ওখানে একরকম মুগ্ধতা আছে, একরকম আগ্রহ আছে। শিউলির বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি।
সেই রাতেই শিউলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল বেঁধে নতুন করে দেখতে থাকে। কে এই মেয়েটা? এই চুল, এই চোখ, এই মুখের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কেমন যেন নতুন শিউলি! সেই মেয়েটাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, আবার ভয়ও করে। মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে—“মেয়ে মানুষের শরীর মানে দাগের ভয়।”
পরের দিন প্রদীপ হেসে বলল, “তোমার জন্য একটা ক্রীড়া-জার্সি এনেছি।” হাতে তুলে দিল একটা লাল-নীল রঙের টিশার্ট। শিউলি প্রথমে নিতে চায়নি, কিন্তু প্রদীপ বলল, “টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে এটা দিচ্ছি, নাও।” শিউলির কষ্ট হলেও নিতে হল। সেই রাতে লুকিয়ে ওড়নার নিচে টিশার্টটা ঢুকিয়ে রেখেছিল। মা যেন না দেখে ফেলে!
সেই রাতেই শিউলির মা রান্নাঘরে শিউলির বাবাকে বলছিলেন, “শিউলি বড় হচ্ছে। ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে সাবধানে থেকো।” বাবার গলা কঠিন, “হুঁ, মেয়েমানুষদের জন্যই এ সমাজে সবচেয়ে বেশি নিয়মকানুন। আমি শিউলিকে চোখে চোখে রাখব।” শিউলির কানে কথাগুলো পৌঁছে যায়। শিউলির বুকের মধ্যে যেন একরাশ কষ্ট জমে ওঠে। ও কি দোষ করেছে? ও তো শুধু দৌড়ের অনুশীলন করছিল, প্রদীপ ওকে জার্সি দিয়েছে—তাহলেই দোষ?
ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন, পুরো মাঠ ভর্তি মানুষ। স্কুলের হেডমাস্টার মাইকে বলছেন, “সবাইকে স্বাগত জানাই, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দিতে থাকুন।” শিউলি দৌড়ের লাইনে দাঁড়িয়ে, প্রদীপ মাঠের একপাশ থেকে হাত নাড়ছে। শিউলির বুকের ভেতর ঢাক ঢাক করে কাঁপছে, পা যেন কাঁপছে—তবু দৌড় শুরু হলে ও দৌড়চ্ছে! দৌড়ের শেষে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেল শিউলি। হাঁটুতে লেগে গেল কাঁদা, খোলা সালোয়ার গলে পা কেটে রক্ত ঝরছে। প্রদীপ দৌড়ে এল, “শিউলি, তুমি কেমন আছো?” শিউলির চোখে জল—যন্ত্রণার নয়, অপমানের। মাঠের মাঝখানে সবার দৃষ্টি ওর দিকে! ওড়না খুলে গেছে, চুল এলোমেলো, শরীরের প্রতিটি কণা লজ্জায় কাঁপছে।
প্রদীপ ওর কাঁধে হাত রাখল, “ভয় নেই, আমি আছি।” শিউলি ওর দিকে তাকাতে পারল না। সেই মুহূর্তে ওর মনে হলো, মায়ের সেই ‘দাগ’ কথাটা যেন সত্যি হয়ে গেছে। মাঠের মাঝখানে দাগ লেগেছে ওর শরীরে, ওর আত্মায়।
বাড়ি ফিরে মা শিউলির হাঁটুতে ওষুধ দিচ্ছিলেন। “দৌড়াতে গিয়ে পড়েছিস? সাবধানে চলতে শিখ।” শিউলি বলল না, প্রদীপের কথা, জার্সির কথা, কারো চোখের দৃষ্টি। কেবল ভেতরে ভেতরে পুড়ছিল ও।
সেই রাতেই শিউলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল—হাঁটুর দাগটা ঠিক যেন একটা গল্প বলছে। মায়ের কথা মনে পড়ে গেল, “দাগ মানে ভয়, দাগ মানে লজ্জা, দাগ মানে গোপনীয়তা।” শিউলি প্রথমবার মনে মনে বলল, “এই দাগই আমাকে শক্ত করে তুলবে। আমি আর ভয় পাব না।”
কিন্তু শিউলির জীবনের সেই দাগের ছায়া তখনো ওর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, ধীরে ধীরে ওকে পুড়িয়ে দিতে চায়।
৩
শিউলির বয়স এখন আঠারো পেরিয়ে উনিশ। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কলেজের রাস্তা, নতুন মুখ, নতুন বই, নতুন স্বপ্ন—সব মিলিয়ে ওর চারপাশটা যেন এক রঙিন খাঁচা। শিউলি কখনো এই খাঁচার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, কখনো আবার মুক্তি চাইতে চায়।
কলেজের প্রথম দিনেই ও বুঝে গেল—এ জগৎ একেবারে আলাদা। ছোটবেলার সেই নিরাপদ উঠোন, মায়ের আঁচল, আমগাছের ছায়া—সব পেছনে ফেলে নতুন এক অচেনা নদীর ধারে দাঁড়িয়েছে শিউলি। বন্ধুবান্ধব হয়েছে কয়েকজন—অর্পিতা, সুমনা, রিমা। ওদের সঙ্গে হাসিখুশি গল্প, সেমিনার, ক্যান্টিনের চা আর সিঙাড়া—সব মিলে দিনগুলো উড়ে যাচ্ছে।
তবে এই শহরের রাস্তাগুলো একদম নিরাপদ নয়। অটোস্ট্যান্ডে দাঁড়ালে, বাসস্ট্যান্ডে ভিড়ের মধ্যে, কলেজের করিডরে—কোথাও না কোথাও একজোড়া চোখ ওকে গিলে খেতে চায়। শিউলি টের পায়—মেয়েমানুষ হিসেবে ওর শরীরের প্রতিটি ভাঁজ যেন কারো না কারো লোভের বস্তু। ওর মধ্যে অজানা এক শক্তি তৈরি হয়, ও চোখ নামিয়ে নয়, চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে শিখে যায়।
একদিন কলেজের ক্যান্টিনে বসে শিউলি আর অর্পিতা হাসতে হাসতে গল্প করছিল—হঠাৎ করিডরের এক প্রান্ত থেকে ওর দিকে এগিয়ে এল এক অজানা ছেলে। ছেলেটির নাম রাহুল, অন্য বিভাগে পড়ে। লম্বা, চাপ দাড়ি, চোখে চশমা, হাতে ডায়েরি। এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি শিউলি তো? তোমার কবিতা পড়েছি কলেজ ম্যাগাজিনে—খুব ভালো লেগেছে। তোমার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে তুমি খুব সংবেদনশীল। যদি কিছু না মনে করো, আমি তোমার সঙ্গে গল্প করতে চাই।”
শিউলির গলায় একরাশ কৌতূহল, আবার সন্দেহও। “আমার কবিতা? হ্যাঁ, লিখেছিলাম… কিন্তু…” রাহুল বলল, “তুমি ভাবছ আমি অযথা কথা বলছি? না, সত্যিই আমি তোমার লেখা পছন্দ করেছি। শুধু একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই—তুমি কিসের দাগ নিয়ে লিখেছিলে?”
শিউলির বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। “দাগ? মানে?”
রাহুল হাসল, “তুমি লিখেছিলে—‘দাগ মানে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা এক অজানা গল্প।’ সেই গল্পটা কী, সেটা জানার ইচ্ছে আছে।”
শিউলি কোনো জবাব দিতে পারল না। মায়ের সেই পুরনো কথা মনে পড়ল—“মেয়ে মানুষের দাগ লুকিয়ে রাখতে হয়।” শিউলি মাথা নিচু করে বলল, “সব দাগের গল্প বলা যায় না।” রাহুল আর কথা বাড়াল না, শুধু বলল, “ঠিক আছে, একদিন যদি বলতে ইচ্ছে করে, আমি শুনব।” তারপর চলে গেল।
সেদিন রাতে শিউলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে তাকাল। ওর কপালে এক বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ওর দাগগুলো—শুধু হাঁটুর দাগ নয়, বুকের ভেতরের দাগও—সব যেন কণ্ঠনালী পর্যন্ত উঠে আসে। ও চিৎকার করে কাঁদতে চাইল, কিন্তু পারে না। মায়ের সেই আঁচলের মতো কোনো নিরাপদ আশ্রয় ওর নেই এখন।
পরের দিন কলেজ থেকে ফেরার পথে অটোস্ট্যান্ডে হঠাৎ এক ছেলের দল ওর চারপাশে ঘিরে ধরল। “এই সুন্দরী, একা যাচ্ছো নাকি?” “দূরদূর করে না, দাঁড়াও না একটু!” শিউলি বুকের মধ্যে একটা কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ও চোখে চোখ রেখে বলল, “দয়া করে রাস্তা ছেড়ে দিন।” কিন্তু ওদের অট্টহাসি—যেন ওর শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাবে। ঠিক সেই সময় রাহুলের কণ্ঠ শুনতে পেল, “এখান থেকে সরে যাও, নইলে পুলিশ ডাকব!” ছেলেগুলো গালাগালি করে সরে গেল। রাহুল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছো তো?” শিউলি শুধু মাথা নেড়ে বলল, “ধন্যবাদ।”
রাহুলের মুখে একরাশ দয়া আর সহানুভূতি। শিউলি বুঝতে পারল—সব পুরুষ মানুষ একরকম নয়। কেউ কেউ পাশে দাঁড়াতেও জানে।
সেই রাতেই শিউলি মায়ের সেই পুরনো কথা মনে করে আবার বলল, “মা, তোমার আঁচল কোথায়? আমার বুকের দাগগুলো দেখানোর মতো কেউ আছে কি?” মায়ের কথা মনে করে ওর বুকের মধ্যে কান্নার ঢেউ উঠল। কিন্তু এখন আর ও একা কাঁদে না। ও জানে—এই দাগই ওকে লড়তে শেখাবে। এই দাগই ওকে শক্ত করে তুলবে।
দিন যায়, রাত আসে। কলেজের দেয়ালে পোস্টার লাগছে, “নারী স্বাধীনতা চাই।” শিউলির মনে হয়—নারী স্বাধীনতা মানে কি দাগ লুকিয়ে রাখা নয়? বরং দাগ দেখিয়ে দেওয়া—দাগকে অহংকার করে বাঁচা?
একদিন ক্যান্টিনে বসে শিউলি রাহুলকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি বলেছিলে—তুমি আমার দাগের গল্প শুনতে চাও। আজ বলি শোনো—দাগ মানে লজ্জা নয়, দাগ মানে শক্তি। এই দাগ নিয়েই আমি বাঁচব, লড়ব, হাসব, আর পৃথিবীকে দেখাব—মেয়েমানুষ মানে শুধু ফুল নয়, আগুনও।”
রাহুল চুপ করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি একদম ঠিক বলেছ। তোমার সেই আগুনে আমি পাশে থাকতে চাই—তুমি চাইলে।”
শিউলি বুকের ভেতর গভীর প্রশান্তি অনুভব করল। ওর মনে হলো—দাগ লুকিয়ে রাখার দিন শেষ। ও এবার দাগ নিয়ে বাঁচতে শিখছে।
৪
শিউলির জীবনের গল্পটা যেন এখন আরও বেশি কংক্রিট হয়ে গেছে। কলেজের শেষ বর্ষে পৌঁছে শিউলির জীবনে প্রতিটি দিনই যেন একেকটা লড়াই। সকালে ক্লাস, বিকেলে টিউশন, রাতে পড়াশোনা—সেইসঙ্গে অজানা ভয় আর অদ্ভুত কিছু চোখের শিকার হওয়া। তবু এইসবের মাঝেও শিউলি তার দাগগুলো বয়ে নিয়ে বাঁচতে শিখে ফেলেছে।
কলেজে নারী উন্নয়ন সেলের ক্যাম্পেইন চলছে। “নারীর অধিকার মানে নিজের স্বরকে সবার সামনে তুলে ধরা।” শিউলি সেই আন্দোলনে যোগ দিল। তার কবিতা, বক্তৃতা, দেয়ালে দেয়ালে আঁকা পোস্টার—সব মিলিয়ে যেন নতুন শিউলি তৈরি হচ্ছে।
একদিন কলেজে এক সেমিনারে শিউলি মঞ্চে উঠে বলল, “আমাদের শরীর মানেই লজ্জা নয়, আমাদের দাগ মানেই গোপনীয় নয়। এই দাগই আমাদের গল্প, আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস। যারা এই দাগ নিয়ে ছিঃছিঃ করবে, তাদের লজ্জা হোক।” তার কথায় কেমন যেন আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ছেলেমেয়েরা হাততালি দিতে লাগল। শিউলি মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। ও জানে—এ লড়াই সহজ নয়, তবু এই লড়াই ওর জীবন।
কিন্তু যতই সে শক্ত হয়, ততই যেন বিপদ ওর চারপাশে ঘনিয়ে আসে। কলেজের একজন সিনিয়র, নাম বিকাশ, চোখে চশমা, একটু রাশভারী চেহারা—শিউলির এই তেজী বক্তৃতাগুলো ওর সহ্য হচ্ছিল না। বিকাশের বন্ধুরা শিউলিকে বারবার কটাক্ষ করে। “বড্ড জোশ মেয়েটার! কে জানে এর পেছনে কেমন দাগ লুকিয়ে আছে!”
একদিন লাইব্রেরি থেকে বেরোতে গিয়ে বিকাশ শিউলির পথ আটকে বলল, “এই যে শিউলি, খুব বড় বড় কথা শিখেছ, না? এত সাহস কই পেলে?”
শিউলি চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার দাগই আমাকে সাহস দিয়েছে। আর দাগ নিয়ে বাঁচতে শিখেছি।”
বিকাশ হেসে বলল, “দাগ তো কারো শরীরেই হয়। কিন্তু তুমি মনে হচ্ছে সেই দাগ দেখিয়ে নায়িকা সাজার চেষ্টা করছ!”
শিউলির গলায় আগুন ঝরে পড়ল। “তুমি যা খুশি ভেবো। আমি জানি আমার দাগ লজ্জা নয়, শক্তি।”
সেই রাতে শিউলি নিজের রুমে বসে কবিতার খাতাটা খুলল। কলমের খোঁচায় খোঁচায় লিখতে লাগল—
“আমার দাগ লুকিয়ে রাখব না আর আমার দাগ মানেই বেঁচে থাকা আমার দাগ মানেই আগুন যে আগুনে আমি আজও পুড়ছি যে আগুনে আমি নতুন করে গড়ছি নিজেকে।”
শিউলির চোখ ভিজে গেল। ও জানে—এই কবিতা শুধু কাগজে নয়, ওর রক্তে লিখা।
এরপর একদিন কলেজে নারী উন্নয়ন সেলের পক্ষ থেকে একটি বড়ো মিছিলের আয়োজন করা হলো। “নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোল” এই স্লোগানে গোটা কলেজের ছেলেমেয়েরা একত্রিত হলো। শিউলি মিছিলের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ড ধরল—“আমার দাগ আমার গল্প।” তার কণ্ঠে ঝড়ের মতো জেদ, চোখে আগুন।
হঠাৎ বিকাশ সঙ্গী কিছু ছেলেকে নিয়ে মিছিলের মাঝখানে এসে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, “এই মেয়েটা নায়িকা সাজার চেষ্টা করছে! ওর শরীরের দাগ তো আমাদের সবার জানা আছে!”
শিউলির বুকের ভেতর আবার সেই পুরনো কষ্টের ঢেউ। কিন্তু ওর চোখে জল নেই, ওর চোখে শুধু আগুন। ও সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি যা বলছ, তা তোমার অসভ্যতা। আমার দাগ মানেই আমার লড়াই। সেই লড়াইকে আমি মিথ্যে হতে দেব না।”
মিছিলের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “শিউলি, আমরা তোমার সঙ্গে আছি!”
বিকাশ কুণ্ঠিত মুখে সরে গেল। শিউলির বুকের ভেতর উজ্জ্বল এক আলো ফুটল। ও জানল—এই আলো নিভবে না আর। এই আলোই ওর লড়াই।
সেই রাতে শিউলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দাগগুলো দেখল। হাঁটুর দাগ, কনুইয়ের দাগ, বুকের ভেতরের দাগ—সব দাগ মিলিয়ে ওর একটা সম্পূর্ণ গল্প। ও হাসল। ও জানে—এই লড়াই শেষ হবে না। এই লড়াইকে বুকে নিয়েই ও নতুন দিনকে আলিঙ্গন করবে।
৫
শিউলির জীবনে যেন নতুন এক সকাল এসেছে। কলেজ শেষের পথে, চারপাশে চাকরির প্রস্তুতির তোড়জোড়, নতুন স্বপ্ন, নতুন দায়িত্ব। ওর ভেতরের সেই দাগের গল্পও যেন ওকে নতুন করে তৈরি করেছে। শিউলি এখন আগের চেয়ে দৃঢ়, নিজের মতো করে ভাবতে ও বাঁচতে শিখেছে।
কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। শিউলি এখন হোস্টেলে থাকে। সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে ও আকাশের দিকে তাকায়—নীল আকাশে ছোট ছোট মেঘের ভেলা ভাসছে। শিউলি মনে মনে ভাবে—যেমন দাগগুলো নিয়ে আমি দাঁড়িয়েছি, তেমনিভাবে ও আকাশেরও দাগ আছে। কিন্তু তবু সে আলো ছড়ায়।
হঠাৎ হোস্টেলের মেইন গেটে একটা অচেনা ছেলে ওর নাম ধরে ডাকল, “শিউলি!”
শিউলি ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “কোনো কাজ?”
ছেলেটা একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি সোহাগ। তোমার কলেজের নতুন ছাত্র। আমি তোমার লেখা কবিতা পড়েছি ম্যাগাজিনে। খুব ভালো লেগেছে। যদি কিছু মনে না করো, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
শিউলি ভেবেই পেল না কী বলবে। একসময় ওর কবিতার প্রশংসা করে রাহুল ওর জীবনে এসেছিল। রাহুলের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল, আর সেই বন্ধুত্ব ওকে সাহস জুগিয়েছিল। রাহুল এখনো বন্ধু, যদিও আলাদা বিভাগের পড়া, আলাদা ব্যস্ততা।
সোহাগকে বলল, “ঠিক আছে, কিন্তু এখানেই বলো, আমার তাড়া আছে।”
সোহাগ ম্লান হাসল, “তুমি খুব শক্ত মেয়ে, তাই না?”
শিউলি চুপ করে রইল। ওর চোখের কোণে পুরনো দাগের গল্পগুলো ভিড় করে আসে। “হ্যাঁ, কিছু দাগ মানুষকে শক্ত করে তোলে।”
সোহাগ বলল, “তোমার কবিতা থেকে আমি শিখেছি—মেয়েদের দাগ মানে ওদের লড়াইয়ের গল্প। আমি চাই, সেই গল্পগুলো আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাক।”
শিউলির বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। ওর কবিতা নিয়ে কেউ কখনো এভাবে ভাবেনি। সোহাগ চলে গেলে শিউলি নিজের খাতায় নতুন করে কবিতা লিখতে শুরু করল—
“আমার দাগের গল্প শোনাবে আকাশ আমার দাগের গল্প শোনাবে বাতাস আমার দাগ মানে আলো, আগুন, বৃষ্টি আমার দাগ মানে লড়াই, লড়াই আর লড়াই।”
পরীক্ষা শেষে শিউলি আবার গ্রামে ফিরল। মায়ের বাড়ির সেই উঠোনে, আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শিউলি নিজের শৈশবকে মনে করল। হাঁটুর সেই ছোট্ট দাগের কথা মনে পড়ল। মা বলত, “মেয়েদের দাগ লুকিয়ে রাখতে হয়।” কিন্তু আজ শিউলি জানে, সেই দাগই ওর সবচেয়ে বড়ো অহংকার।
মা এখনো আগের মতো ওকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু শিউলি মাকে বলল, “মা, আমি আর লুকিয়ে রাখব না। আমি সব দাগ নিয়ে বাঁচতে শিখেছি। তোমাকেও বলতে চাই—মেয়েরা দাগ নিয়ে বাঁচে, দাগ নিয়ে লড়ে, আর সেই লড়াইতে ওরা জেতে।”
মা স্তব্ধ হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই খুব বদলে গেছিস রে।”
শিউলি মায়ের হাতটা ধরে বলল, “হ্যাঁ মা, বদলে গেছি। বদলাটা দরকার ছিল।”
রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো। শিউলি মায়ের সঙ্গে ছাদে বসে সেই আলো দেখল। মায়ের চোখে জল—অথচ সেই জলে ভয় নেই, আছে গর্ব।
পরদিন সকালে শিউলি আবার শহরে ফিরল। রাহুলের সঙ্গে দেখা হলো কলেজের ফটকে। রাহুল বলল, “তুমি বদলে গেছ। আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছ।”
শিউলি হাসল। “আমার দাগগুলো আমাকে বদলে দিয়েছে, রাহুল। সেই দাগগুলোই আমার যুদ্ধ। যুদ্ধ মানে শুধু লড়াই নয়, যুদ্ধ মানে নিজেকে গড়া।”
রাহুল মুগ্ধ হয়ে বলল, “তুমি তো সত্যিই এক নতুন সকাল।”
শিউলির চোখে ভোরের আলো ফুটল। ওর বুকের ভেতর আগুনের মতো শক্তি, আকাশের মতো নীল স্বপ্ন। ও জানে—এই সকাল ওর নতুন জীবনের, নতুন লড়াইয়ের। দাগ নিয়ে, আলো নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে ওর পথ চলা শুরু হলো আবার নতুন করে।
৬
শিউলির লড়াই যেন এক নিঃশেষ যুদ্ধ। শহরের কোলাহলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ও নিজের ছায়ার ভেতর নিজের দাগ খুঁজে পায়। রাত্রির আঁধারে, সড়কের বাতিতে, মানুষের ভিড়ের মধ্যে—ওর সেই দাগের গল্পগুলো কেবলই ঘুরে ফিরে আসে।
কলেজের শেষ বর্ষের ফল বেরিয়েছে। শিউলি প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেছে। সেই খুশি নিয়ে মা’কে ফোন করল। মায়ের গলায় গর্ব, আবার শঙ্কাও। “মা, আমি চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি।”
মা বলল, “যা খুশি কর মা, তবে সাবধানে থেকিস।”
শিউলির মনে হলো, মায়ের সাবধান থাকার কথা আসলে ওর সেই দাগগুলোরই জন্য। মা এখনো সেই দাগগুলো লুকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু শিউলি জানে, ওর রক্তে সেই দাগই ওর অস্তিত্বের শিকড়।
ইন্টারভিউর দিন। শিউলি চোখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে করপোরেট অফিসের গেট দিয়ে ঢুকল। চকচকে ফ্লোর, এয়ারকুলারের ঠান্ডা, নীল দেওয়ালে কোম্পানির লোগো। শিউলির মনে হলো, এই দেওয়ালে কি ওর সেই দাগগুলোও জায়গা পাবে?
রিসেপশনে নাম লিখিয়ে বসল। ওর বুকের ভেতর অদ্ভুত ধুকপুকানি। দাগগুলো যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে, “তুই পারবি।”
সাক্ষাৎকার কক্ষে বসে থাকা এক্সিকিউটিভ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, “শিউলি, আপনার অর্জনগুলো খুব ভালো। কিন্তু আপনার কবিতাগুলো নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বলে শুনেছি। আপনি নিজের দাগ নিয়ে এত কবিতা কেন লেখেন?”
শিউলি গলা শক্ত করে বলল, “স্যার, আমার দাগ মানেই আমার গল্প। আমি সেই গল্প নিয়ে বাঁচতে শিখেছি। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের দাগই তার বেঁচে থাকার ইতিহাস।”
ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। “আপনি সাহসী মেয়ে। আমাদের কোম্পানিকে এমন সাহসী মানুষেরই দরকার।”
সাক্ষাৎকার শেষে বেরিয়ে এসে শিউলি নীচের ক্যান্টিনে বসল। ক্যান্টিনের এক কোণে বিকাশ আর তার বন্ধুরা বসে আড্ডা দিচ্ছিল। বিকাশ শিউলিকে দেখে কটাক্ষ করল, “এই যে দাগওয়ালি নায়িকা! এবার কি চাকরিও দাগ দেখিয়ে পাবে নাকি?”
শিউলির বুকের ভেতর লাল আগুনের ফুলকি। ওর মনে হলো, এ আগুন থামানো যাবে না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বিকাশ, এই দাগ নিয়েই আমি চাকরি পাবো। এই দাগই আমাকে লড়াই করতে শিখিয়েছে। আর তুমি? তুমি কোনো দিন দাগের মূল্য বোঝনি। তুমি শুধু অন্যের দাগ নিয়ে হাসতে জানো।”
চারপাশের ক্যান্টিনে হাসির ফোয়ারা, কেউ ফিসফিস করে, কেউ মুখ নিচু করে। কিন্তু শিউলির কণ্ঠে কোনো কম্পন নেই। বিকাশের চোখ নামিয়ে নেয়ার সময় ওর বুকের ভেতর যেন বিজয়ের আগুন জ্বলে ওঠে।
সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফিরে শিউলি আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ওর হাতের দাগগুলো, পায়ের দাগগুলো, বুকের ভেতরের দাগগুলো—সব মিলিয়ে এক যুদ্ধক্ষেত্র। ওর মুখে হাসি, চোখে আগুন। ও জানে, এই দাগ লুকিয়ে রাখলে আর লড়াই হবে না, এই দাগ দেখিয়ে দিয়েই ওকে এগোতে হবে।
রাতে ওর ফোনে রাহুলের মেসেজ আসে, “তুমি কেমন আছ?”
শিউলি উত্তর দেয়, “ভালো আছি। দাগগুলো আমাকে সাহস শিখিয়েছে। কাল থেকে নতুন করে শুরু করছি।”
রাহুল লেখে, “তুমি তো রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছ!”
শিউলি মৃদু হাসে, “হ্যাঁ, রক্তের মতো লাল। আগুনের মতো লাল। এই রঙেই আমি আমার দাগগুলোর গল্প লিখছি।”
রাতের খোলা আকাশে শিউলি তাকিয়ে থাকে। ওর বুকের ভেতর থেকে একটা গর্জন শোনা যায়—যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলবেই। সেই যুদ্ধেই রক্তের মতো লাল শিউলি প্রতিটি নতুন ভোরে নিজের দাগের গল্প লিখবে।
৭
শিউলির চোখের পাতা কাঁপছে। নতুন চাকরি হাতে এসেছে। রক্তের মতো লাল দাগগুলো যেন আরও দৃঢ়ভাবে ওর শরীরের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছে। ও জানে, এই দাগগুলো লুকিয়ে রাখা মানেই নিজের লড়াইকে অস্বীকার করা। তাই শিউলি বেছে নিয়েছে—দাগ নিয়েই বাঁচবে।
চাকরির প্রথম দিন। সোনালি ভোর। বাসে বসে শিউলি জানালার কাঁচে হাত রেখে তাকায়—রাস্তার ভিড়, ট্রাফিক, মানুষের মুখে মুখে অজানা ক্লান্তি। শিউলির ভেতর যেন একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ। এতদিন যে দাগ ওকে কাঁদিয়েছে, সেই দাগই ওকে আজ সাহসী করে তুলেছে।
অফিসের রিসেপশনটা চকচকে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কাঁচের কিউবিকলে ঢোকার পর মনে হয় যেন একটা অজানা যুদ্ধক্ষেত্র। সহকর্মীরা শিউলিকে নিয়ে ফিসফিস করে। “এই মেয়েটা না কবিতা লেখে? দাগ নিয়ে?”—একটু যেন কৌতুক মাখানো প্রশ্ন।
শিউলি হেসে ওঠে। মনে মনে ভাবে, ওরা যা খুশি ভাবুক। এই অফিসেই ও নিজের দাগের গল্প লিখবে, আগুনের মতো রঙিন করে তুলবে।
প্রথম মিটিংয়ে বসে ও শুনছে, বস সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দিচ্ছেন। শিউলির ভাগে এসেছে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ। বস এক পলক শিউলির চোখে তাকিয়ে বললেন, “তোমাকে নিয়েই কিন্তু আমাদের বড়ো আশা।”
শিউলির বুকের ভেতর আগুনের রঙ লাল হয়ে ওঠে। ও জানে, এই লড়াই সহজ নয়। এই অফিসে ওর মেধা প্রমাণ করতে হবে, দাগ নয়। তবু ওর সেই দাগ ওর লড়াইয়ের প্রতীক।
দুপুরে লাঞ্চে সোহাগ ফোন করে বলল, “তুমি কেমন আছো?”
শিউলি হাসল, “ভালো। তবে চারপাশে এখনো দাগের গল্প ঘুরছে।”
সোহাগ বলল, “তোমার দাগ নিয়ে লেখা কবিতা পড়ে আমাদের কলেজের ম্যাগাজিনে অনেকে চিঠি পাঠিয়েছে। ওরা তোমাকে অনুপ্রেরণা বলছে।”
শিউলির চোখ ভিজে উঠল। “জানি সোহাগ, সেই দাগই আমার যুদ্ধ, সেই যুদ্ধই আমার আলো।”
অফিসের কফি মেশিনের সামনে একদিন সহকর্মী রুবিনা মজা করে বলল, “তুমি কি আসলে নাটক করতে এসেছো? তুমি না কবি, তাও আবার নিজের দাগ নিয়ে!”
শিউলি মৃদু হেসে বলল, “না রুবিনা, আমি নাটক করতে আসিনি। আমি এসেছি সত্যি বলতে, আর সেই সত্যি হলো—দাগ মানে লড়াই।”
রুবিনা হাসল। “তোমাকে দেখে সাহসী মনে হয়। তবে সাবধানে থেকো।”
শিউলি ভাবল, সাবধানে থাকাটা আসলে দাগ লুকিয়ে রাখা নয়। সাবধান মানে নিজের আলো নিয়েই বাঁচা।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে শিউলি শহরের ভিড়ে হারিয়ে গেল। হঠাৎ এক অচেনা গলিপথে বিকাশের বন্ধুর সঙ্গে দেখা। ছেলেটা চিৎকার করে বলল, “এই যে দাগওয়ালি কবি! অফিসেও তোমার নাটক চলবে না!”
শিউলি বুক সোজা করে বলল, “তুমি আমাকে দাগওয়ালি বলছো? ধন্যবাদ। এই দাগই আমার লড়াই, আমার রঙ।”
রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলো শিউলির মুখে পড়ল। ওর চোখে আগুনের মতো রঙ। ও জানে—এই আগুনে রঙিন হয়েই ওর দাগের গল্প লিখবে। আর সেই গল্পই ওর জীবন।
সেই রাতে ওর কবিতার খাতায় ও লিখল—
“দাগ মানে আগুন দাগ মানে রঙ দাগ মানে লড়াই এই আগুনেই জ্বলে উঠুক নতুন সকাল।”
শিউলির রক্তের ভেতর সেই আগুনের রঙ। ওর দাগগুলো ওর অস্তিত্বের গল্প। এই গল্প থামবে না, থামবে না কখনো।
৮
শিউলির জীবনে লড়াই যেন কখনোই থামবে না। প্রথম চাকরি, নতুন অফিসের চারপাশের মানুষের নানা কৌতুক, ফিসফিসানি—সবকিছুর মধ্যেই ও নিজের দাগগুলোকে আগুনের মতো বুকে ধরে রাখে। এবার ওর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে, আর সেই অধ্যায়েই ও পেয়েছে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার সুযোগ।
রাতে শিউলি নিজের ঘরে বসে খাতায় লিখছে—
“দাগ মানে যুদ্ধ যুদ্ধ মানে বেঁচে থাকা বেঁচে থাকা মানে আলো আর সেই আলো মানেই আমি।”
শিউলির ঘরের জানালা খোলা। বাইরে পূর্ণিমার আলো। সেই আলোয় ওর দাগগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ওর মায়ের কথা মনে পড়ল—“মেয়েদের দাগ লুকিয়ে রাখতে হয়।” শিউলি জানে, সেই লুকিয়ে রাখা দাগই একসময় ওকে দমিয়ে রেখেছিল। আজ সেই দাগই ওর বাঁচার গল্প।
অফিসে নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছে শিউলি। বড়ো ক্লায়েন্ট মিটিং। সবাই ভেবেছে—এই মেয়ে পারবে তো? শিউলি নিঃশ্বাস ফেলল, বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। দাগ নিয়ে লড়াই করতে শিখেছে ও।
ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে প্রেজেন্টেশন শেষ করে ও বলল, “এই প্রজেক্ট আমার কাছে শুধু কাজ নয়, আমার স্বপ্নের গল্প। আমি বিশ্বাস করি, এই দাগগুলোই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে।”
ক্লায়েন্ট মুগ্ধ হয়ে বলল, “তুমি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক মেয়ে।”
শিউলির চোখে জল এলো। যুদ্ধের শেষে আলো দেখে যেন বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। সেই আলো ওকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, ওর দাগগুলোর গল্পগুলোকে আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে শিউলি ফোন করল রাহুলকে। রাহুল বলল, “তুমি কি আজ সত্যিই বদলে গেলে?”
শিউলি হাসল, “না রাহুল, বদলাইনি। আমি সেই আগের শিউলি। শুধু আমার দাগগুলো আগের চেয়ে স্পষ্ট হয়েছে। সেই দাগগুলোই আমাকে আলো দেখাচ্ছে।”
রাহুল চুপ করে রইল। ও জানে, শিউলির দাগ নিয়ে হাসাহাসি করা মানুষের ভিড়ের মধ্যেও শিউলি যে আলো নিয়ে বাঁচতে শিখেছে, সেই আলোই ওর অস্তিত্বের নতুন ঠিকানা।
রাতে শিউলি নিজের খাতায় লিখল—
“আমার দাগ মানে যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, আমার দাগ মানে নতুন যুদ্ধের শুরু। আমার দাগ মানে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমি সেই আলোতেই বাঁচতে চাই, যেখানে আমার দাগগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যেখানে আমি সত্যি হয়ে উঠি।
এই দাগই আমার শেষ আলো, যেটা শেষ নয়, শুরুর আলোকরেখা।”
শিউলির চোখে ভিজে আসা হাসি। ও জানে, লড়াই শেষ নয়। আলো এখনো ডাকছে, দাগগুলো বুকে আগুনের মতো জ্বলছে। আর সেই আগুনেই ওর স্বপ্নের শেষ আলো ফুটে উঠছে, নতুন গল্পের শুরু ঘোষণা করছে।
শিউলির জীবন শেষ আলোয় রঙিন হয়ে গেল। এই আলোতেই ও নিজের দাগের গল্পের শেষ অক্ষর লিখে রাখল—যেন প্রতিটি মেয়ের দাগই নতুন করে বাঁচার গল্প হয়ে ওঠে।
এই শেষ আলো, এই শেষ দাগ, এই শেষ যুদ্ধ—এই নিয়েই শিউলির দাগের গল্প শেষ নয়, বরং নতুন শুরু।
___




