Bangla - রহস্য গল্প

দত্তবাড়ির সিন্দুক

Spread the love

সৌরভ বসু


এক

শহরের এক প্রান্তে, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায় আর গলিপথের শেষে ঝোপঝাড়ে ঢাকা অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে দত্তবাড়ি। এককালে প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর গৌরবের প্রতীক ছিল এই প্রাসাদসদৃশ বাড়িটি, যার বিশাল খিলান, রঙচটা বারান্দা আর কাঠের দরজাগুলো একসময় শহরের মানুষকে বিস্ময়ে মুগ্ধ করত। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে যেন ইতিহাসও তাকে বিস্মৃত করেছে। কেউ আর কাছে আসে না, ধীরে ধীরে চারদিকের দেওয়ালে শেওলা জমেছে, ছাদ থেকে ইট খুলে পড়ে যায়, জানালার কাঁচ ভেঙে ঝুলে থাকে বাতাসে আর ভিতরের ঘরগুলো ধুলোয় ঢাকা অন্ধকারে ডুবে থাকে। মানুষ বলে—দত্তবাড়ি অভিশপ্ত, আর সেই অভিশাপের ছায়া পুরো বাড়িটার উপর গাঢ় কুয়াশার মতো ছড়িয়ে আছে। দিনের বেলায়ও কেউ যদি সাহস করে কাছে যায়, চারদিকে এক ভয়ানক শূন্যতা আর হিমশীতল বাতাস শরীর কাঁপিয়ে দেয়, মনে হয় যেন অদৃশ্য চোখের দৃষ্টি কারও পিছু নিচ্ছে। যে কোলাহল শহরের বাকি অংশে নিরবচ্ছিন্নভাবে ধ্বনিত হয়, সেই শব্দ এখানে এসে নিস্তব্ধ হয়ে যায়, যেন বাড়ির দেয়ালগুলো নিজেরাই শব্দ গিলে নেয়। মানুষ বহুদিন ধরে বলে আসছে, রাত নামলেই বাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে আলো জ্বলে ওঠে—হলুদাভ, টিমটিমে আলোর রেখা। অথচ সেখানে তো কারও থাকার কথা নয়। আরও শোনা যায়, ভেতর থেকে কারও ফিসফিসানি ভেসে আসে, যেন অদৃশ্য লোকেরা কথা বলছে, কখনও ঝগড়া করছে আবার কখনও একসাথে অচেনা কোনো মন্ত্র পড়ছে। কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষরা এই শব্দে আতঙ্কে কেঁপে ওঠে, কেউ কেউ কান বন্ধ করে শুয়ে পড়ে, আবার কেউ রাতের অন্ধকারে মশাল হাতে দত্তবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ এগিয়ে যেতে সাহস করে না। শহরের বাচ্চারা খেলার ছলে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ দেয়—কে রাত বারোটায় গিয়ে বাড়ির দরজায় নক করতে পারে। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ কেউ পূর্ণ করে ফিরে এসেছে এমন গল্প শোনা যায় না।

বাড়িটির ইতিহাস নিয়েও নানা রহস্য রটেছে। অনেক পুরোনো লোকজন বলে, এই বাড়ির দত্ত পরিবার ছিল একসময় শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী জমিদার পরিবার। তাদের অঢেল সম্পদ, জমিজমা, রাজনীতির প্রভাব—সবই ছিল। কিন্তু সেই পরিবারের পতনও হয়েছিল ভীষণ রহস্যময়। শোনা যায়, শেষ প্রজন্মে পরিবারে এক ভয়াবহ খুন সংঘটিত হয়—এক ভাই অন্য ভাইকে উত্তরাধিকারের জন্য নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। সেই হত্যার পরে বাড়ির ভেতর শুরু হয় নানা অদ্ভুত ঘটনা। রাতে চাকরবাকররা শুনতে পেত করুণ আর্তনাদ, দেয়ালে হাত ঘষার শব্দ, কিংবা খালি পায়ে কারও হাঁটার ছন্দ। ধীরে ধীরে চাকররা একে একে পালিয়ে যায়, আর বাড়ি হয়ে ওঠে নির্জন। দত্ত পরিবারের বাকি লোকেরা হয় মারা যায়, নয়তো শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে দত্তবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে একা, সময়ের স্রোতে ভুলে যাওয়া এক নিস্তব্ধ ভৌতিক স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। অথচ শহরের সাধারণ মানুষের মনে তার ভয়াবহতা আরও ঘনীভূত হয়েছে কারণ কৌতূহলী যারা এগিয়ে গেছে, তারা আর কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। কেউ নিখোঁজ, কেউ আবার ফিরে এসে অস্বাভাবিক নীরব হয়ে গেছে, যেন ভিতরে কিছু দেখেছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কেউ কেউ আবার বলে, তাদের শরীরের ভেতর থেকে ভেসে আসে অদ্ভুত শব্দ, যেন তাদের ভিতরে অচেনা কেউ বাস করছে। এইসব গল্প শুধু গুজব কিনা, না সত্যি, কেউ জানে না; কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, ততই দত্তবাড়ির চারপাশে রহস্য আরও গাঢ় অন্ধকারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রতিটি সন্ধ্যায়, যখন সূর্যাস্তের লাল আভা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন মানুষরা নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়ে আর গলিপথ ফাঁকা হয়ে যায়। কুকুর পর্যন্ত সেই পথ এড়িয়ে চলে। মনে হয়, শহর নিজেই এক অলিখিত নিয়ম মানে—অন্ধকার নামার পর দত্তবাড়ির কাছাকাছি যাওয়া মানেই অদৃশ্য শক্তিকে জাগিয়ে তোলা।

কিন্তু সবকিছুর মাঝেও মানুষের মনে ভয় আর কৌতূহল পাশাপাশি জন্ম নেয়। যারা অনেকটা দূর থেকে দত্তবাড়ির দিকে তাকায়, তারা ভাবে—আসলেই কি বাড়ির জানালায় আলো জ্বলে ওঠে, না কি চোখের ভুল? যারা রাতের নিস্তব্ধতায় ফিসফিসানি শোনে, তারা ভাবে—ওগুলো বাতাসের খেলা, না কি সত্যিই অদৃশ্য আত্মারা এখনো ওই দেওয়ালের ভেতরে বাস করে? অনেক সময় রাস্তায় হাঁটা মানুষদের মনে হয়, বাড়ির ভাঙা বারান্দা থেকে কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ বলে, তারা সাদা শাড়ি পরা এক মহিলার অবয়ব দেখেছে, যার মুখ নেই; কেউ বলে, একজন বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর তাদের নাম ধরে ডেকেছিল। পুলিশ কিংবা প্রশাসন কখনও এই গল্পগুলোকে আমল দেয়নি, কিন্তু শহরের সাধারণ মানুষদের কাছে এগুলো নিছক কল্পনা নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শোনা গেছে এই কাহিনি, তাই দত্তবাড়ি যেন হয়ে উঠেছে শহরের ভয়ের প্রতীক। সেখানে কেউ বসবাস করে না, কেউ বসবাস করতে চায়ও না। অথচ, সেই শূন্যতা আর নীরবতার মাঝেই লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক টান। দত্তবাড়ি যেন নিজেই ডাকছে মানুষকে, সাহসীদের জন্য অপেক্ষা করছে। হয়তো কোনো একদিন আবার কেউ সাহস করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে, আর সত্যিটা উদ্ঘাটন করবে। কিন্তু আপাতত দত্তবাড়ি রয়ে গেছে—নীরব, স্থির, অথচ অদৃশ্য জীবন্ততায় ভরা। তার প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি জানালা, প্রতিটি ফাঁকা ঘর যেন কথা বলতে চায়, ফিসফিসিয়ে বলতে চায় অতীতের ভয়ঙ্কর কাহিনি। আর তাই এই বাড়িকে শহরের মানুষ শুধু একটি ভাঙাচোরা স্থাপনা বলে ভাবে না—তাদের কাছে এটা এক জীবন্ত অভিশাপ, এক নীরব দানব, যার অস্তিত্ব অন্ধকার রাতের সাথে একাত্ম হয়ে আছে।

দুই

দত্তবাড়ি নিয়ে যেমন ভয়ের গল্প প্রচলিত, তেমনি তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক পুরোনো সিন্দুকের কথাও বহু বছর ধরে কানাঘুষো হয়ে বেড়িয়েছে গ্রাম-শহরের আনাচে-কানাচে। লোকেরা বলে, বাড়ির অন্দরমহলের এক অন্ধকার ঘরে, বহু পুরোনো এক লোহার সিন্দুক পড়ে আছে, যেটা কোনো মানুষ আজ পর্যন্ত খোলার সাহস করেনি। সিন্দুকটা নাকি এত ভারী যে চার-পাঁচজন মানুষ মিলে তুললেও নড়ানো যায় না, আর তার গায়ে খোদাই করা আছে অচেনা চিহ্ন, যেগুলো সাধারণ অক্ষর বা নকশা নয়, বরং অদ্ভুত রহস্যময় প্রতীক, যেগুলো দেখলেই শরীর কেঁপে ওঠে। গ্রামের প্রবীণ লোকেরা বলে, ওই সিন্দুকেই বন্দি আছে দত্তবাড়ির আসল ইতিহাস, সেই ভয়ানক কাহিনি যা পরিবারটিকে ধ্বংস করেছিল। কেউ বলে সেখানে রক্তমাখা দলিল আছে, কেউ বলে খুনের অস্ত্র, আবার কেউ বলে, সিন্দুকের ভেতরে আছে অভিশপ্ত কোনো মূর্তি কিংবা গুপ্তধন, যেটা নিয়ে অশুভ শক্তি ভর করেছে গোটা বাড়ির উপর। এসব গল্প এতবার শোনা গেছে যে এখন দত্তবাড়ির নাম উচ্চারণ করলে সিন্দুকের কথাও সমানভাবে উঠে আসে, আর মানুষ ভাবে—সিন্দুকটা আসলেই আছে কি না, নাকি মানুষের কল্পনার ফসল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই কানাঘুষোর মাঝে মাঝে এমন সব তথ্য ভেসে ওঠে যা নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কয়েক দশক আগে নাকি এক চোর সাহস করে রাতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছিল গুপ্তধনের খোঁজে। সকালে তার দেহ পাওয়া যায় বাড়ির বারান্দায়, চোখ দুটো বিস্ফারিত আর মুখ হাঁ করে জমে গেছে, যেন কোনো অদৃশ্য আতঙ্ক তাকে শেষ মুহূর্তে গ্রাস করেছিল। কেউ কেউ বলে, সে সিন্দুকের সামনে গিয়েই এমন অবস্থায় মারা গিয়েছিল, যেন সিন্দুকের ভেতর থেকে কোনো দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করে দিয়েছিল।

শহরের মানুষরা আবার এই সিন্দুক নিয়ে নানা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। কেউ বলে, দত্ত পরিবারের শেষ জমিদার ছিলেন এক গোপন তান্ত্রিক সাধক, যিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে রক্তবলির মাধ্যমে অশুভ শক্তির আশীর্বাদ চাইতেন। তার সব গোপন দলিলপত্র, যজ্ঞের সামগ্রী, আর সেই অভিশাপের মূল সূত্র তিনি বন্দি করেছিলেন সিন্দুকে। তাই সেই সিন্দুক ভাঙা মানেই অশুভ শক্তিকে মুক্ত করে দেওয়া। আবার অন্য এক গোষ্ঠী বিশ্বাস করে, পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরে শেষ রাতে সমস্ত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দলিলপত্র ওই সিন্দুকে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করেছিল। যিনি সিন্দুকের আসল চাবি রেখেছিলেন, তিনি হঠাৎ এক রহস্যময় অগ্নিকাণ্ডে মারা যান। ফলে আজও সিন্দুক তালাবদ্ধ পড়ে আছে, আর ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস সময়ের সাথে সাথেই মানুষের মনে আরও অদ্ভুত কৌতূহল আর ভয়ের জন্ম দিচ্ছে। এইসব গল্প ছড়িয়ে পড়েছে এতটাই যে দূরের গ্রাম থেকেও মানুষ কেবল দত্তবাড়ির সিন্দুকের গল্প শোনার জন্য আসে। গ্রামের হাটে কিংবা শহরের চায়ের দোকানে রাতের আড্ডায় কেউ না কেউ এই সিন্দুকের গল্প তোলে, আর সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মনে হয় যেন সবাই একসাথে বুঝতে পারে—এই গল্প শুধু মজা করার জন্য নয়, বরং এর মধ্যে সত্যিই কোনো অদ্ভুত অজানা শক্তি কাজ করছে। এমনকি, শহরের স্কুলের বাচ্চারা যখন ভূতের গল্প করে, তখন দত্তবাড়ির সিন্দুকের গল্প তাদের সবচেয়ে প্রিয়। তারা একে অপরকে ভয় দেখায়, “সিন্দুকটা একদিন খোলা হলে শহরটা মাটির তলায় চলে যাবে,” বা “ওর ভেতরে শয়তান বন্দি আছে।” যদিও এসব গল্প অতি বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, কিন্তু মানুষের মুখে মুখে এতবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে তা এখন শহরের সম্মিলিত বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

তবুও, মানুষের মনে প্রশ্ন থেকেই যায়—সিন্দুকটা আসলে কী? কেন এত ভয় জড়ানো আছে এর চারপাশে? অনেকে বলে, সাহসী হলে গিয়ে দেখে আসা উচিত, কিন্তু কথাটা বলা যতটা সহজ, কাজে ততটাই অসম্ভব। রাত নামার পর কেউ দত্তবাড়ির কাছাকাছি যেতেই ভয় পায়, দিনের আলোতেও কেউ ভেতরে ঢোকার সাহস করে না। মাঝে মাঝে কিছু লোক শহরে এসে দাবি করে তারা সিন্দুকের ভেতরের সত্য জানে। কেউ বলে ওটা অভিশপ্ত সম্পদ, কেউ বলে আত্মাদের কারাগার, আবার কেউ বলে, সিন্দুকের ভেতরে এমন এক দলিল আছে যা যদি প্রকাশ পায়, তবে শহরের সম্মানী পরিবারগুলোর ইতিহাস ধুলোয় মিশে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য হলো, এই দাবিগুলোর কোনোটাই প্রমাণিত হয়নি। সিন্দুক রয়ে গেছে বন্ধ, তার রহস্য অক্ষত, আর মানুষের কল্পনা দিন দিন আরও ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, দত্তবাড়ির নীরবতা যতটা ভয়ঙ্কর, তার থেকেও ভয়ঙ্কর হলো এই সিন্দুকের চারপাশে গড়ে ওঠা লোককাহিনি। যেন বাড়ির দেয়ালগুলো শুধু ভৌতিক ইতিহাস ধারণ করছে না, বরং সিন্দুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা সত্য ধীরে ধীরে বাইরের মানুষের মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের ভয়, কৌতূহল আর কল্পনার ফাঁদে দত্তবাড়ির সিন্দুক এক অদৃশ্য বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে—একটা বাস্তবতা, যেটা চোখে দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। যে শহরে দত্তবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে এখনকার প্রজন্মও জানে, বাড়ির নাম উচ্চারণ হলেই সিন্দুকের গুজবও ফিরে আসে, যেন তারা একে অপরের সাথে বাঁধা। তাই সিন্দুক শুধু একটা পুরোনো লোহার বাক্স নয়; সেটা হয়ে উঠেছে এক অজানা আতঙ্ক, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে আসা অভিশপ্ত উত্তরাধিকার, যেটা একদিন হয়তো কেউ সত্যি সত্যি উন্মোচন করবে—আর তখন শহরের ভাগ্য কোন পথে যাবে, তা কেউই অনুমান করতে পারে না।

তিন

সেই রাতটা ছিল এক ভীষণ ঝড়ো রাত, শহরের গলিপথে হাহাকার করা বাতাস ছুটে যাচ্ছিল, আর বজ্রপাতের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য বারবার ভেসে উঠছিল দত্তবাড়ির ভাঙাচোরা প্রাচীর আর ফাঁকফোকর ভরা জানালা। শহরের মানুষজন ঘরে গুটিয়ে বসেছিল, কেউ বাইরে বেরোবার সাহস করেনি, কিন্তু সেই ভৌতিক অন্ধকারের মধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিল দুজন তরুণ—রাহুল আর সায়ন্তন। রাহুল ছিল এক কৌতূহলী গবেষক, যিনি ইতিহাস আর লোককথার অদ্ভুত টান থেকে মুক্ত হতে পারতেন না। তার কাছে দত্তবাড়ি কেবল ভয়ের স্থান ছিল না, বরং ছিল এক অমূল্য গবেষণার ক্ষেত্র, যেখানে সত্য-মিথ্যার জাল ছিঁড়ে হয়তো বেরিয়ে আসবে অজানা কোনো ইতিহাস। তার সঙ্গী সায়ন্তন ছিল খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত, তবুও বন্ধুর উচ্ছ্বাস আর নিজের ভেতরের লুকোনো রোমাঞ্চপ্রিয়তা তাকে এই ঝড়ের রাতে টেনে এনেছিল দত্তবাড়ির সামনে। যখন তারা বাড়ির বিশাল লোহার গেট ঠেলে খুলল, সেটা এক অদ্ভুত কর্কশ শব্দে গোটা প্রাঙ্গণ কাঁপিয়ে তুলল, যেন বাড়ি নিজেই তাদের আগমনে চমকে উঠল। ভেতরে ঢুকেই তারা অনুভব করল, বাইরের ঝড়ের গর্জনের থেকেও ভয়ানক নীরবতা এখানে বিরাজ করছে, যেন এই বাড়ি আর বাইরের পৃথিবী আলাদা এক সময়ের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে শুকনো পাতার স্তূপ, ভাঙা টালি আর কচকচে ধুলো পায়ে মিশে এক অচেনা গন্ধ তৈরি করছিল। তারা টর্চ জ্বালাতেই আলোর রেখা ধরা দিল দেয়ালে ঝুলে থাকা ছেঁড়া ছবিগুলোয়—মলিন মুখ, চিরুনিতে আঁচড়ানো মতো ভাঙা রঙ, চোখগুলো যেন এখনো জীবন্ত, অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

তারা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল বাড়ির ভেতরে। ভাঙা দরজা ঠেলে পেরোতেই তাদের সামনে দেখা দিল সেই জীর্ণ সিঁড়ি, যেটা উপরের তলায় ওঠার একমাত্র রাস্তা। কাঠের সিঁড়ির ধাপগুলো পচে গেছে, প্রতিটি ধাপ পা রাখলেই কেঁপে উঠছিল, যেন তাদের ওজন সহ্য করতে পারছে না। রাহুল টর্চের আলো ফেলল সিঁড়ির পাশের দেওয়ালে, আর সায়ন্তন আঁতকে উঠল—সেখানে অদ্ভুত দাগ, যেন কেউ রক্তমাখা হাত টেনে নিয়ে গেছে উপরের দিকে। রাহুল শান্ত গলায় বলল, “এটা হয়তো মরিচা বা রঙের দাগ, ভয় পেও না।” কিন্তু তার নিজের চোখে তখনো এক অদ্ভুত ভয়ের ছায়া খেলা করছিল। উপরে উঠতেই তারা টের পেল, প্রতিটি ঘর যেন সময়ের কাছে হার মানা কবরের মতো—ভাঙা আসবাবপত্র, ছেঁড়া জানালার পর্দা, দেওয়ালের ফাটল থেকে বের হওয়া লতাগুল্ম আর নিস্তব্ধতায় ভেসে আসা অদৃশ্য কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। হঠাৎ করেই তারা একটা ঘরে ঢুকে পড়ল, আর সেখানে দেখা গেল কয়েকটা প্রতিকৃতি ছবি এখনো টাঙানো আছে। ছবির লোকগুলো সব দত্ত পরিবারের, হয়তো জমিদার আর তার স্ত্রী, কিন্তু ছবির মুখগুলো ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, যেন সময় তাদের মুছে দিতে চেয়েছে। সায়ন্তন ফিসফিস করে বলল, “এরা সবাই কি তখন…?” তার গলা শুকিয়ে গেল, বাক্য শেষ করতে পারল না। রাহুল ছবির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, “আমাদের যেটা খুঁজতে হবে, সেটা এখানেই কোথাও আছে… সিন্দুক।” বাইরে ঝড়ের বজ্রপাত তখন তাদের কথার সাথে সাথে এক অদ্ভুত ছন্দে মিলছিল, যেন প্রকৃতিই তাদের অনুসন্ধানকে ভয়ঙ্কর এক অভিশাপের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

তাদের অনুসন্ধান থামল না। তারা এগোতে লাগল আরও ভেতরে, আর প্রতিটি দরজা ঠেলে ঢুকতেই মনে হচ্ছিল যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তাদের পথ দেখাচ্ছে, অথবা আরও গভীরে ঠেলে দিচ্ছে। একটা ঘরের ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ মেঝের উপর একটা ভাঙা খাটের পাশে পাওয়া গেল এক পুরোনো ডায়েরি। রাহুল সেটা তুলে টর্চের আলোয় পড়তে শুরু করতেই দেখা গেল ভেতরে অচেনা হস্তাক্ষরে লেখা কিছু ভাঙাচোরা বাক্য—“অভিশাপ… সিন্দুক… মুক্তি নেই…”। এই কয়েকটা শব্দ পড়েই সায়ন্তনের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ করেই বাতাস যেন থমকে গেল, আর ভাঙা জানালা দিয়ে কানে এলো ফিসফিস করার মতো অদ্ভুত আওয়াজ। তারা দুজনেই বুঝতে পারল, এই বাড়ি শুধু ভাঙাচোরা ইট আর কাঠের সমাহার নয়, বরং এর মধ্যে সত্যিই লুকিয়ে আছে অদৃশ্য জীবন্ততা। ভয় আর কৌতূহলের মাঝেই তারা এগিয়ে গেল এক বিশাল দরজার সামনে, যেটা অদ্ভুতভাবে বন্ধ ছিল। দরজায় হাত দিতেই সেটা হালকা ঠেলাতেই খুলে গেল, আর ভেতরে দেখা দিল এক অন্ধকার ঘর। ঘরের মাঝখানে কেমন যেন ভারী কোনো বস্তু রাখা আছে, কিন্তু ঝড়ো রাতের টর্চলাইটের আলোয় সেটার স্পষ্ট রূপ ধরা পড়ল না। তবে তাদের বুকের ভেতর তীব্র স্পন্দন শুরু হলো, যেন তারা সেই কিংবদন্তির সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাহুল মৃদু গলায় বলল, “আমরা হয়তো সিন্দুকের কাছাকাছি চলে এসেছি।” ঝড় তখন বাইরে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল ভেতরের নিস্তব্ধতা, যা মনে হচ্ছিল দম আটকে দেবে। সায়ন্তন অনুভব করল, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন অজানা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তবুও ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা তার ভেতরে জন্ম নিল না। কারণ দত্তবাড়ির ভেতরে তারা একবার প্রবেশ করেছে, আর এখন এই অভিশপ্ত বাড়িই যেন তাদের নিজের হাতে ধরে গভীর অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।

চার

অন্ধকার ঘরের গভীরে টর্চের আলো যখন ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াতে লাগল, তখনই রাহুল ও সায়ন্তনের চোখ পড়ল ঘরের এক কোণে থাকা সেই বিশাল লোহার সিন্দুকের উপর। প্রথমে যেন ওটা কেবল একটা সাধারণ মরচেধরা বাক্স, কিন্তু টর্চের আলোয় ধীরে ধীরে যখন তার গা ভেসে উঠল, তখন তারা বুঝতে পারল—এটা কোনো সাধারণ সিন্দুক নয়। চারপাশে ধুলো জমে থাকা মেঝের মধ্যেও সিন্দুকের চারপাশে যেন অদ্ভুত এক আঁচড়ের দাগ রয়েছে, যেন সময়ের সাথে সাথে কেউ বারবার এটাকে নড়াতে চেষ্টা করেছে কিন্তু কখনো সফল হয়নি। সিন্দুকের উপরে মরিচা জমে গাঢ় লালচে রঙ ধরেছে, যেন রক্ত জমে শক্ত হয়ে গেছে। ভারী লোহার তৈরি সিন্দুকটা এত বড় যে দুজন মানুষ মিলেও সেটা সহজে নাড়াতে পারবে না। উপরে খোদাই করা আছে অচেনা প্রতীক, যা দেখতে মন্ত্রের অক্ষরের মতো, আর তাকালেই মনে হচ্ছিল যেন প্রতীকগুলো অদৃশ্য আলো ছড়াচ্ছে, এক অদ্ভুত চেতনার মতো চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভয়। সায়ন্তন আঁতকে উঠল, তার গলা শুকিয়ে এল, সে ফিসফিস করে বলল, “এটা… এটা নিশ্চয়ই সেই সিন্দুক।” রাহুল টর্চটা কাছে এনে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল প্রতীকগুলো, তার মনে হচ্ছিল, কোনো অচেনা শক্তি তাকে এই রহস্যের গভীরে ডেকে নিচ্ছে। তাদের দুজনের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল, কারণ তারা বুঝতে পারছিল—এটা শুধু একটা বাক্স নয়, বরং দত্তবাড়ির সেই অভিশপ্ত ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু, যার চারপাশে এত গল্প, এত ভয়, এত কানাঘুষো ছড়িয়ে আছে। বাইরে ঝড় তখন আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল, জানালার কাঁচ ভেঙে হাহাকার করা বাতাস ভেতরে ঢুকে ঘরের আলোকে দুলিয়ে দিচ্ছিল, আর সেই দুলুনি সিন্দুকের ছায়াকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছিল।

রাহুল সিন্দুকের তালাটা লক্ষ্য করল। সেটা ছিল অস্বাভাবিক মোটা আর শক্ত লোহার তৈরি, এতটাই যে সাধারণ কোনো হাতুড়ি বা যন্ত্র দিয়েও ভাঙা সম্ভব হবে না। মরচে জমে তালাটা আরও অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেছে, যেন এক মৃত প্রাণীর খুলি ঝুলছে সিন্দুকের গায়ে। সায়ন্তন কাঁপা গলায় বলল, “এটা খোলা সম্ভব নয়, চল আমরা এখান থেকে বের হয়ে যাই।” কিন্তু রাহুলের চোখে তখন এক অদ্ভুত আলো, তার ঠোঁটের কোণে কৌতূহলের ছায়া—সে যেন ভয়কে উপেক্ষা করেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে হাত দিয়ে সিন্দুকের গায়ে চাপ দিল, ঠাণ্ডা ধাতব স্পর্শে তার আঙুল জমে গেল, আর হঠাৎ করেই সে অনুভব করল সিন্দুকের ভেতর থেকে এক হালকা শব্দ ভেসে আসছে। সেটা কোনো যন্ত্রের মতো শব্দ নয়, আবার পুরোপুরি মানুষের কণ্ঠও নয়—বরং অদ্ভুত চাপা একটা শব্দ, যেন কেউ ভেতর থেকে শ্বাস নিচ্ছে, কিংবা ধীরে ধীরে দেয়ালে নখ ঘষছে। সায়ন্তন আতঙ্কে পিছিয়ে গেল, তার মনে হচ্ছিল বুক ফেটে বেরিয়ে যাবে, কিন্তু রাহুল ঝুঁকে কান লাগাল সিন্দুকের গায়ে। তখন আরও স্পষ্টভাবে শোনা গেল সেই শব্দ—মৃদু গর্জন, ফিসফিস আর কণ্ঠের মতো কিছু, যেন কোনো বন্দি প্রাণ ভেতরে আটকে আছে। বজ্রপাতের আলোয় হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সিন্দুকের মরচে ধরা পাটাতন কেঁপে উঠল, যেন ভেতরের কিছু মুক্তি পেতে চাইছে। সায়ন্তন হিম হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “রাহুল, এটা স্বাভাবিক নয়, আমরা ভুল করছি।” রাহুল নিঃশব্দে জবাব দিল, “সত্যি জানার একমাত্র উপায় এই সিন্দুক।”

তাদের সামনে তখন দ্বন্দ্ব—ভয় নাকি কৌতূহল। সায়ন্তনের মনে হচ্ছিল, এখনই এই অভিশপ্ত ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু রাহুলের চোখে দেখা যাচ্ছিল এক অদ্ভুত নেশা, যেন সে আর ফিরতে পারছে না। সিন্দুকের গা থেকে আসা চাপা শব্দ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছিল, এখন যেন স্পষ্ট ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল। শব্দগুলো অচেনা ভাষায়, হয়তো প্রাচীন কোনো মন্ত্র, কিন্তু তবুও তাদের মনের গভীরে ঢুকে পড়ছিল। সায়ন্তন কানে হাত দিল, কিন্তু শব্দটা যেন ভেতর থেকেই শোনা যাচ্ছে, বাইরের বাতাসে নয়। রাহুলের ঠোঁট শুকিয়ে গেল, কিন্তু তার চোখে তখনো গবেষকের কৌতূহল—সে টর্চের আলোয় খুঁজছিল কোনো ফাঁক, কোনো চাবির ছিদ্র, কোনো গোপন সংকেত। আর ঠিক তখনই হঠাৎ সিন্দুকের তালাটা টুক করে শব্দ করল, যেন ভেতর থেকে কেউ তা নেড়ে দিল। দুজনেই আঁতকে উঠল, টর্চ কেঁপে উঠল তাদের কাঁপা হাতে, আর ঘরের নিস্তব্ধতার মধ্যে স্পষ্ট শোনা গেল—একটা ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ। বাইরের ঝড় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, কেবল ভেতরের সেই চাপা শব্দ গুমগুম করে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, আর মনে হচ্ছিল দত্তবাড়ির প্রতিটি দেয়াল তার সাথে একসাথে শ্বাস নিচ্ছে। রাহুল আর সায়ন্তন দুজনেই বুঝে গেল—তাদের আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই, তারা সত্যিই দত্তবাড়ির সেই অভিশপ্ত রহস্যের কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে, আর সিন্দুকের ভেতরে যা-ই থাকুক, সেটা তাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে।

পাঁচ

রাহুল আর সায়ন্তন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করার পর অবশেষে সেই মরচেধরা সিন্দুক খুলতে সক্ষম হলো। প্রথমে তালার ভেতরের যান্ত্রিক অংশগুলো খুলে গিয়ে এক অদ্ভুত কাঁপুনি উঠেছিল পুরো বাড়িতে, যেন বহু বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা কোনো অদৃশ্য শক্তি আচমকা জেগে উঠেছে। সিন্দুকের ভারী দরজা এক গর্জনের শব্দে যখন খুলল, তখন দুজনের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। টর্চের আলো ভেতরে ফেলতেই দেখা গেল সিন্দুকের তলায় ছেঁড়া কাগজপত্র, পুরোনো দলিল আর কিছু বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবি ছড়িয়ে আছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য ছিল সেই রক্তমাখা কাগজগুলো। যেন রক্ত আজও শুকোয়নি, কাগজের প্রান্তে হালকা লালচে আভা টর্চের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল। রাহুল কাগজটা হাতে তুলতেই সারা শরীর শিউরে উঠল—এটা কোনো সাধারণ নথি নয়, এর গায়ে এমন এক ভয়ের ছাপ লেগে আছে, যা শব্দে প্রকাশ করা কঠিন। সায়ন্তনও বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, চোখে আতঙ্ক, ঠোঁটে নিঃশব্দ প্রশ্ন—“এটা আসলে কী?”

তারা ধীরে ধীরে দলিলগুলো উল্টে দেখতে শুরু করল। পুরোনো দলিলের মধ্যে জমির কাগজপত্র, দত্তবাড়ির সম্পত্তির বিবরণ, আর কিছু আইনি চুক্তি পাওয়া গেল, যা ইতিহাসের নির্দিষ্ট এক অংশকে সামনে আনছিল। কিন্তু রক্তমাখা কাগজের টুকরোগুলো আলাদা করে শিহরন জাগাচ্ছিল। প্রথম কাগজটিতে কেবল কয়েকটি অস্পষ্ট শব্দ বোঝা যাচ্ছিল—“খুন”, “চক্রান্ত”, “রক্তের দায়”। দ্বিতীয় কাগজের অর্ধেক অংশে যেন কলম দিয়ে আঁচড় কেটে লেখা ঢাকা হয়েছিল, তবে কিছু শব্দ তখনও পড়া যাচ্ছিল—“দত্তবাড়ির উত্তরাধিকার”, “গোপন সাক্ষী”, “অন্ধকার রাত”। তৃতীয় কাগজে কিছু লেখা প্রায় মুছে গেলেও সেখানে আঁকা ছিল রক্তে ভেজা আঙুলের ছাপের মতো দাগ। এই সব দেখে দুজনেই বুঝল, বিষয়টা কেবল সম্পত্তি বা পারিবারিক দলিল নয়—এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো মারাত্মক অপরাধের প্রমাণ, যা ইচ্ছে করে কেউ সিন্দুকের ভেতর বন্দি করে রেখেছিল। তারা টর্চের আলোয় এক এক করে ছবি দেখতে লাগল—একটিতে দেখা যাচ্ছে দত্তবাড়ির সদর দরজার সামনে পরিবারের সকলের ছবি, আরেকটিতে এক অচেনা মহিলার মুখ, যার চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। ছবিগুলো যেন অতীতের কোনো নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

ভয় আর কৌতূহলের মাঝখানে রাহুল আর সায়ন্তন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল, দত্তবাড়ি নিয়ে যে সব গুজব গ্রাম-শহরে ছড়িয়ে আছে, তার পেছনে সত্যিই কিছু লুকিয়ে আছে। শুধু অভিশাপের গল্প নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে রক্ত, খুন আর চক্রান্তের অন্ধকার ইতিহাস। সায়ন্তন কাঁপা গলায় বলল, “রাহুল, এটা যদি সত্যি হয়, তবে আমরা এমন এক রহস্যের দরজা খুলে ফেলেছি, যার ভেতরে ঢুকলে হয়তো ফিরে আসা সহজ হবে না।” রাহুল চুপ করে কাগজগুলো টর্চের আলোয় ঘনিষ্ঠভাবে পড়ার চেষ্টা করছিল, তার চোখে এক ধরনের উন্মাদ কৌতূহল। সে জানত, ইতিহাসের অধ্যয়ন শুধু বইয়ের পাতা দিয়ে হয় না—কখনও কখনও তাকে ছুঁয়ে যেতে হয় অতীতের রক্তাক্ত বাস্তবতাকে। কিন্তু সেই বাস্তবতা যতটা আকর্ষণীয়, ততটাই বিপজ্জনকও। সিন্দুকের ভেতর পাওয়া দলিলগুলো যেন তাদের ডাকছিল, বলছিল—“আমাদের পড়ো, আমাদের বুঝো, তাহলেই সত্যিটা জানবে।” কিন্তু সেই সত্য কতটা ভয়ংকর হতে চলেছে, তা তারা তখনও কল্পনাও করতে পারেনি।

ছয়

রাহুল আর সায়ন্তন সিন্দুক থেকে উদ্ধার করা দলিলপত্র ও রক্তমাখা কাগজের প্রমাণ নিয়ে তদন্ত শুরু করল। তারা শহরের পুরনো আর্কাইভ, লাইব্রেরি এবং স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে ধীরে ধীরে দত্তবাড়ির অতীতের এক জটিল ছবি তৈরি করতে শুরু করল। জানা গেল, দত্ত পরিবার একসময় শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং ধনী জমিদার পরিবার ছিল। তাদের বিশাল সম্পদ, অসংখ্য জমিজমা এবং রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। সেই প্রাচুর্য এবং ক্ষমতার ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক গভীর দ্বন্দ্ব—এক ভাই অন্য ভাইয়ের ওপর হিংসা, ঈর্ষা এবং সম্পত্তির লোভে বিভীষণ রূপ নেয়। প্রবীণরা বলে, একসময় সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বৈরিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রাত্রে এক ভাই অন্য ভাইকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। ইতিহাসের পুরনো সংবাদপত্র এবং আর্কাইভের দলিলগুলো বলছিল, শহরবাসী প্রথমে এই দুর্ঘটনাকে একটি দুর্ঘটনা মনে করেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সত্যটা প্রকাশ পায়। শহরের মানুষ চোখ খুলে দেখে যে দত্তবাড়ির ভেতরে শুধু সম্পত্তি নয়, বরং রক্তমাখা প্রতিশোধ এবং এক চক্রান্তের খাঁটি ইতিহাস লুকিয়ে ছিল।

তদন্ত যত এগোতে থাকে, রাহুল ও সায়ন্তন বুঝতে পারে যে দত্তবাড়ির ভিতরের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি কোণের নিস্তব্ধতা সেই অতীতের সাক্ষী। তারা জানতে পারে, দত্ত পরিবারের ভাইদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুধু সম্পত্তি নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না; এতে ছিল রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক মর্যাদা, এবং শহরের ক্ষমতার কেন্দ্রটি দখল করার লোভ। ভাইদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি চোখের দৃষ্টি সন্দেহ আর ভয়ের ছাপ ফেলে। পরিবারে এক ভয়ঙ্কর খুন সংঘটিত হয়—এক ভাইকে হত্যা করে, আর তার রক্তে লেখা দলিল, দলিলপত্র ও গুপ্তনথি সিন্দুকের ভেতরে রাখা হয়। এই রক্তমাখা দলিলগুলো শহরের ইতিহাসে লুকিয়ে থাকা এক অন্ধকার অধ্যায়ের পরিচায়ক। প্রবীণরা আরও বলে, সেই রাতে দত্তবাড়ির ভেতরে যে চিৎকার শুনা গিয়েছিল, তা শুধুই কল্পনা নয়, বরং শহরের প্রাচীন লোকেরা সত্যিই তা শুনেছিল। পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, বাকি সদস্যরা পালিয়ে যায় বা একে একে মারা যায়, আর দত্তবাড়ি হয়ে দাঁড়ায় নিঃসঙ্গ, ভাঙাচোরা প্রাসাদ, যা রাত্রে টর্চের আলোতে ভয়ঙ্কর ছায়া বিস্তৃত করে।

ধাপে ধাপে রাহুল ও সায়ন্তন বুঝতে পারে, এই দ্বন্দ্ব কেবল পারিবারিক সমস্যা নয়, বরং শহরের ইতিহাস, মানুষের বিশ্বাস, এবং কৌতূহলের সঙ্গে গাঁথা এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। তারা দলিলপত্র থেকে জানে, ভাইদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণ শুধু সম্পদ বা ক্ষমতা নয়, বরং প্রতিটি সিদ্ধান্তে ছিল এক অদৃশ্য শক্তির ছায়া—যদি কেউ একবার ভুল পথে যায়, তার জীবন আর আত্মার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে। রক্তমাখা দলিল, অচেনা চিহ্ন, এবং ভাঙা ছবি সব মিলিয়ে দেখাচ্ছে যে দত্তবাড়ির নীরবতা, ভাঙা দরজা আর ঝড়ের রাতে ফিসফিসানি কেবল কল্পনা নয়, বরং অতীতের রক্তমাখা ইতিহাসের জীবন্ত প্রতিফলন। এই ইতিহাস তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—দত্তবাড়ির ভেতরের নীরবতা, সিন্দুকের চাপা শব্দ, আর ভাঙা ঘরের নিস্তব্ধতা সবই সেই রক্তাক্ত অতীতের অদৃশ্য সাক্ষী। রাহুল ও সায়ন্তন উপলব্ধি করে যে, তারা শুধু একটি পুরোনো বাড়ির রহস্য খুঁজে বের করছে না; তারা এক পুরো শহরের, এক প্রজন্মের ভুল এবং চক্রান্তের মধ্যে লুকানো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

সাত

রাহুল এবং সায়ন্তন যখন সিন্দুকের ভেতরের রক্তমাখা কাগজগুলো খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল, তখন ধীরে ধীরে তাদের সামনে ধরা পড়ল এই দলিলগুলোর প্রকৃত রূপ। প্রথমে মনে হয়েছিল এগুলো শুধু খুন আর চক্রান্তের অস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করছে, কিন্তু যত পড়া হলো, তত স্পষ্ট হয়ে উঠল—এগুলো আসলে এক গোপন উইল বা উত্তরাধিকারী সম্পর্কিত দলিল। দলিলগুলোতে ছিল দত্ত পরিবারের সম্পত্তি, জমির দলিলপত্র, আর সেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কে কোন অংশের অধিকারী, তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা। আর সেই সঙ্গে ছিল এমন অদ্ভুত শর্তাবলী যা কেউ সাধারণ চোখে পড়লে বুঝতেই পারবে না। দলিলগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, এটি পড়লেই বোঝা যায়—যে ব্যক্তি এই উইলের আসল অধিকারী, সেই ব্যক্তির প্রতি দত্ত পরিবারের রক্তসম্পর্কিত দায়িত্ব অক্ষত। কিন্তু শহরের ইতিহাস এবং প্রবীণদের কথামতো, এই উইল প্রকাশের আগে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে। ভাইদের মধ্যে সম্পত্তি এবং ক্ষমতার লোভ এতটাই বেড়ে যায় যে, তারা একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। আর সেই বিশ্বাসঘাতকতার চরম রূপে ঘটে এক ভয়ঙ্কর খুন। রক্তমাখা দলিল, যা তারা আজ হাতে পেয়েছে, আসলে সেই খুনের পেছনের আসল কারণ, যা বহু বছর ধরে সিন্দুকের ভেতর লুকিয়ে ছিল।

দলিলগুলোতে আরও এক অদ্ভুত বিষয় দেখা গেল—প্রতিটি পৃষ্ঠার ওপর অদ্ভুত চিহ্ন, যেন কোনো প্রাচীন কোড বা সিম্বল দিয়ে লেখা। রাহুল টর্চের আলোয় চোখ বুলিয়ে বলল, “এই চিহ্নগুলো কেবল লেখার অংশ নয়, এগুলো নির্দেশনা, সঠিক উত্তরাধিকারীকে চিহ্নিত করার জন্য।” সায়ন্তন কাঁপা গলায় বলল, “তো এই উইলটাই ছিল সব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু—যার জন্য দত্তবাড়িতে খুন, চক্রান্ত আর রক্তপাত ঘটেছিল।” ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, সিন্দুকের ভেতরে রাখা দলিলগুলো শুধুমাত্র অতীতের সত্যকে রক্ষা করতে বানানো হয়নি; বরং এগুলো ছিল এক প্রমাণ—যে কোনো অবৈধ হাত এই সম্পদ হরণ করলে, তা ইতিহাসের আলোকে উন্মোচিত করবে। পুরনো ছবি, ভাঙা দলিলপত্র এবং রক্তের দাগ সব মিলিয়ে একটা সুস্পষ্ট ইতিহাস ফুটে উঠছে। শহরের ধনী জমিদার দত্ত পরিবার শুধু সম্পদই অর্জন করেছিল না, তারা সেই সম্পদ রক্ষা করার জন্য এক গোপন উইলও তৈরি করেছিল, যা প্রকাশ পেলে শহরের অনেকেই ধরা পড়ত।

রাহুল এবং সায়ন্তন যখন এই সত্য উপলব্ধি করল, তখন ভেতরের ঘরের নিস্তব্ধতা আরও ভয়ের মতো হয়ে উঠল। তারা বুঝতে পারল, কেবল ইতিহাস জানলেই শেষ নয়; এই উইল প্রকাশ করা বা তা সঠিক ব্যক্তির হাতে পৌঁছানো এক ধাপ বিপজ্জনক কাজ। কারণ সেই উইলই দত্তবাড়িতে সংঘটিত খুন, দ্বন্দ্ব এবং ভয়ঙ্কর ঘটনার মূল কারণ। এই দস্তাবেজ শুধু অতীতের ইতিহাসের সাক্ষী নয়, বরং বর্তমানের জন্যও এক অদৃশ্য সংকেত হয়ে দাঁড়াচ্ছে—যে কোনো ভুল পদক্ষেপ ভবিষ্যতের বিপদ ডেকে আনতে পারে। রাহুল ধীরে ধীরে কাগজগুলো ভাঁজ করে রাখল, মনে করে, তারা এখন শুধু অনুসন্ধানকারী নয়; তারা ইতিহাসের ধারক, যারা এই গোপন উইলকে সামনে এনে শহরের মানুষকে সত্য জানাতে পারে। কিন্তু সেই সত্য, রক্তমাখা ইতিহাস এবং ভাঙা সিন্দুকের গোপন ছায়া মিলিয়ে তাদের মনে একটি এক অদ্ভুত, ভীতিকর উত্তেজনা তৈরি করল—যেন দত্তবাড়ির প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোণ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে যে এই গোপন দলিল শুধু একটি কাগজ নয়; এটি অতীতের চক্রান্ত, রক্ত এবং এক অভিশপ্ত উত্তরাধিকারিক সংঘাতের প্রতিফলন।

আট

রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দত্তবাড়ির নিস্তব্ধতা ক্রমশ ঘনীভূত হতে লাগল। বাইরে ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু ভেতরের অন্ধকার ঘরে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা থমকে দাঁড়িয়েছে। টর্চের আলো দুই তরুণকে ছুঁড়ে ঘুরলেও প্রতিটি কোণ থেকে ভেসে আসছে অচেনা শব্দ—একটি হালকা ফিসফিসানি, দূরের ভাঙা দরজার কচকচানি এবং মেঝের নিচ থেকে আসা এক অদ্ভুত ধ্বনি। রাহুল প্রথমে এটিকে কেবল কল্পনা ভেবেছিল, কিন্তু যতক্ষণ তারা ঘরের মধ্যে এগোচ্ছিল, শব্দগুলো ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল, কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারি করছে। রাহুল টর্চ আলোর দিকে তাকিয়ে ঘরের কোনায় ঢুকে থাকা ছায়াগুলো লক্ষ্য করল। এগুলো শুধুই ছায়া নয়—এগুলো যেন কোনো জীবন্ত কণ্ঠের আভাস দিচ্ছে। সায়ন্তনের হাত কেঁপে উঠছিল, সে ফিসফিস করে বলল, “রাহুল, মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখছে।” রাহুল হালকা কণ্ঠে উত্তর দিল, “হয়তো… হয়তো সেই খুন হওয়া উত্তরাধিকারীর আত্মা। সে শান্তি খুঁজছে, আর আমরা তার পথে চলছি।” হঠাৎ ভাঙা জানালার কাচ ভাঙার মতো শব্দ করে কেঁপে উঠল ঘর, আর বাতাসে যেন অদৃশ্য কোনো সত্তা নড়েচড়ে উঠল। তারা দুজনেই স্থির হয়ে দাঁড়াল, মনে হচ্ছিল প্রতিটি নিঃশ্বাসে ঘরের ভেতরের অদ্ভুত উপস্থিতি তাদের চারপাশে বদ্ধমত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ভিতরে এগোতে এগোতে রাহুল আরও অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করল। সিন্দুকের পাশে থাকা রক্তমাখা দলিলগুলো হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের স্পর্শ করছে। কাগজের উপর লেখা শব্দগুলো যেন ফিসফিস করে তাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল। সায়ন্তন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ কমতে শুরু করেছে। প্রতিটি পদক্ষেপে হঠাৎ করে শুনতে পাচ্ছিল ভাঙা মেঝের ধ্বনির সাথে মিলিত একটি দূরের চিৎকার। রাহুল বুঝতে পারল, এটি কোনো দৈবিক শব্দ নয়; এটা অতীতের রক্তমাখা ঘটনার পুনর্জাগরণ। মনে হচ্ছিল, খুন হওয়া উত্তরাধিকারী নিজের আত্মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার প্রেতাত্মা এখনও এই জায়গার নীরবতার ভেতর আটকে আছে। তারা ঘরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল, আর প্রতিটি ঘরে ভেসে আসা ফিসফিসানি যেন তাদের বলছিল—“সত্যটি জান, তবে সাবধান।” ভয়ের মধ্যে রাহুল অনুভব করল, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তার প্রতিটি নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করছে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে আত্মার চাপ অনুভূত হচ্ছে।

হঠাৎ করেই রাহুলের কানে স্পষ্ট শোনা গেল—একটি নিঃশ্বাসের শব্দ, যা ভিন্ন এবং ভারী, যেন কারো দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার আভাস দিচ্ছে। সে টর্চের আলো ঘুরিয়ে দেখল, ঘরের অন্ধকারে কোনো শক্তি ধীরে ধীরে ঘুরছে, যেন এটি এক জীবন্ত সত্তা। সায়ন্তন ভীত কণ্ঠে বলল, “এটা বাস্তব, রাহুল। আমাদের চারপাশে সত্যিই কেউ আছে।” রাহুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এই আত্মা কোনো ক্ষতিকারক উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে নেই; বরং এটি চায় যে তার অতীতের চক্রান্ত ও খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হোক, যাতে সে শান্তি পেতে পারে। তারা ধীরে ধীরে সিন্দুকের দিকে এগোল, যেন সেই প্রেতাত্মার চাহিদা মেনে চলার চেষ্টা করছে। রাতের নীরবতা, ফিসফিসানি, হালকা ধ্বনি—সব মিলিয়ে রাহুল এবং সায়ন্তনের মনে এক অদ্ভুত ভয়মিশ্রিত উত্তেজনা তৈরি করল। তারা বুঝতে পারল, দত্তবাড়ির অতীত এবং তার আত্মার উপস্থিতি এক অটল সত্যের অংশ, যা তারা উন্মোচন না করা পর্যন্ত সেই ঘরের নিস্তব্ধতা ভাঙবে না। এই রাত যেন তাদের শিক্ষা দিচ্ছিল, ইতিহাসের প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি রক্তমাখা দলিল, প্রতিটি অচেনা শব্দ—সবই এক জীবন্ত সত্যের অংশ, যা শুধু সাহসী মনই বুঝতে পারে।

নয়

দলিলপত্রের প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি চিহ্ন বিশ্লেষণ করে রাহুল এবং সায়ন্তন অবশেষে সেই ষড়যন্ত্রের জাল উন্মোচন করতে শুরু করল যা বহু দশক ধরে দত্তবাড়ির অতীতকে ছাপিয়ে গেছে। তারা বুঝতে পারল, যে ব্যক্তি বর্তমানে দত্তবাড়ির উত্তরাধিকার দাবি করছে, সে আসলে সম্পূর্ণ প্রতারক। দলিলগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে, আসল উত্তরাধিকারীর অধিকার কখনো ভুলে যাওয়া যায়নি; বরং তা ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করা হয়েছিল। পুরোনো নথি ও উইলের খণ্ডনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, শহরের উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালী কেউ বা কারা দায়িত্ব নিয়েছিল আসল উত্তরাধিকারীকে মানুষের চোখ থেকে আড়াল রাখার। এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্পত্তি এবং ক্ষমতার কুক্ষিগত দখল। রাহুল এবং সায়ন্তন যখন দলিলের সূত্র ধরে পুরো কাহিনী ধরে রাখল, তখন বোঝা গেল, দত্তবাড়িতে সংঘটিত খুন, রক্তমাখা দলিল, অদ্ভুত চিহ্ন—সবই এই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ, গোপন চুক্তি, এবং শহরের ধনিকদের অবৈধ হস্তক্ষেপ—এসব মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এক জটিল এবং বিপজ্জনক নেটওয়ার্ক, যা বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

তদন্ত যত গভীর হলো, ততই তারা দেখল কিভাবে বর্তমান উত্তরাধিকারীরা চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে সম্পত্তি দখলের জন্য সমস্ত সুযোগ এবং প্রমাণ মুছে ফেলতে চেয়েছিল। দলিলগুলো থেকে বোঝা গেল, মূল উত্তরাধিকারী ছিলেন এক বংশধর যাকে ছোটবেলা থেকেই গোপনে অন্যত্র পাঠানো হয়েছিল, শহরের সকলের নজর থেকে আড়াল রাখা হয়েছিল। এই সন্তান, বা তার বংশধর আজও জীবিত, কিন্তু সম্পূর্ণ শহর তাকে অজানা অবস্থায় রেখেছিল। রাহুল ধীরে ধীরে ভাবল, সেই বংশধরের সঠিক পরিচয় খুঁজে বের করলেই এই চক্রান্তের চূড়ান্ত সত্য বেরিয়ে আসবে। এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে এক উত্তেজনা তৈরি করল, কারণ তারা শুধু ইতিহাসের নথি খুঁজে বের করেনি, তারা একটি প্রাচীন অস্পষ্ট সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে—যা একবার প্রকাশ পেলে শুধুমাত্র দত্তবাড়ির ইতিহাস নয়, বরং শহরের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোও পাল্টে যেতে পারে।

রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দলিলের আরও সূক্ষ্ম দিকগুলো খুঁজে পেল। নানা সূচিপত্র এবং নোটের ভেতর লুকিয়ে থাকা চিহ্নগুলো স্পষ্ট করে দেখালো, বর্তমান উত্তরাধিকারীরা কতটা পরিকল্পিতভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। প্রতিটি দলিল, প্রতিটি নথি তাদের সামনে প্রকাশ করল—কীভাবে আসল উত্তরাধিকারীকে আড়াল করা হয়েছিল, কিভাবে সম্পত্তি চুরি করা হয়েছিল এবং কিভাবে দত্তবাড়ির অতীতের রক্তমাখা ঘটনার সত্যকে সময়ের সাথে ধুলোয় চাপা দেওয়া হয়েছিল। রাহুল এবং সায়ন্তন বুঝতে পারল, তাদের হাতে শুধু দলিল নেই, বরং একটি শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে যা শহরের সকলকে দেখাতে পারবে—কারা সত্যিকারের উত্তরাধিকারী, আর কারা প্রতারক। এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে এক ধরনের দায়িত্ববোধ তৈরি করল, যেন তারা শুধু ইতিহাস জানছে না, বরং সেই ইতিহাসের যথার্থ ধারক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দত্তবাড়ির নীরবতা, সিন্দুকের চাপা শব্দ, এবং আত্মার ফিসফিসানি সব মিলিয়ে এবার একটি উদ্দেশ্য পেল—সত্য উন্মোচন, এবং চক্রান্তের ছায়া চিরতরে দূর করা।

দশ

রাহুল এবং সায়ন্তন ধীরে ধীরে শহরের আদালতের পথ ধরল। হাতে ছিল সিন্দুক থেকে উদ্ধার করা রক্তমাখা দলিলগুলো, যা দত্তবাড়ির ইতিহাসের চূড়ান্ত প্রমাণ বহন করছিল। আদালতের কক্ষে প্রতিটি দলিল পেশ করা হলো, বিচারক এবং আইনজীবীরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। দলিলগুলোতে ছিল দত্ত পরিবারের গোপন উইল, বিভিন্ন চক্রান্ত এবং সম্পত্তি দখলের প্রমাণ, যা দীর্ঘ বছর ধরে শহরের মানুষকে প্রতারিত করেছিল। রক্তমাখা কাগজের প্রতিটি ছেঁড়া অংশ আদালতের কক্ষে নতুন জীবন পেয়েছিল, যেন অতীতের সকল চক্রান্ত এবং হত্যাকাণ্ড ধীরে ধীরে সামনে আসছে। বিচারক দলিলের দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে রইল, কারণ এই নথি শুধু পারিবারিক ইতিহাস নয়, বরং পুরো শহরের ঐতিহ্য এবং আইনগত দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত। সায়ন্তন এবং রাহুল বুঝতে পারল যে, তাদের কাজ কেবল অনুসন্ধান নয়—তারা ইতিহাসকে পুনঃস্থাপন করছে, যাতে যারা প্রতারক ছিল তাদের যথাযথ বিচার হয় এবং আসল উত্তরাধিকারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আদালতের বাতাসে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল, যেটা প্রতিটি উপস্থিতির মনে এক ধরনের উত্তেজনা এবং ভয় সৃষ্টি করছিল।

দলিলের প্রমাণে দেখানো হলো কিভাবে বর্তমান উত্তরাধিকারীরা বহু বছর ধরে আসল উত্তরাধিকারীর পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিল। আদালতে ধীরে ধীরে সব তথ্য সামনে আসে—কিভাবে দত্তবাড়িতে খুন সংঘটিত হয়েছিল, কিভাবে সম্পত্তি দখল করা হয়েছিল, এবং কিভাবে শহরের লোকদের চোখ থেকে সত্য আড়াল করা হয়েছিল। বিচারক সকল প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন, আসল উত্তরাধিকারীর অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং প্রতারকরা তাদের কাজের জন্য শাস্তি পাবেন। রাহুল এবং সায়ন্তন তখন উপলব্ধি করল, শুধু দলিল এবং প্রমাণই যথেষ্ট নয়, বরং সাহস, অধ্যবসায় এবং সত্যের প্রতি অদম্য মনোভাব ছাড়া এটি সম্ভব হত না। দত্তবাড়ির অতীতের ছায়া ধীরে ধীরে উঠে যেতে থাকে, ঘরের ভেতরের নীরবতা এখন আর ভয়ঙ্কর নয়, বরং এক ধরনের শান্তির আভা ছড়িয়ে দেয়। আদালত রুমে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারল, ইতিহাস কখনো চিরকাল লুকিয়ে থাকা যায় না; এক সময় সত্য তার পথ খুঁজে বের করে এবং প্রতারককে মুখোমুখি দাঁড় করায়।

শেষ দৃশ্যে রাহুল এবং সায়ন্তন দত্তবাড়িতে ফিরে আসে। সিন্দুকটি ফাঁকা পড়ে আছে—তার মরচে, ভাঙা তালা, এবং ভেতরের ছেঁড়া কাগজগুলো সবই ইতিহাসের সাক্ষী। তারা বুঝতে পারল, যদিও দত্তবাড়ির অভিশাপ ভেঙেছে, এর রক্তমাখা ইতিহাস শহরের মনে চিরকাল প্রতিধ্বনিত হবে। ঘরের ভেতরে এখন নিস্তব্ধতা, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা শুধু শান্তি নয়, বরং সতর্কবার্তা—যে কেউ অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে না, তার জন্য ইতিহাস আবারও ঘুরে ফিরে আসতে পারে। সিন্দুকের ভেতরের প্রতিটি ছেঁড়া দলিল, প্রতিটি রক্তের দাগ, প্রতিটি ফিসফিসানি—সবই এখন গল্প হয়ে গেছে, যা শহরের মানুষকে চিরকাল মনে করিয়ে দেবে দত্তবাড়ির নীরবতা ও রহস্যের ভয়ঙ্কর সত্য। রাহুল ধীরে ধীরে সিন্দুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন সব শেষ। সত্য প্রকাশিত, বিচার হয়েছে, এবং সেই আত্মাগুলি শান্তি পেয়েছে।” সায়ন্তন এক প্রশান্ত নিঃশ্বাস নিল, কিন্তু চোখে এখনো সেই অতীতের ছায়া ভেসে উঠছিল। দত্তবাড়ি, সিন্দুক এবং তার রক্তমাখা ইতিহাস—সবই এখন শহরের চিরন্তন স্মৃতি হয়ে আছে, যা শুধুমাত্র গল্প নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা, যা চিরকাল কাঁপিয়ে রাখবে প্রতিটি অনুসন্ধানকারীকে।

সমাপ্ত

1000066408.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *