সুজন মুখোপাধ্যায়
অধ্যায় ১:
অর্পিতা ছিলো ইতিহাসের ছাত্রী, গবেষণার কাজে তার এক বিশেষ আগ্রহ ছিলো লোকাচার, লোকবিশ্বাস আর প্রাচীন দেবীসাধনা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন—অসম্পূর্ণ একটি প্রবন্ধের জন্য মাঠপর্যায়ের কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সেই সূত্রেই সে পৌঁছাল এক বহু পুরোনো, প্রায় ভগ্নদশা মন্দিরে, যা এখন আর কারও তীর্থক্ষেত্র নয়, কেবলমাত্র গ্রামবাসীদের চোখে ভয়ের প্রতীক। চারিদিকে বুনো লতাগুল্মে ঢাকা, মন্দিরের প্রাচীর ভেঙে গেছে অনেক জায়গায়, পাথরের মূর্তি গুলো অর্ধেক মাটির নিচে চাপা পড়েছে। মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতেই অর্পিতা অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতলতা, যদিও বাইরের রোদ ছিলো প্রবল। বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি জেগে উঠল তার, তবুও সে এগোলো—কারণ গবেষণার নেশা তাকে সবসময় অজানার দিকে ঠেলে দেয়। হাতে ছোট একটি টর্চ, ব্যাগে নোটবই, আর ক্যামেরা নিয়ে যখন সে মন্দিরের ভেতরে পা রাখল, তখনই যেন অচেনা কোনো দৃষ্টি তার পেছন থেকে তাকিয়ে আছে বলে মনে হলো। এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে, তারপর মাথা ঝেড়ে হেসে উঠল—ভাবল হয়তো নিজের মনেরই ভুল।
মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সে প্রথমেই লক্ষ করল মেঝেতে ছড়িয়ে আছে লাল রঙের কিছু গুঁড়ো, হয়তো সিন্ধুর কিংবা শুকনো রক্তের মতো দেখতে। পাশে কিছু ভাঙা প্রদীপ, ছাই, আর অদ্ভুত নকশায় আঁকা এক গোলাকার চিহ্ন, যা দেখে তার মনে পড়ল তন্ত্রসাধনার বৃত্তের কথা। সে অবাক হলো—এমন নির্জন মন্দিরে কেউ কি এখনো তন্ত্রচর্চা করে? অর্পিতা হাঁটু গেড়ে বসে ছবি তুলতে গিয়েছিলো, কিন্তু অসতর্কতাবশত তার কনুই লেগে গেল সেই নকশার ওপর রাখা একটি ছোট পাথরের বাটিতে। বাটি উলটে গেল, আর তার ভেতরে থাকা কালো ধোঁয়াটে ধূপের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। মুহূর্তের মধ্যেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, মন্দিরের দেয়ালে টর্চের আলো নাচতে লাগল অস্বাভাবিকভাবে। অর্পিতার বুকের ভেতরে হঠাৎ করেই কেমন চাপ পড়ল, যেন চারপাশের হাওয়া তার নিঃশ্বাস কেড়ে নিতে চাইছে। সে ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু হঠাৎ কানে আসতে লাগল মৃদু মৃদু মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ—যেন বহু দূর থেকে বহু কণ্ঠ একসাথে বলছে, অথচ মন্দিরের চারপাশে মানুষের অস্তিত্ব নেই।
তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল এক ঝলক আলোয়। মনে হলো যেন মন্দিরের পুরোনো ভগ্ন মূর্তিগুলোর চোখে লালচে আগুন জ্বলে উঠেছে। ভয়ে অর্পিতা টর্চ ফেলে দিল, কিন্তু শরীরটা যেন শিকলবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার সামনে দেখা দিল এক অবয়ব—না, পুরোপুরি দৃশ্যমান নয়, ধোঁয়ার ভেতর ভেসে ওঠা এক নারীমূর্তি। মূর্তির চোখ ছিলো শূন্য অথচ দীপ্ত, কণ্ঠে বজ্রের মতো ধ্বনি, এবং এক মুহূর্তের জন্য অর্পিতা অনুভব করল সে যেন নিজেকেই দেখছে অন্য রূপে। শরীরের ভেতরে হঠাৎ বিদ্যুতের মতো একটা স্রোত বয়ে গেল, হৃদপিণ্ড প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা মারল, আর মস্তিষ্কের ভেতরে এক ঝড় উঠল। তার মাথায় ভেসে উঠল অজানা দেবদেবীর নাম, যেগুলো সে কখনো শুনেনি, তার ঠোঁট থেকে বেরোতে লাগল অচেনা ভাষায় কিছু শব্দ, যা শুনে সে নিজেই আঁতকে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে প্রচণ্ড বজ্রপাত হলো, আর মন্দিরের অন্ধকারে যেন সারা আকাশ গর্জে উঠল।
অর্পিতা ছুটে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু পা একটুও সরল না। তার চারপাশে যেন অদৃশ্য এক ঘূর্ণিবাতাস তৈরি হলো, ধুলো আর ছাই উড়তে লাগল, প্রদীপের নিভে যাওয়া শিখাগুলো আবার হঠাৎ জ্বলে উঠল। চোখের সামনে যেন একে একে ফুটে উঠল দশটি মুখ—কেউ ভীষণ ভয়ঙ্কর, জিভ বের করা, খুলি হাতে ধরা; কেউ আবার মায়ের মতো মমতাময়ী, চোখে করুণার সাগর। এই দশ অবয়ব মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে তার শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল যেন আগুনের স্রোতের মতো। অর্পিতা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। বুকের ভেতর সেই আগুন একসময় শান্ত হলো, আর তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল অদ্ভুত নীলচে আলোয়। কিছুক্ষণ পর সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল—ঝড় থেমে গেল, প্রদীপ নিভে গেল, মন্ত্রোচ্চারণ স্তব্ধ হলো। অর্পিতা হাঁপাতে হাঁপাতে মন্দিরের দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল, কপাল ঘামে ভিজে, বুক ধড়ফড় করছে। তার মনে হলো সে আর আগের অর্পিতা নেই—কোনো অচেনা শক্তি যেন তাকে ভিতর থেকে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। সেই রাতে গ্রামে অকারণেই বিদ্যুতের তার কেটে গেল, কিছু পশু অদ্ভুত আচরণ করতে লাগল, আর চারপাশের মানুষ এক অস্বস্তিকর অশুভ অনুভূতি নিয়ে বাড়ির দরজা বন্ধ করল। অথচ অর্পিতা চুপচাপ বসে ছিলো মন্দির থেকে দূরে এক পাথরের ধারে, ভেতরের কাঁপুনি সামলাতে না পেরে। তার ভেতরে এখন আর শুধু একজন ছাত্রী নেই, বরং লুকিয়ে আছে এক মহাশক্তির বীজ, যার জাগরণ সে নিজেও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না।
অধ্যায় ২:
মন্দির থেকে ফেরা পথটা অর্পিতার কাছে যেন অনন্ত দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। শরীরটা ক্লান্ত, মাথার ভেতর ভারী, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো—তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় যেন অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে গাছের পাতার খসখস, দূরের কুকুরের ডাক, এমনকি বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দও অদ্ভুতভাবে স্পষ্ট হয়ে শোনা যাচ্ছিল। হেঁটে চলার সময় সে হঠাৎ থেমে গেল, কারণ অনুভব করল, সামনের ঝোপে একটা হরিণ শুয়ে আছে। অথচ এত অন্ধকারে এমনটা দেখা তার পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথা নয়। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অর্পিতা বুঝল, শুধু দেখা নয়, সে প্রাণীটার ভেতরের ভয়ের স্রোতও যেন অনুভব করতে পারছে—হরিণটি আহত, আর পালাতে চাইলেও অক্ষম। এই অভিজ্ঞতায় সে একদিকে শিউরে উঠল, অন্যদিকে অজানা উত্তেজনায় ভরে উঠল বুক। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ঝোপের দিকে ইশারা করল, আর অবিশ্বাস্যভাবে বাতাসের একটা ঝাপটা উঠে গিয়ে ঝোপের ডালগুলো আলাদা করে দিল। চাঁদের আলোয় হরিণটার শরীর ফুটে উঠল স্পষ্টভাবে। অর্পিতা ভয় পেয়ে দ্রুত হাত গুটিয়ে নিল, কিন্তু তার মনে হলো, নিছক ইশারাতেই যেন প্রকৃতি তার নির্দেশ মানল।
হাঁটতে হাঁটতে গ্রামে ঢোকার মুখে কিছু যুবককে দেখতে পেলো সে, যারা আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, “আজকে ওই মন্দিরে আবার কিছু ঘটেছে, আমি স্পষ্ট আলো দেখেছি।” অন্যজন হেসে উড়িয়ে দিল, “সবই ভুলভাল কল্পনা।” কিন্তু তাদের কথার ফাঁকে অর্পিতা হঠাৎ টের পেল, তাদের মনের অন্তর্গত ভাবনাগুলো তার কানে ভেসে আসছে। এক তরুণ মনে মনে ভাবছিলো, “কখন ওকে বলব ভালোবাসার কথা?” আরেকজনের মনে ভয়—“এখন বাড়ি না ফিরলে বাবা বকবে।” অর্পিতা হাঁটা থামিয়ে বিস্ময়ে চারপাশে তাকাল। সে বুঝতে পারছে, অন্যেরা যা শুধু মনে ভাবছে, তা-ও সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। এই অদ্ভুত ক্ষমতা তাকে বিভ্রান্ত করল। “না, এটা হতে পারে না,” সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার সেই অচেনা স্রোত বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। যেন মন্দিরে ঘটনার পর তার শরীর আর মনকে কেউ অন্য ছাঁচে গড়ে তুলছে।
বাড়িতে পৌঁছে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকাল। সাধারণত বাদামি রঙের চোখ এখন যেন মাঝে মাঝে নীলচে আভা ছড়াচ্ছে। চুলের গোড়ায় হালকা উজ্জ্বল রেখা, যেন আলোর স্পর্শ। অর্পিতা আতঙ্কে পেছনে সরে এল, তারপর হাত ধুতে গিয়ে খেয়াল করল—জল ছিটিয়ে ওঠা ফোঁটা এক মুহূর্তের জন্য মাঝ আকাশে থেমে রইল, তারপর ধীরে ধীরে নিচে পড়ল। সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। যদি কেউ দেখে ফেলে? যদি এই পরিবর্তন থামানো না যায়? বুকের ভেতরে ভয়ের পাশাপাশি আরেকটা অনুভূতি জেগে উঠল—অদ্ভুত এক শক্তির গর্ব। ছোটবেলা থেকে সে সবসময় নিজেকে সাধারণ ভেবেছিলো, ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা এক শিক্ষার্থী মাত্র। অথচ হঠাৎ করেই সে হয়ে উঠছে অস্বাভাবিক, এক অলৌকিক সত্তা। ভয়ের মতোই তীব্র আকর্ষণও তাকে আচ্ছন্ন করল।
কিন্তু রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে অর্পিতা বুঝতে পারল, এই পরিবর্তন কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলে ভেসে উঠছে অদ্ভুত দৃশ্য—কালো আকাশ, শ্মশানের আগুন, সমুদ্রের ঢেউ, সোনালি রথ, রক্তাভ চাঁদ। প্রতিটি দৃশ্য যেন তাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে অচেনা জগতে প্রবেশের, যেখানে দেবী আর শক্তির অবয়ব একে একে জেগে উঠছে। তার শরীরের ভেতরে কখনো আগুন জ্বলছে, কখনো অদ্ভুত শান্তি নেমে আসছে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘরের জানালা খুলে গেল ঝড়ো হাওয়ায়, অথচ বাইরে কোনো ঝড় নেই। সে ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করতে দৌড়ল, কিন্তু হাত রাখতেই দরজাটা নিজের থেকে বন্ধ হয়ে গেল জোরে। ভয়ে আর বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অর্পিতা। তখনই তার মনে হলো, নিজের শরীরের ভেতর থেকে কেউ ফিসফিস করছে—একটি নয়, বহু কণ্ঠ। তারা তাকে ডাকছে, পথ দেখাচ্ছে, আবার হুমকিও দিচ্ছে। অর্পিতা কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় ফিরে এল, বুকের ভেতর হাত চেপে ধরল, আর ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল—তার জীবন আর স্বাভাবিক রইল না। সে অজান্তেই এমন এক শক্তির অধিকারিণী হয়ে উঠেছে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তাকে ধ্বংস করে দেবে, আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তাকে নিয়ে যাবে অকল্পনীয় উচ্চতায়।
অধ্যায় ৩:
সারারাত অদ্ভুত দুঃস্বপ্নে কাটিয়ে যখন ভোরের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকল, অর্পিতা তখনও ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে জেগে শুয়ে ছিল। মাথা ধরে আছে, বুক ধড়ফড় করছে, আর চোখের ভেতরে ভেসে আছে আগের রাতের অদ্ভুত দৃশ্যগুলো। ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করছিল, কিছু একটা তার শরীরকে দখল করে নিচ্ছে। চারপাশের শব্দগুলো খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, এমনকি বাইরে দিয়ে হেঁটে যাওয়া দু’জন মানুষের কথাও যেন সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, যদিও তারা বেশ দূরে। ভয়ের পাশাপাশি ভেতরে এক অদ্ভুত টান কাজ করছিল, যেন কেউ তাকে বাইরে ডেকে নিচ্ছে। অবশেষে নিজেকে সামলে দরজা খুলে বাইরে বেরোল অর্পিতা। সকালের রোদ ঝলমলে, অথচ চারপাশ যেন অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ। সেই নিস্তব্ধতার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রবীণ পুরুষকে দেখে তার বুক কেঁপে উঠল। মাথায় ধূসর চুল, কপালে চন্দনের টিপ, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে কাঠের দণ্ড। লোকটি শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন তার আগমনের অপেক্ষাতেই ছিল।
অর্পিতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই লোকটি ধীর কণ্ঠে বললেন, “তুমি ভয় পেয়ো না, অর্পিতা। তোমার জন্যই আমি এসেছি।” সে থমকে দাঁড়াল, কপালে ভাঁজ পড়ল। “আমার নাম অচ্যুত আচার্য। তুমি হয়তো আমায় চিনবে না, কিন্তু আমি তোমার কথা জানি। তুমি সেই যন্ত্রধারিণী, যার শরীরে মহাশক্তির আসন হয়েছে।” অর্পিতার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। যন্ত্রধারিণী শব্দটা তার কানে অদ্ভুত এক ভার বহন করল। সে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “আপনি এসব বলছেন কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গে কী হচ্ছে? আমি চাই না এসব।” অচ্যুত আচার্য শান্ত চোখে তার দিকে তাকালেন। “তুমি যা চাও, বা না চাও, তাতে এখন আর কিছু যায় আসে না। তুমি যে রাতে ওই পরিত্যক্ত মন্দিরে প্রবেশ করেছিলে, তুমি ভেঙে দিয়েছিলে এক অসমাপ্ত যজ্ঞচক্র। সেই চক্র থেকেই তোমার শরীরে প্রবাহিত হয়েছে দশ মহাবিদ্যার শক্তি। এখন তুমি তাদের ধারক—যন্ত্রধারিণী। যদি তুমি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না শেখ, তবে তা শুধু তোমাকেই নয়, তোমার চারপাশকেও ধ্বংস করবে।”
অর্পিতা ভয়ে ও ক্ষোভে কাঁপতে লাগল। “কেন আমি? আমি তো সাধারণ মানুষ, গবেষণার জন্য গিয়েছিলাম মাত্র। এ সব আমার জীবনে কেন ঘটবে?” অচ্যুত আচার্য ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এলেন। তার কণ্ঠে কোনো ভীতি নয়, বরং এক অদ্ভুত আশ্বাস ছিল। “শক্তি কাউকে বেছে নেয়। তুমি ভেবেছিলে তুমি মন্দিরে দুর্ঘটনাক্রমে গিয়েছো, কিন্তু সত্যি হলো—তোমাকে সেখানে টেনে আনা হয়েছিল। দেবীরা তোমার মধ্যেই তাদের আসন খুঁজে পেয়েছেন। তাই তারা তোমার ভেতরে জেগে উঠেছেন। এখন তোমার সামনে দুটো পথ—এক, তুমি ভয় পেয়ে শক্তিকে অবদমন করতে চাও, তখন শক্তিই তোমাকে গ্রাস করবে। দুই, তুমি ধীরে ধীরে শিখবে নিয়ন্ত্রণ করতে, শিখবে ব্যবহার করতে, আর তখন তুমি হয়ে উঠবে সৃষ্টির আর ধ্বংসের সমন্বিত শক্তি।” অর্পিতা চোখ নামিয়ে ফেলল। মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল সেই ভয়ঙ্কর মুখগুলো, যা সে দেখেছিলো মন্দিরে—কালী, তারা, ছিন্নমস্তা, ভুবনেশ্বরী, আর সেইসব ভিন্ন ভিন্ন রূপ, যারা তার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। মনে হলো, আচার্যের কথা মিথ্যা নয়।
আচার্য এবার আস্তে করে তার হাতে হাত রাখলেন। “তুমি যা এখন অনুভব করছো—বাতাস নড়ানো, মনের কথা শোনা, স্বপ্নে বিভ্রম দেখা—এসবই কেবল শুরু। শক্তি তোমার মধ্যে একে একে দশ রূপে প্রকাশ পাবে। কালী তোমায় দেবে ধ্বংসের আগুন, তারা দেবে রক্ষার শক্তি, ছিন্নমস্তা শেখাবে আত্মসংযম, ভুবনেশ্বরী মাতৃত্বের দান করবে। আবার ধূমাবতী দেবে দুঃখ ও নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা, বগলামুখী দেবে শত্রুবিনাশের শক্তি, মাতঙ্গী দেবে জ্ঞান, ত্রিপুরাসুন্দরী দেবে মায়া আর সৌন্দর্য, ত্রিপুরাভৈরবী দেবে ভয়ঙ্কর তেজ, আর কমলা আশীর্বাদ করবেন সমৃদ্ধি দিয়ে। এই শক্তিগুলো তোমার ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি করবে, একে অপরের সাথে লড়াই করবে। তোমার কাজ হবে তাদের সামঞ্জস্য শেখা। যদি তুমি ব্যর্থ হও, তাহলে তারা তোমাকেই ভস্ম করে দেবে। আর যদি সফল হও, তাহলে তুমি হয়ে উঠবে এক মহাশক্তির আধার।” অর্পিতা আতঙ্কে সরে গেল, কিন্তু ভিতরে কোথাও একটা টান অনুভব করল—এই শক্তিকে সে অস্বীকার করতে পারবে না। আচার্যের চোখে দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল, যেন তিনি শুধু কথা বলছেন না, বরং তার আত্মায় প্রবেশ করছেন। অর্পিতা বুঝতে পারল, আর পালানোর রাস্তা নেই। এই অদ্ভুত নিয়তি তাকে স্বীকার করতেই হবে।
অধ্যায় ৪:
অর্পিতা আচার্যের কথা শোনার পর থেকে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিলো, বুকের ভেতর দিয়ে যেন বারবার আগুনের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। মাথা অকারণেই গরম হয়ে উঠছিল, সামান্য কিছুতেই সে রেগে যাচ্ছিল। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ফাঁকে সহপাঠীদের সাথে আলোচনা করতে গিয়ে হঠাৎ এক ছাত্রী তার কাজ নিয়ে ঠাট্টা করলে অর্পিতার চোখে যেন আগুন নেমে এল। ভেতর থেকে কেউ যেন চিৎকার করে উঠল—“ধ্বংস কর!” মুহূর্তের মধ্যে অর্পিতা এমন দৃষ্টিতে তাকাল যে মেয়েটি ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। চারপাশের বাতাস হঠাৎ ঘন হয়ে এল, জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল। অর্পিতার গলা দিয়ে ভিন্ন সুরে এক অদ্ভুত শব্দ বের হলো—যা তার নিজের নয়। মনে হলো যেন হাজার বছরের রাগ একসাথে জেগে উঠেছে। সে নিজেকে আটকাতে চাইছিল, কিন্তু তার হাত কাঁপছিল, আঙুলের ডগা থেকে যেন বিদ্যুতের ঝলক বেরোতে চাইছিল। তখনই তার সামনে ভেসে উঠল এক ভয়ঙ্কর রূপ—মহাকালী। জিহ্বা বের করা, গলায় খুলি, হাতে তরবারি—এক ভয়ঙ্কর নারীমূর্তি। অর্পিতা তার ভেতরে কালীকে অনুভব করল, এবং সেই অনুভূতি তাকে উত্তেজনায় ভরিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল, সামান্য ইশারাতেই সে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। সেই মুহূর্তে তার মনে আর ভয় ছিল না, বরং এক তীব্র ক্রোধ, এক অদম্য শক্তি, যা চারপাশকে গ্রাস করতে চাইছিল।
কিন্তু সেই ধ্বংসাত্মক রাগের মধ্যেই হঠাৎ অন্য এক অনুভূতি জন্ম নিল। বুকের ভেতর থেকে কোমল এক স্রোত ভেসে এল, যেন মাতৃস্নেহে ভরা এক শীতল স্পর্শ। অর্পিতা আচমকা থমকে গেল। ভেতরের আগুনকে ঠেলে সামনে এল এক নীলাভ শান্তি। চোখ বন্ধ করতেই সে দেখল—মহাতারা, শান্ত অথচ ভীষণ শক্তিশালী এক দেবী, যার কোলে আশ্রয় খুঁজে পায় ক্লান্ত ভক্তরা। কালী যেখানে তাকে ক্রোধে অগ্নিশিখার মতো করে তুলেছিল, সেখানে তারা এনে দিল গভীর শান্তি, রক্ষার বোধ, নিঃশর্ত ভালোবাসার প্রবাহ। অর্পিতা অনুভব করল, তার হাত যেটি ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল, সেই হাতই হঠাৎ থেমে গেল, এবং বুকের ভেতরে মাতৃত্বের এক অদ্ভুত আবেগ জেগে উঠল। যাকে কিছুক্ষণ আগেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল, সেই সহপাঠীর প্রতি করুণার বোধ জেগে উঠল। সে বুঝতে পারল, তার ভেতরে যে শক্তি কাজ করছে, সেটি দ্বিমুখী—একদিকে ধ্বংসের আগুন, অন্যদিকে রক্ষার মমতা।
তবে এই বিপরীত অনুভূতি তাকে বিভ্রান্ত করে তুলল। প্রতিবার সে চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় কালী—রক্তমাখা চোখ, ভয়ঙ্কর চেহারা, চিৎকার করে বলছে—“ধ্বংস কর, শেষ করে দাও।” আবার পর মুহূর্তেই ভেসে ওঠে তারার রূপ—“না, রক্ষা করো, বাঁচাও।” এই দ্বন্দ্বে অর্পিতা প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল। কখনো মনে হচ্ছিল সে সব ভেঙেচুরে ফেলবে, আবার কখনো মনে হচ্ছিল সে সবার মা হয়ে যাবে, সবাইকে আগলে রাখবে। রাতে ঘুম আসত না, শরীর কাঁপত, চোখে জল আসত। সে আচার্যের কাছে দৌড়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! আমার ভেতরে দুই বিপরীত সত্তা লড়াই করছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।” অচ্যুত আচার্য শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এটাই দশমহাবিদ্যার প্রথম উন্মেষ। কালী তোমাকে শক্তি দেবে ধ্বংসের, আর তারা তোমাকে শেখাবে রক্ষার পথ। এই দুই শক্তি বিরোধী নয়, বরং একই শক্তির দুই দিক। তোমাকে শিখতে হবে কবে কালী হয়ে উঠতে হবে, আর কবে তারার মতো আশ্রয় দিতে হবে।” অর্পিতা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, কিন্তু আচার্যের চোখে ছিলো দৃঢ় বিশ্বাস—এটাই তার নিয়তির পথ।
দিন গড়াতে অর্পিতা ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের এই দ্বন্দ্বকে উপলব্ধি করতে শুরু করল। সে লক্ষ্য করল, যখনই অন্যায় বা অপমানের মুখোমুখি হয়, কালী তার ভেতরে মাথা তোলে, তাকে ক্রোধে উন্মত্ত করে তোলে। আর যখনই কারও কষ্ট বা অসহায়তা দেখে, তখন তারা তার হৃদয়ে প্রবেশ করে, তাকে মাতৃত্বে ভরিয়ে তোলে। কখনো দু’টি অনুভূতি একইসাথে এসে তাকে টেনে ছিঁড়তে থাকে। অর্পিতা একদিকে ভয় পায়, কারণ বুঝতে পারে—যদি সে নিজেকে সামলাতে না পারে, তাহলে এক মুহূর্তেই ধ্বংস ডেকে আনবে। আবার অন্যদিকে মনে হয়—এই দ্বন্দ্বই তাকে পূর্ণ করছে, তাকে একসাথে ভয়ঙ্কর আর করুণাময়ী করে তুলছে। রাতের আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে ভাবত, হয়তো এটাই তার নিয়তি—শিখতে হবে কালী ও তারার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে, কারণ একা কালী তাকে রক্তপিপাসু করে তুলবে, আর একা তারা তাকে দুর্বল বানাবে। এই উপলব্ধি নিয়েই সে নতুন পথে পা রাখল—এক অচেনা সাধনার, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে শিখতে হবে নিজের ভেতরের আলো আর অন্ধকারকে একসাথে নিয়ন্ত্রণ করার পাঠ।
অধ্যায় ৫:
অর্পিতার ভেতরের পরিবর্তন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আগে সে ছিলো একেবারেই সাধারণ এক ছাত্রী—চুপচাপ বই পড়ত, লাইব্রেরিতে সময় কাটাত, আর মাঝে মাঝে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিত। কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে তার মধ্যে এক অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অনেকেই টের পেয়েছিল, তবে কেউ মুখ খোলেনি। কেবল ঋজু, যে অর্পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না, কিন্তু মাঝে মাঝে প্রজেক্ট বা আলোচনায় একসাথে কাজ করত, সে বিষয়টা লক্ষ করল গভীরভাবে। অর্পিতার চোখে মাঝে মাঝে যে অদ্ভুত ঝলক দেখা যেত, হঠাৎ রেগে গিয়ে আবার শান্ত হয়ে যাওয়া, অকারণেই চুপচাপ হয়ে যাওয়া—সবকিছুই ঋজুর কৌতূহল বাড়িয়ে তুলল। একদিন লাইব্রেরির কোণে অর্পিতাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সে এগিয়ে গেল। অর্পিতা বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেও আসলে তার মন অন্য কোথাও ছিল। ঋজু শান্ত গলায় বলল, “তুই কি ঠিক আছিস, অর্পিতা? কয়েকদিন ধরে তোকে আলাদা লাগছে।” অর্পিতা চমকে উঠে তাকাল, তার চোখে ছিল ক্লান্তি আর গোপন আতঙ্ক। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল, কারণ কারও কাছে নিজের ভেতরের ঝড়ের কথা বলা তো সহজ নয়।
প্রথমে অর্পিতা চুপ করে থাকল, এমনকি ঋজুর প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু ঋজু হাল ছাড়ল না। সে নিজের স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “দেখ, আমি জানি তুই হয়তো কিছু বলতে চাইছিস না, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তোর ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। সেটা ভয়ানক হোক বা অদ্ভুত হোক, তুই যদি বলতে চাস, আমি শুনব।” এই আন্তরিক কথাগুলো অর্পিতার ভেতরে চাপা পড়া আবেগকে নাড়া দিল। হঠাৎ তার মনে হল, সে একা নয়। এতদিন সে ভেবেছিল এই বোঝা তাকে একাই বইতে হবে, কিন্তু ঋজুর দৃষ্টিতে যে নির্ভরতা ছিল, সেটি তাকে ভরসা দিল। অর্পিতা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—প্রথমে খুবই সাধারণভাবে, কেবল দুর্ঘটনার কথা, মন্দিরে যাওয়া আর অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ। ঋজু গভীর মনোযোগে শুনছিল, কোনো প্রশ্ন না করে। কিন্তু যখন অর্পিতা বলে ফেলল যে সে মাঝে মাঝে ভেতরে ভয়ংকর শক্তি অনুভব করে, তখন ঋজুর চোখে বিস্ময়ের ঝলক দেখা গেল। কয়েক মুহূর্ত সে চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি জানি না এইসব তন্ত্রমন্ত্র বা শক্তির কথা কতটা সত্যি, কিন্তু তুই মিথ্যে বলছিস না। আমি তোকে বিশ্বাস করি।” এই কথাটি অর্পিতার জন্য ছিলো আশীর্বাদের মতো।
ঋজুর এই সমর্থন অর্পিতার জীবনকে নতুন মোড় দিল। অচ্যুত আচার্য তাকে প্রতিদিন শিক্ষা দিচ্ছিলেন—মন্ত্র, ধ্যান, আর নিজের ভেতরের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায়। কিন্তু আচার্যের শিক্ষার বাইরেও তাকে মানসিক সমর্থন প্রয়োজন ছিল, যা ঋজু তাকে দিতে শুরু করল। যখন অর্পিতা ভেতরে কালী আর তারার দ্বন্দ্বে ভুগত, তখন ঋজুই তাকে বুঝাত, “তুই ভয় পাবি না। তোর ভেতরে যে শক্তি আছে, সেটা তোর শত্রু নয়। সেটা তোর অংশ। তুই যদি তাকে বন্ধু ভাবিস, সে তোর পাশে দাঁড়াবে।” অর্পিতা কখনো রাগে নিজেকে সামলাতে পারত না, তখন ঋজুর কথা তাকে শান্ত করত। আবার যখন হঠাৎ কারও কষ্ট অনুভব করে তার চোখ ভিজে যেত, তখন ঋজুই তাকে বলত, “এটাই তো তোর আসল শক্তি—তুই অন্যের যন্ত্রণা বুঝতে পারিস।” এভাবে দু’জনের মধ্যে এক গভীর বন্ধুত্ব জন্ম নিতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যস্ত করিডোরেও, আড্ডার টেবিলেও, বা লাইব্রেরির নীরবতাতেও, তাদের কথোপকথন যেন অদৃশ্য এক আশ্রয় তৈরি করল অর্পিতার জন্য।
অচ্যুত আচার্যও ঋজুর উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন। একদিন তিনি অর্পিতাকে বললেন, “তোর শক্তির নিয়ন্ত্রণ শুধু সাধনার মাধ্যমে আসবে না। তোর হৃদয়কে শক্ত হতে হবে। আর সেই শক্তি আসে বিশ্বাস থেকে। ঋজুর প্রতি যে ভরসা তুই রাখিস, সেটাই তোকে রক্ষা করবে।” অর্পিতা তখন বুঝতে পারল—আচার্যের শিক্ষা আর ঋজুর বিশ্বাস, এই দুই মিলে তার ভিতরের শক্তিকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলছে। তার ভেতরে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিল। আর সেই আত্মবিশ্বাসই তাকে সামনে এগোনোর সাহস দিল। কালী ও তারা—ধ্বংস আর রক্ষার দ্বন্দ্ব এখনো চলছিল, কিন্তু অর্পিতা অনুভব করল, সে আর একা নয়। আচার্যের দীক্ষা তাকে পথ দেখাচ্ছে, আর ঋজুর বন্ধুত্ব তাকে মজবুত করে তুলছে। জীবনে প্রথমবার সে উপলব্ধি করল—অসাধারণ শক্তি থাকলেই যথেষ্ট নয়, বরং সেই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বাস, সমর্থন আর সম্পর্কের মমতা। এই উপলব্ধি নিয়েই অর্পিতা নিজের ভেতরের যন্ত্রণা মেনে নিয়ে যাত্রা চালিয়ে গেল—এক নতুন অধ্যায়ের পথে।
অধ্যায় ৬:
অর্পিতা ধীরে ধীরে নিজের শক্তিকে চিনতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে শিখছিল। অচ্যুত আচার্যের দীক্ষা ও ঋজুর সমর্থন তাকে ভরসা দিচ্ছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে জানত—এই যাত্রা এত সহজ হবে না। এক অজানা অশুভ উপস্থিতি যেন দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছিল, প্রতিদিনের ধ্যানের সময়ে তার মন হঠাৎই কেঁপে উঠত। সে বুঝতে পারত, কোথাও কেউ আছে, যে তার শক্তির প্রতি নজর রাখছে। এই অস্বস্তির মধ্যেই একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পুরনো নাট্যশালায় এক অদ্ভুত নারী তার সামনে এসে দাঁড়াল। গাঢ় নীল শাড়ি, ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, চোখে যেন অন্ধকারের দীপ্তি—তার নাম তিলোত্তমা। প্রথম পরিচয়ে সে নিজেকে এক গবেষক বলে পরিচয় দিল, যে প্রাচীন তন্ত্র ও শাক্ত সাধনার ওপর কাজ করছে। অর্পিতা চমকে উঠল, কারণ এতদিন সে একা মনে করেছিল এই পথে হেঁটে চলতে হচ্ছে। তিলোত্তমা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি তোমার ভেতরে কিছু ঘটছে। আমি সাহায্য করতে চাই।” কথাগুলো ছিল কোমল, কিন্তু অর্পিতার মনে হল এর আড়ালে কোনো অন্য উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে।
প্রথম দিকে তিলোত্তমা অর্পিতার কাছে ভরসাযোগ্য মনে হল। সে নানা প্রাচীন কাহিনি বলত—দশমহাবিদ্যার রহস্য, গুপ্ত সাধকদের অভিজ্ঞতা, এমনকি পুরনো গ্রন্থের উদ্ধৃতি। ঋজু আর অচ্যুত আচার্যের বাইরে এমন কাউকে পাওয়া, যে তার অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে শুনছে, অর্পিতার মনকে বিভ্রান্ত করল। তিলোত্তমা বলত, “অচ্যুত আচার্য যতই বয়স্ক ও জ্ঞানী হোন না কেন, তারা তো অতীতের মানুষ। নতুন যুগে নতুনভাবে শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।” অর্পিতা এই যুক্তিকে পুরোপুরি মানতে না পারলেও, তিলোত্তমার কথায় এক ধরনের আকর্ষণ ছিল। তিলোত্তমার আশেপাশে থাকলেই অদ্ভুত ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যেত, যেন কোনো অন্ধকার সত্তা তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে সে অর্পিতাকে গোপনে অদ্ভুত মন্ত্র শোনাত, যেগুলি শুনে অর্পিতার বুক কেঁপে উঠত, চোখে অন্ধকার ভেসে আসত। তবু তিলোত্তমার প্রতি এক ধরনের টান কাজ করছিল, আর সেই টানই তাকে দ্বিধায় ফেলছিল।
অচ্যুত আচার্য দ্রুতই তিলোত্তমার উপস্থিতি টের পেলেন। একদিন গুরুতর মুখে তিনি অর্পিতাকে সতর্ক করলেন, “তিলোত্তমা বিপজ্জনক। তার শক্তি অশুভ তন্ত্র থেকে উৎসারিত। সে সাহায্য করতে চায় না, বরং তোমার শক্তিকে দখল করতে চায়।” কিন্তু অর্পিতা তিলোত্তমার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে দ্বিধায় পড়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না, কাকে বিশ্বাস করবে। তিলোত্তমা যখন তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি যদি সত্যিই যন্ত্রধারিণী হও, তবে তোমার শক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটানো দরকার। আচার্য তোমাকে ভয় দেখাচ্ছেন, আটকে রাখছেন। আমি তোমাকে মুক্তি দিতে চাই,” তখন অর্পিতা এক অদ্ভুত টানে তার দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে তার ভেতরে কালী ও তারার দ্বন্দ্ব আরও জোরালো হয়ে উঠছিল। কালী তাকে তিলোত্তমার প্রতি সন্দেহ জাগাতে বলছিল, আর তারা মায়ের মতো সাবধান করছিল—“অন্ধকারকে কাছে টেনে নিও না।” অর্পিতা ভেতরে ভেতরে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিল, তার মন দ্বিধার ভারে কেঁপে উঠছিল।
তিলোত্তমা বুঝতে পারছিল, অর্পিতার ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছে। সে এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছিল। এক গভীর রাতে, চন্দ্রগ্রহণের সময়, তিলোত্তমা তাকে ডেকে পাঠাল। বলল, “আজ তোমার ভেতরের শক্তি সবচেয়ে প্রবল। যদি সাহস থাকে, তবে এসো।” অর্পিতা দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে সেখানে গেল। মন্দ আলোয় ভরা সেই জায়গায় অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা ছিল মাটিতে, চারপাশে জ্বলছিল কালো ধূপ। তিলোত্তমা মন্ত্র জপতে শুরু করতেই অর্পিতা অনুভব করল, তার ভেতরের শক্তি যেন টেনে নেওয়া হচ্ছে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল, চোখে ঝলকানি দেখা দিল। তখনই তার মনে পড়ল আচার্যের সতর্কবাণী, আর ঋজুর মুখে শোনা কথাগুলো—“তুই তোর শক্তিকে ভয় পাবি না। ওটা তোরই অংশ।” অর্পিতা ভেতরে এক অদ্ভুত সাহস অনুভব করল। সে তিলোত্তমার মন্ত্রচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু বুঝল—এটা এত সহজ নয়। তিলোত্তমা হেসে বলল, “এখন আর পালানোর সময় নেই, যন্ত্রধারিণী। তোমার শক্তি আমার হবে।” সেই মুহূর্তে অর্পিতা উপলব্ধি করল, তার পথ কেবল আলোকময় নয়, বরং অন্ধকারেরও প্রতিপক্ষ আছে। এবং সেই অন্ধকার ইতিমধ্যেই তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
অধ্যায় ৭:
অর্পিতার ভেতরে শক্তির জাগরণ ক্রমে তীব্রতর হচ্ছিল। তিলোত্তমার অশুভ মন্ত্রচক্র থেকে ফিরে আসার পর থেকেই তার মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হল। সে বুঝতে পারছিল, শক্তি শুধু নিয়ন্ত্রণের বিষয় নয়, বরং সেই শক্তিকে সঠিক পথে চালনা করাই তার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। কিন্তু তার মন যেন বিভক্ত—একদিকে কালী ও তারার দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে তিলোত্তমার ছলনাময় প্রলোভন। এই দোলাচলের মাঝেই একদিন ধ্যান করতে করতে হঠাৎই তার শরীর কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর থেকে যেন বজ্রঝড় ফেটে বেরোল, মাথার ভেতরে এক তীব্র আলো ভরে গেল। অর্পিতা দেখল, সে দাঁড়িয়ে আছে এক ভিন্ন জগতে—মহাশ্মশানের অগ্নিকুণ্ডের সামনে। সেখানে রক্তাভ আলোয় উদ্ভাসিত এক দেবী—ছিন্নমস্তা। নিজের মাথা কেটে হাতে ধরে আছেন তিনি, কিন্তু রক্তধারা ঝরছে বুক থেকে, আর সেই রক্ত তিনি নিজেই পান করছেন। দৃশ্যটি ভীতিকর অথচ মহিমান্বিত। অর্পিতা প্রথমে ভয়ে কেঁপে উঠল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই অনুভব করল—এ দৃশ্য ভয়ের নয়, বরং আত্মত্যাগের প্রতীক। ছিন্নমস্তার কণ্ঠ যেন তার ভেতরে ধ্বনিত হল—“নিজেকে জয় কর, তবেই শক্তি সত্য অর্থে তোমার হবে।”
অর্পিতার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু মনের গভীরে এক নতুন উপলব্ধি জন্ম নিচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, শক্তি মানে শুধু বাইরের শত্রুকে ধ্বংস করা নয়; সবচেয়ে বড় শত্রু লুকিয়ে থাকে নিজের ভেতরে—লোভ, অহংকার, ক্ষমতার মোহ। ছিন্নমস্তা যেন তাকে শেখালেন—নিজেকে সংযমে আনো, ত্যাগ করতে শিখো। নিজের ইচ্ছা, নিজের কামনা যদি ত্যাগ করতে না পার, তবে শক্তি তোমার হাত থেকে ফসকে যাবে। এই উপলব্ধি অর্পিতাকে কাঁপিয়ে দিল। এতদিন সে শক্তিকে ভয় পেত, আবার সেই শক্তি দিয়ে বাঁচতে চাইত। কিন্তু এবার সে বুঝল, শক্তি আসলে পরীক্ষা—যেখানে জয় মানে আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি। ধ্যানভঙ্গ হতেই অর্পিতা হাঁপাতে লাগল। ঋজু দৌড়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। অর্পিতা শুধু চোখ মেলে ফিসফিস করে বলল, “আমি ছিন্নমস্তাকে দেখেছি… তিনি বললেন, আমাকেই নিজেকে জয় করতে হবে।” ঋজু অবাক হলেও বুঝল, অর্পিতা আরও গভীর স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে।
ছিন্নমস্তার এই শিক্ষা অর্পিতাকে বদলে দিল। সে নিজের দৈনন্দিন জীবনে সংযম আনতে শুরু করল। অচ্যুত আচার্য লক্ষ্য করলেন, অর্পিতার চোখে আর সেই আতঙ্ক নেই, বরং আছে এক ধরনের শান্ত জেদ। আচার্য বললেন, “তুমি ছিন্নমস্তার দীক্ষা পেয়েছ। এবার তুমি বুঝতে শিখছ শক্তি মানে আত্মশুদ্ধি।” কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কয়েকদিনের মধ্যেই আরেক নতুন শক্তি তার ভেতরে প্রকাশ পেতে শুরু করল। ধ্যানের সময়ে এক অপরূপ আলো তার সামনে ভেসে উঠল—অপরিমেয় আকাশ, অসীম স্নিগ্ধতা, আর তার মধ্যে এক দেবী, ভুবনেশ্বরী। তাঁর মুখে মাতৃসুলভ কোমলতা, চোখে অশেষ করুণা। তিনি যেন সমগ্র বিশ্বকে নিজের বুকে ধারণ করেছেন। অর্পিতা তাঁর সামনে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলল। এতদিনের ভয়ের, বিভ্রান্তির, ক্ষোভের ভার যেন মুহূর্তে গলে গেল। ভুবনেশ্বরীর স্নেহময় উপস্থিতি তাকে শেখাল—শক্তি মানেই কেবল ধ্বংস নয়, শক্তি মানে সৃষ্টি, ভালোবাসা, মমতা।
ভুবনেশ্বরীর জাগরণ অর্পিতার মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন এক স্রোত বইয়ে দিল। সে অনুভব করল, তার ভেতরে মাতৃত্বের এক বিশাল ঢেউ বইছে। সে শুধু নিজের বাঁচার কথা ভাবছিল না, বরং চারপাশের মানুষদের রক্ষা করার দায়িত্ব অনুভব করছিল। ঋজু একদিন বলেছিল, “তোকে দেখে মনে হয়, তুই একদিকে ভয়ংকর ঝড়, আবার অন্যদিকে আশ্রয়ের ছাতা।” এবার অর্পিতা সেই কথার আসল অর্থ বুঝতে পারল। ভুবনেশ্বরী তাকে শিখিয়েছিলেন, শক্তির আসল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বকে রক্ষা করা, ভালোবাসা দেওয়া। সেই মুহূর্তে তার মনে হল, হ্যাঁ, এই শক্তি যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে তা কারও সর্বনাশ নয়, বরং সকলের মঙ্গল। অচ্যুত আচার্য মৃদু হেসে বললেন, “এখন তুমি ভারসাম্যের পথে পা রেখেছ। ছিন্নমস্তা তোমাকে সংযম শিখিয়েছে, ভুবনেশ্বরী তোমাকে করুণা দিয়েছে। এ দুটো ছাড়া কোনো শক্তিই সম্পূর্ণ নয়।” অর্পিতা গভীরভাবে মাথা নত করল। সে জানত, তার সামনে আরও অনেক পরীক্ষা আছে, কিন্তু এবার তার ভেতরে ভয় কমে গেছে। সে বুঝেছে—আলো আর অন্ধকার দুটিই তার ভেতরে আছে, আর সত্যিকারের শক্তি হলো এই দুইয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখা।
অধ্যায় ৮:
অর্পিতার জীবন যেন একের পর এক অদৃশ্য দরজা খুলে দিচ্ছিল, প্রতিটি দরজার ওপারেই অপেক্ষা করছিল নতুন এক দেবীর রূপ, নতুন এক শক্তির অভিঘাত। ছিন্নমস্তা ও ভুবনেশ্বরীর দীক্ষার পর সে কিছুটা ভারসাম্য খুঁজে পেয়েছিল। ভেবেছিল—এবার হয়তো শক্তির যাত্রা সহজ হবে, এবার হয়তো তার ভেতরে কেবল শান্তি ও করুণার আলোয় ভরে উঠবে। কিন্তু ভাগ্যের খেলা অন্যরকম। এক অমাবস্যার রাতে ধ্যান করতে বসে হঠাৎ তার ভেতরে প্রবল কম্পন জাগল। বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো, মস্তিষ্ক জুড়ে এক ভয়ানক অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল। সে অনুভব করল—ত্রিপুরা-ভৈরবী, ধূমাবতী আর বগলামুখী একসঙ্গে তার ভেতরে উথলে উঠেছে। প্রথমে সে বিভ্রান্ত হয়ে গেল, মাথার ভেতর যেন হাজার ঝড় একসঙ্গে বইছে। চোখে ভেসে উঠল ভৈরবীর অগ্নিময় দৃষ্টি, ধূমাবতীর ধ্বংসস্তূপে ভরা শূন্যতা, আর বগলামুখীর তীব্র রোষে জমাট বাঁধা প্রতিশোধস্পৃহা। এই তিন শক্তি মিলে অর্পিতাকে এমন তাণ্ডবময় অবস্থায় ঠেলে দিল, যা আগে সে কল্পনাও করেনি। তার শ্বাস ভারী হয়ে উঠল, শরীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে লাগল, আর মনের মধ্যে এমন ক্রোধ জন্ম নিল যে মনে হচ্ছিল সে মুহূর্তেই পৃথিবী ভস্ম করে দিতে পারবে।
এই তাণ্ডবময় অভিজ্ঞতা তাকে শুধু বিভ্রান্তই করছিল না, ধীরে ধীরে তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করতে শুরু করেছিল। ত্রিপুরা-ভৈরবীর শক্তি তাকে অকল্পনীয় ক্রোধে ভরিয়ে তুলছিল—তার মনে হচ্ছিল, এতদিন যারা তাকে আঘাত করেছে, যারা তাকে উপহাস করেছে, সবাইকে সে এক নিমিষে ছাই করে দেবে। ধূমাবতীর প্রভাব তাকে গভীর দুঃখ আর নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত করল। মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে তার কোনো আশ্রয় নেই, তার লড়াই একাকীত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর বগলামুখীর শক্তি তাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলছিল। হঠাৎই তার মনে হচ্ছিল, ঋজুও কি সত্যিই তাকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করছে, নাকি গোপনে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে? অচ্যুত আচার্যও কি সত্যিই তার মঙ্গল চান, নাকি তার শক্তিকে ব্যবহার করতে চান? এই সন্দেহ, অবিশ্বাস আর রোষ মিলেমিশে তার ভেতরে এক অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে দিল। সে নিজেই যেন নিজের ভয়ঙ্করতম শত্রু হয়ে উঠছিল। একসময় অর্পিতা অনুভব করল, তার শরীর থেকে অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছে, ঘরের জিনিসপত্র কাঁপছে, বাতাস শো শো শব্দে বয়ে যাচ্ছে। সে আয়নায় তাকাতেই দেখল—তার চোখ লাল হয়ে জ্বলছে, মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, যেন তার ভেতরের দেবীরা রূপ নিয়ে তাকে গ্রাস করতে চাইছে।
এই ভয়ংকর মুহূর্তেই আবির্ভাব ঘটল তিলোত্তমার। সে যেন সব আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। ঘূর্ণিঝড়ের মতো অর্পিতার অগ্নিগর্ভ শক্তির মধ্যে তিলোত্তমা এসে দাঁড়াল, তার চোখে এক অদ্ভুত কুটিল হাসি। সে কোমল স্বরে বলল, “দেখছিস তো, শক্তি কেমন ভয়ানক হতে পারে? তোকে কেউ সামলাতে পারবে না, এমনকি তোর আচার্যও না। তুই যদি সত্যিই মুক্তি চাস, যদি সত্যিই নিজের ক্ষমতার আসল রূপ জানতে চাস, তবে তোর ভেতরের রোষ, দুঃখ আর প্রতিশোধকে আটকাবি কেন? ওদের মুক্ত করে দে, পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দে। তুই দেবী হয়ে জন্মেছিস, মানুষের মতো দুর্বল হয়ে বাঁচতে হবে না।” তিলোত্তমার কথা অর্পিতার কানে বিষের মতো ঢুকছিল। তার ভেতরের বগলামুখী শক্তি এই প্রলোভনের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, হ্যাঁ, সে যদি সব বাঁধন ছিঁড়ে দেয়, তবে তার শক্তি অপ্রতিরোধ্য হবে। এক মুহূর্তের জন্য অর্পিতা সত্যিই ভাবল—সে কি তিলোত্তমার পথেই পা বাড়াবে?
কিন্তু সেই তাণ্ডবময় অবস্থার ভেতরেও অর্পিতার মনে কোথাও যেন ভুবনেশ্বরীর করুণার স্মৃতি টিকে ছিল, ছিন্নমস্তার ত্যাগের শিক্ষা অল্প হলেও জেগে ছিল। তার চোখে ভেসে উঠল ঋজুর মুখ—যে সত্যিই তাকে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু তারপরও তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আচার্যের দৃঢ় কণ্ঠ মনে পড়ল—“শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাই আসল পথ, অন্যথায় শক্তি তোকে গ্রাস করবে।” এই স্মৃতিগুলো মনের অন্ধকারে ছোট ছোট প্রদীপের মতো জ্বলে উঠল। যদিও ক্রোধ আর প্রতিশোধের ঢেউ তাকে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তবুও তার ভিতরে এক ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বলছিল—না, এ পথ সঠিক নয়। তিলোত্তমা তখনও তার কানে ফিসফিস করে যাচ্ছিল—“তুই যদি আমার সঙ্গে আসিস, তোর ভেতরের তিন দেবীর শক্তি আমার হাতে অর্পণ করিস, তবে তুই অমরী হবে। কেউ তোকে ঠেকাতে পারবে না।” কিন্তু অর্পিতা হঠাৎই চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নিল। সে অনুভব করল—তার ভেতরে আলো আর অন্ধকারের ভয়ংকর সংঘাত চলছে। সে জানে, ভুল করলে সব শেষ। ধীরে ধীরে সে নিজের হাত জোড় করল, মনে মনে প্রার্থনা করল সেই শক্তির কাছে, যে তাকে ভারসাম্য শেখাবে। তাণ্ডব থামল না, কিন্তু অন্তরে এক ক্ষুদ্র প্রতিরোধ জেগে উঠল। হয়তো সেটাই তাকে ভাসমান রাখতে যথেষ্ট ছিল। তিলোত্তমার চোখে তখন তীব্র হতাশা—সে বুঝল, অর্পিতা এখনও পুরোপুরি তার ফাঁদে পড়েনি।
অধ্যায় ৯:
অর্পিতার জীবনের সেই কঠিন সন্ধিক্ষণ—যখন ত্রিপুরা-ভৈরবীর ক্রোধ, ধূমাবতীর শূন্যতা আর বগলামুখীর প্রতিশোধস্পৃহা তাকে প্রায় গ্রাস করতে যাচ্ছিল—তখনই তার অন্তরের গভীর থেকে এক আশ্চর্য আলোকধারা জন্ম নিল। এই আলো ছিল অন্ধকারের বিপরীতে দাঁড়ানো এক শান্ত ও স্নিগ্ধ শক্তি, যা ধীরে ধীরে তার অস্থির চিত্তকে স্থির করে তুলল। প্রথমে সে এক কোমল সুর শুনতে পেল, যেন বাঁশির মূর্ছনা অথবা সরোদে বাজানো কোনো মধুর রাগ। সুরের সেই আবাহনে তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলেন মাতঙ্গী—জ্ঞান, সঙ্গীত ও কলার দেবী। তিনি অর্পিতার কানে ফিসফিস করে বললেন, “শক্তির প্রকৃত অর্থ ধ্বংস নয়, সৃষ্টি। জ্ঞানের আলোই তোর প্রকৃত পথ।” মাতঙ্গীর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে অর্পিতার চারপাশের অগ্নি ও অশান্তি যেন মুছে গিয়ে কোমল আলোয় ভরে উঠল। তার ভেতরে এতদিন যে সন্দেহ, রাগ, হতাশা ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেগুলো যেন সুরের তালে ধীরে ধীরে গলে গেল। অর্পিতা অনুভব করল—শক্তি মানে শুধু বাহ্যিক ক্ষমতা নয়, মনের গভীর শান্তি আর শিল্পসৃষ্টি। এই উপলব্ধি তাকে প্রথমবার মনে করাল, সে কেবল মহাবিদ্যার বাহক নয়, বরং জ্ঞানের আলোরও রক্ষক।
এরপরই তার চোখে ফুটে উঠল আরেক আশ্চর্য দৃশ্য—ত্রিপুরা-সুন্দরীর রূপ। তিনি যেন মহাজগতের মায়াবী রাণী, রূপ ও সৌন্দর্যের প্রতীক। ত্রিপুরা-সুন্দরীর আবির্ভাব ছিল যেন বসন্তের প্রথম দিনের মতো, চারিদিকে আলো, ফুলের গন্ধ, আর অদৃশ্য স্নিগ্ধতার পরশ। তিনি অর্পিতাকে শিখিয়ে দিলেন—সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক সাজ নয়, বরং মানুষের হৃদয়ে প্রেম, করুণা আর সামঞ্জস্য জাগানোর এক অদৃশ্য শক্তি। অর্পিতার হৃদয়ে তখন নতুন এক আবেগ জন্ম নিল—সে বুঝতে পারল, শক্তির পথ কেবল লড়াই বা প্রতিশোধে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের হৃদয় জয় করার মধ্যেই প্রকৃত মহিমা। ত্রিপুরা-সুন্দরীর প্রভাবে তার হৃদয়ে প্রেমের আলো ফুটল, জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম নিল। সে প্রথমবার উপলব্ধি করল, যন্ত্রধারিণীর পথ কেবল যুদ্ধের পথ নয়—এটি প্রেম, সৌন্দর্য ও সামঞ্জস্যেরও পথ। তার চোখের কোণে তখন অশ্রু জমল, কিন্তু সেটি দুঃখের অশ্রু নয়, বরং এক অজানা প্রশান্তির।
মাতঙ্গী ও ত্রিপুরা-সুন্দরীর আলোকধারায় অর্পিতা যেন এক নবজন্ম লাভ করল। তার মনের ভিতরে শিল্পের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল—সে অনুভব করল, সে চাইলে শব্দ দিয়ে সৃষ্টি করতে পারে, চিত্রে জীবন আনতে পারে, কিংবা সুরে পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। এতদিন যে শক্তিকে সে ভয় পেত, এখন সেই শক্তি তার কাছে এক অসাধারণ দান বলে মনে হলো। অচ্যুত আচার্যের শিক্ষা হঠাৎই স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে—শক্তি মানে কেবল নিয়ন্ত্রণ নয়, শক্তি মানে সৃষ্টি ও সুষমা। অন্যদিকে ত্রিপুরা-সুন্দরীর প্রভাবে সে বুঝতে পারল, মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যকে না জাগালে শক্তি কখনো পূর্ণতা পায় না। তার হৃদয়ে তখন ঋজুর কথা ভেসে উঠল—যে তাকে ভয় পেয়েও পাশে দাঁড়িয়েছিল। অর্পিতার মনে হল, হয়তো তার ভেতরে জন্ম নেওয়া প্রেমও এই শক্তিরই এক প্রকাশ। তার চোখে তখন ঋজুর উপস্থিতি নতুন আলোয় ধরা দিল—সে বুঝতে পারল, এই লড়াই কেবল নিজের নয়, বরং দুজনের।
এভাবেই মাতঙ্গী ও ত্রিপুরা-সুন্দরীর আশীর্বাদে অর্পিতা অন্ধকারের গভীর গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল। তার ভেতরে যে ভীতি, বিভ্রান্তি আর ধ্বংসস্পৃহা ছিল, সেগুলো এখন জ্ঞানের আলো ও সৌন্দর্যের রূপে রূপান্তরিত হলো। সে বুঝতে পারল—যদি কালী ও তারা ধ্বংস আর রক্ষার প্রতীক হন, ছিন্নমস্তা ও ভুবনেশ্বরী আত্মসংযম আর করুণার শিক্ষা দেন, তবে মাতঙ্গী ও ত্রিপুরা-সুন্দরী হলেন সেই সেতু, যারা অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসেন। তাদের প্রভাবে অর্পিতার মধ্যে জন্ম নিল এক নতুন উপলব্ধি—সে কেবল একজন শক্তিধারিণী নয়, বরং জ্ঞান, প্রেম আর সৌন্দর্যের আলোকবাহকও। এই উপলব্ধি তাকে মানসিকভাবে দৃঢ় করল। তিলোত্তমার ফাঁদ যতই ভয়ংকর হোক না কেন, সে জানল—আলো থাকলে অন্ধকার কখনো জয়ী হতে পারে না।
অধ্যায় ১০:
অর্পিতার অন্তরের যাত্রা এতদিন ধরে ছিল এক অন্তহীন দ্বন্দ্বের পথ—কখনো ক্রোধ, কখনো ভয়, কখনো ধ্বংস, আবার কখনো করুণা ও সৃষ্টির শক্তি। কিন্তু সবকিছুর পর অবশেষে এল সেই মুহূর্ত, যখন তার ভেতরের সব শক্তি একত্রিত হয়ে সমবেত সুরে ধ্বনিত হলো। আকাশ যেন ঝলসে উঠল, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা, আর তার সামনে আবির্ভূত হলেন দশম মহাবিদ্যা—মহামায়া কমলা। তিনি ছিলেন এক অসামান্য রূপসী, অথচ সেই রূপের গভীরে লুকিয়ে ছিল সমৃদ্ধি, শান্তি ও পূর্ণতার অমৃতধারা। কমলার আগমন যেন পৃথিবীতে শস্যের ভাণ্ডার উন্মুক্ত হওয়ার মতো, যেন পদ্মফুলে ভরা সরোবর অর্পিতার হৃদয়ের সামনে ফুটে উঠল। তিনি মৃদু হাসি দিয়ে অর্পিতাকে বললেন, “তুমি যে সমস্ত শক্তি অনুভব করেছ, তা কোনো বিচ্ছিন্ন খণ্ড নয়। কালী থেকে শুরু করে সুন্দরী পর্যন্ত, প্রতিটি রূপই জীবনের একেকটি দিক। আমি তাদের মিলনের প্রতীক। আমাতে ধ্বংসও আছে, করুণাও আছে, সৃজনও আছে, পূর্ণতাও আছে। এ সব একসাথে বুঝতে পারলেই নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।” অর্পিতা বিস্ময়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল, এতদিন সে যে ভয় ও দ্বন্দ্বের মধ্যে ডুবে ছিল, সেগুলো আসলে একে অপরের পরিপূরক মাত্র।
কিন্তু এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গেই আবার সামনে এসে দাঁড়াল তার প্রধান প্রতিপক্ষ—তিলোত্তমা। রহস্যময়ী নারীটি তখন আর কেবল প্রতারণার মুখোশে ঢাকা ছিল না; তার চোখ লাল হয়ে জ্বলছিল, সারা শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল অশুভ তন্ত্রশক্তির দাউদাউ আগুন। সে চিৎকার করে উঠল, “অর্পিতা, তুই যদি সত্যিই যন্ত্রধারিণী হয়ে থাকিস, তবে তোর ভেতরের এই শক্তি আমাকে দে! আমি হব মহাশক্তির একমাত্র অধিকারিণী।” অর্পিতা তখন আর আগের মতো ভয় পেল না। কমলার আশীর্বাদে তার ভেতরে যে স্থিরতা জন্মেছিল, তা তাকে দৃঢ় করে তুলল। সে অনুভব করল, দশ মহাবিদ্যার সম্মিলিত শক্তি তার ভেতরে স্রোতের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। তিলোত্তমার অশুভ শক্তি যতই তাকে আক্রমণ করুক না কেন, অর্পিতা বুঝতে পারল—অন্ধকারকে পরাজিত করার জন্য আলোর প্রয়োজন নেই, বরং তাকে গ্রহণ করেই আলোকে উজ্জ্বল করতে হয়। এই উপলব্ধি থেকেই সে তিলোত্তমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “শক্তি দখল করার নয়, শক্তি ভাগ করার। তুই যদি গ্রহণ করতে পারিস, তবে এই শক্তি তোরও হতে পারে।” কিন্তু তিলোত্তমার অহংকার তাকে পিছিয়ে আসতে দিল না—সে অন্ধ আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর সেই মুহূর্তে অর্পিতা দশ মহাবিদ্যার মিলিত শক্তি দিয়ে এক জ্যোতির্ময় তরঙ্গ ছড়িয়ে দিল, যা তিলোত্তমাকে ভস্ম করে দিল। তার আর্তচিৎকার আকাশে মিলিয়ে গেল, আর পৃথিবী আবার শান্ত হলো।
অর্পিতা তখন অনুভব করল, যুদ্ধটা আসলে বাইরের কারও সঙ্গে নয়—যুদ্ধটা ছিল নিজের ভেতরের বিভ্রান্তি, অস্থিরতা আর ভয়কে জয় করার। কমলার আশীর্বাদে সে উপলব্ধি করল, শক্তি মানেই কেবল বাহ্যিক ক্ষমতা নয়, বরং জীবনকে পূর্ণ করে তোলার এক সামগ্রিক অভিজ্ঞতা। তার ভেতরে কালী এখনো আছে, কিন্তু আর ভয়ের প্রতীক নয়—বরং অশুভ ধ্বংসের শক্তি। তারা তাকে এখনো রক্ষা করছে, ছিন্নমস্তা তাকে আত্মসংযম শিখিয়েছে, ভুবনেশ্বরী মাতৃত্ব দিয়েছে, ভৈরবী দৃঢ়তা দিয়েছে, ধূমাবতী শূন্যতার স্বাদ শিখিয়েছে, বগলামুখী তাকে শত্রুর মুখ বন্ধ করার ক্ষমতা দিয়েছে, মাতঙ্গী জ্ঞানের আলো দিয়েছে, সুন্দরী প্রেম ও সৌন্দর্যের পথ দেখিয়েছে। আর কমলা সবগুলোকে একত্রিত করে তাকে পূর্ণ করেছে। এই উপলব্ধি তাকে মানসিকভাবে এমন উচ্চতায় পৌঁছে দিল, যেখানে আর বিভ্রান্তি নেই—শুধু শান্তি ও নিয়ন্ত্রণ। সে বুঝল, নিয়ন্ত্রণ মানে শক্তিকে বেঁধে রাখা নয়, বরং তাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। এই জ্ঞানই ছিল তার প্রকৃত বিজয়।
গল্পের শেষ মুহূর্তে অর্পিতা আর আগের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাধারণ গবেষক রইল না। সে যেন এক নবজন্ম লাভ করল। তার চারপাশে তখন ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে, পাখিরা ডেকে উঠছে, আর বাতাসে মিশে আছে শস্যের গন্ধ। সে পদ্মফুলে ভরা এক সরোবরের ধারে দাঁড়িয়ে অনুভব করল—সে আর কেবল অর্পিতা নয়, বরং শক্তি ও করুণার এক মিলিত রূপ, এক যন্ত্রধারিণী, যে ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে। তার চোখে তখন আর ভয় বা বিভ্রান্তি নেই—বরং গভীর প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস। সে জানত, পথ এখনো দীর্ঘ, চ্যালেঞ্জ এখনো আসবে, কিন্তু সে আর একা নয়। দশ মহাবিদ্যা তার ভেতরে চিরকাল জেগে থাকবে, আর তাদের মিলনই তার সত্যিকারের শক্তি। গল্প শেষ হলো তার নবজন্মের প্রতীকে—এক নারী, যে শুধু নিজেকে নয়, পৃথিবীকে আলো দেখাতে প্রস্তুত।
শেষ