অনিন্দিতা মুখার্জি
সন্ধ্যার আঁধারে গ্রামটা যেন এক অচেনা বিষণ্নতার আস্তানা। খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলো, ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা আর কাদামাটি ভেজা উঠোন—সবকিছুই যেন নিঃশব্দে নিজের অসহায়তার গল্প বলে চলে। মীরার জন্ম এই গ্রামেই, মাটির গন্ধ মেখে বড় হওয়া সেই ছোট্ট মেয়ে আজ কিশোরীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে, তার জীবনটা আর পাঁচজন মেয়ের মতোই হবে—বাল্যবিবাহ, সংসারের ঘানি টানা, আর সারাজীবন কেবল রান্নাঘর আর ঘরের কোণে বন্দি থাকা। অথচ তার চোখের গভীরে যে অদ্ভুত আলো ঝলমল করে, সেটাকে কেউই দেখতে চায় না।
ছোটোবেলা থেকেই মীরা বইয়ের প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করত। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের ভাঙা বেঞ্চে বসে যখন মাস্টারমশাই অক্ষর শেখাতেন, মীরার মনে হতো যেন এক নতুন জগৎ খুলে যাচ্ছে তার সামনে। ঘরে ফিরে মা গঞ্জনা দিতেন—“পড়াশোনা করে কী হবে? হাঁড়ি-পাতিল সামলাতে শিখো, ওটাই তোমার ভবিষ্যৎ।” কিন্তু তবুও মীরা অন্ধকারে কুপি জ্বেলে পড়ত, বইয়ের পাতায় চোখ রেখে নিজের স্বপ্নগুলোকে আঁকড়ে ধরত।
বাবা ছিলেন কড়া মানুষ। তিনি প্রায়ই বলতেন—“মেয়েদের বিদ্যে বাড়লে মাথা খারাপ হয়। বেশি পড়াশোনা করলে বিয়ের বাজারে দাম কমে যায়।” কথাগুলো মীরার কানে ঝনঝন করে বাজত। সে জানত, বাবা তার জন্য শিগগিরই এক পাত্র ঠিক করবেন, আর একরাশ গয়নাগাটি দিয়ে তাকে বিদায় করবেন অন্য বাড়িতে। কিন্তু মীরার ভেতরের কোনো অদৃশ্য শক্তি বারবার ফিসফিস করে বলত—“আমি অন্যরকম হব, আমি বাঁধা মানব না।”
গ্রামের মেয়েরা ছোট থেকেই সংসারের কাজে জড়িয়ে পড়ে। নদী থেকে জল আনা, গরু চরানো, রান্না করা, ছোট ভাইবোন সামলানো—এই ছিল তাদের নিয়মিত জীবন। মীরা অনেক সময় কাজ করতে করতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত, যদি একদিন সে শহরে পড়তে যেতে পারত! শুনেছিল শহরে নাকি অনেক বড় স্কুল আছে, লাইব্রেরি আছে, মেয়েরাও ডাক্তার, শিক্ষিকা কিংবা অফিসার হয়। এই স্বপ্ন তাকে পাগলের মতো তাড়া করত।
কিন্তু বাস্তব সবসময় স্বপ্নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে। মীরার চৌদ্দ বছর পূর্ণ হতেই পাড়ার এক আত্মীয় পাত্রের কথা তুলল। লোকটা বয়সে অনেকটা বড়, শহরে কাজ করে, আর্থিক অবস্থাও ভালো। পরিবার এককথায় রাজি হয়ে গেল। মায়ের চোখে জল থাকলেও তিনি প্রতিবাদ করার সাহস দেখালেন না। মীরার ভেতরটা তোলপাড় করতে লাগল। সে জানত, এই বিয়ে মানেই তার জীবনের সমাপ্তি। পড়াশোনা, স্বপ্ন, আশা—সব শেষ হয়ে যাবে।
সেই সময় গ্রামে এলো সুমিত্রা নামের এক তরুণী। তিনি শহর থেকে আসা এক সমাজকর্মী, গ্রামে মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি ছোট্ট কেন্দ্র খোলার চেষ্টা করছেন। অনেকেই বিদ্রূপ করল—“মেয়েদের আবার স্কুল কিসের?” কিন্তু সুমিত্রা নাছোড়বান্দা। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়েদের নিয়ে আসতে লাগলেন। মীরা প্রথম দিনই চুপচাপ গিয়ে দাঁড়াল সেই কুঁড়েঘরের সামনে, যেখানে সুমিত্রা বোর্ড টাঙিয়ে লিখেছেন—“নারী শিক্ষাকেন্দ্র।”
ভেতরে ঢুকেই মীরার বুক কেঁপে উঠল। টিনের ট্রাঙ্ক থেকে কটা নতুন বই বের করে রেখেছেন সুমিত্রা। কাগজের গন্ধে মীরার চোখে জল চলে এলো। সে বুঝতে পারল, এটাই তার বাঁচার রাস্তা। সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল—যেভাবেই হোক, পড়াশোনা সে চালিয়ে যাবে।
পরদিন সকালে যখন সে স্কুলে যেতে চাইলো, বাবার গলা বজ্রের মতো বাজল—“কোথায় যাচ্ছিস?”
মীরা দ্বিধা না করে বলল—“আমি পড়তে চাই, স্কুলে যাব।”
বাবা রাগে চড় মেরে বললেন—“কাজ শিখ, মেয়ে মানুষ হয়ে বিদ্যে শেখার দরকার নেই।”
চড়ের ব্যথা মীরার গালে নয়, বুকের ভেতর গভীরে গিয়ে লাগল। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, চোখে জল আসেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে যেন আরও কঠিন হয়ে গেল। মায়ের চোখে উদ্বেগ, কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। সমাজের ভয় মাকে গিলিয়ে রেখেছে।
মীরা বুঝতে পারল, এই লড়াইটা তাকে একাই লড়তে হবে। রাতের অন্ধকারে, সবাই ঘুমোলে সে কেরোসিন কুপির আলোয় বই পড়ত। জানালার বাইরে হাহাকার করা হাওয়ার মতোই তার ভিতরেও এক হাহাকার জমে উঠত—স্বাধীনতার, মুক্তির, নিজের পরিচয় খুঁজে পাওয়ার।
কয়েকদিন পর, এক দুপুরে, সুমিত্রা নিজে এলেন তাদের বাড়ি। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললেন—“কাকা, মীরা খুব ভালো পড়াশোনা করে। ওকে স্কুলে যেতে দিন। মেয়েরা যদি শিক্ষা পায়, গোটা গ্রামটাই বদলাবে।” বাবা হেসে উড়িয়ে দিলেন—“এ সব শহুরে কথা এখানে চলবে না। মেয়ে মানুষ মানে সংসার সামলানো। বিদ্যে শেখালে মাথা উঁচু করবে, শ্বশুরবাড়ি মানবে না।”
কথাগুলো শুনে মীরার বুকটা ধক করে উঠল। সে অনুভব করল, তার স্বপ্নকে এভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সুমিত্রা শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়লেন না। তিনি প্রতিদিন আসতেন, মীরাকে সাহস দিতেন, বলতেন—“তুই লড়াই কর, আমি আছি।” এই কয়েকটা কথাই মীরার মনে আগুন জ্বালিয়ে দিল।
এক রাতে, বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার খবর সে শুনল। তার ছোট ভাই চুপিচুপি বলল—“জ্যাঠা ঠিক করেছে, আগামী মাসে তোর বিয়ে হবে।” মীরার শরীর কেঁপে উঠল, মনে হলো সমস্ত দিগন্ত যেন অন্ধকারে ঢেকে গেছে। তবুও বুকের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত কণ্ঠ ভেসে এলো—“না, আমি মানব না। আমার জীবন আমি নিজে বেছে নেব।”
সেদিন জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল মীরা। পূর্ণিমার আলোয় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যে আগুন তার ভেতরে জ্বলছে, সেই আগুন দিয়ে সে একদিন অন্ধকারকে গলিয়ে ফেলবে। সমাজ তাকে থামাতে চাইবে, পরিবার তাকে শৃঙ্খলে বাঁধতে চাইবে, কিন্তু সে হার মানবে না।
এভাবেই শুরু হলো মীরার অন্তর্দাহ, তার লড়াইয়ের প্রথম অধ্যায়। যে অগ্নি তার ভেতরে জ্বলে উঠেছে, সেই অগ্নি একদিন পুরো গ্রামকে আলোকিত করবে কি না—সেটা তখনও কেউ জানত না। কিন্তু মীরা জানত, সে আর ফিরে যাবে না।
বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়ে যাওয়ার পর থেকে মীরার চারপাশে অদ্ভুত এক চাপা অশান্তি জমে উঠেছিল। পাড়ার মহিলারা তাকে দেখলেই হেসে বলত, “তোর তো এখন ভাগ্য খুলে গেছে রে মীরা, শহরের চাকুরে বর, পেট ভরে খেতে পাবি।” কেউ আবার খোঁচা দিত, “পড়াশোনা করে কী হবে, সংসারই তো সামলাতে হবে।” মীরার কানে এইসব কথা তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বিঁধত। ভিতরে ভিতরে তার বুকের ভেতর জমে উঠছিল এক জেদ, এক আগুন—যা কোনোভাবেই নেভানো যাবে না।
এক রাতে মীরার মা তাকে পাশে বসিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “বাবা খুব জেদি মানুষ। আমি জানি তুই পড়াশোনা করতে চাইছিস, কিন্তু কিছু বলিস না। সংসারের শান্তি ভেঙে যাবে।” মীরার চোখ ভিজে উঠল। সে মায়ের হাত ধরে বলল, “তুমি তো জানো মা, আমি অন্যরকম কিছু হতে চাই। আমি যদি এখন চুপ করি, তবে কোনোদিন আর সুযোগ আসবে না।” মা কিছু বলতে পারলেন না, শুধু মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
পরদিন সকালে মীরা সাহস করে সুমিত্রার কাছে গিয়ে সব খুলে বলল। সুমিত্রা অনেকক্ষণ চুপ করে শুনলেন, তারপর দৃঢ় গলায় বললেন, “তুই ভয় পাবি না মীরা। এই বিয়ে যদি হয়ে যায়, তোর জীবন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা লড়াই করব। তুই একা নোস।” মীরার মনে হলো তার বুকের ভেতর যে ভার জমে ছিল, তা যেন একটু হালকা হলো।
তারপর থেকে শুরু হলো এক অদ্ভুত টানাপোড়েন। দিনে পরিবার বিয়ের প্রস্তুতি নিতে লাগল, রাতে মীরা চুপিচুপি বই পড়তে বসত। প্রতিবার কেরোসিন কুপির আলোয় অক্ষরগুলো যেন তার কাছে মুক্তির দরজা হয়ে উঠত। সে পড়ত ইতিহাসের নায়িকাদের কথা, যারা লড়াই করে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিল। মনে মনে ভাবত—“আমি যদি পারি, তাহলে এই গ্রামের মেয়েরা একদিন আমাকে অনুসরণ করবে।”
কিন্তু গ্রামে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। লোকেরা বলতে শুরু করল—“ও মেয়ে পড়াশোনা করে মাথা উঁচু করছে। কালকে শ্বশুরবাড়ি মানবে না।” বাবা এইসব কথা শুনে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। একদিন তিনি মীরাকে ডেকে বললেন, “তোর সব খেলা শেষ। মাসের শেষে তোর বিয়ে। আর যদি বিদ্রোহ করিস, তবে তোর মুখ আমি আর দেখব না।”
সেদিন রাতে মীরার বুকের ভেতর ঝড় উঠল। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করল—“আমি কি তবে হেরে যাব?” কিন্তু মনে পড়ল সুমিত্রার সেই কথা—“তুই একা নোস।” মীরার চোখে দৃঢ়তা ভেসে উঠল।
কয়েকদিন পর গ্রামে একটি মেলা বসেছিল। সুমিত্রা সেই সুযোগে গ্রামের কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে স্কুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মীরাও সেখানে গেল। সেখানে উপস্থিত ছিল গ্রামের ক’জন তরুণ, যারা গোপনে মেয়েদের পড়াশোনা সমর্থন করত। তারা বলল, “আমরা মীরার বিয়ে আটকাবো। যদি দরকার হয়, আমরা পঞ্চায়েতের কাছে যাব।” কথাগুলো শুনে মীরার শরীর কেঁপে উঠল। সে বুঝল, তার লড়াই শুধু নিজের নয়—এখন এটা একটা আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে।
তবুও বিপদ যেন পিছু ছাড়ছিল না। একদিন মীরাকে কাঁদতে কাঁদতে তার এক বান্ধবী বলল, “আমারও বিয়ে ঠিক হয়েছে, আমি কিছু করতে পারছি না।” মীরার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে জানত, যদি নিজের জন্য কিছু না করে, তবে তার এই বান্ধবী আর গ্রামের অন্য মেয়েরাও একই ভাগ্যে আটকে যাবে। সেই মুহূর্তে মীরা শপথ নিল—যে করেই হোক, সে এই বিয়ে ভাঙবে।
এক ভোরে, মীরা চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুমিত্রার কাছে গিয়ে বলল, “আমাকে রক্ষা করুন। আমি পড়াশোনা করব, আমি বিয়ে করব না।” সুমিত্রা তার চোখের দিকে তাকালেন, সেখানে ভয় আর সাহস দুটোই মিশে আছে। তিনি বললেন, “তুই ভয় পাস না। আমরা সবাই মিলে তোর পক্ষে দাঁড়াব।”
কিন্তু এর ফল ভালো হলো না। খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে—মীরা নাকি বিদ্রোহ করেছে। পাড়ার লোকেরা বাবাকে উস্কে দিল। বাড়ি ফিরে মীরা ভীষণ মার খেল। বাবা চিৎকার করে বললেন, “আমার মুখ কালো করেছিস! তোর জন্য আমাদের সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে গেল।” মীরার শরীর ক্ষতবিক্ষত হলেও তার মন ভাঙল না। সে শুধু মনে মনে বলল, “আমাকে ভাঙতে পারবে না।”
সেই রাতে, আকাশে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি নামল। কেরোসিন কুপির আলো দপদপ করতে লাগল। মীরা বিছানায় শুয়ে আকাশের বজ্রপাতের শব্দ শুনতে শুনতে ভাবছিল—তার জীবনও যেন এই বজ্রপাতের মতোই বিদ্যুতের ঝলকানি নিয়ে ঝরে পড়তে চাইছে। কিন্তু সে জানত, অন্ধকার যত গভীরই হোক, বিদ্যুতের আলো তবু ছড়িয়ে পড়ে।
পরদিন সকালেই সুমিত্রা পঞ্চায়েতে খবর দিলেন। তিনি বললেন, “একটা নাবালিকা মেয়ের বিয়ে আটকাতে হবে।” পঞ্চায়েত প্রথমে হাসাহাসি করল, কেউ বলল—“এইসব শহুরে কাণ্ড এখানে হবে না।” কিন্তু সুমিত্রা নাছোড়বান্দা। তিনি আইনের কাগজপত্র দেখালেন—“চৌদ্দ বছরের মেয়ের বিয়ে বেআইনি। যদি আপনারা থামান না, আমি থানা পর্যন্ত যাব।”
পঞ্চায়েতের ভেতর গুঞ্জন শুরু হলো। মীরার বাবার মুখ রাগে লাল, কিন্তু অন্যদিকে গ্রামের কিছু মানুষ ফিসফিস করে বলল—“আইন যদি বলে বেআইনি, তবে মীরার কথায় দোষ কোথায়?”
মীরার মনে হলো, প্রথমবার তার লড়াই একটা ছোট জয় পেল। কিন্তু সে জানত, এ লড়াই শেষ হয়নি। আসল সংগ্রাম এখনও বাকি।
পঞ্চায়েতের বৈঠক শেষ হওয়ার পর গ্রামে যেন দুই ভাগ হয়ে গেল। একপক্ষে যারা মীরার বাবার সঙ্গে একমত—তাদের যুক্তি, মেয়েদের বিয়ে হলে সমাজের নিয়ম অটুট থাকে, আর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কিছু লোক, যারা সুমিত্রার দেখানো কাগজে বিশ্বাস রেখে বলল—“আইন যদি বলে না হয়, তবে আমাদেরও বদলাতে হবে।” এই অদ্ভুত টানাপোড়েন যেন গ্রামটাকে ছিঁড়ে ফেলল, প্রতিটি উঠোনে প্রতিটি বারান্দায় নতুন নতুন বিতর্ক শুরু হয়ে গেল।
মীরার মনে হচ্ছিল, তার নামটা যেন এখন আর শুধু একটা মেয়ে নয়, পুরো গ্রামজুড়ে ঝড় তোলা এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে প্রতিটি জায়গায় যায়, সেখানে ফিসফিস করে কেউ না কেউ বলে—“ওই যে সেই মেয়ে, যে বিয়ে মানছে না।” কথাগুলো শুনে তার বুক কেঁপে উঠত, ভয়ও লাগত, কিন্তু আবার অন্যদিকে এক অদ্ভুত শক্তি এসে ভর করত—“আমি একা নই।”
কিন্তু বাবার রাগ কমল না। তিনি প্রতিদিন মীরার দিকে বিষাক্ত চোখে তাকাতেন। খাওয়া-দাওয়ার সময় তাকে প্রায়ই বসতে দিতেন না, আর অন্যদের সামনে প্রকাশ্যে অপমান করতেন। মীরার মা চুপ করে সব সহ্য করতেন, কিন্তু মাঝে মাঝে রাতে মীরার কাছে এসে অশ্রুসজল চোখে বলতেন, “মা, আমি কিছু করতে পারছি না, তুই ক্ষমা কর।” মীরা তখন মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলত, “তুমি ভেবো না, আমি পারব।”
একদিন দুপুরে, মীরার বান্ধবী শিলা তার সঙ্গে দেখা করতে এলো। তার চোখ লাল, মুখ শুকনো। শিলা কাঁপা গলায় বলল, “আমার বিয়ে আগামী সপ্তাহে। আমি পালাতে পারব না, মা-বাবার মুখ ভাঙতে পারব না।” মীরার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। সে বুঝল, এই লড়াই শুধু নিজের নয়, শিলাদেরও জন্য। শিলা যখন চলে যাচ্ছিল, মীরা তার হাত ধরে বলল, “ভয় পেয়ো না, আমি যদি দাঁড়াই, তুইও দাঁড়াস।” কিন্তু শিলা কেবল মলিন চোখে তাকিয়ে বলল, “তুই সাহসী, আমি নই।”
এই কথাগুলো মীরার বুকের ভেতর কষ্টের মতো চেপে বসে থাকল। রাতে ঘুম ভাঙল কয়েকবার, জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে তার মুখে পড়ছিল। সে ভাবল, “আমার লড়াই যদি জিতে যাই, তবে একদিন এই গ্রামের মেয়েরা বিশ্বাস করবে যে তারাও পারে।”
এদিকে গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল—মীরা নাকি শহরের সমাজকর্মীদের হাত ধরে আইন দেখিয়ে গ্রাম ভাঙতে চাইছে। কেউ বলল, “ও তো শহরে পালিয়ে যাবে।” কেউ আবার চেঁচিয়ে উঠল, “এমন মেয়ে সমাজের জন্য কলঙ্ক।” মীরার কানেও সব পৌঁছত, কিন্তু সে কেবল দাঁত চেপে চুপ করে থাকত। তার ভেতরে তখন আর ভয় নেই, কেবল এক দৃঢ় সংকল্প—“আমি এক পা-ও পিছোব না।”
এক বিকেলে সুমিত্রা মীরাকে ডাকলেন। তাঁর চোখে ক্লান্তি, কণ্ঠে দৃঢ়তা। তিনি বললেন, “শোন মীরা, তোর বাবারা আবার নতুন করে চাপ দিচ্ছে পঞ্চায়েতকে। তারা বলছে, আইন কাগজে থাকে, কিন্তু আমাদের গ্রামে চলবে আমাদের নিয়ম। আমি জানি লড়াইটা কঠিন হবে। তুই কি সত্যিই প্রস্তুত?” মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দিদি, আমি তো আর পিছিয়ে যেতে পারি না। আমি যদি হার মানি, তবে এই গ্রামের প্রতিটি মেয়ে হার মানবে। আমি লড়ব।”
সুমিত্রার চোখ ভিজে উঠল। তিনি মীরার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুই অগ্নির মতো জ্বলছিস মীরা। মনে রাখ, অগ্নি ভস্মও করে, আলোও দেয়।”
কিন্তু মীরার বাবার ধৈর্য শেষ হয়ে এলো। এক সন্ধ্যায়, বৈঠক থেকে ফিরে এসে তিনি গর্জে উঠলেন, “এই মেয়েকে আর আমি ঘরে রাখব না। কালই ওর বিয়ে হবে। যেদিন যাবে সেদিনই শান্তি পাব।” মায়ের আর্তচিৎকার, ছোট ভাইয়ের কান্না—সব চাপা পড়ল বাবার গলার তেজে। মীরার শরীর শিউরে উঠল, কিন্তু মুখ থেকে একবিন্দু শব্দ বেরোল না। তার চোখ তখন স্থির, দিগন্তের দিকে তাকানো।
রাত গভীর হলে, মীরা চুপচাপ উঠে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। বাতাসে তালপাতার শব্দ হচ্ছিল, দূরে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবী তাকে গিলে ফেলতে চাইছে, কিন্তু আবার কোথা থেকে যেন এক আলো এসে বলছে, “না, তুই হারবি না।” সে নিজের বুকের ভেতর হাত চেপে ধরে শপথ করল—যদি কাল তাকে জোর করে পাঠানো হয়, তবে সে পালাবে। বাঁচুক বা মরুক, সে বিয়ে মেনে নেবে না।
পরদিন সকালে গ্রামে হঠাৎ অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। পঞ্চায়েত থেকে দুজন লোক এসে মীরার বাবাকে সতর্ক করে গেল। তারা বলল, “আপনার মেয়ে নাবালিকা, বিয়ে দিলে জেলে যেতে হবে।” বাবার মুখ গম্ভীর, চোখে বিদ্বেষের আগুন। কিন্তু চারপাশে প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে বলল, “আইন তো আইনই।”
এই ঘটনার পর গ্রামে উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল। কেউ বলল, “দেখো, আইন এসে গেছে, আর কিছু করার নেই।” আবার কেউ বলল, “এটা সমাজ ভাঙার চেষ্টা।” সন্ধ্যা নামতেই চায়ের দোকানে, খড়ের গাদার পাশে, মাটির দাওয়ায় একটাই আলোচনা—মীরা।
মীরার মনে হচ্ছিল, সে যেন নিজের জীবনটা হারিয়ে ফেলে পুরো গ্রামের ভাগ্যকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ভয় তার ভেতরে এখনও ছিল, কিন্তু সেই ভয়কে ঢেকে দিয়েছে এক তীব্র সংকল্প।
সেদিন রাতে হঠাৎ গ্রামের মাঝখান দিয়ে মিছিলের মতো আওয়াজ এলো। কয়েকজন তরুণ স্লোগান দিচ্ছিল—“শিক্ষা চাই, বাল্যবিবাহ চাই না।” মীরার জানলা দিয়ে সেই আওয়াজ ভেসে এলো, তার চোখে জল চলে এল। এতদিন যে স্বপ্নটা সে একা দেখত, আজ বুঝল সেটি আর শুধু তার নয়।
কিন্তু বাবার রাগ থামল না। তিনি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কালই আমি মীরাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেব। এখানে থাকলে আরও সমস্যা হবে।” মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল, তিনি প্রতিবাদ করতে পারলেন না।
মীরা সব শুনল। তার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে জানত, আগামী দিনই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। যদি সে টিকে যায়, তবে আলো আসবে। যদি না পারে, তবে অন্ধকার চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।
আকাশের ওপরে তখন কালো মেঘ জমছে। দূরে বাজ পড়ল, বিদ্যুতের ঝলকানি অন্ধকার ছিঁড়ে মীরার মুখ আলোকিত করল। সে জানত, ঝড় আসছে। আর সেই ঝড়ের মধ্যেই শুরু হবে তার লড়াইয়ের আসল অধ্যায়।
রাত যত গাঢ় হচ্ছিল, মীরার বুকের ভেতর ততই ভয় আর জেদের মিশ্রণে এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠছিল। বাবা যে কথা বলেছিলেন—কালই মীরাকে অন্য কোথাও পাঠানো হবে—সেটা যেন তার কানে বিষের মতো বাজছিল। চারপাশে অন্ধকারে কেবল তালপাতার খসখস শব্দ, দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আর খোলা আকাশে বজ্রের ঝলকানি। ঘরের ভেতর মায়ের চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে কান্নায়, কিন্তু মুখে একটিও শব্দ নেই। ছোট ভাই কুঁকড়ে শুয়ে আছে, ভয় তার গা জড়িয়ে ধরেছে। মীরা জানালার ধারে বসে প্রতিজ্ঞা করল—“যা-ই হোক, আমি আর কারও হাতে নিজের ভাগ্য তুলে দেব না।”
সকাল হতেই বাবার আচরণ আরও কঠিন হয়ে উঠল। তিনি এক গম্ভীর কণ্ঠে মাকে বললেন, “বাড়ির ভেতর থেকে মীরাকে বেরোতে দিও না। আজ বিকেলেই ওকে শহরে পাঠিয়ে দেব।” মীরার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সে জানত, এভাবে পাঠিয়ে দেওয়া মানেই তাকে বিয়ের আসরে ঠেলে দেওয়া। তার মাথার ভেতর তখনই একটা পরিকল্পনা ঘুরতে লাগল।
দুপুরে যখন মা রান্নাঘরে ব্যস্ত, মীরা ছোট ভাইকে পাশে টেনে বলল, “শোন, যদি কিছু হয় তবে তুই ভয় পাবি না। আমি পালাবো। সুমিত্রাদির কাছে যাব। ওরা আমাকে লুকিয়ে রাখবে।” ভাই চুপ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে করে বলল, “কিন্তু বাবা?” মীরা তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ফিসফিস করল, “চুপ। আমি সব সামলাবো।”
এদিকে গ্রামজুড়ে উত্তেজনা আরও বেড়ে যাচ্ছিল। পঞ্চায়েতের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদল বলছিল, “আইন আছে, আমাদের মানতেই হবে।” অন্যদল আবার বাবার পক্ষে সুর তুলে বলছিল, “আমাদের সমাজে আইন দিয়ে কিছু হবে না, মেয়েদের বিয়ে থামানো মানে সমাজ ভাঙা।” চায়ের দোকান থেকে শুরু করে নদীর ঘাট পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় মীরার নাম ঘুরছিল। সে যেন এক সাধারণ মেয়ে থেকে হঠাৎ করেই পুরো গ্রামের বিবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
বিকেল নামতেই বাবার দুই আত্মীয় এসে হাজির হলো। তারা বাবাকে বলল, “সময় নষ্ট করো না, মেয়েকে এখনই পাঠিয়ে দাও। যত দেরি করবে, তত সমস্যা বাড়বে।” মীরা সব শুনছিল। তার বুক ধড়ফড় করে উঠছিল, কিন্তু চোখে তখন এক অদ্ভুত স্থিরতা। সে বুঝে গেছে, আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অন্ধকার নামতেই মীরা চুপিচুপি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশে কালো মেঘ ঘন হয়ে এসেছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি চারদিক আলোকিত করে দিচ্ছে। তার মনে হলো, প্রকৃতি যেন তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। সে মায়ের কাছে গিয়ে আস্তে করে বলল, “মা, আমি পালাচ্ছি। আমাকে থামিও না।” মা থরথর করে কেঁপে উঠলেন। তাঁর চোখে আতঙ্ক, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “যদি তোকে ধরে ফেলে তবে কী হবে?” মীরা উত্তর দিল, “তাহলেও আমি চেষ্টা করব। আমাকে যদি আজ থামানো হয়, তবে সারাজীবন আমাকে থেমে থাকতে হবে।”
মা মীরার হাত শক্ত করে ধরে কেঁদে ফেললেন। তারপর কাঁপা হাতে তার গলায় একটা পুরনো লকেট ঝুলিয়ে দিলেন। বললেন, “এটা আমার বিয়ের সময় পেয়েছিলাম। এটা তোর সঙ্গে থাকুক। যদি কিছু হয়, মনে করবি আমি তোকে আশীর্বাদ করছি।” মীরার চোখ ভিজে উঠল। সে মাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর ধীরে ধীরে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাতের আঁধারে মাটির গন্ধ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছিল। মীরা ধীরে ধীরে পায়ের শব্দ চাপা দিয়ে এগোতে লাগল। তার বুক কাঁপছিল, শরীর কাঁপছিল, কিন্তু পা থামল না। মনে হচ্ছিল প্রতিটি ছায়া যেন তাকে গিলে ফেলতে চাইছে, প্রতিটি কুকুরের ডাক যেন বাবার চিৎকার হয়ে কানে বাজছে। তবু সে থামল না।
পথে যেতে যেতে হঠাৎ দুজন গ্রামবাসী তাকে দেখে ফেলল। তারা চিৎকার করে বলল, “ওই তো মীরা! পালাচ্ছে!” মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ থেকে লোকজন বেরিয়ে এল। মীরার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু সে দৌড়তে শুরু করল। কাঁদামাটির পথ, ঝোপঝাড়, অন্ধকার—সব পেরিয়ে সে ছুটল। পিছনে লোকজনের আওয়াজ, গালিগালাজ, হুমকি—“ধর ওকে! পালাতে দিও না!”
মীরার পা কাদা মাটিতে পিছলে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরে তখন আগুন জ্বলছে। মনে হচ্ছিল, যদি এখন থেমে যায় তবে তার জীবন শেষ। হঠাৎ সামনে একটা আলো দেখা গেল। সেটা সুমিত্রার স্কুলঘর। সে দৌড়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। সুমিত্রা দরজা খুলে হতবাক হয়ে তাকালেন। মীরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমাকে বাঁচান দিদি, ওরা আমাকে টেনে নিয়ে যাবে।”
সুমিত্রা কোনো প্রশ্ন না করে তাকে ভেতরে টেনে নিলেন। দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাইরে থেকে গর্জন শোনা যাচ্ছিল—“ওকে দাও আমাদের হাতে!” সুমিত্রা দরজার আড়াল থেকে চিৎকার করে বললেন, “এখানে তোমরা কোনো মেয়েকে পাবে না। এটা স্কুল, আইনের জায়গা। আমি পুলিশ ডাকব।”
বাইরের লোকেরা গালিগালাজ করতে লাগল, কেউ লাঠি দিয়ে দরজায় আঘাত করল। মীরা ভয়ে কেঁপে উঠল, কিন্তু সুমিত্রার দৃঢ় কণ্ঠে সে যেন নতুন শক্তি পেল। সুমিত্রা তার হাত ধরে বললেন, “ভয় পাস না মীরা। তুই ঠিক কাজ করেছিস। আজ থেকে তুই শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য লড়ছিস।”
অল্প কিছুক্ষণ পর কয়েকজন তরুণ দৌড়ে এল। তারা দাঁড়িয়ে গেল স্কুলের সামনে, লোকজনকে ঠেকিয়ে রাখল। বলল, “যদি জোর করো তবে আমাদের পেরিয়ে যেতে হবে।” তর্ক-বিতর্ক, চিৎকার, হুমকি চলতে লাগল। মীরার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু তার চোখে তখন ভয় নয়, এক অদ্ভুত জেদ—“আমি এবার আর ফিরব না।”
রাত গভীর হলে ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সুমিত্রা জানলা দিয়ে তাকিয়ে বললেন, “আজ বেঁচে গেছি, কিন্তু কাল কী হবে কে জানে।” মীরা নিঃশ্বাস ফেলল, জানত বিপদ এখনও শেষ হয়নি। তবু তার বুকের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত শক্তি উঠে এলো—“আমি লড়ব, যতক্ষণ না আলো আসে।”
সেদিন রাতে সে প্রথমবার ঘুমোতে পারল না। জানলার বাইরে অন্ধকার, দূরে মাঝে মাঝে কুকুর ডাকছে। কিন্তু মীরার মনে হচ্ছিল, এই অন্ধকার ভেদ করে আলো একদিন আসবেই। তার লড়াই হয়তো আরও কঠিন হবে, হয়তো তাকে আরও রক্ত দিতে হবে, কিন্তু সে জানত—এখন আর ফেরার পথ নেই।
সকাল গড়িয়ে এল, রাতের উত্তেজনার ছাপ যেন পুরো গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে রইল। আগের রাতে মীরার পালানো, স্কুলে আশ্রয় নেওয়া, আর গ্রামবাসীর আক্রমণ—সব খবর বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। ভোরবেলা চায়ের দোকানে, মাঠের আড়ালে, নদীর ঘাটে—যেখানেই যাওয়া যায়, শুধু একটাই আলোচনা, “ওই মেয়েটা কি করে সাহস পেল?” কেউ রাগে ফুঁসছিল, কেউ আবার ফিসফিস করে বলছিল, “আসলে ঠিকই তো করছে।”
মীরার বাবা রাত্রি জেগেই কাটালেন। চোখ লাল, মুখ গম্ভীর, ভেতরে কেবল ক্ষোভ আর লজ্জার আগুন। পাড়ার লোকেরা বিদ্রূপ করছিল, “বেটি মানে না বাপের কথা, মেয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে না।” কথাগুলো তার পুরুষ অহংকারে আরও আগুন ঢেলেছিল। তিনি গর্জে উঠলেন, “আজই পুলিশে দেব। ওই স্কুল যদি আমার মেয়েকে লুকিয়ে রাখে তবে সবাইকে ভোগাতে হবে।”
এদিকে সুমিত্রা সারারাত স্কুলঘরে বসে মীরাকে সাহস দিচ্ছিলেন। ক্লান্ত চোখে কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলছিলেন, “মীরা, ভয় পাস না। আইন আমাদের পাশে আছে। তবে লড়াইটা সহজ হবে না।” মীরার বুকের ভেতর এখনও ধুকপুক করছিল, কিন্তু তার চোখে ভয় নয়, বরং অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ভেসে উঠেছিল। সে বুঝে গেছে, আর ফেরার পথ নেই।
সকালেই থানার দুজন কনস্টেবল স্কুলে এলো। খবর পেয়ে পঞ্চায়েতও হাজির। চারপাশে গ্রামবাসীর ভিড়। পুলিশ এসে সবার সামনে বলল, “মেয়েটির বয়স চৌদ্দ। আইন অনুযায়ী এর বিয়ে দেওয়া বেআইনি। যদি কেউ চেষ্টা করে, তাকে শাস্তি পেতে হবে।” কথাগুলো শুনে মীরার বুকটা যেন হালকা হয়ে গেল। এতদিন যে সত্য সে কেবল মনে মনে জানত, আজ সেটাই প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলো।
কিন্তু বাবার মুখে কোনো ভয় দেখা গেল না। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, “আইন শহরে চলে। আমাদের গ্রামে আমরা নিজের নিয়মে চলি। আমার মেয়ে আমার সম্পত্তি। আমি ঠিক করব ওর কী হবে।” লোকজন হু হু করে উঠল, কেউ হাততালি দিল, কেউ আবার চোখ নামিয়ে নিল। পুলিশকর্মী দৃঢ় গলায় বলল, “না কাকা, মেয়েকে সম্পত্তি বলা যায় না। এটা অপরাধ।”
মীরার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সে প্রথমবার সাহস করে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি বিয়ে করব না।” চারপাশে যেন হুহু করে উঠল লোকজন। কেউ ফিসফিস করে বলল, “ওই যে নিজেই মুখ খুলল।” কেউ আবার চিৎকার করে উঠল, “দেখেছ? বিদ্রোহ শিখছে।”
পুলিশ অফিসার বললেন, “তোর ইচ্ছা তোকে রক্ষা করবে। ভয় পাস না।” মীরার গলা কাঁপলেও সে আর থামল না। বলল, “আমার মতো অনেক মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য লড়ছি।” কথাগুলো যেন আগুনের ফুলকি হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
সেদিনই পঞ্চায়েত বাধ্য হয়ে ঘোষণা করল—“মীরার বিয়ে আপাতত বন্ধ। আইন মানতেই হবে।” গ্রামজুড়ে সাড়া পড়ে গেল। মীরার চোখ ভিজে উঠল। সে জানল, প্রথম জয় পাওয়া গেছে।
কিন্তু এই জয় ছিল কেবল শুরু। সেই রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের চোখে অশ্রু দেখে মীরার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। মা বললেন, “তুই ঠিক করেছিস মা, কিন্তু এখন থেকে তোর জীবন আর সহজ হবে না।” মীরা মায়ের হাত ধরে উত্তর দিল, “আমি প্রস্তুত। আমি একা নই। দিদিরা আছে, আইনের লোক আছে, আর আমার নিজের সাহস আছে।”
অন্যদিকে বাবার রাগ দমল না। তিনি গ্রামের কিছু লোককে ডেকে বললেন, “আজকে মানলাম, কিন্তু মেয়ে যদি এভাবে মাথা উঁচু করে থাকে তবে কালকের দিন সমাজ ভেঙে যাবে। এই আগুন নেভাতে হবে।” কথাগুলো গ্রামে গুঞ্জন তুলল। একদল লোক ভয় পেয়ে গেল, তারা বলল, “যদি সত্যিই মেয়েরা এভাবে দাঁড়াতে শুরু করে, তবে আমাদের পুরনো নিয়মগুলো ভেঙে যাবে।” অন্যদল চুপচাপ থেকে গেল, মনে মনে ভাবল—“হয়তো বদলানো দরকার।”
সুমিত্রা বুঝতে পারলেন, মীরার সংগ্রাম এখন আরও বিপজ্জনক রূপ নেবে। তিনি মীরাকে বললেন, “তোকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তোকে অন্য মেয়েদেরও সঙ্গে নিতে হবে। শুধু নিজের জন্য লড়লে চলবে না।” মীরা মাথা নাড়ল। তার মনে হলো, সে যেন এক নতুন দায়িত্ব পেয়েছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুলঘরে আরও মেয়েরা আসতে শুরু করল। তারা চুপচাপ মীরার দিকে তাকিয়ে থাকত, কেউ সাহস করে বলত, “তুই যেভাবে দাঁড়াস, আমরাও দাঁড়াতে চাই।” মীরার বুক ভরে উঠত অদ্ভুত গর্বে, আবার ভয়ও হতো—“আমি যদি হেরে যাই তবে এদের স্বপ্নও ভেঙে যাবে।”
এদিকে গ্রামে চাপা অশান্তি জমে উঠছিল। কেউ রাতের অন্ধকারে স্কুলের দেয়ালে কাদা ছুড়ে মারত, কেউ গালি লিখে দিত—“বদমাইশ মেয়ে, সমাজ ভাঙছে।” সুমিত্রা সেসব মুছে দিতেন, কিন্তু মীরার বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ ব্যথা জমত। তবু সে চুপ থাকত না। প্রতিদিন কুপি জ্বেলে পড়ত, অন্য মেয়েদেরও পড়তে শেখাত।
এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ শিলার মা স্কুলে এলো। তার চোখ লাল, কণ্ঠ ভাঙা। তিনি বললেন, “আমার মেয়েকে রক্ষা কর। ওর বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে।” মীরার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। সে শিলার হাত ধরে বলল, “তুই ভয় পাবি না। আমরা একসঙ্গে লড়ব।” সেই মুহূর্তে সে বুঝল, তার লড়াই আর একার নয়, এখন সেটা এক আন্দোলন।
গ্রামের পুরুষেরা এখনও ক্ষুব্ধ। তারা মাঝে মাঝে সভা ডেকে চেঁচামেচি করত—“মেয়েদের লাগাম টেনে ধরো। না হলে সমাজ থাকবে না।” কিন্তু তাদের কণ্ঠে আগের মতো দৃঢ়তা থাকত না। কারণ তারা জানত, এখন মেয়েদের চোখে ভয় নয়, বিদ্রোহ জেগে উঠেছে।
মীরার মনে হচ্ছিল, তার বুকের ভেতর যে আগুন এতদিন দগ্ধ করে রেখেছিল, এখন সেটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আগুন ভস্ম করে, আবার আলোও দেয়। তার লড়াই হয়তো এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু সে জানত, এই আগুন আর নেভানো যাবে না।
সেদিন রাতে আকাশে চাঁদ উঠেছিল পূর্ণিমার মতো উজ্জ্বল। মীরা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, কত পথ এখনও বাকি, কত লড়াই এখনও আসবে। কিন্তু তার চোখে তখন আর অন্ধকার নেই, কেবল আলো। সে মনে মনে বলল, “আমি হেরে যাব না। আমি শুধু মীরা নই, আমি প্রতিটি মেয়ের কণ্ঠ।”
শীতের সকালের স্নিগ্ধ আলোয় গ্রামটা যেন নিরীহ আর নিস্তব্ধ, কিন্তু এই শান্তির নীচে অদৃশ্য তোলপাড় চলছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মীরার নাম যেন বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখন আর কেউ তাকে কেবল বাবার অবাধ্য মেয়ে বলে না—কেউ বলে সে সাহসী, কেউ বলে সমাজ ভাঙার অশনি সংকেত। স্কুলঘরের কাঁচা মেঝেতে প্রতিদিন কয়েকজন নতুন মেয়ে বসে পড়ে, বই হাতে নেয়, চোখে আলো নিয়ে বলে—“আমরাও শিখতে চাই।” সুমিত্রা হাসিমুখে তাদের পাশে বসান, আর মীরা এখন তাদের অক্ষর শেখায়, যেমন একদিন সে নিজেই শিখেছিল।
তবু চারপাশে চাপা রাগ থেমে নেই। বাবার মুখ এখনও অন্ধকার মেঘের মতো ভারী। তিনি প্রায় কথা বলেন না, কিন্তু চোখে তার ঘৃণা জ্বলে ওঠে প্রতিবার মীরাকে দেখলে। মা মাঝেমাঝে চুপিচুপি এসে মীরার জন্য ভাতের থালা রেখে যান, আবার গুটিয়ে ফিরে যান। ছোট ভাইটা এখন মীরার সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে, রাতে চুপিচুপি এসে বলে, “তুই জিতবি দিদি, আমি জানি।” মীরার বুকের ভেতর তখন হঠাৎ এক টুকরো আলো ঝলকে ওঠে, যেন এত অন্ধকারের মধ্যে এটাই তার বেঁচে থাকার কারণ।
একদিন দুপুরে সুমিত্রা স্কুলে এসে বললেন, “শোন মীরা, শহরের এক সংবাদপত্রের সাংবাদিক আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা তোমার লড়াইয়ের গল্প ছাপতে চায়।” মীরার বুক কেঁপে উঠল। “সংবাদপত্র?”—শব্দটা তার কাছে যেন স্বপ্নের মতো। সুমিত্রা বললেন, “হ্যাঁ, যদি ওরা লেখে, তাহলে অন্য গ্রামেও বার্তা ছড়িয়ে যাবে—মেয়েদেরও অধিকার আছে।” মীরার মনে হলো, তার ভেতরের ছোট্ট অগ্নিশিখাটা হঠাৎ বড় হয়ে জ্বলে উঠল।
কিন্তু এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। চায়ের দোকানে একদল লোক দাঁত চেপে বলল, “এখন তো আবার শহরের কাগজে নাম ছাপাবে! লজ্জা নেই।” অন্যদিকে কিছু তরুণ চুপচাপ হাসল, বলল, “ঠিক করছে তো। কেউ না দাঁড়ালে আর কবে বদল হবে?” মীরার কানে এসব সব পৌঁছত, কিন্তু সে এখন আর কেঁপে উঠত না। তার চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা জমেছে—যেন বুঝে গেছে, ভয় পাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে।
দুইদিন পর সাংবাদিকরা এলেন। দুটো মোটরসাইকেলে, পিঠে ব্যাগ, হাতে ক্যামেরা আর খাতাপত্র। গ্রামের লোকজন হা করে তাকিয়ে রইল। তারা স্কুলঘরে ঢুকে মীরার সঙ্গে কথা বলল। মীরা প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের গল্প বলতে শুরু করল—কীভাবে ছোটোবেলা থেকে পড়াশোনার জন্য লড়েছে, কীভাবে বিয়ের আসরের হাত থেকে পালিয়েছে, কীভাবে আজ সে অন্য মেয়েদের শেখাচ্ছে। কথা বলতে বলতে তার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু কণ্ঠে এক বিন্দু কাঁপুনি রইল না।
সাংবাদিকদের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গিয়েছিল। তারা সুমিত্রার কাছ থেকেও বিস্তারিত জানল, তারপর কয়েকটা ছবি তুলল—একটা ছবিতে দেখা গেল, মীরার ছোট্ট আঙুলে চক ধরা, বোর্ডে অক্ষর আঁকছে, চারপাশে ছোট ছোট মেয়েরা বসে মন দিয়ে দেখছে। তারা চলে যাওয়ার সময় বলল, “তুমি জানো না মীরা, তুমি একদিন অনেক মেয়ের স্বপ্ন হয়ে উঠবে।”
রাতের দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল—“কাল শহরের কাগজে মীরার গল্প বেরোবে।” পাড়ার লোকজন কেউ অবিশ্বাসে, কেউ ঈর্ষায়, কেউ কৌতূহলে ফিসফিস করতে লাগল। বাবা সেদিন কোনো কথা বললেন না, কেবল মাটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মুখে ক্ষোভ থাকলেও, চোখে যেন অদ্ভুত একটা ভাঙন ফুটে উঠল, যেন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন—এই মেয়েকে আর থামানো যাবে না।
পরদিন ভোরে কাগজ এসে পৌঁছল। দোকানের সামনে লোকজট। প্রথম পাতায় না হলেও, দ্বিতীয় পাতায় বড় শিরোনামে লেখা—“এক কিশোরীর লড়াই: বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এক গ্রামের বিদ্রোহ।” সঙ্গে মীরার ছবি—চোখে স্থিরতা, মুখে আলো। কেউ বলল, “দেখো দেখো, সত্যিই ছেপেছে,” কেউ হেসে বলল, “এখন তো আমাদের গ্রাম বিখ্যাত হবে।”
মীরা কাগজটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল, এতদিন যেটাকে সে নিজের ছোট্ট ব্যক্তিগত যুদ্ধ ভাবত, সেটা যেন আজ একটা বড় ইতিহাসের শুরু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুমিত্রা পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “এখন তোর পেছনে অনেক চোখ তাকিয়ে থাকবে। ভুল করলে তোর শত্রুরা খুশি হবে। সোজা থাকিস।” মীরা মাথা নাড়ল, তার চোখে ঝলসে উঠল আগুনের মতো এক দীপ্তি।
এই ঘটনার পর স্কুলে মেয়েদের ভিড় আরও বাড়ল। আগের লাজুক কিশোরীরা এখন গর্বভরে বলছে, “আমরাও শিখব, আমরা আর কাঁদতে চাই না।” মীরার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ জমে উঠত, আবার একটা ভয়ও থেকে যেত—এই আগুন যদি নিভে যায়? কিন্তু সে ভয় চেপে রাখত, মুখে শুধু হাসি ফুটত।
এদিকে গ্রামে বিরোধীরা হাল ছাড়েনি। কয়েকজন পুরুষ রাতে সভা করে বলল, “এখনই যদি ঠেকানো না যায়, মেয়েরা একদিন পুরো গ্রাম দখল করবে।” তারা গোপনে পঞ্চায়েতের ওপর চাপ দিতে লাগল—স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হোক। খবরটা সুমিত্রা জানতে পেরে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি মীরাকে বললেন, “তোর নাম যত বড় হচ্ছে, তোর শত্রুও তত বাড়ছে। তোর আরও শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে।”
সেই রাতে, জানালার ধারে বসে মীরা চাঁদের আলোয় কাগজের খবরটা বারবার পড়ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই কাগজটা যেন কোনো যাদুমন্ত্র—যা তার বুকের ভেতরের জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখাকে আরও তীব্র করে দিচ্ছে। দূরে তালপাতার খসখস শব্দে সে যেন শুনতে পেল—“তুই পারবি।”
পরদিন সকালে পঞ্চায়েত আবার বৈঠক ডাকে। এবার সেখানে অনেক তরুণও উপস্থিত। তারা বলল, “আমরা আর মেয়েদের বন্দি থাকতে দেব না। স্কুল চলবে।” মীরার চোখ ভিজে উঠল, সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু মনে হলো যেন তার ভেতরের যুদ্ধটা একটু হালকা হলো।
বাবা বৈঠকে কিছু বললেন না। সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি উঠোনে এসে দাঁড়ালেন, দূরে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। মীরা দরজার আড়াল থেকে দেখছিল। বাবা হঠাৎ ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন। চোখে রাগ ছিল না, ছিল ক্লান্তি, আর যেন একটু সম্মান। এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখের দৃষ্টি একে অপরের সঙ্গে জুড়ে গেল—এটা কোনো আত্মসমর্পণ ছিল না, কিন্তু ছিল নীরব স্বীকারোক্তি—“তুই থামবি না।”
সেই রাতে, বাতাসে শীতের গন্ধ আর মাটির মোলায়েম গন্ধ মিলেমিশে ছিল। মীরা বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবল, কতদূর আসতে হয়েছে, আর কতদূর যেতে হবে। তার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, এই নিস্তব্ধ গ্রামটা আর আগের মতো নেই। এখানে এখন মেয়েদের চোখেও আলো জ্বলে, আর সেই আলো নিভবে না—যতক্ষণ না প্রতিটি মেয়ের ডানা গজায়।
শীতের সকালের কুয়াশা যেন সেইদিন গ্রামটাকে পুরো গিলে ফেলেছিল। বাতাসে ধোঁয়ার মতো হিম আর নিস্তব্ধতা, যেন ঝড়ের আগে কোনো অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে। মীরার চোখে ঘুম ছিল না, সারা রাত সে ছাদের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছে। বাবার সেই নীরব দৃষ্টি তার মনে বারবার ফিরে আসছিল—সেটা রাগ নয়, ক্লান্তি, হয়তো হার মানার আগের নিঃশ্বাস। কিন্তু মীরা জানত, গ্রামটা এখনও হার মানেনি। বিরোধীরা চুপচাপ বসে নেই, বরং যেন আরও অন্ধকার ষড়যন্ত্র গেঁথে চলেছে।
দুপুরে সুমিত্রা স্কুলে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “মীরা, খবর খারাপ। কয়েকজন লোক গতরাতে বৈঠকে ঠিক করেছে, এই স্কুল ভেঙে দেবে। তারা বলছে, মেয়েদের বিদ্রোহ থামাতে না পারলে নিজেদের মান ইজ্জত থাকবে না।” মীরার বুক ধক করে উঠল, কিন্তু সে একটুও চমকাল না। তার চোখ স্থির, মুখ কঠিন। সে বলল, “তারা যদি ভাঙে, আমরা আবার গড়ব। কিন্তু আমি পিছু হটব না।” সুমিত্রা তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোর সাহস যেন তোর ধ্বংস না ডেকে আনে। তবে হ্যাঁ, পিছু হটিস না।”
সেইদিন বিকেলে স্কুলঘরের সামনে ক’জন কিশোরী বসে পড়ছিল, হাতে খাতা-কলম। হঠাৎ পেছন দিক থেকে কিছু গালিগালাজ আর ধুলো উড়তে লাগল। পাঁচ-ছয়জন পুরুষ হাতে বাঁশ, লাঠি নিয়ে এসে দাঁড়াল। তারা চিৎকার করল, “এই অপসংস্কৃতি আজই শেষ!” এক মুহূর্তের জন্য মেয়েরা ভয়ে সরে যেতে চাইছিল, কিন্তু মীরা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ছড়িয়ে বলল, “কেউ ভেতরে ঢুকবে না।” তার গলা কাঁপছিল না, চোখে আগুন জ্বলছিল।
পুরুষদের মধ্যে এক জন এগিয়ে এসে গর্জে উঠল, “তোর এত সাহস?” মীরা এক পা এগিয়ে বলল, “আমি নিজের অধিকার চাইছি। এটা অপরাধ নয়।” লোকটা লাঠি তুলতেই সুমিত্রা সামনে এসে দাঁড়ালেন, বললেন, “এই স্কুল আইনের অনুমতিতে চলছে। ভাঙার চেষ্টা করলে পুলিশ ডাকা হবে।”
দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চূড়ান্তে পৌঁছল। কিশোরীরা কাঁপতে কাঁপতে পেছনে জড়ো হল, কিন্তু মীরা নড়ল না। তখন হঠাৎ গ্রামের কিছু তরুণ দৌড়ে এসে তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে গেল। তারা গলা ফাটিয়ে বলল, “মেয়েদের পড়াশোনা থামানো যাবে না। যার সাহস আছে, আমাদের পার হয়ে ঢুকে দেখাক।” এক মুহূর্তে দৃশ্যটা পালটে গেল।
পুরুষদের দল কিছুক্ষণ গালিগালাজ করল, তারপর ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। কিন্তু যাওয়ার সময় একজন দাঁত চেপে বলল, “এটা শেষ না, মীরা। এবার শহরে খবর দেব। তোর নাম মুছে ফেলব।” মীরার গলা শুকিয়ে গেল, কিন্তু সে মুখ না ঘুরিয়ে শুধু বলল, “তোমরা যা খুশি করো। আমি থামব না।”
রাত নামার পর গ্রামে গুজব ছড়াল—মীরার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেবে বিরোধীরা। তাদের দাবি, সে নাকি গ্রামের মেয়েদের বিপথে চালাচ্ছে, সংসার ভাঙার কথা শেখাচ্ছে। এই গুজব মীরার কানে পৌঁছল। তার বুকের মধ্যে কাঁপুনি উঠল, কিন্তু মনে মনে সে ভাবল—“যদি থানাও যায়, আমি সত্য বলব। আমি ভুল করিনি।”
মা সেই রাতে চুপিচুপি এসে মীরার পাশে বসে বললেন, “তারা যদি তোকে জেলে দেয়?” মীরা তার মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল, “তবে আমি জেলেও গিয়ে বলব, মেয়েদের অধিকার আছে।” মা থরথর করে কেঁপে উঠলেন, কিন্তু তার চোখে গর্বের দীপ্তি ফুটে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তুই সত্যিই আমার মেয়ে।”
পরদিন সকালে সত্যিই পুলিশ এলো। দুজন অফিসার এসে বললেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি, আপনি নাকি গ্রামের মেয়েদের উসকাচ্ছেন।” সুমিত্রা শান্ত গলায় বললেন, “উসকানি নয়, শিক্ষা। আপনারা চাইলে মেয়েদের খাতা, বই দেখতে পারেন।” পুলিশ মেয়েদের খাতা ঘাঁটল—কেউ লিখেছে অ আ ক খ, কেউ নিজের নাম। অফিসারদের মুখ নরম হয়ে গেল। তারা বলল, “এটা তো শিক্ষা দিচ্ছেন, এতে অপরাধ নেই।”
পুলিশ চলে যেতেই মেয়েরা তালি দিয়ে উঠল, “জয় হোক পড়াশোনার!” তাদের কণ্ঠে সাহসের ঝলকানি। মীরার চোখ ভিজে গেল, কিন্তু মুখে দৃঢ় হাসি। সে জানল, এই লড়াই আর কেবল তার একার নয়, এটা এখন এক ঝড়।
তবে বিরোধীরা থামেনি। রাতে তারা পঞ্চায়েতের ওপর চাপ দিতে লাগল—“স্কুল বন্ধ না করলে আমরা শহরের রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে আনব।” সুমিত্রা চিন্তিত হয়ে বললেন, “মীরা, এখন তোকে শুধু সাহস নয়, বুদ্ধিও দেখাতে হবে। আমাদের আইনিভাবে স্কুলের অনুমোদন লাগবে।” মীরা মাথা নাড়ল, বলল, “আমরা করব দিদি, আমি লড়ব।”
সেই রাতে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মীরা তার ছেঁড়া খাতার পাতায় নিজের নাম লিখল, বড় করে—“মীরা: শিক্ষিকা”। চোখের কোণে জল চলে এল, মনে হলো এই একটুকরো শব্দের জন্য কত অন্ধকার পার হতে হয়েছে। দূরে তালপাতার খসখস শব্দের মাঝে যেন সে শুনতে পেল, “তুই পারবি।”
পরদিন সে এবং সুমিত্রা ব্লকে গিয়ে শিক্ষা দপ্তরের কাছে আবেদন করল, যাতে এই স্কুল সরকারিভাবে অনুমোদন পায়। অফিসের কেরানিরা প্রথমে অবিশ্বাসের চোখে তাকাল, কিন্তু সুমিত্রা যখন কাগজপত্র রাখলেন, আর মীরা যখন শান্ত কণ্ঠে বলল, “আমাদের মেয়েদের ভবিষ্যৎ এখানে ঝুলছে,” তখন কেরানিদের মুখ নরম হয়ে গেল। তারা বলল, “দেখি কী করা যায়।”
গ্রামে ফিরে এসে মীরার মনে হলো, সে যেন এক নতুন অধ্যায়ের দ্বার খুলে দিয়েছে। কিন্তু সে জানত, এখনো ঝড় থামেনি, বরং এই আবেদন বিরোধীদের আরও ক্ষিপ্ত করবে। তবুও তার চোখে ভয় নয়, ছিল এক অদ্ভুত দীপ্তি—যেন আগুনের শিখা, যা ঝড়ের মাঝেও নিভে না।
রাতে মা তার পাশে এসে বললেন, “তুই এখন আর শুধু আমার মেয়ে নোস, তুই সবার আশা।” মীরা মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করল, “আমি থামব না মা। যতদিন না এই গ্রামের প্রতিটি মেয়ে নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে পারে।”
দূরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল। মাটির গন্ধে ভিজে থাকা বাতাসে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছিল, যেন এই ছোট্ট গ্রামটার বুকেও আজ একটু আশা জেগেছে।
শীতের সকালের কুয়াশা যেন সেইদিন আগের যেকোনো দিনের চেয়ে ঘন ছিল, কিন্তু মীরার চোখে তখন কুয়াশা নয়, ছিল আলো। ব্লক অফিসে দেওয়া আবেদন নিয়ে সুমিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে সে আজ গ্রামের সীমানার বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল—এখন আর শুধু নিজের স্বপ্নের জন্য নয়, এক গোটা প্রজন্মের জন্য সে লড়ছে। কিন্তু সেই আশার আলোকে ঘিরে এখনও অন্ধকার ষড়যন্ত্রের ধোঁয়া জমে আছে।
দুদিন পর ব্লক অফিস থেকে খবর এল—একজন আধিকারিক আসবেন স্কুল পরিদর্শনে। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল, “যদি অনুমোদন পায়, তাহলে তো মেয়েরা আরও মাথা চাড়া দেবে।” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল, “হয়তো বদলটা দরকার।” বাবার মুখে কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু তাঁর চোখে স্পষ্ট অস্বস্তি ফুটে উঠছিল, যেন মনের ভেতর লড়াই চলছিল—মেয়ের হার মানা ভালো, না বদলে যাওয়া ভালো।
এদিকে বিরোধীরা গোপনে পঞ্চায়েতে চাপ দিতে শুরু করল। তারা বলল, “অফিসার এলে আমরা স্কুল ঘিরে ফেলব, যেন ওরা দেখে মেয়েরা বিদ্রোহ করছে।” সুমিত্রা এই খবর পেয়ে রাতেই মীরার কাছে ছুটে এলেন। তাঁর কণ্ঠ উত্তেজনায় কাঁপছিল, “তারা চাইছে অফিসারকে ভয় দেখিয়ে অনুমোদন রুখে দিতে। আমাদের এক মুহূর্তও ভুল করা চলবে না।” মীরা শান্ত গলায় বলল, “তাহলে আমরা আরও গুছিয়ে দাঁড়াব। অফিসার দেখবেন আমরা আলো ছড়াচ্ছি, আগুন না।”
পরের দুই দিন মেয়েরা প্রাণপণে স্কুল পরিষ্কার করল—ভাঙা বেঞ্চ মেরামত, দেওয়ালে অক্ষর আঁকা, উঠোন ঝাঁট দেওয়া। মীরার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি ছিল, যেন তার বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুন এখন শিখার বদলে আলো হয়ে উঠছে। শিলা আর অন্য কিশোরীরা সারাদিন গলা ফাটিয়ে পড়তে লাগল, যেন প্রমাণ করতে চায়—তারা আর ভয় পায় না।
অবশেষে সেই দিন এল। সকালে কুয়াশা ভেদ করে একটা সাদা জিপ এসে থামল। ব্লক অফিসার নামলেন—পরিপাটি জামা, চোখে কড়া দৃষ্টি, সঙ্গে দুজন কেরানি। গ্রামের লোকজন ভিড় করে দাঁড়াল। বিরোধীরা একটু দূরে গোঁফে হাত বুলিয়ে তাকিয়ে রইল। মীরার বুক ধুকপুক করছিল, কিন্তু সে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে।
অফিসার স্কুলঘরে ঢুকে মেয়েদের খাতা-কলম দেখলেন, তাদের পড়তে বললেন। মেয়েরা অ আ ক খ গেয়ে উঠল, শিলা গলা কাঁপলেও কবিতা বলল। অফিসার হালকা হাসলেন। তারপর মীরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কেন এত লড়ছো?” মীরার চোখে অশ্রু জমে উঠল, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা, “কারণ আমি জানি, শিক্ষা ছাড়া মেয়েদের জীবন শুধু ছায়া হয়ে থাকে। আমি চাই আলো।”
অফিসার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর ধীরে মাথা নাড়লেন। “তুমি সাহসী মেয়ে,” তিনি বললেন, “আমি এই স্কুলের অনুমোদনের সুপারিশ করব।” কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো নেমে এলো চারপাশে। মেয়েরা চিৎকার করে উঠল, “জয়!” সুমিত্রার চোখে জল, মীরার বুকের ভেতর যেন পাহাড় ভেঙে আলো ঝরে পড়ল।
কিন্তু বিরোধীরা চুপ করে গেল না। তারা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁত চেপে বলল, “এটা শেষ না। শহরের নেতা আসবে, ওদের বলব স্কুলে নাস্তিকতা শেখানো হচ্ছে।” সুমিত্রা কানে কানে মীরাকে বললেন, “এখন তোকে আরও প্রস্তুত হতে হবে। রাজনীতি অনেক নোংরা, কিন্তু আমরা যদি ভয় পাই তবে সব শেষ।” মীরা মাথা নেড়ে বলল, “আমি ভয় পাব না। আমি শুধু বই শেখাচ্ছি, তবুও যদি ওরা যুদ্ধ করতে চায়, আমিও প্রস্তুত।”
দুদিন পর সত্যিই শহরের এক রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা গ্রামে এলেন। সঙ্গে গাড়ি, মাইকে গান বাজছে, চারপাশে লোকজন। তিনি পঞ্চায়েত ভবনে বৈঠক ডাকলেন। সেখানে গিয়ে বললেন, “এই স্কুল নাকি সমাজ ভাঙছে? মেয়েরা কি বাপের কথা শুনছে না?” পঞ্চায়েতের কিছু পুরনো সদস্য চুপচাপ মাথা নাড়ল, কিন্তু তখন গ্রামের তরুণেরা উঠে দাঁড়াল। তারা বলল, “ওরা বই শেখাচ্ছে, সংসার ভাঙছে না। মীরা আমাদের বোন।”
সেই সময় মীরা নিজে উঠে দাঁড়াল। হলঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সে বলল, “আমি শুধু পড়াশোনা করতে চেয়েছি। আমি কারও বিরুদ্ধে না, আমি শুধু অন্ধকারের বিরুদ্ধে। যদি পড়াশোনা সমাজ ভাঙে, তবে সমাজকে গড়তে হবে নতুন করে।” কথাগুলো যেন ছুরি হয়ে বাতাস চিরে গেল। নেতার মুখ শক্ত, কিন্তু চোখে এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা জ্বলে উঠল। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, আমি দেখব। তবে মনে রেখো, এই আগুন যেন গ্রাম পুড়িয়ে না দেয়।”
লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, কিন্তু গুঞ্জন রয়ে গেল—“নেতাও থামাতে পারল না।” মীরার বুক ধুকপুক করছিল, তবু তার চোখে শান্তি। সে জানত, সে আর একা নয়। এই গ্রামে এখন প্রতিটি মেয়ে তার পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
রাত নামলে মা তার পাশে এসে চুপচাপ বসে রইলেন। অনেকক্ষণ পর বললেন, “তুই এত বড় হয়ে গেছিস যে আমি তোকে চেনতেই পারছি না। তোর চোখে এখন যেন আকাশ।” মীরা হাসল, বলল, “আকাশ না মা, আলো। আমি চাই এই আলো সবার চোখে জ্বলে উঠুক।” মা তার কপালে চুমু খেয়ে চলে গেলেন।
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মীরা দূরে অন্ধকার মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। তালপাতার খসখস শব্দের ফাঁকে সে যেন শুনতে পেল—“তুই থামিস না।” আর তার মনে হলো, আজ এই গ্রামে সত্যিই কিছু বদলে গেছে।
শীতের সকালটা যেন অন্যরকম ছিল। কুয়াশা সরতেই সূর্যের আলো পড়ল স্কুলঘরের কাঁচা উঠোনে, যেন নতুন দিনের আগমন ঘোষণা করছে। ব্লক অফিসার কথা রেখেছেন—সুমিত্রা খবর আনলেন, সরকারিভাবে স্কুলের অনুমোদন মিলে গেছে। একটুকরো সরকারি কাগজ, অথচ যেন একটুকরো মুক্তির আকাশ। মেয়েরা খুশিতে চিৎকার করে উঠল, শিলা লাফিয়ে মীরাকে জড়িয়ে ধরল, কেউ কেঁদে ফেলল, কেউ হাসল। মীরার বুকের ভেতর যেন এতদিন জমে থাকা পাহাড় ভেঙে আলো ঝরে পড়ল। সে বোঝে, এটাই তার প্রথম বড় জয়—কিন্তু তার চোখে কোনো উচ্ছ্বাস নয়, বরং এক গভীর শান্তি।
গ্রামজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল—“স্কুল এখন সরকারিভাবে স্বীকৃত।” কেউ বলল, “দেখছো, মেয়েরা সত্যিই জিতে গেল,” কেউ আবার দাঁত চেপে বলল, “এটা শেষ না।” বিরোধীরা চুপচাপ হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের চোখে বিষাক্ত দৃষ্টি। তারা পঞ্চায়েত ভবনে গোপনে বৈঠক করল—“এখন মেয়েরা আরও মাথা চাড়া দেবে। আমরা যদি এখন না থামাই, কালকে সংসার ভেঙে পড়বে।” একজন ফিসফিস করে বলল, “স্কুল পুড়িয়ে দিই। সব শেষ হয়ে যাবে।”
এই খবর সুমিত্রার কানে পৌঁছাল। তিনি রাতে মীরার ঘরে এসে বললেন, “ওরা শেষ আঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হয়তো আগুন লাগানোর চেষ্টা করবে।” মীরার বুকের ভেতর ধক করে উঠল, কিন্তু তার চোখ শান্ত রইল। সে বলল, “আগুন আমাদের ভয় দেখাতে পারে না দিদি। আমরা তো আলো হয়ে গেছি।” সুমিত্রা তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোর সাহস যেন তোর সর্বনাশ না ডেকে আনে। তবে আমি জানি, তুই থামবি না।”
পরদিন বিকেলে হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ জমল, কুয়াশার মধ্যে ঝড়ের গন্ধ। মেয়েরা স্কুলে পড়ছিল, মীরা বোর্ডে লিখছিল ‘স্বাধীনতা’। ঠিক তখনই বাইরে গুঞ্জন উঠল। কয়েকজন পুরুষ লাঠি হাতে এগিয়ে আসছে, চোখে হিংসার আগুন। মেয়েরা আঁতকে উঠল, কেউ কেঁদে ফেলল। মীরা তাদের সামনে দাঁড়াল, তার গলা কাঁপছিল না, চোখে ঝলকানি, “কেউ এক পা বাইরে যাবে না। এটা আমাদের ঘর।”
পুরুষদের একজন চিৎকার করল, “এই ঘর আমরা জ্বালিয়ে দেব!” আরেকজন তেলভরা বোতল তুলল। ঠিক তখনই বজ্রপাতের মতো আওয়াজ শোনা গেল—“পুলিশ!” রাস্তার ধুলো চিরে জিপ এসে দাঁড়াল, সঙ্গে ব্লক অফিসার ও কয়েকজন কনস্টেবল। তারা গর্জে উঠল, “এক পা এগোলে জেল। এটা এখন সরকারি স্কুল।”
পুরুষেরা থমকে গেল। মেয়েরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। মীরার বুকের ভেতর তখন ঝড়, তবু মুখ শক্ত। ব্লক অফিসার সোজা পঞ্চায়েতের কয়েকজন বৃদ্ধ সদস্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা যদি আর একবার স্কুলে হিংসা ছড়ান, শুধু জেল নয়, স্কুলের চারপাশে সুরক্ষা বলয় বসানো হবে।” কথাগুলো যেন কাঁপিয়ে দিল চারদিক।
পুরুষরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল, মুখ নিচু করে, চোখে ভগ্ন গর্ব। ঝড়ের মতো যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই মিলিয়ে গেল। মাঠে হঠাৎ হাওয়া বইল, যেন সব গুঞ্জন উড়িয়ে নিয়ে গেল দূরে। মেয়েরা চুপচাপ মীরার দিকে তাকিয়ে রইল—সে তখন বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে, মুখে ঘামের রেখা, চোখে দীপ্তি।
সেদিন রাতে, গ্রামজুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। বিরোধীরা আর বৈঠকে বসল না। কেউ কেউ চুপচাপ এসে নিজেদের মেয়েদের হাতে খাতা ধরিয়ে দিল, কেউ দূর থেকে স্কুলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মীরার মনে হলো, যুদ্ধ শেষ নয়, কিন্তু এক যুগ পার হয়ে এসেছে।
বাড়ি ফিরে মা তাকে দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখলেন। মায়ের চোখে জল, মুখে শান্তি। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তুই সত্যিই আলো হয়ে গেছিস মা।” মীরা মায়ের বুকের কাছে মাথা রাখল, বলল, “আমি একা পারতাম না মা, তুমি পাশে ছিলে বলেই আজ আমরা সবাই জিতেছি।”
রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল, আলোয় ভেসে যাচ্ছিল গ্রামটা। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মীরা দূরে স্কুলের ছাউনিটা দেখতে পেল—সেই স্কুল যেটা একদিন ছিল তার আশ্রয়, আজ হয়ে উঠেছে এক প্রজন্মের মুক্তির প্রতীক। তার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, এই ছোট্ট গ্রামটা আর কখনও আগের মতো অন্ধকার হবে না।
বছর ঘুরেছে। ঋতু বদলেছে। সেই একদা নিঃশব্দ, ভাঙাচোরা, অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রামটা আজ আর আগের মতো নেই। কুয়াশা ভেদ করে যে সকালের আলো এখন গ্রামটাকে ছুঁয়ে যায়, তার ভেতরে মিশে থাকে মেয়েদের হাসির শব্দ, খাতার পাতায় কলমের খসখস, আর ছুটন্ত স্বপ্নের পায়ের শব্দ। সময় যেন এক অদৃশ্য হাত দিয়ে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে, কিন্তু মীরার মনে বারবার ফিরে আসে সেই রাতগুলো, যেদিন সে জানালা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, বুকের ভেতর ভয় আর আগুন একসঙ্গে ধুকপুক করছিল।
এখন সেই স্কুল আর কুঁড়েঘর নয়। পাকা দেওয়াল, টিনের ছাউনি, কাঠের দরজা, টেবিল-চেয়ার—সবই নতুন। সরকার থেকে তহবিল এসেছে, শহরের কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। ব্ল্যাকবোর্ডের নিচে বড় অক্ষরে লেখা—“মীরা শিক্ষা কেন্দ্র”। প্রথম দিন যখন এই নামের ফলক ঝুলছিল, মীরার চোখে জল চলে এসেছিল। সে কেবল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল, আর চারপাশের মেয়েরা হাততালি দিচ্ছিল, গলা ফাটিয়ে বলছিল, “দিদির জয় হোক!”
এখন মীরা আর কিশোরী নয়, যুবতী। তার চোখে এখনও সেই পুরনো জেদ, কিন্তু মুখে এক পরিণত শান্তি। সে নিজেই এখন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। প্রতিদিন ভোরে সে উঠোন ঝাঁট দেয়, বোর্ডে নতুন পাঠ লিখে রাখে, আর মেয়েদের মাঝে বসে পাঠ শেখায়। ছোট ছোট মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে থাকে—কেউ আঁকতে শেখে, কেউ কবিতা বলে, কেউ প্রথমবার নিজের নাম লিখে গর্বে তাকিয়ে থাকে। মীরার মনে হয়, এরা যেন সেই ছোট্ট মীরা, যাকে কেউ একদিন থামাতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।
গ্রামটাও বদলে গেছে। আগের সেই ফিসফিস, গালাগাল, বিদ্রূপের বদলে এখন চায়ের দোকানে শোনা যায়—“আমার মেয়েকেও ভর্তি করিয়েছি,” “ও তো ক্লাস ফাইভে উঠে গেছে।” যে পুরুষেরা একদিন স্কুল পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, তারাই এখন মেয়েদের ফলাফলের খোঁজ নেয়। তাদের চোখে গর্বের ঝিলিক, মুখে নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি—মীরা ঠিক ছিল।
বাবা এখন বুড়িয়ে গেছেন। তার চোখে আর আগুন নেই, আছে শান্ত ধোঁয়া। তিনি প্রতিদিন বিকেলে লাঠি নিয়ে উঠোনে বসেন, দূর থেকে স্কুলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে যখন মেয়েরা গাইতে গাইতে যায়, তিনি মুখ ঘুরিয়ে রাখেন, কিন্তু তার চোখের কোণে নরম একটা হাসি খেলা করে। একদিন মীরা চুপচাপ তাঁর কাছে গিয়ে বসেছিল। বাবা চুপচাপ বলেছিলেন, “তুই যা করেছিস, আমি থামাতে পারিনি। এখন বুঝি, তুই সঠিক ছিলি।” কথাটা বলেই তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু মীরার চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল।
শিলার জীবনও বদলেছে। একদিন যে মেয়েটি ভয়ে কাঁপত, আজ সে মাধ্যমিক পাস করে শহরে নার্সিং পড়ছে। মাঝে মাঝে চিঠি আসে—“দিদি, যদি সেদিন তুমি না দাঁড়াতে, আমি হয়তো আজও পর্দার আড়ালে আটকে থাকতাম।” এইসব চিঠি পড়লে মীরার মনে হয়, তার সমস্ত ব্যথা সার্থক হয়েছে।
সুমিত্রা এখন আর শুধু সমাজকর্মী নন, জেলা শিক্ষা পরিদর্শকের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। তবু মাঝে মাঝে তিনি আসেন, উঠোনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের গলা ফাটিয়ে কবিতা আবৃত্তি শুনে চোখে জল নিয়ে হাসেন। একদিন তিনি মীরার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, “তুই জানিস না, তুই কতটা ইতিহাস হয়ে গেছিস।”
মীরার মনে তখনই ফিরে এসেছিল সেই অন্ধকার রাতটা—পালিয়ে আসা, স্কুলের দরজা বন্ধ করা, বাইরে লাঠির আঘাত, গালিগালাজ, আর ভেতরে কাঁপতে থাকা বুকের ধ্বনি। সে জানে, সেই এক রাতই তার জীবন বদলে দিয়েছিল, আর আজ এই পুরো গ্রামটা সেই রাতের আগুন থেকে আলো পেয়েছে।
রাতের শেষে যখন গ্রামে নিস্তব্ধতা নামে, আর চাঁদের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে, মীরা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে স্কুলঘর নিঃশব্দে ঘুমোয়, অথচ মনে হয় তার ভেতর থেকেও আলো বেরিয়ে আসছে। সে জানে, এই লড়াই হয়তো এখানেই শেষ নয়—কোথাও আরও অনেক মীরা আছে, যারা এখনও অন্ধকারের শিকলে বন্দি। কিন্তু সে এটুকু নিশ্চিত, তার গল্প তাদের কাছে পৌঁছোবে।
মীরার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু তার মুখে এক শান্ত হাসি ফুটে থাকে। তার মনে হয়, সে আর কেবল এক মেয়ে নয়, সে এক আগুন—যে আগুন ধ্বংস করে না, আলোকিত করে। একদিন যে ছায়ার ভেতর সে দগ্ধ হয়েছিল, আজ সেই দগ্ধ ছায়া থেকেই আলো জন্ম নিয়েছে।